অ-আ-ক-খুনের কাঁটা – ৭

সাত

সাত তারিখ।

গাড়িটা যখন চন্দননগর থানা-কম্পাউন্ডে প্রবেশ করল তখন সকাল ছটা সাতচল্লিশ।

বাসু-সাহেবের নজরে পড়ল-থানা-কম্পাউন্ডে বসে আছেন কয়েকজন : ইন্সপেক্টার বরাট, রবি বোস, আর চন্দননগর থানার ও. সি. দীপক মাইতি। গাড়িটা পার্ক করে উনি পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলেন সেদিকে। ওঁর পিছন-পিছন কৌশিক আর সুজাতা। কেউ ওদের স্বাগত জানালেন না। সুপ্রভাতও নয়। কেমন একটা খট্‌কা লাগল বাসু-সাহেবের। যেন ওঁরা সবাই কী একটা শোকবার্তা শুনে একমিনিট নীরবতা পালন করছেন।

বাসু সবিস্ময়ে বলেন, কী ব্যাপার? সবাই সাতসকালেই এমন চুপচাপ?

দীপক বিহ্বলভাবে উঠে দাঁড়ায়। রবি মেদিনীনিবদ্ধ দৃষ্টি। ইন্সপেক্টর বরাট বলে ওঠেন, উই আর এক্সট্রিমলি সরি বাসু-সাহেব! দ্য ড্রামা ইজ ওভার! নাটকের শেষ যবনিকা পড়ে গেছে

বাসু নিজের অজান্তেই বসে পড়েন। অস্ফুটে বলেন, মানে?

—বাংলা মতে অবশ্য ছয় তারিখ—যেহেতু সূর্যোদয় হয়নি—কিন্তু ইংরেজী মতে ‘সি. ডি. ই.’ তার কথা রেখেছে। সাতই সকাল সাড়ে পাঁচটায়!

—কে? কোথায়? কখন খবর পেলেন?

—খবর পেয়েছি মিনিট পাঁচেক আগে। টেলিফোনে। ডেড-বডি এখনো সেখানেই পড়ে আছে। আমরা যাচ্ছিলাম। আসুন, আপনি বরং নিজের গাড়িটাই নিন।

দরজার সামনে অপেক্ষা করছিল দুখানি জীপ। থানার সামনে এখনো দাঁড়িয়ে আছে জনা-দশেক পুলিস—য়ুনিফর্মে এবং ছদ্মবেশে। কে কোথায় পাহারা দেবে সব নির্দেশ এখনো পায়নি ঐ কজন। দীপকের ইঙ্গিতে তাদের কয়েকজন উঠে বসল জীপের পিছনে।

মটোরকেডটা প্রায় গোটা চন্দননগর শহরটা পাড়ি দিল। গঙ্গার কাছাকাছি একটা প্রায়-নির্জন অঞ্চলে এসে থামল। প্রকাণ্ড হাতাওয়ালা দ্বিতল একটি সাবেকি বাড়ি। সামনে ঢালাই লোহার কারুকার্য করা গেট। বোঝা যায়, এককালে শৌখিন বাগান ছিল বাড়িটা ঘিরে—এখন আগাছায় ভর্তি। দারোয়ান সসম্ভ্রমে স্যালুট করে বললে, ইধার পাধারিয়ে সাব!

বাড়িতে ঢুকলেন না ওঁরা। দারোয়ানকে অনুসরণ করে এগিয়ে গেলেন গঙ্গার দিকে। উঁচু একটা বালিয়াড়ি মতো। হয়তো কোন যুগে গঙ্গার ভাঙন রুখতে কেউ মাটি ফেলে পাথর দিয়ে বাঁধিয়েছিল। এখন কালকাশুন্দির জঙ্গলে ভরা। সেখানে একটা কংক্রিটের বেঞ্চি পাতা। জায়গাটা এমন যে, রাস্তা থেকেও নজরে পড়ে না, গঙ্গার দিক থেকেও নয়। সেই কংক্রিটের বেঞ্চির ঠিক সামনে পড়ে আছে মৃতদেহটা। মধ্যবয়সী একজন ভদ্রলোক, বয়স পঞ্চাশের বেশ নিচে। পরানে ফুলপ্যান্ট, পুরোহাতা শার্ট, হাফহাতা সোয়েটার, গলায় মাফলার জড়ানো। পায়ে মোজা ও হান্টিং শ্য। একটু দূরে ছিটকে পড়ে আছে একটি সুদর্শন হাতির দাঁতের মুঠওয়ালা শৌখিন ছড়ি। মৃত্যুর কারণ স্পষ্ট: মাথার পিছন দিকটা থেঁতলে গেছে!

বাসু-সাহেব আপন মনে অস্ফুটে বললেন, আসানসোল!

সুজাতা সবিস্ময়ে একবার তাঁর দিকে তাকালো। কৌশিক কানে কানে তাকে বলল, অর্থাৎ সেই প্রথম পদ্ধতিটা। আস্তিনের ভিতর লুকিয়ে কোনও হাতুড়ি নিয়ে এসেছিল লোকটা।

পুলিস ফটোগ্রাফার চার-পাঁচটা ফটো নিল। স্ট্রেচার নিয়ে যারা অপেক্ষা করছিল তারা বলল, অব্ উঠাই সা’-ব?

—জেরা সে ঠা যাও!—বললেন ইন্সপেক্টর বরাট। মৃতব্যক্তির পকেট তল্লাসী করে দেখলেন। লাইফ-টাইম পার্কার কলম, মানিব্যাগ—তাতে শ-দুই টাকা, নোটে ও ভাঙানিতে, রুমাল, নস্যির ডিবে, একটা নোট বই। লিস্ট বানানো হল। দুজন সাক্ষীর স‍ই নিয়ে ইনকোয়েস্টও করা হল। বাঁ-হাতের ঘড়িটা ভাঙেনি—সেটা টেরও পায়নি যে, তার মালিকের হৃদস্পন্দন থেমে গেছে। ঠিকই সময় দিচ্ছে ঘড়িটা : টিক্‌টিক্—টিক্‌টিক্!

বাসু বরাটকে বললেন, কে উনি? কী নাম?

—ডক্টর চন্দ্রচূড় চ্যাটার্জি অব্ চন্দননগর!

—ডক্টর? মেডিক্যাল প্র্যাকটিশনার?

—না। ডকটরেট। বাঙলার অধ্যাপক ছিলেন। আসুন, ঘরে গিয়ে বসি।

দারোয়ান পথ দেখিয়ে নিয়ে গেল। বৈঠকখানা খুলে ওঁদের বসতে দিল। গৃহবাসী কেউই এগিয়ে এলেন না ভিতর থেকে। বোধহয় সকলেই শোক-বিহ্বল। মিনিট-পাঁচেক নিঃশব্দে অপেক্ষা করে বাসু-সাহেব প্রশ্নটা না করে পারলেন না, আর কে কে আছেন বাড়িতে? আই মীন…

জবাব দিল থানা-অফিসার দীপক মাইতি, আছেন ওঁর স্ত্রী, কিন্তু তিনি গুরুতর অসুস্থ। শয্যাশায়ী। আর আছেন ডক্টর চ্যাটার্জির শ্যালক মিস্টার বিকাশ মুখার্জি। কিন্তু তিনি গতকাল বিকালে কলকাতা গেছেন। আজ সকালেই ফেরার কথা। এনি মোমেন্ট এসে পড়বেন।

—আর কেউ নেই? যার কাছে কিছু জানতে পারি? অন্তত দুটো খবর…

—কী স্যার সে-দুটো? আমি ওঁদের বেশ ভালোভাবেই চিনি। আই মে হেল্প য়ু।—জানতে চায় দীপক।

—এক নম্বর : ডক্টর চ্যাটার্জি খবরের কাগজ পড়তেন কিনা, আর দু নম্বর : তিনি জানতেন কি না যে, তাঁর নাম চন্দ্রচূড় চ্যাটার্জি!

দীপক চুপ করে রইল কিছুক্ষণ। তারপর বললে, আমি মিস্ গাঙ্গুলীকে খবর পাঠিয়েছি। উনি বলতে পারবেন…মানে, গতকালকার কাগজটা ডক্টর চ্যাটার্জি দেখেছেন কি না।

—মিস গাঙ্গুলীটি কে?

—ওঁর প্রাইভেট সেক্রেটারী।

—আই সী! ওঁর কারবারটা কী ছিল?

—কোনও কারবারই ছিল না স্যার…আমি যতটুকু জানি বলি, মানে ব্যাকগ্রাউন্ডটা— চন্দননগরের এই চট্টোপাধ্যায় পরিবার এককালে যথেষ্ট ধনী ছিলেন। বিশিষ্ট বনেদী পরিবার। চন্দ্রচূড়ের বৃদ্ধ প্রপিতামহ ছিলেন ফরাসী সরকারের বেনিয়ান। জাহাজে মাল আমদানি-রপ্তানি করতেন। জাহাজ যেত শহর কলকাতা পণ্ডিচেরী হয়ে মার্সল্স্ বন্দরে। এক পুরুষে যা সঞ্চয় করেন বাকি চারপুরুষ তা এখনো শেষ করে উঠতে পারেননি। চন্দ্রচূড়ের পিতামহ ছিলেন আবার অন্য জাতের মানুষ। বিখ্যাত চারু রায়ের ছাত্র ছিলেন তিনি—রাসবিহারী, কানাইলাল, শ্রীশ ঘোষদের সঙ্গে গোপন যোগাযোগ ছিল। শ্রীঅরবিন্দ যখন চন্দননগর থেকে পণ্ডিচেরী চলে যান তখন তাঁর কিছু প্রত্যক্ষ ভূমিকাও ছিল। তাঁর নাতি চন্দ্রচূড় বাঙলায় এম. এ. পাস করে কিছু দিন অধ্যাপনা করেছিলেন। তারপর হঠাৎ রিজাইন দিয়ে বাড়ি বসেই একটি গবেষণা করছেন আজ পাঁচ-সাত বছর ধরে। গুটি পাঁচসাত কলেজের ছেলে প্রতিদিন কলেজ ছুটির পর এ বাড়িতে আসে, কী সব রুদ্ধদ্বার আলোচনা হয়। সে সব ব্যাপার দীপক ঠিক জানে না—ওঁর প্রাইভেট সেক্রেটারী অনিতা গাঙ্গুলী বলতে পারে।

চন্দ্রচূড় তাঁর পিতার একমাত্র সন্তান। এবং তিনি নিঃসন্তান। স্ত্রীর স্বাস্থ্য কোনকালেই ভাল ছিল না। মাস ছয়েক হল একেবারে শয্যাশায়ী হয়ে পড়েছেন। ঠিকে ঝি, চাকর, দারোয়ান সংসারটা চালায়। মহাদেব ড্রাইভার গাড়ি চালায়। চন্দ্রচূড়ের নির্দেশে নয়—তিনি সাতে-পাঁচে নেই—বিকাশের ব্যবস্থাপনায়। সে এ পরিবারে আছে আজ বছর-দশেক। বাইরের দিকটা সেই দেখে, সংসারটা এতদিন দেখতেন রমলা অর্থাৎ মিসেস চ্যাটার্জি—ইদানীং উনি শয্যাশায়ী হবার পর, অনিতা।

বেলা সাড়ে আটটা নাগাদ সে এল। একটা রিক্শা চেপে। ওর সঙ্গে একটি বছর বিশেকের কলেজী ছাত্র। বস্তুত সেই খবর পেয়ে অনিতাদিকে ডেকে এনেছে।

কৌশিকের মনে হল—অনিতার বয়স ত্রিশের কাছে-পিঠে। কিন্তু মেদবর্জিত সুঠাম দেহ। মাজা রঙ, মুখখানি মিষ্টি—কেঁদে কেঁদে এখন চোখ দুটো রক্তিম। প্রসাধনের চিহ্নমাত্র নেই।

দীপক ওকে চেনে মনে হল। নাম ধরে ডাকল, এস অনিতা। বস, এঁরা কলকাতা থেকে এসেছেন। তোমার কাছে কিছু জানতে চান।

অনিতা বসল না। প্রতিপ্রশ্ন করল, বিকাশদা কই?

—কলকাতায়। এখনো ফেরেননি।

—সে কী : কাল রাত্রেই তো তাঁর ফিরে আসার কথা। দিদিকে বলা হয়েছে?… আই মীন, মিসেস্ চ্যাটার্জিকে?

এবার জবাব দিল বলাই—গৃহভৃত্য। বললে, না! তিনি এখনো ঘুমোচ্ছেন। কিছু জানেন না।

দীপক পুনরায় বলল, তাঁকে জানানোটা জরুরী নয়। আদৌ জানানো হবে কি না তা ডাক্তার বলবেন। মোট কথা, বিকাশবাবু ফিরে না আসা পর্যন্ত তাঁকে জানানো হবে না। তুমি বস। এঁরা তোমাকে…উনি হচ্ছেন ইন্টেলিজেন্স বিভাগের মিস্টার বরাট, আর উনি ব্যারিস্টার পি. কে. বাসু। প্লীজ টেক্ য়োর সীট।

তবু বসল না অনিতা। তার হাতব্যাগ খুলে একটা নোট বই বার করল। সঙ্গের ছেলেটিকে বললে, বাবলু, এই নম্বরে তুই একটা কল বুক করতো।

—কার নম্বর ওটা?—জানতে চাইল ইন্সপেক্টর দীপক।

—‘সুইট হোম’ নামের একটা হোটেল। শেয়ালদায়। হ্যারিসন রোড ফ্লাইওভারের কাছে। বিকাশদা সচরাচর কলকাতায় নাইট হল্ট করলে ওখানেই ওঠে। ম্যানেজারের নাম হলধরবাবু।

কৌশিকের খেয়াল হয়নি, কিন্তু সুজাতার মনে একসঙ্গে অনেকগুলি প্রশ্ন জেগেছে : বিকাশ দেখতে কেমন? বয়স কত? অনিতা যখন কলকাতায় যায় তখন নিশ্চয় প্রয়োজনে ‘সুইট হোমে’ ওঠে। তার মানে কি ওরা দুজনে যখন… না, তা হতে পারে না! হলধরবাবুও নিশ্চয় চেনেন ওদের।…কোনও ডবল-বেড রুমে…অসম্ভব!

সম্বিৎ ফিরে পেল যখন, তখন নজর পড়ল ঘরের ওপ্রান্তে বাবলু টেলিফোন ডায়াল করছে, আর অনিতা বসে বসে তার এজাহার দিচ্ছে।

অনিতা বাঙলায় এম. এ.। ডক্টর চ্যাটার্জিকে রিসার্চে সাহায্য করে। প্রতিদিন সকালে নটা নাগাদ আসে। সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে যায়। বাড়ি ফটকগোড়া অঞ্চলে। বাবা নেই, মা আছেন, একটি ভাই আছে। সে ডেলি-প্যাসেঞ্জারি করে। কলকাতায় কোনও সওদাগরী অফিসে চাকরি করে। এভাবে বছর পাঁচেক সে কাজ করছে ডক্টর চ্যাটার্জির কাছে।

বাসু প্রশ্ন করেন, আপনাকে উনি কোনও রিসার্চ অ্যালাওয়েন্স দেন?

—মাহিনাই বলতে পারেন। মাসে পাঁচ শ। তাছাড়া দুপুরে এখানেই খাই। বলাই রান্না করে। বিকালে যারা আসে—মানে, কলেজের ছাত্ররা—ওরা ঘণ্টা-হিসাবে অ্যালাওয়েন্স পায়। আমিই হিসাব রাখি।

—গবেষণাটা কী নিয়ে?

—উনি একটা ‘রবীন্দ্র-অভিধান’ রচনা করছেন। আমরা স্বরবর্ণ শেষ করে ব্যঞ্জনবর্ণের ‘প’ অক্ষর পর্যন্ত পৌঁছেছি—

বাসু বলেন, ‘রবীন্দ্র-অভিধান’ মানে?

মিস্টার বরাট ওঁকে বাধা দিয়ে বলেন, মাপ করবেন, বাসু-সাহেব, এ সব অ্যাকাডেমিক আলোচনা আপনি পরে করবেন। আমাকে কয়েকটা জরুরী ব্যাপার জেনে নিতে দিন আগে।

—অল রাইট! য়ু মে প্রসীড!—বাসু পাইপ ধরালেন।

বরাটের প্রশ্নোত্তরে জানা গেল আরও কিছু তথ্য। বিকাশ ব্যাচিলার। পেশায় মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভ। হাওড়া, বাঁকুড়া, বর্ধমানের বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুরতে হয় তাকে। চন্দননগরকে কেন্দ্র করে। ইতিপূর্বে কলকাতার একটি মেসে থাকত। ওর দিদি শয্যাশায়ী হবার পর থেকে এখন চন্দননগরই ওর হেড কোয়ার্টার্স। তবে সপ্তাহে তিন রাত্রি থাকে কি না সন্দেহ।…হ্যাঁ, ডক্টর চ্যাটার্জি গতকাল খবরের কাগজটা পড়েছিলেন। চন্দননগরে যে আজ একটা বীভৎস হত্যাকাণ্ড হতে পারে—এবং টার্গেট যে ‘C” অক্ষরের নামের অধিকারী এ কথা জানতেন। চন্দ্রচূড়ের নাম ও উপাধি দুটোই ‘সি’ দিয়ে, সুতরাং… রবি বোস প্রশ্ন করে, বেশ বোঝা যাচ্ছে উনি প্রাতঃভ্রমণ করতেন। তা আপনি তাঁকে বলেননি আজ সকালে এভাবে একা-একা বার হওয়া তাঁর উচিত হবে না?

—আমি বলিনি। বিকাশদা বলেছিলেন।

—কেন, আপনি বলেননি কেন?

কাল রবিবার ছিল। ছেলেরা কেউই আসেনি। আমারও আসার কথা ছিল না। কিন্তু খবরের কাগজটা পড়ে ভীষণ আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ি। এখানে একটা ফোন করি। বিকাশদা ফোন ধরেন। তিনি বলেন, খবরের কাগজ ওঁরাও পড়েছেন। উনি এবং ‘স্যার’। যাবতীয় সাবধানতা ওঁরা অবলম্বন করছেন। তবু আমি শান্ত হতে পারিনি। বিকেল পাঁচটা নাগাদ একটা রিক্শা নিয়ে এ-বাড়ি চলে আসি। কারণ আমি কিছুতেই ভুলতে পারছিলাম না—ওঁর নাম ও উপাধি দুটোই ‘সি’ দিয়ে।

এখানে এসে স্যারের দেখা পাইনি। উনি বিকালেও ঘণ্টাখানেক বাগানে অথবা গঙ্গার ধারে পায়চারি করেন। তাই বাড়ি ছিলেন না। তবে বিকাশদা ছিলেন। গাড়ি নিয়ে কলকাতা যাবার জন্য তৈরি হচ্ছিলেন। মহাদেব ড্রাইভারই গাড়িটা চালিয়ে নিয়ে যাবে। চন্দ্রচূড়ের নিরাপত্তার বিষয়ে কী কী সাবধানতা নেওয়া হয়েছে বিকাশবাবু তা অনিতাকে বিস্তারিত জানালেন। দারোয়ান সতর্ক থাকবে, কোনও লোককে বাড়িতে ঢুকতে দেবে না। গেট সমস্ত দিন-রাত তালাবন্ধ থাকবে। কোনও অজুহাতেই যেন বাইরের কেউ না ঢোকে। বড়-সাহেবের অনুমতি নিয়ে কেউ যদি নেহাতই বাড়িতে ঢোকে তাহলে দারোয়ান একটা খাতায় তার নাম, ধাম, সময় ও স্বাক্ষর রাখবে। এরপর নাকি অনিতা ওঁকে অনুরোধ করেছিল, ‘আজ কলকাতায় নাই বা গেলেন, বিকাশদা?’ তার জবাবে উনি বলেছিলেন, ‘আমার একটা জরুরী অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে অনিতা, তবে আজ তো রোববার ঘোষিত তারিখটা আগামী কাল, সাতই। আমি আজ রাত্রেই যেমন করে হোক ফিরে আসব।

—তারপর?—জানতে চাইলেন বরাট সাহেব।

—তারপর ওঁরা রওনা হয়ে গেলে আমি দারোয়ানের কাছে খাতাখানা দেখতে চাই। দেখি, সে একটি খাতায় নির্দেশ পাওয়ার পর থেকে নিষ্ঠাভরে ‘এন্ট্রি’ করেছে। কে আসছে, যাচ্ছে, সব

—ডক্টর চ্যাটার্জি জানতেন না এসব কথা?

—কেন জানবেন না? খবরের কাগজ তিনিই সবার আগে পড়েন। পড়ে বিকাশবাবুকে ডেকে হাসতে হাসতে বলেছিলেন, ‘আমার নামটা যে ভয়াবহ তা অ্যাদ্দিন জানতুম না!’ উনিই বিকাশবাবুকে এইসব সাবধানতার কথা বলেছিলেন এবং নিজে থেকেই বলেছিলেন যে, তিনি সাত তারিখে আদৌ বাড়ির বাইরে যাবেন না।

—মিসেস্ চ্যাটার্জি বা বলাইকে কিছু বলেননি আপনি?

—দিদিকে কিছু বলার প্রশ্ন ওঠে না। আর বলাই সে সময় বাড়ি ছিল না।

—আপনি একটু অপেক্ষা করলেন না কেন? উনি ফিরে আসা পর্যন্ত?

—আমার তাড়া ছিল। আমি আরও কয়েকজনকে ব্যক্তিগতভাবে সাবধান করে দেব স্থির করেছিলাম—আমার বান্ধবী চন্দ্রা চৌধুরী, এক বুড়ি পিসিমা চন্দ্রমুখী চট্টরাজ, আর ঘড়িঘরের কাছে একজন বৃদ্ধ ব্যবসায়ী, চিমল্লাল ছারিয়া, ওঁর মেয়েকে আমি পড়াই।

এই সময় বাবলু বলে উঠে, সাইলেন্স প্লীজ!

সকলে তার দিকে ফেরে। বাবলু ততক্ষণে টেলিফোনের কথা মুখে বলছে, ‘সুইট হোম’?…আমি চন্দননগর থেকে বলছি…হ্যাঁ হ্যাঁ ট্রাঙ্ক লাইনে। মিস্টার বিকাশ মুখার্জি নামে এক ভদ্রলোক…ইয়েস! ওঁর বাড়িতে একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে…হ্যাঁ, হ্যাঁ চন্দননগরেই…ওঁকে একটু…ঠিক আছে, আমি ধরে থাকছি।

এদিকে ঘুরে বলে, ওদের হোটেলে ঘরে ঘরে ফোন নেই। বিকাশদা ঘরে আছে, ডাকতে লোক গেছে।

ইন্সপেক্টার বরাট এক লাফ দিয়ে এগিয়ে যান। বাবলুর হাত থেকে টেলিফোন রিসিভারটা ছিনিয়ে নেন। বললেন, লেট মি স্পীক….

একটু পরে শোনা গেল একতরফা কথোপকথন : বিকাশবাবু?…হ্যাঁ চন্দননগর থেকেই বলছি। কী ব্যাপার? কাল রাত্রে ফিরলেন না যে?…না, আপনি আমাকে চিনবেন না।…হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছেন, অ্যাক্সিডেন্ট।…না, না, আপনার ভগ্নিপতি ভালই আছেন?…ও তাই নাকি? তাঁর নামও ‘C” দিয়ে?…কী? না, আপনাদের বাড়ির কেউ নয়। যিনি খুন হয়েছেন তাঁর নাম চিমনলাল ছাবড়িয়া। গঙ্গার ঘাটে!…হেড ইঞ্জুরি।…বিকজ আপনাদের বাড়ির সামনেই, এবং পুলিস আপনাদের চাকর না দারোয়ান কাকে যেন অ্যারেস্ট করেছে।…অনিতা দেবীর কাছে শুনলাম এই নম্বরে আপনাকে পেতে পারি, উনিই আপনাকে ফিরে আসতে..ইয়েস্! যত শীঘ্র সম্ভব!

লাইনটা কেটে দিলেন উনি।

অনিতা বলে ওঠে, মানে? অহেতুক মিথ্যা কথা বললেন কেন?

—এতটা পথ ড্রাইভ করে আসবেন। না হয় বাড়ি এসেই দুঃসংবাদটা শুনবেন!

দীপক বলে, ইতিমধ্যে ওঁর স্টাডিরুমটা কি একটু দেখবেন? সেখানে যদি কোনো ক্লু…

বরাট বললেন, তুমি দেখে এসো, আমরা একটু পরে যাচ্ছি।

অনিতা আন্দাজ করে তার অনুপস্থিতিতে ওঁরা কিছু আলোচনা করতে চান। তাই বলে, চলুন, আমি ঘুরিয়ে সব দেখাচ্ছি। তুইও আয় বাবলু।

ওঁরা ভিতরের দরজা দিয়ে প্রস্থান করতেই রবি বলে, আপনি হঠাৎ বিকাশবাবুকেই

সন্দেহ করলেন যে?

বরাট বলেন, কবি বলেছেন, “যেখানে দেখিবে ছাই, উড়াইয়া দেখ তাই, পাইলে পাইতে পার—” কী যেন বাসু-সাহেব?

বাসু মুখ থেকে পাইপটা সরিয়ে পাদপূরণ করেন, ‘কাল-কেউটে সাপ!”

রবি বললে, কিন্তু এটা তো একটা ‘অ্যালফাবেটিক্যাল সিরিজে’র থার্ড টার্ম, বিকাশবাবু!

বরাট বলেন, ইয়াং ম্যান! তার গ্যারান্টি কোথায়? ‘C.D.E.’ হয়তো সন্ধ্যায় বা দুপুরে আর কোন ‘সি’কে খুন করবে। এটা একটা ইন্ডিভিজুয়াল মার্ডার কেস! কেন হতে পারে না? এমনকি হতে পারে না যে, চন্দ্রচূড় একটি উইল করে তাঁর সম্পত্তি বিশ্ববিদ্যালয়কে দিয়ে যেতে চান? তিনি নিঃসন্তান, তাঁর স্ত্রী মৃত্যুশয্যায়। ফলে তাঁর নিকটতম আত্মীয় এবং ওয়ারিশ ঐ C.D.E.-র ঘোষণার সুযোগ নিয়ে—যেহেতু তাঁর ভগ্নিপতির নাম চন্দ্রচূড় চ্যাটার্জি…এই অপকর্মটা করে বসল? এবং তারপর এমনও হতে পারে যে C.D.E. চন্দননগরে এসে শুনল, সাম মিস্টার ‘C.C.C.’ ফৌত হয়েছেন! সে ব্যাটা কোনও উচ্চবাচ্য না করে কেটে পড়ল। আর ঝড়ে মরা কাকটার কেরামতি বুদ্ধিমান ফকিরের মত দাবী করে বসল? সে-ক্ষেত্রে বিকাশকে পুলিস কোনওদিনই সন্দেহ করবে না। তোমার ডিডাকশান মতো চন্দ্রচূড় মার্ডারটা চিরটাকাল ক্রিমিনালদের ইতিহাসে লেখা থাকবে অ্যালফাবেটিকাল সিরিজের থার্ড টার্ম হিসাবে।

বাসু বলেন, কারেক্ট, ভেরি কারেক্ট। শুধু তাই বা কেন বরাট সাহেব? সেই ‘হোমিসাইডাল ম্যানিয়াটাকে যখন আমরা গ্রেপ্তার করব তখনো হয়তো সে স্বীকার করবে না যে, থার্ড মার্ডারটা সে করেনি। কারণ ফাঁসি তো তার একবারই হবে! একটা খুন করুক অথবা তিনটেই। সে তো হত্যার রেকর্ড তৈরি করে ক্রিমিনোলজির ইতিহাসে নিজের নাম লিখে দিতে চায়।

বরাট উঠে দাঁড়ান। রবির দিকে ফিরে নিজের মাথায় একটা টোকা মেরে বলেন, এখানকার গ্রে-সেলগুলোকে আর একটু সচল রাখ রবিবাবু। ডোন্ট টেক এভরিথিং অ্যাট দেয়ার ফেসভ্যালু!

বাসু বরাট-সাহেবকে জিজ্ঞাসা করলেন, হাউ ডিড্ হি টেক দ্য পাঞ্চ? মানে, জামাইবাবুর বদলে ছাবরিয়া খুন হয়েছে শুনে?

—নরম্যাল রিয়্যাক্‌শন! হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। কৃত্রিম সৌজন্যবশত বলল, কী দুঃখের কথা! কিন্তু বেশ বোঝা যাচ্ছিল—অ্যাক্সিডেন্ট শুনেই সে আঁৎকে উঠেছিল। জামাইবাবু ভালো আছেন শুনে জেনুইনলি রিলিজ্ড! আসুন, এবার স্টাডিটাকে স্টাডি করি।

—আপনি দেখুন। আমরা একটু পরে আসছি।

বরাট হাসলেন। বলেন, অল রাইট!

একাই এগিয়ে গেলেন তিনি ডক্টর চ্যাটার্জির স্টাডি-রুমের দিকে। বাসু বলেন, রবি, ঐ দারোয়ান বাবাজীবনকে একটু ডাক দিকিন!

দারোয়ান এল। জেরার উত্তরে জানালো যে, গেট রোজ রাত্রেই তালাবন্ধ থাকে। বড়সাহেব ভোরবেলা রোজই বেড়াতে যান, তখন এসে সে গেট খুলে দেয়। আজ সকালে সে গেট খুলতে আসেনি, কারণ ছোটবাবু বলে গিয়েছিলেন যে, বড়াসাব আজ সকালে বেড়াতে যাবেন না। বড়াসাবের নাকি তবিয়ৎ খারাপ। সে স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি যে, বড়াসাব ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে গেট খুলে…

—বড়াসাহেবের কাছে যে ডুপ্লিকেট চাবি আছে, তা তুমি জানতে?

—জী নেহী সাব!

—বড়াসাহেবের তবিয়ৎ খারাপ, এ কথা তোমাকে কে বলল?

—ছোটাসাব! তবিয়ৎ খারাপ হায় ইয়ে বাৎ নেহী বোলা, লেকিন বোলা থা কি উন্‌হোনে ঘরসে বিলকুল বাহার নেহি যায়েঙ্গে। ইস্ লিয়ে ম্যয়নে সোচা…

—তোমনে অরমে যো খবর…

—জী নেহী সাব! আজই শুনা! ‘বিশ্বামিত্র’মে বহ্ খবর নেহী থা কল!

বাসু-সাহেব ত্বরিৎগতি রবির দিকে ফিরে বলেন, ‘বিশ্বামিত্রে’ ইন্‌সার্শন দেওয়া হয়নি?

রবি সলজ্জ বললে, ঠিক জানি না স্যার!

—ছি-ছি-ছি! বিশ্বামিত্রে ‘ডবল কলম—পাঁচ সেন্টিমিটার’ বিজ্ঞাপন দিতে কত খরচ পড়ে? রবি চুপ করে ভর্ৎসনা শোনে।

বাসু-সাহেব বারকতক পায়চারি করে ফিরে এসে বললেন, দারোয়ানজী, তোমার খাতাটা নিয়ে এস তো।

দারোয়ান সেলাম করে তার ঘর থেকে খাতাটি আনতে গেল।

—আশ্চর্য তোমরা! আই. জি. ক্রাইম-সাহেব ক্লিয়ার ইন্‌স্ট্রাকশন দিলেন…আর তোমরা…কী ভেবেছ তোমরা? পশ্চিমবঙ্গে উর্দুভাষী, হিন্দিভাষী লোকের নাম ‘সি’ অক্ষর দিয়ে হয় না? নাকি চন্দননগরে আজ যে কয়েক হাজার মানুষ আসছে তারা সবাই বাংলা-ইংরাজি জানে?

রবি এ কথা বলল না যে, বিজ্ঞাপন দেওয়ার ব্যাপারে তার কোনও হাত ছিল না। মাথা নিচু করে ভর্ৎসনাটা শুনল। দোষটা যারই হোক, আরক্ষা-বিভাগের। ফলে, সেও দোষী।

খাতাটা এল। হিন্দিতে লেখা। বাসু-সাহেব বললেন, তুমি পড়ে শোনাও দারোয়ানজী। আমি হাতে-লেখা দেবনাগরী হরফ ভাল পড়তে পারি না।

দারোয়ান পড়ে শোনায় : এতোয়ার : এক বাজ কর দশ মিনিট…পরকাস্বাবু…

—প্রকাশবাবুটি কে?

বড়াসাহেবের দোস্ত্। তিনি মিনিট-কুড়ি ছিলেন। খাতায় স্বাক্ষর দিয়ে গেছেন :

প্রকাশচন্দ্র নিয়োগী। তারপর বিকাল চারটেয় এসেছিল স্থানীয় কিছু ছেলে, জগদ্ধাত্রী পূজার চাঁদা চাইতে। বড়াসাহেব ঘুমোচ্ছেন বলে দারোয়ান তাদের তাড়ায়। পাঁচটা দশে অনিতা দিদি। দারোয়ান তাঁর স্বাক্ষর দাবী করেনি। সওয়া ছে বাজে কিতাববাবু—কিন্তু ভিতরে ঢোকেননি।

—কিতাববাবুটি কে?

দারোয়ান জানায় ভদ্রলোককে সে আগে কখনো দেখেনি। বেগানা লোক বলে হাঁকিয়ে দিতে যাচ্ছিল, কিন্তু খোদ বড়াসাব তাকে ভিতর থেকে দেখতে পান। এগিয়ে এসে কোলাসিবল গেটের দুপাশ থেকে তাঁদের কী সব বাৎচিৎ হয়। লোকটা আদৌ ভিতরে আসেনি; কিন্তু বড়াসাহেব তার কাছ থেকে কী একটা কেতাব খরিদ করেন। ওঁর কাছে টাকা ছিল না তখন। বড়াসাহেবের নির্দেশ মত টাকাটা দারোয়ান ঐ কেতাববাবুকে মিটিয়ে দেয়। খরচটা খাতায় লিখে রাখে।

—তাঁর সই কই?

—না সই রাখা হয়নি। তিনি তো বাড়ির ভিতরে ঢোকেননি।

—বইটা কোথায় আছে জান?

—বড়াসাবকা টেবিল প্যে হোগা শায়েদ।

—দেখ তো, খুঁজে পাও কিনা।

দারোয়ান স্টাডিরুমে ঢুকে গেল। একটু পরে ফিরে এল একখানি বাঁধানো বই হাতে। প্রকাশক : নবপত্র প্রকাশন। গ্রন্থের নাম—’উপনিষদ ও রবীন্দ্রনাথ’। লেখক হিরণ্ময় বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রথম পাতাতে ডক্টর চ্যাটার্জির স্বাক্ষর ও গতকালকার তারিখ।

বাসু-সাহেব বলেন, তোমার মনে আছে দায়োয়ানজী? লোকটার চেহারা?

—জী হাঁ! বুঢ়ঢ়া, বড়াসাব সে উমর জেয়াদাই হোগা শায়েদ! পায়ে ক্যাম্বিসের জুতো। হাতে একটা ঝোলা, তাতে বহুত-সে কিতাব?

—গায়ে একটা ‘ঢিলে-হাতা’ ওভারকোট ছিল কি?

দারোয়ান সবিস্ময়ে বলে, জী হাঁ!

—আর দেখ তো, তোমার হিসাবের খাতায় যে অঙ্কটা লেখা আছে সেটা কি সাড়ে বাইশ টাকা? বইটার দাম?

দারোয়ান দেখে নিয়ে বললে, জী হাঁ! আপকো কৈসে মালুম পড়া?

উত্তেজনায় রবি দাঁড়িয়ে উঠেছে। বলে, স্যার। য়ু মীন…য়ু মীন…

বাসু সাহেব বইটার প্রথম পাতাটা খুলে ধরেন।

ঝুঁকে পড়ে দেখল গ্রন্থটার দাম : পঁচিশ টাকা।

রবি বললে, মনে পড়েছে। আসানসোলের সেই ভদ্রলোকও বলেছিলেন টেন পার্সেন্ট কমিশনে লোকটা বই বেচতে এসেছিল। কিন্তু ‘ঢিলে-হাতা’ কোটটা…

—বাঃ! হাতুড়িটা তো আস্তিনের হাতার মধ্যেই রাখতে হবে!

—মাই গড! একটা বুড়ো ফেরিওয়ালা শেষ পর্যন্ত!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *