অ-আ-ক-খুনের কাঁটা – ১২

বারো

মিসেস চ্যাটার্জির বয়সটা আন্দাজের বাইরে। ‘কর্কটিকা-ডাস্টার’ ওঁর তনুদেহের ব্ল্যাকবোর্ডে লেখা কৈশোরের স্বপ্ন, তারুণ্যের উদ্দামতা, যৌবনের নিভৃতকূজনের সব ইতিকথা লেপে মুছে দিয়েছে! ব্ল্যাকবোর্ড ব্ল্যাঙ্ক! কঙ্কালসার দেহটি বিরাট ডবল্-বেড শয্যায় অর্ধশায়িত! পিঠের দিকে একাধিক উপাধান। হাত দুটি সবল, কারণ যুক্তকরে নমস্কার করে অম্লান হেসে বললেন, ‘ওয়েস্ট-এর ওয়েস্ট’ থেকে আজ প্রথম দেখলাম ‘প্যারী ম্যাসন্ অব দ্য ইস্টকে।’ বসুন।

প্রথম ‘ওয়েস্ট’-এর স্বরান্ত এবং দ্বিতীয় ‘ওয়েস্টের দীর্ঘায়ত উচ্চারণে বাসু-সাহেবের মনে হল—ঐ শয্যালীন মহিলাটি এক কালে বেণী দুলিয়ে স্কিপিং করতেন—কোনও কনভেন্ট স্কুলে। আর ওঁর অম্লান হাসিটি দেখে অনুভব করলেন—যন্ত্রণাদায়ক ক্যানসার রোগও পারেনি ওঁর সব কিছু মুছে দিতে। আরও মনে হল, ডক্টর চ্যাটার্জি ‘প’ অক্ষর পর্যন্তই লিখে গেছেন। ‘ম’ অক্ষরে উপনীত হয়ে তিনি লিখে যাবার সময় পাননি: ‘আমি ‘মৃত্যু’ চেয়ে বড়, এই শেষ কথা বলে, যাব আমি চলে!”

বাসু-সাহেব ওঁর শয্যাপার্শ্বে বসে পড়লেন। কঙ্কালসার হাত দুটি তুলে নিয়ে বললেন, ‘ওয়েস্টের ওয়েস্ট’ কেন বলছেন মিসেস চ্যাটার্জি, সূর্য তো প্রতিদিন অস্ত যায়, উদিত হবার প্রতিজ্ঞা নিয়ে। এই তো কদিন আগে জগদ্ধাত্রীর বিসর্জন হল। কিন্তু ‘বিসর্জন’ তো ‘নেমেসিস্’ নয়—বি পূর্বক সৃজ-ধাতুর অ’—বিশেষ রূপে জন্ম নেওয়া। ধাতুটা ‘সৃজ্‌’! বিসর্জনের মন্ত্র: পুনরাগমনায় চ।

মনে হল, ভারি তৃপ্তি পেলেন ভদ্রমহিলা। মিনিটখানেক চোখ বুজে স্থির থেকে বললেন, আমার নাম রমলা। আপনি আমাকে নাম ধরেই ডাকবেন।

বাসু বলেন, তোমার কি কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে, রমলা?

—এখন হচ্ছে না। যখন ‘স্প্যাজম্’ আসে, তখন হয়। যাই হোক, আপনার সঙ্গে আমার কয়েকটা গোপন কথা আছে, বাসু-সাহেব। ওদের যেতে বলুন।

বাসু এদিকে ফিরলেন। ঘর ছেড়ে একে একে সকলে বার হয়ে গেল। এমনকি শুক্লা, অনিতাও।

—দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে এখানে এসে বসুন।

বাসু ওঁর আদেশ তামিল করার পর রমলা দেবী বালিশের তলা থেকে একগোছা চাবি বের করে বললেন, ঐ গোদরেজ-এর আলমারিটা খুলুন। এইটা বাইরের চাবি, এইটা সিক্রেট-ড্রয়ারের।

বাসু বিনা বাক্যব্যয়ে নির্দেশমতো কাজ করার পর মহিলা বললেন, একটা চন্দন-কাঠের বাক্স আছে না? বাঁদিকে। উপরে হাতির-দাঁতের কাজ-করা। পেয়েছেন? ওটা নিয়ে আসুন।

দেখা গেল তাতে খান কয়েক গিনি আছে। আর একটা ফর্দ। গহনার ফর্দ।

রমলা ওঁকে জানালেন—এই গহনাগুলি আছে ওঁর কলকাতার সেফ্-ডিপজিট ভল্টে। সব তাঁর স্ত্রীধন—বিবাহের যৌতুক, অথবা পরে উপহার পাওয়া, বা ক্রয় করা। বললেন, প্রতিটি গহনার পাশে তিনি এক-একজনের নাম লিখে সই করে দিতে চান, যাতে তাঁর অবর্তমানে…

বাসু বাধা দিয়ে বললেন, এতদিন এসব করে রাখেননি কেন?

তিনি যে মহিলাটির ব্যক্তিত্বে অভিভূত হয়ে নিজের অজান্তেই আবার ‘আপনি’-তে ফিরে গেছেন, তা টের পাননি।

—উনি রাজী ছিলেন না। সুপারস্টিশান! ওটা লিখলেই নাকি আমি মরে যাব। ওটা লেখা হয়নি, একথা যতদিন আমার মনে থাকবে ততদিন মনের জোরেই আমি নাকি বেঁচে থাকব! আচ্ছা বলুন তো! এসব নিছক পাগলামি নয়? তাছাড়া এই যন্ত্রণা নিয়ে পঙ্গু হয়ে আমি কি বেঁচে থাকতে চাই?

বাসু-সাহেবের মনে পড়ে গেল,—এ প্রশ্নটা তিনি জীবনে এই প্রথম শুনছেন না। সে প্রিয়জনটি কিন্তু ক্যান্সারে ভুগছিল না। উনি প্রশ্ন করলেন, আপনি ঠিক কী করতে চাইছেন?

—ঐ লিস্ট-এ প্রতিটি গহনা কাকে দিচ্ছি তা লিখে আমি সই করে দেব। কাগজখানা আপনার কাছে থাকবে। আমার মৃত্যুর পর আমার গহনার ভাগ কীভাবে হবে তার বিলিব্যবস্থা আপনাকে করে দিতে হবে। আর একথা আপনি ওঁকে জানাবেন না। উনি দিল্লী থেকে ফিরে আসতে আসতেই আমার যদি কিছু হয়ে যায়…

বাসু অন্ধকারে একটা ঢিল ছুঁড়লেন, উনি কবে ফিরছেন? আপনাকে কিছু বলে গেছেন?

—না! সে সময় আমার একটা ক্রাইসিস্ চলছিল। যাবার সময় দেখা করেও যেতে পারেনি। তবে দিল্লীতে পৌঁছে চিঠি দিয়েছে। লিখেছে, সেন্ট্রাল গভর্নমেন্ট থেকে ওর রবীন্দ্র অভিধান বাবদে একটা ‘গ্র্যান্ট’ না ‘রিসার্চ-স্কলারশিপ’ দেবার সম্ভাবনা আছে, ও তাই নিয়ে দরবার করতে গেছে। ফিরতে কিছু দিন দেরী হবে। তার আগেই যদি…

এ সংবাদটা চমকপ্রদ বৈকি। দিল্লী থেকে স্বর্গীয় চন্দ্রচূড় চট্টোপাধ্যায় মহাশয়ের পত্রপ্রেরণ। কিন্তু কৌতূহল দেখানো চলে না। বাসু বলেন, সেন্ট্রাল গভর্নমেন্ট-এর কোন ডিপার্টমেন্ট? রবীন্দ্রনাথের বিষয়ে সেন্টারের এত দরদ…

—এই দেখুন না।—অম্লানবদনে বালিশের তলা থেকে একটি খাম বার করে দিলেন। খামের উপর টাইপ করা মিসেস্ রমলা চট্টোপাধ্যায়ের নাম-ঠিকানা। পোস্টাল ছাপটা পরিষ্কার নয়াদিল্লীর। বাসু ইতস্তত করে বলেন, ওঁর আপনাকে লেখা চিঠি আমি পড়ব?

—এমন কিছু প্রেমপত্র নয়। আমাদের বিয়ে হয়েছে একুশ বছর আগে। পড়ুন।

খামের ভিতর থেকে চিঠিখানা বার করলেন। টাইপ করা চিঠি। আদ্যন্ত ফরাসী ভাষায়। সম্বোধনেই হোঁচট্ খাবার অভিনয় করে বললেন, ‘মঞ্চেরি’ মানে? আপনার আর এক নাম কি ‘মঞ্চেরি’?

হাত বাড়িয়ে খামটা ফেরত নিলেন রমলা দেবী। হাসতে হাসতে বলেন, ‘মঞ্চেরি’ নয়, Mon Cheri—ফরাসী শব্দ একটা। আদরের ডাক: ‘আমার প্রিয়!’ আদ্যোপান্ত চিঠিটাই ফরাসী ভাষায় লেখা!

বাসু বলেন, আপনারা কি ফরাসী ভাষায় প্রেমপত্র আদান-প্রদান করতেন?

—উপায় কি? আমি স্কুল-কলেজে পড়েছি পারীতে। আমার বাবা ছিলেন পারীর ইন্ডিয়ান এম্ব্যাসীতে, ফরেন সার্ভিসে। ইংরাজীটা পরে শিখেছি। আর উনি যেটায় ডক্টরেট করেছেন সেই বাঙলা সামান্যই জানি। যাক্ কাজের কথায় আসুন। এ লিস্টটা বানিয়ে আপনি আমার এক্সিকিউটার হিসাবে কি….

—নিশ্চয়ই করব। বলুন আপনি একে একে।

লিস্টে পঁয়ত্রিশটা আইটেম! প্রত্যেকটি গহনার নিখুঁত বিবরণ ও ওজন উল্লিখিত। উনি একে একে বলে গেলেন—কে কোনটা পাবে। অনিতা পাবে হীরের নেকলেস্-ছড়া, আর মকরমুখী বালা। শুক্লা ছ-গাছা চুড়ি। উমা (বলাইয়ের স্ত্রী) মফচেনটা, বুধির-মা (ঝি) কানবালা, সীতা (দরোয়ানের ঘরওয়ালী) দুগাছা চুড়ি ইত্যাদি ইত্যাদি। অধিকাংশই বাসু-সাহেবের অপরিচিতা—তাদের বিশদ পরিচয়ও লিখে নিলেন। তারপর প্রশ্ন করলেন, বিকাশবাবুর ভাবী বধূকে কিছু দিচ্ছেন না?

—বাকি সম্পত্তিটাই তো তার। উনি যাবতীয় সম্পত্তি আমার নামে উইল করে দিয়েছেন। আমি আর কতদিন? আর আমার একমাত্র ওয়ারিশ তো খোকনই, আই মীন, বিকাশ! দিন এবার, সই করে দিই।

বাসু বলেন, না! এখনই নয়। অন্তত দুজন সাক্ষীর সামনে সইটা করবেন। আমি সুজাতা আর বিকাশবাবুকে ডাকি বরং।

—বিকাশের বদলে অনিতাকে ডাকলে হয় না?

—না। হয় না। অনিতা একজন ‘বেনিফিশিয়ারি’, মানে তাকেও আপনি কিছু দিচ্ছেন যে।

অগত্যা এরপর বিকাশ ও সুজাতাকে ডেকে উনি ব্যাপারটাকে বুঝিয়ে দিলেন। সাক্ষী হিসাবে ওঁদের দুজনকে সই দিতে হবে। রমলা সই দিলেন। বাকি তিনজনও দিলেন। এরপর বাসু-সাহেব সুজাতাকে বলেন, ডক্টর চ্যাটার্জির স্টাডিরুমে একটা স্ট্যাম্প-প্যাড দেখছি। ওটা নিয়ে এস। চারজনের টিপছাপও নিতে হবে।

বিকাশ বললে, টিপছাপের কী দরকার? সই করেই দিলাম তো?

বাসু তার দিকে তাকিয়ে বলেন, এম.এ. পাস করার পর কিছুদিন ‘ল’ পড়েছিলে বুঝি?

—না তো! কেন?

—লাখ টাকার উপর যার মূল্যমান তেমন দলিলে সইয়ের সঙ্গে টিপছাপও দিতে হয়। ইন্ডিয়ান স্ট্যাম্প অ্যাক্ট, 1935, অ্যামেন্ডেড ইন 1955, ধারার নং 135 (c).

বিকাশ আর উচ্চবাচ্য করল না। সুজাতা স্ট্যাম্প-প্যাডটা নিয়ে এল। সকলের টিপছাপ নিয়ে কাগজখানা পকেটস্থ করলেন বাসু! রমলা বললেন, খোকন, তোরা আবার বাইরে যা। ওঁর সঙ্গে আমার আরও কিছু কথা আছে।

দ্বিতীয়বার ঘর নির্জন হলে রমলা তাঁর চন্দনকাঠের বাক্স থেকে তিনখানি গিনি তুলে নিয়ে বাসু-সাহেবকে দিলেন, বললেন দুটো আপনার ‘ফি’ আর একটা সুজাতাকে আমার উপহার। এবার আলমারিটা বন্ধ করে চাবিটা আমাকে দিয়ে যান।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *