অদেখা ভুবন – ১.১৫

পনেরো

গায়ে তোয়ালে জড়িয়ে উপরতলার বাথরুম থেকে বেরিয়ে এল সিলভিয়া। নিজের ঘরের দিকে রওনা হয়েছে, স্ট্যাচু হয়ে গেল মাঝপথে। তাকিয়ে আছে মেঝের দিকে।

জ্যোৎস্নার আলো এসে পড়েছে মেঝেতে। গাছপালার দীর্ঘ ছায়া বিছিয়ে রয়েছে দূরপ্রান্তের জানালাটা থেকে। ঝিরিঝিরি কাঁপছে ছায়াটা। সব কিছুই স্বাভাবিক যেন।

কিন্তু না, একটা অস্বাভাবিকতা ধরা পড়েছে সিলভিয়ার চোখে।

ছায়াটা। কেউ যেন বসে রয়েছে গাছটার ডালে! সরু, লম্বা বাহু… বাঁকা নখর থাবায়… স্থূলকায় ধড়টা থেকে বেরিয়ে আছে যেন কিম্ভূতকিমাকার পা দুটো… ছায়ায় মিশে থাকলেও আলাদা করা যাচ্ছে বৈশিষ্ট্যগুলো।

নিজের উপর জোর খাটিয়ে চাইল সিলভিয়া জানালাটার দিকে।

নাহ… কিছু নেই ওখানটায়!

.

কুপারদের কিচেনে এসে ঢুকল তাহিতি। এখনও মেয়েদের মায়ের ইন্টারভিউ নিচ্ছে টনি। টেপটা পজ করে তাকাল স্ত্রীর দিকে।

‘বাইরে যাচ্ছি আমি,’ স্বামীকে বলল তাহিতি।

নড করল টনি। ‘আমারও হয়ে এসেছে প্রায়।’

.

পার্শ্বদরজা দিয়ে বেরিয়ে এল তাহিতি বাড়ির বাইরে। এক মুহূর্তের জন্য ল্যাণ্ডিঙে থেমে তাকাল চারপাশে।

শূন্য বাগানটায় ঠায় দাঁড়িয়ে আছে কাকতাড়ুয়া। জীর্ণ, বিবর্ণ। দেখে মনে হচ্ছে, দু’হাত দু’দিকে ছড়িয়ে ক্রুশবিদ্ধ করা হয়েছে ওটাকে।

গোলাঘরের দিকে দৃষ্টি সরে গেল মহিলার। অনিষ্টকারী কোনও জানোয়ারের মতো গুড়ি মেরে রয়েছে যেন ওটা অন্ধকারে।

মনস্থির করল ও ওদিকে যেতে।

পোর্চ থেকে নেমে এল তাহিতি। আধাআধি পেরিয়েছে উঠনটা, থেমে গেল আচমকা পা দুটো। কিছু একটা যেন টের পেয়েছে। মনে হচ্ছে মহিলার, নজর রাখছে কেউ ওর উপরে।

গোলাঘরটা ছাড়িয়ে আরও দূরে চলে গেল তাহিতির স্থির দু’চোখের দৃষ্টি। মাতাল হাওয়া বেদম দোলাচ্ছে গাছগুলোকে।

অস্বস্তিটা চাপা দিয়ে রেখে এগোতে শুরু করল আবার। কাছে পৌঁছে খুলতে যাবে দরজাটা, লক্ষ করল, দুটো মরা পায়রা পড়ে আছে মাটিতে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে, ঘাড় ভাঙা ওগুলোর।

দরজাটা খুলে ধরে তাকাল ও ভিতরে।

রুপালি আলোর বর্শা প্রবেশ করছে ভিতরে গোলাটার পুরানো, ক্ষয়া তক্তার জোড়ার ফাঁক ভেদ করে।

বিদ্যুৎ-ঝলকের মতো উদয় হওয়া আরেকটি দৃশ্য গ্রাস করে নিল ওকে তৎক্ষণাৎ। দেখতে পেল, রক্তাক্ত এক লোক পড়ে রয়েছে মাটিতে। ভচকে দেয়া হয়েছে লোকটার মুখমণ্ডল।

জোনা।

বার্নের ভিতরে পা রাখল তাহিতি। আগে বাড়ল কয়েক কদম। থেমে দাঁড়াল পরিবেশটা নিজের মধ্যে ধারণ করার জন্য।

লম্বা একটা ওয়ার্কবেঞ্চের পাশেই দাঁড়িয়ে আছে পুরানো এক শেভি পিকআপ গাড়ি। পরিত্যক্ত আধ ডজন হর্সস্টল গোলাঘরটার এক পাশে। একটা মই ঠেস দিয়ে রাখা ছাতের নিচের তাকমতো জায়গাটায়।

ফেরার জন্য ঘুরতে যাচ্ছিল, দড়াম করে লেগে গেল দরজাটা!

এক জোড়া নগ্ন পা ঝাঁকি খেতে খেতে নিথর হয়ে গেল তাহিতির ঠিক মুখের সামনে!

অস্বাভাবিক লম্বা পায়ের নখগুলো। নোংরা আর ভাঙা।

উপরে চাইল তাহিতি।

ছাতের আড়া থেকে রশিতে ঝুলছে এক মহিলা! বেকায়দাভাবে কাত হয়ে রয়েছে মাথাটা। কোনও সন্দেহ নেই, ভেঙে গেছে ঘাড়।

ধূসর, দীর্ঘ জামা মৃতার পরনে। মুখের দু’পাশ দিয়ে নেমে আসা কালো চুলগুলো এলোমেলো। বিস্ফারিত চোখ দুটো ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাইছে কোটর থেকে। যেন অভিযোগের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তাহিতির দিকে।

‘তুমি এখানে!’ গলা শোনা গেল টনি ডায়েসের।

ঝট করে দরজার দিকে তাকাল তাহিতি। দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে আছে ওর স্বামী। টেরই পায়নি, কখন এসে হাজির হয়েছে।

দ্রুত দরজার দিকে পা চালাল তাহিতি। ঝুলন্ত পা দুটোকে ভেদ করল ওর মাথা! পিছনে তাকালে দেখতে পেত, ক্রমেই অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে ও-দুটো!

ষোলো

কিচেনের টেবিলে বসে আছে স্বামী-স্ত্রী। খালি হয়ে যাওয়া কফিকাপগুলো ভরে দিচ্ছে রোজমেরি।

গলে যাওয়া তিন বাঁদরের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রয়েছে টনির স্ত্রী। ওর সামনেই রাখা ওটা, টেবিলের উপরে।

‘কী মনে হয় আপনার?’ প্রশ্ন করল রোজমেরি। ‘সিলভিয়া দেখেছিল যেটাকে, ওটাই এটা?’ এই মাত্র নিজের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছে তাহিতি।

‘এসব যখন হানা দিচ্ছে বাড়িটায়,’ নিজের মত দিচ্ছে টনি। ‘পুরো সম্ভাবনা রয়েছে, কোনও কিছুতে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে এদেরকে। অথবা, কোনোভাবে প্রশস্ত করে দিচ্ছে এগুলোর আসার রাস্তা।’

‘মেয়েদের সাথে কথা বলেছি আমি,’ বলল তাহিতি। ‘আপনার কাছে জানতে চাইছি, আপনি কিংবা আপনার স্বামী… কখনও কি কোনও ধরনের প্রেতচর্চা করেছিলেন আপনারা? অকাল্টের সাথে সম্পর্ক রয়েছে, এমন যে-কোনও কিছু?’

বিষয়টা চিন্তা করেই আতঙ্কিত বোধ করল রোজমেরি। ‘মাই গড, নো!’

‘অনেকেরই ঝোঁক রয়েছে এদিকে,’ বলছে টনি। ‘অনেকে আবার স্রেফ মজা হিসেবে নেয় এটাকে। খেলার ছলে বসে পড়ে ওইজা বোর্ড নিয়ে। প্ল্যানচেটের মাধ্যমে আবাহন করে অপশক্তিকে। তার পর যা হয়… মুক্ত হতে পারে না এসবের কবল থেকে। শুনলে অবাক হবেন, ভূরি ভূরি ঘটনা আছে এরকম। প্রায়ই কানে আসে আমাদের।’

‘বেইসমেন্টে যা-কিছু দেখেছি আমি, তাতে করে মনে হচ্ছে, কোনও একভাবে শয়তানের মন্দির হয়ে উঠেছে বাড়িটা।’ এক মুহূর্ত বিরতি নিয়ে বলল তাহিতি, ‘আপনারা কি ইতিহাস জানেন ফার্মটার?’

‘এটুকু বলতে পারি, আঠারো শ’র শেষ দিকে কোনও এক সময় তৈরি হয়েছিল এটা। ব্যাঙ্ক ট্রাস্টের মাধ্যমে নিলাম থেকে কিনেছি আমরা বাড়িটা। আসল মালিকের ব্যাপারে একদমই জানা নেই কিছু।’ একটু থামল রোজমেরি। ‘বরাবরই গ্রামে থাকতে চেয়েছি আমি। শহরের চাইতে নিরাপদ বলে মনে হয়েছিল এই জায়গা।’

এক মুহূর্ত সময় নিল টনি। তার পর বলল, ‘নিশ্চিতভাবেই ঝাড়ফুঁক চালাতে হবে এ-বাড়ির উপর। কাজটা করার জন্য চার্চের অনুমতি দরকার। সেটা পেয়ে গেলেই একজন প্রিস্টকে দিয়ে কাজ শুরু করতে পারি আমরা।’

‘আমার দিক থেকে কোনও সমস্যা নেই, জানাল রোজমেরি।

‘যতটা সহজ ভাবছেন, অত সহজ নয় ব্যাপারটা। যেসমস্ত ঘটনা ঘটছে বলে দাবি করছেন আপনারা, আসলেই সেগুলো ঘটেছে কি না, সে-ব্যাপারে প্রমাণ সরবরাহ করতে হবে আমাদের। এটাই হচ্ছে প্রক্রিয়াটার সবচেয়ে কঠিন অংশ।’

‘কেন বলছেন এ কথা?’

‘কারণ,’ জবাবটা দিয়ে দিল তাহিতি। ‘বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, প্রমাণ পাওয়া যায় না দরকারের সময়।’

‘সেরকম যদি হয়, কী হবে তা হলে?’

‘সবচেয়ে খারাপটা। চার্চকে পাওয়া যাবে না পাশে।’

শুনেই মনটা দমে গেল রোজমেরির।

.

ফ্রন্ট-ডোরের সামনে দাঁড়িয়ে আছে টনি আর তাহিতি, তৈরি ওরা ফেরার জন্য।

টনির হাতে কিচেন থেকে নেয়া ঘড়িটা। সরাসরি তাকাল রোজমেরির চোখে। ‘কীসে বিশ্বাস করেন আপনি? আই মিন, কোন্ ধর্মমতে?’

‘…মেথডিস্ট হিসেবে বড় হয়েছি আমি। আমার তো মনে হয়–’

‘ব্যাপটাইজ করা হয়েছে আপনার বাচ্চাদের?’

‘না… সত্যি বলতে কি, চার্চে যাতায়াতের অভ্যাস নেই আমাদের।’

তাহিতির দিকে চকিত চাউনি হানল টনি I

‘এই বিষয়ে তা হলে ভেবে দেখতে বলব আমরা আপনাদের,’ বলল ও রোজমেরিকে। ‘বিশ্বাস ছাড়া কোনও কিছুই রক্ষা করতে পারবে না আপনাদেরকে।’

দ্বিধাদ্বন্দ্বের দোলায় দুলছে রোজমেরি।

‘পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলতে পারে এখানে আমাদের উপস্থিতি,’ বলল আবার টনি।

‘… কেন?’

‘কারণ, হুমকি আমরা ওগুলোর জন্য… যা-ই থাকুক না কেন এখানে, ব্যাপারটা পছন্দ করবে না ওরা।’

আবেগ সামলাতে পারল না রোজমেরি। অত্যন্ত বাড়াবাড়ি এসব! খোদাই জানেন, কীসের মধ্য দিয়ে যেতে হবে সামনে!

হাত ধরে টেনে, মহিলাকে আলিঙ্গন করল তাহিতি। ‘আপনার বাড়ি এটা। টনি আর আমি যা যা জানি, সব কিছুই করব এর উপর থেকে অশুভ প্রভাব হটাতে। কেউই পছন্দ করে না অনিমন্ত্রিত অতিথিদেরকে, তা-ই না?’

চোখ মুছল রোজমেরি।

‘সকালে কথা বলব আমরা কোনও ইতিহাসবিদের সাথে,’ বলল টনি। ‘দেখা যাক, কী বেরোয়। আবার এখানে আসতে আসতে ক’টা দিন পেরিয়ে যাবে হয়তো। নিশ্চিত হতে হবে আগে, ফ্রি রয়েছে কি না আমাদের টেকনিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট। গোটা প্রক্রিয়াটার ভিডিয়ো করার জন্য প্রয়োজন হবে ওকে।’

সিলভিয়া আর সিনথিয়ার দিকে মনোযোগ আকৃষ্ট হলো তাহিতির। ভীত, উদ্বেগ ভরা চেহারায় তাকিয়ে আছে ওরা সিঁড়ির উপর থেকে।

সতেরো

হ্যারিসভিল মোটেলের প্রবেশপথ দিয়ে প্লিমাথটা ঢোকাল টনি ডায়েস।

একতলা একটা দালান। কামরা হয়তো সব মিলিয়ে বিশ-পঁচিশটা।

.

মোটেলের কামরায়, কুইন সাইজ বিছানার কিনারে বসে ফোনে আলাপ করছে তাহিতি। বাইরে থেকে রুমে ঢুকলে, চোখাচোখি হলো টনির সঙ্গে। ছোট একটা সুটকেস আর কার্ডবোর্ডের একটা বাক্স নিয়ে এসেছে ও, টেপ রেকর্ডার আর কিচেন-ক্লকটা রয়েছে ওটার মধ্যে।

‘হ্যাঁ-হ্যাঁ… চমৎকার কাজ করেছেন দাদিমা…’ মেয়ের সঙ্গে কথা বলছে তাহিতি। ‘এখন রাখছি, মা, কেমন? ঘুমানোর দেরি হয়ে যাচ্ছে তোমার… কালকে স্কুল আছে না?’

হেসে, বাক্স আর সুটকেসটা ড্রেসারের উপরে রাখল টনি।

‘হ্যাঁ, সোনা… এই তো… কাছেই রয়েছে বাবা…’ বলছে তাহিতি। ওপাশের কথা শুনে বলল, ‘আই লাভ ইউ, টু, মামণি!’

টনির জন্য ধরে রাখল ফোনটা ওর মিসেস। স্বামী পাশে এসে বসতেই ঠোঁট নেড়ে বোঝাল: ‘কসম খাচ্ছে ও।’

কেমন জানি বিস্মিত দেখাচ্ছে এমিলির বাবাকে। বুঝতে পারেনি স্ত্রীর বক্তব্যের মানে। ফোনটা কানে ধরে বলল, ‘কী, গো, কুমড়োসোনা, এত রাত অব্দি জেগে আছ কেন?’ শুনল চুপচাপ ওপাশের কৈফিয়ত। ‘ও, আচ্ছা… ফাঙ্কি ফ্যানটম দেখাচ্ছে?’ কার্টুন সিরিজটার ভক্ত ওর মেয়ে, জানা আছে টনির।

.

চোখ জোড়া বন্ধ, সাবানের ফেনা ভর্তি বাথটাবে শরীর ডুবিয়ে আধশোয়া হয়ে আছে তাহিতি। স্বামীর বুকের উপর হেলে রয়েছে মাথাটা। বাষ্পে ভরে উঠছে বাথরুমের ভিতরটা।

তাহিতির নগ্ন বাহুতে হাত বুলিয়ে আদর করছে টনি। জিজ্ঞেস করল, ‘কী ব্যাপার, তাহি? চুপচাপ হয়ে পড়লে যে! ঠিক আছ তো তুমি?’

‘বাড়ির কথা মনে পড়ছে বড্ড! ওই যে মেয়েটা… সিনথিয়া… আমাদের এমিলির কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে বার বার।’

‘হুম… যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, মিটিয়ে ফেলতে হবে ওদের ব্যাপারটা।’

.

গায়ে রোব চাপিয়ে বাথরুম থেকে বেরিয়ে এল তাহিতি। চুল মুছছে তোয়ালে দিয়ে। মোটেই ভালো লাগল না স্বামীর দিকে তাকাতে যে চাউনি দিল লোকটা।

আগেই স্নান সেরে বেরিয়েছে টনি ডায়েস। স্রেফ পাজামা পরে বসে আছে এখন বিছানার প্রান্তে। এক হাতে টেপ রেকর্ডার। ওটাই ওর বিচিত্র অভিব্যক্তির কারণ।

‘কী হয়েছে, টনি?’ জিজ্ঞেস করল তাহিতি। ‘কোনও সমস্যা?’

‘মিসেস কুপারের কথাগুলো রেকর্ড হয়নি টেপে!’

‘বলো কী! রেকর্ডচাপতে ভুলে যাওনি তো?’

‘প্রশ্নই আসে না… দেখো…’

প্লে বাটনে চাপ দিল টনি। বেজে চলল:

‘আমি টনি ডায়েস বলছি। পয়লা নভেম্বর আজকে, উনিশ শত বাহাত্তর সাল। রোজমেরি কুপার নামে এক ভদ্রমহিলার জবানবন্দির রেকর্ড নিচ্ছি আমি, অতিপ্রাকৃত অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে যাঁর গোটা পরিবার। … নিন, শুরু করুন এবার।

দীর্ঘ নীরবতা এর পর

‘তার পর… তার পর কী হলো?’ আবার শোনা গেল টনির গলা।

এবং আবারও নীরবতা। বোঝাই যাচ্ছে, টনির কথাগুলোই শুধু রেকর্ড হয়েছে রেকর্ডারে!

যন্ত্রটা বন্ধ করে দিল বিমূঢ় টনি। অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাল বউয়ের দিকে। বুঝতে পারছে না, আদৌ কোনও কাজে লাগবে কি না এই রেকর্ডিং।

আঠারো

এক গেলাস দুধ হাতে সিঁড়ির ধাপ ভেঙে ভেঙে উপরে উঠছে সিলভিয়া; জলের নিম্নমুখী, মন্থর একটা স্রোত ক’ধাপ উপর থেকে এসে স্পর্শ করল কিশোরীর চপ্পল, গড়িয়ে চলে যাচ্ছে নিচের দিকে।

উপরে চাইল সিলভিয়া। চোখ দুটো বড় বড় হয়ে উঠল ওর দৃশ্যটা দেখে।

এগারো-বারো বছরের এক বাচ্চা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে ধাপ কয়েক উপরে! আপাদমস্তক ভিজে আছে ছেলেটা। পরনে পুরানো আমলের কাপড়চোপড়।

গায়ের চামড়া ফ্যাকাসে বাচ্চাটার, পচন ধরেছে জায়গায় জায়গায়। ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে অনবরত চুইয়ে বেরোচ্ছে পানি।

চুরমার হয়ে গেল গেলাসটা হাত থেকে পড়ে। বাড়ি ফাটিয়ে চিৎকার দিল সিলভিয়া। এক সেকেণ্ডেই কপালে হাজারটা ভাঁজ নিয়ে উপরের ল্যাণ্ডিঙে উদয় হলো রোজমেরি।

‘একটা… একটা ছ্‌-ছেলে… একটু আগেই দাঁড়িয়ে ছিল ওইখানটায়!’ কোনও মতে কথাগুলো বলতে প সিলভিয়া।

আঙুল দিয়ে দেখাল ও, কোথায় দেখেছে ছেলে-টাে জায়গাটা ফাঁকা এখন। কিন্তু প্রমাণ রয়ে গেছে ও উপস্থিতির। এখনও পানি গড়াচ্ছে সিঁড়ি দিয়ে!

উনিশ

নাইট-লাইটের মৃদু আলো কোমল আড়া বিলাচ্ছে বিছানায় নিদ্রামগ্ন টনি আর তাহিতির উপরে।

খুট করে একটা আওয়াজের সঙ্গে আপনা থেকেই চালু হয়ে গেল রেকর্ডারটা!

আমি টনি ডায়েস বলছি। পয়লা নভেম্বর আজকে, উনিশ শ’ বাহাত্তর সাল…

জোরাল ভলিউমের কারণে ধড়মড় করে ঘুম ভেঙে উঠে বসতে বাধ্য হলো স্বামী-স্ত্রী। নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না ওরা, বিশ্বাস করতে পারছে না নিজেদের চোখ দুটোকে।

খাটের পায়ার কাছে, ছোট এক টেবিলের উপর রাখা টেপ রেকর্ডারটা। ওটার উপর সেঁটে রয়েছে টনি আর তাহিতির বিস্ফারিত দৃষ্টি।

রোজমেরি কুপার নামে এক ভদ্রমহিলার জবানবন্দির রেকর্ড নিচ্ছি আমি, অতিপ্রাকৃত অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে যাঁর গোটা পরিবার। …নিন, শুরু করুন এবার।

টেপের যে যে অংশ ব্ল্যাঙ্ক পেয়েছিল ওরা ইতোপূর্বে, সেটাই এখন ভরাট হয়ে রয়েছে অচেনা নারীকণ্ঠের ভুতুড়ে ফিসফিসানিতে! টনির পরের কথাগুলো উচ্চারিত হওয়ার আগপর্যন্ত শোনা গেল ভৌতিক স্বরটা।

তার পর… তার পর কী হলো?

তার পর খটাস করে বন্ধ হয়ে গেল রেকর্ডারটা!

‘টনি, ঘড়ি!’ মনোযোগ আকর্ষণ করল ওর স্ত্রী।

তাকাল যুবক, যেদিকে চক্ষুস্থির হয়ে আছে তাহিতির।

রেকর্ডারের পাশেই রাখা জিনিসটা—কুপারদের বাড়ি থেকে আনা টেবল-ক্লকটা। পাঁচটা কুড়ি—সময় দেখাচ্ছে এখন।

স্থির দৃষ্টিতে যন্ত্রটার দিকে তাকিয়ে রইল ওরা।

না… নড়ছে না ঘড়ির কাঁটা। পাঁচটা কুড়িতেই আটকে আছে সময়!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *