অ-আ-ক-খুনের কাঁটা – ৮

আট

আটই নভেম্বর। বেলা এগারোটা লডন স্ট্রীটে আই. জি. সি. সাহেবের ঘরে কনফারেন্স।

ইন্সপেক্টার বরাট বললেন, এখন লোকটাকে খুঁজে বের করা তো ছেলেখেলা। উচ্চতা—একশ সত্তর/আশি সে.মি.; ওজন—আন্দাজ সত্তর কে.জি। রঙ-তামাটে, মুখে খোঁচা-খোঁচা দাড়ি। গায়ে ঢিলে হাতা কোট, পায়ে ক্যাম্বিসের জুতো, বয়স অ্যারাউন্ড ষাট। ক্যানভাসের ব্যাগে বই ফিরি করে। ডি. আই. জি. বার্ডওয়ান বলেন, কিছু মনে করবেন না বরাটসাহেব। আপনি যা বলছেন তার অর্ধেক আন্দাজ, বাকি অর্ধেক এফিমেরাল!

—‘এফিমেরাল’! মানে?

—ক্ষণস্থায়ী। লোকটা হয়তো ইতিমধ্যে দাড়ি কামিয়েছে, জুতো ছেড়ে চটি পরেছে, ঢিলে-কোটটার বদলে এখন তার গায়ে পুরোহাতা সোয়েটার!

বরাট বলেন, কিন্তু আমরা যখন ওর ঘর সার্চ করব? তখন তো ঐসব জিনিস…

—আগে তার পাত্তা পাই, তার পর তো সার্চ। প্রশ্ন হচ্ছে, ওর যেটুকু বর্ণনা জানা গেছে তা জানিয়ে কি আমরা কাগজে বিজ্ঞপ্তি দেব?

বাসু জানতে চাইলেন, ‘বিশ্বামিত্র’, ইত্তেফাক’ ইত্যাদি সমেত?

ডি. আই. জি. কঠিনভাবে বলেন, ওটা আপনার ভুল ধারণা বাসু-সাহেব! বিশ্বামিত্রে বিজ্ঞাপন থাকলেও কাজ হত না। ডক্টর চ্যাটার্জিকে মৃত্যু টানছিল! নাহলে সব জেনেশুনেও তিনি ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে গেট খুলে শহীদ হতে যাবেন কেন?

রবি বলে, কোল্যাপসি গেটের দু-পাশ থেকে দুজনের কী কথোপকথন হয়েছে তা দারোয়ান জানে না। লোকটা কি ডক্টরসাহেবকে কোনওভাবে সম্মোহিত করে…

ডক্টর পলাশ মিত্র সাইকলজিস্ট। বলেন, অসম্ভব! মানুষ সারারাত ঘুমিয়েও পরদিন ওভাবে সম্মোহিত হয়ে গেট খুলে বেরিয়ে যেতে পারে না। আমি অন্য একটা কথা ভাবছি। এ সংবাদটা কি আপনারা নিয়েছিলেন যে, ডক্টর চ্যাটার্জি ‘সোমনাম্‌বোলিস্ট’ কি না?

বাসু স্বীকার করেন, দ্যাটস্ আ গুড পয়েন্ট! না, ও সম্ভাবনার কথাটা আমাদের মনেই হয়নি। তা হতে পারে বটে! অনেকে ঘুমের ঘোরে নিজের অজান্তেই হেঁটে চলে বেড়ায়। কিন্তু তারা কি রাতের পোশাক ছেড়ে জামা-কাপড় পরতে পারে? গেট বন্ধ দেখলে চাবি খুঁজে নিয়ে…

ডক্টর মিত্র বলেন, খুব রেয়ার কেস-এ এমন নজিরও আছে!

আই. জি. ক্রাইম একটু অধৈর্যের সঙ্গে বলে ওঠেন, অলরাইট! অলরাইট! ডক্টর চ্যাটার্জি কেন সব জেনে-বুঝেও মৃত্যুর মুখে এগিয়ে গেছিলেন তার হেতুটা আপনারা খুঁজে বার করেছেন। আমি অন্য একটি বিষয়ে উৎসাহী : ঐ হত্যাবিলাসীটাকে কীভাবে আমরা খুঁজে পাব?

ডক্টর পলাশ মিত্র বলেন, থার্ড-মার্ডার থেকে এটুকু বোঝা যাচ্ছে যে, লোকটার ‘ভিক্‌টিম্‌’ চয়নে কোনো পক্ষপাতিত্ব নেই। দুটি পুরুষ, একটি স্ত্রী। দুটি বৃদ্ধ, একটি অল্পবয়সী। প্রথমটি নিম্নবিত্তের, দ্বিতীয়টি মধ্যবিত্তের, তৃতীয়টি উচ্চবিত্তের। এদের জীবনযাত্রা, উপজীবিকা, শিক্ষা-দীক্ষায় কোনই মিল নেই। এ থেকে একটিই সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়। ও ‘মেগালোম্যানিয়াক্’–ও মনে করে যে, ও নিজে একজন দুর্লভ প্রতিভার মানুষ। যেহেতু নিজ জীবিকায় সে স্বর্ণাক্ষরে নিজের নাম লিখে রেখে যেতে পারেনি তাই অন্য একটি ক্ষেত্রে—ক্রিমিনোলজির ইতিহাসে—সে রক্তাক্ষরে নিজের স্বাক্ষর রেখে যাবে!

রবি বলে, দারোয়ানের জবানবন্দি হিসাবে লোকটাকে আদৌ পাগল বলে বোঝা যায় না কিন্তু।

ডক্টর ব্যানার্জি বিজ্ঞের মতো হেসে বললেন, সে-কথা তো প্রথম দিনেই আমি বলেছিলাম। জ্যাক দ্য রীপার, জন-দ্য কীলারকে দেখেও বোঝা যায়নি যে, তারা হত্যাবিলাসী।

আই. জি. সাহেব বলেন, বাসু-সাহেব! আপনার কী সাজেশান? ঐ খুনিটাকে খুঁজে বার করার ব্যাপারে?

বাসু বলেন, আমাদের প্রথমে ভেবে দেখতে হবে, লোকটা কী ভাবে ভিন্ন-ভিন্ন শহরে ভিন্ন-ভিন্ন মানুষের নাম-উপাধি জানল? কেমন করে বুঝতে পারল একটি বিশেষ পূর্ব-ঘোষিত দিনে ঠিক কোন মুহূর্তটিতে ঐ বিশেষ নামের মানুষটি সবচেয়ে ভানারে। এ ধাঁধাটা সমাধানের আগে তাকে ধরবার চেষ্টা বৃথা—

—আর একটু বিস্তারিত করে বলবেন?

—ধরুন আসানসোল। অধরবাবু যে অত রাত্রে দোকানে একা থাকবেন, হঠাৎ যে লোড-শেডিং হবে, এসব কথা তো হত্যাকারী জানত না। জানা সম্ভবপর নয়। বনানী যে গভীর রাত্রে ঐ ট্রেনের ফার্স্ট-ক্লাস কামরায় একা থাকবে তাও নয়। তাহলে পাঁচ-সাত দশ দিন আগে থেকেই সে কীভাবে আমাকে ঐ জাতের চিঠি লিখতে পারে? ডক্টর চ্যাটার্জির হত্যাটা তো একেবারে ভেল্কির পর্যায়ে!

ইন্সপেক্টর বরাট মুচকি হেসে বলেন, ভেল্কি! তাহলে এতদিনে আপনি আপনার আই. কিউ-র সমতুল্য প্রতিদ্বন্দ্বীর সাক্ষাৎ পেয়েছেন বলুন?

বাসু-সাহেব ক্ষুব্ধস্বরে বললেন, মিস্টার বরাট! চিঠিগুলো সে ব্যক্তিগতভাবে আমাকে লিখেছে বটে কিন্তু সে ব্যঙ্গ করেছে এই স্টেটের একটি বিশেষ বিভাগের ইন্টেলিজেন্সকে–ট্যাক্সপেয়ারদের অর্থে যাঁদের সংসারযাত্রা নির্বাহ হয়! আমি ডিফেন্স-কাউন্সেল! অপরাধী খোঁজা আমার জাত-ব্যবসা নয়।

আই. জি. সাহেব বাধা দিয়ে বলেন, প্লীজ ব্যারিস্টার সাহেব…

পাইপ-পাউচ কাগজপত্র গুছিয়ে নিয়ে বাসু-সাহেব উঠে দাঁড়ান।

আই. জি. সাহেব বলেন, আপনাকে আমি সনির্বন্ধ অনুরোধ করছি, বাসু-সাহেব…হ্যাঁ, বরাটের ঐভাবে বলাটা খুবই অন্যায় হয়েছে।

ইন্সপেক্টর বরাটের মুখখানা কালো হয়ে যায়।

বাসু বলেন, আদৌ না! আমি স্বীকার করছি—লোকটা অত্যন্ত বুদ্ধিমান, প্রায় অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী! কিন্তু তাকে পাকড়াও করা আমার কাজ নয়। আজ মিটিঙের শুরুতেই নিজ পদাধিকার বলে যিনি ঘোষণা করেছেন—’এখন তো লোকটাকে গ্রেপ্তার করা ছেলে-খেলা’—তাঁকে সেই খেলাটা শেষ করতে দিন। তারপর তাকে যখন আদালতে তুলবেন তখন হয়তো আবার আমার ভূমিকা শুরু হবে। ডিফেন্স-কাউন্সেল হিসাবে।

হঠাৎ ডক্টর মিত্র আই. জি. কে বলে ওঠেন, স্যার! কিন্তু মনে করবেন না। আমরা পুলিশ বিভাগের লোক নই। এক্সপার্ট-ওপিনিয়ান নিতে আপনি ডেকে পাঠিয়েছেন বলেই আমি, বাসু-সাহেব বা ডক্টর ব্যানার্জি এ মিটিঙে এসেছি…

ইন্সপেক্টার বরাট ধরা গলায় বলেন, অল-রাইট! আই অ্যাপলজাইজ।

বাসু-সাহেব বলেন, অল-রাইট! লেটস্ প্ৰসীড!

আলোচনা আরও অনেকক্ষণ চলল। কিন্তু না বাসু-সাহেব, না বরাট—কেউই মুখ খোলেননি। স্থির হল এখনই সন্দেহজনক ব্যক্তিটির আনুমানিক বর্ণনা সংবাদপত্রে ছাপানো হবে না।

.

নয়-দশ-এগারো। চারদিন পরে বারো তারিখের সকালে বিকাশ মুখার্জি আর অনিতা এসে হাজির হল বাসু-সাহেবের নিউ আলিপুরের বাড়িতে। রানী দেবীর মাধ্যমে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে তাঁরা দেখা করলেন ব্যারিস্টার সাহেবের সঙ্গে।

—কী ব্যাপার? আপনারা?

বিকাশ যা বললেন তার সারাংশ—ওঁরা পুলিসের উপর আদৌ ভরসা রাখতে পারছেন না। একটা ‘হোমিসাইডাল ম্যানিয়াক্’ সমাজে নির্বিবাদে ঘুরে বেড়াচ্ছে আর ওঁরা টি. এ. বিল বানাতে ব্যস্ত! ডক্টর চ্যাটার্জির কেসটার তদন্ত করবার জন্য বিকাশ মুখার্জি ওঁকে রিটেন করতে চান।

বাসু-সাহেব বললেন, তোমরা ভুল করছ। আমি গোয়েন্দা নই –

—আমরা জানি। ফর্মালি আমরা ‘সুকৌশলী’কেই এনগেজ করব, কিন্তু যদি আমরা নিশ্চিন্ত হই যে, তার পিছনে আপনার ব্রেনটা আছে।

বাসু বলেন, লুক হিয়ার বিকাশবাবু। লোকটা ব্যক্তিগতভাবে আমাকেই বারবার তিনবার পত্রাঘাত করেছে। আমাকেই ‘ডি-ফেম’ করেছে। এবং আমি সে খবর সংবাদপত্রে ছাপিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছি। সুতরাং এটা আমার একটা ব্যক্তিগত চ্যালেঞ্জ! তোমরা রিটেন কর বা না কর…

বাধা দিয়ে অনিতা বলে, মাপ করবেন স্যার। আপনি কি আমাদের দিকটাও একটু ভেবে দেখেছেন? একটা নৃশংস খুনী দেবতুল্য ডক্টর চ্যাটার্জিকে খুন করে গেল, আর আমরা হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকব? কবে কোন ক্রুর সাহায্যে ঐ বরাটসাহেব বিকাশদার হাতে হাতকড়া পরাবেন?

—বিকাশদা?

—আপনি কি বলতে চান, কেন সেদিন মিস্টার বরাট টেলিফোনে এক গঙ্গা মিথ্যে কথা বললেন তা বোঝেননি?

—আই সী?

—আপনি বিশ্বাস করেন, এটা সম্ভবপর? স্যারকে উনি বড় ভাইয়ের মতো… দিদিকে বিধবা করা…

বাধা দিয়ে বিকাশ বলে, প্লীজ অনিতা, থাম তুমি—

—না। আমাকে বলতে দাও বিকাশদা।

বাসু বলেন, এ প্রশ্নটাই অবৈধ। ডক্টর চ্যাটার্জি যখন খুন হন তখন বিকাশবাবু কলকাতায়।

—তাহলে? ‘স্যার’ কত লক্ষ টাকা রেখে গেছেন আমরা জানি না। কিন্তু তা থেকে কিছু খরচ করতে কেন দেবেন না আমাদের? লোকটা আপনাকে চিঠি লিখেছে একথাও যেমন সত্য, তেমনি আমাদের সর্বনাশ করে গেছে এটাও তো মিথ্যা নয়? আপনি একা কেন খরচ-পত্র করবেন। অ্যালাও আস টু হেল্প য়ু-

বাসু-সাহেব বললেন, অলরাইট। আই এগ্রি। লেটস্ ফর্ম এ টীম! আরও তিনটি লোকের কাছে আমি প্রতিশ্রুত। তাদের সাহায্যও আমি নেব। তাদের অর্থ নেই তোমাদের মত, কিন্তু আন্তরিকতা একইরকম আছে।

—কোন্ তিনজন স্যার?—জানতে চায় বিকাশ।

—এক নম্বর, অধরবাবুর ছোট ছেলে সুনীল আঢ্য, দু নম্বর বনানীর পাণিপ্রার্থী অমল দত্ত আর তিন নম্বর বনানীর ছোট বোন ময়ূরাক্ষী।

বস্তুত সেদিনই সকালে বাসু-সাহেব ময়ূরাক্ষীর একখানি চিঠি পেয়েছিলেন। মেয়েটি লিখেছে, “আপনি সেদিন আমাদের জবানবন্দি নিতে আসেননি। সত্যই সেদিন আমরা মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলাম না। পরে পুলিস আমাদের জবানবন্দি নিয়ে গেছে। সেসব কাগজপত্র আপনি এতদিনে নিশ্চয় দেখেছেন। কিন্তু তারপরে আমি কয়েকটি সংবাদ ঘটনাচক্রে জানতে পেরেছি। চিঠিতে তা জানানো সম্ভবপর নয়। প্রথমত অনেক অনেক কথা লিখতে হবে। দ্বিতীয়ত ব্যাপারটা একটু ডেলিকেট। আপনি ব্যস্ত মানুষ। আমিও যেতে পারছি না। বাবা-মাকে ছেড়ে এ সময় কলকাতা যাওয়া সম্ভবপর নয়। তাছাড়া বুঝতেই পারছেন, আমাদের আর্থিক অবস্থাটা। এখন…জানি না, পরীক্ষাটা দেবার চেষ্টা করব, না চাকরি-বাকরি খুঁজব। টিউশানি একটা ধরেছি। সে যাই হোক, আপনার অধীনে একজন মহিলা সেক্রেটারি আছেন শুনেছি। তিনি কি আসতে পারেন একবার? মহিলা বলেই ভাল হয়। কারণ আগেই বলেছি, ব্যাপারটা ডেলিকেট।”

এত কথা বাসু-সাহেব ভাঙলেন না অবশ্য। ডেকে পাঠালেন কৌশিক ও সুজাতাকে। স্থির হল, ওঁরা একটি বে-সরকারী অনুসন্ধান-দল গঠন করবেন। পরের সপ্তাহে রবিবার, বিশ তারিখে সন্ধ্যায় ওঁর বাড়িতে এই অনুসন্ধানকারী দলটির প্রথম অধিবেশন বসবে।

সুজাতা আর কৌশিক পরদিনই রওনা হয়ে গেল আসানসোল-ভায়া-বর্ধমান। তিনজনকে নিমন্ত্রণ জানাতে এবং সুনীল ও ময়ূরাক্ষীকে আসা-যাওয়ার রাহা-খরচ অজুহাতে বেশ কিছু অর্থ সাহায্য করে আসতে। ময়ূরাক্ষীর বক্তব্য সুজাতা একাই শুনবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *