অধ্যায় ৩ – সংকল্প : ওসামু নোনোগুচির বক্তব্য

অধ্যায় ৩ – সংকল্প : ওসামু নোনোগুচির বক্তব্য

এই ঘর ছেড়ে বেরুবার আগে আমাকে লিখিত বক্তব্যটুকু শেষ করার বিশেষ অনুমতি দিয়েছেন ডিটেক্টিভ কাগা। অবশ্য আমি কেন লেখা চালিয়ে যেতে চেয়েছি, তা নিশ্চয়ই বোধগম্য হয়নি ওনার কাছে। বললেও অবশ্য বুঝতেন বলে মনে হয় না। লেখকমাত্রই যে কোন অসম্পূর্ণ লেখা শেষ করার একটা তাগিদ থেকে যায়। হোক সেটা উদ্দেশ্যপূর্ণ কোন লেখা।

গত এক-দেড় ঘন্টায় যা ঘটলো, তা লিখে রাখা দরকার বলেই আমার বিশ্বাস। আর এর জন্যে আমার লেখক সত্তাকেই দায়ী করবো। তবে এখন যা লেখবো, তা ভবিষ্যতে আমার জন্যে কাল হয়ে দাঁড়াবে, সেই বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।

***

আজ (২১শে এপ্রিল), ঠিক সকাল দশটায় আমার বাসায় এলেন ডিটেক্টিভ কাগা। বেলের শব্দ শুনেই আমার কেন যেন মনে হচ্ছিল দরজা খুলে হয়তো তাকেই দেখবো। পিপহোলে উঁকি দেয়া মাত্র অনুমানটা বাস্তবে রূপ নেয়। তবুও চেষ্টা করেছি নিজের অস্থিরতাটুকু যথাসম্ভব চেপে রাখার।

“না বলে হুট করে চলে আসার জন্যে দুঃখিত,” স্বভাবসুলভ শান্তস্বরে বলল সে। “আসলে, কিছু বিষয়ে আপনার সাথে কথা বলা দরকার।“

“কী?” দরজা থেকে সরে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলাম।

ডিটেক্টিভ সোফায় এসে বসলে চা বানাবো কি না জানতে চাইলাম। সে মানা করলেও অবশ্য আপত্তিটুকু কানে তুললাম না। ঝটপট বানিয়ে ফেললাম।

“তো, কী যেন বলবেন বলছিলেন?” চায়ের কাপটা তার সামনে নামিয়ে রাখি আমি। হাতটা মৃদু কাঁপছে, চোখ তুলে দেখি সেদিকেই তাকিয়ে আছেন ডিটেক্টিভ কাগা।

চায়ের দিকে হাত বাড়ালো না সে। “আসলে,” আমার চোখে চোখ রেখে বলল, “আমার কথাগুলো শুনতে হয়তো আপনার ভালো লাগবে না।”

“জি?” প্রাণপণে চেষ্টা করলাম একদম স্বাভাবিক থাকার কিন্তু বুকের ভেতরে কে যেন হাতুড়িপেটা করছে। বারবার মনে হচ্ছে, এই বুঝি অজ্ঞান হয়ে যাব।

“আপনার অ্যাপার্টমেন্টে তল্লাশি চালাতে চাই আমি।”

বিস্ময়ের ভাব ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করলাম চেহারায়। স্বাভাবিক ভঙ্গিতে হাসার চেষ্টাও করলাম। জানি না, কতটা সফল হলাম। কাগার কাছে নিশ্চয়ই সবকিছু তেতো লাগছে।

“কী বলছেন এসব? এখানে তল্লাশি চালানোর কি কোন দরকার আছে? কিছু তো পাওয়া যাবে না।”

“অনিচ্ছাসত্ত্বেও কাজটা করতে হবে আমাকে, মাফ করবেন।”

“দাঁড়ান! আপনি কি ভাবছেন আমি খুন করেছি হিদাকাকে? এখানে আলামত খুঁজতে এসেছেন?”

“একভাবে বললে, হ্যাঁ,” আলতো মাথা নেড়ে বলল ডিটেক্টিভ কাগা।

“অবাক হচ্ছি বললেও কম হবে,” মিথ্যাটুকু বলতে গলা কাঁপলো না আমার। অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকালাম। আমার অভিনয় ক্ষমতা বলতে এটুকুই। “আসলে আমি বুঝে উঠতে পারছি না কী বলবো, আপনি ঠাট্টা করছেন না তো?”

“না, ঠাট্টা নয়। এখন প্রাক্তন সহকর্মীকে কথাটা বলতে আমার নিজেরও খারাপ লাগছে। কিন্তু সত্য উদঘাটনের জন্যে যা যা করা দরকার, আমি করবো।”

“আপনার চাকরি নিয়ে ধারণা আছে আমার। যদি কোন বিষয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহও থেকে থাকে, তবে সেটা খুঁটিয়ে দেখা জরুরি। ঘটনার সাথে তদন্তকারীর ঘনিষ্ঠ বন্ধু বা আত্মীয়তার সম্পর্ক আছ, এমন কেউ জড়িত থাকলেও পিছপা হওয়া যাবে না। তবে সত্যি বলতে, আমি যতটা না অবাক হয়েছি, তার চেয়ে বেশ চমকে গেছি। আসলে হুট করেই চলে এসেছেন তো।”

“ওয়ারেন্ট আছে আমার সাথে।”

“সার্চ ওয়ারেন্ট? তা তো থাকবেই। কিন্তু তল্লাশি শুরুর আগে আমাকে কি দয়া করে বলবেন কেন এমনটা করছেন? মানে আমাকে—”

“সন্দেহ করছি কেন?”

“হ্যাঁ, এটাই। নাকি কোন প্রকার ব্যাখা ছাড়াই যে কারো বাসায় ঢুকে হুটহাট তল্লাশি শুরু করে দেন?”

“দরকার পড়লে,” টেবিলের দিকে তাকিয়ে অবশেষে চায়ের কাপটা তুলে নিল কাগা। এরপর আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “কিন্তু আপনাকে জানাতে কোন অসুবিধে নেই।”

“শুনে খুশি হলাম। তবে আপনার সাথে একমত হবো কি না, সেই বিষয়ে নিশ্চয়তা দিতে পারছি না।”

জ্যাকেটের পকেট থেকে একটা নোটবুক বের করে আনলো কাগা। “সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টা হচ্ছে ভিক্টিমের মৃত্যুর সময়টা। প্রাথমিক ধারণা মোতাবেক, পাঁচটা থেকে সাতটার মধ্যবর্তি কোন এক সময়ে মারা গেছেন ভদ্রলোক। কিন্তু করোনারের ভাষ্যমতে, সময়টা ছয়টার আগে হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। মৃত ব্যক্তির পাকস্থলী পরীক্ষা করে মৃত্যুর সম্ভাব্য সময় আন্দাজ করা একটা সর্বজনবিদিত পদ্ধতি। আর এ রকম কেসের ক্ষেত্রে সময়কালটা যথাসম্ভব নিখুঁত হলে সুবিধে হয় তদন্তে। খাবার কতটা পরিপাক হয়েছে, তা বিবেচনার মাধ্যমে এই ব্যপ্তিটুকু দুই ঘন্টারও কমে নামিয়ে আনা সম্ভব। কিন্তু একজন সাক্ষীর ভাষ্যমতে সন্ধ্যা ছ’টার পরেও বেঁচে ছিলেন হিদাকা।”

“কথাটা তো সত্যি। ভুল কিছু বলিনি আমি। জানি, আপনি হয়তো আমার সাথে একমত হবেন না কিন্তু স্বাভাবিক পরিস্থিতি বিবেচনায় ডাক্তার সাহেবের ভুল হতেও পারে। বিশ-ত্রিশ মিনিট এদিক ওদিক হওয়া অস্বাভাবিক কিছু না। “

“অবশ্যই না, কিন্তু আমার খটকা অন্য জায়গায়। মি. হিদাকা যে ছ’টার পরেও বেঁচে ছিলেন, এটা আপনি দাবি করছেন স্রেফ একটা ফোনকলের ওপরে ভিত্তি করে। অপর প্রান্তে যে আসলেও মি. হিদাকাই ছিলেন, সেটা নিশ্চিত করার কোন উপায় নেই আমাদের।”

“হিদাকাই ছিল, এই বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই আমার।”

“বুঝলাম, কিন্তু প্রমাণ তো করতে পারবেন না। আপনি বাদে আর কেউ তখন লাইনে ছিল না।“

“আমার মুখের কথাই আপাতত মেনে নিতে হবে আপনাদের।”

“আমার কোন আপত্তি নেই—মেনে নিতামও কিন্তু কোর্ট আপনার কথা মানবে না।”

“একটা ব্যাপার ভুলে যাবেন না, ফোনটা আমি করিনি। বরং আমার নম্বরেই কল এসেছিল। তখন কিন্তু একজন অতিথিও ছিল আমার বাসায়…মি. ওশিমার সাথে বোধহয় এই বিষয়ে আলাপ হয়েছে আপনার, নাকি?”

“হয়েছে। তিনি নিশ্চিত করেছেন ছ’টার কিছুক্ষণ পরে একটা ফোন আসে আপনার।“

“আমাদের কথা বলতে শোনেনি সে?”

“আপনাদের নয়, কেবল আপনাকে কথা বলতে শুনেছিল সে। তার কাছে মনে হয় কারো সাথে দেখা করার পরিকল্পনা করছিলেন তখন। এরপরেই আপনি তাকে জানান যে কুনিহিকো হিদাকা ফোন দিয়েছিল।”

“তাহলে, এটুকুই কি প্রমাণ হিসেবে যথেষ্ট নয়? নাকি আপনি ভাবছেন, অন্য কেউ ফোন দিয়েছিল আমাকে আর সেটাকেই হিদাকার নামে চালিয়ে দিয়েছি?”

ভ্রু কুঁচকে নিচের ঠোঁটে কিছুক্ষণ চিমটি কাটলো কাগা। “সেই সম্ভাবনা ও পুরোপুরি উড়িয়ে দেয়া যায় না।”

“কারো মুখের কথায় আপনার বোধহয় ইদানীং আর বিশ্বাস-টিশ্বাস করেন না,” ভাব দেখালাম যেন তার কথাটা শুনে ভীষণ মর্মাহত হয়েছি।

“কিন্তু মৃত্যুর সময় নিয়ে এত টানা-হেঁচড়া করছেন কেন, বলুন তো? মানলাম ময়নাতদন্তে উল্লেখিত সময়ের সাথে একটু নাহয় হেরফের হচ্ছে, কিন্তু সেটুকু তো আর খুব বেশি না। আপনার কথা শুনে তো মনে হচ্ছে, কয়েক মিনিট এদিক সেদিক হলেই গোটা বিষয়টা আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দেবেন। যেন গোটা ব্যাপারটাই আমার বানোয়াট। আশা করি আমাকে সন্দেহ করার পেছনে এর চেয়েও ভালো কোন কারণ আছে আপনার। আর যদি না থাকে, তাহলে, বিষয়টা আমার জন্যে অপমানজনক। “

জবাব দেয়ার আগে কিছুক্ষণ আমার দিকে ঠায় তাকিয়ে থাকলো কাগা। “ভালো কারণ আছে।”

“বলুন, শুনি।”

“সিগারেট।”

“বুঝলাম না?”

“আপনি আমাকে বলেছেন মি. হিদাকা মাত্রাতিরিক্ত ধূমপান করতেন। এতটাই বেশি যে মাঝে মাঝে আপনার মনে হতো কেউ বুঝি মশার ঔষধ দিয়েছে তার অফিসে।”

“হ্যাঁ, বলেছি, তো?” হঠাৎই অদ্ভুত এক আশঙ্কায় ছেঁয়ে উঠল মন। যেন কালো ধোঁয়ার দল জাপটে ধরছে আমার ফুসফুসটাকে।

“অ্যাশট্রেতে কেবল একটা সিগারেটের উচ্ছ্বিষ্ট ছিল।”

অস্ফুট একটা শব্দ বেরিয়ে গেল আমার মুখ দিয়ে।

“একটা সিগারেটের উচ্ছ্বিষ্ট, তাও দোমড়ানো। মিয়াকো ফুজিও বাড়ি ফিরে যাওয়ার পর সে যদি আসলেই কাজ করতো তাহলে কিন্তু আরো অনেকগুলো সিগারেটের মাথা থাকার কথা ছিল ওখানে। আর ওই সিগারেটটাও তিনি আপনার সাথে কথা বলার সময়েই খেয়েছিলেন, মি. নোনোগুচি। কাজ করার সময় নয়। আপনি নিজেই সেটা উল্লেখ করেছিলেন।”

হঠাৎই আমার মনে পড়ে, কাগা হিদাকার সিগারেট খাওয়া নিয়ে প্রশ্ন করেছিল সেদিন। তাহলে সে কি শুরু থেকেই আমাকে সন্দেহ করে আসছে? “অর্থাৎ,” আমার প্রাক্তন সহকর্মী বলে, “মিয়ায়কো ফুজিও বাসা ছেড়ে বেরুনোর পর থেকে খুন হওয়া অবধি কোন সিগারেট ধরাননি তিনি। ওনার স্ত্রী’র সাথে কথা হয়েছে আমার। তার ভাষ্যমতে, মি. হিদাকা যদি আধঘন্টাও কাজ করতেন, তাহলে কম করে হলেও দুটো বাড়তি সিগারেটের উচ্ছ্বিষ্ট দেখা যেত অ্যাশট্রেতে। বরং নতুন কোন ধারাবাহিক নিয়ে কাজ করার সময় গতানুগতিকের চাইতে আরো বেশি সিগারেট দরকার হতো মি. হিদাকার। কিন্তু সেই রাতে একটা সিগারেটও জ্বালাননি ভদ্রলোক। এর কারণ কী হতে পারে?”

মনে মনে নিজেকে ভর্ৎসনা ছাড়া আর কিছু করার নেই আমার। এত গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয় নজর এড়িয়ে গেল! আমি নিজে ধূমপায়ী ন‍ই বলেই এমনটা হয়েছে।

“হয়তো সিগারেট ছিল না ওর কাছে,” জানি যে পরিত্রাণের কোন উপায় নেই, তবুও বললাম। “কিংবা, পরবর্তিতে খাওয়ার জন্যে হয়তো বাঁচিয়ে রাখছিল?”

“সেদিন লাঞ্চের সময়েই চার প্যাকেট সিগারেট কেনেন হিদাকা। তার ডেস্কের প্যাকেটটায় চোদ্দটা সিগারেট পেয়েছি আমরা, অক্ষত। ড্রয়ারে না খোলা তিনটা প্যাকেট।”

কাগা কথাগুলো শান্তস্বরে বললেও শব্দগুলোর অন্তরালে ক্রমশ অগ্রসরমান অভিযোগের তীর ঠিকই অনুভব করতে পারছি। ধীরে ধীরে হালে পানি পাচ্ছে। কেন্দো খেলায় বরাবরই ভালো ছিল সে। একটা শীতল স্রোত নেমে গেল আমার শিরদাঁড়া বেয়ে।

“তাই নাকি?” বললাম আমি। “তাহলে তো অ্যাশট্রেতে একটা সিগারেটের উপস্থিতি আসলেও সন্দেহের উদ্রেক ঘটাবে। তবে প্রশ্নটার উত্তর জানতে হলে হিদাকাকেই জিজ্ঞেস করতে হবে আপনাকে, ডিটেক্টিভ। হয়তো গলা খুসখুস করছিল বেচারার কিংবা, অন্য কিছুও তো হতে পারে, তাই না?” শেষ চেষ্টা করলাম।

“তেমনটা হলে আপনার সামনে সিগারেট ধরালেন কেন? সব কিছু বিবেচনায় সহজ ব্যাখাটা মেনে নেয়াই শ্রেয়।”

“অর্থাৎ, আরো আগেই মৃত্যু হয়েছে তার?”

“হ্যাঁ, বেশ আগে। সিগারেটের এই বিষয়টা থেকে আমরা আন্দাজ করতে পারি, মিস ফুজিও বেরুনোর পর অফিসে ফিরে যান তিনি, ডেস্কে বসার কিছুক্ষণের মধ্যেই খুন হন।”

“আপনাকে বেশ আত্মবিশ্বাসী মনে হচ্ছে এই বিষয়ে।”

“আরেকটা বিষয়, মিস ফুজিওর সাথে কথা বলার সময়েও কোন সিগারেট ধরাননি মি. হিদাকা। তার স্ত্রী’র ভাষ্যমতে, সিগারেটের ধোঁয়া পছন্দ নয় মিস ফুজিওর। তাই তার কথা ভেবেই সিগারেট বের করেননি হিদাকা। ভেবেছিলেন এতে হয়তো মিস ফুজিও আলোচনায় স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবেন।

“তা নিশ্চয়ই ভেবেছিল।” হিদাকা বরাবরই মানুষকে পড়তে ওস্তাদ। প্রতিটা কাজের পেছনেই কোন না কোন উদ্দেশ্য থাকে।

“কিন্তু মিস ফুজিওর সাথে তার যে বিষয়ে আলাপ হয়েছে, তা যে কোন মানুষের মনে চাপ ফেলতে বাধ্য। তাই ভদ্রমহিলা বিদায় নেয়ার পর, স্ত্রীর সাথে কথা শেষ করে বুভুক্ষের মত সিগারেটের প্যাকেটের দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়াটাই স্বাভাবিক ছিল মি. হিদাকার জন্যে। কিন্তু তেমনটা হয়নি। তিনি কি ধূমপান করেননি? নাকি ধূমপানের সুযোগ পাননি? আমাকে জিজ্ঞেস করলে দ্বিতীয় সম্ভাবনাটার পক্ষেই বাজি ধরবো।

“কারণ ততক্ষণে খুন হয়ে যায় ও।”

“হ্যাঁ,” মাথা নেড়ে বলে কাগা।

“কিন্তু আমি তো অনেক আগেই ওখান থেকে চলে এসেছি।“

“জানি আমি। সামনের দরজা দিয়েই বের হয়েছিলেন আপনি। এরপর বাগান ঘুরে আবারো হিদাকার জানালার কাছে ফিরে যান।”

“আপনি মনে হয় পাশে দাঁড়িয়ে সবকিছু দেখছিলেন?”

“আসলে, আপনার কথা থেকেই ধারণাটা প্রথম মাথায় উঁকি দেয় আমার। মনে আছে, আপনি বলেছিলেন যে মিয়াকো ফুজিওই সম্ভাব্য খুনি? বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার নাম করে বাগান ঘুরে আবারো হিদাকার অফিসে উপস্থিত হয় সে, তাই না? এমনটাই তো ধারণা আপনার? এখন তো আমার মনে হচ্ছে, নিজে যা করেছিলেন, ঘুরিয়ে ফিরিয়ে মিস ফুজিও’র নাম করে সেটাই আমাকে শোনাচ্ছিলেন আপনি।”

ধীরে ধীরে মাথা ঝাঁকালাম আমি। “আপনাকে সাহায্য করতে গিয়ে দেখি ফেঁসে গেলাম! আপনি যদি আমার কথা আমার বিরুদ্ধেই এভাবে ব্যবহার করবেন জানতাম, তাহলে টু শব্দও করতাম না।”

নোটবুকের দিকে তাকালো কাগা। “আপনার লিখিত বক্তব্যে হিদাকাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার দৃশ্যটা বর্ণনা করেছেন এভাবে—’বাই,’ বলে আমি দৃষ্টির আড়াল হওয়া অবধি দরজায় দাঁড়িয়ে থাকলো রাই।’”

“তো? তাতে কী?”

“আপনার বর্ণনা মতে, বিদায় জানানোর জন্যে সামনের গেট পর্যন্ত হেঁটে আসেন রাই হিদাকা। কিন্তু আমি যখন তাকে জিজ্ঞেস করি, তখন তিনি বলেন, বাড়ির দরজা অবধি এসেছিলেন। দু’রকম কথা হয়ে গেল না তাহলে?”

“দু’রকম কথা! বড়জোর এটা বলতে পারেন যে আমরা দুইভাবে মনে রেখেছি ঘটনাটা।”

“তাই কি? আমার তো মনে হয় আপনি ইচ্ছে করে মিথ্যে বিবরণ দিয়েছেন। লেখাটা যে পড়বে সে ধরেই নেবে, বাড়ির সীমানা ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। অথচ মূল ঘটনা ভিন্ন।”

“ফালতু কথা,” ভ্রু কুঁচকে বলি। “আপনি জোর করে আমাকে এসবে জড়াতে চাচ্ছেন। আসলে, আমরা যদি গল্পের শেষটা নিজের মনমত গড়ে নেই, তখন ভাবি সবকিছু সেই মোতাবেকই ঘটেছে।”

“ব্যক্তিগতভাবে আমার ধারণা, আমি ঠিক পথেই এগোচ্ছি।”

ওর চোখের দৃষ্টি দেখে চমকে উঠলাম। আমার মাথায় অবশ্য তখন অন্য সব চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। যেমন, এই লোকটা ‘ব্যক্তিগতভাবে’ শব্দটা এত বেশি বলে কেন?

“আচ্ছা, যাইহোক, আপনি কি আন্দাজ করবেন সেটা নিতান্তই আপনার ব্যাপার। তবে আমাকে দয়া করে পুরো বিষয়টা খুলে বলুন। যেভাবে আপনি ভাবছেন আরকি। এরপর কি হলো? জানালার নিচে ঘাপটি মেরেছিলাম, তারপর? জানালা গলে ভেতরে ঢুকে হিদাকাকে আঘাত করি?”

“করেছিলেন নাকি?” সোজাসুজি আমার দিকে চেয়ে বলল ডিটেক্টিভ কাগা।

“আপনাকে জিজ্ঞেস করছি আমি।”

একবার মাথা ঝাঁকালো কাগা। “অপরাধটা যে করেছে, একমাত্র সে-ই জানবে উত্তরটা।”

“কী? আপনি কি আমাকে দোষ স্বীকার করে নেয়ার কথা বলছেন? খুশিমনেই করতাম, কিন্তু হয়েছে কী, আমি খুনটা করিনি। আপনার পরিকল্পনায় পানি ঢেলে দেয়ার জন্যে দুঃখিত। ফোন কলটার বিষয়েই নাহয় কথা বলি আমরা? আপনার মতে ও খুন হওয়ার পরে আমার ফোনটা বেজেছিল। আচ্ছা, ধরলাম আপনার কথাই সত্য। এবারে আমাকে বলুন, হিদাকা ফোন না দিলে কার সাথে কথা বলি আমি? টিভিতে কিন্তু ফলাও করে প্রচার করা হয়েছে আমার বক্তব্য। অন্য কেউ যদি ফোন করেই থাকতো, এতক্ষণে আপনাদের জানাতো নিশ্চয়ই।” যেন সদ্যই কিছু মাথায় এসেছে এমন ভঙ্গিতে আঙুল তুলি আমি। “নাকি আপনার ধারণা, এই ষড়যন্ত্রে কোন সঙ্গী আছে আমার! যে ইচ্ছে করে আমাকে ওই সময়ে ফোন দেয়।”

জবাব না দিয়ে চারপাশে চোখ বুলায় কাগা। ডাইনিং রুমের টেবিলে রাখা কর্ডলেস ফোনটা দৃষ্টিগোচর হয় তার। উঠে গিয়ে সেটা নিয়ে এসে আবারো সোফায় বসে।

“কোন সঙ্গীর দরকার ছিল না আপনার। এই ফোনটা বাজলেই হতো।”

“কিন্তু কেউ ফোন না দিলে রিং বাজবে কী করে?” বলেই একবার তালি বাজালাম। “আচ্ছা! আপনার মাথায় কী ঘুরছে বুঝতে পারছি। আপনি নিশ্চয়ই ভাবছেন পকেটে আরেকটা মোবাইল ফোন ছিল আমার। ওশিমা একটু অন্যমনষ্ক হলে সেটা থেকেই আমার বাসার নম্বরে ফোন করি। তাই তো?”

“চাইলে এভাবেও করা যায় কাজটা।”

“কিন্তু সেটা অসম্ভব। আমার কোন মোবাইল ফোন নেই। আমার পরিচিত এমন কেউও নেই, যার কাছ থেকে ধার নেব একদিনের জন্যে।

তাছাড়া আপনারা চাইলে ফোন রেকর্ড খতিয়ে দেখতে পারেন। টেলিফোন কোম্পানির ওরা নিশ্চয়ই বলতে পারবে আমি নিজের নম্বরে ফোন করেছিলাম কি না। “

“আসলে রিভার্স ট্রেস করে কোন নম্বর থেকে ফোন এসেছিল সেটা বের করা বেশ কঠিন।”

“রিভার্স ট্রেস বলে তাহলে এটাকে?”

“যাইহোক, সেটার দরকার নেই। সচরাচর যাকে ফোন করা হয়, সে-ই বলে দিতে পারে কে ফোন করেছিল। এইক্ষেত্রে আমাদের কেবল দেখতে হতো যে মি. হিদাকা সেদিন ফোনটা করেছিলেন কি না।”

“দেখেছেন?”

“হ্যাঁ,” বলে মাথা নাড়ে কাগা।

“জবাবটা জানাই আছে আমার, তবুও জিজ্ঞেস করছি। কী দেখলেন?”

“তার বাসা থেকে আপনার অ্যাপার্টমেন্টে ছ’টা তেরোয় একটা ফোন করা হয়েছিল।”

“এমনটাই তো হবার কথা। কারণ ও ফোন করেছিল, আর আমরা কথাও বলি,” কন্ঠে যথাসম্ভব আত্মবিশ্বাস ফুটিয়ে বলার চেষ্টা করি। তবে সত্যি বলতে, ভেতরে ভেতরে আশঙ্কা চেপে বসছে মনে। ফোন কোম্পানির রেকর্ড ঘেটেও যদি কাগা সন্তুষ্ট না হয়, তাহলে ধরে নিতে হবে আমার চালটা প্রায় ধরে ফেলেছে সে।

উঠে দাঁড়িয়ে ফোনটা জায়গামত রাখলো কাগা। তবে এবারে আর সোফায় ফিরলো না। “লেখা শেষ করে পান্ডুলিপিটা সম্পাদকের কাছে ফ্যাক্স করার কথা ছিল হিদাকার কিন্তু তার অফিসে কোন ফ্যাক্স মেশিন নেই। কেন নেই, সেটা নিশ্চয়ই জানা আছে আপনার। “

প্রায় বলেই ফেলেছিলাম যে জানি না, কিন্তু সামলালাম নিজেকে।

“কারণ সেটা তো চাইলে সরাসরি তার কম্পিউটার থেকেই পাঠানো যেত, তাই না?” কাগা জিজ্ঞেস করলো।

“সেটাও করা যায় শুনেছি।”

“যাদের এখনও ফ্যাক্স করতে হয়, তাদের জন্যে এটা দারুণ একটা সুবিধা, হাতের কাছে কোন কাগজ রাখতে হয় না। তাছাড়া কানাডায় চলে গেলে সেখান থেকে নিশ্চয়ই ইমেইলের মাধ্যমেই লেখা জমা দিতেন হিদাকা। সম্পাদকের সাথে এই বিষয়ে আগেই কথাবার্তা বলে রেখেছিলেন তিনি।”

“এই ব্যাপারে আমি কিছু জানি না। কম্পিউটার খুব একটা ব্যবহার করিনি। শুধু এটুকু মনে আছে, হিদাকা একবার কম্পিউটার থেকে সরাসরি ফ্যাক্স করার কথা উল্লেখ করেছিল।”

“ব্যাপারটা কঠিন কিছু না, যে কেউ চাইলে করতে পারে সফটওয়্যারটার দারুণ কিছু ফিচারও আছে। দরকার পড়লে একসাথে কয়েকটা নম্বরে ফ্যাক্স করা যায়। দরকারি নম্বরগুলোর তালিকা সেইভ করে রাখতে পারবে ইউজার। এছাড়া-” থেমে আমার দিকে তাকালো কাগা। “সময় ঠিক করে দিলে, স্বয়ংক্রিয়ভাবেও ফ্যাক্স পাঠানো যায়। “

নিচের দিক থেকে চোখ ওঠালাম না। “আপনার ধারণা আমি সেটাই করেছি?”

প্রশ্নের জবাব দিলো না কাগা। দেয়ার দরকারও নেই আসলে।

“লাইটের ব্যাপারটা প্রথম থেকেই খোঁচাচ্ছিল আমাকে,” বলল কাগা। “আপনার ভাষ্যমতে, হিদাকাদের ওখানে পৌঁছে দেখেন সব লাইট বন্ধ। খুনি নিশ্চয়ই সবাইকে বোঝাতে চাইছিল, হিদাকারা কেউ বাসায় নেই। তবে কম্পিউটারটা কেন বন্ধ করেনি, এটা বুঝতে পারেননি আপনি, তাই তো? আমি বোধহয় এখন কারণটা জানি। ফ্যাক্সের কৌশলটা কাজে লাগানোর জন্যে ওটা চালু রাখতেই হতো। হিদাকাকে হত্যার পর নিজের জন্যে যে করেই হোক একটা অ্যালিবাই তৈরি করা দরকার ছিল আপনার, নয়তো ফেঁসে যেতেন। সেজন্যেই, কম্পিউটার খুলে কিছু ডকুমেন্ট আপনার কাছে ঠিক সন্ধ্যা ৬:১৩-এর সময় ফ্যাক্স করার ব্যবস্থা করে ফেলেন। এরপর বাড়ির সব লাইট বন্ধ করে দেন, এই ধাপটাও জরুরি ছিল আপনার গল্পের জন্যে। কারণ আটটার সময় হিদাকাদের বাড়ির সামনে থেকে ঘুরে গিয়ে হোটেলে ফোন করে ‘কেউ বাসায় নেই” বলার জন্যে বাতি নেভানো থাকাটাই দরকার ছিল। শুধু ওই একটা ঘরেও যদি বাতি জ্বালানো থাকতো, তাহলে ঘুরে গিয়ে ওখানে উঁকি দেয়াটাই স্বাভাবিক ছিল যে কারো জন্যে। কিন্তু আপনি বিশেষ করে চাইছিলেন যাতে মৃতদেহটা আবিষ্কারের সময় রাই হিদাকা আপনার সাথেই থাকে।”

এটুকু বলে চুপ করলো কাগা। বোধহয় আমার কাছে কোন অজুহাত আশা করছে আবারো। মুখ বন্ধই রাখলাম আমি

“আমার ধারণা কম্পিউটার মনিটরটা বন্ধ করবেন কি না, এই বিষয়ে বেশ ভাবনা-চিন্তা করেছেন আপনি,” কিছুক্ষণ পর বলল কাগা। “যেমনটা আগেও বলেছি, মনিটরটা চালু থাকলে বেশ ভালো আলো ছড়ায় চারপাশে। কিন্তু যে করেই হোক পিসিটা চালু রাখতে হতো। আপনি চাইলে কেবল মনিটরটা বন্ধ করে রাখতে পারতেন কিন্তু সেটা বিপজ্জনক হতে পারত আপনার জন্যে। মৃতদেহটা খুঁজে পাওয়ার সময় রাই আপনার সাথেই ছিল। সে যদি টের পেয়ে যেত পিসি চলছে কিন্তু মনিটরটা বন্ধ, তাহলে তখনই হয়তো পুলিশের সন্দেহের আওতায় চলে আসতেন আপনি।”

ঢোক গেলার চেষ্টা করলাম, কিন্তু আমার মুখের ভেতরটা পুরোপুরি শুকনো। বুঝতে পারছি এই মুহূর্তে কাগার চোখে চোখ রাখা সম্ভব নয় আমার পক্ষে। আমার দূর্বল অজুহাতগুলো ধোপেই টেকেনি ওর সামনে। ঠিক আমার মাথায় যে আশঙ্কাগুলো ঘুরছিল, সেসব নিয়েই কথা বলছে এখন।

“হিদাকাদের ওখান থেকে খুব সম্ভবত সাড়ে পাঁচটা নাগাদ বেরিয়ে যান আপনি। অ্যাপার্টমেন্টে ফেরার পথে দোজিশা পাবলিশিংয়ের মি. ওশিমাকে ফোন দিয়ে বলেন যেন পান্ডুলিপিটা তখনই নিয়ে যায় সে। মি. ওশিমা ভেবেছিল আপনি বোধহয় পান্ডুলিপিটা ফ্যাক্স করবেন। তাই আপনি দেখা করে নেয়ার কথা বললে কিছুটা অবাক হন ভদ্রলোক। আপনার ভাগ্য ভালো, ওনার অফিস থেকে আপনার অ্যাপার্টমেন্টে ট্রেনে করে আসতে ত্রিশ মিনিটের বেশি লাগে না। আমি খেয়াল করেছি, আপনার লিখিত বক্তব্যে এই বিষয়গুলোর কোন উল্লেখ নেই। বরং আপনি এমনভাবে কথাগুলো বলেছেন যেন মি. ওশিমার আগে থেকেই আসার কথা ছিল।”

এই কথাটাও ভুল বলেনি কাগা। কিন্তু এবারেও মুখ না খুলে আরেকটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম আমি।

“মি. ওশিমাকে কেন নিজের বাসায় ডেকে পাঠিয়েছেন, সেটা ব্যাখা করার দরকার নেই বোধহয়। আপনি চাইছিলেন নিজের অ্যালিবাইটা পোক্ত করতে। হিদাকার কম্পিউটার থেকে আপনার বাসায় ফোনটা আসে ঠিক ছ’টা তের মিনিটে। ঠিক যেমনটা চাইছিলেন আপনি। ব্যস, রিসিভার তুলে একদম পাকা অভিনেতাদের মতন অভিনয় করতে শুরু করে দেন। হিদাকার ফ্যাক্স প্রোগ্রামটা আপনার ফোনের সাথে সংযোগ স্থাপনের চেষ্টা চালাচ্ছিল তখন। কিন্তু আপনি এমন আচরণ করেন, যেন ওপাশ থেকে কেউ কথা বলছে। অভিনয় শেষে রিসিভার নামিয়ে রাখেন। হিদাকার কম্পিউটারে এটা একটা ডায়ালিং এরর হিসেবে নথিভুক্ত হয়, কল কেটে যায়। মি. ওশিমা ঘুনাক্ষরেও কিছু সন্দেহ করতে পারেন না। এরপর আর খুব বেশি কাজ বাদ থাকে না আপনার। রাই হিদাকাকে পাশে নিয়ে মৃতদেহটা আবিষ্কার করতে হবে, এটুকুই। আর পুলিশ আসার আগে, তার বেখেয়ালে কম্পিউটারট থেকে কলের রেকর্ড মুছে ফেলতে হবে।”

খেয়াল করলাম কথা বলার মধ্যে একটা পর্যায়ে কিছুক্ষণ পরপর মাথা নিচু করা থামিয়ে দিয়েছে কাগা। স্কুলে নতুন শিক্ষক হিসেবে যোগ দেয়ায় সিনিয়রদের সাথে ওভাবে কথা বলতে বলতে অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল ওর। অবশ্য কাগার আচরণের এই পরিবর্তনে বিরক্ত হলাম না। আমাদের এখনকার সম্পর্কের প্রেক্ষিতে এমনটাই বরং স্বাভাবিক।

“কৌশলটার তারিফ করতেই হয়। পুরো পরিকল্পনা করতে খুব বেশি সময়ও নিশ্চয়ই পাননি আপনি। তবে একটা ভুল করে ফেলেছেন।”

মনে হচ্ছে ভুলটার কথা সে নিজেই বলবে।

“হিদাকাদের বাসার আসল ফোনটার কথা মাথায় ছিল না আপনার। মি. হিদাকা যদি আসলেই আপনাকে ফোন করতো তাহলে রিডায়াল বাটনে চাপ দিলেই হয়ে যেত কিন্তু।“

ভেতরে ভেতরে গুমরে উঠলাম

“কিন্তু সেরকম কিছু হয়নি। বরং রিডায়ালে চাপ দেয়ার পর ভ্যাঙ্কুভারে একটা নম্বরে ফোন চলে যায়। মিসেস হিদাকা আমাদের জানিয়েছেন, সেদিন ভোর ছ’টার দিকে কানাডার একটা নম্বরে ফোন করেন মি. হিদাকা। অবশ্য এমনটাও ধরে নেয়া যায় আপনার অ্যাপার্টমেন্টে ফোন করার পরেও কানাডার নম্বরটায় ফোন করেন তিনি। কিন্তু রিং বাজার আগেই কেটে দেন। কিন্তু কানাডা আর জাপানের সময়ের পার্থক্য বিবেচনায় নিলে সেটা আর বাস্তবসম্মত মনে হয় না। যে ব্যক্তি ফোন করার জন্যে ভোরে উঠতে পারেন, তার এরকম ভুল করার কথা নয়। কারণ কানাডায় তখন মধ্যরাত।”

কথা থামিয়ে আমার দিকে তাকালো কাগা। “এটুকুই বলার ছিল।”

কয়েক মুহূর্ত কোন কথা হলো না আমাদের মধ্যে। আমার চেহারায় কোন প্রতিক্রিয়া দেখতে চাইলে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে কাগাকে। আমার মাথা একদম ফাঁকা এখন।

“কিছু বলার নেই আপনার?” একটু অবাকই মনে হলো ওকে।

অবশেষে মাথা তুললাম। চোখাচোখি হলো আমাদের। ওর অভিব্যক্তি একদম শান্ত, কোন প্রকার উত্তেজনার লেশমাত্র নেই। ডিটেক্টিভরা সন্দেহভাজনদের সাথে সচরাচর এভাবে কথা বলে না। কেন জানি না, ব্যাপারটা বেশ স্বস্তিদায়ক ঠেকল আমার কাছে।

“পান্ডুলিপিটার ব্যাপারে তো কিছু বললেন না,” আমি বললাম। “তুষার দ্বার উপন্যাসের যে পর্বটা হিদাকার কম্পিউটারে ছিল, সেটা? ধরে নিলাম আপনার থিওরিটা নির্ভুল, সেক্ষেত্রে ওটা কখন লেখা হলো?”

ঠোঁটে ঠোঁট চেপে সিলিংয়ের দিকে তাকালো কাগা। আমার মনে হচ্ছে ও জানে, কী বলতে হবে, কিভাবে বলবে সেটা ভাবছে।

অবশেষে মুখ খুলল কাগা। “দুটো সম্ভাবনার কথা মাথায় আসছে এই মুহূর্তে। প্রথমটা হচ্ছে, মি. হিদাকা ওটুকু লিখেই রেখেছিলেন, বিষয়টা খেয়াল করার পর আপনি ওটাকে নিজের পরিকল্পনার অংশ করে নেন।”

“আরেকটা সম্ভাবনা?”

“অন্যটা হচ্ছে—” আবারো আমার চোখের দিকে তাকালো ও। “—আপনি নিজেই ওটুকু লিখেছেন। হয়তো কোন ডিস্কে করে লিখে নিয়ে গিয়েছিলেন, নিজের অ্যালিবাই তৈরি করার জন্যে। এরপর দ্রুত কপি করে ফেলেছেন হিদাকার কম্পিউটারে।”

“আপনার বুদ্ধির তারিফ করতেই হয়!” কিছুটা শ্লেষাত্মক সুরে কথাটা বলার চেষ্টা করলাম কিন্তু লাভ হলো না। চেহারা যেন একদম জমে গেছে আমার।

“মাসিক সোমেই পত্রিকার মি. ইয়ামাবেকে পান্ডুলিপির ফাইলটা দেখিয়েছি আমি। তিনি মোটামুটি নিশ্চিত, ওটা হিদাকা লেখেননি। শব্দগুলো অন্যরকম তো বটেই, যতিচিহ্নের ব্যবহারেও গড়মিল খেয়াল করেছেন ভদ্রলোক।”

“তাই…ইয়ে, আপনি…” কথা জড়িয়ে এলো আমার। কাশি দিয়ে গলা পরিস্কার করলাম। “আপনি ধরেই নিয়েছেন ওকে হত্যা করার পরিকল্পনার অংশ হিসেবে পান্ডুলিপিটুকু লিখে নিয়ে গিয়েছিলাম আমি।”

“না, এরকমটা ভাবছি না আমি। এটা যদি আগে থেকেই আপনার পরিকল্পনার অংশ হতো, তাহলে আপনি যথাসাধ্য চেষ্টা করতেন হিদাকার মত করে লেখার। ওনার সম্পাদকের মতে সেটা এমন কঠিন কিছু হতো না, বিশেষ করে যেহেতু উপন্যাসটার বেশ খানিকটা অংশ আগেই প্রকাশিত হয়েছে পত্রিকায়। তাছাড়া, একটা পেপারওয়েট দিয়ে হত্যা করা হয়েছে হিদাকাকে আর মি. ওশিমাকে একদম শেষ মুহূর্তে ডেকে পাঠানো হয়েছে আপনার অ্যালিবাইয়ের অংশ হবার জন্যে। আমার ধারণা খুনটা পূর্ব পরিকল্পিত ছিল না।”

“তাহলে পান্ডুলিপিটা আগেই তৈরি করা হল কেন?”

“এটাই তো মূল প্রশ্ন, তাই না? ‘তুষার দ্বার’ উপন্যাসটার পরবর্তি অধ্যায় আপনার কাছে কেন? আর সেটা জিজ্ঞেস করার আগে আপনাকে জিজ্ঞেস করা উচিত যে আপনিই বা ওটা লিখতে গেলেন কেন। এই ব্যাপারটা নিয়ে আমি ভীষণ কৌতূহলী। এই প্রশ্নের উত্তরেই হয়তো মি. হিদাকাকে হত্যার মোটিভটা লুকিয়ে আছে।”

চোখ বুজলাম যেন আতঙ্কটুকু গোপন করতে পারি। “পুরোটাই আপনার কল্পনা। কোন প্রমাণ নেই আপনার কাছে। “

“ঠিক। সেজন্যেই আজ আমি এসেছি আপনার অ্যাপার্টমেন্টে তল্লাশি চালাতে। আমি নিশ্চিত, আপনি এতক্ষণে বুঝে গেছেন কী খুঁজছি আমি।”

জবাব দিলাম না।

“আমি একটা ডিস্ক খুঁজছি যেটায় পান্ডুলিপিটা আছে। অথবা আপনার ওই ওয়ার্ড প্রসেসরটার হার্ড ড্রাইভে হয়তো ওটা খুঁজে পাব আমি। হয়তো না…আমি নিশ্চিত, পাব। পান্ডুলিপিটা যদি আপনার পরিকল্পনার অংশ বিশেষ হতো, তাহলে এতক্ষণে সব প্রমাণ লোপাট করে দিতেন। কিন্তু আমার সেটা মনে হয় না। ওটা এখানেই কোথাও আছে।”

চোখ খুলে দেখলাম একদম আমার চোখের দিকে তাকিয়ে আছে কাগা। তবে এবারে চোখ নামিয়ে নিলাম না। নিজেকে পুরোপুরি সামলে নেয়ার জন্যে কিছুক্ষণ চোখ বুজে থাকাই যথেষ্ট ছিল।

“যা খুঁজছেন, সেটা যদি পেয়ে যান তাহলে আমাকে গ্রেফতার করবেন? “

“জি।”

“আমি যদি এখন আত্মসমর্পণ করি?”

বিস্ময় ভর করলো কাগার চোখের তারায়। একবার মাথা ঝাঁকাল ও। “দুর্ভাগ্যবশত, আত্মসমর্পণের সুযোগ এই মুহূর্তে নেই আপনার। আমি আশা করবো গ্রেফতারের সময় কোন প্রকার বাঁধা দেবেন না।”

“বেশ।” কাঁধজোড়া ঝুঁকে গেল আমার। হতাশ লাগছে তবে স্বস্তিও অনুভব করছি। আর কোন প্রকার অভিনয় করতে হবে না। “আমাকে প্রথম কখন সন্দেহ হলো আপনার?”

“প্রথম রাতে।”

“আসলেই? ভুল কিছু করেছিলাম কি?”

“হ্যাঁ,” মাথা নেড়ে সায় দিলো ও। “হিদাকার মৃত্যুর সম্ভাব্য সময় জানতে চেয়েছিলেন। “

“এটা কি অবাক হবার মত কিছু?”

“হ্যাঁ। আপনি যদি আসলেই ছয়টার সময় মি. হিদাকার সাথে কথা বলে থাকেন, তাহলে আপনার জানার কথা যে আটটার মধ্যে মারা গেছেন তিনি কারণ মিসেস হিদাকাকে সাথে নিয়ে তখনই তার লাশটা খুঁজে পান আপনি। সেক্ষেত্রে কেন আগ বাড়িয়ে জানতে চাইলেন মৃত্যুর সম্ভাব্য সময়?”

“ওহ্।”

“তাছাড়া পরদিন রেস্তোরাঁতেও আমার কাছ একই কথা জানতে চান আপনি। তখনই বুঝতে পারি, আমার সন্দেহটা অমূলক নয়। আপনি এটা জানতে চাননি যে খুনটা কখন হয়েছে। আপনি জানতে চান পুলিশের ভাষ্যমতে খুনটা কখন হয়েছে।”

ভুল বলেনি কাগা। আমি বোঝার চেষ্টা করছিলাম, পরিকল্পনাটা কাজে লেগেছে কি না।

“বাহ, চমৎকার। আপনি যে দারুণ একজন গোয়েন্দা, সেই বিষয়ে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই।”

“ধন্যবাদ,” নাটুকে ভঙ্গিতে বাউ করে বলল কাগা। “আপনি এখান থেকে বের হবার প্রস্তুতি নেয়া শুরু করতে পারেন। অবশ্য আপনাকে চোখে চোখে রাখতে হবে আমার। অনেক কেসেই দেখা গিয়েছে, সন্দেহভাজনরা একাকী থাকলে তার পরিণতি বিশেষ সুখকর হয় না।”

“চিন্তা করবেন না, আমার পক্ষে আত্মহত্যা করা সম্ভব নয়,” হেসে উঠে বললাম। কথাটা আপনা আপনিই বেরিয়ে এলো মুখ দিয়ে, আমি নিজেও অবাক হলাম একটু।

“না হলেই ভালো,” পাল্টা হেসে বলল কাগা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *