অদেখা ভুবন – ১.২৫

পঁচিশ

কুপার পরিবারের সবাই মাইকেলের দু’পাশে দাঁড়িয়ে গোগ্রাসে গিলছে যেন মনিটরের দৃশ্যগুলো। দেখতে পাচ্ছে ওরা, সেলারের দরজা দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করল টনি, তাহিতি আর পিটার পারকার।

পিন-পতন নিস্তব্ধতা বাড়ি জুড়ে।

সুইচ টিপে জ্বেলে দিল বাতিটা টনি।

.

টনি আর তাহিতিকে অনুসরণ করে প্রায় খাড়া সিঁড়ির ধাপ বেয়ে নামছে পিটার পারকার। এক সময় পৌঁছে গেল ওরা তলাটায়।

এক মুহূর্ত সময় নিল টনি। তাকাল বেইসমেন্টের চারপাশে। এর পর নজর বোলাল হাতে ধরা ইএফডি-টাতে।

১ আর ২-এর মাঝখানে লাফাচ্ছে কাঁটাটা!

কিছু একটা নিশ্চিত রয়েছে এখানে! আওড়াল টনি মনে মনে।

আরও ভিতরদিকে এগিয়ে চলল ও।

‘ঠিক আছে, বন্ধু…’ বিড়বিড় করে শান্ত করার প্রয়াস পাচ্ছে নিজেকে। ‘নজরেই রয়েছ তুমি আমাদের…

নীরবতা।

‘সঙ্কেত দাও… সঙ্কেত দাও যে, আমাদের সাথে যোগাযোগ করতে চাও তুমি…’

সেলারের চারদিকে ক্যামেরা ঘোরাচ্ছে পিটার। নিজেও নিশ্চিত নয়, কীসের খোঁজে। মিস্টার ডায়েসের উপরে এসে স্থির হলো ক্যামেরা।

অপর পক্ষের সাড়া পাওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে টনি। কিন্তু না… নিথর নীরবতা যেন ভরাট করে রেখেছে ভূগর্ভস্থ কামরাটা।

‘দরজাটা বন্ধ করতে পারো… জায়গা থেকে সরাতে পারো কোনও কিছু…’ বাতলে দিচ্ছে ও। ‘করো কিছু একটা… যে-কোনও কিছু…’

অপেক্ষা…

তাকাল টনি ইএফডি-র দিকে। পাগলের মতো নাচানাচি করছে কাঁটা।

অপেক্ষা… অপেক্ষা… অপেক্ষা…

.

ব্যর্থ মনোরথে বেরিয়ে আসছে ওরা বেইসমেন্ট থেকে, রোজমেরি, অ্যালবার্ট আর মাইকেল রডম্যান ভিড় করল দরজার মুখটায়।

প্রশ্ন উপচে পড়া রোজমেরি-কুপারের-চোখের দিকে তাকাল টনি।

‘যেমনটা বলেছিলাম আপনাকে,’ কৈফিয়ত দিচ্ছে যেন। ‘যখন যেরকম চাই, তেমনটা ঘটে না সব সময়।’

ঘুরতে যাচ্ছে দরজাটা বন্ধ করার জন্য, বিকট দড়াম করে লেগে গেল পাল্লাটা। ঠিক ওর মুখের উপরে!

বন করে ঘুরে গেল প্রত্যেকে। সবচেয়ে বেশি চমকেছে পারকার।

স্বামীর দিকে চকিত চাউনি হানল ‘রোজমেরি, যদিও বুঝতে পারছে না লোকটা, কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছোবে ও এ ঘটনা থেকে।

ছাব্বিশ

রাত। কিচেন-কাউন্টারের ঘড়িটা সময় দেখাচ্ছে: একটা তেত্রিশ।

রান্নাঘরে প্রবেশ করল পিটার। দেখতে পেল, ভেজিটেবলের একটা কনটেইনার ফ্রিজ থেকে বের করে নিচ্ছে মাইকেল।

‘খাবেন?’ জিজ্ঞেস করল পিটারকে।

‘নাহ, পেট ভরা।’

কফিপটটার কাছে গেল অফিসার।

‘কী মনে হয় আপনার,’ জিজ্ঞেস করল রসিক মাইকেল। ‘লবণ দিয়ে কী করছেন তেনারা?’

পটটার পাশেই লবণ আর মরিচের শেকারটা দেখতে পেল পিটার কাউন্টারে।

‘এই তো, এখানে।’ নির্দেশ করল হাত নেড়ে। সল্ট শেকারটা তুলে দিল মাইকেলের হাতে।

‘ধন্যবাদ,’ বলল ডায়েসদের সহকারী। জোরে জোরে ঝাঁকি দিয়ে পুরু করে লবণ ছড়াতে লাগল ও খাবারটার উপরে।

‘কৌতূহল হচ্ছে, বুঝলেন?’ মন্তব্য করল হাত চালাতে চালাতে। ‘ওইভাবে যে দড়াম করে বন্ধ হয়ে গেল দরজাটা, কী মতামত আপনার এই ব্যাপারে?’

দুর্বলভাবে শ্রাগ করল পিটার। :…বাতাসের কারণে হতে পারে।’

শুনে মনে হলো, আমোদ পেয়েছে মাইকেল। মুখে পুরল ও এক চামচ ভেজিটেবল।

‘মজা পেলাম, ভাই। যত জোরেই হোক না কেন বাতাস, বাতাসে কখনও ব্যাঙ গিলে ফেলা চেহারা হয় না আমার! দেখেছিলেন না তখন?’

জবাব দেয়ার দরকার পড়ল না। কথা তো সত্যি।

‘এই জন্যই, বুঝলেন… এই কারণেই যন্ত্রপাতি নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করি আমি। কারণ হচ্ছে, আবেগ কিংবা অনুভূতি নেই যন্ত্রের, কখনও তৈরিও হয় না। যন্ত্র হয় কাজ করে, নয় তো করে না।’ আরেক চামচ সবজি ঢুকল মাইকেলের মুখের মধ্যে। ‘তা আপনি যদি বিশ্বাস না-ই করবেন এসবে, এসে জুটলেন কন আমাদের সাথে?’

‘টাকার জন্য,’ সরাসরিই জবাব দিল পিটার। ‘বাপ হতে চলেছি আমি। যে টাকাটা পাব এখান থেকে, কাজে লাগবে আমার।’

‘তার মানে… আপনার কি ধারণা, এগুলো আসলে বানায় মানুষে—তিল থেকে তাল?’

‘মনে পড়ে… ক্লজিটের মধ্যে বুগিম্যান থাকে—এই ধারণা নিয়ে বড় হচ্ছিলাম আমি। কিন্তু যখনই চেক করত মাম্মি-ড্যাডি, কিচ্ছু পেত না ওখানে।’

হাসির ভঙ্গিতে বেঁকে গেল মাইকেলের ঠোঁটের কোনা।

‘কিন্তু এটা তো মানবেন যে, স্রেফ আপনি দেখতে পাচ্ছেন না বলেই যে ওখানে নেই জিনিসটা, না-ও তো হতে পারে সেটা।’ প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করল মাইকেল, ‘কাছের কাউকে হারিয়েছেন কখনও?’

‘…আব্বুকে, কেন?

‘তাহিতিকে বলতে হবে বিষয়টা। দেখা যাক, আপনার বাবার সাথে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারে কি না ও।’

আমোদের হাসিটা আটকাতে পারল না পিটার। ‘বিশ্বাস করি না আমি—কথাটার কোন্ অংশটা বোধগম্য হচ্ছে না আপনার?’

আরেক চামচ সবজি গেল মাইকেলের মুখে।

‘কীসে ভয় পাচ্ছেন আপনি, বলুন তো!’ বলল ও চিবোতে চিবোতে। ‘আপনার ওই সঙ্কীর্ণ চিন্তাভাবনাগুলো হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে- সেজন্য? এক কাজ করুন না, অফিসার… কেবল আপনিই জানেন, এমন কোনও কিছুর কথা বলুন আমাকে। স্রেফ এটা বলবেন না যে, জিনিসটা কী আসলে!’

মনে মনে খেলছে পিটার প্রস্তাবটা নিয়ে।

‘ওকে,’ বলল ও প্রস্তুত হয়ে। ‘কিছু একটা রেখেছি আমি আব্বুর ব্যবহার করা ছোট একটা বাক্সে। জিনিসটা আমাদের দু’জনের জন্যই বিশেষ কিছু।’

তাহিতিকে দেখা গেল কিচেনে।

উজ্জ্বল হয়ে উঠল মাইকেলের চেহারাটা। হাসছে ও। ‘এক্কেবারে সময়মতো এসেছ!’

‘কেন বলছ এ কথা?’ বলল তাহিতি ফ্রিজের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে। দরজাটা খুলে মেলে ধরল ওটার।

‘ছোট্ট একটা এক্সপেরিমেন্ট করছি আমরা,’ উত্তেজিত কণ্ঠে বলল মাইকেল। ‘আমাদের নৈরাশ্যবাদী অফিসার—এই যে, ইনি—কিছু একটা রেখেছেন ওঁর বাবার ছোট এক বাক্সে। জিনিসটা কী, বলতে পারবে ওঁকে?’

একটা সোডা-বোতল তুলে নিল তাহিতি ফ্রিজের তাক থেকে। সম্মতির জন্য তাকাল এর পর পিটারের দিকে।

অনীহা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে অফিসারের চেহারায়। হাসল তা-ও।

‘অবশ্যই, কেন নয়?’ উচ্চারণ করল মুখে।

লোকটার মুখোমুখি এসে দাঁড়াল তাহিতি। কাউন্টারের উপরে রাখল সোডা-টা।

‘হাত দুটো দিন তো আপনার!’ তালু চিত করে নিজের হাত দুটো বাড়িয়ে ধরল তাহিতি। অফিসারের হাত জোড়া নিজের হাতে নিয়ে বন্ধ করল চোখ দুটো।

সামান্য অস্বস্তি হচ্ছে পিটারের।

দীর্ঘ একটা মুহূর্তের পর শুরু করল তাহিতি।

‘বেইসবল… হ্যাঁ, একটা বেইসবল দেখতে পাচ্ছি আর কিছু একটা লেখা রয়েছে বলের গায়ে। বড় হাতের একটা P আর একটা C ছাড়া আর তো কিছুই ভাবতে পারছি না ও- দুটোকে….’

চোখ মেলল তাহিতি। হাত দুটো ছেড়ে দিল অফিসারের। ‘…তো?’

কাঁধ ঝাঁকাল পিটার। ‘…হয়নি। কোনও ধরনের বল-টল রাখিনি আমি বাক্সটায়।’

বিচিত্র অভিব্যক্তি নিয়ে লোকটার দিকে তাকিয়ে রইল তাহিতি। সত্যিই কি মেলেনি জবাবটা?

ওহ… ঠিক আছে,’ মেনে নিল হার। ‘রুমাল তা হলে বিড়াল হয়ে গেছে!’

.

মনিটরের সামনে, রোজমেরি কুপারের পাশে বসে রয়েছে তাহিতি। দেখতে পাচ্ছে, সিলভিয়ার বিছানায় গুটিসুটি মেরে ঘুমাচ্ছে এ-বাড়ির দুই মেয়ে।

‘মনে হচ্ছে, এখানে আপনাদের উপস্থিতিতে নিরাপদ বোধ করছে ওরা,’ প্রশান্ত মন্তব্য ওদের মায়ের। ‘দেখছেন না, কেমন নিশ্চিন্ত-নির্ভার হয়ে আছে!’

.

জানালা ভেদ করে বৈঠকখানায় ঢুকে পড়েছে সকালের সোনালি আলোর টুকরো। উষ্ণ করে তুলছে কামরাটাকে।

টিক করে পাঁচটা কুড়ি থেকে একুশে পৌঁছাল গ্র্যাণ্ডফাদার ক্লকের কাঁটাটা, ঘুরতে লাগল চক্রাকারে।

টনি, তাহিতি, পিটার, মাইকেল— প্রত্যেকেরই নজর এক-একটা ঘড়িতে। না, বন্ধ হয়ে যায়নি একটা ঘড়িও।

‘ঠিক আছে,’ সিদ্ধান্তে পৌঁছাল টনি। ‘এবার তা হলে ডাকা যাক ওটাকে।’

.

বাইরে গিয়েছিল টনি আর তাহিতি, শেষ বিকেলে কুপারদের বাড়ির ড্রাইভওয়েতে এসে থামল ওদের গাড়িটা। এ-বাড়িতে দ্বিতীয় দিন আজ ওদের।

নেমে এল ওরা গাড়ি থেকে।

কুপারদের স্টেশন ওয়াগেনটা নেই এখন পার্কিঙে।

এগোল তাহিতি বাড়ির দিকে।

গোলাঘরের দিকে পা বাড়াল টনি।

সদর দরজায় পৌঁছে টোকা দিল তাহিতি।

…কারও সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না বাড়িতে।

আরেকটু অপেক্ষা করল মহিলা। এর পর সিদ্ধান্ত নিল, ঢুকেই পড়বে ভিতরে।

খোলাই ছিল দরজাটা। হুড়কো দেয়া হয়নি ভিতর থেকে। ঠেলা দিয়ে পাল্লাটা খুলে ফেলল তাহিতি।

বাড়িটার সমস্ত বাতি নেভানো যদিও, জ্বলছে না অন্য কোনও আলোও, তার পরও দেখতে পেল ও রোজমেরিকে। হল-এর ওমাথায় বেরিয়ে আসছে সেলারের দরজা দিয়ে!

দেখে মনে হচ্ছে, কেমন একটা ঘোরের মধ্যে রয়েছে মহিলা। পা টেনে টেনে ঢুকে পড়ল রান্নাঘরে। টের পায়নি তাহিতির উপস্থিতি।

কিচেনের দরজায় এসে দাঁড়াল তাহিতি। ওর দিকে পিছন ফিরে কাউন্টারে কাজ করছে রোজমেরি কুপার।

‘মিসেস কুপার…’ ডাকল তাহিতি মৃদু কণ্ঠে।

ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াল রোজমেরি। একটা সেকেণ্ড যেন বেশি লেগে গেল মহিলার তাহিতিকে চিনতে।

‘…আগে আগে চলে এসেছেন, মনে হচ্ছে…’ মুখ খুলল সংবিৎ ফিরে পেয়ে।

‘বিশ্বাস হচ্ছে না, সেলারে নেমেছিলেন আপনি!’

‘সুপ বানাচ্ছি,’ সহজ গলায় বলল রোজমেরি। ‘ক’টা বিট (গাজর-জাতীয় কন্দ বিশেষ) আনার দরকার ছিল।’

কৈফিয়তটা মনঃপূত হলো না তাহিতির। কিন্তু আর কথা বাড়াল না এ নিয়ে।

সাতাশ

রাত নেমেছে।

কোথায় যেন গিয়েছিল, ফিরে এসেছে অ্যালবার্ট মেয়েদের নিয়ে। ড্রাইভওয়েতে উঠল ওর স্টেশন ওয়াগেনটা। হেডলাইটের আলো গিয়ে পড়ল ডায়েসদের পার্ক করা গাড়িটার গায়ে।

থামাল অ্যালবার্ট ওয়াগেনটা। ও আর মেয়েরা বেরিয়ে আসছে, নজরে পড়ল অ্যালবার্টের, দরজাটা খোলা গোলাঘরের। আলো জ্বলছে ভিতরে।

মেয়েরা বাড়ির দিকে রওনা হলে দেখতে চলল অ্যালবার্ট।

স্বস্তির শ্বাস ফেলল বার্নে পৌঁছে। পিকআপটা নিয়ে কাজ করছে টনি ডায়েস।

জ্যাকের সাহায্যে উঁচু করা হয়েছে গাড়ির সামনের দিকটা। বাড়তি সতর্কতা হিসেবে দু’টুকরো লাকড়ি ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে ফ্রন্ট-অ্যাক্সেলের নিচে।

‘খেয়াল করলাম, বিয়ারিঙের কাজটা শেষ করেননি আপনি,’ সাফাই গাইল টনি। ‘কিছু মনে করেননি, আশা করি… কাজটা ফেলে রাখতে ইচ্ছা করল না আরকী।’

‘না-না… অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। আপনি তো বরং উপকারই করলেন আমার।’

‘গ্রিজ আছে আর?’

‘হুম… দাঁড়ান, দিচ্ছি।’

ওয়ার্কবেঞ্চের দিকে হেঁটে গেল অ্যালবার্ট। একটা ক্যাবিনেট খুলল ও বেঞ্চের ঠিক উপরের। একটা ক্যান বের করে আনল তাক থেকে। মুখটা খুলতে খুলতে ফিরে এল আগের জায়গায়, টনি ডায়েসের হাতে দিল কৌটোটা।

‘থ্যাঙ্কস,’ বলল টনি।

কাঠের এক ক্রেট টেনে নিল অ্যালবার্ট পাশ থেকে। ওটায় বসে দেখতে লাগল ডায়েসের কাজকর্ম।

‘মেরির কাছে শুনলাম… আপনি নাকি যাজক হতে চেয়েছিলেন?’ একটু পরে জিজ্ঞেস করল অ্যালবার্ট।

ভাবল ডায়েস এক মুহূর্ত। আলাপ করবে কি না এ নিয়ে, চিন্তা করছে।

‘ইচ্ছা তো ছিল সেরকমই,’ মুখ খুলল অতঃপর। ‘কিন্তু অভিষেক-অনুষ্ঠানের সময় যত ঘনিয়ে এল, সন্দেহ জমতে শুরু করল মনে। একটা পর্যায়ে উপলব্ধি করলাম, দায়িত্বটা নেয়ার জন্য যথেষ্ট উপযুক্ত নই আমি। যতটা প্রয়োজন, ততটা মনের জোর নেই আমার। সুতরাং, পিছিয়ে আসি ওখান থেকে।’

ক’টা মুহূর্ত কেটে গেল চুপচাপ। তার পর বলল অ্যালবার্ট: ‘টাক না পড়া তক মাথার সব চুল ছিঁড়লেও বুঝতে পারব না আমি, কেন আপনি এ কাজ করছেন ওটার বদলে… এই সব ভূতপ্রেত নিয়ে…

‘মনে করে দেখুন তো, ছোট বেলায় এরকম কোনও ভয় কাজ করত কি না আপনার মনে… ভয় পেতেন কি না বিছানার পাশ দিয়ে হাত ঝুলিয়ে দিতে! কারণ, তখন আপনার মনে হতো, খাটের নিচ থেকে কিছু একটা বেরিয়ে এসে আঁকড়ে ধরবে হাত… ‘

সন্দিহানভাবে মাথা দোলাল অ্যালবার্ট।

‘ওয়েল… ঠিক তা-ই হয়েছিল আমার ক্ষেত্রে।‘

‘সরি?’

‘কিছু একটা খপ করে হাত চেপে ধরেছিল আমার।’

চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে অ্যালবার্ট, নির্বিকার চেহারায় বিয়ারিঙের উপর গ্রিজ ঢালল টনি।

‘টান দিয়ে মেঝেতে নামিয়ে এনেছিল আমাকে ওই জিনিস-টা। ওটা যে আসলে কী ছিল, বুঝতে পারিনি আমি। এত অন্ধকার ছিল বিছানার নিচটা!

‘…টান দিয়ে ছুটিয়ে আনলাম হাতটা। তার পর ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে পালালাম কামরা থেকে।

‘বাবা বিশ্বাস করেননি আমাকে। তিনি করলেন কী, টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে গেলেন আমাকে কামরাটায়। নিষ্ঠুরভাবে জানিয়ে দিলেন, অজানা ভয়টার মুখোমুখি হতে হবে – আমাকে। সোজা কথায়, জয় করতে হবে ভয়কে।

‘বিছানার চাদরের নিচে গুটিসুটি মেরে গোর দিলাম নিজেকে। ভয়ে, মনে হচ্ছিল, মারাই যাব। তখনও খাটের নিচে আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি ওটার। তার পর মনে পড়ল আমার, একবার এক নান কী বলেছিল আমাকে। সকলের

তরে সর্বত্র বিরাজমান ঈশ্বর। তিনিই তোমার রক্ষাকর্তা।

‘নাইটস্ট্যাণ্ড থেকে তুলে নিলাম রডম্যান ক্রোকেট চাকুটা। বিছানা থেকে নেমে এসে উঁকি দিলাম খাটের তলে। চিৎকার করে শাসালাম, যা-ই থাকুক না কেন ভিতরে, এক্ষুনি যদি চলে না যায়, লাথি মেরে তাড়াবেন ওটাকে খোদা। বার বার বলতে লাগলাম কথাগুলো। শেষ পর্যন্ত চলে গেল ওটা, চিরতরে। কখনোই ফিরে আসেনি আর।’

ফিরে তাকাল টনি অ্যালবার্টের দিকে।

‘সঠিক কাজটাই করেছিলেন বাবা আমার জন্য, জীবনের সেরা শিক্ষাটা দিয়েছিলেন আমাকে। এর পর থেকে বিশ্বাস রাখতে শুরু করলাম সৃষ্টিকর্তার উপরে… প্রতিটি দিন… প্রতিটি মুহূর্তে। আর… আরেকটা কাজ করছি তখন থেকে আজ অবধি… তলাটা পরীক্ষা করছি খাটের।’

হাতের কাজ শেষ হয়েছে টনির। ঢাকনা লাগিয়ে দিল ও বিয়ারিঙের।

নুড়ির উপরে টায়ারের মড়মড় আওয়াজ কানে এল ওদের।

দেখার জন্য বাইরে বেরোল অ্যালবার্ট।

মাইকেলের ভ্যানটা নিয়ে বাইরে থেকে ফিরে এসেছে ও আর পিটার।

আটাশ

কফিমগ হাতে কিচেনে ঢুকল পিটার। হাই তুলল ক্লান্তিতে।

তিনটা বেজে দশ মিনিট দেখাচ্ছে কাউন্টারের ঘড়িটা। আরেক মগ কফি নিল ও পট থেকে। ফ্রিজের সবচেয়ে উপরের তাকটা থেকে বের করল দুধের কার্টনটা। রাখল ওটা মগটার পাশে। এবারে ঘুরল সিঙ্কের উপরের তাকটার দিকে। চিনি নেবে। কিন্তু যেই না বাড়াতে গেছে হাত-

জোরাল এক প্রতিধ্বনি হলো দড়াম্‌ম্‌ম্‌ করে।

লাটিমের মতো বোঁ করে ঘুরে গেল পিটার পারকার।

খোলাই ছিল ফ্রিজের দরজাটা ওর পিছনে, বন্ধ এখন!

একই সঙ্গে বিস্মিত আর বিভ্রান্ত দেখাল অফিসার পারকারকে। কারণ, ও ছাড়া দ্বিতীয় কোনও প্রাণী নেই রান্নাঘরে!

এবার আবিষ্কার করল, কার্টুনটা উধাও হয়ে গেছে মগের পাশ থেকে!

টপ…. টপ… টপ… টপ করে একটা আওয়াজ পুনরায় মনোযোগ ফেরাতে বাধ্য করল ফ্রিজটার দিকে।

বন্ধ ফ্রিজ চুইয়ে মেঝেতে নামছে দুধের ধারা!

কম্পিত পায়ে এগিয়ে গেল অফিসার। দ্বিধা করল একটা মুহূর্ত। তার পর এক টানে খুলে ফেলল ফ্রিজের দরজা।

টপ-শেলফে ফিরে এসেছে কার্টুনটা!

কিন্তু পুরোপুরি ভচকে গেছে ওটা! ছলকে পড়ে একাকার ভিতরের শুভ্র তরল।

ঊনত্রিশ

ঝড়ের বেগে লিভিং রুমে প্রবেশ করল পিটার। তাকাল ওখানে উপস্থিত টনি, তাহিতি, রোজমেরি আর অ্যালবার্টের দিকে। সোফায় বসে ছিল ওরা; অফিসারের হাবভাব আর চেহারার অভিব্যক্তি দেখেই বুঝতে পারল, কিছু একটা ভজকট হয়েছে। মাইকেলও চোখ তুলে তাকাল মনিটর থেকে।

‘ক্-কিছু একটা… কিছু একটা ঘোরাফেরা করছে রান্নাঘরে!’ হড়বড় করে বলল পিটার পারকার। ‘ইধার কা মাল উধার করে দিচ্ছে!’

.

তাহিতি, টনি আর মাইকেলের পিছন পিছন ফের কিচেনে এসে হাজির হলো পিটার। আপনা-আপনি চোখ চলে গেল ওর ফ্রিজের দিকে

দুধ আর চোয়াচ্ছে না ওখান থেকে!

সত্যি বলতে, এক ফোঁটা দুধ পর্যন্ত পড়ে নেই মেঝেতে!

সাঁত করে পিটারের দৃষ্টি সরে গেল কাউন্টারের দিকে।

কফিমগটার পাশেই দুধের ওই কার্টনটা, ঠিক যেখানে রেখেছিল ওটা পুলিস অফিসার!

‘কসম কেটে বলছি,’ বলল লোকটা মরিয়ার মতো। ‘মোটেই ছিল না ওখানে কার্টনটা। ওটা ছিল ফ্রিজের মধ্যে… পুরোপুরি ভচকানো অবস্থায়… দুধ ছড়িয়ে যা-তা অবস্থা!’

মজা পেয়ে গেছে মাইকেল। চটাস করে চুটকি বাজিয়ে বলল, ‘সম্ভবত চূড়ান্ত কিছু শুরু করার আগে খসড়া এটা। …এই তো চাই!’

জবাবে কী বলবে, ভেবে পেল না অফিসার।

টনি আর মাইকেল বেরিয়ে যাচ্ছে কিচেন থেকে, পিছন পিছন তাহিতিও, আলতোভাবে মহিলার কাঁধ স্পর্শ করে থামাল ওকে পারকার।

বুকে হাত বেঁধে ঘুরে দাঁড়াল তাহিতি।

‘একটা সেকেণ্ড কথা বলতে পারি আপনার সঙ্গে?’ বলল অফিসার কাতর গলায়।

‘শিয়োর।’

অন্যরা দূরে না যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করল পিটার। তার পর শুরু করল:

বেসবলের ব্যাপারে ঠিকই বলেছিলেন আপনি! ওই P আর C হচ্ছে ফিল কলিনস। আমার যখন দশ বছর বয়স, ওয়ার্ল্ড সিরিজ দেখাতে নিয়ে গিয়েছিল আমাকে বাবা—খেলাটা ছিল ইয়াঙ্কি আর ডজারদের মধ্যে। মাঠের বাম ধারে বসেছিলাম আমরা, টিকেটের দাম ছিল দুই ডলার। হিট করেই জয়সূচক রান নিচ্ছে কলিনস, বাবা ধরে ফেলে বলটা, ধরেই তুলে দেয় আমার হাতে। জীবনের শ্রেষ্ঠ স্মরণীয় দিন ছিল সেটা!’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *