৭.
তনির বাবা রুহুল আমিনের সঙ্গে চাচাতো ভাই জহির উদ্দিনের জমি-জায়গা নিয়ে অনেক দিন থেকে মামলা চলেছে। রুহুল আমিন আপস মিমাংসা করতে চাইলেও জহির উদ্দিন তাতে রাজি হন নি। তাই তাদের মধ্যে শত্রুতা। জহির উদ্দিনের ছেলে রফিক ঢাকায় থেকে লেখাপড়া শেষ করে কয়েকদিন হল গ্রামে ফিরে এসেছে। জ্ঞান হওয়ার পর থেকে সে তনিকে ভালবাসে। কিন্তু সে কথা কারও কাছে প্রকাশ করেনি। কারণ দুই ফ্যামিলির শক্রতার কথা সে জানত। কিন্তু তনি যখন যৌবনে পদার্পণ করল তখন তার রূপে মুগ্ধ হয়ে সিদ্ধান্ত নিল, যেমন করে থোক তাকে বিয়ে করবেই। তাই বি. এ. পাস করার পর একদিন রাতে খাওয়ার সময় মায়ের সামনে বাবাকে বলল, চাচাঁদের সঙ্গে মিটমাট করে নাও।
জহির উদ্দিন খাওয়া বন্ধ করে কপাল কুঁচকে বললেন, কথাটা তুই নিজে বলছিস, না কেউ তোকে বলতে বলেছে?
নিজে বলছি।
হঠাৎ একথা বলছিস কেন? জ্ঞাতিদের সঙ্গে মামলা-মোকদ্দমা করা বা শত্রুতা রাখা কি ঠিক?
জহির উদ্দিন রেগে উঠে বললেন, তুই কালকের ছেলে, গলা টিপলে এখনও তোর মুখ থেকে মায়ের দুধ বেরোবে। জমি-জমা ও মামলা-মোকদ্দমা সম্পর্কে কি বুঝিস? যা বলার বলেছিস আর কোনোদিন বলবি না।
রফিক মা-বাবার একমাত্র সন্তান। খুব আদরে মানুষ হয়েছে। যেমন জেদী তেমনি রাগী। বাবাকে রেগে যেতে দেখে বলল, তুমি রাগ করছ কেন? আমি ভালো বলেছি না মন্দ বলেছি, পাঁচজনকে জিজ্ঞেস করে দেখ। গলা টিপলে মায়ের দুধ বের হওয়ার কথা ঠিক বলেছ কিনা জানি না, তবে তোমরা আমাকে বি. এ. পাস করিয়েছ এবং এম. এ. পড়াতে চাও। ফলে গলা থেকে মায়ের দুধের সাথে ভালো-মন্দ কথাও বেরোবে।
জহির উদ্দিন স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমার ছেলের কথা শোন, শিক্ষিত করেছি বলে বাপের দোষগুণ বিচার করবে।
রফিকের খাওয়া তখনও শেষ হয়নি। বাবার কথা শুনে প্লেটে ভাত রেখে উঠে চলে গেল।
জোবেদা বিবি স্বামীকে বললেন, ছেলে বড় হয়েছে, লেখাপড়া করছে, ভালো-মন্দ বোঝার মতো জ্ঞানও হয়েছে। ন্যায়-অন্যায় দেখলে বলবেই। তোমার রেগে যাওয়া উচিত হয়নি। পাতে ভাত রেখে উঠে গেল। যা বলার খাওয়ার পর ঠান্ডা মেজাজে বুঝিয়ে বললেই পারতে।
ও তুমিও দেখছি ছেলের মতো উপদেশ দিতে শিখে গেছো। মনে হয় ছেলে তোমাকে তালিম দিচ্ছে?
জহির উদ্দিনের অনুমান মিথ্যে নয়। দু’দিন আগে রফিক যখন মাকে বলল, আমি তনিকে পছন্দ করি। এম. এ. পাস করা পর্যন্ত যদি ওর কোনো বিয়ের প্রস্তাব আসে, তা হলে তুমি বাবাকে আমার কথা আর মামলা আপোষ মিমাংসা করার কথা বলবে।
জোবেদা বিবি বললেন, তোর বাপ যে আমার কোনো কথা নেয় না, তা তো তুই জানিস। আমি বললে কানেই তুলবে না, বরং আমাকে রাগারাগি করবে। তার চেয়ে আমার সামনে সময় সুযোগ মতো বলিস। তখন না হয় আমি তোর হয়ে দু’চারটে কথা বলব। তাই এখন স্বামীর কথা শুনে বললেন, ছেলে তালিম দেবে কেন? কথায় আছে, ভাই ভাই ঠাঁই ঠাঁই। ভাই হয়ে আর এক ভাইয়ের সঙ্গে কতদিন মামলা চালাবে? কতদিন শত্রুতা রাখবে? ছেলে সেয়ানা হয়েছে। লেখা পড়া করছে তারও তো একটা মতামত আছে। তারপর এদিক ওদিক তাকিয়ে কাউকে দেখতে না পেরে ফিস ফিস করে বললেন, তনিকে রফিকের খুব পছন্দ। তাই বলি কি ভাই-এ ভাই-এ মিটমাট করে নাও।
জহির উদ্দিন ভীষণ রেগে গিয়ে কটমট করে স্ত্রীর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন, মায়ে পুতে তা হলে এই যুক্তি হয়েছে। তোমরা কেউ আমার মান সম্মানের দিকে খেয়াল করলে না। মান সম্মান ডুবাবার জন্য তোমরা শত্রুর মেয়েকে ঘরে তুলতে চাও?
স্ত্রী অন্যায় কিছু করলে বা বললে জহির উদ্দিন আগে মারধর করতেন। একবার রেগে যখন মারতে গিয়েছিলেন তখন জোবেদা বিবি ছেলের নাম ধরে ডেকে বললেন, তোর বাপ আমাকে মারতে চায়, তুই এসে দেখ।
রফিক তখন ক্লাস টেনে পড়ে। সে তার ঘরে পড়ছিল, মায়ের কথা শুনে দরজার কাছে এসে বলল, তোমরা যদি এরকম কর, তা হলে যেদিক দু চোখ যায়, সেদিক চলে যাব।
ছেলের কথা শুনে জহির উদ্দিনের রাগ পড়ে যায়। সেই সাথে লজ্জা পেয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যান। তারপর থেকে স্ত্রীর গায়ে আর হাত তোলেন নি। তাই আগে স্বামীকে খুব ভয় করলেও ঐদিন থেকে আর করেন না। এখন স্বামীর কথা শুনে খুব নরম স্বরে বললেন, গত বছর আমাদের মসজিদের সামনে যে ওয়াজ মাহফিল হয়েছিল, সেখানে একজন মৌলভী কি ওয়াজ করেছিলেন মনে নেই বুঝি? তিনি ওয়াজ করতে করতে একসময় বললেন, হাদিসে আছে”এক মুসলমান আর এক মুসলমানের ভাই। এবং এক মুসলমানের জান, মাল ও ইজ্জৎ অন্য মুসলমানের জন্য হারাম। এটা কুরআন হাদিসের কথা। “এটা কুরআন হাদিসের কথা হাদিসে আরও আছে, “কোনো বিশ্বাসী অন্য কোনো বিশ্বাসীকে তিন দিনের অতিরিক্ত ত্যাগ করে থাকা বৈধ নয়। তিন দিন গত হইয়া গেলে সে যদি তাহার সাথে সাক্ষাৎ করে, সে যেন তাকে সালাম দেয়, সে যদি সালামের উত্তর দেয়, উভয়েই পুণ্যের অংশীদার হইবে। সে যদি উত্তর না দেয়, সে পাপী বিবেচিত হইবে এবং সালাম প্রদানকারী ত্যাগের পাপ হতে তখনই মুক্ত হইয়া যাইবে।” [বর্ণনায় : হযরত আবু হোরায়রা (রাঃ)- আবু দাউদ]
তাই বলছিলাম তনিকে বৌ করে আন আর না আন তার বাপের সঙ্গে মিটমাট করে নাও।
স্ত্রীর মুখে কুরআন হাদিসের কথা শুনে জহির উদ্দিনের রাগ পড়ে গেল, তারপর চুপচাপ খাওয়া শেষ করে উঠে গেলেন।
জহির উদ্দিন একদিন জুম্মার নামাযের পর রুহুল আমিনকে সালাম দিলেন।
অনেক দিন থেকে দেনদরবার করেও যে লোক আপোষ মিমাংসা করতে রাজি হয়নি, এমন কি দেখা সাক্ষাত হলে সালামের উত্তর না দিয়ে না দেখার ভান করে এড়িয়ে গেছে, সেই লোককে আগে বেড়ে সালাম দিতে শুনে সালামের উত্তর দিয়ে রুহুল আমিন বললেন, কিছু বলবে? রুহুল আমিন জহির উদ্দিনের থেকে চার পাঁচ বছরের বড়।
জহিরুদ্দিন বললেন, অনেক চিন্তা করে দেখলাম দীর্ঘদিন ধরে মামলা চালিয়ে দু’জনেরই অনেক টাকা খরচ হচ্ছে। তা ছাড়া ভাইয়ে ভাইয়ে কত দিন আর …. বলে থেমে গেলেন।
রুহুল আমিন আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে বললেন, তুমি কি মামলা আপোষ মিমাংসার কথা বলছ?
হ্যাঁ, রফিকের ও তার মায়েরও তাই ইচ্ছা।
রুহুল আমিন আর একবার আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে বললেন, আল্লাহ আমাদের সবাইকে হেদায়েত দান করুন। একদিন গ্রামের পাঁচজনকে নিয়ে বসা যাবে।
ঠিক আছে, তাই হবে বলে জহির উদ্দিন সালাম বিনিময় করে চলে গেলেন।
বাড়িতে এসে রুহুল আমিন কথাটা স্ত্রীকে জানালেন।
মানসুরা বেগম শোকর আলহামদুল্লিহ বলে বললেন, মিমাংসার পর একদিন ওদেরকে দাওয়াত করে খাওয়াতে ইচ্ছা করছে।
রুহুল আমিন বললেন, বেশ তো তাই হবে।
কিছু দিনের মধ্যে কোর্টে আপোষ মিমাংসার পিটিসন দিয়ে মামলা তুলে নিলেন জহির উদ্দিন। তারপর একদিন গ্রামের পাঁচজনকে নিয়ে আপোষ মিমাংসা করে নিলেন। তার কিছুদিন পর রুহুল আমিন স্ত্রীর কথা মতো ওনাদের খাওয়ার দাওয়াত দিলেন।
দাওয়াত খেতে মা-বাবার সঙ্গে রফিকও এসেছে, নাস্তা খাওয়ার পর রুহুল আমিন ও জহির উদ্দিন এবং মুনসুরা বেগম ও জোবেদা বিবি যখন গল্প করছিলেন তখন কিক তনির রুমের দরজার কাছে এসে বলল, আসতে পারি?
ছোটবেলায় চাচাতো ভাই ও কাছাকাছি ঘর থাকায় রফিকের সঙ্গে তনি। খেলাধুলা করেছে। তাকে রফিক ভাই বলে ডাকত। একটু বড় হতে আর করেনি। সাবালিকা হওয়ার পর থেকে তনি তাদের ঘরে যায়নি। তারপর রফিক ঢাকায়। পড়তে যাওয়ার পর থেকে একরকম দেখা সাক্ষাৎ হয়নি। রফিক ছুটিতে বাড়িতে এলে হঠাৎ হঠাৎ দু’একবার দেখা হলে রফিক ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করলে অল্প কথায় উত্তর দিয়ে সরে গেছে।
এখন তনি ইন্টার ফাইনালে পড়ছে। সে বাবা ও চাচাঁদের মধ্যে শক্রতার কারণ জানত। এখন যে মিমাংসা হয়েছে এবং আজ তাদেরকে বাবা-মা দাওয়াত করে খাওয়াবেন তাও জানে। ওনারা আসার পর সালাম বিনিময় করে নিজের রুমে এসেছে। সে ভাবতেই পারেনি রফিক ভাই তার রুম চলে আসবে। তার গলা পেয়ে একটু রেগে গেলেও সৌজন্য রক্ষার জন্য সংযত কণ্ঠে বলল, আসুন।
রফিক তার মুখের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়েছিল। এ অবস্থায় ভেতরে ঢুকে বলল, মনে হচ্ছে আমি এসেছি বলে তুমি অসন্তুষ্ট হয়েছ?
তনি মুখে মেকি হাসি ফুটিয়ে বলল, না-না, অসন্তুষ্ট হব কেন? বসুন বলে একটা চেয়ার এগিয়ে দিল।
রফিক বসে বলল, পড়াশোনা কেমন হচ্ছে?
তনি বলল, ভালো। আপনার?
অনার্স পরীক্ষা দিয়ে বাড়িতে এসেছি। আশা করি, রেজাল্ট ভালো হবে। মাস্টার্স করার ইচ্ছা আছে। তারপর বলল, তোমাদের সঙ্গে আমাদের অনেক দিনের মনোমালিন্য দূর হল, তাই না?
হ্যাঁ, তাই।
নিশ্চয় খুশি হয়েছ?
খুশি হওয়াই তো উচিত।
কি জান, এ ব্যাপারে আমিই বাবাকে উৎসাহিত করেছি। অবশ্য মাও আমার দলে ছিল। এবারে বেশ কিছুদিন থাকব। যদি বল, আমি প্রতিদিন এসে পড়াশোনার ব্যাপারে তোমাকে সাহায্য করতে পারি।
রফিকের দৃষ্টিতে এমন কিছু ছিল যা তনিকে বিরক্ত করছে। পড়াশোনার সাহায্য করার কথা শুনে আরও বিরক্ত হয়ে বলল, ধন্যবাদ, আল্লাহর রহমতে কখনও আমার কারও সাহায্য দরকার হয়নি। কিছু মনে করবেন না রফিক ভাই, আমার পড়ার চাপ আছে।
ও স্যরি, তা হলে তো এতক্ষণ সময় নষ্ট করা ঠিক হয়নি। যাক, আসি তা হলে বলে রফিক সেখান থেকে বৈঠক খানায় এসে বাবার পাশে বসল।
রুহুল আমিন তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তনির সঙ্গে আলাপ হল?
রফিক বলল, জি। ওর পড়ার চাপ আছে বলে চলে এলাম।
খাওয়া দাওয়ার পর রফিক ওনাদের বিদায় নিয়ে বাড়ি চলে গেল।
দাওয়াত খেতে আসার সময় জোবেদা বিবি স্বামীকে বলেছিলেন, তারা যখন আগে দাওয়াত করেছেন তখন তনিকে বৌ করার প্রস্তাব দিলে হয়তো খুশি মনে মেনে নেবেন।
জহির উদ্দিন বললেন, তোমার যদি তাই মনে হয়, তা হলে তনির মায়ের কাছে তুমিই প্রস্তাবটা দিও।
জোবেদা বিবি বললেন, বেশ আমিই না হয় দেব।
এখন খাওয়ার পর মুনসুরা বেগমের সঙ্গে কথা বলতে এক সময় জোবেদা বিবি প্রস্তাবটা দিলেন।
মুনসুরা বেগম খুব বুদ্ধিমতি মহিলা, দেবরকে এত বছর মামলা চলাবার পর হঠাৎ করে মামলা তুলে আপোষ মিমাংসার কারণ বুঝতে পারলেন। ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে বললেন, এই কাজ হলে আমরা খুশিই হব। আমাদের তো একটাই মেয়ে ঘরের কাছে থাকলে সব সময় দেখতে পাব। এসব ব্যাপারে তো তড়িঘড়ি না করে ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। তনি ও তনির বাবার সঙ্গে আলাপ না করে এক্ষুনি কিছু বলতে পারছি না। তা ছাড়া তনি বলেই রেখেছে বি. এ. পাস না করে সে বিয়ে করবে না।
জোবেদা বিবি বললেন, রফিকও এম. এ. পাস না করে বিয়ে করবে না বলেছে। তনির মতো এত ভালো মেয়েকে বেশি দিন রাখা সম্ভব নয় ভেবে আমরা আগাম প্রস্তাব দিয়ে রাখলাম। আপনারা রাজি থাকলে আমরা আংটি পরিয়ে পাকা কথা বলে রাখতাম।
মুনসুরা বেগম বললেন, ঠিক আছে, তনির বাবার সঙ্গে আলাপ করে জানাব।
ফেরার পথে জহির উদ্দিন স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলেন, প্রস্তাব দিয়েছিলে?
জোবেদা বিবি বললেন, হ্যাঁ দিয়েছি। তারপর তনির মা যা কিছু বলেছেন বললেন।
ভাবি ভালো কথা বলেছে। বিয়ে-সাদির ব্যাপারে সবার সঙ্গে আলাপ আলোচনা ও চিন্তা ভাবনা করে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। প্রস্তাব শুনে ভাবির মুখের কোনো পরিবর্তন হল কিনা লক্ষ্য করেছ?
খারাপ কিছু দেখিনি, বরং হাসি মুখেই তো কথাগুলো বললেন।
জহির উদ্দিন বললেন, কয়েকদিন অপেক্ষা করে দেখা যাক তনির বাবা কি বলে।
স্বামী ঘরে এলে মুনসুরা বেগম জোবেদা বিবির প্রস্তাবের কথা বললেন।
রুহুল আমিন জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি বলেছ?
মুনসুরা বেগম যা বলেছিলেন জানিয়ে বললেন, আমার কি মনে হয় জান, তনিকে রফিক পছন্দ করে। সে কথা মা-বাবাকে জানিয়ে মামলা তুলে নিয়ে আপোষ মিমাংসা করার জন্য চাপ দেয়। একমাত্র সন্তানের কথা না রেখে পারেন নি। তাই মামলা তুলে নিয়ে আপোষ মিমাংসায় আসেন এবং সুযোগ পেয়ে প্রস্তাব দিয়েছেন।
রুহুল আমিন বললেন, তোমার কথা শুনে আমারও তাই মনে হচ্ছে।
মুনসুরা বেগম একমাত্র মেয়েকে সই মাজেদার ছেলে আমজাদের সঙ্গে বিয়ে দেয়ার কথা ভেবে রেখেছিলেন। কথাটা সইকে বলবেন বলবেন করেও বলা হয়নি। চাচাতো জা বিয়ের প্রস্তাব দিলে সে কথা মনে পড়ল। তাই স্বামী থেমে যেতে নিজের ইচ্ছার কথা জানিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার কি মত?
তুমি খুব ভালো কথা বলেছ, রফিকের থেকে আমজাদ হাজার গুণ ভালো ছেলে। ওর মা-বাবাও খুব ভালো। তা ছাড়া ওদের সঙ্গে আমাদের একটা গাঢ় সম্পর্কও রয়েছে। এখন আমজাদ ও তার মা-বাবার মতামত আগে জানতে হবে। তারপর রফিকের মা-বাবাকে যা বলার বলা যাবে। আর সবার আগে তনির মতামত জানতে হবে।
মুনসুরা বেগম বললেন, তনি যে আমজাদকে পছন্দ করে তা অনেক আগেই বুঝতে পেরেছি।
তবু তাকে জিজ্ঞেস করো। দু’একদিনের মধ্যে আমজাদের মা-বাবার সঙ্গে আমরা এ ব্যাপারে আলাপ করতে যাব।
মুনসুরা বেগম কথাটা সই ও সয়াকে বলা মাত্র স্বামী কিছু বলার আগে মাজেদা বেগম আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে বললেন, আমার কথাটা আল্লাহ তোর মুখ দিয়ে বলালেন। কয়েকদিন আগে আমজাদের বাবার সঙ্গে এ ব্যাপারে আলাপ করেছি। উনিও খুশি। তবে আমজাদ পড়াশোনা শেষ করুক তারপর তনিকে বৌ করে ঘরে তুলব।
মুনসুরা বেগম বললেন, সে তো খুব ভালো কথা। ততদিনে তনিও বি. এ. পাস করে ফেলবে।
আফজাল হোসেনকে উদ্দেশ্য করে রুহুল আমিন বললেন, তা হলে এটাই। আমাদের পাকা কথা হয়ে রইল।
আফজাল হোসেন বললেন, ইনশাআল্লাহ এটাই আমাদের পাকা কথা।
মুনসুরা বেগম সইকে উদ্দেশ্য করে বললেন, আমজাদের মতামত না নিয়ে পাকা কথা দেয়া কি ঠিক হচ্ছে?
মাজেদা বেগম বললেন, আমজাদ আমাদের সেরকম ছেলে নয় যে, মা বাবার কথার অবাধ্য হবে।
ঘরে ফেরার সময় মুনসুরা বেগম স্বামীকে বললেন, তোমার চাচাতো ভাইকে কি বলবে?
কি বলব আমার মাথার আসছে না, তুমিই বল কি বলব?
আমজাদের মায়ের সঙ্গে আমার সম্পর্কের কথা এবং তনির ও আমজাদের নানির বাড়ি যে একই গ্রামে সে কথা জানিয়ে বলবে, তনির নানি ও আমজাদের নানি অনেক আগে থেকে ওদের বিয়ের কথা পাকা করে রেখেছেন। সেকথা আমরা ও আমজাদের মা-বাবা জানতেন না। আমরা যখন তনির নানিকে আপনাদের প্রস্তাবের কথা বললাম তখন উনি আমাদেরকে নিয়ে আমজাদের নানির কাছে নিয়ে গিয়ে কথাটা জানালেন। তারপর ওনারা দু’জন আমাদেরকে নিয়ে আমজাদের বাড়িতে এসে তার মা-বাবাকে কথাটা জানিয়ে বললেন, আমজাদের পড়াশোনা করে ঘরে এলে তোমরা ওদের বিয়ে দেবে।
ঐ দু’জন মুরুব্বীর কথা আমরা বা আমজাদের মা-বাবা না রেখে পারলাম না। ওনাদের কথামতো আমরা রাজি হয়ে পাকা কথা দিয়েছি।
রুহুল আমিন বললেন, কথাটা মন্দ বলনি। তবে একথা জহির উদ্দিনের প্রস্তাবের কথা জানিয়ে আমাদের এই প্ল্যানের কথা আমজাদের মা-বাবাকে জানাতে হবে।
মুনসুরা বেগম বললেন, তুমিও ভালো কথা বলেছ। নচেৎ যদি কোনো দিন আমাদের প্ল্যানের কথা ফাঁস হয়ে যায়, তা হলে তোমার চাচাতো ভাই আবার দুষমনী শুরু করবে।
কিছুদিন পর জহির উদ্দিনের সঙ্গে দেখা করে রুহুল আমিন প্ল্যানমতো কথাগুলো জানিয়ে বললেন, ব্যাপারটা যদি আমরা আগে জানতাম, তা হলে ঐদিনই তোমাদেরকে জানিয়ে দিতাম।
শুনে জহির উদ্দিন অসন্তুষ্ট হলেও মেকি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, কি আর করা, বড় আশা ছিল, তনিকে বৌ করে ঘরে আনব। তা আর হল না। তারপর ওনাকে বিদায় দিয়ে ঘরে এসে স্ত্রীকে জানালেন।
শুনে মাজেদা বিবিও অসন্তুষ্ট হলেন। বললেন, তনি ও আমজাদের নানিদের কথা সত্য কিনা জানি না। তবে তনির মা ও আমজাদের মা যে সই এবং একই গ্রামের মেয়ে তা জানি। তাই তনির মা আমজাদকে তো জামাই করতে চাইবেই।
জহির উদ্দিন বললেন, বাদ দাও তো তনির কথা। দুনিয়াতে কি আর সুন্দরী মেয়ে নেই। রফিক পড়াশোনা শেষ করুক তারপর ওর থেকে ঢের বেশি সুন্দরী মেয়েকে বৌ করে আনব আমরা।
তা তাতো আনব, কিন্তু রফিক কথাটা শুনে কি করবে জানি না।
কি আবার করবে? জন্ম, মৃত্যু ও বিয়ে আল্লাহ পাকের হাতে। কথাটা বুঝিয়ে বলবে, শিক্ষিত ছেলে নিশ্চয় বুঝবে।
মায়ের মুখে কথাটা শুনে রফিক যেমন দুঃখ পেল, তেমনি রেগেও গেল। ভাবল, অ্যাসিড মেরে তনির মুখের চেহারা বদলে দিলে বিয়ের কথা পাকাপাকি থাকুক আর যতই আত্মীয়তা থাকুক, আমজাদ নিশ্চয় তাকে বিয়ে করবে না।
ছেলের মুখের কাঠিন্য লক্ষ্য করে জোবেদা বেগম আতঙ্কিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, চুপ করে কি ভাবছিস?
রফিক নিজেকে সংযত করে স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল, কি আবার ভাববো?
জোবেদা বেগম বললেন, তুই শিক্ষিত ছেলে। তোর কথামতো আমরা এতদিনের শত্রুতা মিমাংসা করেছি। বিয়ে সাদি তকৃদিরের লিখন। সেখানে মানুষের কিছু করার নেই। তক্বদিরকে অস্বীকার করে কিছু করতে যাওয়া কি উচিত? নিশ্চয় উচিত নয়? তারপর তার বাবার কথা বলে অনেক বোঝালেন।
.