অধ্যায় ১ – খুন : ওসামু নোনোগুচি’র বয়ান
ঘটনাটা ঘটে ১৯৯৬ সালের ১৬ই এপ্রিল, এক মঙ্গলবারে।
বিকেল সাড়ে তিনটা নাগাদ কুনিহিকো হিদাকার বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হই আমি। মাত্র এক স্টেশন দূরেই ওর বাসা, ট্রেনে চেপে যেতে খুব বেশিক্ষণ লাগে না। স্টেশন থেকে বেরিয়ে খানিকটা পথ বাসে যেতে হয়, এরপর বাকিটা হেঁটে। মেরেকেটে বিশ মিনিট।
ওর বাসায় যেতে বিশেষ কোন উপলক্ষের দরকার পড়তো না কখনোই;
বন্ধুর বাসায় যেতে আসলে কোন কারণ লাগেও না। তবে আজকের ব্যাপারটা ভিন্ন। একটা নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে নিয়ে ওর ওখানে গিয়েছিলাম। আজকে না গেলে হয়তো লম্বা একটা সময় হিদাকার সাথে দেখা হতো না।
ওর বাড়িটা এক অভিজাত আবাসিক এলাকায়। আশপাশের বাড়িগুলোর প্রত্যেকটাই রুচিশীল, রীতিমত ম্যানশন বলা চলে। আগে একসময় বন ছিল জায়গাটায়। অনেক বাসিন্দাই পুরনো গাছগুলো না কেটে নিজের সীমানার মধ্যে রেখে দিয়েছে সৌন্দর্য বর্ধনের নিমিত্তে। লম্বা লম্বা বিচ আর ওক গাছগুলোর কারণে রোদের মধ্যে রাস্তায় হেঁটে বেশ আরাম। তবে রাস্তাগুলো কিন্তু যথেষ্ট চওড়া; সবগুলোই ওয়ান-ওয়ে। সুতরাং, বুঝতেই পারছেন যে
এখানে কেমন লোকেদের আবাস।
কয়েক বছর আগে যখন জানতে পারলাম যে হিদাকা এই এলাকায় বাড়ি কিনেছে, খুব একটা অবাক হইনি। এখানে একটা স্থায়ী ঠিকানার ব্যবস্থা করা অনেকের জীবনেরই স্বপ্ন।
হিদাকাদের বাড়িটাকে অবশ্য ঠিক ম্যানশন বলা চলে না। কিন্তু নিঃসন্তান কোন দম্পতির বসবাসের জন্যে যথেষ্ট বড়। সূঁচালো ছাদ আদ্দিকালের জাপানিজ বাড়িগুলোর কথা মনে করিয়ে দেবে। কিন্তু বাদবাকি সবকিছু পাশ্চাত্য তরিকায় তৈরি-জানালা, ঝুলবারান্দা, বাগান—সবই। বাড়ির নকশা কেমন হবে, সেটা নিয়ে স্বামী-স্ত্রী দুজনই বিস্তর আলোচনা করেছে নিশ্চিত। তবে বাড়ির চারধারের নিচু দেয়ালগুলো দেখলেই বোঝা যাবে, গিন্নির মতই প্রাধান্য পেয়েছে বেশি। কথায় কথায় সে একবার আমাকে বলেছিল, ছোট থেকেই ইউরোপিয়ান কায়দার দূর্গগুলো আকর্ষণ করতো তাকে। হ্যাঁ, চিন্তাভাবনা কিছুটা অদ্ভুতই ছিল ওর স্ত্রীর।
মৃত মানুষের ব্যাপারে অবশ্য এভাবে কথা বলাটা উচিত নয়। কিন্তু সত্য তো সত্যই।
দেয়ালের পাশ দিয়ে কিছুদূর হেঁটে গেটের সামনে এসে দাঁড়ালাম। ইন্টারকমের বাটনটা গেটের পাশেই। দেয়ালের ইটগুলো এমনভাবে গাঁথা হয়েছে যে পাশ দিয়ে হাঁটার সময় কেবল লম্বাটে অংশটুকু দেখা যায়।
বাটনটায় চাপ দিয়ে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পরেও ভেতর থেকে কোন শব্দ ভেসে এলো না। এ সময় খেয়াল করলাম ড্রাইভয়েতে টয়োটা গাড়িটা নেই। ভাবলাম, হয়তো বাইরে গেছে।
ওর ফেরত আসা পর্যন্ত কিভাবে সময় কাটাবো চিন্তা করছিলাম, এমন সময় ওদের বাগানের চেরি গাছটার কথা মনে হলো। শেষবার হিদাকাদের বাসায় আমি আসি দশদিন আগে। তখনও চেরি ফুলগুলো পুরোপুরি ফোটেনি। হঠাৎই দেখার ইচ্ছে হলো গাছটা।
সাত-পাঁচ না ভেবে গেট খুলে ভেতরে ঢুকে পড়লাম। আশা করছি আমার অনধিকার প্রবেশে খুব বেশি কিছু মনে করবে না ওরা। গেটের সামনে থেকে বাড়ির দিকে যে রাস্তাটা চলে গেছে তা কিছুদূর যাবার পরেই দুই ভাগ হয়ে যায়। বাড়তি রাস্তাটা ধরে কিছুদূর এগোলেই বাগান। আমার গন্তব্যও সেই দিকে।
কিছু ফুল মাটিতে পড়ে আছে। তবুও গাছে যা আছে, তাকে একদম আদর্শ ‘চেরি ব্লসম’ বলা চলে। মনোমুগ্ধকর দৃশ্য। আমি হয়তো লম্বা সময় ধরে গাছটার দিকেই তাকিয়ে থাকতাম, যদি অচেনা এক নারীকে ওখানে
ম্যালিস
চোখে না পড়তো। মাটির দিকে তাকিয়ে কিছু একটা খুঁজছিল সে। পরনে ক্যাজুয়াল জিন্স আর সোয়েটার। সাদা কিছু একটা ধরে রেখেছে এক হাতে।
“হ্যালো?” তাকে বললাম।
আমার ডাক শুনে চমকে গেল মহিলা, দ্রুত মাথা তুলে বলল, “ওহ, সরি।”
এবারে খেয়াল করলাম, তার হাতের সাদা জিনিসটা আসলে হ্যাট। “বাতাসের আমার হ্যাটটা বাড়ির ভেতরে এসে পড়েছিল। সরি, কাউকে দেখলাম না বাসায়।”
দেখে মনে হচ্ছে মহিলার বয়স চল্লিশের কাছাকাছি। সরু চোখ, সূচালো নাক এবং চাপা ঠোঁটজোড়ায় বিশেষ কোন কিছু নেই। একদমই গড়পড়তা ধাঁচের ফ্যাকাসে চেহারা। এক মুহূর্তের জন্যে কেমন যেন সন্দেহ হলো আমার। আসলেই কি এত জোরে বাতাস বইছিল যে হ্যাট উড়ে যাবে কারো?
“ওখানে কিছু চোখে পড়েছে নাকি আপনার?” জিজ্ঞেস করলাম। “এত সুন্দর করে জন্মেছে এখানকার ঘাস, ভাবছিলাম কিভাবে এগুলোর যত্ন নেয় এখানকার বাসিন্দারা,” হেসে বলল সে।
“আসলে আমি নিজেও জানি না,” বলে একবার কাঁধ ঝাঁকালাম। “এটা আমার বন্ধুর বাড়ি।”
জবাবে মাথা নাড়লো মহিলা। বোধহয় আগেই বুঝতে পেরেছিল আমি এখানে থাকি না। “এভাবে হুট করে ঢুকে পড়ার জন্যে দুঃখিত,” বলে একবার বাউ করে আমাকে পাশ কাটিয়ে গেটের দিকে পা বাড়ালো।
এর পাঁচ মিনিট পর ড্রাইভওয়ে থেকে একটা গাড়ির শব্দ কানে এলো আমার। চলে এসেছে হিদাকা। বাড়ির সামনের দরজার কাছে এসে দেখি গ্যারেজে টয়োটাটা ঢোকাচ্ছে সে। আমাকে দেখে একবার মাথা নাড়লো কেবল। পেছনের সিটে বসে আছে ওর নব পরিণীতা স্ত্রী। মিষ্টি হেসে আমার উদ্দেশ্যে একবার বাউ করলো সে।
“সরি,” গাড়ি থেকে বেরিয়ে বলল হিদাকা। “শেষ মুহূর্তের কেনাকাটায় বের হয়েছিলাম, আসার পথে রাস্তায় ভীষণ জ্যাম ছিল, অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছো নাকি?”
“তোমাদের চেরি গাছটা দেখছিলাম।”
“সব ফুল তো ঝরেই গেছে।”
“যা আছে, তা-ও কম কী?”
হাসলো হিদাকা। “তা অবশ্য ঠিক। খুব সুন্দর লাগে না দেখতে? কিন্তু আসলে ঝামেলাটা শুরু হয় সব ফুল ঝরে যাওয়ার পরে। শয়ে শয়ে শুঁয়োপোকা জড়ো হয় বাগানে। আমার অফিসের একদম পাশেই তো গাছটা…সেখান থেকে সব দেখা যায়।”
“তাহলে তো তোমার ভাগ্য ভালো বলতে হচ্ছে। লম্বা একটা সময়ের জন্যে চলে যাচ্ছো।”
“ভাই, ওই সময় এখানে পাগলেও থাকতে চাইবে না। যাইহোক, ভেতরে চলো। এখনও সব কাপ ব্যাগে ভরিনি। তোমাকে এক কাপ কফি খাওয়াতে পারবো অন্তত।”
ভেতরে যাওয়ার জন্যে পা বাড়ালাম আমরা।
বাড়ির সবকিছুই ততক্ষণে বাক্সপেটরায় ভরে ফেলা হয়েছে। এমনকি দেয়ালে ঝোলানো পেইন্টিংগুলো অবধি উধাও।
“প্যাকিং শেষ নাকি?” জিজ্ঞেস করলাম।
“শুধু অফিস রুমের জিনিসপত্রগুলো গোছগাছ করা বাকি,” হিদাকা বলল। “অবশ্য আমরা নিজেরা খুব বেশি কিছু করিনি। মুভিং কোম্পানির লোকেরা এসেছিল বেশ কয়েকবার।”
“আজ রাতে কোথায় থাকবে?”
“হোটেলে একটা রুম বুক করে রেখেছি। দ্য ক্রাউন…চেনো বোধহয়? তবে আমার মনে হয় এখানেই থেকে যেতে হবে।”
ওর অফিসে চলে গেলাম আমরা। ঘরটা ঠিক বড়ও না, আবার ছোটও না। ভেতরে আসবাব বলতে একটা কম্পিউটার টেবিল আর বুকশেলফ রয়ে গেছে।”
“তোমার বোধহয় কালকে একটা বই জমা দেয়ার ডেডলাইন?”
ভ্রু কুঁচকে মাথা নাড়লো হিদাকা। “হ্যাঁ, সিরিজের শেষ বই। আজকে রাতের মধ্যে প্রকাশককে ফ্যাক্স করে পাঠাতে হবে। সেজন্যেই ফোনের লাইন খুলে ফেলিনি এখনও।”
“আর কত পৃষ্ঠার মত লেখা বাকি?”
“ত্রিশের আশপাশে…হয়ে যাবে।”
ডেস্কের একপাশে মুখোমুখি দুটো চেয়ারে বসলাম আমরা। এসময় কফি হাতে রাই প্রবেশ করলো ভেতরে।
“ভ্যাঙ্কুভারে আবহাওয়া যে কেমন এখন, কে জানে। এখানকার চেয়ে ঠান্ডা হবে নিশ্চিত,” ওদের দুজনের উদ্দেশ্যে বললাম আমি।
“পুরোপুরি ভিন্ন একটা মহাদেশে পাড়ি জমাচ্ছি। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে অনেকটাই উপরে…ঠান্ডা বেশি হওয়াটাই স্বাভাবিক।”
“ওদের গ্রীষ্মকালেও তাপমাত্রা অনেক কম থাকে, এটা একটা স্বস্তির বিষয়,” রাই বলল। “সব সময় এসি চালিয়ে রাখতে ভালো লাগে না আমার।”
“হিমেল হাওয়ায় রুমের মধ্যে বসে আরামসে লেখালেখি করতে পারবো, এটা ভাবতে ভালো লাগে আমার। কিন্তু আমরা দুজনেই জানি, সেরকম কিছু হবে না,” হাসি ফুটলো হিদাকার মুখে।
“ওসামু, আপনি কিন্তু আমাদের ওখানে ঘুরতে আসবেন। পুরো ভ্যাঙ্কুভার ঘুরে দেখাবো,” প্রস্তাব দিলো রাই।
“ধন্যবাদ। চেষ্টা করবো।”
“অবশ্যই আসবে কিন্তু,” বলে একবার বাউ করলো রাই। “ আপনারা দুই বন্ধু গল্প করুন তাহলে।” রুম থেকে বেরিয়ে গেল সে।
কাপ হাতেই চেয়ার ছেড়ে উঠে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো হিদাকা। “শেষবারের মতন নিজের আঙিনায় চেরি ব্লসম দেখে যেতে পারছি, এই বা কম কী?”
“আচ্ছা যাও, আগামী বছর যদি ফুল ফোটে, আমি ছবি তুলে পাঠাবো তোমাদের। কানাডায় কি চেরি গাছ আছে?”
“জানি না। আমরা যেখানটায় উঠছি, সেখানে নেই অন্তত,” কফির কাপে চুমুক দিলো সে।
“ওহ্, একটা ব্যাপার। তোমরা আসার আগে আমি ভেতরে ঢুকে দেখি একজন মহিলা দাঁড়িয়ে আছে চেরি গাছটার সামনে,” ওকে কথাটা বলবো কি না বুঝতে পারছিলাম না এতক্ষণ।
“তাই নাকি?” ভ্রু কুঁচকে গেল হিদাকার।
মহিলাটার ব্যাপারে সব খুলে বললাম। সন্দেহের জায়গায় এবারে শুকনো একটা হাসি ফুটে উঠল ওর মুখে। “ভদ্রমহিলা দেখতে কি ‘কোকেশি পুতুলগুলোর মতন? মাথাটা একদম গোল?”
“হ্যাঁ, তুমি বলার পর এখন সেরকমই মনে হচ্ছে,” হেসে বললাম।
“ওনার নাম নিমি। এই রাস্তারই শেষ মাথায় থাকে। দেখলে বোঝা যায় না কিন্তু ভদ্রমহিলার বয়স চল্লিশের ওপরে। রাইয়ের ধারণা সে বিবাহিত, স্বামী চাকরির সুবাদে অন্য কোন শহরে থাকে। দূরত্বের সাথে মানিয়ে নিয়েছে দুজনে।”
“বাহ, বেশ ভালোই খোঁজখবর রাখো দেখছি। তোমাদের পারিবারিক বন্ধু নাকি?”
“বন্ধুর উল্টোটা বলতে পারো,” কথাটা বলে জানালা খুলে দিলো হিদাকা। পর্দা অবশ্য ভেজানো এখন। ঝিরঝির হাওয়া প্রবেশ করলো ঘরের ভেতরে, সেই সাথে শুকনো পাতার সোঁদা গন্ধ। “আমাকে দেখতে পারে না নিমি।”
“দেখতে পারে না? কেন?”
“বিড়াল। ওর বিড়ালটা মারা গেছে কিছুদিন আগে। কাজ শেষে বাড়ি ফেরার পথে দেখে মরে পড়ে আছে রাস্তার পাশে। পশু ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়ার পর জানা যায় বিষ মেশানো খাবার দেয়া হয়েছিল বিড়ালটাকে।”
“সেটার সাথে তোমার কি সম্পর্ক?”
“নিমির ধারণা আমিই দায়ী এর জন্যে। ইচ্ছেকৃতভাবে মিটবলে বিষ মিশিয়ে বাইরে রেখে দিয়েছিলাম আর সেটা খেয়ে মারা গেছে বিড়ালটা।”
“কী বলছো আবোল তাবোল, এসব ভাবতে যাবে কেন সে?”
“আরে, এখানেই তো মজার শুরু,” বলে শেলফ থেকে একটা পত্রিকা নামালো হিদাকা। নির্দিষ্ট একটা পেইজ খুলে আমার দিকে এগিয়ে দিলো। “দেখো।“
‘ধৈর্য্যের সীমা’-শিরোনামে একটা প্রবন্ধ ছাপা হয়েছে পত্রিকাটায়। ইনসেটে হিদাকার ছবি। প্রবন্ধটার বিষয়বস্তু একটা বিড়াল, যে কি না বারবার চলে আসে এক লেখকের বাগানে। তবে শুধু ঘুরতেই আসে না, প্রবন্ধটা পড়ে মনে হবে যেন লেখককে বিরক্ত করাই তার মূল উদ্দেশ্যে। প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে লেখককে আগে বাগান থেকে বিড়ালের মল পরিস্কার করতে হয়। ছোট ছোট গাছগুলোরও রেহাই নেই, থাবা দিয়ে আঁচড়ে সেগুলোর অবস্থা করুণ করে দেয় বিড়ালটা। পায়ে কাদামাখা অবস্থায় গাড়ির উপর দিয়ে হেঁটে বেড়ায়। সাদা-খয়েরি রঙের বিড়ালটাকে বেশ কয়েকবার দেখেছে লেখক, জানে যে সে-ই কালপ্রিট। তবুও কোন ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হয় না। অনেক চেষ্টা করেছে সে কিন্তু ফলাফল শূন্য। একবার একজন পরামর্শ দেয় বিড়ালেরা নাকি প্রতিবিম্ব দেখে ভয় পায়, তাই বাগানজুড়ে পানি ভর্তি বোতল রেখে দেয় লেখক, যাতে বিড়ালটা সেখানে আর পা না দেয়। কিন্তু লাভ হয়নি। প্রবন্ধটার সারকথা-প্রতিদিন ধৈর্য্য পরীক্ষা দিতে হচ্ছে লেখককে।
“একটু আগে যে একটা বিড়াল মারা গেছে বললে, সেটাও কি খয়েরি- সাদা রঙের?” জিজ্ঞেস করলাম।
“হ্যাঁ, ওরকমই।”
“তাহলে তো তোমাকে সন্দেহ করার উপযুক্ত কারণ আছে ভাই।”
“গত সপ্তাহে নিমির চেহারা যদি দেখতে! দুদ্দাড় করে এখানে এসে বলে যে ওর বিড়ালকে কেউ একজন বিষ খাইয়ে মেরে ফেলেছে। সরাসরি আমাকে দোষারোপ করেনি অবশ্য কিন্তু হাবভাবে বুঝিয়ে দিয়েছে। রাই তাকে বলে একজন মানসিক রোগের ডাক্তার দেখাতে। ভেবেছিলাম আর হয়তো জ্বালাতন করবে না কিন্তু এখন দেখছি বাগানে এসে ছোঁকছোঁক শুরু করেছে। বোধহয় আমাকে এখনও সন্দেহ করে। বিষ মেশানো খাবার খুঁজতে এসেছিল।”
“সন্দেহবাতিক, নাকি?”
“আরে, মেয়েরা এমনই হয়।”
“নিমি কি জানে না তোমরা কানাডা চলে যাচ্ছো?”
“রাই তাকে গত সপ্তাহে আমাদের ভ্যাঙ্কুভার যাওয়ার ব্যাপারে ওকে বলেছিল। ‘বুঝতে পারছো, কি বলছি? আমরা তো চলেই যাচ্ছি এখান থেকে, তাহলে বিড়ালটাকে মাথা ঘামানোর দরকারটা কি, শুনি?’ রাইকে দেখে বোঝা যায় না কিন্তু দরকারের সময় ঠিকই উচিত কথা শুনিয়ে দিতে পারে সে,” হাসি ফুটলো হিদাকার মুখে।
“ওর কথায় কিন্তু যুক্তি আছে। বিড়ালটাকে হত্যা করার তোমাদের কোন কারণই নেই।”
কেন জানি আমার কথা প্রেক্ষিতে সাথে সাথে কিছু বলল না হিদাকা শুধু হেসে জানালার দিকে মুখ ফিরিয়ে নিল। খানিক বাদে কফির কাপে লম্বা চুমুক দিয়ে তাকালো আমার দিকে। “কাজটা আমি-ই করেছি।
“কী?” ওর কথার অর্থ বুঝতে পারলাম না প্রথমে। “কী করেছো?”
“বিড়ালটাকে আমিই মেরেছি। মিটবলে বিষ মিশিয়ে বাগানে রেখে দিয়েছিলাম। তবে পদ্ধতিটা যে কাজে আসবে বুঝতে পারিনি। মানে একদম মরেই যাবে।”
প্রথমে মনে হলো আমার সাথে ঠাট্টা করছে হিদাকা কিন্তু এরপরেই ওর হাসিটা খেয়াল করলাম। নির্জীব।
“বিষ মেশানো মিটবল কোথায় পেলে?”
“আরে, এটা কোন ব্যাপার? ক্যাট ফুডের সাথে কীটনাশক মিশিয়ে বাগানে রেখে দিয়েছিলাম। বিড়াল যা দেখে সেটাতেই মুখ দেয়,” সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল হিদাকা। আয়েশ করে টান দিলো একবার। জানালার বাতাসে ধোঁয়া মিলিয়ে গেল বাইরে।
“কিন্তু কেন?” সত্যি বলতে হিদাকার অকপট স্বীকারোক্তিটা মানতে একটু কষ্টই হচ্ছিল আমার।
“তোমাকে তো বলেছিলাম, আমরা এখনো কোন ভাড়াটে খুঁজে পাইনি?” শীতল হাসিটা মিইয়ে গেল ওর মুখ থেকে।
“হ্যাঁ।”
“আমাদের রিয়েল এস্টেট এজেন্ট এখনও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে কিন্তু গতদিন এখানে এসে এমন একটা কথা বলে সে, যেটা আমার পছন্দ হয়নি।“
“কি?”
“তার মতে বাগানে অতগুলো প্লাস্টিকের বোতল দেখে অনেকেই ভাবতে পারে রাস্তার বিড়ালগুলো নিয়মিত জ্বালাতন করে আমাদের, সেজন্যেই কেউ ভাড়া নিচ্ছে না।“
“তাহলে তো বোতলগুলো ফেলে দিলেই হতো। এমনিতেও কোন কাজে আসেনি ওগুলো।”
“হ্যাঁ, কিন্তু তাতে মূল সমস্যার সমাধানটা হতো না। যদি কেউ বাড়ি দেখতে এসে খেয়াল করে বাগানের এখানে সেখানে বিড়াল পায়খানা করে রেখেছে, তখন? আমরা থাকলে নাহয় পরিষ্কার করতে পারবো কিন্তু চলে যাওয়ার পরে কি হবে? আমি চাই না বাড়িটা বিড়ালের টাট্টিখানায় পরিণত হোক।”
“এজন্যে মেরে ফেললে বিড়ালটাকে?”
“এভাবে বলছো কেন? বিড়ালটার মালিকও সমান দোষী। অবশ্য এই সত্যটা বোঝার ক্ষমতা নেই ওর,” সিগারেটটা অ্যাশট্রেতে গুঁজে দিয়ে বলল হিদাকা।
“রাই জানে এটা?”
আবারো হাসি ফিরে এলো হিদাকার মুখে। “পাগল হয়েছো? মেয়েরা বিড়াল খুব পছন্দ করে। সত্যিটা বলতে আমাকে সাক্ষাৎ শয়তান ভাববে ও।”
চুপচাপ বসে রইলাম আমি। আসলে কী বলবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না। ঠিক এই সময় ফোনটা বেজে ওঠায় রিসিভার তুলে কানে ঠেকালো হিদাকা।
“হ্যালো?…ওহ, হাই। তোমার ফোনেরই অপেক্ষা করছিলাম…হ্যাঁ, সব শিডিউল অনুযায়ীই হচ্ছে…না, মানে, এই এখনই শুরু করবো। ঠিক আছে, শেষ হলেই পাঠিয়ে দেব, ভেবো না। না, আসলে এই ফোনের সংযোগ কালকে দুপুরের পরেই কেটে দিবে। আমিই ফোন করবো তোমাকে….হ্যাঁ, হোটেল থেকে। আচ্ছা, বাই।“
রিসিভার নামিয়ে রেখে একবার দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো হিদাকা। “তোমার সম্পাদক নাকি?”
“হ্যাঁ। জমা দিতে সাধারণত একটু দেরিই হয়ে যায় আমার কিন্তু এবারে পরিস্থিতি অন্যরকম। যদি আজকে রাতে না দিতে পারি, তাহলে সময়মত আর দেয়া সম্ভব হবে না। পরশুদিনই দেশ ছাড়বো
“বেশ,” বলে উঠে দাঁড়ালাম চেয়ার ছেড়ে। “আমি তাহলে আসি এখন। তোমাকে আর বিরক্ত করবো না।”
কলিংবেল বেজে উঠল এসময়। “কোন সেলসম্যান এসেছে নিশ্চয়ই,” বলল হিদাকা। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই অফিসের দরজায় কড়া নাড়লো রাই।
“কি হয়েছে?” গলা চড়িয়ে বলল আমার বন্ধু।
দরজা খুলে গম্ভীর ভঙ্গিতে বাইরে থেকে উঁকি দিলো রাই। “মিস ফুজি ও এসেছেন,” বলল শান্ত স্বরে।
নামটা শোনামাত্র চেহারায় মেঘ ভর করলো হিদাকার। “আবার?”
“তোমার সাথে নাকি জরুরি একটা বিষয়ে কথা আছে।”
“বাহ্,” বলে নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটতে লাগলো হিদাকা। “নিশ্চয়ই
জানতে পেরেছে আমরা কানাডা চলে যাচ্ছি।”
“তুমি ব্যস্ত আছো বলে দেব?”
“হ্যাঁ,”-বলেই মত পরিবর্তন করলো হিদাকা, “না, আমি দেখা করবো। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ঝামেলা চুকিয়ে ফেলাই ভালো, তাহলে আর পরে অযথা মাথা ঘামাতে হবে না। তুমি ওনাকে ভেতরে এনে বসাও।”
“আচ্ছা, তুমি যখন বলছো…” বলে আমার দিকে তাকালো রাই।
“আরে, আমাকে নিয়ে ভাববেন না,” বললাম। “এখনই চলে যাচ্ছি।”
“ঝামেলায় পড়ে গেলাম,” রাই চলে যাবার পরে লম্বা একটা শ্বাস ছেড়ে বলল হিদাকা।
“ফুজিও বলতে কি মাসায়া ফুজিও?”
“হ্যাঁ, ওর বোন…নাম মিয়াকো।” একবার মাথা চুলকালো হিদাকা। “যদি শুধু নগদ টাকা চাইতো, তাহলে কোন সমস্যা ছিল না। কিন্তু সবকিছু আবার মনে করে বলাটা অসম্ভব। পুনর্লিখনও সম্ভব না।”
হলরুম থেকে দুজনের পদশব্দ কানে এলো এসময়। সাথে সাথে মুখ বন্ধ করে ফেলল হিদাকা। স্বল্প আলোর জন্যে কারো কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করতে শুনলাম রাইকে। কিছুক্ষণ পরেই দরজায় কড়া নাড়লো সে।
“কি?” জিজ্ঞেস করলো হিদাকা।
“মিস ফুজিও এসেছেন,” বলে দরজা খুলল রাই।
তার পেছনে যিনি দাঁড়িয়ে ছিলেন, তাকে মহিলা না বলে যুবতী বলাটাই ঠিক হবে। বয়স ত্রিশ ছুঁইছুঁই। লম্বা চুল কোমর অবধি নেমে এসেছে, পরনে সদ্য ইন্টারিভিউয়ে ডাক পাওয়া বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রছাত্রিদের মত স্যুট। দেখে মনে হচ্ছে না যে হুট করে এসে পড়েছে সে। বেশ সময় নিয়ে প্রস্তুত হয়েছে।
“তোমার সাথে তাহলে পরে দেখা হবে,” হিদাকার উদ্দেশ্যে বললাম। পরশুদিন আবারো ওকে বিদায় জানাতে আসবো বলতে গিয়েও সামলালাম নিজেকে। মিস ফুজিও হয়তো জানেন না যে কানাডা পাড়ি জমাচ্ছে আমার বন্ধু। সেক্ষেত্রে ঝামেলায় পড়ে যাবে বেচারা। একবার মাথা নাড়লো হিদাকা।
আমাকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিলো রাই। “সরি, আপনাকে এখনই চলে যেতে হচ্ছে,” দুই হাত এক করে বলল সে। হিদাকার তুলনায় বেশ খাটো ও, তন্বী গড়ন। চেহারা দেখে মনে হবে যেন এখনও কলেজে পড়ছে। অথচ বয়স ত্রিশের উপরে।
“সমস্যা নেই। পরশুদিন আপনাদের বিদায় জানাতে আসবো।”
“আরে, আপনাকে কষ্ট করে আসতে হবে না। অন্য কাজ আছে নিশ্চয়ই…”
“কিসের কষ্ট? আসবো অবশ্যই।”
“বাই,” বলে আমি দৃষ্টির আড়াল হওয়া অবধি দরজায় দাঁড়িয়ে থাকলো রাই।
***
অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে সবে কাজে হাত দিয়েছি, এমন সময় কেউ কড়া নাড়লো দরজায়। আমার বাড়িটা কিন্তু হিদাকাদের বাড়িটা থেকে একদম অন্যরকম; একটা পাঁচতলা বিল্ডিংয়ে বড় স্টুডিও অ্যাপার্টমেন্ট। জায়গাটা একদম মাঝে ভাগ করা। একদিকে বেডরুম আর ওয়ার্কস্পেস, অন্যদিক লিভিং রুম, ডাইনিং রুম আর রান্নাঘর।
রাইয়ের মতন কেউ নেই আমার জীবনে, তাই দরজায় কারো কড়া নাড়ার শব্দ কানে এলে নিজেকেই উঠতে হয়।
পিপহোল দিয়ে একবার বাইরে তাকিয়ে দরজা খুলে দিলাম। আমার সম্পাদক, ওশিমা এসেছে।
“সময়মতই হাজির হয়েছো তাহলে,” বললাম।
“তোমাকে নিয়ে আমার অনেক আশা, ভাই,” বলে বিখ্যাত একটা মিষ্টির দোকানের প্যাকেট আমার দিকে বাড়িয়ে ধরলো সে। “এই নাও, ঘুষ।”
আমাকে খুব ভালো করেই চেনে ও।
“কষ্ট করে এত দূরে আসতে হলো তোমাকে, সরি।”
জবাবে মাথা ঝাঁকালো ওশিমা। “আরে, এদিক দিয়ে বাড়ি ফিরতে হয় আমাকে।”
ওকে ভেতরে বসতে বলে কেতলি থেকে চা ঢেলে আনলাম। এরপর আমার অফিসে ঢুকে ডেস্ক থেকে তুলে নিলাম নতুন খসড়াটা। “কেমন হয়েছে জানি না, কিন্তু কাজ শেষ।”
“দেখি একবার।”
চায়ের কাপটা নামিয়ে রেখে খসড়াটা নেয়ার জন্যে হাত বাড়ালো ওশিমা। কিছুক্ষণের মধ্যেই ডুবে গেল গল্পে। খবরের কাগজ তুলে নিলাম আমি। কেউ আমার সামনে বসে আমার লেখা পড়লে বরাবরই অস্বস্তিতে ভুগি।
ওশিমা খসড়ার প্রায় অর্ধেকটা পড়ে ফেলেছে, এমন সময় ফোনের আওয়াজ ভেসে এলো ডাইনিং রুম থেকে।
উঠে গিয়ে তুলে নিলাম রিসিভারটা। “হ্যালো, নোনোগুচি বলছি।
“আমি, হিদাকা,” ওর কন্ঠস্বর শুনে মনে হলো কিছু একটা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছে।
“কি অবস্থা?” আসলে আমি জানতে চাইছি, মিয়াকো ফুজিও’র সাথে ওর কি আলাপ হলো আজকে।
“তুমি কি ব্যস্ত নাকি?” কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর বলল হিদাকা।
“একজন মেহমান এসেছে আমার বাসায়।”
“আচ্ছা। কাজ শেষ হবে কখন?”
ঘড়ির দিকে তাকালাম এক ঝলক। সোয়া ছয়টার মতন বাজছে। “খুব বেশিক্ষণ না। কেন?”
“ইয়ে, মানে…ফোনে আলাপ করার মতন বিষয় না এটা। একটা ব্যাপারে তোমার সাথে কিছু কথা আছে। আসতে পারবে?”
“নিশ্চয়ই,” আরেকটু হলেই জিজ্ঞেস করে বসেছিলাম, বিষয়টা ফুজিওকে নিয়ে কি না, কিন্তু সামলে নিলাম শেষ মুহূর্তে। ওশিমা যে লিভিং রুমে বসে আছে সেটা প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম।
“আটটার দিকে আসো, নাকি?”
“ঠিক আছে।”
“আমি অপেক্ষা করবো। রাখলাম,” বলে লাইন কেটে দিলো হিদাকা। রিসিভারটা কেবলই নামিয়ে রেখেছি এমন সময় সোফা ছেড়ে উঠতে শুরু করলো ওশিমা।
“তুমি যদি ব্যস্ত থাকো, তাহলে আমি নাহয় “
“আরে, বসো বসো,” হাত নেড়ে বললাম। “আমার বন্ধুর সাথে দেখা করবো আটটার দিকে। অনেক সময় আছে হাতে। পড়ো তুমি।”
“ঠিক আছে তাহলে,” বলে আবারো পড়ায় মনোযোগ দিলো ওশিমা। খবরের কাগজে মনোযোগ দেয়ার চেষ্টা করলাম কিন্তু মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে হিদাকা আর মিয়াকোর কথা। দু’ বছর আগে একজন কাঠশিল্পীকে নিয়ে ‘নিষিদ্ধ প্রান্তর’ নামে উপন্যাস লিখেছিল আমার বন্ধু। গল্প কাল্পনিক হলেও উপন্যাসের মূল চরিত্রটি ছিল বাস্তব থেকে অনুপ্রাণিত-মিয়াকা ফুজিও’র ভাই মাসায়া ফুজিও।
আমার আর হিদাকা’র সাথে একই মিডল স্কুলে পড়াশোনা করতো ফুজিও। কিশোর বয়সে আমরা যা যা করেছি, সেসবের অনেক কিছুই উঠে এসেছিল বইটায়। সতর্কতা হিসেবে অবশ্য চরিত্রগুলো নাম বদলে দেয়া হয়। কিন্তু উপন্যাসটায় এমন কিছু বিষয় উঠে আসে, যেগুলো ছাপার অক্ষরে দেখলে খুশি হতো না মাসায়া ফুজিও। ছাত্রজীবনে তার যাবতীয় কুকীর্তি যতটা সম্ভব সত্যের কাছাকাছি থেকে বর্ণনা করে হিদাকা। এক দেহপসারিনীর হাতে ফুজিওর খুন হবার ঘটনাটাও বাদ যায়নি।
কিছুদিনের মধ্যেই বেস্টসেলার তালিকার শীর্ষে উঠে আসে ‘নিষিদ্ধ প্রান্তর’। যারা মাসায়াকে চিনতো, বইটা পড়ে তাদের বুঝতে অসুবিধে হবে না যে কার কথা বলা হচ্ছে। ঘটনাক্রমে ফুজিও পরিবারের এক সদস্যের কাছেও চলে যায় উপন্যাসটি।
মাসায়ার বাবা ততদিনে পরলোকগমন করেছেন কিন্তু তার মা এবং বোন ছেড়ে কথা বলেনি। উপন্যাসটা যে মাসায়ার জীবনের উপর ভিত্তি করে লেখা হয়েছে সেটা বুঝতে কোন সমস্যা হয়নি তাদের; বিনাঅনুমতিতে এরকম একটা বই লিখে ফেলায় হিদাকার কঠোর সমালোচনাও করে। তাদের চোখে বিষয়টা ব্যক্তিগত এবং সামাজিক মর্যাদাহানির সামিল। কিছুদিনের মধ্যে ‘নিষিদ্ধ প্রান্তরে’র সবগুলো কপি দোকান থেকে তুলে নেয়ার দাবি জানানো হয়।
“উপন্যাসটির কিছু অংশের পুনর্লিখন করা হলে আমরা পুনরায় প্রকাশের অনুমতি দেব, এর আগে নয়,” এমনটাই জানান ফুজিওর মা।
হিদাকা যেমনটা বলেছে, কোন প্রকার ক্ষতিপূরণ দাবি করা হয়নি ফুজিওর পরিবার থেকে। তবে পুনর্লিখনের বিষয়টা কেবল বলার জন্যে বলা নাকি দর কষাকষির প্রথম ধাপ, সেই বিষয়টা এখনও অনিশ্চিত।
ফোনে ওর কন্ঠস্বর শুনে মনে হয়নি যে অনিশ্চয়তা দূর হয়েছে। তবুও, আমাকে ফোন করার হেতু বুঝে উঠতে পারছি না। হয়তো আসলেও ঝামেলায় পড়ে গেছে। আমি কিভাবে কোন কাজে আসবো, কে জানে।
আমি এসব নিয়ে মাথা ঘামাতে ঘামাতেই খসড়াটা পড়া শেষ হয়ে গেল ওশিমার। “বেশ ভালো। খানিকটা নস্টালজিক, কিন্তু আমার পছন্দ হয়েছে।”
“বাহ, শুনে খুশি হলাম,” আসলেও স্বস্তি ভর করেছে আমার চিত্তে। চায়ের কাপে লম্বা একটা চুমুক দিলাম। ওশিমা ছেলেটা ভালো, শুধু শুধু তেল দেয়ার জন্যে কথাগুলো বলেনি।
সাধারণত ওর খসড়া পড়া শেষে পরবর্তি প্রজেক্ট নিয়ে আলাপ করি আমরা, কিন্তু আজকে হিদাকার সাথে দেখা করতে হবে। ঘড়ির দিকে তাকালাম। সাড়ে ছ’টার একটু বেশি বাজছে।
“তোমার হাতে সময় আছে?” ওশিমা জানতে চাইলো।
“হ্যাঁ, কিন্তু আমি ভাবছিলাম-এখানে কাছেই একটা ভাল রেস্তোরাঁ আছে, আমরা নাহয় খেতে খেতে কথা বলি?”
“নিশ্চয়ই, আমারও খেতে হবে,” বলে খসড়াটা ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখলো ওশিমা। যতদূর জানি, ওর বয়স ত্রিশের কাছাকাছি, এখনও বিয়ে করেনি।
রেস্তোরাঁটা আমার অ্যাপার্টমেন্ট থেকে পাঁচ মিনিটের হাঁটা দূরত্বে। ক্যাজেরোল খেতে খেতে এটাসেটা বিষয়ে আলাপ করলাম আমরা। একসময় ইচ্ছে করেই হিদাকার কথা তুললাম।
ওর নাম শুনে বিস্ময় ভর করলো ওশিমার চেহারায়। “তাকে চেনো তুমি?”
“ও আমার ছেলেবেলার বন্ধু। একই এলাকায় বড় হয়েছি, জায়গাটা এখান থেকে খুব বেশি দূরে নয়। চাইলে হেঁটেই চলে যেতে পারবে ওখানে, অবশ্য আমাদের আগের বাড়িগুলো আর নেই। অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিং বানানোর জন্যে ভেঙে ফেলা হয়েছে অনেক আগেই।”
“তাহলে স্কুলে থাকতেই পরিচয় হয় তোমাদের?”
“হ্যাঁ, এখনও যোগাযোগ আছে।”
“বাহ,” আগ্রহ চকচক ওশিমার চোখজোড়ায়, সেই সাথে খানিকটা ঈর্ষার ছাপও আছে। “জানতামই না।”
“ও-ই কিন্তু আমাকে তোমাদের পত্রিকায় কাজ পাইয়ে দিয়েছে।”
“তাই নাকি?”
“হ্যাঁ, তোমাদের প্রধান সম্পাদক ওর কাছে একটা লেখা চায়, কিন্তু বাচ্চাদের গল্প লিখতে অতটা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে না হিদাকা, তাই মানা করে দিয়েছিল। পরে আমাকে নিয়ে যায় ভদ্রলোকের কাছে। এজন্যে আমি ওর প্রতি কৃতজ্ঞ,” ম্যাকারনি মুখে দিয়ে বললাম।
“কই! আমাকে তো কেউ এসব বলেনি। বাচ্চাদের সাহিত্যে হিদাকার মত লেখকের বিচরণ কেমন হবে, তা কিন্তু ভাবনার বিষয় আসলেও,” আমার দিকে তাকালো ওশিমা। “আচ্ছা নোনোগুচি, তুমি কি কখনো বড়দের জন্যে কিছু লেখার কথা ভেবেছ?”
“হয়তো পরে কোন একসময় লিখবো, যদি সুযোগ হয়,” মন থেকেই বললাম কথাটা।
সাড়ে সাতটায় রেস্তোরাঁটা থেকে বেরিয়ে একসাথে হেঁটে স্টেশনে চলে এলাম দু’জনে। আমাদের গন্তব্য ভিন্ন, তাই প্লাটফর্মে বিদায় জানালাম ওশিমাকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে পড়লো ট্রেন।
ঠিক আটটার সময় পৌছে গেলাম হিদাকাদের বাসায়। সামনের দরজার কাছে গিয়েই মনে হলো কি যেন একটা ঠিক নেই। পুরো বাড়ি অন্ধকার। এমনকি প্রবেশপথের বাতিও নেভানো।
ইন্টারকমের বাটনে চাপ দিলাম কিন্তু কোন জবাব এলো না ভেতর থেকে। প্রথমে মনে হলো আমার বুঝতে ভুল হয়েছিল। হিদাকা আটটায় সময় দেখা করতে বলেছিল ঠিকই, তবে সেটা হোটেলেও হতে পারে। আরো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর উল্টোদিকে ঘুরে স্টেশনের পথে রওনা হয়ে গেলাম। কিছুদূর এগোলেই একটা পার্কের পাশে সারি সারি অনেকগুলো পে-ফোন। ওয়ালেট বের করে ঢুকে পড়লাম একটা বুথে।
ইনফরমেশন সেন্টারের ফোন দিয়ে ক্রাউন হোটেলের নম্বর নিলাম প্রথমে। এরপর ওখানে যোগাযোগ করে হিদাকার নাম বললাম। কিছুক্ষণের মধ্যে রাইয়ের কন্ঠস্বর ভেসে এলো রিসিভারে। “হ্যালো?”
“আমি, নোনোগুচি। হিদাকা আছে?”
“না, ও তো এখনও হোটেলে আসেনি। বাড়িতেই আছে বোধহয়। কাজ বাকি রয়ে গেছিল।”
“বাড়িতে তো কেউ নেই,” কিছুক্ষণ আগের ঘটনা খুলে বললাম রাইকে।
“ও আমাকে বলেছিল যে হোটেলে ফিরতে বেশ দেরি হবে। “
“তাহলে বোধহয় বাইরে হাঁটতে বেরিয়েছে?”
“এরকমটা তো করার কথা নয় ওর,” উদ্বেগ খেয়াল করলাম রাইয়ের কন্ঠস্বরে। “তুমি দাঁড়াও, আমি এসে দেখ হ,” খানিকক্ষণ বাদে বলল ও। “চল্লিশ মিনিটের মত লাগবে আসতে, তুমি এখন কোথায় আছো?”
বললাম যে স্থানীয় একটা ক্যাফেতে সময় কাটিয়ে চল্লিশ মিনিট পর ওদের বাসার সামনে উপস্থিত হবো। ফোন বুথ থেকে বেরিয়ে ক্যাফেটায় যাওয়ার আগে হিদাকাদের বাসায় আরেকবার ঢুঁ মারার সিদ্ধান্ত নিলাম। ওখানে পৌছে দেখি বাতি এখনও নেভানো। কিন্তু এবারে ড্রাইভওয়েতে টয়োটা গাড়িটা নজর এড়ালো না। বাইরে কোথাও গেলে সাধারণত গাড়ি নিয়েই যায় হিদাকা।
ক্যাফেটা হচ্ছে একটা স্পেশালিটি কফি শপ, হিদাকার সবচেয়ে পছন্দের জায়গাগুলোর একটা। হাওয়া বদলের দরকার হলেই এখানে এসে পড়তো সে। আমিও এসেছি কয়েকবার। মালিক লোকটা আমাকে দেখামাত্র হেসে হিদাকার কথা জিজ্ঞেস করলো। জবাবে বললাম, হিদাকারও আসার কথা ছিল, কিন্তু শেষ মুহূর্তে না করে দিয়েছে। আধঘন্টা বেইজবল এবং অন্যান্য কিছু বিষয়ে আলাপ শেষে বিল মিটিয়ে বেরিয়ে এলাম ক্যাফে থেকে। হিদাকাদের বাসার উদ্দেশ্যে পা চালালাম দিনে চতুর্থবারের মতন।
আমি গেইটের সামনে পৌঁছে দেখি রাই ট্যাক্সি থেকে নামছে। ডাক দিতেই আমার দিকে ফিরে হাসলো সে। কিন্তু বাড়ির দিকে তাকাতেই মুখটা কালো হয়ে গেল বেচারির। “একটা বাতিও জ্বলছে না।”
“বোধহয় এখনও বাইরে।”
“কিন্তু আমাকে তো বলেছিল এখানেই থাকবে।”
প্রবেশপথ পেরিয়ে বাড়ির সামনের দরজার কাছে এসে ব্যাগ থেকে চাবি বের করলো রাই। আমিও ওর ঠিক পেছনেই দাঁড়িয়ে আছি। কি-হোলে চাবি ঢুকিয়ে মোচড় দিতেই খুলে গেল দরজাটা। ভেতরে ঢুকে প্রথমে বাতিগুলো জ্বেলে দিলো সে। পুরো বাড়ি একদম নিশ্চুপ, ঠান্ডা
হলওয়ে থেকে হিদাকার অফিসের দিকে এগোলো রাই। এই দরজাটাও বন্ধ।
“বাইরে যাওয়ার আগে সবসময়ই অফিস বন্ধ করে যায় নাকি হিদাকা?” জিজ্ঞেস করলাম।
“না,” মাথা ঝাঁকিয়ে পার্স থেকে আরেকটা চাবি করলো ও। “অন্তত আমি আসার পর বন্ধ করেনি।”
দরজাটা খুলে ভেতর দিকে ঠেলা দিলো রাই। রুমটায় কোন বাতি জ্বলছে না, তবে কম্পিউটারটা চালু বিধায় অন্ধকার পুরোপুরি কব্জা করতে পারেনি। মণিটরের টিমটিমে আলোয় আলোকিত হয়ে আছে একপাশ। দেয়ালে সুইচবোর্ডের দিকে হাত বাড়াতে গিয়ে হঠাৎই থেমে গেল রাই।
ঘরের মাঝখানে উপুড় হয়ে পড়ে আছে হিদাকা।
দৃশ্যটা দেখে জমে গেলাম আমরা দু’জনেই। তবে দ্রুত ঘোর ভেঙে স্বামীর দিকে এগোলো রাই, হিদাকার দিকে হাত বাড়াতে গিয়ে থমকে দাঁড়ালো সে। মুখে হাতচাপা দিয়ে রেখেছে এখন।
ধীরে ধীরে আমিও এগোলাম ওদিকে। উপুড় হয়ে থাকলেও হিদাকার চেহারার বাম পাশ দেখা যাচ্ছে। আধখোলা চোখটায় কোন প্ৰাণ নেই।
“মারা গেছে ও,” বললাম।
মেঝেতে ঢলে পড়লো রাই। বুক চিড়ে বেরিয়ে এলো স্বজন হারানোর কান্না।
***
পুলিশের লোকেরা সবকিছু পরীক্ষা করে দেখার সময় লিভিং রুমেই অপেক্ষা করতে লাগলাম আমি আর রাই। এখন অবশ্য এই ঘরটাকে লিভিং রুম বলার জো নেই। সোফা এবং টেবিল সবই নিয়ে গিয়েছে মুভিং কোম্পানির লোকেরা। পত্রিকা ভর্তি একটা কার্ডবোর্ড বাক্সের উপরে বসে আছে রাই আর আমি পায়চারি করছি ঘরজুড়ে। একটু পরপর হলওয়েতে গিয়ে দেখে আসছি তদন্তের কতটা অগ্রগতি হয়েছে। তখন থেকে একটানা কেঁদেই চলেছে রাই। আমার হাতঘড়ির দিকে তাকালাম। সাড়ে দশটার মতন বাজছে।
অবশেষে দরজায় কড়া নেড়ে রুমের ভেতরে প্রবেশ করলেন সৌম্য দর্শন এক পুলিশ কর্মকর্তা। ডিটেক্টিভ সাকোদার বয়স পঞ্চাশের আশপাশে। আজকের তদন্ত তিনিই পরিচালনা করছেন।
“আপনাদের সাথে একটু কথা বলতে পারি?” রাইয়ের দিকে একবার তাকিয়ে আমার উদ্দেশ্যে প্রশ্নটা করলেন ডিটেক্টিভ।
“নিশ্চয়ই।”
“আমিও কথা বলতে পারবো,” রুমাল দিয়ে চোখ মুছে বলল রাই। গলার স্বর এখনও ভারী হয়ে আছে, কিন্তু কথা বোঝা যাচ্ছে স্পষ্ট সকালবেলা হিদাকার বলা কথাটা মনে পড়লো, দেখতে যতটা না মনে হয়, তার চেয়ে অনেক শক্ত রাই।
“খুব বেশিক্ষণ লাগবে না। “
হিদাকার মৃতদেহ আবিষ্কারের আগ অবধি যা যা ঘটেছে, সব বিস্তারিত জানতে চাইলেন ডিটেক্টিভ সাকোদা। আমিই মুখ খুললাম প্রথমে। কথা বলার এক পর্যায়ে মনে হলো মিয়াকো ফুজিও’র আগমনের বিষয়টাও তুলতে হবে।
“হিদাকা আপনাকে ফোন দিয়েছিলেন কখন?”
“ছয়টার একটু পরে বোধহয়।“
“তখন কি মিস ফুজিও’র বিষয়ে কিছু বলেছিলেন তিনি আপনাকে?”
“না, শুধু বলেছিল কি একটা বিষয়ে যেন কথা বলবে।”
“তাহলে হয়তো অন্য কোন ব্যাপারে আপনার সাথে আলাপ ছিল তার?”
“হয়তো।”
“আপনি কি আন্দাজ করতে পারছেন, কেন আপনাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন হিদাকা?”
“নাহ্।”
আলতো করে একবার মাথা নেড়ে রাইয়ের দিকে ঘুরলেন ডিটেক্টিভ। “মিস ফুজিও ফিরে যান কখন?”
“পাঁচটার দিকে।”
“এরপর কি হিদাকার সাথে কথা হয়েছিল আপনার?”
“অল্প।”
“কেমন মনে হয়েছিল তাকে দেখে?”
“ভালো না। মিস ফুজিওর সাথে আলাপটা আশানুরূপ হয়নি। তবে আমাকে ও বলেছিল, দুশ্চিন্তার কিছু নেই।“
“এরপরই বাড়ি থেকে বেরিয়ে হোটেলে চলে যান আপনি?”
“হ্যাঁ।”
আবারো মাথা নাড়লেন ডিটেক্টিভ। “তাহলে আজকে রাতটা এবং আগামীকাল ক্রাউন হোটেলে থেকে পরশু কানাডার উদ্দেশ্যের রওনা দেয়ার কথা ছিল আপনাদের? কিন্তু আপনার স্বামীর কিছু কাজ বাকি ছিল, তাই বাসায় রয়ে যান তিনি।” হাতের নোটবুকটার দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বললেন সাকোদা। “আপনার স্বামী যে বাড়িতে একা থাকবে, এটা কে কে জানতো? “
“আমি আর…” বলে আমার দিকে তাকালো রাই
“হ্যাঁ, আমি জানতাম। ‘সোমেই’ পত্রিকার কেউ একজনও জানতো বোধহয়।” হিদাকা যে মাসিক পত্রিকাটার জন্যে একটা ধারাবাহিক উপন্যাস লিখছিল, সেই বিষয়ে খুলে বললাম। মূলত উপন্যাসটার কাজ শেষ করার জন্যেই বাড়িতে রয়ে যায় সে। “সন্দেহভাজনের তালিকা ছোট করে আনতে এই তথ্যটা আপনাদের বিশেষ কাজে আসবে বলে মনে হয় না।”
“তদন্তে কোন তথ্যই ফেলনা নয়,” মৃদু হেসে বললেন ডিটেক্টিভ সাকোদা।
এরপর রাইয়ের কাছে জানতে চাইলেন গত কয়েক দিনে বাড়ির আশেপাশে সন্দেহজনক কাউকে চলাফেরা করতে দেখেছে কি না। জবাবে মাথা ঝাঁকিয়ে না করে দিলো সে। এসময় আমার মনে হলো, দিনের বেলা বাগানে একজন মহিলাকে দেখেছিলাম কিন্তু বিষয়টা চেপে গেলাম। বিড়াল হত্যার প্রতিশোধ নেয়ার জন্যে কেউ তো আর মানুষ খুন করবে না।
প্রশ্নোত্তর পর্ব শেষ হলে ডিটেক্টিভ বললেন, তার একজন অফিসার আমাকে বাড়ি পৌছে দেবে। ভেবেছিলাম রাইয়ের সাথেই থেকে যাবো কিন্তু তাদের কথাবার্তা শুনে মনে হলো ইতোমধ্যে রাইয়ের বাবা-মা’র সাথে আলাপ হয়ে গেছে; ওকে নিতে আসছে তারা।
বন্ধুর মৃতদেহ আবিষ্কারের উত্তেজনা প্রশমিত হয়ে আসার সাথে সাথে ক্লান্তি ভর করলো আমার দেহে। এই অবস্থায় স্টেশনে হেঁটে ফেরাটা সহজ হবে না। তাই সাকোদার প্রস্তাব মেনে নিলাম।
অফিস রুমটার ভেতরে আর বাইরে এখনও অনেক পুলিশ অফিসার কাজে ব্যস্ত। কেউ কেউ ঘুরে বেড়াচ্ছে গোটা বাসায়। অফিসের দরজাটা খোলা হলেও ভেতরে কিছু দেখতে পাচ্ছিনা। মৃতদেহটা খুব সম্ভবত সরিয়ে ফেলা হয়েছে।
ইউনিফর্ম পরিহিত এক অফিসার আমাকে ডেকে সামনের গেটের বাইরে দাঁড়ানো টহল গাড়িটার কাছে নিয়ে গেল। পুলিশের গাড়িতে চড়ার অভিজ্ঞতা নেই আমার। বেশি জোরে গাড়ি চালানোর জন্যে এক অফিসার আমাকে জরিমানা করেছিল একবার। পুলিশি বিষয়ে আমার অভিজ্ঞতা বলতে এটুকুই। লম্বা মতন একটা লোক দাঁড়িয়ে আছে ক্রুজারটার পাশে। পুলিশ অফিসার হলেও ইউনিফর্ম পরেনি। আলোর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখার চেহারা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না।
“অনেক দিন পর আপনার দেখা পেলাম, নোনোগুচি,” বলল সে।
“আমি কি আপনাকে চিনি?” চোখ কুঁচকে ভালো করে দেখার চেষ্টা করলাম।
ছায়া থেকে একটু সামনে এগিয়ে এলো অফিসার। এবার পরিচিত চেহারাটা চিনতে কোন অসুবিধে হলো না। সেই টিকোলো নাক, সরু চোখ। তবে নামটা কেন যেন মনে পড়ছে না।
“আমাকে মনে আছে আপনার?”
“হ্যাঁ! ইয়ে.. “ পেটে আসলেও মুখে আসছে না নামটা। “কাগা না আপনি?”
“বান্দা হাজির,” একবার বাউ করে বলল সে। “লম্বা সময় পর।”
“আসলেও,” তার উদ্দেশ্যে মাথা নেড়ে বললাম। সুদর্শন চেহারাটা বয়সের সাথে আরো পরিণত হয়েছে। কম করে হলেও দশ বছর দেখিনি ওকে। “আপনি যে পুলিশে যোগ দিয়েছেন, এটা তো জানতাম না। আর এরকম একটা পরিস্থিতিতে দেখা হয়ে যাবে, সেটাও কল্পনার অতীত।”
“তা বটে। মরদেহটা কে আবিষ্কার করেছে, সেটা শোনার পর ভেবেছিলাম হয়তো একই নামের অন্য কেউ। কিন্তু আপনার বিজনেস কার্ডটা দেখার পর বুঝতে পারি…“
“নোনোগুচি নামটা অত প্রচলিত নয়, জানি আমি,” মাথা ঝাঁকিয়ে বললাম। “জীবন মাত্রই কাকতাল! কি বলেন?”
“গাড়িতে যেতে যেতে কথা বলি আমরা। আপনাকে বাসায় পৌঁছে দেব আমি। সরি, আজকে টহল গাড়িতেই উঠতে হবে,” পেছনের দরজাটা আমার জন্যে খুলে ধরলো কাগা। ইউনিফর্ম পরা অফিসার চালকের আসনে বসে পড়েছে আগেই
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষ করে মিডল স্কুলে টিচার হিসেবে যোগ দেয় কাগা। সেই স্কুলে আগে থেকেই সামাজিক বিজ্ঞান পড়াতাম আমি। অন্যান্য নতুন টিচারদের মতনই, প্রথমদিকে উৎসাহ উদ্দীপনার কোন কমতি ছিল না কাগার মধ্যে। কেন্ডোকা নামে জাপানিজ মার্শাল আর্টে তার দক্ষতা ছিল। চাকরিতে যোগ দেয়ার কিছুদিনের মধ্যে কেন্ডো ক্লাবের দায়িত্ব নেয়। অন্যান্য টিচারেরাও ওর ব্যবহারে মুগ্ধ ছিল।
কিন্তু মাত্র দু’বছর পরেই কিছু কারণে শিক্ষকতা ছেড়ে দেয় সে। আমি যতদূর জানি, কোন দোষ ত্রুটির কারণে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়নি ওকে, নিজে থেকেই ছেড়েছিল। তবে সত্যি বলতে, আমার কখনোই মনে হয়নি, শুধুমাত্র একটা মিডল স্কুলের শিক্ষতার পেশাতেই আটকে থাকবে সে।
“এখন আপনি কোন স্কুলে আছেন?” কাগা জানতে চাইলো কিছুদূর এগোনোর পর।
কাগা। স্কুলে নতুন যোগ দেয়ার পরে এই নামেই তাকে ডাকতাম। এখন থেকে ডিটেকটভিভ কাগা বলে ডাকতে হবে, নিজেকে বললাম মনে মনে।
“আমার এলাকায় একটা মিডল স্কুলে চাকরি করতাম কিছুদিন আগ পর্যন্ত,” একবার মাথা ঝাঁকিয়ে বললাম। “মার্চে চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছি।”
বিস্ময় ভর করলো কাগার চেহারায়। “তাই নাকি? কেন?”
“আসলে, ব্যাপারটা ওরকম কিছু না। এখন লেখালেখির দিকেই পুরো মনোযোগ দেব বলে ঠিক করেছি। টুকটাক লেখালেখিও করছি বাচ্চাদের জন্যে।“
“তাই নাকি! কাজের সূত্রেই তাহলে কুনিহিকো হিদাকাকে চিনতেন?”
“নাহ্।” আমাদের দু’জনের অতীত সম্পর্কে খুলে বললাম। সবকিছু গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনলো কাগা। ডিটেক্টিভ সাকোদা বোধহয় কিছু জানায়নি ওকে।
“শিক্ষকতা করার সময়ই লেখালেখি শুরু করেছিলেন?”
“হ্যাঁ, কিন্তু খুব বেশি লিখতাম না তখন। এই বছরে দুয়েকটা ছোটগল্প। যখন সিদ্ধান্ত নিলাম লেখালেখিকেই মূল পেশা হিসেবে নিব, তখন বুঝতে পারি, চাকরিটা ছেড়ে দিতে হবে।”
“ওহ, আচ্ছা। সিদ্ধান্তটা সহজ ছিল না নিশ্চয়ই,” কাগার কন্ঠস্বর শুনে মনে হচ্ছে আমার চাকরি ছেড়ে দেয়ার বিষয়টাকে ইতিবাচক হিসেবেই নিয়েছে। নিজের চাকরি ছেড়ে দেয়ার ঘটনার সাথে তুলনা করেছে কি না কে জানে। তুলনাটা ঠিক যথার্থ হবে না। পঁচিশের আগে চাকরি ছাড়লে নিজেকে গুছিয়ে নেয়ার সময় পাওয়া যায়। কিন্তু চল্লিশের পরে সেই সুযোগটা কম।
“মি. হিদাকা কেমন উপন্যাস লিখতেন?”
“আপনি কুনিহিকো হিদাকার লেখা কিছু পড়েননি!” ওর দিকে তাকিয়ে বললাম।
“নামটা শুনেছি কিন্তু পড়ার সৌভাগ্য হয়নি। আসলে এখন খুব একটা বই পড়া হয় না।”
“ব্যস্ত থাকেন নিশ্চয়ই?”
“নাহ্, অলসতার কারণে পড়া হয় না। জানি, মাসে দুই তিনটা হলেও বই পড়া উচিত।” মাথায় হাত রাখলো ও।
মাসে দুই তিনটা বই পড়া উচিত –এই কথাটা শিক্ষকতার সময়ে প্রায়ই বলতাম আমি। কাগা বোধহয় সেটা মনে রেখেছে এখনও।
হিদাকার লেখালেখির ক্যারিয়ার সম্পর্কে সংক্ষেপে খুলে বললাম তাকে। দশ বছর আগে প্রথম উপন্যাস প্রকাশিত হয় আমার বন্ধুর। কিছুদিনের মধ্যেই অনেকগুলো পুরষ্কারে ভূষিত হয় সে। বেস্টসেলার লিস্টে জায়গা করে নেয়। চলতি সাহিত্যের পাশাপাশি গুরুগম্ভীর সাহিত্য রচনার বিষয়েও সমান আগ্রহী ছিল হিদাকাব।
“ওনার কোন লেখা কি আমার ভালো লাগতে পারে?” কাগা জিজ্ঞেস
করলো। “কোন রহস্যোপন্যাস?”
“বেশ কয়েকটা মার্ডার মিস্ট্রি লিখেছে হিদাকা। “
“আমাকে নামগুলো বলেন তো।”
হিদাকার ‘সমুদ্রের ডাক’ উপন্যাসটার নাম বললাম ওকে। অনেক আগে পড়েছিলাম বিধায় খুব বেশি কিছু মনে নেই কিন্তু খুন-খারাবি ছিল গল্পে।
“হিদাকা কানাডায় কেন পাড়ি জমাচ্ছিল, সেটা জানেন?” আমার কথা শেষে জানতে চাইলো কাগা।
“নির্দিষ্ট একটা কারণ বলাটা একটু কঠিন। তবে আমার ধারণা এখানে ক্লান্ত হয়ে উঠেছিল ও, সেজন্যেই বিদেশে গিয়ে কয়েক নিভৃতে কিছু সময় কাটাতে চাইছিল আর কি। ভ্যাঙ্কুভারে যাওয়ার সিদ্ধান্তটা অবশ্য রাইয়ের।”
“রাই তো বোধহয় ওনার স্ত্রী’র নাম, তাই না? বয়স বেশ কম মনে
হলো।”
“গত মাসেই বিয়ে হয়েছিল ওদের। এটা হিদাকার দ্বিতীয় বিয়ে। “ “আর প্রথম স্ত্রী?…তার সাথে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে?”
“হ্যাঁ, তা বলতে পারেন। কিন্তু ডিভোর্স বা ওরকম কিছু নয়। পাঁচ বছর আগে দুর্ঘটনায় মারা যায় হিদাকার প্রথম স্ত্রী।“
আমি হিদাকাকে যে আর কোনদিন দেখতে পাবো না, এই ভাবনাটা মাথায় আসতেই অবসাদ জেঁকে বসলো মনে। কেমন যেন শূন্য একটা অনুভূতি। আজকে সন্ধ্যায় কোন ব্যাপারে কথা বলতে চেয়েছিল কে জানে। ওশিমার সাথে সময় না কাটিয়ে ওর ওখানে গেলেই ভালো হতো। বলা যায় না, তখনই চলে গেলে হয়তো বেঁচে যেত আমার বন্ধু। জানি, এসব ভেবে এখন আর কোন লাভ নেই, তবুও সখেদ চিন্তাগুলো দূর করতে পারলাম না মন থেকে।
“আচ্ছা, ওনার একটা উপন্যাস প্রকাশিত হবার পর একটু ঝামেলা হয়েছিল শুনেছিলাম। মি. ফুজিও নামের একজনের জীবন অবলম্বনে কিছু লিখেছিলেন বোধহয়,” কাগা বলল। “এরকম কি আর কোন ঘটনা আছে? কিংবা ব্যক্তিগত জীবনে কারো সাথে কোন সমস্যা ছিল?”
“আমার জানামতে তো নেই,” এতক্ষণে বুঝতে পারলাম, কৌশলে আমাকে জেরা করছে কাগা। সামনে বসে থাকা ইউনিফর্ম পরিহিত পুলিশ অফিসারের নীরবতা বড্ড কানে লাগলো হঠাৎ।
“ওহ্, একটা কথা জিজ্ঞেস করতে তো ভুলেই গেছি,” নোটবুক খুলে বলল কাগা। “আপনি কি নামিকো নিশিজাকি নামে কাউকে চেনেন?”
“কী?”
“আরো দুটো নাম আছে আমার কাছে-তেতসুজি ওসানো আর হাজিমে নাকানে।”
“বুঝতে পেরেছি,” কিছুক্ষণ ভাবনার পর বললাম। “এগুলো হিদাকার ‘তুষার দ্বার’ উপন্যাসের চরিত্রের নাম। এই উপন্যাসটাই ধারাবাহিকভাবে লিখছিল ও।” উপন্যাসটার এখন কি হবে কে জানে। মাঝপথেই ওটা থামিয়ে দেয়া ছাড়া উপায় নেই সম্পাদকের।
“মৃত্যুর আগ অবধি এই উপন্যাসটা নিয়েই কাজ করছিলেন তিনি।”
“ওহ্! ওর কম্পিউটারটা তো ছিল, তাই না?
“ডকুমেন্ট ফাইলটাও ওপেন করা ছিল মনিটরে।”
“আচ্ছা,” হঠাৎই একটা ভাবনা এলো মাথায়। “উপন্যাসটির কতটুকু লেখা হয়েছে?”
“কতটুকু বলতে কী বোঝাচ্ছেন?”
“কত পৃষ্ঠা?”
ওকে বললাম, হিদাকা আমাকে সকাল বেলা জানিয়েছিল রাতের মধ্যে আরো অন্তত ত্রিশ পাতা লিখতে হবে তাকে।
“আড়াই পাতার মত লেখা হয়েছিল,” ডিটেক্টিভ কাগা বলল।
“এখান থেকে আপনারা মৃত্যুর সময়টা আন্দাজ করতে পারবেন। আমি যখন ওদের বাসা থেকে বের হই তখনো কাজ শুরু করেনি হিদাকা। “
“হ্যাঁ, এটা আমরাও ভেবেছি। কিন্তু লেখালেখি তো আর নির্দিষ্ট সময় বেঁধে হয় না। সুতরাং কতটুকু লেখা হয়েছে, সেটা দেখে কিছু আন্দাজ করাটা একটু মুশকিল।”
“সেটা ঠিক বলেছেন। কিন্তু আপনারা যদি হিদাকার লেখার সর্বোচ্চ গতি সম্পর্কে জানতে পারেন, তাহলে আন্দাজ করতে সুবিধা হবে।“
“তাই তো,” কাগা বলল। “আপনার কি মনে হয়, হিদাকার লেখালেখির সর্বোচ্চ গতি কত ছিল?”
“ভালো প্রশ্ন। আমাকে একবার ও বলেছিল, ঘন্টায় গড়ে চার পাতার মতন লেখে।”
“তাহলে ধরে নেয়া যায়, খুব তাড়াহুড়ো করলেও ঘন্টায় ছয় পাতার বেশি লেখাটা বোধহয় সম্ভব নয় তার পক্ষে।”
“ওরকমই।”
চুপ হয়ে গেল ডিটেক্টিভ কাগা। বোধহয় মনে মনে কিছু একটা হিসেব করছে।
“কী হয়েছে?”
“বলাটা একটু কঠিন,” একবার মাথা ঝাঁকালো কাগা। “আমি আসলে নিশ্চিত নই, কম্পিউটারের মনিটরে যে ডকুমেন্ট ফাইলটা ওপেন করা ছিল সেটা নতুন উপন্যাসটার কি না।”
“হয়তো প্রথম দিকের পর্বগুলোর কোন একটা দেখছিল হিদাকা। “
“হতে পারে। প্রকাশকের সাথে আগামীকাল কথা বললে জানা যাবে।” কী ঘটতে পারে, সেটা নিয়ে আপনমনেই ভাবতে লাগলাম। রাইয়ের ভাষ্যমতে মিয়াকো ফুজিও বাড়ি ফিরে যায় পাঁচটার দিকে। আমাকে হিদাকা ফোন দেয় ছয়টার সময়। ওই এক ঘন্টায় যদি লিখতে বসে হিদাকা, তাহলে সর্বোচ্চ পাঁচ কি ছয় পাতা লেখা সম্ভব হতো ওর পক্ষে। তাহলে মূল প্রশ্নটা হচ্ছে, আসলে কতটুকু লিখেছিল ও?
“জানি, আপনাদের অনেক বিধি নিষেধ আছে, আমাকে হয়তো বলতে পারবেন না,” ডিটেক্টিভ কাগার দিতে তাকালাম। “কিন্তু মৃত্যুর সম্ভাব্য সময় কি আন্দাজ করতে পেরেছেন আপনারা?”
“ঠিক বলেছেন, এটা কাউকে জানানো যাবে না। নিষেধ আছে। তদন্তের এই পর্যায়ে বাইরের কাউকে কিছু বলাটা উচিতও নয় আসলে। কিছু মনে করবেন না,” হেসে বলল কাগা। “তবে এখনও সুরতহালের রিপোর্ট আমাদের হাতে আসেনি, তাই আন্দাজটুকু বলতে দোষ নেই। আমরা মোটামুটি নিশ্চিত, পাঁচটা থেকে সাতটার মধ্যে মারা গেছেন হিদাকা।”
“কিন্তু আমাকে ছয়টার সময় ফোন দিয়েছিল ও।”
“তাহলে আমরা ধরে নিতে পারি, ছয়টা থেকে সাতটার মধ্যে ঘটেছে ঘটনাটা।”
তার মানে আমার সাথে কথা বলার কিছুক্ষণের মধ্যেই খুন হয় হিদাকাব।
“কীভাবে মারা গেছে ও?” শুনে মনে হবে, নিজেকেই প্রশ্নটা করেছি। চোখ বড় করে আমার দিকে তাকালো কাগা। আমি আর রাই আবিষ্কার করেছিলাম হিদাকার মরদেহ, সুতরাং আমার মুখে প্রশ্নটা বোধহয় একটু বেমানানই বটে। কিন্তু আমি আসলেও জানি না জবাবটা। এতটাই ভয় পেয়ে গেছিলাম যে ভালোমত যাচাই করে দেখার কথাও মাথায় আসেনি।
কাগাকে খুলে বললাম বিষয়টা। সব শুনে মাথা নাড়লো ও। “সুরতহালের রিপোর্ট পাওয়া অবধি কিছু বলা যাচ্ছে না। তবে প্রথম দর্শনে
আমার মনে হয়েছে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে আপনার বন্ধুকে।
“মানে কেউ হাত দিয়ে গলা চেপে ধরেছিল?”
“নাহ্, টেলিফোনের তারটা পেঁচানো অবস্থায় পাওয়া যায় হিদাকার গলায়।”
“কী?” টেলিফোনটা দেখেছিলাম কি না মনে করতে পারলাম না।
“এছাড়াও আরেকটা ক্ষত দেখেছি আমি। মাথার পেছনে কিছু একটা দিয়ে আঘাত করা হয়েছিল। আমাদের লোকেরা ধারণা করছে, খুব সম্ভবত পিতলের পেপারওয়েটটা ব্যবহার করেছে আততায়ী। ওটাও হিদাকার পাশে মেঝেতে পড়ে ছিল।”
“তার মানে প্রথমে মাথায় আঘাত করে অচেতন করা হয় ওকে…এরপর টেলিফোনের তার গলায় পেঁচিয়ে খুন করে?”
“এটাই একমাত্র যুক্তিসঙ্গত ব্যাখা,” নিচু কণ্ঠে কথাটা বলল কাগা। “দয়া করে কারো সাথে এই বিষয়ে আলাপ করবেন না, ঠিক আছে?”
“অবশ্যই।”
আমার অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিংয়ের সামনে পৌঁছে গেছে গাড়িটা।
“লিফটের জন্যে ধন্যবাদ। এই অবস্থায় ট্রেনে করে আসতে ইচ্ছে করছিল না একদমই। “
“কোন সমস্যা নেই। আপনার সাথে কথা বলে আমিও অনেক কিছু জানতে পেরেছি।”
গাড়ি থেকে বের হতে যাবো এসময় কাঁধে হাত রেখে আমাকে থামালো কাগা। “পত্রিকাটার নাম বলুন তো আমাকে।”
“সোমেই। ওরাই ধারাবাহিকভাবে প্রতি মাসে ছাপাচ্ছিল উপন্যাসটা।”
মাথা ঝাঁকালো কাগা। “আরে, আপনার লেখা যেখানে ছাপানো হয়, সেটার কথা বলেছি।”
বোকার মত একটা হাসি ফুটলো আমার মুখে। নামটা বললে নোটবুকে সেটা টুকে নিল কাগা। শুভরাত্রি জানিয়ে যার যার পথ ধরলাম আমরা।
অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে চুপচাপ সোফায় বসে থাকলাম কিছুক্ষণ। সারাদিনে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো নিয়ে ভাবছি, কিন্তু কোনটাই বাস্তব মনে হচ্ছে না। মানুষের জীবনে এরকম দিন কমই আসে। এমনকি, অনেকের পুরো জীবন কেটে যায় নিস্তরঙ্গভাবে; যেখানে পরিচিত কারো মৃতদেহ আবিষ্কার করতে হয় না তাদের।
ঘটনাটা মর্মান্তিক, সেই বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। এরকম একটা দিনের শেষে ঘুমোনোটা সমীচীন হবে না মোটেও। অবশ্য বিছানায় শোয়ার পর ঘুম আসবে বলে মনে হয় না, বিশেষ করে আজকে। তখনই মাথায় আসে, আমার বন্ধু কিভাবে মারা গেল, সেটা লিখে রাখা উচিত 1
এখন যা লিখছি, সেটা মূলত এই কারণেই।
আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি হিদাকার কেসটা সমাধান না হওয়া অবধি সবকিছু টুকে রাখবো।
***
পরদিন হিদাকার মৃত্যুসংবাদ বড় করে ছাপা হয় পত্রিকায়। রাতের বেলা টিভি দেখিনি, কিন্তু ধারণা করছি এগারোটার সংবাদেই প্রথম সম্প্রচারিত হয় খবরটা।
পেপারের প্রথম পাতায় মূল শিরোনামের নিচে লেখা প্রতিবেদনটি খুব বেশি বড় না হলেও ভেতরের পাতায় বিস্তারিত উল্লেখ করা হয়েছ সবকিছু। হিদাকার বাড়ির বিশাল একটা ছবিও ছাপানো হয়েছে। ইনসেটে হিদাকার ছবি। খুব সম্ভবত কোন পত্রিকায় ছাপানোর জন্য তোলা হয়েছিল ছবিটা।
প্রতিবেদনটায় একটা তথ্য বাদে অন্যান্য সবকিছু মোটামুটি ঠিকঠাকই উল্লেখ করা হয়েছে। কেবল হিদাকার মরদেহ আবিষ্কারের ঘটনার বিষয়ে প্রতিবেদক লিখেছে, ‘বাড়ির সব বাতি লম্বা সময় ধরে নেভানো দেখে তার স্ত্রী রাই’কে ফোন করে জানায় একজন। তখন বাড়ি ফিরে অফিস রুমে হিদাকার মৃতদেহ খুঁজে পান রাই।’ লেখাটা পড়ে সবাই ভাববে, রাই একাই ছিল ওখানে। আমার নাম কোথাও উল্লেখ করা হয়নি।
প্রতিবেদনটার মতে, তদন্ত কর্মকর্তাগণ দুটো সম্ভাবনা খতিয়ে দেখছে। প্রথমটা হচ্ছে, পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে হিদাকাকে। আর দ্বিতীয়টা, মুহূর্তের উত্তেজনায় তাকে হত্যা করেছে আততায়ী। সামনের দরজাটা ভেতর থেকে আটকানো ছিল। তাই সাংবাদিক ধরেই নিয়েছে, অফিসের জানালা দিয়ে ভেতরে ঢুকেছিল খুনি, সেই পথেই বেরিয়ে গেছে।
পত্রিকাটা নামিয়ে রেখে নাস্তা বানানো শুরু করবো, এমন সময় ডোরবেল বেজে উঠল। দেয়ালঘড়ি অনুযায়ী এখন সময় আটটা দশ। সাধারণত এত সকালে কেউ আসে না।
ইন্টারকমটা খুব একটা ব্যবহার করি না আমি। সরাসরি দরজা খুলে দেই। কিন্তু আজকে ইন্টারকমের রিসিভারটা তুলে নিলাম।
“কে?”
“মি. নোনোগুচি?” একটা নারীকণ্ঠ ভেসে এলো স্পিকারে। জোরে জোরে হাঁপাচ্ছে সে, যেন দৌড়ে এসেছে কোথাও থেকে
“জি, বলছি। আপনি কে?”
“এত সকালে বিরক্ত করার জন্যে দুঃখিত। আমি চ্যানেল এইট নিউজ থেকে এসেছি। গত রাতের ঘটনার বিষয়ে আপনার সাথে কথা বলতে চাচ্ছিলাম।”
অবাক হলাম বললেও কম হবে। কোন খবরের কাগজে আমার নাম ছাপা হয়নি কিন্তু টিভি চ্যানেলের লোকেরা দেখি ঠিকই খোঁজ পেয়ে গেছে কোন একভাবে।
“ইয়ে, মানে…” কী বলবো বুঝে উঠতে পারছি না। অসাবধানতাবশত এমন কিছু বলে ফেলতে চাই না যার কারণে পরে পস্তাতে হবে। “ঠিক কী জানতে চাইছেন আপনি?”
“বিখ্যাত লেখক কুনিহিকো হিদাকা গত রাতে নিজ বাসগৃহে খুন হন। আমরা শুনেছি তার স্ত্রী যখন মরদেহটা খুঁজে পায় তখন আপনিও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। এটা কি সত্যি, মি. নোনোগুচি?”
চ্যানেল এইট নিউজ শো’টার কাজই হচ্ছে বিভিন্ন রকমের খবর ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে প্রচার করা। মহিলা এমনভাবে কথা বলছে যেন সবকিছু ইতোমধ্যে তার জানাই আছে, কেবল আমার স্বীকার করার অপেক্ষা। তবে মিথ্যে বলাটা উচিত হবে না।
“হ্যাঁ, এটা সত্যি।”
ইন্টারকমেও বুঝতে পারলাম, উৎসাহের পারদ বেশ চড়ে গেছে অপর পাশে।
“আপনি মি. হিদাকার বাড়িতে গিয়েছিলেন কেন?”
“সরি, এই বিষয়ে আপনাদের সাথে কোন আলাপ করতে পারবো না। যা বলার পুলিশকে বলেছি।”
“মি. হিদাকার স্ত্রী’র সাথে নাকি আপনিই যোগাযোগ করেছিলেন প্রথমে? কী দেখে প্রথমে সন্দেহ হয়েছিল আপনার?”
“দয়া করে পুলিশের লোকদের সাথে কথা বলুন,” বলে ইন্টারকমটা নামিয়ে রাখলাম।
টিভি নিউজ শো’তে যারা চাকরি করে তারা একটু অভদ্র কিসিমের হয় বলেই শুনেছি। কিন্তু আজ প্রথমবারের মতন নিজের অভিজ্ঞতা হলো। ওদের কি বিবেক বলতে কিছু নেই? বন্ধু মারা যাবা পরদিন কী করে কারো সাথে এসব বিষয়ে কথা বলবে কেউ?
ঠিক করলাম, বাইরে বের হবো না, নতুবা অন্য কোন সাংবাদিক এসে জেরা শুরু করতে পারে। ভেবেছিলাম রাইয়ের সাথে একবার দেখা করবো বা অন্তত হিদাকার বাড়িটা থেকে ঘুরে আসবো কিন্তু আজকে আর ওদিকে যাওয়া সম্ভব হবে বলে মনে হয় না।
মাইক্রোওয়েভে দুধ গরম করছি, এ সময় আবারো বেজে উঠল ডোরবেল। এবারেও ইন্টারকমটা কানে ঠেকালাম।
“হ্যালো, আমি চ্যানেল ফোর নিউজ থেকে বলছি। কিছুক্ষণ সময় হবে আপনার?” এবার একটা পুরুষ কন্ঠ ভেসে এলো স্পিকারে। “মি. নোনোগুচি, পুরো দেশের মানুষ উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করছে গতকালের ঘটনা সম্পর্কে বিস্তারিত জানার জন্যে অন্য কোন সময় হলে এরকম অতি নাটুকে কথা শুনে হাসি পেত আমার।“
“দেখুন, আমি আসলে কেবল হিদাকার মরদেহটা খুঁজে পাই…এর বেশি কিছু জানি না।”
“কিন্তু আপনি তো মি. হিদাকার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন, তাই না?”
“হ্যাঁ। কিন্তু গত রাতের কোন বিষয়ে আপনাকে কিছু জানাতে পারবো না আমি।”
“আপনি যদি আমাদের কেবল মি. হিদাকার বিষয়ে কিছু বলেন, তবুও চলবে,” লোকটা হাল ছাড়ার পাত্র নয়।
লম্বা একটা শ্বাস ছাড়লাম। এভাবে নিউজ শো’র লোকজন যদি তাদের ক্রুসমেত আমার বাড়ির সামনে আস্তানা গাড়ে তাহলে প্রতিবেশীরা স্বাভাবিকভাবেই খুব বিরক্ত হবে।
রিসিভার নামিয়ে রেখে দরজা খুলে দিলাম। চকিতে এক ঝাঁক মাইক্রোফোন উদয় হলো আমার সামনে।
***
বাকিটা সকাল সাক্ষাৎকার দিতে দিতেই কেটে গেল। ঠিকভাবে নাস্তা করার সময়টুকুও পেলাম না। অবশেষে, দুপুর নাগাদ ফিরে এলাম অ্যাপার্টমেন্টে। উদোন খেতে খেতে টিভি দেখছি, এ সময় নিজের চেহারা ভেসে উঠতে দেখলাম টিভিতে। আরেকটু হলেই গলায় নুডলস আটকে যাচ্ছিল। মাত্র দু’ঘন্টা আগে রেকর্ড করা ফুটেজটা এখনই সম্প্রচার করছে ওরা।
“আপনারা তো বাল্যবন্ধু ছিলেন, তাই না? মানুষ হিসেবে মি. হিদাকাকে কিভাবে মূল্যায়ন করবেন?” তীক্ষ্ণ কন্ঠে প্রশ্নটা করলো সেই নারী রিপোর্টার। স্ক্রিনে আমাকে প্রশ্নটা নিয়ে বেশ লম্বা সময় ধরে ভাবতে দেখা যাচ্ছে।
একটা পর্যায়ে আমি বুঝতে পারি, একটু বেশিই সময় নিয়ে ফেলছি। তখনকার অস্বস্তি ভাবটাও স্পষ্ট ফুটে উঠেছে ক্যামেরার সামনে। এই অংশটুকু চাইলে কেটে বাদ দিতে পারতো ওরা, কিন্তু সময় নষ্ট করেনি। আমার চারপাশে দাঁড়িয়ে থাকা রিপোর্টারেরাও অধৈর্য হয়ে ওঠে।
“দারুণ ব্যক্তিত্ব ছিল ওর,” স্ক্রিনের আমি বললাম অবশেষে। “যা করবে বলে মনস্থির করতো, সেটার জন্যে জানপ্রাণ দিয়ে দিত। ওর সাথে যারা মিশেছে তাদের অনেকে হয়তো বলবে, ওর মতন মানুষই হয় না, আবার অনেকে এটাও বলতে পারে যে, ক্ষেত্রবিশেষে ওর আচরণ একটু শীতল। আসলে, আমরা সবাই এ রকম।”
“শীতল আচরণ বলতে কী বোঝাচ্ছেন?”
“মানে…” বলতে গিয়েও কিছু একটা ভেবে চুপ করে গেলাম। “নাহ্, এই মুহূর্তে এরকম প্রশ্নের জবাব দেয়া সম্ভব না আমার পক্ষে।“
হিদাকা যে তার প্রতিবেশীর বিড়ালটাকে মেরে ফেলেছে, এই চিন্তাটাই তখন ঘুরপাক খাচ্ছিল মাথায়। কিন্তু ক্যামেরার সামনে তো আর এসব বলা যায় না।
আরো কিছু দুর্বিনীত প্রশ্নের পর নারী রিপোর্টারটা আমাকে জিজ্ঞেস করলো, “হিদাকার খুনির উদ্দেশ্যে আপনি কি কিছু বলতে চান?”
জানতাম, এরকম কিছু জিজ্ঞেস করা হবে। গোটা প্রশ্নটাই একটা ফাঁদ। উল্টোপাল্টা কিছু বললেই সেটার খেসারত দিতে হবে সারাজীবন।
“নাহ, এই মুহূর্তে কিছু বলার নেই,” জবাব দিলাম। মহিলার চেহারাতেই স্পষ্ট যে উত্তরটা বিশেষ পছন্দ হয়নি।
এরপর আবার সংবাদ পাঠকের চেহারা ভেসে উঠল পর্দায়। পরবর্তি রিপোর্টটা হিদাকার উপন্যাসগুলো নিয়ে। লম্বা সময় ধরে সাহিত্যের বিভিন্ন ধারায় ওর পদচারণার বিষয়ে বিস্তারিত বলা হলো। এক পর্যায়ে রিপোর্টার মন্তব্য করলো যে হিদাকার বিচিত্র ধরনের গল্পগুলো অনেকাংশেই তার নিজের জীবন থেকে অনুপ্রাণীত। এই কথাটা যে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, তা বোঝার জন্যে সংবাদবোদ্ধা হতে হবে না। ওরা বোঝাতে চাইছে, লেখার মাঝে ব্যক্তিগত জীবনকে টানার প্রায়শ্চিত্তই করতে হয়েছে হিদাকাকে।
‘নিষিদ্ধ প্রান্তর’ উপন্যাসটা প্রকাশিত হবার পর সৃষ্ট বিতর্ক নিয়েও বিস্তর আলোচনা করলো এক রিপোর্টার। বলা হলো, উপন্যাসটা যার জীবনের উপরে ভিত্তি করে লেখা হয়েছে, তার পরিবার বিষয়টাকে ‘ব্যক্তিগত জীবনে হস্তক্ষেপ’ বলে আখ্যায়িত করেছে। মিয়াকো ফুজিও যে গতকাল হিদাকার বাসায় গিয়েছিল, এই তথ্যটা এখনও পায়নি সংবাদকর্মীরা।
এরপর খ্যাতিমান বিভিন্ন ব্যক্তি হিদাকার মৃত্যু নিয়ে আলোচনা শুরু করলে টিভিটা বন্ধ করে দিলাম। খাওয়ার রুচি নষ্ট হয়ে গেছে আমার।
জাপানের পাবলিক ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশন, অর্থাৎ এনএইচকে ঘটনাটা নিয়ে কোন প্রতিবেদন সম্প্রচার করলে সবচেয়ে ভালো হতো। এ রকম কেসের ব্যাপারে ওরা কখনো মনগড়া কিছু প্রচার করে না। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, হিদাকার মৃত্যু নিয়ে বিশেষ কোন প্রোগ্রাম তৈরি করার মত ফান্ড ওদের নেই।
ফোনটা বেজে উঠল এই সময়। আজকে সকাল থেকে খানিক পরপর রিং বেজেই যাচ্ছে, তবুও দরকারি কাজে কেউ ফোন করতে পারে ভেবে রিসিভারটা তুলে নিলাম নেই।
“হ্যালো, নোনোগুচি বলছি,” কিছুটা রুক্ষই শোনালো আমার কন্ঠ।
“হ্যালো, আমি,” কন্ঠস্বরটা যে রাইয়ের, সেই বিষয়ে কোন সন্দেহ
“ওহ, কী খবর? গতকাল কি হলো?” জানি যে প্রশ্নটা অদ্ভুত, কিন্তু অন্য কিছু মাথায় এলো না।
“মা-বাবার বাড়িতে চলে গিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম সবাইকে ফোন করে জানাবো, কিন্তু সেটা সম্ভব হয়নি।“
“আমি বুঝতে পারছি। এখন কোথায় তুমি?”
“বাসায়। পুলিশের ওরা ফোন দিয়েছিল সকালবেলা। বলল ক্রাইম সিনটা আরেকবার তদারকি করে দেখবে আর আমার সাথেও নাকি আলাপ আছে।”
“কথা শেষ তাদের সাথে?”
“হ্যাঁ। কয়েকজন ডিটেক্টিভ অবশ্য এখনও আছে এখানে।”
“আর মিডিয়ার লোকজন? তারা জ্বালাতন করছে তোমাকে?”
“সে আর বলতে! কিন্তু হিদাকার প্রকাশকের বেশ জানাশোনা আছে এই লাইনে। তারাই এখানে এসে সবকিছু সামলাচ্ছে। এখন আর তেমন অসুবিধে হচ্ছে না আমার।”
“আচ্ছা।”
“ভালো” বলা থেকে নিজেকে আটকালাম একদম শেষ মুহূর্তে। সদ্য স্বামী হারানো একজন নারীকে এই কথাটা বলা মানানসই হবে না।
“তোমার কি অবস্থা, নোনোগুচি? তোমাকেও নিশ্চয়ই বিরক্ত করছে ওরা। একজনের কাছে শুনলাম টিভিতে নাকি তোমাকে দেখিয়েছে। দুশ্চিন্তা হচ্ছিল, তাই ফোন দিলাম।”
“আমাকে নিয়ে একদমই চিন্তা করো না। এখন আর কেউ নেই এখানে।”
“তোমাকে এ রকম ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে দেখে আমি দুঃখিত,” গলার স্বর শুনেই বোঝা যাচ্ছে, একদম মন থেকে কথাটা বলেছে রাই। ওর মানসিকতা আসলেও প্রশংসার দাবিদার। এই মুহূর্তে সে গোটা পৃথিবীর সবচেয়ে দুঃখী মানুষদের একজন, অথচ নিজের এই অবস্থাতেও আমাকে নিয়ে চিন্তা করছে। হিদাকা যে ভুল বলেনি তার প্রমাণ পাচ্ছি পদে পদে।
“যদি কোন দরকার হয়, তবে সাথে সাথে আমাকে জানাবে,” বললাম তাকে।
“ঠিক আছে। কিন্তু আপাতত কিছু লাগবে না। হিদাকার পরিবারের অনেকে এসেছে। আমার মা-ও আছে এখানে।”
“আচ্ছা,” হিদাকার ভাইয়ের কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। ওর চেয়ে দুই বছরের বড় সে, বিবাহিত। হিদাকার মা তার সাথেই থাকেন। “তবুও…কিছু লাগলে ফোন দিও।”
“অনেক ধন্যবাদ তোমাকে, নোনোগুচি। পরে কথা হবে।”
“খোঁজ নেয়ার জন্যে তোমাকেও ধন্যবাদ।”
নামিয়ে রাখলাম রিসিভারটা, তবুও রাইয়ের চিন্তা দূর হলো না মাথা থেকে। সে এখন কী করবে, কোথায় থাকবে—এসব নিয়ে ভাবছি। বয়স খুব একটা বেশি না ওর, পরিবারও যথেষ্ট বিত্তবান। সুতরাং, কোন প্রকার ঝামেলায় পড়ার কথা না। তবে হিদাকাকে হারানোর কষ্টটা কাটিয়ে উঠতে সময় লাগবে। হাজার হলেও, মাত্র একমাস ধরে বিয়ে হয়েছিল ওদের।
হিদাকার সাথে সামনাসামনি দেখা হবার অনেক আগে থেকেই তার লেখার সাথে পরিচিত ছিল রাই। বিশাল ভক্ত বললেও কম বলা হবে। কাজের খাতিরে পরিচয় হবার কিছুদিনের মধ্যেই প্রণয়ে রূপ নেয় ওদের সম্পর্কটা। অর্থাৎ, গতকাল রাতে নিজের স্বামী এবং প্রিয় লেখকে নতুন উপন্যাস—এই দুটো জিনিসই হারায় সে।
এসব নিয়ে ভাবনার মাঝেই আবারো বেজে উঠল ফোনটা। একটা খবরের অনুষ্ঠানে আমার সাক্ষাৎকার নিতে চায় চ্যানেল এইট। মুখের ওপর মানা করে দিয়ে রিসিভার নামিয়ে রাখলাম।
***
সন্ধ্যা ছয়টার কিছুক্ষণ পর আমার বাড়িতে হাজির হলো ডিটেক্টিভ কাগা। চেহারায় রাজ্যের বিরক্তি ফুটিয়ে দরজা খুলে দেখি বাইরে ও দাঁড়িয়ে আছে। তবে একা আসেনি সে, মাকিমুরা নামের কম বয়সি আরেকজন ডিটেক্টিভও আছে সাথে।
“আপনাকে বিরক্ত করার জন্যে দুঃখিত। আমার আরো কিছু প্রশ্ন ছিল।”
“হ্যাঁ, ভাবছিলাম যে কখন যোগাযোগ করবেন। আসুন, ভেতরে আসুন।”
কিন্তু দরজার বাইরে থেকে নড়লো না ডিটেক্টিভ কাগা। “আপনি কি খাচ্ছিলেন নাকি?”
“না, এখনও খাইনি। তবে খাবো ভাবছিলাম।”
“তাহলে আমরা বাইরে কোথাও বসি? সত্যি বলতে আজকে এত কাজ ছিল যে দুপুরে ঠিকমতো খেতেও পারিনি আমরা। তাই না?” মাকিমুরার দিকে তাকিয়ে বলল কাগা। জবাবে বোকা বোকা একটা হাসি মুখে সায় জানালো সে।
“ঠিক আছে। কোথায় যেতে চান? কাছেই একটা ভালো পর্ক কাটলেট রেস্তোরাঁ আছে।”
“যে কোন এক জায়গায় গেলেই হলো,” বলে কি যেন একটা ভাবলো কাগা। “আচ্ছা, কাছেই একটা ফ্যামিলি রেস্তোরাঁ আছে না? আপনি আর আপনার সম্পাদক, মি. ওশিমা গিয়েছিলে যেখানে?”
“আছে তো। যাবেন ওখানে?”
“হ্যাঁ, সময় কম লাগবে আর যতবার ইচ্ছে কফিও নেয়া যাবে। “কফি পেলে মন্দ হতো না,” পাশ থেকে মাকিমুরা বলল।
“আচ্ছা দাঁড়ান, আমি জ্যাকেট পরে আসছি,” বললাম।
ওদের দরজার ওখানটায় দাঁড় করিয়ে রেখে ভেতরে এসে কাপড় বদলে নিলাম। কাগা ওই রেস্তোরাঁটায় যেতে চাচ্ছে কেন কে জানে। কোন বিশেষ কারণ কি আছে? নাকি বিনামূল্যে কফি খাওয়ার লোভে?
কোন যুতসই জবাব মাথায় এলো না। কিছুক্ষণের মধ্যেই বাইরে বেরিয়ে এলাম তিনজন।
রেস্তোরাঁয় পৌছে আমি অর্ডার করলাম শ্রিম্প ডোরিয়া আর দুই ডিটেক্টিভ নিল ল্যাম্ব স্টেক এবং মিট লোফ।
“আচ্ছা, উপন্যাসটার নাম যেন কী? তুষার দ্বার?” ওয়েট্রেস অর্ডার নিয়ে চলে যাবার পর বলল কাগা। “মি. হিদাকার কম্পিউটার স্ক্রিনে খোলা ছিল যেটা।”
“হ্যাঁ। আপনি তো কালকে ভাবছিলেন যে ওই লেখাগুলো পূর্ব প্রকাশিত কি না। সেটা জানতে পেরেছেন?”
“জেনেছি। ওগুলো নতুন, কালকেই লেখা হয়েছে। মাসিক সোমেই পত্রিকার সম্পাদকের সাথে কথা বলেছি আমরা। তার মতে উপন্যাসের আগের অংশের সাথে মিলে গেছে ওটুকু।”
“তাহলে লেখার মাঝে খুন করা হয় ওকে?”
“একটা বিষয় একটু অদ্ভুত লেগেছে আমার এক্ষেত্রে,” হালকা সামনে ঝুঁকে ডান হাতটা টেবিলে রেখে বলল ডিটেক্টিভ কাগা।
“অদ্ভুত?”
“পৃষ্ঠা সংখ্যা। ডকুমেন্ট ফাইলটা প্রিন্ট করার পর সাতাশ পৃষ্ঠা হয়েছে। তিনি যদি মিস ফুজিও চলে যাবার পরপরই লিখতে বসেন, তবুও তো এত লেখা সম্ভব না। আর আপনি কালকে যেমনটা বললেন, ঘন্টা বড়জোর ছয় পৃষ্ঠা লিখতেন মি. হিদাকাব।“
“সাতাশ পৃষ্ঠা! এ তো অনেক বেশি।”
আমি হিদাকাদের বাড়িতে যাই আটটার দিকে। যদি ধরে নেই তখনও জীবিত ছিল সে, তবুও ঘন্টায় নয় পৃষ্ঠা করে লিখতে হবে তাকে।
“তাহলে,” বললাম। “হয়তো মিথ্যে বলেছিল ও?”
“মানে?”
“দুপুরে আমার সাথে যখন দেখা হয় ততক্ষণে নিশ্চয়ই দশ বারো পৃষ্ঠা লেখা হয়ে গিয়েছিল ওর। কিন্তু আমাকে বুঝতে দিতে চায়নি। বড় লেখকেরা নিজেদের অতিরিক্ত ব্যস্ত প্রমাণের জন্যে এমন করে প্রায়ই। “
“পত্রিকার সম্পাদকও একই কথা বলেছেন।”
“তারাও জানে এসব।”
“হিদাকা রাইকে বলেছিলেন হোটেলে ফিরতে দেরি হবে কিন্তু আটটার আগেই তার সাতাশ পৃষ্ঠা লেখা হয়ে গিয়েছিল। প্রতি মাসে ‘তুষার দ্বার’ উপন্যাসটির ত্রিশ পৃষ্ঠার মতন করে প্রকাশিত হতো পত্রিকায়। সেই হিসেবে বলা যায়, কাজ প্রায় গুছিয়ে এনেছিলেন হিদাকা। আমি তো জানতাম যে লেখা জমা দিতে বেশিরভাগ সময়ই দেরি হয়ে যায় লেখকদের। কিন্তু কেউ কি আগেভাগে শেষ করে?”
“করতেই পারে। লেখালেখি তো আর ধরাবাঁধা নিয়ম-কানুন মেনে হয় না। কখনো কখনো ঘন্টার পর ঘন্টা কম্পিউটারের সামনে বসে থাকলেও এক পাতা লেখা বেরোয় না। আবার লেখা আসতে শুরু করলে থামানোই যায় না মাঝে মাঝে।”
“মি. হিদাকাও কি ওরকম লেখক ছিলেন?”
“হ্যাঁ। সত্যি বলতে কী, সব লেখকেরাই এমন।”
“আচ্ছা। এই বিষয়ে ধারণা ছিল না আমার,” আবারো সিটে হেলান দিয়ে বসে বলল কাগা।
“মারা যাবার আগে কতদূর লিখেছিল হিদাকা, এটা নিয়ে এত মাথা ঘামাচ্ছেন কেন বুঝতে পারছি না,” বললাম। “মূলকথা হচ্ছে, রাই যখন হোটেলে যায়, তখনও গল্পটা লেখা শেষ হয়নি হিদাকার। কিন্তু ওর মরদেহ উদ্ধারের সময় দেখা যায় যে লেখাটা প্রায় গুছিয়ে এনেছিল। অর্থাৎ, মৃত্যুর আগেই কাজটুকু করে সে। তাই তো?”
“সেরকমই মনে হচ্ছে,” মাথা নাড়লো ডিটেক্টিভ কাগা, তবে অসন্তুষ্ট ভাবটা দূর হয়নি চেহারা থেকে।
আমার প্রাক্তন সহকর্মী সামান্য তথ্যের গড়মিলও খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে এখন। এটা নিশ্চয়ই তার কাজেরই অংশ। এই সময় ওয়েট্রেস আমাদের খাবার নিয়ে এলে কথাবার্তা বন্ধ থাকলো কিছুক্ষণ।
“একটা বিষয় জানতে চাইছিলাম,” কিছুক্ষণ পরে বললাম আমি। “হিদাকার মরদেহের কি হবে? আজকে ময়নাতদন্তের কথা বলেছিলেন না আপনি?”
“হ্যাঁ, ময়নাতদন্ত শেষ ইতিমধ্যে,” মাকিমুরার দিকে তাকিয়ে বলল কাগা। “তুমি ছিলে না ওখানে?”
“না, আমি না। থাকলে এখন এখানে এসব খেতে পারতাম?” ভ্রু কুঁচকে মিট লোফ মুখে দিতে দিতে বলল মাকিমুরা।
“তা ঠিক,” একটা শুকনো হাসি ফুটলো কাগার মুখে। “ময়নাতদন্তের ব্যাপারে কোন প্রশ্ন আছে আপনার?” এবারে আমাকে জিজ্ঞেস করলো সে।
“কখন মারা গেছে ও, সেটা জানতে পেরেছেন?”
“রিপোর্টটা আমি নিজে পড়িনি, তবে শুনেছি ঠিকঠাকই আন্দাজ করেছে ওরা।”
“তারা একদম নিশ্চিত?”
“সেটা নির্ভর করছে কিসের ভিত্তিতে আন্দাজ করেছে, তার উপরে। যেমন—” বলতে গিয়েও থেমে গেল কাগা। “নাহ্, এখন কথাটা বলা উচিত হবে না।
“কেন?”
“আপনার খাওয়ার রুচি থাকবে না,” আমার প্লেটের দিকে ইঙ্গিত করলো ও।
“ওহ,” বলে মাথা নাড়লাম। “তাহলে পরেই শোনা ভালো।” সায় দিলো ডিটেক্টিভ কাগা। ঠিক কথাটাই বলেছি আমি।
বাকি সময় খুনের ব্যাপারে কোন আলোচনা হলো না। বরং আমি বাচ্চাদের যে বইগুলো লিখছি, সেগুলোর বিষয়ে জানতে চাইলো ও। এখনকার বাচ্চারা কেমন লেখা পছন্দ করে, কোন ধারায় লিখলে বেশি জনপ্রিয়তা পাওয়া যায়, বই পড়ুয়ার সংখ্যা কমে যাওয়াটা আমি কিভাবে দেখি—এসব।
জবাবে বললাম, যে বইগুলো শিক্ষা মন্ত্রনালয় থেকে সুপারিশকৃত, সেসব বইয়ের বিক্রিই তুলনামূলক বেশি। আর বাচ্চাদের বই পড়ার অভ্যাস কমে যাওয়ার জন্যে দায়ী তাদের বাবা-মায়েরা।
“এখন তো বড়রা তেমন বই পড়ে না, কিন্তু তারাই আবার বাচ্চাদের জোর করে হলেও বই পড়াতে চায়। ফলে হিতে বিপরীত হবার সম্ভাবনাই বেশি। পড়ার অভ্যাসের মধ্যে না থাকলে কোন বইটা ভালো, এটাও বোঝা যায় না। আর তার শিক্ষা মন্ত্রনালয় থেকে যে বইগুলো সুপারিশ করা হয়, সেগুলোর চাহিদা এত বেশি। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে ওই বইগুলোয় অতিরিক্ত মাত্রায় একঘেয়ে। ফলে বাচ্চারা কোন আগ্রহবোধই করে না। একটা দুষ্ট চক্র বলতে পারো গোটা ব্যাপারটাকে, যে চক্র ছিন্ন করে বেরিয়ে আসাটা আশু দরকার।”
খেতে খেতে মনোযোগ আমার কথাগুলো শুনলো দুই ডিটেক্টিভ। তবে এসব বিষয়ে আদৌ তাদের কোন আগ্রহ আছে কি না সন্দেহ।
খাবার শেষে কফি দিয়ে গেল ওয়েট্রেস। আমি আমার জন্যে এক গ্লাস দুধের অর্ডার দিলাম।
“আপনি তো সিগারেট খান?” টেবিলে রাখা অ্যাশট্রে দেখিয়ে বলল ডিটেক্টিভ কাগা।
“না।”
“ছেড়ে দিয়েছেন?”
“হ্যাঁ, দুই বছর হতে চলল প্রায়। ডাক্তারের নির্দেশ। আমার পাকস্থলির বারোটা বেজে যাচ্ছিল।“
“ওহ্। সরি, তাহলে আমাদের স্মোকিং জোনে বসাটা উচিত হয়নি। লেখকদের কথা মাথায় এলেই মনে হয় যে তারা নিয়মিত ধূমপান করে। মি. হিদাকা তো চেইন স্মোকার ছিলেন, তাই না?”
“হ্যাঁ। মাঝে মাঝে ওর অফিসে গেলে মনে হতো মশা তারানোর জন্যে ধূপ জ্বালিয়েছে।”
“গত রাতে এরকম কিছু চোখে পড়েছিল? আপনারা যখন ওনার মরদেহটা খুঁজে পান, তখন?”
“গতকাল…আসলে তখন এসব খেয়াল করার মত মানসিক অবস্থা ছিল না, বুঝতেই পারছেন,” বলে দুধের গ্লাসে একবার চুমুক দিলাম। “তবে আপনি বলায় এখন মনে পড়ছে, ধোঁয়ার গন্ধ পেয়েছি।”
“আচ্ছা।” কফির কাপটা ঠোঁটে ছোঁয়ালো ডিটেক্টিভ কাগা, এরপর ধীরে সুস্থে পকেট থেকে একটা নোটবুক বের করলো। “আসলে আরেকটা বিষয়ে আপনার সাথে একটু আলাপ ছিল। আপনি তো আটটার দিকে মি. হিদাকার বাড়িতে গিয়েছিলেন।“
“হ্যাঁ।”
“আপনি বলেছেন, ইন্টারকমে কেউ জবাব না দেয়ায় রাইকে কল করেছিলেন বুথ থেকে। বাড়ির সব আলো নেভানো ছিল তখন।“
“হ্যাঁ।”
“আচ্ছা, সব বাতি কি আসলেও নেভানো ছিল? আপনই নিশ্চিত?”
“কোন সন্দেহ নেই আমার এই ব্যাপারে,” উত্তর দিতে দেরি করলাম না।
“কিন্তু সামনের গেট থেকে অফিস রুম দেখা যায় না। আপনি কি বাগানের ওদিকটায় গিয়েছিলেন?”
“না, যাইনি। দেখা না গেলেও গেটের ওখানে দাঁড়িয়ে বোঝা যায় ভেতরে আলো জ্বলছে কি না।“
“তাই নাকি? কিভাবে?” ডিটেক্টিভ কাগা জানতে চাইলো।
“অফিসের জানালার পাশেই বড় একটা চেরি গাছ আছে। যদি ওখানকার আলো জ্বলে তাহলে গাছটা পরিস্কার দেখা যায়।”
সমঝদারের ভঙ্গিতে মাথা নাড়লো দুই ডিটেক্টিভ। “বুঝেছি।”
“কেন, কোন সমস্যা?”
“নাহ, এগুলো আসলে রুটিন প্রশ্ন। খুঁটিনাটি সব তথ্য না জানলে আমাদের বস আবার রাগ করেন।”
“বেশ কঠোর বস মনে হচ্ছে।“
“কোন চাকরিতে বসরা বন্ধুর মত হয়, বলুন?” কাগার মুখের হাসিটা আমার শিক্ষকতা জীবনের কথা মনে করিয়ে দিলো।
“তদন্ত কেমন চলছে? কোন সূত্র পেলেন?” দুই ডিটেক্টিভের দিকে তাকিয়ে বললাম।
“সবে তো শুরু হয়েছে,” কাগার কথার সুরে স্পষ্ট যে এই বিষয়ে বেশি কিছু বলতে চাইছে না।
“টিভিতে বলাবলি করছিল, এটা নাকি অনিচ্ছাকৃত খুনও হতে পারে। মানে মুহূর্তের উত্তেজনায় ভাবনা চিন্তা না করেই কাজটা করেছে খুনি, “ বললাম আমি।
“এই সম্ভাবনাটাও উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে না এই মুহূর্তে,” ডিটেক্টিভ কাগা বলল।
তবে ওরা যে এমন কিছু ভাবছে না, তা দুই ডিটেক্টিভের অভিব্যক্তিই বলে দিচ্ছে।
“কিন্তু আপনার ধারণা এমনটা না ঘটার সম্ভাবনাই বেশি।”
“হ্যাঁ।”
“কেন?”
“নির্জন বাড়িতে চুরি করতে গেলে সাধারণত সামনের দরজা দিয়েই ভেতরে ঢোকে আততায়ী। কারো চোখে পড়ে গেলে এটা সেটা বুঝিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে, সেটাও সামনের দরজা দিয়েই। আর আপনি তো জানেনই, মি. হিদাকার বাড়ির সামনের দরজাটা বন্ধ ছিল।”
“চোরেরা বাড়ির দরজা বন্ধ করে যেতে পারে না?”
“আপনার বন্ধুর বাড়ির দরজার ডেড বোল্টটা ভেতরের দিকে, সুতরাং বাইরে থেকে বন্ধ করার জন্যে চাবির প্রয়োজন। হিদাকাদের দরজার চাবি মোট তিনটা। এর মধ্যে দুটো ছিল রাইয়ের কাছে, আরেকটা মি. হিদাকার ট্রাউজারের পকেটে।”
“কিন্তু কিছু চোর তো জানালা দিয়েও ভেতরে ঢোকে, তাই না?”
“তা ঠিক। কিন্তু জানালা দিয়ে যারা ভেতরে ঢোকে, তারা লম্বা সময় ধরে পরিকল্পনা করে নেয় আগে। ভেতরের বাসিন্দারা কে কোথায় আছে, সেই বিষয়েও তথ্য থাকে তাদের কাছে। ফলে ধরা পড়ার ঝুঁকিটা কমে যায়।”
“এক্ষেত্রে ও রকম কিছু হয়নি?”
“আসলে…” হাসি ফুটলো কাগার মুখে। “ভেতরে তো চুরি করার মত খুব বেশি কিছু নেই। ঝুঁকি নেয়াটা পোষানোর কথা না।“
কাগার ভাবনার গভীরতা দেখে মুখ হা হয়ে গেল আমার।
“আসলে…” ওকে দেখে মনে হচ্ছে পরের কথাটা বলা ঠিক হবে কি না ভাবছে। “আমার ধারণা খুনি মি. হিদাকার পরিচিত কেউ।”
“এই ভাবনাটা একটু কেমন যেন।”
“কাউকে কিন্তু কিছু বলবেন না এই বিষয়ে,” ঠোঁটের সামনে আঙুল নিয়ে আমাকে সাবধান করলো সে।
“নিশ্চয়ই,” ওকে আশ্বস্ত করলাম।
একবার ডিটেক্টিভ মাকিমুরার দিকে তাকালো কাগা। সাথে সাথে বিলের কাগজটা হাতে নিয়ে ক্যাশ রেজিস্টারের দিকে রওনা হয়ে গেল জুনিয়র ডিটেক্টিভ।
“আরে, আমি বিল দেই।“
“দরকার নেই,” হাত উঁচিয়ে বলল ডিটেক্টিভ কাগা। “আমরাই তো আপনাকে বাইরে নিয়ে এসেছি।”
“কিন্তু ডিপার্টমেন্ট থেকে তো আপনাদের খাওয়ার খরচ দেয় না। “
“নাহ, ডিনার আমাদের নিজেদের পয়সাতেই করতে হয়।”
“তাহলে তো ঝামেলা হয়ে গেল।”
“আরে, ব্যাপার না।”
ক্যাশ রেজিস্টারের দিকে তাকালাম আমি। মানিব্যাগ বের করেছে ডিটেক্টিভ মাকিমুরা। তবে টাকাটা কাউন্টারের মহিলার হাতে না দিয়ে কিছু একটা জিজ্ঞেস করলো সে। পরক্ষণেই আমার দিকে আড়চোখে তাকালো মহিলা, এরপর মাকিমুরার উদ্দেশ্যে কী যেন বলল।
“সরি,” কাগার দৃষ্টি আমার দিকে। চেহারার অভিব্যক্তির কোন পরিবর্তন আসেনি ওর। “আপনার অ্যালিবাই ঠিক আছে কি না সেই বিষয়ে খোঁজ নিতে এসেছি আমরা। “
“অ্যালিবাই?”
“হ্যাঁ,” বলে মাথা নাড়লো সে। “আপনার সম্পাদক, মি. ওশিমার সাথে কথা বলেছি আমরা কিন্তু আরেকবার যাচাই করে নেয়াটা জরুরি। এটা আমাদের কাজ, কিছু মনে করবেন না।”
“এজন্যেই কি এখানে আসার কথা বলেছিলেন?”
“হ্যাঁ,” কাগার কর্মপরিকল্পনায় অভিভূত না হয়ে পারলাম না।
কিছুক্ষণ পর ফিরে এলো ডিটেক্টিভ মাকিমুরা। তার দিকে চেয়ে একবার মাথা নাড়লো কাগা। “কি? অতিরিক্ত বিল রেখেছে নাকি এবারও?”
“নাহ্।”
“যাক, বাঁচা গেল,” বলে আমার দিকে তাকালো কাগা। মুখের হাসিটা এখন চোখেও বিস্তৃত হয়েছে।
যখন বললাম গত দুই দিন ধরে কি ঘটছে সব লিখে রাখছি, আগ্ৰহ ফুটলো আমার প্রাক্তন সহকর্মীর চেহারায়। রেস্তোরাঁ থেকে বের হয়ে বাড়ির পথে হাঁটছি আমরা তিনজন এখন। আমি যদি কিছু না বলতাম, তাহলে বিদায় নিয়ে নিজেদের রাস্তা মাপতো ডিটেক্টিভ দু’জন।
“আসলে এরকম অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হইনি তো কখনো আগে, তাই লিখে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এর জন্যে আমার লেখকসত্ত্বাকে দায়ী ধরে নিতে পারেন।”
কথাটা শুনে কিছুক্ষণ কি যেন ভাবলো ডিটেক্টিভ, এরপর বলল, “যদি কিছু না মনে করেন, আপনার লেখাটা আমি পড়তে চাই।”
“কি?! আপনি পড়বেন? ইয়ে মানে…আসলে অন্য কেউ লেখাটা পড়বে, এসব ভেবে কিছু লিখিনি।“
“প্লিজ,” বলেই আমার সামনে এসে মাথা ঝোঁকালো কাগা। তার দেখাদেখি ডিটেক্টিভ মাকিমুরাও একই কাজ করলো।
“আরে আরে করছেন কি আপনারা! রাস্তার পাশে দুইজন পুলিশ অফিসারকে আমার সামনে এভাবে বাউ করতে দেখলে লোকে কী বলবে? আপনাদের তো সব কিছু বলেছি আমি।”
“তবুও দেখতে চাই।“
“আচ্ছা, এত করে যখন বলছেন,” মাথা চুলকে বললাম। “অ্যাপার্টমেন্টে আসতে পারবেন? আমার ওয়ার্ড প্রসেসরে আছে ফাইলটা। প্রিন্ট করে দিতে হবে।
“কোন সমস্যা নেই,” কাগা বলল।
আমার সাথে সাথে অ্যাপার্টমেন্টে উঠে এলো দুই ডিটেক্টিভ। লেখাটা প্রিন্ট করছি এ সময় আমার পিছে এসে দাঁড়ালো কাগা। “ওয়ার্ড প্রসেসর ব্যবহার করেন নাকি আপনি?”
“হ্যাঁ।”
“মি. হিদাকা দেখলাম কম্পিউটার ব্যবহার করতেন।”
“লেখালেখি ছাড়াও আরো অনেক কাজে ওটা ব্যবহার করতো ও। ইমেইল পাঠানো, গেইম খেলা—এসব।”
“আপনি কম্পিউটার ব্যবহার করেন না কেন, নোনোগুচি?”
“ওয়ার্ড প্রসেসরই আমার জন্যে যথেষ্ট।”
“তাহলে পান্ডুলিপি প্রকাশকের অফিসে পাঠান কিভাবে? কেউ এসে নিয়ে যায়?”
“না, সাধারণত ফ্যাক্স করে দেই। ওই দেখুন,” আমার রুমের একপাশে রাখা ফ্যাক্স মেশিনটার দিকে ইঙ্গিত করলাম। একটা ফোনের লাইন আমার বাসায়। তাই কর্ডলেসটা ফ্যাক্স মেশিনের সাথেই লাগানো।
“কিন্তু কালকে তো খসড়া পান্ডুলিপিটা নেয়ার জন্যে আপনার সম্পাদক এসেছিল বাড়িতে,” আমার চোখে চোখ রেখে বলল কাগা। ক্ষণিকের জন্যে মনে হলো ওর দৃষ্টিতে সন্দেহ খেলা করছে। এটা অবশ্য আমার মনের ভুলও হতে পারে। কিন্তু একটু আগে কাগা বলেছে, ওর ধারণা খুনি হিদাকার পরিচিত।
“আসলে এবারের লেখাটা নিয়ে কিছু আলাপ ছিল আমার, সেজন্যেই তাকে ফোন করে আসতে বলেছিলাম।“
নীরবে আমার কথাটা শুনলো কাগা, তবে জবাবে কিছু বলল না। প্রিন্টআউট দেয়া শেষ হলে ওর হাতে লেখাগুলো তুলে দিলাম “আপনাকে একটা কথা বলা হয়নি।”
“তাই?” ডিটেক্টিভ কাগাকে দেখে মনে হলো না যে অবাক হয়েছে।
“হ্যাঁ। এই লেখাগুলো পড়লেই বুঝতে পারবেন। তবে এটাও মাথায় রাখবেন যে যখন এসব লিখছিলাম, তখন ভাবিনি আমি বাদে অন্য কেউ আমার বয়ানটুকু পড়বে। ইচ্ছেকৃতভাবে কাউকে সন্দেহভাজন হিসেবে উপস্থাপন করার ইচ্ছেও আমার নেই।”
হিদাকা এবং ওই বিড়ালটার প্রসঙ্গে কথাগুলো বললাম।
“বেশ। চিন্তার কিছু নেই, আমি ওরকম কিছু ভাববো না।” আমাকে বেশ কয়েকবার ধন্যবাদ জানালো ডিটেক্টিভ কাগা। এরপর অ্যাপার্টমেন্ট ছেড়ে বেরিয়ে গেল দুই ডিটেক্টিভ।
কাগা এবং তার সহকারী বেরিয়ে যাওয়ার পর আজকের ঘটনাবলি লিখতে বসেছিলাম। ও হয়তো আমার নতুন লেখাগুলোও পড়তে চাইবে। কিন্তু লেখার সময় সেই কথা মাথায় আনা যাবে না। নতুবা লেখাগুলো নিরপেক্ষতা হারাবে, তাই না?
***
আজ হিদাকার মৃত্যুর তৃতীয় দিন। অন্তেষ্টিক্রিয়ার আয়োজন করা হয়েছিল ওর বাড়ি থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে একটা বৌদ্ধ মন্দিরে। প্রকাশনা জগতের অনেক রথী-মহারথী উপস্থিত হয়েছিল সেখানে। সেই সাথে ভক্ত পাঠকদের ভিড় ছিল দেখার মতন।
টিভি চ্যানেলের লোকেরা আগেভাগেই চলে গিয়েছিল মন্দিরে। গম্ভীর মুখে মাইক্রোফোন হাতে ঘুরে বেড়াচ্ছিল রিপোর্টারেরা। উপস্থিত কারো চোখে পানি দেখলেই ক্যামেরা ঘুরে যাচ্ছিল সেদিকে।
বেদিতে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন শেষে ছাউনির নিচে গিয়ে দাঁড়াই আমি। বেশ কয়েকজন সেলেব্রেটিকে চোখে পড়ে। হিদাকার গল্প থেকে বানানো সিনেমায় যারা বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছে, তারাও এসেছে।
মন্ত্রপাঠ এবং কিছুক্ষণ কথা বলার পর সবাইকে শ্রদ্ধার্ঘ নিবেদনের সুযোগ করে দেন প্রধান পুরোহিত। রাইয়ের পরনে একটা কালো ড্রেস, হাতে পুতির জপমালা। পুরোহিতের কথা শেষ হলে সামনে গিয়ে সবাইকে ধন্যবাদ জানায় সে, এরপর হিদাকার স্মৃতি রোমন্থন করে কিছুক্ষণ। অনুষ্ঠানের এই পর্যায়ে বেশ কয়েকজনের কান্নার শব্দ এলো কানে।
রাই তার বক্তব্যে খুনির বিষয়ে কোন কিছু বলল না। সচরাচর এসব ক্ষেত্রে দেশবাসীর সামনে খুনির দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করে ভিক্টিমের আত্মীয় স্বজনেরা। মানুষ হিসেবে সে যে অন্য ধাঁচের, তার প্রমাণ বারবার পাচ্ছি।
শববাহকেরা কফিন নিয়ে রওনা হয়ে গেলে ভিড় কমে আসতে শুরু করলো। এসময় একজনকে চোখে পড়ায় থমকে গেলাম। অবশ্য, মনে মনে
জানতাম যে সে আসবে।
“মিস ফুজিও?” মন্দির থেকে বের হওয়ার পথে ডাক দিলাম তাকে। নিজের নাম শুনে থেমে পেছনে তাকালো মিয়াকো ফুজিও। “আপনি?”
“হিদাকার অফিসে দেখা হয়েছিল আমাদের।”
“ওহ্, হ্যাঁ।”
“আমার নাম নোনোগুচি, আমি হিদাকার বন্ধু। আপনার ভাইও আমাদের সাথে একই ক্লাসে পড়তো।”
“জি, শুনেছি। হিদাকা সেদিন বলেছিল আমাকে।”
“যদি আপনার সমস্যা না হয়, তাহলে কিছুক্ষণ কথা বলতে চাইছিলাম। সময় হবে কি?”
একবার ঘড়ির দিকে তাকালো মিয়াকো। “আসলে, একজন অপেক্ষা করছে আমার জন্যে,” বলে দূরের পার্কিং লটের দিকে তাকালো সে।
তার দৃষ্টি অনুসরণ করে আমিও তাকালাম সেদিকে। পার্কিং লটের রাস্তার পাশেই একটা সবুজ ভ্যান রাখা। ড্রাইভিং সিটে বসে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে এক যুবক।
“আপনার স্বামী?”
“নাহ্…..”
তাহলে প্রেমিক হবে।
“আমরা এখানেই কথা বলতে পারি। খুব বেশি সময় লাগবে না।”
“কী নিয়ে কথা বলতে চাইছেন?”
“সেদিন আপনার সাথে হিদাকার কোন বিষয়ে কথা হয়েছিল?”
“যে বিষয়ে সবসময় কথা হয়। বইগুলো যত দ্রুত সম্ভব মার্কেট থেকে তুলে নেয়া, আনুষ্ঠানিক বক্তব্যের মাধ্যমে নিজের ভুল স্বীকার করা এবং পুরো বইয়ের পুনর্লিখন, যেখানে আমার ভাইয়ের ব্যাপারে কিছু থাকবে না। আমি জানতে পারি, কানাডায় চলে যাচ্ছেন তিনি, তাই কিভাবে এসব করবেন সেটা জানার আগ্রহ থেকেই গিয়েছিলাম।”
“হিদাকা কি বলেছে আপনাকে?”
“বলেন যে তিনি ভুল কিছু করেননি।”
“অর্থাৎ আপনার দাবিগুলো মেনে নেয়ার ইচ্ছে ছিল না ওর?”
“তার মতে শিল্পগুণ রক্ষার খাতিরে আমার ভাইয়ের ব্যক্তিগত কিছু বিষয় তুলে ধরাটা প্রয়োজন ছিল। কোন প্রকার খারাপ উদ্দেশ্য থেকে কাজটা করেননি তিনি।”
“কিন্তু আপনি তার সাথে একমত নন।“
“অবশ্যই একমত নই।” আগের তুলনায় কিছুটা কোমল হল মিয়াকোর চাহনি।
“তাহলে আপনার সেদিন ওখানে যাওয়ার উদ্দেশ্যটা সফল হয়নি।”
“হিদাকা বলেছিলেন কানাডায় গিয়ে সবকিছু গুছিয়ে নেয়া মাত্র আবারো আলোচনা শুরু করবেন। কথাও দিয়েছিলেন এই ব্যাপারে। আমি বুঝতে পারি যে কানাডায় পাড়ি জমানোটা তার জন্যে জরুরি, এ জন্যে আর বাড়াবাড়ি কিছু করিনি, বিদায় নিয়ে চলে আসি।”
হিদাকার জায়গায় আমি থাকলেও একই কথাই বলতাম নিশ্চয়ই।
“ওখান থেকে সরাসরি বাসায় যান আপনি?”
“আমি?…হ্যাঁ।”
“পথে কোথাও থামেননি?”
“না,” বলে মাথা ঝাঁকালো সে। এরপর হঠাৎই চোখ বড় করে আমার দিকে তাকালো মিয়াকো ফুজিও। “আপনি কি আমার অ্যালিবাইয়ের বিষয়ে খোঁজ নিচ্ছেন?”
“না, না,” চোখ নামিয়ে বললাম। আসলে তো তার অ্যালিবাইয়ের খোঁজ নিচ্ছিলাম আমি!
লম্বা একটা শ্বাস ছাড়লো মিয়াকো। “কিছুদিন আগে একজন ডিটেক্টিভ এসেছিলেন আমার বাসায়, তিনিও ঠিক এই প্রশ্নগুলোই করেছিলেন। তবে আপনার মত পেঁচিয়ে বলেননি ভদ্রলোক, সরাসরিই জানতে চেয়েছেন, মি. হিদাকার প্রতি কোন ক্ষোভ পুষে রেখেছি কি না।“
“ওহ আচ্ছা,” তার দিকে তাকালাম আবারো। “আপনি কী বললেন?”
“বললাম, ক্ষোভ পুষে রাখার প্রশ্নই আসে না। আমি শুধু চাইছিলাম, আমার মৃত ভাইয়ের ভাবমূর্তি কোন কারণে নষ্ট না হোক।”
“তাহলে আমি ধরে নিতে পারি ‘নিষিদ্ধ প্রান্তর’ উপন্যাসটি আপনার পছন্দ হয়নি?”
“দেখুন, মি. নোনোগুচি…প্রত্যেকের জীবনেই নিগূঢ় কিছু বিষয় থাকে। যা তাদের একান্ত গোপনীয়। আমাদের উচিত সেই গোপনীয়তার প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা।”
“কিন্তু সেই বিষয়গুলো যদি কারো আবেগের অংশ হয়? সেই আবেগটুকু কি সবার সাথে ভাগাভাগি করে নেয়ার অধিকার নেই কারো?”
“আবেগ?” মিয়াকোর চোখে এখন খেলা করছে কৌতূহল। “মিডল-স্কুল পড়ুয়া একটা মেয়েকে ধর্ষণের মধ্যে আবেগ কোথায় খুঁজে পাচ্ছেন আপনি?”
“গল্প লেখার সময় পাঠকের মনে আবেগের উদ্রেক ঘটানোর লক্ষ্যে এরকম সত্য ঘটনা প্রায়শই ব্যবহার করে লেখকেরা।”
আবারো দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো মিয়াকো। “আপনিও একজন লেখক, তাই না?”
“হ্যাঁ, তবে আমি বাচ্চাদের জন্যে লিখি।”
“যেহেতু আপনি একজন লেখক, তাই হিদাকার পক্ষ টানছেন?”
“হয়তো,” কিছুক্ষণ ভেবে জবাব দিলাম।
“দারুণ একটা পেশা!” ওর কন্ঠের শেষটুকু ধরতে অসুবিধে হলো না। “মাফ করবেন, আমাকে এখন যেতে হবে,” জবাবের অপেক্ষা না করেই ভ্যানের দিকে রওনা হয়ে গেল সে।
***
অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিংয়ে ফিরে আমার মেইলবক্সে একটা কাগজ দেখতে পেলাম।
“আগের দিন আমরা যেখানে খেয়েছিলাম, সেই রেস্তোরাঁয় অপেক্ষা করছি আমি। ফোন করবেন। কাগা।”
কাগজের নিচের দিকে লেখা নম্বরটা নিশ্চয়ই ওই রেস্তোরাঁর।
শেষকৃত্যানুষ্ঠানের পোশাক পাল্টে একটা প্যান্ট আর জ্যাকেট গায়ে চাপিয়ে সোজাসুজি রেস্তোরাঁটায় চলে এলাম। ইচ্ছে করেই ফোন দেইনি। একটা জানালার পাশে বসে বই পড়ছিল ও। বইটার নাম দেখা যাচ্ছে না।
আমাকে দেখে উঠে দাঁড়ালো কাগা। হাত নেড়ে ওকে বসতে ইশারা করলাম। “আরে, দাঁড়ানোর দরকার নেই। “
“এভাবে হঠাৎ ডেকে পাঠানোর জন্যে দুঃখিত,” একবার বাউ করে বলল ডিটেক্টিভ। ও জানে যে আজকে হিদাকার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া ছিল।
ওয়েট্রেসকে এক গ্লাস দুধ দিতে বলে সিট টেনে নিয়ে বসে পড়লাম। “জানি কেন এসেছেন আজকে। এগুলো নেয়ার জন্যে নিশ্চয়ই?” জ্যাকেটের পকেট থেকে কাগজগুলো বের করে ওর সামনে রাখলাম। গত কয়েকদিনে যা যা ঘটেছে, সব লেখা আছে ওখানে। এখানে আসার আগে প্রিন্ট করে এনেছি।
“অশেষ ধন্যবাদ আপনাকে,” বলে কাগজগুলো তুলে নিল কাগা।
“এখানে না পড়লে হয় না? আগের লেখাগুলো তো পড়েছেন নিশ্চয়ই? জানেন যে আপনার বিষয়েও লিখেছি আমি। এখন যদি আমার সামনেই আমার লেখা পড়েন, তাহলে ব্যাপারটা একটু কেমন যেন হয়ে যায়। “
হাসি ফুটলো ওর মুখে। “তা বটে। তাহলে এগুলো এখন আপনার কাছ থেক দূরে রাখাই উত্তম,” কাগজগুলো ভাঁজ করে পকেটে ঢুকিয়ে রেখে বলল কাগা।
“তাহলে,” পানির গ্লাসে চুমুক দিলাম। “আমার নোটগুলো কাজে আসছে?”
“হ্যাঁ, ভীষণ,” সাথে সাথে জবাব দিলো কাগা। “কেবল দেখে বা শুনে অনেক সময় সবকিছু বোঝা যায় না। লেখার অক্ষরে দারুণভাবে গুছিয়ে আনা যায় সবকিছু, পাঠকেরও বুঝতে সুবিধে হয়। অন্যান্য প্রত্যক্ষদর্শীরাও যদি এরকম লিখিত বয়ান দিত, খারাপ হতো না।”
“লেখাগুলো আপনার কাজে এসেছে জেনে খুশি হলাম।”
আমার অর্ডার করা দুধের গ্লাসটা দিয়ে গেল ওয়েট্রেস। উপরের ফেনাটুকু খাওয়ার জন্যে একটা চামচও দিয়েছে সাথে।
“বিড়ালটার ব্যাপারে আপনার মতামত কি?” জানতে চাইলাম। “অবাক হয়েছিলাম ভীষণ। বিড়ালদের জ্বালাতনের অনেক নজির আছে, কিন্তু তাই বলে মেরে ফেলা…”
“বিড়ালটার মালিক সম্পর্কে খোঁজ খবর নিয়েছেন?”
“আমার বসের কাছে রিপোর্ট করেছি। অন্য কাউকে হয়তো কাজটা দিয়েছেন তিনি।”
“আচ্ছা,” বলে দুধের গ্লাসে চুমুক দিলাম। এভাবে কারো ওপর দোষ চাপিয়ে দেয়াটা আমার নিজের কাছেই ভালো লাগছে না। “ওই একটা ঘটনা বাদে সবকিছু অবশ্য আপনাকে আগেই বলেছিলাম।”
“তা বলেছিলেন,” মাথা নেড়ে বলল হিদাকা। “কিন্তু খুঁটিনাটি বিষয়গুলো আমার কাজে এসেছে বেশি।”
“খুঁটিনাটি বিষয় বলতে?”
“এই যেমন মি. হিদাকার অফিসে তার সাথে আপনার কথোপকথনের বিষয়টা। লিখেছেন যে কথা বলতে বলতে একটা সিগারেট ধরিয়েছিলেন তিনি। যদি আপনার নোটগুলো না পড়তাম, তাহলে এই তথ্যটা কখনো পেতাম না।”
“হ্যাঁ…তবে ও আসলে একটাই সিগারেট খেয়েছিল কি না, এই ব্যাপারে শতভাগ নিশ্চিত নই আমি। দুইটাও খেতে পারে। শুধু এটুকু মনে ছিল যে ওর হাতে সিগারেট দেখেছিলাম।“
“না, একটা সিগারেটই খেয়েছিলেন তিনি,” বেশ আত্মবিশ্বাসের সাথে বলল কাগা। “আপনার ভুল হয়নি।”
“আচ্ছা।”
সিগারেট খাওয়া না খাওয়ার সাথে খুনের তদন্তের কী সম্পর্ক, তা বুঝতে পারলাম না। হয়তো ডিটেক্টিভেরা এভাবেই তাদের কাজ করে। সবকিছু আমলে নিতে হয় কাজের অংশ হিসেবে।
মিয়াকো ফুজিও’র সাথে যে আমার কথা হয়েছে আজকে, সেটাও বললাম কাগাকে। এটা শোনার পর কৌতূহলী হয়ে উঠল আমার প্রাক্তন সহকর্মী।
“সে অবশ্য বেফাঁস কিছু বলেনি আমাকে,” বললাম। “কিন্তু ওর কি আসলেও অ্যালিবাই আছে?”
“আমাদের একজন লোক খোঁজ নিচ্ছে এই বিষয়ে। তবে আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে যে আছে।”
“বেশ। তার বিষয়ে মাথা ঘামিয়ে খুব বেশি লাভ হবে না তাহলে।”
“আপনি কি তাকে সন্দেহ করেন?”
“বিষয়টা সন্দেহ নাকি জানি না, তবে তার কিন্তু মোটিভ আছে।”
“মানে তার ভাইয়ের ব্যক্তিগত জীবন পুরো পৃথিবীর সামনে উন্মোচিত করে দিয়েছে হিদাকা, সেটার ক্ষোভ পুষে রেখেছে বলছো? কিন্তু তাকে হত্যা করার মাধ্যমে তো কোন সমাধান হবে না।”
“এমনটাও তো হতে পারে, সে বুঝতে পেরেছিল হিদাকা মন থেকে অনুতপ্ত নয়, এজন্যে মেজাজ হারিয়ে আক্রমন করে বসে অকস্মাৎ।”
“কিন্তু তিনি যখন ওখান থেকে বেরিয়ে যান, মি. হিদাকা বহাল তবিয়তেই ছিলেন।”
“পরে হয়তো ফিরে এসেছিল।”
“খুন করার উদ্দেশ্য?”
“হ্যাঁ,” মাথা নেড়ে বললাম। “হতেই পারে।“
“কিন্তু রাই তো তখনও বাড়িতে ছিলেন।“
“তাহলে তার চলে যাওয়া অবধি অপেক্ষা করেছে মিয়াকো, এরপর চুপিসারে ভেতরে ঢুকেছে।”
“অর্থাৎ মিয়াকো ফুজিও আগে থেকে জানতো রাই তার স্বামীকে বাসায় একা রেখে হোটেলে চলে যাবেন।”
“আলাপের এক পর্যায়ে হয়তো জানতে পেরেছিল।”
“হয়তো শব্দটা একটু বেশিই ব্যবহার করছেন আপনি,” আমার দিকে তাকিয়ে বলল ডিটেক্টিভ কাগা। একমনে টেবিলে আঙুল বাজিয়ে চলেছে সে। দিব্যচোখে দেখতে পাচ্ছি মাথার কলকব্জাগুলো ভন ভন করে ঘুরছে তার। “মিস ফুজিও কি দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকেছিলেন?”
“জানালা দিয়েও ঢুকতে পারে।”
“তাহলে আপনার ভাষ্যমতে, স্যুট পরিহিত এক যুবতী জানালা দিয়ে ভেতরে ঢোকে,” হেসে বলল কাগা। “আর গোটা সময় রুমে বসে দৃশ্যটা দেখেন মি. হিদাকা?”
“ওর বাথরুমে যাওয়া অবধি অপেক্ষা করেছিল বাইরে। এরপর ভেতরে প্রবেশ করে দরজার পেছনে গিয়ে লুকায়।”
“পেপারওয়েটটা তুলে নিয়েছিল টেবিল থেকে,” একবার বল ছোড়ার ভঙ্গিতে হাত নাচিয়ে বলে ডিটেক্টিভ।
“সেরকমই হবার কথা,” ডান হাতে মুঠো পাকিয়ে বলি। “এরপর সুযোগ বুঝে ওটা বসিয়ে দেয় হিদাকার মাথার পেছনে।
“আচ্ছা। এরপর?”
হিদাকার মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে কাগা আমাকে সেদিন যা বলেছি, তা মনে করার চেষ্টা করলাম। “টেলিফোনের তার গলায় পেঁচিয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যার পর পালিয়ে যায়?”
“ক্রাইম সিন থেকে কিভাবে পালায় সে?”
“জানালা দিয়ে। সামনের দরজা দিয়ে যদি বের হতো তাহলে আমরা ভেতরে ঢোকার সময় পাল্লাটা খোলাই পেতাম।”
“এটা ঠিক,” বলে কফির কাপটার দিকে হাত বাড়ালো কিন্তু কাপটা খালি। “তবে সামনের দরজা ব্যবহার করলো না কেন?”
“তা জানি না। হয়তো কেউ দেখে ফেলবে এই ভয় পাচ্ছিল। তবে আসল কথা হচ্ছে তার পোক্ত অ্যালিবাই আছে। সুতরাং এসব উর্বর মস্তিষ্কের কল্পনা বৈ কিছু নয়।”
“হ্যাঁ, আসলেও তার অ্যালিবাইটা বেশ পোক্ত। অর্থাৎ এসব আসলেও উর্বর মস্তিষ্কের কল্পনা।“
এমনভাবে আমার কথার পুনরাবৃত্তি করলো কাগা, একটু অদ্ভুতই ঠেকলো বিষয়টা। “তাহলে ভুলে যান আমি এসব কিছু বলেছি।”
“নাহ, এরকম চিন্তা মাথায় আসতেই পারে। হাজার হলেও হিদাকা আপনার বাল্যবন্ধু। আচ্ছা, আরেকটা বিষয় আমাকে ভেবে বলতে পারবেন?”
“আসলে, আমি এসবে দক্ষ নই। তবুও বলুন দেখি…”
“রুম থেকে বেরিয়ে যাবার সময় লাইট নিভিয়ে গেল কেন খুনি?”
“এটা তো সহজ,” কিছুক্ষণ ভাবার পর বললাম। “লাইট নেভানো থাকলে বাইরে থেকে মনে হবে বাড়িতে কেউ নেই। ফলে হিদাকার মরদেহ খুঁজে পেতেও সময় লাগবে বেশি। বাস্তবেও কিন্তু এমনটাই হয়েছে। “তাহলে খুনি ইচ্ছেকৃতভাবে দেরি করিয়ে দিতে চাইছিল?”
“সব খুনিই কি সেটা করে না?”
“হয়তো,” বলল কাগা। “তাহলে কম্পিউটারটা চালু করে রেখে গেল কেন?”
“কম্পিউটার?”
“হ্যাঁ। আপনারা যখন রুমে ঢোকেন, কম্পিউটারের স্ক্রিনটা চালু দেখতে পান। আপনিই বলেছেন এটা।”
“তা ঠিক। হয়তো কম্পিউটারের বিষয়ে কোন মাথা ব্যথা ছিল খুনির।“
“সেদিন আপনারা চলে আসার পর একটা এক্সপেরিমেন্ট করি আমি। রুমের সব লাইট নিভিয়ে দিয়ে কেবল কম্পিউটারের মনিটরটা চালু করে রাখি। বেশ উজ্জ্বল আলো হয় কিন্তু…পর্দা টানা থাকলেও বাইরে থেকে হালকা আলোর আভা দেখা যায়। খুনি যদি আসলেও চাইতো সবাই ভাবুক বাড়িতে কেউ নেই, তাহলে কম্পিউটারটাও বন্ধ করে যেত সে।”
“হয়তো সুইচ খুঁজে পায়নি। যারা কম্পিউটার সম্পর্কে বেশি কিছু জানে না, তারা এসব বিষয়ে ঝামেলায় পড়ে যায়।“
“অন্তত মনিটরটা তো বন্ধ করাই যেত, নাকি? ওটার সুইচ তো সামনেই…আর এটাও যদি না বোঝে সে, তাহলে প্লাগটা সকেট থেকে খুলে ফেললেই ঝামেলা মিটে যেত।”
“হয়তো ভুলে গেছিল।”
কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো ডিটেক্টিভ কাগা। “এটাই। হয়তো ভুলে গেছিল।”
বলার মত আর কিছু খুঁজে পেলাম না।
উঠে দাঁড়ালো কাগা। সময় দেয়ার জন্যে আমাকে ধন্যবাদ জানালো আরেকবার। “আজকের সবকিছুও কি লিখে রাখবেন?”
“হ্যাঁ, লেখার ইচ্ছে আছে।“
“আমি পড়তে পারবো?”
“আপনার ইচ্ছা, আমার কোন সমস্যা নেই। “
ক্যাশ রেজিস্টারের দিকে রওনা হতে গিয়েও থেমে গেল সে। “আপনার কি আসলেও মনে হয়েছিল, শিক্ষকতা পেশায় বেশিদিন টিকতে পারবো না আমি?”
আমার বয়ানে ওরকমই কিছু লিখেছিলাম বোধহয়। “এটা আসলে একান্তই আমার ব্যক্তিগত মতামত।”
নিচের দিকে তাকিয়ে একবার দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চলে গেল কাগা।
ওর মাথায় কী ঘুরছে কে জানে। কেসটার বিষয়ে কিছু একটা যদি ইতিমধ্যে জেনেই থাকে, তাহলে আমাকে বলল না কেন?