একদিন অপরাহ্নে – ৬

৬.

কণা একদিন অপরাহ্নে পোস্ট অফিসে এসে গালিবের সঙ্গে সালাম ও কুশল বিনিময় করে বলল, রহিম চাচা চিঠি বিলি করতে গেছেন, তাই না?

গালিব বলল, হ্যাঁ, তাই।

একটা ব্যাপারে আলাপ করতে এলাম, আপনার কাজের ডিস্টার্ব হবে না তো?

কণা কি আলাপ করতে চায় গালিব বুঝতে পেরে মৃদু হেসে বলল, না ডিস্টার্ব হবে না।

কণা বলল, সেদিন আপনি কেন বললেন, ভাইয়ার সঙ্গে তনির বিয়ে হবে না?

গালিব কিছু না বলে নিচের দিকে মুখ করে চুপ করে রইল।

কি হল? চুপ করে আছেন কেন? সেদিনও এই কথায় উত্তর না দিয়ে চলে এসেছিলেন।

তনি আমার কথা বিশ্বাস করলেও আপনি তো করেন নি। তবু জিজ্ঞেস করছেন কেন?

কণা অবাক হয়ে বলল, আমরা বিশ্বাস করি বা না করি, সেকথা আপনি জানলেন কেমন করে?

অনুমান করে।

অনুমান করে কিছু করা বা বলা নিষেধ, এটা হাদিসের কথা।

তা আমিও জানি।

তা হলে বললেন কেন? জানেন আপনার কথা শুনে তনি খুব ভেঙে পড়েছে।

আমি না বললেও কিছুদিনের মধ্যে আপনারা যখন জানতেন তখন তো ভেঙে পড়তেন।

ভাইয়ার সঙ্গে তনির বিয়ে হবে না, এটাও কি অনুমান করে বলেছেন?

না।

তা হলে তনিকে মিথ্যে ভয় দেখিয়েছেন?

আমি কখনও মিথ্যা বলি না। এ ব্যাপারে আর কোনো প্রশ্ন করবেন না। করলেও উত্তর দিতে পারব না।

একটা সত্যি কথা বলবেন?

এক্ষুনি বললাম না, আমি কখনও মিথ্যা বলি না। তা ছাড়া কোন মুসলমানেরই মিথ্যা বলা উচিত নয়।

আপনি কি তনিকে পছন্দ করেন অথবা ভালবাসেন?

যদি বলি আপনাকে ভালবাসি।

কণা একটু রেগে উঠে বলল, আমার প্রশ্নের উত্তর দিন।

তার আগে আপনাকে ওয়াদা করতে হবে, যা বলব তা তনি বা অন্য কাউকেই বলবে না।

ঠিক আছে করলাম।

শুধু পছন্দ করি বা ভালবাসি না, ওকে না পেলে জীবনে বিয়েই করব না।

এই ওয়াদার মেয়াদ কত দিন?

আপনার ভাইয়া বাড়িতে আসার আগ পর্যন্ত।

আপনি কি জানতেন তনি ভাইয়াকে ভীষণ ভালবাসে?

জানতাম।

জেনেও এরকম কথা বলছেন কেন?

মনে হয় প্রেম ভালবাসা কি জিনিস আপনি জানেন না। শোনেন নি, দু’এক ছেলের মাও স্বামী ফেলে প্রেমিকার সঙ্গে পালিয়েছে। অবশ্য পুরুষরাও স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে থাকা সত্ত্বেও অন্য মেয়ের সঙ্গে প্রেম করে বিয়ে করে।

কণা আরও রেগে উঠে বলল, তারা মানুষ নয়, পশু। আপনিও কি তাদের দলে?

গালিব বলল, আপনি এত রেগে যাচ্ছেন কেন? আমি মানুষ না পশু, তা আপনারা ভালো করেই জানেন। আমি হান্ড্রেড পার্সেন্ট সিওর আপনার ভাইয়া তনিকে বিয়ে করবেন না। আপনার ভাইয়ার কাছ থেকে সরাসরি কথাটা জানলে উনি বেশি আঘাত পেতেন। তাই আমি জানিয়েছি যাতে করে আঘাত পেলেও অতটা পাবেন না।

আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে, ভাইয়ার সঙ্গে আপনার পরিচয় আছে এবং তার কাছ থেকে কথাটা জেনে তনিকে ভালবেসেছেন।

এসব কথার উত্তর এখন দিতে পারব না। এবার আপনি আসুন, অনেক কাজ পড়ে আছে। কিছুদিনের মধ্যে আপনার ভাই আসবেন। ওনার কাছ থেকে সব কিছু জেনে নেবেন। আর যে বিষয়ে ওয়াদা করেছেন, তা ভঙ্গ করবেন না। জানেন তো, ওয়াদা ভঙ্গ করা গুনাহে কবিরা?

কণা সংযত কণ্ঠে বলল, প্লিজ আর একটা কথা জানতে চাই।

ঠিক আছে, বলুন।

যদি বলি আমি আপনাকে ভালবেসে ফেলেছি এবং বিয়েও করতে চাই?

গালিব একটু জোরে হেসে উঠে বলল, কথাটা যে মনের না মুখের, তা বুঝতে পারছি। আর যদি সত্যি সত্যি ভালবেসে থাকেন, তা হলে তো আপনাদের স্বপ্ন সফল হয়ে যাবে। সতীন হয়ে সারাজীবন একসঙ্গে থাকতে পারবেন বলে আবার জোরে হেসে উঠল।

আপনি ছোটলোক ইতর বলে রাগে গরগর করতে করতে কণা চলে গেল।

গালিব মৃদু হাসতে হাসতে তার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইল।

এমন সময় রহিম চাচা ফিরে এসে দৃশ্যটা দেখে জিজ্ঞেস করল, কণা মা এসেছিল কেন?

গালিব বলল, ঝগড়া করতে।

রহিম চাচা এই এক বছর গালিবদের সঙ্গে থেকে বুঝতে পেরেছে, গালিব খুব উচ্চশিক্ষিত ও গুণী ছেলে। কেন যে সুদূর পল্লীগ্রামে পোস্ট মাস্টার হয়ে এসেছে চিন্তা করেও কোনো উত্তর খুঁজে পায়নি। আর কণা যে ঝগড়াটে মেয়ে নয় তাও জানে। তাই গালিবের মুখে ঝগড়ার কথা শুনে খুব অবাক হয়ে বলল, কণা মা ঝগড়া করতে এসেছিল?

গালিব বলল, তাই করতে এসে আমাকে ছোটলোক, ইতর বলে গেল।

আরও অবাক হয়ে রহিম চাচা বলল, সত্যি বলছেন?

এতে এত অবাক হচ্ছেন কেন? ওনার চোখে হয়তো আমি ছোটলোক, ইতর। তাই ঐ কথা বলে গেলেন। মনে হচ্ছে উনি আমাকে বুঝতে ভুল করেছেন। তাই ঐসব কথা বলেছেন। ভুল ভাঙলে নিজেই এস ক্ষমা চাইবেন। যাক, ওনার কথায় আমি কিছু মনে করি নি। আপনি আবার এসব কাউকে বলবেন না।

কলেজ বন্ধ থাকায় পরের দিন কণা তনিদের বাড়িতে গেল। আলাপ করার সময় বলল, তোর চোখে গালিব সাহেব যাই হোক না কেন, তিনি যে একজন ছোটলোক ও ইতর তা আমি ভালো করেই জানি।

তনি বলল, মনে হচ্ছে ওনার সঙ্গে তোর কথাকাটি হয়েছে।

কণা বলল, তা তো হয়েছেই।

হঠাৎ তার সঙ্গে ঝগড়া করতে গেলি কেন? ভদ্রলোক তোকে কি ভাবল বল দেখি?

যাই ভাবুক তাতে আমার কি? কি বলেছেন জানিস?

কি করে বলব? আমি তো সে সময় তোদের কাছে ছিলাম না।

বলেন কি না, তুই ও আমি যদি ওনাকে বিয়ে করি, তা হলে আমরা সতীন হয়ে আজীবন একসঙ্গে থাকতে পারব। শোনামাত্র আমিও ছোটলোক, ইতর বলে চলে এসেছি।

তনি হেসে উঠে বলল, আজও তোর আক্কেল হল না। সেই ছোটবেলার মতো বোকা রয়ে গেছিস। হুট করে রেগেও যাস। রেগে গেলে মানুষের ভালো মন্দ জ্ঞান লোপ পায়। ঐ কথা বলে যে তোকে রাগিয়েছেন, তাও বুঝতে পারলি না? তিনি খুব ভালো মানুষ, ওনার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিস।

তনির কথা শুনে কণারও এখন তাই মনে হল। ভাবল, হঠাৎ রেগে উঠে ওরকম কথা বলা উচিত হয় নি।

কি রে, কি ভাবছিস?

ভাবছি, তোর কথাই ঠিক। আসলে কি জানিস, ভাইয়া তোকে বিয়ে করবে না জিজ্ঞেস করে উত্তর না পেয়ে মাথা গরম হয়ে গিয়েছিল।

তুই আবার সেকথা জিজ্ঞেস করতে গিয়েছিলি কেন? উনিতো সেদিন বলেই দিলেন, বলবেন না। কিছু দিনের মধ্যে এমনিই আমরা জানতে পারব।

উনি তোকে ভীষণ ভালবাসেন এবং বিয়েও করতে চান, তোকে না পেলে জীবনে আর বিয়েই করবেন না, কথাটা বলতে গিয়েও ওয়াদার কথা মনে পড়তে সামলে নিয়ে চুপ করে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।

কি রে, মনে হচ্ছে কিছু বলতে চাচ্ছিস অথচ বলতে পারছিস না। কোনো দ্বিধা না করে বলে ফেল।

না, তেমন কিছু না। একটা কথা জানতে ইচ্ছা করছে।

বল না, কি জানতে ইচ্ছা করছে।

আল্লাহ না করুক, যদি সত্যি সত্যি ভাইয়ার সঙ্গে তোর বিয়ে না হয়, তখন কি করবি?

তনি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে বলল, কি আর করব, তক্বদিরকে মেনে নেব।

তোর কি বিশ্বাস হয়, ভাইয়া তোকে বিট্রে করব?

তনি চোখ মুছে বলল, আসল কথা তুই জানিস না, আমি তোর ভাইয়াকে ভালবাসলেও সে যে আমাকে ভালবাসে তা আজও আমি জানি না। তাই বিট্রে করার কথা এখানে আসে না।

কণা অবাক হয়ে বলল, সে কিরে? সে কথা তো তুই এত দিন বলিস নি? আমি তো জানি তোরা দুজন দুজনকে ভালবাসিস। তা হলে তুই ভাইয়াকে তার মনের কথা বলিস নি?

অনেকবার বলতে চেয়েছি, আমজাদ ভাই অন্য প্রসঙ্গ তুলে আমাকে কথাটা বলতে দেয়নি।

ঠিক আছে, ভাইয়ার পরীক্ষা হয়ে গেলে তো আসবে, তাকে আমি তোর কথা বলব।

যতবার তনি মনের কথা আমজাদকে জানাতে গেছে ততবারই আমজাদ অন্য প্রসঙ্গ তুলে তাকে কথাটা বলতে দেয়নি। তখন তনি ব্যাপারটা বুঝতে না পারলেও গালিব সাহেবের কথা শোনার পর প্রায়ই মনে হয়, “আমজাদ তাকে ভালবাসে না, ছোট বোনের মতো স্নেহের চোখে দেখে।” এখন কণার কথা শুনে বলল, না, আমার কথা তুই তাকে কিছু বলবি না। বাড়িতে এলেই তো মুরুব্বীরা যে আমাদের বিয়ের কথা পাকা করে রেখেছে, তা তো শুনবেই। শোনার পর কি হয় না হয়, জানা যাবে।

সেদিন বাড়ি ফেরার সময় কণা ভাবল, ভাইয়ার সঙ্গে গালিব সাহেবের নিশ্চয় পরিচয় আছে, তাই ভাইয়া কেন তনিমাকে বিয়ে করবে না সে কথা জানে। যাই হোক, ভাইয়া এলেই সবকিছু জানা যাবে।

পোস্ট অফিসের কাছে এসে ভাবল, গতকালের ঘটনার জন্য আজই ক্ষমা চেয়ে নেয়াই ভালো। পোস্ট অফিসের দরজায় উঁকি দিয়ে দেখল, আজও রহিম চাচা নেই। গালিব তাকে দেখতে পেয়ে সালাম দিয়ে বলল, বাইরে কেন ভেতরে আসুন।

কণা সালামের উত্তর দিয়ে ভেতরে এসে লজ্জা পেয়ে ক্ষমা চাইতে না পেরে মুখ নিচু করে রইল।

গালিব বুঝতে পেরে হাসি মুখে বলল, দাঁড়িয়ে থাকবেন, বসবেন না?

গতকাল আপনার সঙ্গে খুব খারাপ ব্যবহার করে ফেলেছি, দয়া করে ক্ষমা করে দিন।

আপনি তো তেমন কোনো খারাপ ব্যবহার করেন নি। যা করেছেন ঐ পরিস্থিতি সবাই তাই করত। তা ছাড়া আপনার কথায় আমি কিছু মনে করিনি।

তবু বলুন ক্ষমা করেছেন।

কেউ দোষ করে অনুতপ্ত হলেই ক্ষমার যোগ্য হয়ে যায়। ঠিক আছে, করলাম। এবার নিশ্চয় বসবেন?

আজ আর বসব না, অন্যদিন এসে আলাপ করব বলে কণা বিদায় নিয়ে চলে গেল।

.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *