দ্য উইচ – পিটার ট্রিমেন
পুরানো কটেজটায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে নেমে এল সাঁঝের আঁধার। আমার মত শহুরে মানুষের জন্য গ্রামে যাতায়াত কঠিন কাজই বটে। আমাকে বলা হয়েছিল কর্ক সিটি চোখে পড়বে। কিন্তু আয়ারল্যান্ডে মাইলগুলো বড্ড গোলমেলে। লোকে ‘আইরিশ মাইল’ বলে ঠাট্টা করে এ জন্যই। বোগেরাগ পর্বতমালার ছায়ায় শুয়ে আছে কটেজটা। এদিকে সারাক্ষণ হু হু করে বাতাস বইছে, ন্যাড়া গুল্ম ছাড়া কিছু জন্মায় না। পাহাড়ের ধূসর গ্রানিট বুকে খোঁচা খোঁচা দাড়ির মত খড় ছিটিয়ে আছে। বাতাস এখানে পাথরের গায়ে বাড়ি খেয়ে শিস তোলে, পাক খেতে খেতে উঠে যায় উপরে। এরকম এলাকায়, উঁচু-নিচু রাস্তা আর পাথুরে ঢাল ধরে হেঁটে আসতে কমপক্ষে দু’ঘণ্টা সময় লাগবে। তবে মাইলখানেক রাস্তা আবার মোটামুটি মন্দ নয়। প্রশ্ন জাগতে পারে এই অচেনা, আতিথেয়তাশূন্য জায়গায় আমি কী করছি? এদিকে আসবার কোন খায়েশ ছিল না আমার। কিন্তু খেটে খাওয়া মানুষকে পেটের টানে অনেক জায়গাতেই যেতে হয়। আর আমি বেঁচে আছি RTE’র উপর নির্ভর করে। এটি আইরিশ স্টেট টেলিভিশন। কাজ করছি টেলেফিস আয়ারিয়্যানের সঙ্গে। এক প্রযোজকের মাথায় হঠাৎ ঢুকেছে আইরিশ ফোক প্রথার উপর একটা প্রোগ্রাম বানাবে। দায়িত্বটা আমাদের উপর বর্তেছে। ফলে আমাকে পুরানো বইয়ের দোকানে ঢুঁ মারতে হলো, যেখানে অকাল্ট সাহিত্যের উপর বই মেলে। রিভার লী’র সিয়ারেস স্ট্রীটের ছোট একটি গলিতে দোকানটা। এ এলাকার বর্ণনা কর্ক সাহিত্যে আছে। আর এখানে ট্যুরিস্টদের আনাগোনাও একসময় কম ছিল না। সে স্বর্ণযুগ গত হয়েছে অনেক আগে,এখন এ এলাকায় কারিগরদের বাড়িঘর আর দোকানপাট ছাড়া কিছু নেই।
আমাকে বলা হয়েছে মৃতদের সাথে জড়িত কুসংস্কারের বিষয় খুঁজে বের করতে। আমি এ বিষয়ে একটা বইয়ের পাতা ওল্টাচ্ছি, এক বৃদ্ধা এসে দাঁড়াল পাশে। উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করল কী পড়ছি।
‘তুমি আইরিশ প্রথা আর মৃতদের সাথে কুসংস্কারের সম্পর্কের বিষয়ে আগ্রহী দেখতে পাচ্ছি,’ তীক্ষ্ণ, ধারাল গলায় বলে উঠল সে। মুখ তুলে তাকালাম তার দিকে। ছোটখাট গড়ন, কাঁধজোড়া নুয়ে গেছে সামনের দিকে। পরনে লম্বা, কালো পোশাক, তার সাথে মেলানো বড় হ্যাট এবং ঘোমটা, যেন ভিক্টোরিয়ান নাটক থেকে উঠে আসা কোন চরিত্র। চেহারা দেখে বয়স অনুমান করা শক্ত, তবে মহিলার পোশাকের ধরনে মনে হয় প্রাচীন মানুষ। অনেক প্রাচীন, যাকে সময় প্রায় ভুলে গেছে।
‘জ্বী,’ বিনীত গলায় সায় দিলাম আমি।
‘ইন্টারেস্টিং একটা বিষয়। ওয়েস্টকর্কে মৃতদের নিয়ে অনেক গল্প আছে, যারা জীবন ফিরে পেয়েছিল। গ্রামে গেলে এদেরকে নিয়ে অবিশ্বাস্য সব গল্প শুনতে পাবে তুমি।’
‘সত্যি?’ মৃদু গলায় প্রশ্ন করলাম। ‘জোম্বিদের কথা বলছেন?’
বিরক্তির ভঙ্গিতে নাক টানল মহিলা।
‘জোম্বি! ওটা তো আফ্রিকার ভুডু কুসংস্কার। তুমি আয়ারল্যান্ডে রয়েছ, যুবক। না, আমি মার্ভ ভিও’র কথা বলছি।’
‘ওটা কী জিনিস?’ জানতে চাইলাম আমি।
‘বেঁচে থাকা লাশ,’ জবাব দিল বৃদ্ধা। ‘আয়ারল্যান্ডের গ্রাম্য এলাকায় মার্ভ ভিওদের নিয়ে অনেক গল্প আছে।’
আবার নাক টানল সে। অভ্যাস। বদভ্যাসও বলা যায়। ‘আমি সত্যি কথাই বলছি, এমন সব গল্প আছে, শুনলে তোমার ঘাড়ের সমস্ত চুল সরসর করে খাড়া হয়ে যাবে। অবিশ্বাস্য এবং ভয়ঙ্কর সব গল্প। জ্যান্ত কবর দেয়ার কাহিনী। টাগ ও ক্যাথেনের গল্প, বদমাইশীর জন্যে একে শাস্তি দেয়া হয়েছিল, প্রতি রাতে ভয়ঙ্কর এক জিন্দালাশ বা মার্ভ ভিও তাকে নির্যাতন করত। লাশটা চাইত তাকে কবর দেওয়া হোক। সে লোকটাকে গির্জার কবরখানা নিয়ে যেত, মৃতেরা উঠে আসত কবর থেকে। কিন্তু কেউ লাশটাকে কবর দিতে রাজি হত না। আরও লাশ আছে যারা ভূতুড়ে হ্রদের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে পানিতে ডুবে মরা মানুষ খাওয়ার জন্যে। আরও দারুণ দারুণ গল্প তুমি শুনতে পাবে ওখান থেকে মাইল খানেক রাস্তা গেলেই।’
চট্ করে একটা বুদ্ধি এসে গেল মাথায়।
‘স্থানীয় কাউকে চেনেন আপনি যে এসব গল্প জানে?’ জিজ্ঞেস করলাম আমি। ‘আমি একটা টেলিভিশন প্রোগ্রাম নিয়ে কাজ করছি, তাই এমন কারও সঙ্গে কথা বলা দরকার…’
আবার নাক টানল সে। ‘মার্ভ ভিও সম্পর্কে জানে এমন কারও সঙ্গে কথা বলতে চাইছ?’
হাসলাম আমি। বৃদ্ধ এমনভাবে কথাটা বলল যেন আমি মৌমাছির চাষ কীভাবে করতে হয় জানার জন্য সেরকম কাউকে খুঁজছি। দ্রুত উপর-নীচে মাথা ঝাঁকালাম।
‘তা হলে মুশেরামোর পাহাড়ে চলে যাও, ‘টিচ ড্রচ চু’ কোথায় জিজ্ঞেস করবে। টিচ ড্রচ চুতে ফাদার নেসান ডোহেনিকে পাবে। তাঁর সঙ্গে কথা বললেই হবে।’
হাতের বইটা নামিয়ে রাখলাম আমি, হাত বাড়ালাম অ্যাটাশে কেসের দিকে, বের করলাম নোটবুকটা। বৃদ্ধাকে ধন্যবাদ দেওয়ার জন্য ঘুরে দাঁড়াতেই একটা ধাক্কা খেলাম। নেই! চলে গেছে বুড়ি। মুহূর্তের মধ্যে যেন হাওয়া হয়ে গেছে। দোকানের মালিক বসে দোতলায়। বৃদ্ধার কথা জিজ্ঞেস করলাম তাকে। বুড়িকে সে দেখেছে কিনা বা চেনে কিনা। ডানে-বামে মাথা নাড়ল সে। শ্রাগ করে নিজের কাজে মন দিলাম। বৃদ্ধার বলা নামগুলো লিখে নিলাম নোটবুকে। পুরানো বইয়ের দোকানে এরকম অদ্ভুত মানুষ কত আসে। তবে বৃদ্ধার সঙ্গে দেখা হয়ে ভালই হয়েছে। সারাদিন বই ঘাঁটাঘাঁটির যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাওয়া গেছে। ভাল টেলিভিশন প্রোগ্রামে লোকে মানুষ-জন, গল্প বলিয়েদের দেখতে চায়, উপস্থাপকের রসহীন একঘেয়ে বক্তৃতা শুনতে চায় না।
মুশেরামোর বোগেরাগ পর্বতের সবচে’ বড় চুড়ো। কর্ক শহর থেকে বেশি দূরে নয়। ফোন বুক উল্টোপাল্টে দেখেও ফাদার নেসান ডোহেনি বা টিচ ড্রচ চু বলে কোন নাম তালিকায় চোখে পড়ল না। তবে জায়গাটি যেহেতু কাছে, ভাবলাম একুশ মাইল দূরে হলেও মুশেরামোর থেকে ঘুরে সেদিনই শহরে ফেরা যাবে। বলতে ভুলে গেছি আমি খুব ভাল মোটর সাইকেল চালাতে জানি। মোটর চালানো আমার শখ। ধর্মযাজক বা পাদ্রির সঙ্গে কথা বলে মাঝরাতের আগে ফিরে আসতে পারব, মনে মনে হিসাব করলাম।
কর্কের সোজা এবং চওড়া একটি রাজপথ ম্যাক্রম। ওই রাস্তা ধরে এগিয়ে চললাম আমি। তারপর উত্তর দিকে মোড় নিলাম। এদিকে ছোট একটি রাস্তা চলে গেছে বালিনাগরি নামের গ্রামে। গ্রামটি দূরে, মুশেরামোরের কালো একটি চুড়োয় দাঁড়িয়ে রয়েছে। সহজ যাত্ৰা। আমি স্থানীয় একটি গ্যারেজে বাইক থামালাম, তেল ভরলাম। গ্যারেজের লোকটাকে জিজ্ঞেস করলাম টিচ ড্রচ চুটা কোন দিকে। অদ্ভুত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালে সে। যেন খুব গোপন কোন ব্যাপারে জানতে চেয়েছি তার কাছে। ‘কেন এসেছ তা জানি’ ধরনের হাসি ফুটল তার চেহারায়, তারপর বলে দিল কীভাবে পৌঁছুতে হবে গন্তব্যে।
এরপরে শুরু হলো আমার আসল যাত্রা।
ঘণ্টাখানেক লাগল লোকজনকে জিজ্ঞেস করে গন্তব্যে পৌঁছুতে। লজ্জা লাগলেও স্বীকার করছি, আমার আইরিশ উচ্চারণ তেমন সুবিধের নয়। যে দেশের মানুষ দ্বিভাষা-ভাষী, এবং ইংলিশ যেখানে আইরিশের চেয়ে বেশি বলা হয়, সেখানে দ্বিতীয় ভাষাটা কেউ কম জানলেও তাতে তেমন কিছু এসে যায় না। যা হোক, আমি জানলাম, ‘টিচ’ মানে আইরিশ ভাষায় বাড়ি। যদিও পুরো অর্থটা এ থেকে পরিষ্কার হলো না। তবে বহু কষ্টে কটেজটা খুঁজে পাবার পরে ওটাকে ‘বাড়ি’ বলা যাবে কিনা ভেবে সন্দেহ হলো আমার।
ওটা পাহাড়ের ঠোঁটের সামনে, ঠেলে বেরিয়ে আসা গুহার ধারে দাঁড়িয়ে আছে। চারদিকে গাছপালা আর ঝোপঝাড়ের অন্ধকার সারি বেড়ার মত সৃষ্টি করেছে। প্রাচীন, সেঁতসেঁতে এবং বিষন্ন লাগল কুটিরটাকে। ওটাকে যখন খুঁজে পেলাম ততক্ষণে করেছে।
মোটরবাইক দাঁড় করালাম আমি, আঁকাবাঁকা একটা রাস্তা ধরে এগোলাম। রাস্তার ধারে গজিয়ে ওঠা পিরাকান্থা ঝোপের ধারাল কাঁটার খোঁচা লাগল হাতে, জ্যাকেট টেনে ধরতে চাইল। অবশেষে সরু চৌকাঠের দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম।
চলটা ওঠা, রঙ দেওয়া কপাটে আঙুলের গাঁট দিয়ে টোকা দিতেই ঘর থেকে বাঁশির মত তীক্ষ্ণ একটা গলা ভেসে এল। ভিতরে যেতে বলছে আমাকে।
উঁচু পিঠঅলা চেয়ারে বসা রোগা-পাতলা মানুষটিই ফাদার নেসান ডোহেনি হবেন, অনুমান করলাম। ঘাসের চাপড়ার অগ্নিকুন্ড তাঁর সামনে, শিখাহীন জ্বলছে। মানুষটার মাথার সবগুলো চুল পাকা, বর্ণহীন চোখজোড়া বিষণ্ণ, তাতে প্রাণচাঞ্চল্য অনুপস্থিত, গায়ের চামড়া হলদে পার্চমেন্টের মত। সরু, থাবার মত হাত জোড়া কোলের উপর ভাঁজ হয়ে আছে। বয়স নব্বুইয়ের কম হবে না। পরনে কালো, চকচকে সুট, সাদা রোমান কলারটা খোলা। আগুন জ্বললেও ঘরের মধ্যে গা হিম করা ঠান্ডা।
‘মৃতরা?’ বাঁশির তীক্ষ্ণ সুর বেজে উঠল আবার, আমি আমার আগমনের কারণ ব্যাখ্যা করার পরে। পাতলা, রক্তশূন্য ঠোঁটজোড়া বেঁকে গেল ওপরের দিকে। সম্ভবত এটা তাঁর হাসি। ‘জীবিত মানুষদের মৃতদের সম্পর্কে জানার এত কৌতূহল কেন?’
‘ফকলোর মানে লোকাচারবিদ্যার ওপরে টেলিভিশন প্রোগ্রামের জন্যে, ফাদার,’ হালকা গলায় বললাম আমি।
‘লোকাচারবিদ্যা, অ্যাঁ?’ মুরগীর মত কক্কক্ করে উঠলেন তিনি। ‘মৃতদের এখন লোকাচারবিদ্যার মধ্যে ঢোকানো হচ্ছে?’
অনেকক্ষণ চুপ হয়ে রইলেন ফাদার। আমি ভাবলাম বুড়ো বোধহয় ঘুমিয়েই পড়েছেন। হঠাৎ মুখ তুলে চাইলেন তিনি আমার দিকে, ঝাড়া দিলেন মাথা।
‘আমি আপনাকে মৃতদের অনেক গল্প শোনাতে পারি। তারা জীবিতদের মতই বাস্তব। এখান থেকে অল্পদূরে একটা গোলাবাড়ি আছে। এ অঞ্চলের একটি প্রথা হলো রাতের বেলা পানি ফেলার সময়, এদিকে অনেক বাড়িতেই এখনও কুয়ো থেকে পানি তোলা হয়, যে লোক পানি ফেলবে সে চেঁচিয়ে বলবে, ‘টগ ওট আস উয়িশ!’ এর মানে হলো পানি থেকে তুমি দূরে থাকো।’
‘তারা এ কথা কেন বলবে, ফাদার?’
‘কারণ লোকের বিশ্বাস পানি লাশের ওপর পড়লে ওটা জ্বলে যাবে পানি পবিত্র বলে। এত রাতে কাছের এক খামার বাড়িতে এক মহিলা এক জগ পানি ফেলার সময় সতর্কবাণী উচ্চারণ করতে ভুলে গেছে। সাথে সাথে তীব্র একটা আর্তনাদ শুনতে পায় সে। ব্যথায় গোঙাচ্ছে কেউ। অন্ধকারে কাউকে অবশ্য দেখা যাচ্ছিল না। মাঝরাতে ওই বাড়ির দরজা খুলে যায়, কালো একটি ভেড়া ঢুকে পড়ে ঘরে, তার পিঠে দগদগে ঘা। উনুনের পাশে শুয়ে ওটা যন্ত্রণায় গোঙাতে থাকে। চাষী এবং তার বউ ভেড়াটাকে নিয়ে কী করবে বুঝে ওঠার আগেই মারা যায় প্রাণীটা।
‘চাষী পরদিন সকালে কবর দেয় ভেড়াটাকে। মাঝরাতে আবার তার ঘরের দরজা খুলে যায়, ভেতরে ঢোকে সেই ভেড়া পিঠে আগের মতই দগদগে ঘা। উনুনের পাশে শুয়ে যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে মারা যায় ওটা। চাষী আবার তাকে কবর দেয়। কিন্তু তৃতীয়বারও যখন একই ঘটনা ঘটে, চাষী আসে আমার কাছে। তখন আমি বয়সে তরুণ, তবে কী ঘটেছে বুঝতে পেরে তক্ষুণি মৃত আত্মার শান্তির উদ্দেশে একটি প্রার্থনা করি। তারপর আর ভেড়াটিকে দেখা যায়নি।’
আমি দ্রুত নোট নিচ্ছিলাম। একটা নোটবুক পাশের টেবিলে রেখেছি। আরেকটা খাতায় ঘটনার বর্ণনা লিখতে লিখতে বললাম, ‘দারুণ, ফাদার। এ দিয়ে চমৎকার একটি গল্প হবে।’
ফাদার কটমট করে তাকালেন আমার দিকে। ‘আমি আপনার সঙ্গে মশকরা করছি না। জীবিতদের মতই শক্তিধর মৃতেরা। কাজেই এদেরকে নিয়ে ঠাট্টা না করাই ভাল।’
মুচকি হাসলাম আমি। ‘আমি ওদেরকে নিয়ে ঠাট্টা করব না, ফাদার শুধু প্রোগ্রামটা হয়ে গেলেই…’
ফাদার ডোহেনি ঝাঁকি খেলেন একটা, যেন খুব ব্যথা পেয়েছেন। আমি অবশ্য ব্যাপারটা পাত্তা দিলাম না।
‘আয়ারল্যান্ডে জোম্বি বলে সত্যি কি কিছু আছে?’
নাক টানলেন তিনি। সাথে সাথে বইয়ের দোকানের বৃদ্ধার কথা মনে পড়ে গেল। ‘মানে যাদু দিয়ে লাশ পুনরুজ্জীবিত করা’?
‘জী। আয়ারল্যান্ডে জিন্দালাশ নিয়ে কোন গল্প নেই? মার্ভ ভিও যার নাম?
ফাদারের বিষণ্ন চোখ জোড়া জ্বলে উঠল ধক্ করে। ‘অবশ্যই মৃতরা চলাফেরা করতে পারে। এ দেশে জীবিত আর মৃতদের মাঝে পাতলা একটা পরদা ছাড়া কিছু নেই। সঠিক সময়ে যথার্থ উদ্দীপনা পেলে মৃতরা আমাদের জগতে ঢুকে পড়তে পারে, যেভাবে আমরা যেতে পারি তাদের দুনিয়ায়।’
আমি আর হাসি থামিয়ে রাখতে পারলাম না। ‘রোমের গির্জায় ঠিক এ কথাগুলোই লেখা আছে।’
বিরুক্তিতে পাতলা ঠোঁট জোড়া পরস্পরের সাথে চেপে ধরলেন ফাদার। ‘খ্রিস্টান ধর্মের আবির্ভাবের বহু আগে থেকে প্রাচীন মানুষেরা এসব ব্যাপার জানতেন। এটাকে হালকাভাবে নেয়া ঠিক না।’ ফাদার নেসান ডোহেনি বক্তা হিসাবে ভালই। আমি দ্রুত তাঁর বাণীর নোট নিয়ে চলেছি। তার অদ্ভুত গল্প দিয়ে ভাল একটা প্রোগ্রাম বানানো যাবে।
‘বলে যান, ফাদার,’ অনুরোধ করলাম আমি। ‘মৃতদের রাজ্যে এই পরদা দিয়ে কীভাবে ঢোকা যাবে বলুন তো?’
‘ক্যাহেরবার্নাহেতে তখন ধর্মযাজক আমি। বয়স অল্প। এক মহিলা বাস করত ওখানে। এক রাতে বাড়ি ফিরছে সে, একটা জলধারার পাশে দাঁড়াল। পানি খাবে। আঁজলা ভরে পানি পান করে সিধে হয়েছে মহিলা, কানে ভেসে এল নিচু গলার গান। একদল লোক আসছিল রাস্তা ধরে, অদ্ভুত একটা গান গাইছিল তারা। গা-টা কেমন কেঁপে ওঠে মহিলার। হঠাৎ লক্ষ করে কাছেই দাঁড়িয়ে আছে লম্বা এক তরুণ। দেখছে তাকে। তরুণের চেহারা অদ্ভুত, বিষণ্ন, বড় বড় চোখ জোড়ায় কোন ভাষা ফুটে নেই। ‘
‘মহিলা তরুণের পরিচয় জানতে চাইল। মাথা নাড়ল তরুণ। পরিচয় দেবে না। বলল মহিলার সামনে বিরাট বিপদ। সে তরুণের সঙ্গে পালিয়ে না গেলে শয়তান মহিলাকে গ্রাস করবে। মহিলা তরুণের সঙ্গে ছুটতে শুরু করে, তখন রাস্তা ধরে আসা গানের দল ‘ফিরে এসো!’ বলে চেঁচাতে থাকে। কিন্তু ভয়ের চোটে মহিলার পায়ে যেন তখন পাখা গজিয়েছে। সে ছুটতে থাকে তরুণের সঙ্গে। ছুটতে ছুটতে চলে আসে একটি ছোট জঙ্গলের ধারে। দাঁড়িয়ে পড়ে তরুণ। বলে এখন তারা নিরাপদ। তারপর সে মহিলাকে তার মুখের দিকে তাকাতে বলে।
‘মহিলা মুখের দিকে তাকিয়ে দেখে তরুণ আর কেউ নয়, তার বড় ভাই, বছরখানেক আগে যে পানিতে ডুবে মারা গেছিল। লক ডালুয়ার কালো পানিতে সাঁতার কাটতে গিয়ে ডুবে যায় সে। তার লাশের আর খোঁজ মেলেনি। তখন মহিলা কী করল? তার মনে হলো শয়তান তার আশপাশেই রয়েছে। আমার কাছে ছুটে এল সে। স্বীকার করল সব। কনফেশনের সময় ভয়ে কাঁপছিল মহিলা। তারপর মারা যায় সে।’
‘ভয়ঙ্কর গল্প,’ বললাম আমি। এ ঘটনাও উৎসাহের সাথে টুকে নিয়েছি নোটবুকে।
‘মৃতদের গল্প এ দেশের আনাচেকানাচে ছড়িয়ে আছে,’ বললেন বৃদ্ধ প্রীস্ট।
ঘরের কোণের দেয়ালে ঝোলানো পুরনো ঘড়ির ঢংঢং শব্দে সচকিত হয়ে উঠলাম। সর্বনাশ! দশটা বেজে গেছে। কিন্তু ফাদার এমন চমৎকার সব গল্প শোনাচ্ছেন, উঠতে ইচ্ছে করল না।
‘মার্ভ ভিও’র ব্যাপারটা কী ফাদার?’ জিজ্ঞেস করলাম আমি। ‘এদেরকে জিন্দালাশের চেয়েও ভূতুড়ে মনে হলো। এরা কি রিঅ্যানিমেটেড লাশ?’
পাদ্রির চেহারার অভিব্যক্তির পরিবর্তন ঘটল না।
‘ভূত হোক আর জিন্দালাশ, মৃত মৃতই-সে যে আকারেই তারা আসুক না কেন।’
‘কিন্তু রিঅ্যানিমেটেড মানে পুনরুজ্জীবিত লাশ?’ বললাম আমি। ‘এদের ব্যাপারটা কী?’
‘কথা যদি বলি, বলতেই হবে,’ বৃদ্ধ প্রীস্ট কথার অর্ধেকটা যেন নিজেকে শোনালেন, বাকিটুকু আমাকে উদ্দেশ্য করে। ‘বলব কী? ‘
ভাবলাম প্রশ্নটা আমাকেই করা হয়েছে তাই হ্যাঁ সূচক মাথা দোলালাম।
‘তা হলে বলি। আপনাকে একটা গল্প শোনাই,’ এক ইংরেজ ভূস্বামীর গল্প। ইংল্যান্ডের কাছ থেকে তখনও স্বাধীন হয়নি আয়ারল্যান্ড। ওই ভূস্বামীর দখলে ছিল এদিককার পাহাড়গুলো।
ঘড়ির দিকে দ্রুত একবার চোখ বোলালাম, ‘এটা কি সেই জিন্দা লাশ মার্ভ ভিও’র গল্প?
আমার কথা না শোনার ভান করলেন প্রীস্ট। ‘ইংরেজ লর্ডটির নাম আর্ল অভ মুশেরামোর, লিয়ার এবং লিসনারহারার ব্যারন। বিশাল এক প্রাসাদ ছিল তাঁর, প্রচুর সহায়-সম্পত্তির মালিক ছিলেন। বেশিরভাগ জমি ছিল বোগেরাগ পর্বতমালা ঘিরে। আর্ল অভ মুশেরামোর ছিলেন ধনী এবং প্রভাবশালী।’
বৃদ্ধের কণ্ঠ মৌমাছির গুঞ্জনের মত, সম্মোহক, ঘুম এসে যায় চোখে।
তার গল্পের মূল ঘটনার সময় ‘মহা দুর্ভিক্ষ’র কাল। ঊনবিংশ শতকের মাঝামাঝিতে আলুর মাঠগুলো ফসলশূন্য হয়ে যায়। ইংরেজ ভূস্বামীরা প্রজাদের খোঁজ-খবর নিতেন না বলে আয়ারল্যান্ডের কৃষকরা প্রচন্ড দারিদ্রের কবলে পড়ে, আলুই তখন প্রধান খাদ্য হয়ে দাঁড়ায়। তারা লুকিয়ে শিকার করত, মাছ ধরত নদী থেকে। তবে মাছ ধরতে গিয়ে বা শিকার করার সময় ধরা পড়ে গেলে প্রজাদেরকে কঠোর শাস্তি দিতেন ভূস্বামীরা। একবার এক তরুণ লর্ড মুশেরামোরের এলাকা থেকে খরগোশ শিকারের সাহস দেখায়। তার বিরাট পরিবারটি তখন অনাহারে ধুঁকছে। ধরা পড়ে যায় তরুণ, তাকে অস্ট্রেলিয়ার ভ্যান ডিয়েমেন-এর জমিনে পাঠিয়ে দেওয়া হয় বহু বছরের জন্য। ওই সময় চোরা শিকারীদের এটাই শাস্তি ছিল।
আলুর মাঠগুলো ফসলশূন্য হয়ে পড়লে দুর্ভিক্ষ শুরু হয়ে যায়। তিন বছরের মধ্যে দেশের জনসংখ্যা কমে যায় পঁচিশ লাখ। অথচ তখনও ভূস্বামী আর তাদের কর্মচারীরা প্রজাদের কাছ থেকে খাজনা আদায় করিছল। তাদের ছোট গোয়ালঘরের ভাড়া চাইত। না দিতে পারলে বের করে দিত ঘর থেকে। পুরুষ-নারী-শিশু কারও ক্ষমা ছিল না। ঘর থেকে বিতাড়িত হয়ে বেরিয়ে পড়তে হত খোলা আকাশের নীচে, তুষারপাতের মধ্যে। আবার যাতে ঘরে ফিরতে না পারে সেজন্য জমিদারের দালালরা কৃষকদের বাড়িঘর ভেঙে টুকরো করে ফেলত। অনাহার, শীতের কামড়সহ নানা অসুখে কৃষকরা মারা যেতে শুরু করে। চারদিকে মহামারীর মত ছড়িয়ে পড়ে কলেরা।
ওদিকে ভূস্বামীরা কিন্তু ফুলে উঠছিলেন। তারা আইরিশ জেটিতে জাহাজ বোঝাই করে শস্য, গম, তিসি, গরু-ছাগল, ভেড়া, হাঁস-মুরগি ইংল্যান্ডে পাঠিয়ে দিচ্ছিলেন বিক্রির জন্য।
দেশের সর্বত্র একটা তিক্ত অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছিল। শাসককুলের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ দানা বেঁধে উঠলে সামরিক বাহিনী কঠিন হাতে তা দমন করে।
লর্ড মুশেরামোরের গ্রামের চাষীরা, প্রাসাদের বাইরে সবুজ ঘাস মোড়ানো লনে একদিন এল হাতে হাত ধরে, ভূস্বামীর কাছে সাহায্য চাইতে। আসন্ন শীতে যেন বেঁচে থাকতে পারে, তারই ব্যাকুল প্রার্থনা। কারণ ইতোমধ্যে অনেকেই না খেয়ে মারা গেছে। শীত শুরু হয়ে গেলে, উপযুক্ত সাহায্য না পেলে হয়তো কেউই বাঁচবে।
লর্ড মুশেরামোরের জমিদারির প্রতি তেমন নজর ছিল না। ত্ৰিশ বছরের এই যুবক জমিদার হবার পরে মাত্র একবার তার জমিদারি দর্শন করেছেন। লন্ডনে বাস করতেই পছন্দ করেন তিনি, ভালবাসেন মদ আর জুয়ো নিয়ে থাকতে। তবে এবার তিনি গ্রামে এসেছেন দেখতে ‘দুর্ভিক্ষ’র কারণে যেন তাঁর জমির উৎপাদন কোন রকম ব্যাহত না হয়।
লনে লোকের ভিড় দেখে শঙ্কিত হয়ে উঠলেন লর্ড মুশেরামোর। মানুষের সংখ্যা কয়েকশো হবে। এরা সবাই এসেছে গ্রাম থেকে। জমিদার তাঁর নায়েবকে সোজা পাঠিয়ে দিলেন ম্যালোতে, সেনাবাহিনীকে খবর দিতে। তিন প্লাটুন অশ্বারোহী সৈন্য চলে এল সাথে সাথে। চাষারা হামলা করে বসতে পারে এই ভয়ে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলল প্রাসাদ। দলের ক্যাপ্টেন লর্ড মুশেরামোরের কথার প্রতিধ্বনি তুলে বলল, কৃষকদেরকে এক্ষুনি চলে যেতে হবে। তারা ইতস্তত করছে দেখে ক্যাপ্টেন তার সেনাবাহিনী নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল গ্রামবাসীর উপর। যেন উন্মাদ হয়ে গিয়েছিল অশ্বারোহী সৈন্যরা। তরোয়াল দিয়ে ইচ্ছেমত কুপিয়ে চলল অসহায় লোকগুলোকে। ঘটনাস্থলেই মারা গেল অনেকে। এদের মধ্যে স্থানীয় প্রীস্টও ছিল সে এসেছিল কৃষকদের পক্ষে জমিদারের সঙ্গে কথা বলতে।
গ্রামবাসীদের মাঝে ব্রিড কাপিন নামে এক বৃদ্ধাও ছিল। যখন দুর্ভিক্ষের শুরু হয়নি, সেই সময় থেকেই লোকে সভয়ে এড়িয়ে চলত তাকে ডাইনি ভেবে। বুড়ি পালিয়ে বাঁচল। শুধু তরবারির আঘাতে তার থুতনির অনেকটা কেটে গিয়েছিল। তবে আঘাতটা বেশি লেগেছিল বুকে। জমিদারের কাছ থেকে এরকম আচরণ মোটেই আশা করেনি সে।
ব্রিড কাপিন পালিয়ে গেল পাহাড়ে। গুহার মধ্যে সারাদিন লুকিয়ে রইল। রাতের বেলা গুহা ছেড়ে বেরিয়ে পড়ল। চলে এল জমিদারের লনে। ওখানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে চাষাভুসোদের লাশ। বুড়ি পাগলের মত লাশের মধ্যে কী যেন খুঁজছিল। অবশেষে পেয়ে গেল কাঙ্ক্ষিত জিনিস। একটা লাশ। তবে লাশটার গায়ে আঘাতের চিহ্ন কম। মারাত্মক ভাবে কেটে-ছিঁড়ে যায়নি তার কোন অঙ্গ। বুড়ির গায়ে কোত্থেকে আসুরিক শক্তি ভর করল কে জানে, হয়তো ঈশ্বর কিংবা শয়তান যুগিয়েছে, সে লাশটা টেনে নিয়ে চলল রাতের আঁধারে। হেঁচড়াতে হেঁচড়াতে নিয়ে এল পাহাড়ের সেই গুহায়।
গুহার মধ্যে বসে প্রাচীন নানা মন্ত্র পড়া শুরু করে দিল বৃদ্ধা। সেই অদ্ভুত মন্ত্র বুঝবার সাধ্য কোন গেইলিক পন্ডিতেরও নেই। ঝোপঝাড় খুঁজে কিছু ভেষজ লতাপতা নিয়ে এল সে, আগুন জ্বালাল। কেতলিতে পানি ভরে তাতে ছুঁড়ে দিল লতাপাতা। তারপর চুলোয় বসিয়ে দিল কেতলি। কিছুক্ষণ পরে কেতলির পানি দিয়ে গোসল করাল লাশটাকে। অবশেষে চাঁদ যখন আলো ছড়াতে উঁকি দিল মাঝ আকাশে, ঘোষণা করল মধ্য রাতের, ওই সময় লোকটার শরীর কাঁপতে শুরু করল, স্পন্দন জাগল নাড়িতে, চোখ মেলে চাইল সে।
বুড়ি ব্রিড কাপিন চেঁচিয়ে উঠল সোল্লাসে।
সে মার্ভ ভিও সৃষ্টি করেছে, তার আহ্বানে জ্যান্ত হয়ে উঠেছে লাশ। প্রাচীনকালে বলা হত কোন অখ্রিস্টান পুরোহিত যদি অপঘাতে মরে যাওয়া কোন ব্যক্তির লাশের গায়ে প্রাণ ফিরিয়ে আনতে পারে তবে যে লোক অন্যায়ভাবে ওই ব্যক্তিকে হত্যা করেছে তার উপর প্রতিশোধ নেওয়া যাবে। আর বৃদ্ধা তখন প্রতিহিংসার আগুনে দাউদাউ জ্বলছে। সে জিন্দালাশকে পাঠিয়ে দিল প্রতিশোধ নিতে।
লর্ড মুশেরামো এক সন্ধ্যায় কর্কের জেটিতে এসেছেন ইংল্যান্ডগামী জাহাজে উঠতে, অতর্কিত হামলা হলো তাঁর উপর। আক্ষরিক অর্থেই তাঁকে ছিঁড়ে টুকরো করে ফেলল হামলাকারী। তবে কেউ চিনতে পারেনি ঘাতককে। পুলিশ এবং সৈন্যরা শপথ করে বলল, তারা হত্যাকারীকে বেশ কয়েকবার গুলি করেছে। তবে স্থানীয় ম্যাজিস্ট্রেট তাদের কথা বিশ্বাস করলেন না। পুলিশ আর সৈন্যরা যদি হামলাকারীর গায়ে গুলি লাগিয়েই থাকে তা হলে জেটিতে রক্তের চিহ্ন কই? ওখানটা শুধু লর্ড মুশেরামোর তাজা রক্তে মাখামাখি ছিল, হত্যাকারী যেন মিলিয়ে গেছে বাতাসে।
এরপরে হামলার শিকার হলো সেই অশ্বারোহী বাহিনীর ক্যাপ্টেন। ম্যালোতে নিজের নিরাপদ ব্যারাকে। তাকেও ছিঁড়ে টুকরো করে ফেলা হয়েছে। হামলাকারী নিঃসন্দেহের প্রচন্ড শক্তিধর এবং হত্যার নেশায় উন্মত্ত। নইলে ব্যারাকের পাথর আর লোহার দেয়াল ভেঙে ভিতরে ঢুকতে যেত না। ক্যাপ্টেনের ছিন্নভিন্ন লাশ দেখে ভারত ও আফ্রিকায় কাজ করা অনেক অভিজ্ঞ সৈনিকই ঘটনাস্থলে অসুস্থ ও আতঙ্কিত হয়ে পড়ল।
এ ঘটনার কয়েকদিন পরে, লর্ড মুশেরামোরের নায়েব মেজর ফারান তার বিশাল দুই হাউন্ড নিয়ে সন্ধ্যাবেলায় হাঁটাহাঁটি করতে বেরোয়। ফারান দীর্ঘদেহী, গাট্টাগোট্টা, পৃথিবীর কোনকিছুতে তার ভয় নেই। সঙ্গে একজোড়া পিস্তল সবসময়েই থাকে। আর শিকারী কুকুর দুটো শুধু সঙ্গ দেওয়ার জন্য মনিবের সাথে থাকে না। হুকুম পাওয়ামাত্র চোখের পলকে যে কাউকে ছিন্নভিন্ন করে ফেলতে ওস্তাদ তারা। মেজর ফারানকে মুশেরামোরের কৃষক সম্প্রদায় সবচে’ বেশি ঘৃণা করত। আর কথাটা জানত বলেই সে জমিদারিতে টহল দেওয়ার নাম করে ভয় ছড়াতে পছন্দও করত। যদিও কারও অতর্কিত হামলার অসহায় শিকার হতে চায় না বলে সতর্কতা অবলম্বন করে চলত মেজর ফারান।
কিন্তু পিস্তল বা হাউন্ড কেউ তাকে বাঁচাতে পারল না সেই সন্ধ্যায়। তিন দিন বাদে মেজর ফারানের রক্তাক্ত, ছিন্নভিন্ন লাশ পাওয়া গেল রাস্তার ধারে। ডাক্তার স্বীকার করলেন তিনি টুকরো হয়ে যাওয়া হাউন্ডগুলোর মাংস থেকে ফারানের লাশের শত টুকরো মাংস আলাদা করতে পারেননি। বুঝতেই পারেননি কোন্টা কুকুর, কোন্টা মানুষ
এ সমস্ত ঘটনা যখন ঘটছে ওই সময় বুড়ি ব্রিড কাপিন পাহাড়ের ঢালে, তার গুহার আস্তানায় অসন্তোষে গোঙাচ্ছে।
মুশেরামোরের জমিদারিতে যাদেরকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়েছে, সেই হত্যাকারীদের ভয়ঙ্কর পরিণতি ঘটিয়েও সন্তুষ্ট হতে পারছিল না সে। বৃদ্ধা প্রতিজ্ঞা করেছিল তার আত্মীয় এবং গ্রামের স্বজনদেরকে কেড়ে নেওয়ার অপরাধে সে মুশেরামোর পরিবারের কাউকে ছাড়বে না, প্রত্যেককে এ জন্য মাশুল দিতে হবে। প্রতিশোধের নেশায় পাগল হয়ে গিয়েছিল সে। আর প্রতিশোধ নেওয়ার অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করত মার্ভ ভিওকে।
শোনা যায়, বছরের পর বছর ব্রিড কাপিন রাতের বেলা বোগেরাগ পর্বমালার প্রাম চষে বেরিয়েছে প্রতিহিংসায়, সঙ্গে ছিল সেই জিন্দালাশ।
হঠাৎ করেই চুপ হয়ে গেলেন ফাদার ডোহেনি। আমি হাঁ করে তাঁর গল্প শুনছিলাম আসনের একেবারে কিনারে বসে।
‘দারুণ গল্প, ফাদার,’ অবশেষে বিড়বিড় করলাম আমি গল্পের সমাপ্তি ঘটেছে বুঝতে পেরে। ‘লর্ড মুশেরামোর বলে সত্যি কেউ ছিলেন?’
জবাব দিলেন না বৃদ্ধ, এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন ধূমায়িত ঘাসের চাপড়ার দিকে। আমি মৃদু কেঁপে উঠলাম শীতে। চাপড়াটা খামোকাই জ্বলছে। ঘরের ঠান্ডা একরত্তি দূর করতে পারেনি।
‘আপনি কি কর্কে, আমাদের স্টুডিওতে একবার আসবেন?’ অনুরোধ করলাম আমি। ‘মার্ভ ভিও’র ব্যাপারে টিভি প্রোগ্রামে একটু বলতেন। বিনিময়ে কিছু সম্মানী অবশ্যই পাবেন।’
হঠাৎ দমকা একটা ঠান্ডা হাওয়া লাগতে পেছন ফিরে চাইলাম।
কটেজের দরজা খোলা। অবাক হয়ে দেখলাম দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে আছে বইয়ের দোকানের সেই বৃদ্ধা। তার ভিক্টোরিয়ান পোশাক পতাকার মত উড়ছে পাহাড় থেকে ধেয়ে আসা বাতাসে, যেন কালো দাঁড়কাকের ডানা।
‘তোমার কাজ নিশ্চই শেষ হয়েছে,’ শত বর্ষের পুরানো গলা খখন করে উঠল কর্তৃত্বের সুরে।
‘আমি ফাদার ডোহেনির সঙ্গে দেখা করতে এসেছি,’ বৃদ্ধ প্রীস্টের দিকে ফিরলাম সমর্থনের আশায়। ‘অবশ্য আপনার পরামর্শেই,’ বিনয়ের সুরে যোগ করলাম শেষ কথাটা।
বৃদ্ধ সম্ভবত সায় দেওয়ার ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকালেন, তার থুতনি এসে ঠেকেছে বুকে, চোখ বোজা।
‘বেশ। দেখা হয়েছে। কথাও বলেছ। এখন ভাগো!
বৃদ্ধার অভদ্র আচরণে বিরক্ত হয়ে কটমট করে তাকালাম তার দিকে।
‘অন্যের বাড়িতে এসে আমাকে দয়া করে উপদেশ দেবেন না, ম্যাডাম।’ কঠিন গলা আমার।
কালো ঘোমটার আড়ালে মুখ হাঁ করল বুড়ি, মৃগী রোগীর মত এমন বিকট গলায় হেসে উঠল, ঘাড়ের পেছনের সব ক’টা চুল সরসর করে দাঁড়িয়ে গেল আমার।
‘এখানকার দায়িত্বে আছি আমি,’ ফোঁস ফোঁস করে শ্বাস ফেলল সে।
‘আপনি ফাদার ডোহেনির হাউজকীপার?’ অবাক ভাবটা গোপন রাখতে পারলাম না। চুলো থেকে টেবিলে চায়ের কেতলি এ মহিলা বয়ে নিয়ে যেতে পারবে কিনা সন্দেহ, এমনই রোগা-পাতলা সে। এ কী ভাবে হাউজকীপারের দায়িত্ব পালন করবে!
আবার খলখল হাসির শব্দ শোনা গেল।
‘অনেক দেরি হয়ে গেছে, খোকা,’ অবশেষে বলল বুড়ি। ‘তোমার ব্যাপারে নাক গলাতেই হচ্ছে। রাতের বেলা একটা শয়তান আসে এ পাহাড়ে। ওটার কথা ভাবতে হয় আমাকে।’
ঝট করে থাবার মত একটা হাত ছুঁড়ল সে বাইরের দিকে ইঙ্গিত করে। তার মানে এখন কেটে পড়ো।
আমি আবার তাকালাম ফাদার ডোহেনির দিকে। কিন্তু লোকটার চেহারায় কোন ভাব ফুটে নেই। অগত্যা নোটবুক গুছিয়ে, পকেটে পুরে সিধে হলাম আমি।
বৃদ্ধাকে ‘শুভ রাত্রি’ বললেও সে না শুনবার ভান করে দরজার একপাশে সরে দাঁড়াল আমাকে যেতে দেওয়ার জন্য।
কটেজের বাইরে, চাঁদ উঠেছে আকাশে। মেঘেরা ছোটাছুটি করছে। বাতাস আর্তনাদ তুলছে পাথরে বাড়ি খেয়ে। সাদা পরদা নিয়ে নামতে শুরু করেছে কুয়াশা। তাপমাত্রা পড়ে গেছে অনেক। এখানে আসবার সময় এতটা শীত লাগেনি। দূর থেকে ভেসে এল কুকুরের ডাক। রাতের বাতাসে অপার্থিব এবং অবাস্তব লাগল ডাকটাকে।
মোটর সাইকেলে চড়ে বসলাম আমি। কয়েক মুহূর্ত লাগল ট্রায়াঙ্কের ইঞ্জিন চালু হতে। পাহাড়ি রাস্তা বেয়ে নেমে আসতে থাকলাম। মাইলখানেক পথ এগিয়েছি, হঠাৎ মনে পড়ল, আরি! ফাদার ডোহেনি’র কুটিরের ছোট টেবিলটার উপর একটা নোটবুক ফেলে এসেছি। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে থেমে পড়লাম। ট্রায়াম্ফকে ঘুরিয়ে নিলাম, মেঠো রাস্তা ধরে আবার ফিরে চললাম ‘টিচ ড্রচ চলু’র দিকে।
কুটির থেকে কিছু দূরে থামালাম বাইক, হেঁটে এগোলাম বাড়িটার কালো কাঠামোর দিকে।
হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে পড়তে হলো দোরগোড়ায়।
তীক্ষ্ণ মন্ত্রোচ্চারণের শব্দ ঢুকেছে কানে।
সেই বৃদ্ধার কণ্ঠ। কিন্তু শব্দগুলোর মাথামুন্ডু অর্থ কিছুই বুঝতে পারলাম না। মনে হলো প্রাচীন আইরিশ শব্দে মন্ত্র পড়ছে বুড়ি। ভীষণ ইচ্ছে হলো জানালার শার্সির কাঁচ দিয়ে ভিতরে তাকাতে।
সেই বৃদ্ধ প্রীস্ট ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছেন। বৃদ্ধ তার সামনে, কাঁধ কুঁজো করে বিলাপের সুরে মন্ত্রোচ্চারণ করছে। অবাক হয়ে দেখলাম বুড়ির হাতে পুরানো দিনের অশ্বারোহী বাহিনীর তরবারি, ফলাটা বাঁকা। তীক্ষ্ণ খনখনে কণ্ঠে তার মন্ত্র পড়া, যেভাবে তরবারিটা ধরে রেখেছে হাতে, সবকিছুর মধ্যে কেমন অদ্ভুত এবং অশুভ একটা ব্যাপার আছে বলে মনে হলো।
আচমকা থেমে গেল সে।
‘মনে করো, ডোহেনি,’ হুকুম করল বৃদ্ধ।
আড়ষ্ট ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছেন বুড়ো প্রীস্ট, বর্ণহীন চোখ জোড়ার বিস্ফারিত দৃষ্টি বুড়ির উপর
‘তোমাকে মনে করতেই হবে। ওরা এই করেছিল।’
আমি সাবধান করে দেওয়ার আগেই বৃদ্ধা হাতের তরবারিটা মাথার উপরে তুলে, তারপর হাড় জিরজিরে শরীরের পূর্ণ শক্তি দিয়ে অস্ত্রের ডগার পুরোটা ঢুকিয়ে দিল প্রীস্টের হৃদপিন্ড বরাবর। সম্পূর্ণ ফলাটা পড়পড় করে ঢুকে গেল বুড়োর বুকে, পিঠ ঠেলে বেরিয়ে এল। আশ্চর্য, তারপরও তিনি স্থির দাঁড়িয়ে রইলেন! মুখ হাঁ হয়ে গেল আমার। ভয় আর বিস্ময়ে মুখের কথা হারিয়ে ফেলেছি আমি।
তবে আরও ভয়ঙ্কর ঘটনা দেখবার বাকি ছিল তখনও। বৃদ্ধা ছেড়ে দিল তরবারি, সরে দাঁড়াল প্রীস্টের কাছ থেকে। ‘মনে করো, ডোহেনি!
বৃদ্ধের থাবার মত হাত চেপে ধরল তরবারির হাতল, প্রচন্ড টানে ফলাটা বের করে আনল সে শরীরের ভিতর থেকে। ফলা ঝলমল করছে আগুনের আলোয়, এক ফোঁটা রক্তের চিহ্ন নেই ওতে।
আমি জানালার ধারে দাঁড়িয়ে জমে গেলাম আতঙ্কে।
যা দেখেছি বিশ্বাস করতে পারছি না। এ অসম্ভব! বুড়ি প্রীস্টের শরীরে ধারাল তরোয়াল ঢুকিয়ে দিল অথচ বুড়োর চোখের পাতা কাঁপল না পর্যন্ত। প্রীস্ট ওটা শরীরের ভিতর থেকে টেনে বের করে আনলেন। শরীরে কোন ক্ষত চিহ্নও নেই। ‘মনে করো, ডোহেনি!‘
আমি ভয়ার্ত একটা আর্তনাদ করেই ঘুরে দাঁড়ালাম, ছুটলাম বাইক লক্ষ্য করে। আতঙ্কে অবশ হয়ে গেছে শরীর। মনে হলো পা চলছে না। মোটর স্টার্ট দিচ্ছি, ঠিক ভাবে স্টার্ট হচ্ছে না। বুড়ির চিৎকার শুনতে পেলাম, রাস্তায় কার যেন ছায়া পড়েছে। আসছে এদিকে। ঘাড়ের কাছে বিকট গন্ধ নিয়ে ঝাপটা মারল বাতাস। এমন সময় গর্জন ছেড়ে চালু হয়ে গেল বাইক, ঝড়ের বেগে ছুটলাম আমি। রাস্তাটা আঁকাবাঁকা এবং এবড়োখেবড়ো। পিচ্ছিল কাদায় তেমন গতি তুলতে পারছি না। আমি যেন বাইক রেস করছি, ঝাঁকি খেয়ে, লাফিয়ে পার হচ্ছি খানা-খন্দ। বেলিনগিরি নামে একটা গ্রাম আছে কাছে। ছুটছি ওদিকেই। জীবনেও এত জোরে বাইক চালাইনি, যেন কয়েকশো পিশাচ তাড়া করেছে আমাকে।
সবে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছি, চোখে পড়ল পাহাড়ি, তীব্র খরস্রোতা একটা নদীর উপর পিঠ কুঁজো একটা ছোট সেতু। গ্রানিট পাথরের সেতুটা চওড়ায় এত কম যে পাশাপাশি তিনজন মানুষও হেঁটে আসতে পারবে না। সেতুটার উপর উঠে পড়ব কিনা ভাবছি। এমন সময় …
বাইকের সামনের আলোয় দেখলাম সেতুর মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে বৃদ্ধ প্রীস্ট; অপেক্ষা করছে আমার জন্য।
ভয়ের চোটে বাইকের হ্যান্ডলবার চেপে ধরলাম, মোচড় দিলাম জোরে, সেতুতে উঠবার বদলে অগভীর স্রোত পার হবার ঝুঁকি নেওয়াটা নিরাপদ ঠেকল আমার কাছে।
বাইকের সামনের চাকা বাড়ি খেল পাথরের গায়ে, পরমুহূর্তে ছিটকে গেলাম আমি। দড়াম করে আছড়ে পড়লাম কর্দমাক্ত নদীর তীরে। ব্যথায় ফুসফুসের সমস্ত শ্বাস বেরিয়ে গেল আমার। জ্ঞান হারিয়ে ফেললাম। বোধহয় কয়েক মুহূর্ত জ্ঞান ছিল না আমার। চেতনা ফিরে পেলাম বমি বমি একটা ভাব নিয়ে। চোখ পিটপিট করে তাকালাম।
আমার মুখের কাছ থেকে ফুটখানেক দূরে দাঁড়িয়ে আছে প্রীস্ট। বর্ণহীন চোখজোড়া যেন কটমট করে চেয়ে আছে আমার দিকেই। ফোঁসফোঁস দুর্গন্ধময় নিশ্বাস ফেলছে সে। তাকে ঘিরে আছে যেন মৃত্যুর বিকট গন্ধ। আমার দিকে ঝুঁকল সে, লম্বা, নখঅলা হাতজোড়া বাড়িয়ে দিল। শক্তিশালী থাবায় চেপে ধরল গলা। ‘থামো, ডোহেনি!’
বৃদ্ধার খনখনে সেই কণ্ঠ। প্রীস্টের কাঁধের উপর দিয়ে এক ঝলক দেখতে পেলাম তাকে। ঘোমটা নেই, নরকঙ্কালের মত ভয়ঙ্কর মুখ, গাল থেকে কপাল পর্যন্ত একটা লম্বা ক্ষত, তাকিয়ে আছে বিজয় উল্লাস চোখে নিয়ে। গলার চাপ একটু কমল।
‘ও ওদের কেউ নয়, ডোহেনি। ওকে ছেড়ে দাও। আমরা যা করেছি তা সবই দেখেছে ও। সবই ওর মনে থাকবে। সবাইকে ও জানিয়েও দেবে। আর সেটাই আমি চাই। ওকে ছেড়ে দাও। চলে যাক ও।’
অবিশ্বাস্য শক্তিধর প্রীস্ট আমাকে ধরে এমন জোরে ঝাঁকি মারল যেন আমি একটা ভাঙা পুতুল।
‘ছেড়ে দাও ওকে।’ আবার আদেশ এল।
এরপরে আমার আর কিছু মনে নেই।
কতক্ষণ অজ্ঞান ছিলাম জানি না। চেতনা ফিরে পেয়ে দেখি কেউ নেই ওখানে। আমি ফুলে ওঠা কপালে আলতো করে হাত বুলালাম, টলতে টলতে সিধে হলাম। প্রথমে দু’এক মুহূর্ত মনে করতে পারিনি পাহাড়ি নদীর ধারে চিৎ হয়ে পড়েছিলাম কেন। পরে মনে পড়ে গেল সব। চারদিকে চোখ বুলালাম। বৃদ্ধ প্রীস্ট বা মহিলার চিহ্নও নেই কোথাও। পাহাড় আঁধারে ঢাকা। শুধু গাছের পাতার সরসর আর পাহাড় থেকে ছুটে আসা বাতাসের শব্দ ছাড়া আর কোন শব্দ নেই।
শক্তি ফিরে পেতে কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে রইলাম। তারপর আমার ট্রায়াম্ফ বাইকটিকে চোখে পড়ল। জলের মধ্যে পড়ে আছে। ওটাকে তুলতে গিয়ে দেখি চাকার অনেকগুলো স্পোক ছুটে গেছে। স্টার্ট দিলেও কাজ হবে না। তবু স্টার্ট দেওয়ার চেষ্টা করলাম। দুর্বল ‘ফুট’ শব্দ করে ওটা নীরব হয়ে গেল। ইঞ্জিনে পানি ঢুকে গেছে। এ আর চলবে না।
বাইকটিকে নদীর তীরে তুলে নিয়ে এলাম। তারপর এগোলাম সেতুর দিকে। বালিনাগ্রিতে হেঁটে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। আমার মাথা দপ্ দপ্ করছে ব্যথায়, চিন্তাভাবনাগুলো কেমন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। আমি যা দেখেছি তা কি সত্যি? কেউ কি অমন ভয়ঙ্কর হতে পারে? নাকি ওসব দৃষ্টিভ্রম ছিল?
ঝাড়া তিনঘণ্টা মেঠো রাস্তা দিয়ে হাঁটবার পরে সভ্যতার চিহ্ন মিলল।
গ্যারেজের আবছা কাঠামোটা ফুটে উঠল অন্ধকার ভেদ করে। এখান থেকে পেট্রল নিয়েছি আমি। টলতে টলতে এগিয়ে গেলাম ওটার দিকে, শীতে হি হি করে কাঁপছি। দরজায় কড়া নাড়লাম। কয়েক মুহূর্ত পরে গ্যারেজের সামনের ঘরের জানালা খোলার শব্দ পেলাম। ভেসে এল আলোক রেখা, সেই সাথে মানুষের গলা, ‘কে ওখানে?’
‘আমার মোটর বাইক নষ্ট হয়ে গেছে। আমি খুব বিপদের মধ্যে আছি, ‘ চেঁচিয়ে উঠলাম আমি। ‘এখানে কোন ট্যাক্সি মিলবে কিংবা রাতটা থাকার জন্যে আশ্রয়?’
‘এখন রাত তিনটা বাজে সে খেয়াল আছে?’ কঠিন গলায় বলল লোকটি।
‘আমি মুশেরামোর পাহাড় বয়ে এসেছি, ভাই। আমাকে একটু আশ্রয় দিন। অনুনয় করলাম আমি।
সজোরে জানালা বন্ধ হবার শব্দ শুনতে পেলাম। আশা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। অবশেষে নীচের জানালায় আলো দেখা গেল। তারপর খুলে গেল দরজা।
‘ভেতরে আসুন।’ বলল পুরুষ কণ্ঠ।
ঘরে ঢুকলাম। তীব্র ঠান্ডা আর কিছুক্ষণ আগের ঘটে যাওয়া ঘটনা আমাকে বিধ্বস্ত করে ফেলেছে। আমার উপর লণ্ঠনের আলো ফেলল লোকটি। চিনে ফেলল। ‘আপনিই না আজ সন্ধ্যায় ‘টিচ ড্রচ চলু’র ঠিকানা জানতে চেয়েছিলেন আমার কাছে?’
মাথা ঝাঁকালাম। এ লোকই সন্ধ্যাবেলায় আমাকে পেট্রল দিয়েছে। তার ওভারঅলের উপর নাম লেখা ছিল ‘মানুস’।
‘ঠিক বলেছেন। আমার মোটর বাইক নষ্ট হয়ে গেছে। একটা ক্যাব দরকার।’
হতবুদ্ধি ভঙ্গিতে ডানে-বামে মাথা নাড়ল সে।
‘আপনাকে খুব পরিশ্রান্ত লাগছে।’ কাবার্ড থেকে এক বোতল জেমিসন আর একটা গ্লাস নিয়ে এল সে। ‘এটা খেলে একটু চাঙা হয়ে উঠবেন।’ হুইস্কি ঢেলে গ্লাসটা আমার হাতে ধরিয়ে দিল সে।
‘এত রাতে ‘টিচ ড্রচ চলু’তে কী করছিলেন? আপনি ভূতের ওঝা নাকি?’ জবাবের অপেক্ষা না করে সে বলতে লাগল, ‘আমি ম্যাক্রুমে ফোন করে দিচ্ছি। ট্যাক্সি চলে আসবে। কোথায় যাবেন?
‘কর্ক সিটিতে।’
‘বাইক নষ্ট হয়েছে কোথায়?’
‘পাহাড়ের কাছে, একটা নদীর ধারে। নদীর ওপর সেতু আছে।’
‘জায়গাটা চিনি আমি। কাল সকালে আপনার বাইক নিয়ে আসব। আপনার যোগাযোগের নাম্বারটা দিন। বাইকের কী ক্ষতি হয়েছে ফোনে জানিয়ে দেব।’
আমি মাথা দোলালাম। হুইস্কির গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে ভুরু কুঁচকে তাকালাম তার দিকে।
‘আমি ভূতের ওঝা কিনা জিজ্ঞেস করলেন কেন?’
‘আপনি যে ‘টিচ ড্রচ চলু’র খবর জানতে চাইলেন। স্থানীয়রা ও নামেই ডাকেও বাড়িকে। বাড়িটির পৈশাচিক কুখ্যাতি রয়েছে। অনেকেই বলে ওটা ভূতুড়ে বাড়ি। দুর্ভিক্ষের সময়ে যে ক’টা কটেজ টিকে ছিল ওটা তার একটা।’ অবিশ্বাসে মাথা নাড়লাম আমি, চুমুক দিলাম হুইস্কিতে। ঠান্ডা শরীরে তরল আগুনটা বেশ উষ্ণতা জোগাচ্ছে। ‘আমি ফাদার নেসান ডোহেনিকে খুঁজতে গিয়েছিলাম,’ ব্যাখ্যা করলাম।
অবাক চোখে তাকাল লোকটি আমার দিকে, তারপর হেসে উঠল চাপা গলায়।
‘তা হলে আমি ঠিকই ধরেছি, কী বলেন? নিশ্চয়ই তার খোঁজ পাননি?’ গরম হওয়ার জন্য দু’হাতের তালু ঘষছিলাম। থেমে গেলাম। অবাক গলায় প্রশ্ন করলাম, ‘মানে?’
‘মানে ফাদার নেসান’ ডোহেনি একশো ষাট বছর আগে মারা গেছেন। বরফ জলের একটা স্রোত নেমে গেল আমার শিরদাঁড়া বেয়ে।
‘একশো ষাট বছর আগে মারা গেছেন?’
‘হ্যাঁ। কেন আপনি জানেন না গল্পটা? দুর্ভিক্ষের সময় তিনি লোকজন নিয়ে মুশেরামোর প্রাসাদে গিয়েছিলেন লর্ড মুশেরামোরের কাছে গ্রামের চাষাদের জন্যে সাহায্য চাইতে, তাদেরকে যেন গৃহহীন হতে না হয় সে ব্যাপারে অনুরোধ করতে। লর্ড মুশেরামোর ম্যালো থেকে সৈন্য ডেকে পাঠান এবং প্রাসাদের লনে হাঁটু গেড়ে বসে থাকা লোকগুলোর ওপর সেনাবাহিনীকে লেলিয়ে দেন। ফাদার নেসান ডোহেনি তাঁর সঙ্গীদের সহ তরবারির আঘাতে ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারিয়েছেন।’
জোরে ঢোক গিললাম আমি।
‘আর…আর ব্রিড কাপিনের কী হয়েছিল?’
লোকটি এবার গলা ছেড়ে হাসল।
‘আপনি তা হলে পুরানো কিংবদন্তীর খবরও জানেন! অবশ্য জানারই কথা। স্থানীয়রা বলে ‘টিচ ড্রচ চলু’ ছিল ওই বৃদ্ধার পুরানো কুটির। সবই অবশ্য কিংবদন্তীর অংশ। আমার অন্তত তাই মনে হয়। কিংবদন্তী ছাড়া কিছু নয়। বেচারা ফাদার ডোহেনি আর ডাইনি ব্রিড কাপিন মারা গেছে বহু আগে। যদিও শোনা যায়, এক বুড়ি এক প্রীস্টের লাশকে নাকি আবার বাঁচিয়ে তুলেছিল লর্ড মুশেরামোর আর তার বংশকে নির্বংশ করার প্রতিশোধের নেশায়। ঈশ্বর রক্ষা করুন আমাদেরকে!’ সে ক্রুশ আঁকল বুকে। ‘এ আসলে কিংবদন্তী ছাড়া অন্য কিছু নয়।’