অধ্যায় ৫ – স্বীকারোক্তি : ওসামু নোনোগুচির বয়ান

অধ্যায় ৫ – স্বীকারোক্তি : ওসামু নোনোগুচির বয়ান

গত কয়েক দিন ধরেই আমার মনে হচ্ছিল এর পরেরবার যখন ডিটেক্টিভ কাগা হাসপাতালে আমার সাথে দেখা করতে আসবে, প্রয়োজনীয় সমস্ত উত্তর হয়তো থাকবে তার কাছে। এমনি এমনি নয়, তার কাজের ধরণ দেখেই এমনটা মনে হয়েছিল আমার। তদন্ত প্রক্রিয়া যাকে বলে একদম নিখুঁত। যেখানে দেখিবে ছাই, উড়াইয়া দেখিবে তাই-নীতিতে বিশ্বাসী। কোন সিদ্ধান্তে উপনীত হতে খুব বেশি সময় নষ্ট করে না। চোখ বন্ধ করলেই যেন তার পায়ের শব্দ শুনতে পাই। সে হাতসুমির ব্যাপারে জেনে ফেলার পরেই একরকম হাল ছেড়ে দেই আমি। চুপচাপ অপেক্ষা করতে থাকি। কপালে যা আছে সেটাই হবে।

ওর চোখের দ্যুতিতে সবসময় চিকচিক করে কৌতূহল। জীবনে কার কি করা উচিত, সেই বিষয়ে মন্তব্য করার অভ্যেস কখনোই ছিল না আমার, কিন্তু শিক্ষকতার পেশা থেকে বেরিয়ে আসার সিদ্ধান্তটা নিয়ে ভালোই করেছিল ও।

পরের বার কাগা উপস্থিত হলো দুটো প্রমাণ নিয়ে। প্রথম প্রমাণটা হচ্ছে একটা ছুরি, আর দ্বিতীয়টা একটা ভিডিওটেইপ। এটা শুনে অবাক হলাম যে টেপটা সমুদ্রের ডাক বইয়ের ভেতরের পাতাগুলো কেটে বসানো ছিল। হিদাকা ছাড়া আর কার মাথা থেকে এই বুদ্ধি বেরুবে, ভাবলাম আমি। অনেকে হয়তো ভাববে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবেই কাজটা করেছিল ও। যদি ওটা অন্য কোন বই হতো তাহলে ডিটেক্টিভ কাগার পক্ষেও এত দ্রুত সত্যের কাছাকাছি পৌঁছে যাওয়া সম্ভব হত না।

“এই টেপের দৃশ্যগুলো ব্যাখা করুন, দয়া করে। যদি আরেকবার দেখতে চান, আমি নিশ্চিত হাসপাতালে খুঁজে একটা ভিডিও প্লেয়ার পাওয়া যাবেই।”

পুরো সত্যটা আমার মুখ থেকে বের করার জন্যে এটুকুই বলার দরকার ছিল তার। ভিডিওটেইপে যে দৃশ্যটা দেখা যাবে, সেটার ব্যাখা দেয়ার জন্যে সত্য কথা না বলে উপায় নেই।

হ্যাঁ, এরপরেও আমি কিছুটা জোরাজুরি করি। জবাব না দিয়ে এড়িয়ে যেতে চাই, কিন্তু তখনও আমি জানতাম, এসব করে কোন লাভ নেই। আমার পিছু ছাড়বে না সে। আমাকে খোলসের ভেতরে ঢুকে পড়তে দেখে সময় নষ্ট না করে নিজের থিওরিটা বলতে শুরু করলো ডিটেক্টিভ কাগা। সে আগে থেকেই আন্দাজ করে রেখেছিল, এরকম কিছু একটা ঘটবে।

একদম শেষটায় উপসংহারের মত করে বলল, “এখন অবধি আমি যা যা বললাম, তার পুরোটাই অনুমান। কিন্তু হিদাকাকে খুন করার পেছনে আপনার মোটিভ খুঁজে বের করতে এটুকুই যথেষ্ট। আপনিই তো বলেছিলেন, চাইলে আমরা নিজেদের মত মোটিভ ভেবে নিতে পারি। সেটাই করেছি।”

ভুল বলেনি ও। সত্যটা স্বীকার করার চাইতে আমার মনে হয়েছিল ওরা কিছু একটা কল্পনা করে নিলেই ভালো। কিন্তু তখন কে জানত, কাগার অনুমান এরকম নির্ভুল হবে?!

“হারিয়েই দিলেন শেষ পর্যন্ত,” থকথক করতে থাকা নীরবতার জাল ছিড়ে ফেলে বললাম অবশেষে। নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করছি যেন আমার বিস্ময়টুকু গোপন থাকে কিন্তু শেষ অবধি তা-ও সম্ভব হলো না।

“এবার কি খুলে বলবেন সব?”

“না বললে কি আপনি এতক্ষণ আমাকে যা যা বললেন তা কোর্টেও বলবেন?”

“হ্যাঁ।”

“তাহলে তো আর কোন কিছু লুকোনোর কোন মানে হয় না। বিড়াল যেহেতু থলে থেকে বেরিয়েই গেছে, সব তথ্য ঠিকঠাকভাবে উপস্থাপিত হলেই ভালো।”

“আমার অনুমানে কোথাও কি কোন ভুল ছিল?”

“খুব বেশি কিছু না। তবুও সম্মান রক্ষার্থে কিছু সংযুক্তির দরকার আছে।”

“আপনার সম্মান?”

মাথা ঝাকিয়ে না করে দিলাম। “হাতসুমি হিদাকার সম্মান।”

সায় জানিয়ে পাশে বসা ডিটেক্টিভকে তথ্যগুলো টুকে নেয়ার কথা বলল কাগা।

“দাঁড়ান, দাঁড়ান!” বললাম। “কাজটা কি এভাবেই করতে হবে আপনাদের?”

“মানে?”

“অনেক লম্বা কাহিনী। সবকিছু একদম ঠিকঠাক মনে করতে হবে আমাকে। আমি চাইছি না একটানা কথা বলতে গিয়ে গোলমাল পাকিয়ে ফেলতে।”

“রিপোর্টটা লেখা শেষ হলে আপনাকে পড়তে দেব।”

“আমি জানি। কিন্তু স্বীকারোক্তি যদি দিতেই হয়, নিজের ভাষাতে দিতে চাইছিলাম।”

বেশ লম্বা একটা সময় নীরব রইলো ডিটেক্টিভ কাগা। অবশেষে জিজ্ঞেস করলো, অর্থাৎ, আপনি আপনার স্বীকারোক্তি নিজেই লিখতে চাইছেন?”

“আপনি যদি অনুমতি দেন আর কী।”

“ঠিক আছে। আমাদের জন্যেও সেটাতেই সুবিধা। কতক্ষণ লাগবে?”

“একদিন পুরো তো লাগবেই।”

“আগামীকাল সন্ধ্যা নাগাদ আসব আমি।” ঘড়ি দেখে বলল ডিটেক্টিভ কাগা। বিদায় নিয়ে বেরিয়ে গেল এরপর

***

আর এভাবেই নিজের স্বীকারোক্তি নিজেই লিখতে বসলাম আমি। লেখাটা এই ভেবে লিখছি যে, এটাই হবে আমার লিখিত শেষ কোন কিছু। আমার চূড়ান্ত কাজ। আর এই চিন্তাটা মাথায় ঢোকার পর মনে হল, একটা শব্দও বৃথা খরচ করা যাবে না। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও এটা আমাকে মেনে নিতে হবে যে, শব্দ নিয়ে খেলা করার মতো সময় এখন আমার হাতে নেই।

যেমনটা আগেও বলেছি, কুনিহিকো হিদাকার সাথে আমার দেখা হয়েছিল সাত বছর আগে। ততদিনে ওর প্রথম বই প্রকাশিত হয়ে গেছে। আমাদের দেখা হওয়ার দু’বছর আগেই ছোটখাটো একটা প্রকাশনী থেকে সেরা নবীন লেখকের পুরস্কারও বাগিয়ে ফেলেছে। সেই সময় নাগাদ একটা গল্পগ্রন্থ ও তিনটা উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে হিদাকার। ‘সাহিত্যে নবদিনের সূচনা’ ওর লেখা নিয়ে প্রকাশক এমনটাই বলেছিল। অবশ্য কোন নতুন লেখক পেলেই প্রকাশকেরা এটা অনেক আগে থেকেই বলে আসছে।

লাইব্রেরীতে ওর বই বিক্রি শুরু হওয়ার সময় থেকেই আমি খেয়াল করছিলাম সবকিছু। বন্ধু হিসেবে কিছুটা গর্বও হচ্ছিল। তবে অস্বীকার করবো না, ওর সাফল্য দেখে হিংসের পরিমাণটাও কম ছিল না। একদম ছোট থেকে লেখক হবার ব্যাপারে কথা বলতাম আমরা। দুজনেই বই পড়তে অনেক ভালবাসতাম। অনেক বই আদান প্রদান করে পড়া হতো। হিদাকাই আমাকে শার্লক হোমস আর আর্সেন লুপার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। এর বদলে জুল ভার্নের জাদুকরি জগতের ঠিকানা বাতলে দেই আমি।

হিদাকা প্রায়শই গর্ব করে বলতো এদের যে কারো তুলনায় ভালো লেখক হয়ে দেখিয়ে দেবে সে। খুব বেশি বিনয় কোন কালেই ছিল না ওর মধ্যে। তবে বুক ফুলিয়ে এই কথাগুলো না বললেও, আমি নিজেও এই স্বপ্ন দেখতাম। সুতরাং, আপনারা নিশ্চয়ই বুঝতেই পারছেন কেন ওর সাফল্যে ঈর্ষা কাজ করতে শুরু করে আমার মনে। যেখানে আমি লেখক হবার সিঁড়ির প্রথম ধাপেই পা রাখিনি, সেখানে ও ইতিমধ্যে অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছিল।

তবে মন থেকেই অভিনন্দন জানাতে চেয়েছিলাম ওকে। সেই সাথে স্বার্থপরের মতন এটাও ভেবেছিলাম, আমাকেও হয়তো কোন একটা সুযোগ করে দেবে হিদাকা। ওর মাধ্যমে প্রকাশকদের সাথে যোগাযোগ করতে পারবো, দেশের প্রকাশনা শিল্পের সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলব-খুব ছোট থেকেই যে স্বপ্নটা বুকে লালন করছি।

তখনই যোগাযোগ করতে চেয়েছিলাম ওর সাথে কিন্তু ভয় পাচ্ছিলাম, প্রথম বই প্রকাশিত হবার পরপরই যোগাযোগের চেষ্টা করলে হয়তো বিরক্ত হবে। বন্ধুত্ব যতই পুরনো হোক না কেন। তাই নীরবেই উৎসাহ জুগিয়ে যাই ওকে। পত্রিকায় গল্প প্রকাশিত হলে পড়ে ফেলতাম। নতুন উপন্যাস প্রকাশিত হলে কিনতে দেরি করতাম না। এর মাঝে ওর সাফল্য দ্বারা উৎসাহিত হয়ে নিজেও আবার লেখালেখি শুরু করি। এর আগে আমার লেখালেখি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহিত্য পত্রিকায় গল্প প্রকাশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল।

বেশ কয়েক বছর ধরেই মাথায় নতুন কয়েকটা গল্প ঘুরঘুর করছিল। সেখান থেকেই একটা বেছে নিয়ে লিখতে শুরু। এক আতশবাজির কারিগরিকে নিয়ে গল্প। আমি যেখানে বড় হয়েছি, সেখানকারই এক বুড়োর জীবন দ্বারা অনুপ্রাণিত ছিল গল্পটা। এলিমেন্টারি স্কুলে পড়ার সময় শেষ দুটো বছর তার ওখানে নিয়মিত যাতায়ত ছিল আমার। একথা কখনো ভুলিনি যে কিভাবে জীবনের শেষার্ধে এসে নিজেকে নতুন করে খুঁজে পায় সে। একজন ছাপোষা কেরানি বেড়াতে গিয়ে আতশবাজির প্রদর্শনী দেখে সেটার প্রেমে পড়ে যায়। আমার মনে হয় এই গল্পটাকেই বড় করে উপন্যাসে রূপ দেয়া যায়। সেটার নাম দেই বহ্নিচক্র।

প্রায় দুই বছর পর প্রথম হিদাকাকে চিঠি দেই আমি। বলি ওর সবগুলো বই আমার পড়া হয়ে গেছে। বন্ধুর সাফল্যে ভীষণ গর্বিত। শেষে বলি ওর সাথে দেখা করতে পারলে ভালো লাগবে। আমাকে অবাক করে দিয়ে পরদিনই ফোন দেয় হিদাকা

আমাদের একসাথে কাটানো শৈশবের কথা ওর স্মৃতিতে মলিন হয়নি। ফোনে কথা বলতে বলতে বুঝতে পারি এলিমেন্টারি স্কুল থেকে পাশ করার পর লম্বা একটা সময় তেমন যোগাযোগই হয়নি আমাদের মাঝে।

“মা’র কাছে শুনেছিলাম তুমি স্কুলে পড়ানো শুরু করেছো। খারাপ না কিন্তু, চাকরি হিসেবে যথেষ্ট ভাল। কোন ঝুঁকি নেই। আমার চেয়ে অন্তত ভালো। আমি তো কোন বোনাসও পাই না। আগামী দিনে কী ঘটবে তা-ও বুঝতে পারি না।” হেসে কথাগুলো বলে ও।

তবে হাসিটা নির্ভার। আমরা দু’জনেই ভালো করে জানতাম জীবনযুদ্ধে অনেকটাই এগিয়ে গেছে হিদাকা। তবে এটা নিয়ে আমার মধ্যে কোন প্রকার বিবমিষা ছিল না।

দেখা করার পরিকল্পনা করি আমরা। প্রথমে শিনজুকুর একটা ক্যাফেতে কফি খেয়ে চাইনিজ রেস্তোরাঁয় ডিনার। অফিস থেকে সরাসরি চলে যাই হিদাকার সাথে দেখা করতে, স্যুটটাও পাল্টাইনি। ওর পরনে ছিল একটা বোম্বার জ্যাকেট আর জিন্সের প্যান্ট। ‘গৎবাধা চাকরি না করার এই এক সুবিধা—সেই মুহূর্তে একথাই মনে হয়েছিল হিদাকাকে দেখে। কোন এক অদ্ভুত কারণে বিষয়টা মাথায় গেথে যায় আমার।

ফেলে আসা সময় আর পরিচিত বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে আলাপ করি আমরা। এক সময় আলোচনা মোড় নেয় ওর উপন্যাসগুলোর দিকে। হিদাকা যখন জানতে পারে যে আমি আসলেই ওর প্রকাশিত সবগুলো কাজ পড়েছি, ভীষণ অবাক হয়। ওর কাছ থেকে নতুন লেখা নেয়ার জন্যে যে সম্পাদকেরা পেছন পেছন ঘুরতো, তারাও নাকি সব লেখা পড়েনি। এবারে আমার অবাক হবার পালা।

সেদিন একদম কথায় পেয়ে বসেছিল ওকে। মুখে খই ফুটছিল অনবরত। কিন্তু আমি বইয়ের বিক্রিবাট্টার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা মাত্র চেহারায় আঁধার ঘনায়।

“তোমার কাছে আর কি লুকোবো। একটা সাহিত্য পত্রিকার সেরা তরুণ সাহিত্যিকের পুরষ্কার জিতলেই রাতারাতি সফল হওয়া যায় না। মানুষের হাতে হাতে তোমার বই পৌছাতে হবে। সেটা নিয়ে আলোচনা হতে হবে। হ্যাঁ, পুরষ্কার তোমাকে আগের তুলনায় কিছুটা পরিচিত করে তুলবে পাঠকদের মধ্যে, কিন্তু ওটুকুই। এরপর কি হবে বলা মুশকিল।”

বিষয়টা একটু হতাশাজনক নিশ্চয়ই, ভাবি আমি, লেখক হিসেবে কিছুটা নাম কামানোর পরপরই বোঝা যায় যে কষ্টের কেবল শুরু। আমার বিশ্বাস হিদাকাকে তখনও কিছুটা বেগ পেতে হচ্ছিল এসব নিয়ে। অনেকে রাইটার্স ব্লক বিষয়টাকে মেনে নিতে পারে না। আমার মনে হয় ভবিষ্যত নিয়ে কিছুটা অনিশ্চয়তায় ভুগছিল ও। অবশ্য তখন সেটা আমি বুঝতে পারিনি।

এরপরেই ওকে খুলে বলি যে আমি নিজেও একটা উপন্যাস লেখার কাজে হাত দিয়েছি। শিঘ্রই সেটা প্রকাশ করারও ইচ্ছে আছে।

“লিখে ফেলেছ নাকি?” জানতে চায় ও।

“না, মানে আসলে, এখনও প্রথম উপন্যাসটা নিয়েই আছি। আশা করি কিছুদিনের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে।“

“বেশ তো, শেষ হলে নিয়ে এসো। আমি পড়তে চাই। ভালো লাগলে তোমার সাথে কয়েকজন সম্পাদকের পরিচয় করিয়ে দেয়া যাবে।”

“আসলেই? কী বলে যে তোমাকে ধন্যবাদ দেব। আমার তো এখনই আবার লিখতে বসে যেতে ইচ্ছে করছে। আসলে আমার এই লাইনে পরিচিত কেউ নেই তো, ভাবছিলাম তরুণ লেখকদের ওসব প্রতিযোগীতায় উপন্যাসের খসড়াটা পাঠিয়ে দিব কি না। “

“আরে, ওগুলোর পেছনে সময় নষ্ট কোরো না। মানদন্ডের কোন ঠিক ঠিকানা নেই। বেশিরভাগ লেখকই ভাগ্যজোরে জিতে যায়। ওদের প্যানেলের যে বিচারক থাকবে, তাদের পছন্দমত না লিখলেই তোমার বই বাদ। ছাপার অক্ষরে তখন আর নিজের নাম দেখতে হবে না।”

“কিছুটা ধারণা আছে।”

“ভেতরের দৃশ্য আরো বাজে। এর চেয়ে সরাসরি সম্পাদকদের সাথে আলাপ করাই ভালো।”

সেদিনকার মত বিদায় নেয়ার আগে ওকে কথা দিলাম যে লেখা শেষ হওয়া মাত্র জানাব।

এবারে মনে মনে একটা ডেডলাইন ঠিক করে নিয়ে আটঘাট বেঁধে লিখতে বসি। এক রাতের মধ্যেই লেখার প্রতি আমার মনোভাব পুরোপুরি পাল্টে যায়। একমাসের মধ্যে শেষ করে ফেলি উপন্যাসের বাকি অংশটুকু। মাঝারি দৈর্ঘ্যের একটা কাজ, দু’শো পাতা হবে বড়জোর।

হিদাকার সাথে যোগাযোগ করে জানাই, বইটা লিখে শেষ করেছি। ও পাঠিয়ে দিতে বললে ফটোকপি করে কুরিয়ার করে দেই। এরপর অপেক্ষার পালা। মনে আছে, সেদিন কাজে গিয়েও কোন কিছুতে মনোযোগ দিতে পারিনি।

কিন্তু হিদাকার পক্ষ থেকে কোন জবাব আসে না। ধরে নেই ও হয়তো ব্যস্ত, সেজন্যে বিরক্তও করিনি। কিন্তু আমার মনের ভেতরে একটা অংশ খুব করে জানতে চাইছিল ওর কাছে উপন্যাসটা কেমন লেগেছে। মাঝে মাঝে বিচিত্র সব চিন্তাও এসে ভর করতো মাথায়। ওগুলো নিয়ে খুব বেশি ভাবতে ইচ্ছে করতো না।

ওর কাছে খসড়াটা পাঠানোর পুরো একমাস পর অবশেষে ফোন দেয়ার সিদ্ধান্ত নেই। হিদাকার জবাব শুনে কিছুটা হতাশ হই, তবে সেটার কারণ সম্পূর্ণ ভিন্ন। ও নাকি তখনও পড়েইনি উপন্যাসটা।

“সরি, কিছু মনে কোরো না, আমি কয়েকটা কাজ নিয়ে ব্যস্ত এই মুহূর্তে।”

এর জবাবে আমার আর কী-ই বা বলার ছিল। ও একজন পেশাদার লেখক। নিজের পেটটাও তো চালাতে হবে ওকে, নাকি?

“ঠিক আছে, আমার কোন তাড়া নেই। হাতের কাজ শেষ করে নাও তুমি,” কেন যে ওকে এই কথাগুলো বলেছিলাম সেদিন, জানি না।

“সরি, হাতের কাজগুলো শেষ হলেই পড়ে ফেলব। শুরুর কয়েক পাতা উল্টিয়েছিলাম। একজন আতশবাজির কারিগরকে নিয়ে লিখেছো, তাই না?”

“হ্যাঁ।”

“মন্দিরের কাছে যে বুড়ো লোকটা থাকত, তাকে নিয়েই গল্প সাজিয়েছ বোধহয়?”

“হ্যাঁ।”

“আমাদের কত স্মৃতি ছিল ওখানে! যাইহোক, আমি আসলেই উপন্যাসটা পড়তে চাই, কিন্তু সময় করে উঠতে পারছি না।”

“তোমার হাতের কাজ শেষ হতে কতদিন লাগতে পারে?”

“আরো প্রায় মাসখানেক। পান্ডুলিপিটা আমার সামনেই রাখা আছে। পড়ামাত্র তোমাকে ফোন দিয়ে জানাব।”

ধন্যবাদ জানিয়ে ফোন রেখে দেই। আমার মাথায় তখন ঘুরতে থাকে একজন পেশাদার লেখকের জীবন কেমন হয়, এসব নিয়ে চিন্তা। হিদাকার উৎসাহকে ঘুণাক্ষরেও মেকি হয়নি তখন।

আরো এক মাস কেটে যায় এভাবে। কিছু জানায় না ও। কাউকে বারবার বিরক্ত করা আমার স্বভাবের সাথে একদমই যায় না। কিন্তু আমার লেখাটা ওর কেমন লাগলো তা জানতেই হতো। থাকতে না পেরে একসময় আবারো ফোন করি ওকে।

“সরি, এখনও পড়া হয়নি আসলে,” হিদাকার মুখে এই কথা শুনে এবার সত্যিই দমে যাই। “যা ভেবেছিলাম তার চেয়েও বেশি সময় নিয়ে নিচ্ছে হাতের কাজটা। একটু অপেক্ষা করতে পারবে? আমি আসলেও দুঃখিত।”

“আচ্ছা, ব্যাপার না।” সত্যি বলতে, তখন আসলে আমি অপেক্ষা করার মত অবস্থায় ছিলাম না। অন্য একটা বুদ্ধি মাথায় আসে। “তুমি যদি বেশি ব্যপ্ত হও, তাহলে অন্য কারো কাছে লেখাটা একটু পাঠাতে পারবে? কোন সম্পাদক?”

গম্ভীর হয়ে ওঠে ওর কন্ঠস্বর। “সম্পাদকেরা অনেক ব্যস্ত থাকে। লেখাটা ভালো নাকি খারাপ, এসব না জেনে কাউকে কিছু পাঠানো আমার পক্ষ থেকে শোভন হবে না। বিশ্বাস করো, প্রতিদিন প্রায় কয়েক শত পান্ডুলিপি এসে জমা হয় ওদের কাছে। আমি যদি তাদের সাথে কাউকে পরিচয় করিয়ে দেই, আগে আমার নিজের সেই লেখকের লেখা পড়তে হবে। বুঝতে পারছ কি বলছো? অবশ্য তুমি যদি আমার মতামত না চাও, তাহলে ভিন্ন কথা। চাইলে পান্ডুলিপিটা ফেরত পাঠিয়ে দিতে পারি।”

এই কথার জবাবে কী বলতাম আমি? “আমি আসলে এরকম কিছু বোঝাতে চাইনি। তোমার ব্যস্ততার কারণেই বললাম।”

“সরি, কিন্তু কোন সম্পাদকের হাতে এরকম কাচা লেখা পড়ার মত সময় নেই। চিন্তা কোরো না…আমিই পড়বো, কথা দিচ্ছি।”

“আচ্ছা…দেখ একটু লেখাটা,” বলে লাইন কেটে দেই।

যেমনটা ভেবেছিলাম, আরো সপ্তাহদুয়েক কেটে যাওয়ার পরেও হিদাকার কাছ থেকে কোন ফোন আসে না। আরো একবার হতাশ হতে হবে, এটা মেনে নিয়েই ডায়াল করি ওর নম্বরে।

“হ্যালো, আরে, তোমাকেই ফোন দেয়ার কথা ভাবছিলাম,” ওর গলার ঔদাসিন্য শঙ্কা জোগায় আমার মনে।

“পড়েছ?”

“হ্যাঁ, দুই দিন আগে শেষ করলাম।”

তাহলে দুই দিন আগেই কেন ফোন করে জানায়নি এই প্রশ্নটা করা থেকে বিরত করলাম নিজেকে। “কেমন লাগল?”

“আসলে…” কয়েক সেকেন্ড পেরিয়ে যায় কিন্তু কিছু বলে না ও। “ফোনে এসব ব্যাপারে আলোচনা করা কঠিন,” অবশেষে মুখ খোলে। “তুমি চলে এসো আমার বাসায়। আলাপ করা যাবে।“

ও যে আমাকে ডেকে পাঠাতে পারে, তা মাথাতেই আসেনি আমার। আমি তো কেবল এটুকু জানতে চাইছিলাম লেখাটা ওর ভালো লেগেছে কি না। এমনি এমনি আমার সময় নষ্ট করছে, তা-ও বলা যায় না। নতুবা বাসায় ডাকতে যাবে কেন? অর্থাৎ, বইটা হয়তো পুরোপুরি পড়েছে ও। বিশেষ কিছু বলতে চায় সেই ব্যাপারে। কিছুটা দোটানা নিয়েই ওর বাসায় যেতে সম্মত হই আমি।

আর এভাবেও হিদাকাদের ওখানে যাওয়া আসার শুরু। এই সামান্য একটা ব্যাপারই যে আমার জীবনটা পালটে দিবে, তা ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারিনি।

বাসাটা তখন কেবল কিনেছে ও। চাকরি করার সময় নাকি কিছু টাকা জমিয়েছিল। তাছাড়া আমার ধারণা ওর বাবার কাছ থেকেও উত্তরাধিকার সূত্রে বেশ অর্থ সমাগম হয়েছে। ওর ভাগ্য ভালো, কিছুদিনের মধ্যে বেস্টসেলিং তালিকায় চলে আসে উপন্যাসগুলো। নতুবা বাড়ির মর্টগেজের টাকা দিতে পারত কি না সন্দেহ।

বাসায় প্রথম যাচ্ছি, এই উপলক্ষে এক বোতল হুইস্কি কিনি আমি। দরজায় আমাকে স্বাগত জানালো হিদাকা। পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল হাতসুমি।

এখন চিন্তা করলে বুঝতে পারি লোকে প্রথম দর্শনেই প্রেম বলতে আসলে কী বোঝায়। ওকে দেখা মাত্র গলা শুকিয়ে যায় আমার। শিল্পীরা তাদের আঁকাআঁকির জন্যে যেমন অনুপ্রেরণা খুঁজে নেয় প্রেয়সীর মাঝে, সেরকম ছিল ব্যাপারটা। দেজাভু হতে থাকে আমার। মনে হয়, এমন একজনের সাথে দেখা হয়েছে, যার সাথে দেখা হওয়া আমার ভাগ্যেই ছিল। অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি। কিছু বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছিলাম।

হিদাকা অবশ্য আমার ক্ষণিকের এই বিহ্বলতা টের পায়নি। হাতসুমিকে কফি বানাবার কথা বলে আমাকে নিয়ে নিজের অফিসে ঢুকে পড়ে ও।

কিন্তু ভেবেছিলাম সরাসরি আমার উপন্যাসটা নিয়ে আলাপ শুরু করবে, কিছুক্ষণ কথা বলার পর মনে হয়ে ব্যাপারটা এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে হিদাকা। তৎকালীন রাজনীতি নিয়ে কিছুক্ষণ আলাপ করি আমরা। আমার শিক্ষকতা কেমন চলছে এই বিষয়ে টুকটাক প্রশ্ন করে ও। এমনকি হাতসুমি কফি নিয়ে আসার পরেও এটাসেটা নিয়ে কথা বলতে থাকে হিদাকা। শেষ পর্যন্ত আর থাকতে না পেরে জিজ্ঞেস করেই বসি আমি, “আমার গল্পটা কেমন লেগেছে? যদি খারাপ লেগে থাকে, তাহলে সরাসরি বলো।”

হাসিটা মলিন হয়ে গেল ওর। “গল্পটা খারাপ না।”

“মানে, খারাপ না আবার ভালোও না?”

“আসলে…হ্যাঁ, তা বলা যায়। ভালো বই একদম শুরু থেকেই পাঠককে চুম্বকের মত টেনে ধরে। রান্নার সাথে যদি তুলনা করি, তাহলে বলা যায়, তোমার উপকরণগুলো সব ঠিকই আছে, কিন্তু রেসিপিটা ভুল।”

“কোন্ অংশটায় সমস্যা? একটু বলবে?”

“চরিত্রগুলো অতটা আকর্ষণীয় না, আর গল্প বলার ধরনটাও…কী বলবো, নিরামিষ ধাঁচের।”

“চরিত্রগুলোর কোন গভীরতা নেই, এটা বলতে চাইছো? গল্পটাও জুতের না?”

“ওরকমই। আমাকে ভুল বুঝো না কিন্তু, কাচা হাতের কারো লেখা উপন্যাস তুলনায় অনেক ভালো। লেখা ঠিক আছে, গল্পের সব উপাদানও আছে কিন্তু উপাদানগুলো যেভাবে ব্যবহার করা হয়েছে, পাঠকের মনোযোগ ধরে রাখাটা একটু কঠিনই হবে। প্রকাশ হবার ক্ষেত্রেও মূল বাঁধা এটাই। কোন বিষয়ের ক্রিয়া-কৌশল জানলেই যে তুমি ভালো একটা প্রোডাক্ট তৈরি করে ফেলতে পারবে, এমন নয় কিন্তু। দিনশেষে সব উপন্যাসই একটা প্রোডাক্ট, ভুলে যেও না।”

সমালোচনা শোনার জন্যে মনে মনে তৈরিই ছিলাম আমি। কিন্তু ও যা বলল, তাতে পুরোপুরি দমে গেলাম। যদি আমার গল্পে নির্দিষ্ট কোন অংশে ভুল থাকত, তাহলে সেটা ঠিক করা যেত নাহয়। কিন্তু ‘পাঠকের মনোযোগ ধরে রাখতে পারবে না’ এটা আবার কি? তোমাকে দিয়ে লেখালেখি হবে না-একভাবে ধরলে এই কথাই বলেছে হিদাকা।

“তাহলে, আমি গল্পটা নিয়ে আরেকটু ঘাটাঘাটি করবো? অন্য কোন দিক দিয়ে সামনে এগোবো এবারে?” বলি আমি। তখনও পুরোপুরি হাল ছেড়ে দেইনি।

মাথা ঝাঁকিয়ে না করে দিলো হিদাকা। “এই একটা গল্প নিয়েই পড়ে থাকলে চলবে না। আমি তোমার জায়গায় থাকলে আবার নতুন করে শুরু করতাম সব। নতুবা দেখা যাবে আবারো একই ভুল করছো। আমার পরামর্শ থাকবে এবারে সম্পূর্ণ নতুন কিছু লেখ।”

এরকম কিছু শোনার জন্যে প্রস্তুত ছিলাম না। কিন্তু ওর কথা একেবারে ফেলনাও নয়।

জানতে চাই আমি আরেকটা গল্প লিখলে সেটা ও পড়বে কি না।

“আলবত পড়বো,” বলে হিদাকা।

পরদিনই লিখতে বসে যাই। এবারে আমার কলম চলছিলই না। প্রথম উপন্যাসটা লেখার সময় নিজেকে পুরোপুরি সঁপে দিয়েছিলাম, কিন্তু এবারে প্রতিটা শব্দ লেখার পর মনে হচ্ছিল কোথাও একটা সমস্যা হয়েছে। মাঝে মাঝে কেবল একটা বাক্য নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দিচ্ছিলাম ডেস্কে। এর কারণ হতে পারে লেখার সময় হিদাকার মতামতের বিষয়টা মাথায় ঘোরা। যেভাবে ইচ্ছা, সেভাবে লেখার সাহসটা হারিয়ে ফেলি। হয়তো এটাই একজন পেশাদার আর অপেশাদার লেখকের তফাত।

তবুও, কষ্ট করে লেখা চালিয়ে যাই আমি। এর মাঝে হিদাকাদের বাসাতেও যাওয়া আসা চলতে থাকে। বলা যায় আমাদের বন্ধুত্ব দীর্ঘ বিরতির পর আবার পুনর্জীবন খুঁজে পায়। একজন পেশাদার লেখকের জীবন নিয়ে স্বভাবতই আগ্রহ কাজ করছিল আমার। আর হিদাকাও নিশ্চয়ই নিজের সম্পাদকদের বাইরে কারো সাথে আড্ডা দিয়ে মজাই পাচ্ছিল। কথায় কথায় একবার আমাকে বলেছিল যে লেখালেখিকেই মূল পেশা হিসেবে নেয়ার পর বাইরের দুনিয়া থেকে নিজেকে কেমন যেন বিচ্ছিন্ন লাগতে শুরু করে ওর।

এখানে স্বীকার করে নেয়া ভালো, ওদের বাড়িতে যাতায়াতের সম্পূর্ণ ভিন্ন আরেকটা কারণও ছিল আমার। হাতসুমি। জীবন সঙ্গীনি হিসেবে আমি যেরকম একজন মানুষকে চেয়েছিলাম, ও ছিল ঠিক তাই। আমার জন্যে ওর মুখে সদা আন্তরিক একটা হাসি লেগেই থাকতো। যা-ই পড়তো না কেন, সুন্দর মানিয়ে যেত ওকে। রোজকার পোশাকেও। কখনো অবশ্য একদম সাজগোজ করা অবস্থায় দেখিনি ওকে, তবে সেভাবে যে আরো সুন্দরি দেখাবে, সেই বিষয়ে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই। হিদাকা হয়তো ওরকম হাতসুমিকেই পছন্দ করত বেশি। কিন্তু আমি যে হাতসুমির প্রেমে পড়েছিলাম—সে ছিল স্নিগ্ধ, মিষ্টি হাসির অধিকারী। বাড়ি ফিরে যাকে দেখলে চিত্ত শান্ত হয়। এরকম সৌন্দর্যের হয়তো স্বপ্নই দেখে যায় অনেক নারী।

একদিন আগে ফোন না করেই চলে যাই আমি। অজুহাত হিসেবে বলি, সেই এলাকায় গিয়েছিলাম একটা কাজে, ভাবলাম দেখা করে যাই। কিন্তু সত্যটা হচ্ছে, একটানা কাজ করার ফাঁকে হঠাৎই ওই হাসিটা দেখার তীব্র বাসনা অনুভব করি আমি। ওখানে গিয়ে দেখি হিদাকা বাসায় নেই। তখন নিজেকে মনে মনে বলি, এবারে বেরিয়ে যেতে হবে, যেহেতু অজুহাত হিসেবে বলেছিলাম বন্ধুর সাথে দেখা করতে গিয়েছি।

কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে ভেতরে আসতে বলে হাতসুমি। জানায়, কেবলই একটা কেক বানিয়েছে সে, আমি যেন সেটা চেখে দেখি। কয়েকবার বিড়বিড় করে বলার চেষ্টা করি, ওকে বিরক্ত করতে চাই না অসময়ে। কিন্তু সত্যি বলতে মনে মনে সুযোগটা হাতছাড়া করতে ইচ্ছে হচ্ছিল না।

পরবর্তি দুই ঘন্টা ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে সেরা দুটো ঘন্টা। ভেতরে ভেতরে ভীষণ উচ্ছ্বাস কাজ করছিল। ঝড়ের গতিতে কথা বলছিলাম একের পর এক বিষয়ে। হাতসুমি বিরক্ত তো হয়ইনি বরং বারবার হেসে উঠছিল। ওর সেই কাচ ভাঙা শব্দের মতন হাসি হৃদয়ে আলোড়ন তুলছিল আমার। ভেতরে ভেতরে নিশ্চয়ই আনন্দে ফেটে পড়ছিলাম আমি। কারণ বাইরে বের হওয়ার পর ঠান্ডা বাতাসও উপভোগ করতে শুরু করি। সবকিছু রঙিন মনে হয়।

হিদাকার কাছ থেকে লেখালেখির বিষয়ে পরামর্শ নেয়ার অজুহাতে ঘনঘন ওদের বাসায় আসা-যাওয়া চলতে থাকে আমার কিন্তু মূল উদ্দেশ্য ছিল হাতসুমিকে দেখা। হিদাকা অবশ্য এসব খেয়াল করেনি। আমার সাথে নিয়মিত কথা বলার সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা উদ্দেশ্য ছিল ওর, তবে সেটা আমি তখন বুঝতে পারিনি।

অবশেষে দ্বিতীয় উপন্যাসটা লেখা শেষ হয় আমার। এবারেও হিদাকাকে দিয়ে লেখাটা পড়িয়ে নিতে চাই। আর এবারেও হতাশ হতে হয় আমাকে, কারণ উপন্যাসটা ওর মনঃপুত হয়নি।

“সেই গৎবাঁধা পুরনো প্রেমের উপন্যাস,” আমাকে বলে ও। “নিজের চেয়ে বেশি বয়সি কোন নারীর প্রেমে পড়ার কাহিনী এখন আর চলে না। নতুন কোন চমক আনতে হবে তোমাকে এই গল্পে। তাছাড়া নায়ক যার প্রেমে পড়েছে তার চরিত্রটা ঠিক যাচ্ছে না গল্পের সাথে। ঠিক বাস্তবিক ঠেকছে না। তুমি তোমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে লিখছো না এটা জানি, কিন্তু লেখার মধ্যে আরেকটু বাস্তবতা আনতে হবে।”

কঠোর সমালোচনা বোধহয় একেই বলে। ওর কথাগুলো শুনে একদম হতবাক হয়ে যাই আমি। বিশেষ করে গল্পের নায়িকাকে নিয়ে বলা কথাগুলো বুকে শেলের মতন বেঁধে। কারণ হাতসুমিই ছিল আমার অনুপ্রেরণা।

হিদাকার কাছে জানতে চাই, আমাকে দিয়ে আদৌ লেখালেখি হবে কি না।

কিছুক্ষন ভাবে হিদাকা, এরপর বলে, “এত তাড়া কিসের তোমার, শুনি? চাকরি তো আছেই একটা। ওটার পাশাপাশি শখ হিসেবে লেখালেখি চালিয়ে যাও। প্রথম বই প্রকাশের জন্যে তাড়াহুড়ো করো না। “

ওর কথা শুনে খুব যে ভরসা পেলাম, তা নয়। দ্বিতীয় উপন্যাসটা নিয়ে অনেক আশা ছিল আমার। নিজের দক্ষতা নিয়ে সন্দেহ হতে শুরু করে। এমনকি হাতসুমির সান্ত্বনাবাক্যও আমার হতাশা কমাতে পারে না।

পরপর বেশ কয়েকদিন রাতে ঘুমাতে পারি না, ফলে খুব দ্রুত খারাপ হয়ে যায় শরীর। একপর্যায়ে বুকে ঠান্ডা বসে শয্যাশায়ী হয়ে পড়ি। এরকম সময়গুলোতে একাকীত্ব বড্ড অসহ্য ঠেকত আমার। বিছনায় কম্বল মুড়ি সিয়ে কুন্ডলী পাকিয়ে শুয়ে থাকা ছাড়া করার আর কিছু ছিল না।

এরপরেই একদম অভাবনীয় ঘটনাটা ঘটে, যা ডিটেক্টিভ কাগাকে ইতিমধ্যে বলেছি আমি। আমাকে দেখতে অ্যাপার্টমেন্টে আসে হাতসুমি। নক শুনে দরজার পিপহোল দিয়ে বাইরে উঁকি মেরে দেখার পর মনে হয় ভুলভাল দেখছি বুঝি

“ওর কাছে শুনলাম আপনি অসুস্থ, কাজেও যেতে পারছেন না,” বলে হাতসুমি।

আমি যে ওকে দেখে কতটা খুশি হয়েছে এটা প্রাথমিক অবস্থায় চোখে পড়ে না ওর। ভেতরে ঢুকেই সরাসরি রান্নাঘরে চলে যায়। রান্নার সব সরঞ্জাম সাথে করে নিয়ে এসেছে। আমার মনে হয় আমি যেন মেঘের উপরে ভাসছি, তবে সেটা জ্বরের ঘোরে নয়।

হাতসুমি আমার জন্যে যে সব্জির স্যুপটা রান্না করে, তার স্বাদ ছিল অনন্য। তবে আমি যে স্বাদটা খুব বেশি উপভোগ করতে পারছিলাম, এমন নয়। জ্বরের কারণে মুখ থেকে স্বাদ চলে যায়। কিন্তু যা খাচ্ছি, তা হাতসুমির রান্না করা, এই ভাবনাটাই যথেষ্ট ছিল আমার জন্যে। সেদিন রাতে নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখি মানুষ মনে হয় আমার।

পুরো এক সপ্তাহ ছুটি নেই অফিস থেকে। শারীরিক দিক দিয়ে কখনোই সুস্বাস্থ্যের অধিকারী বলা যাবে না আমাকে। ঠান্ডা থেকে সেরে উঠতে প্রায়ই বেশ সময় লেগে যেত আমার; কিন্তু সেবারই এই শারীরিক অসুস্থতার জন্যে ভাগ্যবান মনে হয় নিজেকে। সেই সপ্তাহে তিনবার আমার বাসায় আসে ও। শেষদিন ওর কাছে জানতে চাই আমার খেয়াল রাখার কথা হিদাকা ওকে বলেছিল কি না।

“আসলে ও কিছু জানে না এই ব্যাপারে।”

“কেন?”

“আসলে…আপনি তো জানেনই। ও একটু…” বলতে গিয়ে থেমে যায় হাতসুমি। “আসলে ও বুঝত না।”

“আচ্ছা, ব্যাপার না,” ওর মাথায় কী ঘুরছে সেটা জানতে ইচ্ছে হলেও এই ব্যাপারে আর কিছু বলি না।”

পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ওঠার পর হাতসুমির জন্যে কৃতজ্ঞতা স্বরূপ কিছু একটা করতে ইচ্ছে করে আমার। উপহার দিলে সেটা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারে অনেকে। তাই এক সন্ধ্যায় ডিনারের আমন্ত্রণ জানাই।

প্রথম দিকে ইতস্তত বোধ করলেও শেষ পর্যন্ত রাজি হয় হাতসুমি। উপন্যাসের কিছু বিষয়ে রিসার্চের জন্যে কয়েকদিনের জন্যে বাইরে গিয়েছিল হিদাকা। আয়োজনটা সেই সময়ে হলে আমার কোন সমস্যা হবে কি না জানতে চায় সে। সমস্যা তো ছিলই না, বরং আমার কাছে সেই সময়টাই একদম যথার্থ মনে হয়।

রোপ্পোঙ্গির একটা ট্র্যাডিশনাল জাপানিজ রেস্তোরাঁয় ডিনারে যাই আমরা। সেদিন রাতে আমার সাথে আমার অ্যাপার্টমেন্টে ফেরে ও।

এর আগে বোধহয় আমাদের সম্পর্কের ব্যাপারে বলেছিলাম যে ওর প্রতি টান অনুভব করি আমি। এখন সেই বক্তব্যটা পাল্টে ফেলার সময় হয়েছে। আসলে একে অপরকে ভালোবাসতাম আমরা। একে কোনভাবেই টান বা সাময়িক আবেগ হিসেবে আখ্যা দেয়া যায় না। প্রথম যেদিন ওর উপরে চোখ পড়ে, সেদিন থেকেই জানতাম নিয়তি ওকেই পছন্দ করে রেখেছে আমার জন্যে। সেই রাতট ছিল আমাদের ভালোবাসার সূচনা পর্ব।

চোখের পলকে কেটে যায় মুহূর্তগুলো; শেষদিকে হাতসুমি আমাকে বলে—”হিদাকা তোমাকে দমিয়ে রাখার চেষ্টা করছে।” ওর চোখেমুখে খেলা করছিল নিদারুণ এক বিষণ্ণতা, অথচ কিছুক্ষণ আগেও সেখানে ছিল উচ্ছ্বাস।

“মানে?”

“ও চায় না তোমার কোন লেখা প্রকাশিত হোক। এতে হতাশ হয়ে এক সময় লেখালেখি থেকে মন উঠে যাবে তোমার।”

“আমার উপন্যাসগুলো এতটাই বাজে?!”

“না, মোটেও না। বরং, এর পুরো বিপরীত। ও হিংসে করে তোমাকে, কারণ তোমার লেখা ওর লেখার তুলনায় মানের দিক দিয়ে অনেক ভালো।”

“অসম্ভব।”

“আমার নিজেরও একথা শুরুতে বিশ্বাস হতে চায়নি। কিন্তু এছাড়া ওর এরকম আচরণের আর কোন ব্যাখ্যা নেই।”

“কী রকম আচরণ?”

“তুমি যখন প্রথম উপন্যাসটার পান্ডুলিপি পাঠিয়েছিলে, সেটা পড়ার কোন ইচ্ছেই ছিল না ওর। বলছিল এসব কাচা হাতের লেখা পড়া আর সময় নষ্ট করা একই কথা। উপর উপর দিয়ে একটু চোখ বুলিয়ে তোমাকে যা বলার বলে দেবে।”

“কী বলছো এসব!” হিদাকা আমার সাথে যেরকম ব্যবহার করেছে তার সাথে হাতসুমির বর্ণনার কোন মিলই খুঁজে পাচ্ছি না। “ও কি আসলেও পড়েছিল লেখাটা?”

“সেটাই তো বলছি তোমাকে। একবার পড়তে শুরু করার পর আর ছেড়ে উঠতে পারেনি। সাধারণত বই খুব বেছে পড়ে হিদাকা। একটু একঘেয়ে লাগলেই ছুড়ে ফেলে দেয়। কিন্তু তোমার বইটা একদম বুভুক্ষের মতন পড়ে ও। সেটা নিশ্চয়ই এমনি এমনি না? লেখায় দম ছিল বলেই পড়েছে ওভাবে। ছাড়তেই পারছিল না। “

“কিন্তু আমাকে তো বলেছিল ছাপার যোগ্য না।”

“সত্যিটা বলেনি। কয়েকবার তো আমার সামনেই মিথ্যে বলেছিল। তুমি যে ফোন করতে…বই পড়া হয়ে গেলেও বলতো যে পড়ার সময় পায়নি। ও আসলে তখনও ভাবছিল লেখাটা নিয়ে কী করবে। শেষমেষ তোমাকে নিরুৎসাহিত করার সিদ্ধান্ত নেয় যাতে লেখালেখি ছেড়ে দাও।”

“হয়তো…” বললাম, “হয়তো ওভাবে মনোযোগ দিয়ে পড়ছিল কারণ আমরা বন্ধু।”

“নাহ্, আমি তো চিনি ওকে। নিজেকে ছাড়া আর কাউকে নিয়ে ভাবে না।”

লম্বা সময় প্রেম করে বিয়ে করার পর কেউ যদি স্বামীকে নিয়ে এরকম কিছু বলে সেটা অস্বাভাবিকই ঠেকবে। তবে এখন চিন্তা করলে মনে হয়, হয়তো আমার কাছে সান্ত্বনা খুঁজছিল সে। যে মানুষটাকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিল, সে বদলে গিয়েছে। তাই…এই বিষয়টা নিয়ে ভাবতে চাই না আমি।

হাতসুমি আমাকে বলে লেখালেখি নিয়ে বেশ বাজে সময় কাটছিল হিদাকার। নতুন কিছু লেখা হচ্ছিল না দেখে হতাশ হয়ে পড়ছিল দিন দিন নতুন আইডিয়া না পেয়ে আত্মবিশ্বাস গিয়ে ঠেকেছিল তলানিতে।

“তুমি আর তোমার কোন লেখা পাঠিও না ওর কাছে। অন্য কারো কাছে যাও, যে আসলেও সাহায্য করবে।”

“দাঁড়াও, দাঁড়াও! হিদাকা যদি এটাই চায় যে আমার লেখা কেউ প্ৰকাশ না করুক, তাহলে দ্বিতীয় উপন্যাসটা পড়তে নিল কেন?”

“তুমি ওকে চেন না। ইচ্ছে করে দেরি করাচ্ছে যেন অন্য কারো সাথে কথা বলতে না পার। দেরি করালে হতাশ হবার এক পর্যায়ে লেখালেখি ছেড়ে দেবে, সেজন্যেই ঘুরাচ্ছে বারবার। সম্পাদকদের কারো সাথে পরিচয় করানোর কোন ইচ্ছে নেই।” হাতসুমির কন্ঠে রুক্ষতা স্পষ্ট।

হিদাকা যে এতটা বিদ্বেষপূর্ণ মনোভাবের হতে পারে, তা বিশ্বাস করা আমার জন্যে কষ্টকর। এ রকম অসূয়া তো মানুষ ঘোর শত্রুর জন্যেও কামনা করে না। তবুও হাতসুমি তো আর বানিয়ে বলবে না এসব। আমি ওকে জানাই, তৎক্ষনাৎ যোগাযোগ বন্ধ করবো না, কিছুটা সময় নিয়ে দেখব পরিস্থিতি কোন দিকে গড়াচ্ছে। পরিকল্পনাটা হাতসুমির বিশেষ পছন্দ হয় না, কিন্তু এই ব্যাপারে আর কিছু বলেও না সে।

এরপর থেকে হিদাকাদের বাসায় আনাগোণা কমিয়ে দেই। এমন নয় যে হিদাকার উপর থেকে ভরসা উঠে গেছে, আসলে আমি নিজেকেই ভরসা করতে পারছিলাম না। কেবলই মনে হচ্ছিল, ও হয়তো বুঝে যাবে আমার আর হাতসুমির সম্পর্কের ব্যাপারটা। হিদাকা বরাবরই সবকিছু মনোযোগ দিয়ে খেয়াল করে। একবার যদি টের পায় আমি হাতসুমির দিকে অন্য দৃষ্টিতে তাকাচ্ছি, তাহলেই সব শেষ।

কিন্তু হাতসুমিকে না দেখে লম্বা সময় কাটানোও সম্ভব নয় আমার পক্ষে; জনসম্মুখে কোথাও দেখা করবো, সেই উপায়ও নেই। তাই গোপনে আলোচনা করে দু’জনে সিদ্ধান্ত নেই, ও আমার অ্যাপার্টমেন্টেই আসবে। যেমনটা ডিটেক্টিভ কাগা জানে, আমার অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সটায় খালি অনেকগুলো ফ্ল্যাট আছে, কেউ হয়তো খেয়ালও করবে না ওকে। আর খেয়াল করলেও হাতসুমির পরিচয় তাদের জানার কথা নয়। তাই গুজব ছড়ানোর কোন সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।

হাতসুমি অপেক্ষা করতো কখন হিদাকা রিসার্চের কাজে শহরের বাইরে যাবে। আমার বাসায় অবশ্য কখনো রাত কাটায়নি ও, কিন্তু রাতের খাবার বানাতো প্রায়ই। দু’জনে একসাথে খেতাম। আর এসব দিনেই রান্না করার সময় অ্যাপ্রোনটা পরতো ও (হ্যাঁ, এই অ্যাপ্রোনই খুঁজে পেয়েছিল ডিটেক্টিভ কাগা এবং তার সঙ্গী)। ওকে অ্যাপ্রোন পরা অবস্থায় রান্নাঘরে দেখলে মনে হতো আমরা নবদম্পতি, এই বাড়িতে সদ্য উঠেছি।

সাথে থাকার সময়টা যতই আনন্দে কাটুক, যখন একজন আরেকজনের কাছ থেকে বিদায় নিতাম, বিষাদে ছেয়ে উঠত মন। ঘড়ির কাটাগুলোকে বড্ড নিষ্ঠুর মনে হত।

প্রায়ই ভাবতাম একসাথে দু’তিন দিন কাটানো গেলে কেমন লাগবে। কথাও বলতাম ব্যাপারটা নিয়ে, যদিও দুজনই জানতাম বিষয়টা অসম্ভব। এই পর্যায়ে এমন একটা সুযোগ এলো যেটা হাতছাড়া করা আমাদের কারো পক্ষেই সম্ভব ছিল না। একটা কাজে সপ্তাহখানেকের জন্যে অ্যামেরিকা যেতে হতো হিদাকাকে। সাথে ওর একজন সম্পাদকও যাবে। হাতসুমি এই সময়টা বাড়িতেই থাকবে।

এরকম একটা সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিলাম আমরা। পুরো সময়টা কি করবো, তা নিয়ে অনেক আগে থেকেই জল্পনা-কল্পনা করছিলাম দুজনে। কিশোর-কিশোরীদের মতন হেসে একজন আরেকজনের শরীরে ঢলে পড়তাম আলোচনা করতে করতে। এক পর্যায়ে সিদ্ধান্ত নেই ওকিনাওয়া যাব। এমনকি একটা ট্রাভেল এজেন্সিতে গিয়ে টিকেটও কেটে ফেলি। আমাদের ভ্রমণের সময়কাল খুব বেশিদিন হবে না, কিন্তু এই অল্প সময়ই স্বামী-স্ত্রীর মতন সর্বক্ষণ একসাথে থাকব। আনন্দে নেচে ওঠে আমার মন।

ঘুরতে যাওয়ার পরিকল্পনা করার সময়টুকুই ছিল আমাদের সম্পর্কের সবচেয়ে সুখি সময়। যেমনটা আপনারা জানেন, ওকিনাওয়ায় আমাদের আর যাওয়া হয়নি। যে পত্রিকার আমন্ত্রনে যাওয়ার কথা ছিল, তারা অল্প ক’দিন আগে মানা করে দেয় হিদাকাকে। কারণ সম্পর্কে খুব বেশি কিছু জানি না আমি। হিদাকা মুষড়ে পড়ে, কিন্তু তার চেয়েও বেশি কষ্ট পেয়েছিলাম আমরা দুজন।

মনে হয় আমাদের হাতের ফাঁক গলে বেরিয়ে গেল স্বর্গ। লক্ষ্যের এত কাছে গিয়েও ফিরে আসায় ওকে দেখার বাসনাটা আরো তীব্র রূপ ধারণ করে। প্রায় পাগলের মতন হয়ে যাই আমি। যখনই দেখা হতো, মন ভরতো না। ও চোখের আড়াল হওয়া মাত্র দিন গুণতে শুরু করতাম পরবর্তি সাক্ষাতের।

একটা সময় হঠাৎ আমার বাসায় আসা কমিয়ে দেয় হাতসুমি। কারণ জিজ্ঞেস করলে যা বলে, শুনে রীতিমত আত্মা শুকিয়ে যায়। ওর ধারণা হিদাকা আমাদের ব্যাপারটা আঁচ করতে পেরেছে। আরো বলে, সম্পর্কের ইতি টানাই উচিত হবে আমাদের।

“ও যদি টের পেয়ে যায়, তাহলে কোন না কোন উপায়ে প্রতিশোধ নেবেই। আমার কারণে তোমাকে ভুগতে হোক, এটা চাই না।”

“যা হয় হবে,” বলি আমি। কিন্তু সত্যি কথা বলতে, আমিও চাই না ও কোন কারণে কষ্ট পাক। হিদাকাকে খুব ভালো করেই চেনা ছিল আমার, ডিভোর্সের কাগজে সই করার মত মানুষ নয় ও। তা সত্ত্বেও হাতসুমির সাথে আর দেখা হবে না, এটা ভাবতেই কেমন যেন লাগছিল।

আমার মাথা থেকে দূর করতে পারি না ব্যাপারটা। বাচ্চাদের পড়ানো শিকেয় তুলে ভাবতে থাকি কী করে সবকিছু ঠিক করবো। অবশেষে, একটা সিদ্ধান্তে আসি। ডিটেক্টিভ কাগা ইতিমধ্যেই ধরে ফেলেছেন কী পরিকল্পনা এটেছিলাম আমি। হ্যাঁ, হিদাকাকে খুন করবো বলে ঠিক করেছিলাম।

এভাবে কথাটা লিখে ফেলে এখন অদ্ভুত লাগছে। কিন্তু সেই সময় একদম দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলাম ব্যাপারটা নিয়ে। পরিকল্পনাটা করার সময় এক মুহূর্তের জন্যেও আফসোস হয়নি। এখানে বলে রাখা ভালো, সেদিনের আগেও আরো অনেকবার মনে মনে হিদাকার মৃত্যু কামনা করেছিলাম আমি। হাতসুমি যে ওর স্ত্রী, তা মানতেই পারতাম না। আমরা, মানুষেরা কতটা খেয়ালী হতে পারি এর একটা উদাহরণ এটা। কারণ এখানে ভুল কাজটা আমিই করছিলাম-অন্যের অধিকার খর্ব করছিলাম। কিন্তু মানুষের মৃত্যু কামনা করা এবং তাকে নিজ হাতে খুন করার মধ্যে অনেক পার্থক্য।

যেমনটা অনেকেই আন্দাজ করবে, হাতসুমি আমার পরিকল্পনার ঘোর বিরোধী ছিল। কান্নাকাটি জুড়ে দেয় ও। বলে, আমাকে এমন কিছু করতে দেবে না। কারণ ধরা পড়লে কঠিন শাস্তি পেতে হবে। কিন্তু ওর কান্না আমার ক্রোধের অনলে যেন ঘি ছড়িয়ে দেয়। মনে হতে থাকে হিদকাকে হত্যা করা ছাড়া আর কোন উপায় খোলা নেই।

“ভুলেও আমাকে সাহায্য করার কথা মাথায় আনবে না,” ওকে বলি। “যা করার নিজেই করবো। যদি ধরা পড়ে যাই, পুলিশ গ্রেফতার করে আমাকে, তোমার নাম মুখেও আনব না।”

আপনারা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, এই পর্যায়ে যৌক্তিকভাবে চিন্তা করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলি আমি। হাতসুমি হয়তো বুঝতে পারে আমার সংকল্প কতটা দৃঢ়, কিংবা ও নিজেও জানত এছাড়া আর কোন উপায় নেই আমাদের এক হবার। তাই কিছুদিন পর আমাকে সাহায্য করার কথাও বলে। আমি চাইনি ও ঝুঁকি নিক। কিন্তু একটা বিষয় একদম পরিস্কার করে দেয় ও–হয় কাজটা একসাথে করবো আমরা, নয়তো করবোই না।

এরপর দুজনে মিলে কুনিহিকো হিদাকাকে হত্যার ছক সাজাই। কিন্তু এখন আমার মনে হয় না পরিকল্পনাটা খুব একটা ভালো কিছু ছিল। গোটা ব্যাপারটাকে ডাকাতির চেষ্টা হিসেবে সাজানোর পরিকল্পনা করি আমরা। দিন ঠিক হয় ডিসেম্বরের ১৩ তারিখ।

সেদিন গভীর রাতে গোপনে হিদাকাদের বাগানে ঢুকে পড়ি আমি। ডিটেক্টিভ কাগা ইতিমধ্যেই জানেন সেদিন কি ছিল আমার পরনে–একটা কালো প্যান্ট, কালো জ্যাকেট। যদি সেদিন কোন মুখোশ পরতাম, তাহলে হয়তো আজকে আর এই স্বীকারোক্তিটা লেখা হতো না। কিন্তু সেই মুহূর্তে কথাটা মাথায় আসেনি।

হিদাকার অফিস ঘরের লাইটটা নেভানো ছিল। ভয়ে ভয়ে জানালায় হাত দিয়ে পাল্লাটা একপাশে সরিয়ে দেই। সহজেই খুলে যায় ওটা। শ্বাস চেপে ঘরের ভেতরে ঢুকে পড়ি। দেখি, সোফার এক কোণায় চিত হয়ে শুয়ে আছে হিদাকা। বুকটা ওঠানামা করছে নির্দিষ্ট ছন্দে। ঘুমাচ্ছিল ও। আমরা সেই দিনটা বেছে নেই কারণ পরদিন একটা কাজ জমা দেয়ার কথা ছিল হিদাকার; এ রকম হলে সাধারণত অফিসেই রাত কাটাতো ও।

কিন্তু মাথায় কাজের খড়গ নিয়েও কেন ঘুমাচ্ছিল ও, তা ব্যাখা করা দরকার। হাতসুমি ওর রাতের খাবারের সাথে ঘুমের ঔষধ মিশিয়ে দিয়েছিল। হিদাকা প্রায়ই ঘুমের ঔষধ খেত বিধায় ময়নাতদন্তের রিপোর্ট দেখেও কারো কিছু সন্দেহ হবে না। হিদাকাকে ওখানে শুয়ে থাকতে দেখে বুঝে যাই, সব পরিকল্পনা মাফিকই এগোচ্ছে। কাজ করতে করতে এক পর্যায়ে ক্লান্ত হয়ে সোফায় গা এলিয়ে দিয়েছিল নিশ্চয়ই, এরপরেই ঘুমিয়ে গেছে। হাতসুমি ভেতরে ঢুকে নিশ্চিত হয় ও আসলেই ঘুমাচ্ছে, এরপর বাতি নিভিয়ে বেরিয়ে যায়। তবে যাওয়ার আগে জানালাটা খুলে দিতে ভোলে না।

বাকি দায়িত্ব আমার। কম্পমান হাতে জ্যাকেটের পকেট থেকে ছুরিটা বের করি আমি। এই ছুরিটাই হিদাকাদের অন্যান্য জিনিসের মাঝে খুঁজে পেয়েছেন ডিটেক্টিভ কাগা।

সত্যি বলতে আমি চেয়েছিলাম ওকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করতে। ছুরিকাঘাত করছি, এটা ভাবলেই যেন কেমন লাগতো। কিন্তু সেটাই বিশ্বাসযোগ্য দেখাবে তদন্তে। অস্ত্র ছাড়া নিশ্চয় কেউ ডাকাতি করতে ঢোকে না।

প্রথমে আমি বুঝে উঠতে পারি না, ওকে কোথায় আঘাত করবো। পাশে দাঁড়িয়ে সিদ্ধান্ত নেই ওর বুকেই ছুরিটা চালিয়ে দেব। ছুরির বাটটা ভালোমতো ধরার জন্য হাত থেকে গ্লাভস খুলে ফেলি। ভেবেছিলাম পরে মুছে ফেললেই হবে। এরপর ছুরিটা চেপে ধরে হাত দুটো মাথার উপরে নিয়ে আসি। ইচ্ছে ছিল ফলাটা একদম ওর বুকে গেঁথে দেব।

ঠিক সেই মুহূর্তে অবিশ্বাস্য একটা ঘটনা ঘটে যায়। চোখ খুলে হিদাকা। জমে যাই আমি। হাত নামিয়ে আনতে পারি না। মুখে কথাও ফোটে না।

কিন্তু হিদাকা খুব দ্রুত ওখান থেকে সরে যায়। কী ঘটছে তা বুঝে ওঠার আগেই টের পাই ও আমাকে মাটিতে ফেলে দিয়ে পিঠের উপরে চেপে বসেছে। ছুরিটা আগেই হাত থেকে ছুটে গিয়েছে। হিদাকা বরাবরই আমার তুলনায় স্বাস্থ্যবান ছিল।

“হচ্ছেটা কী? আমাকে খুন করতে চাইছো কেন?” চেঁচিয়ে বলে সে। জবাবে বলার মত কিছু খুঁজে পাইনি আমি ।

এক পর্যায়ে হাতসুমিকে ডাকে হিদাকা। ফ্যাকাসে মুখে ভেতরে প্রবেশ করে ও। স্বামীর ডাক শুনেই নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছিল কী ঘটেছে।

“পুলিশে ফোন দাও,” নির্দেশ দেয় আমার বন্ধু।

কিন্তু হাতসুমি ওখানে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে।

“এভাবে সঙের মতন দাঁড়িয়ে আছো কেন? ফোন নিয়ে এসো!”

“কিন্তু এটা তো নোনোগুচি।

“সেটা তো আমিও জানি! ও আমাকে খুন করতে চাইছে, এই সত্যটা তো আর বদলাচ্ছে না।”

“না, কুনিহিকো, তুমি ভুল বুঝছ—” নিজের জড়িত থাকার বিষয়টা বলতে উদ্যত হয় হাতসুমি।

কিন্তু ওকে মাঝপথেই থামিয়ে দেয় হিদাকা। “তোমার কি আমাকে গর্দভ মনে হয়?”

কিভাবে যেন আমাদের পরিকল্পনার কথা জেনে গিয়েছিল সে। আসলে সোফায় শুয়ে ঘুমানোর অভিনয় করছিল। আমি ছুরি চলাতে উদ্যত হলেই লাফ দিয়ে উঠে বসে।

“নোনোগুচি,” আমার মুখটা কার্পেটে ঠেস দিয়ে ধরে বলে ও। “বিনা অনুমতিতে কারো বাড়িতে ঢোকার আইন সম্পর্কে কিছু জানো? চাইলে আত্মরক্ষার্থে এখন যদি তোমাকে আমি হত্যাও করি, আমার কিন্তু তেমন শাস্তি হবে না।”

ওর শীতল কণ্ঠ শুনে কেঁপে উঠি আমি। যদিও আমার মনে হয় না, আসলেও কাজটা করবে ও। কিন্তু সেটার বদলে কী করতে পারে, তা ভাবতেই গলা শুকিয়ে যায়।

“তবে তোমার ভাগ্য ভালো, আজকে আমি ভালো মেজাজে আছি। তোমাকে হত্যা করে আমার কোন লাভই হবে না। পুলিশে ধরিয়েই দেই বরং—” বাঁকা দৃষ্টিতে হাতসুমির দিকে তাকিয়ে হেসে বলে হিদাকা, এরপর আবার আমার দিকে দৃষ্টি ফেরায়। “কিন্তু তুমি জেলে পচলেও আমার কী লাভ হবে?”

ওর কথার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারি না। সেজন্যই ভয়টা আরো জেঁকে বসে মনের মধ্যে।

টের পাই ওর হাতের বাঁধন হালকা হয়ে গেছে। কিছুক্ষণ পর আমার উপর থেকে উঠে যায়। হাতে কম্বল পেচিয়ে দূরে পড়ে থাকা ছুরিটা তুলে নেয় সে।

“চিন্তা নেই, নোনোগুচি…তোমাকে আমি যেতে দিচ্ছি। এই জানালা দিয়ে বেরিয়ে যেতে পার তুমি।” মুখ বিকৃত করে বলে। “মনে হচ্ছে যেন তুমি ভুত দেখেছো। আমি মত বদলানোর আগেই চলে যাও এখান থেকে।”

“কী পরিকল্পনা তোমার?” কেঁপে উঠল আমার কন্ঠস্বর।

“সেটা নিয়ে তোমার চিন্তা না করলেও চলবে। বের হও তো…” ছুরিটা দেখিয়ে বলে ও। “এটা আমি প্রমাণ হিসেবে রেখে দিচ্ছি।”

ভাবলাম ছুরিটা প্রমাণ হিসেবে আদালতে দেখানো হবে কি না, এতে তো আমার ফিঙ্গারপ্রিন্ট আছে। যেন আমার চিন্তাটা পড়তে পারল ও। বলতে থাকল, “একটা জিনিস জেনে রাখ, এই ছুরিটাই একমাত্র প্রমাণ নয়। আমার হাতে আরেকটা প্রমাণ আছে। সেটা আদালতে দেখালে কোনভাবেই নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে পারবে না। “

ভাবার চেষ্টা করলাম, কীসের কথা বলছে ও, কিন্তু কিছুই আন্দাজ করতে পারলাম না। হাতসুমির দিকে তাকালাম। কাগজের মত সাদা দেখাচ্ছে ওর সুন্দর মুখটা, চোখের কোণ লাল। এ রকম বিষাদ কারো চেহারায় কখনো দেখিনি আমি, ভবিষ্যতে কখনো দেখব, সেই সম্ভাবনাও নেই। উঠে জানালা দিয়ে বেরিয়ে বিভ্রান্তি নিয়েই হাঁটতে থাকলাম। কয়েকবার ভাবলাম দৌড় দিয়ে একেবারে উধাও হয়ে যাই। কিন্তু সেটা করলাম না, কারণ হাতসুমির সাথে কী ঘটতে পারে সেটা নিয়ে চিন্তা হচ্ছিল।

দিনগুলো ভয়ে ভয়ে কাটতে লাগলো আমার। কেন না হিদাকার প্রতিশোধ নেয়ার আশা ত্যাগ করার সম্ভাবনাই নেই। যদিও জানি না কী ধরনের প্রতিশোধের কথা ভেবে আমি আতঙ্কিত।

হাতসুমি বা হিদাকার সাথে আর দেখা করতে যাইনি। আমাদের একমাত্র যোগাযোগের মাধ্যম ছিল ফোনকল। হাতসুমি কাজে বের হলে তখনই কথা হত শুধু।

“ওই রাতের ব্যাপারে কোনো কথা বলেনি ও,” আমাকে জানায় হাতসুমি। “মনে হয়েছে যেন পুরো ব্যাপারটা ভুলে গিয়েছে।”

আমরা দুজনেই জানি, ও ভোলেনি। অস্বস্তিবোধটা ধীরে ধীরে বাড়তে শুরু করে আমার।

কিন্তু কয়েক মাস পর সব পরিস্কার হয়। একটা বইয়ের দোকানে গিয়ে প্রথম টের পাই এর ব্যাপারে। আমি নিশ্চিত, ডিটেক্টিভ কাগাও এতক্ষণে বুঝে গিয়েছেন। হিদাকার জনপ্রিয় ‘নিভে যাওয়া অনল’ বইটাতেই রয়েছে ব্যাপারটা। প্রথমে ওই উপন্যাসিকাটা আমিই ওকে দেখাই, এরপর সেটাকে বিস্তৃত করে নিজের মাস্টারপিসে রূপান্তরিত করেছে হিদাকা।

আমি বিশ্বাস করতে পারিনি ব্যাপারটা, করতে চাইও না। আমার জন্য এটা দুঃস্বপ্ন। যে মানুষটা দীর্ঘদিন ধরে লেখক হওয়ার স্বপ্ন দেখেছে, তার জন্যে এর চেয়ে বড় আঘাত আর কী হতে পারে? হিদাকার পক্ষেই এরকম কঠিন ও নির্মম শাস্তি দেয়া সম্ভব।

একজন লেখক হিসেবে হিদাকার লেখা তার নিজেরই একটা অংশ। বলা চলে লেখালেখির বিষয়টা তার কাছে সন্তানের মত। পিতা-মাতা যেমন সন্তানকে ভালোবাসে, লেখকরাও নিজেদের সৃষ্টিকে একইভাবে ভালোবাসেন। ‘নিভে যাওয়া অনল’ বইটা কুনিহিকো হিদাকার লেখা উপন্যাস হিসেবেই পরিচিতি পেয়ে যাবে, যদি না আমি কিছু ফাঁস করে দেই। কিন্তু হিদাকা ভালোমতোই জানে, আমি এমনটা করবো না।

এটাই সত্যি। হৃদয়ে খুবই বাজেভাবে আঘাত পাওয়া সত্ত্বেও মুখ বন্ধ রাখব। জানি, একটু আওয়াজও যদি করি, সে বলবে-”মুখ বন্ধ রাখ, নয়তো জেলে যেতে হবে।”

হিদাকার কারচুপি ফাঁস করতে চাইলে আমাকে স্বীকার করে নিতে হবে ওর বাড়িতে ঢুকে ওকে খুন করার চেষ্টা চালিয়েছিলাম। পুলিশের কাছে নিজেকে সমর্পন করার পর ‘নিভে যাওয়া অনল’ উপন্যাসটি নিজের বলে ঘোষণা দেয়ার কথা অনেকবার ভেবেছি আমি। একবার তো ফোন তুলে স্থানীয় পুলিশ স্টেশনে নম্বরে ডায়ালও করা শুরু করেছিলাম কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর পারিনি। খুনের চেষ্টা চালানোর দায়ে গ্রেফতার হওয়ার ব্যাপারটাকে ভয় পেয়েছি বারবার। তবে আসল ভয়টা ছিল হাতসুমিকে নিয়ে। ওর বিরুদ্ধেও অভিযোগ আনা হবে আমার সহায়তাকারী হিসেবে। যতই জোর দিয়ে বলি না কেন আমি নিজে থেকেই কাজটা করেছি, পুলিশ নিশ্চিতভাবেই বুঝে নেবে আমার একজন সহায়তাকারীর প্রয়োজন ছিল। আর সেটা হাতসুমি ছাড়া আর কারোর পক্ষে হওয়া সম্ভব নয়। তাছাড়া, হিদাকা হাতসুমিকে ছেড়ে কথা বলবে, এমনটাও অকল্পনীয়। আমি দোষ স্বীকার করে নিলে কোনোভাবেই হাতসুমিকে নিরাপদ রাখতে পারতাম না। এ জন্য আমার লেখাটা তার নামেই প্রকাশ করতে দিয়েছি। যদিও কষ্টে বুকটা ফেঁটে গিয়েছে। কিন্তু আমি চাইনি আমার জন্য হাতসুমিকে আর কোনো ঝামেলায় পড়তে হোক। নিশ্চিত, এটা পড়তে গিয়ে নিজমনেই হাসছেন ডিটেক্টিভ কাগা। আমি একজন স্বঘোষিত খুনি, যে কি না নিজেকে মহৎ দেখানোর চেষ্টা করছি।

আমাকে সান্ত্বনা দেয়ার মত ভাষা জানা ছিল না হাতসুমির। তবে হিদাকা বেরিয়ে গেলে আমাকে কল দিত ও। কিন্তু ওই ফোনকলগুলোতে বিরাজ করত অস্বস্তিকর নীরবতা।

“কখনোই ভাবিনি, এতটা খারাপ কাজ করতে পারে ও। চুরি করবে তোমার লেখা। এটা তো..“

“বাদ দাও। এই ব্যাপারে আমাদের দুজনের কিছু করার নেই।”

“কিন্তু এটা ভাবলে আমার খুব খারাপ লাগে।”

“তোমার কোনো দোষ নেই, আমিই আসলে নির্বোধ। যেমন কর্ম করেছি তেমন ফলই ভোগ করছি।”

যে মেয়েটাকে ভালোবাসি তার সাথে এই ধরনের কথাবার্তা আমার অন্তরে কোনো আশা বা স্পৃহা জাগাত না। অনুভব করতাম দিনে দিনে অতল গহ্বরে তলিয়ে যাচ্ছে আমার হৃদয়। ভাগ্যক্রমে, বেশ সাদরেই নিভে যাওয়া অনল’ বইটাকে গ্রহণ করে পাঠক। কোনো পত্রিকা বা ম্যাগাজিনে বইটার প্রশংসা দেখলেই মনে হত অজানা কিছু একটা চিবিয়ে খাচ্ছে আমার হৃদয়টা। মুহূর্তের জন্য প্রশংসাগুলো দেখে ভালোই লাগত, কিন্তু পরক্ষনেই মনে হত, লেখাটা প্রশংসিত হচ্ছে সেটা আমার নামে নয়।

এই বইয়ের জের ধরে আলোচনার বিষয়বস্তুতে পরিণত হয় হিদাকা। সবাই বলতে থাকে, সে কোনো সাহিত্য সম্মাননার যোগ্য কি না। আমি ভাবি, তাকে সাহিত্য সম্মাননা গ্রহণ করতে দেখলে আমার অন্তরে যে যন্ত্রণা অনুভূত হবে সেটা কি আদৌ কেউ কখনো বুঝবে? এই ভাবনায় কয়েক রাত আমি ঘুমাতে পারিনি পর্যন্ত।

এ রকম দুঃস্বপ্নের প্রহরই কাটছিল আমার, এরপর একদিন হঠাৎ করেই কানে এলো ডোরবেলের আওয়াজ। দরজার পিপহোলে চোখ রেখে মনে হল শ্বাস আটকে আসছে। দরজার অপরপাশে দাঁড়িয়ে ছিল কুনিহিকো হিদাকা ওই রাতে তার বাড়িতে চুরি করে ঢোকার পর এই প্রথম দেখলাম ওকে। আমার লেখা চুরির জন্য ওকে ঘৃণা করলেও, আমি যা করেছি সেটার জন্য অনুতাপ হচ্ছিল। এক সেকেন্ডের জন্য ভাবলাম, ঘাপটি মেরে বাড়িতে না থাকার অভিনয় করি।

কিন্তু এভাবে পালিয়ে বেরিয়ে লাভ নেই। খুললাম দরজাটা।

হাসল হিদাকা, “ঘুমাচ্ছিলে নাকি?”

“নাহ।” রবিবার ছিল সেদিন, আমার পরনে তখনও রাতের পোশাক।

“দারুণ। তোমার আরামের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাতে চাইনি।” আমার পেছনে একবার উঁকি দিলো সে। “ভেতরে এলে কিছু মনে করবে নাকি? একটু আলাপ করার ছিল।”

“নিশ্চয়ই…ঘরগুলো কয়েকদিন ধরে পরিস্কার করা হয়নি।”

“সমস্যা নেই। এমন তো না যে, আমরা পত্রিকার জন্য ফটোশ্যুট করছি।”

ইদানিং পত্রিকা অফিস থেকে প্রায়ই ওর বাসায় লোক আসে।

“তাছাড়া,” বলল সে। “আমার মনে হল কিছু একটা বলতে চাও তুমি।”

কিছুই বললাম না জবাবে। লিভিংরুমের সোফায় মুখোমুখি বসে আছি আমরা।

আমার অ্যাপার্টমেন্টের চারদিক দীর্ঘক্ষণ ধরে দেখল হিদাকা। একটু নার্ভাস লাগল, ভাবলাম হাতসুমির কোনো কিছু তার নজরে না পড়ে যায়। অ্যাপ্রনটা পরিস্কার করে সরিয়ে রেখেছি ভেবে স্বস্তি পেলাম।

“একজন ব্যাচেলরের বাড়ি হিসেবে জায়গাটা বেশ পরিপাটি,” অবশেষে বলল।

“সম্ভবত।”

“কেউ কি এসে ঘর পরিস্কার করে দিয়ে যায়?”

সামান্য অপ্রস্তুত হয়ে তাকালাম ওর দিকে। এখনও শীতল হাসি ঝুলে রয়েছে ঠোঁটে। কিসের দিকে ইঙ্গিত করছে সেটা আমার কাছে পরিস্কার।

“কী ব্যাপারে কথা বলতে এসেছ?”

“এত তাড়াহুড়ো কিসের?” সিগারেট ধরাল ও। সাম্প্রতিক রাজনৈতিক কেলেঙ্কারিগুলোর ব্যাপারে টুকটাক কথা বলতে লাগলো। আমি নিশ্চিত, আমাকে অপেক্ষায় রেখে মজা পাচ্ছে, সেজন্যেই কাজটা করছে হিদাকা।

ধৈর্যের বাঁধ ভাঙার দ্বারপ্রান্তে চলে এসেছি, ঠিক তখনই সে একইরকম শীতল কণ্ঠস্বরে বলে উঠল, “তাহলে নিভে যাওয়া অনলের ব্যাপারে…”

সোফায় সোজা হয়ে বসে তার পরবর্তি শব্দের জন্য অপেক্ষায় থাকলাম। “ভাবলাম, তোমার লেখার সাথে মিল থাকার কারণে ক্ষমা চাওয়া উচিত। যদিও ব্যাপারটা নিতান্তই অনিচ্ছাকৃত এবং কাকতলীয়। তোমার বইটার নাম কী যেন ছিল? অগ্নিবলয়, ঠিক না?”

ওর দিকে তাকালাম। নিজের কানকেও বিশ্বাস করতে পারছি না। ন্যূনতম লজ্জাও নেই নাকি হারামিটার? অনিচ্ছাকৃত এবং কাকতলীয়? তার লেখাটা যদি চুরি না হয় তাহলে চুরি শব্দটাই ডিকশনারি থেকে তুলে দেয়া উচিত।

বলা শুরু করল সে, “সত্যি বলতে, কিছু অংশ কাকতলীয়ভাবে লেখা যায় না। আমি অস্বীকার করবো না, উপন্যাসটা লেখার সময় তোমার বইটা আমি পড়ছিলাম। এর প্রভাব আমার লেখায় পড়তে পারে। অবচেতনভাবে কিছু জিনিস আমার মনে গেঁথে গিয়েছিল, যা স্থান পেয়েছে লেখায়। তুমি হয়তো জানো, গীতিকারদের সাথেও এমনটা হয়ে থাকে। অনিচ্ছাকৃতভাবে তাদের সুর করা গান অন্য গানের মত শোনায়।”

হতবিহ্বল হয়ে ওর কথাগুলো শুনলাম। ও কিভাবে আশা করে আমি তার এসব কথা বিশ্বাস করবো?

“আর বইটার ব্যাপারে জানার পর তুমি টু শব্দটিও করোনি বলে আমি খুব খুশি হয়েছি। ভালোই হয়েছে। আমরা তো অপরিচিত কেউ নই। দীর্ঘদিন ধরে গড়ে উঠেছে আমাদের ভেতরকার সম্পর্ক। তুমি এই ব্যাপারে কোনো উচ্চবাচ্য না করে বিচক্ষনের মত কাজ করেছো। এতে আমাদের দুজনেরই মঙ্গল।”

ওর বলা কথাটার অন্তর্নিহিত অর্থ হল-উচ্চবাচ্য করোনি বলেই বেঁচে গেছো। মুখ বন্ধ রাখো, নাহলে সবাই জেনে যাবে তুমি আমাকে হত্যার চেষ্টা করেছো।

“যাইহোক, আজকে আমি তোমার সাথে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা প্রসঙ্গে আলাপ করতে এসেছি।”

ওর দিকে তাকালাম। ভাবলাম, হারামজাদাটা নতুন কি শয়তানী শুরু করবে এখন।

“নিভে যাওয়া অনল বইটার সাফল্যের পর অনেক কিছু মাথায় এসেছে। অসংখ্য মানুষ বইটা পড়ছে, ভবিষ্যতে আরও অনেক মানুষ পড়বে। এর জন্য যে সাহিত্য সম্মাননা পেয়েছি সেটার কথা নাহয় বাদ-ই দিলাম। আমার মতে, একটা উপন্যাসের পরই যদি আমার জনপ্রিয়তা ম্লান হয়ে যায় তবে সেটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক হবে।”

টের পেলাম রক্ত সরে যাচ্ছে আমার চেহারা থেকে। আবারও ও একই কাজ করতে চলেছে। আমার দ্বিতীয় বইটার উপরে ভিত্তি করে নিজের পরবর্তি উপন্যাস লিখতে চাইছে। ওই বইটার একটা পান্ডুলিপি ওর বাড়িতে রয়েছে। আমিই পাঠিয়েছিলাম।

“তাহলে তুমি ওই লেখাটাও চুরি করবে?”

ভ্রু কুঁচকে তাকাল হিদাকা। “এই শব্দটা তোমার মুখ থেকে শুনতে চাইনি আমি।”

“এত নাটক করে লাভটা কী? আমরা সবাই-ই সত্যি কথাটা অপরের মুখ থেকে শুনতে নারাজ। তুমি যা খুশি তাই বলতে পার কিন্তু আমার কাছে লেখা চুরির অর্থ লেখা চুরিই। যাকে সোজা কথায় প্ল্যাজিয়ারিজম বলে।“

পুরোপুরি অভিব্যক্তিহীন দেখালো হিদাকাকে, সে বলল, “আমি নিশ্চিত প্ল্যাজিয়ারিজম শব্দটার অর্থের ব্যাপারে তুমি পরিচিত নও। ডিকশনারিতে গিয়ে দেখো। এতে বলা আছে, ‘কারোর লেখা অনুমতি ব্যতীত নিজের নামে চালানো।’ বুঝতেই পারছ, কী বোঝাতে চাইছি আমি। যদি অনুমতি না নিই তাহলে সেটা প্লেজিয়ারিজম, আর নিলে সেটা অন্য কিছু।”

ছোটলোকের বাচ্চা, আমি তোকে কোনোদিনই অনুমতি দিইনি, মনে মনে ভাবলাম। “মানে বলতে চাইছো আমার আরেকটা লেখা তুমি নিয়ে নিলে আমি কোনো অভিযোগ করতে পারবো না?”

জবাবে কাঁধ নাচাল করল হিদাকা। “তুমি আবারও আমাকে ভুল বুঝছ। আমি একটা চুক্তির প্রস্তাব দিচ্ছি আর কি। বলা যায়, বেশ লোভনীয় প্রস্তাব। “

“আমি জানি প্রস্তাবটা কি। আমি লেখা চুরির ব্যাপারে মুখ বন্ধ রাখলে তুমি ওই রাতের ঘটনার ব্যাপারে পুলিশকে জানাবে না।”

“অযথা এতটা উত্তেজিত হয়ো না। ‘ওই রাতের ঘটনা’র ব্যাপারে তোমাকে কবেই মাফ করে দিয়েছি। আরও ভালো প্রস্তাব দিতে চলেছি আমি।”

জানি না ওর দেয়া প্রস্তাব কতটা ভালো বা কিভাবে আমাকে স্বস্তি দেবে। তবে কিছু বললাম না, কথা চালিয়ে যেতে দিলাম। চুপচাপ বসে নড়তে দেখলাম তার ঠোঁট।

“দেখো নোনোগুচি, তোমার প্রতিভার ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। তবে প্রতিভাবান ও একজন প্রতিষ্ঠিত লেখক হওয়া দুটো সম্পূর্ণ আলাদা বিষয়। আর বেস্টসেলিং লেখক হতে হলে প্রতিভার দরকার হয় না। ব্যাপারটা পুরোপুরি ভাগ্যের ওপর নির্ভরশীল। আর এই ভাগ্যের আশীর্বাদ কিভাবে পাওয়া যায় সেটা জানা খুবই কঠিন। সবাই এটা পেতে চায়, পৌঁছাতে যায় ওই জায়গাটাতে। কিন্তু মানুষ যা ভাবে সেটা সবসময় ঘটে না।”

ওর চেহারায় ফুটে ওঠা গম্ভীর ভাবটা আমার নজর এড়াল না। মনে হল যেন লেখক হিসেবে কাটানো কঠিন দিনগুলোতে ফিরে গিয়েছে।

“তোমার কি মনে হয়? ‘নিভে যাওয়া অনল’ ভালো বই বলে এত সাফল্য পেয়েছে? এটা অস্বীকার করা যাবে না। তবে ভালো বই হওয়াটাই সবকিছু নয়। একটা জটিল উদাহরণ দিই তাহলে। ধরো, বইটা আমার নামে না প্রকাশিত হয়ে তোমার নামে হল। বইয়ের প্রচ্ছদে কুনিহিকো হিদাকার পরিবর্তে ওসামু নোনোগুচির নাম থাকলে তফাতটা কী হতো, বলো দেখি? তোমার মনে হয়, বইটা বিক্রি হত?”

“এমনটা না ঘটা পর্যন্ত আমরা কিছুই বলতে পারবো না।”

“নাহ, পারবো। বইটার কোনো গতিই হত না। কারো নজরে না পড়ায় এক সময় হারিয়ে যেত। তোমার মনে হত, বিশাল সমুদ্রে এক টুকরো পাথর ফেলেছো কেবল।“

কথাগুলো আসলেও হজম করা কঠিন, তবে অযৌক্তিক কিছু বলেনি ও। প্রকাশনা জগৎটা কতটা কঠিন সেই বিষয়ে ধারণা আছে।

“তুমি কেন নিজের নামে বইটা প্রকাশ করলেন সেটাই বোঝাতে চাইছো তাহলে?” বললাম আমি। “তুমি যেটা করছো বা সামনেও করবে, সেটাকে সমর্থন করতে বলছো?”

“আমি শুধু বলতে চাইছি, বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনা করে মনে হচ্ছে বইটা আমমার নামে প্রকাশ পেয়েই ভালো হয়েছে। নতুবা এত মানুষের কাছে পৌঁছাত না। “

“তোমার ভাব দেখে মনে হচ্ছে আমার বিরাট উপকার করেছো।”

“আমি কোনো ভাব-ই ধরছি না। যেটা সত্যি সেটাই শুধু বলার চেষ্টা করছি। বিশ্বাস করো, একটা বই বেস্টসেলার হওয়ার আগপর্যন্ত অনেক কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যেতে হয় লেখককে।”

“তোমার ধারণা আমি এসব জানি না?”

“নাহ, জানো না। আর সেটা তোমার আচরণেই স্পষ্ট। যদি জানতে তাহলে বুঝতে আমি কী বলার চেষ্টা করছি। দেখো, আমি আসলে তোমাকে লেখক কুনিহিকো হিদাকা হতে বলছি।”

“দুঃখিত, মনে হচ্ছ ভুল কিছু শুনলাম। তুমি কি আমাকে তোমার নাম নিয়ে লিখতে বললে?”

“এত অবাক হওয়ার কিছু নেই। খুব বড় কোনো ব্যাপার নয় এটা। বরং এভাবে ভাবো, কুনিহিকো হিদাকা কোনো ব্যক্তির নাম নয়। এই ট্রেডমার্কটা ব্যবহার করে বইগুলো বিক্রি করবো আমরা।”

এবারে গোটা বিষয়টা ধরতে পারলাম। “তোমার গোস্টরাইটার হওয়ার প্রস্তাব দিচ্ছ আমাকে। “

“এই শব্দটাও আমার পছন্দ নয়। একটা কাপুরুষোচিত ভাব আছে এতে। যাইহোক, হ্যাঁ, অনেকটা এরকমই ধরে নিতে পার।”

ওর দিকে তাকালাম। “তোমার সাহসের প্রশংসা না করে পারছি না।”

“আমি খুব অযৌক্তিক কিছু বলেছি, তা বলতে পারবে না।”

“এর থেকে ফালতু কোন প্রস্তাবের কথা কখনো শুনিনি আমি।”

“ওহ। আচ্ছা ধরো, আমার জন্য লেখা তোমার একটা উপন্যাস পেপারব্যাক আকারে প্রকাশিত হল। আমি আমার পুরো সম্মানীর পঁচিশ শতাংশ তোমাকে দেব। এবার ভালো লাগছে তো?”

“মাত্র পঁচিশ শতাংশ? পুরো বইটা লিখে অর্ধেকও পাবো না? এটা কি ধরনের গাঁজাখুরি প্রস্তাব?”

“তাহলে তোমাকে একটা প্রশ্ন করি। ধরো, তুমি নিজের নামেই বইটা বের করলে, কতগুলো বিক্রি হত তখন? আমার নামে প্রকাশিত হলে যা বিক্রি হবে তার সিকিভাগও বিক্রি হত বলে মনে হয় তোমার? কুনিহিকো হিদাকা নামটাই সব এখানে।”

ভুল বলেনি হিদাকা। আমার নামে বই বের করলে ওর মোট বিক্রির সিকিভাগও হবে না, এই ব্যাপারে আমি মোটামুটি নিশ্চিত। হয়তো সিকিভাগেরও অনেক কম হবে।

তবুও পুরো ব্যাপারটা বিবেচনা করে বললাম, “পয়সার বিনিময়ে নিজের আত্মা বিক্রি করতে পারবো না আমি।”

“তাহলে তুমি প্রস্তাবটা প্রত্যাখ্যান করছো?”

“ঠিক ধরেছো, প্রস্তাবটা প্রত্যাখ্যান করছি আমি।”

“আচ্ছা!” বিস্মিত দেখাল হিদাকাকে। “এমনটা আশা করিনি অবশ্য।” ওর কথা বলার ধরণে এমন কিছু ছিল যা শুনে একটা শীতল স্রোত বয়ে গেল আমার মেরুদন্ডের মাঝ বরাবর। ওর চোখের দৃষ্টিতে আগুন ঝরছে।

কিছুক্ষণ আগের হিদাকা আর এই হিদাকার মধ্যে অনেক তফাত।

“আমি আমাদের সম্পর্কটা ভালো রাখার চেষ্টা করছিলাম কিন্তু তোমার মধ্যে কোনো চেষ্টার ছিটেফোঁটাও নেই। একহাতে কখনো তালি বাজে না।”

পাশে থাকা ব্যাগটা উঠিয়ে নিয়ে ভেতর থেকে একটা চারকোনা প্যাকেট বের করে টেবিলে রাখলো হিদাকা। “এটা এখানে রেখে যাচ্ছি। আমি চলে যাওয়ার পর দেখবে। কিছুক্ষণ পর ফোন করবো, আশা করি ততক্ষণে মত বদলাবে তুমি।”

“কী এটা?”

“দেখলেই বুঝতে পারবে।” আর কথা না বাড়িয়ে অ্যাপার্টমেন্ট থেকে বেরিয়ে গেল হিদাকা। আমার দিকে ফিরেও তাকালো না।

ও চলে যাওয়ার পর একবিন্দুও না নড়ে কাউচে বসে তাকিয়ে থাকলাম জিনিসটার দিকে। লম্বা সময় পরে অবশেষে খুললাম প্যাকেটটা। ভেতরে একটা ভিএইচএস টেপ। টেপটা ভিসিআরে ঢোকানোর সময় দুরুদুরু করতে লাগল বুকের ভেতরটা।

ডিটেক্টিভ কাগা এরইমধ্যে এই টেপের বিষয়বস্তুর ব্যাপারে অবগত, কিন্তু আমার জন্যে সেবারই ছিল প্রথম। হিদাকাদের বাড়ির বাগানটা দেখতে পাই পর্দায়। নিচের দিকে ভেসে ওঠা টাইমফ্রেমের দিকে তাকিয়ে জমে যাই আমি। তারিখটা সেদিনের, যেদিন আমি হিদাকাকে খুনের চেষ্টা করি।

কিছুক্ষণ পর হঠাৎই একটা লোক এসে হাজির হল পর্দায়। লোকটার পরনে কালো পোশাক, অন্ধকারের সাথে মিশে গিয়েছে একদম। কিন্তু তার চেহারাটা স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে!

কেন আমি মাস্ক পরার কথা ভাবিনি?

যে কেউ-ই টেপের লোকটাকে দেখে পরিস্কার বুঝতে পারবে এটা ওসামু নোনোগুচি। ক্যামেরায় একদম পরিস্কার বোঝা যাচ্ছে চেহারাটা। পর্দার নোনোগুচি বাগানের দিককার জানালা ধরে উঠে গেল। টেপে শুধু এই জিনিসটাই রয়েছে। আর এটুকুই যথেষ্ট। যদি খুনের চেষ্টা চালানোর ব্যাপারটা অস্বীকারও করি, ওখানে কী করছিলাম, এর যৌক্তিক ব্যাখ্যা দিতে পারবো না।

বিবশ হয়ে বসে রইলাম। ওই রাতে হিদাকা আমাকে যা বলেছিল সেই কথাটাই ঘুরতে লাগল মাথার ভেতর। এই টেপটাই তাহলে তার হাতে থাকা আরেকটা প্রমাণ।

বসে আছি, নিশ্চিত নই কী করবো, তখনই বেজে উঠল ফোন। হিদাকা ফোন করেছে। একেবারে নিখুঁত টাইমিং। যেন আমার প্রতিটি পদক্ষেপের উপর নজরে রাখছে ও।

“টেপটা দেখেছো?” বলা চলে ব্যাপারটা উপভোগ করছে হারামিটা। বললাম, দেখেছি।

“তাহলে কী ভাবছ?”

“তুমি জানতে, না?” কিছু না ভেবেই বললাম।

“কী জানতাম?”

“ওই রাতে আমি তোমার বাড়িতে চুরি করবো। তাই আগে থেকেই ভিডিও ক্যামেরা লাগিয়ে রেখেছিলে।”

হাসিতে ফেঁটে পড়লো হিদাকা। “কীভাবে জানবো আমি?”

“যাইহোক, আমি…“

“দাঁড়াও!” আমাকে থামিয়ে বলল ও। “তোমার পরিকল্পনার ব্যাপারে কারোর সাথে আলাপ করেছিলে নাকি? কেউ কি জানত, ওই রাতে তুমি আমাকে খুন করতে যাবে? তাহলে হয়ত কোনোভাবে আমার পক্ষে জানা সম্ভব হত। কেন না লোকে বলে, দেয়ালেরও কান আছে।”

আমার মনে হল হিদাকা আমার কাছ থেকে হাতসুমির সহযোগিতার কথাটা বের করতে চাইছে। অথবা ও জানে, আমি হাতসুমির ব্যাপারে কখনোই মুখ খুলব না, সেজন্য আমার সাথে খেলছে। কিন্তু আমি কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালাম না।

আবারও বলতে শুরু করল ও, “আসলে ক্যামেরা লাগিয়েছিলাম অন্য কারণে। বাগানের গাছগুলো তছনছ করে রেখে যাচ্ছিল কোন জন্তু। তাই দেখতে চাইছিলাম কার কাজ এসব। তবে জীবনেও ভাবিনি এই জন্তুটা তুমি, নোনোগুচি।”

কথাটা অবিশ্বাস্য কিন্তু এই প্রসঙ্গে আর তর্কে গেলাম না। “তাহলে ভিডিওটা আমাকে দেখিয়ে কী প্রমাণ করতে চাইছো? আমাকে কী করতে বলছো?”

“আবারো বলতে হবে? এখনও বুঝতে পারোনি? তুমি তো অতটাও বোকা নও। ওহ, এখনই বলে রাখি, তোমার কাছে থাকা টেপটা কপি, আর আসলটা আমার কাছে নিরাপদে রয়েছে।”

“আমাকে কি ব্ল্যাকমেইল করে তোমার গোস্টরাইটার বানাতে চাইছো? এরকম জবরদস্তি করলে আমার জন্য লেখা কঠিন। জোর করে লেখার কথা কল্পনাও করতে পারি না।” কথাটা বলেই মনে হল এটা বলা উচিত হয়নি। মনে হচ্ছে ওর টোপের দিকে পা বাড়িয়ে ফেলেছি। এছাড়া আমার আর কীই বা করার আছে?

“আসলে আমার বিশ্বাস ছিল তুমি বুঝবে ব্যাপারটা,” ওর কন্ঠস্বর শুনে বলতে পারি ও ভাবতে শুরু করেছে জয় ওরই হবে। ভেঙে পড়তে শুরু করেছে আমার রক্ষণ। “আমি দ্রুতই ফোন করবো,” বলে রিসিভার রেখে দিলো।

পরের কয়েক সপ্তাহ ধরে ভূতের মত জীবনযাপন করলাম। বলা ভালো, ভূত লেখকের মত। ধারণা নেই কি করতে চলেছি। কাজে যাওয়া বন্ধ করলাম না, যদিও ক্লাস নেয়া আমার জন্য সবথেকে কঠিন কাজ হয়ে উঠেছিল। নিশ্চিত কয়েকজন ছাত্র আমার ব্যাপারে অভিযোগও জানিয়েছে। কেননা হেডমাস্টার তার রুমে ডেকে আমাকে ভালোই বকাবকি করে।

এরপর একদিন একটা বইয়ের দোকানের সাহিত্য বিষয়ক ম্যাগাজিনে ব্যাপারটা দেখলাম। কুনিহিকো হিদাকার প্রকাশিতব্য নতুন উপন্যাসের সারসংক্ষেপ। কাঁপা হাতে দ্রুত ডিসপ্লে থেকে ম্যাগাজিনটা তুলে নিলাম। মাথা ঘোরাতে শুরু করে আমার। মনে হচ্ছিল যেন ওখানেই জ্ঞান হারাবো। যে ভয় পেয়েছিলাম, সেটাই। এই বইটা হিদাকাকে পড়তে দেয়া আমার দ্বিতীয় উপন্যাসের ওপর ভিত্তি করে লেখা।

পুরো দুনিয়া যেন আমার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে লাগল। সপ্তাহ জুড়ে নিজের নির্বুদ্ধিতার কারণে নিজেকে অভিশাপ দিতে থাকলাম। বারবার ভাবলাম কেন ওই রাতে খুনের চেষ্টা করেছিলাম ওকে। কোথাও পালিয়ে গিয়ে নিজেকে লুকিয়ে ফেলার কথাও চিন্তা করলাম। কিন্তু এমন কিছু করার মত পর্যাপ্ত সাহস নেই আমার। হিদাকার হাত থেকে বাঁচতে চাইলে আমাকে বহুদূরে পালাতে হবে, আর রেজিস্টার করা যাবে না আমার নতুন ঠিকানা এর অর্থ আমি আর শিক্ষকতা করতে পারবো না। তাহলে বাঁচব কিভাবে? কায়িক শ্রম করার মত অবস্থাও আমার শরীরের নেই। তখনকার মত হীনমন্যতায় আমি কখনোই ভুগিনি। আর কোনোভাবেই হাতসুমিকে ফেলে রেখে যেতে পারতাম না। ওই বাড়িতে ওই লোকটার সাথে থেকে ওর কষ্টের কথা কল্পনা করেই রাগ লাগত আমার।

পেপারব্যাক আকারে দ্রুতই বেরিয়ে গেল হিদাকার নতুন উপন্যাস, ভালোই বিক্রি হল সেটা। যতবারই বেস্টসেলারের তালিকায় বইটা দেখতাম অনুশোচনা বোধের সাগরে আছড়ে পড়তাম আমি। চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যেত আমার আত্মমর্যাদা। আবার পরিস্থিতির কথা বিবেচনা করে ঠান্ডা মাথায় মাঝেমধ্যে ভাবতাম, এই বই আমার নামে প্রকাশিত হলে হয়ত বিক্রিই হত না।

কয়েক সপ্তাহ পরে, এক রোববার আবারও এলো হিদাকা। এমনভাবে আমার অ্যাপার্টমেন্টে ঢুকে সোফায় বসল যেন কিছুই ঘটেনি।

“কথা অনুযায়ী…” একটা এনভেলপ রাখল ও টেবিলের ওপর।

জিনিসটা তুলে দেখতে পেলাম এর ভেতরে রাখা টাকাগুলো।

“…এতে দুই মিলিয়ন ইয়েন আছে। যা অনেক লোকের এক বছরের বেতনের সমান।“

“এটা কীসের জন্য?”

“বলেছিলাম তো, বইটা চললে তোমার অংশটা তুমি পেয়ে যাবে। আমার সম্মানীর পঁচিশ শতাংশ এটা।”

খামটার দিকে আরেকবার তাকিয়ে মাথা নাড়লাম। “আমি তো তোমাকে বলেছিই, কোনোভাবেই নিজের বিবেক বিক্রি করবো না।”

“এত নাটক করো না তো। কেবল ভাব, এই বইটার পেছনে তোমার অবদানের ব্যাপারে। আজকাল যৌথভাবে উপন্যাস লেখা অপ্রচলিত কিছু নয়। নিজের পাওনা বুঝে নেয়ার অধিকার তোমার আছে।”

“এইটা যৌথভাবে লেখা কোনো উপন্যাস নয়।” হিদাকার দিকে তাকালাম আমি। “এটা একপ্রকার ধর্ষণ। তুমি নিজের ইচ্ছেমত আমাকে ব্যবহার করছো। এরপর এমনভাবে আমাকে পয়সা দিচ্ছ যেন আমি একজন পতিতা।”

“বিশ্রী ও অসভ্য চিন্তাভাবনা!”

“তাই নাকি?”

“চুপচাপ বসে থেকে কেউ কোনোদিন ধর্ষিত হয়নি, কিন্তু তুমি হচ্ছো।”

লজ্জায় পাল্টা কোনো জবাব দিতে পারলাম না।

“বলাই বাহুল্য,” অনেক কষ্টে বললাম আমি। “এই টাকাটা আমি নিতে পারবো না।” খামটা ঠেলে দিলাম ওর দিকে।

জিনিসটার দিকে তাকিয়ে থাকল হিদাকা, ওটা উঠিয়ে নেয়ার কোনো ভাব দেখা গেল না ওর মধ্যে, টেবিলেই পড়ে থাকল।

“আসলে এরপর কী হবে এই ব্যাপারেই কথা বলতে এসেছি আমি।”

“তাহলে বল, এরপর কী হবে?” কণ্ঠে যতটা পারা যায় ব্যঙ্গাত্মক সুর এনে বললাম আমি।

“আমাদের পরবর্তি উপন্যাস…একটা মাসিক ম্যাগাজিনের জন্য ধারাবাহিক গল্প লেখার কথা আমার। আমরা কিছু আইডিয়া নিয়ে আলাপ করতে পারি।”

এমনভাবে বলল, যেন আমি ওর গোস্টরাইটার হওয়ার প্রস্তাবে রাজি হয়ে বসে আছি।

মাথা ঝাঁকালাম আমি। “তুমি একজন লেখক, তোমার বোঝা উচিত এরকম মানসিক অবস্থায় কিভাবে কোনো গল্পের আইডিয়া আমার মাথায় আসবে? ভালো গল্পের কথা বাদ-ই দিলাম। জোর করে এসব হয় না। শারীরিক ও মানসিক উভয়ভাবেই এটা অসম্ভব।”

তবুও পিছু হটল না ও, উল্টো অপ্রত্যাশিত একটা কথা বলে বসল। “আমি কিন্তু বলছি না, এক্ষুনি একটা গল্প লিখে দিতে হবে তোমাকে। কিন্তু আগেই লেখা আছে এমনকিছু তো খুঁজে দিতে পার? এটা তো কঠিন হওয়ার কথা না।”

“আমার আর কিছু লেখা নেই, যা ছিল সবই তুমি দেখেছো।”

“আমার সাথে নাটক করবে না। স্কুল ম্যাগাজিনের জন্য যেগুলো লিখতে সেগুলোর কি অবস্থা?”

“হ্যাঁ?” সত্যিকার অর্থেই অবাক হয়ে বললাম। “ওসব আর নেই আমার কাছে।”

“ধ্যাৎ।”

“সত্যি বলছি। দীর্ঘদিন আগে ওগুলো ফেলে দিয়েছি।”

“দেখো, তোমার কথা বিশ্বাস করছি না আমি। লেখকেরা কখনো তাদের পান্ডুলিপি ফেলে দেয় না। তুমি না স্বীকার করলে আমি তোমার বাড়িতে খুঁজে দেখব। বেশি সময় লাগবে না। হয়তো তুমি ওগুলো ডেস্ক ড্রয়ার বা বুকসেলফের মধ্যে ফেলে রেখেছো।” উঠে দাঁড়িয়ে পাশের রুমে চলে গেল হিদাকা।

আতঙ্কিত হয়ে উঠলাম আমি। আমার শুরুর দিককার লেখা গল্পগুলো সব একটা স্পাইরাল নোটবুকে রয়েছে। ওই নোটবুক বুকসেলফে রাখা।

“একটু দাঁড়াও,” বলে উঠলাম আমি। “ওসব দিয়ে তোমার কোনো লাভ হবে না। ছাত্রাবস্থায় ওই গল্পগুলো লিখেছিলাম। লেখা একেবারে দুর্বল আর প্লটগুলো যাচ্ছেতাই। একজন পরিণত লেখকের কাজ নয় ওগুলো।”

“সিদ্ধান্তটা আমাকেই নিতে দাও। আর আমি কোনো সম্পূর্ণ লেখাও খুঁজছি না, শুধু কিছু কাচামাল দরকার যা আমি ঘষেমেজে ঠিক করতে পারবো। বড় কথা নিভে যাওয়া অনল কখনোই সাহিত্য জগতে ইতিহাস সৃষ্টি করতে পারত না আমার তুলির শেষ আঁচড় ছাড়া।”

বুঝতে পারলাম না কিভাবে কারো লেখা চুরি করে এত গর্ব করতে পারে কেউ।

ওকে সোফায় বসতে বলে পাশের রুমে চলে এলাম। অফিসের সেলফের ওপর রাখা আছে আমার পুরাতন আটটা নোটবুক। একটা বাছাই করলাম। ঠিক সেই মুহূর্তেই ঘরে ঢুকল হিদাকা।

“তোমাকে অপেক্ষা করতে বলেছিলাম আমি। “

কোনো কথা না বলেই সামনে এগিয়ে এসে আমার হাত থেকে নোটবুকটা ছিনিয়ে নিয়ে পাতা ওল্টাতে থাকল সে, এরপর বুকশেলফের দিকে তাকিয়ে তুলে নিলো বাকি নোটবুকগুলোও।

“আমাকে বোকা বানাতে চাইছিলে, তাই না?” মুখ বিকৃত করে বলল। “তুমি যে নোটবুকটা হাতে নিয়েছিলে ওতে ছিল অগ্নি বলয়ের খসড়া, ঠিক না? তোমার মনে হয় ওইটা দিয়ে আমাকে বোকা বানাতে পারতে?”

ঠোঁট কামড়ে মেঝের দিকে তাকালাম।

“যাইহোক, আমি এগুলো নিয়ে যাচ্ছি। সবগুলোই।”

“হিদাকা,” মাথা উঁচু করে তাকিয়ে বললাম। “তোমার কি লজ্জা করে না? তোমার প্রতিভা কি এতটাই কমে গিয়েছে যে এমন কিছু চুরি করতে হচ্ছে যা আমি ছাত্রাবস্থায় লিখেছি?”

কথা দিয়ে ওকে ঘায়েল করতে চাইলাম, অল্প হলেও। তবে এর থেকে বেশি কিছু আর বলতে পারলাম না। তবে প্রভাব পড়ল আমার বলা কথার। জ্বলে উঠল হিদাকার চোখ, কলার চেপে ধরল আমার।

“একজন লেখক হওয়ার অনুভূতি তুমি বুঝবে না।”

“ঠিক বলেছো। আমি বুঝবো না। তবে লেখক হওয়ার মানে যদি তোমার মত কিছু হয়, তবে আমি কখনোই লেখক হতে চাইবো না। “

“লেখক হওয়ার স্বপ্নের কি হল?”

“আমার ঘুম ভেঙে গিয়েছে।”

আমাকে ছেড়ে দিলো ও। “এতেই বোধহয় ভালো হয়েছে।”

বিড় বিড় করে বলে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।

“দাঁড়াও, এটা নিতে ভুলে গিয়েছ তুমি,” দুই মিলিয়ন ইয়েনের খামটা বাড়িয়ে দিলাম তার দিকে। আমার দিকে এক ঝলক তাকিয়ে, কাঁধ ঝাঁকিয়ে খামটা তুলে নিলো ও।

ধারাবাহিক উপন্যাসটা শুরু হল দুই বা তিন মাস পরে। পড়ার পর টের পেলাম আমার একটা ছোটগল্পের ওপর ভিত্তি করেই লেখা এটা। ততদিনে হাল ছেড়ে দিয়েছি আমি অথবা বলা চলে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি। প্রথম দুটো উপন্যাসের মত অবাক হইনি এটা দেখে। আর লেখক হওয়ার ব্যাপারেও হাল ছেড়ে দিয়েছিলাম, এজন্য লেখাটা পড়ে মনে হল যাক আমার লেখা গল্পগুলো কোনো না কোনোভাবে প্রকাশিত হচ্ছে। তখনও মাঝেমধ্যে কল করত হাতসুমি। স্বামীকে তিরস্কার করে ক্ষমা চাইত আমার কাছে।

একবার সে বলল, “যা হয়েছে সেটার জন্য কখনো যদি আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত নাও তবে আমার যে শাস্তিই হোক আমি সানন্দে মাথা পেতে নেবো।”

বুঝতে পারলাম, হাতসুমি এই কথাটা বলেছিল কেন না সে জানত আমাদের সম্পর্কটার ফায়দা লুটছে হিদাকা। আমাকে বাঁচার একটা পথ বানিয়ে দিতে চেয়েছিল হাতসুমি। কথাটা শুনে আনন্দে প্রায় কেঁদে ফেলি 1 আমাদের দুজনের দীর্ঘদিন দেখা না হলেও আমাদের হৃদয়ের যোগাযোগ মুছে যায়নি।

“তোমাকে এই ব্যাপারে ভাবতে হবে না,” তাকে বলি আমি। “কিছু একটা করব…কোনো না কোনো উপায় বের করবই।”

“কিন্তু ইতিমধ্যে অনেক কিছু সহ্য করেছো তুমি,” ফোনের অপরপ্রান্ত থেকে ভেসে আসত হাতসুমির কান্নার আওয়াজ।

ওকে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করতাম আমি, কিন্তু জানা ছিল না কী বলবো। কোনো উপায় বের করার কথাটা আমার নিজের কাছেই ফাঁপা বুলি বলে মনে হত, হতাশা ভর করত চিত্তে।

ওই সময়ের কথা ভাবলেই আফসোসে ভরে ওঠে মন। ভাবি, কেন হাতসুমির কথা মত কাজ করলাম না। কেন আত্মসমর্পণ করলাম না আমরা। যদি করতাম তাহলে অন্তত আমার জীবনের সবচেয়ে প্রিয় জিনিসটা হারানো লাগত না।

দুর্ঘটনার খবরটা পত্রিকা থেকে জানি আমি। যতই হোক, একজন বেস্টসেলার লেখকের স্ত্রী ও, বেশ গুরুত্ব সহকারেই প্রতিবেদনটা ছাপা হয়েছিল। জানি না কতটা ভালোভাবে তদন্ত করেছে পুলিশ, তবে কাউকেই বলতে শুনিনি হাতসুমির মৃত্যু দুর্ঘটনা ব্যতীত অন্য কিছু। কিন্তু খবরটা শোনার মুহূর্তেই আমি জানতাম, এটা দুর্ঘটনা নয়-আত্মহত্যা করেছে ও। কেন, সেটা বলাই বাহুল্য।

এককথায় তাকে খুন করেছি আমি। আমি পাগলের মত হিদাকাকে খুন করতে না গেলে এসব কোন কিছুই ঘটত না।

ওই সময় মরার মত বেঁচে ছিলাম আমি। আমার দেহটা ফাঁকা খোলসের মত হয়ে গিয়েছিল। হাতসুমির মৃত্যুর ব্যাপারে খোঁজ নেয়ার শক্তিটা পর্যন্ত ছিল না। অসুস্থ হয়ে পড়ি, কাজে যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। এর মাঝেও লিখতেই থাকে হিদাকা। আমার কাজগুলোর ওপর ভিত্তি করে লেখা উপন্যাস ছাড়া কিছু মৌলিক উপন্যাসও লেখে সে। আমি আর খতিয়ে দেখতে যাইনি কোনটা বেশি জনপ্রিয় হয়েছে।

হাতসুমির মৃত্যুর প্রায় ছয়মাস পর পার্সেলে একটা প্যাকেজ পাই আমি বড় এনভেলপের ভেতরে ছিল প্রায় ত্রিশটা প্রিন্ট করা পেইজ। ভেবেছিলাম কোনো গল্প হয়ত কিন্তু পড়া শুরু করে বুঝলাম এর থেকেও ভয়াবহ কিছু। হাতসুমির লেখা একটা জার্নাল এটা, এর সাথে রয়েছে হিদাকার লেখা কিছু অংশও। জার্নাল অংশে লেখা আছে এন (আমি) নামক এক পুরুষের সাথে বিশেষ সম্পর্কে জড়ায় হাতসুমি, এই লোকটার সাথে চক্রান্ত করে খুন করতে চায় নিজের স্বামীকে। হিদাকার অংশে লেখা আছে, স্ত্রীর ভালোবাসা বঞ্চিত এক স্বামীর দুঃখগাঁথা। এরপর এসেছে হত্যাচেষ্টার ব্যাপারটা। এতদূর পর্যন্ত কমবেশি সবই সত্য। কিন্তু এরপর যা পড়লাম তার বেশিরভাগই ফিকশন, একেবারে মনগড়া। হাতসুমিকে দেখানো হয়েছে একজন অনুতপ্ত নারী হিসেবে যে স্বামীর কাছে ক্ষমা ভিক্ষা চেয়েছে। লেখা আছে, দীর্ঘ আলাপের পর তাকে ক্ষমা করে আরেকবার নতুন করে সবকিছু শুরুর সিদ্ধান্ত নেয় হিদাকা। সব ঠিকভাবেই চলছিল, তখনই এক দুর্ভাগ্যজনক দুর্ঘটনার মুখোমুখি হয় হাতসুমি। লেখাটা শেষ হয়েছে হাতসুমির শেষকৃত্য দিয়ে। ফিকশন হিসেবে খারাপ না। পাঠকদের জন্য উপভোগ্যই।

কিন্তু পুরোটা পড়ার পর বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম আমি। কী করবো এটা দিয়ে?

সেই রাতে ফোন করল হিদাকা। “পড়েছো ওটা?”

“কী লিখেছো এসব? কেন লিখেছো?”

“আগামী সপ্তাহে আমার সম্পাদককে এটা দেয়ার কথা ভাবছি। আগামী মাসে একটা ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হবে লেখাটা।

“পাগল হয়েছ নাকি? জান কী হবে এতে?”

“ভালোভাবেই জানি,” শান্তস্বরে বলল ও।

“এটা প্রকাশ করলে আমি সত্যিটা ফাঁস করে দেব।”

“কোন সত্যি?”

“যেটা তুমি আমি দুজনেই জানি…আমার লেখা চুরি করেছো তুমি।”

“এখনও করেছি?” অপ্রস্তুতভাবে বলল ও। “কেউ বিশ্বাস করবে তোমার

কথা? কোনো প্রমান আছে তোমার কাছে?”

“প্রমাণ?” ঢোক গিললাম আমি। কিভাবে প্রমাণ করবো আমার লেখা চুরি করেছে হিদাকা। যে দুটো উপন্যাস চুরি করেছে তার কপি আমার কাছে রয়েছে, একটা ওয়ার্ড প্রসেসরে। কিন্তু এতে কি প্রমাণিত হয়? ঠিক তখনই উপলব্ধি হল, হাতসুমির মৃত্যুর সাথে সাথেই আমার ও হিদাকার মধ্যে যা যা ঘটেছে সেসবেরও মৃত্যু ঘটেছে।

“অবশ্য, লেখাটা এখন তোমার ভালো না লাগলে আমার সম্পাদকের কাছে পাঠাবো না। ভালো সময়ের জন্য সবসময়ই অপেক্ষা করতে রাজি আমি।” ও বলার আগেই ধারণা করতে পারলাম কী বলতে চাইছে “আপাতত পঞ্চাশ পৃষ্ঠার একটা গল্প দাও…ওটাই সম্পাদককে দিই।”

তাহলে এটাই ওর পরিকল্পনা। এমন একটা পরিস্থিতি সৃষ্টি করা যাতে আমি ওর জন্য লিখতে বাধ্য হই। আমার বাধা দেয়ার কোনো উপায় নেই। কারণ কোনোভাবেই জার্নালটা প্রকাশ হতে দিতে পারি না আমি। হাতসুমির স্মৃতির দোহাই দিয়ে হলেও এটা প্রকাশ হতে দেয়া যাবে না।

“কখন দরকার তোমার?” নিরস কন্ঠে বললাম।

“আগামী সপ্তাহে।”

“এবারই শেষবারের মত?” প্রশ্নটা পুরোপুরি করতেও পারিনি। কিন্তু জবাব দেয়ার প্রয়োজন বোধ করল না হিদাকা।

“লেখা শেষ হলে কল দিও,” বলে রেখে দিলো ফোন।

ওইদিন-ই কুনিহিকো হিদাকার পুরোদস্তুর গোস্টরাইটার বনে গেলাম আমি। এযাবৎ তার হয়ে সতেরোটা ছোটগল্প ও তিনটা উপন্যাস লিখেছি। পুলিশের পাওয়া কম্পিউটার ফাইলেই ওগুলো রয়েছে। ডিটেক্টিভ কাগা যদি এটা পড়ে থাকেন তবে আমি নিশ্চিত তিনি ভাবছেন আমি কেন আরেকটু লড়াই করলাম না। সত্যি বলতে, হিদাকার বিরুদ্ধে স্নায়ুযুদ্ধে আমি ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। সে যা চাইছিল সেটা লিখে দেয়াই সহজ বলে মনে হয়েছিল। এতে হাতসুমির সাথে আমার অতীতটা গোপন থাকত।

বিশ্বাস করা কঠিন হলেও এটাই সত্যি, পরবর্তি দুই-তিন বছরে আমার সাথে হিদাকার সম্পর্কটা সহযোগীর মতো হয়ে যায়। আমাকে এক শিশু সাহিত্যের প্রকাশকের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয় ও, কেন না এই ঘরানায় ওর আগ্রহ ছিল না। ততদিনে হয়ত একটু অনুতপ্তবোধ করতে শুরু করেছে। অবশেষে একদিন সেই কথাটা তুলল ও, যেটা শোনার অপেক্ষায় ছিলাম আমি।

“পরবর্তি উপন্যাসটা শেষ হলেই তুমি মুক্ত। আমাদের কাজের সম্পর্ক শেষ।”

নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না আমি। “সত্যিই?”

“সত্যি। কিন্তু আমি চাই তুমি শুধু বাচ্চাদের বই লিখবে। আমি যে ধারায় লিখি সেখান থেকে দূরে থাকবে, বুঝলে?”

মনে হচ্ছিল স্বপ্ন দেখছি। আর একটা বই, এরপরই আমি মুক্ত।

অল্পসময় পরেই বুঝলাম হিদাকার মন পরিবর্তনের কারণ। রাইয়ের সাথে তার বৈবাহিক জীবন ভালো চলছে, পাকাপাকিভাবে ভ্যাঙ্কুবারে চলে যাওয়ার কথা ভাবছে ওরা। ব্যাগ গোছানোর সময় পুরাতন কিছু জিনিস ফেলে যেতে চাইছিল হিদাকা।

মনে হয়, এই নবদম্পতির চেয়ে আমিই বেশি অপেক্ষায় ছিলাম ওদের ভ্যাঙ্কুবারের উদ্দেশ্যে উড়াল দেয়ার দিনটার জন্য।

অবশেষে দিনটা এলো, একটা ডিস্কে করে ‘তুষারদ্বার’-এর পরবর্তি কিস্তি নিয়ে রওনা হলাম হিদাকার বাড়ির উদ্দেশ্যে। শেষবারের মত কম্পিউটার ফাইল দিতে চলেছি তাকে। যেহেতু আমার নিজস্ব কম্পিউটার নেই, হিদাকা কানাডা চলে গেলে পান্ডুলিপির বাকি অংশগুলো তাকে ফ্যাক্স করে পাঠাতে হবে। ‘তুষারদ্বার’ লেখা শেষ হলেই আমি মুক্ত।

হিদাকার হাতে ডিস্কটা দেয়ার পর তাকে বেশ চনমনে দেখাল। ভ্যাঙ্কুবারে তার নতুন জায়গার ব্যাপারে কিছুক্ষণ আলাপের পর জিজ্ঞেস করলাম, “আমার জিনিসগুলো তো আজকে ফেরত দিয়ে দেবে, নাকি?”

“কোন জিনিস?” যদিও কোনোভাবেই এগুলোর ব্যাপারে ভোলার কথা

নয় ওর। তবু জল ঘোলা না করলে ওর ভালো লাগে না।

“আমার নোটবুকগুলো। ভালোমতোই জান, কী বলছি।”

“নোটবুক?” এমন ভাব করল যেন ও বুঝতে পারেনি। “আহ্? মনে পড়েছে। দীর্ঘদিন ওগুলো দেখা হয়নি।”

ড্রয়ার খুলে আটটা স্পাইরাল নোটবুক বের করল।

নোটবুকগুলো বুকের সাথে চেপে ধরলাম আমি। এবার সমতায় এলো সবকিছু। হয়তো ওর লেখা চুরির ব্যাপারটা প্রমাণ করতে পারবো।

“খুশি দেখাচ্ছে তোমাকে,” বলল হিদাকা।

“বলতে পার।”

“আচ্ছা। আমি ভাবছি ওগুলো ফেরত পাওয়ার জন্য এত মরিয়া হয়ে উঠেছো কেন তুমি?”

“কারণটা কি স্পষ্ট নয়? তোমার বইগুলো আমার গল্পের ওপর ভিত্তি করে

লেখা ওগুলো সেটার প্রমাণ।”

“এই তাহলে ব্যাপার,” আবারও হাসল সে। “ঘটনাটা যদি উল্টো ঘটে? কেউ যদি ভাবে, তুমি বইগুলো পড়ে নিজের মত করে ওই নোটবুকে গল্পগুলো লিখেছো?”

“কী?” শীতল স্রোত বয়ে গেল আমার মেরুদণ্ড বেয়ে। “এভাবে ব্যাপারটা উপস্থাপন করতে চাও তুমি?”

হতবাক দেখাল হিদাকাকে। “কেন কারোর কাছে কিছু উপস্থাপন করতে যাব আমি? তুমি যদি তৃতীয় কোনো ব্যক্তিকে জানাও তখন হয়ত এভাবে আত্মপক্ষ সমর্থন করবো। কে সত্যি বলছে আর কে মিথ্যে, সেটা যাচাই করা ওই তৃতীয় ব্যক্তির মাথাব্যথা। এই ব্যাপারে এখন আমি আর তর্ক করতে চাই না। তোমাকে বুঝতে হবে, এই নোটবুকগুলো দিয়ে আমার বিরুদ্ধে বিন্দুমাত্র সুবিধাও করতে পারবে না। “

“হিদাকা,” ওর দিকে তাকালাম। “আমি আর তোমার গোস্টরাইটার নই।”

“জানি। তুষারদ্বার-ই শেষ। সমস্যা নেই।”

“তাহলে এত কথা কিসের?”

“কিছুই না। শুধু একটা বিষয় মনে রাখবে, আমাদের মধ্যেকার পরিস্থিতির কিন্তু কোনো পরিবর্তন হয়নি।”

হিদাকার মুখের শীতল হাসি দেখেই বুঝতে পারলাম, আমাকে ছাড়ার কোনো বাসনা ওর নেই। দরকার পড়লে আবারও আমাকে ব্যবহার করবে।

“ওই টেপ আর ছুরিটা কোথায়?” জিজ্ঞেস করলাম।

“কোন টেপ আর ছুরি?”

“নাটক করবে না। ভালোমতোই জান কীসের কথা বলছি।”

“ওহ, ওগুলো…নিরাপদ স্থানে রাখা আছে। শুধু আমি জানি, কোথায় আছে।“

ঠিক সেই সময় দরজায় নকের আওয়াজ পাওয়া গেল। রাই উঁকি দিয়ে বলল মিয়াকো ফুজিও এসেছে।

সম্ভবত ওই মহিলার সাথে দেখা করতে চাইবে হিদাকা, কেন না এখন আমাকে অফিস থেকে বের করার একটা অজুহাত দরকার তার।

রাগ গিলে নিয়ে রাইকে বিদায় জানিয়ে বেরিয়ে এলাম। আমাকে দরজা দিয়ে বেরিয়ে যেতে দেখে রাই, ডিটেক্টিভ কাগা এই তথ্যটা জানেন।

এরপর বাগান পেরিয়ে চলে যাই হিদাকার অফিসের জানালার কাছে। জানালার আড়ালে লুকিয়ে শুনতে থাকি মিয়াকো ফুজিওর সাথে কী ব্যাপারে আলাপ করছে হিদাকা। যেমনটা ভেবেছিলাম, ফুজিওর অভিযোগের প্রতিক্রিয়ায় বিভ্রান্ত দেখাচ্ছিল হিদাকাকে। অভিযোগের বিষয়বস্তু ছিল তার হয়ে আমার লেখা উপন্যাস নিষিদ্ধ প্রান্তরের ব্যাপারে। এই বিষয়ে আলাপ করার মত হিদাকার জ্ঞান নেই বললেই চলে।

এক সময় চলে যায় ফুজিও, স্পষ্টতই বিরক্ত দেখাচ্ছিল তাকে। এরপর দ্রুতই হোটেলের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যায় রাই। বাথরুমে যাওয়ার জন্যে অফিসের বাইরে পা রাখে হিদাকা।

ভাবি, সবকিছু চিরতরে শেষ করে দেবার এটাই সুযোগ। হিদাকার পিছু নেই আমি। দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে সারাজীবনেও হিদাকার হাত থেকে মুক্তি মিলবে না।

ভাগ্য ভালো জানালা খোলা ছিল। ভেতরে ঢুকে দরজার আড়ালে লুকাই আমি, হাতে ছিল পিতলের পেপারওয়েটটা। এরপর যা ঘটল সেসব আর বিস্তারিত বলার প্রয়োজন নেই। বলা বাহুল্য, হিদাকা বের হওয়ার সাথে সাথেই তার মাথার পেছনে সজোরে আঘাত হানি। মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে সে। নিশ্চিত হওয়ার জন্য ফোনকর্ড গলায় চেপে শ্বাসরোধ করি ওর। এরপর ডিটেক্টিভ কাগার অনুমান মতই সব ঘটেছে। হিদাকার কম্পিউটার ব্যবহার করে নিজের অ্যালিবাই তৈরি করি আমি। যে কৌশলটা খাটিয়েছি সেটা ভেবে রেখেছিলাম একটা কিশোর রহস্য উপন্যাসের জন্য। হ্যাঁ, ঠিক, এই কৌশল প্রয়োগ করে বোকা বানানো যেত বাচ্চাদের। হাসি পেলে হাসতে পারেন।

মনে মনে প্রার্থনা করতাম, সন্দেহভাজনের তালিকা থেকে আমাকে বাদ দিতে এটা যেন যথেষ্ট হয়। এটাও আশা করেছিলাম, হিদাকার ওপর প্রথমবার হত্যাচেষ্টা চালানোর ব্যাপারটা আলোর মুখ না দেখুক। এজন্যই রাইকে বলি কানাডা থেকে হিদাকার ভিডিও টেপ ফিরে এলে আমাকে জানাতে।

এতকিছুর পরও ডিটেক্টিভ কাগা দক্ষ হাতে সমাধান করে ফেললেন সব নিগূঢ় রহস্যের। তার অনুমান ক্ষমতা দুর্দান্ত, এতই দারুণ যে আমি এই দক্ষতাকে ঘৃণা করি। তবে ডিটেক্টিভকে দোষ দেয়ার কিছু নেই।

এই স্বীকারোক্তির শুরুতে যেমনটা বলেছি, আমার কুকর্মের ভিডিও টেপটা দেখে আমি নিজেও চমকে উঠেছিলাম। কেন না টেপটা ছিল ‘সমুদ্রের ডাক’ বইয়ের একটা কপির ভেতরকার ফাঁকা অংশে। ‘সমুদ্রের ডাক’ হিদাকার নিজের লেখা নতুন উপন্যাস। উপন্যাসের প্লট ছিল মূল চরিত্রের স্ত্রী আর স্ত্রীর প্রেমিককে নিয়ে। আমার বিশ্বাস, জানালায় আমার যে প্রতিফলন দেখা গিয়েছিল সেটাই ডিটেক্টিভ কাগাকে সত্যের দিকে নিয়ে গিয়েছে 1 মৃত্যুর পরও আমাকে ধ্বংস করার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছিল হিদাকা।

অবশেষে সফল হল ও।

যা বলার ছিল বলে ফেলেছি। আমি আমার মোটিভ গোপন করেছিলাম, কারণ আমি হাতসুমির ব্যাপারে সত্যটা লুকাতে চেয়েছি। আমার জন্য যেসব অসুবিধার সৃষ্টি হয়েছে সেসবের জন্য আমি দুঃখিত। আশা করি এই লেখাটা আমার মনের অবস্থাটা সবাইকে বোঝাতে সাহায্য করবে।

যেকোনো শাস্তি মাথা পেতে নিতে প্রস্তুত আমি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *