অ-আ-ক-খুনের কাঁটা – ১৪

চোদ্দ

হাজতের একান্তে একটি কোনায় বসেছিলেন বৃদ্ধ। কান-মাথা দিয়ে একটা ব্যান্ডেজ বাঁধা। যেন কানকাটা ভিন্সেন্ট ভাঁ গখ্! বাসু-সাহেবকে ঘরের ভিতরে ঢুকিয়ে দিয়ে প্রহরী বাইরে গেল। শ্রুতিসীমার বাইরে, দৃষ্টিসীমার নয়। আসামী আগন্তুকের দিকে মুখ তুলে তাকিয়ে দেখে। পরক্ষণেই নত করে তার দৃষ্টি। তার মুখ ভাবলেশহীন।

—আপনি আমাকে চেনেন? –মুখোমুখি দাঁড়িয়ে প্রশ্নবাণ নিক্ষেপ করলেন বাসু।

কথা বলতে ওঁর বোধহয় কষ্ট হচ্ছিল। মনে হয় জিবটা কেটে গেছে। জড়িয়ে জড়িয়ে তবু বললেন, চিনি। উকিলবাবু।

—ঠিক বলেছেন। কিন্তু আমার নামটা জানেন?

শিবাজীপ্রতাপ নেতিবাচক গ্রীবাভঙ্গি করলেন। মেদিনীনিবদ্ধদৃষ্টি।

—আমার নাম : পি. কে. বাসু

—ও।

—আমার নাম ইতিপূর্বে কখনো শুনেছেন?

আবার ঘড়ির পেন্ডুলামের মতো মাথাটা নড়ল। নেতিবাচক গ্রীবাভঙ্গি।

—প্রসন্নকুমার বাসু, ‘পি. কে. বাসু, বার-অ্যাট-ল’ এর নাম কখনো শোনেননি?

এতক্ষণে উনি আগন্তুকের দিকে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখলেন। গম্ভীরমুখে প্রশ্ন করলেন, আপনি ছত্রপতি শিবাজীর নাম শুনেছেন? চিতোরের রানা প্রতাপের?

—হ্যাঁ শুনেছি। নিশ্চয় শুনেছি।

—আপনি কি মনে করেন, আপনি ওঁদের মত একজন কেওকেটা?

-–না, তা মনে করি না! কিন্তু তাহলে আপনি কেমন করে জানলেন যে, আমি উকিল!

—সহজেই। আমার মতো কপর্দকহীন আসামীর জন্য আদালত থেকে সরকারী খরচে উকিল দেওয়া হয় এটা জানি বলে।

—না। ওখানে ভুল হচ্ছে আপনার। আমি সরকার-নিযুক্ত নই। আমাকে নিযুক্ত করেছেন ডক্টর দাশরথী দে। তাঁকে চেনেন?

হঠাৎ উৎফুল্ল হয়ে উঠলেন বৃদ্ধ, বাঃ! দাসুকে চিনব না? কেমন আছে ওরা? দাশু, বৌমা, মৌ?

—ওরা সবাই ভাল আছে। শুনুন, আমি আপনার পক্ষের উকিল, মানে আপনার বিরুদ্ধে পুলিস যে অভিযোগ এনেছে আমি হচ্ছি তার…

—বুঝেছি, বুঝেছি! য়ু আর দ্য ডিফেন্স-কাউন্সেল!

—আমাকে সব কথা খুলে বলবেন তো? সব, সব কথা?

বৃদ্ধ ঊর্ধ্বমুখে অনেকক্ষণ কী-যেন চিন্তা করলেন। তারপর বললেন, বলব, তবে এক শর্তে।

—শর্ত। কী শর্ত!

—আপনি কথা দিন যে, আন্তরিকভাবে চেষ্টা করবেন যেন আমার… আমার ফাঁসি হয়। যাবজ্জীবন নয়! কথা দিন!

বাসু একটু থমকে গেলেন। বৃদ্ধের কথাবার্তা, ব্যবহারে পাগলামির কোনও লক্ষণ তো নেই! বলেন, কেন? কেন নয় বেকসুর খালাস?

–সেটা অসম্ভব! আর তাছাড়া তাহলে তো আবার সেই রেকারিং ডেসিমেল?

–তার মানে?

—নিজেকে খুঁজে ফেরা। কিছুতেই নিজের নাগাল পাব না ….’খুড়োর কল’-এর মতো…

—অথবা সেই চিল্লানোসরাস্-এর মতো…

—এক্সজ্যাক্টলি! যে কোনওদিনই ব্যাচারাথেরিয়ামের নাগাল পাবে না।

—তাহলে ছবিটা কেটে ফেললেন কেন?

—কেটে তো ফেলিনি। ছুরি মেরে ছিলাম! …ও ইয়েস্ অ্যাদ্দিনে ঠিক মনে পড়েছে। এই দেখুন দাগ!

ডান হাতের তালুটা মেলে ধরুন। সত্যিই তাতে একটা কাটা দাগ। বেশি পুরানো নয়।

বাসু প্রশ্ন করেন, কাকে ছুরি মেরেছিলেন? চিল্লানোসরাসকে?

—দূর! তাকে মারব কেন? সে তো কামড়ায় না। শুধুমুধু হাঁ করে! ভয় দেখায়।

—তবে কাকে ছুরি দিয়ে মেরেছিলেন?

—ভুলে গেছি।

বাসু কোনও নাগালই পাচ্ছেন না। সবই ধোঁয়াশা। আবার প্রশ্ন করেন, আপনার ঘরে একটা টাইপ-রাইটার দেখলাম। সেটা কত দিয়ে, কোন দোকান থেকে কিনেছিলেন মনে আছে?

—কিনিনি তো। আমার এক ছাত্তর উপহার দিয়েছিল। তার নামটা ভুলে গেছি।

-–নাম তো ভুলে গেছেন, চেহারাটা মনে আছে?

—ধুস্! কদ্দিন তাকে দেখি নাই।

—নাম তো মনে নেই, উপাধিটা মনে আছে। বামুন না কায়েত, হিন্দু না মুসলমান…

—হ্যাঁ, হ্যাঁ, আপনি বলাতে মনে পড়ল, ছেলেটি মুসলমান। আর কিছু মনে নেই।

বাসু এবার অন্যদিক থেকে প্রশ্নবাণ নিয়ে আক্রমণ শুরু করেন। বলেন, এই নামগুলোর একজনকেও চেনেন? অধর, বনানী…..

—বাঃ! ওদের খুন করলাম, আর নাম জানব না? আসানসোলের অধর আত্যি, উনিশে অক্টোবর; বর্ধমানের বনানী বনার্জী, সাতাশে অক্টোবর; নেক্সট চন্দননগরের চন্দ্রচূড় চাটুজ্জে, সাতই নভেম্বর।

—আর পঁচিশে ডিসেম্বর?

—পঁচিশে ডিসেম্বর! সেটা তো লর্ড যীসাস্-রে জন্মদিন! সেদিন আবার কাউকে খুন করতে যেতে হবে নাকি? আঃ—ছি-ছি-ছি! অমন পুণ্যদিনে! কই কোনও নির্দেশ তো পাইনি?

বাসু হঠাৎ ওর দিকে ঝুঁকে পড়ে বলেন, যাঃ! এটা কি ভোলা যায়? ঐ একই লোক তো ইনস্ট্রাকশান দিল?

—কোন লোক?

—সেটা তো আপনি বলবেন! কোন্ লোক?

বৃদ্ধ আপ্রাণ চেষ্টা করলেন মনে হল। অথবা অপরূপ অভিনয়! মনে হল, তিনি অন্ধকারের ভিতর হাড়াচ্ছেন— কে সেই লোকটা, যে বারে বারে ওঁকে নির্দেশ দিয়ে যাচ্ছে, আসানসোলের অধর আঢ্যি, বর্ধমানের বনানী বনার্জি, চন্দননগরের চন্দ্রচূড় চ্যাটার্জি-

শেষে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, আয়াম সরি। একদম মনে পড়ছে না।

বাসু বললেন, ঠিক আছে। আমি আবার আসব। মনে করবার চেষ্টা করুন। কে আপনাকে নির্দেশ দিয়ে যাচ্ছিল : ‘এ’ ফর আসানসোল, ‘বি’ ফর বার্ডওয়ান; ‘সি’ ফর চন্দননগর, এ্যান্ড ‘ডি’ ফর…

—কী? ‘ডি’ ফর কী?

—ভাবুন ভাবুন। ‘ডি’ ফর কী হতে পারে? ক্লু তো দিয়ে গেলাম। একই লোক নিৰ্দেশ দিল। পঁচিশে ডিসেম্বর! এই নিন, এই নোট বই আর পেনসিলটা রাখুন। যখন যেটা মনে পড়বে চট্ করে লিখে ফেলবেন, ‘ডি’ ফর কী? কে আপনাকে টাইপ-রাইটারটা উপহার দিয়েছিল, কে আপনাকে এতগুলো নির্দেশ একের পর এক দিয়ে যাচ্ছিল …কেমন?

বাসু উঠে দাঁড়ালেন। ইন্টারভিউ শেষ হয়েছে।

বৃদ্ধও উঠে দাঁড়ালেন। বাসু-সাহেবের হাত দুটো ধরে বললেন, আমি আমার কথা রেখেছি। আপনিও আমার অনুরোধটা রাখবেন তো?

—কোনটা?

—যাতে ওরা যাবজ্জীবন না দেয়! তিন তিনটে খুন! ফাঁসী না দেবার কোনও যুক্তি নেই। নয়?

–বাসু-সাহেব ফিরে আসতেই কৌশিক এগিয়ে এল। প্রশ্ন করল শিবাজীবাবুর সঙ্গে দেখা হল?

—হল? কিন্তু কিছুই ওঁর মনে পড়ছে না। তুমি ইতিমধ্যে কতদূর কী করলে বল?

কৌশিক তার রিপোর্ট দাখিল করল। খবরের কাগজে যে মেন্টাল হস্পিটালের উল্লেখ আছে সেখানে সে গিয়েছিল। মানসিক চিকিৎসালয়টি ভাল। ডাক্তারবাবুও বেশ সজ্জন। শিবাজীপ্রতাপ চক্রবর্তীর কেস-হিস্ট্রিটা তিনি রেজিস্টার খুলে দেখিয়েছিলেন। কৌশিক সেটা আদ্যন্ত টুকে এনেছে। মাস্টারমশাই কবে ঐ মানসিক হাসপাতালে প্রথম আসেন, কতদিন ছিলেন এবং সবচেয়ে বড় কথা রোগীর অবচেতন মনের জট ছাড়ানোর উদ্দেশ্যে যেসব প্রশ্নোত্তর করা হয়েছে তাও। তাতে ওঁর পূর্বকথা অনেক কিছু জানা গেল। বাসু-সাহেব অনেকক্ষণ তন্ময় হয়ে পড়তে পড়তে হঠাৎ লাফিয়ে ওঠেন : এই তো! নামটা পাওয়া গেছে। হানিফ মহম্মদ!

কৌশিক তৎক্ষণাৎ বলে, হ্যাঁ। পরীক্ষার হলে উনি যার গলা টিপে ধরেন তার নাম হানিফ মহম্মদ। এটাই প্রথম কেস। তারপর …

বাধা দিয়ে বাসু বলেন, হানিফ মহম্মদ! আশ্চর্য! তাহলে আমি যে পথে ভাবছি… আবার চুপ করে যান উনি। বাসু-সাহেব কোন পথে কী ভাবছেন তা কৌশিকের জানা নেই কিন্তু এটুকু জানে যে, এখন নীরবতা ভঙ্গ করতে নেই।

বাসু হঠাৎ তুলে নিলেন টেলিফোনের রিসিভারটা। একটা নম্বর ডায়াল করলেন।

—হ্যালো, আমি পি. কে. বাসু. বলছি, তোমার বাবা কি বাড়ি আছেন? …ও নেই বুঝি… হ্যাঁ, দেখা হয়েছে। উনি ভালো আছেন, শারীরিক ও মানসিক। তোমাদের কথা জিজ্ঞাসা করছিলেন …হ্যাঁ আমাকে তাঁর ডিফেন্স-কাউন্সেল হিসেবে মেনে নিয়েছেন। আচ্ছা শোন, একটা কথা বলতে পার? ওঁর ডান হাতের তালুতে একটা কাটা দাগ দেখলাম—হাতটা কী ভাবে… ইয়েস, বল?

কৌশিক নীরবে অপেক্ষা করে। বুঝতে পারে ও প্রান্ত থেকে মৌ একটি দীর্ঘ ইতিহাস বলে যাচ্ছে। অনেকক্ষণ একটানা শুনে বাসু-সাহেব বললেন, তা সেদিন এসব বলনি কেন? …আই সী! ঠিক কথা! সেদিন আমি ওঁর ডিফেন্স-কাউন্সেল ছিলাম না। তা সেদিন আর কিছু গোপন করেছিলে নাকি? … বাঈ জোড়! ডায়েরি! ওঁর নিজের হাতে লেখা! সেটা পুলিশে সীজ করেনি? ও! তুমি আগেই লুকিয়ে ফেলেছিলে! শোন, কৌশিক, রিপ্রেজেন্টিং ‘সুকৌশলী’ আধঘণ্টার মধ্যে তোমার কাছে যাচ্ছে। তার আইডেন্টিটি চেক আপ্ করবে প্রথমে; তারপর আমার ভিজিটিং কার্ডের পিছনে তোমাকে লেখা একখানা চিঠি পেলে কৌশিকের হাতে ডায়েরিটা দিয়ে দিও। কেমন? …কী? বাঃ! আমার লাইন কেউ ট্যাপ করছে কি না তার গ্যারান্টি কী? ঐ ডায়েরিটা ভাইটাল এভিডেন্স!

নিজের ভিজিটিং কার্ডের পিছনে মৌকে লিখিত নির্দেশ দিয়ে কার্ডখানা কৌশিকের হাতে দিয়ে বললেন, কী করতে হবে বুঝতে পেরেছ?

—আজ্ঞে হ্যাঁ। গাড়িটা নিয়ে ডক্টর দাশরথী…

—আজ্ঞে না! ট্যাক্সি নিয়ে যাও। গাড়ি নিয়ে আমি ঐ মেন্টাল হস্পিটালে যাব। –কেন মামু?

—যে ভাইটাল ব্লুটা তুমি জেনে আসনি, সেটা জানতে! অফ্‌ য়ু গো!

দুজনে দুদিকে রওনা হয়ে গেলেন আবার।

বাসু-সাহেব যখন ফিরে এলেন তখন তাঁর মুখটা থম্‌থম্ করছে। ঢুকতেই দেখা হয়ে গেল সুজাতার সঙ্গে। বাসু প্রশ্ন করেন, কৌশিক ফিরেছে?

—হ্যাঁ! ডায়েরিটা আপনার স্টাডিরুমের টেবিলে…

—থ্যাঙ্কু! শোন! আমাকে কেউ যেন এখন ডিসটার্ব না করে! ও. কে.?

উনি সটান ঢুকে গেলেন ওঁর চেম্বারে।

ঘণ্টাখানেক পরে ইন্টারকমে উনি রানী দেবীকে খুঁজলেন, রানু, উড য়ু কাইন্ডলি হেপ্ মি এ বিট? এ ঘরে চলে এস প্লীজ।

হুইল-চেয়ারে পাক মেরে রানু প্রবেশ করলেন ওঁর খাস-কামরায়।

বাসু বলেন, ডায়েরিটা পড়া হয়ে গেছে। এখন আমার দুটো কাজ। এক নম্বর একটু নিরিবিলি চিন্তা করা; দুনম্বর—একগাদা টেলিফোন করা। তুমি দ্বিতীয় কাজের দায়িত্বটা নাও। একে একে ডায়াল করে লোকগুলোকে ধর। লাইন পেলেই আমাকে দিও। একটা কাগজে নামগুলো লিখে নাও। এই পর্যায়ে : রবি বোসকে তার অফিস নাম্বারে, চন্দননগরে বিকাশকে, ‘কুশীলব’-এর দপ্তরে যাকে পাওয়া যাবে, আর স্যারকে।

রানী দেবী খুশি হলেন কিছু করতে পেয়ে। টেলিফোন গাইড আর নোটবই দেখে একে একে নম্বরগুলো ডায়াল করতে থাকেন। ‘স্যার’ বলতে কার কথা বলতে চেয়েছেন তা বুঝতে অসুবিধা হয়নি রানুর, অশীতিপর ব্যারিস্টার এ.কে. রে. যাঁর অধীনে প্রথম জীবনে জুনিয়ার হিসাবে বাসু-সাহেব ব্যারিস্টারি শুরু করেছিলেন।

প্রথমেই রবি বসু। লাইনটা পেতেই রিসিভারটা এগিয়ে দিলেন রানী দেবী।

–শোন রবি। আমি বাসু বলছি। আমি স্থিরসিদ্ধান্তে পৌঁছেছি A. B. C-র মধ্যে একটা অ্যালফাবেটের জন্য S.P.C. দায়ী নন! …সরি, টেলিফোনে আর কিছু বলা যাবে না। তুমি কখন আসতে পারবে? …না, না, অত তাড়াতাড়ি নয়। কারণ এখানে আসার আগে তোমাকে আর একটি কাজ করে আসতে হবে! তোমার সন্ধানে কোন ‘এ-ওয়ান-গ্রেড’-এর পকেটমার আছে? …হ্যাঁ গো! ‘পকেটমার’!…কী আশ্চর্য! পুলিসের লোক আর ‘পিকপকেট’ চেন না? …হ্যাঁ! এক সন্ধ্যার জন্য তাকে নিযুক্ত করতে চাই! …যাকে পাও …মকবুল, ছোট খোকন, যোসেফ যাকে হয় …তবে পাকা হাত হওয়া চাই …ও.কে.! আমি অপেক্ষা করব। …হ্যাঁ, ঐ ‘কনৌসার অফ্ পিক-পকেট’কে সঙ্গে নিয়ে আসা চাই।

রিসিভারটা ফেরত দিয়ে উনি পাইপ ধরালেন। রানী দেবী জানতে চাইলেন না পকেটমারের কী প্রয়োজন হল। চন্দননগরে ডায়াল করতে থাকেন।

বিকাশ জানালো, তার মনে আছে। রবিবার সন্ধ্যা ছয়টা। হ্যাঁ, অনিতাকে নিয়েই সে আসবে। তার দিদি একটু ভাল আছেন। চিকিৎসা-বিজ্ঞানকে নস্যাৎ করে। বোধ করি, স্বামীর সঙ্গে শেষ সাক্ষাতের অপেক্ষায় তিনি এভাবে মৃত্যুকে ঠেকিয়ে রাখতে পারছেন। হ্যাঁ, উনি স্বামীকে চিঠি লিখেছেন। ইংরাজিতে। ডিকটেশন দিয়েছেন। শুক্লা লিখে নিয়েছে। বলা বাহুল্য, সে চিঠি ডাকে দেওয়া হয়নি। বিকাশ আরও বলল, এখন কি আর রবিবারের মিটিংয়ের আদৌ কোনও মানে হয়?

বাসু-সাহেব জবাবে বললেন, আসানসোল থেকে সুনীল, বর্ধমান থেকে অমল দত্ত, মনীশ সেনরায় আর ময়ূরাক্ষী আসছে। ওদের দুজনকে মৃত ব্যক্তিদ্বয়ের দুটি ফটো আনতে বলা হয়েছে। বিকাশও যেন চন্দ্রচূড়ের একটি আলোকচিত্র নিয়ে আসে। ঘরোয়া পরিবেশে পরস্পর পরস্পরকে সান্ত্বনা জানানো আর স্বর্গতঃ আত্মার শান্তিকামনা। অপরাধী যখন ধৃত তখন আর তো কিছু করার নেই।

‘কুশীলব’-এর দপ্তরেও একই বার্তা জানানো হল। আরও অনুরোধ করা হল, রবিবারের এই যৌথ শোকসভায় ‘কুশীলব’-এর তরফে কেউ যেন বনানীর অভিনয়-প্রতিভার বিষয়ে কিছু বলেন, আর ঊষা বাগচী যেন অবশ্যই আসে। দুটি গান গাইতে। উদ্বোধনী আর সমাপ্তি সঙ্গীত। বাসু-সাহেব জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলেন ঊষার বাড়িতে টেলিফোন আছে। অতঃপর তাকে ব্যক্তিগতভাবে বাড়িতে ফোন করে অনুরোধ করলেন। জানতে চাইলেন, তোমাকে এ জন্য যে সম্মান-দক্ষিণা…

ঊষা তীব্র প্রতিবাদ করে ওঠে, কী বলছেন স্যার! বনানী আমার বন্ধু, সহকর্মী! তার স্মরণসভায় আমি পয়সা নিয়ে গান গাইব? আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, আমি আসব, স-তবলচি।

রানী জিজ্ঞাসা করেন, তোমার লিস্ট খতম। আর কাউকে ফোন করতে হবে কি?

—হ্যাঁ, ডক্টর মিত্র, ডক্টর ব্যানার্জি আর টেম্পল চেম্বারে নিবিকে

—’নিবি’ কে?

—ভাল নামটা মনে নেই, ‘মজুমদার নিবি’তে এন্ট্রি আছে আমার ‘ফোন-বুকে।’ ক্রিমিনোলজি এক্সপার্ট ও মনস্তাত্ত্বিক পণ্ডিতটিকে একই আমন্ত্রণ জানানো হল। নিবি মজুমদার ব্যক্তিটিকে রানী চিনতে পারলেন না। কিন্তু বাসু-সাহেবের একতরফা আলাপচারী শুনে ওঁর মনে হল তিনি কোনও প্রখ্যাত সলিসিটার ফার্ম-এর পার্টনার।

—কে নিবি? হ্যাঁ, আমি বাসুই বলছি। আমার মনে হয় সময় হয়েছে। আর অপেক্ষা করার প্রয়োজন নেই। তুমি দলিলটা নিয়ে রবিবার বিশ তারিখ সন্ধ্যা ছটার সময় আমার বাড়িতে চলে এস। …হ্যাঁ হ্যাঁ জানি, তুমি উত্তরপ্রান্তে থাক। বাড়ি ফিরতে রাত হবে। তা হোক না একদিন। গিন্নিকে বলে এস যে, আমার বাড়িতে আসছ! না হয় বল আমিই আরতিকে ফোন করে অনুমতি চেয়ে নিচ্ছি তার কর্তাকে আটকে রাখার জন্য।

ও প্রান্তবাসী কী বললেন তা শুনতে পেলেন না রানী। তবে হাসির কথা নিশ্চয়ই। কারণ হেসে উঠলেন বাবু-সাহেব। বললেন, সেম টু য়ু!

রানী দেবীর ডিডাক্‌শান—ঐ অজ্ঞাত নিবি মজুমদারের শেষ শব্দটা ছিল ‘গুড়-লাক স্যর!’

বাবু-সাহেব হেসেছেন। ‘পর্বতো খোশমেজাজ হাস্যাৎ’। তাই রানী এতক্ষণে সাহস করে বললেন, তিনটে খুনের অন্তত একটা মাস্টারমশাই করেননি, নয়?

বাসু পাইপে একটা টান দিয়ে বললেন। কারেক্ট! আর কোনও ডিডাক্‌শান? –এবং সেই খুনের নায়ক রবিবার সন্ধ্যায় আমন্ত্রিত হলেন? ঠিক বলেছি?

—সুপার্ব! এ না হলে পি. কে. বাসুর বউ।

—এবং সেই একমাত্র খুনটা হচ্ছে : বনানী?

—পার্টলি কারেক্ট!

—‘পার্টলি কারেক্ট’ মানে? হয় ‘কারেক্ট’ নয় ‘ইন্কারেক্ট’। তিনটে খুনের একটা…

—এ ধাঁধার সমস্যা পি.কে. বাসুর বউয়ের স্বামী ছাড়া কেউ সমাধান করতে পারবে না।

ঠিক তখনই বেজে উঠল টেলিফোনটা। রানী দেবী তুললেন, শুনে নিয়ে যন্ত্রটা বাড়িয়ে ধরে বললেন, লডন স্ট্রীট থেকে আই.জি. ক্রাইম তোমাকে খুঁজছেন।

বাসু রিসিভারটা গ্রহণ করে তার ‘কথা-মুখে’ বলেন, শুভ সন্ধ্যা ঘোষাল সাহেব! বলুন?

—আজ সন্ধ্যায় আপনার প্রোগ্রাম কী?

—নিত্যকর্মপদ্ধতি-অনুসারে গৃহাবরোধে মদ্যপান।

—একটু পরিবর্তন করা যায় না? না, না, প্রোগ্রামটা বদলাতে বলছি না, ‘ভেনু টা’—অর্থাৎ নিত্যকর্মপদ্ধতিটা যদি আমার গৃহাররোধে সারতে আসেন? অ্যারাউন্ড সাড়ে আটটায়?

—ম্যাগনিফিক্! কিন্তু হেতুটা?

—কাল হঠাৎ আবিষ্কার করেছি, আমার ‘সেলারে’ একটা ‘রয়্যাল-স্যালুট’ বন্দিনী অবস্থায় প্রতীক্ষারতা। ও বস্তুটা একা একা উপভোগ করা যায় না, আবার উপযুক্ত সঙ্গী পাওয়াও শক্ত। আপনি কি আমাকে সঙ্গ দিয়ে কৃতার্থ করতে পারেন না?

—আঁসাতে! আমি রাজী। কিন্তু একটি শর্ত আছে ঘোষাল সাহেব।

—হুকুম করুন।

—‘রয়্যাল-স্যালুট’-এর সঙ্গে আপনি প্যারীচরণ সরকারকে পাঞ্চ করবেন না এই প্রতিশ্রুতি দিতে হবে।

—প্যারীচরণ সরকার? অস্যার্থ?

—প্যারীচরণ ছিলেন ‘The Arnold of the East! তাঁর করুণাতেই প্রথম A.B.C.D. শিখেছিলাম!

টেলিফোন রিসিভারে ভেসে এল ঘোষাল সাহেবের অট্টহাসি। বললেন, কিন্তু ‘প্যারীচরণ’কে ‘রয়্যাল স্যালুট’-এর সঙ্গে কেন পাঞ্চ করা যাবে না, তার কারণ তো একটা দেখাবেন?

—শ্যুওর! প্যারীচরণ সরকার শুধু ‘ফার্স্টবুক’ লিখেই ক্ষান্ত হননি—তিনি আরও একটি পাপ কাজ করেছিলেন। তিনি ‘বঙ্গীয় মাদক নিবারণ সমাজ’-এর প্রতিষ্ঠাতা!

আবার অট্টহাস্য। ঘোষাল বললেন, চট্‌ট্জলদি জবাব সব সময়ে আপনার ঠোঁটের আগায়। অলরাইট! আমরা বরং ‘এ.বি.সি.ডি.’র বদলে ‘অ-আ-ক-খ’ পাঠ করব। ঈশ্বরচন্দ্রের বর্ণপরিচয়। বিদ্যাসাগর মশাইও জীবনে অনেক পাপ কাজ করেছেন, কিন্তু মদ্যপদের সহ্য করতেন—না হলে মাইকেল তাঁর Vid -এর করুণালাভ করতেন না।

.

রাত পৌনে নটা। ঘোষাল-সাহেবের ড্রইংরুম। স্তিমিত আলোক। টিপয়ের উপর সদ্য-বন্ধনমুক্ত রয়্যাল স্যালুটের বোতল, দুটি গ্লাস, বরফের কিউব, স্ন্যা–আর দু-প্রান্তে দুই প্রৌঢ়।

আই.জি.ক্রাইম বললেন, আপনি হয় তো বরাটের উপর রাগ করছেন বাসু-সাহেব, কিন্তু ….

বাধা দিয়ে বাসু বলেন, ওটা আপনার ভুল ধারণা ঘোষাল-সাহেব। বরাটের উপর আদৌ আমি রাগ করিনি। সে আমাকে ‘ফেয়ার অফার’ দিয়েছিল। আমি যদি ঐ পাগলটার ডিফেন্স দেব না বলে প্রতিশ্রুতি দিই তাহলেই সে পুলিসের ‘সাঁজ’ করা জিনিসগুলো আমাকে দেখতে দেবে। ন্যায্য কথা। পুলিস এখন চার্জ-ফ্রেম করতে ব্যস্ত। প্রতিবাদী পক্ষের বরাট তার হাতের তাস আগে-ভাগেই দেখিয়ে দিতে পারে না। অধিকার-বহির্ভূত সে কিছু করেনি।

—তার মানে আপনি শিবাজীপ্রতাপের ডিফেন্স দিতে মনস্থ করেছেন?

—ইয়েস! আমি ইতিমধ্যে তার কেসটা নিয়েছি। হাজতে তার সঙ্গে দেখাও করে এসেছি।

—আপনার কি ধারণা লোকটা সত্যিই পাগল? সে স্বজ্ঞানে খুনগুলো করেনি? ওর পিছনে আর কোনও ক্রিমিনাল লুকিয়ে রয়েছে?

বাসু স্মিত হাসলেন। জবাব দিলেন না।

—অলরাইট! অলরাইট! আই অ্যাডমিট! আপনিও আপনার হাতের তাস আগে-ভাগে দেখাতে পারেন না। ঠিক আছে। আমিই খুলে বলি। বুঝতেই পাচ্ছেন, একটা বিশেষ বার্তা আপনাকে জানাতে চাই বলেই এই নিভৃত সাক্ষাতের আয়োজন। আমি মন খুলে আমার বক্তব্য রাখি। আপনি আপনার হাত এক্সপোজ না করে যতটুকু সম্ভব আপনার মতামত জানান। প্রথম কথা : আমার বিশ্বাস—তিনটে খুনই শিবাজীপ্রতাপ করেনি। লোকটার বিরুদ্ধে প্রমাণগুলো নিশ্ছিদ্র—ওর টাইপ-রাইটার, ওর আলমারিতে সাজানো ধর্মপুস্তক এবং সবার উপরে না-খোলা প্যাকেটে ঐ সুকুমার রায়-এর বইটা, যা থেকে তিন-তিনটে ছবি কেটে তিনটি চিঠিতে আঠা দিয়ে সাঁটা হয়েছিল। ডক্টর মিত্র অজ্ঞাত হত্যাবিলাসীর বিষয়ে যা যা ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন তার সবগুলোই মিলে গেছে। এক নম্বর, লোকটা অঙ্কের মাস্টার; দু নম্বর সে শিশুসাহিত্য পড়তে ভালবাসে; তিন নম্বর, ভাল টাইপিং জানে; চার নম্বর সে মেগ্যালোম্যানিয়াক’; পাঁচ নম্বর সে হত্যাবিলাসী! কিন্তু আমি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছি না যে, ঐ লোকটা দ্বিতীয় খুনের জন্য দায়ী। আই মীন, বনানী ব্যানার্জি। মনীশ সেনরায় যাকে ঐ ফার্স্টক্লাস কামরায় আপাদমস্তক চাদর মুড়ি দেওয়া অবস্থায় দেখেছিল সে লোকটা ঐ ষাট বছরের আধা-পাগলা বুড়ো হতে পারে না। শুধু এই কারণেই শিবাজীপ্রতাপের বিরুদ্ধে চার্জটা ফ্রেম করা যাচ্ছে না। বরাটও এটা মন থেকে মেনে নিতে পারছে না। খুব সম্ভবত পুলিস শিবাজীপ্রতাপের বিরুদ্ধে দুটো খুনের চার্জই আনবে। বনানী-মার্ডার নিয়ে আমরা এখনো কোনও সিদ্ধান্তে আসতে পারিনি।

ঘোষাল-সাহেব থামলেন। বাসু নিঃশব্দে এক চুমুক পান করে নিরুত্তরই রইলেন।

আই.জি. ক্রাইম আবার শুরু করেন, আপনি কি বনানী হত্যার বিষয়ে আমাদের সঙ্গে সহযোগিতা করতে প্রস্তুত? যেহেতু আপনার ক্লায়েন্টের বিরুদ্ধে ও চার্জটা নেই?

বাসু বললেন, আমি গোটা কেসটাকে এ-ভাবে খণ্ড খণ্ড করে দেখতে প্রস্তুত নই। আমার মতে তিনটি হত্যা বাগর্থের মতো সম্পৃক্ত। তাদের পৃথক করা সম্ভবপর নয়।

—কেন নয়? ধরা যাক, দ্বিতীয়টা অন্য লোকের হাতের কাজ। সে নাম-উপাধির সুযোগ নিয়ে বর্ধমানের কেসটাকে অ্যালফাবেটিক্যাল সিরিজের একটা সেকেন্ড টার্ম হিসাবে চালিয়ে দিতে চাইল?

—কিন্তু বনানী যখন খুন হয় তখনো তো আমরা খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দিইনি? বনানীর হত্যাকারী তো জানে না যে, আমরা ঐ জাতের চিঠি পাচ্ছি?

—ধরুন কোনও সূত্রে সে তা জেনেছে। আমরা সাত-আটজনে বসে কনফারেন্স করেছি। ঘরে স্টেনো ছিল। এঁরা সকলেই অত্যন্ত বিশ্বাসভাজন, কিন্তু বাড়ি ফিরে এমন মুখরোচক গল্পটা নিজ-নিজ ধর্মপত্নীকে যে গল্প করে শোনাননি তার গ্যারান্টি নেই। আর মেয়েমানুষের পেটে কথা থাকে না এটা তো প্রবাদবাক্য!

বাসু বলেন, তা সত্ত্বেও আমি যা বলেছি সে অসুবিধেটা থেকেই যাচ্ছে। তিনটি কেসকে পৃথক করা যাচ্ছে না। একটু বুঝিয়ে বলি। ধরুন আমি জেনেছি, এ টাইপ-রাইটারটা শিবাজীবাবুকে যে উপহার দিয়েছিল তার নাম হানিফ মহম্মদ। কিন্তু লোকটা কে, কোথায় আছে তা জানি না। আমি জেনেছি, পণ্ডিচেরীর এক অজ্ঞাত মহারাজ শিবাজীবাবুকে মাস মাস টাকা পাঠাতেন এবং পার্সেলে বই পাঠাতেন; অথচ পণ্ডিচেরীতে গিয়ে আমি কোনও অনুসন্ধান করতে পারিনি। আমি জানি না, এগুলো আপনারা জানেন কি না, পুলিস কোনও তদন্ত করেছে কি না। করে থাকলেও পুলিস তা আমাকে জানাতে পারে না; কারণ আমি শিবাজীবাবুর ডিফেন্স-কাউন্সেল। এক্ষেত্রে আমি কেমন করে…

বাধা দিয়ে ঘোষাল সাহেব বলেন, জাস্ট এ মিনিট। আমি জবাব দিচ্ছি। পুলিস এ সব তদন্ত শেষ করেছে। তার ফলাফল আমিই আপনাকে জানিয়ে দিচ্ছি। শুনুন মিস্টার বাসু। লোকটা যদি সত্যই নিরপরাধ হয় তাহলে তাকে ফাঁসিকাঠ থেকে ঝুলিয়ে দেবার ইচ্ছা আমাদের কারও নেই। …হ্যাঁ, ওকে যে লোকটা টাইপ-রাইটার উপহার দিয়েছিল আপাতদৃষ্টিতে তার নাম হানিফ মহম্মদ। হেমাঙ্গিনী বয়েজ স্কুলে তার পার্মানেন্ট অ্যাড্রেস পুলিস জোগাড় করেছে। লোকটা মারা গেছে। বছর দশেক আগে। আপনি তো জানেনই যে, প্রতিটি ঘড়ির পিছনে যেমন ম্যানুফ্যাকচারার-এর দেওয়া ক্রমিক সংখ্যা থাকে, তেমনি প্রতিটি টাইপ-রাইটার যন্ত্রেরও তাই থাকে। সেই সূত্র থেকে আমরা একথাও জেনেছি যে, ঐ যন্ত্রটা রেমিংটন কোম্পানীর ডালহৌসি স্কোয়ার কাউন্টার থেকে দেড় বছর আগে বিক্রয় হয়—হানিফের মৃত্যুর বহু বছর পরে। যে লোকটা কিনেছিল সে নগদ মূল্যে খরিদ করেছিল। ক্রেতার হদিশ পাওয়া যায়নি। ফলে শিবাজীপ্রতাপের ও কথাটা ভুল—উপহারটা হানিফ পাঠায়নি। …তিন-নম্বর : পণ্ডিচেরীতে তল্লাসী চালিয়ে একথাও জানা গেছে যে, ‘মাতৃসদন’ এবং তার ‘মহারাজ’ সবই অলীক। সুতরাং একটি সিদ্ধান্তই এক্ষেত্রে নেওয়া চলে : ‘হোমিসাইডাল ম্যানিয়াক্ টাকে দিয়ে একের পর একটি খুন করালেও সমস্ত পরিকল্পনার পিছনে আর একটি ব্রেন কাজ করে চলেছে। কে, কেন, কীভাবে তা আমরা এখনো আবিষ্কার করতে পারিনি। এবার বলুন বাসু-সাহেব? আপনি কি সহযোগিতা করতে প্রস্তুত?

—বাসু বলেন, আপনার ও কথার জবাব দেবার আগে আমার আরও একটি প্রশ্ন আছে। পুলিসের মতে এক নম্বর : শিবাজীপ্রতাপ প্রথম ও তৃতীয় খুনটা স্বহস্তে করেছেন, কিন্তু দ্বিতীয় খুনটা করেননি। দু নম্বর : সমস্ত ব্যাপারটার পিছনে একটি অজ্ঞাত অতি-ধূর্ত পাকা ক্রিমিনালের হাত আছে—যে লোকটা শিবাজীপ্রতাপকে (i) টাইপ-রাইটারটা উপহার দিয়েছে (ii) মাস-মাস মাহিনা দিয়েছে (iii) তাঁর ‘হোমিসাইডাল’ মনোবৃত্তিকে উকিয়ে এক ও তিন নম্বর খুন দুটি করিয়েছে। এবং তিন নম্বর : সেই পাকা-ক্রিমিনালটির পাত্তা আপনারা পাচ্ছেন না। কেমন তো? এক্ষেত্রে আমার প্রশ্ন : সেই পাকা ক্রিমিনালের মূল উদ্দেশ্যটা কী? কোনটা তার টার্গেট? কী কারণে দেড় বছর ধরে সে এই বিরাট পরিকল্পনা ফেঁদে ধাপে ধাপে এগিয়ে চলেছে?

—এর একটাই জবাব হতে পারে, বাসু-সাহেব। সেই অজ্ঞাত লোকটাই আসলে ইচ্ছে ‘হোমিসাইডাল ম্যানিয়াক’! মানুষ খুন করাতেই তার তৃপ্তি। এবং সেই পাকা ক্রিমিনালটি কোনও কারণে আপনাকে শত্রুপক্ষ মনে করে। হয়তো আপনার হাতে তার কোনও হেনস্থা হয়েছে; তাই আকাশচুম্বী আত্মম্ভরিতা নিয়ে আপনাকে ডিফেম করে কুখ্যাত হতে চাইছে। শিবাজীপ্রতাপকে সে পুতুল হিসাবে ব্যবহার করেছে শুধু। নিজে হাতে সে একটি মাত্র খুন করেছে—ঐ দু’নম্বর হত্যাটা : বনানী ব্যানার্জি। বাকি দুটি শিবাজীকে প্ররোচিত করে তার হত্যাবিলাস চরিতার্থ করেছে। এই আমার থিয়োরি। আপনি কী বলেন?

বাসু-সাহেব আর এক চুমুক পান করে বললেন, মিস্টার ঘোষাল! আপনি আপনার সবকটি হাতের তাস টেবিলে বিছিয়ে দিয়েছেন। আয়াম এক্সট্রিমলি সরি— আমি এখন, এই মুহূর্তেই আমার সবগুলো তাস মেলে ধরতে পারছি না। কিন্তু অধিকাংশ তাসই আমি বিছিয়ে ধরছি। দেখুন, তাতে যদি কোনও সুরাহা হয়। প্রথম কথা : সমস্ত ব্যাপারটা বর্তমানে আমার কাছে স্ফটিক স্বচ্ছ—কোথাও কোনও আবিলতা নেই!

—মানে?

—মানে, আপনার বর্ণনা অনুযায়ী নেপথ্যচারী হত্যাবিলাসীর পরিচয় আমি জানি।

—জানেন! আপনি জানেন লোকটা কে?

—জানি। তাকে আপনিও চেনেন। আপনারা অনেকেই চেনেন। সে আমাদের অতি নিকটেই রয়েছে। লোকটা আদৌ ‘হোমিসাইডাল ম্যানিয়াক’ নয়। তা সত্ত্বেও সে যে কেন পরপর তিনটি খুনের পরিকল্পনা করেছে তাও আমার জানা-

ঘোষাল-সাহেব উৎসাহে বাসুর হাতটা চেপে ধরে বলেন, আপনি জানেন? কে? কেন?

—জানি। কে এবং কেন।

—তাহলে কেন আমাদের বলতে পারছেন না?

—একটিমাত্র কারণে। আপনাকে যদি এখনই নামটা বলে দিই, তাহলে কোনওদিন তার ‘কভিশন’ হবে না!

—কেন? কেন?

—কারণ যে-যে ব্লুর সাহায্যে আমি সিদ্ধান্তে উপনীত হয়ে অপরাধীকে চিহ্নিত করেছি তা জানালে আপনি বাধ্য হবেন এখনি তাকে গ্রেপ্তার করতে। আর এই মুহূর্তে গ্রেপ্তার হলে তাকে আদালতে চূড়ান্তভাবে দোষী প্রমাণ করা যাবে না। আমি তাকে আর একটি ভ্রান্ত পদক্ষেপ নিতে বাধ্য করতে চাই। তার কভিশান হবার মতো আর একটি প্রমাণ আমি হাতে পেতে চাই…

—আমরা কি যৌথভাবে সে-কাজে এগিয়ে যেতে পারি না? পুলিসের সহায়তায় কি আপনি সেই নিশ্ছিদ্র প্রমাণটি সংগ্রহ করতে পারেন না?

—নিশ্চয়ই পারি। কিন্তু এই মুহূর্তে লোকটিকে চিহ্নিত না করে।

— কেন?

—এখনি তা আমি বলছি—সে ক্ষেত্রে আপনি তাকে গ্রেপ্তার করতে বাধ্য হবেন। আমার ফাঁদে পা দেবার দুর্যোগ থেকে সে অব্যাহতি পেয়ে যাবে। আমি সুযোগ হারাব।

ঘোষাল সাহেব আর এক চুমুক পান করলেন।

বাসু বললেন, এবার আমার প্রস্তাবটা শুনুন ঘোষাল-সাহেব। রবিবার সন্ধ্যায় আমার বাড়িতে একটি শোকসভার আয়োজন করেছি। তিনজন মৃত ব্যক্তির প্রতি আমরা পর্যায়ক্রমে সম্মান জানাবো—প্রত্যেকটি মৃতব্যক্তির নিকট আত্মীয়দের প্রতিনিধি হিসাবে কেউ না কেউ আসবেন। পরস্পরকে সান্ত্বনা দেবেন। এটাই হচ্ছে বাহ্যিক আয়োজন। আমার দৃঢ় বিশ্বাস—এই পরিকল্পনার মূল নায়কও ঐ সভায় উপস্থিত থাকবেন এবং আমার আশা—সওয়াল-জবাবের মাধ্যমে ঐ সভাতেই আমি তাকে চিহ্নিত করে ফেলব। ‘কভিক্‌শন’ হবার উপযুক্ত এভিডেন্স ঐ সভাতেই আমাদের হস্তগত হবে। আপনি আসুন, রবি বোসকেও আমি ডেকেছি—ইন অ্যান্টিসিপেশন্ অব্ য়োর এনডোর্সমেন্ট— বলেছি, হ্যান্ডকাফ নিয়ে সে যেন সশস্ত্র আসে। কিন্তু প্লেন-ড্রেস সশস্ত্র পুলিসও থাকবে সভায়। যদি ঐ দিন সর্বসমক্ষে শয়তানটাকে আমি হাতে-নাতে ধরতে না পারি তাহলে—কথা দিচ্ছি—আমি আমার হতের সব কয়খানা তাসই আপনার সামনে বিছিয়ে দেব। ডাজ দ্যাট স্যাটিসফাই য়ু?

—পার্ফেক্টলি! আই উইশ য়ু অল সাকসেস্।

.

ড্রইং- -কাম-ডাইনিং হলটাকে ঢেলে সাজানো হয়েছে। খাবার টেবিলটি অপসৃত। অন্যান্য ঘর থেকে চেয়ার এনে ঘরটা পৃথকভাবে সাজানো হয়েছে। একপ্রান্তে একটি টেবিলে পাশাপাশি তিনখানি মাল্যভূষিত আলোকচিত্র। রবি বসু বাদে নিমন্ত্রিতরা সবাই এসে পৌঁছেছেন। শোকসভাটি পরিচালনা করছেন বাসু-সাহেবের গুরু—অতিবৃদ্ধ এ.কে.রে।

ঊষা বাগচী উদ্বোধনী-সঙ্গীতটি গাইল দরদভরা গলায় :

“অল্প লইয়া থাকি তাই মোর যাহা যায় তাহা যায়
কণাটুকু যদি হারাই তা লয়ে প্রাণ করে হায় হায়।”

অনেকের চোখই অশ্রুসজল হয়ে উঠল। সুনীল দু-হাঁটুর মধ্যে মুখ গুঁজে বসেছিল। তার পিঠটা মাঝে মাঝে কেঁপে-কেঁপে উঠছে। ময়ূরাক্ষীও বারে বারে চোখ মুছছিল। আর মৌ, মৃত ব্যক্তিত্রয়ের একজনকেও যে দেখেনি, সেও বারে বারে রুমাল দিয়ে চোখ মুছছে।

অনিতা তার মাস্টারমশায়ের অর্থাৎ ডক্টর চ্যাটার্জির কথা কিছু বলল।

ময়ূরাক্ষী মাথা নেড়ে অস্বীকার করায় ‘কুশীলব’-সংস্থার তরফে অন্য একজন বনানীর অভিনয়-প্রতিভা ও অমায়িক স্বভাবের সম্বন্ধে কিছু শোনালেন। সুনীল আঢ্য কিছু বলার অবস্থায় নেই। তাই বাসু-সাহেব নিজেই স্বর্গত আঢ্যমশায়ের বিষয়ে যেটুকু জানেন তা জানালেন-সৎ, সজ্জন, ধর্মভীরু, মানুষটির পরিচয়।

প্রয়াত ব্যক্তিত্রয়ের আত্মার শান্তি কামনায় সকলে কিছুক্ষণ নীরবতা পালন করলেন। ঊষা আবার হারমনিয়ামটা টেনে নিতে যাচ্ছিল, তাকে বাধা দিয়ে বাসু বলেন, না না, সভার কাজ এখনো শেষ হয়নি। আরও একজনের বিষয়ে কিছু আলোচনা করা দরকার। দৈহিক বিচারে তিনি জীবিত, মস্তিষ্কের পরিমণ্ডলে মৃত। আমি হেমাঙ্গিনী বয়েজ স্কুলের প্রাক্তন শিক্ষকটির কথা বলছি। আমরা সবাই জানি—তিনি এক বিকৃতমস্তিষ্ক হতভাগ্য। সজ্ঞানে তিনি হত্যা করেননি কাউকে। দু-চার মাসের মধ্যেই অনিবার্যভাবে তাঁর ফাঁসি হবে। আত্মিকভাবে মৃত মাস্টারমশায়ের সম্বন্ধে আমি ডক্টর দাশরথী দেকে কিছু বলতে অনুরোধ করছি।

বিকাশ একটু ক্ষুব্ধ স্বরে বলে ওঠে, এ সভায় কি সেটা প্রাসঙ্গিক? শোকসভায় একজন ক্রিমিনাল…

এ. কে. রে. বলে ওঠেন, না! তিনি ক্রিমিনাল না, বর্তমানে তিনি অভিযুক্ত মাত্ৰ।

আই. জি. সি. ঘোষাল-সাহেব সংক্ষেপে শুধু বলেন, কারেক্ট!

অনিতাও বলে ওঠে, আমি বরং শুনতেই চাই। দুদিন পরে তো তাঁকে ফাঁসিকাঠ থেকে ঝুলিয়েই দেওয়া হবে। আমরা জানতেও পারব না, কী-জন্য কী করে তিনি পর পর তিনজনকে…..

দেখা গেল, সভায় অনেকেই শিবাজীপ্রতাপের পশ্চাৎপট বিষয়ে আগ্রহান্বিত।

অতঃপর ডক্টর দে তাঁর মাস্টারমশায়ের বিষয়ে অনেক কথা বলে গেলেন। যতটুকু তাঁর জানা। ইতিপূর্বে তিনি কতবার মানুষের গলা টিপে ধরেছিলেন, তাঁর কম্পাউন্ডারির চাকরি, প্রুফরিডারি, হাইকোর্টের রেলিং ঘেঁষে টাইপ-রাইটিং করে গ্রাসাচ্ছাদনের প্রচেষ্টা এবং ‘প্রাচীন ভারতে গণিতচর্চা’ বিষয়ে তাঁর অসমাপ্ত গ্রন্থের কথা।

উনি থামতেই বাসু-সাহেব বলে ওঠেন, শিবাজীপ্রতাপ চক্রবর্তীর গোটা ইতিহাসটাই আপনারা শুনলেন। তিনি জীবনে ব্যর্থ, মাঝে মাঝে ক্ষেপে গিয়ে মানুষের গলা টিপে ধরতেন। তাঁর নামের ভিতরেও পৈত্রিকসূত্রে প্রাপ্ত একটা ‘মেগালোম্যানিয়াক’ ইঙ্গিত। তিন তিনটি হত্যাকাণ্ডের সময় তাঁকে অকুস্থলের কাছাকাছি দেখা গেছে! কাকতালীয় ঘটনা তিন-তিনবার ঘটে না। তাছাড়া তাঁর ঘরে যে টাইপ-রাইটার আর সুকুমার রচনা-সমগ্র সেগুলিও তাঁর বিরুদ্ধে মোক্ষম প্রমাণ। কিন্তু একটা কথা—আমি যখন হাজতে গিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করি, তখন বেশ বুঝতে পারি ‘পি. কে. বাসু. বার-অ্যাট ল’ এই নামটি তাঁর কাছে অপরিচিত। এক্ষেত্রে তিনি কেমন করে আমার নামে তিন-তিনখানি চিঠি…

ডক্টর ব্যানার্জি বাধা দিয়ে বলেন, সেটা ওঁর নিখুঁত অভিনয় হতে পারে। আপনি ধরতে পারেননি।

—দ্বিতীয় কথা : পুলিস আবিষ্কার করেছে—ঐ টাইপ-রাইটারটি রেমিংটন কোম্পানির ডালহৌসী-স্কোয়ারের দোকান থেকে দেড় বছর আগে নগদ মূল্যে কেউ খরিদ করেছে। সে সময় দেখছি শিবাজীপ্রতাপ কপর্দকহীন। তিনি কেমন করে ওটা ঐ সময় নগদ দামে কিনলেন?

ডক্টর ব্যানার্জিই পুনরায় প্রশ্ন করেন, এ বিষয়ে তিনি নিজে কী বলেন? যন্ত্রটা কী সূত্রে তাঁর হেপাজতে এল, এ কথা কি তাঁর মনে পড়ে না?

—পড়ে, তিনি বলেন—এটি ওঁকে উপহার দিয়েছিল ওঁর এক ছাত্র : হানিফ মহম্মদ।

বিকাশ বলে, তবে তো ল্যাটা চুকেই গেল। কীভাবে কপর্দকহীন মাস্টারমশাই…

—না, চুকলো না। তথ্য বলছে যে, হানিফ মহম্মদ দশ বছর আগে মারা গেছে।

সকলে নীরব। বাসু সাহেব আবার শুরু করেন। সুতরাং বেশ বোঝা যাচ্ছে, কেউ নাম ভাঁড়িয়ে যন্ত্রটা ওঁকে উপহার দিয়েছিল। যাতে ঐ এভিডেন্সটা ওঁর হেপাজতে থাকে। বাড়ি সার্চ করার সময় যেন টাইপ-রাইটারটা পুলিসে উদ্ধার করে।

অ্যান্ড্রুইয়ুলের মনীশ সেন রায় জানতে চায়, তিনটি চিঠিই যে ঐ টাইপ-রাইটারে ছাপা এটা কি প্রমাণিত হয়েছে?

—হ্যাঁ, তিনটিই। কিন্তু আদ্যন্ত নয়। প্রতিটি চিঠির শেষের দিকে ঐ স্থান আর তারিখের অংশটুকু বাদে।

—তার মানে?

—তার মানে, হানিফ মহম্মদের নাম করে যে ওঁকে যন্ত্রটা উপহার দেয় সে নিজেই চিঠিগুলি টাইপ করেছে, কিন্তু স্থান ও তারিখটা তখন বসায়নি। সে লোকটা দেড় বছর আগে জানতো না—কোন্ তারিখে, কোথায় কোন খুনটা হবে।

অমল দত্ত বলে বসে স্ট্রেঞ্জ!

—হ্যাঁ। শুধু ঐটুকুই নয়। পণ্ডিচেরীর যে মহারাজ ওঁকে মাস-মাস মনি-অর্ডার করতেন, আর বইয়ের পার্সেল পাঠাতেন তিনিও অলীক। তাঁর পাত্তা পুলিসে পায়নি।

ডক্টর ব্যানার্জি বলেন, এ থেকে কী প্রমাণ হয়?

—আমি জানি না। আপনারা বিবেচনা করে বলুন।

—আপনি কি বলতে চাইছেন যে, শিবাজীপ্রতাপকে শিখণ্ডী খাড়া করে আর কোনও ‘হোমিসাইড্যাল ম্যানিয়াক্’ এ কাজগুলো করছিল?

বাসু বলেন, সেটা আপনাদের বিবেচ্য। আমি এইটুকু বলতে পারি যে, তিনটি খুনের একটি যে শিবাজীপ্রতাপ করেননি এটুকু আমি জানতে পেরেছি।

এ. কে. রে. বলেন, তোমার কাছে কোনও এভিডেন্স আছে?

—আছে স্যার! অকাট্য প্রমাণ!

—কোন কেসটা?

—বলছি স্যার। তার আগে আমার একটা প্রশ্নের জবাব চাই—আপনাকেই আমি বিশেষভাবে প্রশ্ন করছি ডক্টর ব্যানার্জি। কারণ অপরাধ-বিজ্ঞানে আপনি পণ্ডিত। এমন কি হতে পারে না যে, নাম ও স্থানের কোয়েন্সিডেন্স-এর সুযোগ নিয়ে একজন খুনী তার পথের কাঁটা সরিয়ে ফেলল—এই স্থির বিশ্বাসে যে, পুলিস কেসটাকে ঐ ‘অ্যালফাবেটিকাল সিরিজের একটা ‘টার্ম’ বলে ধরে নেবে?

—এমনটা হতেই পারে। আপনি কোনও সূত্র পেয়েছেন?

—পেয়েছি। যাঁকে সন্দেহ করেছি তিনি এ ঘরেই বর্তমানে উপস্থিত। আমার প্রস্তাব—এ ঘরের প্রত্যেকটি ব্যক্তিকে আমি এক-একটি প্রশ্ন করব। জবাবে তাঁরা নিছক সত্য কথা বলবেন, অথবা বলবেন, ‘আমি জবাব দেব না।’ তাহলেই সেই আততায়ীকে আমি চূড়ান্তভাবে সনাক্ত করতে পারব। আপনারা আমার সঙ্গে সহযোগিতা করতে রাজি?

প্রায় বিশ সেকেন্ড ঘর নিস্তব্ধ।

ডক্টর মিত্র বললেন, এতে আমাদের আপত্তি করার উপায় নেই। প্রতিবাদ যে করতে যাবে, সে নিজেই তৎক্ষণাৎ চিহ্নিত হয়ে যাবে। আপনি শুরু করুন।

—আমি আপনাকেই প্রথম প্রশ্নটা করছি : আপনাকে আই. জি. ক্রিমিন্যাল-সাহেব কয়েকবার এক্সপার্ট হিসাবে কনফারেন্সে ডেকেছিলেন। সেজন্য ধন্যবাদও জানিয়েছেন। কিন্তু আপনার মনে হয়েছিল, এজন্য আপনার একটা ‘প্রফেশনাল ফি প্রাপ্য ছিল।—ইয়েস অর নো?

ডক্টর মিত্র গম্ভীরস্বরে বললেন, আমি জবাব দেব না।

—নেক্সট সুনীল! তুমি একদিন লুকিয়ে সিগারেট খাচ্ছিলে; হঠাৎ বাবার সামনে পড়ে গিয়ে সিগারেট লুকিয়ে ফেল। বাবা দেখতে পাননি।

—ইয়েস অর নো?

সুনীল মাথা নিচু করে বললে, ইয়েস।

—থার্ড! মিস্টার অমল দত্ত। আপনি এজাহারে বলেছিলেন–বনানী যে ট্রেনে আসছিল তার আগের লোকালে আপনি বর্ধমান আসেন। অথচ বর্ধমানে একজন রিকশাওয়ালা—যে আপনাকে চেনে, যাকে আপনি চেনেন না—বলছে যে, ঐ শেষ লোকালেই আপনি এসেছিলেন। রিকশাওয়ালাটা কি মিথ্যা কথা বলেছে?

অমল দত্তের মুখটা সাদা হয়ে গেল। ঢোক গিলে বলল, ইয়ে… মানে, এক কথায় এর জবাব হয় না। আমি বুঝিয়ে বলছি, শুনুন।

গর্জে ওঠেন বাসু-সাহেব : কৈফিয়ত দেবার অবকাশ নেই।

—ইয়েস অর নো? অমল দাঁতে দাঁত দিয়ে বললে, আমি জবাব দেব না।

—ফোর্থ! মনীশবাবু! বনানীর বাক্সে কিছু প্রেমপত্র পাওয়া গেছে। তার একটা সিরিজ টাইপ-রাইটারে ছাপা। আমার বিশ্বাস সেই চিঠিগুলি অ্যান্ড্রুইয়ুল কোম্পানির কোন টাইপ-রাইটারে ছাপা। পুলিস-তদন্ত হলে এ সত্য প্রতিষ্ঠিত হবে।

—ইয়েস অর নো?

মনীশ জ্বলন্ত দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর বললে, ইয়েস… বাট্… —নো ‘বাট্’ প্লীজ। পঞ্চম সাক্ষী ময়ূরাক্ষী। তুমি ‘বাট-ফাট্’ বলবে না। ‘হ্যাঁ, না,’ অথবা ‘বলব না’-র মধ্যে তোমার জবাব সীমাবদ্ধ করবে। প্রশ্নটা এই—সুজাতা ফিরে এসে আমাকে বলেছিল যে, অমল দত্ত তোমাকে কিছু অর্থসাহায্য করতে চেয়েছিল এবং তুমি তা প্রত্যাখ্যান কর—

—ইয়েস!

বাসু হেসে বলেন, প্রশ্নটা আগে আমাকে শেষ করতে দাও। ওটা তো ফ্যাক্ট। প্রতিষ্ঠিত সত্য। আমার প্রশ্নটা এই : তুমি ওর কাছে আর্থিক সাহায্য নাওনি এই কারণে যে, অমল তোমার দিদিকেই ভালোবাসত, এ কথা জেনেও যে বনানী তাকে ভালবাসত না; অথচ তুমি অমল দত্তকে ভালবাসতে এবং ভালোবাস।…

ময়ূরাক্ষী ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায়। যেন সর্বসমক্ষে বাসু-সাহেব তার ব্লাউজটা টেনে ছিঁড়ে ফেলেছেন। তার ঠোঁট দুটি থর থর করে কাঁপতে থাকে। বলে, এসব… আপনি… কী বলছেন?

—ইয়েস, নো’ অথবা ‘বলব না’ প্লীজ!

দু-হাতে মুখ ঢেকে বসে পড়ল ময়ূরাক্ষী। তিনটে জবাবের একটাও যোগালো না তার মুখে।

সুজাতা নিঃশব্দে তার বাহুমূলটা ধরে বললে— বাথরুমটা ঐ দিকে।

হাত ধরে সে সভাস্থল থেকে ময়ূরাক্ষীকে নিয়ে বেরিয়ে গেল।

ঘরে আপিন-পতন নিঃস্তব্ধতা।

—সিক্সথ্—অনিতা! তোমাকে যে প্রশ্নটা করছি তা এই; যদিও বিশ বছরের বয়সের ফারাক এবং যদিও তুমি মিসেস্ চক্রবর্তীকে নিজের দিদির মত ভালোবাস, তবু মিসেস্ চক্রবর্তীর মৃত্যুর পর যদি ডক্টর চন্দ্রচূড় চ্যাটার্জি তোমাকে বিবাহ-প্রস্তাব দিতেন তাহলে তুমি সম্মত হতে! —ইয়েস অর নো?

অনিতাও আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। যেন ময়ূরাক্ষীর পর এবার তার বস্ত্রহরণ পালা শুরু হল! তারও ঠোঁটদুটি নড়ে উঠল—বাক্যস্ফূর্তি হল না।

ঠিক তখনই কক্ষের ও-প্রান্ত থেকে এ. কে. রে. বলে ওঠেন, অবজেক্‌শান সাসটেইন্ড! ইরেলিভেন্ট অ্যান্ড আর্গুমেন্টেটিভ! কী হলে কী হত, তা সাক্ষী বলতে বাধ্য নয়, এমনকি ‘আমি বলব না’– তাও নয়। তুমি বসে পড় অনিতা

কাঁপতে কাঁপতে অনিতা বসে পড়ে।

—সেভেন্থ, মিস্টার নিবি মজুমদার! তোমাকে দীর্ঘদিন পূর্বে ডক্টর চন্দ্রচূড় চ্যাটার্জি তাঁর উইলটা সেফ্-কাস্টডিতে রাখতে দিয়েছিলেন। তাতে স্ত্রী, শ্যালক, অনিতা এবং অন্যান্যদের জন্য যথাযোগ্য লীগাসির ব্যবস্থা করে তাঁর সমস্ত সম্পত্তি একটি ট্রাস্ট বোর্ডকে দিয়ে গিয়েছিলেন—কিছু গবেষণামূলক গ্রন্থরচনার দায়িত্ব দিয়ে। —ইয়েস অর নো?

নিবি মজুমদার উঠে দাঁড়ালো। থ্রি-পীস স্যুট পরা একটি সুদর্শন যুবক। তার বয়স যে চল্লিশের কোঠায় তা বোঝা যায় না। ঘরের প্রত্যেকটি ব্যক্তি তার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে। একমাত্র ব্যতিক্রম পি. কে. বাসু! তাঁর দৃষ্টি অন্যত্র!

নিবি হেসে বললে, ইয়েস! ওঁর উইল আমি সঙ্গে নিয়েই এসেছি।

বাসু বললেন, অষ্টম সাক্ষীকে প্রশ্ন করার আগে আমি একটু বিশ্লেষণ করতে চাই। ধরুন আমি যদি বলি, ‘এখানে একটা আলপিন রয়েছে’ অমনি আপনাদের দৃষ্টি যাবে মেঝের দিকে। মনে হবে কারো পায়ে না ফোটে, তারপর সোফা বা সেটিগুলোর দিকে তাকাবেন। তারপর টেবিলের উপর দৃষ্টি বুলিয়েও যখন আলপিনটা নজরে পড়বে না, তখন হয়তো বলবেন, ‘কই?” টেবিলের উপর পিন-কুশানে গাঁথা আমার সেই বিশেষ আলপিনটা দেখেও নজর করবেন না। এটা ‘হিউম্যান-সাইকলজি’। আমরা কি এখানে ঐ জাতের ভুল করছি? মনে করুন, একজন লোক দীঘার ধীরেন্দ্র ধরকে কোনও কারণে খুন করতে চায়। কিন্তু সে জানে—পুলিস সেই খোঁজ করবে ধীরেনবাবুর মৃত্যুতে কে সবচেয়ে লাভবান হল? কে সম্ভাব্য খুনী হতে পারে? এই জন্যে সে ধীরেন ধর-নামক আপিনটাকে পিন্ কুশানে গেঁথে ফেলতে চাইল। সে যদি পর পর চারটি খুন করে—প্রথমে আলমবাজার, আলিপুর ও আগরতলার অসীম আচার্য, অনিমা আগরওয়াল ইত্যাদি নামের যে-কোন একজনকে, এবং তারপর বাটানগর, ব্যারাকপুর, বেহালায় ‘বি’ নাম-উপাধির কাউকে, এবং তারপর ‘সি’-য়ের ঘাট পার হয়ে দীঘার ধীরেনবাবুকে খুন করে? আর ঐ সঙ্গে যদি হোমিসাইড্যাল ম্যানিয়াকের ছদ্মবেশে পি. কে. বাসুকে ক্রমাগত পত্রাঘাত করতে থাকে তাহলে…

বাধা দিয়ে ডক্টর ব্যানার্জি বলে ওঠেন, কিন্তু সে-ক্ষেত্রে ‘পি. কে. বাসু’কে কেন? সে তো সরাসরি ঘোষাল সাহেবকেই চ্যালেঞ্জ থ্রো করবে। ‘পি. কে. বাসু’ বিখ্যাত ডিফেন্স কাউন্সেল—অপরাধী ধরে বেড়ানো তাঁর পেশা নয়?

—তার হেতুটা যদি এই হয় যে, সে ইচ্ছাকৃতভাবে ঠিকানায় ভুল-জোনাল নম্বর দিয়ে কোনও একটি বিশেষ চিঠি ডেলিভারি হতে দেরি করাতে চায়? ‘আই. জি. ক্রিমিনাল, কলকাতা’ লেখা খাম পরদিনই এগারো-র এ লডন স্ট্রীটের ঠিকানায় পৌঁছে যাবার সম্ভাবনা—জোনাল নাম্বারে অন্য কিছু থাকা সত্ত্বেও!

সকলেই একমনে চিন্তা করছেন—এটা একটা নতুন ধরনের যুক্তি।

বাসু বলেন, সে-ক্ষেত্রে ঐ আততায়ীকে এ. বি. সি. নামের বিভিন্ন জায়গায় খুঁজে খুঁজে উপযুক্ত লোকের নাম এবং কে কখন—কোথায় ভালনারেবল সে খবরগুলো জানতে হবে। এটা তার পক্ষেই সম্ভব যাকে চাকরির প্রয়োজনে ক্রমাগত ঘোরাঘুরি করতে হয়। যেমন ধরুন একজন মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভ। যার এলাকা, বর্ধমান, কলকাতা, হাওড়া, হুগলি, মেদিনীপুর।

এবার বিকাশ হেসে ওঠে। বলে, আপনার যুক্তিটা যেন আর নৈর্ব্যক্তিক থাকতে চাইছে না বাসু-সাহেব! সূচীমুখ হতে চাইছে যেন? তাই নয়?

—ইয়েস! যেমন কথার কথা হিসেবে ধরুন আপনার চাকরি। আপনাকে ক্রমাগত স্থান থেকে স্থানান্তরে ঘুরে বেড়াতে হয়। আপনার পক্ষে আরও একটু সুবিধা আছে। আপনি ক্রমাগত ডাক্তারদের সঙ্গে দেখা করেন। এমনকি সাইকিয়াট্রিস্টদের সঙ্গেও। ফলে ‘অস্মার’ রোগে ভুগছে—অর্থাৎ মাঝে-মাঝে যার স্মৃতি হারিয়ে যায় এমন রুগীর নাম-ঠিকানা সংগ্রহ করা সহজ। কারণ শেষ পর্যন্ত একটা ‘ফল গাঈ’, মানে ‘রাঙা-মূলো’ তো পুলিসের নাকের ডগায় ঝুলিয়ে দিতে হবে। যে লোকটা আপনার বদলে ‘ফাঁসিকাঠ থেকে ঝুলবে! তার নাম যদি ‘শিবাজীপ্রতাপ রাজ চক্রবর্তী’ হয়, তাহলে তো সোনায় সোহাগা। স্বতই মনে হবে, পৈত্রিক সূত্রে..সে মনে করে যে সে একজন মহা প্রতিভাবান ব্যক্তি। লোকটার যদি পূর্ব-ইতিহাসে বারে বারে মানুষের গলা টিপে ধরার তথ্যটা থাকে তাহলে আরও ভালো। ধরুন আপনি ঘটনাচক্রে তার সম্পূর্ণ ইতিহাসটা জেনে ফেললেন—তাহলে কিছু ফিনিশিং টাচ দেওয়া দরকার। লোকটা শিশু সাহিত্য পড়তে ভালোবাসে, ফলে সুকুমার গ্রন্থাবলী থেকে কেটে নিয়ে আর একটা এভিডেন্সও যোগ করা যেতে পারে। লোকটা অঙ্কের মাস্টার? তাহলে একপিঠে অঙ্ককষা-কাগজে চিঠিগুলো টাইপ করলে…

বিকাশ অট্টহাস্য করে ওঠে। বলে, বাসু-সাহেব! আপনার বিশ্লেষণটি প্রাঞ্জল! প্রাণ জল হয়ে গেল সকলের! তা আমি সে-ক্ষেত্রে তিনটির ভিতর কোন খুনটা করব বলে দেড়-দু-বছর ধরে এতবড় পরিকল্পনাটা ফেঁদেছি?

—সেটা তো আপনিই আমাদের বলবেন বিকাশবাবু। কারণ আপনিই আমার অষ্টম সাক্ষী। আপনাকে আমার প্রশ্ন : ফিল্‌ম্-প্রডিউসার-এর ভেক ধরে আপনি কি বনানীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা করেননি? নির্জন ফার্স্টক্লাস কামরায় আপনি ওকে গলা টিপে মেরে রাত বারোটা পাঁচে চন্দননগরে ট্রেন থেকে নেমে যাননি? –ইয়েস্ অর নো? নাকি ‘বলব না?’

–আজ্ঞে না মহাশয়! আমি বলব : বনানী ব্যানার্জিকে আমি জীবনে কখনো দেখিনি!

—তার মানে : নো?

—আজ্ঞে না, তার মানে ‘অ্যান এম্ফাটিক্ নো’।

—থ্যাঙ্কু!

বাসু-সাহেব থামলেন। ঘরের প্রত্যেকটি লোকের দৃষ্টি এখন বিকাশের দিকে। সে নড়েচড়ে বসল। বাসু-সাহেব বলেন, আমার নবম সাক্ষী ঊষা বাগচী। যার গান আপনারা শুনলেন। ঊষা, তোমাকে আমার প্রশ্ন : তুমি সুজাতাকে বলেছিলে-বনানীর অনেক বয়-ফ্রেন্ডকে চিনতে। তুমি কি কখনো ঐ বিকাশ মুখুজ্জে-মশাইকে দেখেছ বনানীর সঙ্গে?

ঊষা বললে, ওঁর নাম বিকাশ মুখার্জী কি না তা আমি জানি না। কিন্তু সেদিনই তো ফটো দেখে বলেছিলাম—ঐ ভদ্রলোক একজন ফিল্ম প্রডিউসার। বনানীকে ফিল্‌মে নামার সুযোগ দিতে চাইছিলেন।

বিকাশ রুখে ওঠে, ফটো দেখে? কোন ফটো? কার ফটো?

বাসু তাঁর পকেট থেকে একটি ফটো বার করে দেখান : এইখানা। তোমারই! এই ফটোটা তোমাকে লুকিয়ে তুলতে হবে বলে সেদিন কম্পাস টেলিফটো-লেন্স ইত্যাদি নিয়ে আমি চন্দননগরে গিয়ে একটা হচ্পচ্ পরিবেশ সৃষ্টি করেছিলাম।

বিকাশ দৃঢ়স্বরে বলে, রঙ আইডেন্টিফিকেশন! এ থেকে কিছুই প্রমাণ হয় না! আমি কেন তাকে খুন করব? কী স্বার্থ আমার যে, বনানীকে খুন করব বলে দেড়-বছর ধরে….

বাধা দিয়ে বাসু বলেন, কিন্তু বনানী যদি পিন্-কুশানের একটা ছোট্ট পিন হয়?

—তার মানে? তাহলে কে আমার মেন টার্গেট? ধরণীধর অব দীঘা?

—না! ডক্টর চন্দ্রচূড় চ্যাটার্জি অব চন্দননগর!

—জামাইবাবু! আপনি বদ্ধ উন্মাদ! যাঁর সম্পত্তির আমি একমাত্র ওয়ারিশ?

—তা যে তুমি নও সে-কথা তো আমরা সবাই জেনেছি বিকাশবাবু! এটাই ডক্টর চ্যাটার্জির জীবনের সব চেয়ে বড় ভ্রান্তি–মন্ত্রগুপ্তি! সমস্ত সম্পত্তিটা যে তিনি উইল করে একটা ট্রাস্ট-বোর্ডকে দিয়ে গেলেন সেটা তোমাকে না জানানো! তাহলে তাঁকে এভাবে বেঘোরে মরতে হত না।

বিকাশ রুখে ওঠে, মিস্টার বাসু! আপনার যুক্তির আর পারম্পর্য থাকছে না কিন্তু! মক্কেলের মতো আপনিও এবার পাগলামি শুরু করেছেন! হয় আমি জানতাম ঐ উইলের কথা, অথবা জানতাম না। যদি সেটা আমার জানা থাকত তাহলে এই বীভৎস হত্যার কোনও মোটিভ থাকে না। আর যদি সেটা আমার না-জানা থাকত তাহলেও কোনও মোটিভ থাকে না, যেহেতু আমার বিশ্বাস অনুযায়ী—আমিই তাঁর ওয়ারিশ।

পিছন থেকে কে যেন বলে ওঠেন, কারেক্ট!

বাসু বাধা দিয়ে বলেন, না! তৃতীয় একটি বিকল্পও যে রয়ে গেল…

—তৃতীয় বিকল্প? আমার জানা এবং না-জানার মাঝামাঝি?

—জানতে চায় বিকাশ —হ্যাঁ তাই! তুমি জানতে যে, ঐ রিসার্চের ব্যাপারে চন্দ্রচূড় আর অনিতা পরস্পরের উপর নির্ভরশীল হতে শুরু করেছিলেন; জানতে যে, তোমার দিদির প্রয়াণের পর চন্দ্রচূড়ের সংসারের দায়িত্ব বর্তাতো অনিতা দেবীর উপর। তাঁরা বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হতেন। ক্রমে তাঁদের সন্তানাদি হত। ডক্টর চ্যাটার্জির প্রথমপক্ষের শ্যালকের তখন মঞ্চ থেকে নিঃশব্দে প্রস্থান অনিবার্য হয়ে পড়তো! রে সাহেব বাধা দেওয়ায় অনিতা যে প্রশ্নটার জবাব দিল না সেই জবাবটা অনেকদিন আগেই তুমি জানতে পেরেছিলে, বিকাশবাবু! তাই নয়?

বিকাশ জ্বলন্ত একজোড়া চোখ মেলে বাসু-সাহেবের দিকে তাকিয়েছিল। এখন ধীরে ধীরে বললে, কিন্তু আপনি ভুলে যাচ্ছেন বাসু-সাহেব—হত্যা যখন সংঘটিত হয় তখন আমি ঘটনাস্থল থেকে অনেক-অনেক দূরে। শেয়ালদহ-র কাছাকাছি সুইট-হোমে!

—আহ্! দ্যাটস্ য়োর ডিফেন্স! বজ্রবাঁধুনি অ্যালেবাঈ! তাই নয়? বিকাশবাবু! তুমি দু-বছর ধরে এতসব কিছু করলে অথচ ঐ সামান্য ব্যাপারটার কথা ভুলে গেলে? বেসিনের কলটার দিকে নজর গেল না তোমার?

—মানে?

—হোটেল চেক-ইন করে রুদ্ধদ্বারকক্ষে তুমি মেক-আপ নিলে, যাতে পথে-ঘাটে বা চন্দননগরে কেউ হঠাৎ দেখলে চিনতে না পারে। তারপর রাত দশটায় ট্যাক্সি নিয়ে চলে গেলে হাওড়া স্টেশন। রাত এগারোটা সাতের লোকাল ধরে পৌঁছালে চন্দননগর। তুমি জানতে তোমার ভগ্নিপতি ঠিক কয়টার সময় মর্নিংওয়াকে বার হন, কতদূর যান এবং কোন্ বেঞ্চিতে বসে বিশ্রাম করেন। জানতে যে, খবরের কাগজটা তিনি দেখেননি, কারণ আগেই সেটা সরিয়ে ফেলেছিলে তুমি। প্রত্যাশিতভাবে ডুপ্লিকেট-চাবি দিয়ে গেট খুলে তিনি যে ওখানে ভোররাত্রে উপস্থিত থাকবেন এটা তোমার জানা ছিল। তাই কাজ হাসিল করে ভোর পাঁচটা সাতান্নর লোকাল ধরে ফিরে আসাটা কোনও অসুবিধাজনক হয়নি। তাই নয়? নাকি ছয়টা এগারোর লোকালটা ধরতে হয়েছিল?

বিকাশ উঠে দাঁড়ায়। অনিতার হাতটা বজ্রমুষ্ঠিতে ধরে বলে, চলে এস অনিতা! এইসব পাগলের বক্রকানি শুনতে হবে জানলে আমি এ শোকসভায় আদৌ আসতাম না।

অনিতা জোর করে তার হাতটা ছাড়িয়ে নেয়। বলে, না! আমাকে ব্যাপারটা বুঝে নিতে দাও বিকাশদা। বাসু-সাহেব, আপনি বলুন, এসব আন্দাজ আপনি করছেন কী সূত্রে?

বাসু বলেন, আন্দাজ নয় অনিতা, ফ্যাক্ট! ঐ যে একটা ছোট্ট ভুল করে ফেলেছিল তোমার বিকাশদা! ক্রিমিনোলজি বলে—’পার্ফেক্ট-ক্রাইম বলে কিছু হতে পারে না।’ বিকাশবাবু সব কিছু ঠিক ঠিক করল, কিন্তু হোটেল ছেড়ে যাবার সময় বেসিনের কলটা বন্ধ করে যেতে ভুলে গেল। সে সময় কলে জল আসছিল না! জল আসতে শুরু করে রাত দুটোয়। শুধু ঐ ঘর নয়, করিডরটাও জলে থৈ থৈ! নাইট-ওয়াচম্যান বাধ্য হয়ে ম্যানেজারকে ডেকে তোলে। ডাকাডাকি করে বোর্ডারের সাড়া না পেয়ে বাধ্য হয়ে ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে ঘর খুলে কলটা বন্ধ করা হয়। সে-রাত্রে বিকাশবাবু যে ঐ ঘরে ছিল না তার তিনটি সাক্ষী আছে! ম্যানেজার মনোহরবাবু, দারোয়ান রঘুবীর আর হোটেলবয় মদ্‌না!

বিকাশ যেন পাথরের মূর্তিতে রূপান্তরিত। হঠাৎ সম্বিত পেয়ে সে অনিতাকেই বলে ওঠে, তুমি না যাও তো এইসব আষাঢ়ে গল্প শুনতে থাক। আমি চললাম।

বাধা দিলেন আই. জি. ক্রাইম, জাস্ট ও মিনিট বিকাশবাবু! আপনাকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। যেখানে ইচ্ছে যাবার স্বাধীনতা আপনার এই মুহূর্তে আছে। কিন্তু আমার একটি পয়েন্ট-ব্ল্যাঙ্ক প্রশ্নের জবাব না দিয়ে গেলে আপনার সেই স্বাধীনতাটুকু আর থাকবে না। বলুন : সে রাত্রে কি আপনি ঐ হোটেলে রাত্রিবাস করেছিলেন?

বিকাশ দাঁড়িয়ে পড়ে। মাথাটা নিচু হয়ে যায় তার। কিন্তু স্পষ্ট উচ্চারণে বলে, না স্যার! রাতটা আমি প্রস্টিটুট-কোয়ার্টার্সে কাটিয়েছি!

ঘরে পুনরায় নিস্তব্ধতা ফিরে আসে।

বাসুই নীরবতা ভঙ্গ করে বলে ওঠেন, সে সম্ভাবনার কথাও আমি ভেবেছি। ব্যাচিলার মানুষ। এমনটা তো হতেই পারে। সেজন্য আমি বিকল্প আর একটি প্রমাণ নিয়ে এসেছি। একজোড়া ফিঙ্গার-প্রিন্ট। ডক্টর ব্যানার্জি, আপনি ফিঙ্গারপ্রিন্ট-এক্সপার্ট! অনুগ্রহ করে দেখুন তো, এই দুটি টিপছাপ কি একই ব্যক্তির?

দুখানি পোস্টকার্ড-সাইজ ফটোগ্রাফ তিনি বাড়িয়ে ধরেন ডক্টর ব্যানার্জির দিকে। তারপর এদিকে ফিরে বললেন, উনি ততক্ষণ পরীক্ষা করুন, আমি ইতিমধ্যে আপনাদের শোনাই—কীভাবে ঐ ফিঙ্গার-প্রিন্ট দুটি সংগ্রহ করেছি। একটি পাওয়া গেছে শিবাজীপ্রতাপের আলমারিতে রাখা বইয়ের বান্ডিল থেকে। যে প্যাকেটে সুকুমার রায়ের বইটি ছিল, সেই না-খোলা প্যাকেটের উপর। প্যাকেটটা পণ্ডিচেরী থেকে পোস্টাল পার্সেলে এসেছে। যে পিয়ন বিলি করেছে, যে-সব পোস্টাল কর্মচারী হ্যান্ডল করেছে তাদের কারও আঙুলের ছাপ নয়, কারণ কালিটা হচ্ছে সেই কালি যাতে ঠিকানাটা লেখা। অর্থাৎ যে লোকটা শিবাজীপ্রতাপকে পার্সেলে বইটা পাঠিয়েছিল।

বাসু-সাহেব থামলেন।

ডক্টর ব্যানার্জি সেই অবকাশে বলেন, পয়েন্টস্ অব সিমিলারিটি ষোলো, না, সতের…. না, না আরও নজরে পড়ছে…

—আপনি দেখতে থাকুন ডক্টর ব্যানার্জি…

—না, না আর দেখার দরকার নেই। দুটি আঙুলের ছাপ একই ব্যক্তির।

বোধ করি কথাটা কানে গেল না বাসু-সাহেবের। তিনি একই ভঙ্গিতে বলে চলেন, আর দ্বিতীয়খানি আমি সংগ্রহ করেছি নিতান্ত ঘটনাচক্রে। চন্দননগরে। যেহেতু ইন্ডিয়ান স্ট্যাম্প অ্যাক্ট, 1935, অ্যামেন্ডেড ইন্‌ 1955, ধারা নং 153 (c) -তে বলা হয়েছে যে, লাখ টাকার উপর যার মূল্যমান তেমন দলিলে সইয়ের সঙ্গে টিপছাপও দিতে হয়….

—নেভার হার্ড অব্ ইট! ইন্ডিয়ান স্ট্যাম্প অ্যাক্টের কত ধারা বললে যেন? জানতে চাইলেন ব্যারিস্টার এ. কে. রে।

বাসু হাসলেন, আপনাকে ধাপ্পা দিচ্ছি না স্যার; কিন্তু ঐ ধারাটা আউড়ে সন্দেহভাজন একটি ব্যক্তিকে সেদিন ধাপ্পা দিতে সক্ষম হয়েছিলাম। না হলে তার নিখুঁত ফিঙ্গারপ্রিন্ট সংগ্রহ করা আমার পক্ষে….

কথাটা শেষ হল না। হঠাৎ বিকাশ লাফ দিয়ে ঘরের ও-প্রান্তে সরে গেল।

ঘরসুদ্ধ সকলের দৃষ্টি গেল তার দিকে।

বিকাশের হাতে একটি উদ্যত রিভলভার।

প্রতিটি শব্দ স্পষ্ট উচ্চারণ করে বললে, ছয়টা চেম্বারে ছয়টা বুলেট! আই কনগ্র্যাচুলেট য়ু মিস্টার পি. কে. বাসু, বার-অ্যাট-ল। দুঃখ এটুকুই যে, ফাঁসির দড়িটা আমার গলায় পরানো গেল না; আর কী অপরিসীম দুঃখ! আমার সঙ্গে তোমার খেলাও শেষ হয়ে গেল। ছয়-নম্বর বুলেটটা আমার। পঞ্চমটা তোমার! বাকি চারজন কে কে আমাদের সঙ্গে যাবে তুমিই নির্বাচন করে দাও বাসু-সাহেব।

প্রত্যেকটি মানুষ যে যার আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে।

ঘরে সূচীপতন নিস্তব্ধতা

পরিস্থিতি যে একমুহূর্তে এভাবে বদলে যেতে পারে তা কেউ স্বপ্নেও ভাবেনি।

বাসু-সাহেব দু-হাত মাথার উপর তুলে দাঁড়িয়ে আছেন। নির্বাক। নিস্পন্দ। ভয় কতটা পেয়েছেন বোঝা গেল না। অসীম আত্মসংযম তাঁর। কিন্তু কথা যখন বললেন তখন তাঁর গলাটাও কেঁপে গেল। বললেন, আমিই তোমার একমাত্র রাইভাল বিকাশ! বাকি কজন নিরীহ প্রাণীকে…

—সে কী! সে কী! তুমিই না প্রমাণ করেছ আমি ‘হোমিসাইডাল ম্যানিয়াক’! …ডোন্ট মুভ! আই ওয়ার্ন য়ু!

শেষ সাবধানবাণীটা ঘোষাল-সাহেবকে। তিনি তিলমাত্র নড়েছিলেন।

বিকাশ আরও এক পা পিছিয়ে গেল। যাতে এক লাফে কেউ তার নাগাল না পেতে পারে। সেখান থেকে বলল, না, বাসু-সাহেব তোমার জন্য পঞ্চম বুলেটটা জমিয়ে রাখলাম। প্রথম বুলেটটা তোমার ঐ পঙ্গু স্ত্রীকে উপহার দিই বরং…

কিন্তু ট্রিগার টানবার অবকাশ সে পেল না। চকিতে ক্ষিপ্ত শার্দূল-শাবকের মতো তার দিকে লাফ দিল সুনীল। ষোল বছরের তারুণ্যে ভরপুর কিশোর! এক লাফে বিকাশের কাছে পৌঁছানো তার পক্ষে অসম্ভব! কারণ দূরত্ব যথেষ্ট! বিকাশ বিদ্যুদ্‌গতিতে পাশ ফিরে সুনীলকে লক্ষ্য করে ফায়ার করল। আশ্চর্য! তবু শূন্যে ডিগবাজি খেয়ে সুনীল উল্টে পড়ল না। তার বজ্রমুষ্টির আঘাতটা গিয়ে লাগল বিকাশের নাকে। নাকটা থেঁৎলে গেল। দরদর ধারে ওর নাক দিয়ে রক্ত পড়ছে! কিন্তু তা সত্ত্বেও বিকাশ ভূপতিত হয়নি। টাল সামলে নিয়ে সে পর পর তিনটি ফায়ার করল সুনীলকে লক্ষ্য করে। পয়েন্ট-ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জে!

চার-চারবার ট্রিগার টানা সত্ত্বেও ফায়ারিং-এর শব্দ শোনা গেল না একবারও।

এতক্ষণে পিছনের পর্দা সরিয়ে হুড়মুড়িয়ে ঘরে ঢুকেছে রবি বোস, তার সাঙ্গোপাঙ্গ সমেত। রবি বজ্রমুষ্টিতে ধরে ফেলেছে বিকাশের দুই বাহুমূল। পিছন থেকে। বিকাশ আপ্রাণ চেষ্টায় নিজেকে ছাড়িয়ে, বাসু-সাহেবকে লক্ষ্য করে আবার ফায়ার করতে চাইছে।

বাসুর হাতদুটি তখনো মাথার উপর তোলা। ঐ অবস্থাতেই বললেন, ওর চেম্বারে আরও দুটি বুলেট বাকি আছে, রবি। ওকে বাধা দিও না। ওকে আশ্ মিটিয়ে প্রতিশোধ নিতে দাও।

রবির হাত ছাড়িয়ে বিকাশ আবার ফায়ার করল। এবারও শব্দ হল না কিছু।

পিছনের পর্দা সরিয়ে ইতিমধ্যে ঘরে ঢুকেছে মক্‌কুল। সে বলে ওঠে, ব্রেথাই হাঁকপাক করতিছ্যান কর্তা! নাই! অ্যাড্ডাও গুলি নাই। ছয়টা বুলেটই আমার জের্-এ। দু-দুবার পাকিট মারছি! পেত্যয় না হয়, অ্যাই দ্যাহেন!

তার প্রসারিত তালুতে ছয়টি তাজা বুলেট।

বাসু এতক্ষণে ঊর্ধ্ববাহুমুদ্রায় ক্ষান্ত দিলেন। বললেন, আয়াম সরি ফর য়ু মিস্টার এ. বি. সি. ডি.। ফাঁসির দড়ি ছাড়া তোমার আর বিকল্প রইল না কিছু!

সকলের দিকে ফিরে বলেন, রবি তার ডিউটি করুক। আপনারা বসুন। ঊষার সমাপ্তিসঙ্গীতটা বাকি আছে!

রানী দেবী বলেন, শোকসভা। তাই সামান্য একটু মিষ্টিমুখের আয়োজন করেছি। বেশি কিছু নয়।

মনীশ বলল, এ-ছাড়া আমাদের মনে এখন যে প্রশ্নের পাহাড় জমে আছে! আপনি কী করে বুঝলেন?

রবি দ্বারের কাছে দাঁড়িয়ে ছিল। বিকাশের হাতে হ্যান্ডকাফ্ পরিয়ে বললে, বাঃ! আমি একাই ডিউটি করব? শুনতে পাব না?

—কেন পারবে না? ওর মাজার দড়িটা ঐ স্টীল আলমারির পায়ার সঙ্গে বেঁধে দাও! শুধু তুমি কেন, বিকাশবাবুরও ব্যাপারটা জেনে যাবার অধিকার আছে। আফটার অল, সেই তো নিয়োগ করেছিল আমাকে। পুলিসের উপর আস্থা না থাকায়

কৌশিক জানতে চায়, ঠিক কোন্ মুহূর্তটিতে আপনি নিঃসন্দেহ হলেন?

—যে মুহূর্তটিতে সেই মেন্টাল অ্যাসাইলামের ডাক্তারবাবু বললেন, চন্দননগরের মেডিক্যাল-রিপ্রেজেন্টেটিভ্ বিকাশ মুখার্জীকে তিনি ঘনিষ্ঠভাবে চেনেন। বছর-দুই আগে একদিন তিনি বিকাশবাবুর সঙ্গে ঐ কেসটি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছিলেন। শিবাজীপ্রতাপের গোটা কেস হিস্ট্রি—হানিফ মহম্মদের গলা টিপে ধরা থেকে সব কিছু।

সুজাতা বলে, কিন্তু আপনি সুইট-হোমের ঐ জলপ্লাবনের কথাটা কখন শুনলেন?

—শুনিনি তো! কিন্তু এটুকু জানতাম যে, মনোহর ঐ ঘরটা বিকাশবাবুকে সেরাত্রে ভাড়া দিতে চায়নি—কলে জল নেই বলে! অর্থাৎ বিকাশ জানত, কলে জল আসছিল না। ঘটনাটা সে রাত্রে ঘটেনি কিন্তু আমার বর্ণনা শুনে বিকাশের ধারণায় ওটা ঘটেছিল! সুইট-হোমের তিন-তিনটি প্রত্যক্ষদর্শীকে রুখতে সে প্রস্ কোয়ার্টার্সে যাওয়ার আষাঢ়ে গল্পটা ফেঁদে ফেলল। একবারও মনে হল না—প্রস কোয়ার্টার্সে রাত কাটাতে হলে হোটেলে আশ্রয় খোঁজা তার পক্ষে অযৌক্তিক!

—আর ফিঙ্গার-প্রিন্ট? পুলিসের ‘সীল’ করা প্যাকেটটাও তো আপনি দেখেননি।

—না, আমি দেখিনি। কিন্তু বিকাশও জানে না যে, আমি দেখিনি। ইনফ্যাক্ট—দুটো ফিঙ্গার-প্রিন্টই মিসেস্ চ্যাটার্জির সেই লিস্ট থেকে ফটো নেওয়া। ওটা ছিল আমার শেষ অস্ত্র! ততক্ষণে বিকাশবাবু মরিয়া হয়ে উঠেছে। পাঁচ-পা পিছিয়ে গেছে। তোমরা লক্ষ্য করোনি, কিন্তু তখন ওর ডান-হাত ছিল পকেটে। বেচারি তো জানে না, ইতিমধ্যে মক্‌কুল দুবার তার পকেট মেরেছে! একবার বুলেটগুলো বার করে নিতে, একবার ফাঁকা অস্ত্রটা ওর পকেটে ঢুকিয়ে দিতে!

এবার প্রশ্ন করে রবি, আপনি কী করে আন্দাজ করলেন যে শোকসভায় ও রিভলভার নিয়ে আসবে?

–চন্দননগরে ইচ্ছাকৃতভাবেই ওর সঙ্গে আমার একবার ধাক্কা লাগে। ওর ধারণা অনিচ্ছাকৃতভাবে। আমি অনুভব করেছিলাম—তার ডান পকেটে সব সময়েই একটি রিভলভার থাকে। তাই এই সমাজসেবীটির সাহায্য নিয়েছিলাম। মক্‌কুল নাকি শহর-কলকাতার চ্যাম্পিয়ান–’ইয়ে’।

মকবুল ঘোষাল-সাহেবের দিকে আড়চোখে একবার দেখে নিয়ে বলে, আর লজ্জা দিয়েন না ছার!

সুনীল জানতে চায়, আমার সিগারেট খাওয়ার কথা?

—স্রেফ আন্দাজ! ও বয়সে আমার জীবনেও অনুরূপ ঘটনা ঘটেছিল। আন্দাজটা ভ্ৰান্ত হলে তোমার জবাব হত— ‘নো’। তাতে ক্ষতিবৃদ্ধি হত না কিছু। কিন্তু সুনীল, তুমি ওর হাতে উদ্যত রিভালভার দেখেও কী ভাবে অমন করে ঝাঁপিয়ে পড়লে?

সুনীল লজ্জা পেল। বললে, বাবার সেই উবুড় হয়ে পড়ে থাকা চেহারাটা হঠাৎ চোখের সামনে ভেসে উঠেছিল, স্যার! নিজের মৃত্যুর কথাটা তখন আর আমার খেয়াল ছিল না। মনে হল, মরার আগে ওর নাকটা অন্তত থেঁৎলে দিয়ে যাব আমি!

ঘোষাল সাহেব বলেন, কাজটা তোমার হঠকারিতা হয়েছিল সুনীল। যাহোক, রবি ওর নাম-ঠিকানাটা আমাকে দিও তো।

অমল দত্ত বলে, আমার একটা প্রশ্ন আছে। মনু সেদিন আমার কাছে কেন টাকা নেয়নি

—আহ্! অমলদা! কী পাগলামো করছ!—চাপাকণ্ঠে ময়ূরাক্ষী প্রতিবাদ করে।

বাসু বলেন, হ্যাঁ। ওসব অবান্তর আলোচনা না করাই ভালো। অনেকের অনেক গোপন কথা ফাঁস হয়ে গেছে। এজন্য আমি দুঃখিত। কিন্তু আপনারা বিশ্বাস করুন, কাউকে বেইজ্জত করা বা অপমান করার উদ্দেশ্য আমার একতিলও ছিল না। আমি শুধু ‘টেম্পো’-টা তুলতে চাইছিলাম। উত্তেজনা আর কনফেশনের টেম্পোটা। জাল গুটিয়ে তোলার আগে এমনভাবে একটা মানসিক চাপ সৃষ্টি করার প্রয়োজন হয়। যাতে প্রকৃত অপরাধী ক্রমশ নার্ভাস হয়ে পড়ে; ডান-বাঁয়ে ক্রমাগত সকলের গোপন কথা ফাঁস হয়ে যেতে দেখে! না হলে বিকাশ আমার শেষ ধাপ্পাটা ধরে ফেলতো। ঐ ফিঙ্গার-প্রিন্টের ব্যাপারটা। কিন্তু ততক্ষণে তার উত্তেজনা তুঙ্গে উঠে গেছে। ওর বুদ্ধি আর কাজ করছে না। ও নিজেও ওর শেষ অস্ত্রটার উপর নির্ভর করতে শুরু করল। তাই বারে বারে পিছু হঠে যাচ্ছিল—সকলের নাগালের বাইরে। ডান হাতটা ওর অনেক আগেই পকেটে ঢুকেছে। কিন্তু এসব বিশ্লেষণ এখানেই বন্ধ থাক। আবার বলি, যদি কাউকে আঘাত দিয়ে থাকি অসৌজন্যমূলক প্রশ্ন করে, তবে আমি ক্ষমা চাইছি!

.

মূল কাহিনী শেষ হয়েছে। উপসংহারে বছর-দুয়েক পরেকার কয়েকটি তথ্য পেশ করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না।

একনম্বর : শিবাজীপ্রতাপ এখন ঐ চিলে-কোঠার ঘরে থাকেন। ডক্টর পলাশ মিত্রের চিকিৎসায় তিনি দিন দিন সুস্থ হয়ে উঠছেন। অন্য কোনও চাকরি করেন না। দিবারাত্র পরিশ্রম করে চলেছেন। চন্দননগরের একটি ট্রাস্ট-বোর্ড তাঁকে নাকি রিসার্চ স্কলারশিপ দিয়েছেন একটি গ্রন্থ রচনার জন্য : ‘প্রাচীন ভারতে গণিতচর্চা।’

ঐ ট্রাস্ট-বোর্ডে যে মহিলা সেক্রেটারী মোটা মাহিনায় নিযুক্ত হয়েছেন তাঁর নাম : অনিতা সেনরায়। শোনা যায়, তিনি ছিলেন ডক্টর চ্যাটার্জির রিসার্চ-অ্যাসিস্টেন্ট! তখন উপাধি ছিল গাঙ্গুলী। জনৈক ‘মুগ্ধভ্রমরের’ কৃতিত্বে বর্তমান উপাধি— সেনরায়।

স্বর্গত ডক্টর চট্টোপাধ্যায়ের বিধবা স্ত্রী মিসেস্ রমলা চট্টোপাধ্যায়ের সধবা অবস্থায় দেহান্ত ঘটেছে।

সুনীল আঢ্য এখন তার বাবার দোকানে বসে। সেকেন্ড ডিভিশনে সে স্কুল ফাইনাল পাশ করার পর পড়াশুনাটা আর চালায়নি।

গতবছর সাহসিকতার জন্য সে একটি পুলিস-মেডেল পেয়েছে।

একটা দুঃখের খবর : ময়ূরাক্ষীর এবছর বি. এ. পরীক্ষা দেওয়া হয়নি। অর্থাভাবে নয়। হেতুটা এই : পরীক্ষার সময় মিসেস্ ময়ূরাক্ষী দত্ত ছিলেন আসন্ন সন্তানসম্ভবা!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *