অদেখা ভুবন – ১.৩৫

পঁয়ত্রিশ

মৃদু একটা ক্লিঙ্ক আওয়াজের সঙ্গে পড়ে গেল বসার ঘরের ম্যান্টলে রাখা ক্রুশটা।

দ্বিতীয় আরেকটা ক্রুশ খসে পড়ল গ্র্যাণ্ডফাদার ক্লকের উপর থেকে। কারপেটের উপর পড়ায় শব্দ হলো না তেমন।

কফি-টেবিলের উপর দাঁড় করানো তৃতীয় ক্রুশটাও শামিল হলো আগের দুটোর সঙ্গে।

পর পর আওয়াজগুলো নাড়িয়ে দিল পারকারকে। তক্ষুনি ঘুম জড়ানো, মৃদু স্বর শোনা গেল সিনথিয়ার।

‘আপু, থামো বলছি!’

ছোট্ট মেয়েটার দিকে দৃষ্টি চলে গেল পারকারের।

যদিও আধো-ঘুমন্ত মেয়েটা, ঘুমের মধ্যেই ধরে নিয়েছে, চুল ধরে উত্ত্যক্ত করছে ওর বড় বোন।

বিরাট একটা ধাক্কা খেল পিটার সেদিকে তাকিয়ে।

নিজ থেকেই খাড়া হয়ে যাচ্ছে সিনথিয়ার চুলের গোছা!

ধীরে, সাবধানে হাতের কাছের ক্যামেরাটা তুলে নিল পিটার প্রমাণ সংগ্রহ করবে বলে।

.

চোখ না খুলেই পিছনে হাত চালাল সিনথিয়া। বিরক্তির সঙ্গে থাবড়া মারল এমন কিছুর গায়ে, যেটা আসলে অদৃশ্য। এখনও শূন্যে খাড়া হয়ে রয়েছে মেয়েটার লম্বা চুলগুলো।

‘বললাম না থামতে!’ আবারও বিরক্তি ওগরাল সিলভিয়ার ছোট বোনটা।

এবার চোখ জোড়াও খুলে গেল সিনথিয়ার। পিছনে তাকিয়ে কাউকেই দেখতে পেল না ও অবাক বিস্ময়ে। অথচ কীসে যেন হ্যাঁচকা টান দিল চুলে!

এমন আক্রমণাত্মকভাবে চুল টেনেছে যে, ছিটকে সোফা থেকে পপাত ধরণীতল হলো মেয়েটা। চিৎকার দিল গলা ফাটিয়ে।

সারাটা মেঝের উপর দিয়ে নির্দয়ভাবে ছেঁচড়ে নিয়ে চলল ওকে অদৃশ্য জিনিসটা!

ভিডিয়ো করা বন্ধ করে দিয়ে সোফায় ছুঁড়ে ফেলল পিটার ক্যামেরাটা, যদিও চালু রয়েছে যন্ত্রটা। ত্বরিত এগোল সিনথিয়ার দিকে, শক্ত হাতে পাকড়াও করল মেয়েটাকে।

কিন্তু যে জিনিসটা চুল ধরে রয়েছে বাচ্চাটার, সেটা এতই শক্তিশালী যে, সিনথিয়াকে রক্ষা করার চেষ্টা করছে পিটার—এ অবস্থায় ওদের দু’জনকে সুদ্ধই টেনে নিয়ে চলল। পিটারের শরীরের নিচে ঢাকা পড়ে আছে মেয়েটি; একবার এদিকে, আরেক বার ওদিকে গড়াতে লাগল দেহ দুটো। এক পর্যায়ে ধাম করে গিয়ে বাড়ি খেল কফি-টেবিলটার গায়ে।

পিটারের উপর দিয়েই গেল মূলত জোরাল আঘাতটা। প্রতিক্রিয়ায় মড়মড় করে উঠল কাঠের জোড়া।

ঝড়ো গতিতে ছুটে এল টনি আর তাহিতি। পিটারের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল টনি, আপ্রাণ চেষ্টা করছে এক জায়গায় ধরে রাখতে দু’জনকে। কাজ হচ্ছে না তেমন।

চলতে লাগল টাগ অভ ওয়ার। বুনো আতঙ্কে বিস্ফারিত সিনথিয়ার চোখের দৃষ্টি। চিৎকার

করে চলেছে হিসটিরিয়াগ্রস্তের মতো। ব্যথায় যেন আগুন ধরে গেছে মাথার তালুতে। পানি গড়াচ্ছে চোখ ফেটে।

মেয়েদের বাবাও ছুটে এসে হাজির হলো ঘটনাস্থলে। তার পিছনে রোজমেরি। মহিলাকে দেখে মনে হচ্ছে—যেরকম প্রতিক্রিয়া হওয়ার কথা, ততটা হয়নি যেন।

‘হায়, ঈশ্বর!’ আঁতকে উঠল অ্যালবার্ট।

আবার বাড়ি খেল পিটার, এবারে সোফার কোনায়। মেঝের উপর দিয়ে চার ফুট আন্দাজ সরে গেল সোফাটা। আবার ওদেরকে হিঁচড়ে নিয়ে চলেছে অদৃশ্য আতঙ্ক।

অ্যালবার্টও ঝাঁপিয়ে পড়ে প্রবৃত্ত হলো ওটাকে ঠেকাতে। এমনভাবে টান টান হয়ে আছে সিনথিয়ার চুলগুলো, উপড়ে আসবে যেন চাঁদি থেকে।

সেটা আর হলো না…

একটা আওয়াজ হলো হুশ করে।

নায়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে এক জোড়া কাঁচি। কুট করে কেটে দিয়েছে চুলের গোছাটা। সঙ্গে সঙ্গে টান ছুটে গেল চুল থেকে।

পিটার আর সিনথিয়ার উপরে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে রয়েছে তাহিতি, ওর হাতেই শোভা পাচ্ছে কাঁচিটা।

দেরি না করে বুকে টেনে নিল মেয়েকে অ্যালবার্ট।

আহত, বিপর্যস্ত পিটারের দিকে তাকিয়ে আছে টনি। কপালের একটা কাটা থেকে রক্ত ঝরছে অফিসারের।

‘ঠিক আছেন তো আপনি?’ হাস্যকর শোনাল টনির প্রশ্নটা।

‘অস্ত্রধারী বডিগার্ড রাখার চিন্তা চলছে এই মুহূর্তে,’ তেতো স্বরে রসিকতা করল পিটার।

ক্যামেরার আলোর দিকে চোখ পড়ল টনির।

‘ভিডিয়ো করছিলেন নাকি?’ জিজ্ঞেস করল ও।

হতচকিত অফিসার মাথা ঝাঁকাল নীরবে।

ছত্রিশ

সকালের প্রথম আলো উঁকি দিচ্ছে দিগন্ত থেকে।

কুপারদের বাড়ির সামনে দাঁড় করানো স্টেশন ওয়াগেনটার পিছনদিকে রওনা হয়েছে টনি আর অ্যালবার্ট। দুটো করে ছোট সুটকেস বইছে দু’জনে।

‘ফুটেজটা ডেভেলপ করাতে যাচ্ছি আমরা,’ বলল টনি। ‘চার্চের সামনে উপস্থাপন করব এগুলো প্রমাণ হিসেবে। ভালো মতন একটা ঝাড়ফুঁক দরকার বাড়িটার… যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।’

গাড়ির ব্যাক-ডালা খুলল অ্যালবার্ট।

‘হোটেলের ভাড়া কিন্তু পরিশোধ করতে হবে আপনাদেরকেই!’ বলল কাঁচুমাচু হয়ে। ‘হাতে কোনও টাকাপয়সা নেই আমাদের।’

‘এখন এসব নিয়ে চিন্তা না করি!’

অন্তরের গভীর থেকে কৃতজ্ঞতা ফুটে বেরোল মিস্টার কুপারের। ভিতরে রেখে দিল সে সুটকেস দুটো।

‘কবে নাগাদ বাড়ি ঝাড়ার জন্য লোক আনতে পারবেন বলে মনে করেন?’ জিজ্ঞেস করল টনিকে।

‘দু’-চার দিনের বেশি লাগার কথা নয়। …কিন্তু শুনুন…’

ব্যগ্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল অ্যালবার্ট।

‘আমরা না বলা পর্যন্ত ফেরা চলবে না এই বাড়িতে, ‘ সতর্ক করল টনি। ‘কোনও অবস্থাতেই না!’

.

বসার ঘর থেকে বেরিয়ে কুপারদের বাড়ির সিঁড়ির দিকে চলল তাহিতি। পিছনে কাজে ব্যস্ত পিটার আর মাইকেল; খুলে, গুটিয়ে নেয়া হচ্ছে যন্ত্রপাতিগুলো।

দুই বোনের উদ্দেশে এগিয়ে যাচ্ছে মহিলা। সিঁড়ির গোড়ায়, বড় বোনের কোলে বসে রয়েছে সিনথিয়া। ভয়াবহ যে অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে ওকে, শারীরিক ও মানসিক সেই আঘাতের ধকল এখনও মোছেনি মেয়েটির চেহারা থেকে।

বাচ্চাটির কষ্ট দেখে ভিতরটা দুমড়ে গেল তাহিতির।

‘সব ঠিক হয়ে যাবে, বাচ্চারা,’ সান্ত্বনা দিল দু’জনকে। ‘কিছুই আর ব্যথা দিতে পারবে না তোমাদেরকে। প্রমিজ করছি।’

উঠে দাঁড়াল সিনথিয়া। অপ্রত্যাশিতভাবে আলিঙ্গন করল তাহিতিকে। দৃঢ়, দীর্ঘ আলিঙ্গন।

মহিলাকেই প্রথমে উদ্যোগী হতে হলো আলিঙ্গনমুক্ত হওয়ার জন্য। আরও কয়েক সেকেণ্ড তবু সেঁটে রইল মেয়েটা সহানুভূতিশীল তাহিতির শরীরের সঙ্গে।

‘তোমার মা কি উপরে?’ সিলভিয়ার দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করল তাহিতি।

‘না, কিচেনে।’

কিচেনের দিকে রওনা হলো তাহিতি। দরজা দিয়ে উঁকি দিল ভিতরে।

না, নেই কেউ।

চোখে পড়ল, পিছনের দরজাটা খোলা।

এবার পা বাড়াল সেদিকে। ব্যাক-পোর্চে বেরিয়ে এল ও পিছন দরজাটা দিয়ে। এক ঝলকের জন্য দেখতে পেয়েছে রোজমেরিকে। ঢুকে পড়েছে মহিলা গোলাবাড়িটার পিছনের জঙ্গলে।

.

জঙ্গলের ভিতর দিয়ে পথ করে এগোচ্ছে তাহিতি, আদতে যে পথটা ধরে গিয়েছিল এর আগে, প্রয়াস পাচ্ছে সে-পথ খোঁজার। ফাঁকা জায়গাটার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে দেখতে পেল, কবরখানার দেয়ালের উপরে বসে রয়েছে রোজমেরি ওর দিকে পিছন ফিরে। মাথার উপরের পাতার চাঁদোয়ার ফাঁকফোকর দিয়ে নেমে আসছে আলোর বর্শা। ত

‘মিসেস কুপার…!’ ডাকল তাহিতি।

তাকাল না রোজমেরি।

ধীর কদমে এগিয়ে গেল তাহিতি।

‘আর ইউ ওকে?’ জিজ্ঞেস করল আবার।

কাছিয়ে যেতে যেতে বোঝা মুশকিল হলো ওর, রোদ আর ছায়া বিভ্রম সৃষ্টি করছে কি না। কারণ, মিসেস কুপারকে পাশ থেকে দেখে বিজাতীয় অনুভূতি জাগছে তাহিতির মনে। ওটা যেন রোজমেরি নয়, অন্য কোনও মানুষ…

আস্তে করে মাথাটা ঘোরাল, মহিলা তাহিতির দিকে।

নাহ, কই! হাঁপ ছাড়ল তাহিতি। ঠিকই তো মনে হচ্ছে সব কিছু। তার পরও…

রোজমেরির দৃষ্টি যেন এই জগতে নেই। তাকিয়ে রয়েছে সুদূরে।

‘হ্যাঁ…?’ মুখ খুলল দূরাগত কণ্ঠস্বরে।

‘কী করছেন এখানে?’ লক্ষ করল তাহিতি, গুপ্ত কামরায় দেখা সুন্দর-দেখতে-খেলনাটা মুঠোয় ধরে রেখেছে রোজমেরি!

.

গ্রাম্য রাস্তা ধরে প্লিমাথ চালাচ্ছে টনি ডায়েস।

‘…মহিলা বলছেন, এমনিই নাকি গিয়েছিলেন ওখানে, ‘ বলছে পাশে বসা তাহিতি। ‘সুন্দর একটা খেলনা ছিল ওঁর হাতে, যেটা আমি দেখেছিলাম গোপন ওই কামরায়।’ থামল মেয়েটি। ‘…যদ্দূর বুঝতে পারছি, খুব একটা সহজ হবে না চার্চকে রাজি করানো।

বাঙ্কার হিল ব্রিজ ধরে ডাউনটাউন বস্টনে প্রবেশ করল প্লিমাথটা। গন্তব্য: হলি ক্রস ক্যাথিড্রাল।

বিশাল বড় এক সম্ভ্রম জাগানিয়া পাথরের-স্থাপনার সামনে পার্ক করাল গাড়িটা টনি। চোখা চুড়ো বাড়িটার। রঙিন কাচ জানালা-দরজায়। .

স্বামী-স্ত্রী গাড়ি থেকে নেমে আসতেই অল্প বয়সী, মোলায়েম এক কিন্নর কণ্ঠীর গান ভেসে এল কানে চার্চের খোলা দরজা দিয়ে।

শুনতে শুনতে দরজামুখী পাথরের সিঁড়ির দিকে এগোল টনি আর তাহিতি। সোজা প্রবেশ করল ভিতরে।

চার্চ-হলের বিশালত্বের তুলনায় নিজেদের খুবই ক্ষুদ্র মনে হচ্ছে ওদের। মাঝের আইলটা বিভক্ত করেছে বিপুল সংখ্যক বেঞ্চির সারি দুটোকে।

সামনে রিহার্সাল চলছে। ভক্তি ভরে গেয়ে চলেছে অল্প বয়সী এক ছেলে। এরই গলা শুনতে পাচ্ছিল ওরা বাইরে থেকে।

এক পাশে দাঁড়িয়ে আছেন গায়কদের নির্দেশক। ওদের পিছনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রয়েছে বাকি ছেলেগুলো।

পবিত্র জল ভরা মারবেল পাথরের বাটিতে আঙুলের ডগা ডোবাল টনি। নীরব প্রার্থনা সেরে নিয়ে ক্রুশ আঁকল নিজের বুকে।

একই কাজ করল তাহিতিও।

ফাদার ফ্রিম্যান এগিয়ে এলেন ওদের দিকে। সাদর সম্ভাষণ জানালেন উষ্ণ হেসে।

‘দেখা যাক, কী পেয়েছেন আপনারা,’ বললেন তিনি সহজ গলায়।

.

মরগান ফ্রিম্যানের অফিসে বসে রয়েছে ওরা। ডেস্কের উপর রাখা টনির টেপ রেকর্ডারটা।

অন্ধকার হয়ে রয়েছে কামরাটা। জানালার শার্সির উপর দিয়ে টেনে দেয়া হয়েছে ভারি পরদা।

পাশে রাখা প্রজেক্টরটা বন্ধ করে দিলেন ফ্রিম্যান। দেয়ালে টানানো সাদা পরদার উপর রেকর্ড করা দৃশ্যগুলো ফুটিয়ে তুলছিল ওটা এতক্ষণ।

তাকিয়ে রয়েছে ওরা ফাদারের প্রতিক্রিয়া জানার জন্য। কিছুটা কিংকর্তব্যবিমূঢ় দেখাচ্ছে নিপাট ভালো মানুষটিকে।

‘…নাহ!’ মুখ খুললেন অবশেষে। ‘ছেলেখেলা নয় ব্যাপারটা। সরাসরি আর্চবিশপের গোচরে আনতে যাচ্ছি আমি এটা…’

.

সন্ধ্যা নেমেছে।

নিজেদের বাড়ির সদর দরজায় গাড়ি থেকে নেমে এল টনি আর তাহিতি।

ওদের সাড়া পেয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এল এমিলি।

ছুটে গেল তাহিতি মেয়ের দিকে। বাজ পাখির মতো ছোঁ মেরে কোলে তুলে নিল এমিলিকে।

নাতনির পিছনে বেরিয়ে এসেছেন মহিলার শাশুড়ি।

.

ছ’দিন পরের কথা।

লাঞ্চের জন্য ভিড় জমেছে রেস্তোরাঁটায়।

লাইনোলিয়াম কাউন্টারের টুলে বসে আহার সারছে সিলভিয়া-সিনথিয়া। বব ডিলান-এর থ্রি এঞ্জেলস বাজছে ব্যাকগ্রাউণ্ডে।

কাউন্টারের বিপরীতে, কথা শোনা যায় না—এমন দূরত্বে একটা বুথে বসেছে মেয়েদের বাবা অ্যালবার্ট কুপার। সঙ্গে টনি আর তাহিতি। গভীর দুশ্চিন্তার ছায়া ওদের চেহারায়।

‘….আপনি কিন্তু বলেছিলেন—অল্প কিছু দিনের ব্যাপার এটা!’ খেদ ঝাড়ল অ্যালবার্ট।

‘বুঝতে পারছি না, কেন এত সময় লাগছে!’ অসহায় দেখাল টনিকে। ‘ফাদার ফ্রিম্যান বলছেন, ভ্যাটিকান থেকে ধৈর্য ধরার জন্য বলা হচ্ছে ওঁকে। তবে আমি কিন্তু আর অপেক্ষা করছি না। কালই নিউ ইয়র্ক যাচ্ছি আমি। দেখি, ফাদার পেরেজ যদি এ ব্যাপারে কিছু আলোকপাত করতে পারেন। উচ্চ পর্যায়ের কারডিনাল তিনি। আগেও কাজ করেছি ওঁর সাথে। ভালো করেই চেনেন তিনি আর্চবিশপকে।’

‘আসলে দুশ্চিন্তাটা স্রেফ মেরির জন্য।’ মরিয়া দৃষ্টি ফুটে উঠল অ্যালবার্টের দুই চোখে। ‘দেখেশুনে মনে হচ্ছে—এসব আর নিতে পারছে না ও। হারিয়ে গেছে কোথায় যেন। স্নান করছে না, সাজগোজ করছে না, ঘুমাচ্ছে পর্যন্ত না বলতে গেলে। আর… কোথায় কোথায় যেন উধাও হয়ে যাচ্ছে ঘণ্টা কয়েকের জন্য।’

.

সে-মুহূর্তে ক্যারেন স্কালির দোকানে রয়েছে রোজমেরি। কেনার জন্য এক সেট উল বোনার কাঁটা রাখল কাউন্টারে।

মহিলার উস্কখুস্ক চেহারাটা অস্বস্তি জাগাচ্ছে ক্যাশ রেজিস্টারে থাকা ম্যাণ্ডির মধ্যে।

‘শুধু কি কাঁটাই কিনবেন, হাসির ভঙ্গি করে বলল স্কালির ভাতিজি। ‘উল নেবেন না বোনার জন্য?’

ডাইনে-বাঁয়ে ঘাড় নাড়ল মহিলা।

সাঁইত্রিশ

পরদিন।

সেইণ্ট প্যাট্রিক’স ক্যাথিড্রাল।

নিউ ইয়র্ক সিটি।

পাথরে গড়া, চোখ জুড়ানো, প্রকাণ্ড সব গির্জার সমাহার এখানে। রং-বেরঙের কাচগুলো দৃষ্টিনন্দন করে তুলেছে ওগুলোকে।

কোণের একটা ফোনবুথে রয়েছে টনি, কানে চেপে ধরে আছে রিসিভার।

‘ফাদার পেরেজ সরাসরি যোগাযোগ করেছিলেন ভ্যাটিকানের সাথে,’ বলছে টনি। ‘ওরা ওঁকে বলেছে, আর্চবিশপ পালন করতে পারতেন আনুষ্ঠানিকতাগুলো। কিন্তু এখানে কিছু ব্যাপার আছে…’

‘কী ধরনের ব্যাপার?’ বলল তাহিতি ওপাশ থেকে। ‘কী বলতে চাইছে ওরা?’

‘ঠিক বলতে পারলেন না ফাদার। ওরা কিছু ভেঙে বলেনি।’

‘…এখন তা হলে করণীয় কী?’

‘বুঝতে পারছি না। আপাতত বাড়ি ফিরছি আমি। মাঝরাত পেরিয়ে যাবে ফিরতে ফিরতে।’

‘ঠিক আছে। সাবধানে থেকো। লাভ ইউ, টনি।’

‘লাভ ইউ, টু।’

.

ফোন বাজছে।

কিচেনে ঢুকে রিসিভার তুলল তাহিতি।

‘হ্যালো? …হাই! কী খবর, মাইকেল?’

কলিং বেলটা বেজে উঠল এ সময়।

রিসিভারের মাউথপিসে হাত চাপা দিল তাহিতি। মেয়ের উদ্দেশে বলল গলা তুলে: ‘দেখো তো, মামণি, কে এল! ফোনে কথা বলছি আমি।’

সিঁড়ি দিয়ে নামছিল এমিলি। সে-ও চেঁচাল: ‘যাচ্ছি, মা!’

ফিটফাট বাদামি ইউনিফর্ম পরা ইউনাইটেড পারসেল সার্ভিসের ডেলিভারি ম্যান দাঁড়িয়ে দরজায়। স্বাভাবিকের তুলনায় বড় একটা ম্যানিলা খাম লোকটার হাতে।

‘হাই,’ বলল এমিলি।

‘হ্যালো,’ বলল বাদামি ইউনিফর্ম সহাস্যে। ‘কেমন আছ?’

‘ভালো। আপনি?’

‘আমিও ভালো। আ… ডায়েস পরিবারের কেউ হও তুমি?’

‘হ্যাঁ।’

‘বেশ। এটা তা হলে তোমাদের।’ ম্যানিলা খামটা এমিলিকে হস্তান্তর করল লোকটা। ‘হ্যাভ আ নাইস ডে।’

‘থ্যাঙ্ক ইউ।’

দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে কিচেনের দরজায় এসে দাঁড়াল এমিলি। ওর মা তখনও কথা বলছে ফোনে।

….এদিকে মাথা-খারাপ অবস্থা টনির,’ বলতে বলতে তাকাল তাহিতি মেয়ের দিকে। এমিলি এগিয়ে এলে খামটা হাতে নিয়ে পড়ল ও রিটার্ন অ্যাড্রেসটা।

হ্যারিসভিল থেকে এসেছে ওটা, প্রেরকের নাম: ক্যারেন স্কালি।

ছোট এক ঝুড়ি তুলে নিল এমিলি কাউন্টার থেকে। মায়ের দিকে তাকিয়ে নিচু কণ্ঠে বলল, ‘ক’টা ডিম নিয়ে আসি, মা?’

আবারও মাউথপিস চাপা দিল তাহিতি। ‘খুব ভালো হয় তা হলে।’

পিছন-দরজার দিকে রওনা হলো মেয়েটা।

.

‘গারফিল্ড… ইসাবেলা… ডলি…’ খোঁয়াড়ের কাছাকাছি হতে নাম ধরে’ ডাকতে লাগল মেয়েটা। একটু পরে দরজা খুলে পা রাখল ভিতরে। অবাক হয়ে দেখল, মুরগির একটা ছানা ও বেরিয়ে পড়েনি খোপ থেকে, বরাবরই যেটা হয়ে আসছে।

কিছু একটা দৃষ্টি আকর্ষণ করল এমিলির। ধুলোময়লার মধ্যে পড়ে আছে ওটা পায়ের কাছে।

ভালো করে দেখার জন্য নিচু হলো এমিলি।

কুপারদের বাড়ির ওই খেলনাটা! আধাআধি বেরিয়ে রয়েছে মাটি থেকে।

জিনিসটা তুলে নিল এমিলি। উল্টেপাল্টে দেখে নিয়ে রেখে দিল ঝুড়িটার মধ্যে। এগিয়ে যাচ্ছে খোপটার দিকে।

আশ্চর্য ব্যাপার! একটুও চেঁচামেচি করছে না মুরগিগুলো।

‘গারফিল্ড… ইসাবেলা… ডলি… কোথায় তোরা?’ বলতে বলতে হুড়কো খুলল ও দরজার। মেলে ধরল পাল্লাটা।  

ভিতরটা অন্ধকার।

ঘাড় নিচু করে চোখ সইয়ে নেয়ার চেষ্টা করছে, টে পেল না, খোঁয়াড়ের দরজাটা ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে য পিছনে!

.

কিচেনের জানালা দিয়ে এমিলিকে দেখতে পাচ্ছে তাহিতি।

….ঠিক আছে। কিছু পেলে জানাব তোমাকে।’ আলাপের শেষ পর্যায়ে পৌঁছে গেছে মহিলা। ‘আন্টিকে আদাব দিয়ো আমার।’

কথা শেষ করে রাখতে গেছে রিসিভারটা, ছোট্ট মেয়েটার রক্ত জমাট করা চিৎকার উদগীরিত হলো হেনহাউস থেকে।

.

সারা শরীর কাঠ হয়ে গেছে তাহিতির। কিন্তু সে মুহূর্তকালের জন্য। এক দৌড়ে কিচেন থেকে বেরিয়েই ছুটল মহিলা ব্যাক- ইয়ার্ডের দিকে।

পা যেন মাটিতে নেই তাহিতির। সুপারম্যানের মতো হাওয়ায় উড়ে পৌঁছে গেল ও খোঁয়াড়টার কাছে।

‘এমিলিইইই!’ বুক চিরে বেরিয়ে এল চিৎকার।

না… সাড়াশব্দ নেই মেয়েটার!

মহিলার মনে হলো, এই নীরবতা যেন খুন করছে ওকে।

‘এমিলি!’ খোঁয়াড়ে ঢুকে ডাকল ফের তাহিতি।

জবাব নেই এবারও। নেইও কেউ ওখানে।

অস্থির আশঙ্কায় মুরগির খোপের দিকে ছুট লাগাল মহিলা।

‘কোথায় তুমি, মামণি? কথা বলো… কথা বলো, মামণি!’

বলার সঙ্গে সঙ্গে খোপের দরজাটা খোলার চেষ্টা করছে তাহিতি। কিন্তু এক চুলও নড়ছে না ওটা!

সব রকমভাবেই চেষ্টা করল এমিলির মা। টানতে লাগল, যত জোরে সম্ভব। শেষমেশ যেন হাল ছেড়ে দিয়ে পরাস্ত হলো দরজাটা। একদম হঠাৎ করেই!

সাঁত করে পাল্লাটা খুলে যেতেই বাতাসের একটা ঝাপটা লাগল তাহিতির চোখেমুখে। মাথাটা নিচু করে উঁকি দিল ও ভিতরে।

খোদা! আছে মেয়েটা!

হাঁটুতে ভর দিয়ে মেয়েটাকে বসে থাকতে দেখল তাহিতি খোপের ভিতর, মুখ করে রয়েছে উল্টো দিকে। ধীরে ধীরে মুখ ঘোরাল এমিলি মায়ের দিকে। দু’গাল বেয়ে গড়িয়ে নামছে পানি।

এবারে লক্ষ করল তাহিতি। দু’হাতের তালুতে একটা মুরগি ছানা ধরে রেখেছে এমিলি। নড়ছে না বাচ্চাটা।

‘গারফিল্ডটা মরে গেছে, আম্মু!’ কান্নাভেজা স্বরে বলল তাহিতির মেয়ে। ‘সবগুলোই!’

সবগুলোই!

এতক্ষণে খেয়াল হলো মহিলার, অস্বাভাবিক নীরব হয়ে আছে খোঁয়াড়টা।

মেয়ের উপর থেকে দৃষ্টি সরে গেল তাহিতির। তাকিয়ে দেখছে চারদিকে।

ঠিকই বলেছে এমিলি। মরা মুরগির ছানা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে সবখানে। বিদঘুটে ভঙ্গিতে বেঁকে রয়েছে সব ক’টার ঘাড়!

এমিলির পাশে রাখা ঝুড়িতে পরিচিত খেলনাটা চোখে পড়তেই কীসে যেন খামচে ধরল তাহিতির কলজেটা।

কোথায় পেলে ওটা?’ কম্পিত, কিন্তু শাসনের সুরে জানতে চাইল।

জল ভরা চোখে মায়ের দৃষ্টি অনুসরণ করল ছোট্ট খুকি।

‘…এখানেই,’ উত্তর করল। ‘পড়ে ছিল মাটিতে।’ মেয়েকে নিয়ে বাড়ির ভিতর ঢুকল তাহিতি। ট্র্যাশক্যানে ফেলে দিল খেলনাটা।

আটত্রিশ

রাতের বেলা।

চার কোনায় চারটে খুঁটি আর শিফনের চাঁদোয়াঅলা বিছানার কিনারায় বসে রয়েছে মা-মেয়ে। শেষ হয়ে এল বলে মেয়ের চুলে বেণি করার কাজটা।

ঘুমানোর জন্য পাজামা পরেছে এমিলি। কেমন যেন গুম মেরে রয়েছে বাচ্চাটা, যা ঠিক স্বাভাবিক নয়। বুঝতেই তো পারছেন, কেন।

‘বলেছ নাকি আব্বুকে ফোন করে?’ জিজ্ঞেস করল মেয়েটা।

তোমার আব্বু এখন রাস্তায় রয়েছে, মামণি,’ নরম গলায় বলল তাহিতি। ‘এলে পরে বলব সব।’

.

এক ফালি চাঁদের আলো ঢুকেছে জানালার কাচ ভেদ করে, ঘুমন্ত তাহিতির মুখের উপর বিছিয়ে রয়েছে আলোটা।

ঝট করে খুলে গেল মহিলার চোখ দুটো। চমকে গেছে আত্মা।

তাকাল তাহিতি মেয়ের মুখের দিকে।

ঘুমের ঘোরে প্রলাপ বকছে মেয়েটা।

‘… সরি, মা!… সরি, মা!’

শব্দগুলো বরফজল ঢেলে দিল তাহিতির হাড়ের মধ্যে। মৃদু ঠেলা দিল ও মেয়েকে।

‘এমিলি!’

জাগল না বাচ্চাটা। বলে চলেছে তখনও

‘…সরি, মা! … সরি, মা!’

‘মামণি…’ মেয়ের গা ধরে ঝাঁকুনি দিল তাহিতি আরেকটু জোরে।

ফলাফল: ‘ পাশ ফিরে শুল এবার বাচ্চাটা। অস্পষ্ট শোনাচ্ছে এখন গলার স্বর।

সময় নিয়ে উঠে বসল তাহিতি। বর্তমান ঘটনাপ্রবাহের সঙ্গে মানিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছে মনটাকে। হঠাৎই বন্ধ হয়ে এল দমটা।

কেউ একজন দাঁড়িয়ে রয়েছে কামরাটার দূর-কোণে!

মনে হচ্ছে… মনে হচ্ছে… সরাসরি ওর দিকেই তাকিয়ে রয়েছে… কে ওটা?

রোজামাণ্ড! কিন্তু…

প্রেতাত্মা বলে তো মনে হচ্ছে না মহিলাকে! জলজ্যান্ত বাস্তব যেন!

ছায়ামূর্তিটার উপর থেকে চোখ সরাতে পারছে না তাহিতি। বাতির সুইচের জন্য হাতড়াল পাশে।

পেয়েছে!

খুট করে জ্বলে উঠল লণ্ঠন। আলো গিয়ে পড়ল কোনাটায়। কিন্তু…

না… কেউ দাঁড়িয়ে নেই ওখানটায়! স্রেফ অপ্রশস্ত এক কর্নার-ক্যাবিনেট দাঁড়িয়ে আছে।

সাবধানে ছাড়ল তাহিতি চেপে রাখা শ্বাসটা।

.

তাহিতির পরনে এখন পাজামা। চোখেমুখে পানি দেয়া সারা। বাতিটা অফ করে দিয়ে বেরিয়ে এল ও বাথরুম থেকে। থামল বিছানার কাছে এসে। নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে এমিলি।

সন্তর্পণে চাদরের নিচে ঢুকে পড়ল তাহিতি। বাতি নেভানোর জন্য হাত বাড়াতে যাবে, ধাঁই করে চড়ে গেল ব্লাডপ্রেশার।

ফেলে দেয়া খেলনাটা কী করে যেন হাজির হয়েছে এসে টেবিল-ল্যাম্পটার পাশে!

ক্যাঁচকোঁচ করে উঠল বিছানার খুঁটিগুলো।

প্রচণ্ড অস্বস্তি নিয়ে ঘাড় ঘোরাল তাহিতি। কী দেখতে হবে, জানা নেই; সেজন্য সময় নিচ্ছে ইচ্ছে করেই।

রোজামাণ্ড!!! এবার কোনও ভুল নেই!

হাত-পা ছড়িয়ে উপুড় হয়ে রয়েছে মহিলা চাঁদোয়ার উপরে! শরীরের ওজনে মড়মড় করছে খুঁটিগুলো।

ওই অবস্থাতেই নিচে নেমে আসছে ধীরে ধীরে! শিফনের উপর দিয়ে পরিষ্কার ফুটে রয়েছে প্রেতিনীর ক্রুর দৃষ্টি, বিকট মুখভঙ্গি আর শরীরের বেঢপ আকৃতি।

টান টান হয়ে আছে চাঁদোয়াটা। কিছুটা ভিতরদিকে বেঁকে রয়েছে খুঁটি চারটের উপরদিকটা। রাবারের তৈরি যেন ওগুলো। কী যে প্রচণ্ড শক্তি প্রয়োগ করা হচ্ছে খুঁটির উপরে, তারই জলজ্যান্ত প্ৰমাণ।

পঙ্গু হয়ে পড়েছে যেন তাহিতি। শক্তি নেই নড়ার। অশুভ বাস্তবতা পাথর করে দিয়েছে ওকে। তার পরও বাতাস দিয়ে ভর্তি করে ফেলল ফুসফুস দুটো। ছিটেফোঁটা শক্তি যা রয়েছে, জড়ো করতে চাইছে।

সহসা পাশ থেকে ছোঁ মেরে তুলে নিল এমিলিকে। পলকে এক গড়ান খেয়ে নেমে পড়ল তাহিতি বিছানা থেকে। মুহূর্তের মধ্যে দরজা পেরিয়ে বাইরে।

ও-ও বেরিয়েছে, দরজাটাও লেগে গেল পিছনে ধড়াম করে!

.

বেরিয়ে এল টনি রেস্টুরেন্ট থেকে, হাতে একখানা থার্মোস নিয়ে। গাড়িতে গিয়ে উঠল ও বাড়ি ফেরার জন্য। প্যাসেঞ্জার-সিটে আসন পেল থার্মোসটা।

সামনে তাকাতেই বিট মিস করল টনির হৃৎপিণ্ড।

বদলে গেছে রিয়ার-ভিউ মিরর থেকে ঝোলানো এমিলির ছবিটা!

চোখ দুটো এখন মণিবিহীন মেয়েটার—সম্পূর্ণ সাদা! রেস্টুরেন্টে ফিরে এল টনি। ফোন করবে কাউন্টার থেকে।

.

ফোন বাজছে ডায়েসদের বাড়িতে… বেজেই চলেছে। কিন্তু কেউ তুলছে না ফোনটা।

.

সাঁই করে শেষ বাঁকটা ঘুরল টনি, নিজেদের বাড়ির ড্রাইভওয়েতে ঢোকাল গাড়িটাকে। কিছুটা স্কিড করে থামল তবে প্লিমাথটা।

ছিটকে ওটার ভিতর থেকে বেরোল চালক টনি। দুই লাফে পৌঁছে গেল বাড়িটার সামনের দরজায়।

খোলাই ছিল দরজাটা। ঠেলা দিতেই নিঃশব্দে উন্মুক্ত হলো কবাট।

সাঁত করে ভিতরে সেঁধোল দুশ্চিন্তিত টনি। ‘তাহিতি!’

জবাব এল না।

‘তাহিতি!!’

এবারও নয়।

ছুটল যুবক সিঁড়ির দিকে।

এক এক বারে দুটো করে ধাপ ডিঙিয়ে স্বল্পতম সময়ে পৌঁছে গেল ও উপরতলায়। ল্যাণ্ডিঙে পৌঁছেই শার্প টার্ন নিল ডান দিকে। ওদিকেই রয়েছে ওদের বেডরুমটা।

দরজাটা বন্ধ ওই কামরার। খুলে ফেলল টনি কবাটটা। দরজা থেকে চাইল বিছানার দিকে।

খালি।

যুবকের আতঙ্কিত দৃষ্টি ঘুরে বেড়াতে লাগল অন্ধকারে। নাহ, স্ত্রী নেই এখানে।

হলওয়েতে নেমে ছুটল ও এবার এমিলির কামরার উদ্দেশে।

বন্ধ এই দরজাটাও।

আস্তে করে মেলে ধরল কবাটটা। কী-না-কী দেখতে হয়, সেই ভয়ে এতটুকু হয়ে আছে।

প্রথমেই ওর চোখ গেল বিছানায়।

শূন্য যথারীতি।

অন্ধকারে ঘুরতে লাগল টনির বিস্ফারিত দৃষ্টি।

ওই তো তাহিতি! ছায়ায় ডুবে আছে মেয়েটার দেহকাঠামো।

ফ্লোরে বসে আছে মহিলা এমিলিকে কোলে নিয়ে। ছুটে গেল টনি।

একটা বাইবেল খোলা তাহিতির সামনে। হাতে পেঁচিয়ে রেখেছে জপমালা।

চোখাচোখি হলো স্বামী-স্ত্রীর।

‘ক্-কী হয়েছে, তাহিতি?’ উদ্বেগাকুল স্বরে জিজ্ঞেস করল টনি।

কিছু বলছে না মহিলা। কথা সরছে না যেন। শেষমেশ মুখ খুলতে পারল।

‘ও এসেছিল, টনি! ডাইনিটা এসেছিল এখানে!’

.

রাগে ফুলতে ফুলতে কিচেনে ঢুকল টনি। তাহিতি এল ওর পিছন পিছন।

‘বিশ্বাস করি না এসব…’ বলল যুবক সংশয় ভরা কণ্ঠে হাত বাড়াল ও কাউন্টারের ফোনটার পাশে রাখা অ্যাড্রেস-বুকের দিকে। দ্রুত উল্টে চলল বইটির পাতা।

…এখানে নিরাপদ থাকার কথা আমাদের,’ গজগজ করছে তখনও। ‘অথচ তুমিই ওটার এখানে আসার রাস্তা সুগম করে দিয়েছ!’

‘তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে, ইচ্ছা করে ওটাকে আসতে দিয়েছি আমি?’ চোখ জোড়া ছলছল করছে তাহিতির।

‘কী থেকে কী হতে পারে, সেটা তোমার জানা ছিল না বলছ?’ যেটা খুঁজছিল, পেয়ে গেছে টনি। ডায়াল করল ও নাম্বারটা।

.

বেজে উঠল পিটার পারকারের স্টাডির ফোনটা।

একটি মাত্র আলো জ্বলছে কামরায়, আর সেটা টেবিলের উপর।

রিসিভার কানে চেপে ওপাশের কথাগুলো শুনল পিটার।

জানালার কাচে মাথা কুটছে বৃষ্টি।

পিটারের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী উদয় হলো দরজায়। পরিস্থিতি সম্বন্ধে সজাগ মহিলা।

‘…ঠিক আছে, করব,’ জবাব দিল পিটার টনির উদ্দেশে। ‘মাইকেলের সঙ্গে কথা বলেছেন?’

‘এখনও বলিনি,’ বলা হলো ওপাশ থেকে। ‘এই মুহূর্তে পাচ্ছি না আমরা ওকে। সম্ভবত রাস্তায় রয়েছে ও। ফিরে আসছে ওর মায়ের ওখান থেকে।’

‘এক কাজ করি তা হলে… অ্যালার্ট করে দিই রাস্তার সবগুলো পয়েন্টকে। ওর খোঁজ পেলে ওরা ইনফর্ম করবে ওকে… বলবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, আপনাকে কল করতে।’

‘তা হলে তো ভালো হয় খুব। সাবধানে থাকবেন, পিটার। করুন, যা যা বললাম। আর যা বলবেন, মনে বিশ্বাস নিয়েই বলবেন।’

‘নিশ্চয়ই।’

আস্তে করে ফোন রেখে দিল অফিসার। চাইল সে স্ত্রীর দিকে। ‘একটা বাইবেল দরকার আমার।’

.

সকালের সূর্যটা উঁকি দিয়েছে কেবল দিগন্তের ওপার থেকে।

চলন্ত ভ্যানের স্টিয়ারিঙের পিছনে বসে রয়েছে মাইকেল। শুনছে পিঙ্ক ফ্লয়েড ব্যাণ্ডের ফিয়ারলেস গানটা।

ছোট এক পাহাড়ের ঢালে ওঠার পর সৃষ্টি হলো ব্রেক চাপার মতো পরিস্থিতি। রাস্তা বন্ধ সামনে। ভয়াবহ এক দুর্ঘটনা ঘটেছে—একখানা ফোর্ড পিনটো আর শেভরোলেট স্টেশন ওয়াগেনের মধ্যে সংঘর্ষ। ছেঁচড়ানোর বিচ্ছিরি দাগ পেভমেন্টে। বাষ্প আর ধোঁয়া উদ্‌গীরিত হচ্ছে গাড়ি দুটো থেকে।

স্টিয়ারিঙের উপর শক্ত হয়ে এঁটে বসল মাইকেলের পাঞ্জা দুটো। প্রাণপণ চেষ্টা করছে ও গাড়িটার নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখার জন্য। ধুলোময়, ঢালু রাস্তায় পিছলে চলেছে ভ্যানটা, পিছনদিকটা ওটার হড়কে সরে যাচ্ছে রাস্তাটার পাশের দিকে। আচমকা থেমে যাওয়ার আগে তিন শ’ ষাট ডিগ্রি পাক খেল গাড়িটা, সজোরে গিয়ে ধাক্কা মারল পিনটোটার সামনের দিকে।

তুবড়ে যাওয়া গাড়ি দুটোর দিকে চেয়ে রয়েছে মাইকেল। দু’জন টিনেজ বয়সী ছেলে বেরিয়ে এল পিনটোটার ভিতর থেকে। স্টেশন ওয়াগেনটার সওয়ারি কেবল একজন, বছর পঞ্চাশের এক পুরুষ। নেতিয়ে পড়ে আছে সামনের দিকে। নড়ছে না একটুও। আগুনের শিখা গ্রাস করে ফেলেছে ইঞ্জিন কমপার্টমেন্ট।

ভ্যানের ভিতর থেকে বেরিয়ে এল মাইকেল। রক্তাক্ত, বিভ্রান্ত টিনেজার দুটোকে পাশ কাটিয়ে ছুটে গেল স্টেশন ওয়াগেনটার দিকে।

ড্রাইভারের দিকের জানালাটার কাচ নামানো ওয়াগেনটার। স্টিয়ারিং হুইলের উপর ঝুঁকে রয়েছে গাড়ি চালক। সিটবেল্টটা আটকানো এখনও। সকালের খবর হচ্ছে রেডিয়োতে।

মাথা ঢোকাল মাইকেল গাড়ির ভিতরে। নাড়ি পরীক্ষা করবে ড্রাইভারের। ক্ষীণ হলেও পাওয়া গেল পালস।

এবার তাকাল ইঞ্জিনের দিকে।

বাড়ছে আগুন।

ড্রাইভারের দিকের দরজাটার হাতল ধরল ও। সম্পূর্ণ তুবড়ে গেছে দরজাটা। ভিতর থেকে ওটা খোলার জন্য হাত ঢুকিয়ে দিল জানালা দিয়ে। টান দিল লেভার ধরে। কাজ করছে না মেকানিজম।

দ্রুত হেঁটে অন্য দরজাটার কাছে চলে গেল মাইকেল। গাড়ির সামনে দিয়ে ঘুরে আসার সময় টের পেল প্রচণ্ড উত্তাপ। বেড়েই চলেছে তাপটা। দরজার হাতল ধরে টান দিতেই আরও স্পষ্ট হলো রেডিয়ো-ডিজের গলার স্বর:

‘সুপ্রভাত জানাচ্ছি আর্লি রাইজারদের। পাঁচটা উনিশ এখন ঘড়িতে…’

টায়ার স্কিড করার তীব্র আওয়াজের নিচে চাপা পড়ে গেল উপস্থাপকের পরের কথাগুলো।

ঝটিতি তাকিয়ে দেখতে পেল মাইকেল, আঠারো চাকার এক ট্রাক এসে হাজির হয়েছে পাহাড়ি রাস্তায়। ব্রেক চেপেছে ওটার চালক। কিন্তু গতিজড়তার কারণে রাস্তাটার পাশের দিকে সরে আসছে ট্রাকটা। নিরেট ধাতব একটা দেয়াল এগিয়ে আসছে যেন মাইকেলকে পিষে মারার জন্য। ওকেই টারগেট করেছে যেন।

প্রতিক্রিয়া দেখানোর সময়টুকুও পেল না মাইকেল রডম্যান। গা গোলানো একটা আওয়াজের সঙ্গে স্টেশন ওয়াগেনের পাশ থেকে চেঁছে নিয়ে গেল ওকে ট্রাকটা।

.

বিপর্যস্ত দেখাচ্ছে টনি ডায়েসকে। কিচেনের কাউন্টারে দাঁড়িয়ে কথা বলছে ও ফোনে।

‘…ঘণ্টা কয়েক আগে মেসেজ দিয়ে রেখেছিলাম ফাদার ফ্রিম্যানের জন্য। উনি কি ফিরেছেন?’

‘না, দুঃখিত,’ বলল একটা পুরুষ কণ্ঠ। ‘বিকেলের আগে ফেরার কথা নয় ওনার।’

‘কোনোভাবেই কি যোগাযোগ করা যায় না ওঁর সাথে?’

‘দেখুন… এ মুহূর্তে বিরক্ত করা সম্ভব নয় ওনাকে। উনি আছেন এক শোকসভায়…’

‘আচ্ছা, ঠিক আছে। এলে বলবেন, ফোন করেছিল টনি ডায়েস। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, ওঁর আমাকে ফোন করাটা জরুরি। নাম্বার ওঁর কাছেই আছে।’

ফোনটা রাখা মাত্রই বেজে উঠল ওটা।

খানিকটা চমকে গেছে টনি। ধাতস্থ হওয়ার আগেই তুলল ও ফোনটা।

‘…হ্যালো!’

শুনতে শুনতে ছাইবর্ণ ধারণ করল টনির চেহারা। দু’চোখ থেকে ঠিকরে বেরোচ্ছে অবিশ্বাস।

‘না… না… না… না…’ উচ্চারণ করছে জনান্তিকে।

শঙ্কার আঁচ পেয়ে কিচেনে ঢুকল তাহিতি। তাকিয়ে আছে টনির দিকে।

আরও কয়েক সেকেণ্ড ওদিককার কথা শুনল টনি। শেষমেশ ‘…অলরাইট, থ্যাঙ্কস,’ বলে বিমূঢ়ের মতো নামিয়ে রাখল ফোনটা।

‘কী হয়েছে, টনি?’ জিজ্ঞেস করল উৎকণ্ঠিত তাহিতি। অনেক কষ্টে যেন স্ত্রীর দিকে ঘাড় ঘোরাল যুবক। ‘ফোন করেছিল পিটার পারকার! মাইকেল আর নেই!’

‘নেই মানে?!’

‘অ্যাকসিডেন্ট! ভোরবেলায়!’

মুহূর্তে পানিতে ভরে উঠল তাহিতির চোখ দুটো।

ভয়ানক ক্ষুব্ধ দেখাচ্ছে টনিকে। ধাম করে এক কিল বসিয়ে দিল কাউন্টারে। ‘যথেষ্ট হয়েছে!’

সঙ্কল্পের ছায়া দেখতে পেল তাহিতি স্বামীর চেহারায়।

‘গাড়ি নিয়ে যাচ্ছি আমি চার্চে,’ কঠোর কণ্ঠে বলল টনি। ‘করবই আজকে এক্সোরসিজমের ব্যবস্থা!

চাবির গোছাটা মুঠোবন্দি করতেই স্বামীর গা ঘেঁষে এল তাহিতি। ‘আমিও যাচ্ছি তোমার সাথে!

‘না, যাচ্ছ না!’

ওর উপর ভরসা রাখতে পারছে না—সত্যটা হুলের মতো দংশন করল তাহিতিকে। গটমট করে বেরিয়ে গেল মহিলা কিচেন থেকে।

.

প্লিমাথের সিটে গিয়ে উঠেছে টনি। স্টার্ট দিতে যাবে, এমন সময় খুলে গেল প্যাসেঞ্জার-সিটের দরজাটা।

তাকাল টনি স্ত্রীর দিকে। হ্যারিসভিল থেকে আসা ম্যানিলা খামটা নিয়ে গাড়িতে উঠছে তাহিতি।

‘কী করছ তুমি?’ অবাক হয়ে প্রশ্ন করল ওর স্বামী।

‘যাচ্ছি আমরা… একসাথে!’ দৃঢ় কণ্ঠে বলল তাহিতি। ‘ওই পরিবারটার কাছ থেকে দূরে থাকতে চাই না আমি। আমাদেরকে প্রয়োজন ওদের। আমাদেরকে!’

’কিন্তু তোমার আসাটা উচিত হচ্ছে না সত্যিই। অনেক বেশি জড়িয়ে পড়েছ তুমি।’

‘হয়তো পড়েছি। কিন্তু এটাই আমাকে কিছু একটা করার শক্তি জোগাচ্ছে ওদের জন্য।’

মেয়েটার অভিব্যক্তিই বলে দিচ্ছে, আত্মবিশ্বাস ফিরে পেয়েছে তাহিতি।

হাল ছেড়ে দিয়ে নড করল টনি।

সশব্দে নিজের দিকের দরজাটা লাগাল মহিলা।

.

চলছে গাড়ি। পেরিয়ে গেল একটা সাইনপোস্ট: বস্টন ২৪৫ মাইল।

মিসেস স্কালির পাঠানো কাগজগুলো পড়ছে আর মন্তব্য করছে তাহিতি:

‘ওয়াইল্ডার আর কুপারদের মাঝখানে আর মাত্র দুটো পরিবার থেকেছিল বাড়িটায়।

বাড়িটায়। অ্যানিসটনরা; ওদের ছেলেটাকেই দেখেছিলাম আমি। অন্য পরিবারটা হচ্ছে ডি সিলভা-দের। স্কালি লিখেছেন: ওদেরও একটা ছেলে ছিল; পানিতে চুবিয়ে হত্যা করে ওকে ওর মা…’

.

ফিরে যাই অতীতে…

সিলভিয়া যাকে দেখতে পেয়েছিল সিঁড়িতে, বুদ্বুদের আকারে মুখ দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে কিশোরটির শেষ নিঃশ্বাস।

পুকুরের ফুট খানেক গভীরতায় চেপে ধরে আছে ওকে ওর মা!

সারা শরীর শিথিল হয়ে পড়ল ছেলেটার। বিস্ফারিত অবস্থায় থির হয়ে গেছে চোখ জোড়া। একদৃষ্টে চেয়ে রয়েছে যেন জলসমতলের উপর থেকে অভিব্যক্তিহীন চেহারায় তাকিয়ে থাকা মায়ের দিকে।

.

…এর পর আত্মহত্যা করে মহিলা,’ বলে চলেছে তাহিতি।

.

দ্রুত গতিতে ছুটে আসা ট্রেনটার মুখোমুখি এগিয়ে যাচ্ছে ছেলেটির মা। ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল ধাতব চাকাগুলোর নিচে পড়ে…

.

‘ওহ, মাই গড!’ আঁতকে উঠে স্বামীর দিকে তাকাল তাহিতি। আচমকাই উপলব্ধি করতে পেরেছে সমস্ত ব্যাপারটা। ‘মায়েদের উপরে ভর করছে ওটা! মায়েদের দিয়ে তাদের সন্তানদেরকে উৎসর্গ করাচ্ছে শয়তানের কাছে!’

.

বস্টন ক্যাথিড্রাল। রাত্রি।

সোজা ফাদার ফ্রিম্যানের অফিসরুমে গিয়ে ঢুকল টনি আর তাহিতি। আর্চবিশপ ফাদার ও’হারা-র সঙ্গে কথা বলছিলেন তিনি সে-মুহূর্তে।

ষাট পেরোল বলে আর্চবিশপের বয়স। চেহারাটা সম্ভ্রান্ত।

অনাহূত প্রবেশে থতমত খেয়ে গেলেন দু’জনেই।

‘কী হচ্ছে এখানে, বলুন তো!’ কোনও রকম ভূমিকা না করেই বিরক্তি ওগরাল টনি। ‘আর তো পারছি না অপেক্ষা করতে!’

‘টনি, তাহিতি,’ বললেন ফ্রিম্যান খানিকটা বিব্রত চেহারায়। ‘ইনি হচ্ছেন আর্চবিশপ, ফাদার ও’হারা।

আপনাদেরকে ফোনে ধরার চেষ্টা করেছি অনেক বার…’

‘রাস্তায় ছিলাম আমরা।’

‘প্লিজ, বসুন,’ অনুরোধ করলেন আর্চবিশপ।

‘বসতে আসিনি আমরা!’ ভব্যতার তোয়াক্কা করল না টনি। ‘একটা এক্সোরসিজমের প্রয়োজন দেখা দিয়েছে আজকের মধ্যে, অনুমতি চাইছিলাম সেটার। তো, কী সমস্যা এখানে?

কথাগুলো গুছিয়ে নিলেন ফাদার ও হারা। অপ্রিয় সত্য বলাটা বড় সহজ নয়।

‘অনুমতি দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে চার্চ।’

টনিকে দেখে মনে হচ্ছে, অপ্রস্তুত অবস্থায় কেউ যেন ঘুষি হাঁকিয়েছে ওর মুখে।

‘প্রথমত, প্যারিশের (ParIsh: ‘কাউন্টি বা জেলার অন্তর্গত যাজকীয় বিভাগ, যার নিজস্ব গির্জা ও যাজক আছে) লোক নয় পরিবারটি,’ ব্যাখ্যা করছেন ফাদার। ‘বাচ্চাগুলোও দীক্ষা নেয়নি ওদের।’

‘তাতে কী হয়েছে?’ বিস্মিত তাহিতি।

‘বিশ্বাস করুন, সর্বাত্মক চেষ্টা করেছি আমরা,’ আন্তরিক স্বরে বললেন ও’হারা। ‘কিন্তু ভ্যাটিকানকে যদি চার্চের গণ্ডির বাইরে কিছু করতে হয়, জনসাধারণের প্রতিক্রিয়া তাতে কী হবে, সেটা ভেবেই উদ্বিগ্ন ওঁরা।’

‘ওঁদের বলুন যে, যা-ই ঘটুক না কেন, কারও জাত চলে যাবে না এতে! বুঝতে পারছেন না কেন, আওতার বাইরে চলে যাচ্ছে ব্যাপারটা! থামাতে হবে এসব! এক্ষুনি!’

‘বোঝার চেষ্টা করুন বিষয়টা! হাত-পা বাঁধা আমার এ ব্যাপারে। খারাপ লাগছে, কিন্তু…’

হতবুদ্ধি দেখাচ্ছে টনিকে। ‘তার মানে… কিচ্ছু করবেন না আপনারা?’

.

ফাদার ফ্রিম্যানের সঙ্গে চার্চ থেকে বেরিয়ে এল টনি আর তাহিতি। হাঁটছে পাশাপাশি। স্বভাবতই মন-মেজাজ ভালো নেই ওদের।

‘অন্য কাউকে খুঁজে নিতে হবে আরকী এক্সোরসিজমের জন্য,’ বেপরোয়া মন্তব্য টনির

‘মিস্টার ডায়েস, নরম গলায় বললেন ফাদার ফ্রিম্যান। ‘চার্চের বিরুদ্ধে যায়, এমন কিছুই করতে পারবেন না আপনারা। কাউকে পাওয়া-না-পাওয়া তো পরের ব্যাপার।’

‘বিশ্বাস হয় না আমার।’

ওদেরকে পেরিয়ে সামনে চলে এলেন ফ্রিম্যান, মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থামালেন স্বামী-স্ত্রীকে। তাকিয়ে আছেন নিষ্পলক, তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে।

‘দু’জনেই আপনারা দেখেছেন আগে এক্সোরসিজমের কায়দা-কানুনগুলো… অন্তত ডজন খানেক বার, তা-ই না?’ জিজ্ঞেস করলেন তিনি।

এমন দৃষ্টিতে ফাদারের দিকে তাকাল টনি, যেন মাথা খারাপ হয়ে গেছে ওঁর। বুঝতে পেরেছে মানুষটার প্রশ্নের তাৎপর্য।

‘দেখা আর যোগ্যতা অর্জন করা তো এক কথা নয়!’ বলল ও।

‘আমি সেটা মনে করি না। আপনার মনের জোর আর বাইবেল সম্পর্কে আপনার যে জ্ঞান, এই কাজের জন্য তা যথেষ্টই।’

‘কিন্তু এমনকী প্রিস্টের উপস্থিতিতেও ভয়াবহ দিকে মোড় নিতে দেখেছি আমি গোটা ব্যাপারটা।’

‘আমি বিশ্বাস করি, শিক্ষা কিংবা প্রশিক্ষণ, কিংবা এ- সংক্রান্ত পলিটিকসের চাইতে বিশ্বাসটাকেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেন সর্বশক্তিমান ঈশ্বর।’ মুহূর্তের বিরতি নিলেন ফাদার। ‘আর কোনও উপায় নেই পরিবারটির। কিন্তু আপনার সেটা রয়েছে। ঈশ্বরকে পাশে পাচ্ছেন আপনি। যদি চান তো, সাহায্য করবেন ওদেরকে, তো যান, করুন।’

মতামতের আশায় স্ত্রীর দিকে তাকাল টনি। কিন্তু তাহিতির মাথার মধ্যেও চলছে দ্বিধাদ্বন্দ্বের ঘূর্ণিপাক।

.

হ্যারিসভিল মোটেল। রাত্রি।

নিজেদের কামরার দিকে এগোচ্ছে সিলভিয়া আর সিনথিয়া।

ডোরনবের দিকে হাত বাড়িয়েছে বড় জন, ভিতর থেকে খুলে গেল দরজাটা।

দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে আছে ওদের আম্মু।

দীর্ঘ, ধূসর গাউন মহিলার পরনে। ময়লা চুলগুলো টেনে বাঁধা পিছনদিকে। কৃশকায় দেখাচ্ছে তাকে আগের চাইতে।

বাইরে এসে পিছনে আটকে দিল পাল্লাটা রোজমেরি। ‘এসো আমার সাথে।’

‘কোথায়, মা?’ জানতে চাইল সিলভিয়া। ‘বাড়ি যাচ্ছি আমরা।’

‘কিন্তু বাবা যে বলল-’

‘ওখানেই আমাদের সঙ্গে দেখা হবে তোমাদের বাবার!’ ধমকের সুরে বলল রোজমেরি। ‘কথা না বাড়িয়ে চলে এসো এখন!’

.

কামরায় ঢুকলে দেখতে পেত মেয়েরা, মেঝেতে অচেতন অবস্থায় পড়ে আছে ওদের বাবা, ভাঙা একটা লণ্ঠনের পাশে। রক্তে ভরে আছে মাথার পিছনটা।

.

ড্রাইভ করছে রোজমেরি। গাড়ির পিছনে বসেছে মেয়েরা।

নীরবে রাইড করল ওরা কিছুক্ষণ। তার পর কথা বলে উঠল সিলভিয়া।

‘আম্মু… ঠিক আছ তো তুমি?’

জবাব দিল না রোজমেরি।

মুখ চাওয়াচাওয়ি করল দুই বোন। বিভ্রান্ত বোধ করছে, সেই সঙ্গে উদ্বিগ্নও।

তেরছা দৃষ্টিতে তাকাল রোজমেরি রিয়ার-ভিউ মিররে। সেদিকে তাকালে বুঝতে পারত মেয়েরা, স্বাভাবিক আর নেই ওদের আম্মু।

চোখ জোড়ায় প্রাণ নেই রোজমেরির। সাদা অংশ বলতেও নেই যেন কিছু। সম্পূর্ণ কালো ও-দুটো! কিছুতেই মানবিক বলা যাবে না সেটাকে।

.

কোথাও একটা ফোন বাজছে… বেজেই চলেছে…

.

একটা ফোনবুথ থেকে ফোনটা করেছে টনি। কিন্তু রিসিভার ওঠানোর নাম নেই অপর পাশে।

বুথের বাইরে পার্ক করা গাড়িতে অপেক্ষা করছে ওর স্ত্রী তাহিতি।

.

হ্যারিসভিল মোটেলের একটা কামরায় বাজছে ফোনটা।

বেজেই চলেছে…

বেজেই চলেছে…

অবশেষে একটা হাত হাতড়াতে লাগল রিসিভারটা… পেয়েও গেল।

অ্যালবার্ট কুপার ওটা। মাথার পিছনটা আঁকড়ে ধরে আছে লোকটা আরেক হাতে। যুঝছে তীব্র যন্ত্রণার সঙ্গে।

‘হ্যালো… হ্যালো…?’ ভেসে এল ওপাশ থেকে।

‘মিস্টার ডায়েস!’ কোলা ব্যাঙের স্বর বেরোল মিস্টার কুপারের গলা থেকে। ‘মেরি… মারার চেষ্টা করেছিল ও আমাকে!’

ঢোক গিলল টনি। ‘মেয়েরা কোথায় আপনার?’

.

ড্রাইভওয়েতে বাঁক নিল রোজমেরি। গাড়ি নিয়ে এগোল অন্ধকারে ডুবে থাকা বাড়িটার দিকে।

‘তুমি বলেছিলে, আব্বুর সঙ্গে দেখা হবে এখানে, ‘ সন্দেহের সুর সিলভিয়ার কণ্ঠে।

কোনও উত্তর এল না রোজমেরির কাছ থেকে। গাড়ি পার্ক করল মহিলা দালানটার সামনে। একটা ব্যাগ নিয়ে নেমে এল গাড়ি থেকে। এক জোড়া উলের কাঁটা রয়েছে ব্যাগটার মধ্যে।

একে অন্যের দিকে তাকাল সিলভিয়া আর সিনথিয়া। ঘটনা যে কোন্ দিকে গড়াচ্ছে, আন্দাজও করতে পারছে না ওরা। কোনও দিকে না তাকিয়ে সোজা সদর দরজার দিকে এগিয়ে যেতে দেখছে মেয়েরা আম্মুকে। দরজাটা হাট করে খুলে রেখেই অদৃশ্য হয়ে গেল মহিলা ভিতরে।

সাবধানী পায়ে ফ্রন্ট-পোর্চ পেরিয়ে দরজাটার সামনে এসে দাঁড়াল দুই বোন। শিরদাঁড়ায় শীতল অনুভূতি।

সেলারে নামার দরজাটাও হাট করে খোলা হলওয়ের শেষ মাথায়। কবাটের গায়ে গভীরভাবে বসে যাওয়া আঁচড়ের দাগগুলো মনে করিয়ে দিচ্ছে, কেন বন্ধ করে দিতে হয়েছিল ওটা। কিন্তু এখন…

চেয়ার আর গোঁজটা সরিয়ে রাখা হয়েছে এক পাশে।

‘আম্মু!’ গলা চড়িয়ে ডাকল সিলভিয়া। ‘কী করছ তুমি? চলে যাওয়া উচিত এখান থেকে!’

নেই কোনও সাড়াশব্দ। কবরখানার মতো নীরব হয়ে আছে গোটা বাড়ি।

ছোট বোনের হাত ধরল সিলভিয়া। ইচ্ছার বিরুদ্ধে প্রবেশ করল বাড়ির ভিতরে। হলওয়ে ধরে এগিয়ে যাচ্ছে সেলারের দরজাটার দিকে। পদক্ষেপ মন্থর।

‘আম্মু!’ আবার ডাকল সিলভিয়া। ‘নিচে নাকি তুমি?’

যখন এসে পৌছাল দরজাটার কাছে, শূন্য সিঁড়ির ধাপ দেখতে পেল ওরা উঁকি দিয়ে।

‘আম্মু…?’

ক্ষীণ আওয়াজ এল পা ঘষটে হাঁটার।

‘কিছু বলছ না কেন, আম্মু?’ পাগলা ঘোড়ার মতো লাফাচ্ছে যেন সিলভিয়ার কলজেটা। ‘আর ইউ ওকে?’

থেমে গেল কর্কশ আওয়াজটা।

মেয়েটার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় চিৎকার করে বলছে ওকে চলে যেতে এখান থেকে। আম্মুটার জন্যই পারছে না যেতে।

‘থাক তুই এখানে,’ বোনকে বলল সিলভিয়া। হাতড়ে লাইট জ্বালার চেষ্টা করল ও। কাজ করছে না সুইচ।

‘চলো, আপু, চলে যাই এখান থেকে!’ বোনের হাত ধরে টান দিল সিনথিয়া। কাঁদো কাঁদো হয়ে পড়েছে চেহারা।

পাত্তা দিল না সিলভিয়া। বোনকে দরজায় রেখে নামতে লাগল ও নিচে। থেমে দাঁড়াল সিঁড়ির মাঝামাঝি এসে।

‘মা…?’

হুউশ!

আচমকা একটা হাত উদয় হলো অন্ধকার ফুঁড়ে। মেয়েটির গোড়ালির গাঁট চেপে ধরল সেটা খপ করে। হুমড়ি খেয়ে পড়ার অবস্থা হলো সিলভিয়ার। বলাই বাহুল্য, চমকে গেছে ভীষণ।

হ্যাঙরেইলটা আঁকড়ে ধরে পড়ে যাওয়ার হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করল মেয়েটা। অন্ধকারে ভয়ার্ত চোখ মেলে দেখতে পেল—বুনো, প্রাণহীন দৃষ্টিতে ওর দিকেই তাকিয়ে আছে ওর আম্মু। হাতটা এখনও চেপে ধরে রেখেছে সিলভিয়ার গোড়ালি।

মুক্ত পা-টা দিয়ে কবজিতে লাথি হাঁকাল সিলভিয়া। শিথিল হয়ে গেল বজ্রমুষ্টি। হাঁচড়ে-পাঁচড়ে, হামাগুড়ি দিয়ে সিঁড়ি ভাঙতে লাগল মেয়েটি।

.

উপরে উঠেই সর্বশক্তিতে দরজাটা লাগিয়ে দিল সিলভিয়া। যে মুহূর্তে ও চেয়ারটা ফের সশব্দে এনে রাখল আগের জায়গায়, ভীষণ জোরাল আওয়াজ প্রতিধ্বনিত হতে লাগল ভিতরে। উন্মত্তের মতো ধাক্কানো হচ্ছে দরজাটা।

আওয়াজের প্রতিক্রিয়ায় কুঁকড়ে গেল মেয়েরা। স্পষ্টতই কাঁপছে থরথর করে। এ কোন নরক গুলজার শুরু হলো? এক্ষুনি বেরিয়ে যেতে হবে এ-বাড়ি থেকে…

দু’কদম মাত্র এগিয়েছে বাইরের দরজাটার দিকে, হুড়কো ভেঙে আক্ষরিক অর্থেই উড়ে গেল সেলারের দরজাটা। সামনে ঠেস দেয়া চেয়ারটারও যে পাখা গজাল, সে তো বলাই বাহুল্য।

দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে আছে রোজমেরি। অন্ধকারে আধো- অবগুণ্ঠিত, আধা-প্রকাশ্য। শ্বাস নিচ্ছে হাপরের মতো শব্দ করে। শক্ত করে ধরে রেখেছে উলের কাঁটাগুলো।

বোঁ করে ঘুরে গেল মেয়েরা গোড়ালির উপরে। ভোঁ- দৌড়াচ্ছে বাইরের দরজাটার দিকে।

কাছে পৌঁছতেই দড়াম করে বন্ধ হয়ে গেল খোলা দরজা! এবারও আপনা-আপনি!

চিল-চিৎকার দিল দুই বোন।

দরজার নব ধরে কসরত করে চলেছে সিলভিয়া। এক চুলও নড়ানো যাচ্ছে না কবাটটা!

‘তাড়াতাড়ি খোলো! তাড়াতাড়ি খোলো, আপু!’ চিৎকার করছে সিনথিয়া।

‘পারছি না! পারছি না খুলতে!’ পাশের জানালা দিয়ে একটা নড়াচড়া ধরা পড়ল মেয়েটির চোখে।

পিকআপ নিয়ে ছুটে আসছে অ্যালবার্ট ড্রাইভওয়ে ধরে! ‘আব্বুউউউ!!!’ আনন্দে চিৎকার দিল সিলভিয়া। কাঁধের উপর দিয়ে আতঙ্কিত দৃষ্টি মেলে দেখতে পেল, এগিয়ে আসছে ওঁদের আম্মু!

ছোট বোনের হাত আঁকড়ে ধরে সিঁড়ির দিকে দৌড় দিল মেয়েটা।

.

কর্কশ আওয়াজে টায়ারের ছাল-চামড়া তুলে ব্রেক কষে দাঁড়াল ট্রাকটা। লাফ দিয়ে গাড়ি থেকে বেরিয়ে এল, অ্যালবার্ট।

‘আব্বুউউউ!!!’ ভেসে এল বাড়ির ভিতর থেকে।

ঝাঁপিয়ে পড়ল অ্যালবার্ট সামনের দরজাটার উপরে। বন্ধ ওটা। লাথির পর লাথির পর লাথি পড়তে লাগল কবাটে, যতক্ষণ না ফ্রেম থেকে ছিটকে যায় ওটা।

কলিনস ট্যাফট রোড। রাত্রি।

দ্রুত বেগে ছোটা একটা পুলিস ক্রুজারকে অনুসরণ করছে তাহিতিদের গাড়িটা। পিটার পারকার রয়েছে ক্রুজারের চালকের আসনে।

পিছলে কুপারদের ড্রাইভওয়েতে টার্ন নিল অফিসার। ঝিলিক দিচ্ছে ক্রুজারের ছাতের আলো।

দরজা খোলা অবস্থায় অ্যালবার্টের ট্রাকটা দেখতে পেল ওরা। চালু অবস্থায় রয়েছে ইঞ্জিন। হেডলাইটগুলোও বন্ধ করা হয়নি, সেন্টার-স্টেজের মতো আলোকিত করে তুলেছে বাড়িটাকে।

স্কিডের আওয়াজ তুলে থেমে দাঁড়াল গাড়ি দুটো।

তিনজনে ওরা গাড়ি থেকে বেরিয়ে আসতেই উপরতলার বেডরুমের জানালায় মাজল-ফ্ল্যাশের সঙ্গে গুলির বিকট আওয়াজ ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়ে মিলিয়ে গেল রাতের স্বাভাবিক নীরবতায়।

পাঁই করে ঘুরে, স্বামীর দিকে তাকাল তাহিতি। ব্যাখ্যা করা মুশকিল, এরকম এক অভিব্যক্তি মহিলার চেহারায়।

পিস্তল বের করে ফেলেছে পারকার। সবাই ওরা এগোতে লাগল বাড়ি-অভিমুখে।

‘আব্বু! নাআ!’ ভিতরে পা রাখতেই কানে এসে ধাক্কা মারল সিলভিয়ার চিৎকার।

এক একবারে দু’-তিন ধাপ করে সিঁড়ি টপকে উঠতে লাগল ওরা উপরে।

সিঁড়ির মাথায় পৌঁছোতেই শোনা গেল মেয়েটার কাতর অনুনয়। ‘…প্লিজ… ছেড়ে দাও ওকে!’

হলওয়ে ধরে ছুট দিল টনি মাস্টার বেডরুমের দিকে। আধ-ভেজানো দরজাটার ওপাশ থেকেই আসছে সিলভিয়ার কাতর গলা। পিছন পিছন অনুসরণ করল পিটার আর তাহিতি।  

এক টান দিয়ে দরজাটা খুলেই দেখতে পেল টনি, পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে রোজমেরির মাথায় রাইফেল তাক করে রয়েছে ওর স্বামী। বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে সিনথিয়ার গলায় বাহুর চাপ দিচ্ছে মহিলা। এক জোড়া উলের কাঁটা লুটাচ্ছে ওর পায়ের কাছে।

তাজা একটা বুলেটের-গর্ত চোখে পড়ল টনির ঘরের ছাতে। খসে পড়া প্লাসটার ছড়িয়ে-ছিটিয়ে মেঝের এখানে- ওখানে।

অল্প দূরেই পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সিলভিয়া।

‘ছেড়ে দাও ওকে, মেরি!’ শাসাল অ্যালবার্ট হিসহিসে কণ্ঠে। ‘অপ্রিয় কাজটা করতে বাধ্য কোরো না আমাকে দয়া করে!’

‘মিস্টার কুপার… না!’ শাণিত কণ্ঠে সতর্ক করল টনি।

‘মেয়েটাকে খুন করতে চাইছে মেরি!’ নালিশের মতো শোনাল কথাটা।

‘নিজে থেকে কিছু করছেন না উনি!’

ছাড়া পাওয়ার জন্য ছটফট করছে সিনথিয়া… শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে মেয়েটার।

অ্যালবার্টের দিকে এগোতে লাগল টনি।

‘আহ্-আম্মু!’ বলল সিনথিয়া অস্পষ্ট স্বরে। ‘ব্যথা দিচ্ছ আমাকে!’

‘থামো, আম্মু!’ তীক্ষ্ণ স্বরে বলল সিলভিয়া।

‘ছেড়ে দাও, মেরি!’ আবার নির্দেশ দিল অ্যালবার্ট। ‘ঠিক এটাই চাইছে ডাইনিটা… ট্রিগার চাপুন আপনি!’ লোকটাকে থামানোর প্রয়াস পেল টনি। ‘আরেকটা স্যাক্রিফাইস হয়ে যাচ্ছে তা হলে!’

এক পা, এক পা করে কুপার সাহেবের কাছাকাছি হচ্ছে পুলিস অফিসার।

‘নামান বলছি রাইফেলটা!’ বলল ও কর্তৃত্বপূর্ণ কণ্ঠে। ‘দিয়ে দিন ওটা আমাকে!’

‘না! ….আবার বলছি, মেরি… ছেড়ে দাও মেয়েটাকে!’ খেপা জানোয়ারের মতো দেখাচ্ছে দুই মেয়ের বাপকে।

‘প্লিজ, মিস্টার কুপার!’ অনুনয় করল তাহিতি। ‘দিয়ে দিন অস্ত্রটা!’

সিদ্ধান্ত নিতে দ্বিধায় ভুগছে অ্যালবার্ট। সামনে দাঁড়ানো বউয়ের উন্মাদ-চেহারাটার দিকে তাকিয়ে রয়েছে বুনো দৃষ্টিতে। পলক ফেলতেও ভুলে গেছে যেন।

এদিকে মহিলার অভিব্যক্তি দেখে মনে হচ্ছে, উপভোগ করছে পরিস্থিতির প্রতিটা মুহূর্ত। সিনথিয়ার গলায় চাপ বাড়িয়ে ত্যক্ত করে মারছে লোকটাকে।

‘কাম’ন, মিস্টার কুপার!’ আরেক বার চেষ্টা করল তাহিতি। ‘দিয়ে দিন ওটা অফিসারকে!

সঙ্গে সঙ্গে মেয়ের গলায় বাহুর চাপ বাড়াল রোজমেরি।

যন্ত্রণায় নীল হয়ে উঠছে সিনথিয়া। সইতে না পেরে রাইফেল তাক করল অ্যালবার্ট।

‘আপনি যেটা করতে চলেছেন, সেটাই কিন্তু চাইছেন আপনার মিসেস!’ আরও একবার সতর্ক করল টনি।

হার মানল অ্যালবার্ট। ‘সত্যি যেন হয় আপনার কথাগুলো।’

রাইফেলটা পিটারের হাতে তুলে দেয়ার জন্য নামিয়ে আনছে, এত প্রচণ্ড শক্তিতে লাথি হাঁকাল রোজমেরি যে, পালকের মতো হাওয়ায় উড়াল দিল অ্যালবার্ট। কামরা পেরিয়ে আছড়ে পড়ল দেয়ালে পিঠ দিয়ে। কীসের যেন আওয়াজ হলো ভাঙার, কাচ-টাচ ভেঙে সব দিকে ছুটল টুকরোগুলো।

সড়সড় করে মেঝের উপর দিয়ে ছুটে যাচ্ছে রাইফেলটা। সিলভিয়ার পায়ের কাছে আসতেই এক লাথিতে পাঠিয়ে দিল ওটাকে আরেক দিকে, ওদের মায়ের নাগালের বাইরে।

মহিলার খপ্পর থেকে সিনথিয়াকে রক্ষা করার জন্য একসঙ্গে এগোল পিটার আর টনি।

খোলা হাতটার উল্টো পিঠ দিয়ে সপাটে টনির মুখে চড় কষাল রোজমেরি। ঠোঁট-টোট কেটে গিয়ে বেরিয়ে এল রক্ত।

অফিসার ঝাঁপ দিল মহিলার উপরে। ওকে আর সিনথিয়াকে নিয়ে শুয়ে পড়ল ও মেঝেতে। মেয়েকে ছাড়েনি রোজমেরি, তেমনি চেপে ধরে রয়েছে বজ্র আঁটুনিতে। এবারে সত্যি সত্যি বের করে নিতে চায় জানটা!

‘হাতটা ছুটিয়ে আনতে হবে ওঁর!’ চিৎকার করল তাহিতি অ্যালবার্টের উদ্দেশে। বলেই, বসে রইল না নিজে। ও আর অ্যালবার্ট—দু’জনেই তৎপর হলো রোজমেরির নাগপাশ শিথিল করতে। মিলিত শক্তির কাছে পরাস্ত হতেই হলো ডাইনির আছর হওয়া মহিলাকে।

নিজেকে সামলে নিয়ে পায়ের উপরে খাড়া হয়েছে টনি, পবিত্র পানির ভায়ালটা বের করে আনল পকেট থেকে। ঢাকনাটা খুলে নিয়ে তর্জনি ডোবাল পানিতে, তার পর ক্রস আঁকল নিজের বুকে।

এই বার….

‘হে, প্রভু!’ আওড়াচ্ছে টনি। ‘সর্বশক্তিমান তুমি… তুমিই পিতা আমাদের…

তৎক্ষণাৎ প্রতিক্রিয়া হলো রোজমেরির। ধনুকের মতো সামনের দিকে বেঁকে গেল মহিলার শরীরটা। তার পর আরও বেঁকে উল্টো-U-এর আকার নিল। চোখ দুটো সটান চেয়ে আছে সামনের দিকে।

মিসেস কুপারের কাছে এসে দাঁড়াল টনি। আঙুল বাড়িয়ে ক্রুশচিহ্ন এঁকে দিল মহিলার কপালে।

‘একে ক্রুসেম ডোমিনে,’ উচ্চ কণ্ঠে আওড়ে চলেছে। ‘ফিউজিটে পারটেস অ্যাডভারসা!’

সব কিছু ছাপিয়ে শোনা যাচ্ছে—নাগাড়ে প্রার্থনামন্ত্র জপে চলেছে তাহিতি।

ড্রেসারের উপরে রাখা ছবিগুলো যেন আলোর গতিতে উড়ে গিয়ে আছড়ে পড়ল বিপরীত-দেয়ালে। ভাঙল ফ্রেম, চুরমার হয়ে গেল কাচ।

‘শ্রদ্ধেয় যাজকের পক্ষ থেকে প্রার্থনার মধ্য দিয়ে হাত জোড় করছি তোমার কাছে, প্রভু!’ আওড়ে চলেছে টনি। ‘শয়তানি শক্তির নিগড়ে বন্দি আমাদের এই বোনটির পরিত্রাণের জন্য সাহায্য চাইছি তোমার আর তোমার প্রধান তিন দেবদূত—মাইকেল, রাফায়েল, গ্যাব্রিয়েলের!’

স্ট্যাচু হয়ে গেছে সিলভিয়া—ভয়ে, আতঙ্কে নিশ্চল।

‘ইমপোন্যাট এক্সট্রেমান পারটে স্টোলা এস!’ বাক্যটা উচ্চারণ করে নিজের বুকে ক্রস আঁকল এবার টনি। এর পর হোলি ওয়াটার ছিটিয়ে দিল রোজমেরির উপরে।

ভয়াল আর্তনাদ বেরিয়ে এল মহিলার গলার ভিতর থেকে। বিশাল হাঁ হয়ে গেছে মুখটা। লালায় তৈরি মাকড়সার বাসা যেন মুখগহ্বরটা। সেকেণ্ডের ভগ্নাংশ সময়ের জন্য স্বচ্ছ রূপ নিল রগ ওঠা ত্বক, স্পন্দিত হচ্ছে দপ দপ করে।

মোচড় খেতে আরম্ভ করল রোজমেরির দেহটা, ঘষটে ঘষটে পাক খেয়ে চলেছে মেঝের উপর দিয়ে। ওর সঙ্গে সঙ্গে ঘুরতে হচ্ছে মহিলাকে ধরে থাকা পিটার আর তাহিতিকেও। অস্বাভাবিক খিঁচ ধরে রয়েছে রোজমেরি কুপারের মাংসপেশি।

হঠাৎ কোত্থেকে প্রবল বাতাস এসে ঢুকতে লাগল ঘরের মধ্যে। বাতাসের দাপটে উড়ে বেড়াতে লাগল সব কিছু। মাথার চুল আর পরনের কাপড়চোপড় সামলানো দায়, সপাত-সপাত আওয়াজ তুলছে চাবুকের মতো।

‘স্যাঙ্কটিসিমা ভেরো ইউক্যারিসটিয়া সুপার কাপুত অবসেসি, আউত অ্যালিটার এস করপোরি নে অ্যাডমোভিয়েটার, ওব ইরেভেরেনশিয়া পেরিকুলাম!’

মহিলার চোখের মণি দুটো ক্রমাগত এপাশ-ওপাশ করছে, দেখতে পেল তাহিতি। নীল হয়ে এল পিচ-কালো মণি দুটো। ভালো-মন্দের লড়াই চলছে যেন ভিতরে।

‘হাল ছাড়বেন না, মিসেস কুপার!’ চিৎকার করে বলল টনির স্ত্রী। ‘প্রভুত্ব করতে দেবেন না ওটাকে আপনার উপর!’

মেঝের উপর দিয়ে হড়কে এল ড্রেসারটা। গভীর দাগ রেখে গেল কাঠের গায়ে। সোজা কাত হয়ে পড়ে যাচ্ছে তাহিতির উপরে।

একটুর জন্য মিস করল ওকে আসবাবটা। চলটা ছিটকে এসে আঁচড় কাটল মহিলার অনাবৃত চামড়ায়।

সিলভিয়ার দিকে চাইল তাহিতি। ‘হেল্প আস!’

ওকে টেনে এনো না এর মধ্যে!’ টনিও বলল চিৎকার করে।

‘না, টনি! কোনও একটা ব্যাপার আছে নিশ্চয়ই, যে কারণে খুন করেনি ওকে দুষ্ট প্রেতটা! ওটার সঙ্গে ফাইট করছে ওর মা, সিলভিয়াই পারবে এ মুহূর্তে মাকে সাহায্য করতে! নিয়ে এসো ওকে এখানে!’

সেকেণ্ডের জন্য কর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ল টনি। ঝড় চলছে মগজের মধ্যে। পরিষ্কার বুঝতে পারছে ও, এ ছাড়া আর নেই করার। মাথা ঝাঁকাল সে স্ত্রীর সঙ্গে একমত হয়ে।

‘ওঁর পা ধরো তুমি!’ সিলভিয়াকে নির্দেশ দিল তাহিতি।

দ্রুত সে-নির্দেশ পালন করল মেয়েটা। মেঝের সঙ্গে চেপে ধরল পা দুটো।

ধনুষ্টঙ্কার রোগীর মতো বীভৎসভাবে বেঁকে যাচ্ছে রোজমেরির দেহটা। এমনভাবে দুমড়ে যাচ্ছে, যেন যে- কোনও মুহূর্তে মড়াত করে ভেঙে যাবে মেরুদণ্ডটা।

জোরাল ধপ আওয়াজে মেঝেতে পিঠ দিয়ে পড়ে গেল রোজমেরি। এখনও পেঁচিয়ে ধরে রেখেছে নিস্তেজ হয়ে পড়া সিনথিয়ার গলা। অক্সিজেনের অভাবে নীল হয়ে গেছে মেয়েটির চেহারা।

মহিলার বাহুবন্ধন আলগা করতে মরিয়া চেষ্টা চালাল টনি আর পিটার। কিন্তু কোত্থেকে যেন হাতির শক্তি এসে ভর করেছে রোজমেরির মধ্যে!

তীব্র বাতাস ঘূর্ণি তুলেছে ঘরের মধ্যে।

তাকাল তাহিতি রোজমেরির চোখের দিকে। এখনও ডান-বাম করছে মণি দুটো।

‘চালিয়ে যান! চালিয়ে যান লড়াই!’ উৎসাহ দিচ্ছে যেন তাহিতি। ‘মনোবল হারাবেন না!’

‘প্লিজ, আম্মু… প্লিজ!’ বলল সিলভিয়া কান্নাভেজা স্বরে। ‘পারবে তুমি! সত্যি সত্যি পারবে! সিনথিকে ছেড়ে দিতে বাধ্য করো ওটাকে!’

‘নোস এরিপেরেস ডি পোটেসটেট ডায়াবোলি! এব অমনি হোস্টে ভিজিবিলি এট ইনভিজিবিলি এট ইউবিক ইন হক স্যেকুলো লিবারেটার!’

প্রচণ্ড শক্তিতে উল্টে গেল খাটটা, দেশলাই-বাক্সের মতো উড়ে গিয়ে আঘাত করল দেয়ালে। বিস্ফোরণের মতো খুলে গেল আচমকা সব ক’টা জানালা। ভোল্টেজের ওঠানামায় মিটমিট করছে বাতিগুলো।

শেষ বারের মতো শরীরের সবটুকু শক্তি দিয়ে চিৎকার ছাড়ল রোজমেরি। খিঁচুনি দিয়ে উঠতে লাগল পেশিগুলো, চামড়ার নিচ থেকে ফুলে-ফেঁপে বেরিয়ে আসার উপক্রম করছে শিরা-উপশিরা। শক্ত করে চেপে ধরে রেখেছে ওকে প্রত্যেকে। আর তার পরই…

কেউ যেন এক টানে খুলে ফেলল রোজমেরির পাওয়ার- প্লাগটা।

নড়াচড়া থেমে গেছে মহিলার। নিথর, নিস্তেজ। প্রাণের স্পন্দন নেই যেন। সিনথিয়ার গলা থেকে বাহুটা খসে পড়ল আলগোছে। মরা লাশের মতো মেঝেতে এলিয়ে পড়ল মেয়েটা।

স্থবির হয়ে পড়েছে সমস্ত কিছু। কোথাও শব্দ নেই কোনও। ফুরিয়েছে সব খেলা।

কালবিলম্ব না করে মেয়ের মুখে মুখ লাগিয়ে শ্বাস দিতে শুরু করল অ্যালবার্ট।

কান্না… প্রার্থনা… প্রত্যাশা… এর মধ্যে একটা কাশির আওয়াজ মনোযোগ কেড়ে নিল সবার।

রোজমেরি ওটা। যুঝছে মহিলা নিজের মধ্যে ফিরে আসার জন্য। শেষমেশ যখন সফল হলো সে-কাজে, ভেঙে পড়ল সে মেয়েকে নড়তে না দেখে।

ঈশ্বর মহান! ছোট্ট একটা কাশি দিয়ে সবার মাঝে স্বস্তি ফিরিয়ে আনল সিনথিয়াও। দম নিল লম্বা করে। অশ্রুর বন্যা বইছে ওর বাপ-বোনের চোখ থেকে।

ছোট মেয়ের চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে আছে রোজমেরি। নিবিড় আলিঙ্গনে টেনে নিল ও মেয়েটাকে। দু’জনেই ভেঙে পড়েছে অদম্য আবেগে। অ্যালবার্ট আর সিলভিয়াও জড়িয়ে ধরল মা-মেয়েকে।

চোখে পানি নিয়ে কুপার পরিবারের পুনর্মিলন দেখল তাহিতি। চাইল এর পর স্বামীর দিকে। চোখাচোখি হলো দু’জনের।’ হাসছে মেয়েটা। কাছে এসে জড়িয়ে ধরল টনিকে।

‘চমৎকার কাজ দেখিয়েছ তুমি!’ গাঢ় স্বরে বলল তাহিতির স্বামী।

‘তুমিও।’

এর পর দীর্ঘ নীরবতা।

‘এখনও কি মনে হচ্ছে, ছেড়েছুঁড়ে দেবে সব কিছু?’ প্রশ্ন রাখল টনি কৌতুকপূর্ণ কণ্ঠে।

ধীরে ধীরে হাসি ছড়িয়ে পড়ল তাহিতির মুখে। ‘না… আপাতত না।’

.

বাড়ি ফিরে এসেছে ওরা। দিনের আলোয় ঝকঝক করছে প্রকৃতি।

ড্রাইভওয়েতে গাড়িটা এসে উঠতেই সদর দরজা পেরিয়ে বাইরে বেরিয়ে এল এমিলি আর ওর দাদি। দৌড়ে গেল মেয়েটা প্লিমাটার দিকে। তর সইছে না ওর বাবা-মা’র সঙ্গে মিলিত হতে।

মেয়েকে কোলে তুলে নিয়ে গভীরভাবে জড়িয়ে ধরেছে তাহিতি, ব্যাকসিট থেকে একটা বাক্স বের করে বাচ্চাটির হাতে তুলে দিল ওর বাবা।

বাক্সটা খুলেই কান ফাটানো খুশির চিৎকার ছাড়ল এমিলি।

এক ডজন মুরগি ছানা কিচির-মিচির করছে ওটার মধ্যে।

উপসংহার

সেদিনই অভিশপ্ত ওই বাড়ি ছেড়ে চলে যায় কুপার পরিবার। কোনও দিনই আর ফিরে আসেনি ওরা ওখানে।

অরেগনে গিয়ে ঠাঁই গাড়ে পরিবারটি। আর কোনও জীবন্ত দুঃস্বপ্নের মুখোমুখি হতে হয়নি ওদের।

কুপাররা বাড়ি ছাড়ার কিছু দিন পরই অজ্ঞাতপরিচয় এক ব্যক্তি কিনে নেয় ওটা। টনি আর তাহিতির দৃঢ় বিশ্বাস, ক্যাথলিক চার্চই মূলত বাড়িটির ক্রেতা।

কুপারদের কেসটার মতো আরও অসংখ্য অলৌকিক ঘটনা তদন্তের অভিজ্ঞতা হয়েছে ডায়েসদের। টনি ডায়েসই ভ্যাটিকান অনুমোদিত একমাত্র ডেমনোলজিস্ট, যাজক না হয়েও যে-লোক সফলতার সঙ্গে প্রেতাত্মার মোকাবেলা করেছে।

ওই ঘটনার বছর খানেক পর ভূতের আছর তাড়াতে আরেকখানে যেতে হয় টনি আর তাহিতিকে।

জায়গাটার নাম-অ্যামিটিভিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *