অদেখা ভুবন – ১.৩০

ত্রিশ

হলওয়েতে, ক্যামেরা-ট্রাইপডের উপর বসানো ইএফডি মিটারের কাঁটা কাঁপাকাঁপি করতে লেগেছে ওয়ান পয়েন্ট সেভেন মেগাহার্টজের ঘর ছাড়িয়ে। এক পর্যায়ে এক লাফে স্পর্শ করল দশের ঘরের বাইরের প্রান্ত।

সঙ্গে সঙ্গে শটাশট ফ্ল্যাশ জ্বলতে লাগল ক্যামেরার। মোটর ড্রাইভের ক্লিক ক্লিক আওয়াজটা মিশে যেতে লাগল ফ্ল্যাশের শব্দটার সঙ্গে।

আলোর আচমকা ঝলকানি আর আওয়াজটা কিচেনের বাইরে তাকাতে বাধ্য করল পিটার আর তাহিতিকে। চট করে হলওয়েতে বেরিয়ে এল মহিলা। সঙ্গে সঙ্গেই হল-এর ক্যামেরায় ফ্ল্যাশ ঝলসে উঠল আরেক বার।

সিঁড়ির তলায় এসে দাঁড়িয়েছে টনি আর মাইকেল। ওদেরও দৃষ্টি সেঁটে আছে ক্যামেরার দিকে।

এক সেকেণ্ড বাদে, সিঁড়ির মাথায় বসানো ক্যামেরাটাতেও ঝলসাতে শুরু করল ফ্ল্যাশ!

‘উপরে উঠছে ওটা!’ বলল টনি উত্তেজিত স্বরে।

দ্রুত লিভিং রুমে এসে যোগ দিল ও রোজমেরি আর অ্যালবার্টের সঙ্গে। মনিটরে আঠার মতো আটকে আছে ওদের বিস্ফারিত চোখের দৃষ্টি। অন্ধকার হলওয়েতে বারংবার ফ্ল্যাশ মারছে ক্যামেরা—সেটাই দেখাচ্ছে ভিডিয়োর পরদা।

পিটার, তাহিতি আর মাইকেল এসে হাজির হলো টনির পিছনে।

‘ওহ, মাই গড!’ আঁতকে উঠল রোজমেরি।

সিলভিয়ার কামরা দেখতে পাচ্ছে ওরা মনিটরে। ছোট বোনের সঙ্গে শান্তির ঘুম ঘুমাচ্ছে মেয়েটা। রোজমেরির আঁতকে ওঠার কারণটা হলো—মেয়ে দুটোর নিঃশ্বাসের সঙ্গে বেরিয়ে আসা বাষ্প। ঠাণ্ডা হয়ে এসেছে সিলভিয়া আর সিনথিয়ার শ্বাসপ্রশ্বাস।

‘এত দ্রুত কখনও তাপমাত্রা নেমে যেতে দেখেছি বলে মনে পড়ছে না আমার!’ উত্তেজিত কণ্ঠে স্বীকার করল মাইকেল।

এবার ফ্ল্যাশ করতে শুরু করল মেয়েদের কামরার ক্লজিটে রাখা ক্যামেরাটা। ফস… ফস… ফস… ফস আওয়াজের সঙ্গে উজ্জ্বল সাদা আলোর ঝলকানি।

নড়ে উঠল মেয়েরা।

স্থির থাকা কঠিন হয়ে উঠল অ্যালবার্টের জন্য।

আচমকা চোখ দুটো খুলে গেল সিলভিয়ার। ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসল মেয়েটা। চেহারায় বিভীষিকার ছায়া। বাতির কাঁপা কাঁপা আলোয় ছাড়া ছাড়া একটা অবয়ব দেখতে পাচ্ছে কোনও কিছুর, জানালার বাইরে থেকে তাকিয়ে আছে যেটা ঘরের ভিতরে!

জানোয়ার ওটা, অন্য কোনও ভুবনের! ছায়ার রূপে এর আগেও দেখা দিয়েছিল সিলভিয়াকে।

চিল-চিৎকার দিয়ে উঠল মেয়েটা।

তড়াক করে বিছানায় উঠে বসেছে এবার সিনথিয়া। ঠিক তক্ষুনি স্লাইড-বোল্টের জোরাল আওয়াজ প্রতিধ্বনিত হতে লাগল অনবরত। খুলছে আর বন্ধ হচ্ছে ওটা নাগাড়ে।

শব্দটা আসছে ক্লজিট থেকে। পাজি কোনও বাচ্চার কাণ্ডকারখানা যেন, বাজনা বাজাচ্ছে হুড়কো দিয়ে।

আর অপেক্ষা করা সম্ভব হলো না অ্যালবার্টের পক্ষে। ছিটকে বেরোল ও কামরা থেকে।

হঠাৎ করেই থেমে গেল গোলমালের ধাতব আওয়াজটা। নেমে এল শান্তির নীরবতা।

বন্ধ হয়ে গেছে ফ্ল্যাশের ঝলকানিও। অন্ধকারে ডুবে গেছে আবার কামরাটা।

অন্ধকারেই তীরবেগে ছুটে বেরোল মেয়েরা নিজেদের কামরা থেকে। ততক্ষণে অ্যালবার্টও পৌঁছে গেছে হলওয়েতে। ঝাঁপিয়ে পড়ল ওরা বাপের বাহুডোরে।

হল-এর শেষ মাথায় বসানো ক্যামেরাটার ফ্ল্যাশ জ্বলে উঠল একটি বার।

অদৃশ্য-আতঙ্কে চেঁচিয়ে উঠল মেয়ে দুটো।

সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠছে টনি, আরেক বার ফ্ল্যাশ জ্বলল ল্যাণ্ডিঙে বসানো ক্যামেরাটায়। তার এক সেকেণ্ড পর নিচের হলওয়েতে উজ্জ্বল আলো জ্বলে ওঠায় ওদিকে মনোযোগ চলে গেল টনির।

আরও ফ্ল্যাশ জ্বলার জন্য অপেক্ষা করছে ও। কিন্তু আর জ্বলে উঠল না আলো।

বৈঠকখানা থেকে বেরিয়ে এসে উপরে তাকাল তাহিতি—স্বামীর দিকে।

‘যা-ই হোক না কেন, নিচে নেমে গেছে জিনিসটা,’ বলল টনি গম্ভীর মুখে।

একত্রিশ

অ্যালবার্টের কোলে সিনথিয়া, নিজেদের বিছানার প্রান্তে বসে আছে লোকটা। অন্য দিকে সিলভিয়াকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে রোজমেরি, বসেছে বিছানার আরেক কিনারে।

তাকাল অ্যালবার্ট বউয়ের দিকে। ‘রোজি…’

দু’জোড়া চোখ মিলিত হলো পরস্পরের সঙ্গে।

কীভাবে বলবে কথাগুলো, বুঝতে পারছে না অ্যালবার্ট। ভিতরটা হাতড়ে খুঁজে পাচ্ছে না কোনও শব্দ বা বাক্য।

‘…বলতে হবে না, ডারলিং,’ শেষমেশ মুখ খুলল রোজমেরি। ‘বুঝতে পেরেছি আমি।’

.

নিজের সামনে একখানা ইএফডি বাড়িয়ে ধরে সিলভিয়ার ক্লজিটের দিকে এগোচ্ছে মাইকেল ধীর পায়ে। এগোতে এগোতে দৃশ্যটা ভিডিয়ো করছে পিটার পারকার।

ক্লজিটের পিছনের দেয়াল ভালো মতো দেখার জন্য কাপড়গুলো এক পাশে সরিয়ে দিল মাইকেল।

কামরার প্রবেশমুখে দাঁড়িয়ে ট্রাইপডে বসানো ক্যামেরা থেকে ফিল্ম আনলোড করছে টনি—দেখছে তাহিতি।

ইএফডি সরিয়ে ফেলল মাইকেল দেয়ালের কাছ থেকে।

‘নাহ, পাওয়া গেল না কিছু,’ রিপোর্ট করল ঠোঁট উল্টে।

এ সময় অ্যালবার্ট এসে মিলিত হলো ওদের সঙ্গে।

কেমন আছে মেয়েরা?’ জিজ্ঞেস করল তাহিতি।

‘আগের চাইতে ভালো,’ বলল ওদের বাবা।

তাকাল টনি লোকটার দিকে। ‘কসম কেটে বলছিল ওরা, ক্লজিটের ভিতর থেকেই শোনা যেত হুড়কোর আওয়াজটা…’

‘…হ্যাঁ।’

‘কিছু কি আছে দেয়ালের ওই পাশে?’ প্যানেলের গায়ে আঙুলের গাঁট দিয়ে টোকা দিল টনি।

‘কোনও ধারণা নেই আমার।’ অনিশ্চিতভাবে কাঁধ ঝাঁকাল অ্যালবার্ট

‘পরীক্ষা করে দেখলে আপত্তি আছে?’

‘ভেঙেও যদি ফেলেন, কিচ্ছু যায় আসে না তাতে!’ চোয়াল শক্ত হলো মিস্টার কুপারের।

.

খানিক বাদেই মজবুত কাঠের প্যানেলিঙের একটা অংশে হাতুড়ির সাহায্যে কসরত করতে দেখা গেল টনি ডায়েসকে। দেয়াল থেকে খসিয়ে আনার চেষ্টা করছে ও ওই অংশটা। আলগা করার জন্য বার বার প্যানেলটার উপরে-নিচে হাতুড়ির চ্যাপ্টা মাথাটা ঢুকিয়ে চাড় দিতে লাগল।

শেষমেশ আলাদা করতে পারল টেনে।

সবার আগে ভিতরে তাকাল তাহিতি।

আরেকটা দেয়াল ওপাশে। দুই ফুট বাই দুই ফুট মাপের ছোট এক ট্র্যাপডোর দেখা যাচ্ছে দেয়ালের গায়ে। বাইরে থেকে হুড়কো লাগানো দরজাটায়।

চোখ বুজল তাহিতি।

বেজায় মোটা হাতের এক মহিলা, সসেজের মতন যার আঙুলগুলো, রাগের সঙ্গে দড়াম করে লাগিয়ে দিল দরজাটা। তার পর আটকে দিল ল্যাচ টেনে…

অন্যরাও উঁকিঝুঁকি মারতে শুরু করেছে মহিলার দু’পাশ থেকে।

ট্র্যাপডোরের সামনে হাঁটু গেড়ে বসল টনি। খুলে দিল ল্যাচটা। তার পর ধীরে ধীরে খুলে ফেলল দরজাটা।

এত অন্ধকার যে ভিতরটা, বোঝাই যায় না, কী রয়েছে ওপাশে।

‘কেউ কি একটা ফ্ল্যাশলাইট আনতে পারবে?’ চাইল ও।

‘আনছি,’ বলল অ্যালবার্ট। ‘আমাদের ঘরে একটা আছে।’

কিছুক্ষণের জন্য অদৃশ্য হয়ে গেল ও।

স্বামীর কাঁধে হাত রাখল তাহিতি। ‘আমি ঢুকতে চাই ওখানে।’

ছোট একটা ফ্ল্যাশলাইট নিয়ে গৃহস্বামী ফিরে এলে হামাগুড়ি দিয়ে মেঝেতে বসল তাহিতি। লাইটটা তুলে দিল অ্যালবার্ট ওর হাতে।

যন্ত্রটার সুইচে বুড়ো আঙুল দাবাল মহিলা। আলো ফেলল খোলা দরজা দিয়ে।

চারপাশে কাঠঘেরা, গুড়ি মেরে এগোনোর মতো সঙ্কীর্ণ এক পথ জুড়ে ছড়িয়ে পড়ল আলো।

শরীরের উপরের আধখানা ভিতরে ঢুকে গেল তাহিতির, হাতে ধরা ফ্ল্যাশলাইটটা আলোকিত করে রেখেছে সামনেটা।

এত সরু জায়গা দিয়ে এগোনো কষ্টসাধ্য কাজ। তার পরও এগিয়ে চলেছে তাহিতি। কারণ, অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, প্রশস্ত কোনও স্পেসে শেষ পর্যন্ত উন্মুক্ত হতে চলেছে পথটা।

‘কোনও ধরনের কামরা মনে হচ্ছে,’ বিড়বিড় করল মহিলা।

কোনও রকম আভাস না দিয়েই অকস্মাৎ নিভে গেল লাইটটা। ঘুটঘুটে অন্ধকারে তলিয়ে গেল তাহিতি।

হাতের তালু দিয়ে বার কয়েক বাড়ি দিল মহিলা। আলোয় আলোকিত হলো আবার সঙ্কীর্ণ জায়গাটা।

আলোটা সামনে ধরতেই উদ্বেগ আর আতঙ্কে ভরা বাচ্চা দুটো ছেলেমেয়েকে দেখতে পেল তাহিতি, হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে আসছে ওরই দিকে!

সোজা মহিলার শরীর ভেদ করে বেরিয়ে গেল দু’জনে!

এদেরকেই ছবিতে দেখেছিল তাহিতি!

কাঁপছে যুবতী। তার পরও অব্যাহত রাখল এগোনো।

এক সময় পৌছে গেল গুপ্ত কামরাটায়।

ধীরে ধীরে সিধে হয়ে দাঁড়াল তাহিতি। অন্ধকারের চার ভাগের এক ভাগ মাত্র দূর করতে পারছে ফ্ল্যাশলাইটের দুর্বল আলো, সর্বত্র ছড়ানো মাকড়সার জালগুলোর গায়ে বাধা পেয়ে ফিরে আসছে।

পুরানো, ধুলোময় কম্বল রাখা অস্থায়ী এক বিছানার উপর গিয়ে পড়ল আলোটা। সুন্দর দেখতে একটা খেলনা বিছানাটার উপরে।

কাছে গিয়ে তুলে নিল ওটা তাহিতি। আরও খেলনা রাখা কাঠের একটা বাক্স চোখে পড়ল ওর বিছানাটার পাশে।

ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চারপাশে আলো ফেলল মহিলা। আবিষ্কার করল, সব ক’টা দেয়ালেই আঁকাবাঁকা অক্ষরে একই বাক্য লেখা ক্রেয়ন দিয়ে। উপরে, নিচে, ডাইনে, বাঁয়ে—সবখানে বার বার লিখে ভরিয়ে ফেলা হয়েছে দেয়ালগুলো।

কাছে গেল তাহিতি। এবার বুঝতে পারছে, কী লেখা রয়েছে দেয়ালে।

সরি, মা।

সরি, মা।

সরি, মা।

সরি, মা…

থমকে গেল তাহিতি। কিছু যেন অনুভব করছে ও। আস্তে করে দেয়াল থেকে আলোটা সরিয়ে ফেলল কবজির উপর।

দাঁড়িয়ে গেছে রোমগুলো।

এক সেকেণ্ডের জন্য বিট মিস করল হার্টটা।

আরও কিছু একটা দেখতে পেয়েছে ও চোখের কোনা দিয়ে…

কবজি থেকে আলোটা গিয়ে পড়ল এবার পিছনে, মেঝের উপর। রোজামাণ্ডের নোংরা, হাড়সর্বস্ব নগ্ন পা জোড়া দেখতে পেল মহিলা আস্তে করে ঘাড়টা ঘুরিয়ে; মনে হচ্ছে, মূর্ছা যাবে।

ঘুরে দাঁড়ানোর আগেই আগ্রাসীভাবে দেয়ালের মধ্যে সেঁধিয়ে গেল রোজামাণ্ড!

অবিশ্বাস্য এই দ্রুততা কাঁপিয়ে দিল ফ্ল্যাশলাইটটাকে। হাত থেকে খসে মেঝেতে পড়ে গেল ওটা। বদ্ধ কামরায় আওয়াজ হলো বিকট।

বত্রিশ

আওয়াজটা কানে যেতেই তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া হলো টনির। চট করে মাথা ঢুকিয়ে দিল ও ট্র্যাপডোরের ভিতর।

‘তাহিতি….?’ ডেকে উঠল উৎকণ্ঠিত গলায়।

.

যে মুহূর্তে হামাগুড়ি দিয়ে গুপ্ত কামরাটায় পৌঁছাল টনি, ঠিক সে-মুহূর্তেই ফ্ল্যাশলাইটটা খুঁজে পেল তাহিতি।

‘ঠিক আছি আমি,’ স্বামীকে আশ্বস্ত করল মহিলা। এক সেকেণ্ড পর বলল, ‘এটা ওই মহিলা, টনি!’

তীব্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে টনির স্ত্রী। ভালো মতন ঝাঁকি খেয়েছে একটু আগের অভিজ্ঞতাটায়।

‘কোনও কিছুকে এত অশুভ বোধ করিনি এর আগে!’ আবার বলল মহিলা। ‘এ-বাড়ি থেকে তাড়াতে হবে ওটাকে…..

ট্র্যাপডোর দিয়ে বেরিয়ে এল টনি আর তাহিতি।

মাইকেলের দিকে চাইল টনি সরাসরি।

‘সব ক’টা ক্যামেরা এক করো, মাইক। দেখতে চাই, কী পেয়েছি আমরা!’

.

ত্বরিত তৎপরতায় নিচতলার বাথরুমটাকে ছোট এক ডার্করুমে পরিণত করছে টনি আর মাইকেল। সম্যক ধারণা রয়েছে ওদের নিজেদের কাজ সম্বন্ধে

একটা ফোটো এনলার্জার রাখা হয়েছে কাউন্টারে। পাশেই তিনখানা সলিউশনের ট্রে পর পর সাজানো। এ ছাড়া শাওয়ারের রড থেকে ঝুলছে ছোট একটা রশি।

তিনটে ট্রের একটাতে ডেভেলপার ঢালছে মাইকেল, এদিকে বালব লাগানো শেষ হয়েছে টনির। দেয়ালের সুইচ চাপতেই গাঢ় লালচে আলোয় ডুবে গেল ভিতরটা।

.

লিভিং রুমে, মনিটরের সামনে বসে আছে তাহিতি; মাস্টার বেডরুম দেখাচ্ছে যেটাতে, চেয়ে রয়েছে ওটার দিকে। বিছানায় শোয়া ঘুমন্ত সিনথিয়াকে বুকের কাছে জড়িয়ে ধরে রেখেছে ওর বাবা। নিদ্রামগ্ন সিলভিয়াকেও একইভাবে আলিঙ্গনে বেঁধেছে পাশে শোয়া রোজমেরি। খোলা জানালা দিয়ে ভেসে আসছে ঝিঁঝি আর ব্যাঙের সঙ্গত।

জোরাল এক থপ-থপ আওয়াজ বাইরে তাকাতে বাধ্য করল তাহিতিকে। দেখতে পেল, গোলাঘরের পাশের মাটিতে দাপাদাপি করছে কিছু একটা; ধুলো উড়ছে তার ফলে। যেন কোনও ধরনের জোর-জবরদস্তি হচ্ছে ওখানে!

এক পেয়ালা ধূমায়িত কফি হাতে কামরায় প্রবেশ করলে পিটার পারকারের দিকে তাকাল মহিলা।

‘কিছুক্ষণের জন্য চোখ রাখবেন মনিটরে? আসছি আমি এখুনি।’

বেরিয়ে গেল তাহিতি কামরা ছেড়ে।

.

যেখানটায় দাপাদাপি হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে, সেদিকে এগোচ্ছে তাহিতি।

প্রতিটা পা ফেলার সঙ্গে সঙ্গে থিতিয়ে আসছে যেন তোলপাড়টা।

যখন পৌছাল ওখানে, থেমে গেল একদম।

জিনিসটা কী, বুঝতে পারছে এখন তাহিতি। বিশাল এক গোলাঘরের-পেঁচা।

ঘাড়টা ভাঙা। চোখ দুটো বিস্ফারিত।

মরে গেছে পাখিটা।

আফসোসের একটা অভিব্যক্তি খেলে গেল তাহিতির চেহারায়। তার পরই কানে এল ওর দূরাগত একটা সম্মিলিত কণ্ঠের আওয়াজ: যন্ত্রণাকাতর; আতঙ্ক আর উদ্বেগে ভরা।

আওয়াজটা অনুসরণ করে গোলাবাড়িটার পিছনদিকে চলে এল তাহিতি।

গাছ আর গুল্মলতার পুরু দেয়ালের ওপাশে পুরানো এক পরিত্যক্ত পায়ে-চলা পথের আভাস পাওয়া যাচ্ছে যেন, চলে গেছে গাছপালার ভিতর দিয়ে

সামনে এগোল তাহিতি।

.

জঙ্গলাকীর্ণ পথটা ধরে যতই এগোচ্ছে, ততই বেড়ে চলেছে আওয়াজটা। আগ্রাসী ডালপাতা সরিয়ে কষ্টেসৃষ্টে এগিয়ে চলেছে তাহিতি। দেখতে চায়, কী রয়েছে পথটার শেষে।

ছোট এক ফাঁকা জায়গায় বেরিয়ে এল ও এক পর্যায়ে।

কোত্থেকে আসছে আওয়াজটা?

ভাঙাচোরা পাথরের দেয়াল আর আগাছার জঙ্গল-ঘেরা পুরানো এক কবরখানা তাহিতির সামনে। অন্তত চল্লিশটা কবরফলক হবে ওর ভিতরে। কিছু ভেঙে গেছে, নড়বড়ে হয়ে পড়েছে কোনোটা, কিছু আবার কালের প্রবাহে ধুলোয় মিশে যা ওয়ার অপেক্ষায়।

গলার আওয়াজটা কবরখানার ওপাশে কোথাও থেকে আসছে বলে মালুম হচ্ছে।

ঢুকে পড়ল তাহিতি গোরস্তানের মধ্যে।

জমিনের উপর দিয়ে ঝরাপাতা ঝেঁটিয়ে নিয়ে চলেছে বাতাস। বিশেষ একটা সমাধিফলক মনোযোগ আকর্ষণ করল মহিলার।

কার কবর, পড়ল ও নামটা।

রোজামাণ্ড ওয়াইল্ডার!

সম্মোহিতের মতো এগিয়ে যাচ্ছে তাহিতি কবরটার দিকে। এদিকে সমস্বরে হয়ে চলা আওয়াজটা জোরাল হচ্ছে ক্রমেই। কানে যেন তালা লাগার জোগাড়।

অকস্মাৎ থেমে গেল সমস্ত আওয়াজ। মৃত্যুর মতো নীরবতা নেমে এসেছে যেন চারপাশে।

সাহস হারাতে শুরু করেছে তাহিতি। কিছু একটা যেন অনুভব করছে ও। কারও উপস্থিতি। কাছে… খুব কাছে…

চারপাশের গাছপালাগুলো জরিপ করল তাহিতি। কিন্তু সমস্ত কিছুকেই গ্রাস করে নিয়েছে রাতের ছায়া।

তাকিয়ে রইল তা-ও। কারণ, ও জানে, গাছগুলোর ঠিক ওপাশে রয়েছে কিছু একটা।

এক মুহূর্ত পর ঘুরল মহিলা রোজামাও ওয়াইল্ডারের কবরটার দিকে।

কবরফলকের সামনের মাটি ভেদ করে উঁকি দিচ্ছে কী যেন।

ছোট এক বাচ্চার হাত ওটা! আধেক ঢাকা পাতা আর ময়লায়।

হাতটার রং ফ্যাকাসে সাদা, নখগুলো ভাঙা ভাঙা, সম্পূর্ণ কালো হয়ে আছে নোংরায়।

আরও কিছু পাতা উড়ে গেল জমিনের উপর দিয়ে আরেকটু উন্মুক্ত হয়ে পড়ল কোনও রকমে কবর দেয়া শরীরটা।

ইঞ্চি কয়েক কাছিয়ে গেল তাহিতি।

সত্যিই বাচ্চা এক মেয়ের লাশ ওটা। উল্টো দিকে কাত হয়ে রয়েছে মাথাটা। জট পাকানো চুলগুলো লেপটে রয়েছে পোরসেলিন-সাদা মুখের পাশে।

ভালো করে দেখার জন্য ঘুরে ওদিকটায় চলে গেল তাহিতি। হ্যাঁ, এবারে দেখতে পাচ্ছে ছোট্ট মেয়েটির মুখটা…

ভয় আর আতঙ্কে ফ্যাকাসে হয়ে গেছে তাহিতি।

এ যে ওরই মেয়ে! ছোট্ট এমিলি!

ডুকরে উঠল মহিলা।

বিচিত্র একটা ব্যাপার ঘটতে আরম্ভ করল তখন। ধূসর হতে শুরু করল মৃত মেয়েটির ফ্যাকাসে ত্বক। গাঢ় হতে হতে হয়ে গেল ছাইয়ের মতো। এক ঝলক বাতাস এসে ধুলোর মতো উড়িয়ে নিয়ে গেল এমিলিকে! চতুর্দিকে ছড়িয়ে গেল মৃত দেহটার প্রতিটি কণা।

শরীর আর সত্তা জুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল তাহিতির। কিছু যেন পরিষ্কার হয়ে আসছে ধীরে ধীরে। উপলব্ধিটা স্থবির করে দিল ওকে কয়েক মুহূর্তের জন্য। তার পর উল্টো ঘুরে ছুট লাগাল মহিলা, ঠিক যেদিক থেকে এসেছিল।

তেত্রিশ

বুনো একটা ঢাল বেয়ে ফিরে আসার পথ খোঁজার প্রয়াস পাচ্ছে তাহিতি, চারদিক থেকে জামাকাপড়ে ডালের থাবা বসাতে চাইছে যেন ঝুঁকে আসা গাছপালাগুলো।

হঠাৎ করেই ঢালের মাথায় দেখতে পেল মহিলা গোলাটাকে।

আর, দেখা মাত্রই বিদ্যুৎ খেলে গেল শরীরে। সোজা গায়ের জোরে উড়িয়ে দিল ও সামনে পড়া ডালপাতার প্রতিবন্ধকতা। জঙ্গলের বুনট ভেদ করে উঠে এল ঢালের উপরে।

থামল না এর পরও। প্রাণপণে বাড়ির দিকে দৌড়ে চলল গোলাটাকে পিছনে ফেলে।

সামান্য একটু গতি কমল কেবল বাড়িটার কাছাকাছি পৌঁছে। পরের সেকেণ্ডে আক্ষরিক অর্থেই আছড়ে পড়ল মহিলা সদর দরজাটার উপরে। বুলেটের বেগে ফয়ারে পা রেখেই ছুটল ও কিচেনের দিকে

বৈঠকখানা থেকে সবই দেখল পিটার। বিভ্রান্ত হয়ে পড়ল ও মহিলার এ বিক্ষিপ্ত উত্তেজনা দেখে।

হাঁ করে শ্বাস নিতে লাগল তাহিতি কিচেনে পৌঁছে। সুস্থির হওয়ার আগেই ছোঁ মেরে তুলে নিল ফোনটা দেয়াল থেকে। ডায়াল করল ঝড়ের গতিতে।

ঢুকল টনি কিচেনে এসে। ফেটে পড়ছে ও কৌতূহলে। কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, হাত তুলে থামিয়ে দিল ওকে তাহিতি। কানে ঠেসে ধরেছে ও ফোনটা।

‘মা!’ বলল ও ওদিককার উদ্দেশে। ‘তাহিতি বলছিলাম! …ঠিক আছে তো এমিলি?’ ঠোঁট কামড়ে ওপাশের কথা শুনল চুপচাপ। ‘আপনি কি একবার দেখে আসবেন, প্লিজ?’ ছটফট করছে মহিলা। ‘দোহাই, মা! দেখে আসুন না একটি বার!’ কাতর দৃষ্টিতে চাইল তাহিতি স্বামীর দিকে। বাধ মানছে না চোখের পানি। অপেক্ষা করতে লাগল ফোনটা কানে ধরে।

‘কী হচ্ছে, দয়া করে বলবে আমাকে?’ শুধাল টনি বিচলিত কণ্ঠে

‘এমিলি!’ কেঁদে ফেলবে যেন তাহিতি।

‘কী বলছ এসব! কী হয়েছে এমিলির?’

‘ওকে দেখেছি আমি! জঙ্গলের মধ্যে… ও… ও…’

ফোনের ওপাশে আবার কথা বলে উঠলেন তাহিতির শাশুড়ি।

ফোঁস করে স্বস্তির দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল তাহিতি।

‘থ্যাঙ্ক ইউ, মা!’ বলে উঠল কান্নাভেজা কণ্ঠে। ‘এভাবে আসলে ভয় পাইয়ে দিতে চাইনি আপনাকে!’ ওপাশের কথা শুনে বলল, ‘পরে ব্যাখ্যা করব সব কিছু। … ঠিক আছে, মা। গুডনাইট।’ আস্তে করে ঝুলিয়ে রাখল ও ফোনটা।

‘হয়েছেটা কী তোমার, বলো তো!’ রেগে উঠল টনি। ‘দেখে মনে হচ্ছে, ভূতের তাড়া খেয়েছ!’

‘ভয়ানক বিপর্যস্ত দেখাচ্ছে তাহিতিকে। এখনও অশ্রু গড়াচ্ছে দু’চোখ থেকে।

’গোলাঘরটার পিছনে একটা কবরখানা আছে। ওখানে দেখেছি আমি এমিলিকে… মৃত অবস্থায়! এখন আমি বুঝতে পারছি, কোনও ধরনের ওয়ার্নিং ছিল ওটা! অসংখ্য প্রেতাত্মা আটকা পড়ে আছে ওখানে! ওদের গলার আওয়াজ শুনতে পেয়েছি আমি! রোজামাণ্ড… জীবিত আর মৃত—দুই জগতেই আধিপত্য রয়েছে ওই মহিলার!’

‘এসব বন্ধ করতে হবে তোমার!’ কঠোর কণ্ঠে বলল টনি।

ভ্যাবাচ্যাকা খেল তাহিতি। ‘বন্ধ করব! কী বন্ধ করব?’

স্ত্রীর কাঁধে হাত রাখল টনি ডায়েস। ‘ওগুলো… ভালো করেই বুঝতে পারছ, কীসের কথা বলছি। আগেই সাবধান করেছিলাম তোমাকে।’

‘মনে করেছিলাম, কিছু হয়েছে আমাদের এমিলির…’

‘কিচ্ছু হয়নি….’

আলতো করে স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরল টনি। সহমর্মিতা প্রকাশ পাচ্ছে আলিঙ্গনে।

‘যতটুকু শক্তিশালী ওটা, তার চাইতে আরও বেশি ক্ষমতা যাতে না পেয়ে যায়…’ বলল টনি ফিসফিস করে। ‘তা হলে কিন্তু খারাপ হবে ব্যাপারটা।’

চিন্তা করে দেখল তাহিতি। উপলব্ধিতে এল ওর টনির বলা কথাগুলো। ঠিকই বলছে লোকটা। মনের জোর না হারানোটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এখন। হালকা নড করল মহিলা স্বামীর উদ্দেশে।

কিচেনে মাথা ঢোকাল অ্যালবার্ট, কোলে আধা-জাগ্রত সিনথিয়া।

‘ঠিক আছেন তো আপনারা?’ জিজ্ঞেস করল লোকটা। টনি তাকাল তাহিতির দিকে। ফের চাইল অ্যালবার্টের উদ্দেশে।

‘ইয়াহ।’ এক মুহূর্ত থামল ও কথাটা বলে। ‘আপনারা?’

‘জেগে গিয়েছিল সিনথিয়া। ভয় পাচ্ছিল একটু একটু…’

চৌত্রিশ

বাথরুমে।

ডেভেলপারের ট্রেতে চোবানো একখানা ফোটো-পেপার চিমটা দিয়ে তুলে ধরল টনি। সিঁড়ির ছবি ফুটে উঠতে শুরু করেছে ওটাতে।

এরই মধ্যে ডেভেলপ হওয়া আরেকখানা ছবি ওয়াশ-ট্রে থেকে তোলায় ব্যস্ত মাইকেল। শাওয়ারের রডে আটকানো রশিতে ক্লিপ দিয়ে আটকাল ও ছবিটা।

দুটো ছবিই স্পষ্ট এখন।

চিমটায় ধরা ছবিটাতে ফুটে ওঠা কিছু একটা চোখের কাছে এনে দেখতে বাধ্য করল টনিকে।

কীসের জানি একটা অবয়ব মূর্ত হয়ে উঠছে সিঁড়ির উপরে।

.

শশব্যস্তে বসার ঘরে ফিরে এল টনি।

ঘুমিয়ে পড়েছে সিনথিয়া। গুটিসুটি মেরে রয়েছে অ্যালবার্টের পাশের সোফায়। মেয়ের চুলে বিলি কেটে দিচ্ছে বাবা।

ধপ করে মনিটরের পাশের চেয়ারে বসল পিটার পারকার।

কাছেই একটা আসন দখল করেছে তাহিতি। ও আর অ্যালবার্ট তাকাল টনির দিকে।

‘একটা জিনিস দেখা দরকার তোমাদের!’ বলল টনি ফিসফিসিয়ে।

.

কিচেন।

টেবিল ঘিরে দাঁড়িয়েছে টনি, তাহিতি, অ্যালবার্ট আর রোজমেরি। তাকিয়ে আছে টেবিলে রাখা ফোটোগ্রাফটার দিকে।

মাইকেল দাঁড়িয়ে আছে টেবিলের এক ধারে। ওর হাতে আরও দুটো ফোটোগ্রাফ।

‘এই ছেলেটাকেই দেখেছি আমি গুপ্ত কক্ষে,’ বলল তাহিতি।

পুরোপুরি নিরেট নয় যদিও অবয়বটা—অর্ধস্বচ্ছ এবং ঘোলাটে, তার পরও চিনে নিতে একটুও কষ্ট হচ্ছে না মহিলার। নিশ্চিত করেই বলা যায়, ছবির এই চশমা পরা ছেলেটাই দেখা দিয়েছিল গোপন কক্ষটাতে।

সিঁড়ির মাথায় দাঁড়িয়ে আছে ছেলেটা। নামতে উদ্যত। ‘এবার এটা দেখুন।’ দ্বিতীয় আরেকটা ফোটোগ্রাফ রাখল মাইকেল।

একই অ্যাঙ্গেল থেকে উঠেছে ছবিটা ক্যামেরায়। তবে এটায় পাঁচ কদম নেমে এসেছে ছেলেটি।

আরেকটা পার্থক্য হচ্ছে—চশমাধারীর আতঙ্কিত চেহারা। কাঁধের উপর দিয়ে চেয়ে রয়েছে ও পিছনে। কেউ বা কিছু যেন রয়েছে সিঁড়ির মাথায়।

‘কী দেখছে ছেলেটা?’ নিজেকেই যেন জিজ্ঞেস করল অ্যালবার্ট।

‘এটা…’ তৃতীয় এবং শেষ ছবিটা টেবিলে ফেলল মাইকেল।

এই ছবিতে ছেলেটা অনুপস্থিত। ওর বদলে অশুভ উপস্থিতি রয়েছে অন্য আরেক জনের।

রোজামাণ্ড ওয়াইল্ডার! দাঁড়িয়ে রয়েছে সিঁড়ির একেবারে মাথায়।

ছেলেটার মতোই অর্ধস্বচ্ছ, ঘোলাটে অবয়ব রোজামাণ্ডের, তা-ও চেহারার বৈশিষ্ট্য এটায় বেশি স্পষ্ট। সবচেয়ে বেশি যেটা চোখে পড়ে, তা হচ্ছে— মহিলা-র মণিবিহীন, তুষারশুভ্র চোখ দুটো।

‘এই সেই মহিলা!’ দম চেপে বলল তাহিতি।

বড় বড় হয়ে উঠেছে অ্যালবার্ট আর রোজমেরির দৃষ্টি, সারা শরীর অবশ যেন।

‘…মহিলাকে দেখে ভয় পাবে কেন ছেলেটা?’ সঙ্গত কারণেই প্রশ্নটা করল অ্যালবার্ট। ‘ওরা দু’জনেই তো মৃত!’

‘সেটা আমাদের দৃষ্টিকোণ থেকে,’ জবাব দিল তাহিতি। ‘কিন্তু ছেলেটার দিক থেকে দেখলে, ওই মহিলা জীবন্ত ওর কাছে। যেমন আপনার কাছে জীবন্ত আমি এবং আমরা।’ পরের কথাগুলো গুছিয়ে নিয়ে বলল, ‘ডাইনি হিসেবে মৃত্যু হয়েছে বটে রোজামাণ্ডের, কিন্তু এমন এক শক্তি নিয়ে ফিরে এসেছে, যে ক্ষমতা এক মাত্র শয়তানই দিতে পারে ওকে…

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *