ছয়
পুলিশ কর্তৃপক্ষ তবু সিদ্ধান্তে আসতে পারলেন না। সমস্ত খবরটা সংবাদপত্রে প্রকাশ করার স্বপক্ষে প্রায় সকলেই ভোট দিলেন। একমাত্র ব্যতিক্রম ডক্টর ব্যানার্জি। তাঁর মতে A B C—না এখন ওর
নাম B.C.D.―লোকটা ‘নটোরিটিই’ চাইছে। কাগজে সব কিছু ছাপা হলে তার হত্যালিপ্সা আরও বেড়ে যাবে। আরও আত্মপ্রচার চাইবে। আরও খুন করবে। ইন্সপেক্টার বরাট বলেন, ওর ইগো’ যদি স্ফীত হয়, তাহলেই ওর সতর্কতা কমে যাবে। ও ভাববে—বাসু-সাহেব আর পুলিস তার বুদ্ধির তুলনায় কিছুই নয়। ও ভুল করবে!
মনস্তত্ত্ববিদ ডক্টর পলাশ মিত্র বললেন, আমার অভিজ্ঞতা বলে—তা আদৌ হবে না। ওর হত্যালিপ্সাটাই শুধু বৃদ্ধি পাবে। সতর্কতাটা হ্রাস পাবে না। আপনারা বারে বারে বলছেন, ওর মনের দুটো অংশ আছে—ডুয়েল পার্সোনালিটি’। একটা অংশে ‘মেগ্যালোম্যানিয়া’–’হাম্বড়াই ভাব’! সে অংশটা ওকে বলছে : তুমি একজন দুর্লভ প্রতিভা! বিশ্বের শ্রেষ্ঠ অপরাধী! পি. কে. বাসু বা পুলিস বিভাগ তোমার কেশাগ্র স্পর্শ করতে পারবে না। আর দ্বিতীয় অংশটা ‘হোমিসাইড্যাল ম্যানিয়াক’–সে হত্যাবিলাসী। জ্যাক দ্য রীপারের মতো মার্ডারার, স্টোনম্যানের মতো। জন দ্য কীলারের মতো। কিন্তু আমার মতে তার মনের ভিতর আরও দুটি সত্তা আছে!
—আরও দুটি?
—হ্যাঁ। তিন-নম্বর—সে শিশুর মতো সরল। কৌতুকপ্রিয়, শিশু-সাহিত্য পাঠে তার আগ্রহ, লুকোচুরি খেলায়, ধাঁধা সল্ভ করায়, লেগ-পুলিং করায়। ওর মস্তিষ্কের সে অংশটা পরিণত হয়নি। বাচ্চাদের দলে ভিড়ে সে আজও খেলতে চায় : ও কুমির তোর জলকে নেমেছি! আর চতুর্থ দিক : লোকটা অঙ্ক কষতে ভালোবাসে। থিওরি অব নাম্বার্স, তার প্রিয়। হায় অ্যার্সেন্ডিং অর্ডার, অথবা ডিসেন্ডিং অর্ডার। তার প্রতিটি পদক্ষেপ আঙ্কিক ছকে বাঁধা!
ইন্সপেক্টার বরাট বলেন, যেহেতু ওর টাইপ-করা কাগজের পিছনে সর্বদা অঙ্কই থাকে?
—শুধু সে জন্য নয়। আপনার থার্ড লেটারটা দিন তো বাসু-সাহেব?
বাসু-সাহেব ওঁর সকালে পাওয়া তিন নম্বর চিঠিখানা মেলে ধরলেন।
ডক্টর মিত্র তিনখানি চিঠি পাশাপাশি রাখলেন টেবিলের ওপর। বললেন, লক্ষ করে দেখুন, তিনখানি চিঠি যদিও দশ-পনের দিন আগে-পরে টাইপ করা কিন্তু একটা আঙ্কিক যোগাযোগ আছে। যেন একটা ম্যাথমেটিক্যাল সিরিজ! তিন নম্বর চিঠিখানা দেখুন প্রথমে!
সকলে ঝুঁকে পড়েন।
তিন নম্বর চিঠি, যেখানি প্রাপ্তিমাত্র বাসু-সাহেব ছুটে এসেছেন, তার আকৃতি ও বয়ান একই রকম। খাম, কাগজ, টাইপ-রাইটারের সেই ছোট হাতের ‘t’ অক্ষরটার একইভাবে লাইন ছাড়া। এবারেও উপরে একটি—একরঙা ছবি। অন্য কোনও বই থেকে কেটে আঠা দিয়ে সাঁটা। চিঠিটা এই রকম—
‘C’-FOR CHILLANOSARAUSAIH NAMAH!
শ্রীযুক্ত পি. কে. বাসু বার-অ্যাট-লয়েষু,
“…আমরা মনে করিলাম যে, এইবার বেচারাকে খাবে বুঝি, কিন্তু পাঁচ দিন গেল, দশ দিন গেল, কেবল চীৎকারই চলতে লাগল, খাবার কোন চেষ্টাই দেখা গেল না…।”
কী দুঃখের কথা!
ধেড়ে জন্তুটা চীৎকার থামিয়ে সাপের মতো এঁকেবেঁকে যদি নদীর দিকে চলে যেতে রাজী থাকে তাহলে সংবাদপত্রে পার্সোনাল কলমে একটি বিজ্ঞপ্তি দিলেই তো ল্যাঠা চুকে যায়। অযথা বাকি চতুর্বিংশতিটি হতভাগ্য সুখে স্বচ্ছন্দে কালাতিপাত করতে পারে।
অধীর আগ্রহে কাগজের পার্সনাল কলম লক্ষ করব। ধেড়ে জন্তুটা হার মানল কি? ‘C’ FOR CHANDANNAGAR তাং : নভেম্বরের সাতই। ইতি
গুণসন্দিগ্ধ
C.D.E.
ডক্টর মিত্র বললেন, লক্ষ করে দেখুন, দশ-পনের দিন আগে-পিছে টাইপ করা চিঠিগুলোর মধ্যে একটা সম্পর্ক আছে। আঙ্কিক নিয়মে। প্রথম চিঠির সম্বোধন ‘শ্রীল শ্রীযুক্ত বাবু’; দ্বিতীয়টাতে ‘শ্রীল’ বাদ গেছে, তৃতীয়টিতে ‘বাবু’ পরিত্যক্ত হয়েছে। অর্থাৎ শ্রদ্ধা, সৌজন্যবোধ তিল-তিল করে কমছে। ওদিকে পত্রশেষেও ‘একান্ত গুণমুগ্ধ’, দ্বিতীয়ে ‘একান্ত’ পরিত্যক্ত, তৃতীয়তে একটি নূতন শব্দ ‘গুণসন্দিগ্ধ’। নিজের নামটাও একটা ম্যাথমেটিক্যালি প্রগ্রেশানে এগিয়ে চলেছে—A.B.C.; B.C.D.; এবারে C.D.E.! লোকটা অঙ্কের মাস্টার হলে আমি বিস্মিত হব না।
ইন্সপেক্টার বরাট বলেন, দশ-পনের দিন আগে-পিছে টাইপ করলেও ওর কাছে তো আগেকার চিঠির অফিস-কপি থাকতে পারে?
পারে? আমার সন্দেহ হয়। ফাইল করে যে অফিস-কপি সাজিয়ে রাখে, সে না পাগল, না ক্রিমিনাল! আমার মতে লোকটা আদৌ কোনও কপি রাখেনি। যাতে তার বাড়ি সার্চ করে আপনারা নিশ্চিত প্রমাণ না পেতে পারেন। আমার তো ধারণা, চিঠিগুলো একই টাইপ-রাইটারে টাইপ করাও নয়। অতি সযত্নে দু-তিনটি টাইপ-রাইটারে ‘t’ অক্ষরটাকে ঐ ভাবে উঠিয়ে ছাপানো হয়েছে।
ডক্টর ব্যানার্জি প্রতিবাদ করেন, না! আমার দৃঢ় ধারণা সব চিঠি একই যন্ত্রে ছাপা। অর্থাৎ ‘A’ FOR ASANSOL 7th inst’, ‘B. for BURDWAN, 27th inst’ এবং ‘C’ for CHANDANNAGAR, 7th Nov’—এই অংশগুলির টাইপ ভিন্ন যন্ত্রের।
—আপনি বলতে চান, ঐ রকম একটা ধূর্ত ক্রিমিনাল এ ধরনের একটা টাইপ-রাইটার নিজের হেপাজতে রাখবে? বাড়ি সার্চ হলে যা হবে একটা জোরালো এভিডেন্স?
—তা কী করে সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন? হয়তো যন্ত্রটা রাখা আছে অন্যত্র। যেখানে গিয়ে নির্জনে বসে টাইপ করার সুযোগ তার আছে।
বাসু-সাহেব বলেন, আমার প্রশ্ন : খবরটা কি কাগজে ছাপিয়ে দেবেন? দিলে আজই ব্যবস্থা করতে হয়। কারণ সময়ের ব্যবধান এবার মাত্র দু-দিন।
আই.জি.ক্রাইম বলেন, সেটা নিতান্ত দুর্ভাগ্যের কথা। পোস্টাল জোনটা ভুল টাইপ করায় চিঠিখানা অহেতুক ডেলিভারি হতে দেরি হয়েছে।
নিউ আলিপুরের 700053-র বদলে খামে অসাবধানে ছাপা হয়েছে 700035। ফলে খামের উপর পোস্টাল ছাপটা উনত্রিশে অক্টোবরের হওয়া সত্ত্বেও চিঠিখানি বাসু-সাহেবের হস্তগত হয়েছে মাত্র আজই সকালে—অর্থাৎ নভেম্বরের পাঁচ তারিখে। আলমবাজার পোস্টঅফিস থেকে রি-ডাইরেকটেড হয়ে।
এস.এস. বার্ডওয়ান রেঞ্জ বলেন, দু দিনই যথেষ্ট। আমার ব্যাটেলিয়ান রেডি। আজই খবরটা আমরা প্রেস-এ দিচ্ছি। তিনখানি চিঠির ব্লক সমেত সমস্ত ব্যাপারটা প্রতেকটি নামী দৈনিক পত্রিকায় সরকারী প্রেস-নোট হিসাবে ছাপা হয়ে যাবে। এ ছাড়া সরকারী বিজ্ঞাপনও থাকবে। চন্দননগরে প্রতিটি মানুষ—অন্তত ‘সি’ অক্ষর দিয়ে যার নাম বা উপাধি সে সতর্ক থাকবে। ঐ একটি দিন—সাতই নভেম্বর।
বাসু বলেন, তারিখটা সাতই, কিন্তু তিথিটা স্মরণ আছে আপনার?
—তিথি? মানে?
শুক্লা অষ্টমী। চন্দননগরে ঐদিন জগদ্ধাত্রী পূজা! প্রায় লাখখানেক বহিরাগত ওখানে আসবে। সেটা ভেবে দেখেছেন?
আই. জি. ক্রাইম সাহেব শুধু বললেন, মাই গড!
বাসু বললেন, আমার কিন্তু ধারণা পোস্টাল-জোন নাম্বারটা সজ্ঞানকৃতভাবে ভুল ছাপা। যাতে চিঠিটা ডেলিভারি হতে দেরী হয়।
ইন্সপেক্টার বরাট মুচকি হেসে বললেন, এটা কিন্তু আপনার প্রতিদ্বন্দ্বীকে ‘বিলো-দ্য-বেল্ট’ হিট করা হচ্ছে বাসু-সাহেব। প্রতিবারই সে পাঁচ-সাতদিন সময় আমাদের দিয়েছে. ঠিকানার ভুলটা স্বজ্ঞানকৃত নয়!
বাসু কোনও অফেন্স নিলেন না। বললেন, কিন্তু লোকটা বুঝতে পারছে আমরা ক্রমশ সতর্ক হয়ে উঠছি। আশঙ্কা করেছে, এবার হয়তো আমরা ব্যাপারটা কাগজে ছাপিয়ে দেব। সে জন্যই সে ঐ বিশেষ দিনটি বেছে নিয়েছে। কারণ সে জানে, ঐ দিন ‘সি’ নামের অসংখ্য যাত্রী একবেলার জন্য চন্দননগরে জগদ্ধাত্রী পূজা দেখতে যাবে। আর হয়তো চিঠিখানা আমরা পাব ঐ সাত তারিখেই।
কিন্তু বহিরাগত যাত্রীর মধ্যে কার নাম অথবা উপাধি ‘সি’-অক্ষর দিয়ে তা সে কেমন করে জানবে?
—তা কেমন করে বলব? বনানী ব্যানার্জি যে ঐ ট্রেনে বর্ধমানে যাবে সেটাই বা সে কেমন করে জানল? বনানী তো সারাদিন বর্ধমানে ছিল না!
আই.জি. বললেন, যেমন করেই হক–চন্দননগরেই যেন এই বীভৎস নাটকের যবনিকাপাত হয়!
বরাট বললেন,—আমাদের চেষ্টার ত্রুটি হবে না স্যার।
স্থির হল, ভোর চারটে চব্বিশের ফাস্ট টু হান্ড্রেড ওয়ান আপ লোকালে শতখানেক প্লেন-ড্রেস পুলিস চন্দননগর যাবে। বিভিন্ন গ্রুপে তারা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকবে সারা শহরে। নামী খবরের কাগজে পর পর দুদিনই সাবধানবাণীটা ছাপা হবে। ছয় ও সাত তারিখে।
.
পরদিন সকাল। অর্থাৎ ছয় তারিখ। বেলা নটা নাগদ। বিডন স্ট্রীট বাড়ির চিলে-কোঠার ঘর। ভিতর থেকে ঘরটা ছিটকিনি বন্ধ। চৌকি এবং টেবিল দুটিই স্থানচ্যুত। চৌকির উপর বিছানো আছে সেদিনের সংবাদপত্র। আর গৃহস্বামী চতুষ্পদের ভঙ্গিতে সারা ঘরটা হামাগুড়ি দিয়ে বেড়াচ্ছেন। প্রায় মিনিট পনের হামা দিয়ে তিনি উঠে দাঁড়ালেন। বুড়ো মানুষ, মাজাটা ধরে গেছে। একটু আড়মোড়া ভাঙলেন, তারপর আবার তুলে নিলেন খবরের কাগজটা।
যা খুঁজছিলেন এতক্ষণ ধরে, তা পাননি। একটা পেনসিল-কাটা ছুরি আর পেনসিলটা!
অনেকক্ষণ ঊর্ধ্বমুখে চিন্তা করলেন। সিদ্ধান্তে এলেন—ছুরিটা নিশ্চয় বৌমা অথবা দাশু সরিয়ে নিয়েছে। পাছে তিনি আবার হাত কেটে ফেলেন। এ সিদ্ধান্তের পিছনে দুটি যুক্তি। এক নম্বর, ওঁর টেবিলের উপর রাখা আছে একটা পেনসিল-কাটা কল। যেগুলোয় হাত কাটে না, ঘুরিয়ে-ঘুরিয়ে পেন্সিল-কাটা যায়। নিঃসন্দেহে দাশু রেখে গেছে। দু নম্বর, ওঁর দাড়ি কামানোর সরঞ্জামটি অন্তহৃত।
খোঁজ করেছিলেন সেটার বিষয়ে। দাশু বলেছিলেন, ‘আপনি এবার থেকে দাড়ি রাখুন স্যার। বেশ খোলতাই অধ্যাপক-অধ্যাপক দেখাবে।’ উনি হেসে জবাবে বলেছিলেন, ‘দূর পাগল! দাড়ি রাখলেই কি থার্ড-মাস্টার কলেজের অধ্যাপক হয়?’
কিন্তু বুঝতে পেরেছেন—শেভিং সেটটা ওরা ইচ্ছে করেই সরিয়ে নিয়ে গেছে। সেফটি রেজার নয়, উনি বরাবর ক্ষুর দিয়ে কামাতেন।
তা সে যাই হোক—পেন্সিলটা গেল কোথায়?
গভীরভাবে চিন্তা করেও মনে করতে পারলেন না, ওঁর এই চিলে-কোঠার ঘরে কোনও পেন্সিল কোন্ কালে ছিল কি না। কাগজপত্র সব উল্টে-পাল্টে দেখলেন—না! পেন্সিলের লেখা তো কোথাও নেই! সব কলম অথবা ডট্ পেন! তাহলে ‘কী’ ছুলতে গিয়ে অমন মরাত্মকভাবে হাতটা কাটল সেদিন? তবে কি
ওঁর ডায়েরিটা বার করে আনলেন। খবরের কাগজের সংবাদের সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে গিয়ে বৃদ্ধ যেন বজ্রাহত হয়ে গেলেন। ওঁর হাত-পা থরথর করে কাঁপতে থাকে। বিচিত্র কোয়েন্সিডেন্স! কাকতালীয় ঘটনা! পর পর দু বার? প্রব্যাবিলিটির অঙ্কটা কীভাবে কষতে হবে?
ডায়েরিতে লেখা আছে : উনিশে অক্টোবর রাতে উনি ছিলেন আসানসোলের একটি হোটেলে। সাতাশে বর্ধমানে যান, ফেরেন আঠাশে! রাত্রে কোথায় ছিলেন? ডায়েরিতে লেখা নেই। রাত দুটোর সময়? ডায়েরি নীরব। সাতাশে কোন ট্রেনে বর্ধমান যান? ডায়েরি নিরুত্তর!
তবে কি….?
অসম্ভব! এ হতে পারে না! তিনি ফার্স্টক্লাস টিকিট কাটবেন কেন? কিন্তু টিকিট ছাড়াই যদি তিনি ঐ কামরায় উঠে থাকেন? একটি অরক্ষিতা মেয়ে…নীল সিল্কের শাড়ি পরা…নীল ব্লাউজ…রেলকামরায় আর কেউ নেই…আবছা-আবছা মনে পড়ছে না?…
সবিস্ময়ে তাকিয়ে দেখেন দশটা আঙুল নিজের অজান্তেই কখন বিস্তারিত হয়ে গেছে! একি? একি! তিনি ওঁর মাথার বালিশটার গলা টিপে ধরেছেন।
নিজের অজান্তেই আর্তনাদ করে ওঠেন বৃদ্ধ।
নিজের কণ্ঠস্বরেই…
তৎক্ষণাৎ সম্বিত ফিরে আসে।
একটু পরে দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ!
বৃদ্ধ দ্রুত হাতে খাট আর টেবিলটাকে স্বস্থানে সরিয়ে দিলেন। খবরের কাগজটাকে বিছানার তলায় চাপা দিয়ে এগিয়ে গেলেন দরজার ছিটকিনি খুলে দিতে।
—কী হয়েছে স্যার? চীৎকার করে উঠলেন কেন?—চৌকাঠের ও প্রান্তে সস্ত্রীক দাশরথী।
—আমি? কই না তো!—দীর্ঘ-দীর্ঘদিন বাদে সজ্ঞান অনৃতভাষণ করলেন হেমাঙ্গিনী বয়েজ স্কুলের প্রাক্তন থার্ড মাস্টার।
দাশরথী বললেন, আশ্চর্য! আমি যে স্পষ্ট শুনলাম!
—তা হবে। পাগল মানুষ তো!
দাশরথীর পিছনেই দাঁড়িয়ে ছিলেন প্রমীলা। মাস্টারমশাই বললেন, বৌমা বর্ধমানে যেদিন গেলাম—ও মাসের সাতাশ তারিখে—সেদিন আমি কি সকালের ট্রেনে গেছিলাম, না রাতের ট্রেনে?
প্রমীলা একটু আশ্চর্য হয়ে বললেন, কেন বলুন তো?
—ডায়েরিতে লিখে রাখতে ভুলেছি।
একটু মনে করে প্রমীলা বললেন, বর্ধমানে তো? সকালে। সিঁড়ির মুখে দাঁড়িয়ে আপনি আমাকে বলে গেলেন বর্ধমান যাচ্ছি, মনে নেই।
—হ্যাঁ, হ্যাঁ মনে পড়েছে।—আসলে কিন্তু কিছুই মনে পড়েনি ওঁর।
ডাক্তারবাবু সস্ত্রীক নেমে গেলে উনি একটু চিন্তা করলেন। অঙ্কের মাস্টার। পাঁচ মিনিটেই সল্ভ হয়ে গেল অঙ্কটা। ডানহাতের তালুটাই কেটেছে। আঙুলগুলো অক্ষত। লিখতে কোনও অসুবিধা হচ্ছে না। ডায়েরির সেদিনের পাতাখানা খুললেন। ছয়ই নভেম্বর। দেখলেন, লেখা আছে : ‘চন্দননগর— ঘড়িঘর থেকে গঙ্গাঘাট, বাঁ-হাতি প্রত্যেকটি দোকান ও বাড়ি’ ওঁর নিজেরই হাতের লেখা। কবে লিখেছিলেন সে-কথা মনে নেই, তবে এটুকু মনে আছে পণ্ডিচেরী আশ্রম থেকে মহারাজের পত্রপ্রাপ্তিমাত্র এটা লিখেছিলেন ডায়েরিতে। পাতা উল্টে দেখলেন, সাতই নভেম্বরের পাতায় লেখা আছে মহারাজের নির্দেশ : ডুপ্লে কলেজ থেকে ফটকগোড়া—বাঁ-হাতি সব দোকান ও বাড়ি। সন্ধ্যায় প্রত্যাবর্তন।
উনি ডায়েরির ছয় তারিখের পাতায় এখন লিখলেন—”সকাল আটটা দশ : খবরের কাগজ ক্রয়। সাড়ে আট : পেন্সিল খুঁজিলাম। পাইলাম না। পৌনে নয়টা : বৌমা বলিল, সাতাশ তারিখ সকালের ট্রেনে বর্ধমান গিয়াছিলাম। এখন নয়টা চল্লিশ : স্টেশান অভিমুখে যাত্রা করিতেছি। উদ্দেশ্য—এগারোটা দশের গাড়িতে চন্দননগর রওনা হওয়া। বাসযোগে হাওড়া যাইব।
ডায়েরিটা বন্ধ করে এবার আলমারিটা খুললেন। বেছে বেছে খান দশ-বারো বই ব্যাগে ভরে নিলেন। সবই ধর্মপুস্তক। এখনো অনেক বইয়ের প্যাকেট খোলাই হয়নি। উপায় কী? লোকে যে ধর্মপুস্তক কিনতেই চায় না। শিবাজীপ্রতাপ এজন্য বিব্রত। মহারাজ যদি বিক্রীত বইয়ের উপর কমিশন দিতেন তাহলে সঙ্কোচের কিছু থাকত না। কিন্তু তিনি মনি-অর্ডারে ওঁকে মাস-মাহিনা দেন—বিক্রি হোক আর না হোক! নিঃসন্দেহে মহারাজ ওঁকে তির্যকপন্থায় অর্থ সাহায্য করতেই এ ব্যবস্থা করেছেন। ভাবখানা : ভিক্ষা নয়, উনি উপার্জন করছেন। উপায় কী?
টাইম টেবলটা দেখলেন। এগারোটা দশের লোকালখানা ধরতে চেষ্টা করবেন। নিশ্চয়ই সেটা ধরা যাবে। কিন্তু প্রতি আধ ঘণ্টা পর পর ডায়েরিতে উনি লিখে যাবেন—সময় উল্লেখ করে—কখন, কোথায় উনি কী করছেন! স্মৃতির উপর আর ভরসা রাখতে পারছেন না। উনি দেখতে চান—আগামীকাল চন্দননগরে যদি কোনও দুর্ঘটনা ঘটে, যদি ইংরাজী ‘C” অক্ষরযুক্ত নামের কোনও হতভাগ্য—আহ্। সেকথা ভাবাও যায় না। না যাক! উনি দেখতে পান, দুর্ঘটনার মুহূর্তে উনি কোথায়, কী করছিলেন। স্মৃতিনির্ভর সিদ্ধান্ত নয়—ডায়েরি কী বলে!
কুঁজো থেকে গড়িয়ে এক গ্লাস জল খেলেন। ক্যাম্বিসের জুতোর ফিতে বাঁধলেন। তারপর বইয়ের ব্যাগটা তুলে নিয়ে এবং ডায়েরিখানা ভুলে টেবিলের উপর ফেলে রেখে অঙ্কের মাস্টারমশাই ধীরে ধীরে নিচে নামতে শুরু করেন।
একতলার ডাক্তারখানায় ওঁকে আটকালেন ডাক্তারবাবু। বললেন, আজ আর নাই গেলেন স্যার? আপনার শরীর এখনো দুর্বল!
—না, না! আমার শরীরটা ভালোই আছে। বৌমাকে বলে দিও, কাল সন্ধ্যায় ফিরব।
—কোথায় চলেছেন আজ?
—শ্রীরামপুর।
মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল কথাটা!
মুখ ফসকে? না কি পাকা-ক্রিমিনালের মতো?—মনে মনে ভাবলেন অঙ্কের প্রাক্তন থার্ড মাস্টারটি! মুখটা বেদনার্দ্র হয়ে ওঠে! এ কী হলো তাঁর? এত মিথ্যে কথা কী ভাবে বেরিয়ে আসছে তাঁর মুখ থেকে? জিহ্বা যেন ওঁর শাসন মানছে না! আশ্চর্য! উনি কি নিজের অজান্তেই তিল তিল করে বদলে যাচ্ছেন? নির্বিরোধী গণিতশিক্ষক থেকে একটা পাকা ক্রিমিনালে রূপান্তরিত হচ্ছেন? ডোরিয়ান গ্রে-র ছবিখানার মতো?
ডাক্তারবাবু বললেন, শ্রীরামপুর? চন্দননগর নয় তো?
যেন ইলেক্ট্রক শক্ খেয়েছেন বৃদ্ধ। তাঁর আপাদমস্তক একবার থরথর করে কেঁপে উঠল। দরজায় চৌকাঠখানা ধরে সামলে নিলেন নিজেকে। আমতা আমতা করে বলেন, চ-ন্দ-ন-ন-গ-র! ও…ও-কথা বললে কেন হঠাৎ?
ওঁর ভাবান্তরটুকু ডাক্তারবাবুর নজর হয়নি। তিনি সিরিঞ্জ হাতে রুগীর বাহুমূলটা ধরে ইনজেকশান দেওয়ায় ব্যস্ত ছিলেন। সেদিকে তাকিয়েই বললেন, এক নম্বর; আজ সেখানে প্রচণ্ড ভীড়—কাল জগদ্ধাত্রী পূজা। দু-নম্বর : আজ খবরের কাগজ দেখেননি?
বৃদ্ধা জবাব দিতে পারলেন না। গলকণ্ঠটা বারকতক ওঠা-নামা করল। ঢোক গিললেন।
যাকে ইনজেকশান দেওয়া হচ্ছিল সেই রোগীটি বলল, সাংঘাতিক খবর মশাই। বিশ্বাস হয়? খুনিটা নাকি দেখতে নিতান্ত সাধারণ—আপনার-আমার মতো!
বৃদ্ধ নতনেত্রে নেমে পড়েন পথে। বিনা বাক্যব্যয়ে।
সামনেই একটা পান বিড়ির দোকান। আয়নাটায় দেখতে পেলেন নিজ প্রতিবিম্ব। নিতান্ত সাধারণ! আপনার-আমার মতো!
.
ছয় তারিখ রাত আটটা। নৈশাহারে বসেছেন বাসু-সাহেব। সপরিবারে। সচরাচর ওঁরা ডিনারে বসেন রাত সাড়ে নয়টায়। আজ দেড়ঘণ্টা আগে। কারণ আগামীকাল ভোর পাঁচটার মধ্যে উনি গাড়ি নিয়ে চন্দননগর যাবেন। ওঁরা তিনজন। রানী দেবী বাদে। ফলে রাত চারটেয় অ্যালার্ম দিয়ে উঠতে হবে। গাড়িতে পেট্রল ভরা আছে। সঙ্গে যা যাবে সবই গাড়িতে তোলা হয়েছে। শুধুমাত্র বাসু-সাহেবের রিভলভারটা ছাড়া।
কৌশিক বললে, তৃতীয় চিঠিখানার ঐ লাইনটা রোমান হরফে বাঙলায় কেন টাইপ করা হল এটা আমি বুঝতে পারিনি। ঐ যে “Amr a mone karil ā m je, aib ār Bechārake khābe bujhi”… ইত্যাদি। ওটার ইংরেজী অনুবাদ করা হল না কেন?
বাসু-সাহেব বললেন, জবাব দেবার আগে একটা প্রতিপ্রশ্ন করি : ‘ব্যাচারাথেরিয়াম্’
আর ‘চিল্লানোসরাস্’ জন্তু দুটোকে চেন?
কৌশিক বলে, না; জুরাসিক পিরিয়ডের নয়, এটুকুই শুধু বলতে পারি।
–কেমন করে জানলে?
—‘এসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটেনিকা’ আর ‘জুওলজিক্যাল ডিক্সনারি’ ঘেঁটে।
—হুঁ! তাহলে আমাকে জিজ্ঞাসা করনি কেন? অথবা রানুকে?
কৌশিক নীরব। বাসু-সাহেবই আবার বলেন, সঙ্কোচে?
কৌশিক আমতা আমতা করে, না, মানে ভেবেছিলাম কাল্পনিক কোনও জীব।
—বটেই তো! কিন্তু কল্পনাটা কার?… জান না! সুকুমার রায়ের নাম শুনেছ? শোননি! না শোনাই স্বাভাবিক, যেহেতু তিনি সিনেমা করতেন না! অন্তত সত্যজিৎ রায়ের নামটা শুনেছ? ঐ যে, যে ভদ্রলোক ‘পাঁচালীর পথে’ না কী যেন একখানা পিক্চার তুলেছেন? বিভূতি মুখুজ্জে না বলাইচাদ বাঁড়ুজ্জে কার যেন লেখা বইটা! শোননি?
রানীদেবী হাসতে হাসতে বলেন, এতে কিন্তু প্রমাণ হচ্ছে তুমি ঐ লোকটার চিঠি পেয়ে দারুণ ক্ষেপে গেছ! এতটা মেজাজ খারাপ তো সচরাচর কর না তুমি?
তারপর কৌশিকের দিকে ফিরে রানী দেবী বললেন, ওটা সুকুমার রায়ের লেখা ‘হেশোরাম হুঁশিয়ারের ডায়েরি’ থেকে একটা উদ্ধৃতি। নিছক হাসির গল্প। অবশ্য এখন দেখছি ‘নিছক হাসির’ নয়, ও গল্পটা পড়ে কেউ কেউ ক্ষেপেও যায়!
আড়চোখে স্বামীর দিকে তাকালেন তিনি। বাসু-সাহেব নির্বাক আহারে মন দিলেন।