দ্য গ্রে ম্যাটার – স্টিফেন কিং

দ্য গ্রে ম্যাটার – স্টিফেন কিং

সারা হপ্তা ধরে উত্তুরে হাওয়া বইবার কথা বলছিল ওরা। বিষ্যুদবার হামলে পড়ল ঝড়। বিকেল চারটার মধ্যে আট ইঞ্চি তুষার জমে উঠল রাস্তায়, থামার কোনও লক্ষণ নেই। আমরা অভ্যাসমত বিকেল পাঁচটা/ছ’টার দিকে হাজির হয়ে গেলাম হেনরি’র ‘নাইট আউল’-এ। ব্যাঙ্গোরের এই একটাই মাত্র দোকান যা ঘড়ির কাঁটায় কাঁটায় খোলে।

হেনরি কেউকেটা কোনও ব্যবসায়ী নয়, কলেজ ছাত্রদের কাছে বিয়ার আর মদ বিক্রি করে। আমাদের মত অকর্মার ধাড়িদের আড্ডার চমৎকার জায়গা হেনরির বার।

আজ বিকেলে হেনরি বসেছে কাউন্টারে। আমি, বিল পেলহ্যাম, বার্টি কনরস আর কার্ল লিটলফিল্ড ঘিরে বসেছি চুল্লি। বাইরে, ওহায়ো স্ট্রীটে কোনও গাড়ি চলছে না। বৈদ্যুতিক লাঙল দিয়েও জমাটবাঁধা তুষার কাটতে গলদঘর্ম হয়ে যাচ্ছে লোকগুলো। শোঁ শোঁ শব্দে বইছে প্রবল হাওয়া। ডাইনোসরের মেরুদণ্ডের মত উঁচু আর স্তূপ হয়ে আছে তুষার বাড়িঘরের ছাদে।

হেনরির দোকানে আজ বিকেলে খদ্দের বলতে মোটে তিনজন-অবশ্য কানা এডিকে যদি এর কাতারে ফেলা যায়। এডির বয়স সত্তরের কাছাকাছি, পুরোপুরি অন্ধ নয় সে। হপ্তায় দু’তিনদিন আসে সে এখানে। কোটের নীচে ব্রেড লুকিয়ে নিয়ে বেরিয়ে যায়, ‘তোমাদেরকে আবার কেমন বোকা বানালাম’ এমন ভাব নিয়ে। হেনরি এডিকে পছন্দ করে বলে তার কাছ থেকে কখনোই রুটির দাম রাখে না।

আমরা বসে আড্ডা দিচ্ছি, হঠাৎ দড়াম করে খুলে গেল দরজা, ঠাণ্ডা হাওয়ার ঝাপটা নিয়ে। টলতে টলতে ভিতরে ঢুকল এক কিশোর। মেঝেতে পা ঠুকে জুতো থেকে বরফ ঝাড়ছে। ওকে দেখেই চিনে ফেললাম। রিচি গ্রেনাডাইনের ছেলে। চেহারায় তীব্র উৎকণ্ঠা। মুখ ফ্যাকাসে। কণ্ঠমণি ওঠানামা করছে, ঘন ঘন ঢোক গিলছে বলে।

‘মি, পার্মালি,’ হেনরির উদ্দেশে বলল সে, চোখের মণি ঘুরছে সকেটের মধ্যে। ‘আপনাকে এখুনি একবার আসতে হবে। ওঁর জন্য বিয়ার নিয়ে যাব। আমি ও বাড়িতে আর ফিরতে চাই না। আমার ভয় লাগছে।

‘একটু সুস্থির হয়ে বসো,’ কসাই’র সাদা অ্যাপ্রনটা খুলে রেখে কাউণ্টার ঘুরে এল হেনরি। ‘কী হয়েছে? তোমার বাবা মাতাল হয়ে গেছে?’

হেনরির কথায় বুঝলাম রিচি বেশ কয়েকদিন ধরে ওর দোকানে আসছে না। প্রতিদিনই ওর একটা বিয়ার চাই, সবচেয়ে সস্তাটা কিনবে সে। বিশালদেহী, মোটকু রিচি বিয়ার খেতেও পারে। ক্লিফটনের করাত-কলে কাজ করত সে। কিন্তু কী একটা ভুলের অপরাধে চাকরিটা চলে যায়। করাত–কল কোম্পানি অবশ্য ওকে ক্ষতিপূরণ দিয়েছিল। চাকরি ছাড়ার পর থেকে সারাদিন বিয়ার খেতে খেতে আরও ফুলেছে রিচি। এখন ছেলেকে পাঠায় বিয়ার কিনতে।

‘বাবা মাতাল হয়েছে,’ শুনতে পেলাম ছেলেটা বলছে। ‘কিন্তু সমস্যা সেটা নয়। সমস্যা…সমস্যা….ওহ্ ঈশ্বর, ব্যাপারটা ভয়ঙ্কর!’

হেনরি কার্লকে বলল, ‘কার্ল, তুমি এদিকে দু’মিনিট খেয়াল রাখতে পারবে?’

‘অবশ্যই।’

বেশ। টিমি স্টকরুমে চলো। শুনি কী হয়েছে।’

ছেলেটাকে নিয়ে চলে গেল হেনরি। কার্ল কাউন্টারে এসে বসল হেনরির টুলে। কেউ কিছুক্ষণ কোনও কথা বলল না। আমরা হেনরির গভীর, ধীর গলা শুনতে পেলাম। টিমি উত্তেজিত ও দ্রুত কণ্ঠে কথা বলছে। তারপর ফুঁপিয়ে উঠল সে।

বিল পেলহ্যাম গলা খাঁকারি দিয়ে পাইপে তামাক ভরতে লাগল। ‘রিচিকে অনেকদিন দেখি না।’ বললাম আমি।

ঘোঁত ঘোঁত করে উঠল বিল, ‘তাতে কিছু আসে যায় না।’

‘অক্টোবরের শেষে একবার এসেছিল,’ জানাল কার্ল। ‘হ্যালোইনের সময়। এক কেস বিয়ার কিনল। দিনদিন ফুলে যাচ্ছিল ও।’

তারপর আর কিছু বলার মত পেলাম না। ছেলেটা এখনও কাঁদছে। তবে কাঁদতে কাঁদতে কথাও বলছে। বাইরে গর্জন ছাড়ছে বাতাস, দরজা-জানালায় চাবুক কষাচ্ছে। রেডিওতে বলল সকালের মধ্যে আরও ছয় ইঞ্চি পুরু হয়ে বরফ পড়বে। এখন জানুয়ারির মাঝামাঝি। ভাবছিলাম অক্টোবরের পর থেকে রিচির চেহারা আদৌ কেউ দেখেছি কিনা।

আরও কিছুক্ষণ ছেলেটার সঙ্গে কথা বলল হেনরি। তারপর ওকে নিয়ে বেরিয়ে এল। ছেলেটা কোট খুলে ফেলেছে তবে হেনরি তার কোট গায়ে চাপিয়েছে। ছেলেটার বুক হাপরের মত ওঠা-নামা করছে, চোখ লাল।

হেনরিকে উদ্বিগ্ন দেখাল ‘টিমিকে ওপরে পাঠিয়ে দিচ্ছি আমি। ওর খিদে পেয়েছে। আমার বউ ওকে খাইয়ে দেবে। আমি রিচির বাসায় যাব।’

‘তোমরা কেউ আমার সঙ্গে চলো। টিমি বলল ওর বাপের বিয়ার লাগবে। টাকাও দিয়েছে।’ হাসার চেষ্টা করল হেনরি, কিন্তু হাসি ফুটল না মুখে।

‘কী বিয়ার?’ জানতে চাইল বার্টি। ‘আমি নিয়ে আসি।’

‘হ্যারোস সুপ্রিম’, বলল হেনরি। ‘কয়েকটা প্যাাকেট আছে ওখানে।’

আমি উঠে পড়লাম। হেনরির সঙ্গে বার্টি যাবে, আমাকেও যেতে হবে। ঠাণ্ডায় কার্লের বাতের ব্যথাটা বেড়েছে। আর বিলি পেলহ্যাম এখানেই থাকছে।

বার্টি হ্যারোস-এর চারটা প্যাকেট নিয়ে এল। ওগুলো বাক্সে ভরলাম আমি। হেনরি দোতলায়, ওর বাসায় নিয়ে গেল ছেলেটাকে। টিমিকে বউয়ের কাছে রেখে নেমে এল নীচে। মাথা ঘুরিয়ে দেখে নিল সিঁড়ির দরজাটা বন্ধ আছে কিনা। বিলি প্রায় চেঁচিয়ে উঠল, ‘হয়েছেটা কী? রিচি মেরেছে ছেলেটাকে?

‘না’, বলল হেনরি। ‘আমি এখনই কিছু বলতে চাই না। শুনলে পাগলের প্রলাপ মনে হবে। তবে একটা জিনিস দেখাচ্ছি। টিমি বিয়ারের দাম দেয়ার জন্য যে টাকাটা এনেছে ওটা দেখো।’ পকেট থেকে চারটে ডলার বের করল হেনরি, রাখল কাউন্টারের কিনারে। টাকাগুলোর গায়ে ধূসর, পিচ্ছিল, ঘিনঘিনে কী একটা জিনিস লেগে আছে। কার্লকে বলল, ‘এ টাকা কেউ যেন না ছোঁয়। ছেলেটা যা বলেছে তার অর্ধেকও যদি সত্যি হয় এ টাকায় হাত দেয়া যাবে না।’

মাংসের কাউন্টারে গিয়ে সিঙ্কে হাত ধুয়ে নিল হেনরি।

আমি গায়ে কোট চাপালাম, গলায় মাফলার বেঁধে নিলাম। গাড়ি নিয়ে লাভ হবে না, তুষার ঠেলে যেতে পারব না। রিচি কার্ভ স্ট্রিটের একটি অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিং-এ থাকে। এখানে থেকে হাঁটা পথের দূরত্ব।

‘আমরা বেরুচ্ছি, বিল পেলহ্যাম বলল, ‘সাবধানে যেয়ো।’ হেনরি শুধু মাথা ঝাঁকাল। হ্যারোস-এর বিয়ারের কেস ছোট একটি হ্যান্ডকার্টে রেখেছে, দরজার ধারে। আমরা বেরিয়ে পড়লাম।

করাতের ব্লেডের মত বাতাস যেন পোচ দিল গায়ে। মাফলারটা দিয়ে মাথা ঢেকেঢুকে নিলাম আমি। বার্টি দ্রুত মোজা পরে নিল।

‘আমি তোমাদেরকে ভয় দেখাতে চাই না’, বলল হেনরি, মুখে অদ্ভুত হাসি। তবে যেতে যেতে বলব ছেলেটার গল্প… কারণ ঘটনাটা তোমাদের জানা দরকার।’

কোটের পকেট থেকে ৪৫ ক্যালিবারের একটা পিস্তল বের করল হেনরি। ১৯৫৮ সাল থেকে দিন-রাত চব্বিশঘন্টা গুলি ভরা পিস্তলটা প্রস্তুত থাকে কাউন্টারের নিচে। একবার এক লোক মাস্তানি করতে এসেছিল হেনরীর সঙ্গে। লোকটাকে পিস্তল তুলে দেখানো মাত্র কেটে পড়েছিল সুড়সুড় করে। আরেকবার এক কলেজে পড়া ছোকরা চাঁদা চাইতে এসেছিল। তারপর এমন ভাবে সে ছুটে পালায়, যেন ভূতে তাড়া করেছে।

প্রচন্ড ঝড়ো হাওয়ার মধ্যে বেরিয়ে পড়েছি তিনজন। কার্ট ঠেলতে ঠেলতে ছেলেটার গল্প বলল হেনরি। ছেলেটা বলেছে ঘটনার সূত্রপাত নিশ্চয় কোন বিয়ারের ক্যান থেকে। কিছু কিছু বিয়ার খুব বাজে স্বাদের হয়। একবার এক লোক আমাকে বলেছিল বিয়ারের কৌটায় অত্যন্ত ক্ষুদ্র ছিদ্র থাকলেও তা দিয়ে ব্যাকটেরিয়া ঢুকে দ্রুত সব কান্ড ঘটাতে পারে। এসব ব্যাকটেরিয়া বিয়ার খেয়ে বেঁচে থাকে।

যা হোক, ছেলেটা বলল অক্টোবরের এক রাতে রিচি গোল্ডেন লাইট- এর এক কেস বিয়ার কিনে বাসায় ফেরে। সে বিয়ার খাচ্ছিল আর টিমি ব্যস্ত ছিল স্কুলে হোমওয়ার্ক নিয়ে।

টিমি ঘুমাতে যাবে, এমন সময় শুনতে পেল তার বাপ বলছে, ‘ক্রাইস্ট জেসাস, জিনিসটা ভাল না।’

টিমি জিজ্ঞেস করল, ‘কী হয়েছে, বাবা?’

‘ওই বিয়ার।’ বলল রিচি। ‘ঈশ্বর, এরকম বাজে স্বাদের বিয়ার জীবনেও খাইনি আমি।’

রিচির মত বিয়ারখেকো মানুষ দ্বিতীয়টি দেখিনি। একবার বিকেলে ওয়ালি স্পাতে ওকে দেখেছি বাজি ধরে বিয়ার খেতে। সে এক লোকের সঙ্গে বাজি ধরেছিল এক মিনিটে বাইশ গ্লাস বিয়ার সাবাড় করবে। স্থানীয় কেউ ওর সঙ্গে বাজি ধরার সাহস পায় না। কিন্তু এ লোকটা এসেছিল মন্টপেলিয়ের থেকে। সে কুড়ি ডলার বাজি ধরে। রিচি তিপ্পান্ন সেকেন্ডে কুড়িটি বিয়ার সাবড়ে দেয়। তারপরও বার ছেড়ে যাওয়ার সময় ওকে বিন্দুমাত্র টলতে দেখিনি

‘আমার বমি আসছে’, বলল রিচি। ‘সাবধান!’

টিমি বলল সে বিয়ারের ক্যানের গন্ধ শুঁকেছে। মনে হয়েছে ভিতরে কিছু একটা নড়াচড়া করছে। তারপর আর ওটার কোনও সাড়াশব্দ নেই। ক্যানের মাথায় ধূসর রঙের একটা বুদ্বুদ দেখেছে টিমি।

দিন দুই পরে ছেলেটা স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে এসে দেখে রিচি টিভি দেখছে। অবাক হলো সে। কারণ তার বাপ ন’টার আগে কখনও বাড়ি ফেরে না।

‘কী ব্যাপার?’ জিজ্ঞেস করল টিমি।

‘ব্যাপার কিছু না। টিভি দেখছি’, জবাব দিল রিচি। ‘আজ আর বেরুতে ইচ্ছে করল না।’

সিঙ্কের বাতি জ্বালিয়েছে টিমি, খেঁকিয়ে উঠল রিচি। ‘বাতি নেভা!’

টিমি বাতি নেভাল, জানতে চাইল না বাতি ছাড়া অন্ধকারে সে হোমওয়ার্ক করবে কীভাবে। রিচির মেজাজ খারাপ হলে তার সঙ্গে কথা বলা যায় না।

‘দোকান থেকে আমার জন্য একটা বিয়ার কিনে নিয়ে আয়’, হুকুম করল রিচি। টাকা টেবিলের উপর রাখা আছে।’

ছেলেটা বিয়ার নিয়ে ফিরে এসে দেখে বাপ তখনও বসে রয়েছে অন্ধকারে। টিভি অফ করা। গা ছমছম করে ওঠে ছেলেটার। অবশ্য অন্ধকারে ফ্ল্যাটে বড়সড় একটা পিণ্ডের মত বাপকে ঘরের কোণে বসে থাকতে দেখলে কে না ভয় পাবে?

টিমি টেবিলের উপর বিয়ারের ক্যান রাখল। বাপের সামনে আসা মাত্র ভক্ করে পচা একটা গন্ধ নাকে ধাক্কা মারল তার। পচা চিজের বিটকেলে গন্ধ। কিন্তু বাপকে এ ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞেস করতে সাহস পেল না টিমি। দরজা বন্ধ করে হোমওয়ার্ক নিয়ে বসল। কিছুক্ষণ পর শুনল চালু হয়েছে টিভি, সেই সাথে বিয়ারের ক্যান খুলছে রিচি।

হপ্তা দুই এরকমই চলল। ছেলেটা সকালে উঠে স্কুলে যায়। স্কুল থেকে ফিরে এসে দেখে তার বাপ টিভির সামনে বসে বসে আছে, টেবিলের উপর বিয়ার কেনার টাকা।

একদিন বিকেল চারটা নাগাদ বাসায় ফিরেছে টিমি-ততক্ষণে বাইরেটা কালো হয়ে এসেছে-রিচি হুকুম করল, ‘আলো জ্বেলে দে।’ সিঙ্কের বাতি জ্বালল টিমি। দেখল বাপ কম্বল মুড়ি দিয়ে বসা।

‘দেখ’, বলে কম্বলের নিচে থেকে একটা হাত বের করে আনল রিচি। তবে ওটা হাত নয়। ধূসর রঙের একটা মাংসপিণ্ড। আঁতকে উঠল টিমি | জিজ্ঞেস করল, ‘বাবা, তোমার কী হয়েছে?’

রিচি জবাব দিল, ‘জানি না। তবে ব্যথা লাগছে না বরং…ভালই লাগছে।’

টিমি বলল, ‘আমি ডাক্তার ওয়েস্টফেলকে ডেকে আনি।’ তখন কম্বলটা ভয়ানক কাঁপতে শুরু করল, যেন ওটার নিচে প্রবল বেগে কিছু ঝাঁকি খাচ্ছে। রিচি বলল, ‘খবরদার, ডাক্তারের কাছে যাবি না। সে চেষ্টা করলে তোকে আমি ধরে ফেলব। তারপর তোর দশা হবে এরকম। বলে মুখের উপর থেকে কম্বলটা সরিয়ে ফেলল রিচি।

আমরা এতক্ষণে হার্লো ও কার্ভোস্ট্রিটের মোড়ে চলে এসেছি। শুধু ঠাণ্ডা নয়, ভয়েও গা-টা কেমন হিম হয়ে আছে আমার। এরকম গল্প হজম করা মুশকিল। তবে কিনা পৃথিবীতে অনেক আজব ঘটনাই ঘটে। জর্জ কেলসো নামে এক লোককে চিনতাম আমি। ব্যাঙ্গর পাবলিক ওয়ার্কস ডিপার্টমেন্টে কাজ করত। পনেরো বছর সে কাটিয়েছে মাটির নিচে পানির পাইপ আর বৈদ্যুতিক তার মেরামতের কাজে। অবসর নেয়ার তখন মাত্র দু’বছর বাকি। একদিন সে চাকরিটা ছেড়ে দিল। ফ্রল্কি হ্যাল্ডম্যান ওকে চিনতো। সে বলেছে জর্জ একদিন এসেক্সের একটি ড্রেনের পাইপ সারাতে হাসি মুখে, স্বভাবসুলভ ঠাট্টা মশকরা করতে করতে মাটির নিচে গিয়েছিল। পনেরো মিনিট পর যখন সে উপরে উঠে এল, তার সমস্ত চুল বরফের মত সাদা, চাউনি দেখে মনে হচ্ছিল নরক দর্শন করে এসেছে। সে সোজা ওয়ালি’র স্পাতে ঢুকে আকণ্ঠ মদপান শুরু করে। মদ খেয়ে খেয়ে দু’বছরের মাথায় মারা যায় জর্জ। ফ্রাঙ্কি ওর সঙ্গে কথা বলে জানার চেষ্টা করেছিল সিউয়ার পাইপে কী দেখে ভয় পেয়েছে জর্জ। জর্জ ফ্রাঙ্কিকে জিজ্ঞেস করেছিল সে কোনদিন কুকুর সাইজের মাকড়সা দেখেছে কিনা। ঘটনা কতটা সত্য আর কতটা অতিরঞ্জিত আমি জানি না, তবে পৃথিবীতে নিশ্চয় এমন ঘটনা ঘটে যা সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষকেও পাগল বানিয়ে ছাড়ে।

আমরা রাস্তার মোড়ে মিনিট খানেকের জন্য দাঁড়ালাম। যদিও তীব্র ঠাণ্ডা বাতাসের চাবুক আছড়ে পড়ছে গায়ের উপর।

‘টিমি কী দেখল? জিজ্ঞেস করল বাটিং।

‘টিমি বলেছে ও ওর বাপকেই দেখেছে,’ জবাব দিল হেনরি। তবে সারা গায়ে ধূসর জেলি মাখা। পরনের জামাকাপড় যেন গলে গিয়ে লেগে ছিল শরীরের সঙ্গে।’

‘ঈশ্বর!’ বলল বাৰ্টি

‘রিচি আবার কম্বল দিয়ে মুড়ে নেয় নিজেকে এবং বাতি নিভিয়ে দেয়ার জন্য চেঁচাতে থাকে বাচ্চাটার উদ্দেশে।’

‘ফাঙ্গাস বা ছত্রাকের মত দেখাচ্ছিল বোধহয় ওকে,’ মন্তব্য করলাম আমি।

‘হ্যাঁ,’ সায় দিল হেনরি। ‘অনেকটা সেরকমই।’

‘পিস্তলটা রেডি রেখো,’ বলল বার্টি।

‘রেডি আছে,’ বলল হেনরি। আমরা আবার হাঁটা দিলাম।

রিচি গ্রেনাডাইনের অ্যাপার্টমেন্ট হাউজটি পাহাড়ের প্রায় চূড়োতে, ভিক্টোরিয়ান আদলে গড়া। এগুলোকে এখন অ্যাপার্টমেন্ট হাউজে রূপান্তর ঘটানো হচ্ছে। বার্টি হাঁপাতে হাঁপাতে বলল রিচি তিনতলায় থাকে। আমি সুযোগ বুঝে হেনরির কাছে জানতে চাইলাম এরপরে বাচ্চাটার কী হলো।

নভেম্বরের তৃতীয় হপ্তায়, এক বিকেলে বাচ্চাটা বাসায় এসে দেখে তার বাপ প্রতিটি জানালা চাদর দিয়ে ঢেকে দিচ্ছে। ঘর থেকে বদ গন্ধটার তীব্রতা বেড়েছে আরও, কেমন ফল পচা গন্ধ।

সপ্তাহখানেক ধরে রিচি তার ছেলেকে দিয়ে চুল্লিতে বিয়ার গরম করাল। ভাবা যায়? বেচারা দিনের পর দিন ওই বাড়িতে বসে চুল্লিতে বিয়ার গরম করছে আর শুনছে চুক চুক করে তা পান করছে তার বাপ।

এরকম চলল আজতক পর্যন্ত। আজ বাচ্চাটা ঝড়ো হাওয়ার কারণে ছুটি পেয়ে তাড়াতাড়ি চলে এসেছিল বাসায়।

‘ছেলেটি বলেছে সে সোজা ঘরে ঢুকে পড়ে,’ আমাদেরকে বলল হেনরি। ‘উপরতলায় হলঘরে একটি বাতিও জ্বলছিল না-টিমির ধারণা ওর বাপ সবগুলো বাল্ব ভেঙে রেখেছে। তাই প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে দরজার সামনে আসতে হলো ওকে।’

‘এমন সময় শুনতে পেল কিছু একটা নড়াচড়া করছে ওখানে, হঠাৎ টিমির মনে পড়ল তার বাপ সারাদিন কী করে সে সম্পর্কে সে কিছুই জানে না। বাপকে সে গত একমাসে বলতে গেলে চেয়ার ছেড়ে নড়তেই দেখেনি। তার কি বাথরুমে যাওয়ারও প্রয়োজন হয় না!

দরজার মাঝখানে একটা ফুটো ছিল। ফুটোর মধ্যে আঙুল ঢুকিয়ে কৌশলে ছিটকিনি খুলে ফেলল টিমি। তারপর একটা চোখ রাখল ফুটোতে।

আমরা রিচির বাড়ির সামনে চলে এসেছি। আমাদের সামনে উঁচু, নোংরা একটা মুখের মত ঝুলে আছে বাড়িটি। তিনতলার জানালা বন্ধ। অন্ধকার। যেন কেউ কালো রঙ মেখে দিয়েছে জানালায়, যাতে বাইরে থেকে ভিতরে কী হচ্ছে বোঝা না যায়।

অন্ধকারে চোখ সইয়ে নিতে কয়েক মুহূর্ত সময় লাগল টিমির। তারপর প্রকাণ্ড ধূসর একটা পিণ্ড দেখতে পেল সে, মানুষের আকৃতির মত নয় মোটেই, মেঝের উপর গড়িয়ে চলছে, পিছনে রেখে আসছে ধূসর, পিচ্ছিল একটা চিহ্ন। সাপের মত একটা হাত বাড়িয়ে দিল ওটা-দেয়াল থেকে টান মেরে খুলে নিল একটা তক্তা। দেয়ালের গর্ত থেকে টেনে আনল একটা বেড়াল। এক মুহূর্ত বিরতি দিল হেনরি। তারপর বলল, ‘একটা মরা বেড়াল। পচা। গায়ে কিলবিল করছিল সাদা সাদা পোকা…’

‘থামো,’ কাতরে উঠল বার্টি।

ঈশ্বরের দোহাই লাগে বেড়ালটা খেয়ে ফেলে রিচি।

ঢোক গেলার চেষ্টা করলাম, দলা দলা কী যেন ঠেকল গলায়। ‘তখন টিমি এক ছুটে পালিয়ে আসে ওখান থেকে,’ সমাপ্তি টানল হেনরী।

‘ওখানে আর যেতে পারব বলে মনে হচ্ছে না,’ বলল বার্টি। হেনরি কোনও মন্তব্য করল না। বার্টি আর আমার উপর চোখ বুলাল শুধু।

‘যাব,’ বললাম আমি। ‘রিচির জন্য বিয়ার নিয়ে এসেছি না!’ বার্টি আর কিছু বলল না। আমরা সিঁড়ি বেয়ে সামনের হলরুমের দরজায় চলে এলাম। সঙ্গে সঙ্গে নাকে ধাক্কা দিল গন্ধটা।

কী যে বিশ্রী, ভয়ঙ্কর বোটকা গন্ধ! বমি ঠেলে এল গলায়।

হলঘরের নীচে একটা মাত্র হলুদ বাতি জ্বলছে টিমটিম করে। সিঁড়িগুলো উঠে গেছে উপরে, মিশেছে অন্ধকারে।

হেনরি তার কার্ট থামাল। ও বিয়ারের কেস তুলছে, আমি নিচের সিঁড়ির বোতামটা চেপে ধরলাম। দোতলার ল্যান্ডিং বাল্ব জ্বলে উঠবে। কিন্তু জ্বলল না। টিমি ঠিকই বলেছে সবগুলো বাল্ব ভেঙে রেখেছে ওর বাপ

বার্টি কাঁপা গলায় বলল, ‘আমি বিয়ার নিয়ে যাই। তুমি পিস্তল রেডি রাখো।’

আপত্তি করল না হেনরি। পিস্তল বাগিয়ে আগে আগে চলল। আমি ওর পিছনে, আমার পিছনে বিয়ার হাতে বার্টি। দোতলার ল্যান্ডিং-এ উঠে এলাম, গন্ধের তীব্রতা বাড়ল আরও। পচা আপেলের গন্ধ।

‘প্রতিবেশীরা এই লোকটাকে লাথি মেরে দূর করে দিচ্ছে না কেন?’ জিজ্ঞেস করলাম আমি।

‘কীসের প্রতিবেশী?’ পাল্টা প্রশ্ন করল হেনরি। ‘এ গন্ধে ভূত পালাবে। কে যাবে ওকে লাথি মেরে দূর করে দিতে?’

তিনতলায় উঠছি আমরা। এ তলার সিঁড়িগুলো আগেরগুলোর চেয়ে সরু এবং খাড়া। গন্ধে নাড়িভুঁড়ি উল্টে আসার জোগাড়। উপরতলায় ছোট একটি হল, একটা দরজা দেখতে পেলাম, দরজার মাঝখানে ছোট একটি ফুটো। বার্টি প্রায় আর্তনাদ করে উঠল, ‘দেখো, কীসের মধ্যে এসেছি।’

হলঘরের মেঝেতে থকথকে পিচ্ছিল একটা জিনিস, ছড়িয়ে আছে সমস্ত জায়গায়। ছোট ছোট গর্ত এখানে-সেখানে। মনে হলো মেঝেতে এক সময় কার্পেট পাতা ছিল, কিন্তু ধূসর জিনিসটা ওটা খেয়ে ফেলেছে।

হেনরি দরজার সামনে গেল, আমরা ওর পিছু নিলাম। বার্টির কথা জানি না, তবে ভিতরে ভিতরে ভয়ানক কাঁপুনি উঠে গেছে আমার। হেনরি পিস্তলের কুঁদো দিয়ে বাড়ি মারল দরজার। ‘রিচি?’ ডাকল সে, কণ্ঠ শুনে মনে হলো না একচুলও ভয় পেয়েছে। যদিও মুখ কাগজের মত সাদা। ‘আমি নাইট আউল-এ হেনরি পার্মালি। তোমার বিয়ার নিয়ে এসেছি।’

পুরো এক মিনিট কোনও সাড়া নেই, তারপর বলে উঠল একটা কণ্ঠ, ‘টিমি কোথায়? আমার ছেলে কই?’ ভয়ের চোটে প্রায় দৌড় দিতে যাচ্ছিলাম। ওটা মোটেই মানুষের কণ্ঠ নয়। ঘরঘরে, অপার্থিব, ভৌতিক একটা আওয়াজ।

‘ও আমার দোকানে আছে’, বলল হেনরি। ‘খানা খাচ্ছে। ও না খেতে পাওয়া বেড়ালের মতই হাড্ডিসার হয়ে গেছে।’

এক মুহূর্ত কিছুই শোনা গেল না, তারপর ভয়ঙ্কর একটা ঘরঘরে শব্দ ভেসে এল। আত্মা কাঁপিয়ে দেয়া গলাটা দরজার ওপাশ থেকে বলল, ‘দরজা খুলে বিয়ারটা ভিতরে ঠেলে দাও। আমি খুলতে পারব না।’

‘এক মিনিট’, বলল হেনরি। ‘এ মুহূর্তে তোমার কী অবস্থা, রিচি?’

‘তা দিয়ে তোমার দরজার নেই’, বলল কণ্ঠটা, ‘বিয়ার দিয়ে চলে যাও।’

‘মরা বেড়ালে আর তাই চলছে না, তাই না? বলল হেনরি। হাতে বাগিয়ে ধরল পিন্তল।

বিদ্যুৎ চমকের মত একটা ঘটনা মনে পড়ে গেল হেনরির কথাটা শুনে। গত তিন হপ্তায় দুটি তরুণী আর এক বুড়ো সৈনিক নিখোঁজ হয়েছে-সকলেই সন্ধ্যার পরে।

‘হয় বিয়ার দাও, নয়তো আমি নিজেই বেরিয়ে আসব’, বলল ভয়ঙ্কর কণ্ঠ। হেনরি আমাদেরকে ইশারা করল পিছু হঠতে। আমরা তাই করলাম। ‘ইচ্ছে হলে আসতে পারো, রিচি’, পিস্তল কক্ করল হেনরি।

ঠিক তখন প্রচণ্ড ধাক্কায় খুলে গেল দরজা। বেরিয়ে এল রিচি। তারপর এক সেকেন্ড, মাত্র এক সেকেন্ড দৃশ্যটা দেখলাম, তারপর তিন তলা থেকে লাফাতে লাফাতে নীচে চলে এলাম আমি আর বার্টি একেকবারে চার/পাঁচটা সিঁড়ি টপকে। বরফের উপর ডিগবাজি খেয়ে পড়লাম। হাঁচড়ে পাচড়ে উঠে দিলাম ছুট।

ছুটতে ছুটতে শুনলাম হেনরির পিস্তলের আওয়াজ। পরপর তিনবার। আমি এক বা দুই সেকেন্ডের জন্য যে দৃশ্য দেখেছি তা জীবনেও ভুলব না। জেলির প্রকান্ড একটা ঢেউ, অনেকটা মানুষের আকারের: থকথকে, পিচ্ছিল একটা জিনিস পিছনে ফেলে এগিয়ে আসছিল।

তবে ওর চেয়েও ভয়ঙ্কর ব্যাপার ছিল। ওটার চোখ হলুদ, বুনো, আর সমতল, তাতে মানুষের আত্মার চিহ্ন নেই। তবে চোখ দুটো নয়। চারটে। জিনিসটা মাঝখানে, দু’জোড়া চোখের মধ্যে সাদা, আঁশের মত গোলাপি মাংসখণ্ড কিলবিল করছিল।

ওটা ভাগ হয়ে যাচ্ছিল একটা থেকে দুটো। আমি আর বার্টি দোকানে ফিরে এলাম একটিও বাক্য বিনিময় না করে। জানি না ও কী ভাবছে, তবে আমার দুই ঘরের নামতা মনে পড়ে যাচ্ছিল। দু’দুগুণে চার, চার দু’গুণে আট দু’গুণে ষোলো, ষোলো দু’গুণে-

আমাদেরকে দেখে লাফিয়ে উঠল কার্ল আর বিল পেলহ্যাম। ঝড়ের বেগে প্রশ্ন করতে লাগল। তবে দু’জনের দু’জনের কেউ কিছু বললাম না। অপেক্ষা করছি হেনরির জন্য। ও ফিরে আসে নাকি ওটা, দেখব। আশা করি হেনরিই ফিরে আসবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *