অ-আ-ক-খুনের কাঁটা – ২

দুই

বিডন স্ট্রিটের একটা ভাঙা দোতলা বাড়ি। একতলায় একজন ডাক্তারের চেম্বার। তিনিই গৃহকর্তা। ডাক্তার দাশরথী দে। একতলার অংশটা ভাড়া দেওয়া। দ্বিতলে ডাক্তারবাবুর নিজস্ব

আস্তানা। স্বামী স্ত্রী আর একটি মেয়ে—মৌ, যাদবপুরে পড়ে তিনতলায় সিঁড়িঘরের লাগোয়া একটা চিলে-কোঠা। এক বৃদ্ধ ওখানে ভাড়া থাকেন। একা মানুষ। তিনকুলে নাকি তাঁর কেউ নেই। তাঁর গৃহস্থালীর সরঞ্জামও সামান্য। পুব দিকে একটা জানলা, মোটা-মোটা লোহার গরাদ দেওয়া। ঘরে একটি তক্তাপোষ, উপরে সতরঞ্চি পাতা; বিছানাটা মাথার কাছে গোটানো। একপ্রান্তে একটি আলমারি। তালাবন্ধ সেটা খুললে দেখা যাবে উপরের তাকে শুধু অঙ্কের বই—পাটিগণিত, বীজগণিত, ক্যালকুলাস, জ্যামিতি; কিছু কিছু শিশুসাহিত্যের বইও। বইগুলি জরাজীর্ণ—মনে হয় সেকেন্ড-হ্যান্ড দোকানে কেনা। পাতা উল্টে দেখলে বুঝতে পারা যাবে—তা ঠিক নয়। প্রত্যেকটি বইয়ের প্রথম পৃষ্ঠাতেই মালিকের নাম লেখা। শ্রীশিবাজীপ্রতাপ চক্রবর্তী। তারিখ দেওয়া-ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ বছর আগেকার। তুলনায় মাঝের শেলফে এক থাক ঝক্‌ঝকে বই—আনকোরা নতুন; যেন বইয়ের দোকানের একটি তাক। কিছু বইয়ের পাতা কাটা নেই। কিছু প্যাকেট খোলাই হয়নি। সেগুলি ধর্মপুস্তক। উদ্বোধন কার্যালয়, বেলুড় মঠ অথবা পণ্ডিচেরীর শ্রীঅরবিন্দ আশ্রম থেকে প্রকাশিত। অবশ্য এসবই দৃষ্টির আড়ালে—যেহেতু কাঠের আলমারিটি তালাবন্ধ।

যেটুকু দৃষ্টিগোচর তাতে দেখা যায়—ঘরের একপ্রান্তে একটি সস্তা টেবিল। একটিমাত্র খাড়া-পিঠ হাতলহীন চেয়ার। কিছু কাগজপত্র—কাগজ-চাপা, পিন-কুশন, আঠার শিশি আর এসবের সঙ্গে নিত্যন্ত বেমানান একটি প্রায়-নতুন পোর্টেবল্ টাইপ-রাইটার।

বৃদ্ধ তালা খুলে ঘরে ঢুকলেন। স্নান করে এসেছেন তিনি। বাথরুম একতলায়, ডিপেন্সারির সংলগ্ন। প্রতিবার বাথরুমে যেতে তাঁকে তিনতলা সিঁড়ি ভাঙতে হয়। এর চেয়ে সস্তায় কলকাতা শহরে ঘর ভাড়া পাওয়া যায় না। তাছাড়া একবেলা তিনি ডাক্তারসাহেবের সংসারে অন্নগ্রহণ করেন। নৈশ আহার। দিনে বাইরেই কোথাও খেয়ে আসেন। সকাল-বিকাল চা খাওয়ার অভ্যাস নেই। সুতরাং আর কোনো ঝামেলা নেই। ডাক্তারের আর্থিক অবস্থা এমন নয় যে, পেয়িং-গেস্ট রাখবার প্রয়োজন। হেতুটা সম্পূর্ণ অন্য জাতের। শিবাজীপ্রতাপ চক্রবর্তীর ছাত্র হচ্ছেন ডক্টর দে। দীর্ঘদিন পূর্বে যখন গৃহকর্তা স্কুলে পড়তেন শিবাজী ছিলেন ওঁদের স্কুলের থার্ড মাস্টার। অঙ্কের ক্লাস নিতেন তিনি। মৌকে পড়ানোর সুযোগ পাননি, কারণ সে অঙ্ক নেয়নি। কিন্তু মৌ রোজ সন্ধ্যায় ওঁর তিনতলার ঘরে উঠে আসে। টাইপিং শিখতে। সখ হিসাবে।

মাস্টারমশাই তাঁর ঝোলা ব্যাগে খানকতক বই ভরে নিলেন। ধুতি পাঞ্জাবি পরে পায়ে একটা ফিতে বাঁধা ক্যাম্বিসের জুতো পরলেন। কাল রাত্রেই একটা ছোট স্যুটকেস গুছিয়ে রেখেছিলেন। সেটাও তুলে নিলেন হাতে। ছাতা? না দরকার নেই। বর্ষাকাল পার হয়েছে। অক্টোবরের আঠারো তারিখ আজ। রোদের তেমন তেজ নেই। ঘরে তালা লাগিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামতে থাকেন। দ্বিতলের ল্যান্ডিঙে নেমে একটু থমকে দাঁড়ালেন। হাঁকাড় পাড়লেন, বৌমা?

মৌ বেরিয়ে এল ঘর থেকে। সিঁড়ির দিকে এগিয়ে এসে বললে, মা বাথরুমে আছেন মাস্টারমশাই। আপনি কি বের হচ্ছেন নাকি?

—হ্যাঁ। তোমার মাকে বলে দিও, দু-দিন থাকব না। বিশ তারিখ সন্ধ্যায় ফিরব। সেদিন রাতে খাব।

—আজ রাতে খাবেন না?

—না। এই তো ট্রেন ধরতে যাচ্ছি।

—একটু কিছু মুখে দিয়ে যান। একেবারে বাসি মুখে…

—না না, কাল একটু দই এনে রেখেছিলাম। ভিজেচিড়ে দিয়ে সকালেই …

–কোথায় যাচ্ছেন এবার?

—আসানসোল।

—ও বাবা! সে তো অনেকদূর! থাকবেন কোথায়?

—হোটেল-ধৰ্মশালা খুঁজে নেব।

মৌ আর কথা বাড়ায় না। বৃদ্ধ টুক্‌টুক্ করে নিচে নামতে থাকেন।

মৌ পিছন ফিরতেই দেখে বাথরুম থেকে প্রমীলা বার হয়ে এসেছেন। বললেন, মাস্টারমশাই কি আবার ট্যুরে গেলেন নাকি?

—হ্যাঁ, আসানসোল। পরশু সন্ধ্যাবেলা ফিরবেন বললেন।

একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল প্রমীলার। যেন আপন মনেই বললেন, কী দরকার এ বয়েসে এতটা পরিশ্রম করার? উনি তো কতবার বলেছেন, ‘মাস্টারমশাই, ওসব চাকরি ছেড়ে দিন এবার। আমরা তো আছি। আমার বাবা-কাকা থাকলে কি দুবেলা দুমুঠো খেতে দিতাম না?’ কিন্তু কে কার কথা শোনে!

মৌ বলল, পাগল মানুষ তো?

—মৌ!—ধমকে উঠলেন প্রমীলা।

মৌ সলজ্জে বলে আমি সে কথা বলিনি, মা! কিন্তু আত্মভোলা মানুষ তো! আর সত্যকে তুমিও অস্বীকার করতে পার না। এককালে উনি পাগলা গারদে আটকও ছিলেন! —সেই কথাটাই ভুলে যেতে চেষ্টা কর। উনি এখন সম্পূর্ণ স্বাভাবিক মানুষ। শুধু তোমার নয়, তোমার বাবারও শিক্ষক উনি। বুড়ো মানুষকে সম্মান দিতে শেখ!

মৌ শ্রাগ্ করল। জেনারেশান গ্যাপ্! সে কী বলতে চায়, আর মা তার কী অর্থ করছে! সে আর কথা বাড়ায় না। আজ তার ফার্স্ট পিরিয়ডে ক্লাস।

.

কৌশিক ব্রেকফাস্ট টেবিলে এসে দেখে চতুর্থ চেয়ারটি খালি। রাণী দেবীর দিকে ফিরে জানতে চায়, মামু কোথায়?

—ভোরবেলা মর্নিং-ওয়াকে গেছেন। এখনো ফেরেননি।

কৌশিক ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল একবার। এত দেরী হয় না তাঁর বেড়িয়ে ফিরতে। কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, ঠিক তখনই সদর খুলে প্রবেশ করলেন বাসুসাহেব। তাঁর পরিধানে সাদা শর্টস, টুইলের জামা, পুলওভার, পায়ে সাদা মোজা আর হান্টিং শ্যূ। বগলে একগাছা দৈনিক পত্রিকা। কাগজের বান্ডিলটা টেবিলের উপর নামিয়ে রেখে বললেন, তোমাদের ডিডাকশানই ঠিক। স্টেটসম্যান, আনন্দবাজার, যুগান্তর, আজকাল, বসুমতী কোনও কাগজেই আসানসোলের কোনও খবর নেই।

কৌশিক দ্বিতীয়বার তার মণিবন্ধের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে। এবার সময় নয়, তারিখটা। আজ বিশে অক্টোবর!

ব্যাপারটা সে ভুলেই গিয়েছিল। বললে, সবগুলো কাগজ খুঁটিয়ে দেখেছেন?

—হ্যাঁ, পার্কের বেঞ্চিতে বসে বসে।

বাড়িতে দুটি কাগজ আসে। একটা বাংলা একটা ইংরাজি। বেলা সাতটা নাগাদ। বেশ বোঝা গেল, বাসুসাহেব মনে মনে একটু চিন্তিত ছিলেন। এ দু-তিন ঘণ্টাও তাঁর সবুর সয়নি। ভোরবেলাতেই পাঁচখানা খবরের কাগজ কিনে নিশ্চিন্ত হয়ে এসেছেন।

অজ্ঞাত পত্রলেখকের বিষয়েই আলোচনাটা মোড় নিল। কোন্ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে সে এমন ‘প্র্যাকটিক্যাল জোক’টা করেছিল? আহারান্তে বিশু যখন চায়ের পটটা রেখে গেল তখনই বেজে উঠল টেলিফোনটা। কৌশিক উঠে গিয়ে ধরল। একটু শুনে নিয়ে বলে, মামু, আপনার ফোন, ট্রাঙ্ক-লাইনে।

বাসু এসে ফোনটা তুলে নিয়ে বললেন, বাসু স্পিকিং…

—আমি, স্যার, রবি বলছি, রবি বোস…

—রবি বোস? আপনাকে তো ঠিক প্লেস করতে পারছি না…কোথায় আমরা মীট করেছি?…

—চিনতে পারছেন না? আমি ইন্সপেক্টর রবি বোস, সেই কমলেশ মিত্র মার্ডার কেস্-এ।

—ও! আই সী! তুমি সেই রবি? এখনো লটারীর টিকিট কেনার বাতিকটা আছে?

-–না, নেই। এক জন্মে কেউ দু-দুবার জ্যাক-পট হিট করে না!

—আই সী! তুমি ইতিমধ্যে একবার লটারীর টিকিটে মোটা দাঁও মেরেছ তাহলে?

—সেটা তো, স্যার, আপনি জানেনই!

—কই না তো! তুমি তো কখনো জানাওনি!

—জানানোর তো প্রয়োজন ছিল না স্যার! ছিল?*

[‘ঘড়ির কাঁটা’-তে বিস্তারিত বিবরণ আছে।]

—না, ছিল না। যা হোক, এখন ফোন করছ কেন? কোথা থেকে বলছ?

—আসানসোল থেকে। আমি এখন আসানসোল সদর থানার ও. সি.! ভৌগোলিক নামটা শ্রবণমাত্র সচকিত হয়ে উঠলেন বাসুসাহেব। পূর্বমুহূর্তের রসিকতার বাষ্পমাত্র রইল না আর। বললেন, ইয়েস! ফায়ার! আয়াম অল ইয়ার্স!

—কাল রাত এখানে একটা খুন হয়েছে। মধ্যরাত্রে। একজন নগণ্য দোকানদার। এসব মামুলি খুন নিয়ে আজকাল আর কেউ মাথা ঘামায় না। কিন্তু গত সপ্তাহে হেড-কোয়ার্টার্স থেকে একটা রহস্যময় চিঠি পেয়েছিলাম—একটা ‘ফোর-ওয়ার্নিং’। তাই মনে হল, ব্যাপারটা আপনাকে জানিয়ে রাখা আমার কর্তব্য।

—মধ্যরাত্রে দোকানদার খুন হয়েছে বলছ? কোথায়? বাড়িতে, না দোকানে?

—মধ্যরাত্র ঠিক নয়। রাত দশটা পঞ্চান্ন থেকে সাড়ে এগারোটার মধ্যে। দোকানেই।

—দোকানের মালপত্র বা ক্যাশ্…

—না, স্যার, কিচ্ছু খোয়া যায়নি। মোটিভ অন্য কিছু। লোকটার বয়স ষাটের কাছাকাছি। ফলে নারীঘটিত ব্যাপার বলে মনে হয় না। রাজনীতির ধারে-কাছে লোকটা কোনওদিন ছিল না—সুতরাং পলিটিক্যাল মার্ডারও নয়। বিরাট সম্পত্তির মালিক নয় যে, উইলঘটিত….

—বাট হোয়াই দেন?

—সেটাই চরম রহস্য! আমার তো মনে হচ্ছে—’কে’ প্রশ্নটাকে ছাপিয়ে উঠেছে : ‘কেন’!

–তোমার বড়কর্তাকে টেলিফোনে জানিয়েছ? তিনি কী বলেন?

—তাঁর মতে পিয়ার কোয়েন্সিডেন্স! কাকতালীয় ঘটনা। অর্থাৎ আপনার পত্রপ্রাপ্তি এবং অধরবাবুর মৃত্যু…

—কী নাম বললে? হলধর?

না স্যার। অ-ধ-র। A for Alligator, D for Delhi…

বুঝেছি! অধর! পুরো নামটা কী?

—অধরকুমার আঢ্যি! অদ্ভুত কোয়েন্সিডেন্স! নয়?

বাসু বললেন, শোন রবি! তুফান এক্সপ্রেসটা অ্যাটেন্ড কর। আমি যাচ্ছি। আমরা দুজন। কোনও হোটেল…

—হোটেল কেন স্যার? আমার গরিবখানাতেই থাকবেন। আপনাকে ঐ লটারীর টাকা পাওয়ার পর…

—হ্যাং য়োর লটারি! সন্দেহজনক সব কজনকে যেন সন্ধ্যাবেলায় পাই। আমরা আসছি।

টেলিফোনটা নামিয়ে রেখে উনি প্রাতরাশের টেবিলের দিকে ফিরে দেখেন সবাই উৎকর্ণ হয়ে বসে আছে। উনি কৌশিকের দিকে ফিরে বললেন, তৈরি হয়ে নাও। আমরা তুফানে আসানসোল যাচ্ছি। বুঝেছ নিশ্চয়? লোকটা ফাঁকা হুমকি দেয়নি।

রাণী বলেন, এটা নেহাৎই একটা কাকতালীয় ঘটনা হতে পারে না?

—সম্ভবত নয়! কারণ মৃত লোকটা ‘অধর আঢ্য অফ আসানসোল’– ‘A’-র অ্যালিটারেশন!

.

অধরবাবুর দোকানটা খুবই ছোট। একটা ডবল বেড খাটের মাপে। তবে অবস্থানটা জবর, জি. টি. রোডের উপর। আসানসোল ই. আই. আর. স্কুলের বিপরীতে। মনিহারী দোকান। অধরবাবুর আদি-বাড়ি পূর্ববঙ্গে। বয়স ষাট-বাষট্টি। পার্টিশানের সময় বাপের হাত ধরে এ দেশে আসেন। দোকানটা খুলেছিলেন ওঁর বাবাই। উত্তরাধিকার সূত্রে এখন উনিই ছিলেন তাঁর মালিক। বিপত্নীক, দুই ছেলে, মেয়ে নেই। বড় ছেলের বিয়ে দিয়েছেন, কুলটিতে সস্ত্রীক বাস করছে। সেখানেই চাকরি করে। ছোটটি ওঁর কাছেই থাকে। ক্লাস অ-অ-ক-খুনের কাঁটা টেন-এ পড়ে—সামনের ঐ স্কুলে। দোকানঘরের উপরে এক কামরার একটি ঘরে বাপ-বেটায় থাকতেন। ঠিকে-ঝি বাসন মেজে যেত। রান্না করতেন অধরবাবু নিজেই।

মৃত্যুর সময়টা নির্ধারিত হয়েছে এইভাবে :

অধরবাবুকে জীবিত অবস্থায় শেষবার দেখেছে ওঁর ছোট ছেলে সুনীল। রাত দশটা নাগাদ সে নেমে এসে বাবাকে বলেছিল, দোকান বন্ধ করবে না? অনেক রাত হয়ে গেল যে!

অধরবাবু ঘড়ি দেখে বলেছিলেন, দশটা দশ হয়েছে। তুই আর একটু জেগে থাক। আধঘণ্টার মধ্যেই আসব আমি। হিসাবটা আজ রাতেই শেষ করে রাখব।

এরপর সুনীল উপরে উঠে যায়। বিছানায় শুয়ে শুয়েই পড়তে থাকে। তারপর সে দরজা খোলা রেখেই কখন ঘুমিয়ে পড়ে। তার বাবা যে রাত্রে খুন হয়েছে তা সে জানতে পারে পরদিন ভোরবেলা। যখন ঘুম ভেঙে দেখে দরজা খোলা। বাবা ঘরে নেই। তখন সবে আলো ফুটছে। ঠিক কটা তা সুনীল জানে না। ওর বাবা খুব ভোরে ওঠেন—কিন্তু ছেলেকে ডেকে দেন। এভাবে দরজা খুলে রেখে নেমে যান না। তাই সুনীল একটু আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে। একছুটে নেমে এসে দেখে যে, দোকানঘরটাও হাট করে খোলা। আর কাউন্টারের ঠিক তলাতেই অধরবাবু ঘাড় গুঁজড়ে পড়ে আছেন। মৃত। রাস্তা থেকে সেটা নজরে পড়ে না। তখন একটু-একটু করে আলো ফুটেছে। দু-চারজন লোক পথ দিয়ে যাতায়াত করছে। মিউনিসিপ্যালিটির ঝাড়ুদার নাকে ফেট্টি জড়িয়ে ঝাড়ু চালাচ্ছে।

—তাহলে কেন তখন টেলিফোনে বললে যে, রাত সাড়ে এগারোটার মধ্যে খুন হয়েছে?—জানতে চাইলেন বাসুসাহেব।

বিস্তারিত বিবরণটা শোনাচ্ছিল থানা অফিসার রবি বোস। থানাতেই। কৌশিক বসে আছে পাশের চেয়ারটায়। তুফান এক্সপ্রেস অ্যাটেন্ড করে ওঁদের দুজনকে রবি নিয়ে এসে বসিয়েছে তার অফিসে। রবি জবাবে বলল, তার কারণ—সাধনবাবুর জবানবন্দি। উনি নাইট শো সিনেমা দেখে রিকশা করে সস্ত্রীক ফিরছিলেন গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড দিয়ে। উনি ধূমপায়ী। পকেটে হাত দিয়ে হঠাৎ দেখেন সিগারেট ফুরিয়েছে। নাইটশো সিনেমাটা ভেঙেছে রাত ঠিক এগারোটা কুড়িতে। ফলে, আন্দাজ এগারোটা পঁচিশ নাগাদ তিনি জি. টি. রোড দিয়ে পাস করছিলেন। হঠাৎ ওঁর নজরে পড়ে একটি দোকান খোলা আছে। লোডশেডিং চলছিল। সব দোকান বন্ধ। শুধু ঐ দোকানটিতে একটা মোমবাতি জ্বলছিল। কাউন্টারের উপর একটা মোমদানিতে। কিন্তু ওঁর স্পষ্ট মনে আছে, মোমবাতিটা একেবারে তলানিতে এসে ঠেকেছে, দপ্ দপ্ করছিল। অধরবাবুর দোকানে যে সিগ্রেট পাওয়া যায় তা ধূমপায়ী ভদ্রলোকটির জানা ছিল। তিনি রিক্‌শা থামিয়ে দোকানের কাছে এগিয়ে যান। কাউকে দেখতে পান না। দোকানের মালিকের নামটা তিনি জানতেন না—তবে টাকমাথা এক ভদ্রলোক যে দোকানটায় বসেন এটা তাঁর জানা ছিল। ‘ও মশাই! শুনছেন? ভিতরে কে আছেন?’—ইত্যাদি বার কয়েক হাঁকাড় পেড়েও কারও সাড়া পান না। ঐ সময়ে তাঁর নজরে পড়ে কাউন্টারের উপরে পড়ে আছে একটা খোলা হিসাবের খাতা আর একটা ডট পেন। আর তার পাশেই একটা বই—উদ্বোধন থেকে প্রকাশিত শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা। ইতিমধ্যে রিক্সা থেকে ওঁর গিন্নী তাড়া দিলেন। মোমবাতিটাও দপ করে নিবে গেল। সাধনবাবু টর্চের আলোয় রিক্সায় ফিরে আসেন। সিগারেট কেনা হয়নি তাঁর।

বাসু বললেন, বুঝলাম। খুব সম্ভবত সাধনবাবু যখন হাঁকাহাঁকি করছিলেন, তখন দোকানের মালিক ওঁর কাছ থেকে হাতখানেক তফাতে মরে পড়ে আছেন। কিন্তু কাউন্টারটা আড়াল করায় রাস্তার সমতলে দাঁড়িয়ে তিনি তা দেখতে পাচ্ছিলেন না। ফলে, নাইন্টিনাইন পার্সেন্ট চান্স সাড়ে এগারোটার আগেই উনি খুন হয়েছেন। কিন্তু দশটা পঞ্চান্নর পরে কেন? ওঁর ছোট ছেলে সুনীল তো তার বাপকে জীবিতাবস্থায় দেখেছিল রাত দশটা দশে?

—কারণ সুনীলের স্পষ্ট মনে আছে যে, সে ঘুমিয়ে পড়ার আগে লোডশেডিং হয়নি। ইলেকট্রিক সাপ্লাইয়ে খোঁজ নিয়ে জেনেছি, ঐ এলাকায় কাল রাত্রে লোড-শেডিং শুরু হয় দশটা বাহান্নয়। তারপর অধরবাবু মোমবাতি জ্বালতে আন্দাজ মিনিট-তিনেক সময় নিয়েছেন নিশ্চয়। ফলে দশটা পঞ্চান্ন। এছাড়া আমি একটা বিকল্প পরীক্ষা করেও দেখেছি। অধরবাবুর দোকান থেকে ঐ বান্ডিলের আর একটি মোমবাতি জ্বেলে আজ সকালে দেখেছি সেটা পুড়ে শেষ হতে ঠিক পঁচিশ মিনিট সময় লাগে।

—গুড ওয়ার্ক! কিন্তু একটা ফাঁক থেকে যাচ্ছে যে রবিবাবু। দশটা পঞ্চান্ন থেকে এগারোটা পঁচিশ হচ্ছে আধঘণ্টা। কিন্তু মোমবাতির আয়ু যে পঁচিশ মিনিট।

–কথাটা আমিও ভেবেছি। হয়তো সে মোমবাতিটা একটু বড় ছিল।

—একটু বড় নয়, টুয়েলভ্ পার্সেন্ট বড়! পঁচিশ মিনিটের বদলে আধঘণ্টা। দ্বিতীয়ত—সিনেমা হাউস থেকে জি. টি. রোডের ঐ জায়গাটায় রিকশায় আসতে কতক্ষণ সময় লাগার কথা? আই মীন—গভীর রাত্রে, ফাঁকা রাস্তা পেলে?

—মিনিট পাঁচেক।

—তাহলে আরও অন্তত মিনিট-পাঁচেক আন-অ্যাকাউন্টেড থেকে যাচ্ছে! তাই নয়? সিনেমা ভাঙামাত্র সাধনবাবু সস্ত্রীক ‘হল’ থেকে ভীড় ঠেলে বার হয়ে এসে রিক্সা ধরেননি নিশ্চয়। তুমি তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলে কি যে, ‘শো’র শেষ পর্যন্ত ওঁরা দেখেছেন কিনা?

—না স্যার। ও সম্ভাবনাটা আমার মনে হয়নি। থ্যাঙ্কু স্যার। আমি জিজ্ঞাসা করব।

কৌশিক হঠাৎ বলে বসে, খুব সম্ভবত তিনি শেষ পর্যন্তই দেখেছেন। এবং তা হলে টাইম এলিমেন্টটা আরও জটিল হয়ে পড়ছে। যে মোমবাতিটার আয়ু পঁচিশ মিনিট তা অন্তত পঁয়ত্রিশ মিনিট জ্বলেছে!

বাসুসাহেব পাইপটা ধরিয়ে নিয়ে বললেন, আদৌ নয়! রবিবাবুর ডিডাক্‌শান কারেক্ট। খুনটা হয়েছে দশটা পঞ্চান্নর পরে এবং সাড়ে এগারোটার আগে।

কৌশিক বলে, কিন্তু মোমবাতিটা তাহলে…?

বাসু বলেন, মোমবাতি যথারীতি পঁচিশ মিনিটই জ্বলেছে। মোমবাতি যারা বানায় তারা ছাঁচে ঢেলে বানায়। এক-আধ মিনিটের বেশি এদিক-ওদিক হওয়ার কথা নয়।

—তাহলে?

—বুঝলে না? ধরা যাক, এগারোটা পাঁচে উনি দোকানের সামনে এলেন। তখন চতুর্দিকে লোড-শেডিং। একটি মাত্র দোকানে একটি মাত্র মোমবাতি জ্বলছে। অর্থাৎ নীরন্ধ্র অন্ধকারে একশ গজ দূর থেকেও আবছা দেখা যাচ্ছে দোকানের আলোটা। হয়তো অস্পষ্ট দেখা যাচ্ছে দোকানদারকে আর আততায়ীর শিলুয়ে। লোকটা দেখতে পেল পিছনের কাউন্টারে কোনও জিনিস—সেটা হরলিক্স, মাথার তেল, টুথপেস্ট যাই হোক। সেটাই কিনতে চাইল। ন্যাচারালি দোকানদার পিছন ফিরবে। তৎক্ষণাৎ আততায়ী ফুঁ দিয়ে নিবিয়ে দিল বাতিটা আর তৎক্ষণাৎ খুন করল লোকটাকে। অন্ধকারেই সে টেনেটুনে মৃতদেহটা ঠেলে দিল কাউন্টারের তলায়। হয়তো দেখে নিল চারিদিক। ঠিক সে সময়ে যদি জি. টি. রোড দিয়ে কোনও ট্রাক বা রিক্সা পাস করে তাহলে অপেক্ষা করবে। চারদিক সুনসান হয়েছে বুঝলে লাইটার জ্বেলে মোমবাতিটা আবার জ্বালবে। কারণ সে তখন নিশ্চিন্ত যে, বহুদূরের প্রত্যক্ষদর্শী যদি আদৌ কেউ থাকে সে তখন দেখবে দোকান থেকে একজন খরিদ্দার ফিরে যাচ্ছে। দমকা হাওয়ায় যে মোমবাতিটা নিবে গিয়েছিল সেটা আবার জ্বালা হয়েছে! দোকানি হয়তো ভিতর দিকে গেছে অথবা নিচু হয়ে কিছু করছে! ফলে মোমবাতি তার নির্দিষ্ট মেয়াদের একতিলও বেশি জ্বলেনি!

.

বাসুসাহেব সকলের এজাহার নিলেন। একে একে। রবি বসু তাঁদের আসতে বলেছিল। কারও কোনও উক্তি থেকে নতুন কিছু আলোকপাত হল না। ইতিমধ্যে কুলটি থেকে অধরবাবুর বড় ছেলে কার্তিক সস্ত্রীক এসে পড়েছে। সে কুলটিতে একটা কারখানায় কাজ করে। সন্তানাদি এখনো হয়নি। বছরতিনেক বিবাহ করেছে। বাপের সঙ্গে সদ্ভাব ছিল। বাপকে খুন করে দোকানটা দখল করার চেষ্টা তার পক্ষে সম্ভবপর নয়। কারণ চাকরী ছেড়ে সে দোকান দেখতে পারে না। কোনও বিশ্বস্ত লোক তাকে মোতায়েন করতেই হত। আর বাপের চেয়ে বিশ্বস্ত লোক সে কোথায় পাবে?

হিসাবের খাতা অনুসারে দেখা গেল—চেনা-জানা খরিদ্দারের কাছে বেশ কিছু ধার আছে। বেশ কিছু মানে মিলিত অঙ্কটা—প্রায় হাজারখানেক টাকা। কিন্তু কোনও একজনের কাছে দেড়শ টাকার বেশি নয়। এত সামান্য টাকার জন্য কেউ মানুষ খুন করে না।

অধরবাবু রাজনীতির ধারে-কাছে ছিলেন না। বার্ণপুর-কুলটি অঞ্চলের লেবার ইউনিয়নের কারও সঙ্গে আলাপ পরিচয় নেই। মস্তান-পার্টিদের কাছ থেকে শতহস্ত দূরে থাকতেন। সচ্চরিত্র ব্যক্তি। স্ত্রীলোকঘটিত কোনও বদনাম নেই। সে রাত্রে ক্যাশ-কাউন্টারে সাড়ে সাতশ মতো টাকা ছিল। খোলা ড্রয়ারে। সেটা খোয়া যায়নি।

ঠিকই বলেছিল রবি! ‘কে’ প্রশ্নটা ছাপিয়ে বড় হয়ে উঠেছে যে প্রশ্নটা, তা ‘কেন’?

সাধনবাবুকে বিস্তারিত জেরা করলেন বাসুসাহেব। কিন্তু ইতিপূর্বে পুলিসকে যা বলেছেন তার বেশি কিছু যোগ করতে পারলেন না। শুধু বললেন, একটা কথা বলি স্যার, আগে ওটা খেয়াল হয়নি—ঐ দুটো একটু ইন্‌কম্পাটেন্স্ নয়? রাত বারোটায় সান-মাইকা-টপ্ দোকানের কাউন্টারে পাশাপাশি দুজনে শুয়ে আছেন? একজন মনিহারি দোকানের খাতা আর দ্বিতীয়জন শ্রীমদ্ভগবদ্‌গীতা!

বাসু বললেন, অধরবাবু বোধ করি আর এক রামপ্রসাদ! হিসাবও কষেন, গীতাও পড়েন।

বইটি উনি পরীক্ষা করে দেখলেন। আনকোরা নতুন। উদ্বোধন প্রকাশনীর। মালিকের নাম লেখা নেই কোথাও। সুনীল বা কার্তিক বইটি কখনো দেখেনি বলল।

সান-মাইকা-টপ্ টেবিলে কোনও ফিঙ্গার-প্রিন্ট নেই। এমন-কি মৃত অধরবাবুরও নয়। আততায়ী সব কিছু মুছে দিয়ে গেছে।

ফিরে আসবার মুখে কার্তিক কাতরভাবে প্রশ্ন করল, কে এভাবে ওঁকে খুন করল স্যার? কী ভাবেই বা মুহূর্তমধ্যে…

বাসুসাহেব বললেন, কে করেছে, কেন করেছে তা বলতে পারছি না কার্তিকবাবু। কিন্তু একটা কথা বলতে পারি—তিনি খুব বেশি যন্ত্রণা পাননি। মুহূর্তমধ্যে মৃত্যু হয়েছে তাঁর। আততায়ী তাঁর পিছন ফেরার সুযোগে তাঁর মাথায় খুব ভারী কোনও কিছু দিয়ে আঘাত করে। সম্ভবত লোহার ডাণ্ডা অথবা লম্বা হাতলওয়ালা হ্যামার—যেটা সে কোটের আস্তিনে লুকিয়ে এনেছিল। ওঁর ক্রেনিয়াম বিচূর্ণ হয়ে যায়। হয়তো পিছন ফিরে আভতায়ীর মুখখানাও তিনি দেখে যাননি।

ঘরের ওপ্রান্তে বসেছিল একটি ষোল-সতের বছরের কিশোর। দু-হাঁটুর মধ্যে মাথা গুঁজে। ডুগ্‌রে কেঁদে ওঠে সে। বাসুসাহেব উঠে এসে তার মাথায় হাতটা রাখলেন। অশ্রু-আর্দ্র লাল একজোড়া চোখ তুলে সুনীল বললে, আমি…আমি আপনাকে কোনও সাহায্য করতে পারি না স্যার? … পুলিস কিছু করবে না! আমার বাবা যে গরিব…

বাসু বললেন, তুমি আমাকে নিশ্চয়ই সাহায্য করতে পার সুনীল। মাসখানেক পরেই তোমার টেস্ট পরীক্ষা। মন খারাপ না করে বাবা যা বলতেন সর্ব প্রথম তাঁর সেই ইচ্ছাটাই পূরণ করবার চেষ্টা কর। ভালভাবে পাশ করবার চেষ্টা কর। দোকানটা তো তোমাকেই দেখতে হবে।

—না, আমি বলছিলাম, ঐ লোকটাকে ধরবার জন্য…

—আমার মনে থাকবে। প্রয়োজন হলেই তোমাকে ডেকে পাঠাব। কিন্তু ততদিন তুমি নিজেকে শক্ত করে রাখ। পড়াশুনাটা ছেড় না। কেমন?

সুনীল আস্তিনে চোখটা মুছে ঘাড় নেড়ে সায় দিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *