অধ্যায় ৭ – অতীত (দ্বিতীয় পর্ব)

অধ্যায় ৭ – অতীত (দ্বিতীয় পর্ব)

পূর্ব-পরিচিত লোকজন (কাগার জিজ্ঞাসাবাদ)

জিজ্ঞাসাবাদ: জুনিচি হায়াশিদা

জানি না কাজে আসবে এমন কিছু আপনাকে জানাতে পারবো কি না। মিডল-স্কুল দীর্ঘদিন আগের ঘটনা! বিশ বছরেরও বেশি সময় আগের, ঠিক না? আমার স্মৃতি মন্দ নয়, তবে এসব তো পুরনো ইতিহাস। ০০০০০০

হিদাকা প্রসঙ্গে :

আপনাকে মিথ্যে বলবো না, সত্যি বলতে কয়েক সপ্তাহ আগেও আমার জানা ছিল না কুনিহিকো হিদাকা নামে কোনো লেখক আছে। দীর্ঘদিন কোনো উপন্যাস পড়িনি। জানি, আমার অনেক পড়া উচিত। আমি একজন নাপিত, সাম্প্রতিক বিষয় নিয়ে কথা বলতে হয় আমার খদ্দেরদের সাথে। কিন্তু পড়ার মত সময়টা পাই না। যাইহোক, পত্রিকা পড়ে কী ঘটেছে সেটা জানার পরই হিদাকার পরিচয় পেলাম। আমি পত্রিকা পড়ি অন্তত। সে আমার ক্লাসমেট ছিল সেটা বুঝতেই পারতাম না, যদি না পত্রিকায় নোনোগুচি ও হিদাকার অতীতের ওপর সামান্য আলোকপাত না করত। হ্যাঁ, ব্যাপারটা অবশ্যই অবাক করার মত, একসময় আমি একজন বেস্টসেলিং লেখক ও খুনি, উভয়ের সাথেই স্কুলে যেতাম!

নোনোগুচি প্রসঙ্গে:

গুচের কথা আমার অপরজনের থেকে বেশি ভালোভাবে মনে আছে। আমার মনে হয় না স্কুলে হিদাকা ওরকম বিশেষ কেউ ছিল; সে ওরকম ধরনের মানুষ যে আপনার মনে কোনো ছাপ ফেলতে পারবে না। ওরা দুজন বন্ধু ছিল, এটাও জানতাম না।

‘গুচ?’ হ্যাঁ, ওকে এই নামেই ডাকতাম আমরা। জানি না কেন, তবে নামটা মিলে গিয়েছিল। ও অনেকটা গুচের মতই ধীরস্থির। সবসময়ই পড়ত। মাঝেমধ্যে ক্লাসে তার পাশে বসতাম বলে মনে আছে আমার। জানি না কী পড়ত। তখনও আমার পড়াশোনার ব্যাপারে তেমন একটা আগ্রহ ছিল না। শুধু জানি ওগুলো কমিক্স বই ছিল না। কম্পোজিশন ক্লাসেও দারুণ করত ও। আমাদের হোমরুম টিচার শেখাত কম্পোজিশন। বলা চলে ওই টিচারের প্রিয় পাত্র ছিল নোনোগুচি।

হয়রানি প্রসঙ্গে:

হ্যাঁ, ওরকম কিছু হত। আজকাল খবরে বুলিয়িং নিয়ে অনেক আলোচনা হয়, তবে এগুলা সবসময়ই ছিল। আর যারা বলে ওসব ছিল না, ওরা জঘন্য। তখন পুরোদমে চলত এসব। পুরো ব্যাপারটাই তো জঘন্য তাই না?

আর নোনোগুচি, অনেক সময় সে-ও টার্গেটে থাকত। হ্যাঁ, বেশ বাজেভাবে মার খেয়েছে। ছেলেপেলে ওর লাঞ্চবক্স, টাকা কেড়ে নিত। দুই একবার দারোয়ানের ক্লোজেটেও বন্ধ করে রাখা হয়েছিল ওকে। ও ওরকম-ই ছিল, বখাটে ছেলেদের পছন্দের টার্গেট।

সেলোফোনে মোড়ানোর ঘটনা:

ওই যে রান্নাঘরে জিনিসপত্র মোড়ানোর কাজে ব্যবহৃত জয় ওই পেপার? হ্যাঁ, এরকম কিছু শুনেছিলাম আমি। কিন্তু আপনাকে বুঝতে হবে, এসব জিনিস সবসময়ই ঘটে।

হাইড্রাক্লোরিক এসিডের ঘটনা প্রসঙ্গে:

এই ব্যাপারে আমি শুনিনি, এমনটা ঘটে থাকতে পারে। অন্তত বলা যায়, নামী কোনো মিডল-স্কুল ছিল না ওটা। তবে মারপিটের জন্য ছিল বিখ্যাত।

“আপনি কখনো এসবে জড়িত ছিলেন?”

ব্যাপারটা নিয়ে আমি লজ্জিত, কিন্তু হ্যাঁ। মাঝেমধ্যে দুয়েকবার আমিও তাল মিলিয়েছি। যদিও অনেক অল্প। সত্যি বলতে সিরিয়াস কিছু নয়। সমস্যাটা হল, ঝামেলাবাজ ছেলেরা চাইতো আমাদের মত সাধারণ ছাত্ররাও যেন এসবে জড়িত হয়। এড়িয়ে চললে এদের পরবর্তি টার্গেট আপনিই

হবেন। ফলে ওদের সাথে তাল মেলাতে হত। ভয়াবহ লাগত আমার। মানে, দুর্বল, যাদের পাল্টা জবাব দেয়ার ক্ষমতা নেই, তাদের গায়ে হাত তুলতে কে-ই বা চায়? সবাই জানত কী চলছে। মনে আছে একটা ছেলের ব্যাগে একবার কুকুরের গু রেখে দিয়েছিলাম। আমাদের ক্লাস ক্যাপ্টেন ওই ছেলেটার পাশেই বসেছিল, সে দেখেও না দেখার ভান করে। ক্লাস ক্যাপ্টেন মেয়েটার নাম ছিল মাসুওকা। ওদেরকে সাহায্য না করলেও, অপরাধ করে পার পেয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা ঠিকই করে দিত। হ্যাঁ, এরা মানুষের পিছে লাগতে পছন্দ করত ঠিকই, কিন্তু আরও বেশি পছন্দ করত অন্যের হাত নোংরা করাতে। এসব বিষয়ে তখন ভাবিনি আমি।

ফুজিওর প্রসঙ্গে:

ওহ হ্যাঁ, ফুজিওকে ভোলার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। নিশ্চিতভাবেই আমি একমাত্র মানুষ ছিলাম না যে চাইত সে উধাও হয়ে যাক। বাজি ধরে বলতে পারি, শিক্ষকরাও চাইত দূরে কোথাও চলে যাক সে।

শালা ছিল একটা আস্ত ঘেড়েল। সরল-সোজা ছেলেদের জীবন দুর্বিষহ করে তোলা ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারত না। বয়সে বড় ছেলেদের চেয়েও লম্বা-চওড়া আর শক্তিশালী ছিল ফুজিও। ফলে কে আটকাতে যাবে তাকে? হেনস্থার শিকার ছেলেরা এটা বোঝার পর তার সাথে বন্ধুত্ব পাতিয়ে ফেলত। নিজেদের নিরাপদে রাখার জন্য শিকারীদের দলেই থাকতে চাইত। আমার মতে এই ব্যাপারটাই আরও উৎসাহিত করত ফুজিওকে, বুঝলেন? বখাটে ছেলের কথা উঠলেই সবাই ফুজিওর কথা বলত।

ফুজিও-ই কি নেতা ছিল?

হ্যাঁ, অবশ্যই। সে-ই সব হুকুম দিতো। আমি শুনেছি, ফুজিওর নির্দেশেই ছেলেপেলের থেকে লাঞ্চের টাকা কেড়ে আনতো তার সাঙ্গপাঙ্গরা। প্রথমে ফুজিওর হাতেই যেত টাকাগুলো, সে-ই ভাগ-বাটোয়ারা করত।

ইয়াকুজাদের থেকে কোনো অংশে কম ছিল না শালারা।

ফুজিওর প্রস্থান প্রসঙ্গে:

ভাই, আমরা কী যে খুশি হয়েছিলাম! শান্তি পেয়েছিলাম অবশেষে। সে চলে যাওয়ার পর অনেক কিছুতে পরিবর্তনও আসে। যেন সবার মনোভাবে বড় ধরণের পরিবর্তন এসেছিল। হ্যাঁ, কয়েকটা পচা ডিম থেকে গিয়েছিল যদিও, কিন্তু ফুজিও থাকাকালীন সময়ের মত কিছু ঘটেনি। যদিও কখনো জানতে পারিনি কি হয়েছিল ফুজিওর। গুজব ছিল অন্য স্কুলের ছাত্রদের সাথে মারামারি করার পর কিশোর সংশোধনাগারে পাঠানো হয় তাকে। তবে এত বড় কিছু ঘটেছিল কি না সন্দেহ, এরকম কিছু ঘটলে তো অন্তত স্থানীয় পত্রিকায় আসত।

আপনার কেসের সাথে কি ফুজিওর কি কোনো সম্পর্ক আছে, ডিটেক্টিভ? হিদাকাকে বই চুরির জন্যই খুন করেনি নোনোগুচি?

ফুজিও গ্যাংয়ের অন্যান্য সদস্য প্রসঙ্গে:

ওদের ব্যাপারে ধারণা নেই। সম্ভবত ওরা সবাই এখন সমাজে বেশ ভালো পর্যায়েই রয়েছে। সম্ভবত এখানেই কোথাও একটা ক্লাস রোস্টার আছে। যদিও ওটাতে থাকা নম্বর ও ঠিকানা পুরনো। দাঁড়ান, আমি নিয়ে আসছি…

জিজ্ঞাসাবাদ: হারুমি নিতা

মিস্টার হায়াশিদার কাছ থেকে আমার নাম জেনেছেন? জুনিচি হায়াশিদা? এমনকি, আমার ক্লাসে হায়াশিদা নামের কেউ ছিল বলে মনে পড়ছে না। না, না ছিল একজন। ভুলে গিয়েছিলাম আমি।

তো কোথায় থেকে শুরু করবো? আমার কুমারী নাম মাসুওকা, হ্যাঁ, আমি ক্লাস ক্যাপ্টেন ছিলাম। প্রত্যেক বছর একটা ছেলে ও একটা মেয়েকে ক্যাপ্টেন নির্বাচিত করত ওরা। এমন কোনো দায়িত্ব ছিল না আমাদের কাঁধে। আমাদের শুধু নিশ্চিত করতে হত সবাই হোমওয়ার্ক বুঝে নিয়েছে কি না, সেইসাথে শিক্ষকদের দেয়া মেসেজ পৌঁছে দিতে হত সবাইকে। ওহ, হোমরুমে স্টুডেন্ট মিটিংয়ের ব্যবস্থা করতে হত আমাদেরকে। ভাই, এই শব্দগুলো অনেকদিন পর উচ্চারণ করছি। আমার কোনো সন্তান নেই।

হিদাকা ও নোনোগুচির প্রসঙ্গে:

দুঃখিত, ওই দুজনের ব্যাপারে কিছুই মনে নেই বললেই চলে। আমি শুধু মেয়েদের সাথেই মিশতাম। মিডল-স্কুলে এরকমই হয় আরকি।

হয়রানী প্রসঙ্গে:

ছেলেদের মধ্যে সম্ভবত বুলিয়িং চলত, কিন্তু আমি ওরকম কিছু লক্ষ করিনি। লক্ষ করলে কী করতাম সেটা বলা কঠিন। সম্ভবত টিচারকে জানানো ভালো একটা পদক্ষেপ হতে পারত।

দুঃখিত…কিছুক্ষণের মধ্যে আমার স্বামী চলে আসবে। যা জানতে চেয়েছেন সেটা পেয়ে গেলে আমরা এই আলাপ শেষ করতে পারি কি? মনে হয় না আমি খুব একটা বেশি সাহায্য করতে পারবো। আর আমি যে ওই মিডল-স্কুলে পড়তাম সেটা আপনি যদি কাউকে না বলেন তাহলে খুশি হব। ব্যাপারটা একটু জটিল। আমি আমার স্বামীকেও জানাইনি। ধন্যবাদ।

জিজ্ঞাসাবাদ: মাসাতোশি সুবুরায়া

আসার জন্য ধন্যবাদ। ভেতরে আসছেন না কেন? আপনি চাইলে ভেতরে হলে বসে কথা বলতে পারি আমরা।

হিদাকা ও নোনোগুচি প্রসঙ্গে:

নিশ্চিতভাবেই ওদের কথা মনে আছে আমার, যদিও আমি রিটায়ার্ড। দশ বছর হল অবসর নিয়েছি আমি। কিন্তু আমার ক্লাসের প্রত্যেকটা ছাত্রের কথাই মনে আছে। বাচ্চাদের সাথে অনেক সময় কাটালে এদেরকে বেশ ভালোভাবে চেনা যায়। ওই স্কুলে আমি শিক্ষকতা শুরুর পর আমার প্রথম ক্লাসের ছাত্র ছিল ওরা দুজন। প্রথম ব্যাচের ছাত্রদের তো ভোলা যায় না। কম্পোজিশনে বেশ ভালো ছিল নোনোগুচি। প্রত্যেক পেপারে হয়ত ১০০ পেত না, কিন্তু ওই বিষয়টাতে দক্ষতা ছিল ওর। আর হিদাকা, নাহ, স্কুলের কাজে ও আমার মনে খুব একটা বেশি ছাপ ফেলতে পারেনি। ভালো মন্দ কিছুই ছিল না ও।

হয়রানীর প্রসঙ্গে:

আমার মনে হয় না হিদাকা খুব বেশি বুলিয়িং বা হয়রানীর শিকার হয়েছে। নোনোগুচি তো হয়নি-ই। অনেক খারাপ ছেলে ছিল ঠিকই কিন্তু তার ব্যাপারে আমি কিছুই শুনিনি।

হায়াশিদা বলল সে নির্যাতিত হত…

আচ্ছা, ব্যাপারটা শুনে অবাক হলাম! সত্যিই আমার কোনো ধারণা নেই! আর আমার দিকে ওভাবে তাকানোর দরকার নেই, ডিটেক্টিভ। সত্যিই বলছি আমি। এখন তো এসব নিয়ে মিথ্যে বলে লাভ নেই, ঠিক না?

দেখুন, আমি বলেছি নোনোগুচির সাথে হয়রানীর ঘটনা ঘটেনি। উল্টো নোনোগুচি সমীকরণের বিপরীত দিকে থেকে থাকতে পারে। একসময় বাজে ছেলেদের সাথে মেশা শুরু করে ও। আমি তখন ওকে নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলাম। এমনকি ওর বাবা-মা এসেও আমার সাথে আলাপ করে যায়। আমার মনে আছে ওকে আলাদা ডেকে এই ব্যাপারে কথা বলি আমি।

নিশ্চিতভাবেই একটা বাচ্চা যখন বাজে সঙ্গের পাল্লায় পড়বে তখন ভালো পথে ফিরিয়ে আনা মুশকিল, যদি না সে কারোর কাছ থেকে সহযোগিতা পায়। বলছি না, আমি, ওর বাবা-মা অথবা অন্য কেউ ওকে সহায়তা করেছে। ওর বন্ধু হিদাকাই ওকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনে। হিদাকাকে দেখলে বোঝা যায় না, কিন্তু মানসিকভাবে বেশ শক্ত ছিল সে। মানুষের বিরুদ্ধে হওয়া অন্যায় চুপচাপ সহ্য করত না। এমনকি আমরা শিক্ষকরা ক্লাসে কঠোর আচরণ করলে আমাদেরও ছেড়ে কথা বলত না।

সম্ভবত একবার নিউ ইয়ারের দিকে এই দুজন আমার বাড়িতে বেড়াতে এসেছিল। মনে হয় হিদাকাই সাথে নিয়ে এসেছিল নোনোগুচিকে। বেশি কিছু বলেনি ওরা, তবে মনে হয় ক্লাসে আমার ওপর খেদ দেখানোর জন্য আমার কাছে ক্ষমা চাইতে এসেছিল।

ভেবেছিলাম এই দুজন সারাজীবন বেস্ট ফ্রেন্ড থাকবে। কিন্তু দুজনকে ভিন্ন হাইস্কুলে চলে যেতে দেখে অবাক হই আমি। দুজনই ক্লাসে মোটামোটি ভালোই করত। আমার মনে হয় না চাইলে একই হাইস্কুলে ভর্তি হওয়া ওদের জন্য কঠিন কিছু হত।

যা ঘটেছে সেটা লজ্জাজনক। জানি না সমস্যাটা কোথায় ছিল। ওদের কারোর কাছ থেকেই আমি এমনকিছু আশা করিনি।

জিজ্ঞাসাবাদ: তোমোয়ো হিরোশাওয়া

নোনোগুচি ছেলেটা? হ্যাঁ, অবশ্যই মনে আছে তাকে।আমাদের প্রতিবেশি ছিল ওরা। প্রায়ই ব্রেড কিনতে আসত আমাদের দোকানে। দশ বছর আগের ঘটনা এটা।

খুন প্রসঙ্গে:

এবার অবাক হলাম। ওই দুজন ছেলে? ওরা এমনকিছু করেছে? অবাক হওয়ার জন্য যথেষ্ট এই তথ্য।

নোনোগুচির শৈশব প্রসঙ্গে:

তার ব্যাপারে খারাপ কিছু বলতে চাই না আমি। তবে ছোট্ট ওসামুর…একটা অন্ধকার দিক ছিল বলা চলে। মাঝেমধ্যে প্রাপ্তবয়স্কদের মত আচরণ করত, মাঝেমধ্যে খুবই বিষন্ন থাকতো।

সম্ভবত এটা তার এলিমেন্টারি স্কুলে পড়ার সময়কার কথা। তখন ঠিকমত স্কুলেও যেত না সে। একদিন তাকে তার বাড়ির দুই তলায় দেখতে পেয়ে ডাক দিই।

“ওসামু, অসুস্থ নাকি? ঠান্ডা লেগেছে?”

কিন্তু ডিটেক্টিভ, কোনো জবাব দেয়নি সে। তার মত একটা বাচ্চা! মাথাটা ঘুরিয়ে পর্দা টেনে দিয়েছিল শুধু। ব্যাপারটা একটু অদ্ভুত-ই ছিল সত্যি বলতে। রাস্তায় মাথা নিচু করে একমনে হেঁটে যেত, কোনদিকে তাকাত না।

একবার শুনি সে একটানা দীর্ঘদিন স্কুলে যায়নি। কারণটা জানতাম না আমি, কিন্তু সবাই বলত দোষটা বাপ-মা’র। দুজনেই কাজ করত, ভালোই ছিল ওরা, তবে কোনকিছুই যথেষ্ট মনে করত না। জানেন তো মাঝেমধ্যে মানুষ কেমন হয়। বাচ্চার ওপর যত্ন নিতে গিয়ে অতিরিক্ত করে ফেলত। মনে আছে, একবার ওর মা ওকে প্রাইভেট এলিমেন্টারি স্কুলে পাঠানোর প্রসঙ্গে বলেছিল-”আমাদের ভালো যোগাযোগ নেই, এজন্য ওসামুকে স্থানীয় ওই নিম্নমানের স্কুলেই দেব।”

অদ্ভুত! নিম্নমানের? আমার ছেলে-মেয়ে দুজনেই ওই স্কুল থেকে ভালোভাবেই পাশ করেছে। এজন্য আমি কৃতজ্ঞ।

ওদের পরিবারটা এখানে মানিয়ে নিতে পারেনি। আমার মনে হয় মিস্টার নোনোগুচির কাজের কারণেই এই এলাকায় আসে ওরা। যদি ওরা এই মফস্বলকে খাটো করেই দেখে থাকে, তাহলে সম্ভবত ওরা এখানে কোনো অভিজাত এলাকা থেকেই এসেছিল।

যাইহোক, বোঝাই যায় কেন ওদের সন্তান স্কুলে যেত না। স্কুল সম্পর্কে বাবা-মার মনোভাব এমন থাকলে তো এমনই হবে। গাছ যেমন ফলও তেমন। তবে ছেলে একেবারে স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিলে উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে ওরা। কখনো স্কুলে পাঠানোর জন্য জোর করতে দেখিনি ওদেরকে।

ওসামুর আবারও স্কুলে যাওয়ার একমাত্র কারণ কুনিহিকো। হ্যাঁ, হিদাকা ছেলেটা। যে খুন হয়েছে। প্রতিদিন সকালে সে ওসামুর বাড়িতে এসে ওকে নিয়ে স্কুলে যেত। জানি না এই ব্যবস্থাটা কে করেছিল। যেহেতু ওরা একই ক্লাসে পড়ত সেহেতু কোনো শিক্ষক হয়ত হিদাকাকে এটা করতে বলে।

প্রতিদিন সকালেই ওদেরকে দেখতাম আমি। আমার বাসার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় উচ্চকণ্ঠে ‘হ্যালো’ বলত হিদাকা। মনে মনে বলতাম, ছেলেটা ভদ্র। একটু পর দেখতাম বিপরীত দিক থেকে ওসামুর সাথে হেঁটে আসছে সে। অবাক হতাম, কুনিহিকো আবারও হাই বললেও ওসামুর মুখ দিয়ে একটা শব্দও উচ্চারিত হত না। মাথা নিচু করে নিজমনে হাটত। প্রতিদিনই।

ভাবতাম,হঠাৎ করে কি কারণে স্কুলে নিয়মিত যাওয়া শুরু করল ওসামু। তাকে কলেজে ভর্তি হতে দেখে মনে হত ছেলেটার কুনিহিকোর প্রতি কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। যা ঘটেছে এরপর আবারও নতুন করে ভাবতে বাধ্য হচ্ছি।

“ওরা কি আসলেও দুজন বন্ধু ছিল?”

প্রায়ই ওদের দুজনকে খেলতে দেখতাম। ফুটন শপের ছেলেটার সাথে মিশত ওরা। আমি অনেকটাই নিশ্চিত, ওদের আড্ডার মধ্যমণি ছিল কুনিহিকোই। কিন্তু সবকিছু ভালোই চলছিল।

শুধু ওসামুর সাথেই ভালো ব্যবহার করত না কুনিহিকো, সব ছেলেদের সাথেই ওর ব্যবহার ভালো ছিল। বিশেষ করে বাচ্চাদের সাথে। এজন্যই যা ঘটেছে সেটা বিশ্বাস করতে খুবই কষ্ট হচ্ছে।

জিজ্ঞাসাবাদ: ইউকিও মাতসুশিমা

জানি না কী বলবো। খবরটা শুনে জ্ঞান হারাতে বসেছিলাম। নাম দুটো শুনে স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ি। এলিমেন্টারি স্কুলে ওদের সাথে খেলতাম, কথাটা সত্যি। আমার বাবা-মা একটা ফুটন শপ চালাত। ওয়্যারহাউজ থেকে ফুটন নিয়ে আসতে সমস্যা হত সবসময়ই।

তবে সত্যি বলতে, আমরা বেস্টফ্রেন্ড টাইপ কিছু ছিলাম না। ওই এলাকাতে আমাদের বয়সি আর কেউ ছিল না বলে একসাথে খেলতাম আরকি। এলিমেন্টারি স্কুলের শেষের দিকে আমার অন্যান্য বন্ধুদের সাথে বেশি মেশা শুরু করি। ওদের কেউ কেউ দূরেও থাকত।

হিদাকা ও নোনোগুচির মধ্যকার সম্পর্ক প্রসঙ্গে:

আচ্ছা, এদের দুজনকেও ভালো বন্ধু বলতে পারবো না আমি। নিশ্চিত নই, ওদেরকে কি বলা যেতে পারে।

রাস্তার ধারের দোকানী মিসেস হিরোশাওয়া বলতেন ওরা বন্ধু। আসলে প্রাপ্তবয়স্করা ছোটদের ব্যাপারে যেমনটা ভাবে আর কি।

ব্যাপারটা হল ওদের মধ্যকার সম্পর্ককে ঠিক ‘সমতা’ বলা যাবে না। হিদাকা সবসময়ই নিজেকে বড় ভাবত। নোনোগুচিকে স্কুলে সাহায্য করার পর থেকেই সম্ভবত হিদাকার মধ্যে এই মনোভাব তৈরি হয়। ওর ওপর কোনকিছু চাপিয়ে দিত না হিদাকা, তবে তার আচরণ দেখেই আঁচ করা যেত এমনকিছু। হিদাকা ছিল সবসময়ই নেতা আর নোনোগুচি তার অনুসারী। মাঝেমধ্যে ব্যাঙ ধরতে যেতাম আমরা। সবসময়ই নোনোগুচিকে নির্দেশনা দিত হিদাকা, বলে দিত কি করতে হবে। যেমন: জায়গাটা বিপজ্জনক, ধরার আগে ভালোমত পজিশন নাও, জুতো খুলে নিও এসব। অনেকটা মা মুরগীর মত আচরণ ছিল তার কিংবা বড় ভাইয়ের মত। যদিও দুজনের বয়স সমান। আমার মতে এই ব্যাপারটা মানতে পারত না নোনোগুচি। হিদাকার অগোচরে কথা বলত নোনোগুচি। সরাসরি মুখের ওপর কিছু বলত না যদিও।

সত্যি বলতে, আমি অনেকটাই নিশ্চিত, ওদের সাথে আমি খেলা বন্ধ করে দেয়ার পর ওরাও একে অপরের সাথে আর খেলত না। এর অন্যতম কারণ নোনোগুচি স্কুলের পর আরেকটা প্রোগ্রামে ভর্তি হয়। এর কারণে খেলার সময়টা বাদ পড়ে। আমার এটাও মনে হয়, নোনোগুচির মা হিদাকাকে পছন্দ করত না। নোনোগুচির সাথে ওর মায়ের আলাপ আড়াল থেকে একবার শুনে ফেলি আমি। “আশা করছি ওই ছেলেটার সাথে তুমি মিশছ না।” বলেছিল সে। বিরক্ত দেখাচ্ছিল তার চেহারা। ওরকম চেহারা রাতে দুঃস্বপ্ন দেখার জন্য যথেষ্ট। ছোট ছিলাম, বুঝতে পারিনি। ভেবেছিলাম হিদাকার সাথে খেললে কি হবে? পরিবারের সমস্যাটা কোথায়? এমনকি আমি আজও জানি না, কেন ওই কথাটা বলেছিল ওর মা।

নোনোগুচির স্কুল না যাওয়া প্রসঙ্গে

আমি ঠিক নিশ্চিত নই, তবে আমার মতে ওই স্কুলে ঠিক মানিয়ে নিতে পারত না। মনে হয় কখনোই তার খুব বেশি বন্ধু ছিল। একবার শুনেছিলাম অন্য একটা ভালো স্কুলে ট্রান্সফার হওয়ার কথা ভাবছে ও। কিন্তু সেটা আর ঘটেনি। এরপর এই প্রসঙ্গে আর কথা বলেনি। আপনার জন্য এটুকুই বলার ছিল আমার। আর কিছু মনে করতে পারছি না আমি। কয়েক দশক আগের ঘটনা এসব।

খুন প্রসঙ্গে:

কী শুনতে চান আমার কাছ থেকে? আমি অবাক হয়েছি, ভাই। যদিও ওদেরকে ছোটবেলায় চিনতাম, একারণে পুরো ঘটনা জানি না। কিন্তু এমন কিছু ঘটবে আশা করিনি। নোনোগুচিকে গোস্টরাইটার হিসেবে ব্যবহার করত হিদাকা, এটাও না। হয়তো নোনোগুচির সাথে একটু প্রভাব খাটানোর চেষ্টা করত সে, কিন্তু কখনোই জোরজবস্তি করেনি। আর একটু হলেও হিদাকার ন্যায়বিচার জ্ঞান ছিল। অবশ্যই মানুষ বদলায়, সেটা বেশিরভাগ খারাপের দিকেই।

জিজ্ঞাসাবাদ: জুনজি তাকাহাশি

কখনোই কল্পনা করতে পারিনি এখানে একজন ডিটেক্টিভ এসে আমাকে এই ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করবে। সত্যি বলতে পত্রিকায় ঘটনাটা পড়ার আগপর্যন্ত ওই দুজনকে আমার সেভাবে মনে ছিল না। সেরকমও বন্ধু তো দূরে থাক কিছুই ছিলাম না আমরা। তাহলে আমার সাথে এর কী কাজ? আর ওই গোস্টরাইটিংয়ের ব্যাপারটা? ভাই, সাহিত্য থেকে আমি এক শ’ হাত দূরে থাকা মানুষ। একই পৃথিবীতে বসবাস করার পরও সাহিত্যের কাছাকাছি যাওয়ার কোনো খায়েশ আমার নাই। (হাসি)

মিডল স্কুল প্রসঙ্গে:

ভাই, ওই জায়গা থেকে বের হওয়ার পরই ওটার কথা ভোলার চেষ্টা করেছি! আর হায়াশিদা আপনাকে আমার কথা বলেছে? শালা জানেও না কোথায় থামা উচিত। (হাসি)

হয়রানির প্রসঙ্গে:

আজকাল এই ব্যাপারে লোকে এমনভাবে কথা বলে যেন এটা বিশাল কোনো সামাজিক সমস্যা। আমিও এই কাজ টুকটাক করেছি ওইসময়। আরে ভাই, বাচ্চা ছিলাম আমরা। আর আমার মতে টুকটাক এসব করা মন্দ নয়। এমন নয় কোনো অজুহাত দিচ্ছি। কিন্তু বড় হয়ে বাস্তব জগতে পা রাখলে অনেক বাজে জিনিস-ই অপেক্ষা করে আমাদের জন্য, ঠিক না? তো স্কুল হল ওসবের জন্য প্রস্তুত হওয়ার মঞ্চ। কঠিন ব্যাপার-স্যাপারের মধ্যে দিয়ে গেলে মানুষ একটু শক্ত ও জ্ঞানী হয়। এমনটাই আমার ধারণা। আজকাল মানুষ বুলিং ব্যাপারটা নিয়ে খুব উচ্চবাচ্য করে। আরে ভাই, এটা তো বাচ্চাদের মামলা।

ওইসময়ে কি ঘটত এই ব্যাপারে যদি সত্যি কথা বলতে চান, তবে আমার সাথে আলাপ করার থেকেও ভালো উপায় আপনার হাতে আছে।

আমার কথা বলতে সমস্যা নাই, কিন্তু আমি অনেক কিছু ভুলে গিয়েছি। সবকিছু মনে রাখা মাঝেমধ্যে কঠিন। গতকালকে যা ঘটেছে সেই ব্যাপারে কথা বলতে গিয়েও মাঝেমাঝে খেই হারিয়ে ফেলি ভাই! (হাসি)

সবথেকে ভালো হয় আপনি যদি ওই হিদাকার নামে বের হওয়া ওই বইটা পড়েন। কি যেন নাম বইটার? নিষিদ্ধ শিকারী না কি যেন?

নিষিদ্ধ প্রান্তর?

হ্যাঁ, এটাই। আপনি এই বইটার নাম শুনেছেন, ডিটেক্টিভ? বইটা পড়লে এত ঝামেলা করে আমার কাছে আসার কোনো প্রয়োজন পড়ত না আপনার। যাইহোক, বই-টই পড়ি না আমি। কিন্তু খুনটার কথা জানার পর ভাবলাম বইটাতে একটু চোখ বুলাই। সেবারই প্রথম লাইব্রেরিতে যাই আমি। লাইব্রেরিতে গিয়ে নার্ভাস লাগছিল, যেন কোনো ঝামেলায় পড়তে চলেছি। (হাসি)

তো বইটার ব্যাপারে শোনার পরই বইটা পড়লাম। বিশেষ করে, ফুজিওর আদলে যে চরিত্রটা বানানো হয়েছে সেই অংশটুকু পড়ে মনে হল এটা আমাদের মিডল-স্কুলের ওপর ভিত্তি করেই লেখা। তো ভাবলাম, বইয়ের কোনো জায়গায় আমিও হয়তো আছি।

আপনি বইটা পড়েছেন, ডিটেক্টিভ?

যাইহোক, বইয়ে লেখা সবকিছুই সত্যি। এই ব্যাপারে কাউকে কিছু বলবেন না আশা করি। মনে হতে পারে উপন্যাসের কাহিনীর খাতিরে সবকিছু বানানো, কিন্তু প্রত্যেকটা ঘটনাই একেবারে নিরেট সত্য, কোনো ভেজাল নাই। অবশ্যই পরিবর্তন করা হয়েছে নামগুলো। কিন্তু বাকিসব যেভাবে ঘটেছে সেভাবেই লেখা। পড়লেই বুঝবেন। এমনকিছু ঘটনাও আছে এতে যা আমি ভুলে গিয়েছি।

“একটা ছেলেকে সেলোফেনে পেঁচিয়ে জিমের কোণায় ফেলে রাখার ঘটনাটা কি মনে আছে আপনার?”

ভাই, এই অংশটা পড়ার সময় পাগলের মত ঘামছিলাম। (হাসি) দেখেন, পুরো ব্যাপারটার দায়িত্বে আমিই ছিলাম। এমন নয় এটা নিয়ে আমি গর্বিত। কিন্তু একটা বাচ্চার জন্য তো ব্যাপারটা বেশ মজার-ই ছিল, ঠিক না?

যাইহোক, পরিকল্পনাটা ছিল ফুজিওর। ব্যাটা নিজে বেশি কিছু করত না, শুধু নির্দেশ দিত। এমন না সে আমাদের লিডার ছিল। কিন্তু ওর সাঙ্গপাঙ্গদের সাথে থাকলে ভালো সময় কাটত। এজন্য থাকতাম। (হাসি)

ধর্ষণ প্রসঙ্গে:

এই ব্যাপারে তেমন জানি না আমি। সত্যিই জানি না। শুধু জানতাম ওর নজর পড়ে এক মেয়ের ওপর। মেয়েটা উচ্চতায় খাটো, লম্বা চুল কিন্তু দেখতে সুন্দর ছিল। আর ফুজিওর চেহারা ছিল গরিলার মত। কিন্তু ওই ছোটখাটো মেয়েটাকে মনে ধরেছিল ওর। এমন মেয়েই পছন্দ করত শালা। বইয়েও এই ব্যাপারে লেখা আছে। পড়ে অবাক হয়েছি। লেখক নিজের কাজে দক্ষ। গুচ যদি লেখে সেক্ষেত্রে ঠিক আছে।

এরপর ফুজিওর মাঝেমধ্যেই উধাও হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা?

বইয়ে লেখা আছে প্রায়ই ষষ্ঠ পিরিয়ডের মাঝে বেরিয়ে যেত সে, মানে স্কুল শেষ হওয়ার আগেই। কিন্তু কথাটা পুরোপুরি ঠিক নয়। ষষ্ঠ পিরিয়ডের মাঝামাঝি সময়ে নয়, যেত ওই পিরিয়ডটা শেষ হলে। এজন্য দিনের শেষে কখনোই হোমরুমে দেখা যেত না ওকে। কোথায় যেত এই ব্যাপারে বইয়ে ঠিকই লেখা হয়েছে। একটা রাস্তা দিয়ে ওই সুন্দরি মেয়েটা প্রতিদিন একা হেঁটে বাড়ি ফিরত। সেখানেই যেত ফুজিও। কখনোই আমাদের কাউকে সঙ্গে নেয়নি। একাই যেত। ফলে বলতে পারলাম না কি করত গিয়ে। শুধু বলতে পারি, বইয়ে যা বলা হয়েছে ওরকম কিছুই করত হয়তো। কোনো গাছের আড়ালে লুকিয়ে, মেয়েটাকে দেখে নিজের পরিকল্পনা সাজাত। ভাবলেই বোঝা যায় ব্যাপারটা ভয়ঙ্কর।

মেয়েটার সাথে ওই কাজটা করার সময় ছাড়া একা ছিল না ফুজিও। সাথে করে কাউকে নিয়ে যেত সে। জানি না কাকে। সত্যিই জানি না। এমন নয় কাউকেই বাঁচানোর চেষ্টা করছি। কেন চেষ্টা করবো? ওটা তো আর আমি নই। দেখেন, কিছু খারাপ কাজ করেছি আমি। তাই বলে কাউকে ধর্ষণ করতে সাহায্য করিনি। বিশ্বাস করতে হবে আপনাকে এটা।

“মাত্র একজন-ই ছিল?”

জানি বইয়ে কী লেখা আছে। কয়েকজন মিলে নজরদারী করা, ভিডিও ক্যামেরায় ব্যাপারটা ধারণ করা। কিন্তু ব্যাপারটা আসলে এমন নয়। মাত্র একজন-ই ছিল, যে চেপে ধরেছিল মেয়েটাকে। আর কোনো ভিডিওটেপ নয়, ছিল কেবল একটা ছবি। যা শুনেছি, ছবিটা ফুজিও নিজেই একটা পোলারয়েড ক্যামেরা দিয়ে তোলে। জানি না ছবিটার কী হয়েছে। তবে ইয়াকুজার কাছে ভিডিওটেপ বিক্রির কাহিনী পুরোটাই বানোয়াট। ছবিটাও কখনো দেখিনি। যদিও ওইসময় দেখতে চেয়েছিলাম। (হাসি) কিন্তু এটা আমার হাত পর্যন্ত এসে পৌছায়নি।

আসলে যদি কেউ কিছু জেনে থাকতে পারে তাহলে সে হল নাকাতসুকা। ফুজিওর ডান হাত ছিল সে। আর ফুজিও নিজের জিনিসপত্র তার কাছে রাখত। যদি কখনো ওকে পুলিশ সার্চ করে এই ভয়ে। ফুজিও যদি কাউকে ছবিটা দিয়ে থাকে তবে নাকাতসুকাকেই দিয়েছে। যদিও আমার সন্দেহ তার কাছে এখনও ওটা আছে নাকি।

তার সাথে যোগাযোগের ঠিকানা নেই আমার কাছে। তবে তার প্রথম নাম আকিও। আকিও নাকাতসুকা।

নোনোগুচি আপনাকে এই ব্যাপারে কিছু বলেনি? আমি নিশ্চিত, ও তো এসবের বেশিরভাগ-ই জানে। এজন্যই তো বইটা লিখতে পেরেছে। হয়তো এসব ব্যাপারে কথা বলা কঠিন এখনো।

কেন কঠিন?

ভাই, কে চাইবে ছোটবেলায় ঘটানো সব বাজে ঘটনা টেনে আনতে? বেশিরভাগই ওসব ভুলে গিয়ে সামনে এগোতে চায়।

নোনোগুচিও কি হেনস্তাকারী ছিল?

হ্যাঁ, তবে বেশিদিন নয়। ফুজিও ওকে কখনো সিরিয়াসলি নেয়নি, অন্তত প্ৰথমে নয়। ফুজিওর নজর ছিল হিদাকার ওপর। ভাবত, ছেলেটা নিজেকে বড় ভাবে। সবকিছু দিয়ে চেষ্টা করত হিদাকাকে শায়েস্তা করতে। কিন্তু হিদাকা পিছু হাটার পাত্র ছিল না। ফলে আরও খারাপ হয়ে ওঠে ফুজিও, শিক্ষা দিতে চায় হিদাকাকে। আর এই ব্যাপারগুলোই বইয়ে লেখা হয়েছে।

হিদাকাই তাহলে সেই ভিক্টিম?

হ্যাঁ, ঠিক। হিদাকাকেই আমরা সেলোফেনে পেঁচিয়ে রেখেছিলাম। জানালা দিয়ে এসিডটাও তাকে লক্ষ করেই ফেলা হয়েছিল।

নোনোগুচি নয়?

না না, গুচ আমাদের সাথেই থাকত তখন। আমাদেরই একজন ছিল। ওর মত আর কোনো চ্যালা ফুজিওর ছিল না। যেকোনো ছোটখাটো কাজ ওকে দিয়েই করাতাম আমরা।

হিদাকা ও নোনোগুচি বন্ধু ছিল না?

সেরকম নয়। জানি না গ্র্যাজুয়েশনের পর ওদের সম্পর্ক কেমন ছিল। সব পত্রিকায় ওদেরকে ভালো বন্ধু বলা হয়েছে। ওরা ভালো বন্ধু হলেও সেটা মিডল-স্কুলের পর হয়েছে। ওদেরকে যে সময় আমি চিনতাম তখন ওরা মোটেও ভালো বন্ধু ছিল না। সত্যি বলতে, নোনোগুচি সবসময়ই ফুজিওর কাছে হিদাকার ব্যাপারে কথা লাগাত। বলত, হিদাকা নাকি তার পিঠ পিছে কথা বলে। এসব না শুনলে আমার মনে হয় না হিদাকাকে শিক্ষা দেয়ার জন্য উঠে পড়ে লাগত ফুজিও।

হামাওকা প্রসঙ্গে:

হ্যাঁ, এই চরিত্রটা হিদাকার আদলেই বানানো। কোনো সন্দেহই নেই জানি, বইটা লিখেছে নোনোগুচি। যেহেতু হামাওকা নামটা ব্যবহার করতে হয়েছে তাকে, এটাই কি বইয়ের কেন্দ্রীয় চরিত্র?

বইয়ের কোন চরিত্রটা নোনোগুচি?

বলা কঠিন। নিপীড়নকারীদের মধ্যে একজন হবে হয়তো।

যদিও ব্যাপারটা ঠিক যৌক্তিক নয়, ঠিক না? একজন নিপীড়নকারীর নিজের ভিক্টিমের নামে বই প্রকাশ করা? এর কারণ কি?

জিজ্ঞাসাবাদ: কোইচি মিতানি

দ্রুত আলাপ সারলে খুশি হবো। আমার একটা মিটিং আছে।

আমি ঠিক জানি না, আমার সাথে আলাপ করে কি জানার চেষ্টা করছেন আপনি। জানি আপনারা ডিটেক্টিভরা সন্দেহভাজনের অতীত ভালোমত খুঁটিয়ে দেখেন। কিন্তু নোনোগুচির সাথে আমার শেষ দেখা হয়েছে হাইস্কুলে।

আমি তার এলিমেন্টারি স্কুলের বন্ধুদের সাথেও কথা বলেছি।

ওয়াও, এত পেছনে গিয়েছেন আপনি? জানি না কি বলবো।

এতকিছুর আসলেই দরকার ছিল কি? আপনাকে কিন্তু আপনার কাজের ব্যাপারেই জ্ঞান দিচ্ছি না আমি। (হাসি)

তো, নোনোগুচি খুবই সাধারণ একজন হাইস্কুল ছাত্র ছিল। বিশেষ কিছু ছিল না ওর মধ্যে। আমরা অনেক কথা বলতাম। কেননা আমাদের বই ও মুভির পছন্দে মিল ছিল।

লেখক হওয়ার ব্যাপারে কিছু বলত সে?

হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। আমাকে বলেছিল এটাই ওর জীবনের লক্ষ্য।

মনে আছে নোটবুকে কিছু ছোটগল্প লিখে ওগুলো আমাকে দেখায় ও। ওগুলোর বেশিরভাগের কথাই আমার মনে নেই। তবে যতদূর মনে পড়ে, সায়েন্স ফিকশন বেশি লিখত। বেশ ভালো ছিল গল্পগুলো, অন্তত একজন হাইস্কুলের ছাত্রকে বিনোদন দেয়ার জন্য যথেষ্ট।

নোনোগুচির হাইস্কুল নির্ধারণ প্রসঙ্গে :

ঠিক জানি না। তবে সম্ভবত ওর মিডল-স্কুলের গ্রেড আমাদের স্কুলে ভর্তি হওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল?

দাঁড়ান, আপনার কথাতে মনে পড়ল, একবার ও বলেছিল ওর বাসার ওখানে ভর্তি হওয়ার মত আরেকটা হাইস্কুল ছিল, কিন্তু কিছু কারণে সেখানে ভর্তি হয়নি ও।

কি কারনে সেটা বলেছিল?

সম্ভবত স্কুল নয়, এলাকাটাই মূল কারণ ছিল। পুরো এলাকাটার প্রতিই বিতৃষ্ণা কাজ করতো ওরা।

মিডল স্কুলের কথা কিছু বলেছিল আপনাকে?

শুধু বলেছিল ওখানকার ছেলে-মেয়েরা খুব নিম্নমানের ছিল। বিশ্বাস করতে পারেন? নিম্নমানের মফস্বলের নিম্নমানের স্কুল, নিম্নমানের ছাত্রছাত্রি। এরকম কিছুই বলেছিল। এমনিতে বেশ ভালো ছিল ও। কিন্তু কোথায় থেকে এসেছে এই প্রসঙ্গ উঠলেই অনেক কথা বলত। স্পষ্ট মনে আছে বিরক্ত হয়ে যেতাম আমি। মানে একাধিকবার এই একই কথা বলেছে ও। হ্যাঁ, তখন বেশ অদ্ভুত এক ছেলে ছিল ও। শৈশবের বেড়ে ওঠা শহরকে অনেকেই সেরা মনে করে, ঠিক না?

আমার মনে হয়, ওর মনে হত বাবার কাজের কারণে অন্য জায়গায় চলে যাওয়াটা খারাপ হয়েছিল ওর জন্য। আমাকে বলত ওই এলাকার অস্থায়ী বাসিন্দা ওরা, এজন্য ওখানকার কাউকে চেনে না। আর এলাকার কোনো বাচ্চার সাথে খেলতও না। অবশ্যই এসবে বিষয়ে আমার কিচ্ছু যায় আসত না। আমাকে এসব বলত ও, এই যা। যেন এসব বলে কোনো অজুহাত দিত আমাকে। তবে ওই এলাকা ছাড়েনি ওরা। অন্তত যখন ওকে চিনতাম তখন পর্যন্ত।

আরেকটা ব্যাপার আছে…যতদূর জানি একটা সময় গিয়ে কোনো একটা কারণে এলিমেন্টারি স্কুল বদলানোর চেষ্টা করেছিল। কিন্তু ওরা ওকে স্কুল বদলাতে দেয়নি কারণ স্কুলে নিয়মিত ছিল ও। ওর মতে ব্যাপারটা ছিল দুর্ভাগ্যজনক। “দিনের পর দিন ওই জঘন্য জায়গায় যাওয়া আর শাস্তি পাওয়া একই কথা।” বলেছিল এলাকায় একটা ছেলে ছিল যে প্রত্যেক সকালে ওর বাসায় আসত ওকে নিতে। ওই ছেলের সাথে হেঁটে স্কুলে যেত ও। ব্যাপারটা পছন্দ ছিল না ওর। যেন ওকে টেনে নিচে নামানোর জন্য এটা ছিল ওই এলাকার কোনো ষড়যন্ত্র।

আমি ভাবতাম, ইশ! আমাকে যদি কেউ প্রতিদিন সকালে এসে স্কুলে নিয়ে যেত, সুন্দরভাবে কথা বলত! কিন্তু নোনোগুচি তো নোনোগুচি।

স্কুলে যাওয়ার জন্য নিতে আসা ওই ছেলেটা কি হিদাকা?

কখনো সেটা বলেনি ও। সত্যি বলতে কুনিহিকো হিদাকার নাম কখনোই উল্লেখ করেনি। খবরেই প্রথম তার ব্যাপারে শুনি আমি।

হিদাকার উপন্যাস প্রসঙ্গে:

আসলে একটাও পড়া হয়নি। আমার বই পড়া হয় তবে বেশিরভাগই রহস্য উপন্যাস। হালকা জিনিসপত্র, যেমন ভ্রমন রহস্য। যেসব উপন্যাসে কয়েকজন বেড়াতে যাওয়ার পর ওদের মধ্যে কেউ খুন হয়, ওই ধরনের। জটিল ধরনের কাহিনী পছন্দ না আমার। কোনো বই পড়তে গিয়ে যদি মাথা ঘামানো লাগে তাহলে সেটা খুব একটা সুখকর হয় না।

যাইহোক, খুনটার ব্যাপারে শোনার পর একটা বই পড়ার জন্য নিই আমি। বইয়ের লেখক নোনোগুচি এটা ভাবার পর থেকেই মেরুদন্ডে শীতল স্রোত বয়ে যাচ্ছিল।

কোন বইটা পড়েছেন?

সমুদ্রের ডাক। যেটাতে একজন শিল্পীকে তার স্ত্রী ধোঁকা দেয়। অনেক কিছুই বুঝতে পেরেছি।

কিভাবে?

বলা চলে বইটার লেখক নোনোগুচি। বইয়ের প্রত্যেকটা পৃষ্ঠাতেই ওর ব্যক্তিত্বের প্রতিফলন ঘটেছে। ছোট থেকেই মানুষের যেসব ব্যাপার কখনোই পরিবর্তন হয় না ওগুলো।

আসলে সমুদ্রের ডাক হিদাকার লেখা।

কি, সত্যিই? দেখলেন জটিল উপন্যাসে আমার অবস্থা!

হালকা ধাঁচের উপন্যাস পড়েই মরে যাওয়া উচিত আমার। (হাসি)

জিজ্ঞাসাবাদ: ইয়াসুশি ফুজিমুরা

আমি ওসামুর মামা। ওসামুর মা আমার বোন। শুধুমাত্র টাকার লোভে বইগুলো লভ্যাংশ দাবি করেছি বলে মনে করবেন না। এমনটা ভাবা অপমানজনক। নিজেদের অধিকার জানান দিতেই এই কাজটা করেছি আমরা। বিষয়টা সবার কাছে পরিস্কার করা জরুরি ছিল। এটাই আরকি।

কিন্তু মিস্টার হিদাকাকে খুন করেছে ওসামু

অবশ্যই এর জন্য শাস্তি হওয়া উচিত তার। সমাজের কাছে তার ঋণ শোধ করা উচিত, এই মনোভাব থেকেই হয়ত স্বীকারোক্তি দিয়েছে।

আর সবকিছুর থেকে এটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ, বুঝলেন। নিশ্চিতভাবেই জঘন্য একটা কাজ করেছে, কিন্তু কারণ ছাড়া এই কাজটা করেনি সে। হিদাকার সাথে তার সম্পর্কের ব্যাপারটা নিয়ে ভাবা গুরুত্বপূর্ণ, ঠিক কি না? গোস্ট রাইটিংয়ের ব্যাপারটা-মিস্টার হিদাকার জন্যই উপন্যাসগুলো লিখত ওসামু। একসময় গিয়ে ব্যাপারটা আর নিতে পারছিল না সে। এটাই হল কথা।

অন্যভাবে দেখলে কিছু দায় মিস্টার হিদাকারও আছে। সব ভুল ওসামুর একার নয়। সে একা কেন শাস্তি ভোগ করবে? এখানে মিস্টার হিদাকার অংশটা কোথায়?

সাহিত্যের বাজার সম্পর্কে ধারণা নেই আমার, তবে যতদূর জানি হিদাকার উপন্যাস বেশ ভালো বিক্রি হয়েছে। সর্বোচ্চ আয় করা অন্যতম একজন লেখক সে। কিন্তু অর্থগুলো আসলে কে আয় করেছে? বিক্রি হওয়া উপন্যাসগুলোর লেখক কি ওসামু নোনোগুচি নয়? একদিকে ওসামু শাস্তি ভোগ করবে আর অন্যদিকে টাকাগুলো আরেকজনের পকেটে যাবে, এটা কি যৌক্তিক? আমার মনে হয় না। আমি হলে পুরো টাকা ফেরত দিয়ে দিতাম। এটাই প্রকৃত ন্যায়বিচার।

আমার মনে হয় না মৃতের পরিবার এতে রাজি হবে।

ওহ্, আমি নিশ্চিত ওরা হবে না। এজন্যই সবকিছু সহজ করতে আইনজীবী নিয়োগ দিয়েছি আমরা। আমি শুধু ওসামুকে সাহায্য করতে চাইছি। কোনো টাকার দরকার নেই আমার। আর টাকাগুলো আমারও না। ওটা ওসামুর কাছেই যাবে।

এটা দেওয়ানী আদালতের মামলা নয়, ডিটেক্টিভ?

আসলে আমি আপনার সাথে আপনার বোন আর তার পরিবার যে এলাকায় থাকত সেটার ব্যাপারে আলাপ করতে চাই।

ওহ…তাহলে সম্মানীর ব্যাপারে কথা বলতে আসেননি আপনি? আচ্ছা ওসামুর জন্মের পরই আমার বোন ওই এলাকাতে চলে যায়। একটা বাড়ি বানায় ওখানেই। ওর স্বামীর আত্মীয়রা ওদের কাছে একটা জায়গা বিক্রি করে, ওই জায়গাতেই বানায় বাড়িটা।

ওই জায়গাটা কি পছন্দ করত আপনার বোন?

খুব একটা না। একবার আমাকে বলেছিল, যদি আগে জানত এলাকাটা কেমন তাহলে কখনোই ওখানে বাড়ি বানাত না।

আসলে কি কারণে জায়গাটা পছন্দ করত না সে?

আমি ঠিক জানি না। কখনো এই প্রসঙ্গে কথা হয়নি। আচ্ছা, আপনি এসব কেন জানতে চাইছেন, ডিটেক্টিভ? কেসের সাথে কি এসবের কোনো সম্পর্ক আছে? বুঝতে পারছি আপনার কাজের ধরন, কিন্তু আমার বোন কেন ওই এলাকা পছন্দ করত না, এটা নিয়ে ভাবা একটু অতিরিক্ত-ই হয়ে যাচ্ছে না!

আমাদের তো লুকানোর কিছু নেই।

জিজ্ঞাসাবাদ: আকিও নাকাতসুকা

নোনোগুচি? এই নামের কাউকে আমি চিনি না।

মিডল স্কুলে আপনার ক্লাসমেট ছিল সে।

সত্যি? আচ্ছা মনে পড়েছে।

খুন প্রসঙ্গে:

দুঃখিত, কয়েকদিন পত্রিকা পড়া হয়নি। আর কোনো লেখকের ব্যাপারে জানি না আমি

সে-ও আপনার ক্লাসমেট ছিল।

আচ্ছা জানতাম না। তো ডিটেক্টিভ, এসবের সাথে আমার কি লেনাদেনা? আমি কাজে ব্যস্ত এখন। অফিসে যেতে হবে। ফলে হাতে সময় নেই।

হিদাকা নামের কাউকে চেনেন?

কি? হ্যাঁ, হিদাকা নামটা মনে আছে। সে-ই খুন হয়েছে? ইয়ার্কি না। কখন, কে, কিভাবে মরে জানার কোনো উপায় নেই।

তো তার স্কুলের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করে এই তদন্তে কী লাভ হবে? কেবল-ই না বললেন কে খুন করেছে আপনি সেটা জানেন? তাহলে আর কী জানার আছে?

আমরা শুধু সব দিকগুলো একটু নিশ্চিত করতে চাইছি।

খুনের রহস্য সমাধান হওয়ার পরও সবকিছু খতিয়ে দেখা নিশ্চয়ই আপনার জন্য ঝামেলার!

হয়রানীর প্রসঙ্গে:

আরে ভাই, নিশ্চয়ই ভাবছেন না…

আচ্ছা, হ্যাঁ আমি কয়েকবার হিদাকাকে ফেলে দিয়েছিলাম। কোনো নির্দিষ্ট কারণে নয়। ওকে একটু ঠিক রাখার জন্য আরকি, বুঝলেন।

কিন্তু ওই হিদাকাও বেশ শক্ত ছিল। কখনোই তার কাছ থেকে পয়সা বের করতে পারিনি আমরা। বেশিরভাগ পোলাপানকে একটু ভয় দেখালেই হাজারখানেক ইয়েন বের করে দিত। তো হ্যাঁ, হিদাকাকে একটু বিশেষ নজর দিতাম আমরা। এখন ভাবলে মনে হয়, সাহস ছিল শালার। যদিও ওই সময় বিরক্ত হয়েছিলাম খুব।

নোনোগুচি প্রসঙ্গে:

ভাই দেখেন, বললাম-ই তো কোনো নোনোগুচিকে চিনি না আমি। দাঁড়ান, গুচের কথা বলছেন? ওহ আচ্ছা, ঠিক, ওর নামই নোনোগুচি। মনে পড়েছে এবার। ফুজিওর মানিব্যাগ ছিল শালা। মানে যেটাতে লোকে টাকা নিয়ে ঘুরে সেটাকেই তো মানিব্যাগ বলে, তাই না? ফুজিওর টাকা দরকার হলেই সেটা দিত গুচ। আর সবসময়ই ফুট ফরমায়েশ খাটাতো গুচকে দিয়ে। ভাইরে ভাই, কি যে আবাল ছিল শালা। দুঃখিত এভাবে বলার জন্যে।

ফুজিও স্কুল ছাড়ার পর কি হয়েছিল?

আমরা সবাই আলাদা হয়ে যাই, গুচকে আর দেখিনি এরপর।

যৌন হয়রানীর প্রসঙ্গে:

হ্যাঁ আমি শুনেছি। মেয়েটা ক্যাথলিক স্কুলের ছিল, ঠিক না? কিন্তু সত্যিটা হল আমি এই ব্যাপারে খুব বেশি জানি না। ফুজিওর সাথে আমার সম্পর্ক ভালো ছিল ঠিকই, কিন্তু এসব বিষয়ে আমাকে কিছু বলত না। ও চলে যাওয়ার পর আর দেখিওনি ওকে। কয়েক মাস ওকে আটক করে রাখা হয়।

ওই কাজে আপনি কি তাকে সহায়তা করেছিলেন?

ভাই, কি বলেন এসব? আমি শুনেছি ওর সাথে কেউ একজন ছিল। কিন্তু ওটা আমি নই। এসব পুরানো কাসুন্দি ঘেঁটে কী হবে?

দেখুন, একটা কথা বলতে পারি। আপনি বললেন খুন হওয়া লোকটার নাম হিদাকা, তাই না? চলে যাওয়ায় পর ফুজিওকে আর দেখিনি আমি। কিন্তু হিদাকাকে একবার দেখেছিলাম, তিন কি চার বছর আগে। আমার বাসায় এসে ফুজিও আর ওই যৌন হয়রানির ব্যাপারে জানতে চায় সে।

আমাকে বলে ফুজিওর ওপর একটা উপন্যাস লিখছে। বিশ্বাস করতে পারেন? তাকে খুব বেশি সিরিয়াসলি নেইনি আমি, এজন্য ব্যাপারটা নিয়ে ভাবিওনি। ভেবেছিলাম উপন্যাসটা বেস্টসেলার হলে, শালার কাছে টাকা চাইবো। (হাসি)

কি বলেছিলেন তাকে?

যতটুক জানি। দেখে মনে হয়নি আমার ওপর কোনো রাগ আছে হিদাকার। তো বলতে সমস্যা কোথায়?

আপনি আসলে কতটুকু জানেন?

সত্যি বলতে তেমন কিছুই না। কিন্তু সে ছিল নাছোড়বান্দা। জানতে চাইছিল কোনো কিছুর খুঁটিনাটি মনে আছে নাকি। পরে বুঝলাম, সে মনে করেছিল আমিই ওই ঘটনায় ফুজিওর সহযোগী ছিলাম।

ছবিটার প্রসঙ্গে:

কোনো ছবির ব্যাপারে জানা নেই আমার।

শুনেছি ছবিটা আপনার কাছে থাকতে পারে।

কোন বোকাচোদা এসব বলেছে? পাগল নাকি! আচ্ছা, ধরা খাওয়ার আগে ফুজিও একটা ছবি দিয়েছিল আমাকে। কিন্তু ছবিটা একেবারেই ঝাপসা।

ছবিটা আপনি নিয়েছিলেন?

হ্যাঁ। এতে সমস্যা কোথায়? এর মানে তো এই না আমি কিছু করেছি। অথবা কোনো বিশেষ কারণেও আমি ওটা নেইনি। শুধু তখন ফেলে দিতে ভুলে গিয়েছিলাম। আমি নিশ্চিত আপনার বাড়িতে খুঁজলেও আপনার ছোটবেলার অনেক ছবিই পাওয়া যাবে।

ওটা আছে এখনো আপনার কাছে?

নাহ। হিদাকা দেখা করতে আসার কয়েকদিন পরই ফেলে দিয়েছি। ছবিটা হিদাকাকে দেখিয়েছিলেন?

হ্যাঁ, দেখিয়েছিলাম। আমার মনে হয়েছিল তার জন্য ওটুকু করা যেতেই পারে। ছোটবেলায় অত্যাচার করেছি তাকে। আর এতদূর থেকে দেখা করতে এসেছিল সে। ছবিটা ধার চেয়েছিল, কয়েকদিনের জন্য ধার দিই। কয়েকদিন পর একটা এনভেলপে করে ছবিটা পাঠিয়ে দেয় হিদাকা। একটা নোট ছিল এর সাথে, ছবি জমা করে না সে এই টাইপ কিছু লেখা ছিল ওতে। যাইহোক, এরপরই এনভেলপ সহ ফেলে দিই ছবিটা।

এরপর হিদাকার সাথে দেখা হয়েছে আর?

নাহ।

আর কোনো ছবি ছিল?

ওই একটাই। আমার জানা নেই ফুজিও ওই একটার বেশি ছবি তুলতে পেরেছিল কি না। আপনার কথা শেষ হয়েছে?

জিজ্ঞাসাবাদ: হেইকিচি সুজিমুরা

নোট: এই জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আমি মিস্টার সুজিমুরার নাতনির সাথে কথা বলেছি। মিস্টার সুজিমুরার নাতনী তার দোভাষী হিসেবে কাজ করে, কেননা তিনি ঠিকমত কথা বলতে পারেন না।

আপনার দাদার বয়স কত?

উম, একানব্বই সম্ভবত, কিন্তু তার হার্ট এখনো ঠিক আছে। তবে হাঁটাচলা করতে পারে না। সবকিছু বুঝতে পারলেও, শোনার সমস্যা আছে।

কবে রিটায়ার করেছেন উনি?

প্রায় পনেরো বছর আগে আতশবাজির ব্যবসা বন্ধ করেছেন তিনি সময়ের আগেই অবসর নিয়েছেন, কারণ চাহিদা কমে গিয়েছিল জিনিসটার। নদীর পাড়ে আতশবাজির খেলা দেখানো বন্ধ করে দেয় ওরা, ফলে ব্যবসায় ভাটা পড়ে। আর আমার বাবা এই ব্যবসায় জড়িত নয়, সেজন্যই আমরা ভাবি এই জিনিস চালিয়ে যাওয়ার কোনো মানে নেই।

এই বইটা দেখেছেন?

নিভে যাওয়া অনল? ওহ, কুনিহিকো হিদাকার লেখা। নাহ শুনিনি এর নাম। মনে হয় না আমার পরিবারের কেউ এই বই পড়েছে।

আপনার দাদাকে একটু জিজ্ঞেস করবেন?

চেষ্টা করছি, কিন্তু আমি উত্তরটা জানি মনে হয়।

…নাহ, সে-ও এর নাম শোনেনি। দীর্ঘদিন কোনো বই পড়েনি সে। কি হয়েছে এই বইটার?

আপনার দাদার কাজের ওপর ভিত্তি করে লেখা এই বইটা।

সত্যিই? বইটা আতশবাজি কারিগরদের নিয়ে?

…দাদা বলছে বেশ অদ্ভুত বিষয়ের ওপর লেখা হয়েছে বইটা। তার কাজের ব্যাপারে খুব কম মানুষই জানে, বলল সে।

হিদাকা প্রসঙ্গে:

আমার দাদার ওয়ার্কশপ শহরে মন্দিরের পাশেই। ফলে ছোটবেলায় হয়তো মিস্টার হিদাকা দাদার কাজ দেখে থাকতে পারেন। সেটা দিয়েই হয়ত উপন্যাস লিখেছেন?

…দাদা বলল, এলাকার কিছু বাচ্চা মাঝেমধ্যে খেলতে আসতো। দাদা ওদেরকে তাড়িয়ে দিত, কারণ কাজটা ছিল বিপজ্জনক। কিন্তু এদের কয়েকজন এতোই নাছোড়বান্দা ছিল, দাদা ওদেরকে ভেতরে ঢুকিয়ে কাজ দেখতে দিত।

অনেকগুলো বাচ্চা আসতো নাকি?

খুব বেশি না, বলল সে। তবে একজনের কথা মনে আছে।

কারোর নাম মনে আছে তার?

…দুঃখিত, না। বলল, সে ওই ছেলেটাকে ভোলেনি। তবে কখনোই নাম জানতো না তার।

ছবি দেখলে কি ছেলেটাকে চিনতে পারবে সে?

ঠিক নিশ্চিত নই, দীর্ঘদিন আগের ঘটনা। জিজ্ঞেস করি দাঁড়ান।

…আচ্ছা, সে বলল তার মনে আছে ছেলেটা দেখতে কেমন ছিল। আপনার কাছে ছেলেটার কোনো ছবি আছে? থাকলে দেখান।

… বলল, যে ছেলেটার কথা মনে আছে সে অন্যদের তুলনায় ছোটখাটো গড়নের ছিল। এটা কি? মিডল-স্কুল ইয়ারবুক? তাহলে ছেলেটা এই গ্রুপের মধ্যের কেউ? কিন্তু ওয়ার্কশপে যখন আসতো তখন তো আরও ছোট ছিল না? ঠিক, এমনটাই মনে হচ্ছে আমার। আচ্ছা আমি তাকে বলার চেষ্টা করছি…

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *