অধ্যায় ৯ – সত্য : কিয়োচিরো কাগার সমাধান

অধ্যায় ৯ – সত্য : কিয়োচিরো কাগার সমাধান

কেমন বোধ করছেন?

আমি এখানে আসার আগে ডাক্তারের সাথে আলাপ করেছি, সে জানাল আপনি সার্জারি করানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। শুনে খুশি হয়েছি। আপনি সবধরণের কাগজপত্রে স্বাক্ষর করে দিয়েছেন। ওরা এখন কাজটার জন্য প্রস্তুত। ফেরার কোনো পথ নেই। আর অপারেশন সফল হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। আপনাকে ভালো বোধ করানোর জন্য বলছি না আমি। সত্যিটাই বলছি।

“আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি, কখন টের পেলেন আপনি অসুস্থ? এই শীতেই? এই বছরই?

“নাহ, আমার মনে হয় আপনি গত বছরের শেষদিকে টের পান আবারও নতুনভাবে ক্যানসার ফিরে আসতে শুরু করেছে। আপনি ভাবেন, এবারই শেষ। আর সুস্থ হওয়ার বা বাঁচার কোনো সুযোগ নেই। ঠিক বলছি না? এজন্যই আর হাসপাতালে যাওয়ার চিন্তা করেননি।

“আমার এমনটা মনে হওয়ার পেছনে কারণ আছে। আমার মতে তখনই আপনি কুনিহিকো হিদাকার খুনের পরিকল্পনা করেন।

“অবাক হচ্ছেন? হওয়া উচিত নয়। আমার এই ধারণার পেছনে যৌক্তিক কারণ আছে। এমনকি এভিডেন্সও আছে আমার হাতে। এটা নিয়েই কথা বলতে চেয়েছি আপনার সাথে। হয়তো অন্যান্য দিনের তুলনায় একটু বেশি সময়ই থাকবো আজকে। চিন্তা নেই, আপনার ডাক্তার আমাকে অনুমতি দিয়েছে।

“এটা দেখুন। ছবিটা চিনতে পারছেন? হিদাকার বাড়িতে আপনার অনুপ্রবেশের ভিডিও থেকে নেয়া এটা। হিদাকার বাগানে লাগানো হিডেন ক্যামেরা, যাতে ধরা পড়ে আপনার কার্যক্রম। আপনার স্বীকারোক্তিতে যেমনটা বলা আছে আর কি।

“আপনি চাইলে একটা প্লেয়ার এনে পুরো ভিডিওটা আরেকবার রিভিউ করতে পারি আমরা। তবে আমার মনে হয় না সেটার আর প্রয়োজন আছে। এই একটা ফ্রেম-ই যথেষ্ট। তাছাড়া, ফুটেজটা বারবার দেখতে দেখতে নিশ্চয়ই বিরক্ত আপনি। যতই হোক ব্যাপারটা আপনারই সাজানো। এই অভিনয়টাও আপনার করা, এমনকি ভিডিওটা আপনিই ধারন করেছেন। এটাই ছিল অভিনেতা ও পরিচালক হিসেবে আপনার অভিষেক।

“হ্যাঁ, আমি দাবি করছি ভিডিওটা ভুয়া। এই টেপের সবকিছু মিথ্যে। এই ছবিটা দেখিয়ে এখন সেটারই প্রমাণ দেব আপনাকে। দেখুন, এই ভিডিওটা সাত বছর আগে ধারণ করা নয়, নিচের তারিখটা দেখেই বোঝা যাচ্ছে।

“দাঁড়ান, ব্যাখ্যা করছি। ব্যাপারটা খুবই সাধারণ। এখানে আমরা হিদাকার বাগানটা দেখতে পাচ্ছি, ঠিক না? গাছগুলো লক্ষ করুন। বোঝাই যাচ্ছে ছবিতে বেশি গাছ নেই। বিখ্যাত চেরি গাছটা ফ্রেমের ঠিক বাইরে। আর লনটা শুষ্ক। এক পলক দেখেই বোঝাই যাচ্ছে এটা শীতকাল। আর যেহেতু এটা মাঝরাতে তোলা সেহেতু বাকিসব খুঁটিনাটি বোঝা কঠিন। এ কারনেই হয়তো ভেবেছিলেন এটা দিয়ে আমাদের বোকা বানাতে পারবেন।

“মিস্টার নোনোগুচি, দুর্ভাগ্যবশত বড় একটা ভুল করে ফেলেছেন আপনি। নাহ, মিথ্যে বলছি না আমি। সত্যিই বড় একটা ভুল করেছেন আপনি। লনের ওপাশে দাগটা দেখতে পাচ্ছেন? ওটা ওই চেরি গাছের ছায়া। যা রাস্তার ধারের স্ট্রিট ল্যাম্পের কারণে সৃষ্টি হয়েছে। হ্যাঁ, এটা আবছা কিন্তু আপনার কারসাজি ধরে ফেলার জন্য যথেষ্ট।

“জানি, জানি ভিডিওর কোয়ালিটি আর বাগানের ওপর পড়া আলোর কারণে বোঝা কষ্টকর চেরি গাছটা সাত বছর নাকি মাত্র আধা বছর পুরানো। এক্ষেত্রে আপনি একবারে নিখুঁত। কিন্তু আমি এটা নির্দেশ করতে চাইছি না। গাছের ছায়ার আকৃতি এক্ষেত্রে সমস্যা নয়, সমস্যাটা হল এখানে মাত্র একটা গাছ রয়েছে।

“আপনাকে বিভ্রান্ত দেখাচ্ছে। ব্যাখ্যা করি বিষয়টা। ভিডিওটা যদি সত্যিই সাত বছর আগে ধারণ করা হয়ে থাকে, তবে হিদাকার লন জুড়ে দুটো গাছের ছায়া থাকতো। কেন জানেন? কারণ, সাত বছর আগে হিদাকার বাগানে পাশাপাশি দুটো চেরি গাছ ছিল, সুখি দম্পতির মত।

“তো ভিডিওটা স্পষ্টভাবেই অত বছর আগের নয়। সম্প্রতি ধারন করা হয়েছে এটা, আর করেছেন আপনি। রাই হিদাকার মতে গত বছরের শেষের দিকে আপনার পক্ষে ভিডিওটা ধারন করা কঠিন ছিল না। কুনিহিকো হিদাকা তখনও অবিবাহিত ছিল, রাই হিদাকা তার বাড়িতে এসে ওঠেনি আপনি অপেক্ষায় ছিলেন এমন এক রাতের যেদিন কুনিহিকো হিদাকা সম্পাদকের সাথে বসে মদ গিলে মাতাল হয়ে থাকবে।

“অবশ্যই বাড়ির একটা চাবি দরকার ছিল আপনার, অফিসের জানালাটা যেন আনলক থাকে সেটা নিশ্চিত করার জন্য। জানালা দিয়ে লাফ না দিলে আপনার ‘হত্যা চেষ্টার’ ভিডিও তো দুর্দান্ত হত না। ওহ, আমি জানি আপনার কাছে হিদাকার বাড়ির চাবির সেট ছিল না। রাইয়ের মতে এতে কোনো সমস্যা হওয়ার কথা না। প্রায়ই শহরের বাইরে গিয়ে চাবি হারিয়ে ফেলত হিদাকা, এজন্য সদর দরজার বাইরে থাকা ফুলের টবের আড়ালে চাবি রেখে যেত সে। এটা জানলে আপনার চাবির সেটের প্রয়োজন হওয়ার কথাও নয়। রাই অনেকটাই নিশ্চিত আপনি চাবির বিষয়ে জানতেন।

“জানি, আপনি এখন কী ভাবছেন মিস্টার নোনোগুচি। ভাবছেন, কোন ডিটেক্টিভ ভিডিওর প্রত্যেকটা ছায়া পর্যন্ত খতিয়ে দেখে সাত বছর আগে পরে কি ছিল সেটা খুঁজে বের করে! আপনার ভাবনাটা যৌক্তিক। কেউই এমনটা করে না। এমনকি আমিও করতাম না। দেখুন, শুধুমাত্র বাগানে অতিরিক্ত গাছের অনুপস্থিতি দেখেই ভাবিনি ভিডিওটা ভুয়া। বরং ভিডিওটা ভুয়া জানতাম বলেই বারবার ওটা দেখেছি। যে এভিডেন্স খুঁজছিলাম সেটা পাওয়ার জন্য হিদাকার বাগানের দুয়েকটা আগের ছবিও খুঁজে বের করা লেগেছে। কিন্তু কিভাবে জানলাম ভিডিওটি ভুয়া? আপনার স্বীকারোক্তি থেকে পাওয়া আরেকটা এভিডেন্স ছিল প্রশ্নবিদ্ধ : যেমন, আপনার অ্যাপার্টমেন্টে বিশাল স্তূপাকারে থাকা পান্ডুলিপি। আমি নিশ্চিত, যা হিদাকাকে খুন করার পেছনে আপনার মোটিভের সাথে সম্পর্কিত।

“গ্রেফতারের পর যে স্বীকারোক্তিটা লিখেছেন আপনি, ওটা পড়তে গিয়ে বেশ কিছু জিনিসে খটকা লাগে আমার। এর সবকিছু আলাদাভাবে হয়ত ব্যাখ্যা করা সম্ভব, কিন্তু একত্রিত করে ভাবলে আমার মনে হচ্ছিল কিছু একটা কাজ করেছে আপনার মাথায়, মিস্টার নোনোগুচি। পুরো লেখাটাতে ছিল এক ধরনের কপটতা, যেটা দেখে আপনি যা লিখেছেন সেটা স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করতে কষ্ট হচ্ছিল।

“ঠিক তখনই প্রথম বড় ব্লু’টা পেলাম। ভেবে অবাক হলাম, আপনার সাথে অনেকবার দেখা করলেও ঐ ব্যাপারটা আগে কখনোই লক্ষ করিনি আমি। কিন্তু সবসময়ই ওটা আমার সামনেই ছিল।

“মিস্টার নোনোগুচি, দয়া করে আপনার ডান হাতটা তুলে ধরুন, যেন আপনার আঙুলগুলো দেখা যায়। আপনার মধ্যাঙ্গুলিতে কলম ধরার কারণে কড়া পড়েছে। বেশ পুরুই সেটা।

“কিন্তু ব্যাপারটা অদ্ভুত, তাই না? আপনি হাতে লেখেন না, গল্প লেখার জন্য ওয়ার্ড প্রসেসর ব্যবহার করেন। শিক্ষক হিসেবে চাকরী করার সময়ও ওয়ার্ড প্রসেসরের সাহায্যেই রিপোর্ট বা অন্যান্য দরকারী জিনিস লিখতেন। তাহলে আপনার হাতে ওই কলমের কড়া পড়ল কিভাবে? এখন হয়ত বিশ্বাস করাতে চাইবেন কলম ধরার কারণে ওই কড়া পড়েনি। তাহলে ওটা কি? আপনিও কি জানেন না? নাকি মনে পড়ছে না আপনার আঙুলের ওই দাগটা কিভাবে এলো?

“এটা নিয়ে বেশি চিন্তা করবেন না। ওই জিনিসটা আপনার আঙুলে আছে, আমার কাছে এটাই গুরুত্বপূর্ণ। ওটা কলম ধরার কারণে সৃষ্ট কড়া- ই। আর ওয়ার্ড প্রসেসর ব্যবহারকারী কারোর আঙুলে কলমের কড়া পড়ার অর্থ সম্প্রতিই সে বিশাল বড় কিছু হাতে লিখেছে।

“এই ব্যাপারটাই আমাকে ভাবিয়েছে। আপনাকে বলি, যা জানতে পেরেছি সেটা ভাবলেই আমার মেরুদন্ডে শীতল স্রোত বয়ে যায়। আমার নতুন থিওরি যদি সত্যি হয় তবে এই তদন্ত পুরো একশো-আশি-ডিগ্রি ঘুরে যাবে।

“সরাসরি প্রসঙ্গে আসা যাক : আপনার অ্যাপার্টমেন্টে যেসব পান্ডুলিপি পাওয়া গিয়েছে ওসব গত কয়েক দশকে লেখা নয়। ওগুলো আপনার হাইস্কুল বা কলেজে পড়াকালীন সময়েও লেখা নয়, ওসব লেখা হয়েছে অতি সম্প্রতি, তাড়াহুড়ো করে। অবিশ্বাস্য শোনাচ্ছে, আমি জানি। কারণ এর মানে দাঁড়ায়, মিস্টার হিদাকা আসলে আপনার কোনো লেখা বা ওই পান্ডুলিপিগুলো থেকে কোন আইডিয়া চুরি করেনি।

“কিন্তু প্রমাণ ছাড়া কোনো থিওরি তো যথেষ্ট নয়। প্রমাণ করার তো কোনো উপায় দরকার, এজন্য আমি কয়েক জায়গায় এর খোঁজ করি।

“মিস্টার নোনোগুচি, আপনি কি হেইচি সুজিমুরা নামের কোনো লোককে চেনেন? চেনেন না? আমার মনে হয় না।

“স্বীকারোক্তিতে আপনি লিখেছেন ছোটবেলায় আপনি আর নোনোগুচি এলাকার আতশবাজি কারখানায় কাজ দেখতে যেতেন। আপনি বলেছেন ওই কারখানায় কাজ দেখার স্মৃতি থেকে আপনি ‘অগ্নিবলয়’ গল্পটা লেখেন। সেটার ওপর ভিত্তি করেই মিস্টার হিদাকা লিখেছে ‘নিভে যাওয়া অনল উপন্যাসটা।

“আতশবাজির কারিগরের নাম মিস্টার সুজিমুরা। হ্যাঁ, অবশ্যই নামটা ভুলে গিয়ে থাকতে পারেন আপনি। এটা গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়। আমার মনে হয় কুনিহিকো হিদাকাকে জিজ্ঞেস করতে পারলে জানা যেতো সে-ও হয়তো ভুলে গিয়েছে।

“কিন্তু মিস্টার সুজিমুরা এখনো বেঁচে আছেন। বয়স নব্বই, তিনি এখন হুইলচেয়ারে। তবে স্মৃতিশক্তি এখনও তীক্ষ্ণ। যে ছেলেটা কারখানায় যেত তাকে ভোলেননি তিনি। একজন ছেলেই যেত, দুজন নয়। আমি আপনার মিডল-স্কুল ইয়ারবুকের ছবি তাকে দেখাই, সে একজনের দিকে ইঙ্গিত করে। ওই একজন কুনিহিকো হিদাকা।

“ওহ্, তাকে আপনার ছবি দেখানোর পর সে বলে আপনাকে কখনোই দেখেনি।

“তার সাক্ষ্যই আমার শেষ সন্দেহের ছাপটাও মুছে দিয়েছে। মিস্টার হিদাকা আপনার কাজ চুরি করেননি, তার কোনো উপন্যাস-ই আপনার লেখার ওপর ভিত্তি করে নয়। আপনার ওই গল্প, উপন্যাসের পান্ডুলিপিগুলোই বরং তার উপন্যাসের ওপর ভিত্তি করে বানানো। ঠিক তখনই উল্টো দিক থেকে বিষয়গুলো দেখতে আরম্ভ করি আমি। সত্যিটা হল, মিস্টার হিদাকা একটা শব্দও আপনার থেকে চুরি করেননি। কোনো প্ল্যাজিয়ারিজম-ই হয়নি, আর প্ল্যাজিয়ারিজম হয়নি মানে কোনো ব্ল্যাকমেইল বা হত্যাচেষ্টার ঘটনাও ঘটেনি।

“তাহলে কী পেলাম আমরা? হাতসুমি হিদাকার সাথে আপনার অবৈধ সম্পর্ক-ই ওই তথাকথিত হত্যাচেষ্টার পেছনে আপনার মোটিভ ছিল? আপনার দাবির কি আদৌও কোনো বিশ্বাসযোগ্যতা আছে? চলুন এভিডেন্সগুলো আবার খতিয়ে দেখা যাক।

“প্রথমে আপনার অ্যাপার্টমেন্টে পাওয়া গেল অ্যাপ্রন, নেকলেস ও ট্র্যাভেল ডকুমেন্ট। এরপর পাওয়া গেল একটা ছবি, পরবর্তিতে জানা গেল যেটা হাতসুমির। ছবিটা তোলা ফুজি নদীর পার্শ্ববর্তি রেস্ট এরিয়ার দিকে। একই জায়গা থেকেই মাউন্ট ফুজির ছবি তুলেছেন সেটা আর বললাম না।

“এসবই। আর কিছুই নেই। কোনো সাক্ষীও নেই যে আপনাদের দুজনকে একসাথে দেখার সাক্ষ্য দিতে পারে, আপনাদের সম্পর্কের ব্যাপারে সাক্ষ্য দেয়ার কথা দূরে থাক।

“ওই ট্র্যাভেল ডকুমেন্টগুলো যেকোনো সময়ই বানানো যায়। ওগুলো কোনো কিছু প্রমাণ করে না। আবার যে নেকলেস হাতসুমির উপহার বলে দাবি করেছেন ওটা অন্য কারোরও হতে পারে, আবার কারোর-ই নাও হতে পারে। তবে অ্যাপ্রনটা হাতসুমিরই। আগে যেমন বলেছি, একটা ছবিতে হাতসুমিকে পরে থাকতে দেখা গিয়েছে ওই অ্যাপ্রন।

“হিদাকার বাড়ি থেকে একটা অ্যাপ্রন চুরি করা আপনার জন্য কঠিন কিছু না। হয়তোবা যখন হিদাকা সম্পাদকের সাথে মদ গিলে মাতাল হয়ে ছিল কিংবা তার মৃত স্ত্রীর জিনিসপত্র পরিষ্কার করার জন্য তাকে সাহায্য করতে গিয়েই চুরি করেছেন ওটা।

“তখনই হয়তো একটা ছবিও চুরি করে নিয়েছিলেন। ছবি চুরির সময় মাথায় রেখেছিলেন কয়েকটা বিষয় : ছবিতে হাতসুমিকে একা থাকতে হবে, ওই একই স্থানের কোনো ছবিতে যেন কুনিহিকো না থাকে। সেইসাথে লাগবে আরেকটা ছিমছাম ছবি, সেটা হতে পারে কোনো দৃশ্যের, যা পুরো ব্যাপারটায় আলাদা মাত্রা নিয়ে আসবে। এই সবগুলো শর্ত পূরণ করে ফুজি নদীর পার্শ্ববর্তি রেস্ট এরিয়াতে তোলা ছবিটা।

“নাহ, আপনি কিছু চুরি করেছেন এমন কোনো প্রমাণ আমার কাছে নেই। আমি শুধু বলছি এমন কিছু করা সম্ভব। কিন্তু আপনার লেখা আমাকে অসংখ্যবার ভুল পথে পরিচালিত করেছে। ফলে আপনার সাথে হাতসুমির অবৈধ সম্পর্কের ব্যাপারটা শুধু কানে শুনেই বিশ্বাস করা সম্ভব নয় আমার পক্ষে। এজন্য ওই সব সম্ভবনার ওপরই ভরসা করতে হচ্ছে।

“অবশ্যই কোনো হত্যাচেষ্টার ঘটনা না ঘটে থাকলে কোনো ব্ল্যাকমেইল বা গল্প নকলের ঘটনাও ঘটেনি। আর এসব ঘটনার সূত্রপাত হয়েছিল হাতসুমির পরকীয়া দিয়ে। কিন্তু বাস্তবে সেটাও ঘটেনি। যা থেকে নিশ্চিত হওয়া যায় হাতসুমির মৃত্যুটা নিছকই দুর্ঘটনা। তার আত্মহত্যার কোনো মোটিভ ছিল না।

“তাহলে আমরা কি পেলাম একটু দেখা যাক—বিশেষ করে গতবছরের শুরু থেকে কি করেছেন আপনি। ক্রমানুসারে বলার চেষ্টা করি ঘটনাগুলো।

“প্রথমে আপনি কিছু অব্যবহৃত কিন্তু পুরানো স্পাইরাল নোটবুক সংগ্রহ করলেন। আমি নিশ্চিত, আপনি যে স্কুলে পড়াতেন ওখানকার কোথাও থেকেই ওগুলো নিয়েছেন। এরপর আপনি কপি করা শুরু করলেন কুনিহিকো হিদাকার প্রকাশিত লেখাগুলো। ঠিক সরাসরি কপি নয়, এমনভাবে ওগুলো কপি করলেন যেন মনে হয় আপনার লেখাগুলোই আসল আর উপন্যাসগুলো ওগুলোর ওপর ভিত্তি করেই লেখা। আমার মতে একেকটা উপন্যাসের পেছনে প্রায় মাসখানেকের মত সময় দিয়েছেন আপনি। বেশ ঝক্কির কাজ। কেন না, সাধারণত ওয়ার্ড প্রসেসর ব্যবহার করেই অভ্যস্ত আপনি।। কাগজে লেখা যেসব গল্পগুলোর হিদাকার গল্পের সাথে কোনো মিল নেই, ওগুলো লিখেছেন কলেজ জীবনে আপনার লেখালেখির প্রমাণ তৈরির জন্য।

“তুষারদ্বার উপন্যাসেই আমরা আসল মাস্টার প্ল্যানারের হাতের কাজের ছাপ পাই। কী ঘটতে পারে সেটা উপলব্ধি করে, আপনার মনে হয়েছিল আপনাকে এমন কিছু লিখতে হবে যা কাজ করবে হিদাকার খুনে আপনার অ্যালিবাই হিসেবে। আর নিশ্চিত করতে হবে সেটা যেন অবশ্যই ডিটেক্টিভের নজরে পড়ে।

“এরপরই আসে ভিডিওর ব্যাপারটা। আগেই বলেছি ওটা ধারণ করা হয়েছে গতবছরের শেষ দিকে। এরপর নতুন বছরের শুরুতেই আপনি চুরি করেন হাতসুমির অ্যাপ্রন ও ছবি। সন্দেহ নেই, আপনিই ওই ট্র্যাভেল ফর্মগুলো পূরণ করেছেন ও কিনেছেন নেকলেসটা। আগে থেকেই কি আপনার কাছে ফাঁকা ট্র্যাভেল ফর্ম ছিল? মনে হয় ওগুলোও স্কুল থেকেই চুরি করেছেন। আপনার ড্রেসারে পাওয়া বিশেষ নকশার নেকটাই ও কাপবোর্ডে থাকা চায়ের কাপ, আপনার দাবি যেগুলো আপনাকে হাতসুমি উপহার দিয়েছে, আসলে ওগুলো আপনিই কিনেছেন। সম্ভবত সম্প্রতিই ওই দুটো জিনিস একসাথেই কিনেছেন আপনি নিজে।

“এরপর আমরা আসি সর্বশেষ ধাপে, যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শুনেছি সবকিছু গোছগাছ করে কানাডাতে পাঠানোর জন্য সপ্তাহখানেক সময় লাগে হিদাকার। ওই সময়ের মধ্যে একবার তার বাড়িতে গিয়েছিলেন আপনি। আমার বিশ্বাস তখন আপনার লক্ষ্য ছিল গোপনে দুটো জিনিস ওদের লাগেজে ঢুকিয়ে দেয়া-ছুরি আর ভিডিওটেপ। ভিডিওটেপটা আপনি রাখেন হিদাকার একটা বইয়ের ভেতরে গর্ত করে, যেন মনে হয় গোপন কিছু লুকাতে চেয়েছে সে।

“এরপর ষোলো এপ্রিল পর্যন্ত অপেক্ষা করেন আপনি, ওদিনই খুন করেছিলেন হিদাকাকে। স্পষ্টতইওটা মেজাজ হারিয়ে করা কোনো খুন নয়। ওটা পূর্বপরিকল্পিত, ঠান্ডা মাথার ভয়াবহ এক খুন। খুনটার পিছে ছিল দীর্ঘদিন ধরে বুনে আসা বিশাল পরিকল্পনা। এমনভাবে চিন্তা করে পরিকল্পনাটা করেছিলেন যেন আর দশটা খুনের সাথে এই খুনের পার্থক্য না বোঝা যায়। স্বীকার করতেই হবে, যে টুইস্ট দিয়েছেন এতে, সেটা দুর্দান্ত। জিনিয়াস! সাধারণত পূর্বপরিকল্পিত খুনগুলো করা হয় অ্যালিবাই বানাতে, গ্রেফতার এড়াতে অথবা দোষ থেকে বাঁচতে। কিন্তু আপনার প্ল্যান ছিল একেবারে অনন্য। আপনার লক্ষ্য ছিল একেবারেই ভিন্ন। গ্রেফতার হতেই চেয়েছেন আপনি। পারফেক্ট ক্রাইম করার কোনো খায়েশ আপনার ছিল না। আপনি তৈরি করতে চাইছিলেন পারফেক্ট মোটিভ।

“জানি, ব্যাপারটা চমকপ্রদ। আপনি হয়ত দুনিয়ার প্রথম খুনি যে অপরাধ করার আগেই মিথ্যা মোটিভ বানিয়েছে। বিশ্বাস করুন, সত্যিটা জানার পর আমারও বিশ্বাস হচ্ছিল না। যে সত্যিটা উন্মোচন করেছি সেটা বিশ্বাস করতে দীর্ঘসময় লেগেছে। তদন্তের প্রত্যেকটা পদক্ষেপে সংশয় তৈরি হয়েছে আমার মধ্যে। এমনকি যে ব্যাপারগুলো সত্যির পক্ষে সাক্ষ্য দিচ্ছিল, ওগুলাও বিশ্বাস করতে ইচ্ছা হয়নি।

“অবশ্যই, এভিডেন্সগুলো, যেমন ধরুন ভিডিওটেপটা, যদি আগে থেকেই ভালোমত খতিয়ে দেখতাম তাহলে হয়তো আরও আগেই সমাধান করা যেত এই ব্যাপারটার। তাছাড়া গুরুত্বপূর্ণ এভিডেন্স প্রভাবিত করার দায়ে কে-ই বা একজন খুনিকে সন্দেহ করবে, যেখানে এভিডেন্সটা তার বিরুদ্ধেই যায়। সত্যিই, দুর্দান্ত খেল দেখিয়েছেন।

“আপনার বানানো জাল পান্ডুলিপিগুলো আর আপনার সাজানো ওই আলামতগুলো, যা নির্দেশ করে আপনার সাথে হাতসুমি হিদাকার অবৈধ সম্পর্কের ব্যাপারে, ওগুলোর ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। এই এভিডেন্সগুলো যদি আপনাকে বাঁচাতে সাহায্য করত, তাহলে অবশ্যই ওগুলো মাইক্রোস্কোপের নিচে নিতাম আমরা। যদিও আমরা কিছুই করিনি কারণ এগুলো শুধুমাত্র আপনার মোটিভের সাথে সম্পর্কিত ছিল বলেই। দুর্ভাগ্যবশত, পুলিশ এমন সব এভিডেন্স নিয়ে ব্যস্ত থাকে যেগুলো সন্দেহভাজনকে সুবিধা দিতে পারে, এমনটা না করে বরং সেই এভিডেন্সগুলো খতিয়ে দেখা উচিত যা অপরাধের সাথে ভালোমত জড়িত করে সন্দেহভাজনকে। এই ব্যাপারটার-ই ফায়দা লুটেছেন আপনি।

“সতর্কতার সাথে জাল বিছিয়ে আমাদের তদন্তকে ভুল পথে পরিচালিত করেছেন। প্রথমটা হল আপনার বানানো নোটবুকগুলো। দ্বিতীয়টা হল অ্যাপ্রন, এরপর নেকলেস, ট্র্যাভেল ডকুমেন্ট ও হাতসুমি হিদাকার ছবি।

এগুলোর কথা ভেবে মনে হচ্ছে, আমাদের ছবিটা খুঁজে বের করতে দেরি হচ্ছে দেখে নার্ভাস হয়ে পড়ছিলেন। তখনই হয়ত ‘গুরুত্বপূর্ণ বইয়ের ওই ইশারা আমাদের দেয়ার প্রয়োজনবোধ করেন আপনি। টোপটা আমি গিললে নিশ্চয়ই খুব স্বস্তি পেয়েছিলেন।

“তৃতীয় ফাঁদে পা দেয়ার জন্যও আমাকে একটু নির্দেশনা দেয়ার প্রয়োজন ছিল আপনার। আপনি যদি কুনিহিকো হিদাকার কানাডা পাঠানো টেপটার কথা রাইকে জিজ্ঞাসা না করতেন তাহলে ধরতেই পারতাম না এর গুরুত্বটা। নিশ্চয়ই সমুদ্রের ডাক বইয়ের ভেতরে টেপটা লুকানোর ব্যাপারটা নিয়ে খুবই আত্মতুষ্টিতে ভুগছিলেন আপনি। কেন না জাল মোটিভ বানানোর বুদ্ধিটা পেয়েছেন এই বইটা থেকেই। এমনকি আপনি নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন যেন এই বইটার ব্যাপারে অবগত থাকি আমি। এজন্যই প্রথম যেদিন দেখা হয় সেদিনই এর প্রসঙ্গ তোলেন আপনি। এগুলো সবই আপনার পরিকল্পনার অংশ ছিল, ঠিক না? বলতে বাধ্য হচ্ছি আমি মুগ্ধ।

“যেদিন কুনিহিকো হিদাকাকে খুন করেছেন সেদিনের প্রসঙ্গে আরেকটু ফেরা যাক। খুনটা বেশ সুপরিকল্পিতভাবেই করা, যদিও সেটা কাউকেই কোনোভাবে বুঝতে দেননি আপনি। দেখাতে চেয়েছেন, মুহূর্তের উত্তেজনার বশে, নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খুনটা করা হয়েছে। যেন কোনোভাবেই আপনার জাল মোটিভ ধরা না পড়ে। ছুরি বা বিষ এক্ষেত্রে কাজে আসত না, এই ক্ষেত্রে ওগুলো ব্যবহার করলে পূর্বপরিকল্পিত বলেই মনে হত ব্যাপারটাকে। শ্বাসরোধ? আপনার শারীরিক গড়ন বিবেচনায় নিলে ওটা একটু কঠিনই আপনার জন্য।

“নাহ, আপনার জন্য সেরা পন্থা ছিল ভোঁতা কোন অস্ত্র : যা দিয়ে পিছন

থেকে আক্রমণ করা যায়। সে মেঝেতে পড়ে গেলে আরামে শ্বাসরোধ করা যাবে। তারপরও খুনের জন্য একটা ভালো অস্ত্রেরই দরকার ছিল আপনার। এমনকিছু যা সিনেই খুঁজে পাওয়া যাবে। হিদাকার পেপারওয়েট কাজটা সহজ করে দিয়েছে আপনার জন্য। কী দিয়ে শ্বাসরোধ করলেন? টেলিফোন কর্ড! আমি জানি, প্রত্যেকটা জিনিসের ব্যাপারে আপনি মাথার ভেতরে আগে থেকেই হিসাব করে রেখেছিলেন।

“কিন্তু সমস্যাটা হল, বাড়ির সব জিনিস প্যাক করা হয়ে গিয়েছিল ওদের। যদি পেপারওয়েটটা ওখানে না থাকত? ফোনকর্ডের মত, পেপারওয়েটটা অতটা প্রয়োজনীয় ছিল না। তবুও ওটা কোনো কার্ডবোর্ড বক্সে প্যাক করে রাখা থাকতেও পারত। এজন্য আপনি একটা বিকল্প জিনিস সাথে করে নিয়ে যান। ডম পেরিয়নের বোতল। বোতলটা আপনি বিকল্প অস্ত্র হিসেবে নিয়ে যান। এজন্য গিয়েই উপহারটা ওদের হাতে দেননি আপনি দিলে ওরা হয়ত জিনিসটা আপনার নাগালের বাইরে অন্য কোথাও রেখে দিত। এজন্যই প্রথমে আপনাকে অফিসটা চেক করতে হয়েছে। পেপারওয়েটটা ওখানে দেখে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেন আপনি। এরপর ওদেরকে শ্যাম্পেইনের বোতলটা উপহার হিসেবে দিতে আর কোনো বাঁধা থাকল না আপনার।

“প্রথমে যখন শ্যাম্পেইনের বোতলটার কথা শুনি, ভেবেছিলাম ওটাতে হয়ত বিষ মেশানো ছিল। এমনকি হোটেলের ম্যানেজারকে জিজ্ঞেস পর্যন্ত করেছি এর স্বাদের ব্যাপারে। বলেছে বেশ ভালো। এখন অবশ্য জানি, আপনি কোনোদিনও বিষ ব্যবহার করতেন না।

“নিজের অ্যালিবাই বানানোর জন্য ওই কম্পিউটারের ফ্যাক্স সফটওয়্যারটা ব্যবহার করেন আপনি-দারুণ আইডিয়া। বয়স্ক ডিটেক্টিভকে বোকা বানানোর জন্য যথেষ্ট। আমি নিশ্চিত, এখনো ব্যাপারটা ধরতে পারেনি চিফ, যদিও ত্রুটি ছিল এতে। অন করা মনিটর ও বাড়ির ফোনে থাকা ভুল রিডায়াল নম্বর দেখে নিশ্চিত যে কেউই বুঝে যেত।

“ভাবছি, যদি আমরা না বুঝতে পারতাম তাহলে আপনি কী করতেন। যদি আপনাকে সন্দেহভাজন হিসেবেই না ধরতাম? দেখতে পাচ্ছি ইতস্তত করছেন আপনি। দুশ্চিন্তার কিছু নেই, আপনার ট্রিক আমরা দেখেছি, আর আপনার পরিকল্পনামত আপনাকে গ্রেফতারও করা হয়েছে।

“আপনাকে ক্লান্ত দেখাচ্ছে। এতক্ষণ ধরে একটানা কথা বলার জন্য দুঃখিত। আর কিছুক্ষণ সহ্য করেন আমাবে। যতই হোক, আপনিই আমাকে এসবের মধ্যে এনে ফেলেছেন। একটু যন্ত্রণা তো আপনাকেও সহ্য করতেই হবে।

“তাহলে চলুন, কোটি টাকার প্রশ্নটা করা যাক…আপনার যেহেতু গ্রেফতার হওয়ারই ইচ্ছা ছিল, সেহেতু কেন এত ঝামেলা করে এই মিথ্যে, জাল মোটিভটা বানাতে গেলেন? ব্যাপারটা আসলেই অস্বাভাবিক 1

“কুনিহিকো হিদাকাকে খুনের পিছে অবশ্যই আপনার একটা মোটিভ ছিল, সম্পূর্ণ ভিন্ন এক মোটিভ। খুনের দায়ে গ্রেফতার হওয়ার থেকেও সত্যিকারের মোটিভ ফাঁস হয়ে যাওয়ার ভয় বেশি ছিল আপনার।

“মোটিভ যেটাই হোক না কেন, আমি জানি আপনার মোটিভ কি ছিল, কিন্তু এটা আমি আপনার মুখ থেকেই শুনতে চাইছি। আচ্ছা? বলবেন না কেন? নীরব থাকার মত তো কোনো কারণ আমি আর দেখছি না।

“নাহ? ঠিক আছে। যেহেতু কথা বলার কোনো ইচ্ছাই আপনার নেই, সেহেতু আমিই বলি।

“জানেন এটা কি, মিস্টার নোনোগুচি? ঠিক, এটা একটা সিডি। কোনো মিউজিকের নয়। এটা সিডি রম, যার একটা পুড়িয়ে ফেলেছে হিদাকা। জানা গিয়েছে, কয়েক বছর আগে নিজের রিসার্চ ম্যাটেরিয়াল, ছবি সবকিছু সিডিতে রাখা শুরু করে সে। পুরনো ছবিগুলো স্ক্যান করে নেয় আর নতুন ছবি তোলার জন্য ব্যবহার করে নতুন একটা ক্যামেরা।

“কেন আমি হিদাকার সব রেফারেন্স ছবিগুলো দেখতে গেলাম? কারণ আমি অতীত ঘাঁটতে চেয়েছি। তার ও আপনার অতীত। একটা নির্দিষ্ট ছবি আমার মনোযোগ আকর্ষণ করে। আমি যা ভেবেছি সেটা যদি ঐ ছবিতে থাকে, তাহলে ধরে নিতে হবে হঠাৎ-ই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠা একটা জিনিসে খুব একটা নজর দেয়া হয়নি। আর এতে আপাত অসম্পর্কিত ব্যাপারগুলো সুন্দরভাবে মিলে যাবে।

“জানতে পারি আসল ছবিটা এরইমধ্যে ফেলে দেয়া হয়েছে। কিন্তু আমি জানতাম, মিস্টার হিদাকার কাছে এই ছবিটা একসময় ছিল। আর ওটা কপি করার মত যথেষ্ট সময় সে পেয়েছে। এই সিডিতেই সেটা কপি করা আছে। দুঃখিত, জানি খুবই নাটকীয় আচরণ করছি। কিন্তু এই জিনিসের কোনো দরকার নেই। আপনি এরইমধ্যে জানেন কোন ছবির কথা বলছি আমি। একটা পুরনো পোলারয়েড ছবি। ছবিটা মিডল স্কুলের এক মেয়েকে মাসায়া ফুজিওর যৌন হয়রানির।

“ছবিটা বেশ পরিস্কার। ভাবছিলাম আপনার জন্য প্রিন্ট আউট করে নিয়ে আসব। পরে ভাবলাম, এর কোনো দরকার নেই। আপনি ভালোমতই জানেন ছবিতে কী দেখেছি আমি। যা ধারণা করেছিলাম ঠিক সেটাই। মেয়েটাকে আপনিই চেপে ধরেছিলেন, মিস্টার নোনোগুচি। ওই মেয়েটাকে ধর্ষণ করতে আপনিই ফুজিওকে সহায়তা করেছেন।

“আপনার স্কুল জীবনের ব্যাপারগুলো খতিয়ে দেখতে গিয়ে একেক মানুষের মুখে একেক কথা শুনি। বুলিয়িং বা হয়রানির প্রসঙ্গ বেশ কয়েকবার-ই উঠে এসেছে। কেউ কেউ বলেছে আপনি ছিলেন ভিকটিম, বাকিরা বলেছে আপনিও হয়রানকারীদের একজন। আমার মতে ওই দুই পক্ষের কথাই ঠিক। আপনি হয়রানির শিকার হয়েছেন, এমনকি ফুজিওর গ্যাংয়ে যুক্ত হওয়ার পরও আপনার ওপর হয়রানি চলমান ছিল। খালি বদলে গিয়েছিল আপনার ওপর হওয়া হয়রানির ধরন।

“শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা থেকে আমরা দুজনেই জানি, বুলিং বা হয়রানির কোনো শেষ নেই। একটা স্কুলের বুলিংয়ের সাথে জড়িত ছেলেরা এসব চালাতেই থাকে। যদি কোনো শিক্ষক বলে, ‘আমার ক্লাসে আর কোনো বুলিং বা হয়রানি নেই,’ তবে ধরে নিতে হবে সে বলতে চাইছে, ‘আমি বিশ্বাস করতে চাই আমার ক্লাসে আর কোনো বুলিং বা হয়রানি নেই।’

“বুঝতে পারছি, মেয়েটার সাথে যা ঘটেছিল সেটা আপনার হৃদয়ে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করেছে। আমি বিশ্বাস করি না, আপনি যা করেছেন সেটা স্বেচ্ছায় করেছেন বা কাজটা করে মজা পেয়েছেন। আপনি জানতেন মাসায়া ফুজিওর কথার অমান্য করলে আবারও আপনার জীবন জাহান্নাম হয়ে যাবে। আমার মতে, নিশ্চয়ই নিজের কাজের জন্য অনুশোচনা হয় আপনার, ঘৃণা হয় নিজের প্রতি। ঐ জায়গায় আমি উপস্থিত না থাকলেও, এই যন্ত্রণাটা অনুভব করতে পারি, মিস্টার নোনোগুচি। ওইদিন-ই আপনি শেষবারের মত হয়রানির শিকার হয়েছিলেন, সম্ভবত সবথেকে বাজেভাবে।

“আপনি খুব করে চাইতেন অতীতের ওই দুঃসহ স্মৃতিটা কবর দিতে এটা ভোলার জন্য এতই মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন, আপনি খুন করতেও পিছ পা হননি।

“দাঁড়ান। কেন এই গূঢ় সত্যটা বিব্রত করছে আপনাকে? নিষিদ্ধ প্রান্তর বইটা লেখার আগেই হিদাকার হাতে এসেছিল ওই ছবিটা। এটা সে অন্য কাউকে দেখিয়েছে এমন কোনো আভাস আমরা পাইনি। কেন নিশ্চিত হতে পারলেন না, আপনার গোপন রহস্য নিরাপদ-ই ছিল হিদাকার কাছে?

“দয়া করে এখন বলবেন না হিদাকা এই ছবিটা দিয়ে ব্ল্যাকমেইল করত আপনাকে। একই মিথ্যা দ্বিতীয়বার কাজ করবে না। আর এরকম শৈল্পিক একটা অপরাধের নেপথ্যে থাকা মানুষের মুখে এই কথাটা মানাবেও না।

“আমার মতে আগুনে ঘি ঢেলেছিল মিয়াকো ফুজিও। বইটা লেখার কারণে কুনিহিকো হিদাকাকে কোর্টে তোলার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল সে। বিশেষ করে বইয়ে তার ভাইকে আবছাভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছিল বলেই। হিদাকা সম্ভবত ধরেই নিয়েছিল এই সমস্যাটা এড়ানো যাবে না। এটাই মূলত দুশ্চিন্তায় ফেলে আপনাকে। ভেবেছিলেন, ছবিটা কোর্টে এভিডেন্স হিসেবে দেখানো হলে কী হবে আপনার।

“আমার ধারণা, আপনার দুশ্চিন্তার শুরু হিদাকার ওই উপন্যাসটা লেখা শুরু করার পর থেকে। মিস ফুজিও হিদাকাকে চাপ দেয়া শুরু করলে আতঙ্ক বাড়তে থাকে আপনার। অবশেষে খুন করার জন্য প্রস্তুত হন আপনি।

“ব্যাপারটা বিশ্বাসযোগ্যই। কিন্তু আমার চোখ এড়িয়ে যায় ধাঁধার সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ টুকরো : কুনিহিকো হিদাকার সাথে আপনার সম্পর্কের ধরন। কেন আপনার মনে হল এই বিষয়টা গোপন রাখতে হিদাকাকে খুন করা প্রয়োজন? যে লোকটার সাথে সাম্প্রতিক কয়েক বছর ধরে বন্ধুত্বের সম্পর্ক চলছিল আপনার। আপনার অথবা আপনি যা করেছেন সেই ব্যাপারে নিজের উপন্যাসে কোনো ইঙ্গিত-ই দেয়নি সে। এমনকি যদি মিয়াকো ফুজিওর সাথে হিদাকার সমস্যাও বাঁধে, তবুও কেন আশা করলেন না আপনার গোপন ব্যাপারটা হিদাকার কাছে নিরাপদ থাকবে?

“আপনার স্বীকারোক্তিতে হিদাকার সাথে মিস ফুজিওর এক ধরনের বৈরিতা আছে বলে দাবি করেছেন। আপনার লেখা সবকিছু নিয়েই প্রশ্ন তোলার অধিকার তো আমার আছে এখন, ঠিক না? চলুন কিছু ব্যাপার নিয়ে আলাপ করা যাক যেগুলো এমনিতেই বোঝা যায়। প্রথমত মিডল স্কুলে হিদাকার সাথে আপনার বন্ধুত্ব ছিল না, এরপর তার সাথে বন্ধুত্ব হয়েছে ও একসময় গিয়ে তার সাথে একটা ভালো সম্পর্ক দাঁড় করাতে পেরেছেন। এমনকি আপনাকে একজন প্রকাশকের সাথে পরিচয়ও করিয়ে দিয়েছে সে যেন আপনি একজন লেখক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারেন। শিশুসাহিত্যের লেখক। এছাড়াও মিয়াকো ফুজিওর সাথে বারবার আলাপ কিংবা নিষিদ্ধ প্রান্তর বইয়ে আপনার নাম ও ওই ঘটনার সাথে আপনার সংশ্লিষ্টতা বিচক্ষণতার সাথে এড়িয়ে গিয়েছে সে।

“এইসব ঘটনার ওপর ভিত্তি করে যদি আমরা ধারণা করার চেষ্টা করি মানুষ হিসেবে আসলে কেমন ছিল হিদাকা, তাহলে দেখা যাবে, সে ছিল তার ছোটবেলার-ই প্রতিরূপ ‘একটা ছেলে, যে চারপাশের সবার প্রতিই মমতাশীল,’ এমনটাই বলা হত তার ব্যাপারে। ফলে বলা যায়, আপনার উদ্দেশ্য যেমনই হোক না কেন, আপনাকে ভালো বন্ধু বলেই মনে করত হিদাকা

“এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে আমার অনেক সময় লেগেছে। কেন না হিদাকার এই প্রতিচ্ছবি, তদন্তের শুরুতে হিদাকাকে যেরকম ভেবেছিলাম সেটার থেকে একেবারে ভিন্ন। সত্যি বলতে, হিদাকার ছোটবেলার ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে তার ওই প্রতিচ্ছবি আমাকে ভালোমতোই খুঁচিয়েছে।

“তার ব্যাপারে আমি যা শুনছি ও আপনার মিথ্যে স্বীকারোক্তি পড়ে তাকে যেভাবে ভেবেছি, এই দুইয়ের মাঝে যে বিস্তর ফারাক, সেটাই কি আমার মনের ভেতরকার ওই বিচ্ছিন্নতার কারণ? নাহ-হিদাকার ব্যাপারে ওরকম নেতিবাচক মনোভাবের বীজ আমার মনের মধ্যে বহু আগেই বোনা হয়েছে। এমনকি আপনার গ্রেফতারেরও আগে। অবশেষে বুঝতে পেরেছি এর সূত্রপাত কোথায় : খুনের দিনের ব্যাপারে আপনি যে লেখাটা লিখেছেন ওখান থেকে।

“আমি ঐ লেখাটা প্রথমবার পড়ার সময় মনোযোগ দিয়েছিলাম লাশ খুঁজে পাওয়ার বিবরণের দিকেই। তাছাড়া আরও একটা গভীর ফাঁদ পাতা ছিল ওতে।

“আপনার চেহারা দেখেই বুঝতে পারছি একেবারে জায়গামতই আঘাত হেনেছি আমি। হ্যাঁ, ঠিক…আমি বিড়ালটার কথাই বলছি। যেটাকে খুন করেছেন আপনি।

আপনার অ্যাপার্টমেন্টের গাছের মাটিতে কীটনাশক খুঁজে পেয়েছি আমরা। অতিরিক্ত কীটনাশকটুকু ড্রেনে ফেলে দিলেই ভালো করতেন। বিড়ালের দেহে যে কীটনাশক পাওয়া গিয়েছে সেটা মিলে গিয়েছে আপনার অ্যাপার্টমেন্ট থেকে পাওয়া কীটনাশকের সাথে। বিড়ালটার মালিক ওটার মৃতদেহ একটা বক্সে ঢুকিয়ে তার বাগানে দাফন করেছিল। আমরা কবর থেকে বিড়ালটাকে তুলে ওর দেহ পরীক্ষা করি।

“সম্ভবত আর্টিকেলে বিড়াল নিয়ে হিদাকার সমস্যার কথা পড়েছিলেন আপনি? অথবা তার সাথে আপনার সম্পর্ক ভালো ছিল, সে-ই হয়তো এই ব্যাপারে আপনাকে বলেছিল? তো আপনি মিটবলে বিষ মিশিয়ে বাগানের মধ্যে ফেললেন। ওই মহিলার বিড়াল সেটা খেয়ে মারা গেল। এই সবকিছু আপনি করেছেন আমার মধ্যে হিদাকার ব্যাপারে নেতিবাচক মনোভাব সৃষ্টি করতে।

“জানেন, এই কেসে কাজ করতে গিয়ে বুঝতে পারলাম সাহিত্য জগতে সময় কাটাতে হবে আমাকে, এজন্য এর সম্পর্কে কিছু পড়াশোনা করবো বলে ঠিক করি। তখনই জানতে পারি সাহিত্যে চরিত্র তৈরি বা ক্যারেক্টারাইজেশনের ব্যাপারে। স্পষ্টতই, একটা চরিত্র কেমন সেটা এক- দুই লাইনে পাঠককে বলে দেয় না লেখক। এর পরিবর্তে ওই চরিত্রের বিভিন্ন অভ্যাস, কথা বলার ধরন দেখিয়ে দেয়। যার সাহায্যে একজন পাঠকের কল্পনায় ভেসে ওঠে ওই চরিত্রের প্রতিচ্ছবি।

“তো প্রথমে ওই লেখাটা লেখার সময় আপনি জানতেন যত দ্রুত সম্ভব মূল চরিত্র মানে কুনিহিকো হিদাকাকে তৈরি করতে হবে। তার নিষ্ঠুরতা দেখানোর জন্য তাকে দিয়ে একটা বিড়াল খুন করানোর থেকে আর ভালো কি উপায় থাকতে পারে? কী কাকতলীয় ঘটনা, বিড়ালের মালিকের সাথে ওইদিন-ই বাগানে দেখা হয় আপনার। লেখার শুরুতেই ওই ঘটনাটা লিখে হিদাকার অন্যায় আচরণ আরও বিশ্বাসযোগ্য করে তোলা গিয়েছে।

“পুরোদমেই বোকা বনে গিয়েছি। এমনকি আপনাকে গ্রেফতারের পর যখন বুঝলাম ওই লেখাটার ওপর ভরসা করা যাবে না, তখনও কল্পনাই করতে পারিনি বিড়ালের ব্যাপারটা মিথ্যে হতে পারে। আর হিদাকার প্রতি আমার প্রথম মনোভাবও সংশোধনের চেষ্টা করিনি।

“প্রথম যখন টের পেলাম বিড়ালটাকে আপনি খুন করেছেন, মাথার ভেতর বাতি জ্বলে উঠল। মনে হল, ঠিক যে কারণে বিড়ালটাকে খুন করেছেন, পুরো অপরাধটা ঘটার কারণও যদি ওটাই হয়ে থাকে? অন্যভাবে বললে, আপনার লক্ষ্য শুধু হিদাকা খুন করাই ছিল না, সেইসাথে তার যশখ্যাতি ধুলোয় মিশিয়ে দেয়াও? তখনই বুঝলাম কোনো একটা দিকে এগোচ্ছি।

“একটু আগেই বললাম, আপনি আপনার অতীত ঢাকতে চাইছিলেন একমাত্র যে ব্যক্তি সেটার ব্যাপারে জানতো তাকে খুন করেই। আপনি এটা অস্বীকার করার কোনো চেষ্টাই করেননি, আমার মনে হয় এই কথাটা একটু হলেও সত্যি। কিন্তু আপনার পরিকল্পনার পেছনে মূল কারণ এটা ছিল না, এটা শুধুই সর্বশেষ ধাপ ছিল আর কি।

“যখন সিদ্ধান্ত নিলেন হিদাকাকে মরতে হবে, তখন আপনার পরবর্তি পদক্ষেপ কী ছিল? প্রথমে আপনি বুঝতে পারলেন আপনার একটা নির্দিষ্ট মোটিভ দরকার। এমন কিছু দরকার যা প্রকাশ পেলে ভিক্টিমের মানহানিই তো ঘটবেই সেইসাথে যেন আপনিও লোকের সহানুভূতি পাবেন। যে সমাধানটা পেয়েছেন সেটার শুরু তার স্ত্রী হাতসুমির পরকীয়ায় আর শেষ জোর করে চাপানো গোস্টরাইটিং দিয়ে। আপনার পরিকল্পনা ঠিকভাবে সফল হলে হাতসুমির সম্মান, হিদাকার চরিত্র সবকিছু তো ধ্বংস হতই, সেই সাথে লেখক হিসেবে যে সম্মান হিদাকা অর্জন করেছে কালি পড়ত সেগুলোতে। এদিকে তার লেখাগুলোর সব ক্রেডিট পেতেন আপনি।

“কষ্ট করে ওই পান্ডুলিপিগুলো লেখা ও রাতের তীব্র ঠান্ডায় ভিডিও বানানোর যোগ্য পুরষ্কার-ই হত সেটা। আমার মনে হয় না শুধুমাত্র নিজের অতীত ঢাকতে এতকিছু করেছেন আপনি। ওটার জন্য একটু কষ্ট করাই যায়, কিন্তু খুনটা ছিল আপনার পরিকল্পনার আরেকটা ধাপ, তাকে খুন করে এযাবৎ হিদাকা যা অর্জন করেছে সেসব ধ্বংস করতে চেয়েছিলেন আপনি।

“আমি দীর্ঘসময় ধরে ভেবেছি, কেন কেউ এরকম কাজ করবে। নিজের জীবনের অবশিষ্ট যেটুকু সময় আছে, সেটা কেন অন্য কাউকে ধ্বংস করতে কাজে লাগাবে। সত্যি বলতে এরকম আচরণের পিছে কোনো যৌক্তিক কারণ খুঁজে পাইনি আমি। ভাবছি, আপনার নিজের কাছেও এর কোনো যৌক্তিক ব্যাখ্যা আছে কি না, মিস্টার নোনোগুচি।

“দশ বছর আগে ঘটা একটা ঘটনা মনে পড়ে গেল আমার। সম্ভবত, আপনারও মনে আছে, ঠিক গ্র্যাজুয়েশনের পরেই বখাটে গ্যাংয়ের নেতাকে ছুরি মারে আমার এক ছাত্র। পুলিশ বখাটেদের জিজ্ঞেস করেছিল কেন বারবার আমার ওই ছাত্রকে হেনস্তা করত ওরা। ওরা উত্তর দিয়েছিল, ‘তাকে পছন্দ করি না বলে’। শুধুমাত্র ঘৃণা, খাঁটি বিদ্বেষ-ই এর কারণ। ইংরেজিতে যাকে বলে ম্যালিস। আপনি তো ইংরেজি কম্পোজিশনের ক্লাসও নিতেন মাঝে মাঝে, শব্দটা আপনার নিশ্চয়ই পরিচিত।

“আমার মনে হয়েছে, আপনার অবস্থাও ওরকমই কি না। আসলে আপনার অন্তরে থাকা হিদাকার প্রতি অসীম বিদ্বেষ-ই হিদাকার মৃত্যু ডেকে এনেছে। যে বিদ্বেষের পরিমান আপনার নিজের পক্ষেও পরিমাপ করা সম্ভব নয়।

“কিন্তু এরকম বিদ্বেষ আপনার ভেতর কিভাবে জন্মেছে?

“আপনার ও হিদাকার দুজনের অতীত নিয়েই বিস্তর ঘাঁটাঘাঁটি করেছি আমি। কিন্তু হিদাকার প্রতি আপনার এত ক্রোধের কারণ আমি খুঁজে পাইনি। ভালো ছেলে ছিল হিদাকা…নাহ, আলাদা রকমের ছিল সে। তাকে খুন নয়, ধন্যবাদ দেয়া উচিত ছিল আপনার। আপনি মাসায়া ফুজিওর চামচামি করতেন, হিদাকাকে হেনস্তা করার জন্য উস্কানি দিতেন। তবুও হিদাকা আপনাকে সাহায্য করেছে।

“জানি, তার কাছে নিজেকে ছোট মনে হত আপনার। প্রাপ্তবয়স্ক হয়েও হিদাকাকে কতটা ঈর্ষা করতেন সেটাও জানি। তার একজন সফল লেখক হওয়ার ব্যাপারটা কখনোই মানতে পারেননি আপনি। আপনি যা যা চাইতেন, সবকিছুই অর্জন করে সে। হিদাকার প্রথম সম্মাননা পাওয়ার সময় আপনার অনুভূতি কেমন ছিল, সেটা ভাবলেই গা শিউরে ওঠে আমার।

“কিন্তু এখনও সে আপনার ধরাছোঁয়ার বাইরে, ঠিক না। একজন লেখক হওয়ার জন্য এতটাই মরিয়া ছিলেন আপনি। ভেবেছিলেন তার সাথে সম্পর্ক রাখলে সহজেই আপনার লক্ষ্য অর্জন সম্ভব হবে। তো সাময়িকভাবে হলেও হিদাকার প্রতি আপনার ভেতরে থাকা বিদ্বেষ ভুলে থাকার চেষ্টা করেছেন।

“কাজটা সহজ নয়, ঠিক না? জানি না এটা আপনার দুর্ভাগ্য, প্রতিভার অভাব, নাকি দুইয়েরই মিশ্রণ, কখনোই নিজের স্বপ্নকে ধরতে পারেননি আপনি। শরীরটা ভেঙে পড়া শুরু করলে, টের পেলেন কখনোই নিজের স্বপ্ন পূরণ করতে পারবেন না।

“যখন বুঝতে পারলেন নিজের মৃত্যু ঘনিয়ে আসছে, থামাতে পারলেন না নিজেকে। অন্তরে ক্রোধের অনল নিয়ে মরতে ইচ্ছা করছিল না আপনার। এদিকে হিদাকা জানত আপনার অতীতের ব্যাপারে, ব্যাপারটা ফাঁস করে দেয়ার মত প্রমাণ তার হাতে ছিল। তবে এই কারণে ওরকম কিছু করেননি আপনি। এটা শুধু প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে। আপনাকে ঠেলে দিয়েছে নিকষ কালো অন্ধকারের পথে। জীবনের শেষ দিনগুলো একটা নিখুঁত অপরাধ ঘটানোর পরিকল্পনা করে কাটিয়েছেন আপনি। একজনকে খুন করে নিজ থেকেই ধরা পড়েছেন যাতে আপনার ভিক্টিমের সবকিছু ছিনিয়ে নিতে পারেন। যেন ধ্বংস করতে পারেন তার সুনাম, সম্মান, খ্যাতি, যা কিছু সে ভালোবাসত। এমনকি চুরি করতে চেয়েছিলেন তার লেখা বইগুলোর ক্রেডিটও।

“এসবই আমার অনুমান। এতক্ষণ যা বললাম এতে আপনার কোনো দ্বিমত আছে? আপনার মৌনতাকে ‘না’ হিসেবে ধরে নেব আমি।”

“যাওয়ার আগে শেষ একটা উপদেশ দিয়ে যাই। আপনাদের ব্যাপারে মানুষকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে গিয়ে জেনেছি ওরা মনে করত হিদাকা ও ওই এলাকার অন্যান্য মানুষদের অপছন্দ করতেন আপনি ও আপনার মা। এদের প্রতি একধরনের বিরূপ মনোভাব ছিল আপনাদের। এই বিরূপ মনোভাবের কোনো ভিত্তি নেই। অন্য কারোরও ওদের প্রতি বিরূপ মনোভাব ছিল, এমন কোনো আভাস পাইনি। আমার মনে হয়েছে হিদাকার প্রতি আপনার এই ঘৃণার সৃষ্টি আপনার ভেতর থেকে নয়। আপনার মা-ই হয়তো হিদাকার প্রতি ঘৃণার বীজ আপনার মধ্যে বপন করে দিয়েছিল। আপনাকে এটাই শুধু জানিয়ে রাখলাম। যেহেতু হিদাকাকে আর দোষারোপ করতে পারবেন না, চাইলে আপনার মাকে দোষারোপ করতে পারেন।

“অনেকক্ষণ ধরে কথা বলছি, তাই না? গলা শুকিয়ে গিয়েছে আমার। সার্জারি করানোর অনুমতি দিয়েছেন আপনি, খোঁজ নিয়ে দেখলাম এটা পরিবর্তন করা যাবে না। কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে আসবে ডাক্তাররা। আশা করছি আপনার সার্জারি সফল হবে। আরও অনেকদিন বাঁচবেন আপনি।

“যা-ই হোক, সামনে দীর্ঘ বিচারকাজ অপেক্ষা করছে আপনার জন্য।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *