অদেখা ভুবন – ২.১৫

পনেরো

তুলোর বলটা অ্যালকোহলে ভেজাল জনি। তানিয়ার নগ্ন কাধে ঘষতে লাগল ভেজা তুলো।

‘দরকার ছিল না এসবের…’ আপত্তি তুলল মেয়েটা।

’অবশ্যই দরকার আছে। বাইরের একটা বিড়াল আঁচড়ে দিলে কী করা উচিত, প্রথম দিনই শেখানো হয় এটা মেডিকেল স্কুলে…’ টিটেনাসের টিকা তুলে নিল যুবক।

‘বিড়াল ছিল না ওটা…’ জোর নেই তানিয়ার গলায়।

‘কী তা হলে?’

জবাব দিতে পারল না মেয়েটা। দৃষ্টি দিল ও স্ট্রলারে ঘুমিয়ে থাকা কন্যার দিকে। কাঁধের উপর পিঁপড়ার কামড় অনুভব করতেই কুঁচকে উঠল ভুরু।

জনির কপালেও ভ্রুকুটি। বিতৃষ্ণা জাগছে জিজ্ঞেস করতে, তার পরও করল ও প্রশ্নটা।

‘তোমার কি ধারণা, কোনও কারণে উত্ত্যক্ত করছে ওটা? পুরানো কোনও ঘটনার জের?’

ঘাড় ঘোরাল তানিয়া। ‘জানি, পাগলের মতো শোনাচ্ছে। কিন্তু আর কী হতে পারে এ ছাড়া? অন্য কিছু তো আসছে না আমার মাথায়…’

‘তানি…’

‘এ-ও জানি, এসব নিয়ে কথা বলতে চাও না তুমি। এর চেয়ে বরং সব কিছু ঠিকভাবেই চলছে—এই ভান করাই পছন্দ তোমার…’

‘না, তানিয়া, ইউ আর রং। ভান নয়; আমি চাই, সব কিছুই ঠিকভাবে চলুক। চলবে না, যদি না আমরা জলাঞ্জলি দিই অভিশপ্ত অতীতটাকে…’

‘এখনও কি বুঝতে পারছ না তুমি?’ কেমন এক সুরে বলল তানিয়া। ‘অতীতকে ভুলতে পারছি না; কারণ, অতীতই আসলে পিছু ছাড়ছে না আমাদের!’

.

বৈঠকখানায় তানিয়ার মুখোমুখি বসেছেন ডিটেক্টিভ ওয়েস্টমোর।

‘ধন্যবাদ আসার জন্য,’ শুকনো স্বরে বলল তানিয়া।

‘না, ঠিক আছে। এখান থেকে বেশি দূরে নয় আমার অফিস। পরিবার নিয়ে থাকার জন্য চমৎকার জায়গা বেছেছেন আপনারা।’

স্মিত হাসল এবার মেয়েটা।

‘আ… ডেইমানদের কেসটার ব্যাপারে যা যা পাওয়া গেছে, নিয়ে এলাম সাথে করে…’ সঙ্গে আনা ফাইলটা খুললেন ওয়েস্টমোর। ভিতর থেকে একটা ফোটোগ্রাফ তুলে নিয়ে বাড়িয়ে দিলেন তানিয়ার দিকে।

ডেইমানদের মেয়ের ছবি ওটা। বছর কয়েক আগে তোলা। গড়পড়তা ক্যালিফোরনিকান মেয়ের মতোই দেখাচ্ছে ওকে। কোনও রকম অস্বাভাবিকতা নেই।

‘চিনতে পারছেন তো?’ ভুরু নাচালেন ওয়েস্টমোর। ‘অ্যানাবেল নাম ওর, অ্যানাবেল ডেইমান। শেষ যে বার দেখেছিলেন ওকে, অনেকটাই অন্য রকম লাগছে তার চেয়ে, তা-ই না? বিশেষ ওই কান্টের খপ্পরে পড়ার আগে তোলা হয়েছে ছবিটা।’

ভালো করে দেখল তানিয়া ছবিটা। রেখে দিল ওটা এক পাশে।

‘বিশেষ ওই কাল্টটার ব্যাপারে আর কোনও গবেষণা করেছেন?’ জিজ্ঞেস করল ও।

‘গবেষণা?’

‘হ্যাঁ… বিশেষ কোনও উদ্দেশ্য ছিল ওদের ওই আক্রমণের পিছনে?’

‘পাগল মানুষের কাজকারবার…’

‘কথা সত্যি। জানি আমি সেটা। কিন্তু ওরা তো আর পাগল ভাবে না নিজেদের। ওরা যেটা করে, উদ্দেশ্য নিয়েই করে……

‘ওয়েল… এদিক-ওদিক তদন্ত করে যেটা বুঝতে পারলাম… ভক্তিমূলক কোনও সঙ্ঘ ছিল না ওটা…’

‘তা হলে?’

‘কিছু একটাকে জাগিয়ে তুলতে চাইছিল ওরা…’

‘জাগিয়ে তুলতে চাইছিল?’ বুক ঢিপঢিপ শুরু হয়ে গেছে তানিয়ার। ‘কী সেটা?’

‘শয়তান… দানব… অপদেবতা… সঠিক করে বলতে পারব না।’

‘কোনও নাম আছে সঙ্ঘটার?’

‘আছে।’ ফাইলটা খুলে রিপোর্টে চোখ বোলালেন ওয়েস্টমোর। ‘নিজেদেরকে ওরা বলে: অর্ডার অভ দ্য রাম। আর-এ-এম… রাম। রিগর… অ্যাডোরেশন… মার্সি। কাঠিন্য… ভক্তি… ক্ষমা। ওপাস ডেই-এর (Opus DeI) হিপ্পি ভার্শন অনেকটা… ‘

ষোলো

সেকেণ্ডহ্যাণ্ড বইয়ের দোকানটায় স্ট্রলার ঠেলে ঢুকে পড়ল তানিয়া। এদিক-ওদিক তাকিয়ে হাঁটতে লাগল একটা আইল ধরে। শেলফে রাখা বইগুলোর শিরদাঁড়া দেখতে দেখতে এগোচ্ছে। সবগুলো বই-ই একই সাবজেক্টের উপরে: অকাল্ট

ক’টা বই টেনে বের করল ও তাক থেকে। দু-এক পাতা উল্টে দেখল বইয়ের। সূচিপত্রের উপর থেকে নিচে নামিয়ে আনল তর্জনি …

দানব

অতৃপ্ত আত্মা

ভয়

প্রেতসাধনা

ইত্যাদি… ইত্যাদি…

চোখ বোলাল ক’টা ছবিতেও …

শয়তান

পেন্টাগ্রাম

নরকের আগুনে পতিত দেবদূত

কালো বিড়াল

ইত্যাদি…

‘কেমন জানি দিশাহারা লাগছে তোমাকে…..’ শোনা গেল একটা গলা।

.

দোকানের পিছনদিককার একটা টেবিলে বসেছে তানিয়া। বেশ ক’টা বইপত্র ওর আর রায়ান অ্যাডামসের মাঝখানে। ভদ্রলোকের বয়স ষাট-পঁয়ষট্টি। তিনিই চালাচ্ছেন দোকানটা।

পুরানো একটা বইয়ের পাতা ওল্টাচ্ছেন মিস্টার অ্যাডামস। খুঁজছেন কী যেন। পেয়েও গেলেন সেটা।

‘দি অর্ডার অভ দ্য রাম হচ্ছে… যে কাহিনীটা শোনালে তুমি, গড়ে উঠেছে সেটার উপর ভিত্তি করে। এক ধরনের ধর্মীয় উন্মাদনা এটা। … বিশেষ এক প্রক্রিয়ার ভিতর দিয়ে যেতে হয় এই সঙ্ঘের সভ্যদের। সেটা হচ্ছে—নিজের রক্ত আর নিরীহ-নিষ্পাপ কারও আত্মা শয়তানের কাছে উৎসর্গ করা। সোজা কথায়, কতল করা। এজন্যই নিজের বাপ-মাকে খুন করেছিল মেয়েটা। কারণ, ওদের রক্ত মানে তো ওরই রক্ত। এর পর গেছে তোমাকে হত্যা করতে… এর কারণ, তুমি তখন অন্তঃসত্ত্বা। আর একজন অনাগত সন্তানের চাইতে নিষ্পাপ আর কী হতে পারে?’

ব্যাপারটা চিন্তা করেই গা গুলিয়ে উঠল মেয়েটার।

‘…কিন্তু যেহেতু তুমি বসে আছ আমার সামনে, এর মানে দাঁড়াচ্ছে—কাজটা শেষ করতে পারেনি ওরা…’

‘সেজন্য উৎপাত করে চলেছে এখনও…’ বোঝা হয়ে গেছে তানিয়ার।

ওয়েল… আমরা যদি ভূতে বিশ্বাস করি… ভাবি যে, মরা মানুষ পিছু নিয়েছে আমাদের… সেক্ষেত্রে কিন্তু নির্দিষ্ট একটা গণ্ডির বাইরে যেতে পারে না ওরা। ওদের সমস্ত কর্মকাণ্ড নিজেদের সেই এলাকার মধ্যে। তোমার সমস্যাটা হলো, ওখান থেকে চলে আসার পরও বিচিত্র সব ঘটনা ঘটে চলেছে তোমাকে ঘিরে…’

‘কেমন জানি লাগছে শুনতে… উদ্ভট… অবাস্তব…’

‘লোহিত সাগরের দু’ভাগ হয়ে যাওয়া কিংবা কথা-বলা জ্বলন্ত ঝোপ অথবা যা-ই বলো না কেন—এগুলোর চাইতে উদ্ভট তো আর নয়। অবিশ্বাসীদের কাছে সব কিছুই অবাস্তব মনে হতে পারে। কিন্তু ওদেরকে পাত্তা দেয় কে?’

মাথা ঝাঁকাল তানিয়া।

‘তো, এই কাল্ট আর তাদের অনুষ্ঠানের ব্যাপারে যা যা বললে আমাকে, তাতে মনে হচ্ছে, অমানুষিক কোনও আত্মা রেখে গেছে ওরা মানুষের মাঝে….

‘অমানুষিক আত্মা?’

‘এমন কিছু, রক্তমাংসে যেটার কোনও অস্তিত্ব ছিল না কখনও…’

…অপদেবতা?’

নড করলেন রায়ান। ‘…আর এক মাত্র অপদেবতারাই নির্দিষ্ট কোনও সীমার মধ্যে আবদ্ধ নয়। ওরা সংযুক্ত নির্দিষ্ট কোনও বস্তুর সঙ্গে। ওসবের উপর ভর করে শেষ পর্যন্ত হাসিল করে নেয় নিজেদের উদ্দেশ্য…

‘নিষ্পাপ আত্মা…’ আপন মনে বিড়বিড় করল তানিয়া। তাকিয়ে আছে মেয়েটার দিকে।

‘তোমার জায়গায় আমি হলে,’ উপসংহারে পৌঁছেছেন রায়ান। ‘যে-জিনিস ব্যবহার করে আতঙ্কে রাখছে আমাকে অপদেবতা—যা-ই হোক না কেন সেটা—দূর করতাম ওটাকে আমার জীবন থেকে…’

.

নিজেদের অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিঙের নিচে পৌঁছে গেছে তানিয়া, হাত ফসকে সাইডওয়াকে পড়ে গেল চাবির গোছাটা।

বিল্ডিঙে ঢোকার সিঁড়ির গোড়ায় স্ট্রলারটা ঠেকিয়ে রেখে উবু হলো তানিয়া জিনিসটা তুলে নেয়ার জন্য। দেখতে পেল না, গড়াতে শুরু করেছে ছোট্ট গাড়িটার চাকা; সরে যাচ্ছে ওটা রাস্তার দিকে!

ভয়ঙ্কর গতিতে রাস্তা ধরে ছুটে আসছে একটা সিটি বাস।

যে মুহূর্তে সাইডওয়াক থেকে কার্বে পড়ল আকিরাকে বহনকারী গাড়িটা, ঠিক সেই মুহূর্তে ঘাড় ঘোরাল তানিয়া কাঁধের উপর দিয়ে।

রাস্তার মাঝখানে গড়িয়ে চলে যাচ্ছে স্ট্রলারটা… ধেয়ে আসা বাসটার সামনেই পড়তে চলেছে ওটা!

‘সামনে দেখোহ!!!’ বলে গগনবিদারী এক চিৎকার তানিয়া।

দেরি হয়ে গেছে অনেক!. আক্ষরিক অর্থেই খুদে গাড়িটাকে উড়িয়ে দিল দানব বাসটা! দোকান থেকে কেনা বইগুলো ছিটকে গেল যত্রতত্র!

ভাগ্যিস, বাচ্চাটা ছিল না ওর গাড়িতে!

জড়বৎ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তানিয়া আকিরাকে কোলে জড়িয়ে! বড় বাঁচা বেঁচে গেছে ও! বাচ্চাটা যদি থাকত ওখানে!

টায়ারের কর্কশ শব্দ তুলে থেমে দাঁড়াল বাসটা।

একই সঙ্গে ছিটকে বেরিয়ে এল জ্যাকসন স্কাই হাই থেকে। পুরো ঘটনাটাই দেখতে পেয়েছে ও।

‘হায়, যিশু! ঠিক আছেন তো আপনি?’ চিৎকার করে জানতে চাইল লোকটা।

কোনও রকমে মাথা ঝাঁকাল তানিয়া। আতঙ্কিত দৃষ্টি মেলে দেখল, বাম্পারের সঙ্গে দুমড়ে মুচড়ে আটকে থাকা খেলনা গাড়িটাকে টেনে ছোটানোর চেষ্টা করছে ড্রাইভার। মোটেই দর্শনযোগ্য নেই আর জিনিসটা।

রাস্তায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়া বইগুলো কুড়িয়ে তুলে দিল জ্যাকসন।

‘থ্-থ্যাঙ্ক ইউ!’ বলল তানিয়া কোনও রকমে। কথা বলার মতো অবস্থা নেই ওর।

বইয়ের নামগুলো লক্ষ করেছে বাড়িঅলা। বিচিত্র অভিব্যক্তি লোকটার চেহারায়।

‘বেডটাইম স্টোরি,’ কাষ্ঠ হেসে ব্যাখ্যা দিল তানিয়া।

সতেরো

দরজা খুলে বাসায় ঢুকল তানিয়া। ফ্লোরে বিছানো ব্ল্যাঙ্কেটের উপর বসিয়ে দিল মেয়েটাকে। বুকশেলফে বইগুলো গুঁজে দিয়েই ছুট লাগাল নার্সারির দিকে।

.

সারাটা কামরা তছনছ করে ফেলল তানিয়া। দোলনা সরিয়ে দেখল ওটার তলায়… খুঁজল রকিং চেয়ারটার পিছনে… ক্লজিটটা দেখল আতিপাতি করে…

চিহ্নও নেই অ্যানাবেলের!

কীভাবে জানি উধাও হয়ে গেছে পুতুলটা!

‘কোথায়?’ শাসানির সুরে চিৎকার করল তানিয়া। ‘কই, ‘রে, তুই, পোড়ামুখী?’

.

বুকশেলফের সামনে বসিয়ে দেয়া হয়েছে আকিরাকে। বাচ্চাটার ঠিক উপরের একটা বই হড়কে বেরিয়ে এল সারি থেকে, খসে পড়ল সেটা তাকের কিনারা থেকে।

থ্যাপ!

ইঞ্চির জন্য পড়ল না বইটা শিশুটির মাথার উপর!

বেরিয়ে এল আরেকটি বই।

থ্যাপ!

আরেকটু কাছে পড়েছে এবারেরটা!

এর পর বোধ হয় আর মিস হচ্ছে না। একসাথে অনেকগুলো পিছলে সরে এসেছে এবার কিনারের কাছে! বই নয়, গোটা শেলফটাই পড়তে যাচ্ছে আসলে মেয়েটার উপরে! কাত হয়ে যাচ্ছে দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা বইয়ের আলমারিটা!

‘আকিরাহ!’ অবিশ্বাসে ঠিকরে বেরোতে চাইছে মহিলার চোখ দুটো। ছুটে গিয়ে সোজা করে দিল আবার বুকশেলফটা। ছোঁ মেরে আত্মজাকে মেঝে থেকে তুলে নিয়েই সরে গেল নিরাপদ দূরত্বে। সাইক্লোন বয়ে যাচ্ছে ওর মাথার মধ্যে।

.

অ্যানাবেল নেই। বাকি পুতুলগুলো তাক থেকে ছুঁড়ে ছুঁড়ে মেঝেতে ফেলতে লাগল তানিয়া। একটু পরে সব ক’টার গন্তব্য হলো আবর্জনার ব্যাগ।

বিল্ডিং থেকে বেরিয়ে এসে, ট্র্যাশব্যাগগুলো ছুঁড়ে ফেলল ও গারবেজে।

একটা ঝামেলা বিদায় করে অ্যাপার্টমেন্টে এসে ঢুকল তানিয়া। ক্ষোভ ঝাড়তে ধড়াম করে লাগিয়ে দিল দরজাটা।

শান্তি!

না… তা বোধ হয় কপালে নেই ওর!

মড়মড় আওয়াজ উঠছে ফ্লোরবোর্ডে!

এগোল তানিয়া নার্সারির দিকে। মনে দ্বিধা নেই কোনও। এসপার ওসপার একটা করেই ছাড়বে!

এগিয়ে যাচ্ছে… সঙ্গে সঙ্গে স্পষ্ট হচ্ছে আওয়াজটা… সতর্ক তানিয়া হাত বাড়াল দরজার নবের দিকে। কিন্তু ঘোরানোর আগেই নিজে থেকে খুলে গেল দরজাটা!

পিছিয়ে গিয়েছিল তানিয়া, স্বস্তির শ্বাস ফেলল স্বামীকে দেখে। খালি তাকগুলোর দিকে চাইল জনি পিছন ফিরে।

‘কী হচ্ছে এসব?’

ঠক… ঠক ঠক ঠক!

.

দরজা খুলতেই উষ্ণ হাসলেন ফাদার রোডরিগেজ।

‘যার-পর-নাই সম্মানিত বোধ করছি আপনাকে দেখে,’ বলল জনি আন্তরিক হেসে। ‘আসুন, ফাদার… ভিতরে আসুন।’

ঢুকলেন ভদ্রলোক। ওঁর কোটটা নিয়ে সোফার পিছনে ঝুলিয়ে দিল জনি।

কে এসেছে, দেখার জন্য ড্রইং রুমে এল তানিয়া। রোডরিগেজকে দেখে খুশিও হলো, লজ্জিতও হলো মেয়েটা।

‘দুঃখিত, ফাদার!’ বলল ও কাঁচুমাচু কণ্ঠে। ‘ডিনার তৈরি হতে দেরি হবে একটু। সত্যি বলতে কি, মেয়েটা হওয়ার পর থেকে সেভাবে আর সুযোগই পাচ্ছি না রান্নাবান্নার… অনভ্যাসে জংও ধরে গেছে হাতে… ‘

‘খুদে দেবদূতদের খাতিরে সাত খুন মাফ…’ বললেন ফাদার মজা করে। র‍্যাপিং পেপার মোড়ানো একটা প্যাকেজ তুলে দিলেন, তিনি তানিয়ার হাতে। ‘সামান্য উপহার তোমাদের জন্য।’

ফ্রেমবন্দি একটা ফোটোগ্রাফ বেরোল প্যাকেটটা থেকে। চার্চের আঙিনায় তোলা মা-মেয়ের ছবিটা।

‘ইট’স বিউটিফুল!’ অভিভূত তানিয়া। ‘থ্যাঙ্ক ইউ সো মাচ, ফাদার!’ দরজার পাশের টেবিলে দাঁড় করিয়ে দিল ও ফ্রেমটা।

.

বলল বটে, কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই প্রচুর আয়োজন করে ফেলল তানিয়া। জনিও অবশ্য সাহায্য করল ওকে।

খুব একটা কথা হলো না খাওয়ার টেবিলে।

খানিকটা অস্বস্তিতে ভুগছেন ফাদার রোডরিগেজ। পরিষ্কার বুঝতে পারছেন, কোনও একটা ঘটনার মাঝখানে এসে উপস্থিত হয়েছেন তিনি। ওদের ব্যক্তিগত কোনও ব্যাপার কি?

কাউন্টারে জড়ো করে রাখা অকাল্টের বইগুলোর উপর চোখ পড়ল তাঁর। ব্যাপারটা লক্ষ করল তানিয়া।

‘আপনিই উপদেশ দিয়েছিলেন,’ মুখ খুলল তরুণী। ‘ভয়ের মুখোমুখি দাঁড়াতে। যতই জানব, ততই ভয়ডর বিদায় নেবে জীবন থেকে…

‘মিথ্যে বোলো না, তানিয়া!’ তিরস্কারের সুরে বলল জনি। ‘আফটার অল, উনি একজন যাজক।’ ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘সরি, ফাদার।

শ্রাগ করলেন রোডরিগেজ।

‘মিথ্যে বলছি না আমি,’ প্রতিবাদ করল তানিয়া।

‘বইগুলো কেনার অন্য কারণটাও বলো তা হলে…’

‘এটা কোনও কনফেশন নয়, জনি গ্রেভ…’ শান্ত গলায় বললেও রেগে উঠেছে জনির স্ত্রী।

‘ঠিকই বলেছে ও,’ পরিস্থিতি সামাল দেয়ার প্রয়াস পেলেন ফাদার। ‘বলতে না চাইলে, সে-অধিকার নিশ্চয়ই রয়েছে মিস গ্রেভের।

নীরবে খাবার চিবোনো চলল কিছুক্ষণ।

‘আমার ধারণা, আমাদের উপরে হামলা করেছিল যারা, কোনও এক অপদেবতাকে জাগিয়ে তুলেছে ওরা, যেটা পিছে লেগেছে আকিরার… ওর আত্মা চায় ওটা!’ সরাসরি বলল তানিয়া। ‘বইগুলো জোগাড় করেছি শয়তানটাকে থামানোর কোনও উপায় রয়েছে কি না, জানার জন্য।’

স্যালিসবারি স্টেক চিবোচ্ছিলেন রোডরিগেজ, প্রায় বিষম খাওয়ার জোগাড় হলো ওঁর মেয়েটির বক্তব্য শুনে। আর যা-ই হোক, এগুলো শোনার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না তিনি ওর আরও ধারণা,’ যোগ করল জনি। ‘সংগ্রহের কোনও পুতুলের উপর ভর করেছে এই অপদেবতা। যেহেতু জানা নেই, কোন্ পুতুলটা, সবগুলো পুতুলই ফেলে দিয়েছে ও…’

‘ভর করেছে, বলিনি!’ আপত্তি করল তানিয়া। ‘বলেছি, পুতুলটাকে ব্যবহার করছে ওটা। ভরা করা তো অন্য জিনিস। শুধু ওই সব জিনিসের উপরই ভর করা যায়, যেগুলোর আত্মা আছে। ঠিক না, ফাদার?

ইতস্তত করছেন রোডরিগেজ। ‘আ… তাত্ত্বিকভাবে… ইয়েস।’

‘বুঝলেন, ফাদার,’ বলল তানিয়া ভর্ৎসনার সুরে। ‘বিজ্ঞানের মানুষ তো, বিজ্ঞানের বাইরে তাই কিছুই মানতে চায় না জনি।’

‘এটা কিন্তু ফেয়ার হচ্ছে না,’ অনুযোগ করল যুবক। ‘ঈশ্বরে বিশ্বাস রয়েছে আমার… বিশ্বাস করি বাইবেলের ঐশী বাণীতে…’

আর সেই বাইবেলেই রয়েছে: নিয়ন্ত্রণ করো নিজের মনটাকে। খোলা রাখো চোখকান। তোমার চিরশত্রু শয়তান বিক্ষুব্ধ সিংহের মতো ঘুরঘুর করছে আশপাশে….

‘তক্কে তক্কে রয়েছে তোমাকে গোগ্রাসে গেলার, ‘ বাক্যটা সম্পূর্ণ করে দিলেন প্রৌঢ় ভদ্রলোক।

পূর্ণ মনোযোগে ফাদারের দিকে তাকাল জনি আর তানিয়া।

‘অপদেবতা সম্বন্ধে কী জানেন আপনি, ফাদার?’ প্রশ্ন করল মেয়েটা।

‘সত্যিই বেশি কিছু জানি না আমি এ ব্যাপারে। তবে এটা জানি যে, এসব অপদেবতা সরাসরি নিতে পারে না আত্মা। আত্মাকে মুক্তি দেয়ার জন্য মৃত্যুবরণ করতে হবে আগে আত্মাধারী ব্যক্তিটিকে।’

‘সেক্ষেত্রে…’ একটুও প্রভাবিত হয়নি জনি। ‘খুব শিগগিরই মরার ইচ্ছা নেই আমার। তোমার আছে, তানি?’

চোখ গরম করে ওর দিকে তাকাল তানিয়া।

‘শুনেছি,’ পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার চেষ্টায় বললেন ফাদার। ‘কিছু চার্চ রয়েছে কাছেপিঠে… এসব নিয়ে নাড়াচাড়া করে, এমন সব লোকের সাথে যোগাযোগ রাখে। কোনও এক ডায়েস দম্পতির বেশ নামডাক রয়েছে এ ব্যাপারে। তোমরা চাইলে ওদের খোঁজ লাগাতে পারি আমি…’

‘থ্যাঙ্ক ইউ, ফাদার।’ হাসি ফুটল তানিয়ার মুখে। ‘খুব ভালো হয় তা হলে।’

.

ফাদার রোডরিগেজকে বিদায় দিতে দরজায় এল জনি আর তানিয়া।

‘অশেষ ধন্যবাদ আমাদেরকে সঙ্গ দেয়ার জন্য,’ গভীর কৃতজ্ঞতা ফুটল মেয়েটির কন্ঠে।

ওর একটা হাত তুলে নিলেন ফাদার, চুম্বন করলেন হাতের পিঠে।

‘মাই প্লেজার, মিস গ্রেভ। প্রায়ই ব্যাখ্যাতীত রহস্যের ব্যাখ্যা খোঁজে লোকে ধর্মের মধ্যে। কিন্তু ধর্মের বাইরেও আরও যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা পাওয়া যায় কখনও কখনও। নিজ বাড়িতে ভয়াবহ যে অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গিয়েছ তুমি…. পার করেছ প্রসবের আগে কঠিন একটা সময়… এদিকে নতুন চাকরিতে যোগ দিয়েছে তোমার স্বামী… এরই মধ্যে প্রথম বাবা-মা হলে তোমরা… যে-কারও জন্যই চাপটা সত্যিই অনেক বেশি হয়ে যায়।’

অদ্ভুত দৃষ্টিতে একবার স্বামীর দিকে, একবার ফাদার রোডরিগেজের দিকে চাইল তানিয়া। ‘বলতে চাইছেন, এগুলো সবই আমার কল্পনা?’

নার্সারিতে কেঁদে উঠল আকিরা।

‘এজন্যই ওঁকে আসতে বলেছ তুমি?’ স্বামীর চোখে চেয়ে কৈফিয়ত দাবি করল মেয়েটা। ‘এটাই প্রমাণ করার জন্য যে, আমি একটা পাগল?’

‘তানিয়া… শোনো…’ বিপন্ন অনুভব করছে জনি।

‘আকিরাকে দেখতে যাচ্ছি আমি,’ বলল তানিয়া কাঠ- কাঠ স্বরে। ‘গুড নাইট, ফাদার।’

দু’জনের বোবা দৃষ্টির সামনে ভিতরে অদৃশ্য হয়ে গেল মেয়েটা।

ভদ্রলোকের সঙ্গে আট তলার হলওয়েতে বেরিয়ে এল জনি। অপেক্ষা করছে এলিভেটরের জন্য।

‘খুবই দুঃখিত আমি, আমি,’ অপ্রস্তুত

অপ্রস্তুত কণ্ঠে বললেন রোডরিগেজ। ‘এর বেশি আর সাহায্য করতে পারছি না তোমাদের। কিছু মনে করছ না, আশা করি…

‘কোনও সমাধানই কি নেই এর?’ জানতে চাইল জনি কাতর কণ্ঠে।

একটু চিন্তা করলেন ফাদার। ‘ওই যে বললাম… ডায়েসদের কথা…’

ডিং!

খুলে গেল এলিভেটরের দরজা।

.

ওটা নিচে নামতে শুরু করতেই মাথায় হ্যাট চাপালেন ফাদার। কোটের বোতাম লাগানোর জন্য-

এইয্‌যাহ! ফেলে এসেছেন ওটা গ্রেভদের অ্যাপার্টমেন্টে।

হাত বাড়িয়ে রাটন টিপলেন এলিভেটরের।

সেভেনথ ফ্লোরের উদ্দেশে উপরে উঠছেন, ল্যাচটা খুলে গিয়ে ফাঁক হলো গ্রেভদের দরজাটা—মাত্র এক কি দু’ইঞ্চি।

ডিং!

ঝাঁঝরিটা সরিয়ে বেরিয়ে এলেন ফাদার এলিভেটর থেকে। এগিয়ে চললেন গ্রেভদের দরজার দিকে।

পৌঁছে দেখতে পেলেন, খোলাই রয়েছে দরজাটা। মৃদু টোকা দিলেন তিনি আঙুলের গাঁট দিয়ে।

জবাব নেই কোনও।

কান পাতলেন ভদ্রলোক। আওয়াজ আসছে ভিতর থেকে। বোধ হয় বচসা চলছে জনি আর তানিয়ার মধ্যে। শোবার ঘরের দরজাটা লাগানো বলে বোঝা যাচ্ছে না ভালো। তবে আন্দাজ করাই যায়, কী নিয়ে ঝগড়া করছে ওরা।

কবাটটা ঠেলে ঢুকে পড়লেন তিনি ভিতরে। আওয়াজ যাতে না হয়, সে-ব্যাপারে সতর্ক।

ওই তো জ্যাকেটটা! দলামোচড়া হয়ে পড়ে রয়েছে সোফাটার উপরে।

হাত বাড়িয়ে জ্যাকেটটা তুলে নিতেই ওটার তলা থেকে বেরিয়ে পড়ল পুতুলটা।

অ্যানাবেল।

অ্যানাবেল?! কিন্তু আমরা তো জানি…

পুতুলটাও হাতে নিলেন ফাদার। ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে নিরীখ করলেন জিনিসটা। তার পর আবার রেখে দিলেন ওটা কাউচের এক পাশে।

দাম্পত্য কলহের আওয়াজ এখন জোরাল। বেডরুমের দিকে চেয়ে বুকে ক্রস আঁকলেন ভদ্রলোক। বেরিয়ে গেলেন অ্যাপার্টমেন্ট ছেড়ে।

.

একটু পরে, রাতের পটভূমিতে দাঁড়িয়ে থাকা দালানটার প্রবেশমুখ দিয়ে বেরিয়ে এলেন প্রৌঢ় যাজক। বেরিয়েই গায়ের উপর টেনেটুনে নিলেন জ্যাকেটটা। ভালোই পড়েছে ঠাণ্ডাটা।

থেমে দাঁড়ালেন ফ্রন্ট-স্টেয়ার দিয়ে নামতে নামতে। কেমন এক বিজাতীয় অনুভূতির চক্কর মনের মধ্যে। পিছন ফিরে চাইলেন তিনি দালানটার উঁচুতে।

আরও ভালো করে দেখার জন্য কার্ব ছেড়ে রাস্তার দিকে পিছিয়ে এলেন ফাদার কয়েক কদম। ঘাড় উঁচু করে চোখ রাখলেন আট তলার জানালায়।

নজরে এল না অস্বাভাবিক কিছু।

.

নিজেই গাড়ি চালাচ্ছেন ফাদার। একাকী তিনি গাড়ির মধ্যে। ডজার গেমের ধারাভাষ্য শুনছেন রেডিয়ো চালিয়ে।

হঠাৎ কথা নেই, বার্তা নেই, প্রচণ্ড জোরে খড়খড় করে উঠল রেডিয়ো। কানের পরদা ফাটিয়ে ফেলবে যেন।

আওয়াজ থেকে বাঁচতে অফ করে দিলেন তিনি বেতারযন্ত্রটা। নির্ভেজাল বিরক্তি ঝরে পড়ছে চোখমুখ থেকে। অনুভূতির এ প্রকাশ বিরলই বলা চলে ওঁর মতন ভদ্রলোকের জন্য।

নীরবে গাড়ি চালালেন কিছুক্ষণ। এর পর আরেকটা আওয়াজ কানে ঢুকল ওঁর …..

কির্‌র্‌র্‌র্‌র্‌র্‌র্‌র্‌র্‌র্‌র্‌র্‌র্‌ক!

ব্যাকসিট থেকে আসছে না শব্দটা?

চলার উপরেই ঘাড় ঘোরালেন ফাদার।

শূন্য সিটটা উপহাস করল যেন তাঁকে।

সামনের দিকে মুখ ফেরাতেই মুখোমুখি এক জোড়া হেডলাইটের চোখ ধাঁধানো তীব্র আলো দিন করে দিল যেন রাতটাকে। তারস্বরে বাতাস চিরল সামনের গাড়ির ভেঁপু। প্রলম্বিত, তীক্ষ্ণ আওয়াজ হলো ব্রেক চাপার।

তা-ও শেষ রক্ষা হলো না।

মুখোমুখি সংঘর্ষে গুঁড়িয়ে গেল বাতিগুলো। আক্ষরিক আর ভাবার্থ—দুই অর্থেই অন্ধকার নেমে এল ফাদার রোডরিগেজের পৃথিবীতে।

.

রকিং চেয়ারে দোল খেতে খেতে মেয়েকে বুকের দুধ খাওয়াচ্ছে ওর মা। জনি রয়েছে ওদের বেডরুমে। কার সঙ্গে জানি জরুরি আলাপ সারছে ফোনে।

‘…ঠিক জানা নেই আমার, কদ্দিন বাচ্চাটার দায়িত্ব নিতে হবে আপনাদের… কিন্তু এ মুহূর্তে সাহায্য দরকার তানিয়ার, আর সেটারই ব্যবস্থা করতে যাচ্ছি আমি। দুটো দিনও রাখতে হতে পারে… আবার লাগতে পারে হপ্তা খানেকও… বোঝা যাবে ওদের সাথে আলাপ করার পর। ….হ্যাঁ, আজই যাচ্ছে ও ওখানে। আমার মতে, এটাই ওর আর আকিরার জন্য ভালো হবে সবচেয়ে…

কিন্তু ফোনটা রাখার সঙ্গে সঙ্গেই দোটানায় ভুগতে শুরু করল জনি। যা করতে যাচ্ছে, ঠিক করছে তো?

.

কাউচে বসে গভীর অভিনিবেশের সঙ্গে বইয়ের পাতা ওল্টাচ্ছে তানিয়া। প্রতিটি শব্দ গিলছে ও, প্রতিটি প্যারাগ্রাফ।

উদয় হলো জনি স্ত্রীর পিছনে। সামনে এসে জিজ্ঞেস করল, ‘আর ইউ শিয়োর, আকিরাকে নিয়ে থাকতে পারবে তুমি?’

মুখ তুলল মেয়েটা বই থেকে। ‘কেন, ভয় পাচ্ছ নাকি?’

‘স্রেফ জানতে চাইছি আমি…’

তানিয়ার দৃষ্টি ফিরে গেল বইয়ে। ‘চিন্তা কোরো না। ভালোই থাকব আমরা।’

দীর্ঘশ্বাস গোপন করল না জনি। বেরিয়ে গেল ও চাবিটা নিয়ে। যাওয়ার আগে বলে গেল: ‘তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরব আজ।’

.

দরজা খুলল জ্যাকসন।

আট তলার বাসিন্দা দাঁড়িয়ে আছে ওর সামনে।

‘সব ঠিক আছে তো?’ জিজ্ঞেস করল বাড়িঅলা।

মাথা নাড়ল জনি। ‘আমি আসলে… আপনাকে এসব জিজ্ঞেস করছি বলে ক্লাউন বলে মনে হচ্ছে নিজেকে… কিন্তু… এখন পর্যন্ত আপনি ছাড়া তেমন কাউকেই চিনি না এখানে… আর…’

‘ইজি, ম্যান। আপনার প্রয়োজনটা বলুন!’

‘লম্বা সময় ধরে কাজ করতে হয় আমাকে … অনেক দীর্ঘ একটা সময়। এ সময়টায় বাড়িতে একা থাকে আমার বউটা… জানেন হয়তো আপনি। আসলে… শরীরটা ইদানীং ভালো যাচ্ছে না ওর… যেরকম ওয়েদার চলছে…

‘কী চাইছেন আপনি… মাঝে মধ্যে খোঁজখবর নিই ওনার?’

‘ধারেকাছে যদি থাকেন আরকী…’

‘নিশ্চয়ই। কোনও চিন্তা করবেন না আপনি।’

‘অসংখ্য… অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে।’

.

পড়ছে তানিয়া। মাঝে মাঝে মন্তব্য লিখছে মার্জিনে। ভীষণ সিরিয়াস দেখাচ্ছে ওকে। ফোনটা বেজে ওঠায় থামাতে হলো পড়া।

উঠে ফোন ধরল মেয়েটা।

‘হ্যালো? হ্যাঁ, গত রাতে এসেছিলেন ফাদার রোডরিগেজ। কেন, কী হয়েছে? সব কিছু…’

তার পর দুঃসংবাদটা শুনল তানিয়া। হাত থেকে খসে পড়ে গেল রিসিভার। ঠোঁটের উপর চলে এসেছে হাতটা।

অসুস্থ বোধ করছে মেয়েটা। যে-কোনও মুহূর্তে জ্ঞান হারাবে যেন। কোনও রকমে বলতে পারল শুধু: ‘ওহ, মাই গড! ওহ, মাই গড!!’

.

আবার ফোন তুলে নিয়েছে তানিয়া।

‘…হ্যাঁ, গ্রেভ! প্লিজ, বলবেন ওকে, ফোন করেছিল ওর স্ত্রী! সঙ্গে সঙ্গে যেন কলব্যাক করে! থ্যাঙ্ক ইউ।’

.

প্রথমেই দরজা লক করল তানিয়া। জানালাগুলোও একটা একটা করে বন্ধ করে লক করে দিল। এর পর চেক করে দেখল স্টোভের নবগুলো। প্লাগ খুলে দিল টিভি আর রেকর্ড প্লেয়ারের। সব শেষে জ্বেলে দিল অ্যাপার্টমেন্টের সবগুলো বাতি।

.

মেয়েকে নিয়ে কুঁকড়ে-মুকড়ে বিছানায় শুয়ে আছে তানিয়া, এ সময় থপ করে একটা শব্দ হলো অন্ধকারে।

ঘুমিয়েই পড়েছিল, ধড়মড় করে জেগে গেল মহিলা।

থপ! থপ!

নেমে দাঁড়াল মেয়েটা বিছানা থেকে।

থপ! থপ! থপ!

লিভিং রুম থেকে আসছে শব্দটা।

শোবার ঘরের দরজা খুলল তানিয়া। চকিত পায়ে ও-ঘরে গিয়ে দেখল, বাকি বইগুলোও খসে পড়ছে বুকশেলফ থেকে!

যতটা হওয়ার কথা, তার চাইতেও বেশি জোরাল শোনাচ্ছে থপ-থপ আওয়াজটা।

…তার পর নীরবতা।

কী করে যেন আচমকা চালু হয়ে গেল রেকর্ড প্লেয়ারটা। একটা বিস্ফোরণ ঘটল যেন আওয়াজের। বাজছে ফুল ভলিউমে।

দে লং টু বি…

ক্লোজ টু ইউ…

এবার খুট করে চালু হয়ে গেল টেলিভিশনটা। একের পর এক চ্যানেল বদলে যাচ্ছে আপনা-আপনি।

পিছাতে শুরু করেছিল তানিয়া, কেঁদে উঠল একাকী আকিরা।

ঘুরেই ছুটল মহিলা বেডরুমের দিকে। সাগরের ঢেউয়ের মতো আছড়ে পড়ল বিছানায় মেয়েকে তুলে নেয়ার জন্য। চাদরটা সরিয়েই কেঁপে গেল বুকটা।

নেই মেয়েটা বিছানায়! বদলে অ্যানাবেল শুয়ে আছে ওখানে!

‘আকিরাআহ!’ গলা ফাটাল মহিলা। ‘কোথায় তুমি, মামণি? আকিরাহ! এই যে… আম্মু এখানে!’

সারাটা ঘর খুঁজল তানিয়া।

চিহ্নও নেই মেয়ের!

হলওয়ে ধরে উড়ে গিয়ে পড়ল ও নার্সারিতে …

হোলি শিট!

ফিরে এসেছে সবগুলো পুতুল! সবগুলোই বসে গেছে জায়গামতো, আগে যেটা যেখানে ছিল!

কিন্তু এবারের পুতুলগুলো একটু অন্য রকম। …..একটু নয়, অনেকটাই। কিছু-না-কিছু পরিবর্তন হয়েছে সব ক’টাতেই…

কোনোটার চোখ উধাও!

কোনোটার হাত-পা ছেঁড়া!

কোনোটার চুল ওপড়ানো!

কোনোটার আবার জামাকাপড় ছিন্নভিন্ন!

‘না! না… না… না… না… না…’ হিসটিরিয়ায় আক্রান্ত মানুষের মতো চেঁচিয়ে চলেছে তানিয়া।

অকস্মাৎ… থেমে গেল শিশুটির কান্না। গলা টিপে ধরে থামিয়ে দেয়া হলো যেন!

‘আকিরাআ!’ ছুটে বেরোল তানিয়া নার্সারি থেকে।

.

পাগলের মতো, মরিয়ার মতো সারা বাড়ি খুঁজে চলেছে তানিয়া তন্ন তন্ন করে। ছুটে যাচ্ছে এক কামরা থেকে আরেক কামরায়।

এদিকে টিমটিম করতে করতে নিভে যাচ্ছে বাতিগুলো… এক-একবারে একটা করে। প্রথমে গেল লিভিং রুমেরগুলো… এর পর রান্নাঘরে… তার পর গেল হলওয়েতে…

প্রতি বারই অ্যানাবেলকে দেখতে পেল তানিয়া আলো নেভার আগে!

…কাউচে!

…চেয়ারের উপর!

….ঘরের কোনায়!

‘কী চাও তুমি?!’ খেপে উঠল মেয়েটা। ‘বল, কী চাস তুই!’

বলতে বলতে ফিরে এল ও মেয়ের ঘরে।

জবাব দিয়েছে শয়তানটা!

নার্সারির চারদেয়াল জুড়ে একটাই শব্দ লেখা বার বার লাল ক্রেয়নে:

আত্মা আত্মা আত্মা আত্মা আত্মা…

বড় হাতের অক্ষরে… ছোট হাতের অক্ষরে …

কামরার ঠিক মাঝখানে মেঝেতে পড়ে থাকতে দেখল তানিয়া অ্যানাবেলকে। সঙ্গে সঙ্গে ছুটে গিয়ে পাকড়াও করল ওটাকে। ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলতে লাগল, ‘ফিরিয়ে দে! ফিরিয়ে দে আমার মেয়েকে! রাগের চোটে দোলনার পাশে আছড়াল ও পুতুলটাকে। এক বাড়িতেই চলটা উঠে গেল অ্যানাবেলের চিবুক থেকে।

ছুটে গেল মহিলা জানালার দিকে। উন্মত্ত হাতে খুলতে চেষ্টা করল জানালাটা। আট তলার উপর থেকে ছুঁড়ে ফেলে দেয়ার ইচ্ছা হতচ্ছাড়া পুতুলটাকে…

কিন্তু না… একটুও নড়াতে পারল না জানালা!

‘কোথায়?!’ কাঁদছে তানিয়া হেঁচকি তুলে। ‘কোথায় আমার বাচ্চাটা!?’

উদ্ভ্রান্তের মতো কামরা থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল তানিয়া; কিন্তু যেই না পৌঁছেছে দরজার কাছে, অমনি — দড়াম! আটকা পড়ল মেয়েটা।

লাভ নেই, জানে; তা-ও বার কয়েক টানাটানি করল নব ধরে। পাথরের মতো অনড় হয়ে আছে দরজাটা।

আবার ফিরে গেল ও জানালার কাছে। কাচের গায়ে নাক ঠেকিয়ে দেখতে পেল নিচের রাস্তায় পথচারীদের আনাগোনা।

দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টায় সজোরে বাড়ি মারতে লাগল ও জানালার কাচে।

নিচের লোকগুলোর তো ধারণাই নেই যে, কোন্ নরক নেমে এসেছে উপরে—দুর্ভাগা একটি পরিবারে। তানিয়ারও জানা নেই, পরিচিত একটা মুখ রয়েছে ওদের মধ্যে—যাকে ঠিক পছন্দ করে না ও।

জোশুয়া জ্যাকসন।

কে জানে, কেন, দৃষ্টি আকৃষ্ট হলো লোকটার আট তলার জানালায়। কিছুই শুনতে পাচ্ছে না ও অত নিচ থেকে, কিন্তু দেখতে ঠিকই পেয়েছে মিসেস তানিয়া গ্রেভকে।

.

দেখতে পেয়েছে তানিয়াও।

‘মিস্টার জ্যাকসন!’ তড়পে উঠল মেয়েটা। ‘প্লিজ, হেএল্প!!’

ছুটে বিল্ডিঙের ভিতর ঢুকতে দেখল ও লোকটাকে।

.

অসহ্য অস্থিরতায় এলিভেটরের কল বাটনে হিট করছে জ্যাকসন ঘন ঘন।

ধুর! আসছে না ওটা।

আর তো দেরি করা যায় না! পা বাড়াতে গেল জ্যাকসন সিঁড়িপথের দিকে…

ডিং!

চলে এসেছে এলিভেটর!

তাজ্জব কাণ্ড! কিন্তু এখন ওসব চিন্তা করার ফুরসতই নেই জ্যাকসনের। ঝাঁপিয়ে পড়ল ও খোলা দরজা দিয়ে।

.

অনর্গল দরজা পেটাচ্ছে মেয়েটা। রকিং চেয়ারটা কোনও রকমে তুলে ধরে ভাঙল ওটাকে বন্ধ কবাটের গায়ে আছড়ে। ভাঙল বটে, তবে কাজের কাজও হলো একটা। দরজার গা থেকে ছুটে এল নব, খুলে গেল কবাট।

বুকের ধনের নাম ধরে চিৎকার করতে করতে ছুটল তানিয়া বসার ঘরে। নাহ… নাম-নিশানাই নেই কোনও ছোট্ট মেয়েটার।

উপায়ান্তর না দেখে ফ্রন্ট-ডোরে চলে গেল ও। গিয়ে দেখল, এ-দরজাটাও বন্ধ হয়ে আছে অশুভ শক্তির ইঙ্গিতে।

পিপ-হোলে চোখ রাখল তানিয়া। দেখতে পাচ্ছে এলিভেটরের ফ্রেমের উপরে ফ্লোর-নাম্বারের ক্রমাগত পরিবর্তন। উঠছে ওটা… পাঁচ… ছয়… সাত…

ডিং!

ঝাঁঝরির ওপাশ থেকে গ্রেভদের অ্যাপার্টমেন্টের দরজা দেখতে পাচ্ছে জ্যাকসন। মহিলার চিৎকারও শুনতে পাচ্ছে আবছাভাবে।

‘তাড়াতাড়ি আসুন, প্লিজ! ওটা নিয়ে গেছে আমার সোনামানিককে!’

ঝাঁঝরি টানল জ্যাকসন। এ কী! এক চুলও নড়ানো যাচ্ছে না ওটা!

বার বার টানাটানি করেও ফল হলো না কোনও! শরীরের পুরো শক্তি খাটাল, তা-ও নয়! নড়বে না বলে পণ করেছে যেন তারের জালটা।

‘পারছি না…’ বলার ভঙ্গিতে প্রকট

বলার ভঙ্গিতে প্রকট হয়ে উঠল জ্যাকসনের অসহায়ত্ব। ‘খুলছে না ঝাঁঝরিটা…’

বলা মাত্রই দেরি নয়, ঝাঁকুনি দিয়ে সচল হয়ে উঠল এলিভেটর! রওনা দিচ্ছে উপরে!

‘নাআহ!’ হাহাকার করে উঠল মেয়েটা। দেখতে পাচ্ছে, আবারও ফ্লোর-নাম্বার বদলে যাচ্ছে ফ্রেমের উপরে।

ভিতরে খটখটখটখট করে ডাউন বাটন টিপে চলেছে বাড়িঅলা।

‘শিট… কী হচ্ছে এসব!’ কাজ করছে না একটা বাটনও! একেবারে টপ ফ্লোরে পৌঁছে তবেই থামল ওটা প্রচণ্ড এক ঝাঁকুনি দিয়ে। আটকে রইল ওখানেই।

কির্‌র্‌র্‌র্‌র্‌র্‌র্‌র্‌র্‌ক!

ঘুরল জ্যাকসন—কীসের আওয়াজ, পরীক্ষা করে দেখার জন্য। তাকাল নিচে, কোনার দিকে।

‘যিজাস!’ বেরিয়ে এল গলা দিয়ে।

অ্যানাবেলের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে জ্যাকসন, একই সঙ্গে লম্বা হচ্ছে ওর তর্জনিটা, এগিয়ে যাচ্ছে ডাউন বাটনের দিকে।

‘কাম অন… প্লিজ….

লোকটার আঙুল খুঁজে নিল বাটনটা… চাপ দিল জোরের সঙ্গে…

কিছুই ঘটল না এক মুহূর্ত। সেটাই বরং ভালো ছিল। কারণ, পরমুহূর্তে তার ছিঁড়ে খসে পড়ল লোহার বাক্সটা! দশ তলার উপর থেকে সোজা রওনা দিয়েছে নিচের দিকে!

অসহায়, বন্দি জ্যাকসন গলা ফাটাতে লাগল অবর্ণনীয় আতঙ্কে।

.

ঝাপসা একটা পতন প্রত্যক্ষ করল তানিয়া.. এলিভেটরের শ্যাফটে। কেয়ামত নাজিল হলো যেন মুহূর্ত পরে। প্রলয়ঙ্কর একটা আওয়াজ কাঁপিয়ে দিল দালানের ভিত পর্যন্ত।

.

জোশুয়া জ্যাকসন আর এ জগতে নেই। একখানা রিইনফোর্সিং বার এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিয়েছে লোকটাকে ধ্বংস হয়ে যাওয়া এলিভেটরের ভিতরে। যেন মহাপতনটা যথেষ্ট ছিল না ওর মৃত্যুর জন্য!

.

দাঁড়ানো অবস্থা থেকে ধসে পড়ল তানিয়াও। সব আশা- ভরসা শেষ হয়ে গেছে ওর।

.

কাজ থেকে বাসায় ফিরছে জনি গ্রেভ। রাস্তার শেষ বাঁকটা ঘুরল ও নিজেদের অ্যাপার্টমেন্ট দালানের উদ্দেশে। থমকে দাঁড়াল সামনে জটলা দেখে।

বিল্ডিঙের বাসিন্দারা সবাই মনে হয় বেরিয়ে এসেছে রাস্তায়। স্থানীয় পুলিসের সঙ্গে কথা বলতে দেখা যাচ্ছে কয়েক জনকে।

‘তানি…’ অস্ফুটে বেরিয়ে এল জনির মুখ দিয়ে। আফ্রিকান ড্রাম বাজছে বুকের মধ্যে।

.

ফোঁপাচ্ছে তানিয়া।

‘…যে-কোনও শর্তেই রাজি আছি আমি… দয়া করো… খালি ফিরিয়ে দাও আমার বুকের মানিককে…’

গভীর একটা গুরুগুরু আওয়াজ হলো।

ঝুলন্ত ছবিগুলো কাঁপতে কাঁপতে খসে পড়তে লাগল দেয়াল থেকে। ফার্নিচারগুলো পিছলে সরে যাচ্ছে কামরার এদিক-সেদিক। ভূমিকম্প হচ্ছে যেন।

দু’হাতে কান ঢাকল তানিয়া। তক্ষুনি কী যেন ভাঙল পড়ে ওর পায়ের কাছে।

আতঙ্কিত, বোবা দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখল তানিয়া। ফাদার রোডরিগেজের দেয়া ফোটোগ্রাফ ওটা।

ত্রস্ত হাতে মেঝে থেকে তুলে নিল ওটা আকিরার আম্মু। বুঝে ফেলেছে, পিশাচ-দেবতা কী বার্তা দিতে চাইছে ওকে।

‘নিষ্পাপ কারও আত্মা চাও তো তুমি?’ সঙ্কল্প ফুটল তানিয়ার গলায়। ‘সৃষ্টিজগতের যে-কোনও প্রাণীর চাইতে স্রষ্টার সবচাইতে কাছের, সবচেয়ে প্রিয় হচ্ছে মায়েরা…’

.

জটলাটার কাছে পৌছে গেছে জনি। সকলেই ফুটছে উত্তেজনায়।

‘কেউ কি বলবেন একটু, কী হয়েছে?’ জিজ্ঞেস করল ও একজনকে। ‘কেউ কি দেখেছেন আমার মিসেসকে?’

‘ভয়ঙ্কর একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে, ভাই!’ বলল লোকটা চোখ কপালে তুলে। ‘এলিভেটরটা—’

আর শোনার জন্য দাঁড়াল না জনি। ফ্রন্ট-স্টেপের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে পায়ে যেন পাখা গজাল ওর।

লবিতে উঠেই দেখতে পেল অফিসার আর প্যারামেডিকদের। ঠেলাঠেলি করছে ভগ্নস্তূপে পরিণত হওয়া এলিভেটরটার সামনে। কে যে কাকে কী বলছে, বোঝা বড় দায়। তা-ও ওভারহিয়ার করল এক অফিসারের বক্তব্য:

‘…মালিকের নাতি নাকি লোকটা… এই মাত্র শনাক্ত করা হয়েছে ডেডবডিটা…’

.

দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে তানিয়া। ওকে ঘিরে ঘটে চলা বিশৃঙ্খলার প্রচণ্ড ঘূর্ণিপাক ছাপিয়ে চিৎকার করে উঠল:

‘…আমার আত্মা নাও তুমি আকিরার বদলে!’

এই একটা কথায় কাজ হলো যেন ম্যাজিকের মতো। নিমেষেই বন্ধ হয়ে গেল নরক গুলজার। সমস্ত কোলাহল এক লহমায় থেমে গিয়ে নেমে এসেছে পিন-পতন নৈঃশব্দ।

তার পর…

শোনা গেল একটা আওয়াজ… মিহি সুরে শিস দিচ্ছে হাওয়া… আহ্বান করছে যেন নার্সারি থেকে!

পায়ে পায়ে এগিয়ে চলল তানিয়া।

.

এক এক বারে দুটো করে সিঁড়ি ভাঙছে জনি। ক্ষণে ক্ষণে ডাকছে স্ত্রীর নাম ধরে।

.

কীভাবে যেন খুলে গেছে নার্সারির জানালাটা! জানালার তাকের উপর বসে রয়েছে অ্যানাবেল!

পরিষ্কার বুঝতে পারল তানিয়া, ঠিক কী চাইছে অপশক্তিটা।

খোলা জানালার দিকে দু’কদম এগোতেই দোলনায় দেখতে পেল ও মেয়েকে! ফিরে এসেছে আকিরা! ফেরত দিয়েছে ওকে অন্ধকারের দেবতা!

বাচ্চাটার কাছে এসে দাঁড়াল জননী। ঝুঁকে চুমু খেল কপালে। অশ্রুর ঢল নেমেছে তানিয়ার দুচোখ থেকে। ফিসফিস করে উচ্চারণ করল, ‘সব কিছুর চাইতে ভালোবাসি আমি তোমাকে… তা-ও যেতে হচ্ছে, মা! তোমার জন্য… তোমারই জন্য করছি আমি কাজটা…’

ঋজু ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে গেল মহিলা। অটল রয়েছে সিদ্ধান্তে। পা বাড়াল আবার খোলা জানালাটার দিকে। কাছে পৌঁছে তাক থেকে তুলে নিল পুতুলটাকে।

.

ঘন ঘন, রোষায়িত শ্বাস ফেলতে ফেলতে পৌছাল জনি আট তলার হলওয়েতে।

বন্ধ ওদের দরজাটা।

‘দরজা খোলো! দরজা খোলো, তানি!’ এক হাতে দরজায় থাবা দিতে দিতে অন্য হাতে পাগলের মতো পকেট হাতড়াতে লাগল যুবক। গেল কোথায় চাবিটা?

.

জানালার তাকে উঠে পড়েছে তানিয়া। শেষ বারের মতো চাইল ও শিশুর মতো কোলে নেয়া অ্যানাবেলের দিকে। হাসছে স্নেহের হাসি। যেন বলতে চাইছে: চল, বাবু, উড়াল দিই বাতাসে!

.

পাওয়া গেছে চাবিটা। খোলা গেছে দরজা।

‘তানি! …কোথায় তুমি?!’ ভিতরে পা রেখেই বাড়ি মাথায় তুলল জনি।

ওর কথা শুনতে পাচ্ছে না তানিয়া। ঝোড়ো বাতাস দু’কান ভরে রেখেছে ওর। বাতাসে উড়ছে নিজের ও ঘরের কাপড়চোপড়গুলো।

নিচের দিকে চাইল মেয়েটা, রাস্তাটার দিকে

জটলার লোকেরা দেখতে পেয়েছে ওকে।

‘নাআআআ! লাফ দেবেন না!’ আকুল আবেদনের ভঙ্গিতে চিৎকার ছাড়ল কৃষ্ণাঙ্গ একটা ছেলে।

‘…কিন্তু আমাকে যে করতেই হবে কাজটা!’ নিজেকে বলল তানিয়া। ‘নিজের জন্য নয়, আমার আকিরা মামণিটার জন্য!’

.

নার্সারির দরজাটার সঙ্গে কুস্তি করছে জনি।

‘তানিহ! ভিতরে আছ তুমি?’

কাঁধের এক ধাক্কায় দড়াম করে খুলে গেল দরজাটা।

.

এক পা আগে বাড়ল তানিয়া বাইরের দিকে। শেষ বারের মতো ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল ও দোলনাটার দিকে। বুকটা ভেঙে যাচ্ছে এভাবে মেয়েটাকে ছেড়ে যেতে… কিন্তু…

‘আসি, মা, কেমন?’

শূন্যে পা রাখল তানিয়া — ঠিক যখন দরজা ভেঙে ভিতরে ঢুকল জনি।

চোখের সামনে স্ত্রীকে জানালা থেকে পড়ে যেতে দেখল যুবক। কিচ্ছু করতে পারল না ও… কিচ্ছু না!

‘তানিয়াআআআআআহ!’

ঝোড়ো বাতাস উড়িয়ে নিয়ে গেল বুক চেরা সে- হাহাকার।

পরিশিষ্ট

সস্তা জিনিস বিক্রি হয় দোকানটায়। টুকিটাকি অনেক কিছুই সাজানো রয়েছে তাকগুলোয়। দরকারি প্রায় সব কিছুই পাবেন আপনি এখানে। কম দামে অবশ্যই।

সকালবেলা।

ঝুনঝুন করে বেজে উঠল দরজার উপরের ঘণ্টিটা। চল্লিশোর্ধ এক মহিলা দরজা ঠেলে প্রবেশ করল দোকানে, টগবগ করছে আগ্রহে।

রেজিস্টারে বসা ক্লার্ক জিজ্ঞেস করল তাকে, ‘বলুন, ম্যাডাম, কী সাহায্য করতে পারি আপনাকে!

হাসল মহিলা। চোখ বোলাচ্ছে তাকগুলোতে।

‘ওহ… থ্যাঙ্কস। মেয়েকে দেয়ার জন্য ভালো একটা উপহার খুঁজছি আসলে…’

‘কী করে আপনার মেয়ে?’

‘ওহ… নার্স ও… মানুষের সেবায় নিয়োজিত যাকে বলে।’ উপরের একটা তাকে চোখ আটকে গেল মহিলার। ধীরে ধীরে চওড়া হলো হাসিটা। এরকম একটা জিনিসই তো চাইছিল ও এক্কেবারে ছেলেমানুষ ওর মেয়েটার জন্য। কপাল ভালো, পেয়ে গেল একবারেই।

‘দেখি তো ওই পুতুলটা!’ দেখাল মহিলা আঙুল দিয়ে।

বড় হয়ে গেলেও এখনও পুতুল নিয়ে খেলতে ভালোবাসে মেয়েটা।

***

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *