অধ্যায় ৮ – অতীত (তৃতীয় পর্ব) : কিয়োচিরো কাগার গল্প
আমার বিশ্বাস, আমি এমন সবার সাথেই দেখা করেছি যারা ওসামু নোনোগুচি ও কুনিহিকো হিদাকার অতীতের ব্যাপারে কিছু না কিছু জানাতে পারবে, বিশেষ করে ওদের মিডল-স্কুলে পড়াকালীন সময়ের ব্যাপারে। আমি নিশ্চিত, আরও অনেকেরই খোঁজ পাইনি, কিন্তু যা পেয়েছি আমার মনে হয় আপাতত ওটুকুই যথেষ্ট। যদিও সকল এভিডেন্স ও সাক্ষ্য পুরো ব্যাপারটাকে বিশাল এক ধাঁধার অসংখ্য টুকরায় পরিণত করেছে।
সবকিছুর কেন্দ্রে রয়েছে হিদাকা ও নোনোগুচির মিডল-স্কুল জীবনে হওয়া ওই বুলিয়িংয়ের ঘটনাগুলো। আর এটাই ব্যাখ্যা করে ওদের ভবিষ্যত সম্পর্ককে। ওই ঘটনাগুলোর গুরুত্ব অনুধাবন করার পর টের পেলাম গল্পের বাকি অংশ মিলে যাচ্ছে। এখন একটা ব্যাপার নিশ্চিত, এই বিভ্রান্তিকর অতীত ইতিহাসটুকু না বুঝলে হিদাকার মৃত্যুর দিন কী ঘটেছিল সেটা বোঝা প্রায় অসম্ভব।
***
বুলিয়িংয়ের ব্যাপারে কিছুটা হলেও ধারণা আছে আমার, যদিও প্ৰত্যক্ষভাবে নয় (ভিক্টিম বা নির্যাতনকারীর সম্পর্কে, অন্তত একটু হলেও এদের ব্যাপারে অবগত)। আমার অভিজ্ঞতা পরোক্ষ। দশ বছর আগে মিডল-স্কুলের হোমরুম টিচার থাকাকালীন নবম গ্রেডের দায়িত্বে ছিলাম আমি। প্ৰথম সেমিস্টারের শেষের দিকে প্রথমবারের মত বুলিয়িংয়ের আভাস নজরে আসে। সেমিস্টার শেষের পরীক্ষা থেকেই পাই প্রথম সূত্র। ইংলিশ শিক্ষকের মতে, হোমরুমের পাঁচজন ছাত্র একটা প্রশ্নের উত্তর একইভাবে ভুল করেছিল।
ওই ইংলিশ টিচারকে ঠাণ্ডা মাথার একজন বিবেচক লোক হিসেবেই জানতাম। কখনোই তাকে কোনো ব্যাপারে রাগ বা বিরক্তি প্রকাশ করতে দেখিনি।
“এটাকে একপ্রকার নকল-ই বলা চলে। এরা সবাই ক্লাসরুমের পিছে একইসাথে বসে পরীক্ষা দিয়েছে। ওদের সাথে গিয়ে কথা বলতে পারতাম, কিন্তু ভাবলাম প্রথমে তোমার সাথে আলাপ করি।”
কয়েকমুহূর্ত বিবেচনা করে তাকে জিজ্ঞেস করলাম ব্যাপারটা আমি খতিয়ে দেখব কি না?যদি সত্যি নকল হয়ে থাকে, তবে সেটা শুধু ইংলিশ ক্লাসেই সীমাবদ্ধ নয়।
“দ্রুত ব্যবস্থা নাও,” বলে সে। “একবার ওদেরকে ছাড় দিলে বাকিরাও পেয়ে বসবে।“
তার কথাটা গুরুত্বের সাথেই নিই আমি।
বাকি শিক্ষকদের কাছে যাই আমি, যাদের সাবজেক্ট ওই ছাত্রগুলোর ছিল, ওদের জিজ্ঞাসা করি পরীক্ষার খাতায় সন্দেহজনক কিছু নজরে পড়েছে নাকি। আমি যে বিষয়টা পড়াতাম: সামাজিক বিজ্ঞান ও ভূগোল—সেটার টেস্টের খাতাও আরেকবার চেক করি।
কেবল ওই পাঁচজনের উত্তরপত্রেই কিছু মিল ছিল। কম্পোজিশন, সায়েন্স ও আমার সাবজেক্টে আর কোনো ছাত্রের নকলের কোনো আলামত পাইনি।
বিজ্ঞান শিক্ষকের মতামত:
“ওরা বোকা নয়। ধরা পড়ে যাবে, এমন কিছু করবে না ওরা। বাচ্চারাও মাথা খাটালে ধূর্ত হতে পারে।”
কিন্তু গণিতে কাজ করল না ওদের চালাকি।
গণিত শিক্ষকের মতামত:
“কোনো ছাত্র প্রথম বা দ্বিতীয় বর্ষে অংক না বুঝলে তৃতীয় বর্ষে সাধারণত কিছুই ধরতে পারে না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কোনো টেস্টের আগে আমি বুঝতে পারি কে কোন প্রশ্নটার উত্তর করতে পারবে। যেমন আমি জানি সর্বশেষ টেস্টে শেষ উপপাদ্যের প্রমানটা করা ইয়ামাওকার ক্ষমতার বাইরে। তার উত্তরটা দেখো : ‘A, D, E, F’ কিন্তু সঠিক উত্তর হল : A, D, E, F I ছেলেটা অন্যের খাতা দেখে লিখেছে নিশ্চিত, আর ডেল্টার স্থানে A বসিয়েছে।”
একজন গণিতবিদের কাছ থেকে এমন যুক্তিই আশা করা যায়।
স্পষ্টতই এই পরিস্থিতিতে আশাবাদী হওয়ার কোনো কারণ নেই। কিন্তু এই বিষয়ে আমার প্রতিক্রিয়ার ব্যাপারে বিবেচনা করতে হত। স্কুলের বাচ্চাদের হাতেনাতে না ধরে নকলের জন্য শাস্তি দেয়া স্কুল পলিসির বাইরে। তবুও ছাত্রদের নকল করার বিষয়টা আমাদের চোখে পড়েছে এটা ওদের জানানো আমাদের কর্তব্য। সোজা কথায় সাবধান করতে হবে ওদেরকে। তো একদিন ক্লাস শেষে জড়িত ছাত্রদের সাবধান হয়ে যেতে বললাম।
প্রথমে জানালাম, নকলের অভিযোগে সন্দেহ করা হচ্ছে ওদেরকে। এরপর বলি সন্দেহের পেছনের কারণ—ইংলিশ পরীক্ষায় একই রকম ভুল করেছে ওরা সবাই।
“তোমাদের কি বলার মত কিছু আছে?” জিজ্ঞেস করি আমি।
কেউই কোনো জবাব দেয় না। ইয়ামাওকার দিকে ইঙ্গিত করে জিজ্ঞেস করি এরপর।
মাথা নাড়ে সে, “আমি নকল করিনি।”
এরপর একে একে প্রত্যেককেই জিজ্ঞেস করি, সবাই-ই অস্বীকার করে। প্রমাণ ছাড়া কিছুই করার নেই আমার। কিন্তু নিশ্চিত ওরা মিথ্যে বলছিল।
কথা বলার সময় নিচু ছিল সবার মাথা, কিন্তু মেইনো নামের একজনের চোখ লাল হয়ে গিয়েছিল আমি কথা শেষ করার সময়। ছাত্রদের অবস্থা ও আগের বছরের রেজাল্টের ওপর ভিত্তি করে আমি অনেকটাই নিশ্চিত ছিলাম এই ছেলেটার খাতা-ই বাকিদের নকলের উৎস। স্কুলের নিয়ম অনুযায়ী, যে নিজের খাতা দেখিয়ে অন্যদের নকল করতে দেবে সে-ও বাকিদের মতই দোষী। ওই রাতে মেইনোর মায়ের কল পাই আমি। মহিলা জানায়, তার ছেলে উদ্ভট আচরণ করছে, স্কুলে কিছু ঘটেছে কি না। নকলের ঘটনাটা তাকে বলি, ফোনের অপরপ্রান্ত থেকে শুনতে পাই দীর্ঘশ্বাস।
“আমার সন্দেহ আপনার ছেলেই বাকিদেরকে তার উত্তরপত্র দেখিয়েছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এটাও অপরাধ। যাইহোক, আমাদের হাতে নিরেট প্রমাণ নেই বলে এবার কিছু করছি না। ওই পাঁচজনকে এবার সাবধান করেই ছেড়ে দিচ্ছি। আপনার ছেলে কী রকম উদ্ভট আচরণ করছে বললেন?”
“পোশাকে কাদামাখা অবস্থায় বাসায় এসেছে ও,” কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলে ওই মহিলা। “এরপর ঘরে দরজা লাগিয়ে বসে আছে, এখনো বের হয়নি। ওর চেহারার দিকে একঝলক তাকিয়েছিলাম। চেহারা ফুলে আছে, মিস্টার কাগা। আমার মনে হয়, আহত হয়েছে ও, রক্তও ঝরেছে।”
পরেরদিন অসুস্থতার কারণে স্কুলে আসেনি মেইনো। একদিন পর সে স্কুলে এলে লক্ষ করলাম তার একটা চোখের ওপর কাটা দাগ। ফোলা মুখ আর কালশিটে দেখেই বোঝা যাচ্ছিল কেউ পিটিয়েছে তাকে। কার কাজ হতে পারে এটা আমার ধারণা ছিল।
ঠিক তখনই বুঝতে পারি যারা মেইনোর খাতা নকল করেছিল ওরা তার বন্ধু নয়। জোর করে তার খাতা দেখে লেখে ওরা। খাতায় ভুল ছিল বলে এভাবে ওকে শাস্তি দিয়েছে। আমি জানতাম না, এই নকলের ঘটনার আগে থেকেই স্কুলে বুলিং চলত নাকি পরে শুরু হয়েছে।
এরপরই গ্রীষ্মকালীন ছুটি শুরু হয়ে যায়, কী বাজে টাইমিং ছুটি শুরু হওয়ার! যখনই ভাবলাম ব্যবস্থা নেবো তখনই ওদেরকে আর পেলাম না ছুটির কারণে। ভেবেছিলাম ছুটি শেষ হলে ওদেরকে ধরব। কিন্তু পারিনি, ব্যস্ত হয়ে পড়ি। পরবর্তি বছরে আমার ছাত্ররা যেন ভালো হাইস্কুলে ভর্তি হতে পারে এজন্য ওদেরকে নিয়েই ব্যস্ত ছিলাম। স্কুলের প্রসপেক্টাস সংগ্রহ, রিকমেন্ডেশন তৈরি, ফর্ম পূরণ আরও কত কাজ। কিন্তু এগুলো কেবলই অজুহাত। এরইমধ্যে ইয়ামাওকা ও তার বন্ধুরা প্রায় দশ হাজার ইয়েনের মত ছিনিয়ে নেয় মেইনোর কাছ থেকে। একজন স্কুলবালকের জন্য টাকার অঙ্কটা বেশ বড়ই। আরও বড় কথা হল দিনে দিনে ওদের মাস্তানি, জোরজবস্তি, হেনস্তা বাড়তেই থাকল। ব্যস্ততার কারণে এসব ব্যাপারে পরে জানতে পারলাম। দ্বিতীয় সেমিস্টারের শুরুর দিকে মেইনোর নিম্নগামী গ্রেড আর বখাটে ছেলেগুলোর মাস্তানি উভয়ের ব্যাপারেই অবগত হলাম। প্রতিদিনই কাউকে না কাউকে হেনস্তা করত ওরা। খারাপ হয়ে উঠছিল পরিস্থিতি। কিন্তু কতটা খারাপ সেটা আমার কল্পনারও বাইরে। পরে জানতে পারি, মেইনোর মাথার চুলের আড়ালে ছিল ছয়টারও বেশি সিগারেটের ছ্যাকার দাগ
আমার কয়েকজনের কলিগের মতে কয়েকদিন পরেই যেহেতু এরা গ্র্যাজুয়েট হয়ে স্কুল ছাড়বে সেহেতু এই বুলিংয়ের ব্যাপারটা এড়িয়ে যাওয়াই উত্তম। অপর কথায় গ্র্যাজুয়েশনকেই এই সমস্যার সমাধান ভাবা হয়েছিল। কিন্তু আমার মতে এটা কোনো সমাধান নয়। আমি শিক্ষক হিসেবেও তুলনামূলক নতুন ছিলাম। ওই বছরই প্রথমবারের মত সিনিয়র ক্লাসের হোমরুমে নিয়োগ দেয়া হয় আমাকে। চাইতাম না, আমার অধীনে থাকার কারণে কোনো ছাত্র আফসোস করুক।
প্রথমে মেইনোর সাথে কথা বলার সিদ্ধান্ত নিই, জানতে চাই এই হয়রানীর শুরুটা কিভাবে আর এযাবৎ কী ঘটেছে।
কথা বলতে রাজি হয় না মেইনো। ভয় পাচ্ছিল, কথা বললে যদি বুলিয়িং বেড়ে যায়। ওর কপাল দিয়ে বেয়ে পড়া ঘাম আর কাঁপতে থাকা আঙুল দেখে বুঝতে পারি ছেলেটা আতঙ্কিত। মেইনোর আত্মবিশ্বাস কিভাবে বাড়ানো যায় সেটা ভাবি। কেন্ডো চর্চা আত্মবিশ্বাস বাড়ানোর ভালো উপায় হতে পারে বলে মনে হয়েছিল আমার। সেসময় স্কুলের কেন্ডো ক্লাবের দায়িত্বে ছিলাম আমি। অনেক ভীতু ছেলেকেও এই খেলাটা খেলে সাহসী হয়ে উঠতে দেখেছি।
বছরের মাঝামাঝি হওয়ায় কেন্ডো ক্লাবে নতুন সদস্য নেয়া হচ্ছিল না, এজন্য প্রত্যেকদিন সকালে স্কুল শুরুর আগে মেইনোকে ব্যক্তিগতভাবে চর্চা করাতে থাকি আমি। আমি কি করার চেষ্টা করছি সেটা বোঝার মত যথেষ্ট বিচক্ষণ ছিল মেইনো। কেন্ডোর নিয়মগুলো বেশ ভালোই রপ্ত করছিল সে, কিন্তু তার আগ্রহ ছিল অন্য কিছুতে : ছুরি নিক্ষেপ।
ছুরি নিক্ষেপের খেলাটা আমি শেখাতাম খেলোয়াড়দের মনযোগ বাড়ানোর জন্য। খেলাটা ছিল সহজ : দেয়ালের তাতামির দিকে লক্ষ্য করে ছুরিটা নিক্ষেপ করা। মাঝেমধ্যে চোখ বন্ধ করে এমনকি উল্টো ঘুরেও লক্ষ্যভেদ করতে পারতাম আমি। এই খেলাটাতে অধিক মনযোগের দরকার হত। চারপাশে সবকিছুর ওপর সজাগ থেকে লক্ষ্য ও ছুরির দিকেই নিবদ্ধ করতে হত সকল মনযোগ। দুর্ঘটনা এড়ানোর জন্য জিমে কেউ আসার আগেই এই অনুশীলনটা করতাম আমি। কিন্তু একদিন আগেভাগেই চলে এসে আমাকে এই অনুশীলন করতে দেখে মেইনো। আমাকে বলে, এই খেলাটা চেষ্টা করতে চায় সেও। কোনো ছাত্রের হাতে ধারালো অস্ত্র দেয়া স্কুলের নিয়মনীতির বহির্ভূত ছিল। এজন্য আমি রাজি হইনি। কিন্তু আমার অনুশীলন দেখতে দিতাম তাকে। নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে, মনযোগ দিয়ে আমার চর্চা লক্ষ করত। একদিন এই খেলার ট্রিকের ব্যাপারে আমার কাছে জানতে চায় সে।
“শুধু বিশ্বাস রাখতে হবে, তোমার দ্বারা এটা করা সম্ভব,” তাকে বলি আমি।
এর কয়েকদিন পরেই বখাটেদের নেতা ইয়ামাওকা অ্যাপেন্ডিসাইটের কারণে হাসপাতালে ভর্তি হয়। যেহেতু বুলিংয়ের বিষয়টা এড়িয়ে যাওয়ার পক্ষে ছিলাম না আমি, সেহেতু এই ঘটনাটিকে মেইনোর মন থেকে ইয়ামাওকার ভয় অপসারণের সুযোগ হিসেবে দেখলাম।
ওকে বললাম প্রতিদিনের ক্লাসনোট কপি করে হাসপাতালে পাঠাতে। চোখে জল নিয়ে কাজটা করতে রাজি হল না ও। কিন্তু আমি শুনলাম না আমি চাইনি হতাশা নিয়ে গ্র্যাজুয়েট হোক ছেলেটা।
জানি না হাসপাতালে কি হচ্ছিল। তবে আমার মনে হয় মেইনো হাসপাতালে গিয়ে চুপিচুপি নোট রেখে চলে আসত। সম্ভবত ওদের দুজনের দেখাও হয়নি হাসপাতালে। আমার অবশ্য কিচ্ছু যায় আসে না। মনে হয়েছিল, ইয়ামাওকা যতই মেইনোর কাছে ঋণী হবে ততই আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠবে মেইনো। এটুকুই যথেষ্ট।
ইয়ামাওকা হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেলে জানতে পারি যেমনটা ভেবেছিলাম ঠিক তেমনটাই হয়েছে। কয়েকজন ছাত্রকে জিজ্ঞেস করি ওই বখাটেদের গ্যাং আর মেইনোর মধ্যকার অবস্থা সম্পর্কে। ওরা জানায়, পুরোপুরি থেমে গিয়েছে বুলিয়িং। ছেলেরা মিথ্যেও বলে থাকতে পারে, তবে মেইনোকে আগের থেকে আনন্দিত দেখাত। আমার মনে হয় সব হয়ত ঠিক হয়ে গিয়েছে।
গ্র্যাজুয়েশনের পর টের পাই কতটা ভুল ছিল আমার ধারণা।
গ্র্যাজুয়েশনের দিন আমি খুব খুশি ছিলাম। আমার ছাত্ররা সব হাইস্কুলে পা রাখবে, নিজের সাথে করে কোনো সমস্যাও নিয়ে যাচ্ছে না ওরা এটা ভেবে। এই সাফল্যের জন্য নিজেকেও একটু আত্মবিশ্বাসী মনে হচ্ছিল। ভেবেছিলাম, অন্তত পেশা নির্বাচনে ভুল করিনি আমি।
ঠিক ওই রাতেই পুলিশের কাছ থেকে একটা ফোনকল পাই। জুভেনাইল অ্যাফেয়ার্সের দায়িত্বে থাকা অফিসার এমন কিছু বলে যা শুনে রক্তে ভয়ের শীতল স্রোত বয়ে যায়। অস্ত্রসমেত গ্রেফতার করা হয়েছে মেইনোকে, মারামারির অভিযোগে।
প্রথমে মনে হয়েছিল ভুল হয়েছে অফিসারের। এর উল্টোটাই হওয়ার কথা নয়?
জানা যায় দুজনেই আহত। গ্রেফতারের সময় ছেড়া ছিল মেইনোর কাপড়। ফুলে ছিল চেহারা, আর পুরো শরীরে কালশিটে।
বিদায় অনুষ্ঠানের পর ইয়ামাওকা ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা মেইনোকে একা পেয়ে ইচ্ছামত পিটায়। মিস্টার কাগা নামক এক শিক্ষকের কড়া নজরে থাকার কারণে এতদিন কিছু করেনি ওরা। কিন্তু আমার নজরের বাইরে যেতেই ঝাঁপিয়ে পড়ে মেইনোর ওপর। পিটিয়ে পাল্টে দেয় ওর চেহারা।
জানি না মার খাওয়ার পর কতক্ষণ ওভাবে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে ছিল মেইনো। কিন্তু উঠে দাঁড়িয়েই প্রথমে জিমের কেন্ডো রুমে চলে যায় ও। ওখানে গিয়ে আমার লকার ভেঙে বের করে থ্রোয়িং নাইফ।
মেইনো জানত ইয়ামাওকাকে কোথায় পাওয়া যাবে, কেননা ওখানে গিয়েই ওদের চাঁদাবাজির টাকাটা ওকে বারবার দিয়ে আসতে হত। আড্ডাখানায় ইয়ামাওকাকে পেয়ে আর ইতস্তত করেনি মেইনো। তার কাছে গিয়ে বারবার ছুরি চালাতে থাকে ও। আড্ডাখানার মালিক কল করে পুলিশকে। পুলিশ এসে দেখে ওখানেই দাঁড়িয়ে আছে মেইনো, তখনো ওর হাতে আমার ছুরি।
তখনই পুলিশ স্টেশনে যাই আমি, কিন্তু আমার সাথে দেখা করতে রাজি হয়নি মেইনো। পরে শুনেছি সুস্থ হয়ে গিয়েছে ইয়ামাওকা, আঘাত গুরুতর ছিল না।
পরেরদিন কেসের দায়িত্বরত অফিসার আমাকে বলে, “জানেন মেইনো ওই জায়গায় ছেলেটাকে ছুরি মারার পর মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত ছিল। বাকি ছেলেদের জিজ্ঞেস করি, কেন ওরা প্রথমে মেইনোকে মেরেছে। ওরা বলে, ওদের নাকি তাকে পছন্দ নয়। কেন পছন্দ নয় জিজ্ঞেস করার পর কী বলেছে, জানেন?
“এমনিই।”
ব্যাপারটা আমাকে চরমভাবে হতাশ করে।
এরপর ইয়ামাওকা বা মেইনো কারোর সাথেই আর কথা বলিনি আমি। ঘটনার কয়েকদিন পর মেইনোর মা আমাকে জানায়, আমিই ‘দুনিয়ার একমাত্র ব্যক্তি যার সাথে কখনোই দেখা করতে চায় না মেইনো।
এপ্রিল মাসে স্কুলের নতুন বর্ষ শুরু হয়। আর ক্লাসরুমে ফিরে যাইনি আমি। একপ্রকার পালিয়েই বেঁচেছি। আজ পর্যন্ত আমার বিশ্বাস, এটাই আমার জীবনের সবথেকে জঘন্য ব্যর্থতা।