দ্য থারটিনথ ফ্লোর – ডন উলফসন

দ্য থারটিনথ ফ্লোর – ডন উলফসন

তেরো বছরের নরমান ওয়েরমের আতঙ্কে সিঁটিয়ে রয়েছে। ঢোলা সুট পরনে তার, এ নিয়ে অস্বস্তিও কম নয়। মা আর ছোট বোনকে নিয়ে ট্যাক্সির পেছনের আসনে মুখ শুকনো করে বসে আছে সে। ট্যাক্সি ছুটে চলেছে অসংখ্য গাড়ির মাঝ দিয়ে। ড্রাইভারের পাশে বসেছেন ওর বাবা।

‘এবারের ছুটিটা বেশ মজার কাটবে,’ ঘাড় ঘুরিয়ে বললেন বাবা। নরমান কোন মন্তব্য করল না। সে জানে বাবা ভুল বলেছেন। তার ধারণা ভয়ানক কিছু একটা ঘটতে চলেছে। আজ শুক্রবারের ১৩ তারিখ। ক্যাব ছুটছে ম্যাসাচুসেটসের বোস্টন শহরের ১৩ নম্বর রাস্তা দিয়ে। এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ১৩ নম্বর রাজ্য। ঘড়ি দেখল নরমান। প্রায় একটা বাজে। মিলিটারি সময় ১৩০০ ঘণ্টা।

১৩! নরমানের মস্তিষ্কে যেন গরম লোহার ছ্যাঁকা লাগল সংখ্যাটা মনে করে। পকেট থেকে খরগোশের পা বের করে হাতের তালুতে ঘষতে লাগল সে।

‘ভাইয়া, আবার সেই জঘন্য জিনিসটা সঙ্গে করে নিয়ে এসেছ!’ বলল ছোট বোন পলা। ‘তোমার যে কী কুসংস্কার!’

‘কীসের কুসংস্কার!’ ধমক দিল নরমান। ‘তোরা কেউ বুঝতে পারছিস না কী ঘটতে চলেছে? আমাদের সামনে ভয়ানক কোন বিপদ ওঁৎ পেতে আছে,পৈশাচিক কিছু। সোজা ওটার ফাঁদে গিয়ে পড়ব।’

ওর বাবা ঘাড় ঘুরিয়ে কটমট করে তাকালেন ছেলের দিকে। ‘নরমান, ফাজলামো অনেক হয়েছে। আর না। ফালতু কুসংস্কার ছাড় তো। ১৩ সংখ্যাটা নিয়ে এত লাফালাফি করিস কেন? আমরা মজা করতে যাচ্ছি এসব কুসংস্কার বাদ দে। নইলে নিজের মজা মাটি তো করবিই, আমাদেরটাও। বোঝা গেছে?’

নরমান চুপচাপ বসে রইল। কোন মন্তব্য করল না। তর্ক করে লাভ কী? গম্ভীর মুখে ভাবছে সে। এরা আমার কথা শুনতেই চাইবে না। বুঝবেও না।

‘হোটেল আর কদ্দূর?’ বাবা জিজ্ঞেস করলেন ড্রাইভারকে।

‘এই তো সামনে, স্যার,’ জবাব দিল ড্রাইভার।

নীরবতা নেমে এল গাড়িতে,আরও তেরোটি ব্লক পার হচ্ছে যান্ত্রিক বাহন। এক, দুই করে গুনছে নরমান।

অবশেষে উইলমন্ট রিজেন্সি হোটেলের সামনে গাড়ি থামাল ড্রাইভার, সাথে সাথে কেমন অদ্ভুত একটা অনুভূতি হলো নরমানের। লবি ধরে হাঁটছে ওরা, অনুভূতিটা জোরাল হয়ে উঠল তার মাঝে

‘আমি আগেও এখানে এসেছি,’ বলল সে।

‘কী বকবক করছিস, নরমান,’ বাবা মৃদু ধমক দিলেন। ‘তুই এর আগে জীবনেও বোস্টনে পা দিসনি।’

নরমান তাকাল চারপাশে। ‘কিন্তু সবকিছু এত পরিচিত লাগছে!’

পলা চোখ ঘুরিয়ে বলল, ‘তুমি সত্যি একটা অদ্ভুত ভাই!’

‘প্লিজ, নরমান,’ অনুনয় মা’র গলায়। ‘আবার শুরু করিস না।’

‘তোর ফালতু প্যাচাল শুনে শুনে আমি ক্লান্ত,’ থমথমে গলায় বললেন বাবা। ‘এখন একটু ক্ষ্যামা দে, নাকি?’ স্পষ্ট বিরক্তি তাঁর চেহারায়, এগিয়ে গেলেন রেজিস্ট্রেশন ডেস্কে। ওখানে তাল গাছের মত লম্বা এক মহিলা, বড় বড় কুচকুচে কালো চোখ, ওদেরকে অভ্যর্থনা জানাল।

মনের মধ্যে রাগ পুষে, কালো মুখ নিয়ে লবিতে ঘুরে বেড়াতে লাগল নরমান। ওর মা আর বোন বাবার সঙ্গে রিসেপশন ডেস্কে। নরমান নিশ্চিত এ হোটেলে সে আগেও এসেছে। ফুল আঁকা গোলাপি সবুজ কার্পেট, নতুন দেখতে গোলাপরঙা সোফা, সুসজ্জিত স্ফটিকের ঝাড়বাতি, এ সবই ও আগে দেখেছে…কিন্তু কবে বা কখন?

হঠাৎ অদ্ভুত, ঘররর একটা শব্দ শুনতে পেল নরমান। পাঁই করে ঘুরল, হোটেল এলিভেটর থেকে আওয়াজটা আসছে।

আগেকার মডেলের রেপ্লিকা বা নকল। এ এলিভেটর অবশ্যই আগে কখনও দেখেছে নরমান।

পুরানো যন্ত্রটার দিকে হেঁটে গেল সে। খাঁচার মত গরাদ দেয়া জিনিসটার মাঝ দিয়ে এলিভেটরের দিকে তাকাল। অন্ধকার, আয়তাকার একটা গর্ত, তাতে মোটা মোটা বিদ্যুতের তার ঝুলছে। এক লোকের মাথা দেখতে পেল নরমান, তারপর পুরো শরীরটা। এলিভেটর নিয়ে উঠে এল সে। খাঁচার মধ্যে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘উপরে যাবে?’

এ লোক নিশ্চয়ই এলিভেটর অপারেটর। গেটের মত দেখতে চকচকে দরজা খুলল সে। এলিভেটরের মেঝেতে সবুজ কার্পেট, দেয়ালে আয়না।

‘না,’ পিছিয়ে এল নরমান। অপারেটরের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। লোকটা বেঁটেখাটো, মাথা ভর্তি লাল চুল, থুতনিতে মস্ত আঁচিল।

‘কী হয়েছে?’ জিজ্ঞেস করল লোকটা।

নরমান লোকটার উপর থেকে চোখ ফিরিয়ে নিতে পারছে না। একে কোথাও দেখেছে সে। কিন্তু কোথায়?

‘আ, আমি বোতামে চাপ দিইনি,’ বিব্রত গলায় বলল নরমান। ‘এলিভেটরে ওঠার কোন ইচ্ছেও আমার নেই।’

বেঁটে লোকটা কাঁধ ঝাঁকাল শুধু, কিছু বলল না। নরমান দ্রুত ফিরে এল বাবা-মা আর পলার কাছে। এক বেল বয় একটি কার্টে ওদের মাল তুলছে। বেল বয়টিকে প্রথমে বাচ্চা ছেলে ভেবেছিল নরমান। লক্ষ করতে বুঝল এ বামন। মস্ত বড় মাথাটা ক্ষুদ্র শরীরের সাথে একেবারেই বেমানান।

‘মা,’ মাকে এক পাশে টেনে নিয়ে ফিসফিস করল নরমান। আমি এখানে থাকতে চাই না। আমার কেমন ভয় লাগছে।’

‘কেন! হোটেলটা তো খুবই সুন্দর!’ চেঁচিয়ে উঠলেন মা, দ্রুএকবার চোখ বুলিয়ে নিলেন চারপাশে।

ওর বাবা পেছন পেছন চলে এসেছেন। ‘আবার কী হলো?’

‘ঠিক বোঝাতে পারব না,’ শুরু করল নরমান, ‘তবে কোথাও একটা ভজকট আছে।’

‘কী?’ অধৈর্য গলা বাবার।

‘জানি না। তবে কিছু একটা ঘটবে মনে হচ্ছে। অদ্ভুত কিছু।’

হেসে উঠল পলা। ‘তুমি নিজেই তো অদ্ভুত।’

‘কোন অদ্ভুত ঘটনাই ঘটবে না,’ বললেন বাবা। ‘এসব নিয়ে কথা বলতে তোকে মানা করলাম না!’

নরমান উত্তেজিত হয়ে কিছু বলতে যাচ্ছিল, থেমে গেল কাঁধে মায়ের হাতের স্পর্শ পেয়ে। ‘শান্ত হ, বাপ,’ বললেন তিনি। ‘মাথা থেকে আজে বাজে চিন্তাগুলো ঝেড়ে ফেলে দে। অন্তত আমার জন্যে এটুকু করবি না?’ কথাটা শেষ করেই বেল বয়ের পেছনে হাঁটা দিলেন মা। সে ওদের ঘর দেখিয়ে দেবে।

‘কেউ আমার কথা শুনতে চায় না,’ বিড়বিড় করল নরমান। এলিভেটরের দিকে পা বাড়াল সে পরিবারের পেছন পেছন।

‘কোন্ ফ্লোর?’ নিরাসক্ত গলায় জানতে চাইল অপারেটর।

‘রূম নাম্বার ১৩০২,’ হাতের চাবি দেখে বললেন বাবা।

‘ওহ্, দারুণ!’ লাফিয়ে উঠল পলা, চোখ টিপল ভাইকে। ‘তেরো নম্বর ফ্লোর!’

‘সর্বনাশ!’ আঁতকে উঠল নরমান, ঝট্ করে নেমে পড়ল এলিভেটর থেকে। ‘আমি এ হোটেলে থাকব না। তেরো নম্বর ফ্লোরে তো নয়ই!’

‘ফিরে আয় বলছি!’ শাসালেন মা।

‘প্রশ্নই ওঠে না,’ খেঁকিয়ে উঠল নরমান। নিতম্বে হাত, চেহারায় বেপরোয়া ভাব।

অপারেটরকে অপেক্ষা করতে বলে এলিভেটর থেকে নেমে এলেন বাবা, নরমানের সামনে এসে বললেন, ‘অনেক হয়েছে, নরমান। ফাজলামো রাখ।’

‘আমি ফাজলামো করছি না,’ দৃঢ় গলা নরমানের

প্রচন্ড রাগে মুহূর্তের জন্য কথার খেই হারিয়ে ফেললেন বাবা। নিজেকে সামলে নিয়ে গোলাপরঙা সোফার দিকে আঙুল তুলে হিম গলায় বললেন, ‘আমরা আমাদের ঘরে যাচ্ছি। আর তুই এ সব ফাজলামো বাদ না দেয়া পর্যন্ত ওখানেই থাকবি।’

নরমান চেঁচিয়ে উঠল, ‘আমি কি বাচ্চা ছেলে নাকি যে যা বলবে তা-ই শুনতে হবে।’

‘তুই বাচ্চা ছেলেরও অধম,’ বললেন বাবা। ‘দুগ্ধপোষ্য শিশুর মত আচরণ করছিস।’

‘না, করছি না। আমি অনেক বড় হয়ে গেছি। তুমি আমাকে বাচ্চা ভাবলেও আমার কিছু আসে যায় না।’

বাবা ঝাড়া কয়েক সেকেন্ড আগুন চোখে তাকিয়ে রইলেন ছেলের দিকে। কষে চড় মারার ইচ্ছেটা দমন করলেন বহু কষ্টে। এলিভেটরে ফিরে গেলেন তিনি। ‘উপরে যান,’ বললেন অপারেটরকে। কটমট করে তাকালেন ছেলের দিকে। ‘তোকে কয়েক মিনিটের মধ্যে উপরে দেখতে চাই।’

‘কিন্তু আমি তোমার চেহারা আর কখনও দেখতে চাই না,’ তারস্বরে চেঁচাল নরমান। ‘তোমাদের কাউকে না!

‘যা বলবে ভেবে চিন্তে বোলো, খোকা,’ একটা লিভার ধরে টান দিল অপারেটর। ‘অনেক সময় বেমক্কা কথাও ফলে যায়।’

‘ফলে গেলেই ভাল!’ একই জোরে চেঁচাল নরমান। রাগে জ্বলছে শরীর।

চকচকে দরজাটা শব্দ করে বন্ধ হয়ে গেল। তারপর একটা গুঞ্জন উঠল, নরমান দেখল তার পরিবারকে নিয়ে উপরে রওনা হয়েছে এলিভেটর। এক মুহূর্ত পরে অদৃশ্য হয়ে গেল।

.

অনেকক্ষণ লবিতে দাঁড়িয়ে রইল নরমান, প্রতি মিনিটে বাড়ছে ক্রোধ। শেষে রাগ সামলাতে না পেরে ঝড়ের বেগে হোটেল থেকে বেরিয়ে এল সে দাঁতে দাঁত ঘষতে ঘষতে। অচেনা শহরে একা একা ঘুরতে লাগল। মূর্তি বোঝাই একটি পার্কের বেঞ্চিতে বসে রইল কিছুক্ষণ, তারপর হাঁটা দিল বাইক চলা একটি পথ ধরে। হাঁটতে হাঁটতে একটা গোরস্তানের সামনে চলে এল। নিজেকে ভীষণ একা, রদ্দি আর বাতিল মাল মনে হচ্ছে, যেন বাবা ওকে ত্যাজ্যপুত্র ঘোষণা করেছেন।

গোরস্তানের পাশের ফুটপাথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে নরমান ভাবতে লাগল কিছুক্ষণ আগে কী রকম ব্যবহার করে এসেছে সে তার পরিবারের সঙ্গে। আস্তে আস্তে ঠান্ডা হতে লাগল মাথা। সবার সঙ্গে সে যাচ্ছে তাই আচরণ করেছে! দোষ সম্পূর্ণ ওরই। সাধে কি আর ওর বন্ধুরা ওকে ‘রগচটা, অদ্ভুত ভাবুক’ বলে ডাকে। বন্ধুরাও জানে কুসংস্কারে সাংঘাতিক বিশ্বাস তার। কিন্তু কী করবে নরমান? কীভাবে সে তার বাবা-মাকে বোঝাবে এক অদ্ভুত, অশুভ শক্তি ক্রমে ওকে গ্রাস করে ফেলছে?

আগে কখনও কুসংস্কার নিয়ে মাথা ঘামাত না নরমান। এখন সে কালো বেড়াল ভয় পায়, মইয়ের নিচে দিয়ে কক্ষনো হাঁটে না, বিশেষ করে ১৩ সংখ্যাটির প্রতি তার ভয়ানক ভয়। এই যে সে ফুটপাথ ধরে হাঁটছে, সতর্ক নজর রয়েছে যাতে কোন ফাটল বা গর্তে পা না পড়ে। এটাও এক ধরনের কুসংস্কার।

নরমান জানে অবশেষে তাকে হোটেলেই ফিরতে হবে, সে ওদিকে পা বাড়াল। তবে এখুনি হোটেলে ঢোকার ইচ্ছে তার নেই। জায়গাটাকে সে শুধু ভয় পায় বলে নয়, এখনও রাগটা পড়েনি যে! মাত্র আড়াইটা বাজে। এত তাড়াতাড়ি হোটেলে গেলে ব্যাপারটা ওর জন্য অস্বস্তিকর হয়ে উঠবে।

কিন্তু কী করবে নরমান? সময় কাটাবে কীভাবে? রাস্তার ওপারে একটা সিনেমা হল-এ আটকে গেল চোখ। সিনেমা দেখে সময় কাটানো যায় পা চালিয়ে রাস্তা পার হলো নরমান। টিকেট কিনে ঢুকে পড়ল অন্ধকার প্ৰেক্ষাগৃহে।

ছবির টাইটেল দেখানো শুরু হয়ে গেছে। ছবির নাম ‘কলিশন কোর্স’। নাম দেখে মনে হলো প্রচুর অ্যাকশন আছে। কিন্তু একটা খামার বাড়ির কে দখল নেবে তা নিয়ে এক লোক আর এক মহিলার বিরক্তিকর দ্বন্দ্বের নিয়ে ছবি। তবে অদ্ভুত ব্যাপার হলো ছবি চলার সময় নরমানের মনে হতে লাগল এ ছবি আগেও দেখেছে সে অনেক আগে, তবে কবে, কোথায় মনে করতে পারল না। রদ্দি মার্কা সিনেমা আর ভ্রমণের ক্লান্তি ঘুম এনে দিল নরমানের চোখে। ঘুমিয়ে পড়ল সে।

.

সিনেমা হল থেকে বেরিয়ে এসে নরমান দেখে রাত নেমেছে। বাবা-মা ওকে এত দেরিতে ফিরতে দেখলে নিশ্চয়ই রেগে যাবেন, ভাবল নরমান। দ্রুত পা চালাল হোটেল অভিমুখে। চোখে ঝাপসা দেখছে সে, হাড় আর জয়েন্টগুলো আড়ষ্ট ও ব্যথা করছে, এক ঝলক শীতল বাতাস ঝাপটা মেরে ঢুকে পড়ল ওর বিশ্রী সুটের মধ্যে। এ জিনিস বাবা-মা ওকে বানিয়ে দিয়েছেন প্লেনে পরে আসার জন্য। তবে ঢোলা সুটটা কোন কারণে এখন টাইট লাগছে, কলারটাও।

আশ্চর্য! ভাবল নরমান। এ পোশাক তো আমার গায়ে ঢিলে হত।

হিম বাতাসে কাঁপতে কাঁপতে হোটেলে ঢুকে পড়ল সে। দূর থেকে ব্যাপারটা লক্ষ করেনি নরমান, কিন্তু লবিতে ঢুকেই পার্থক্যটা চোখে পড়ল। অবাক হয়ে দেখল জায়গাটা বদলে গেছে। সব কিছুর যেন বয়স বেড়ে গেছে, গোরস্তানের বাসী একটা গন্ধ ভাসছে বাতাসে।

এক মুহূর্তের জন্য ভাবল নরমান ভুল কোন হোটেলে চলে এসেছে ও, পরক্ষণে চোখে পড়ল রেজিস্ট্রেশন ডেস্কের উপরে, দেয়ালে ঝোলানো ম্লান সোনালি-বাদামি অক্ষরের প্ল্যাকার্ড : উইলমন্ট রিজেন্সি।

চারপাশে চোখ বুলাল নরমান। গোলাপি-সবুজ রঙের ফুল আঁকা কার্পেট ঠিকই আছে, তবে আগের চেয়ে বিবর্ণ লাগছে দু’এক জায়গায়, ছিঁড়ে সুতো বেরিয়ে গেছে। গোলাপ রঙের সোফা, আগে যা মনে হয়েছে ঝাঁ চকচকে, দেখাচ্ছে জীর্ণ, ডেলার মত, লবির মাঝখানের বড় ক্রিস্টালের ঝাড়বাতিটি জ্বললেও গায়ে ধুলো জমে থাকার দরুন আলো প্রায় দেখাই যাচ্ছে না।

হঠাৎ নরমান গোঙানির মত ঘররর একটা আওয়াজ শুনল। ঘুরল। হোটেল এলিভেটর থেকে শব্দটা আসছে। ওদিকে ছুটল সে, উপরে গিয়ে মিলিত হবে পরিবারের সঙ্গে। কিন্তু ছোটার গতি মন্থর হয়ে গেল প্যান্টের জন্য। বিচিত্র কোন কারণে তার প্যান্ট এত ছোট হয়ে গেছে, জোরে দৌড়ালে ফট্ করে ছিঁড়ে যেতে পারে।

এলিভেটর এসে পৌঁছুল। নরমান বিকট দর্শন, বয়সের ভারে ক্ষয়ে যাওয়া গরাদের গেট পার হয়ে ভিতরে ঢুকল।

‘উপরে যাবেন?’ জিজ্ঞেস করল অপারেটর নিরাসক্ত গলায়।

নরমানের ইচ্ছে করল গলা ফাটিয়ে চিৎকার দেয়। এ সেই আগের অপারেটর, তবে এ মুহূর্তে অনেক বুড়োটে লাগছে, গালে আর কপালে ভাঁজটাজ পড়ে গেছে, মাথার চুলও পাতলা দেখাচ্ছে, থুতনির আঁচিলটা যেন আকারে আরও বড় হয়েছে। লোকটা লম্বা, হলুদ দাঁত বের করে হাসল, ‘কী হয়েছে?’

নরমান ফাঁকা দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল তার দিকে, মুখে রা নেই।

‘কোন্ ফ্লোর?’ জানতে চাইল লোকটা।

‘তে-তেরো,’ অবশেষে বিড়বিড় করে বলল নরমান।

লোকটা অদ্ভুত ভঙ্গিতে তাকাল নরমানের দিকে। ‘এখানে তেরো নম্বর ফ্লোর নেই।’

‘অ্যা?’ হতভম্ব দেখাল নরমানকে। ‘কী বললেন?’

‘বললাম এখানে তেরো নম্বর ফ্লোর নেই,’ পুনরাবৃত্তি করল লোকটা হিম গলায়।

ঢোক গিলল নরমান। ‘এসব ঘটছে কী এখানে?’ জিজ্ঞেস করল সে, টের পেল শিরদাঁড়া বেয়ে বরফ শীতল জল নামছে। ‘আমার সঙ্গে ইয়ার্কি হচ্ছে?’

‘উপরে যাবেন কি যাবেন না?’ প্রশ্ন করল বুড়ো, ভাবলেশহীন চেহারা।

পিছিয়ে এল নরমান, পা চালিয়ে চলে এল রেজিস্ট্রেশন ডেস্কে। ধাতব হ্যান্ড বেল ক্রমাগত বাজানোর পরে তাল গাছের মত লম্বা এক মহিলা বেরিয়ে এল ব্যাক রূম থেকে।

এ সেই মহিলা, বড় বড় কালো চোখ। তবে এরও বয়স বেড়ে গেছে, নুয়ে পড়েছে কাঁধ।

‘কোন সাহায্য করতে পারি?’ কর্কশ গলায় জিজ্ঞেস করল সে।

নরমান জানাল অপারেটর তাকে বলেছে এ হোটেলে নাকি তেরো নম্বর ফ্লোর বলে কিছু নেই।

মাথা ঝাঁকাল মহিলা। ‘ঠিকই বলেছে সে। উইলমন্ট রিজেন্সিতে তেরো নম্বর ফ্লোর ছিল, তবে অগ্নিকান্ডের ঘটনার পরে লোকে কুসংস্কারাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। তেরো নম্বর ফ্লোর তারপর বাদ দেয়া হয়েছে। ‘

‘কী-কীসের অগ্নিকান্ড?’ কথা জড়িয়ে গেল নরমানের।

‘বেশ কয়েক বছর আগে তেরো নম্বর ফ্লোরে আগুন লেগে যায়। সে এক ভয়াবহ কান্ড! মেরামতের পরে নাম্বার পাল্টে ফেলা হয়।’ কাঁধ ঝাঁকাল মহিলা। ‘এ স্রেফ কুসংস্কার ছাড়া কিছু নয়, তবে নাম্বারগুলো এখন ১১… ১২…১৩’র বদলে ১১…১২…১৪। কাজেই, স্যার, আমার ধারণা, আপনি আসলে চোদ্দ নম্বর ফ্লোর খুঁজছেন যা আগে তেরো নম্বর ফ্লোর ছিল।’

‘আগুনে,’ জিজ্ঞেস করল নরমান, মনে মনে ভাবছে মহিলা তাকে ‘স্যার’ সম্বোধন করল কেন, ‘কেউ হতাহত হয়েছিল?’ মহিলার চেহারা বিষণ্ন দেখাল। ‘জ্বী, তিনজন মানুষ মারা যায়।’ এক মুহূর্ত বিরতি দিল। ‘কিন্তু সে তো অনেক আগের কথা।’

‘মারা যায়!’ চেঁচিয়ে উঠল নরমান। ‘আমার বাবা-মা ছিলেন ওই ফ্লোরে!’

‘আপনার কথা বুঝতে পারছি না, সার,’ বলল মহিলা। ‘আমি দুঃখিত যদি -’

কিন্তু মহিলার কথা কানে ঢোকেনি নরমানের। আতঙ্কিত ও হতভম্ব হয়ে সে রওনা দিয়েছে এলিভেটরের উদ্দেশে।

‘আমার পরিবার কোথায়?’ বুড়ো অপারেটরকে ধমকের সুরে প্রশ্ন করল সে।

খাঁচার ভিতরে লোকটা অদ্ভুত ভঙ্গিতে হাসল।

‘তুমি সব জানো, না?’ খেঁকিয়ে উঠল নরমান।

মাথা দোলাল লোকটা।

‘আমার পরিবারের কী করেছ তুমি?’

‘আমি কিছু করিনি,’ ঠান্ডা গলা লোকটার। ‘আপনি করেছেন।’

‘আমি করেছি মানে?’ গলা কেঁপে গেল নরমানের।

‘আপনাকে আগেই সাবধান করে দিয়েছিলাম,’ বলল বুড়ো। ‘কোন

কিছু চাইবার আগে ভেবেচিন্তে তা কামনা করতে হয়।’

‘ঠিক আছে, আমি এখন ১৩০২ নাম্বার রূমে যেতে চাইছি!’

‘মানে ১৪০২, স্যার,’ অপারেটর শুধরে দিল তাকে।

‘আমাকে স্রেফ উপরে নিয়ে চলো!’ হুকুম দিল নরমান।

‘আপনি যা বলেন, স্যার।’

‘আর স্যার স্যার করবে না,’ ঘেউ করে উঠল নরমান। ঢুকে পড়ল এলিভেটরে। আর তখন দেয়ালের আয়নায় নিজের প্রতিবিম্ব দেখতে পেল।

মাঝ-বয়েসী হয়ে গেছে সে!

ঝনঝন শব্দে গেট টেনে বন্ধ করল অপারেটর, টান দিল একটি লিভার ধরে, ক্যাচ কোঁচ শব্দ তুলে উপরে রওনা হয়ে গেল এলিভেটর। ঘেমে নেয়ে গেছে নরমান, দাগপড়া, ফাটা আয়নায় নিজের ভাঙা চোরা প্রতিবিম্ব থেকে চোখ সরাতে পারছে না। তারপর বহু কষ্টে ফ্লোর ইন্ডিকেটরের দিকে দৃষ্টি ফেরাল। বিস্ফারিত চোখে দেখল এক এক করে জ্বলে উঠছে সংখ্যাগুলো : ৯…১০…১১…১২…১৪!

মৃদু ঝাঁকি খেয়ে থেমে গেল এলিভেটর। ‘আপনার ফ্লোর, স্যার।’ বলল অপারেটর, মুখে অশুভ হাসি।

পুরানো হোটেলটির বিবর্ণ হলওয়েতে পা রাখল নরমান। চারদিকে অযত্নের ছাপ, বোঝা যায় অনেক আগে এখানে রিপেয়ারের কাজ চলেছে। সে দ্রুত ১৪০২ লেখা রূমের সামনে চলে এল। দমাদম ঘুসি মারতে লাগল দরজায়।

ক্যাআচ শব্দে খুলে গেল দরজা, বদমেজাজি চেহারার এক বুড়ি উঁকি দিল। ‘কে? কী চাই?’ খ্যাক করে উঠল সে।

‘আমি আমার বাবা-মাকে খুঁজছি,’ ব্যাকুল গলায় বলল নরমান ‘আমার বোন পলাকেও। ওরা সবাই এ ঘরে থাকত, তবে তা অনেক আগে। আমি ওদেরকে এখন কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না।

‘কেটে পড়ুন তো। যত্তসব যন্ত্রণা,’ ঘোঁত ঘোঁত করল মহিলা, নরমানের মুখের উপরে ঠাস করে বন্ধ করে দিল দরজা।

নরমান ছুটে এল এলিভেটরে। ‘আমার পরিবারের কী হয়েছে?’ কাঁদো কাঁদো গলা।

‘আগুনে পুড়ে মারা গেছে,’ জবাব দিল অপারেটর, শয়তানি হাসি মুখে।

‘আর আমি, আমার এরকম দশা হলো কী করে? আমি তো বাচ্চা একটা ছেলে ছিলাম, আর এখন—’

‘এখন আপনি বড় হয়ে গেছেন,’ মুখ বাঁকাল বুড়ো। ‘অন্তত এখন আর কেউ আপনাকে বাচ্চা ছেলে বলে অবহেলা করবে না।’

‘কিন্তু আমি তো বাচ্চা ছেলেই,’ বলল নরমান। ‘অন্তত ছিলাম।’

কাঁধ ঝাঁকাল বুড়ো। ‘আপনি যা কামনা করেছিলেন পেয়ে গেছেন! ভয়ঙ্কর খনখনে গলায় হেসে উঠল সে, একটা লিভার ধরে টান দিল।

ভীত নরমান দেখল এলিভেটর নিচে নামতে শুরু করেছে। ভিতরে, ময়দার তালের মত তেলতেলে বুড়োর মুখটা ক্রমে অদৃশ্য হয়ে যেতে লাগল, এলিভেটর নামছে, ভৌতিক, খনখনে হাসি হেসেই চলেছে লোকটা, তারপর নেই হয়ে গেল চোখের সামনে থেকে।

টলতে টলতে কয়েক পা পিছিয়ে এল নরমান। ‘মা! বাবা!’ বারবার চিৎকার করল ও একা হলওয়েতে দাঁড়িয়ে যা এক সময় উইলমন্ট রিজেন্সির তেরো নম্বর ফ্লোর ছিল। ওর চিৎকারে হলঘরের দু’পাশের কয়েকটি ঘরের দরজা খুলে গেল, উঁকি দিল বাসিন্দারা। বিরক্ত ও বিস্মিত হয়ে দেখল হলওয়ের মাঝখানে দাঁড়িয়ে এক মধ্য বয়স্ক লোক তার বাবা মাকে ডাকছে আর হাপুস নয়নে কাঁদছে…বাচ্চা ছেলেদের মত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *