অধ্যায় ৬ – অতীত (প্রথম পর্ব) : কিয়োচিরো কাগার নোট

অধ্যায় ৬ – অতীত (প্রথম পর্ব) : কিয়োচিরো কাগার নোট

১৪ মে

মিডল স্কুলটাতে গিয়েছিলাম আজ, যেখানে চাকরী করত নোনোগুচি। কেবলই ক্লাস শেষ হয়েছে, গেটের কাছে ভিড় করে রয়েছে শিক্ষার্থীরা। খেলার মাঠের ট্র্যাকে রয়েছে কয়েকজন। ফ্রন্ট অফিসে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম এমন কারোর সাথে কথা বলা যাবে কি না যার সাথে ভালো সম্পর্ক ছিল মিস্টার নোনোগুচির। অফিসের মহিলাটি ভেতরে চলে গেল আরেকজন শিক্ষকের সাথে আলাপ করতে। একটু পর দুজনেই চলে গেল টিচার্স অফিসে। অপেক্ষাটা বিরক্তিকর কিন্তু পাবলিক স্কুলগুলোতে এভাবেই চলে সবকিছু। মোটামোটি আরও মিনিট বিশেক অপেক্ষার পর আমাকে নিয়ে যাওয়া হল একটা মিটিংরুমে।

স্কুল হেডমাস্টারের সাথে দেখা করলাম আমি, লোকটার নাম এতো। তার সাথে রয়েছে আরেকজন লোক, নাম ফুজিওয়ারা, প্রবন্ধ লেখা শেখায় সে। ধারণা করলাম এই লোকটাকে হেডমাস্টার এখানে ডেকেছে স্কুল বোর্ড পার্টির সদস্য হিসেবে।

প্রথমেই দুজনকে জিজ্ঞেস করলাম কুনিহিকো হিদাকার খুন সম্পর্কে তারা জানে কি না। জানে তারা। বলা ভালো, বেশ বিস্তারিতই জানে। আমাকে জানাল, ওনারা অবগত আছেন হিদাকার গোস্টরাইটার ছিল নোনোগুচি। আর হিদাকার প্রতি অসন্তোষই ছিল খুনের মোটিভ। আমার মনে হল এরা আমার থেকে বিস্তারিত জানার জন্য আগ্রহী।

জিজ্ঞেস করলাম নোনোগুচি গোস্টরাইটার হিসেবে কাজ করার সময় তার মধ্যে কোনো বিশেষ কিছু লক্ষ করেছিল কি না।

এক মুহূর্ত ইতস্তত করে ফুজিয়ারা বলল, “আমি জানতাম সে উপন্যাস লিখছে। এমনকি বাচ্চাদের ম্যাগাজিনে তার কয়েকটা লেখা পড়েছিও, তবে আমার কোনো ধারণাই ছিল না সে একজন গোস্টরাইটার। বিশেষ করে হিদাকার মত বিখ্যাত কোনো লেখকের।”

“মিস্টার নোনোগুচিকে কখনো কিছু লিখতে দেখেছেন?”

“নাহ। স্কুলে থাকার সময় সে শিক্ষকতা নিয়েই ব্যস্ত থাকত। সম্ভবত কাজের পর অথবা সপ্তাহান্তে বাসায় বসে লিখত।”

“তাহলে বলছেন স্কুলে তার কাজের চাপ কম ছিল?”

“স্কুলে তার কাজের চাপ কম ছিল এমন কিছু বলছি না। তবে স্কুলের শিক্ষাবহির্ভুত কার্যক্রমগুলো থেকে কৌশলে নিজেকে দূরে রাখত সে। আর প্রতিদিন দ্রুতই বাসায় চলে যেত। বিশেষ করে গত বছরের শুরুর দিক থেকে। তার শারীরিক অবস্থা যদিও ভালো ছিল না, কিন্তু আমরা জানতাম কি সমস্যা ছিল তার। ফলে তার ব্যাপারে সবাই একটু ছাড়-ই দিত। আসলে ওই অতিরিক্ত সময়ে সে কুনিহিকো হিদাকার জন্য উপন্যাস লিখত। বাহ, দারুণ!”

“আপনি বললেন গতবছরের শুরুর দিক থেকে সে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে যেত, এই ব্যাপারটার কোনো রেকর্ড আছে আপনাদের কাছে?”

“আমরা এখানে টাইম কার্ডের মত কিছু ব্যবহার করি না। ফলে এর কম কিছু নেই। তবে আমি অনেকটাই নিশ্চিত ওই সময়ের দিকেই এটা শুরু হয়। প্রবন্ধের টিচারদের প্রত্যেক সপ্তাহে দুইবার মিটিংয়ে বসতে হয়। ওই সময়ের দিকে সে মিটিংয়ে আসা বন্ধ করে দেয়।”

“কিন্তু ওই সময়ের আগে সে নিয়মিত আসত?”

“সে সক্রিয় সদস্য ছিল না, তবে…হ্যাঁ, আসত।” ওসামু নোনোগুচির আচরণের ব্যাপারে

“সে নিজের মত থাকত। ফলে বোঝা সম্ভব নয় সে কী ভাবছে। একাধিকবার তাকে জানালা দিয়ে আনমনে বাইরে তাকিয়ে থাকতে দেখেছি। নিশ্চিতভাবেই কোনকিছু নিয়ে দুশ্চিন্তা করছিল সে। তবে কখনোই নোনোগুচিকে একজন খারাপ মানুষ বলে মনে হয়নি। সম্ভবত বুঝতে পারছি, বছরের পর বছর এভাবে চলতে থাকার পর হঠাৎ-ই ভেঙে পড়ে। তাই বলে ওর করা খুনকে সমর্থন করছি না আমি।” হাসল ফুজিয়ারা। “আমি হিদাকার বেশ কয়েকটি উপন্যাস পড়েছি। ভালো লেগেছিল। কিন্তু ওসব মিস্টার নোনোগুচি লিখেছে জানার পর ওগুলোর প্রতি মনোভাব বদলে গিয়েছে আমার।”

দুজনকেই ধন্যবাদ দিয়ে স্কুল থেকে বেরিয়ে গেলাম আমি।

ফেরার পথে একটা বড় স্টেশনারি শপের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় ভেতরে ঢুকলাম। দোকানের মহিলাকে দেখালাম ওসামু নোনোগুচির ছবি। জিজ্ঞেস করলাম, গতবছর এই লোক দোকানে আসত কি না। মহিলা জানাল লোকটাকে চেনাচেনা লাগছে, তবে স্পষ্ট মনে নেই তার।

.

১৫ মে

আজ রাই হিদাকার সাথে দেখা করতে এসেছি। গত সপ্তাহ থেকে ইয়োকোহামার একটা অ্যাপার্টমেন্টে থাকছে রাই। যা ঘটেছে সেটার ধকল কাটাতেই জায়গা বদলেছে সে। ফোনে বড্ড বিমর্ষ শোনাচ্ছিল তার কন্ঠস্বর 1 আমার মনে হল, আমি কোনো সাংবাদিক হলে আমার সাথে দেখা করতে চাইত না সে। তার অ্যাপার্টমেন্টের কাছাকাছি এক শপিং সেন্টারের ক্যাফেতে দেখা করার সিদ্ধান্ত নিই আমরা। আমাকে জানায়, নিজের অ্যাপার্টমেন্ট কিংবা বিল্ডিংয়ের কাছেও আমার সাথে দেখা করা সম্ভব নয় তার। আমাদেরকে কেউ লক্ষ করতে পারে ভেবে ভয় পাচ্ছিল।

ক্যাফেটা একটা বুটিকের দোকানের পাশে। মূল্যহ্রাস চলছে বুটিক শপে। কিন্তু জায়গাটা শপিং সেন্টারের একটু কোণ ঘেঁষে হওয়ায় বাইরের কেউ আমাদেরকে দেখতে পারবে না। ক্যাফের ভেতরে রয়েছে ডিসপ্লে ও ডিভাইডার। লোকজনের নজর এড়িয়ে কথা বলার মত ভালো জায়গা এটা। পিছনের একটা টেবিলে মুখোমুখি বসলাম আমরা। প্রথমেই জিজ্ঞেস করলাম কী অবস্থা তার।

সে ম্লান হেসে জবাব দিলো, “ভালোই। সত্যি বলতে এই সার্কাস শেষ হওয়ার অপেক্ষায় আছি।

“যেকোনো তদন্ত শুরু হলেই শেষ হতে সময় লাগে।”

বিরক্তির সাথে মাথা নেড়ে বলল সে, “কেউ কি বোঝে এখানে আমরাই ভিক্টিম? সবাই ব্যাপারটাকে সেলিব্রেটি স্ক্যান্ডাল হিসেবে নিয়েছে আর এমন ভাব দেখাচ্ছে যেন আমার স্বামীই দোষী। “

কথাটা সত্যি। পত্রপত্রিকা বা টিভির খবরে কুনিহিকো হিদাকার খুনের চেয়ে তার লেখা চুরির ব্যাপারেই বেশি কথা হচ্ছে। সেইসাথে ট্যাবলয়েড পত্রিকাগুলো তার সাবেক স্ত্রীর পরকীয়ার ব্যাপারটা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে একেবারে।

“এগুলো মাথা থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করুন।“

“বিশ্বাস করুন, সেটাই করছি। না করলে মাথা খারাপ হয়ে যাবে আমার। কিন্তু মিডিয়াই একমাত্র সমস্যা নয়।”

“আর কিছু ঘটেছে?”

“শুধু কিছু না, অনেক কিছু। অসংখ্য ফোনকল আর চিঠি আসছে। হুমকি-ধামকি দিয়ে একাকার করে দিচ্ছে লোকজন। জানি না আমার বাবা- মার ফোন নম্বর ও ঠিকানা পেল কিভাবে ওরা। এখন বাবা-মার বাড়িতে ফোন করছে ও চিঠি পাঠাচ্ছে লোকে। সম্ভবত এই দুষ্কৃতিকারীরা জেনেছে আমি এখন আর পুরানো বাড়িটাতে থাকছি না। “

“পুলিশকে জানিয়েছেন?”

“পুলিশকে জানানো হয়েছে। কিন্তু এই ব্যাপারে পুলিশ সেভাবে কিছু করতে পারবে না।”

তার কথাই ঠিক, কিন্তু সেটা স্বীকার করলাম না। “কি বলা হয়েছে ওসবে, মানে চিঠিগুলোতে আরকি?”

“ওহ, অনেক কিছু। কিছু মানুষ চায় বই থেকে পাওয়া সব সম্মানী ফিরিয়ে দেয়া হোক। আর বাকিরা ক্ষেপে গিয়েছে, ওদের মতে আমার স্বামী ওদেরকে ধোঁকা দিয়েছে। অনেক মানুষ বক্সে ভরে বইগুলো পাঠিয়ে দিয়েছে। কেউ কেউ আবার দাবি করেছে হিদাকার জেতা সব সম্মাননা যেন ফিরিয়ে দেয়া হয়।”

আমার মতে এসব লোকদের বেশিরভাগ-ই তার স্বামীর লেখা অথবা সাহিত্যের ভক্তই নয়। আমি নিশ্চিত, এদের অনেকে খুন হওয়ার আগে কুনিহিকো হিদাকার নাম পর্যন্ত শোনেনি। এরা অন্যদের দেখে এই মহিলাকে এভাবে উত্যক্ত করছে। বাস্তব জীবনে এই মানুষগুলো অসুখি, কারোর জীবন দুর্বিষহ করে তোলার কোনো সুযোগ এরা ছাড়ে না। ভিক্টিম হিসেবে বিবেচনা করা দূরে থাক, রাই হিদাকা কে, এটা ওদের কাছে কোনো ব্যাপারই নয়।

রাইকে এটা বললাম, একমত হল সে।

“হাস্যকর হলেও সত্যি, আমার স্বামীর বই এখনো ভালো বিক্রি হচ্ছে। সম্ভবত লোকের অসীম কৌতূহল-ই এর কারণ। “

আমিও শুনেছি হিদাকার বইয়ের বিক্রি বেড়েছে। বুকস্টোর শেলফে যে বইগুলো আছে ওগুলোই তার বইয়ের একমাত্র কপি। প্রকাশকেরা জানিয়ে দিয়েছে, হিদাকার বই আর রিপ্রিন্ট হবে না। ওই সম্পাদকের কথা ভাবলাম, যে এই গোস্টরাইটার থিওরিটা মানতে নারাজ ছিল। বর্তমানে একেবারে চুপ হয়ে গিয়েছে সে।

হঠাৎ করেই একটা চমকপ্রদ খবর দিলো রাই, যদিও কথাটা স্বাভাবিকভাবেই বলল সে, “কয়েকদিন আগে মিস্টার নোনোগুচির এক আত্মীয়ের থেকে লিগ্যাল নোটিশ পেয়েছি আমি।“

“কী বলা আছে এতে?”

“আমার স্বামীর বই থেকে প্রাপ্ত লভ্যাংশ দাবি করছে ওরা। ওদের মতে, বইগুলোর জন্য অগ্রিম যা নেয়া হয়েছিল অন্তত ওটুকু ওদের প্রাপ্ত। নোনোগুচির মামা হল ওদের মুখপাত্র।”

মিস্টার নোনোগুচি বাবা-মা’র একমাত্র সন্তান। তার বাবা-মা উভয়েই মৃত। এই মামাই তার একমাত্র আত্মীয়। তারপরও যে লোকটা তার স্বামীকে খুন করেছে তার পক্ষ থেকে পাওয়া এই অনুরোধটি এই বিধবা মহিলার জন্য অদ্ভুতই। স্বার্থ হাসিলের জন্যে উঠেপড়ে লেগেছে সবাই, ভাবলাম আমি।

“আপনি কিভাবে জবাব দিয়েছেন?”

“বলেছি আমার আইনজীবী যোগাযোগ করবে।”

“ভালো বলেছেন।”

“সত্যি বলতে আমি খুব অবাক হয়েছি। জীবনেও শুনিনি কেউ ভিক্টিমের পরিবারের কাছে ক্ষতিপূরণ দাবি করেছে!”

“এই কেসটাই একটু অস্বাভাবিক। আর এর আইনী বিষয়গুলোর ব্যাপারে আমি নিজেও নিশ্চিত নই। তবুও ওদেরকে আপনি কিছু দিলে আমি খুবই অবাক হব।”

“আমি নিজেও…কিন্তু টাকাটা সমস্যা না। সমস্যা হল, সবাই ভাবছে আমার স্বামী খুন হয়েছে তার নিজের দোষেই। মিস্টার নোনোগুচির মামাকে একবিন্দুও অনুতপ্ত লাগেনি।”

চোখ জ্বলজ্বল করে উঠল রাই হিদাকার, ঠোঁট কামড়ে ধরেছে সে। দুঃখের থেকে রাগের পরিমাণ বেশি তার চোখে, দেখে ভালো লাগল। আমি চাইনি, ক্যাফেতে কান্নায় ভেঙে পড়ুক সে।

“কথাটা আপনাকে আগেও বলেছি, মিস্টার কাগা…আমি বিশ্বাস করি না আমার স্বামী কারোর কাজ চুরি করেছে। নিজের লেখা নতুন বইয়ের ব্যাপারে কথা বলার সময় চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠত তার, একেবারে বাচ্চাদের মত। আমি জানি, গল্প লিখতে সত্যি ভালোবাসত সে।”

মাথা নেড়ে সায় জানালাম। তার অনুভূতি বুঝতে পারছি।

তবে মনে হল, আমি তার সাথে একমত এই কথাটা বলা ঠিক হবে না। সম্ভবত ব্যাপারটা সে বুঝতে পেরেছে। নিজ থেকেই কথা বলা বন্ধ করে দিলো এই প্রসঙ্গে। জিজ্ঞেস করল কেন দেখা করতে চেয়েছি তার সাথে।

জ্যাকেটের পকেট থেকে কিছু কাগজ বের করে টেবিলে রাখলাম। “দয়া করে কাগজগুলো একটু দেখবেন।”

“কী এটা?”

“যা ঘটেছে সেই ব্যাপারে ওসামু নোনোগুচির স্বীকারোক্তি।”

ভ্রু কুঁচকে তাকাল রাই হিদাকা, স্পষ্টতই বিরক্ত সে। “না দেখাই ভালো। নিশ্চিত আমার স্বামী তার সাথে যা করেছে সেসবেরই লম্বা ফিরিস্তি য়েছে এতে। তাছাড়া পত্রিকায় যা এসেছে আমি সেসব পড়েছি।”

“মনে হয় গ্রেফতার হওয়ার পর মিস্টার নোনোগুচির স্বীকারোক্তির কথা বলছেন আপনি। এইটা আলাদা। এটা সে লিখেছিল খুনটা করার পর পুলিশকে তার থেকে দূরে সরানোর জন্য।”

মনে হল বুঝতে পেরেছে সে, তবুও বিরক্তির ছাপ গেল না চোখ থেকে। “আচ্ছা। কিন্তু যা কোনো কাজে আসবে না সেটা পড়ে লাভ কি?”

“আপনার সংশয় বুঝতে পারছি আমি। তবে একবার পড়ে নিলে ভালো হয়। বেশি বড় নয় লেখাটা। দ্রুতই পড়ে ফেলতে পারবেন।”

“আপনি চাইছেন এখানে বসেই পড়ি এটা?”

“হ্যাঁ, যদি সম্ভব হয়।“

মাথা নাড়ল সে, কিন্তু আর কিছু বলল না। কাগজটা উঠিয়ে পড়তে আরম্ভ করল। পনেরো মিনিট পর তাকাল সে। “আচ্ছা। এখন কী?”

“মিস্টার নোনোগুচি স্বীকার করেছে এতে লেখা তার সাথে মিস্টার হিদাকার কথোপকথনের বর্ণনাটা বানোয়াট। আসল কথোপকথনটা এত সহজ ছিল না তাদের মধ্যে, বরং উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হয়েছিল।”

“ওরকমই লাগছে।”

“সেইসাথে আপনাদের বাড়ি থেকে তার বেরিয়ে যাওয়ার বর্ণনা আসল ঘটনার থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। যদিও আপনি তাকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়েছিলেন, কিন্তু এই লেখাতে সে দাবি করেছে আপনি তাকে এগিয়ে দিয়েছিলেন গেট পর্যন্ত।“

“ঠিক, এই ব্যাপারে আগেও কথা হয়েছে আমাদের।”

“এই বিষয়ে বলার মত আর কিছু আছে? যা ঘটেছে সেই স্মৃতি থেকে ভিন্ন কিছু?”

“তাকে এগিয়ে দেয়া বাদে?” বিভ্রান্ত দেখাল তাকে। কাগজটার দিকে চোখ বুলালো একবার, এরপর মাথা নাড়ল। “নাহ, আর কিছু দেখছি না।”

“এমন কিছু কি রয়েছে যা সেদিন মিস্টার নোনোগুচি বলেছে বা করেছে কিন্তু সেটা এখানে লেখা নেই? মনে পড়ে কিছু? এমনকি ছোটখাট কিছুও হয়ত তদন্তে কাজে আসবে। যেমন সে বাথরুমে গিয়েছিল কি না, এই ধরনের ঘটনা।”

“ওরকম কিছু ঠিক মনে করতে পারছি না। তবে মনে হয় না বাথরুম ব্যবহার করেছে সে।”

“ওখানে তাকে কোনো ফোনকল করতে দেখেছেন বা শুনেছেন?”

“আমার স্বামীর অফিস থেকে ফোন করতে পারে সে, আমার জানার কথা নয় এটা।”

রাই হিদাকার কাছে ওই দিনটা আর দশটা সাধারণ দিনের মতোই ছিল। নিশ্চিতভাবেই সবকিছু বিস্তারিত মনে নেই তার।

আলাপ শেষ করতে চাইছিলাম, ঠিক তখনই আমার দিকে তাকিয়ে বলে উঠল রাই, “একটা ব্যাপার।”

“হ্যাঁ?”

“যদিও আমি নিশ্চিত কেসের সাথে এর কোনো সম্পর্ক নেই।”

“আপনার বলা যেকোনো কিছুই কাজে আসতে পারে।”

“আচ্ছা, ওইদিন যাওয়ার সময় মিস্টার নোনোগুচি আমাকে এক বোতল

শ্যাম্পেইন দেয়। বলে এটা উপহার।”

“আপনি নিশ্চিত এটা ওইদিনের-ই ঘটনা?”

“হ্যাঁ, একদম নিশ্চিত।”

“আপনি বললেন যাওয়ার সময় দিয়েছিল সে। আরেকটু বিস্তারিত বলতে পারবেন?”

“মিস ফুজিও অফিসে ঢোকার পর সে বেরিয়ে আসার সাথে সাথেই ঘটে এটা। একটা কাগজের ব্যাগে ছিল জিনিসটা, দেখে মনে হচ্ছিল কেবলই কিনে আনা হয়েছে। সে নাকি আমার স্বামীর সাথে আলাপে এতই মগ্ন ছিল, তাকে দিতে ভুলে গিয়েছে। এরপর বলে, হোটেলে রাতে যেন এইটা আমি ও আমার স্বামী মিলে পান করি।”

“জিনিসটা কি করেছেন আপনি?”

“অবশ্যই গ্রহণ করি উপহারটা, এরপর হোটেলে নিয়ে যাই।হোটেলের রেফ্রিজারেটরে রাখি। ওই ঘটনার পর আর। হোটেলে ফেরা হয়নি আমার। পরে হোটেল কর্তৃপক্ষ ফোন দেয় এটার ব্যাপারে। আমি ওদেরকে বলি, জিনিসটা নিয়ে ওরা যা খুশি করতে পারে। “

“তাহলে জিনিসটা পান করেননি?”

“আমি? নাহ। আমি ওটা ঠান্ডা করার জন্য রেখেছিলাম, রাতে হিদাকা হোটেলে ফিরলে যেন একসাথে পান করতে পারি।”

“মিস্টার নোনোগুচি কি আগে উপহার হিসেবে অ্যালকোহল এনেছে কখনো?”

“যতদূর জানি ওইবার-ই প্রথম। মিস্টার নোনোগুচি পান করে না।”

“আচ্ছা।”

স্বীকারোক্তিত নোনোগুচি বলেছে প্রথমবার হিদাকার বাড়িতে যাওয়ার সময় সাথে করে এক বোতল স্কচ নিয়ে যায় সে। অবশ্যই রাই সেসময় সেখানে ছিল না। তাকে জিজ্ঞেস করলাম ওইদিনের এমন কোনো ঘটনা মনে পড়ছে কি না যা লেখা নেই। অনেকক্ষণ ধরে ভাবল সে, কিন্তু অবশেষে জানাল বলার মত আর কিছু নেই। এরপর জিজ্ঞাসা করল কেন আমি তাকে এখন এসব জিজ্ঞেস করছি।

“একটা কেস ক্লোজ করার আগে অনেক পেপারওয়ার্ক করতে হয়। এ ধরণের সত্যতা যাচাই সেই প্রক্রিয়ারই অংশ।“

মনে হল না আমার ব্যাখ্যায় সন্দেহ করল সে।

তার সাথে আলাপ শেষ করে, তাকে আরেকবার সান্ত্বনা জানিয়ে চলে গেলাম। শপিং সেন্টার থেকে বেরিয়েই কল করলাম ওই হোটেলে। খুন হওয়ার দিন যেখানে রাত কাটানোর কথা ছিল হিদাকার। জিজ্ঞেস করলাম শ্যাম্পেনের ব্যাপারে। কিছুক্ষণ সময় লাগলেও ওই রাতে যে ম্যানেজার ডিউটিতে ছিল ডেকে দেয়া হল তাকে। একজন পেশাদারের মত স্পষ্ট কণ্ঠে কথা বলল সে। “আমার মনে হয় এটা ডন পেরিয়ন রোজের শ্যাম্পেইন ছিল। রুম রেফ্রিজারেটরে পাওয়া যায় জিনিসটা। বেশ দামি বোতল আর মুখ খোলা হয়নি এর। ফলে আমি কল করলাম ওই রুমের অতিথিকে। সে আমাকে জানালো এটা দেখা মাত্রই ফেলে দেয়া উচিত ছিল আমার।”

তাকে জিজ্ঞেস করলাম কি করেছে ওই শ্যাম্পেইন নিয়ে। কয়েক মুহূর্ত ইতস্তত করে জিনিসটা বাসায় নিয়ে গিয়েছে বলে জানাল সে। এরপর জানতে চাইলাম সেটা পান করেছে কি না।

দুই সপ্তাহ আগে পান করেছে বলে জানালো। ফেলে দেয়া হয়েছে বোতলটা। “আমার কি এমনটা করা উচিত হয়নি?”

“নাহ, কোনো সমস্যা নেই। শ্যাম্পেইনটা ভালো ছিল?”

“হ্যাঁ, খুব ভালো ছিল।”

তাকে ধন্যবাদ দিয়ে ফোন রেখে দিলাম।

বাড়ি ফিরে ফরেন্সিকের পাঠানো ভিডিওটা দেখতে লাগলাম। হিদাকার বাড়িতে ওসামু নোনোগুচির অনুপ্রবেশের ভিডিও। অসংখ্যবার রিওয়াইন্ড করে দেখেছি ভিডিওটা। বারবার খালি ওই একই নিরস দৃশ্যই চোখে পড়েছে আমার।

.

১৬ মে

দুপুর একটার একটু পর ইলেবুকোরোতে অবস্থিত ইয়োকোদা রিয়েল এস্টেট ব্রাঞ্চে পৌঁছালাম। ছোট্ট অফিসটাতে দুটো ডেস্ক রয়েছে কাউন্টারের পেছনে। ডেস্ক দুটো জানালার দিকে। ওই জানালা দিয়ে রাস্তা দেখা যায়। ভেতরে গিয়ে মিয়াকো ফুজিওকে পেলাম। একাই কাজ করছে সে। মহিলা জানাল, সবাই ক্লায়েন্টকে নিয়ে বাইরে গিয়েছে। অফিস ফেলে তার পক্ষে বাইরে যাওয়া সম্ভব নয়। ফলে কাউন্টারের সাথে থাকা টেবিলে বসেই কথা বললাম আমরা। বাইরে থেকে আমাকে দেখলে মনে হবে মলিন ধরনের এক লোক সস্তা অ্যাপার্টমেন্টের খোঁজে এসেছে।

সরাসরি প্রসঙ্গে চলে এলাম। “নোনোগুচির স্বীকারোক্তির ব্যাপারে জানা আছে আপনার?”

মাথা নেড়ে সায় জানাল সে। টানটান হয়ে গেল তার চেহারা। “পত্রিকায় যা এসেছে ওটুকু পড়েছি।”

“এই ব্যাপারে আপনার মনোভাব কি?”

“তেমন কিছু নয়। তবে আমি বেশ অবাক হয়েছি। আমার ধারণাই ছিল না ‘নিষিদ্ধ প্রান্তর’ অন্য কারোর লেখা। “

“নোনোগুচি আমাদের বলেছে কুনিহিকো হিদাকা আপনাকে তার ওই উপন্যাসটার ব্যাপারে বিস্তারিত বলতে পারেনি কারণ এটা তার কাজ নয়। তার সাথে এই উপন্যাস নিয়ে আপনার কথা বলার অভিজ্ঞতাটা কেমন?”

“আসলে আমি ঠিক বলতে পারবো না। আমার সাথে কথা বলার সময় এমনিতেও মিস্টার হিদাকা খুব বেশি গভীরে যেত না। তবে এটা কোনো কিছুই প্রমাণ করে না। “

“আগে কখনো মিস্টার হিদাকার সাথে আলাপের সময় কোনো কিছু অদ্ভুত লেগেছে আপনার কাছে?”

“ঠিক মনে পড়ছে না। এভাবে বলা কঠিন। তবে কখনো কল্পনাই করিনি মিস্টার হিদাকা ওই উপন্যাসটার আসল লেখক নন। ফলে আমার অস্বাভাবিক কিছু লক্ষ না করার সুযোগই বেশি।”

এর জন্য তাকে দোষারোপ করা যায় না। “উপন্যাসগুলোর আসল লেখক মিস্টার নোনোগুচি, এটা জানার পর কিছু কি মনে হচ্ছে?”

“এটাও বলা কঠিন। মিস্টার নোনোগুচি আর আমার ভাই একই স্কুলে

পড়ত। ফলে উপন্যাসগুলো তার পক্ষে লেখা অবশ্যই সম্ভব। এমন নয় যে মিস্টার হিদাকাকেও আমি খুব ভালো করে চিনি।”

মিস ফুজিওর কাছ থেকে নতুন তথ্য পাওয়ার আশা প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলাম। এমন সময় সে বলে উঠল, “যদি মিস্টার হিদাকা উপন্যাসটা না-ই লিখে থাকেন, তাহলে কোনো মন্তব্য করার আগে ওগুলো আমাকে আবারও পড়তে হবে। আমার মনে হয়েছে উপন্যাসের একটা চরিত্র মিস্টার হিদাকার আদলে তৈরি।”

“কিভাবে? চরিত্রটার ব্যাপারে একটু বিস্তারিত বলতে পারবেন?”

“বইটা পড়েছেন?”

“না, পড়িনি। যদিও সারসংক্ষেপটা দেখেছি। আরেকজন ডিটেক্টিভ বইটা পড়ে আমাদের জন্য সারসংক্ষেপ লিখে দিয়েছে।”

“আচ্ছা,বইয়ের একটা অংশে মূল চরিত্রের মিডল-স্কুল জীবনের বর্ণনা রয়েছে। মূল চরিত্রটা বেশ রূঢ়। বন্ধুদের তার দলে যোগ দেয়ার জন্য জোর করে, আর কারোর সাথে মতের মিল না হলে আক্রমণ করে বসে। এইধরনের আচরণকে আজকাল বুলিয়িং বলা হয়। যাইহোক, তার পছন্দের ভিক্টিম ছিল এক ক্লাসমেট, হামাওকা নাম ছেলেটার। আমার সবসময়ই মনে হয়েছে এই ছেলেটা মিস্টার হিদাকার প্রতিরূপ।”

“কেন আপনার মনে হল ওই ছাত্রটাই মিস্টার হিদাকা?”

“আচ্ছা, বইটা এমনভাবে লেখা হয়েছে যেন এটা হামাওকার স্মৃতিচারণ। আর যেহেতু এটা কোনো জীবনী নয় বরং ফিকশন। বলা যায়, বর্ণনাকারীই হল লেখক-মিস্টার হিদাকা। “

মাথা নেড়ে সায় জানালাম।

“সেইসাথে,” একমুহূর্ত ইতস্তত করে বলল মিয়াকো ফুজিও। “আমার মনে হয়েছে কোনো নির্দিষ্ট কারণে এই উপন্যাসটা লিখেছে মিস্টার হিদাকা।”

তার দিকে তাকালাম। “কী কারণ সেটা?”

“বইয়ে মূল চরিত্রের প্রতি হামাওকার ঘৃণাটা স্বাভাবিক। প্রত্যেকটা পৃষ্ঠাতেই এটা বাস্তবিকভাবেই অনুভব করতে পারবেন আপনি। যদিও বইয়ের কোথাওই এই বিষয়ে বলা নেই কিন্তু বুঝতে পারবেন ঘৃণাটাই হামাওকাকে প্রভাবিত করে যে তাকে স্কুলে হেনস্তা করত তার আকস্মিক মৃত্যুর তদন্ত করতে। যদি হামাওকার ক্রোধ লেখকের ক্রোধ হয়ে থাকে, তবে ধরে নেয়া যায় মিস্টার হিদাকা এই বইটা লিখেছে আমার ভাইয়ের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেয়ার জন্য।”

তাকালাম তার দিকে। সে বলার আগে প্রতিশোধ নেয়ার জন্য বই লেখার ব্যাপারটা মাথয় আসেনি আমার। সত্যি বলতে, আমাদের তদন্ত দল নিষিদ্ধ প্রান্তর বইটার দিকে বেশি নজরই দেয়নি।

“তাহলে নোনোগুচির স্বীকারোক্তি আপনার থিওরি বাতিল করে দিচ্ছে,” বললাম আমি।

“হ্যাঁ। তবে বইটা মিস্টার হিদাকা বা মিস্টার নোনোগুচি যে-ই লিখুক না কেন, সেটা কোনো ব্যাপার নয়। লেখক যদি ওই ছেলেটার মাধ্যমে নিজেকে বোঝায় তবে ব্যাপারটা একই থাকবে। আমার কল্পনায় হামাওকা বলতে কুনিহিকো হিদাকার চেহারাটাই ভেসে ওঠে। এজন্য এই জায়গায় অন্য কাউকে কল্পনা করা কঠিন। আপনার পছন্দের কোনো বই থেকে মুভি বানানো হল কিন্তু নায়ক আপনার কল্পনার চরিত্রের সাথে মিলল না, ব্যাপারটা এমনই।”

“তাহলে কুনিহিকো হিদাকা আপনার কল্পনার হামাওকার সাথে মেলে?”

“ওরকমই মনে হয়…কিন্তু বইটা প্রথম পড়ার সময় এই চরিত্রের জায়গায় তাকেই কল্পনা করেছি, এজন্যই হয়তো।”

তাকে জিজ্ঞেস করলাম যেহেতু ‘নিষিদ্ধ প্রান্তর’ বইটার লেখক ওসামু নোনোগুচি, এখন কী করবে।

একমুহূর্ত ভেবে শীতল কন্ঠে সে বলল, “মিস্টার নোনোগুচির বিচারের রায় আসার আগপর্যন্ত অপেক্ষা করবো। এরপর নিজের প্রতিক্রিয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেব।”

থানায় পৌঁছে দেখলাম ডিটেক্টিভ চিফ আমার সাথে কথা বলার জন্য অপেক্ষা করছে। তার অফিসে আমাকে ডেকে জিজ্ঞেস করল কেন এখনো এই কেসটা বন্ধ করে সবকিছু প্রসিকিউটরের অফিসে পাঠিয়ে দিচ্ছি না। আমি এখনও কুনিহিকো হিদাকার খুনের তদন্ত করছি শোনার পর খুব বেশি সন্তুষ্ট দেখাল না তাকে। খুনির স্বীকারোক্তি পাওয়ার পরও এই কেসটার পিছে আমার ছুটে বেড়ানো নিয়ে তার সমস্যা থাকার কারণে তাকে দোষারোপ করতে পারলাম না। কেন না ওই স্বীকারোক্তিতে সব প্রমাণাদি ও মোটিভের ব্যাপারে খোলাসা করা হয়েছে। সবথেকে বড় কথা, ওটা লিখেছে স্বয়ং খুনিই।

“তাহলে কোন জিনিসটা মিলছে না?” কন্ঠে বিরক্তি নিয়ে জিজ্ঞেস করল চিফ। “আমার দৃষ্টিকোণ থেকে তো সবকিছু একেবারে পানির মত পরিস্কার হয়ে গেছে।”

কোনো এভিডেন্স বাতিল করার মত ভিত্তি আমার কাছে নেই, এভিডেন্সগুলো আমিই খতিয়ে দেখেছি। অতি সম্প্রতি, আমার মনে হয়েছিল বেস্টসেলিং লেখকের খুনের ব্যাপারে খতিয়ে দেখার মত আর কিছু নেই। নোনোগুচির মিথ্যা অ্যালিবাই ভেঙে হিদাকার সাথে তার সম্পর্কটা প্রকাশ করতে সফল হয়েছি আমি। বরং নিজের কাজে আমি গর্বিত।

কিন্তু এতসব নিশ্চয়তার মধ্যেও সংশয় দানা বাঁধছে। হাসপাতালের বিছানায় নোনোগুচিকে জিজ্ঞাসাবাদ করার পর রিপোর্ট লেখার সময় এর সূত্রপাত। নোনোগুচির হাতের দিকে নজর গেলে, তার আঙুলের ডগার দিকে তাকিয়ে একটা বিব্রতকর চিন্তা মাথায় আসে। ওইসময় সেটা এড়িয়ে যাই আমি। ব্যাপারটা বড়ই অবাস্তব।

কিন্তু এখনো ওই চিন্তাটা দূরে সরাতে পারিনি। মনের মধ্যে ক্রমাগত খুঁচিয়েই চলেছে ব্যাপারটা। বলা ভালো, প্রথমবার নোনোগুচিকে গ্রেফতারের সময় কোনো ভুল পদক্ষেপ নিচ্ছি কি না ভেবে আমিও শঙ্কিত ছিলাম। এখন এই শঙ্কাটা আরও বেড়ে গিয়েছে।

হতে পারে আমার সংশয়, সন্দেহ কেবলই বিভ্রম। হতে পারে ডিটেক্টিভ হিসেবে আমার একটা দুর্বলতার বহিঃপ্রকাশ-ই এই বিভ্রম। তবুও এরকম সংশয় মনের ভেতর নিয়ে এখনই এই কেসটা বন্ধ করে দিতে চাই না আমি।

একারণেই ডজনখানেক বারেরও বেশি ওসামু নোনোগুচির স্বীকারোক্তিটা পড়েছি। পড়ার সময় নিজেকেই কিছু প্রশ্ন করেছি, যা আগে মাথাতে আসেনি

১. কুনিহিকো হিদাকার ওপর নোনোগুচির চালানো হত্যাচেষ্টার ব্যাপারটাকে ব্যবহার করে হিদাকা নোনোগুচিকে ব্ল্যাকমেইল করে তাকে নিজের গোস্টরাইটার বানায়, নোনোগুচি যদি কিছু না ভেবেই উল্টো গোস্টরাইটারের ব্যাপারটা ফাঁস করে দিত তাহলে কী হত? এতে তো হিদাকারও উল্লেখযোগ্য ক্ষতি হত। হয়তো লেখক হিসেবে তার ক্যারিয়ারটাই শেষ হয়ে যেত। হিদাকা কেন এটা নিয়ে ভয় পায়নি? নোনোগুচির মতে, সে বিষয়টা ফাঁস করেনি কারণ সে হাতসুমির জড়িত থাকার ব্যাপারটা সামনে আনতে চায়নি। কিন্তু হিদাকার তো নিশ্চিতভাবে জানার কথা নয় নোনোগুচি এমন কিছু করবে।

২. হাতসুমির মৃত্যুর পরও কেন নোনোগুচি হিদাকার ব্ল্যাকমেইলে বাঁধা দেয়নি? স্বীকারোক্তিতে নোনোগুচি বলেছে, এই মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধে ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিল সে। যদি সেটাই হয়, তাহলে ঘুরে দাঁড়িয়ে পাল্টা আক্রমণ চালানোই কি ভালো পন্থা ছিল না?

৩. ভিডিও টেপ আর ছুরিটা কি হত্যাচেষ্টার অভিযোগ আনার মত যথেষ্ট এভিডেন্স? টেপে শুধু ধরা পড়েছে হিদাকার অফিসের জানালা দিয়ে নোনোগুচির অনুপ্রবেশ। আর ছুরিটাতে কোনো রক্তের দাগ ছিল না। উপরন্তু, ক্রাইম-সিনে উপস্থিত থাকা দুজন ব্যক্তি হল খুনের চেষ্টা চালানো ব্যক্তি, ভিক্টিম ও হাতসুমি, অপরাধের আরেক ষড়যন্ত্রকারী। হাতসুমির সাক্ষ্যের ওপর নির্ভর করলে ট্রায়ালে নোনোগুচির নির্দোষ প্রমাণিত হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি ছিল।

৪. স্বীকারোক্তিতে নোনোগুচি বলেছে হিদাকার তার সাথে সম্পর্কটা সত্যিকারের সহযোগীর মতোই হয়ে গিয়েছিল। পূর্বের ব্যাপারগুলো বিবেচনা করে, আদৌও কি এমনটা হওয়া সম্ভব?

এই চারটা পয়েন্ট নিয়েই নোনোগুচিকে প্রশ্ন করি আমি। সবগুলোর জন্য একটাই মাত্র উত্তর দিয়েছে সে :

“আপনার কাছে অদ্ভুত লাগতে পারে ব্যাপারটা কিন্তু আপনাকে খুশি করার জন্য যা ঘটেছে সেটা পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। আমি আপনাকে বলতে পারবো না কী করেছি, কেন করেছি, কখন করেছি। শুধু বলতে পারবো, আমার মানসিক অবস্থা ভালো ছিল না কয়েক বছর ধরেই।”

এরপর আমার আর কিছু বলার থাকে না। স্পষ্ট সাংঘর্ষিক কোনো ব্যাপার থাকলে সেটা তার দিকে ছুঁড়ে দিতে পারতাম, তখন হয়ত কিছু পেলেও পাওয়া যেত। কিন্তু এই বিষয়ে আমার সংশয় ও সন্দেহগুলো কেবলই কয়েকটা সূক্ষ্ম মনস্তাত্ত্বিক প্রশ্ন। কোনো শক্ত ভিত্তি নেই এসবের।

যাইহোক, আমার সংশয়গুলোর পিছে আরেকটা কারণ রয়েছে, যা ঐ চারটা পয়েন্টকেও ছাপিয়ে গিয়েছে। সেটা হল লোকটার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। অন্যান্য ইনভেস্টিগেটর ও চিফের চাইতে ওসামু নোনোগুচিকে আমি বেশি ভালো চিনি। তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য আর তার লেখা স্বীকারোক্তি ঠিক খাপ খায় না।

আমার বিকল্প থিওরিটা বাতিল না করার ইচ্ছা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। যেটার কারণেই সৃষ্টি হয়েছে ওই সন্দেহগুলো। থিওরিটা যদি সত্যি হয় তবে সবকিছুরই ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে।

রাই হিকাদার সাথে দেখা করতে যাওয়ার স্পষ্ট উদ্দেশ্য ছিল আমার। আমি যে ধারণা করেছি তা যদি সত্যি হয়, তার স্বামীর ব্যাপারে লেখা ওসামু নোনোগুচির প্রথম স্বীকারোক্তিটার নিশ্চয়ই ভিন্ন কোনো উদ্দেশ্য আছে।

যাইহোক, আমি প্রয়োজনীয় তথ্য বের করতে পারিনি। রাই হিদাকার কাছ থেকে পাওয়া একমাত্র তথ্য হল, নোনোগুচি ওদের জন্য এক বোতল শ্যাম্পেইন নিয়ে গিয়েছিল। নিজের স্বীকারোক্তিতে হয়ত এই ব্যাপারটা যোগ করতে ভুলে গিয়েছে নোনোগুচি। অথবা কোনো কারণে বাদ দিয়েছে এইটা । এই ব্যাপারটা অর্থপূর্ণ-ই মনে হয়েছে, সাধারণত অ্যালকোহল নিয়ে যাওয়ার মত লোক নয় নোনোগুচি। ওই দম্পতির জন্য বিদায়ী উপহার হিসেবেই সম্ভবত জিনিসটা নিয়ে যায় সে। এছাড়া অন্য কোনো কারণ থাকলে সেটা বের করতে পারিনি আমি। আপাতত শ্যাম্পেইনের বোতলটা মাথা থেকে দূরে সরিয়ে রাখলাম, পরবর্তিতে এটা নিয়ে ভাবা যাবে।

আমার মতে ওসামু নোনোগুচি ও কুনিহিকো হিদাকার মধ্যকার সম্পর্কটা আরেকবার যাচাই করে দেখা উচিত। নিশ্চিতভাবেই কোথাও না কোথাও ভুল করেছি আমি, আবারও প্রথম থেকে শুরু করতে হবে আমাকে।

তবে, মিয়াকো ফুজিওর সাথে মিটিংটা কার্যকরী হয়েছে। তার সাথে কথা বলার সময় বুঝতে পেরেছি আমার পরবর্তি পদক্ষেপ কি হবে। এই দুই ব্যক্তির ভেতরকার সম্পর্কের ব্যাপারে পরিস্কার ধারণা পেতে আমাকে ফিরে যেতে হবে ওদের একসাথে কাটানো মিডল-স্কুলের দিনগুলোতে। এই গবেষণায় উপন্যাস ও ডকুমেন্টারি ‘নিষিদ্ধ প্রান্তর’কে বেশ ভালো রিসোর্স বলা যেতে পারে।

মিস ফুজিওর সাথে মিটিং শেষ করে সরাসরি বুকশপে গিয়ে কিনে ফেলি এই বইয়ের একটা কপি। বাড়ি ফেরার ট্রেনে বসেই পড়া শুরু করে দিই। দ্রুতই পড়ে ফেলতে পেরেছি, কেন না জানতাম কোনদিকে যাচ্ছে কাহিনী স্বাভাবিকভাবেই উপন্যাসের সাহিত্যগুণ বিচারের মত কেউ নই আমি।

ফুজিও যেমনটা বলেছে, এই বইটা লেখা হামাওকা চরিত্রটির দৃষ্টিকোণ থেকে। গল্প শুরুই হয় হামাওকাকে দিয়ে, একটা নামবিহীন কোম্পানিতে চাকরী করে সে। সকালবেলা পত্রিকা পড়ে জানতে পারে এক কাঠ খোদাই শিল্পীর খুনের ব্যাপারে। বুকের ওপর ছুরি মেরে খুন করা হয় ওই শিল্পীকে শিল্পীর নাম কাজুয়া নিশিনা। স্কুলে হামাওকাকে যে দলটা উত্যক্ত করত, সেই দলের নেতা ছিল এই নিশিনা।

মিডল স্কুলের শেষ বর্ষে এই উত্যক্তের মাত্রা চরমে ওঠে। বেশ কয়েকবার পেটানো হয় হামাওকাকে। জীবনে একটা দাগ কেটে দিয়েছে এই ব্যাপারটা।। একবার তাকে নগ্ন করে, সেলোফেনে মুড়িয়ে ফেলে রাখা হয়েছিল জিমনেশিয়ামের কোণায়। আরেকবার জানালার পাশ দিয়ে হাঁটার সময় তার মাথায় ফেলে দেয়া হয় এক কাপ হাইড্রোক্লোরিক এসিড। এসব বখাটে ছেলেদের হাতে তার মার খাওয়া নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। গালি, মার ও কিশোর-কিশোরীদের ভষায় ‘প্র্যাঙ্কের’ শিকার হতে থাকে প্রতিদিনই।

বইয়ে বেশ বিস্তারিতভাবেই এসবের বর্ণনা দেয়া আছে। পাঠকের মনে প্রভাব ফেলার মত যথেষ্ট। বুঝতে পারি, কেন ফুজিও এটাকে ফিকশন কম জীবনী বেশি বলে দাবি করেছে।

কিন্তু কেন হামাওকাকেই এভাবে টার্গেট বানিয়ে উত্যক্ত করা হয়েছে সেটা পরিস্কার করা হয়নি। তার মতে হুট করেই একদিন শুরু হয় ব্যাপারটা, যেন “ভুল কবরে পা রেখে শয়তানকে খেপিয়ে দিয়েছিল।” এই নির্যাতনের বর্ণনা পড়ে এর সাথে আমার শিক্ষকতা জীবনে দেখা অন্যান্য নির্যাতনগুলোর বেশ মিল পেয়েছি। প্রথমদিকে মাথা উঁচু রেখে নির্যাতন প্রতিহত করার চেষ্টা করে টার্গেট। কিন্তু আস্তে আস্তে আতঙ্ক ও হতাশায় ঝিমিয়ে পড়তে হয়।

“নির্যাতনটা সবথেকে জঘন্য দিক নয়। জঘন্য দিকটা হল, যে ছেলেরা তাকে ঘৃণা করে তাদের থেকে ধেয়ে আসা নেতিবাচক প্রভাব। কখনোই সে কল্পনা করেনি এরকম বিদ্বেষ এই দুনিয়ায় থাকতে পারে।”

আমার মতে নিষিদ্ধ প্রান্তর বইয়ের এই লাইনটা দিয়েই একজন ভিক্টিমের অনুভূতি সবথেকে ভালোভাবে প্রকাশ করা যায়। শিক্ষক থাকাকালীন দেখেছি, এইধরনের ভিক্টিমরা একনাগাড়ে নির্যাতনের ফলে বুদ্ধিভ্রষ্ট হয়ে পড়ত।

সৌভাগ্যজনকভাবে, এই দলটার নেতা অন্য স্কুলে বদলী হয়ে গেলে হামাওকার হয়রানী বন্ধ হয়ে যায়। কেউ জানত না কোথায় গেছে নিশিনা, তবে গুজব ছিল একটা মেয়েকে যৌন হয়রানী করার কারণেই বদলী করা হয় তাকে।

হামাওকার মিডল স্কুলের কাহিনী এখানেই শেষ। কয়েকটা নাটকীয় কাহিনীর পর (এই কেসের সাথে যা অপ্রাসঙ্গিক) নিশিনার ট্রেইল অনুসরণ করতে থাকে হামাওকা।

বইয়ের বাকি অংশ বিভক্ত হয়েছে হামাওকার স্মৃতিচারণ ও তার তদন্তের ফলাফল দিয়ে। প্রথম অংশে পাঠক জানতে পারবে স্কুল থেকে নিশিনার চলে যাওয়ার পিছনের প্রকৃত ঘটনা। যে মেয়েকে হয়রানী করেছিল নিশিনা, ওই মেয়েটা ছিল কাছের এক ক্যাথলিক স্কুলের ছাত্রি। আড়ালে নিয়ে গিয়ে নিশিনার সাঙ্গপাঙ্গরা মেয়েটাকে চেপে ধরে, এরপর মেয়েটাকে ধর্ষণ করে নিশিনা। আর পুরো ঘটনাটিকে বন্দি করে ভিডিওতে। একটা লোকাল গ্যাংয়ের কাছে ভিডিওটা বিক্রি করার মতলব ছিল তার, যারা এইধরনের ভিডিওর পরিবেশক।

এসবের কোনকিছুই পত্রিকায় আসেনি, কেন না মেয়েটার পরিবার প্রভাবশালী ছিল। পুরো ব্যাপারটাকে আড়াল করে ফেলতে সক্ষম হয় তারা।

বইয়ের প্রথমার্ধেই এই বিষয়টা প্রকাশ পেয়েছে। যা থেকে কাজুয়া নিশিনার হিংস্রতার ব্যাপারে ধারণা পাওয়া যায়। বইয়ের দ্বিতীয়ার্ধে দেখা যায় হুট করেই পরিবর্তন এসেছে নিশিনার জীবনে। নিজেকে একজন কাঠ খোদাই শিল্পী হিসেবে গড়ে তোলে সে। গল্পের শেষ ঘটে নিশিনার প্রথম প্রদর্শনীর ঠিক আগে এক পতিতা রাস্তাতে তার বুকে ছুরি বসিয়ে খুন করার মাধ্যমে। বোঝাই যাচ্ছে, ছুরি মারার ঘটনাটা বাস্তবতার ওপর ভিত্তি করেই লেখা।

বুঝতে পেরেছি, কেন ফুজিওর কাছে স্বয়ং লেখককেই গল্পের হামাওকা বলে মনে হয়েছে। এটা সাধারণ কোনো উপন্যাস হলে ফুজিওর এই ধারণাটা হাস্যকর হত। কিন্তু বাস্তব ঘটনার ওপর ভিত্তি করে লেখা কোনো কিছুর সম্ভাব্য ব্যাখ্যা থাকে।

ফুজিওর মতে এই বইটা লেখা হয়েছে নিজের উত্যক্তকারীর বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেয়ার জন্য। তার দাবি অনুযায়ী, এই বইয়ে কাজুয়া নিশিনা চরিত্রটা পুরো বই জুড়েই লেখকের কোনো সহানুভূতি পায়নি। বলা যেতে পারে শৈশবে এত নির্যাতন ও হয়রানির শিকার না হলে কেউ এত নিখুঁতভাবে ব্যাখ্যা করে নির্যাতনকারীর নিষ্ঠুরতা ও মানবিক দুর্বলতা নিয়ে লিখতে পারত না। এজন্যই হয়ত মিয়াকো ফুজিও দাবি করেছে, এই উপন্যাসে আবর্জনা খুঁড়ে টেনে আনা হয়েছে তার পরিবারের নাম।

ধরে নেয়া যাক, হামাওকা চরিত্রটা হচ্ছে ওসামু নোনোগুচি, তাহলে এক্ষেত্রে কাহিনীতে কুনিহিকো হিদাকা কোনটা? (আর হিদাকা যদি লেখক হয়ে থাকে তাহলে নোনোগুচি কোনটা?)

আপাতদৃষ্টিতে এই বইটা পুরোপুরি ফিকশন। চরিত্রগুলোকে হয়ত তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু এই জিনিসটা আমাকে খোঁচাচ্ছে না। আমি ভাবছি মিডল-স্কুলে থাকাকালীন ওসামু নোনোগুচি হয়রানীর শিকার হলে কুনিহিকো হিদাকা তখন কি করছিল? বসে বসে চুপচাপ তার নির্যাতন হওয়া দেখছিল?

এই ব্যাপারটা নিয়ে ভাবছি একটা নির্দিষ্ট কারণে। খুনের ঘটনার বিবরণ দিয়ে লেখা স্বীকারোক্তিতে নোনোগুচি বারবার ‘বন্ধু” বলে অভিহিত করেছে হিদাকাকে।

দুর্ভাগ্যজনক হলে সত্যি, অভিভাবকের নজরদারি কিংবা শিক্ষকের হস্তক্ষেপেও এসব বুলিয়িং বা নির্যাতন দমানো যায় না। কিন্তু একটা শিশুর সবথেকে বড় সহযোগী তার বন্ধু। হামাওকা চরিত্রটার কোনো বন্ধু থেকে থাকলেও পুরো ঘটনায় তার কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। আর বন্ধুর বিপদে যে এগিয়ে আসে না আদৌ সে কোনো বন্ধু নয়।

ওসামু নোনোগুচির স্বীকারোক্তিতেও এই সাংঘর্ষিক ব্যাপারটা লক্ষ করেছি। এক বন্ধু কখনোই অপর কোনো বন্ধুর স্ত্রীকে ছিনিয়ে নিতে পারে না। বন্ধু কখনোই বন্ধুর স্ত্রীর সাথে মিলে বন্ধুকেই হত্যার পরিকল্পনা করতে পারে না। আর কোনো বন্ধু তার বন্ধুকে ব্ল্যাকমেইল করে বানাতে পারে না নিজের গোস্টরাইটারও।

তাহলে কেন কুনিহিকো হিদাকাকে নিজের বন্ধু বলে বিবেচনা করেছে নোনোগুচি?

আমি যে নতুন থিওরিটা নিয়ে কাজ করছি সেটাতে এই সবকিছুর ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে।

যে থিওরিটা মাথায় এসেছে কলম ব্যবহারের কারণে কড়া পড়ে যাওয়া নোনোগুচির মধ্যাঙ্গুলিটা দেখে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *