অ-আ-ক-খুনের কাঁটা – ৯

নয়

ঐ বারো তারিখ বিকেল সাড়ে চারটে। বিড়ন স্ট্রীটের বাড়ি।

কলিংবেল বাজাতে কুসমির মা সদর দরজাটা খুলে দিল। মৌ কলেজ থেকে ফিরে এল। খাতাপত্র নিয়ে বাইরের ঘরে ঢুকে দেখে, মুখোমুখি বসে আছেন ওর বাবা আর মা। বাবা ইজিচেয়ারে। তাঁর কোলের উপর একখানা ইংরেজি নভেল। খোলা অবস্থায় উপুড় করে রাখা। তিনি কিন্তু তাকিয়ে বসেছিলেন নিস্পন্দ সিলিঙ ফ্যানটার দিকে। মৌকে দেখে বললেন, আয়! আজ এত দেরী হল যে ফিরতে?

মৌ জবাব দিল না। বইখাতা টেবিলের উপর রেখে ঘুরে দাঁড়াল মায়ের মুখোমুখি। তাঁরও কোলের উপর পড়েছিল একটা আধ-বোনা উলের সোয়েটার। নিটিং-এর সরঞ্জাম হাতে তুলে নিয়ে বললেন, মিট-সেফে তোর খাবার আছে। খেয়ে নে।

মৌ পোশাক-পরিচ্ছদ সম্বন্ধে বেশ সচেতন। কলেজে যায় একটু সেজেগুজে। আজ কিন্তু তার প্রসাধনের চিহ্নমাত্র ছিল না—আটপৌরে একটা মিলের শাড়ি পরে কলেজে গিয়েছিল। সে মায়ের নির্দেশমতো রান্নাঘরের দিকে গেল না। মুখ-হাত ধুতে কলঘরের দিকেও নয়। এসে বসল সামনের একটা সোফায়। ডাক্তারবাবু জিজ্ঞাসু এক জোড়া চোখ তুলে ওর দিকে তাকালেন।

মৌ বলল, তোমাদের একটা কথা বলব?

কেউ জবাব দিল না। না অনুমতি, না আপত্তি।

—আমি যাদবপুরে ফিলজফি অনার্স নিয়ে পড়ি। আমার বয়স কুড়ি। আমি প্রাপ্তবয়স্ক।

ডাক্তারসাহেব বইটা তুলে নিয়ে নীরবে পাঠে মন দেন। প্রমীলা তাঁর বোনার সরঞ্জামটা নামিয়ে রেখে বললেন, এ-কথার মানে?

—হোয়াই ডোঞ্চ টেক মি ইন কনফিডেন্স? তোমরা নিজেরাই পাগল হতে চাও, না আমাকে পাগল করতে চাও?

কর্তা-গিন্নির চোখাচোখি হল, গিন্নিই বললেন, কেন? আমরা কী পাগলামী করেছি?

—এক নম্বর: সকালে কলেজ যাবার সময় দেখে গেছিলাম বাপি তিপ্পান্ন পাতাটা পড়ছে। এখনও সেই পাতাটাই খোলা আছে। দু নম্বর: তোমার সেলাই এক-কাঁটাও আগায়নি! তিন নম্বর: আমার এক পিরিয়ড আগে ছুটি হয়েছে আজ। আমি সাড়ে পাঁচটায় সচরাচর ফিরে আসি। অথচ আমি ঢুকতেই বাপি বলল—আজ এত দেরী হল যে ফিরতে?

এতক্ষণে কথা বললেন দাশরথী, কারণটা তো তুই জানিস মৌ! একটা জলজ্যান্ত বুড়ো মানুষ পাঁচ-পাঁচটা দিন নিখোঁজ। আমরা বিচলিত হব না? আমরা কী করতে পারি?

—যা তোমার করণীয়। থানার রিপোর্ট করা। মিসিং স্কোয়াডে! তুমি তা কেন করতে পারছ না, তা আমরা তিনজনেই জানি। কিন্তু আমরা পরস্পর তা আলোচনা করছি না। তোমরা দুজনে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করেছ কিনা তা আমি জানি না—আমাকে কেউ কিছু বলনি। চন্দননগর থেকে মাস্টার মশাই কেন ফিরে এলেন না, হঠাৎ কেন এমনভাবে নিরুদ্দেশ হয়ে গেলেন…

দাশরথী বলেন, চন্দননগর নয়, শ্রীরামপুর।

—না। চন্দননগর।

—ওটা তোর ভুল আন্দাজ। যেহেতু তুই ভেবেছিস….

—কী?

—তা তো বুঝতেই পারছিস! আমার মুখ দিয়ে নাই বলালি?

—অলরাইট! তোমাদের যখন এতই সঙ্কোচ, তখন আমিই মুখ ফুটে বলি; হ্যাঁ। আমার সেটাই আশঙ্কা। ওঁর স্মৃতি মাঝে-মাঝে হারিয়ে যায়। উনি মনে করতে পারেন না যে, একটা ফটো হুক থেকে পেড়ে তাকে ছুরি বিদ্ধ করতে গিয়ে ওঁর হাত কেটে গিয়েছিল…

ডাক্তার-সাহেব স্ত্রীর দিকে তাকালেন। প্রমীলা বললেন, হ্যাঁ, ওকে আমি বলেছি। ওর জানা থাকা দরকার। অনেক সময় একা একা থাকে…মাস্টারমশাই…

ডাক্তার দে চট করে উঠে পড়েন। বারকয়েক নিঃশব্দে পায়চারি করে বলেন, কুমির মা কি….

—চলে গেছে। আমি সদরে ছিটকিনি দিয়ে এসেছি। তুমি মন খুলে বল—বললে মৌ।

—তোমরা ভুল করছ। ইয়েস্, আই অ্যাডমিট। ইতিপূর্বে তিনি মেন্টাল অ্যাসাইলামে দু’বছর ছিলেন। আমার জ্ঞাতসারে তিন-তিনবার মানুষের গলা টিপে ধরেছিলেন। কিন্তু প্রতিবারই প্ররোচনা ছিল।…না, না, প্রতিবাদ করিস না খুকু…আমি জানি, প্ররোচনাটা সামান্য। তোর-আমার দৃষ্টিভঙ্গিতে। কিন্তু ওঁর দৃষ্টিভঙ্গি অন্য জাতের ছিল। পরীক্ষার খাতায় নকল করা, পূজামণ্ডপে মেয়েদের শ্লীলতাহানির চেষ্টা…ঐ গুরুমহারাজের ভণ্ডামী ওঁর দৃষ্টিতে ছিল হিমালয়ান্তিক অপরাধ! কিন্তু আমি যে নিজে চোখে দেখেছি, গায়ে মশা বসলে উনি চাপড় মারতেন না, হাত নেড়ে মশাটাকে উড়িয়ে দিতেন।…ইয়েস! আসানসোল আর বর্ধমানের ঘটনা দুটো যেদিন ঘটে উনি ঘটনাস্থলে ছিলেন। নিতান্ত কাকতালীয় যোগাযোগ। বর্ধমানে উনি গেছিলেন সকালের ট্রেনে-তোর মার স্পষ্ট মনে আছে…

—কিন্তু চন্দননগর?

—আঃ! আবার বলছিস চন্দননগর! উনি সেদিন শ্রীরামপুরে গেছিলেন। অবশ্য বলতে পারিস আবার কোনও লোকাল ট্রেন ধরে…

—এক সেকেন্ড! আমি আসছি।

মৌ উঠে চলে যায় নিজের ঘরে। একটু পরে ফিরে আসে একটা ডায়েরি হাতে। বললে, এই পাতাটা পড়ছি শোন…ছয়ই নভেম্বরের পাতা—

“চন্দননগর-ঘড়িঘর হইতে গঙ্গা ঘাট। বাঁ-হাতি প্রত্যেকটা দোকান ও বাড়ি।”

কুঞ্চিত ভ্রূভঙ্গে দাশরথী বলেন, কই দেখি ডায়েরিটা? ওটা তুই কোথায় পেলি?

—দিচ্ছি। সবটা আগে পড়ি। ঐ লাইনটা নীল কালিতে ফাউন্টেন পেন্-এ লেখা। তারপর ড-পেন-এ-মনে হয় অন্য সময়ে লেখা: “সকাল আটটা দশ: খবরের কাগজ ক্রয়। সাড়ে আট: পেন্সিল খোঁজা। পাইলাম না। পৌনে নয়টা: বৌমা বলিল, সাতাশ তারিখে সকালের ট্রেনে গিয়েছিলাম। এখন নয়টা চল্লিশ: এগারোটা চল্লিশের গাড়িতে রওনা হইতেছি। বাসযোগে হাওড়া স্টেশন যাইব।”

—তুই…তুই ওটা কোথায় পেলি?

মৌ সে-প্রশ্নের জবাব দিল না। একই সুরে বললে, নেক্সট পেজ-

আবার নীল কালিতে ফাউন্টেন পেন-এ এন্ট্রি—মানে অনেক আগে—”সাতই নভেম্বর: ডুপ্লে কলেজ হইতে ফটকগোড়া—বাঁহাতি সব কয়টি দোকান ও বাড়ি। সন্ধ্যায় প্রত্যাবর্তন।” এর পর বাকি পাতা সব খালি।

এবার সে ডায়েরিটা বাপের হাতে তুলে দেয়। তিনি নিজেও আদ্যন্ত পড়লেন। আগেকার কিছু পৃষ্ঠাও উল্টে দেখলেন। সম্ভবত আসানসোল ও বর্ধমানের বিশেষ দিন-দুটির পাতা। প্রমীলাও দেখছিলেন ঝুঁকে পড়ে।

কন্যার দিকে মুখ তুলে তাকাতেই সে বললে, তোমার প্রশ্নটার জবাব মুলতুবি আছে। এটা খুঁজে পেয়েছি তিনতলার চিলে-কোঠার ঘরে। তোমাদের কিছু বলিনি। যেহেতু তোমরা আমাকে কফিডেন্সে নিচ্ছ না! বেশ বোঝা যায়, মাস্টারমশাই নিজেও নিজের স্মৃতির উপর ভরসা রাখতে পারছিলেন না। আশঙ্কা হয়েছিল—নিজের অজান্তেই তিনি খুনগুলো করেছেন। আই মীন, ছ’তারিখের কাগজ পড়েই হয়তো একথা মনে হয়। তাই ছয় তারিখে ঐ অপাত-অসঙ্গত কথাটা লেখা—”সকাল আটটা দশ: খবরের কাগজ ক্ৰয়। “আধঘণ্টা চিন্তা করে তিনি এই সিদ্ধান্তে আসেন, তাই “পেন্‌সিল খোঁজা, পাইলাম না!” ওঁর হয়তো একটু একটু মনে পড়ছিল—পেন্সিল কাটতে গিয়ে হাত কাটেনি। কাউকে খুন করতে গিয়েই ওভাবে হাতটা কেটেছে। কিন্তু কে সে? ওঁর মনে পড়েনি। স্থির করেছিলেন, আর স্মৃতির উপর নির্ভর করবেন না। চন্দননগরে যাচ্ছিলেন তিনি—সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, প্রতি দশ মিনিট অন্তর ডায়েরিতে লিখবেন, কখন কী করছেন। যাতে পরদিন যদি দেখেন চন্দননগরে কেউ খুন হয়েছে তখন স্মৃতিনির্ভর সমাধান নয়, ডায়েরির মাধ্যমে উনি জানতে পারবেন—হত্যামুহূর্তে তিনি ঠিক কোথায়, কী করছিলেন। অথচ ভুলোমানুষের মতো যাবার সময় ডায়েরিটা ফেলে যান।

ডক্টর দে বললেন, তাহলে তিনি আমাকে কেন মিছে কথা বলে গেলেন? কেন বললেন, শ্রীরামপুর যাচ্ছি!

—‘গিল্ট কনশাস্’ মাইন্ডের জন্য। তিনি যে তখন নিজেই জানেন না, তিনিই ঐ ‘হোমিসাইডাল ম্যানিয়াক্’ কি না। যথেষ্ট দেরী হয়ে গেছে বাপি! তুমি এবার থানায় গিয়ে রিপোর্ট কর।…ভাবছ কেন? তুমি তো শুধু বলবে যে, তোমার বাড়ি থেকে একজন বিকৃতমস্তিষ্ক বৃদ্ধ নিখোঁজ হয়েছেন। আর তো কিছু বলবে না তুমি।…না হয় চল, আমি ও তোমার সঙ্গে যাচ্ছি। দাশরথী দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁটটা কামড়ে মিনিটখানেক অপেক্ষা করেন। অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে বললেন, ভগবান আমার প্রার্থনাটা শুনলেন না তাহলে?

মৌ যেন ছোট ছেলেকে আদর করছে। বাপের মাথায় ব্যাকব্রাশ চুলগুলোর উপর হাত বুলিয়ে সেও ধরা-গলায় প্রশ্ন করে, কী? কী প্রার্থনা করছিলে এ কয়দিন?

মেয়ের চোখে চোখ রেখে প্রৌঢ় বলে ওঠেন, একটা মোটর অ্যাকসিডেন্ট… মাস্টারমশাই…ইন্সট্যান্ট ডেথ!

প্রমীলা চোখে আঁচল চাপা দিলেন। তিনি জানতেন, ঐ বৃদ্ধ ছিলেন তাঁর বিকল্প শ্বশুর।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *