দ্য মিডনাইট ফিডিং – জে বি স্ট্যাম্পার

দ্য মিডনাইট ফিডিং – জে বি স্ট্যাম্পার

ক্রি রি রিং। টেলিফোনের শব্দে চমকে উঠলাম। আজ বাড়িতে একা আমি। একটা ভূতের গল্প পড়ছিলাম। বাবা মা সিনেমা দেখতে গেছেন। রাত বারোটার আগে ফিরবেন না। ফোন বেজেই চলেছে। ধরছি না। জানি বাবা মা’র ফোন নয়। প্রয়োজন হলে আমার মোবাইলে তাঁর ফোন করতেন। আজেবাজে কারও ফোন নয়তো? ইদানীং একটা ছেলে খুব জ্বালাচ্ছে আমাকে। যখন তখন মোবাইলে ফোন করে বলে বেশিরভাগ সময় সেল ফোন বন্ধ রাখি। তার পক্ষে আমাদের বাড়ির নাম্বার জোগাড় করা কঠিন কিছু নয়। ধরব না ধরব না করেও রিসিভার তুলে নিলাম। ঝুন ঝুন শব্দটা চাপ সৃষ্টি করছে নার্ভে।

‘হ্যালো?’

এক মহিলা কণ্ঠ। চিনতে পারলাম না। খুব দ্রুত কথা বলছেন। বললেন এ মুহূর্তে তার একজন বেবী-সিটার খুব দরকার। খুব জরুরী প্রয়োজনে এখুনি বাইরে যেতে হচ্ছে তাঁকে। আমি যদি ঘণ্টা তিনেকের জন্য তার সাত মাসের বাচ্চাটাকে একটু দেখে রাখি খুবই কৃতজ্ঞ বোধ করবেন তিনি।

জবাব দিতে ইতস্তত করলাম আমি। স্কুলে গরমের ছুটিতে এবারই প্রথম বাইরে যাইনি। সময় কাটাতে প্রতিবেশী এক আন্টির ডে কেয়ার সেন্টারে বেবী সিটিং করছি। সন্দেহ নেই মহিলা ওখান থেকে জোগাড় করেছে আমার নাম্বার। কিন্তু আমি তো দিনের বেলা কয়েক ঘণ্টার জন্য বেবী সিটিং করি। এখন বাজে রাত সাড়ে আটটা। এত রাতে যাওয়া কি ঠিক হবে?

আমার কণ্ঠে দ্বিধা লক্ষ করে মহিলা চট করে এমন একটা পারিশ্রমিকের প্রস্তাব দিলেন, যা কেয়ার সেন্টারের প্রায় আধা মাসের বেতনের সমান। এবার আর দ্বিধা করলাম না। তা ছাড়া রাতে কখনও বেবী সিটিং করিনি।

এর মধ্যে একটা অ্যাডভেঞ্চারের গন্ধও আছে। মহিলা আমি রাজি হয়েছি শুনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। বললেন পনেরো মিনিটের মধ্যে আমাদের বাসায় আসছেন আমাকে তুলে নিতে। বাড়ির ঠিকানা তাঁর জানাই আছে। ডে কেয়ার সেন্টারে আমাদের ফোন নাম্বারের সঙ্গে বাড়ির ঠিকানাও লেখা

ছিল।

বাবাকে ফোন করলাম। মোবাইল অফ। মনে পড়ল সিনেমা হল-এ ছবি চলাকালীন মোবাইল বন্ধ রাখতে হয়। বাবা মা মেট্রো সিনেমা হল-এ হরর ছবি ‘ভ্যান হেলসিং’ দেখতে গেছেন। ছবিটি নাকি রমরমা চলছে। সিনেমা দেখতে ভাল্লাগে না আমার। আমি কার্টুন ছবি দেখি আর বই পড়ি। বইয়ের মধ্যে নিজের একটা জগৎ সৃষ্টি করে নিয়েছি। বেবী সিটারের কাজটাও উপভোগ করি। নাদুসনুদুস গুটু গুটু বাচ্চাগুলোর সঙ্গে খেলা করে ভালই কেটে যায় সময়।

কাঁটায় কাঁটায় পৌনে ন’টায় আমাদের বাড়িতে হাজির হয়ে গেলেন মহিলা। নিজের পরিচয় দিলেন মিসেস বারলফ বলে। কেনসিংটন স্ট্রীটে থাকেন। হড়বড় করে বললেন হঠাৎ একটি জরুরি বিজনেস ডিনারে যেতে হচ্ছে তাঁকে। তাঁর স্বামী আগেই চলে গেছেন ওখানে। ফোন করে মিসেস বারলফকে এখুনি যেতে বলেছেন। না গেলেই নয়। এতটুকু বাচ্চাকে ডিনারে নিয়ে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। তাই উপায় না দেখে আমাকে ফোন করেছেন। আমার নাম শুনেছেন মিসেস ক্রিস্টির কাছে। মনে পড়ল একটি সুপার মার্কেটে কর্মরত মিসেস ক্রিস্টি তাঁর দু’বছরের মেয়েটিকে সকাল বেলা আমাদের ডে কেয়ার সেন্টারে দিয়ে যান। কাজ শেষে নিয়ে যান।

কালো একটা গাড়িতে চড়ে এসেছেন মিসেস বারলফ। গাড়ি চলতে শুরু করার পর আমার মনে পড়ল মহিলার তড়বড়ানির চোটে তাঁর ফোন নাম্বার কিংবা বাড়ির ঠিকানা কোনও কিছুই বাসায় রেখে আসিনি। এমনকী তাড়াহুড়োয় মোবাইল ফোনটাও আনা হয়নি। মিসেস বারলফ আশ্বস্ত করলেন আমাকে। বললেন বাবা মা বাসায় ফেরার আগেই নিজে বাড়িতে পৌঁছে দেবেন। ডিনার শেষ হওয়া মাত্র নিজের বাসায় চলে আসবেন মিসেস বারলফ।

অ্যাডভেঞ্চারের লোভে বেবী সিটিংয়ের প্রস্তাবে তাৎক্ষণিকভাবে রাজি হয়ে গেলেও এখন কেমন যেন অস্বস্তি লাগছে আমার। বারবার মনে হচ্ছে কাজটা বোধহয় ঠিক করিনি।

বৃষ্টিও পড়ছে। শীতল হাওয়া আসছে খোলা জানালা দিয়ে। ঘুম ঘুম ভাব এসে গেল আমার। চটকা ভেঙে গেল মহিলার খসখসে কণ্ঠস্বরে।

‘আমার বাচ্চাটাকে তোমার ভালই লাগবে,’ বললেন মিসেস বারলফ। ‘মাত্র সাত মাস বয়স ওর। কিন্তু এখনই মাথায় ক্ষুরধার বুদ্ধি।’

‘কী নাম ওর?’ জিজ্ঞেস করলাম আমি। ‘আপনার বাচ্চা কি জেগে আছে এখনও।?’

‘না। না। নিকোলাস ঘুমিয়ে পড়েছে আরও ঘণ্টাখানেক আগে।’ হাসলেন মিসেস বারলফ। মহিলার ঠোঁটে টকটকে লাল লিপস্টিক। ভ্যাম্পায়ারের মত লাগছে।

আমি জানলাম মহিলার বাচ্চা রাত বারোটায় ঘুম থেকে জেগে ওঠে। তখন তাকে দুধ খাওয়াতে হয়।

‘আপনার ফিরতে ফিরতে রাত বারোটা বাজবে নাকি?’ শঙ্কিত হয়ে প্রশ্ন করলাম।

‘আমি বারোটার আগেই ফিরে আসার চেষ্টা করব,’ বললেন মিসেস বারলফ। ‘পার্টির ব্যাপার। বোঝোই তো। তবে ভয় নেই। আমি নিজে পৌঁছে দিয়ে আসব তোমাকে বাসায়।’

অন্ধকার রাত। বৃষ্টির কারণে রাস্তায় লোক চলাচল নেই বললেই চলে। মাঝে মাঝে একটা দুটো গাড়ি স্যাৎ করে আমাদের গাড়িটাকে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে মুখে হেডলাইটের জোরালো আলো ফেলে।

কেনসিংটন স্ট্রীটে ঢুকল কালো গাড়ি। মহিলা ভালই ড্রাইভ করেন। মেইন রোড ধরে বেশ খানিকটা এগিয়ে বামে মোড় নিলেন তিনি। ঢুকে পড়লেন লম্বা, আঁকাবাঁকা একটা গলিতে। আমি জায়গাটা চেনার চেষ্টা করলাম। ইলেকট্রিসিটি নেই। অন্ধকারে বোঝা যাচ্ছে না কিছু। হঠাৎ আরেকটা মোড় ঘুরলেন মিসেস বারলফ। প্রকাণ্ড, পুরানো একটা বাড়ির সামনে ব্রেক কষলেন। প্রকৃতি ফর্সা করে ঝিলিক দিল বিদ্যুৎ। সোনালি আলোতে বাড়িটির পেছনে একটা মাঠ দেখতে পেলাম। তার পরে জঙ্গল। জঙ্গল! নিউইয়র্ক শহরে জঙ্গল!! এ কোথায় এসেছি আমি। গা ছমছম করে উঠল। আশপাশে কোথাও বাতি না জ্বললেও দোতলা বিশাল বাড়িটিতে আলো দেখতে পেলাম। নিশ্চয় জেনারেটর চলছে। বাড়ির সামনে পুরানো আমলের দুটো গ্যাস ল্যাম্প জ্বলছে। মাটিতে অদ্ভুত ছায়া ফেলেছে।

বাড়িটি ধূসর রঙ করা। জানালায় হলুদ রঙ। ছাদটা ঢালু। পুরো বাড়িটিতে কেমন ভীতিকর একটা ব্যাপার আছে। আমার পেটের ভেতরটা শিরশির করছে। আবারও মনে হলো ভুল করে ফেলেছি। এখানে আসা উচিত হয়নি।

আমার দিকের গাড়ির দরজা খুলে গেল। মিসেস বারলফ দাঁড়িয়ে আছেন পাশে, চেহারায় অধৈর্য ভাব।

‘নেমে এসো,’ বললের তিনি। ‘এমনিতেই অনেক দেরি হয়ে গেছে। আমার স্বামী রাগ করবেন।’

মহিলার কণ্ঠে কর্তৃত্বের সুর স্পষ্ট। আমি নামতে চাই না, কথাটা বলার সাহস হলো না। দরজা খুলে নেমে পড়লাম াম। মহিলার পেছনে পেছনে এগোল সদর দরজার দিকে। ভারী সেগুন কাঠের দরজা। বড়, কালো একটা চাবি বের করলেন তিনি, তালায় ঢুকিয়ে মোচড় দিলেন। ক্লিক শব্দে খুলে গেল তালা।

একটা সরু হলঘরে ঢুকলাম আমি। দেয়ালের কুলুঙ্গিতে মিটমিট করে জ্বলছে মোম। কালো, আর লাল ব্রোকেড পেপারে মোড়া দেয়ালে ভৌতিক ছায়া ফেলেছে। মাথায় উপর একটা ঝাড়বাতি জ্বেলে দিলেন মিসেস বারলফ। আমার শুকনো চেহারা লক্ষ করলেন।

‘তোমাকে কেমন চিন্তিত দেখাচ্ছে,’ হাসলেন তিনি। ‘এখানে ভয়ের কিছু নেই। নিকোলাসের ঘর দোতলায়। রান্নাঘরটা বাড়ির পিছন দিকে। লাইব্রেরি আছে। সময় কাটাতে বই পড়তে পারো। তুমি বসো। আমি নিকোলাসকে একটু দেখে আসি।’

মহিলা দোতলায় উঠে গেলেন। একটু পরে নেমে এলেন। ‘নিকোলাস ঘুমাচ্ছে।’ জানালেন তিনি। ‘আমার ফিরতে যদি দেরি হয়ে যায় ওকে কিন্তু খেতে দিতে ভুল কোরো না। আর হ্যাঁ, একটা কথা ভুলেও কিন্তু ওর ঘরের জানালার পর্দা খুলবে না।’

তড়িঘড়ি চলে গেলেন মিসেস বারলফ, আমাকে ‘গুড বাই’ বলারও সুযোগ দিলেন না। মোটর স্টার্ট নেয়ার শব্দ শুনলাম আমি। গর্জন তুলে চলে গেল কালো গাড়ি। হঠাৎ উপলব্ধি করলাম এই অদ্ভুত বাড়িতে আমি একা। সামনের দরজায় দ্রুত গেলাম। লাগিয়ে দিলাম ছিটকিনি।

সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগলাম আমি। বাচ্চার ঘরে যাব। সিঁড়ি বেয়ে উঠছি, ধুকপুক শুরু হয়ে গেল বুকে। সামনের হলঘরটা ছায়াময়, অন্ধকার। পুরো বাড়িটাকেই আমার হরর সিনেমার ভৌতিক বাড়ির মত মনে হচ্ছে।

হলঘরের শেষ মাথায় চলে এলাম। একটা দরজা দেখতে পেলাম। ভেজানো। ধাক্কা মেরে খুলে ফেললাম। উঁকি দিলাম।

লাল ডিম বাতি জ্বলছে ঘরে। লম্বা, কাঠের একটা দোলনা দেখতে পেলাম আমি। নিঃশব্দে ওদিকে হেঁটে গেলাম। ঝুঁকলাম। ভারি সুন্দর একটি বাচ্চা শুয়ে আছে দোলনায়। মুখখানা আমার দিকে ফেরানো। এক মাথা ঘন কালো চুল। আমার আগমন টের পেয়েই কিনা কে জানে, চোখ মেলে চাইল নিকোলাস। ঝাড়া এক মিনিট তাকিয়ে রইল আমার দিকে সম্মোহিতের মত বাচ্চাটার দিকে চেয়ে রইলাম। চোখ বুজল নিকোলাস। ঘুমিয়ে পড়ল আবার। মিষ্টি, নিষ্পাপ মুখে স্মিত হাসি। মিসেস বারলফের শতাব্দী প্রাচীন বাড়িটি আমার বুকে কাঁপন ধরিয়ে দিলেও বাচ্চাটাকে খুবই ভাল লেগেছে।

লাইব্রেরি ঘরটা কোন দিকে দেখিয়ে দিয়েছেন মিসেস বারলফ। ওই ঘরে ঢুকলাম আমি। ঘরটা কালো কাঠের প্যানেলিং দিয়ে তৈরি। বড় বড় পিঠ উঁচু চেয়ার আর এক জোড়া কালো চামড়ার কাউচ চোখে পড়ল। চেয়ারের পাশে একটা বাতি। বাতি জ্বালিয়ে চেয়ারে বসলাম। বাতির আলোয় ঘরের অন্ধকার দূর হলো সামান্যই। তবে বই পড়া যাবে।

লাইব্রেরি ঘরে কয়েকটা কালো কাঠের আলমারি। তাতে প্রায় সবই ঢাউস সাইজের ইংরেজি বই। বাতির আলোয় দু’একটা বইয়ের নাম পড়তে পারলাম। ব্ল্যাক ম্যাজিক আর উইচক্রাফটের উপর লেখা। সঙ্গে একটা হরর বই তো আছেই। তাই ওদিকে আর নজর দিলাম না। নিজের আনা ভৌতিক গল্প সংকলনে মনোনিবেশ করলাম।

কড়-কড়-কড়াৎ! শব্দে বাজ পড়ল কোথাও। বুকের রক্ত ছলকে উঠল আমার। পরমুহূর্তে বিদ্যুতের আলো ঝলসে দিল ঘর। চেয়ার ছেড়ে উঠলাম। হেঁটে গেলাম লাল পর্দা ফেলা জানালার ধারে। ভারী পর্দা টেনে সরালাম। মাঠের ধারের জঙ্গলে বাহু ছড়িয়ে নাচছে গাছের ডাল। বৃষ্টির বেগ বেড়েছে আরও। হঠাৎ কারও সঙ্গে কথা বলার খুব ইচ্ছে জাগল আমার-বাবা, মা, বন্ধু, কিংবা অন্য কেউ। লাইব্রেরি ঘরে টেলিফোন খুঁজে দেখলাম। নেই। হলঘরেও পেলাম না।

অকস্মাৎ আতংক ভর করল আমার মনে। কুড়াক ডাকছে মন। এক ছুটে বসার ঘরে ঢুকলাম। অন্ধকার। দেয়াল হাতড়ালাম বাতির সুইচের জন্য। হঠাৎ কীসের সঙ্গে যেন ধাক্কা খেলাম আমি। নরম কী একটা ছুটে পালিয়ে গেল। চিৎকার করে উঠলাম। দৌড়ে চলে এলাম লাইব্রেরি ঘরে। লাল চেয়ারটাতে বসে পড়লাম। পা মুড়ে নিয়ে হাত দিয়ে ঢাকলাম মুখ। তারপর ফোঁপাতে শুরু করলাম।

তীব্র কান্নার আওয়াজে জেগে গেলাম আমি। কাঁদতে কাঁদতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি জানি না। ভীত চোখে তাকাই চারপাশে। এক মুহূর্তের জন্য বুঝতে পারলাম না কোথায় আছি। তারপর মনে পড়ে গেল সব। দোতলা থেকে ভেসে আসছে ট্যাঁ ট্যাঁ চিৎকার। লাইব্রেরি ঘরের গ্রাণ্ডফাদার ক্লক গম্ভীর ঢং ঢং সুরে জানান দিল বারোটা বাজে। এখন মাঝ রাত। খিদে পেয়েছে নিকোলাসের।

আমার অবাক লাগল ভেবে ঠিক বারোটার সময়ই কি খিদে পেয়ে যায় বাচ্চার? আর এভাবে তারস্বরে কাঁদতে থাকে? মিসেস বারলফ তো বললেন বারোটার আগেই ফিরবেন। কই এলেন না তো এখনও!

বাচ্চার কান্না তীব্রতর হলো। কানে বাড়ি খাচ্ছে দ্রিম দ্রিম। লাফ মেরে উঠে পড়লাম আমি, এক ছুটে চলে এলাম রান্নাঘরে। বাচ্চার কান্না প্রতিধ্বনিত হচ্ছে সারা বাড়িতে।

সুইচ টিপে বাতি জ্বাললাম আমি। সাড়া পেয়ে একটা ইঁদুর ফ্রিজের নীচে লুকিয়ে পড়ল। মাগো, কত্ত বড় ইঁদুর! গায়ে কাঁটা দিল আমার। এক টানে ফ্রিজের দরজা খুললাম। ওপরের শেলফে একটা বোতল বোঝাই কালো রঙের জুস। দুধের বোতল খুললাম। নেই। শেষে জুসের বোতল নিয়েই ছুটলাম সিঁড়ির দিকে। সিঁড়ি বাইছি আমি, কলজে যেন গলায় এসে ঠেকেছে।

নিকোলাসের ঘরে ঢুকলাম আমি। দোলনা ধরে দাঁড়িয়ে আছে বাচ্চা। মুখ হাঁ করে কাঁদছে। আমাকে দেখে থেমে গেল কান্না। হাত বাড়াল বোতলের দিকে। বোতলটা ওর হাতে দিলাম আমি। দেখলাম বোতল মুখে পুরে চুক চুক করে জুস খাচ্ছে নিকোলাস। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম আমি। যাক, বাচ্চা ঠিকই আছে। স্রেফ খিদেয় কান্নাকাটি করছিল। ঘরে জিরো ওয়াটের লাল রঙের ডিম বাতি ছাড়া কিছুই জ্বলছে না। আমি সুইচ খুঁজলাম অন্য বাতিগুলো জ্বেলে দেয়ার জন্য। আশ্চর্য! ডিম বাতি আর এয়ার কুলারের সুইচ ছাড়া আর কোনও সুইচ নেই ঘরে। এয়ারকুলার বন্ধ। তাই ভাপসা গরম লাগছে। এসি ছাড়লাম আমি। চলল না এয়ার কুলার। নষ্ট নাকি? আমি জানালার দিকে এগিয়ে গেলাম। মনে পড়ে গেল মিসেস বারলফের সতর্কবাণী। তিনি জানালা খুলতে নিষেধ করেছেন। হয়তো বিদ্যুতের আলোয় ভয় পেয়ে জেগে যেতে পারে নিকোলাস, এ আশঙ্কায়। এখন তো জেগেই আছে বাচ্চা। জানালার পর্দা টেনে সরিয়ে ফেললাম আমি।

থেমে গেছে বৃষ্টি। আকাশের কালো মেঘ কেটে ভেসে উঠেছে পূর্ণিমার চাঁদ। রূপোলি আলোর বন্যায় ভাসিয়ে দিল নিকোলাসের দোলনা। সে মুখে বোতল রেখে চোখ বড়বড় করে তাকাল চাঁদের দিকে।

জানালা খুলতে যাচ্ছি, থমকে গেলাম অদ্ভুত একটা শব্দ শুনে। বাচ্চার মাথার পেছনের জানালায় থ্যাচ করে একটা শব্দ হয়েছে। এগিয়ে গেলাম ওদিকে। কাঁচের গায়ে সেঁটে আছে একটা বাদুড়, তাকিয়ে রয়েছে বাচ্চার দিকে। ঘেন্নায় মুখ বাঁকালাম আমি, পিছিয়ে গেলাম এক কদম। আরেকটা বাদুড় এসে নামল জানালায়। নিকোলাস হাঁ করে তাকিয়ে আছে বিকট প্রাণীগুলোর দিকে। হঠাৎ হাত থেকে বোতলটা ছুঁড়ে ফেলে দিল সে মেঝেতে। ঝুঁকে গেলাম জানালার দিকে। মেঝে থেকে বোতলটা তুলে নিলাম। ঘন কয়েক ফোঁটা রস পড়েছে মেঝেতে। কালচে রক্তের মত দেখাচ্ছে। গা টা কেমন রি রি করে উঠল।

ঠিক তখন। দিকে মুখ ফিরিয়ে তাকাল নিকোলাস, লম্বা, একটানা সুরে কাঁদতে লাগল। ট্যা আত্মা-ট্যাঁ আ আ! হাত বাড়িয়ে দিল। কোলে নিতে বলছে। নিকোলাসের কান্নাটা ঠিক যেন মানুষের বাচ্চার মত নয়, প্রলম্বিত ভৌতিক একটা সুর। গায়ের রোম খাড়া হয়ে গেল আমার। ওকে কোলে নেব কি নেব না দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছি, চিৎকারের মাত্রা বেড়েই চলল বাচ্চার। শেষে বাধ্য হয়েই ওকে কোলে নিতে হলো। সঙ্গে সঙ্গে থেমে গেল কান্না। আমার ঘাড় জড়িয়ে ধরল নিকোলাস।

আমার পেছনে আবার থ্যাচ করে শব্দ হলো। বুঝতে পারলাম আরেকটা বাদুড় এসে বসেছে জানালায়। ওদের দিকে তাকিয়ে আছে নিকোলাস, চাঁদের আলোয় চকচক করছে চোখ। ওকে কাঁধে তুলে নিলাম আমি। আদর করে চাপড় দিতে লাগলাম পিঠে। ওর মাথাটা ঘাড়ের পাশে এলিয়ে দিলাম। ঘুম পাড়াবার চেষ্টা করছি। আমি টের পেলাম নিকোলাসের শরীর হঠাৎ শক্ত হয়ে উঠেছে। অদ্ভুত হিস্ শব্দ বেরিয়ে এল মুখ থেকে। যখন ব্যাপারটা বুঝতে পারলাম আমি, ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে অনেক। চারটে ছোট দাঁত কামড়ে ধরল আমার ঘাড়, এক টানে ছিঁড়ে ফেলল জুগুলার ভেইন….

***

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *