অদেখা ভুবন – ২.৫

পাঁচ

কে জানে, কতটা সময় পার হয়েছে। দিনের পর দিন এক নাগাড়ে এভাবে বিছানায় শুয়ে থাকতে থাকতে বিরক্ত হয়ে গেছে তানিয়া। কাটতেই চায় না যেন সারাটা দিন।

পিঠের নিচে বালিশ দিয়ে, বিছানায় হেলান দিয়ে বসেছে মেয়েটা। অল মাই চিলড্রেন দেখছে টিভিতে। এবং যেটা অবশ্যম্ভাবী, ভক্ত হয়ে উঠেছে ও সিরিজটার।

রিসেপশন ভালো না টিভিটার। ঝিরঝির করে উঠছে মাঝে মধ্যেই।

মনে মনে প্রমাদ গুনছে তানিয়া। কখন না আবার গায়েব যায় ছবি! সিরিয়ালের মাঝপথে এসে অনন্ত কালের জন্য অপেক্ষা করতে হলে খুবই বাজে হবে ব্যাপারটা।

টেলিভিশনের পরদায় গোপন সত্য উন্মোচন করছে এ মুহূর্তে দজ্জাল এরিকা কেইন। টাইলার নাকি আদতে রুথের সন্তানই নয়। ও হচ্ছে-

যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই সন্ধ্যা হয়।

ধূসর তুষারপাত শুরু হয়ে গেল পরদা জুড়ে। পরক্ষণেই ঝুপ করে কালো হয়ে গেল স্ক্রিন।

তিতিবিরক্ত তানিয়া পাশে পড়ে থাকা গ্ল্যামার ম্যাগাজিনটা তুলে নিয়ে ছুঁড়ে মারল টিভির দিকে। ঝড়ে বক মরার মতো এক বাড়িতে অফই হয়ে গেল টিভিটা।

অনেকক্ষণ দেখা হয়েছে টিভি। ভাবল তানিয়া, এবার একটু বিশ্রাম নেয়া যাক।

পাশ ফিরতেই দরজা দিয়ে দেখতে পেল পুতুলটাকে। হলওয়ের দূরপ্রান্তে পড়ে আছে মেঝেতে। এদিকেই ঘোরানো অ্যানাবেলের মাথাটা। ওরই দিকে চেয়ে আছে যেন।

‘জনি? তুমি কি—’ বলতে শুরু করেও থেমে যেতে হলো তানিয়াকে। খেয়াল হয়েছে, স্বামী এখন ইন্সটিটিউটে।

দেয়ালে ঝোলানো ঘড়িটার দিকে তাকাল মেয়েটা। ঠিক মধ্যদুপুর।

হতাশ হলো ও।

‘…তাড়াতাড়ি চলে এসো, প্লিজ,’ স্বগতোক্তি করল বিড়বিড় করে।

পিছলে বিছানা থেকে নেমে এল তানিয়া। বেডরুমের দরজার দিকে হেঁটে গেল পা টেনে টেনে। শেষ বারের মতো দৃষ্টি দিল ও অ্যানাবেলের দিকে। পরক্ষণে বন্ধ করে দিল দরজাটা।

‘ফালতু একটা!’ ক্ষোভের সঙ্গে বেরিয়ে এল কথাটা।

.

ব্যাণ্ডেজ খুলে ফেলেছে তানিয়া পেটের উপর থেকে। পরীক্ষা করল ছুরির আঘাতের ফলে সৃষ্ট ক্ষতটা। গাল দুটো কুঁচকে উঠল একটু।

ভেজা একটা কাপড় নিয়ে ক্ষতের চারপাশে চাপ দিয়ে দিয়ে মুছতে লাগল মেয়েটা। প্রতি বার চাপ দেয়ার সময় ব্যথা আর বিতৃষ্ণায় ভাংচুর হতে লাগল মুখের অভিব্যক্তিতে।

মোছা শেষ হতে এক পাশে ছুঁড়ে ফেলল ও কাপড়টা। হাত-টাত ধুয়ে নিল ভালো করে। ভালো করে হাত দুটো মুছে নিয়ে বেরিয়ে এল তানিয়া শোবার ঘরের লাগোয়া বাথরুম থেকে। বেরিয়েই ভাঁজ পড়ল কপালে।

দরজাটা খোলা বেডরুমের!

কী করে হলো এটা?

নিজের হৃৎস্পন্দন শুনতে পাচ্ছে তানিয়া।

সঙ্গে সঙ্গে স্বস্তির সুবাতাস হয়ে কিচেন থেকে এসে উদয় হলো জনি।

শব্দ করে বেরিয়ে এল চেপে রাখা শ্বাসটা। জবাব মিলেছে একটা প্রশ্নের। আপাতত বাঁচোয়া!

‘কেমন কাটল আজকে?’ ঘরে ঢুকেই জানতে চাইল জনি।

‘টিভিটা বোধ হয় গেছে আবার।’ বিছানায় উঠতে উঠতে মুখ বাঁকাল তানিয়া।

‘আবারও? বোধ হয় এই রুমটাতেই সমস্যা। সিগন্যাল পায় না ঠিক মতো। ওখানে তো এরকম হয়নি কখনও।’

‘থাক, বাদ দাও। তোমার কী অবস্থা, বলো। কোনও খবর-টবর আছে?

‘আছে।’ ঝলমল করে উঠল জনি। ‘যে-অ্যাডভাইজারের কথা বলেছিলাম তোমাকে, দেখা করেছি তাঁর সাথে। কী বলেছেন তিনি, জানো? প্যাসাডিনায় নাকি সুবর্ণ সুযোগ অপেক্ষা করছে আমার জন্য….

‘বাহ, খুব ভালো খবর!’ আন্তরিক খুশি হলো তানিয়া।

‘বিচ থেকে দূরে কিন্তু জায়গাটা…’ একটু কিন্তু-কিন্তু করছে জনি। ‘শিয়োর, কোনও আপত্তি নেই তোমার?’

‘একদম না। হাওয়া-বদল হলে তো ভালোই হবে সেটা…’

‘ওয়েল।’ একটা ভার নামল যেন জনির মাথা থেকে। ‘এখনই অবশ্য তল্পিতল্পা গোটানো আরম্ভ করছি না। একটা সম্মেলন হতে চলেছে ওখানে হপ্তা কয় বাদে। অ্যাডভাইজার চাইছেন, ওটায় অ্যাটেও করি আমি। এতে করে নাকি ইজি হয়ে যাবে ওখানে নতুন ঠিকানা পাওয়া। একেবারে কনফারেন্সের দিনই ফ্লাই করছি আমি….

‘কিচ্ছু ভেবো না তুমি। একটা দিনেরই তো ব্যাপার। ঠিকই থাকব আমি।’

‘ও, হ্যাঁ… ফোন করেছিলেন ডিটেক্টিভ ওয়েস্টমোর। আমাদের কোনও সমস্যা না থাকলে এ হপ্তায় আসতে চান তিনি… যে-কোনও দিন হতে পারে সেটা…’

সায় দেখা যাচ্ছে না তানিয়ার অভিব্যক্তিতে। ‘আমি বরং ভুলে যেতেও রাজি আছি গোটা ব্যাপারটা।’ তাকাল ও হলওয়ের শেষ মাথায়।

এখনও পড়ে আছে ওখানে অ্যানাবেল। তবে শুয়ে নয়, বসে আছে পুতুলটা।

নিশ্চয়ই জনির কাজ!

‘সরি, ডারলিং,’ বলল তানিয়া। ‘তা-ও বলছি, দূর করো ওটাকে এ-বাড়ি থেকে। পুতুলটাকে আর সহ্য করতে পারছি না আমি। ওটাকে দেখলেই মনে পড়ে যায়, পাগলা ওই মহিলা কোলে নিয়েছিল অ্যানাবেলকে!

স্ত্রীর চোখের দৃষ্টি অনুসরণ করে দেখতে পেল জনি জড়বস্তুটা।

‘ঠিক আছে, জনি,’ বলল এবার তানিয়া। ‘আসতে পারেন উনি… ওনার সুবিধামতো যে-কোনও দিন। শিগগিরই যেহেতু বাড়ি থেকে বেরোতে পারছি না কোথাও…’

.

অ্যানাবেলকে হাতে নিয়ে বেরিয়ে এল জনি বাসা থেকে। এগিয়ে যাচ্ছে কার্বে রাখা গারবেজ-ক্যানগুলোর দিকে। কাছে গিয়ে ঢাকনা তুলল একটা ক্যানের, এবং ভিতরে বিসর্জন দিল পুতুলটাকে।

চিত হয়ে পড়ে একভাবে চেয়ে রয়েছে অ্যানাবেল। খটাং করে ডালাটা লাগিয়ে দিল জনি।

ছয়

‘কোনও এক গুপ্তসঙ্ঘের সদস্য ছিল ওরা।’

কথাটা যিনি বললেন, তিনিই হলেন ডিটেক্টিভ ভিকটর ওয়েস্টমোর। বয়স তাঁর তিরিশের কোঠায়।

লোকটার হাতে এক পেয়ালা কফি ধরিয়ে দিয়ে বউয়ের পাশে, মুখোমুখি সোফাটায় বসল জনি।

‘…আমরা কনফার্ম হয়েছি যে, ও-দু’জন ছিল ডেইমানদের মেয়ে ও তার বয়ফ্রেণ্ড। রিপোর্টারদের কল্যাণে ইতিমধ্যেই জেনে গেছেন হয়তো আপনারা…’

‘উদ্দেশ্যটা কী ছিল সঙ্ঘটার?’ জিজ্ঞেস করল জনি। ‘গোটা দেশটার নিয়ন্ত্রণ নিতে চায়?’

‘যতটা ভাবছেন, অত সরল নয় আসলে বিষয়টা। বিশ্বাস করতে কষ্ট হবে আপনাদের…’

‘বরং বলুন, কষ্ট হবে আপনার বিশ্বাস করাতে,’ বলল তানিয়া নিক্তি দিয়ে ওজন করা কণ্ঠে। ‘চেহারা দেখেই বুঝতে পারছি, নিজেও আপনি অনেক কষ্টে হজম করেছেন . তথ্যগুলো।’

পেয়ালায় চুমুক দিতে গিয়ে শব্দ করে ফেললেন ওয়েস্টমোর।

‘সো? শয়তানের উপাসক ওরা?’ গোয়েন্দাপ্রবরের কষ্ট কমিয়ে দিল তানিয়া।

দ্রুত মেয়েটির সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় করলেন ডিটেক্টিভ। এর পর তাকালেন মহিলার স্বামীর দিকে।

‘ইট’স ওকে,’ সহজ কণ্ঠে বলল জনি। ‘বিষয়টা জানা উচিত ওর। আর, জানানোর জন্যই তো এসেছেন আপনি, তা-ই না?’

‘আমি মূলত এসেছি নিরাপত্তার ব্যাপারে আবারও আপনাদেরকে আশ্বস্ত করার জন্য। …হ্যাঁ… ধারণা করা হচ্ছে, অকাল্টে আগ্রহ ছিল ওদের। কাজটা করেছে নিজেদের আনুগত্যের প্রমাণ দেয়ার জন্য… নিষ্ঠুরতা দিয়ে নিষ্ঠুরের মন জয় করার জন্য।’

‘এ তো স্রেফ পাগলামি….’

‘পাগল মানুষরাই পাগলামি করে, ম্যাডাম। তো, যা বলছিলাম… এই হচ্ছে ব্যাপার। আরও একটু গভীরে খুঁড়ব আমি। দেখা যাক, আর কী কী বেরোয়। সেরকম কোনও ইনফর্মেশন পেলে জানাব আপনাদের…’

‘থ্যাঙ্ক ইউ,’ আগ্রহ নেই তানিয়ার কণ্ঠে। ‘তার আর দরকার হবে না। যতক্ষণ না নিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছে আমাদের, কিচ্ছু শুনতে চাই না ও-ব্যাপারে।’

’বুঝতে পেরেছি।’ মাথা দোলালেন গোয়েন্দা।

সাত

ঝিরঝির করছে টিভিটা। কোনও ছবি-টবি নেই পরদায়।

ছবি ফুটল একটু পরে। এখনও পরিষ্কার নয় অবশ্য রিসেপশন; এই ঠিক হচ্ছে, এই আবার ঘোলা হয়ে যাচ্ছে। এরিয়্যাল নাড়িয়ে-চাড়িয়ে সিগন্যাল ধরার চেষ্টা করে যাচ্ছে জনি গ্রেভ।

‘ওকে… গুড… এই, রাখো-রাখো…’ বিছানা থেকে ধারাভাষ্য দিচ্ছে তানিয়া।

প্রায় শুরু হলো বলে শেষ রাতের সিনেমা। জানে না তানিয়া, কী দেখাবে আজকে। ওয়েস্টার্ন হতে পারে, হতে পারে রোমান্টিক কোনও ক্লাসিক ছবি। হরর না হলেই কোনও আপত্তি নেই ওর।

‘যাই আমি,’ বলে উঠল জনি। ‘পপকর্ন নিয়ে আসি।’

.

জিফি পপ টিন-টা কাবার্ড থেকে নামিয়ে আনল জনি। চড়াল ওটাকে বৈদ্যুতিক স্টোভে। হাই করে দিল বার্নারের নব ঘুরিয়ে। উত্তপ্ত হতে শুরু করল তারের ঝাঁঝরি।

আপাতত ফিরে চলেছে জনি হলওয়ে ধরে।

‘অ্যাই, তানি… শিয়োর তো তুমি, এতখানি মাখন আর লব্—’ বেডরুমে ঢোকার আগেই কথা বলতে শুরু করেছিল যুবক; গোবরাটে পৌছে দেখে, স্বপ্নরাজ্যে বিচরণ করছে ওর স্ত্রী।

এবং আবারও ডিসটার্ব করতে শুরু করেছে টিভিটা।

কাছে গিয়ে বন্ধ করে দিল ওটা। এর পর কিচেনে ফিরে গিয়ে অফ করে দিল চুলাটাও।

এক এক করে নিভে গেল বাড়িটার বাতিগুলো।

.

সকালবেলা।

টাই-এর নট বাঁধতে দেখছে স্বামীকে তানিয়া। টাই বাঁধা শেষে সুটের ভিতরে শরীর গলাল জনি।

‘সরি, তানি, যেতে হচ্ছে বলে, এ নিয়ে এক শ ছাপ্পান্নতম বারের মতো দুঃখপ্রকাশ করল যুবকটি। ‘অ্যাডভাইজার না বললে তো যেতামই না।’

‘এটা তো আমাদের সুনিশ্চিত আগামীর জন্য,’ দ্বিমত পোষণ করল তানিয়া। ‘আমারই খারাপ লাগত, যদি তুমি না যেতে। …কেমন লাগছে, বলো তো!’

‘প্রজাপতি উড়ছে পেটের মধ্যে।’

‘ওদের মন জয় করবে তুমি, দেখে নিয়ো,’ নিশ্চিত বিশ্বাসের সুরে বলল তানিয়া।

.

চলছে টিভিটা। রিসেপশন যথারীতি যাচ্ছেতাই।

চ্‌ঙ্ক্‌চ্‌ঙ্ক্‌চ্‌ঙ্ক্‌চ্‌ঙ্ক্‌চ্‌ঙ্ক্‌চ্‌ঙ্ক্‌চ্‌ঙ্ক্‌চ্‌ঙ্ক্‌…

এক টুকরো কাপড় আগুপিছু করছে তানিয়া সেলাই- মেশিনের সুইয়ের নিচ দিয়ে। সেকেণ্ডে সেকেণ্ডেই ধাতব শলাকাটার এক চুল দূর দিয়ে যাচ্ছে ওর আঙুলগুলো। দুর্ঘটনা ঘটে ঘটে, এরকম চরম মুহূর্তে আঙুলগুলো পিছিয়ে এসে আরও কাপড় ঠেলে দিচ্ছে সামনের দিকে।

চলছে এভাবেই…..

কির্‌র্‌র্‌ আওয়াজ করে সদর দরজাটা খুলে গেল লিভিং রুমে। খুব বেশি ফাঁক হয়নি অবশ্য। তবে যথেষ্টই।

একই সময়ে রান্নাঘরে ঘুরে গেল স্টোভের ডায়ালটা। অফ ছিল, এখন একেবারে হাই!

চ্‌ঙ্ক্‌চ্‌ঙ্ক্‌চ্‌ঙ্ক্‌চ্‌ঙ্ক্‌চ্‌ঙ্ক্‌চ্‌ঙ্ক্‌চ্‌ঙ্ক্‌চ্‌ঙ্ক্‌…

কাপড়… সুই… বিপজ্জনক দূরত্ব…

জিফি পপ টিনটার নিচে তপ্ত হতে হতে উজ্জ্বল কমলা হয়ে উঠল বার্নারের কয়েল। ফুলে-ফেঁপে বেলুনে পরিণত হচ্ছে জিফি পপের রুপালি ফয়েল।

চ্‌ঙ্ক্‌চ্‌ঙ্ক্‌চ্‌ঙ্ক্‌চ্‌ঙ্ক্‌চ্‌ঙ্ক্… আউচ!

মুহূর্তের অমনোযোগে যা হওয়ার, তা-ই হয়েছে। সুই ফুটেছে তানিয়ার আঙুলে। নিমেষে আঙুলের মাথা লাল হয়ে উঠল রক্তে।

‘শিট!’

আহত আঙুলটা চেপে ধরে বাথরুমের দিকে রওনা হলো তানিয়া। ভারি শরীরের কারণে চলতে-ফিরতে কষ্ট। সেজন্য নাইটস্ট্যাণ্ড, ড্রেসার, ইত্যাদি ধরে ধরে এগোচ্ছে।

ওদিকে ফুলতে ফুলতে যে-কোনও মুহূর্তে বিস্ফোরিত হওয়ার অবস্থায় পৌছে গেছে ফয়েল। পপকর্ন ফোটার পপ-পপ আওয়াজ আসছে ভিতর থেকে।

ফসেটটা ছেড়ে দিল তানিয়া বাথরুমে ঢুকে। পড়তে লাগল ঠাণ্ডা পানি। সুই-ফোটা আঙুলটা ধরল ও জলধারার নিচে। ড্রেইন দিয়ে বেরিয়ে যেতে লাগল রক্ত মিশ্রিত পানি। জলের শোঁ শোঁ আওয়াজের নিচে চাপা পড়ে গেছে পপকর্নের পপ-পপ।

আঙুল ধোয়া শেষে একখানা ব্যাণ্ড-এইড খুঁজে নিল তানিয়া মেডিসিন ক্যাবিনেট থেকে, আঙুলে জড়াল ব্যাণ্ড- এইডটা। পানিটা বন্ধ করতেই থেমে গেছে কিচেনের আওয়াজটাও। তবে এখনও ফুলছে ফয়েল।

বেরিয়ে এল তানিয়া বাথরুম থেকে। দমেনি দুর্ঘটনাটায়। আবার বসল ও মেশিনের সামনে।

চ্‌ঙ্ক্‌চ্‌ঙ্ক্‌চ্‌ঙ্ক্‌চ্‌ঙ্ক্‌চ্‌ঙ্ক্‌চ্‌ঙ্ক্‌চ্‌ঙ্ক্‌চ্‌ঙ্ক্‌…

শেষ পর্যন্ত ফটাস করে বিস্ফোরিত হলো ফয়েলটা। চতুর্দিকে ছিটকে গেল পপকর্ন। আগুনের বিরাট একটা শিখা জ্বলে উঠল দপ করে। ঝুলিয়ে রাখা একটা ডিশ-টাওয়েলে ধরে গেল আগুনটা।

চোখ তুলে তাকাল তানিয়া সেলাইয়ের কাজ থেকে। এ মুহূর্তে ক্রিসটালের মতো পরিষ্কার টিভির রিসেপশন।

খেলনার বিজ্ঞাপন দেখানো হচ্ছে টিভিতে। বাচ্চা এক মেয়ে খেলছে পুতুল নিয়ে।

মুচকি হাসল তানিয়া। পরমুহূর্তেই কুঁচকে উঠল ওর নাকটা।

গন্ধ কীসের?

হলওয়েতে চোখ বোলানোর জন্য চেয়ারে কাত হলো মেয়েটা।

কালো ধোয়ার মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে ওখানে!

‘ওহ, গড…’ অস্ফুটে বেরিয়ে এল ওর মুখ থেকে।

ধড়মড় করে চেয়ার ছাড়ল তানিয়া। ওজনদার শরীরটা নিয়ে যতটা সম্ভব, এগোনোর চেষ্টা করছে দ্রুত।

আগুনের একটা স্তম্ভ উঠে গেছে আভেন থেকে, গা চাটছে সিলিঙের। কিচেনে পৌছোতেই সিলিং-ফ্যানটা খুলে পড়ে গেল মেয়েটার পায়ের কাছে।

পিছাতে গিয়ে চিতিয়ে পড়ে গেল তানিয়া। স্বয়ংক্রিয়ভাবে হাত চলে গেল পেটের পাশে। তীব্র যন্ত্রণার একটা ঢেউ ছড়িয়ে পড়েছে ক্ষতটা থেকে। সইতে গিয়ে লাল হয়ে উঠল মেয়েটার ফরসা মুখ। কেঁদে ফেলার অবস্থা।

কাছিয়ে আসছে তপ্ত শিখা। ক্রমেই ঘন হয়ে উঠছে কালো ধোঁয়া।

বাইরে বেরোনোর দরজাটার দিকে ক্রল করতে আরম্ভ করল তানিয়া। ব্যবহার করছে শরীরে অবশিষ্ট শক্তির প্রতিটি আউন্স।

পারবে কি আগুন থেকে বাঁচতে? মনে তো হয় না…

ধড়াম্‌ম্‌ম্!

ভিতরদিকে বিস্ফোরিত হয়েছে দরজাটা। এক প্রতিবেশীকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল তানিয়া গোবরাটে। ছুটে এল লোকটা ওকে সাহায্য করার জন্য।

‘হেএল্প!’ চেঁচিয়ে উঠল বাইরের উদ্দেশ্যে। ‘আটকা পড়েছে মহিলা! সম্ভবত আহত! অ্যামবুলেন্সে ফোন করো জলদি!’

চ্যাংদোলা করে বের করে আনা হলো তানিয়াকে।

আট

প্রায় দৌড়াচ্ছে জনি হাসপাতালের হলওয়ে ধরে। আছড়ে পড়ল একটা ডাবল-ডোরের উপর। আরেকটু হলেই ধাক্কা লেগে যাচ্ছিল এক জ্যানিটরের সঙ্গে।

উদ্ভ্রান্ত চেহারা হয়েছে যুবকের। ঘাম আর অশ্রুর চিহ্ন সারা মুখে। ফাঁসির দড়ির মতো ঢিলে হয়ে বুকের উপর ঝুলে আছে টাইটা।

‘তিন শ’ আট… তিন শ’ আট…’ বিড়বিড় করছে ও পাগলের মতো।

আঙুল দিয়ে হলওয়ের শেষ প্রান্তে দেখাল জ্যানিটর।

জনির মনে হলো, আলোর গতিতে পৌঁছে যেতে পারত যদি!

.

ঝোড়ো হাওয়ার মতো প্রবেশ করল জনি তিন শ’ আট নম্বর কেবিনে।

হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছে ওর আদরের বউটা। পরস্পর-সংযুক্ত নানান ধরনের যন্ত্রপাতি ব্লিপ-ব্লিপ করছে ওর আশপাশে।

ভালো করে নিংড়ে শুকাতে দেয়া কাপড়ের মতো চেহারা হয়েছে মেয়েটার। চেষ্টা করল মাথা তুলতে। মলিন হাসল না পেরে। কিছু একটা বলতে চাইল যেন। কিন্তু স্রেফ দীর্ঘশ্বাসের মতো একটা আওয়াজ বেরোল ওর বুক চিরে।

‘হ্-হেই…’ কেঁদে ফেলবে যেন জনি। ঝুঁকল ও মেয়েটার কাছে এসে। আলতো করে সরিয়ে দিল কপালের উপরে এসে পড়া চুলগুলো। ‘সরি, বেবি! সো সরি আই অ্যাম…’ মমতা ভরে চুম্বন করল যুবক বউয়ের কপালে।

‘পিছনে দেখো…’ ফিসফিস করল তানিয়া। ‘তোমার পিছনে…’

অবাক হয়ে ঘাড় ঘোরাল জনি। সারাটা শরীর অবশ হয়ে গেল ওর দেখে।

সদ্য প্রসূত এক শিশু কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে হাসপাতালের সেবিকা।

গোলাপি। নাদুস-নুদুস। আদুরে এক বিড়াল ছানার মতো।

‘কনগ্র্যাচুলেশনস,’ অভিনন্দন জানাল নার্স জনি গ্রেভকে। ‘মেয়ে হয়েছে আপনার।’ বাপের কোলে তুলে দিল মহিলা মেয়েটিকে।

ছলছল করে উঠল তরুণ পিতার চোখ দুটো। বাঁধ মানতে চাইছে না যেন আনন্দ।

এই যে, পুচি…’ নিজের মেয়ের সঙ্গে কথা বলছে যুবক। ‘আকিরা,’ কোমল স্বরে বলল ওর মা।

জনির হাসিতে স্ত্রীর প্রতি সমর্থন। ‘এই যে, আকিরা… মামণি আমার!’

চেহারায় স্বর্গীয় প্রশান্তি নিয়ে বাপ-বেটির সাক্ষাৎপর্ব দেখছে তানিয়া, অ্যাকসিডেন্টটার কথা মনে পড়ায় মেঘ ঘনাল মুখে।

‘জনি… ‘

‘উ?’

‘আগুনটা…

‘একদমই চিন্তা কোরো না ও-নিয়ে। স্রেফ খুশি যে আমি, সহি সালামতেই রয়েছ তোমরা…

‘জানি না, কী হয়েছিল…’ মুষড়ে পড়েছে তানিয়া। ‘এমন এমন সব ঘটনা ঘটছে, ও-বাড়ি যেন অভিশপ্ত! ওখানে আর ফিরতে পারব না আমি… অন্তত আকিরাকে নিয়ে নয়!’

মেয়েকে নিয়ে মায়ের কাছাকাছি হলো যুবক। ‘তার আর দরকার হবে না, ডারলিং…’

নয়

স্কাই হাই। উনিশ শ’ চল্লিশ সালে নির্মিত দশ তলা এক অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিং। দাঁড়িয়ে আছে প্যাসাডিনা নামের মনোরম ডাউনটাউনটির বৃক্ষের সার দেয়া রাস্তার ধারে। পর্যটকদের জন্য ছাপা ব্রোশারের প্রচ্ছদে অনায়াসে জায়গা পেতে পারে আশপাশের দৃশ্য সহ উঁচু এই দালানটি।

এই বিল্ডিঙেরই অষ্টম তলায় অ্যাপার্টমেন্ট নিয়েছে গ্রেভ দম্পতি।

দুটো বেডরুম। ইট বেরোনো, প্লাসটারবিহীন দেয়াল। মেঝেটা হার্ডউডের, আর ছাতের কিনারাগুলো ক্রাউন মোল্ডিং ধরনের।

বেশ প্রশস্তও অ্যাপার্টমেন্টটা। এখন অবশ্য টের পাওয়া যাচ্ছে না। টেটরিস গেমের হ-য-ব-র-ল অবস্থার মতো অস্থায়ী বাক্সে বোঝাই হয়ে রয়েছে কামরাগুলো।

এত সব বাক্স-প্যাঁটরার ভিড়ের মধ্যেই কাঁদছে কোথাও আকিরা।

মেঝেতে বিছানো ছোট এক কম্বলের দিকে এগিয়ে গেল তানিয়া। জানে ও, ওখানেই পাওয়া যাবে ক্রন্দনরত কন্যাকে। গেলও। তারস্বরে কান্না জুড়েছে পুঁচকেটা।

বাচ্চাটাকে কোলে তুলে নিল তানিয়া। শান্ত করার প্রয়াস পাচ্ছে দোল দিতে দিতে।

কাজ হলো এতে। কান্না থামিয়ে শান্ত হলো আকিরা।

ছাতের উপরে মড়মড় করে উঠতেই উপরে চাইল ওর মা। বিরক্ত হলো একটু। উপরতলার বাসিন্দাদের কাজ এটা, পা ফেলছে জোরে জোরে।

বুঝতে পারছে ও, ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হতে হবে এসব কিছুর সঙ্গে।

শোবার ঘর থেকে বেরিয়ে এল জনি। মা-মেয়ের মতোই নিজের সবচেয়ে ভালো কাপড়টা পরেছে রোববারের প্রার্থনায় শামিল হওয়ার জন্য।

‘রেডি সবাই?’ জিজ্ঞেস করল তাড়া দেয়ার ভঙ্গিতে।

.

সেভেনথ ফ্লোরের হলওয়েতে এলিভেটরের জন্য অপেক্ষা করছে গ্রেভ পরিবার। হড়কে খোলা যায়, এ ধরনের ঝাঁঝরিঅলা দরজাবিশিষ্ট মান্ধাতার আমলের এক এলিভেটর ওটা।

ডিং!

দু’দিকে খুলে গেল জোড়া-দরজা। জোশুয়া জ্যাকসনকে দেখা যাচ্ছে এলিভেটরের মধ্যে। লম্বায় তাল গাছ। বেশভূষা অগোছাল। কেবল পা দিয়েছে তিরিশে।

শিগগিরই শাওয়ার নেয়া দরকার জ্যাকসনের। অন্তত দু’ঘণ্টা ধরে। উডস্টকের কনসার্টে গিয়েছিল সে গত কাল। ঘামের গন্ধ ছুটছে কাপড়চোপড় থেকে।

কিছুটা দ্বিধা বোধ করছে তানিয়া এলিভেটরে উঠতে জিজ্ঞেস করল জ্যাকসন, ‘হ্যালো, মিস্টার গ্রেভ! কেমন আছেন, স্যর?’

উঠে পড়ল জনি এলিভেটরে। তাড়া দিল ও তানিয়াকে।

আকারে একটা কফিনের মতো এলিভেটরটা। একটু চাপাচাপিই হয়ে যায় দু’জনের জন্য। সেখানে তিন-তিনজন বড়মানুষ উঠেছে ওরা।

‘তানিয়া, উনি হচ্ছেন…’ পরিচয় করিয়ে দিতে গিয়ে আবিষ্কার করল জনি, মনে পড়ছে না ভদ্রলোকের নামটা।

‘জোশুয়া জ্যাকসন,’ নিজেই নিজের পরিচয় দিয়ে দিল সদাহাস্য যুবক। ‘ভালো আছেন, ম্যাডাম?’

‘জি, ভালো। নাইস টু মিট ইউ।’

বলল বটে, তবে প্রীত মনে হচ্ছে না তানিয়াকে। ভাবনায় ফেলে দিয়েছে লোকটার জঙ্গুলে চুল-দাড়ি…

কার কথা মনে পড়ছে একে দেখে? এমন কেউ, যাকে ও প্রাণপণে ভুলে থাকতে চায়…

‘আমাদের বাড়িঅলা উনি,’ খোলসা করল জনি।

কীহ! বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে তানিয়ার। পাগলাটে গোছের লোকটা এই দালানবাড়ির মালিক!

‘আপ্‌…’ বলতে গিয়ে তুতলে গেল তানিয়া। ‘এ-বাড়ির মালিক আপনি?’

‘সেই সাথে ম্যানেজারও,’ বলল জ্যাকসন এক গাল হেসে। ‘যদি কোনও কিছুর প্রয়োজন হয় আপনাদের, নির্দ্বিধায় জানাতে পারেন আমাকে।’

‘বাড়িটা আসলে ওঁর বাপ-মায়ের…’ ব্যাখ্যা করল জনি।

‘দাদা-দাদির, অ্যাকচুয়ালি। ওঁরাই প্রথম কিনেছিলেন এটা; আসল মালিক যিনি ছিলেন, তাঁর কাছ থেকে। সেটা ছিল উনিশ শ’হ…’

বিদঘুটে একটা আওয়াজের সঙ্গে ঝাঁকুনি দিয়ে থেমে গেছে এলিভেটর, দুই ফ্লোরের মাঝামাঝি এসে।

‘কী হলো এটা?’ উদ্বিগ্ন স্বরে জানতে চাইল তানিয়া। চকিত দৃষ্টি বিনিময় করল জনির সঙ্গে।

মুখ বাঁকাল জ্যাকসন। ‘মাঝে মাঝেই ঝামেলা করে এরকম। বুঝতেই তো পারছেন, পুরানো একটা বাড়ি… নিজের মেজাজ-মর্জিমতো চলে যন্ত্রপাতিগুলো…’

‘ঠিক করাতে পারেন না?’ কৈফিয়ত দাবির সুরে জানতে চাইল তানিয়া।

‘ওহ… পারি তো বটেই। সময়ের কোনও অভাব নেই আমার।’

এক… দুই… তিন… চার… দশ সেকেণ্ড পর আবার একটা বিদঘুটে আওয়াজের সঙ্গে ঝাঁকুনি দিয়ে নামতে আরম্ভ করল এলিভেটর।

তলায় যখন পৌছাল, ছিটকে মেয়েকে নিয়ে লবিতে বেরিয়ে এল তানিয়া। তেতো খাওয়া চেহারায় জনির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘সিঁড়ি ব্যবহার করব আমি এর পর থেকে!’

.

সেইণ্ট মনিকাস ক্যাথলিক চার্চে, পুলপিটের পিছনে দাঁড়িয়ে বক্তব্য রাখছেন ফাদার রোডরিগেজ। দেখে মনে হচ্ছে, যাজকের কলারের পরিবর্তে ব্যাজ পরা উচিত ছিল ওঁর। হাবভাব পুলিসের মতো।

‘….ভয়টাকে জেঁকে বসতে দিতে পারি না আমরা, নিজেদের ভিতরে,’ কঠোর কণ্ঠ ফাদারের। ‘ঈশ্বর যেহেতু সর্বদাই সাথে রয়েছেন আমাদের, সত্যিকার অর্থে আমরা সেজন্য একা নই কখনও। সামান্য এই কথাটা উপলব্ধি করতে না পারার কারণ থেকেই যাবতীয় ভয়ের উৎপত্তি দুনিয়ায়। সত্যি কথাটা হলো—যতই জ্ঞান বাড়বে আমাদের, ততই দুর্বল হয়ে পড়বে আমাদের উপর গেড়ে বসা অশুভ শক্তির ধারক-বাহকেরা। ভয়কে তখন জয় করতে পারব আমরা…’

হল-ঘরের পিছনদিককার একটা বেঞ্চিতে বসেছে জনি আর তানিয়া। স্ত্রীর হাত ধরল জনি। ওর বুড়ো আঙুলটা ইঙ্গিতপূর্ণভাবে ছুঁয়ে দিল বউয়েরটাকে, যার তরজমা করলে দাঁড়ায়: খেলবে?

মিষ্টি হাসি ফুটল তানিয়ার ঠোঁটে। পাশে কাত হয়ে ফিসফিস করল ও: ‘যাই… কাপড় বদলাতে হবে আকিরার…’

উঠে দাঁড়াল তরুণী মেয়েকে নিয়ে।

সাইড-এক্সিট ধরে বেরিয়ে যাচ্ছে মা-মেয়ে, ফাদার রোডরিগেজের দৃষ্টি পড়ল ওদের উপর। আবার মনোযোগ দিলেন তিনি সারমনে।

.

চার্চ-ইয়ার্ডের একটা বেঞ্চিতে বসে খেলছে তানিয়া মেয়েকে নিয়ে। ওদের পিছন দিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে আসছে প্রার্থনায় সমবেতরা।

পিছনে তাকিয়ে স্বামীকে খুঁজছে তরুণীর চোখ দুটো; দেখতে পেল ওদের দিকেই এগিয়ে আসছেন ফাদার রোডরিগেজ। একখানা কোডাক ক্যামেরা ঝুলছে ওঁর গলা থেকে।

‘খুদে দেবদূতটার একটা ছবি তুললে কিছু মনে করবে?’ অনুমতি চাইলেন তিনি আকিরার মায়ের কাছে। ‘চার্চের নতুন সদস্য হিসেবে তুলে রাখা দরকার ছবিটা…’

‘ইয়াহ, অফ কোর্স,’ এক বাক্যে রাজি তানিয়া।

‘…ভালো হয়, যদি ওকে কোলে নিয়ে বসাও…’ বললেন ফাদার ক্যামেরা অ্যাডজাস্ট করতে করতে।

‘ওহ, না…’ মাথা নাড়ল তানিয়া। ‘মাফ করবেন, ফাদার। নিজের ছবি তুলতে চাই না আমি। আপনারও তো দরকার নেই বোধ হয়…

‘অবশ্যই দরকার আছে। অন্য সব সৃষ্টির চাইতে মায়েরাই হচ্ছে স্রষ্টার সবচেয়ে কাছের। এ কারণেই যে, সন্তান জন্মদানের মাধ্যমে এক মাত্র ওরাই পারে সৃষ্টিকর্তার অলৌকিক সৃজনশীলতাকে দুনিয়াব্যাপী ছড়িয়ে দিতে।’

মেয়েকে কোলে বসাল তানিয়া। জোর করে হাসি ফোটাল মুখে।

ছবি তুললেন ফাদার রোডরিগেজ। ‘ব্যস, চলবে।’ সন্তুষ্ট দেখাচ্ছে প্রৌঢ়কে। ফিল্ম রিওয়াইও করছেন ক্যামেরায়, তারই ফাঁকে বললেন: ‘তোমার স্বামী বলছিল, কোথায় নাকি নতুন আস্তানা গেড়েছ তোমরা…’

‘জি, ফাদার, প্যাসাডিনায় …..

‘ভালোই হয়েছে,’ মন্তব্য করলেন প্রৌঢ়। নতুন বাচ্চা, নতুন চাকরি, নতুন নীড়… অনেকগুলো নতুন-এর সমাহার…

স্বামীকে দেখতে পেল তানিয়া ভিড়ের মধ্যে।

‘ওই যে… এসে গেছে জনি… যেতে হচ্ছে আমাকে… প্রচুর বাক্স-প্যাঁটরা খোলা বাকি রয়েছে এখনও…’ ক্ষমাপ্রার্থনার ভঙ্গি করে রওনা হয়ে গেল তানিয়া।

‘নতুন অতিথি আর হাওয়া-বদলের জন্য অভিনন্দন, ‘ পিছন থেকে বললেন ফাদার রোডরিগেজ।

.

সদ্য আনপ্যাক করা থালা-বাসন আর রুপোর প্রলেপ দেয়া কাটলারিগুলো ডাঁই করে রাখা সিঙ্কের এক পাশে। ধুতে আরম্ভ করল তানিয়া ফসেটটা খুলে দিয়ে।

ধুচ্ছে… ধুচ্ছে… আচমকা বন্ধ হয়ে গেল পানি। ফাঁপা আওয়াজ বেরোচ্ছে কেবল পাইপের ভিতর থেকে।

বার কয়েক অফ-অন করে দেখল তানিয়া ফসেটটা। কাজ হলো না তাতে।

.

বৈঠকখানায় বই গোছাচ্ছে তানিয়া। একটা একটা করে তাকে সাজিয়ে রাখছে বইগুলো। শুনতে পেল, দেয়ালের অপর পাশে তর্ক চলছে প্রতিবেশীদের।

কাছে এগিয়ে গেল তানিয়া, শ্রবণেন্দ্রিয় তীক্ষ্ণ করে বোঝার চেষ্টা করছে কথাগুলো।

সেজন্যই যেন থেমে গেল উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়।

যেন টের পেয়ে গেছে ওরা মেয়েটার উপস্থিতি!

ভুরুতে ভাঁজ পড়ল তানিয়ার। বিভ্রান্ত দেখাচ্ছে ওকে। কী নিয়ে কথা ব্‌–

ঠক ঠক ঠক ঠক!

চমকে উঠে পিছিয়ে গেল তানিয়া। তাড়াতাড়ি দরজায় গিয়ে চোখ রাখল ফিশ-আই-এ।

জোশুয়া জ্যাকসন।

ঠক ঠক!

‘আছেন নাকি কেউ?’ হেঁকে বলল লোকটা দরজার ওপাশ থেকে। ‘কেউ একজন কল দিয়েছিল ফসেটের ব্যাপারে…’

দরজা খুলল তানিয়া।

ভদ্রতার হাসি ঝুলে রয়েছে বাড়িঅলার ঠোঁটে।

.

আধো আধো বোলে দোলনার উপরে ঝুলন্ত উইণ্ডচাইমটার সঙ্গে কথা বলছে আকিরা। টুং টাং টুং টাং করে বাচ্চাটার কথার জবাব দিচ্ছে বাজনাটা।

ও-ঘরের দরজার পাশে, বসে রয়েছে তানিয়া মেঝেতে। কানে আসছে, রান্নাঘরে পাইপ-টাইপ নিয়ে ধুড়ুম-ধাড়ুম করছে জ্যাকসন।

এরই মাঝে ফোন বেজে উঠল কিচেনে।

.

সেকেণ্ড কয়েক পর।

সিঙ্কের তলায় মাথা ঢুকিয়ে দিয়েছে ম্যানেজার। কী জানি করছে ওখানে একখানা রেঞ্চ নিয়ে।

লোকটার দিকে দৃষ্টি রেখে ফোনের রিসিভার তুলল তানিয়া। ‘…হ্যালো?’

.

সিটি হাসপাতালের হলওয়ে থেকে করা হয়েছে ফোনটা।

লম্বা, সাদা কোট জনির পরনে। কানে ধরে রেখেছে রিসিভারটা। হাসপাতালের স্বাভাবিক কর্মব্যস্ততা ওর পিছনে।

‘আমি, ডারলিং…’ বলল তরুণ ডাক্তার। ‘এমনিই ফোন করলাম। কেমন আছে আমাদের আকিরামণি? …আর তুমি?’

বিল্ডিং ম্যানেজারের পিঠের দিকে তাকিয়ে আছে তানিয়া। লোকটার উপস্থিতি অস্বস্তিতে ফেলে দিয়েছে ওকে।

‘ঠিক আছি আমরা…’ জানাল মেয়েটা। ‘জ্যাকসন সাহেব—’

সময় পেল না আর! উচ্চ নাদে বাজতে আরম্ভ করেছে জনি গ্রেভের মাথার উপরের ইন্টারকমটা।

‘কী যেন বলেছিলে?’ স্ত্রীর শেষ কথাটা খেয়াল করেনি জনি।

‘জ্যাকসন সাহেবের কথা… আমাদের বিল্ডিঙের ম্যানেজার যিনি… উনি এসে পরীক্ষা করে দেখছেন—’

বাধা পেল আবারও। আরেক ডাক্তার এসে চেঁচাতে শুরু করল জনির উদ্দেশে।

‘ডক্টর গ্রেভ! যেতে হবে এক্ষুনি! শুরু হয়ে গেছে আবার!’

‘শিট… তানিয়া! এক্ষুনি ছুটতে হচ্ছে আমাকে!’ বলল জনি উত্তেজিত স্বরে।

‘ফিরছ তো তাড়াতাড়ি? কত গোছগাছ করা বাকি এখনও। আমি—’

‘যাচ্ছি আমি, তানি! আমার হয়ে চুমু দিয়ো আকিরাকে … বাই!’ খটাস করে ফোন রেখে দিল জনি।

ফোন রাখল তানিয়াও। ঘুরেই দেখল, ওর দিকেই হাসিমুখে তাকিয়ে আছে জোশুয়া জ্যাকসন।

‘এবার তো ঠিকঠাক কাজ করাই উচিত,’ আপডেট জানাল বাড়িঅলা-কাম-ম্যানেজার। ‘মিস্টার গ্রেভ বোধ হয় আটকা পড়ে গেলেন সারা দিনের জন্য?’

‘ডক্টর,’ প্রচ্ছন্ন শ্লেষের সঙ্গে শুধরে দিল তানিয়া। ‘জি- না। বাড়ির পথে রওনা হয়েছেন তিনি…’

বৈঠকখানায় এসে মেলে ধরল ও দরজাটা। ইঙ্গিতটা পরিষ্কার। ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে বলল, ‘ধন্যবাদ আসার জন্য।’

‘নিশ্চয়ই… নিশ্চয়ই,’ বলে বিদায় নিল লোকটা।

দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে লক করে দিল তানিয়া।

.

নার্সারিতে এসে ভেজা পোশাক পাল্টে শুকনো কাপড় পরিয়ে দিল মেয়েকে তানিয়া।

‘কেমন লাগছে এখন?’ আলাপ জুড়ল মেয়ের সঙ্গে। ‘কী ভাবনা চলছে ছোট্ট মেয়েটার মাথার মধ্যে? সুপারম্যানের মতো এত বড় শহরটার ভালোমন্দ দেখার জন্য তৈরি হয়ে গেছে নাকি?’

হাসল কেবল আকিরা। বুঝল তো না একটা কথাও।

.

আকিরাকে কোলে নিয়ে আট তলার হলওয়েতে বেরিয়ে এল তানিয়া। তালা লাগিয়ে দিল দরজাটায়।

মিঁয়াও!

বেওয়ারিশ একটা বিড়াল কোত্থেকে ছুটে এসে গা ঘষতে লাগল মহিলার গোড়ালির সঙ্গে।

উবু হলো তানিয়া। ‘ওরে, আমার বিল্লি বাবুটা!’

জবাবে হিস্ করে উঠল বিল্লি বাবু। হলওয়ে ধরে নিয়ে গেল ওটা অন্ধকার এক কোনায়।

ডিং!

যেন কোনও জাদুমন্ত্রের বলে আপনা থেকেই খুলে গেল এলিভেটরের জোড়া-দরজা। শূন্য অভ্যন্তরটা প্রলুব্ধ করছে যেন।

কিন্তু না। প্রতিজ্ঞা ভোলেনি তানিয়া। সিঁড়ির দিকে রওনা হলো ও।

.

বছর আটেকের একটা ছেলে সিঁড়িতে বসে ছবি আঁকছিল ক্রেয়ন ঘষে ঘষে। ছ’বছরের বোনটা ওর মগ্ন ছিল পুতুল নিয়ে। মেয়েকে নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসতেই তাকাল ভাইবোন চোখ তুলে।

‘হাই,’ আলাপ জমানোর সুরে বলল তানিয়া। ‘তোমরাও থাকো নাকি এখানে?

‘আমরা থাকি—’

‘বোলো না… বোলো না!’ তাড়াতাড়ি বোনকে বাধা দিয়ে উঠল ওর ভাই। ‘অপরিচিত লোকজনের সাথে কথা বলতে বারণ করা হয়েছে না?’

সিঁড়ির নিচে, স্টোরেজ ক্লজিটের তালা খুলল তানিয়া। বের করে আনল ভিতরে রাখা নিজেদের স্ট্রলারটা। চার চাকার গাড়িটার মধ্যে বসিয়ে দিল ও আকিরাকে।

‘ঠিকই বলেছ তুমি,’ সহজ কণ্ঠে উৎসাহ দিল ছেলেটিকে। ‘আসলেই কথা বলা উচিত না বাইরের কারও সাথে।’ এবার মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তোমার পুতুলটা পছন্দ হয়েছে আমার। ঠিক এটার মতোই অ একটা আমারও…

‘সত্যি?’ খুশি ঝিলিক দিল মেয়েটির চেহারায়।

‘একটা না, এক জোড়া আছে। …আমার নাম তানিয়া। আর এটা হচ্ছে আমার মেয়ে… আকিরা। তোমরা?’

‘আমার নাম—’

‘আবার কথা বলছ!’ ফের বোনকে শাসন করল ছেলেটি। অসহায় দৃষ্টিতে তানিয়ার দিকে তাকাল মেয়েটি। কাঁধ ঝাঁকাল নিরুপায় ভঙ্গিতে।

মৃদু হাসল তানিয়া। ‘বেশ তো। একদিন নিশ্চয়ই বন্ধু হব আমরা। দেখা হবে… কেমন?’ ঠেলল সে স্ট্রলারটা।

.

সাইডওয়াক ধরে হেঁটে চলেছে তানিয়া, থেমে দাঁড়াল একটা সেকেণ্ডহ্যাণ্ড বুকস্টোরের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময়।

নানান ধরনের বইপুস্তক সাজিয়ে রাখা কাচের ওপাশে, দোকানের ডিসপ্লেতে। বাচ্চাদের বই রয়েছে প্রচুর, কিছু রয়েছে বড়দের বেস্ট সেলার।

অকাল্টের উপরে মোটাসোটা একটা বই চোখে পড়ল তানিয়ার কোনার দিকে। জীর্ণ হয়ে গেছে কাভারটা, ফেটে গেছে জায়গায় জায়গায়। বোঝা যাচ্ছে, অনেক হাত ঘুরেছে ওটা।

মেঘের নেকাব ঢেকে দিয়েছে সূর্য। বয়ে গেল এক ঝলক হিমেল বাতাস।

দূরে তাকাল তানিয়া। কেমন জানি বিচলিত দেখাচ্ছে ওকে। পা চালাল আবার, যেদিকে চলছিল।

.

এক হাতে মেয়েকে ধরে রেখেছে তানিয়া, স্টোরেজ ক্লজিটের তালা খুলে স্ট্রলারটা ঢুকিয়ে রাখল আগের মতো। এবার সিঁড়ি ধরল ও উপরে ওঠার জন্য।

ভাইবোনের চিহ্ন নেই কোথাও। …না, আছে। একটা দরজার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় দেখতে পেল, কবাটের তলার ফাঁকে আটকে রয়েছে একটা ড্রইং পেপার।

তুলল তানিয়া ওটা।

আনাড়িভাবে ক্রেয়ন ঘষে ঘষে আঁকা হয়েছে ছবিটা। বিষয়বস্তু: বাচ্চাকে বসিয়ে স্ট্রলার ঠেলছে তানিয়া। দু’জনের মুখেই চওড়া হাসি। নীল আকাশে হলুদ সূর্য। রাস্তায় গাড়িঘোড়া।

হাসি ফুটল তানিয়ার মুখে। মেয়েকে দেখাল ও ছবিটা। ‘দেখেছ, মামণি… কী এঁকেছে তোমার জন্য? মনে হচ্ছে, বন্ধু হয়ে যাচ্ছি আমরা….’

সিঁড়ি ভাঙতে লাগল মেয়েটা।

এবার আরেকটা ছবি। পড়ে ছিল সিঁড়ির উপর।

আকিরা আর তানিয়া বসে আছে স্ট্রলারের মধ্যে। আগের মতোই হাসছে দু’জনে। নীল আকাশে হলুদ সূর্য। গাড়ি… এবং একটা সিটি বাস।

কষ্ট হচ্ছে সিঁড়ি ভাঙতে। হঠাৎ যেন ক্লান্তি ভর করেছে তানিয়ার শরীরে।

ওহ… আরেকটা!

বাতাসে ফরফর করছে ক’ধাপ উপরে।

কী দেখবে এবার?

কাছে গিয়ে তুলে নিল এটাও।

স্ট্রলারে বসে আছে মা-মেয়ে। আকাশ। সূর্য। সিটি বাস… এবার একটু কাছে।

বিভ্রান্ত দেখাচ্ছে তানিয়াকে। পা চালাল তাড়াতাড়ি। হোঁচট যাতে না খায়, সে-ব্যাপারে সতর্ক। শেষমেশ পৌঁছে গেল আট তলার হলওয়েতে।

ওহ… আবারও!

ঠিক ওদের দরজার সামনে এবারেরটা। পাশেই পড়ে আছে লাল একটা ক্রেয়ন। কাগজটার সঙ্গে ওটাও তুলে নিল তানিয়া।

‘হায়, ঈশ্বর…’ অস্ফুটে বেরিয়ে এল মুখ দিয়ে।

ড্রইঙে দেখা যাচ্ছে: বাসটা পিষে দিচ্ছে স্ট্রলারটাকে। চিৎকারের ভঙ্গিতে দু’হাত উঁচু করে তোলা তানিয়ার।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *