অদেখা ভুবন – ১.১০

দশ

কথামতো পরদিন গোলাঘর থেকে গাড়িটা বের করল অ্যালবার্ট কুপার।

বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে দুটো সপ্তাহ স্বামীকে ছাড়া থাকার জন্য মনটাকে প্রস্তুত করছে রোজমেরি। কেন জানি গভীর দুশ্চিন্তার ভাঁজ ওর কপালে।

চলে গেল গাড়িটা।

গায়ে সোয়েটার থাকা সত্ত্বেও শীত লাগছে রোজমেরির।

.

রাত।

বিছানায় হোমওয়ার্ক করতে করতে গান শুনছে সিলভিয়া।

ফাঁক হলো কামরার দরজাটা। একটা মাথা উঁকি দিল দরজার ফাঁক দিয়ে।

‘কেমন চলছে মামণির বাড়ির কাজ?’ মেয়ের পড়াশোনার খোঁজ নিতে এসেছে রোজমেরি।

‘চলছে, আম্মু,’ দায়সারাভাবে জবাব দিল সিলভিয়া

তোমার বোন আর আমি শুতে যাচ্ছি।’

‘যাও। আমিও শুচ্ছি একটু পর।’

.

ব্যস, শেষ।

হোমওয়ার্কের খাতাটা বন্ধ করে উবু অবস্থা থেকে সিধে হলো মেয়েটা। এবং চমকে গেল।

দুম! দুম! দুম!

আওয়াজ হচ্ছে দরজায়।

দুম! দুম! দুম!

তেমন জোরাল নয় আওয়াজটা। ছোট হাতের মুঠি দিয়ে কেউ যেন আঘাত করছে দরজার ওপাশে।

‘সিনথিয়া?’ মৃদু স্বরে জবাব চাইল সিলভিয়া।

পেল না জবাব। ‘মা নাকি?’

তা-ও কোনও জবাব নেই।

দরজাটার দিকে দৃষ্টি রেখে পিছলে নামল সিলভিয়া বিছানা থেকে। দুম-দুম আওয়াজটার মধ্যেই এগিয়ে চলল ও দরজার দিকে। কিন্তু কাছাকাছি পৌঁছানোর আগেই থামতে হলো থমকে।

কীসের জানি ছায়া এসে উদয় হয়েছে দরজা আর মেঝের মাঝখানের চিলতে ফাঁকটায়।

গভীর দম নিয়ে সাহস সঞ্চয় করল মেয়েটা। পেরোনো স্থির করল বাকিটা দূরত্ব।

এক কদম আগে থাকতেই মন্ত্রবলে থেমে গেল যেন রহস্যময় আওয়াজটা।

নিঃশব্দে অপেক্ষা করছে সিলভিয়া। সম্পূর্ণ সজাগ ওর কান দুটো।

কিন্তু কোথাও কোনও আওয়াজ নেই।

এবং তার পরই…

আস্তে করে খুলে গেল দরজাটা।

আপনা-আপনি!

কেউ নেই দরজায়!

সতর্কতার তাগিদে এক কদম পিছু হটল সিলভিয়া। আর ইচ্ছে করছে না আগে বাড়তে। তা-ও নিজের মনের সঙ্গে যুদ্ধ করে পায়ে পায়ে এসে দাঁড়াল দোরগোড়ায়। বকের মতো গলা বাড়িয়ে দেখে নিল হলওয়ের এপাশ-ওপাশ।

ফাঁকা!

এবারে খেয়াল করল, ইঞ্চি কয়েক ফাঁক হয়ে আছে মায়ের ঘরের দরজাটা।

দু’কদম আগে বেড়েও হলওয়েতে থেমে দাঁড়াতে হলো আবার সিলভিয়াকে। বাজে একটা গন্ধ এসে ঢোকায় কুঁচকে ফেলেছে নাকটা।

আসছে কোত্থেকে গন্ধটা?

ফের চলতে আরম্ভ করল মায়ের ঘরের দিকে।

ভেজানো দরজাটার কাছে পৌঁছে পা রাখতে যাচ্ছে ভিতরে, মাঝপথেই জমে গেল পা-টা। তীব্র আতঙ্ক ভর করেছে চেহারায়।

বিছানাটার পাশে দাঁড়ানো জিনিসটা কি মানুষ, না পেতনি?

শণের মতো উষ্কখুষ্ক চুলগুলো কালো কুচকুচে। মুখের রং দৃষ্টিকটুভাবে সাদা। রং মেখেছে যেন। বিদঘুটে ভঙ্গিতে সামনের দিকে ঝুঁকে রয়েছে দীর্ঘ শরীরটা, ঘুমন্ত সিনথিয়া আর রোজমেরির উপরে। মহিলার (!) উপস্থিতি সম্বন্ধে স্বভাবতই টের পায়নি কিছু সিলভিয়ার আম্মু আর ছোট বোনটা।

লম্বা ঘাড়টা ধীরে ধীরে ঘুরে গেল সিলভিয়ার দিকে। মণিবিহীন তুষারধবল দৃষ্টিতে পলকহীন তাকিয়ে রয়েছে প্রেতনারী।

আচমকা বিদ্যুৎ খেলে গেল ওটার শরীরে। ঝাপসা একটা ঢেউয়ের মতো ছুটে এল জিনিসটা সিলভিয়ার দিকে। সোজা ভেদ করে গেল ভয়ে কাঠ হয়ে যাওয়া মেয়েটির শরীর!

পাঁই করে ঘুরে গেল সিলভিয়া।

অদৃশ্য হয়ে গেছে ভয়ঙ্কর ওই রহস্যময়ী!

মুর্দার ঘুম ভাঙানো বিকট চিৎকার দিল মেয়েটা।

এগারো

মন ভালো করে দেয়ার মতো সুন্দর একটা দিন।

চোখা চুড়োঅলা সাদাসিধে ধরনের বাড়িটার সামনের সবুজ লনে নেমে এলেন বছর পঞ্চাশের ফাদার ম্যাকমবার। হ্যারিসভিলের এক মাত্র ক্যাথলিক গির্জা সাদা রং করা এই দালানবাড়িটা।

জমিনের এক ধারে পোঁতা খুঁটিটার মাথায় আটকানো কাচঘেরা, ছোট এক লেটারবক্সের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন ভদ্রলোক চিঠিপত্রগুলো বের করে নেবেন বলে। বাক্সটার গায়ে লেখা: চার্চ হচ্ছে ঈশ্বরের উপহার। ঈশ্বরকে ভালোবাসুন।

‘এক্সকিউজ মি!’

সামনে থেকে আসা অনুরোধটা থামিয়ে দিল ফাদারকে। প্রশ্নবোধক দৃষ্টি ওঁর সহজেই খুঁজে নিল আগুয়ান মহিলাটিকে।

প্রৌঢ় স্কচম্যানের কাছে এসে থেমে দাঁড়াল রোজমেরি কুপার। ‘ফাদার ম্যাকমবার?’

.

চার্চ-প্রাঙ্গণে, বড় এক উইলো গাছের ছায়ায় পাতা টেবিলে বসেছেন ডজসন ম্যাকমবার আর রোজমেরি কুপার।

অবস্থা শুনে তো মনে হচ্ছে, দোয়াদরুদে ফায়দা হবে না তেমন,’ মন্তব্য করলেন ফাদার। ‘অনেক দূর গড়িয়ে গেছে ঘটনা। …দাঁড়ান, একটা ফোন করছি বিশপকে। দেখা যাক… এসব ব্যাপারে যথেষ্ট অভিজ্ঞতা রয়েছে, এমন কারও খোঁজ দিতে পারেন কি না উনি। তেমন কাউকে পাওয়া গেলে সাহায্য হবে হয়তো আপনাদের।’

এতক্ষণে স্বস্তির শ্বাস নিতে পারল রোজমেরি। ‘অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে, ফাদার।’

বারো

এক হপ্তা পর।

ফোন বাজছে ক্রিং ক্রিং আওয়াজে।

‘…হ্যালো?’ বলল টনি ডায়েস রিসিভারটা কানে ঠেকিয়ে।

‘মিস্টার টনি ডায়েস বলছেন?’ পরিচিত একটা গলা শোনা গেল অপর প্রান্তে। ‘ফাদার ফ্রিম্যান দেখা করতে চাইছেন আপনার সাথে।’

.

বাড়ির ব্যাক-ইয়ার্ডে পাতা গোল টেবিলটায় এক কাপ কফি নিয়ে বসেছে তাহিতি।

চমৎকার রোদেলা দিন।

স্ত্রীর উল্টো দিকে বসেছে টনি।

ছোট্ট এমিলিকে দেখতে পাচ্ছে ওরা অনতিদূরে। খোঁয়াড়ের মুরগিগুলোকে খাবার দেয়ায় ব্যস্ত।

‘আমি আশা করেছিলাম,’ মলিন কণ্ঠে বলল তাহিতি। ‘কথা বলে নেবে তুমি আমার সাথে…

‘সরি, তাহিতি,’ আন্তরিক দুঃখপ্রকাশ করল টনি ‘আমার মনে হয়নি যে, বিরাট কিছু এটা। স্রেফ একটা পারিবারিক সমস্যা। শুনে মনে হয়েছে, সত্যিই সাহায্য দরকার পরিবারটার।’

মুখ ঘুরিয়ে মেয়েকে দেখতে লাগল তাহিতি। ‘মেইন-এ ছিলাম আমরা গত হপ্তায়। তার আগের হপ্তায় নিউ ইয়র্কে …. স্ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে টনি। ভালো করেই চেনে ও তাহিতিকে।

‘কাম’ন, বেবি,’ না বলে পারল না সেজন্য। ‘হয়েছে কী তোমার, বলো তো!’

মুহূর্তকাল নীরব রইল তাহিতি। তার পর মুখ খুলল।

স্রেফ নিশ্চিত নই আমি, কত দিন আর এসব করে যেতে হবে আমাদের। আদতে এসব চাই কি না আমি, সেটাও সত্যি জানা নেই আমার। কিন্তু এটুকু অন্তত বলতে পারি যে, বিশ্রাম চাই আমি… অবসর চাই একটুখানি। এখন আমার সময় কাটানো দরকার মেয়েটার সাথে। অথচ একটার পর একটা কেস আসছে তো আসছেই!’

কেমন একটা বিস্ময়ের অভিব্যক্তি ফুটে উঠল টনির চোখেমুখে।

‘খুব দ্রুত বড় হয়ে উঠছে এমিলিটা,’ বলে চলেছে তাহিতি। ‘এদিকে আমরা বাইরে বাইরেই কাটিয়ে দিচ্ছি বেশির ভাগটা সময়। অথচ ও যখন ছোট ছিল আরও, পরিস্থিতিটা কিন্তু এরকম ছিল না।’

নীরবতায় পেরিয়ে গেল ক’টি মুহূর্ত। স্থবির বসে আছে স্বামী-স্ত্রী।

‘কথা দিচ্ছি তোমাকে,’ শেষ পর্যন্ত মুখ খুলল টনি। ‘এই কেসটা সলভ করি আগে, কেমন? লম্বা এক ব্রেক নেব এর পর। চুটিয়ে উপভোগ করব ছুটিটা। কী বলো, ঠিক আছে?’

‘ঠিক আছে, টনি,’ ক্লান্ত স্বরে বলল তাহিতি।

তেরো

রাতের আঁধার ভেদ করে ছুটে চলেছে প্লিমাথটা। দুই লেন চওড়া গ্রাম্য রাস্তাটা কাঁচা আগাগোড়া। লোকজন নেই এত রাতে।

গাড়ির ভিতরে পাশাপাশি বসে রয়েছে স্বামী-স্ত্রী। কথা নেই কারও মুখে।

কন্যা এমিলির ছোট্ট এক ফ্রেমবন্দি ছবি ঝুলছে রিয়ার- ভিউ মিরর থেকে। বাতাস আর চলন্ত গাড়ির দোলায় দুলছে ওটা, পাক খাচ্ছে অনবরত।

কোনও শৌখিন বন্দুকবাজের গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া ছোট এক রোডসাইনের উপর আলো পড়ল হেডলাইটের। সামনের বাঁকটার কাছেই খাড়া করা হয়েছে ওটা। ফুটো ফুটো হয়ে গেলেও পড়া যাচ্ছে দিব্যি।

কলিনস ট্যাফট রোড

মোড় নিল টনি। একটু পরেই কাঁকর বিছানো এক রাস্তায় গিয়ে পড়ল প্লিমাথটা। গাছপালার ভিতর দিয়ে একটা মেইলবক্সের দিকে বাঁক নিয়েছে রাস্তাটা।

মোড়টা ঘুরে এক বাড়ির ড্রাইভওয়েতে উঠে এল গাড়িটা।

যদিও অন্ধকার নেমে এসেছে পুরোপুরি, আকাশটাও মেঘাচ্ছন্ন; তার পরও মেঘের ফাঁকফোকর দিয়ে চুইয়ে পড়া ভুতুড়ে জ্যোৎস্নায় মোটামুটি পরিষ্কারই দেখা যাচ্ছে ফার্মহাউসটা।

কুপারদের বাড়ি ওটা। আলো, জ্বলছে অনেকগুলো জানালায়। অন্ধকারের পটভূমিতে খুবই উজ্জ্বল দেখাচ্ছে আলোগুলোকে।

কুপারদের স্টেশন ওয়াগেনটা পার্ক করা রয়েছে খামারবাড়ির সামনে।

গাড়িপথটা পেরিয়ে এসে বন্ধ হলো প্লিমাথের ইঞ্জিন। নামল যাত্রীরা গাড়ি থেকে।

প্রথমেই গাড়ির ট্রাঙ্কের কাছে চলে গেল টনি। ডালা তুলল ওটার।

সঙ্গে সঙ্গে শীতল হয়ে গেল তাহিতির সারা শরীর। দাঁড়িয়ে পড়েছে মহিলা। স্মিত হাসিটা গায়েব হয়েছে মুখ থেকে।

পায়ে যেন শিকড় গজিয়ে গেছে, মনে হচ্ছে ওঁর। সময় নিয়ে জরিপ করল আশপাশটা… সামনের দালানবাড়িটা… পিছনের বনজঙ্গল… পাশের গোলাঘরটা আর… নজরে পড়ল যা-কিছু। নিশ্চিতভাবেই কিছু একটা মনোযোগ কেড়ে নিয়েছে ওর। কেবল বুঝতে পারছে না, কী সেটা।

ট্রাঙ্কের ভিতরকার একটা বাক্স খুলে হ্যাণ্ড-হেল্ড টেপ রেকর্ডার আর নোটপ্যাডটা বের করে আনল টনি। তার পর নামিয়ে দিল ডালাটা, বাক্স আর ট্রাঙ্ক—দুটোরই। মিলিত হলো তাহিতির সঙ্গে।

ডান হাতটা স্বামীর চোখের সামনে তুলে ধরল মহিলা। চাঁদের আলোয় দেখতে পেল টনি, গায়ের রোম দাঁড়িয়ে গেছে বউয়ের।

‘মনে হচ্ছে, ঠিক জায়গাতেই হাজির হয়েছি আমরা!’ সমঝদারের মন্তব্য টনির।

ওয়াকওয়ে ধরে এগিয়ে চলল দু’জনে। ছোট একটা বাঁক মাত্র ঘুরেছে, ক’টা হার্টবিট মিস করল তাহিতি।

‘হুশ্‌শ্‌শ্‌!’ বেরিয়ে এল মুখ দিয়ে।

ওদেরকে লক্ষ করেই লাফ দিয়েছে কালো এক ল্যাব্রাডর। শেকলে আটকানো বলে নাগাল পায়নি অল্পের জন্য।

নরকের প্রহরীর মতো দাঁত খিঁচাচ্ছে কুকুরটা। গলার ভিতর থেকে বেরিয়ে আসছে জোরাল গরগরানি। খটাস করে বন্ধ হলো চোয়াল জোড়া।

স্প্রিঙের মতো টান টান হয়ে আছে কুকুরটা। শেকল ছিঁড়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে যেন। তবে সে-আশঙ্কা নেই বললেই চলে। ঘাসজমিন ফুঁড়ে বেরিয়ে আসা ধাতব পোস্টের সঙ্গে আটকানো রয়েছে শেকলটা।

কী হলো, কে জানে, হঠাৎ করেই রণে ভঙ্গ দিল কুকুরটা। হয়তো বুঝতে পেরেছে, এ-বাড়ির জন্য ক্ষতিকর নয় আগন্তুক দু’জন।

অবাক টনি তাকিয়ে আছে তাহিতির দিকে। ‘অ্যাই, তাহিতি… ঠিক আছ তো তুমি?’

‘আম্‌… হ্যাঁ!’ ঢোক গিলল মহিলা।

কুকুরটার সঙ্গে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে, এসে উপস্থিত হলো ওরা সদর দরজার সামনে। টোকা দেয়ার আগেই খুলে গেল দরজাটা।

আগন্তুকদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে রোজমেরি।

‘মিস কুপার?’ অনুমান করল তাহিতি।

‘জি, আমি। বাড়ি খুঁজে পেতে কষ্ট হয়নি তো?’

‘না-না,’ জবাব দিল টনি। ‘কোনোই সমস্যা হয়নি।’

এ পর্যায়ে মেয়েরা এসে যোগ দিল ওদের মায়ের সঙ্গে। উদ্বেগ আর আতঙ্কে এতটুকু হয়ে আছে মুখগুলো।

‘আমার দুই মেয়ে,’ পরিচয় করিয়ে দিল রোজমেরি। ‘সিলভিয়া আর সিনথিয়া।’

‘হাই,’ দুই বোনই বলল একযোগে।

‘ভিতরে আসুন, প্লিজ।’ ঢোকার জন্য জায়গা করে দিল রোজমেরি কুপার।

.

মা আর দুই মেয়ের সঙ্গে ফয়ারে দাঁড়িয়ে আছে স্বামী-স্ত্রী। উদ্ভূত সমস্যাগুলো সম্বন্ধে বলছে ওদেরকে তিনজনে মিলে।

‘…রাতকে রাত খারাপই হচ্ছে কেবল পরিস্থিতি!’ কাতর চেহারায় জানাল রোজমেরি। ‘গত ক’রাত তো ঘুমাতেই পারিনি এক বিন্দু।’

‘হুম…’ মাথা দোলাল টনি। ‘এই যে ভূতপ্রেতগুলো… এগুলো যখন দেখা দিচ্ছে, তখন কি কোনও গন্ধ-টন্ধ পাচ্ছেন আপনারা? একটু চিন্তা করে বলুন তো!’

‘হুম, পেয়েছি,’ জবাব দিল সিলভিয়া। ‘আমি যেটাকে দেখেছিলাম ভয়াবহ গন্ধ ছড়াচ্ছিল ওটা… অনেকটা পচা মাংসের গন্ধের মতো!’

চোখাচোখি হলো টনি আর তাহিতির।

‘কিছু বুঝলেন?’ ব্যগ্র গলায় জানতে চাইল রোজমেরি। ‘হচ্ছে কী এগুলো? প্লিজ, বলুন আমাকে!’

‘যা যা শুনলাম…’ চিন্তার ভাঁজ টনির কপালে। ‘আসলেই পৈশাচিক কিছুর উপস্থিতির আলামত এগুলো।’

আতঙ্কের অদৃশ্য একটা স্রোত বয়ে গেল যেন রোজমেরি আর বাচ্চাদের উপর দিয়ে।

‘ওহ, মাই গড!’ মুখে হাত চাপা দিল রোজমেরি।

হলওয়ের দু’পাশের দরজাগুলোর উপর নজর বোলাল টনি। প্রত্যেকটা দরজার হাতল থেকে ঝুলছে রশির টুকরো।

‘রাতের বেলা যাতে চৌকাঠের গায়ে বাড়ি না খায় দরজাগুলো, তার জন্য এই ব্যবস্থা,’ ব্যাখ্যা করল গৃহকর্ত্রী।

বুঝতে পারার ভঙ্গিতে মাথা দোলাল টনি। ‘বাড়ি খায়, বললেন… আচ্ছা, কী রকম শোনায় আওয়াজটা?’

‘কীসের আওয়াজ?’ প্রশ্নটা বুঝতে পারেনি রোজমেরি। ‘বাড়ি খাওয়ার শব্দটার কথা বলছি…’

‘কী রকম আবার… ধাম-ধাম-ধাম!’

‘পর পর তিন বার করে?

হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল মহিলা।

আবার তাকাল টনি তাহিতির দিকে। আবছাভাবে মাথা ঝাঁকাল তাহিতি।

‘ত্রয়ীকে অপমান করার ইঙ্গিত এটা!’ পিশাচের উপস্থিতি সম্বন্ধে পুরোপুরি নিশ্চিত হয়েছে ওরা।

‘ত্রয়ী?’ অকূল পাথারে রোজমেরি।

‘ঈশ্বর, ঈশ্বরের পুত্র আর মহান আত্মা। বাজি ধরে বলতে পারি, ভোরের দিকে থেমে যায় আওয়াজটা।’

নীরবে জবাব দিল রোজমেরি। হ্যাঁ।

‘থামতেই হবে,’ জোর গলায় বলল টনি। কারণ, পবিত্র কেতাবে আছে—সরাসরি ঈশ্বরের কাছ থেকে আসে ভোরের আলো।’

‘আপনাদের কি কুকুর আছে কোনও?’ অনেকটা অপ্রাসঙ্গিকভাবেই যেন জিজ্ঞেস করল তাহিতি।

‘ছিল।’

‘কালো রঙের ল্যাব্রাডর?’

‘হ্যাঁ। রকেট ওর নাম। ‘কী হয়েছিল ওটার?’

‘যে রাতে এ-বাড়িতে এসে উঠলাম আমরা, ঢোকানোই যায়নি ওটাকে বাড়ির মধ্যে। উপায় না দেখে বাইরেই বেঁধে রাখা হয় কুকুরটাকে।’ থামল রোজমেরি দম নেয়ার জন্য। ‘সকালে মৃত অবস্থায় আবিষ্কার করে ওটাকে সিনথিয়া। নিজেই নিজের গলায় শেকল পেঁচিয়ে মারা পড়েছে কুকুরটা।’

দম আটকাল তাহিতি। যদি মারাই গিয়ে থাকে কুকুরটা, সামনে আঙিনায় কী ওটা তা হলে?

নজরে পড়ল, চেয়ার আর গোঁজ দিয়ে ব্লক করে দেয়া হয়েছে সেলারের দরজাটা।

এগোল মহিলা সেদিকে। পিছু পিছু এগিয়ে গেল রোজমেরি। কেউ কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই জানিয়ে দিল,

ওখানে আর নামি না আমরা।’

‘কেন?’ প্রশ্ন টনির।

‘কিছু একটা রয়েছে ওখানে। দরজার ওপাশটায় আঁচড়ায় খালি! ‘

চেয়ার আর গোঁজটা টেনে সরাল তাহিতি দরজা থেকে। তার পর খুলল দরজাটা। সত্যতা মিলল রোজমেরির বক্তব্যের।

অগুনতি আঁচড় দরজাটার উল্টো পিঠে! আরও গভীর… আরও হিংস্র!

বেইসমেন্টটা আলোকিত করে তুলল তাহিতি সুইচ টিপে। এর পর সিঁড়ি ধরে নামতে লাগল নিচে।

শেষ ধাপটা পেরিয়ে যেতেই বিস্ফোরণের মতো এক ঝাঁক দৃশ্য এসে দ্রুত সরে গেল মস্তিষ্কের পরদা থেকে।

… ছ’টা কাঠবিড়ালি… চামড়া ছাড়ানো ছ’টা নিথর দেহ। বড় এক খাঁচার মেঝে জুড়ে পড়ে আছে চার পা ছড়িয়ে। এর মধ্যে একটার পা আবার কেঁপে কেঁপে উঠছে আক্ষেপে। শিগগিরই মরতে চলেছে ওটা। খাঁচাটার শিক থেকে ঝুলছে জানোয়ারগুলোর নাড়িভুঁড়ি।

… রক্তের বন্যা বয়ে যাচ্ছে এবড়োখেবড়ো কংক্রিটের মেঝেতে।

….. গ্রাফিতির মতো করে, বড়সড় এক রক্তলাল পেন্টাকল আঁকা এক দিকের দেয়ালে।

… আলখেল্লা পরিহিত কেউ একজন সঙ্গম করছে পুরোপুরি নগ্ন, মৃত এক নারীর সঙ্গে। চোখ জোড়া বিস্ফারিত মেয়েটার। কাছাকাছি দাঁড়িয়ে দৃশ্যটা উপভোগ করছে হুডের নিচে মুখ আড়াল করা আরও ক’জন আলখেল্লাধারী।

…একটা হাইপোডার্মিক নিডল পুশ করা হচ্ছে রগ ওঠা একটা বাহুতে।

ওল্টানো একটা ক্রুশকে ঘিরে রয়েছে কতগুলো ছায়ামূর্তি।

…একটা পিস্তলের মাজল ঝলসে ওঠায় এক ঝলক আলো এসে পড়ল ভারি গড়নের এক মহিলার মুখমণ্ডলে। নিজের চিবুকের নিচে পিস্তলের ব্যারেল চেপে ধরে ট্রিগার টেনেছে মহিলা।

ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের কল্যাণে দৃশ্যগুলো একবারে দেখা হয়ে গেল তাহিতির। অসুস্থ বোধ করছে মহিলা।

ততক্ষণে টনিও এসে যোগ দিয়েছে ওর সঙ্গে

এসব দৃশ্যের মানে বুঝতে বাকি নেই তাহিতির। ভূগর্ভস্থ কামরাটায় সংঘটিত সুদূর অতীতের ঘটনা এগুলো। মাথাটা ঝাঁকিয়ে সরিয়ে দিতে চাইল ও ভীতিকর, বীভৎস ছবিগুলো।

‘যা ভেবেছিলাম, অবস্থা তার চাইতেও ভয়াবহ!’ টনির দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করল তাহিতি।

চোদ্দ

মা-মেয়েদের অনুসরণ করে বৈঠকখানায় এসে উপস্থিত হলো টনি আর তাহিতি।

লিভিং রুমের চারপাশে তাকিয়ে দেখছে প্রেত- বিশেষজ্ঞরা। জিজ্ঞেস করল তাহিতি: ‘এখানে কবে এসেছেন আপনারা?’

‘পাঁচ মাস আগে,’ জানাল রোজমেরি

ফায়ারপ্লেসের উপর দৃষ্টি আটকে গেল প্রেত-বিশেষজ্ঞ মহিলার। সঙ্গে সঙ্গে আবারও দৃশ্যের খেলা শুরু হলো ওর মাথার মধ্যে।

… ফায়ারপ্লেস থেকে রক্ত গড়িয়ে এসে ভিজিয়ে দিচ্ছে মেঝেতে পড়ে থাকা এক সেট সরু, লম্বা উলের কাঁটাকে।

রোজমেরি আর মেয়েদের দিকে ঘুরে তাকাল তাহিতি। ‘আপনি কি উল বোনেন?’

মুখ চাওয়াচাওয়ি করল মা আর কন্যারা।

‘না তো!’ বিস্মিত উত্তর রোজমেরির।

.

ডায়েস দম্পতিকে উপরে নিয়ে যাচ্ছে রোজমেরি কুপার, বলে উঠল সিনথিয়া: ‘পাখির ব্যাপারটা বলো না, আম্মু!’

বলতে খেয়াল ছিল না রোজমেরির, এখন হলো।

‘তাজ্জব ব্যাপার, জানেন?’ বিষয়টার গুরুত্ব বোঝাতে চোখ বড় বড় হয়ে গেছে মহিলার। ‘গোলাঘরের উপর গিয়ে আছড়ে পড়ে পাখি! ঘাড় ভেঙে মারা পড়ে!’

‘কী ধরনের পাখি?’ জানতে চাইল টনি।

‘সব ধরনের।’

আগে আগে চলেছিল সিলভিয়া, ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল দম্পতিটির দিকে। ‘…আরও আছে কাহিনী। জ্যান্ত হয়ে ওঠে ঘরের জিনিসপত্র!’

‘কী রকম?’ উৎসুক দৃষ্টি নিয়ে তাকাল তাহিতি।

‘জায়গা থেকে সরে যায় ওগুলো। দেখে মনে হবে, ঘুরে বেড়ায় সারা ঘরে। কিচেনের টেবিলটা দরজা আটকে দিচ্ছিল আজ সকালে।’

‘আরও আছে ঘটনা,’ বলল রোজমেরি দোতলার ল্যাণ্ডিঙে পা রেখে। ‘পাঁচটা বিশ মিনিটে বন্ধ হয়ে যায় ঘড়িগুলো।’

‘সবগুলো ঘড়ি?’ প্রশ্ন তাহিতির।

‘সবগুলোই।’

এগিয়ে চলল সবাই মাস্টার বেডরুমের দিকে।

হলওয়ের দেয়ালগুলো খালি এ মুহূর্তে। একাধিক পেরেক বেরিয়ে আছে দু’পাশের দেয়াল থেকে।

‘পারিবারিক ছবি ছিল ওখানে, ব্যাখ্যা দিচ্ছে রোজমেরি। ‘কিন্তু কীসে জানি পেরেক থেকে ফেলে দেয় ওগুলো। সেজন্য আর লাগাইনি ছবিগুলো… আপাতত।’

‘…আর আপনার স্বামী…’ জিজ্ঞেস করল তাহিতি। ‘এসব ওঁর চোখে পড়েনি?’

ডাইনে-বাঁয়ে মাথা নাড়ল রোজমেরি। মলিন মুখটা আরও কালো হয়ে গেছে মহিলার।

‘ও না থাকলেই সচরাচর শুরু হয় এগুলো,’ জানাল তথ্যটা। ‘ওর ধারণা, এগুলো সব আমাদের কল্পনা।’

‘ইচ্ছে করেই দেখানো হচ্ছে না ওনাকে,’ খোলসা করল টনি। মহিলার চোখে ফাঁকা দৃষ্টি দেখে বলল, ‘আপনাদের সম্পর্কের মাঝে ফাটল ধরানোর চেষ্টা করছে ওটা। যা-ই থেকে থাকুক এখানে, শক্তিশালী হয়ে উঠছে এভাবে নেগেটিভ এনার্জি থেকে।’

‘সেটা হলে বলতে হবে, সফল হয়েছে ওটা,’ বেজার মুখে বলল মিসেস কুপার।

সিনথিয়ার কামরার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় বলল মহিলা, ‘এটা আমার ছোট মেয়ের কামরা। এখানেই খারাপ অভিজ্ঞতাটা হয়েছিল ওর।’

চলা থামিয়ে ভিতরে তাকাল ওরা। দেখতে পেল, কাভার নেই একটা বালিশেরও।

চলে এল স্বামী-স্ত্রীর শোবার ঘরের সামনে।

‘এখানেই দেখা গিয়েছিল প্রেতটাকে?’ জানতে চাইল তাহিতি।

নীরবে মাথা নাড়ল সিলভিয়া।

কামরায় প্রবেশ করল তাহিতি আর টনি। বাইরেই রইল অপর তিনজন, দরজা থেকে দেখতে লাগল স্বামী-স্ত্রীর কার্যকলাপ।

‘ঠিক কোথায় দেখা দিয়েছিল অপচ্ছায়াটা?’

‘বিছানার বাম দিকে,’ জবাব সিলভিয়ার।

এগোল সেদিকে তাহিতি।

টনি পা বাড়াল ড্রেসারটার উদ্দেশে। মেয়েদের একটা ফোটোফ্রেম দেখতে লাগল ও হাতে তুলে নিয়ে। তার পর ওটাকে আগের জায়গায় রেখে দিয়ে দৃষ্টি দিল আরেকটা ছবির দিকে। অ্যালবার্ট আর রোজমেরি কুপারের বিয়ের ফোটো এটা।

আরও একটা ফোটোগ্রাফ রয়েছে ড্রেসারের উপরে। শিকার করা একটা খরগোসের পিছনে এক হাঁটুর ভর দিয়ে বসে আছে অ্যালবার্ট কুপার। বারো পয়েন্টের রাইফেলটা বিশ্রাম নিচ্ছে লোকটার উরুর উপরে।

.

রোজমেরি কুপারের বক্তব্য রেকর্ড করার জন্য কিচেন-টেবিলে এসে বসেছে টনি ডায়েস। টেবিলের উপরে, দু’জনের মাঝখানে রেখেছে টেপ রেকর্ডারটা।

‘একদম প্রথম থেকে শুরু করুন আবার!’ অনুরোধ করল প্রেত-বিশেষজ্ঞ যুবক।

হালকা নড করল রোজমেরি।

রেকর্ডারের প্লে আর রেকর্ড বাটন একসঙ্গে টিপে দিল টনি।

‘আমি টনি ডায়েস বলছি,’ সূচনা-বক্তব্য রেকর্ড করতে শুরু করল ও বাটন টেপার দু-তিন সেকেণ্ড পর। ‘পয়লা নভেম্বর আজকে, উনিশ শত বাহাত্তর সাল। রোজমেরি কুপার নামে এক ভদ্রমহিলার জবানবন্দির রেকর্ড নিচ্ছি আমি, অতিপ্রাকৃত অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে যাঁর গোটা পরিবার…’ তাকাল ডায়েস রোজমেরির দিকে। ‘নিন, শুরু করুন এবার।’

.

ফ্যামিলি-রুমের সোফায় কুপারদের ছোট মেয়েটাকে সঙ্গ দিচ্ছে তাহিতি। শুনছে ওর বক্তব্য। এক পর্যায়ে লক্ষ করল, নখ কামড়াতে শুরু করেছে মেয়েটা। দাঁত দিয়ে নখের কোনা ভেঙে ফেলছে মেঝের উপর।

‘…আর কিছু বলবে?’ কথোপকথনের শেষ পর্যায়ে পৌঁছে গেছে মহিলা।

‘…বাচ্চার কান্নার শব্দ শুনতে পাই আমি মাঝে মধ্যে!’ কোথা থেকে আসে আওয়াজটা?’

‘ফায়ারপ্লেস থেকে!’ ঘর গরম রাখার জায়গাটার দিকে চলে গেল সিনথিয়ার ভীত দৃষ্টি। এ মুহূর্তে আগুন জ্বলছে না ওখানটায়। ছাইয়ে বোঝাই হয়ে রয়েছে ফায়ারপ্লেসের ভিতরটা।

‘তোমার কি মনে হয়েছে কখনও, এগুলোর কোনোটা ক্ষতি করতে চাইছে তোমার?’ পরিষ্কার করে জানতে চাইল তাহিতি।

‘আম্‌… হ্যাঁ….’

দু’জোড়া চোখ তাকিয়ে আছে পরস্পরের দিকে। তাহিতির দৃষ্টিতে ভরসা খুঁজছে সিনথিয়া।

…টের পান আপনি, ওগুলো যখন ধারেকাছে থাকে?’ কৌতূহল হচ্ছে মেয়েটার।

‘হুম, পাই।’

‘কীভাবে?’

‘গুজবাম্পস।’

কী যেন চিন্তা করল সিনথিয়া। ‘তা হলে, আমারও যখন কাঁটা দেবে গায়ে, তখন কি ধরে নেব, কাছাকাছি রয়েছে ওগুলো?’

‘থাকতে পারে,’ বলল তাহিতি অন্যমনস্ক গলায়। ‘তোমার আম্মুর কাছে তো শুনলাম সব কিছু। জাস্ট তুমি কী দেখেছ, বলবে আমাকে? তোমার মুখ থেকেই শুনি আরেক বার!’

.

তাহিতির পাশে, সোফার উপর পা তুলে দিয়েছে সিলভিয়া। কুপারদের বড় মেয়ের বক্তব্য শুনছে এখন মহিলা।

বাহুতে দুই হাঁটু বেড় দিয়ে ধরেছে মেয়েটা। শূন্য, ফাঁকা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।

….জানি না, কী ছিল ওটা,’ ধীরে ধীরে শুরু করল বলতে। ‘আম্মুর ধারণা, ওটাই আঁচড়াচ্ছিল সেলারের দরজায়…’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *