এক
হ্যারিসভিল, রোড আইল্যাণ্ড। উনিশ শ’ বাহাত্তর সাল।
একই ফার্মহাউসের নুড়ি বিছানো ড্রাইভওয়েতে উঠে এল কাঠের প্যানেল করা একখানা ওয়াগেন। উঁহুঁ… আদ্যিকালের ওয়াগেন নয়, উনিশ শ’ সত্তর মডেলের স্টেশন ওয়াগেন ওটা। সামনে-পিছনে নিউ জার্সির নাম্বারপ্লেট লাগানো।
‘এসে গেছি…’ উৎফুল্ল গলা শোনা গেল অ্যালবার্ট কুপারের।
শ’ খানেক গজ দূরে দাঁড়ানো দ্বিতল বাড়িটার দিকে তাকিয়ে আছে লোকটা। বয়সের গাম্ভীর্য যেন ঘিরে রেখেছে ওটাকে। বুড়ো মানুষের মতো সকালের মিষ্টি রোদ লাগাচ্ছে গায়ে।
চারপাশ ঘিরে থাকা গাছপালাগুলো বড় হয়েছে আরও। মহীরুহই বলা যায় এখন। এমনকী গোলাঘরটাও রয়ে গেছে আগের জায়গায়। বোঝাই যায়, ভালোই যত্ন নেয়া হয় সম্পত্তিটার।
খামারবাড়িটার সামনে এসে থামল আধুনিক ওয়াগেনটা। চালকের আসন থেকে নেমে এল অ্যালবার্ট কুপার। ঢ্যাঙা এক লোক। বেশি দিন হয়নি, পা দিয়েছে তিরিশে।
ওর পর পরই গাড়ি থেকে নামল রোজমেরি কুপার। অ্যালবার্টের স্ত্রী ও। ওরও বয়সের কাঁটা তিরিশের ঘরে।
সাদামাটা, ঘরোয়া পোশাক মহিলার পরনে। মাথার উপর চুড়ো করে বাঁধা চুলগুলো।
আরও দু’জন আরোহী রয়েছে স্টেশন ওয়াগেনে। সিনথিয়া আর সিলভিয়া। একজনের বয়স সাত, আরেক জনের পনেরো। গাড়ির পিছন থেকে লাফিয়ে বেরোল মেয়ে দুটো।
ওদের পিছু নিল কুপারদের পারিবারিক কুকুরটা। কালো রঙের ল্যাব্রাডর একটা। রকেট ওর নাম।
নতুন জায়গায় এসে কমবেশি উত্তেজিত হয়ে আছে প্রত্যেকে। এক মাত্র ব্যতিক্রম সিলভিয়া। বয়ঃসন্ধির প্রভাব পড়েছে ওর মধ্যে। হরমোনের কারণে খিটখিটে হয়ে আছে মেজাজটা। তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে তাকাল চারপাশে।
‘হায়, আমার খোদা!’ ব্যঙ্গ ঝরল টিনেজ মেয়েটির কণ্ঠ থেকে। ‘কী বোরিং একটা জায়গা! মনে হচ্ছে, জনমানবহীন কোনও দ্বীপে এসে পড়েছি। সুইস ফ্যামিলি রবিনসন…’
কেউ ওর কথায় কান দিল বলে মনে হলো না।
প্রবল উৎসাহ নিয়ে পোর্চের দিকে ছুট লাগাল সিনথিয়া। অ্যালবার্ট তাকাল রোজমেরির দিকে।
‘শুনতে পাচ্ছ?’ জিজ্ঞেস করল সে স্ত্রীকে। হাসছে মিটিমিটি।
কান পাতল মহিলা।
‘কই, কী শুনব!’ অনিশ্চিত দেখাচ্ছে দুই মেয়ের মাকে। ধীরে ধীরে চওড়া হলো অ্যালবার্টের হাসিটা। ‘সেটাই তো বলছি। একটা কোনও ফালতু আওয়াজ নেই।’
বাড়ি আর গোলাঘরের মাঝখানের ফাঁকা জায়গাটার দিকে তাকাল রোজমেরি।
‘বাগান করার জায়গা পেয়ে গেছি আমি।’ খুশি খুশি দেখাচ্ছে মহিলাকে।
খানিক বাদেই উঠে এল ওরা ফ্রন্ট-পোর্চে। আগে আগে রয়েছে অ্যালবার্ট। ওর পিছনে বাকি তিনজন।
বাবা দরজার পাল্লা মেলে ধরতেই গুলির মতো ভিতরে প্রবেশ করল সিনথিয়া।
‘আমি কিন্তু সবার আগে ঘর পছন্দ করব,’ চেঁচিয়ে ঘোষণা করল মেয়েটা।
ভিতরে ঢুকতে ঢুকতে তাকাল সিলভিয়া বাপের দিকে। ‘নিজের ঘর কি আমি নিজে পছন্দ করতে পারি, আব্বু?’ জানতে চাইল। ‘নাকি এখানেও বাছাবাছির সুযোগ নেই আমার?’
স্বামীর সঙ্গে চোখাচোখি হলো রোজমেরির। মজা পেয়েছে বলে মনে হলো মহিলা। নিউ জার্সি থেকে এরকম একটা অজপাড়াগাঁয়ে চলে আসার ব্যাপারটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না বড় মেয়েটা।
‘অবশ্যই করবে,’ প্রশ্রয়ের হাসি হেসে সম্মতি দিল সিলভিয়ার বাবা।
ভিতরে চলে গেল মেয়েটা।
নিজেরা বাড়িতে ঢোকার আগে চট করে চুমু দিল মহিলা স্বামীর ঠোঁটে। সকৌতুকে স্ত্রীর নিতম্বে চাপড় দিল অ্যালবার্ট কুপার। ঘুরে তাকিয়ে দেখতে পেল, ফুট কয়েক পিছনে দাঁড়িয়ে আছে ওদের কুকুরটা। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে খোলা দরজা দিয়ে। জানোয়ারটার কালো দুই চোখে অতল গভীরতা। সম্মোহিত হয়ে পড়েছে যেন।
কিছুটা বিভ্রান্ত দেখাল অ্যালবার্টকে।
‘আয়, রে, বেটা!’ ডাকল ও আদর করে।
নিজেকে রক্ষার ভঙ্গিতে আরও পিছিয়ে গেল তাতে কুকুরটা। তেমনি চেয়ে আছে নির্নিমেষে।
‘হলো কী, রকেট! আয় না!’ আবার চেষ্টা করল ওর মনিব।
আগের মতোই একভাবে বসে রইল কুকুরটা। ভিতরে ঢোকার বিন্দু মাত্র ইচ্ছা দেখা যাচ্ছে না চারপেয়েটার মাঝে।
কাঁধ ঝাঁকিয়ে হাল ছেড়ে দিল অ্যালবার্ট
‘গাধা একটা!’ গাল দিল বিড়বিড় করে।
দুই
সেই বিকেলে, নিজেদের নতুন বাড়ির ফয়ারে দাঁড়িয়ে আছে অ্যালবার্ট। একটা হলওয়েতে উন্মুক্ত হয়েছে প্রবেশ-কক্ষটা, চলে গেছে বাড়িটার কেন্দ্রবিন্দু পর্যন্ত।
একটা কিচেন রয়েছে অ্যালবার্টের বাম দিকে, ডানে লিভিং রুম। নানান আকারের বাক্স-পেটরা ছড়িয়ে সবখানে। মৌচাকের ব্যস্ততা সবার মধ্যে।
সদর দরজা দিয়ে কাঠের এক গান-কেস বয়ে আনছে সাবধানে হোঁতকা দুই লেবারার।
‘এটা যাবে বসার ঘরে, নির্দেশ দিল অ্যালবার্ট। লিভিং রুমের দিকে পা বাড়াল দুই মোটু।
ভারি এক বাক্স নিয়ে আরেক জন প্রবেশ করল এবার মূল দরজা দিয়ে।
বাক্সের উপরে সাঁটা হাতে লেখা চিরকুটটা পড়ল অ্যালবার্ট
‘সেলারে নিয়ে গিয়ে রেখে দাও এটা,’ বলল ও লোকটাকে। ‘হল-এর শেষ মাথার শেষ দরজাটা।’ ওকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গেল লোকটা।
.
সেই রাতে, সিঙ্কের পাশে, কিচেনের কাউন্টারে দাঁড়িয়ে কাজ করছে রোজমেরি। একটা বাক্স খুলে বের করছে গৃহস্থালির টুকিটাকি।
কাচ লাগানো ক্যাবিনেটগুলোর প্রত্যেকটাই খোলা, ইতোমধ্যে পূর্ণ করা হয়েছে কাপ-ডিশে।
ওক কাঠের বড় এক টেবিল আর গোটা পাঁচেক চেয়ার ফেলা হয়েছে কিচেনের কোনার দিকে। খরগোসের একটা খাঁচার জায়গা হয়েছে ডাইনিং স্পেসের উল্টো দিকে, দেয়াল ঘেঁষে রাখা হয়েছে সেটা।
মোমের এক শো-পিস থেকে মোড়ক ছাড়াচ্ছে এ মুহূর্তে রোজমেরি। কাঠের স্ট্যাণ্ডে বসানো তিন বানরের একটা সেট ওটা—চোখে, মুখে, কানে হাত চাপা দেয়া। স্ট্যাণ্ডের সামনের দিকে ইংরেজিতে খোদাই করে লেখা: মন্দ কিছু দেখব না, মন্দ কথা বলব না, মন্দ কিছু শুনব না।
সিঙ্কের পিছনে, জানালার তাকের উপর রাখল ওটা রোজমেরি।
হাতে বানানো একটা বার্ড-ফিডার হাতে রান্নাঘরে এসে উপস্থিত হলো এ সময় সিনথিয়া। পাখির খাবার দেয়া হয় জিনিসটাতে।
‘আম্মু,’ সুর করে ডেকে বলল মেয়েটা। ‘আমি কি আমার ফিডারটা ঝুলিয়ে দিতে পারি?’
‘অবশ্যই, মামণি,’ অনুমতি দিয়ে দিল রোজমেরি। ‘পিছনের পোর্চে একটা হুক দেখেছিলাম, মনে হয়।’
নাচতে নাচতে চলল সিনথিয়া পিছন-দরজার উদ্দেশে। একটু পরে বেরিয়ে এল বাড়ির ভিতর থেকে।
বারান্দার বাতিটার চারপাশে এরই মধ্যে ভিড় জমিয়েছে পোকামাকড়।
দুঃস্বপ্নের মতো হালকা কুয়াশা ঝুলে আছে সামনের উঠনটার উপরে।
সিনথিয়ার চঞ্চল চোখ জোড়া সহজেই খুঁজে পেল আংটাটা। ফিডারটা হাতে এগোল ও ওটার দিকে।
সোজা দাঁড়িয়ে নাগাল পাওয়া যাচ্ছে না হুকটার। উঁচু হতে হলো পায়ের আঙুলে ভর দিয়ে।
আর তক্ষুনি কানে এল আওয়াজটা।
হিসহিসে একটা কণ্ঠ নাম ধরে ডাকল যেন ওর!
আস্তে করে ঘাড় ঘোরাল মেয়েটা। তীক্ষ্ণ চোখে জরিপ করছে উঠনের কুয়াশা মাখা অন্ধকার। ঠিক নিশ্চিত নয়, কোত্থেকে এসেছে আওয়াজটা। কিংবা, আসলেই কিছু শুনেছে কি না। এমনও তো হতে পারে, বাতাসের ফিসফিসানি ওটা।
‘…হ্যাল্লো?’ কথাটা ছুঁড়ে দিয়েই নিজেকে কেমন বোকা বোকা লাগল মেয়েটার।
সাড়া নেই কোনও।
ভয় ভয় লাগছে একটু। তবে ভয়ের চাইতেও বেশি জাগছে কৌতূহল। ফিডারটা ঝুলিয়ে দিল মেয়েটা হুক থেকে। ফিরে যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়েছে, থমকে দাঁড়াল একটা নড়াচড়া লক্ষ করে।
দশাসই এক ধূসর বিড়াল নেমে গেল পোর্চের সিঁড়ির নিচের ধাপটা থেকে। নোংরা জীবটাকে দেখে মনে হতে পারে, সারা গায়ে চর্মরোগ হয়েছে ওটার।
‘এই যে… পুচু…’ আদুরে নাম ধরে ডেকে উঠল বিড়ালটাকে সিনথিয়া। ভয়ডর কেটে গেছে।
কিন্তু না… থামল না ওটা।
চারপেয়েটাকে ধরার জন্য সিঁড়ির ধাপ ভাঙতে লাগল মেয়েটা।
কোত্থেকে যে এল বিশাল বাবুটা!’ বিড়বিড় করছে আপন মনে। ‘…আয় না, পুচু!’
এবারও মেয়েটার ডাকে সাড়া না দিয়ে বাড়িটার কোনা ঘুরে অদৃশ্য হলো ধূসর বিড়াল।
ছোট ছোট পায়ে সিনথিয়াও পেরোল কোনাটা, এবং… বিস্মিত হলো।
বিড়ালটার চিহ্নও নেই কোথাও।
ইতিউতি খুঁজল সিনথিয়ার চঞ্চল চোখ জোড়া। কিন্তু ধুমসো মার্জার সেঁধোতে পারে, চোখে পড়ল না এমন কোনও জায়গা। বাতাসে যেন মিলিয়ে গেছে প্রাণীটা!
ভুতুড়ে ব্যাপার-স্যাপার!
উল্টো ঘুরে পা চালাল সিনথিয়া।
.
পিছন-দরজা দিয়ে কিচেনে ফিরে এল আবার সিনথিয়া।
একই সময়ে হলওয়ে ধরে রান্নাঘরে প্রবেশ করল সিনথিয়ার বাবা। দু’জন দু’জনকে অতিক্রম করছে, শুধাল মেয়ে: ‘ডেকেছ, আব্বু?’
‘না তো, সোনামণি!’
‘ও,’ যেতে যেতে বলল সিনথিয়া। ‘আশপাশে মনে হয় বিড়াল আছে কোনও।
বেরিয়ে গেল মেয়েটা কিচেন থেকে।
বউয়ের পিছনে গিয়ে দাঁড়াল মিস্টার কুপার। ছোট এক ঘড়ি আনপ্যাক করছে তখন মহিলা। বানরগুলোর পাশেই, জানালার শার্সিতে সাজিয়ে রাখল ওটা।
পিছন থেকে রোজমেরির কোমর জড়িয়ে ধরল অ্যালবার্ট। চুমু দিল ঘাড়ের পাশে।
নীরব প্রশ্রয় মহিলার চেহারার অভিব্যক্তিতে। কিন্তু কপট অনুযোগ প্রকাশ পেল বক্তব্যে।
‘এই… করছ কী! দেখবে তো বাচ্চারা!’
‘দেখুক।’
খিলখিল করে হেসে উঠল রোজমেরি। আজ রাতে মজা হবে, মনে হচ্ছে।’ গোপন কিছুর ইঙ্গিত মহিলার কথায়।
‘সারা দিনের এই ধকলের পর এনার্জি বলে যদি কিছু থাকে…’ থেমে গেল অ্যালবার্ট। ‘টাউনে যাব, ভাবছি। পিৎজা হলে কেমন হয়? আসবার পথে দোকান দেখেছিলাম না একটা?’
‘জোস হবে!’
ঘুরে স্বামীর মুখোমুখি হলো মহিলা। চোখে ভালোবাসার ছায়া।
‘ধন্যবাদ, অ্যালবার্ট।’
‘কেন?’
‘সব কিছুর জন্য।’ কৃতজ্ঞতা ঝরে পড়ছে রোজমেরির দু’চোখ উপচে। ‘জানি, একটু সময় লাগবে মানিয়ে নিতে। তার পরও, ভালো কিছুই হতে যাচ্ছে শেষ পর্যন্ত… তা-ই না, ডারলিং?’
‘একদম তা-ই।’
.
রাত্রি যাপনের জন্য মোটামুটি গোছগাছ করা হয়েছে কুপার দম্পতির বেডরুম। কামরায় জড়ো করা অনেকগুলো বাক্স খোলা বাকি যদিও এখনও।
বিছানার নিচের ওয়ার্ডরোব-ড্রয়ার থেকে বেশ কিছু কাপড় বের করল রোজমেরি। ক্লজিটের দিকে রওনা হলো সেগুলো নিয়ে।
কাপড়গুলো ঝুলিয়ে রাখছে এক এক করে, এমন সময় কাজে ব্যাঘাত ঘটাল কাঠের মৃদু ক্যাচ-ক্যাচ।
সিলিঙের দিকে দৃষ্টি চলে গেল রোজমেরির। শব্দটা এমন, কেউ যেন শব্দ না করে হাঁটার চেষ্টা করছে উপরতলায়। রোজমেরি মনোযোগ দিতেই যেন থেমে গেল আওয়াজটা।
খানিকটা বিচলিত বোধ করল মহিলা। তাড়াতাড়ি কাপড়গুলো রেখে বেরিয়ে এল বেডরুম থেকে। কাছাকাছি যে জানালাটা পেল, দাঁড়িয়ে পড়ল সেটার সামনে। জানালা দিয়ে উঁকি দিল বাইরে।
গাছ ছাড়া কিছুই চোখে পড়ছে না ওপাশে। বাতাসে নড়ছে পাতাগুলো।
বকের মতো গলা বাড়িয়ে দেখার চেষ্টা করল রোজমেরি, গাছটার কোনও ডাল ঘষা খাচ্ছে কি না উপরতলার কাঠের দেয়ালে।
বোঝা গেল না কিছু।
ফিরে আসতে যাচ্ছে, চোখে পড়ল কুকুরটাকে। নিচে, ফ্রন্ট-পোর্চের কাছে অস্থিরভাবে পায়চারি করছে উঠনে।
‘বুঝতে পারছি না, কোথায় হলো সমস্যাটা,’ পিছন থেকে গলা শোনা গেল অ্যালবার্টের। ‘অন্তত এক হাজার বার চেষ্টা করেছি কুত্তাটাকে ভিতরে ঢোকাতে।’ মাথা নাড়ল এপাশ- ওপাশ। ‘লাভ হয়নি।’
ঘুরল রোজমেরি।
হাতের চ্যাপ্টা, কাগজের বাক্সটা অন্যান্য বাক্সগুলোর একটা স্তূপের উপর নামিয়ে রাখল অ্যালবার্ট। ‘আজকের শেষ পিৎজা। …শেষ হয়ে গেছি আমি!’ ক্লান্ত শোনাল লোকটার গলা।
ওকে তো ওভাবে ছেড়ে রাখা যায় না বাইরে!’ উদ্বিগ্ন রোজমেরি। ‘নতুন জায়গা। কোথাও চলে-টলে যায় যদি!’
‘বেঁধে রাখার জন্য বেল্ট-টেল্ট পাই কি না, দেখি। এক রাত বাইরে থাকলে বদলাতেও পারে মন।’
বেডরুমের দিকে যাচ্ছিল অ্যালবার্ট, পিছন থেকে ডাকল ওর বউ।
‘তুমি তো উপরতলায় যাওনি একটু আগে… গিয়েছিলে?’ ঘুরে দাঁড়াল অ্যালবার্ট। ‘হুম?’
‘কিছু একটা শুনেছি আমি। পায়ের আওয়াজ বলে মনে হলো।’
হাসল অ্যালবার্ট। ‘পুরানো একটা বাড়ি এটা, হানি। এসমস্ত উটকো আওয়াজ খুবই স্বাভাবিক এখানে।’
এক মুহূর্তের জন্য মিটমিট করে উঠল এ সময় বাতির আলো।
ওহ, গ্রেট!’ ব্যঙ্গোক্তি বেরিয়ে এল অ্যালবার্টের মুখ দিয়ে।
‘একটা ফ্ল্যাশলাইট রাখতে হবে বোধ হয় হাতের কাছে, ‘ মন্তব্য করল রোজমেরি।
নীরবে ওর সঙ্গে একমত হলো অ্যালবার্ট।
.
অন্ধকারে বিড়ালের মতো চোখ মেলল রোজমেরি।
ভাঙল কেন ঘুমটা?
বুঝতে পারল পরক্ষণে।
আওয়াজ… শত-সহস্র শিশুর দূরাগত চিৎকার যেন মগজের মধ্যে!
কিন্তু সেটা তো হতে পারে না!
পাশ ফিরে তাকাল মহিলা অ্যালবার্টের দিকে। কী নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছে মানুষটা!
কীসের আওয়াজ, পরীক্ষা করার জন্য বিছানা থেকে নামল রোজমেরি।
.
পিছন-দরজা দিয়ে পোর্চে বেরিয়ে এল মহিলা। কান পাতল শীতল বাতাসে।
আগের চাইতে অনেক জোরাল শোনাচ্ছে আওয়াজটা।
মনোযোগ চলে গেল বাড়ির ঠিক পিছন বরাবর জঙ্গলটার দিকে, যেখান থেকে আসছে বলে মনে হচ্ছে রহস্যময় চিৎকারের আওয়াজ।
কাঁধের উপর একটা হাত পড়ায় আত্মা চমকে গেল রোজমেরির। হৃৎপিণ্ডটা যেন এক লাফে এসে ঠেকল গলার কাছে। পাঁই করে ঘুরে দাঁড়াল মহিলা।
ওর ঠিক পিছনেই দাঁড়িয়ে আছে অ্যালবার্ট।
‘ওহ… সরি!’ লজ্জিত হলো মহিলার স্বামী। ‘বেশি ভয় পেয়েছ?’
জবাব দেয়াটা অনর্থক। সিনেমার স্লো মোশন দৃশ্যের মতো অন্ধকার জঙ্গলের দিকে মুখ ঘোরাল আবার রোজমেরি।
‘কীসের আওয়াজ ওটা?’ বেরিয়ে এল মুখ দিয়ে।
স্ত্রীর বিচলিত হয়ে পড়া দেখে কৌতুক বোধ করল অ্যালবার্ট।
‘ব্যাঙ,’ বলল ও। ‘তিনটে ব্যাঙ শোর তুলেছে একসঙ্গে। সফটবলের সমান বড় হবে ওগুলো। ওরা—’ থেমে গেল বলতে গিয়ে। ‘বলো তো, কেন ডাকছে!’
‘কেন?’
দাঁত কেলাল অ্যালবার্ট। ‘শীৎকার আসলে ওইটা। মিলনের আনন্দে গান জুড়েছে পুরুষগুলো।’
কাঁধের উপর দিয়ে স্বামীর দিকে তাকাল রোজমেরি। ‘তুমি বুঝি এক্সপার্ট এসব ব্যাপারে?’
‘হ্যাঁ, গো, হ্যাঁ! ছোট বেলায় কত ব্যাঙ ধরেছি দাদাবাড়িতে!’
ফের অন্ধকারে দৃষ্টি ছড়িয়ে দিল মহিলা। ‘তোমার কথা সত্যি হলে তো বলতে হবে, চরম আনন্দে আছে ওরা। শুনে তো সেরকমই লাগছে আমার কাছে।’
স্ত্রীকে আলিঙ্গনে টানল অ্যালবার্ট।
‘মনে হচ্ছে,’ বলল ও গাঢ় স্বরে। ‘গ্রামীণ পরিবেশে মানিয়ে নিতে একটু না, বেশ খানিকটা সময় লাগবে শহুরে মেয়েটার।’
‘আমারও তা-ই ধারণা।’ স্বামীর গলায় মুখ ঘষল রোজমেরি। লাজুক স্বরে জিজ্ঞেস করল, ‘এখনও কি টায়ার্ড হয়ে আছ?’
‘কেন?’ অন্ধকারে ঝিকমিক করছে অ্যালবার্টের চোখ দুটো। ‘ব্যাঙগুলো কি তোমাকে উত্তেজিত করে তুলেছে নাকি?’
‘ওগুলো না, তুমি,’ শরমে থই থই কণ্ঠে বলল মহিলা। দরজার দিকে হাঁটা ধরেছে ওরা, শেষ বারের মতো পিছন ফিরে আঁধারে হারিয়ে গেল রোজমেরির স্থির দৃষ্টি। ব্যাখ্যা পাওয়ার পরও অস্বস্তির কুয়াশা ঘিরে রয়েছে ওকে।
.
র্যাঞ্চহাউসটার উপরে জড়ো হচ্ছে মেঘ। গিলে নিয়েছে যেন চাঁদ আর তারাগুলোকে।
অশুভ চেহারা নিয়ে জমাট অন্ধকারে দাঁড়িয়ে রয়েছে বাড়িটা।
থেমে গেছে ব্যাঙের কর্কশ ডাক। সেটার জায়গা নিয়েছে এখন প্রলম্বিত, অপার্থিব নিস্তব্ধতা।
.
শোয়ার ঘর থেকে উপরতলার হলওয়েতে বেরিয়ে এল রোজমেরি। পরনে গোলাপি রোব মহিলার। পাশ কাটাল ক’টা বাক্সকে।
দিনের প্রথম আলো প্রবেশ করছে জানালাগুলোর কাচ ভেদ করে। চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে যেন, এখনও কত বাক্স খোলা বাকি।
হলওয়ের বাথরুমের দরজা খুলে গেল, এবং ভিতর থেকে গলা বাড়াল সিলভিয়া।
‘কী মনে হয়, আম্মু?’ বলে উঠল কুপারদের বড় মেয়েটা। ‘হয়তো অন্য কোথাও গিয়ে উঠতে পারি আমরা, যেটার টয়লেটটা অন্তত ঠিকভাবে কাজ করে…’ কিছুতেই মানিয়ে নিতে পারছে না ও এ-বাড়ির সঙ্গে।
পাত্তা দিল না রোজমেরি। ‘তোমার আব্বুকে বলো গিয়ে… কোনও সমস্যা-টমস্যা হলে…’
চলে যাচ্ছে, বলল মেয়েটা পিছন থেকে: ‘এ-ই সব নয়, আম্মু! বিদঘুটে এক গন্ধ পেয়েছি কাল রাতে!’
‘কোথায় পেয়েছ?’ থেমে, ঘুরে দাঁড়িয়ে জানতে চাইল সিনথিয়া-সিলভিয়ার আম্মু।
‘আমার ঘরে! সে কী গন্ধ… বাপ, রে, বাপ! কোনও কিছু মরেছে যেন!’
‘এখনও আছে গন্ধটা?’
‘তা নেই…’
‘তা হলে আর কী সমস্যা?’ কপালের ভাঁজ দূর হলো রোজমেরির।
কিন্তু খুশি হতে পারল না সিলভিয়া। হতাশ একটা ভঙ্গি করল চোখের মণি ঘুরিয়ে। মাথাটা ঢুকিয়ে ফেলল আবার বাথরুমের মধ্যে।
সিঁড়ির নিচে, দেয়ালের লাগোয়া ঘড়িটাকে যখন অতিক্রম করছে মহিলা, খেয়াল করল— পাঁচটা বিশ দেখাচ্ছে ওতে।
দাঁড়িয়ে গেল রোজমেরি। নিজের ঘড়ির সময় দেখল কবজি উল্টে।
সাতটা ঊনতিরিশ।
কাঁটা ঘুরিয়ে ঠিক করে দিল ও সিঁড়ির ঘড়িটার সময়।
.
কিচেন-কাউন্টারে রাখা একখানা প্যাকিং বক্সের দিকে এগিয়ে গেল রোজমেরি। একটা কেটলি বের করল বাক্সটা থেকে। তার পর ওটা নিয়ে চলে গেল সিঙ্কে। পানির কলটা ছেড়ে দিল পাত্রটা পূর্ণ করার জন্য।
শক্ত হয়ে গেল আচমকা। চোখ আটকে গেছে জানালার তাকে রাখা বাঁদর তিনটের দিকে। এক সারিতে থাকার বদলে পরস্পরের মুখোমুখি এখন ওগুলো! আর… সবগুলোরই মাথা গলে গেছে, মিশে গেছে একটা অপরটার সঙ্গে! যেন বিকলাঙ্গ কোনও সৃষ্টি ওটা।
তার পর খেয়াল হলো রোজমেরির, ছোট যে ঘড়িটা রেখেছিল বাঁদরগুলোর পাশে, ওটাও থেমে গেছে পাঁচটা বিশে এসে।
‘আম্মু!’ ডাকল সিনথিয়া পিছন থেকে। ‘রকেটকে দেখছি না! কোথায় ও?’
ঘুরে তাকিয়ে কিচেনের দরজায় মেয়েকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল রোজমেরি।
‘বাইরে আছে,’ বলল মহিলা। ‘সামনের বারান্দায় গিয়ে দেখো। ভালো কথা… দেখো তো, মা, ভিতরে আনতে পারো কি না ওকে। নিশ্চয়ই খিদে পেয়েছে ওর।
দরজা থেকে বিদায় নিল সিনথিয়া। বাউলি কেটে সরে গেল বাপকে ওর দিকে আসতে দেখে।
‘আরে, বেটি… এত তাড়াহুড়ো কীসের?’ ফুরফুরে মেজাজে বলল অ্যালবার্ট কুপার। সিঙ্কে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল রোজমেরিকে। কিছু একটা ঘটেছে, বুঝতে পারল।
‘কী?’ জানতে চাইল ভুরু নাচিয়ে।
এক পাশে সরে দাঁড়িয়ে বাঁদরগুলোকে দেখতে দিল রোজমেরি।
এগিয়ে গেল অ্যালবার্ট।
‘…হলো কেন এরকম?’ কুঁচকে গেছে লোকটার ভুরু। ‘গরম নাকি তাকের উপরটা?’
‘একদম না।’ বিজাতীয় অনুভূতি রোজমেরির মনের মধ্যে। ‘আর এই ঘড়িটা দেখো… থেমে আছে পাঁচটা বিশে। হল-এর ঘড়িটাও তা-ই!’
.
সদর দরজা দিয়ে বেরিয়ে এল সিনথিয়া। দেখতে পেল, একটা খুঁটি পোঁতা বাড়ির সামনের জমিনে। লম্বা একটা শেকল পেঁচিয়ে আছে খুঁটির সঙ্গে।
পোর্চে দাঁড়িয়ে লেজ দেখতে পাচ্ছে ও কুকুরটার। গোটা শরীরটা দৃশ্যমান হচ্ছে না সিঁড়ির গোড়ার ঝোপের আড়ালে থাকায়।
‘অ্যাই, রকেট…’ ডাক দিল মেয়েটা।
নড়ল না লেজটা।
ঘুমাচ্ছে বোধ হয়, ভাবল সিনথিয়া।
‘এই যে, রকেট!’ ডাকল ও আবার। ‘উঠে পড় না, ছোঁড়া! বেলা হয়ে গেছে তো!’
সিঁড়ির এক ধাপ নিচে নামল মেয়েটা। হাততালি দিল কুকুরটার ঘুম ভাঙানোর জন্য।
‘কী হলো, রকেট!’ যার-পর-নাই অধৈর্য হয়ে উঠেছে। ‘নাশ্তা খাবি না?’
তা-ও নড়ছে না কুকুরটা।
লাফ দিয়ে দিয়ে শেষ ধাপটায় নেমে এল সিনথিয়া। খানিকটা ফ্যাকাসে হয়ে গেছে অজানা আশঙ্কায়।
ঝোপের ডালপাতা সরাতেই থরথর করে কাঁপতে আরম্ভ করল ছোট্ট ঠোঁট জোড়া।
মরে নীল হয়ে আছে কুকুরটা! অ্যানাকোণ্ডার মতো পেঁচিয়ে রয়েছে গলায় লোহার শেকলটা! বেরিয়ে পড়েছে জিভ। ঠিকরে বেরিয়ে আসা চোখ দুটো নিষ্প্রভ, বর্ণহীন।
গলা ফাটিয়ে চিৎকার দিল সিনথিয়া।
তিন
‘ভয় জিনিসটা কী? একটা অনুভূতি। বিপদের উপস্থিতিতে কিংবা বিপদ আসছে, টের পেলে অস্থির হয়ে উঠি আমরা, হয়ে উঠি উদ্বিগ্ন। এটাই আসলে ভয়। কথা হচ্ছে এখন বিপদটা কীসের? অনেক কিছু থেকেই হতে পারে। দানব কিংবা ভূতপ্রেত। প্রেতাত্মা কিংবা অশুভ শক্তি… যে-কোনও কিছু।’ একটু থামল টনি। ‘রেনফিল্ড নামে এক লোকের কথা বলছি আপনাদের…’
টনি ডায়েস আর তাহিতি ডায়েস। বাঙালি দম্পতি। দুই পুরুষ ধরে আমেরিকার বাসিন্দা। দু’জনেরই বয়স তিরিশের ঘরে।
বিশাল লেকচার-হল-এর মঞ্চে উপবিষ্ট স্বামী-স্ত্রী, একখানা পোডিয়ামের পিছনে। সামনে দর্শক হিসেবে রয়েছে তিন শ’র বেশি কলেজ-ছাত্র।
সম্মোহিতের মতো লেকচার শুনছে ওরা বিশেষ এই সন্ধ্যাটায়।
বিষণ্নতার প্রতিমূর্তি এক ব্যক্তির ভিডিয়ো-ফুটেজ দেখানো হচ্ছে বড় পরদায়। বিচ্ছিন্নভাবে তোলা হয়েছে ছবিগুলো।
খ্যাংরা-কাঠির মতন একজন মানুষ। বয়সটা বিশের ঘরের শেষ দিকে। বসে আছে একটা চেয়ারে।
চুলের মতোই কালো চোখ লোকটার। পাণ্ডুর চামড়া।
পাশেই বসেছেন একজন ক্যাথলিক যাজক। ল্যাটিন আওড়াচ্ছেন বাইবেল থেকে। শোনা প্রায় যাচ্ছেই না ভদ্রলোকের কথা।
‘কৃষক ছিল লোকটা। ফরাসি আর কানাডিয়ান রক্তের মিশেল ছিল ওর শরীরে,’ ব্যাখ্যা দিতে আরম্ভ করল টনি। ‘পড়াশোনার দৌড় স্রেফ তৃতীয় গ্রেড পর্যন্ত। কিন্তু ভূতের আছর হওয়ার পর অনর্গল ল্যাটিন বেরোতে লাগল লোকটার মুখ থেকে। তা-ও যা-তা ল্যাটিন না, যাকে বলে একেবারে বইয়ের ল্যাটিন। আশ্চর্যের ব্যাপার কী, জানেন? উল্টো দিক থেকেও পড়ত ও কখনও কখনও। কিন্তু একদম নিখুঁতভাবে, কোথাও একটুও না আটকে!
‘ছোট বেলায় বাপের হাতে নির্যাতনের শিকার হতো সে প্রতিনিয়ত। ধর্মকর্ম করত না ওর বাপটা, ছেলেকেও শেখায়নি কিছু। বরঞ্চ লোকটার কাজকর্মে ফুটে উঠত ইবলিস শয়তানের প্রতি গভীর অনুরাগ। নিজের ছেলেকে উৎসর্গ করেছিল সে শয়তানের কাছে।’ থামল টনি এক সেকেণ্ডের জন্য। ‘ফলাফল যা হওয়ার, তা-ই হলো। আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে, কাজেই খারাপ আত্মা ভর করল রেনফিল্ডের উপরে। অনায়াসে সম্ভব হয়েছে সেটা, কারণ, ভালো-খারাপের দ্বন্দ্ব ছিল কৃষকের মনের মধ্যে। উপরন্তু বাধ্য করা হয়েছে ওকে ইবলিসের সামনে নতজানু হতে।’ আবারও মুহূর্তের বিরতি। ‘ওকে দিয়ে নিজের স্ত্রীকে খুন করিয়ে নেয় আত্মাটা। রেনফিল্ডকে বোঝানো হয়েছিল, স্ত্রীর মঙ্গলের জন্যই গুলি করছে ওকে। একই কাজ করেছিল লোকটার বাপও, খুন করে সে রেনফিল্ডের মাকে।’
স্তব্ধ হয়ে গেছে গোটা হলরুম।
‘আপনারা যদি লোকটার চোখের দিকে ভালো করে খেয়াল করেন,’ এবার মুখ খুলল তাহিতি। ‘দেখতে পাবেন, রক্ত ঝরছে রেনফিল্ডের দু’চোখ থেকে, ভিজে উঠেছে শার্টের বুকের কাছটা।’
আসলেই তা-ই। অশ্রু নয়, রক্তই ওটা। টপ-টপ করে ঝরে পড়ছে কৃষকের চেক শার্টের উপর। কালচে রক্তে নোংরা হয়ে উঠেছে পরিষ্কার শার্টটা।
আচমকা চিৎকার শুরু করল লোকটা। শরীরটা মোচড় খাচ্ছে ভয়ঙ্করভাবে…
‘শুধু তা-ই না,’ বলে চলল তাহিতি। ‘উল্টো-ক্রুশ ফুটে উঠতে শুরু করেছে ওর গায়ের চামড়ায়।’
ফুটেজে দেখা যাচ্ছে, ক্যামেরায় প্রদর্শনের জন্য রেনফিল্ডের শার্টটা গুটিয়ে তুলল টনি।
ভয়াবহ ব্যাপার! চামড়া ভেদ করে ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইছে যেন দুটো উল্টো-ক্রুশ!
শেষ হয়ে গেল ফুটেজ।
নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না দর্শক- শ্রোতারা।
‘ধন্যবাদ, মাইকেল,’ কাকে যেন উদ্দেশ্য করে বলল টনি। ‘জ্বেলে দিতে পারো লাইটগুলো।’
লেকচার-হল-এর বাতিগুলো যখন জ্বলে উঠল আবার এক এক করে, কুড়ি বছরের মাইকেল রডম্যানকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল বিশালায়তন হল-এর একদম পিছনে।
টনি আর তাহিতির টেকনিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট এই মাইকেল। লম্বা চুল রেখেছে শখ করে। কর্ডের প্যান্ট আর ফ্লানেলের শার্ট পরে আছে এ মুহূর্তে। শান্তির প্রতীকের আদলে লকেট সহ চামড়ার একখানা নেকলেস ঝুলছে গলা থেকে।
প্রজেক্টরটা বন্ধ করে দিল এবার ডায়েসদের তরুণ সহকারী।
‘কোনও প্রশ্ন?’ দর্শকের উদ্দেশে আহ্বান করল ডায়েস দম্পতি।
হাত উঠে গেল অনেকগুলো।
‘এই যে… আপনি বলুন, দৈবচয়নের ভিত্তিতে বাছাই করল একজনকে মিসেস ডায়েস। ‘হ্যাঁ, আপনি… ছাপা শার্ট পরেছেন যিনি …..
‘এ ধরনের সে কি এই একটাই? নাকি আরও রয়েছে এরকম?’ জানতে চাইল কোঁকড়া চুলের কৃষ্ণাঙ্গ ছাত্রটি, দাঁড়িয়ে গেছে আসন ছেড়ে। ‘যদি থেকে থাকে, সেগুলো তা হলে কত হবে সংখ্যায়?’
‘ধন্যবাদ আপনার প্রশ্নের জন্য,’ বলল মহিলা স্মিত হেসে। ‘এ ধরনের মোটামুটি এক শ’ কেসের তদন্ত করেছি আমরা গত এক বছরে….
‘খাইছে… এক শ’!’ আক্ষরিক অর্থেই চোখ দুটো কপালে উঠল ছেলেটির। তাহিতিকে ধন্যবাদ জানিয়ে নিজের আসনে বসে পড়ল আবার কালো মানিক।
ঊর্ধ্বমুখী হাতগুলো থেকে আরেক জনকে নির্দেশ করল এবারে টনি ডায়েস। চার সারি পিছনের এক চশমাঅলা।
এ ছেলেটিও দাঁড়িয়ে গেল আসন ছেড়ে।
‘যদ্দূর জানি, এটাকেই পেশা হিসেবে নিয়েছেন আপনারা… এই সব ভুতুড়ে জিনিস নিয়ে কারবার…’ আসল প্রশ্নে যাওয়ার আগে ভূমিকা করল চশমা। ‘ভয় লাগে না?’
হালকা হাসি ভেসে এল দর্শকদের মাঝ থেকে। কিছুটা দূর হলো তাতে অস্বস্তির গুমোট ভাবটা।
‘তা,’ শেষ হয়নি চশমাধারীর কথা। ‘ভূতের তাড়া খাওয়া ঠেকাতে কী ধরনের ব্যবস্থা নিয়ে থাকেন আপনারা?’
.
দিগ্গজ পণ্ডিত মনে হচ্ছে ছেলেটার ভাবভঙ্গি দেখে। সিরিয়াস করে রেখেছে চেহারাটা। আসলে, ভিতরে ভিতরে ফেটে পড়ছে হাসিতে।
যেসব লোককে নিয়ে কাজ করি আমরা, কিংবা তদন্ত করি যেসমস্ত ঘটনার, সেগুলোর কোনোটার সঙ্গেই জড়াই না সচরাচর ব্যক্তিগতভাবে,’ সিরিয়াসলিই জবাব দিচ্ছে মিস্টার ডায়েস। ‘নয় তো ইমোশনালি ভঙ্গুর হয়ে পড়বেন আপনি। আর একবার যদি ভেঙে পড়েন তো, সেই সুযোগে মন্দ আত্মা দখল নিয়ে নেবে শরীরটার। … অবশ্য ঠিক এটাও না। আমাদের সম্মিলিত শক্তির প্রকৃত উৎস আসলে মহান ঈশ্বরের প্রতি একান্ত বিশ্বাস।’
ধর্মভীরু ছেলে চশমাঅলা। ফাজলামো করে প্রশ্ন করলেও বসে পড়ল সে সন্তুষ্ট হয়ে।
পরের প্রশ্নকর্তা একজন মেয়ে। একদম সামনের সারি থেকে সুযোগ দিল ওকে লেডি ডায়েস।
সিট ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেও মুখ খুলতে গিয়ে ইতস্তত করতে লাগল পনিটেইল করা মেয়েটি।
..আ… একটা সমস্যা আছে আমার…’ বলতে পারল শেষমেশ।
‘জি, বলুন!’
..মাঝে মাঝেই রাতে ঘুম ভেঙে যায় আমার,’ কাঁপা গলায় বলতে লাগল মেয়েটি। ‘মনে হয় তখন, কেউ যেন শুয়ে আছে পাশে। …এ ধরনের কোনও অভিজ্ঞতা নিয়ে কি কাজ করেছেন আপনারা?’
‘অসংখ্য বার, আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে জবাব দিল তাহিতি। ‘তো? ভয় লাগে তখন?’
‘…আ… হ্যাঁ… একটু একটু…’ স্বীকার করল মেয়েটি। ‘একটু একটু ভয় যদি হয়, ঠিক আছে তা হলে। আমি জানতে চাইছি, হুমকি মনে হয় কি না অনুভূতিটাকে?’
‘…ঠিক তা নয়, ম্যাম। স্রেফ বিচিত্র একটা অনুভূতি।’
এক মিনিটের জন্য এদিকে আসবেন একটু?’ কী ভেবে ডাকল তাহিতি মেয়েটিকে।
মঞ্চের কিনারের দিকে এগিয়ে গেল যুবতী। মিলিত হলো দর্শকসারি থেকে বেরিয়ে আসা মেয়েটির সঙ্গে।
‘হাত দুটো দিন তো আপনার!’ নিজের দু’হাত বাড়িয়ে দিল তাহিতি।
কথামতো কাজ করল মেয়েটি।
পনিটেইলের হাত দুটো নিজের মুঠোয় নিয়ে চোখ বুজল তাহিতি ডায়েস। ওই অবস্থাতেই কথা বলতে আরম্ভ করল ক’মুহূর্ত পর।
যে-খাটে ঘুমান আপনি, সেটা আপনার দাদির ছিল, তা-ই না?’ স্থির বিশ্বাসের সঙ্গে বলছে প্রেত-বিশেষজ্ঞ।
চমকে উঠল মেয়েটা। ‘হ্… হ্যাঁ!’
‘… আর… মৃত্যুর সময় ওঁর খুব কাছাকাছিই ছিলেন আপনি…’
ভক্তিতে গদগদ চেহারা হয়েছে মেয়েটির। ‘দাদির কাছেই বড় হয়েছি আমি!’ জানাল ও।
চোখ মেলল তাহিতি। ‘ওটা উনি।’
‘জি?’
‘আপনার দাদি ওটা। ওঁর আত্মাকেই অনুভব করেন আপনি বিছানায়।’
আবেগ সামলানোর চেষ্টা করছে মেয়েটি। চোখ দুটো ওর ভরে উঠেছে জলে।
‘আপনি যে সহি সালামতে রয়েছেন, ওঁকে সেটা নিজ মুখে জানাতে হবে আপনার,’ অদ্ভুত পরামর্শ দিল তাহিতি। ‘তা হলেই শান্তিতে পাড়ি জমাবেন তিনি ওপারে। হয়েছে কী, এখনও দুশ্চিন্তা করছেন তিনি আপনাকে নিয়ে।’
‘কীভাবে কথা বলব আমি দাদির সাথে?’ ধরা গলায় জিজ্ঞেস করল মেয়েটি
মিষ্টি করে হাসল তাহিতি। ‘আর-সবার সঙ্গে যেভাবে কথা বলেন, সেভাবেই। আবার যখন ওরকম অনুভূতি হবে আপনার, দাদিকে বলবেন: ভালোই আছেন আপনি। উনি যেন চিন্তা না করেন আপনাকে নিয়ে। ব্যস, এটুকুই।’ হাত দুটো ছেড়ে দিল মহিলা।
মেয়েটি নিজের জায়গায় গিয়ে বসলে সামনের সারির আরেক ছাত্রের উদ্দেশে নড করল টনি ডায়েস। উলের টুপি এর মাথায়।
কিন্তু ছেলেটা কিছু বলার আগেই মুখ খুলল আবার চশমা-চোখো ছাত্রটি। আসন থেকেই বলে উঠল: ‘কীসে সব থেকে ভয় পান আপনি, বলবেন একটু?’
উজ্জ্বল এক টুকরো হাসি ফুটল টনির চেহারায়। ‘আমার স্ত্রীর মতো একজন সবজান্তাকে। কোনও কিছু লুকানোর উপায় আছে ওর কাছ থেকে?’
নির্মল হাসিতে ভেঙে পড়ল অডিটরিয়াম।
চার
সকালবেলা।
কুপারদের বাড়ির পাশে, এক যুবকের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে অ্যালবার্ট।
অসম্ভব নোংরা জামাকাপড় যুবকটির পরনে। জমিনের একটা গর্ত দিয়ে উঁকি দিচ্ছে লোকটা সেপটিক সিসটেমের ভিতরে।
দূরে দেখা যাচ্ছে রোজমেরিকে। কাজ করছে বেড়াঘেরা বাগানে। নতুন পাতা এসেছে গাছে, ওগুলোর যত্ন-আত্তিতে ব্যস্ত।
একখানা কাকতাড়ুয়া নিয়োজিত বাগানের নিরাপত্তা রক্ষায়। দুই হাত দুই দিকে ছড়িয়ে দুই ইনটু চার ফিটের একটা অস্থায়ী ক্রুশের ভূমিকা পালন করছে যেন ওটা। অ্যাটেনশনের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে বাগানের ঠিক মাঝখানটায়।
পুরানো একটা ওভারঅল পরিয়ে দেয়া হয়েছে কাকতাড়ুয়াটাকে, পশমি প্ল্যাড শার্ট (স্কটল্যাণ্ডের পাহাড়িদের মধ্যে প্রচলিত পোশাক) রয়েছে ওটার নিচে। মাথায় বসানো পরচুলা থেকে নেমে এসে কাঁধ ছুঁয়েছে দীর্ঘ চুল, ব্র্যাকেটবন্দি করেছে ছোট্ট বালিশটাকে, যেটার উপরে বেখাপ্পাভাবে মুখচোখ আঁকা হয়েছে পুতুলটার।
গোলাঘরের পাশেই পার্ক করে রাখা অ্যালবার্টের সেমি- ট্রেলার ট্রাকটা।
যুবকটির কাছে পৌঁছে গেছে অ্যালবার্ট। ঘুরে ওর মুখোমুখি হলো লোকটা। শার্টে একটা নেমট্যাগ ঝুলছে ওর: আর্ল।
ধরতে পেরেছেন সমস্যাটা?’ জিজ্ঞেস করল অ্যালবার্ট।
‘হুম, পেরেছি,’ জানাল আর্ল নামের যুবকটি। ‘কিন্তু সবটা শুনলে পছন্দ হবে না আপনাদের।’
‘এভাবে বলার জন্যই শেখানো হয়েছে আপনাদের, তা-ই না?’ হুঁ হুঁ, বাবা, আমিও কম সেয়ানা নই—ভাবছে অ্যালবার্ট।
কথাটায় কৌতুকের কিছু খুঁজে পেল না যুবক।
‘সমস্যাটা সেপটিকে,’ বলল ও। ‘বদলাতে হবে জিনিসটা। কমপক্ষে চল্লিশ বছরের পুরানো ওটা।’
কিন্তু এই জবাব তো শুনতে চায়নি অ্যালবার্ট
‘কোনোভাবেই কি সারানো যাবে না?’ জানতে চাইল বিচলিত হয়ে।
‘সম্ভব না,’ জানিয়ে দিল যুবক। ‘এরই মধ্যে ওই কাজ করা হয়েছে একবার।’
‘কী করতে হবে তা হলে?’ ত্যক্ত বোধ করছে বাড়ির মালিক।
দ্রুত কিছু হিসাব কষে ফেলল যুবক।
‘সব কিছুই। সব মিলিয়ে চোদ্দ হাজারের মামলা।’
.
খানিকক্ষণ বাদে।
বাগান পরিচর্যায় ব্যস্ত বউয়ের সামনে দাঁড়িয়ে আছে অ্যালবার্ট। সাঁতার কাটছে চিন্তার সাগরে।
‘নতুন ইলেকট্রিকালের জন্য গেল সাত হাজার, আর এখন যাচ্ছে চোদ্দ…. পোকা গিলে ফেলা চেহারা হয়েছে পরিবারের এক মাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিটির।
‘এরকম সমস্যা যে হতে পারে, সেটা তো আমরা আগেই ধারণা করেছিলাম, তা-ই না, ডিয়ার?’ সান্ত্বনার সুর রোজমেরির কণ্ঠে।
‘তা করেছি। কিন্তু বুঝতে পারছি না, আর কতটা সামাল দিতে পারব এভাবে…’
কাজ থেমে গেল রোজমেরির। একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে স্বামীর দিকে। ‘মানে?’
বলার আগে একটা সেকেণ্ড সময় নিল অ্যালবার্ট। ‘সকালে কল পেয়েছি ফ্লেচারের কাছ থেকে। হতচ্ছাড়া তেলের এই সঙ্কটের কারণে ছাঁটাই শুরু করতে যাচ্ছে ওরা।’
‘ওরা কি তোমার কথা কিছু মিন করছে?’ আতঙ্কিত বোধ করছে রোজমেরি।
‘ঠিক সিনিয়র নই আমি ওখানে, জানোই তো…’ গলায় জোর নেই অ্যালবার্টের। দিন ফুরিয়ে রাত্রি নেমেছে বাগানে।
পূর্ণ চাঁদটা যেন স্পটলাইটের কাজ করছে কাকতাড়ুয়াটার উপরে। যেন কোনও অভিনেতা দাঁড়িয়ে আছে মঞ্চের মাঝখানে। চারদিক থেকে ঘিরে রয়েছে তাকে বাড়ন্ত বাগানটা—ভুট্টা গাছের দীর্ঘ সারি, উজ্জ্বল হলদে স্কোয়াশ, লাল টমেটো আর শিম গাছগুলো।
.
অনেক রাত হয়েছে।
কাপড়চোপড়ের ঝুড়িটা বগলের তলায় গুঁজে হলওয়ের শেষ মাথায় নিজেদের কামরার দিকে চলেছে রোজমেরি। যেতে যেতে দাঁড়িয়ে পড়ল বাথরুমের বন্ধ দরজাটার সামনে। সিলভিয়ার কামরা থেকে মেঝের উপর দিয়ে টেলিফোনের কর্ড গিয়ে ঢুকেছে স্নানঘরের ভিতরে।
স্কুল তো পুরোই ফালতু!’ শোনা যাচ্ছে সিলভিয়ার গলা। ‘সুন্দর একটা ছেলেও নেই… থাকার মধ্যে আছে কেবল হাজারে হাজারে বিরক্তিকর ছারপোকা…’
ভারি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল রোজমেরি।
দরজাটা বন্ধ নয় বাথরুমের, ভেজানো। পাল্লা ঠেলে দেখতে পেল মহিলা, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটা ফোনের রিসিভারটা চেপে রেখেছে কানে। একবার এক চোখ, পরক্ষণে অন্য চোখটা বন্ধ করে আলাদা রঙের দুটো আইশ্যাডোর তুলনা করছে।
‘পাঁচ মিনিট,’ কর্তৃত্বের স্বরে বলল রোজমেরি। ‘এর পর বিছানায় দেখতে চাই তোমাকে।’
আবার লাগিয়ে দিল সে দরজাটা।
.
ঘুরে আসা যাক সিনথিয়ার কামরা থেকে।
৩২
রংবেরঙের কাগজের তৈরি প্রজাপতিগুলো করছে কামরার চার দেয়াল, এমনকী সিলিঙেরও। স্টাফ করা কিছু জীবজন্তু সারি দিয়ে রাখা ভ্যানিটি মিররঅলা ড্রেসারের উপরের ছোট এক তাকে। সহজে বেইক করা যায়, এমন একখানা আভেন আর একখানা বারবি সেট সুন্দরভাবে সাজিয়ে রাখা হয়েছে দেয়াল ঘেঁষে।
চার কোনায় চার খাম্বাঅলা, ঝালর দেয়া বিছানায় চাদরের তলে ঢুকে রয়েছে সিনথিয়া। চোখ দুটো নিমগ্ন বইয়ের পাতায়। মাথাটা সামান্য উঁচু হয়ে রয়েছে তলায় বালিশ থাকায়। শিয়রের পাশের নাইটস্ট্যাণ্ড থেকে চার ফুট ব্যাসার্ধের আলোর ঘের তৈরি করেছে লণ্ঠনটা।
চোখের কোনা দিয়ে রোমশ কী একটাকে ঝটিতি বিছানায় লাফিয়ে উঠতে দেখে আড়ষ্ট হয়ে গেল মেয়েটির শরীর। হাতের বইটার কারণে আলোটা বাধাপ্রাপ্ত হওয়ায় ঠাহর করা গেল না ভালো মতো।
ভালো করে দেখার জন্য আস্তে করে বুকের উপর শোয়াল ও বইটা।
সেই বিড়ালটা! এর আগে দেখেছিল যেটাকে। চার পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে, সোজা তাকিয়ে আছে ওর দিকে।
‘কী, রে!’ বলে উঠল সিনথিয়া। ‘ঢুকলি কী করে এই ঘরে?’
ঝড়াং করে শোয়া থেকে উঠে বসতেই চোখের পলকে খাট থেকে নেমে গেল চারপেয়েটা। নেমেই এক ছুটে কামরা থেকে বেরিয়ে পড়ল হলওয়েতে।
এক ঝটকায় চাদরটা সরিয়েই বিছানা থেকে নামল সিনথিয়া। ত্বরিত পিছু নিল বিড়ালটার।
দরজা থেকে মুখ বের করতেই দেখতে পেল, সুভূত করে বড় বোনের কামরায় ঢুকে পড়েছে ওটা।
সিলভিয়ার কামরার উদ্দেশে পা চালাতে চালাতে শুনতে পেল সিনথিয়া, এখনও ফোনে কথা বলছে বোনটা বাথরুমের মধ্যে। হল-এর শেষ মাথায়, আরেক বেডরুমের খোলা দরজা দিয়ে দেখতে পেল আম্মুকে, কাপড় ভাঁজ করে করে স্তূপ করছে বিছানার উপরে। ছোট মেয়ের উপস্থিতি খেয়াল করল না মহিলা।
বোনের ঘরের দোরগোড়ায় এসে ইতিউতি খুঁজতে লাগল সিনথিয়া।
গেল কোথায় বিড়ালটা?
বিছানার উপরের সিলিঙে লাগানো ডিম লাইটের বেগুনি আভায় জ্বলজ্বল করছে সিনথিয়ার মুখটা।
বিটলস ব্যাণ্ডগ্রুপের পোস্টার ঝুলছে ঘরের দেয়ালে। আরও রয়েছে রূপকথার চরিত্র সিনডারেলা আর পপ গায়ক এলভিস প্রিসলি-র পোস্টার। বেগুনি আলোয় আলোকিত ওগুলোও।
ভীষণ অগোছাল মেয়ে সিলভিয়া। মেঝেময় ছড়িয়ে- ছিটিয়ে রয়েছে ওর জামাকাপড়গুলো। বিছানাটাও এলোমেলো।
নাহ… কোথাও দেখতে পেল না সিনথিয়া বিড়ালটাকে। আর তার পরই বিছানার নিচ থেকে হিসহিস কানে এল ওটার।
‘কী হয়েছে, রে, বিল্লু?’ বলতে বলতে ঘরের ভিতরে প্রবেশ করল সিনথিয়া। এগিয়ে যাচ্ছে বিছানাটার দিকে।
হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল ও বিছানার পাশে। তলায় উঁকি দিতেই চোখ পড়ল একখানা র্যাগিডি অ্যান (আমেরিকান লেখক জনি গ্রুয়েল-এর সৃষ্ট একটি চরিত্র) পুতুলের উপর—স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওর দিকে, যেন জীবন্ত কিছু।
সামান্য চমকে গেল সিনথিয়া।
থেমে গিয়েছিল, আবার শুরু হয়েছে হিসহিসানি। সিনথিয়ার দৃষ্টি খুঁজে পেল না বিড়ালটাকে। আরও অনেক পুতুল গাদা করে রাখা খাটের তলে। ওগুলোর কারণে বাধা পাচ্ছে নজর।
ভিতরে মাথা ঢোকাল মেয়েটা। ক’টা পুতুল সরিয়ে দিল এক পাশে। হ্যাঁ… ওই তো বিড়ালটা!
ওটাকে দেখা মাত্রই গলায় শ্বাস আটকে এল সিনথিয়ার। কালচে-বেগুনি আলোয় ভীতিকর দেখাচ্ছে মার্জারের চোখ দুটো। মনে হচ্ছে—পৈশাচিক কিছু। তাকিয়ে আছে পলক না ফেলে। সিনথিয়ার দিকে নয়, দৃষ্টি যেন ওর ঠিক পিছনের কোনও কিছুতে।
ঝট করে ঘাড়ের উপর দিয়ে ফিরে চাইল মেয়েটা। নাহ, কিচ্ছু নেই!
ভোঁ দৌড় দিল বিড়ালটা সিনথিয়ার পাশ দিয়ে। এতটাই দ্রুত যে, ফের চমকে উঠল মেয়েটা। সহজাত প্রবৃত্তির বশে মাথা বের করল খাটের নিচ থেকে। আধখোলা ক্লজিটের ওপাশের অন্ধকার ভেদ করে হারিয়ে গেল ধূসর বিড়াল।
পায়ের উপরে সিধে হতেই মেয়েটির মা এসে উদয় হলো দরজায়।
‘এ কী!’ আঁতকে উঠল রোজমেরি। ‘তোমার না এখন ঘুমানোর কথা!’
‘বিড়ালটাকে দেখতে পেয়েছি আবার,’ কৈফিয়ত দিল সিনথিয়া। ‘ক্লজিটে গিয়ে ঢুকেছে ওটা।’ বলতে বলতে এগোল ও ক্লজিটটার দিকে।
‘তা-ই নাকি?’ কৌতূহলী হয়ে উঠল রোজমেরিও। ভিতরে পা রেখেই পাশের দেয়াল হাতড়ে টিপে দিল লাইটের সুইচ।
ক্লজিটের সামনে, ছোট মেয়ের পাশে গিয়ে দাঁড়াল ওর মা। হাট করে খুলে দিল দরজাটা।
এবারে হাত বাড়াল উপরদিকে। টান দিল ভিতরের বাতিটার কর্ড ধরে। উজ্জ্বল আলোয় ভরে উঠল এক-মানুষ উচ্চতার বড়সড় ক্লজিটটা। জুতো আর কাপড়চোপড় সার দিয়ে সাজানো রয়েছে ভিতরে। কিন্তু বিড়ালের নামগন্ধ নেই কোনও।
‘ঠিক দেখেছ তো?’ জিজ্ঞেস করল রোজমেরি।
‘হ্যাঁ, মা… কসম।’
‘ছিল হয়তো, নেই এখন,’ মাথা দুলিয়ে মন্তব্য করল মহিলা। ‘কোন্ ফাঁকে সটকে পড়েছে ওটা, দেখতে পাওনি বোধ হয়।’
ঘুরে, নিচে ঝুঁকল সিনথিয়া। আবার দেখল বড় বোনের খাটের নিচে।
না, নেই ওখানেও।
‘শোবে, চলো,’ ডাকল মেয়েকে রোজমেরি। ‘পরে ওটাকে খুঁজে দেখব আমি।’
ফিরে এল সিনথিয়া নিজ কামরায়। বিছানায় উঠতে উঠতে জিজ্ঞেস করল মাকে: ‘আব্বু কখন আসবে?’
‘বলেছে তো, আজই চেষ্টা করবে আসার,’ মেয়েকে আশ্বস্ত করল রোজমেরি। চাদরটা টেনে দিল সিনথিয়ার গায়ের উপর।
‘আজকাল খুব বেশি বাইরে কাটাচ্ছে আব্বু!’ অনুযোগ করল মেয়ে।
‘তোমাদের আব্বুর চাকরিটা চলে গেছে, সুইটি!’ করুণ শোনাল মহিলার গলাটা। ‘সেজন্যই নানা রকম ধান্দা করতে হচ্ছে ওকে। অনেকগুলো বিল এসে জমা হয়ে রয়েছে… শোধ করতে হবে তো ওগুলো!’
‘ছাতার বিল!’ মুখ ভেঙচে বলল সিনথিয়া।
ফিক করে হেসে ফেলল রোজমেরি। ‘ঠিক বলেছ, মামণি।’
‘শোবে, আম্মু, আমার সাথে?’ আবদার ধরল মেয়ে।
‘বেশ তো, আম্মু।’
মেয়ের পাশে শুয়ে ঘুমাচ্ছিল রোজমেরি। কেমন একটা আঁচড়ানির আওয়াজ কানে যেতে ভেঙে গেল ঘুমটা।
শুয়ে থেকে ক’মুহূর্ত শুনল মহিলা স্নায়ুপীড়াদা আওয়াজটা। ভেসে আসছে দূর থেকে।
থেমেও গেল একটা সময়।
ক্ষণিকের জন্য বিরাজ করল নীরবতা। তার পর শুরু হলো আবার।
ব্যাপারটা কী, দেখার জন্য বিছানা থেকে নামল রোজমেরি। চুপিসারে বেরিয়ে এল মেয়ের বেডরুম থেকে।
আওয়াজটা আসছে নিচতলা থেকে।
সিঁড়ির দিকে রওনা হলো মহিলা।
সিলভিয়া, সিনথিয়া আর ওদের চারজনের বেশ কিছু বাঁধানো ফোটোগ্রাফ ঝুলছে হল-এর দেয়ালে। যেতে যেতে পেরিয়ে এল ওগুলো।
হঠাৎ করেই তীব্র হয়ে উঠল আওয়াজটা। গভীর, বিচ্ছিরি শোনাচ্ছে এখন। কাঠের উপরে নখ ঘষছে যেন কেউ।
স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়ায় চলার গতি কমে এল রোজমেরির। সিঁড়ির মাথার কাছে পৌঁছে গেছে মহিলা। প্রচণ্ড অস্বস্তি ভর করেছে মনে। ভয় করছে নিচের দিকে তাকাতে।
দাঁড়িয়ে থেকে সাহস সঞ্চয় করল কিছুটা।
উপর থেকেই বুঝতে পারছে এখন, আওয়াজটা আসছে সেলারের দরজার ওপাশ থেকে। কিছু একটা আঁচড়ে চলেছে দরজাটার উল্টো দিকে!
আওয়াজ লক্ষ্য করে এগিয়ে চলল রোজমেরি। এক পা, এক পা করে সিঁড়ির ধাপগুলো পেরিয়ে সাবধানী পদক্ষেপে এগোতে লাগল হলওয়ে ধরে।
কিন্তু দরজাটার কাছে পৌছানো মাত্রই থেমে গেল আওয়াজটা। গির্জার মতো নীরব হয়ে আছে গোটা বাড়ি।
একাগ্র চিত্তে কান পেতে রইল রোজমেরি। দোটানায় দুলছে কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থার মধ্যে পড়ে।
তার পর এক মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নিয়ে কিচেনে চলে গেল মহিলা। এক সেকেণ্ড পর বেরিয়ে এল ফ্ল্যাশলাইট হাতে। ফিরে যাচ্ছে দরজাটার কাছে।
এবারে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল রোজমেরি দরজাটার পাশে। দুই হাতে ভর দিয়ে উবু হলো ধীরেসুস্থে। মেঝে আর দরজার তলার মধ্যবর্তী ইঞ্চি খানেক ফাঁক লক্ষ্য করে তাক করে রেখেছে ফ্ল্যাশলাইটটা।
গভীর দম নিল মহিলা। এবার বুড়ো আঙুল দাবাল লাইটের সুইচে।
উজ্জ্বল আলো গিয়ে প্রতিফলিত হলো অন্ধকারে ঘাপটি মেরে থাকা এক জোড়া পলকহীন চোখে!
কিন্তু মানুষ, এমনকী জানোয়ারেরও নয় চোখ জোড়া!
ধড়াস করে লাফ মারল রোজমেরির হৃৎপিণ্ড। আতঙ্কে পাগলপারা হয়ে পিছিয়ে এল সে হাঁচড়ে-পাঁচড়ে। প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে কিচেনের দরজার কাছে ফিরে গিয়ে রাবারের একখানা গোঁজ তুলে নিল দরজার পাশ থেকে।
জিনিসটা নিয়ে সেলারের কাছে ফিরে এসেই দরজার ফাঁকটা দিয়ে সজোরে ঢুকিয়ে দিল ওটা এক মুহূর্ত দেরি না করে।
‘কী হচ্ছে ওখানে?’ সিলভিয়ার গলা ভেসে এল উপর থেকে। বিস্ময় ঝরে পড়ছে ওর কণ্ঠ থেকে।
ঝট করে ঘাড় ঘুরে গেল রোজমেরির। সিঁড়ির মাথায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল মহিলা দুই কন্যাকে। তাকিয়ে আছে চোখ বড় বড় করে।
‘থাকো তোমরা ওখানেই!’ চেঁচিয়ে সাবধান করল রোজমেরি। ‘খবরদার, নিচে নামবে না!’
.
কিছুক্ষণ পর।
ড্রাইভওয়েতে উঠে পড়ল অ্যালবার্ট কুপারের প্রকাণ্ড রিগ ক্যাবটা।
হেডলাইটের আলোয় স্ত্রীকে দেখতে পেল লোকটা লিভিং রুমের জানালায়, ওরই দিকে তাকিয়ে আছে। দুশ্চিন্তা আর আতঙ্কের ছাপ মুখাভিব্যক্তিতে।
প্রথমেই মনে হলো অ্যালবার্টের: এত রাতেও জেগে কেন
রোজমেরি!