একদিন অপরাহ্নে – ৩

৩.

খালেক উজ্জামানের বাগান বাড়িতে গালিব এক মাস বেশ নিবিঘ্নে বাস করল, তারপর উৎপাত শুরু হল। প্রথম দিন রাত দশটা এগারটার দিকে ছাদে বেশ কিছুক্ষণ ইট পড়ল। ছাদে ইট পড়ার শব্দ পেয়ে রহিম চাচা বেশ ভয় পেয়েছিল। তাই পরের দিন সকালে গালিবকে বলল, এবার উৎপাত শুরু হল। আপনি অন্য কোথাও থাকার ব্যবস্থা করুন।

গালিব মৃদু হেসে বলল, কি এমন আর উৎপাত, শুধু কয়েকটা ইট পড়েছে। মাত্র। মনে হচ্ছে তাতেই আপনি ভয় পেয়েছেন?

ভূতদের কে না ভয় পায়? না, না, আপনি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব অন্য বাসা ভাড়া নিন।

আপনি তো বয়স্ক লোক, কখনও ভূত দেখেছেন?

না, দেখিনি। তবে ভূতের সম্পর্কে অনেক কথা শুনেছি।

যদি বলি দুনিয়ায় ভূত বলে কিছু নেই?

আপনি একা বললে তো হবে না। দুনিয়াশুদ্ধ লোক ভূত আছে বিশ্বাস করে।

তা হলে আপনার মতে রাতে ভূতেরা আমাদের বাড়ির ছাদে ইট ফেলেছে।

নিশ্চয়ই।

আমি কিন্তু ভূত বিশ্বাস করি না।

আপনি বিশ্বাস না করলেও সব মানুষই ভূত বিশ্বাস করে। তাড়াতাড়ি অন্য জায়গায় থাকার ব্যবস্থা না করলে আমি আর এ বাড়িতে থাকব না।

আজকের রাতটা থাকুন, আমার বিশ্বাস আর কখনও ভূতেরা ছাদে ইট ফেলবে না।

আপনি বললেই হল, ভূতেরা যখন ইট ফেলা শুরু করেছে তখন প্রতিরাতেই ফেলবে।

ঠিক আছে, আজ রাতে যদি ইট পড়ে, তা হলে না হয় পরের দিন চলে যাবেন।

আপনারা থেকে যাবেন?

হ্যাঁ থেকে যাব। বললাম না, ভূত বলে দুনিয়াতে কিছু নেই? আপনি যদি আমাদের সঙ্গে থাকেন। তা হলে ভূতেরা ইট ফেলে, না অন্য কেউ ফেলে দেখতে পাবেন।

রহিম চাচা আর কিছু না বলে চুপ করে রইল।

এখান থেকে থানা প্রায় পাঁচ ছয় মাইল দূর। গালিব রহিম চাচাকে অফিসের কাজ বুঝিয়ে দিয়ে থানায় গেল। কোনো যানবাহন না থাকায় হেঁটে এসেছে। দারোগা সাহেবের সঙ্গে আলাপ পরিচয়ের পর ছাদে ইট পড়ার কথা জানিয়ে ঘটনাটা তদন্ত করার কথা বলল।

দারোগা সাহেব বললেন, ঐ বাড়ি সম্পর্কে অনেক রকম জনশ্রুতি শোনা যায়। ভাড়া নেয়ার আগে আপনাকে কেউ কিছু বলেনি?

গালিব বলল, হ্যাঁ, বলেছে। আমি বিশ্বাস করিনি।

ওটা যে ভূতুড়ে বাড়ি, এখন নিশ্চয় বিশ্বাস করেন?

না। ভূতেরা বাড়ির ছাদে ইট ফেলে না, ফেলে মানুষ। তাই আপনাকে তদন্ত করার জন্য বলতে এসেছি।

দারোগা একটু গম্ভীরস্বরে বললেন, আমি এখানে বিশ বছর কাজ করছি। এই বিশ বছরে অনেকবার তদন্ত করেছি। কিন্তু কোনো ফল হয়নি। আপনি দু’দিন হল এসে যে কথা বলছেন, তা আজ পর্যন্ত কেউ বলেনি। যা বলছি শুনুন, আপনি ঐ বাড়ি ছেড়ে অন্য কোনো বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকুন।

গালিব বলল, পরমর্শ দেয়ার জন্য ধন্যবাদ। তারপর বলল, কিছুদিন আগে ঐ বাড়িতে আমার আগের পোস্ট মাস্টারকে ভূতেরা হত্যা করেছে, সে ব্যাপারে আপনার কি মতামত?

আমার অন্য কোনো মতামত নেই, লোকজন যা বলেছে সেটাই সত্য।

লাশ পোস্টমর্টেম করিয়েছিলেন?

অফকোর্স।

রিপোর্টে কি পাওয়া গিয়েছিল?

অশরীরী আত্মা মানে ভূতেরা ওনাকে গলাটিপে হত্যা করেছে।

গালিব মৃদু হেসে বলল, আমি কিন্তু ঐ বাড়ি সম্পর্কে যেসব জনশ্রুতি আছে, তা বিশ্বাস করি না। আর ভূত বলে পৃথিবীতে কিছু আছে তাও বিশ্বাস করি না। রাতের বেলা ঐ বাড়িতে যা কিছু ঘটছে তা ভূতের কাজ নয়। এটা যে মানুষেরই কাজ তা একদিন প্রমাণ করে দেখাব ইনশাআল্লাহ।

দারোগা সাহেব বললেন, শুনুন গালিব সাহেব আপনি পোস্ট মাস্টার হয়ে এসেছেন, পোস্ট অফিসের কাজ নিয়ে থাকাই আপনার জন্য মঙ্গল। খামাখা ভূতুড়ে বাড়ি নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে অন্য বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকুন।

গালিবের মনে হল, কথিত ভূতেদের সঙ্গে দারোগা সাহেবের যোগসাজ আছে। বলল, চলি দারোগা সাহেব, পরে আবার দেখা হবে। তারপর সালাম বিনিময় করে ফিরে আসার সময় একটা প্ল্যান তৈরি করল।

রাত সাড়ে নয়টার সময় প্ল্যানটা মা ও রহিম চাচাকে জানিয়ে আপাদমস্তক কালো পোশাক পরে গালিব বেরিয়ে গেল। ঠিক দশটার সময় ছাদে ইট পড়া শুরু হতে গালিব পিস্তল দিয়ে দুতিনটে উড়ো ফায়ার করল। ফায়ারের শব্দ হওয়ার সাথে সাথে ইট পড়া বন্ধ হয়ে গেল। গালিব যে গাছের আড়ালে ছিল তার পাশ দিয়ে চারজন মুখোশধারী লোককে দৌড়ে পালাতে দেখে চুপ করে রইল। তারপর কিছুটা দূরে চলে গেছে বুঝতে পেরে আবার দুটো উড়ো ফায়ার করল। লোকগুলো আরও দ্রুত পালিয়ে গেল।

গালিব ঘরে ফিরে এলে আমিনা বিবি জিজ্ঞেস করলেন, ওরা কয়জন ছিল?

চারজন।

ওদের কারও গায়ে গুলি লাগেনি তো?

না।

রহিম চাচা বারান্দা থেকে বলল, ওদেরকে জখম করে বেঁধে রাখলে ভালো হত। সকালে থানায় খবর দিলে পুলিশরা ধরে নিয়ে যেত।

রহিম চাচাকে গালিবও চাচা বলে। তার কথা শুনে বলল, আপনি ঠিক বলেছেন চাচা। কিন্তু বিশেষ কারণে তা করি নি। যাই হোক, আশা করি, আজ থেকে ছাদে ইট আর কেউ ফেলবে না। তারপর আবার তাকে উদ্দেশ্য করে বলল, চাচা, আপনার ভুল ভাঙল তো? এবার গ্রামের লোকজনের এ ভূতুড়ে বাড়ি সম্পর্কে যে ভুল ধারণা ছিল, তা অল্প কয়েকদিনের মধ্যে সবাই জানতে পারবে।

রহিম চাচা বলল, আপনার কি ধারণা, কারা এবং কেন এরকম কাজ এতদিন ধরে করে আসছে?

গালিব বলল, কারা এবং কেন একাজ করছে এবং আগের পোস্ট মাস্টারকে কারা ও কেন হত্যা করল তা জানার জন্য ওদেরকে আজ ছেড়ে দিলাম। যে লোক ওদেরকে দিয়ে এই কাজ করাচ্ছে, তার খোঁজ নিতে হবে এবং এর প্রতিকারও করতে হবে।

আমিনা বিবি ছেলের এখানে চাকরি নিয়ে আসার উদ্দেশ্য জানেন। তাই কিছু না বলে চুপ করে রইলেন।

রহিম চাচা বলল, কিন্তু এদের পিছনে যদি জাঁদরেল কোন লোক থাকেন কিংবা কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থাকে, তা হলে আপনি বিদেশী ছেলে হয়ে একাকী কি ওদের সঙ্গে পেরে উঠবেন? ওরা হয়তো আপনাকে দুনিয়া থেকে বিদায় করার ব্যবস্থা করবে।

তা করতে পারে এবং সেটাই স্বাভাবিক। যার যেভাবে যেখানে আল্লাহ মৃত্যু লিখে রেখেছেন, তার সেখানে সেভাবেই হবে। মুমীন মুসলমান হিসাবে প্রত্যেককে সেকথা বিশ্বাস করতে হবে। আমিও করি। তাই মৃত্যুর ভয় আমি করি না। তা ছাড়া অন্যায়ের বিরুদ্ধে কিছু করতে হলে বিপদের ঝুঁকি তো থাকবেই। এখন এসব কথা থাক। এবার ঘুমিয়ে পড়ুন। আর হ্যাঁ, আজকের ঘটনার কথা কাউকে বলবেন না। লোকজন গুলি হওয়ার কথা জিজ্ঞেস করলে বলবেন, আপনি গুলির শব্দ শুনেছেন। আর কিছু জানেন না।

পরের দিন গালিব পোস্ট অফিসে কাজ করছিল। বেলা বারটার সময় দারোগাকে দু’জন পুলিশসহ আসতে দেখে মৃদু হেসে কাজে মন দিল।

দারোগা সাহেব পুলিশ দু’জনকে বাইরে অপেক্ষা করতে বলে ভেতরে ঢুকলেন।

গালিব সালাম বিনিময় করে বসতে বলে বলল, কি ব্যাপার হঠাৎ এলেন যে?

কাজের প্রয়োজনে আমাদের হঠাই আসতে হয়।

বলুন কি প্রয়োজনে এসেছেন?

গতরাতে আপানার বাসার কাছে নাকি তিন চারটে গুলির শব্দ শোনা গেছে?

কথাটা আপনি জানলেন কি করে? নিশ্চয় গ্রামবাসীদের কেউ বলেছে? ভেবে অবাক হচ্ছি গ্রামবাসী গুলির শব্দের কথা জানাল, অথচ আমার বাসার ছাদে যে, ইট পড়ল, সে কথা জানাল না কেন?

দারোগা একটু রাগের সঙ্গে বললেন, আপনি কিন্তু আমার প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে যাচ্ছেন।

আমার একটা এয়ারগান আছে, পাখি স্বীকার করা আমার হবি। সেটা দিয়ে আমি পাখি স্বীকার করি। আপনাকে জানানোর পরও যখন আপনি কোনো ব্যবস্থা নিলেন না তখন আমি নিজেই ব্যবস্থা নিলাম। কাল যখন ভূতেরা ছাদে ইট ফেলছিল তখন এয়ার গান চালিয়ে ভূতদের তাড়িয়েছি। তারই শব্দ হয়তো গ্রামবাসী শুনে আপনাকে জানিয়েছে।

চলুন, আপনার বাসা সার্চ করব। সেই সাথে আপনার এয়ার গানটাও দেখব।

বাসা সার্চ করে কোনো কিছু পাওয়া গেল না। এয়ারগান পরীক্ষা করে দারোগা সাহেব বুঝতে পারলেন, এটা দিয়ে শুধু পাখি শিকার করা যায়, মানুষ মারা যায় না। তবে আহত করা যায়। তাই বিদায় নিয়ে চলে যাওয়ার সময় বললেন, আপনাকে অহেতুক কষ্ট দেয়ার জন্য দুঃখিত।

গালিবের লাইসেন্স করা একটা রিভালবার আছে। সেটা সে প্রতিদিন সকালে অফিসে এসে আলমারীতে রেখে দেয়। বিকেলে যখন বাসায় ফেরে তখন নিয়ে আসে। তাই পুলিশ তার বাসা সার্চ করে কিছু পায়নি।

এরপর থেকে গালিবের বাসার ছাদে ইটপড়া বন্ধ হয়ে গেছে। একদিন গভীর রাতে কিছুর শব্দে গালিবের ঘুম ভেঙে যেতে কান খাড়া করে অপেক্ষা করতে লাগল। কিছুক্ষণ পরে তিন ব্যাটারি টর্চ হাতে নিয়ে খাট থেকে নেমে পিছনের দিকে জানালা অল্প একটু ফাঁক করতে কয়েকজন লোকের চলে যাওয়ার পায়ের শব্দ শুনতে পেল। টর্চ জ্বেলে লোকগুলোকে দেখার প্রবল ইচ্ছাটা দমন করল। ভাবল, তা হলে কি ওরা এই বাড়ির নিচের গোপন কুঠরীতে গিয়েছিল। এখন তার মনে হল, দরজা লাগাবার শব্দে তার ঘুম ভেঙেছে। যদি ঘটনা সত্য হয়, তা হলে নিশ্চয় জঙ্গলের দিক থেকে গোপন কুঠরীতে যাওয়ার সুরঙ্গ পথ আছে। ভেবে রাখল, দিনের বেলা সেই পথের অনুসন্ধান করবে।

কয়েকদিন চেষ্টা করেও সে পথের সন্ধান পেল না। তা ছাড়া কয়েক রাত জেগে থেকে ও তাদের আনাগোনা দেখতে না পেলেও হতাশ হল না। ভেবে রাখল, বাড়ির গোপন কুঠরীকে ঘিরে যে রহস্য আছে, তা একদিন না একদিন উঘাটন করবেই। কারণ এটার সঙ্গে খালুর হত্যাকাণ্ড জড়িত।

.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *