অ-আ-ক-খুনের কাঁটা – ৪

চার

সকাল নটার মধ্যেই বাসুসাহেব বর্ধমান সদর থানায় উপস্থিত হলেন। মৃতদেহ তার পূর্বেই সদর হাসপাতালে অপসারিত হয়েছে। পোস্টমর্টেম হয়নি। তবে পুলিসের অভিজ্ঞ চোখে মৃত্যুর কারণটা স্পষ্ট—ওর গলার দুদিকে পাঁচ-পাঁচটা আঙুলের স্পষ্ট দাগ : শ্বাসরোধ করে হত্যা।

বর্ধমান থানার ও. সি. আবদুল সাহেব এবং রবি বোস ইতিমধ্যে প্রাথমিক তদন্ত পর্যায়টা শেষ করেছে। গতকাল সারা বর্ধমান প্লেন-ড্রেস পুলিসে ছেয়ে রাখা হয়েছিল। লোকাল টেলিফোন গাইডে ‘B’ অক্ষর দিয়ে যে কটা উপাধি আছে প্রত্যেকটি বাড়িতে টেলিফোন করে আবদুল সাহেবের সহকর্মী একটা রহস্যময় বার্তা জানিয়েছেন : ‘থানা থেকে বলছি। আপনাদের বাড়িতে আজ একটা হামলা হওয়ার গোপন ‘টিপ্‌স’ আমরা পেয়েছি। কথাটা জানাজানি করবেন না। পুলিসে নজর রাখছে। আপনারা নিজেরাও একটু সাবধান থাকবেন। বেশি রাত পর্যন্ত বাড়ির কেউ বাইরে না থাকাই বাঞ্ছনীয়।’

অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নানান জাতের প্রতিপ্রশ্ন হয়েছে—কী জাতের হামলা? ডাকাতি? পলিটিক্যাল? কোন সূত্রে জেনেছেন আপনারা?

প্রতিক্ষেত্রেই একই জবাব : আতঙ্কগ্রস্ত হবার দরকার নেই। পরিবারস্থ মানুষজনের বাইরে কাউকে কিছু বলবেন না। ঝি-চাকরদেরও নয়। এর বেশি কিছু আপাতত বলতে পারছি না। আজ রাতটা কেটে গেলে বুঝবেন ‘টিপ্‌সটা’ ভুল ছিল।

কেউ কেউ অতি-সাবধানী একটু পরে রিং ব্যাক করে জেনে নিয়েছিলেন— থানা থেকে সত্যিই একটু আগে ফোন করা হয়েছিল কিনা।

যতই গোপন করার চেষ্টা হোক খবরটা গোপনে পাবলিসিটি পায়। সারা শহরে একটা চাপা উত্তেজনা। কী—কেন—কার বরাতে ঘটতে যাচ্ছে তা কেউ জানত না—কিন্তু জীপের আনাগোনা যে হঠাৎ প্রচণ্ড বেড়ে গেছে এটাও শহরের মানুষের নজর এড়ায়নি। লোড-শেডিং হয়নি—উপর মহল থেকে কঠিন সতর্কবাণী এসেছিল, সাতাশে রাত্রে যেন গোটা বর্ধমান এলাকায় একেবারে লোড-শেডিং না হয়। প্রয়োজনে আর সব কটা সার্কিট বন্ধ করেও!

মৃতদেহ যিনি আবিষ্কার করেন তাঁর নাম মনীশ সেন রায়। অ্যান্ড্রুইউলের অফিসার। ব্যাচেলার। বয়স পঁয়ত্রিশ। বর্ধমান থেকে ডেলি প্যাসেঞ্জারি করেন। ফার্স্ট ক্লাস মাহুলি আছে। বনানীকে চেনেন—ব্যক্তিগতভাবে নয়, বর্ধমানের একজন উদীয়মানা অভিনেত্রী হিসাবে। তাঁর জবানবন্দির সংক্ষিপ্তসার এই রকম :

সচরাচর সেন রায় সাহেব সন্ধ্যা ছ’টা দশের ব্ল্যাক ডায়মন্ড ধরে রাত আটটার মধ্যে বর্ধমানে পৌঁছে যান। পূর্বরাত্রে, অর্থাৎ সাতাশে একটি নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে হয়েছিল কলকাতায়। তাই বাধ্য হয়ে মেন-লাইনের শেষ বর্ধমান লোকালটা ধরে ফিরছিলেন। প্রথম যে ফার্স্ট ক্লাস কামরাটায় ঢোকেন তার নিচের দুটি বেঞ্চিতেই চাদর পাতা। একটিতে একজন লোক শুয়ে ছিল আপাদমস্তক চাদর মুড়ি দিয়ে। বিপরীত বেঞ্চিতে জানলার ধারে একা বসেছিল বনানী। তার পরনে হালকা নীল রঙের একটা মুর্শিদাবাদী, গায়ে ঐ রঙেরই ব্লাউজ। উপরের বার্থ দুটি খালি। সেন রায়ের সঙ্গে বনানীর চোখাচোখি হয়। বনানী ওঁকে না চিনবার ভান করে। সম্ভবত বনানী ওঁকে চিনত না–বর্ধমানের একজন ডেলিপ্যাসেঞ্জার বলে হয়তো সনাক্ত করতে পারত। অথচ উনি জানতেন, বনানী অভিনেত্রী, এবং তার অনেক পুরুষ ‘ফ্যান’ আছে। বনানীর দৃষ্টিতে একটা বিরক্তির ভঙ্গি লক্ষ করে উনি বুঝতে পারেন,—চাদর মুড়ি দিয়ে শোয়া সহযাত্রীটি ওর ‘নাগর’! তাই উনি পাশের কামরায় গিয়ে বসেন। বনানীর সহযাত্রীটিকে উনি দেখেননি; কিন্তু তার পায়ে ফিতেবাঁধা পুরুষদের জুতোটা চাদরের বাইরে বার হয়ে ছিল। তাতেই উনি আন্দাজ করতে পারেন যে, সে লোকটা পুরুষ।

ট্রেন যখন ব্যান্ডেল ছাড়ে—রাত বারোটা নাগাদ—তখন উনি একবার বাথরুমে যান। লক্ষ করে দেখেন, ঐ কামরার দরজাটা-টানা। ভেতর থেকে বন্ধ কিনা তা জানতেন না অবশ্য। পরীক্ষা করে দেখেননি।

মনীশবাবুর অভিজ্ঞতায় বর্ধমান লোকালের শতকরা নব্বই ভাগ যাত্রী বর্ধমানের আগেই নেমে পড়ে। গভীর রাতের ট্রেন হলে শেষপ্রান্তের যাত্রীরা ঠাঁই বদল করে এক কামরায় এসে জোটেন, ছিনতাই-পার্টির বিরুদ্ধে যৌথ প্রতিরোধের জন্য। এমনকি ফার্স্ট ক্লাস নির্জন হয়ে গেলে সেকেন্ড ক্লাসেও চলে আসেন। ওঁর কামরায় শেষ প্যাসেঞ্জারটি শক্তিগড়ে নেমে গেলে উনি কামরা বদলে এ ঘরে চলে এলেন। দেখলেন, দরজাটা তখনও বন্ধ। কৌতূহলবশে পাল্লাটা ধরে টানতেই সেটা খুলে গেল। উনি অবাক হয়ে দেখলেন, বনানী একা নিচের বেঞ্চেই লম্বা হয়ে ঘুমোচ্ছে। কামরায় দ্বিতীয় প্রাণীটি নেই। বনানী উল্টো দিকে মুখ করে ঘুমোচ্ছিল। মনীশবাবু রীতিমতো বিস্মিত হয়ে যান। ঐ বয়সের একটি মেয়ে দরজা খোলা রেখে এমন অরক্ষিত কামরায় এত রাত্রে এভাবে ঘুমোয় কী করে! যাই হোক ট্রেন গাংপুর স্টেশান পার হলে তিনি বারকয়েক ওকে নাম ধরে ডাকলেন। ওর নাম যে ‘মিস্ বনার্জি’ তা জানা ছিল মনীশের। মেয়েটি সাড়া দিল না। তখন বাধ্য হয়ে ওর কাঁধ ধরে ঝাঁকানি দিলেন। এবং তৎক্ষণাৎ বুঝতে পারেন ও অজ্ঞান হয়ে আছে, ঘুমোচ্ছে না। ট্রেন থামতেই উনি ছুটে গিয়ে গার্ডকে ডেকে আনেন। তখন বোঝা যায়–বনানী অজ্ঞান নয়, মৃত!

ব্যাপারটা ঘোরালো। অত্যন্ত ঘোরালো—যদি মনীশ সেন রায় আদ্যন্ত সত্য কথা না বলে থাকে।

ও. সি. ওঁকে সে-কথা বেশ স্পষ্টভাবেই জানিয়ে দিয়েছেন, মিস্টার সেন রায়, বুঝতেই পারছেন পুলিস-অফিসার হিসাবে আমাকে এটুকু করতেই হবে। আপনার স্টেটমেন্ট অনুসারে আপনি সাধারণ নাগরিকের কর্তব্যই করেছেন; কিন্তু আপনার স্টেমেন্ট করোবরেট করবার কোনও উপায় নেই। একটি নির্জন রেল কামরায় ছিলেন আপনারা মাত্র দুজন। আপনি আর মৃত বনানী

মনীশ সেন রায় রুখে উঠেছিল, আপনি কি সন্দেহ করছেন—আমি খুন করেছি?

—না। কারণ তা করলে আপনাকে অ্যারেস্ট করতাম। তা করছি না। কিন্তু ‘বর্ধমান-কলকাতা’ ছাড়া আপনি এক সপ্তাহ আর কোথাও যাবেন না। গেলে থানাকে জানিয়ে যাবেন। আপনি অফিস-বাড়ি যেমন করছেন তেমনিই করবেন। শুধু আজকের দিনটা ছুটি নিন। কলকাতা থেকে হায়ার-অফিসাররা একোয়ারিতে আসবেন।

—কিন্তু আমার যে সকাল এগারোটায় অফিসে একটা জরুরী অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে। –আপনি আপনার ‘বস’-এর নাম আর টেলিফোন নাম্বারটা দিন, আমি টেলিফোনে তাঁকে জানিয়ে দেব।

—ধন্যবাদ! সেটুকু আমিই করতে পারব। শুধু আজকের দিনটাই তো?

—হ্যাঁ। আয়াম সরি ফর দ্য ট্রান্স্।

—না! আপনার দুঃখিত হবার কী আছে? আমারই ভুল! গার্ডকে না ডেকে আমার নিঃশব্দে কেটে পড়া উচিত ছিল।

আবদুল মহম্মদ হেসে বলেছিলেন, সেটাই ভুল হত আপনার। কারণ তাহলে এতক্ষণে আপনি থাকতেন আমার লক্-আপে!

বনানীর বাবা, মা অথবা ছোট বোন ময়ূরাক্ষীর জবানবন্দি এখনো নেওয়া যায়নি। মানে, তাদের মানসিক অবস্থা বিচার করে। তবে ওদের প্রতিবেশীদের জবানবন্দি থেকে বোঝা গেছে, বনানী চিরকালই একটু ডাকাবুকো ধরনের। অতরাত্রে না হলেও বেশ রাত করে সে অনেকবার কলকাতা থেকে একা একাই ফিরে এসেছে। থিয়েটারে প্রতিরাত্রে ও দেড়শো টাকা করে পেত, তা ছাড়া যাতায়াত খরচ। অর্থাৎ মাসে প্রায় হাজার টাকা রোজগার করত। সুন্দরী, গ্ল্যামারাস, অভিনেত্রী। বদনাম কিছুটা থাকবেই। জনশ্রুতি সে নাকি সিনেমায় নামবার একটা চান্স পেয়েছিল। ভয়েস-টেস্টিং পর্যন্ত হয়ে গেছে। ফলাফল জানা যায়নি।

বাসুসাহেব বাধা দিয়ে বলেন, বাপ-মা-বোন কাউকেই জেরা করনি তোমরা, তাহলে এত খবর পেলে কার কাছে?

অমল দত্ত। বনার্জি মহাশয়ের নেক্সট-ডোর নেবার। সদ্যপাস ইলেক্‌ট্রক্যাল এঞ্জিনিয়ার। ও পরিবারের সঙ্গে খুবই ঘনিষ্ঠতা। ব্যাচিলার, কলকাতায় ফিলিপ্স-এ কাজ করে।

—হুঁ! তার মূল টার্গেটা কী? রিভার না ফরেস্ট?

—আজ্ঞে?

—সদ্যপাস ইলেকট্রিক্যাল এঞ্জিনিয়ার একটি সুপাত্র। প্রতিবেশীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হবার মূল প্রেরণাটা কোথায় ছিল? বনানী, না ময়ূরাক্ষী?

রবি হেসে বলে, আমার ধারণা : বনানী। না হলে এভাবে ভেঙে পড়ত না।

—আর ওঁদের উপাধিটা কী? বনার্জি না ব্যানার্জি?

—ঐ একই কথা। বনানীর বাবা একটা ‘জিনিওলজিক্যাল ট্রি’-র মাধ্যমে হঠাৎ আবিষ্কার করেছেন যে, তিনি স্বনামধন্য ডব্লু. সি. বনার্জির বংশধর। তাই যদিও ওঁর বাবা ছিলেন ব্যানার্জি উনি নিজের নাম লেখেন “বনার্জি’।

—বুঝলাম। তুমি ঐ দুজনের সঙ্গেই আমার ইন্টারভিয়ুর ব্যবস্থা করে দাও। মনীশ আর অমল দত্ত। আর পোস্ট-মর্টাম রিপোর্টটা এলে তার একটা কপি

আবদুল মহম্মদ বললে, ও রিপোর্টে নতুন করে জানবার কিছু নেই স্যার।

—য়ু থিংক সো? আমি জানতে চাই–বনানী হেভি ডোজ-এর কোনও ঘুমের ওষুধ খেয়েছিল কিনা, ওর স্টম্যাকে ভুক্তাবশিষ্ট কী কী পাওয়া গেছে, আহারের কতক্ষণ পর মৃত্যু হয়েছে এবং ওর দাঁতের ফাঁকে পান সুপুরির কুচি ছিল কিনা।

রবি বোস চোখ টিপে ওর সহকর্মীকে বারণ করল। আবদুল আর কিছু প্রশ্ন করল না।

.

মনীশ সেন রায় থানাতে জধানবন্দি দিতে এল রীতিমতো উদ্ধত ভঙ্গিতে। কিন্তু ঘরে ঢুকেই সে একটু থমকে গেল। বাসুসাহেব তখন একমনে পাইপে তামাক ভরছিলেন, মকটা তিনি লক্ষ করেননি। বললেন, প্লীজ টেক য়োর সীট মিস্টার সেন রায়। শুনুন, আমি পুলিসের লোক নই…

বাধা দিয়ে সেন রায় বলে, জানি স্যার! আপনাকে আমি চিনি। ইন্‌ ফ্যাক্ট, আপনার কথাই এতক্ষণ ভাবতে ভাবতে আসছিলাম….

—আমার কথা! হঠাৎ আমার কথা কেন?

-–এই মাথামোটা পুলিসগুলো নিশ্চয় আমার বিরুদ্ধে কেস সাজাবে। তখন আপনাকে আমার প্রয়োজন হবে—ডিফেন্স-কাউন্সেল হিসাবে। তাই।

—আই সী! না, মনীশবাবু! নাইন্টিনাইন-পয়েন্ট-নাইন পার্সেন্ট চান্স তোমার বিরুদ্ধে পুলিস কেস সাজাবে না। আর ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি—তুমি টু হান্ড্রেড-পার্সেন্ট নট্‌-গ্লিটি। আমরা যাকে খুঁজছি সে একটা ‘হোমিসাইড্যাল ম্যানিয়াক’! আধা পাগল! অ্যান্ড্রুইউলের অফিসার সে হতে পারে না।

—হোমিসাইড্যাল ম্যানিয়াক! কী করে জানলেন?

—সম্ভবত কাল-পরশুর মধ্যেই খবরের কাগজে তার বিস্তারিত বিবরণ পাবে। এখন তোমাকে যা জিজ্ঞাসা করব তার সত্য জবাব দিও। আমি গ্যারান্টি দিচ্ছি, আদালতে এসব প্রশ্ন উঠবে না। তা তুমি আসামীই হও অথবা সরকারপক্ষের সাক্ষীই হও। তুমি কি আমাকে আদ্যন্ত সত্য জবাব দেবে? খুনি লোকটাকে ধরতে সাহায্য করবে?

—বলুন স্যার? আমি ওয়ার্ড-অব্-অনার দিচ্ছি।

—বনানীর প্রতি কি তোমার কোনও সফ্‌ট-কর্নার ছিল? রোমান্টিক্যালি অথবা সেক্‌শ্যয়ালি? প্রশ্ন শুনে মনীশ স্তম্ভিত হয়ে গেল। নড়েচড়ে বললে, ছিল, স্যার। বনানী গ্ল্যামারাস মেয়ে; তার সেক্স-আপীল ছিল। স্টেজে এবং ট্রেনে তাকে বারে বারে দেখেছি। কিন্তু তার সঙ্গে আমার মৌখিক আলাপ ছিল না। কোনও দিন কথাবার্তা হয়নি।

—তুমি কি জান তার কোনও লাভার ছিল?

—সঠিক জানি না। আন্দাজ করেছি এবং লোকমুখে শুনেছি সে কন্জারভেটিভ ছিল না।

—মীনিং…পয়সা খরচ করতে রাজি হলে সে লিবারাল হলেও হতে পারত। নতনেত্রে মনীশ বললে, হ্যাঁ, অনেকটা তাই।

—তুমি নিজে কখনো চেষ্টা করেছিলে?

—না, করিনি। আমার মানসিক গঠন সে জাতের নয়। তার সঙ্গে আমার যে আলাপই ছিল না।

—ও কি একা-একা যাতায়াত করতো? কখনো কোনও এস্কর্ট তোমার নজরে পড়েনি?

—অন্ দ্য কন্ট্রারি, ওর সঙ্গে বরাবরই একজন থাকত। ওরই প্রতিবেশী। নামটা ঠিক জানি না। ফিলিপ্স-এর এঞ্জিনিয়ার।

—ওর অভিনয় তুমি দেখনি?

—বহুবার।

—‘কুশীলব’-এ কি ওর কোনও প্রেমিক ছিল?

—আমি ঠিক জানি না, স্যার।

—ঠিক আছে। আজ এই পর্যন্তই। তবে মনে হচ্ছে তোমাকে আবার আমার প্রয়োজন হবে। সময় হলে তোমাকে ডেকে পাঠাব।

অমল দত্ত জবানবন্দি দিতে এল ঝোড়ো কাকের চেহারা নিয়ে। চুলগুলো শুধু অবিন্যস্তই নয়, বুশ-শার্টের বোতামগুলো এক এক-ঘর ভুল ফুটোয় ঢোকানো। তার মুখে নিদারুণ বেদনা, হতাশা আর বিরক্তি। রবি বোস বলল, বসুন অমলবাবু।

অমল সে কথায় কান দিল না। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বলল, আপনারা আর ক-দফা জবানবন্দি নেবেন বলুন তো মশাই?

ও. সি. বলেন, ক্ষুব্ধ হবেন না অমলবাবু। আমাদের উদ্দেশ্যটা তো বুঝছেন। ইনি কলকাতা থেকে এসেছেন…

—অ! তা প্রশ্ন করুন। কী জানতে চান?

বাসু মনে মনে একটা ওকালতি লব্‌জ উচ্চারণ করলেন : ‘হোস্টাইল উইটনেস্’! মুখে বললেন, কাল রাত দুটো নাগাদ আপনি কোথায় ছিলেন অমলবাবু?

—টু ফিফটিন-আপ বর্ধমান লোকালের ফার্স্ট ক্লাস কামরায়। কেন? রবি এবং আবদুল যেন শক্ খেয়েছে। সোজা হয়ে বসে দুজনেই বাসু নির্বিকারভাবে বলেন, আই সী! যে কামরায় বনানী ছিল?

—না হলে তাকে হত্যা করব কী করে? আমিই তো গলা টিপে তাকে মেরেছি। কেন, জানেন না? এঁরা তো সকলেই জানেন।

আবদুল আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে পড়েছে। রবিও সরে গেছে ওর কাছাকাছি। একটা হাত তার পকেটে। বাসুসাহেব কিন্তু এখনো নির্বিকার। বললেন, ফর য়োর ইনফরমেশান, মিস্টার দত্ত। আমি পুলিসের কেউ নই।

—অ! –এতক্ষণে অমল দত্ত বসে পড়ে চেয়ারে। বলে, আপনি ব্যক্তিটি কে?

—আমি একজন ভারতীয়। পুলিসে যখন আততায়ীকে ধরবার চেষ্টা করে তখন মিথ্যা কথা বলি না। যতই ক্ষুব্ধ হই, যতই মানসিক আঘাত পাই। আপাতত এটুকুই আমার পরিচয়।

অমল এবার ওঁকে ভালো করে দেখে বললে, আয়াম সরি, স্যার! আপনি পি. কে. বাসু। কাগজে আপনার ছবি দেখেছি। কী জানেন স্যার, সকাল থেকে এঁরা আমায় জেরবার করে দিচ্ছেন। যেন মানুষের ব্যক্তিগত সেন্টিমেন্ট বলে কিছু থাকতে নেই…আমার একমাত্র অপরাধ আমি বনানীকে ভালোবাসতাম।

—আই সী! এখন কি শান্তভাবে আমার প্রশ্নের জবাব দিতে পারবে? না, আমি পরে তোমাকে ডেকে পাঠাব? তোমার মানসিক ভারসাম্য ফিরে এলে?

—আয়াম এক্সট্রিমলি সরি স্যার! না, না, আমি ঠিক আছি। কাল আমি ঠিক ওর আগের দশটা পঞ্চান্নর কর্ড লাইনের লোকালটায় বর্ধমানে ফিরে আসি। রাত দুটোয় আমি বাড়িতে ঘুমোচ্ছিলাম।

—তুমি কি বনানীকে তোমার মনোভাব কখনো জানিয়েছিলে?

অমল পুলিস-অফিসার দুজনের দিকে দেখে নিয়ে বললে, এঁদের সামনে আমি সেসব কথা বলব না স্যার। আপনি যদি জনান্তিকে জানতে চান এবং এসব কথা খবরের কাগজে ছাপা হবে না গ্যারান্টি দেন…

বাসু-সাহেব পুলিস-পুঙ্গবদ্বয়ের দিকে ফিরে বলেন, তোমরা কী বল?

আবদুল কিছু বলার আগেই রবি বলে ওঠে, থানার ভিতর সেটা অনুমোদনযোগ্য নয়। তবে জীপ রেডি আছে। আপনি মিস্টার দত্তকে নিয়ে রেস্ট হাউসে চলে যান। সেখানে উনি যা বলবেন তা উকিলকে বলা ‘প্রিভিলেজড্ কনফেশন’। আমাদের এক্তিয়ারের বাইরে।

বাসু-সাহেব খুশি হলেন রবির উপস্থিত বুদ্ধি দেখে। উপযুক্ত সহকর্মী বেছে নিয়েছেন তিনি। রবি ভালোভাবেই জানে—অমল দত্ত বাসু-সাহেবের মক্কেল নয়, সে যা বলবে তা আদৌ ‘প্রিভিলেজড্ কনফেশন’ নয়; কিন্তু এভাবেই অমলের আত্মম্ভরিতা বা ‘ইগো’ চরিতার্থ হবে। এভাবেই তার কাছ থেকে ভিতরের কথা বার করা যাবে।

রেস্ট-হাউসে দু’কাপ কফি নিয়ে বাসু-সাহেব অমল দত্তের এজাহারটা শুনলেন।

হ্যাঁ, অমল দত্ত বনানীকে ভালোবাসে, মানে বাসতো। সে কথা সে তাকে বহুবার বলেছে। বনানী সব কিছুই হেসে উড়িয়ে দিত। তার মনোভাবটা বোঝা যায়নি কোনওদিন। কখনো বলেছে, ‘বিয়ের পর তো তুমি আমাকে খাঁচায় ময়না করে রাখবে, থিয়েটার করতে দেবে না’, কখনো বলেছে, ‘আমরা ভিন্ন জগতের মানুষ, তুমি বাতি নেভাও, আর আমি বাতি জ্বালি।’ অমল হয়তো সবিস্ময়ে জানতে চেয়েছে—”তার মানে?’ আর বনানী খিলখিল করে হেসে বলেছে—’আমি স্টেজে ঢুকলে স্পট-লাইট আমার মুখে পড়ে, দেখনি? আর তুমি? ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার—যার একমাত্র কাজ লোড-শেডিং-এর এন্তাজাম করা!’

মোট কথা, বনানীর মনোভাবটা বোঝা যায়নি। তবে অমলকে সে যথেষ্ট প্রশ্রয় দিত। অমল বর্ধমানে ওর প্রতিবেশী। ওরা প্রায়ই এক ট্রেনে যাতায়াত করত। একসঙ্গে কলকাতায় ঘোরাঘুরি করত।

বাসু-সাহেবের মনে হল–বনানী যে অমলকে নিয়ে খেলা করতো তার দুটো উদ্দেশ্য। প্রথমটা হচ্ছে স্বভাবগত—পুরুষমানুষকে নিয়ে খেলা করায় তার আমোদ; দ্বিতীয়টা আত্মরক্ষার্থে—অবাঞ্ছনীয় পুরুষমানুষকে দূরে হটাতে। অমল ছিল বনানীর ‘গ্লোরিফায়েড এস্কর্ট’–রাঙতার সাজপরা দেহরক্ষী।

অমল জানালো, বনানীর একাধিক পুরুষবন্ধু ছিল। ওর ধারণা, এইটা বনানীর স্বভাব। ওর আরও ধারণা, এই আপাত—’বেলেল্লাপনা’ একেবারে উপরকার জিনিস। অন্তরে মেয়েটা ছিল দারুণ ‘পিউরিটান’–অমলকে সে কোনওদিন চুমু পর্যন্ত খেতে দেয়নি।

মাসখানেক হল বনানী নাকি একজন বড়লোক কাপ্তেন ফিল্ম-প্রডিউসারের খপ্পরে পড়েছিল। অমল কখনো তাকে দেখেনি। তবে এটুকু জানে, লোকটা বিবাহিত আর বনানীর পিছনে দেদার খরচ করত। সে নাকি ওকে সিনেমায় নামিয়ে দেবার সুযোগ দিতে চাইছিল।

বাসু-সাহেব অনেক জেরা করেও সেই অজ্ঞাত কাপ্তেনবাবু সম্বন্ধে কোনও তথ্যই সংগ্রহ করতে পারলেন না।

অমলও ওঁকে শেষ পর্যন্ত অনুরোধ করল –বনানীকে যে এভাবে হত্যা করেছে তাকে খুঁজে বার করতে সে সব রকম সাহায্য করতেই প্রস্তুত।

বাসু-সাহেব তাকেও কথা দিয়ে এলেন, সময় হলে তোমাকে ডাকব।

মৃদুল শনিবারের চিঠি’র জন্য একটা ‘স্টোরি’ পেল কিনা বলা কঠিন, কিন্তু সুজাতা একটি মজাদার মেয়ের সন্ধান পেল। তার কণ্ঠটি সোনা দিয়ে বাঁধানো—কী গানে, কী বাকচাতুরীতে। ‘কুশীলব’-এর সবাই এবং ডোভার লেন-এর সকলেই মর্মাহত। কথা বলার মতো মন-মেজাজ নেই কারও। সবাই মুষড়ে পড়েছে। একমাত্র ব্যতিক্রম ঐ ঊষা বাগচী। স্থূলাঙ্গী এবং কুদর্শনা। কিছুটা ভগবান মেরে রেখেছেন, কিছুটা বা তার ভোজনপ্রিয়তা। তবু ‘কুশীলব’-এ তার ডাক পড়ে। কারণ ঊষা বাগচী মধুকণ্ঠী। ফরমাসী নাটক যখন লেখানো হয় তখন অন্তত এক সীনের অ্যাপিয়ারেন্সে ভিক্ষুণী বা বৈরাগিনী বেশে ঊষা একখানি গান গেয়ে যায়—নাটক মুহূর্তে ‘পয়োধি’! ওর সঙ্গে আলাপ করে সুজাতা বুঝতে পারে একমাত্র এই মেয়েটাই অতটা মুষড়ে পড়েনি। কিছুটা স্বভাবগত কৌতুকপ্রিয়তায়, কিছুটা বা ঈর্ষায়! জনান্তিক আলাপে সুজাতাকে ফিস্ ফিস্ করে বললে, কী বলব ভাই—অমন মৃত্যু যেন শত্রুরও না হয়; কিন্তু একথাও বলব—ওজাতের মেয়ে এভাবেই পটলোত্তোলন করে!

—ও জাতের মেয়ে মানে?—সুজাতা মেয়েলী কৌতূহল দেখায়।

—দিনরাত যে মেয়ে গুনগুন্ করে : ‘কে নিবি গো কিনে আমায়, কে নিবি গো কিনে?’

—ওর বুঝি অনেক পুরুষ ‘ফ্যান্’ ছিল?

—তা যদি বলেন, তা হলে বলব—’ফ্যান’ বস্তুটা হচ্ছে ‘নেসেসারি ঈভল’, শিল্পীর কাছে। আচার্য পি. সি. রায়ও তাই বলতেন—কিছুটা ‘ফ্যান’ হজম করা ভালো। তাই বলে কি গাঁৎ গাঁৎ করে শুধু ‘ফ্যান’ই গিলতে হবে? ফ্যানটা গেলে ফেলে ঝরঝরে ভাত খেতে হবে না? নিজের ঝকঝকে ঘর, নিজের তক্তকে বর, নিজের ববকে বাচ্চা?

সুজাতা হেসে বলে, শিল্পী পক্ষে ‘ফ্যান’টা বুঝি ‘নেসেসারি ইভল’?

—নয়? এই আমাকেই দেখুন না। কালো-মোটা! তাই বলে কি ‘ঊষা-ফ্যানে’র নাম কেউ শোনেনি? কিন্তু আমার কথা হচ্ছে—নিজের মান নিজের কাছে। চেনা নেই, অচেনা নেই, যে কেউ এসে পটাস্ করে ফ্যানের বোতাম টিপল আর অমনি বাঁই বাঁই পাক খেতে হবে?

সুজাতা সায় দেয়—বটেই তো। বনানীর বুঝি অনেক ‘লাভার’ ছিল?

—তা ছিল। বৃন্দাবনের কনভার্স থিয়োরেম। ষোড়শ গোপ! থিয়েটার শেষ হলে কাড়াকাড়ি পড়ে যেত কে ওকে ডোভার লেন তক্ এস্কর্ট করে নিয়ে যাবে!

—আপনি তাদের সবাইকে চেনেন?

—কিছু মনে করবেন না ভাই—এটা আপনার বোকার মতো প্রশ্ন হল! ষোড়শ গোপকে কি চিনে রাখা সম্ভব? বনানী নিজেই চিনতে পারত না। তবে হ্যাঁ—’হ্যান্ডসাম, স্মার্ট, টল, ফেয়ার’ এমন কয়েকটি বংশীবাদককে ভুলতে পারিনি। ভোলা শক্ত।

—বংশীবাদক? আপনার গানের সঙ্গে বাঁশী বাজাতেন বুঝি?

—আপনি ছেলেমানুষ অথবা অন্ধ! আমার খানদানী বদনখানা দেখছেন না? বংশী অর্থে এখানে ‘হর্ন’ বা ‘হুটার’! ‘শো’ শেষ হলেই সমস্বরে ওঁরা বংশীধ্বনি করে ‘ধনিকে ডাকতেন।

এর পরেই থিয়েটারের ম্যানেজার আর কৌশিক ওদের দিকে এগিয়ে আসে। ওদের রসসিক্ত নিভৃত কুজন বন্ধ করতে হল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *