দ্য মাংকি’স ব্রেন – জন আর্থার
শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাংলো থেকে বের হতেই গায়ে আগুনের হল্কা অনুভব করল রিচার্ড ক্লার্ক। সকাল এখন, কিন্তু মাত্র একশো গজের মত রাস্তা হেঁটেছে সে, সুতি শার্টটা ঘামে ভিজে সেঁটে গেল পিঠের সাথে। কপাল বেয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় ঘাম ঝরছে, ভুরু ভিজিয়ে চোখে ঢুকছে। চোখ মিটমিট করছে ও, ডান হাতের চেটো দিয়ে একটু পর পর ভুরু থেকে মুছে ফেলছে ঘাম। বন্দরের দিকে মুখ তুলে চাইল ক্লার্ক। সিঙ্গাপুর জেটিতে ডজনখানেক সমুদ্রগামী জাহাজ নোঙর করা, নারকেলের শুকনো শাঁস আর রাবার লোডের অপেক্ষায় আছে। কাজটা শেষ হলে আবার বেরিয়ে পড়বে খোলা সাগরে।
এখানে আবহাওয়ার কোন পরিবর্তন নেই। জানুয়ারি চলছে অথচ গরমটা জুন বা সেপ্টেম্বর মাসের মতই। মাসের পর মাস, দিনে বা রাতে তাপমাত্রা সব সময় নব্বুই ডিগ্রি ফারেনহাইটে স্থির হয়ে থাকছে। বাতাসে আর্দ্রতার পরিমাণ খুব বেশি। এমনকি মৌসুমী বৃষ্টিতেও গা পোড়ানো গরম কমছে না।
তবে রিচার্ড ক্লার্ক এ ধরনের আবহাওয়ায় নিজেকে খাপ খাইয়ে নিয়েছে অনেক আগেই। গত ছ’বছরে এই দ্বীপ এবং তার বাসিন্দাদের হালহকিকত ভালই চেনা হয়ে গেছে তার। বরং বলা যায় এদের জীবনযাত্রার সাথে এতই অভ্যস্ত ক্লার্ক যে অন্য কোথাও গেলে সে হয়তো স্বস্তিই পাবে না। ককেশিয়ান এবং পূর্ব দেশীয় জনগোষ্ঠীর অনেকের সাথেই ওর হার্দিক সম্পর্ক। স্থানীয়দের সাথে সে মিশে যেতে পারে বন্ধুর মতই। আফিম সেবী, ক্ষয়াটে চেহারার চাইনিজ ধোপা বা আবলুস কালো ভারতীয় সুদখোর ব্যবসায়ী কিংবা সোনার দাঁত বাঁধানো মাড়োয়ারী শেঠ, সবাই তাকে চেনে, শ্রদ্ধা ও সম্মানের চোখে দেখে। ক্লার্কও ওদের ধর্মীয় বিশ্বাস, প্রথাগত আচার-অনুষ্ঠানগুলোর প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শনে কার্পণ্য করে না। ওদেরকে সে-ও বন্ধু হিসেবেই দেখে। ক্লার্কের ইউরোপীয় বন্ধু-বান্ধবদের অনেকে এমন মন্তব্যও করেছে, ক্লার্ক আসলে নিজস্ব সংস্কৃতি বিসর্জন দিয়ে ক্রমশ প্রাচ্যমুখী হয়ে উঠছে। তবে ক্লার্ক বিশ্বাস করে, প্রাচ্যের সংস্কৃতিকে পুরোপুরি ধারণ করতে হলে আরও অনেক কিছু জানতে হবে তাকে, শেখার এখনও বাকি আছে অনেক কিছুই। স্থানীয়দের সংস্কৃতি বা ধর্মবিশ্বাসের প্রতি তার আগ্রহ এত প্রবল যে ক্লার্ক ইংল্যান্ডে, নিজের বাড়ি ঘরের কথা প্রায় ভুলে যেতে বসেছে।
হলদে রঙের একটা মার্সিডিজ ট্যাক্সি সগর্জনে ওর পাশ কাটিয়ে যাচ্ছিল, হাত তুলে তাকে ডাকল রিচার্ড ক্লার্ক। প্রায় সাথে সাথে ব্রেক কষল ড্রাইভার, টায়ারের সঙ্গে রাস্তার পিচের তীব্র ঘর্ষণে বিকট আওয়াজ উঠল, লাল ধুলোর মেঘ উড়িয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল ট্যাক্সি ওর কাছ থেকে হাত বিশেক দূরে। গাড়ির জানালা দিয়ে হলদে রঙের একটা মুখ উঁকি দিল, মুচকি হাসছে।
‘ট্যাক্সি, জন?’
পা বাড়াল ক্লার্ক, উঠে বসল পেছনের সিটে, ড্রাইভার বিপজ্জনকভাবে স্পীড বাড়াল, দড়াম করে সিটের সাথে বাড়ি খেল ও, পঙ্খীরাজের গতিতে ছুটছে ট্যাক্সি। রাগ করল না ক্লার্ক। ট্যাক্সিঅলাদের এমন আচরণ গা সওয়া হয়ে গেছে।
‘কোনদিকে, জন?’ জিজ্ঞেস করল ড্রাইভার। তার কাছে সবাই জন।
‘পায়া লেবার এয়ারপোর্ট।
‘পাঁচ ডলার,কেমন?’ তাকাল সে ক্লার্কের দিকে, মুখে চওড়া হাসি ফুটে উঠেছে। প্রত্যুত্তরে ক্লার্কও হাসল।
‘ফাজলামো হচ্ছে, না? তুমি কি আমাকে বোকা ট্যুরিস্ট ঠাউরেছ? তিন ডলার দেব, এক পয়সাও বেশি নয়।’
‘ঠিক আছে, জন,সাড়ে তিন ডলার।’
‘বললাম তো, তিন ডলারের এক পয়সাও বেশি নয়।’
‘ঠিক আছে, জন,আপনার কথাই রইল।’ এখনও হাসছে ড্রাইভার, লোক চিনতে ভুল করেনি সে।
কোলিয়ার জেটি পার হয়ে গেল ওরা, দ্বীপের দূর প্রান্তের ব্যস্ত চায়না টাউনকেও পাশ কাটাল। এয়ারপোর্টে পৌছে ক্লার্ক ড্রাইভারকে তিন ডলার ছাড়া আরও পঞ্চাশ সেন্ট অতিরিক্ত বকশিশ দিল। তরুণ চাইনিজ ড্রাইভার খুশিতে হাত নেড়ে ওকে বিদায় জানাল, গুনগুন করতে করতে আগের চেয়েও বেশি স্পীডে গাড়ি ছোটাল। বার-এ ঢুকে ব্রান্ডির অর্ডার দিল ক্লার্ক, গ্লাসটা নিয়ে চলে এল অবজারভেশন ব্যালকনিতে, ওর মক্কেলের আগমনের অপেক্ষার প্রহর গুণতে হবে।
সব কিছু ঠিকঠাক থাকলে ওয়েন হ্যারিসন আর আধ ঘণ্টার মধ্যে চলে আসবে। ক্লার্ক তার সাথে হ্যান্ডশেক করবে, নিরর্থক শুভেচ্ছা বিনিময় হবে, তার পরের তিনদিন ওর কাজ হবে আমেরিকানটাকে সিঙ্গাপুর ঘুরিয়ে দেখানো। এজন্য ক্লার্ক তিনশো ডলার পাবে। টাকার অঙ্কটাকে মোটেই মন্দ বলা যাবে না। কাজটা তেমন কঠিন নয় অথচ পারিশ্রমিক ভাল। এ ধরনের কাজ করে আরাম পায় ক্লার্ক। এ পর্যন্ত মক্কেল হিসেবে যত ট্যুরিস্ট ক্লার্কের কাছে এসেছে, এদেরকে হ্যান্ড্ল্ করতে কখনও তেমন বেগ পেতে হয়নি তাকে। বিশেষ করে আমেরিকানরা তো ইংরেজি জানা গাইড পেলে বর্তে যায়, থাক গাইডের ইংরেজি উচ্চারণে ভিনদেশী টান। এসব ট্যুরিস্টদের আসলে মনে মনে করুণাই করে ক্লার্ক। এদেরকে তার মনে হয় মাথা মোটা, যাদের কাজ সারাক্ষণ ক্যামেরায় হাবিজাবি ছবি তুলে রাখা, চোখের সামনে যা পড়ে তা-ই দেখে বিস্ময়ে হাঁ হয়ে যাওয়া। ক্লার্ক দেখেছে এরা অত্যন্ত স্বার্থপর স্বভাবের হয়, গরীব মানুষদের প্রতি বিন্দুমাত্র মমতা নেই, পাশ্চাত্য এবং পুবের মাঝে সাংস্কৃতিক বন্ধনের প্রতিও এতটুকু আগ্রহ নেই। সবকিছুর প্রতি উন্নাসিক একটা ভাব, নিজেকে বিচ্ছিন্ন রাখার চেষ্টা। এদের কথা ভাবতে ভাবতে উত্তেজিত হয়ে ব্যালকনির রেলিং শক্ত মুঠোয় চেপে ধরেছিল ক্লার্ক, খেয়াল হতে ছেড়ে দিল। পাশ্চাত্যে জন্ম নিলেও মন-মানসিকতায় নিজেকে প্রাচ্যের ভাবধারায় গড়ে তুলছে বলেই হয়তো আমেরিকানদের প্রতি একটা বিতৃষ্ণা জন্ম নিয়েছে তার মধ্যে। সে নিচে, এয়ার ফিল্ডের দিকে তাকাল। রুপোর মত চকচকে বিশাল এয়ারলাইনারটা স্থির হয়ে থাকা পাম গাছগুলোর মাথায় চক্কর দিচ্ছে। এসে গেছে তার মক্কেলের উড়ুক্কু বাহন।
অ্যারাইভাল লাউঞ্জের বাইরে এসে দাঁড়াল রিচার্ড ক্লার্ক, আয়না বসানো জানালা দিয়ে দেখল কাস্টমস এবং ইমিগ্রেশনের ভিড় ঠেলে যাত্রীদের স্রোত আসছে। নানা চেহারার, নানা আকৃতির প্রচুর মানুষ। তবে ভিড়ের মধ্যেও ওয়েন হ্যারিসনকে চিনে নিতে সমস্যা হলো না ক্লার্কের। পাসপোর্ট হাতে যাত্রীদের দঙ্গল থেকে সামান্য দূরে সরে দাঁড়িয়েছে সে; ফর্সা, থলথলে চেহারায় শিশুর সারল্য ফুটিয়ে তুলে ইতিমধ্যে ক্যামেরার শাটার টিপতে শুরু করেছে। নিজের কাছে যা-ই একটু অদ্ভুত বা আশ্চর্যের মনে হচ্ছে, খটাখট ছবি তুলে নিচ্ছে। এক মিনিটের ভেতরে সে তিনজন কাস্টমস অফিসার, চারটি ভাষায় লেখা ‘ওয়েলকাম টু সিঙ্গাপুর’ সাইন এবং নিজের প্লেনের বেশ কিছু যাত্রীর স্ন্যাপ নিয়ে নিল। ওয়েন হ্যারিসন বেশ লম্বা, মাংসল শরীর, মাথায় পাতলা চুল টাকের আভাস দিচ্ছে। তার পরনে পুরানো কিন্তু অত্যন্ত দামি গাঢ় নীল রঙের সুট, ঢোলা ট্রাউজার, পায়ের বাদামি জুতো জোড়া চকচক করছে। গলার উজ্জ্বল হলুদ রঙের টাইটা কড়া ভাঁজের সাদা শার্টের সাথে মন্দ লাগছে না। বোঝাই যায় দুধ-ঘি খাওয়া মানুষ, বেশ মালদার পার্টি, তবে করোনারি থ্রম্বসিসের শিকার হতেও বোধহয় বেশি দেরি নেই।
ধৈর্য ধরে দাঁড়িয়ে থাকল রিচার্ড ক্লার্ক নিজের জায়গায়। ফর্মালিটিজ সেরে, সুটকেস নিয়ে ওয়েন হ্যারিসন লাউঞ্জে এলে ওর দিকে এগিয়ে গেল সে। যথাসাধ্য চেষ্টা করল চেহারায় অমায়িক ভাবটা ধরে রাখতে।
‘মি. হ্যারিসন? আমি রিচার্ড ক্লার্ক,’ নিজের পরিচয় দিল ও। ‘আশাকরি যাত্রা পথে কোন বিঘ্ন ঘটেনি।’ আমেরিকানটার দুঠোঁট ফাঁক হয়ে গেল, যেন অনেক দিনের জানি দোস্তের সঙ্গে দেখা, এমন ভাব করে হাসি মুখে সে মোটা একটা হাত বাড়িয়ে দিল ক্লার্কের দিকে।
‘আপনি তো, ভাই, খুব পাংচুয়াল দেখছি! একেবারে ঠিক ঠিক সময়ে এসে হাজির।’ লোকটার হাতের নখ সুন্দরভাবে কাটা, লক্ষ করল ক্লার্ক। আর গলার স্বরটাও গমগমে, বিশাল দেহের সাথে মানানসই।
ক্লার্ককে বেশিক্ষণ হাত ঝাঁকাবার সুযোগ দিল না হ্যারিসন, চট করে ক্যামেরাটা তুলে ধরল মুখের সামনে, বিল্ডিং-এর কোণায় সারং-কেবায়া পরা সুন্দরী, মালয়ী মেয়েটি অদৃশ্য হবার আগেই তার একটি ছবি তুলে রাখল। তারপর বোকা বোকা ভাব নিয়ে ঘুরল ক্লার্কের দিকে, যেন সঠিক সময়ে তরুণীর ছবি নিতে পেরে নিজেই হতভম্ব হয়ে গেছে। লোকটার ঢং দেখে গা জ্বালা করে উঠল ক্লার্কের।
হ্যারিসন জরুরী গলায় বলল, ‘বেশ, বেশ। এখন তবে যাত্রা শুরু করা যাক। মাত্র তিনদিন থাকব এখানে, তারপর ব্যবসার কাজে হংকং দৌড়াতে হবে। আশা করি, এই স্বল্প সময়ের মধ্যে আপনি আমাকে এমন সব জিনিস দেখাতে পারবেন, বাড়িতে যার গল্প করে বাহবা নিতে পারব।’
একটা ট্যাক্সি নিল ওরা শহরে ফেরার জন্য। সারা রাস্তা হ্যারিসন ক্রমাগত ক্যামেরার বোতাম টিপে গেল। বর্ণাঢ্য চাইনিজ শব মিছিলের ছবি তুলল সে, ভাবগম্ভীর বুদ্ধ মন্দির এমনকি ঘামে ভেজা শ্রমিকের চেহারাও বাদ গেল না। গুড উড হোটেলে পৌঁছার আগ তক ক্লিক ক্লিক চলতেই থাকল। হ্যারিসন ড্রাইভারকে আমেরিকান ডলারে ভাড়া মেটালে লোকটা অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে ক্লার্কের দিকে তাকিয়ে চোখ মিটমিট করল। জবাবে ক্লার্কও একই কাজ করল। কোন মন্তব্য করল না। শত হলেও, ট্যাক্সির ড্রাইভার এবং তার কাজ একই।
ক্লার্কের ধারণা ছিল, হ্যারিসন লম্বা ভ্রমণের ধকল সামলাতে আজকের দিনটা অন্তত হোটেলে বিশ্রাম নেবে। কিন্তু কোথায় কি? ঘণ্টা তিনেক পরেই দেখা গেল সে ক্লার্ককে নিয়ে ব্লাকাং মাটি আইল্যান্ডে চলে এসেছে, সাম্পানে চড়ে মাছ ধরবে। কিন্তু মাছের বদলে তার বড়শিতে শুধু বিষাক্ত সামুদ্রিক সাপ ধরা পড়ল। ক্লার্ক এবং সাম্পানের জেলে অনেক কষ্টে তাকে ডেকে সাপ ওঠানোর প্রবল ইচ্ছে থেকে নিবৃত্ত করল। শেষে হতাশ হয়ে হ্যারিসন গলুইতে চিৎ হয়ে শুয়ে, বড় স্ট্র হ্যাট দিয়ে মুখ ঢেকে হেঁড়ে গলায় ‘হোম অন দা রেঞ্জ’ গাইতে লাগল। সূর্যের খরতাপ যে তার রংধনু রঙের শার্ট আর হাঁটু পর্যন্ত লম্বা বারমুডা শর্টস পুড়িয়ে দিচ্ছে সেদিকে খেয়ালই নেই।
ওই দিন সন্ধ্যায় ওরা দু’জন ট্রোইকা রেস্টুরেন্টে পেট পুরে ডিনার সেরে ফিরে এল হোটেলে। মদের গ্লাস হাতে নিয়ে প্ল্যান করতে বসল পরদিন কোথায় কোথায় যাবে।
‘আগামীকাল,’ ব্রান্ডির গ্লাসের মুখে আলতোভাবে তর্জনী স্পর্শ করতে করতে ক্লার্ক বলল, ‘আপনাকে থাইপুস মে নিয়ে যাব।’
‘থাই পু…কি বললেন?’ প্রায় চেঁচিয়ে উঠল হ্যারিসন, আরেকটু হলেই সিগারটা গিলে ফেলেছিল।
ক্লার্ক মনে মনে ভাবল গাড়লটাকে সব কথা ব্যাখ্যা না করলে কিছুই বুঝবে না।
সে বলতে শুরু করল, ‘সিঙ্গাপুরে বিশ লাখেরও বেশি মানুষের বাস। এদের বেশিরভাগ চাইনিজ। এদেরও আবার ভাগ আছে, যেমন হোক্কাইন, টিও চিউ, ক্যান্টোনিজ, হাইনানিজ, হাক্কা ইত্যাদি। এরা নানা আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলে। এছাড়া ভারতীয় সিলোনিজ এবং মালয়ীদের সংখ্যাও প্রচুর।
‘থাইপুসাম হলো একটা হিন্দু উৎসবের নাম। ভারতীয় পূজারীরা রাস্তায় রাস্তায় এই উৎসবটি পালন করে তাদের প্রায়শ্চিত্তের নামে। কাল ওদের উৎসব মিছিল দেখলে আপনি অবাক হয়ে যাবেন। ভয়ও পেতে পারেন। কারণ তারা প্রায়শ্চিত্ত করে শরীরে ধারাল সুঁই ফুটিয়ে, কখনও পায়ে স্রেফ নগ্ন পেরেকের স্যান্ডেল পরে। আবার কেউ কেউ তাদের নাক, জিভ, থুতনি বা শরীরের আলগা চামড়া বড়শি দিয়ে ফুঁড়ে রাখে।’
বিরতি দিয়ে চামড়ার আর্ম চেয়ারে গা এলিয়ে দিল ক্লার্ক, লক্ষ করছে গল্প শুনে আমেরিকানটার কি প্রতিক্রিয়া হয়। বিরক্তি লাগল, কারণ হ্যারিসন ওর প্রতি তেমন আগ্রহ দেখাচ্ছে না। তবু সে বলে চলল।
‘কাবাডি হচ্ছে প্রায়শ্চিত্তের আরেক ধরন। জিনিসটা ভারী কাঠ দিয়ে তৈরি, তাতে ক্ষুরের মত ধারাল ব্লেড ঢোকানো। প্রায়শ্চিত্তকারীর দু’কাঁধে কাঠের ফ্রেমটা বসানো হয়।’
হ্যারিসন ক্লার্কের গল্প শুনছে না। তার সমস্ত মনোযোগ চাইনিজ ওয়েট্রেসের দিকে। মেয়েটির পরনে চিওংসাম। সে মদের বোতল নিয়ে ওদের টেবিলে আসছে, প্রতিটি পা ফেলার সময় বিদ্যুৎ ঝিলিকের মত ধবধবে সাদা ঊরু দেখা যাচ্ছে কাটা পোশাকটার আড়াল থেকে। হ্যারিসন ওর দিকে তাকিয়ে আছে দেখে মেয়েটি যেন ইচ্ছে করে আরও বেশি নিতম্ব দোলাল। মদের বোতল রেখে মেয়েটি চলে যাচ্ছে, ওর দিকে লোভাতুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল আমেরিকান। তরুণী দৃষ্টির আড়াল হলে ফিরল সে ক্লার্কের দিকে।
‘চাইনিজদের সম্পর্কে যেসব গল্প শুনি সব কি সত্যি?’ হেসে উঠে জানতে চাইল হ্যারিসন।
ক্লার্কের খুব রাগ হলো লোকটার ওপর। শালার আমেরিকান জাতটাই এমন! দাঁতে দাঁত চাপল সে। তবে চেহারা স্বাভাবিক করে বলতে লাগল, ‘চাইনিজদের সম্পর্কে যে যাই বলুক না কেন, ওরা কিন্তু বেশ অদ্ভুত প্রজাতির মানুষ। ওদের সংস্কৃতি, রীতি-নীতিগুলোও ভারি অদ্ভুত।’ আবার হেলান দিল সে চেয়ারে, অপেক্ষা করছে হ্যারিসন তার টোপটা গেলে কিনা। মুখের সামনে ধোঁয়ার মেঘ জমেছে, আমেরিকানটার চেহারা দেখা যাচ্ছিল না, সে অধৈর্য ভঙ্গিতে হাত নেড়ে ধোঁয়া সরাল, এবার আগ্রহ নিয়ে প্রশ্ন করল, ‘যেমন?’ মাছ টোপ গিলেছে। ক্লার্ক প্রস্তুত হলো ওকে নিয়ে খেলতে।
‘যেমন, কিছু চীনা সম্প্রদায়ের লোক সংফিশের মাথাটাকে খুব সুস্বাদু মনে করে। কাঁটা বাদ দিয়ে পুরো অংশটাই খেয়ে ফেলে, পাশ্চাত্যের মানুষদের কাছে ব্যাপারটা অদ্ভুত মনে হতে পারে, নয় কি?’
এক পাশের ভুরু কপালের দিকে উঠে গেল হ্যারিসনের, ঠোঁটে শুকনো হাসি ফুটল, তবে কোন মন্তব্য করল না। ক্লার্ক তার গল্পটাকে আরও ফাঁপিয়ে তুলল।
‘তারপর ধরুন, এখানে, মানে সিঙ্গাপুরে, এক শ্রেণীর চীনা আছে, এরা সবসময় অন্যদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকে। কিন্তু এরা এমন এক ধরনের উৎসব করে যা নিজের চোখে না দেখলে আমি বিশ্বাসই করতাম না।’
হ্যারিসন তার চেয়ারের এক কোণে কাত হয়ে বসেছিল, তার চেহারায় প্রবল আগ্রহের ভাব ফুটে উঠতে দেখে তৃপ্তি বোধ করল রিচার্ড ক্লার্ক। মনে মনে ভাবল, ব্যাটাকে বড় রকমের একটা ধাক্কা দিতে হবে।
সে আবার শুরু করল, ‘এই চীনারা বিশ্বাস করে বানরের মগজ খেতে পারলে শুধু বুদ্ধি আর জ্ঞানই বাড়বে না, বৃদ্ধি পাবে সন্তান উৎপাদন ক্ষমতা, নিশ্চয়তা দেবে দীর্ঘ জীবনের। তবে মগজটা খেতে হবে জ্যান্ত বানরের মাথা থেকে, তাৎক্ষণিকভাবে, নইলে কাজ হবে না। ওরা করে কি, হতভাগ্য বানরটাকে শক্ত করে বেঁধে ফেলে, তারপর মাথার খুলি ফাটিয়ে ভেতর থেকে মগজ বের করে এনে খায়। বানরটা মারা যাবার আগেই কাজটা করতে হয়। মানে যতক্ষণ জানোয়ারটা যন্ত্রণায় মোচড় খেতে থাকে, সেই সময়ের ভেতরে চীনারা খুবলে নেয় মগজ। সে দৃশ্য না দেখলে বিশ্বাস করবেন না। মগজ খুবলে নেয়ার সময় আহত বানরটা এমন ভয়ঙ্কর চিৎকার দিতে থাকে, এর চে’ ভয়াবহ ব্যাপার আর হয় না।’
হ্যারিসনের চোখ কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে, দৃষ্টিতে অবিশ্বাস।
‘এসব গল্প বলেই আপনি ট্যুরিস্টদের আকর্ষণ করেন, না? চোখে না দেখলে আমি সত্যিই আপনার গল্প বিশ্বাস করব না। এ তো সাংঘাতিক অমানবিক কান্ড!’
হাসল ক্লার্ক। ‘ব্যাপারটা মানবিক না অমানবিক সেটা সম্পূর্ণ নির্ভর করে কোন্ পরিবেশে আপনি বড় হয়ে উঠেছেন তার ওপর। সত্যি বলতে কি, সবার মূল্যবোধও এক নয়। যারা এই কাজটা করে তাদের কাছে কিন্তু এটা অত্যন্ত স্বাভাবিক একটি ব্যাপার।
এরপর বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইল দু’জনে। হ্যারিসনের এখনও সন্দেহ দূর হচ্ছে না। সে ক্লার্কের গল্পটা নিয়ে গভীর ভাবনায় ডুবে গেছে। আবার যখন কথা বলতে শুরু করল, সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রসঙ্গে চলে গেল সে।
‘তিনশো ডলার দেয়ার কথা ছিল আপনাকে।’ হিপ-পকেটের পেট মোটা মানিব্যাগ থেকে এক তাড়া নোট বের করল সে, তিনশো ডলারের বেশিই হবে, টাকাটা টেবিলের ওপর দিয়ে ঠেলে দিল ক্লার্কের দিকে। ‘আপনাকে অ্যাডভান্স দিলাম পুরোটাই। অতিরিক্ত আরও পঞ্চাশ ডলার রাখুন। আশা করি আমাকে স্পেশাল কিছু জিনিস দেখানোর ব্যবস্থা করতে পারবেন।’
টাকাটা নিয়ে উঠে দাঁড়াল রিচার্ড ক্লার্ক, সিদ্ধান্ত নিল ‘স্পেশাল’ কিছু জিনিস আমেরিকানটাকে দেখাবে সে। হ্যারিসন বিশেষ কিছু দেখার অধিকার রাখে। এমন কিছু যা সারা জীবন মনে থাকবে।
পরদিন সকালে একটা গাড়ি ভাড়া করে ক্লার্ক গুড উড হোটেলে চলে এল। হ্যারিসন যে জিনিস দেখতে চেয়েছে তার ব্যবস্থা সে করে এসেছে। গত রাতে, ক্লার্ক হোটেল থেকে চলে আসার পরে, হ্যারিসন নিজেই একটা ট্যাক্সি নিয়ে রাতের শহরে বেরিয়ে পড়ে এবং এক প্রমোদবালাকে ভাড়া করে। লোকে চীনাদের সম্পর্কে যে গল্প বলে তা আদৌ সত্যি নয়, এই ব্যাপারটি হ্যারিসন আবিষ্কার করে ঠিকই, তবে যে জিনিসটি ওকে সবচেয়ে অবাক করেছে তা হলো, মাত্র বিশ ডলারে সে মানসিক প্রশান্তি খুঁজে পেয়েছে মেয়েটির কাছ থেকে। তার রাতের অভিযানের গল্প শুনে ক্লার্ক মৃদু হাসল শুধু, মন্তব্য করার প্রয়োজন বোধ করল না। তার মন পড়ে আছে অন্য জায়গায়। সে হ্যারিসনকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল।
সকালের বেশিরভাগ সময় কেটে গেল থাইপুসাম উৎসব দেখে। বলাই বাহুল্য, এই সময়ে এক মুহূর্তের জন্যেও হ্যারিসনের ক্যামেরা থেমে থাকেনি। উৎসাহ নিয়ে ছবি তুললেও তার চেহারা দেখে ক্লার্ক বুঝতে পারছিল আমেরিকানটা উৎসব দেখে খুব একটা মজা পাচ্ছে না। অথচ ক্লার্কের নিজের এই উৎসবটি খুবই পছন্দ। যতবার সে থাইপুসাম উৎসব দেখেছে ততবার মুগ্ধ বিস্ময়ে ভেবেছে ধর্মবিশ্বাসী মানুষগুলো কি করে এমন শারীরিক যন্ত্রণা সহ্য করছে। ওদের প্রতি শ্রদ্ধা জেগেছে তার। এরকম মহান একটা ব্যাপার হ্যারিসন অবজ্ঞা করছে দেখে মনে মনে খুবই রুষ্ট হলো ক্লার্ক।
ওইদিন বিকেলে হ্যারিসনকে নিয়ে মাউন্ট ফেবারে উঠে দ্বীপ দেখাল ক্লার্ক, নিয়ে গেল টাইগার বাম গার্ডেনের ভৌতিক মূর্তিগুলোর কাছে, হাউস অভ জেড-এর নয়নাভিরাম সবুজ পৃথিবীও দেখাল। প্রতিটি জিনিস দেখানোর সময় সেগুলোর প্রাসঙ্গিক ইতিহাসও বর্ণনা করে চলল ক্লার্ক তার মক্কেলকে খুশি রাখতে।
রাতের বেলা রাগিস স্ট্রীটের একটি বার-এ ঢুকল ক্লার্ক হ্যারিসনকে নিয়ে। বসল কাঠের বেঞ্চিতে। এটা কুখ্যাত একটা জায়গা। দুনিয়ার মাতাল, চোর, বেশ্যা, ভিক্ষুক, পকেটমার, ফেরিঅলা আর বিকৃত রুচি লোকদের বাস এখানে। এখানে পয়সা দিয়ে পাপ কেনা যায়, যে কাউকে ইচ্ছে করলেই করা যায় শয্যাসঙ্গিনী। এই অন্ধকার জগতে দেখার মত অনেক কিছু আছে। হ্যারিসন বেশ আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে থাকল রঙ মাখা একজোড়া বিচিত্র প্রাণীর দিকে। ওরা একদল ব্রিটিশ নাবিকের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য অবিরাম চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল। ক্লার্ক ঝাড়া বিশ মিনিট কসরতের পরে হ্যারিসনকে বোঝাতে সমর্থ হলো যে ওই মেয়েদুটো আসলে পুরুষ। একথা শুনে ওদের ওপর থেকে চোখ ফিরিয়ে নিল হ্যারিসন।
‘আমি আপনাকে গ্যারান্টি দিয়ে দেখাতে পারি,’ ঠান্ডা বিয়ারের মগে চুমুক দিতে দিতে বলল ক্লার্ক, ‘এ জায়গার সবচেয়ে সুন্দরী মেয়েটিও আসলে পুরুষ।’
শুনে হ্যারিসনের সে কি হাসি! মদে ধরেছে ওকে। অতিরিক্ত মদ্য পানে অভ্যস্ত নয় সে। ঝোঁকের মাথায় তরুণ এক মালয়ীর সাথে জুয়ো খেলতে গিয়ে হেরে গেল। ক্লার্ক পাশে বসে রইল চুপচাপ। ফুরফুরে বাতাস বইছে। ম ম করছে মসলার ঘ্রাণ। নাক টানল ও। ভাল লাগে ক্লার্কের অতি সাধারণ এই জীবন যাত্রা। এখানে এলে ও যেন মানবতার গন্ধ খুঁজে পায়।
বেশ কিছুক্ষণ পরে আবার পুরানো প্রসঙ্গটা টেনে আনল ক্লার্ক। ‘আরও খানিকটা উত্তেজনার খোরাক পেতে চান?’ জিজ্ঞেস করল সে হ্যারিসনকে।
‘মানে?’ জড়ানো গলায় প্রশ্ন করল আমেরিকান। লাল টকটকে হয়ে উঠেছে মুখ, নেশায় ঢুলু ঢুলু চোখ। হাতে ধরা মদের পাত্রে চুমুক দিল। ‘নীল ছবি দেখাবেন না?’
‘না,’ জবাব দিল ক্লার্ক।
অনেক কষ্টে চোখ বিস্ফারিত করে তাকাল হ্যারিসন, হাসল। ‘অঃ, সেই বানরের মগজ খাওয়ার কথা বলছেন?’
‘হ্যাঁ। যদি আপনার দেখার ইচ্ছে হয়,’ বলল ক্লার্ক, দম বন্ধ করে রইল জবাবের অপেক্ষায়।
‘বেশ! কখন?’ জানতে চাইল হ্যারিসন।
‘যেতে চাইলে এখনই।
মিনিট দশেক পরে ওরা আলোকিত শহর পেছনে ফেলে যাত্রা শুরু করল অন্য আরেক জায়গার উদ্দেশে।
.
মেইন রোড ছেড়ে গাড়ি নেমে পড়ল এবড়োখেবড়ো এক রাস্তায়, দু’পাশে রাবার আর পাম গাছের সারি, মাঝখানে ঝাঁকি খেতে খেতে এগিয়ে চলল ওরা। নিকষ অন্ধকার চিরে দিচ্ছে হেডলাইটের আলো। মাঝে মাঝে সবুজ শস্য খেত দেখা গেল, গাড়ির সামনে দিয়ে দৌড়ে পালাল ত্রস্ত ইঁদুর। মেঠো পথ ধরে চলতে ভয়ানক ঝাঁকি লাগছে বলে স্পীড কমিয়ে দিয়েছে ক্লার্ক, কাছের ডোবা বা জলা থেকে ভেসে এল কোলা ব্যাঙের কোরাস। পেছনের সিটে দলা মোচড়া হয়ে পড়ে আছে হ্যারিসন। মেঘ গর্জনের মত নাক ডাকছে। গাড়ির ঝাঁকুনিতেও ঘুম ভাঙছে না। ক্লার্ক চোখের কোণ দিয়ে দেখতে পেল একটা বাদুড় উড়ে গেল পাশ দিয়ে, পান্না সবুজ রঙের একটা সাপ দ্রুত রাস্তা পার হলো।
মাইল দুয়েক রাস্তা ড্রাইভ করার পরে ক্লার্ক গাড়ি ঢোকাল ছোট্ট একটি গ্রামের ভেতরে। বেশ কিছু ছোট কুটির দিয়ে ঘেরা গ্রামটা। গাড়ি থেকে নামতে বুড়ো এক চীনা হাতে তেলের প্রদীপ নিয়ে ক্লার্কের দিকে এগিয়ে এল। প্রদীপটা উঁচু করে ধরল, আগন্তুককে চেনার চেষ্টা করছে। পরিচিত মানুষ দেখে তোবড়ানো গালে হাসির রেখা ফুটল। দপ দপ করে জ্বলছে প্রদীপ, তেল ফুরিয়ে এসেছে বোধহয়, বুড়োর লম্বা ছায়া পড়েছে মাটিতে, আলোতে ভৌতিক লাগছে চেহারাটা। বুড়োর হাসিতে উদ্ভাসিত মুখটা যেন একটা গুহা, সাকুল্যে একটা মাত্র দাঁত দেখা যাচ্ছে। সোনা দিয়ে বাঁধানো, বাকি সব শূন্য। লম্বা, কালো, বিনুনি করা চুল ঝুলছে থুতনির কাছে। অসংখ্য ভাঁজ আর রেখায় ভর্তি মুখটা চাষ করা জমির কথা মনে করিয়ে দিল, কোটরে ঢোকা কালো চোখ জোড়া ফাঁকা লাগছে। তবে সে যখন ঝুঁকে এসে গাড়িতে বাঁকা হয়ে শুয়ে থাকা হ্যারিসনকে দেখতে পেল, নিস্তে জ দৃষ্টিতে ঝিলিক দিল আলো।
‘বেশ, বেশ, মি. ক্লার্ক। আপনি আমাদের জন্যে একজন দর্শনার্থী নিয়ে এসেছেন!’
বুড়োর খনখনে কণ্ঠ শুনে বা অন্য যে কোন কারণে হোক, ঘুম ভেঙে গেল হ্যারিসনের। আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসল সে, মাথা ঝাঁকাচ্ছে, ঝিমঝিম ভাবটা কাটছে না কিছুতেই। অনেক কসরত করে গাড়ির দরজা খুলে পা রাখল মাটিতে, সিধে হতেও রীতিমত হিমশিম খেতে হলো। শেষে খোলা দরজার সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকল কোনমতে।
‘আসল জায়গায় এসে পড়েছি নাকি?’ আধ বোজা চোখে একবার চারপাশে দেখল হ্যারিসন, গলা থেকে কোলা ব্যাঙের ডাক বেরিয়েছে।
‘হ্যাঁ,’ জবাব দিল ক্লার্ক। ‘লিম চং আপনাকে ভেতরে নিয়ে যাবে। আমি এখানে আছি। ওসব জিনিস আগেও দেখেছি। আর দেখতে চাই না। ‘
বিড়বিড় করে কি বলল হ্যারিসন বোঝা গেল না, বুড়ো চাইনিজকে অনুসরণ করল। কাছের একটা কুটিরের দিকে হাঁটছে লিম চং, তার সাথে তাল মিলিয়ে চলতে খুবই কষ্ট হচ্ছে হ্যারিসনের। ঘরের ভেতর সে ঢুকতেও পারল না, তার আগেই মেঝের ওপর পড়ে গেল জ্ঞান হারিয়ে।
জ্ঞান ফিরে পাবার পরে ওয়েন হ্যারিসন প্রথমেই নিজেকে ধিক্কার দিল কেন বোকার মত সে স্থানীয় চোলাই মদকে পাত্তা দিতে চায়নি। এগুলোর সাংঘাতিক তেজ বোঝাই যাচ্ছে। হ্যাংওভার কাটেনি এখনও। তালুটা ফেটে যেতে চাইছে। সে একটা হাত তুলে কপালটা চেপে ধরতে চাইল, পারল না। অজানা একটা ভয়ে গায়ে কাঁটা দিল। ভয়টাকে দূর করতে হ্যারিসন ভাবতে লাগল সে কোথায় এসেছে। মাথাটা কাজ করছে না ঠিকমত, আর চোখেও ভাল দেখতে পাচ্ছে না। অন্ধকারে ডুবে আছে ও, নিজের হাত-পা- ও ঠাহর হচ্ছে না। দোরগোড়ায় একটা মাটির প্রদীপ জ্বলছে বটে কিন্তু ওটার আয়ু প্রায় শেষ। কারণ একেবারে মিটমিটে আলো। হঠাৎ বুকের ভেতর হৃৎপিন্ডটা লাফ দিয়ে উঠল হ্যারিসনের প্রদীপটাকে ওর দিকে এগিয়ে আসতে দেখে। কেউ একজন প্রদীপটা হাতে তুলে নিয়েছে, যদিও দেখা যাচ্ছে না তাকে। অবশ্য একটু পরেই লোকটাকে দেখা গেল আলোটা উজ্জ্বল হয়ে উঠতে। তেল দেয়া হয়েছে প্রদীপে। সেই বুড়ো লিম চং। বুড়ো সলতেটা উস্কে দিল, লাফিয়ে উঠল আগুন, হঠাৎ আলোর ঝলকানিতে চোখ কুঁচকে গেল হ্যারিসনের।
‘এসব হচ্ছেটা কি?’ চেঁচিয়ে উঠল ও। ‘ক্লার্ক কোথায়?
লিম চং প্রদীপটাকে কাঠের একটা পায়ার ওপর রেখে দিল, তারপর এগিয়ে গেল হ্যারিসনের দিকে।
‘মি. ক্লার্ক কাছে পিঠেই আছেন,’ বলল সে নরম গলায়।
বুড়োর মুখ থেকে বিকট গন্ধ আসছে, মুখ ঘুরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করল হ্যারিসন। পারল না। পরমুহূর্তে নিজের অবস্থান সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠল ও। সাথে সাথে জমে গেল আতঙ্কে। ওকে ভারী একটা কাঠের চেয়ারের সাথে বেঁধে রাখা হয়েছে, মাথাটা ঢোকানো হয়েছে কাঠেরই তৈরি সাঁড়াশির মত একটা যন্ত্রের ভেতরে। যন্ত্রটা এমনভাবে ওর মাথা চেপে আছে, ডানে বা বাঁয়ে ফিরে তাকানোর উপায় নেই। একটা ঘোরের ভেতর এতক্ষণ ছিল বলে হ্যারিসন বুঝতে পারেনি আসলে সে কাঠের চেয়ারটাতে বন্দী হয়ে আছে। কিন্তু কেন? কারণটা বুঝতে না পারলেও অজানা সেই ভয়টা আবার ফিরে এল ওর মাঝে।
‘তোমরা কি চাও আমার কাছে? টাকা? তাহলে যা আছে নিয়ে নাও। দয়া করে এই অবস্থা থেকে মুক্ত করে দাও!’ চিৎকার করে উঠল হ্যারিসন, তবে কাজ হলো না কোন।
লিম চং ঘুরে ওর পেছনে চলে এল, মুখ খুলতে সেই পচা গন্ধটা নাকে ধাক্কা মারল হ্যারিসনের।
‘না, স্যার। আপনার টাকার দরকার নেই আমাদের।’
একটু পরেই ব্যথায় আর্তনাদ করে উঠল হ্যারিসন। বুড়ো ক্ষুরের মত ধারাল কিছু একটা জিনিস বসিয়ে দিয়েছে ওর কপালের পাশে, হেয়ার লাইনের ঠিক নিচে। পাগলের মত ধস্তাধস্তি করল ও, লাভ হলো না কিছুই। বাঁধন ছিঁড়ল না। সাহায্যের আশায় চিৎকার করে ক্লার্ককে ডাকল সে, কিন্তু কেউ ওর সাহায্যের জন্যে এগিয়ে এল না। তবু গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে যাচ্ছে হ্যারিসন।
ব্যথাটা অসহ্য। কোন কিছুর সাথে তুলনা দেয়া যায় না। হ্যারিসন টের পেল তার খুলি থেকে মাংসসহ চুল কেটে নেয়া হচ্ছে, ঘাড় এবং মুখ বেয়ে গরম রক্ত নামতে লাগল, চোখে আঠালো ধারাটা পড়তে আচ্ছন্ন হয়ে এল দৃষ্টি, লালচে কুয়াশার একটা আবরণ সৃষ্টি হলো সামনে। গলার সমস্ত রগ ফুলে উঠল হ্যারিসনের চিৎকার দিতে গিয়ে, বুকের ভেতরে হৃৎপিন্ডটা পাঁজরের গায়ে দমাদম বাড়ি খাচ্ছে। ভীষণ আতঙ্ক ওকে প্রায় অবশ করে দিল। শরীরের সমস্ত শক্তি নিঃশেষ হয়ে গেছে যেন প্রতিবাদ করেও লাভ হবে না জেনে। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে হ্যারিসনের। এখন আর চিৎকার করছে না, গোঁঙাচ্ছে অস্ফুটে আর ওকে দয়া করতে বলছে। শেষের দিকে কর্কশ, ফোঁপানোর মত আওয়াজ বের হতে লাগল গলা থেকে। শিশুর মত কাঁদতে শুরু করল হ্যারিসন, লবণাক্ত জলের সাথে রক্ত ঢুকে গেল মুখে।
উখা বা করাত ঘষার খরখরে শব্দ শুনতে পেল হ্যারিসন হঠাৎ। লিম চং জিনিসটা দিয়ে ওর খুলি কাটতে শুরু করেছে। প্রচন্ড ভয়ে কেঁপে উঠল হ্যারিসন, বিস্ফারিত চোখে দেখল ওর খুলির ছোট ছোট সাদা হাড় মেঝের ওপর ছিটকে পড়ছে।
গোঙাতে গোঙাতে চোখ তুলে চাইল হ্যারিসন। ওর সামনে হলদে রঙের ভৌতিক কয়েকটা মুখ, প্রদীপের কাঁপা আলোতে দেখা গেল শয়তানী হাসি সব ক’টার ঠোঁটে। ওদের ভেতরে রিচার্ড ক্লার্কও আছে। ‘কেমন জব্দ!’ নিঃশব্দে হেসে যেন বলছে ও। হ্যারিসন দেখল উপস্থিত দর্শকদের সবাই সাগ্রহে থাবার মত হাত বাড়িয়ে দিয়েছে তার খুলি লক্ষ্য করে। পরক্ষণে মাথায় ভয়ঙ্কর একটা ব্যথার অনুভূতি ওর সারা শরীরে আগুন ধরিয়ে দিল। কয়েক সেকেন্ডের জন্য আঁধার হয়ে এল দুনিয়া, শেষ মুহূর্তে, বহু কষ্টে চোখ মেলে তাকাল হ্যারিসন। দেখল ওদের দু’জন রক্ত মাখা, স্পঞ্জের মত ধূসর একটা জিনিস মুখে পুরে কচমচ করে চিবুচ্ছে। তার পরপরই নিঃসীম আঁধার আবার গ্রাস করল হ্যারিসনকে।
ধীরে সুস্থে গাড়ি চালিয়ে নিজের বাংলোয় ফিরে এল রিচাড ক্লার্ক। এখন ভাল করেই জানে এই জীবনে আর ইংল্যান্ডে ফেরা হবে না তার। অবশ্য তাতে অসুবিধে নেই কোন। গাইডের ব্যবসাটা ভালই জমে উঠেছে, আর প্রাচ্যের রহস্যময়তা তাকে এমন মুগ্ধতায় আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে যে এখান থেকে কোথাও যাবার ইচ্ছেও তার নেই।