দ্য আইল্যান্ড অব ইভিল – ভারনন রুথ

দ্য আইল্যান্ড অব ইভিল – ভারনন রুথ

বনেদি পত্রিকা মেডিকোয় বিজ্ঞাপনটা আমার চোখে পড়েছিল। এবং যেহেতু সে সময়েই আমি কিছু মৌলিক গবেষণার সুযোগের সন্ধানে ছিলাম তাই বক্স নং দিয়ে বিজ্ঞাপনে সাড়া দিলাম। এবং পত্রপাঠ লন্ডন ডব্লিউ ১- এর মাউন্ট স্ট্রীটে ক্র্যাস্টারবি হোটেলে ড. ডায়াজ ভোলোর সঙ্গে দেখা করবার জন্যে চিঠি পেলাম।

ক্র্যাস্টারবি হোটেল ছোটখাটো হলেও অত্যন্ত ব্যয়বহুল। ফোম রবার বিছানো পথ ধরে এগোচ্ছি, সুরভিত বাতাসে সেই পথ আমোদিত।

আমি যখন বসবার ঘরে পৌঁছলাম তখন সেখানকার নরম সোফায় মাত্র একজন লোক ছিলেন। আমাকে অভ্যর্থনা করার জন্যে তিনি এক হাতে বিকেলের কাগজ আর অন্য হাতে চশমা নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, ‘বসুন ড. জেমস, উপাধিটা আপনি পছন্দ করেন তো, না কি আপনাকে শুধু

‘মি. জেমস’ বলে সম্বোধন করব?’

আমি ঘাড় নেড়ে জানিয়ে দিলাম ও ব্যাপারে আমার কোন পছন্দ অপছন্দ নেই। তারপর আরামের চেয়ারে তলিয়ে বসলাম, চেয়ারটা তিনি আমার দিকে এগিয়ে না দিলেও পারতেন। যেভাবে তিনি আমাকে অভ্যর্থনা করলেন তা একটু বাড়াবাড়িই মনে হলো। আমাকে হুইস্কি সোডা আর সিগারেট এগিয়ে দিয়ে তারপর তিনি বসলেন। বললেন, ‘এসব কিছুই আমার চলে না, তাই আপনার সঙ্গে যোগ দিচ্ছি না বলে মাপ করবেন।’

এইসব ভদ্রতা সত্ত্বেও, এবং তিনি অত্যন্ত সুপুরুষ হওয়া সত্ত্বেও আমার কিন্তু তাঁকে একটুও ভাল লাগল না। তাঁর বয়স হবে পঞ্চাশের কোঠার শেষ দিকে, তবে আচার ব্যবহার যেরকম সেকেলে তা যেন তাঁর চেয়ে বেশি বয়সীদেরকেই মানায়।

তিনি বললেন, ‘চিঠিতে আমার নাম ডায়াজ ভোলো দেখে হয়তো আপনি আমাকে বিদেশি ভেবেছেন কিন্তু আমি আপনার মতই ইংরেজ। আমার জন্ম বার্নসস্টেপলে, চার পুরুষ ধরে আমরা ওখানকার বাসিন্দা। আমাদের পরিবারের আর এক শাখা নাম পাল্টে ‘ভোলার’ পদবি গ্রহণ করেছে, এবং অপর তৃতীয় এক শাখা গ্রহণ করেছে ‘ফুলার’ পদবি।

এসব কথা তিনি বেশ সুরেলা গলায় বললেন, যাতে তিনি যে ইংরেজ এবং সম্ভ্রান্তবংশীয় তা জানিয়ে আমার বিশ্বাস উৎপাদন করতে পারেন। কথা বলতে বলতে মাঝে মাঝে হাত নাড়ছিলেন সেই সময় তাঁর হাতের একটি আংটি আমার চোখে পড়ল। তাতে একটি আশ্চর্য রত্ন রয়েছে, দেখতে মানুষের চোখের মত। তাঁর চুল পাতলা, রুপোলি, গায়ের রঙ গোলাপি সাদা, মেয়েদের মত। তাঁর চোখে সোনার চশমা, চোখের মণি নীল। এবং সেই চোখের জন্যেই আমার কেমন অস্বস্তি হচ্ছিল আর তাকে পছন্দ করতে পারছিলাম না অশুভ। শরীরের অন্য সব কিছুর মধ্যে যতই সরলতার ছাপ থাকুক, রূপোলি চুলে আর মিষ্টি গলার আওয়াজে তাঁকে যতই নিরীহ মনে হোক, তাঁর চোখের দৃষ্টি কিন্তু কঠিন, অশুভ। তাতে হাসির একটুও ইঙ্গিত নেই। যেন কোন রহস্যময় বাড়ির নীল জানালা যার মধ্যে কোন কিছুর ব্যঞ্জনা নেই, আছে শুধু ঘৃণার রহস্যময় প্রকাশ।

তিনি বললেন, ‘উদ্ভিদ বিদ্যায় তো আপনি বিশেষজ্ঞ, তাই না?

‘জ্বী, এ বিষয়ে আমি অনেক কাজ করেছি।’ এই বলে আমি আমার গত কয়েক বছরের কাজের একটা ফিরিস্তি তাঁকে দিলাম।

‘বাঃ, চমৎকার!’ মাথা দুলিয়ে তিনি তারিফ করলেন। তারপর বললেন, ‘তা, কত তাড়াতাড়ি আপনি কাজে যোগ দিতে পারবেন?’

বুঝতে অসুবিধে হলো না যে চাকরিটা আমি পেয়েছি, এবং তারপর যখন বেতনের কথা শুনলাম তখন তো একেবারে অভিভূত হয়ে গেলাম। জানলাম ওখানে থেকেই চাকরি করতে হবে।

বললাম, ‘কী কাজ করতে হবে সে সম্বন্ধে একটু আন্দাজ পেলে ভাল হয়।’

উনি বললেন, ‘সে আলোচনার জন্যে পরে যথেষ্ট সময় পাবেন। তাহলে ওই কথাই রইল। আশা করি আজ আমার সঙ্গে নৈশ ভোজ করবেন।’

এরপর আর ইতস্তত করার কোন যুক্তি নেই, তাই তাঁর কথাকেই শেষ কথা বলে ধরে নিলাম এবং ফেরার সময় কথা দিয়ে গেলাম যে এক সপ্তাহ পরে আমি কর্মস্থলে গিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করব।

দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলের এক দ্বীপের একটা পুরোনো দুর্গের তিনি মালিক। সেখানেই তিনি গবেষণা করেন, যে গবেষণায় আমি তাঁকে সাহায্য করব। সপ্তাহখানেক পরে ওয়াটার্লু থেকে দ্রুতগামী এক ট্রেনে যাত্রা করলাম। চার ঘণ্টা পরে নামলাম ম্যানটক নামে এক সমুদ্রতীরবর্তী ছোট শহরে। সেখান থেকে একটা ঘোড়ার গাড়িতে করে আমি হাজির হলাম সমুদ্রতীরে একটা মোটর বোটে। একজন শোফার সেই মোটর বোট চালাবে।

বিকেল সন্ধেয় মিশে যাচ্ছে। সারা দিন ধরে টিপটিপ বৃষ্টি, দৃষ্টি বেশি দূর যায় না। শোফারটি যথোপযুক্ত সম্মান জানিয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনিই নিশ্চয় ডক্টর জেমস?’

ঘাড় নেড়ে সায় দিলাম আমি, তার মুখ থেকে চোখ না ফিরিয়ে। তার গালে লম্বা লম্বা সাদা ক্ষতচিহ্ন, হঠাৎ দেখলে, পাপুয়ার মানুষ যেভাবে শরীরের অলঙ্করণ করে তার কথা মনে পড়ে, পার্থক্য এই যে এগুলো কোন নিপুণ সার্জনের হাতে সৃষ্টি, ফলে অত্যন্ত লাগছে ভয়াবহ লাগছে দেখতে। তবে, লোকটি অত্যন্ত ভদ্ৰ সন্দেহ নেই। তার আমন্ত্রণে আমি মোটর বোটে গিয়ে উঠলাম এবং আমার মালপত্র সে-ই তুলে নিল। ইঞ্জিন চালু হলে আমরা ক্ষুদ্র বন্দরটি ছেড়ে তর-তর করে এগিয়ে চললাম।

জিজ্ঞাসা করলাম, ‘বুরফে দ্বীপে পৌঁছতে কতক্ষণ লাগবে?’

লোকটি হয়তো সহৃদয় হাসির সঙ্গে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল, কিন্তু ক্ষতচিহ্নের জন্যে শয়তানি হাসি বলে মনে হলো। সে বলল, ‘মিনিট কুড়ি, কি আধঘণ্টার মত লাগবে, তাতে আর কী এমন তফাত? পৌঁছনো নিয়েই তো কথা। আমার নাম পোটিউস ম্যালোয়ে।’

সঙ্গে সঙ্গে এক বিখ্যাত অপেরা গায়কের কথা মনে পড়ে গেল, যে কয়েক বছর আগে রহস্যজনকভাবে উধাও হয়ে গিয়েছিল।

বলে উঠলাম, ‘কী আশ্চর্য!’

এবার সে এমনভাবে আমার মুখের দিকে তাকাল যে আমি বললাম, ‘না, মানে, আমি তোমার নাম জানতে চাইছি।’

‘নামটা আপনি আগেও শুনেছেন দেখছি।’

‘হ্যাঁ, আমিই হচ্ছি সে।’ মনে হলো লোকটা হয় পাগল, কিংবা অকারণে মিথ্যে বলে। কিন্তু যখন ভাল করে তার মুখের দিকে তাকালাম, যেন খানিকটা সাদৃশ্য দেখতে পেলাম, সঙ্গীত শিল্পীটি ছিলেন যেমন সুকণ্ঠ তেমনি সুদর্শন।

সে বলল, ‘আমার গান হয়তো আপনি শুনে থাকবেন।’ রুক্ষ গলায় তার এই কথা সেই নির্জনতার মধ্যে যেন আতঙ্কের সৃষ্টি করল।

সে মুখ হাঁ করে একটা আওয়াজ করল। যার গানে মুগ্ধ হয়ে শ্রোতারা বার বার তারিফ করত, তার সেই আওয়াজ এখন এমন ভয়াবহ বেসুরো হয়ে তার মুখ থেকে বেরিয়ে এল যে শুনে আমার শরীর হিম হয়ে গেল। তারপর সে থেমে, অদ্ভুত দৃষ্টিতে আমার মুখের দিকে তাকাল। বলল, ‘আমার একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়।’

কিছুক্ষণের মধ্যেই কমে আসা আলো যেন জমাট, ধূসর হয়ে উঠল। আমরা বুরফে দ্বীপের কাছাকাছি পৌঁছে গেছি। সঙ্গীটি ইঞ্জিন বন্ধ করে দিল। আমরা পৌছে গেছি গন্তব্যে। উঠে দাঁড়িয়ে সে ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিল।

বলল, ‘তীরে নামুন, আপনার মালপত্র আমি নামিয়ে দিচ্ছি। এবার একটু খাড়াই ভাঙতে হবে।’

মোটর বোটটা বেঁধে রেখে সে আমার মালপত্র নিয়ে আমার পিছু পিছু চলল।

পথের ধূসর নির্জনতা যেন ঢেউয়ের সিক্ত শোকাবহ সঙ্গীতে আরও প্রকট হয়ে উঠল। সেইসঙ্গে গল পাখির পাক খেতে খেতে বিষণ্ন ডাক, আর তীরের নিকটবর্তী সারিবদ্ধ জনহীন বাড়িগুলো এ সবই এক অশুভের ইঙ্গিত বহন করছে। হয়তো ভগ্নদশাপ্রাপ্ত এইসব বাড়িতে এক সময়ে মানুষ সুখেই দিন কাটাত।

একটা খাড়াই পাথুরে পথ বেয়ে আমি পটিউসের পেছন পেছন এগিয়ে চললাম। মিনিট দশেক পরে আমরা গিয়ে পৌঁছলাম একটা প্রাচীন দরজার সামনে। দরজাটা খুব মজবুত, পাথরের উঁচু দেয়ালের দরজাটিতে লোহার তীক্ষ্ণ ফলা বসানো।

মালপত্র নামিয়ে পটিউস ঘণ্টা বাজাল, ঘণ্টাটা দরজার কাছে দেয়ালের উপর। সঙ্গে সঙ্গে যে এসে দরজা খুলে দিল সেরকম দানব মানুষ আমি আর দেখিনি। লম্বায় সে সাত ফুটের কম হবে না, সেই তুলনায় মানানসই চওড়া। এক হাতে প্রকাণ্ড একথোলো চাবি। আর তার পেছনে পেছনে যে কুকুরটা এল সে-ও লম্বায় চওড়ায় কম নয়, প্রায় একটা টাট্টু ঘোড়ার মতই প্রকাণ্ড। প্রথম দর্শনে ভেবেছিলাম সিংহ।

পটিউস বলল, ‘এগিয়ে যান, ও কিছু বলবে না, ও কিছুই বলে না কুইল্পের হুকুম ছাড়া, তা ছাড়া ওর সঙ্গে কথা বলারও চেষ্টা করবেন না, কারণ ওর জিভ নেই।‘

ভিতরে প্রবেশ করলাম আমি, দানব কুইল্প দরজা বন্ধ করে তালা দিল। আমার মনে হলো আমি যেন এখানে বন্দি হয়ে গেলাম। কুইল্পের বিরাট মাথা সম্পূর্ণ ন্যাড়া, রঙ গোলাপি। দাঁত বার করা একটা হাসি তার মুখে সর্বদা লেগে আছে। তার অমানুষিক হলদে দাঁতগুলো সব সময়েই ক্রুদ্ধ, ভয়ঙ্কর শ্বাপদের দাঁতের মত বেরিয়ে থাকে।

কিন্তু আমার মনোযোগ চলে গেল বাগানে। সেই বাগান বাড়িটির চারদিক ঘিরে রেখেছে। এমন ভীতিকর বাগানের অস্তিত্ব কেবলমাত্র কল্পনাতেই সম্ভব।

গাছগুলো চেনা, তবু মনে হয় যেন চেনা নয়, জড়িয়ে মড়িয়ে এমন বিকট আকৃতি তাদের যে দেখলে আতঙ্ক জাগে। কোনটার গুঁড়ি প্রায় মাটি বরাবর এঁকে বেঁকে এগিয়ে গেছে, আর ডালগুলো অত্যন্ত বিকটভাবে জট পাকিয়ে আছে। এমনও মনে হলো যেন গাছগুলো দীর্ঘশ্বাস ফেলছে আর যন্ত্রণাসূচক আওয়াজ করছে। যেন কোন জন্তুর মুখ থেকে বেরিয়ে আসছে। এই অত্যন্ত উদ্ভট দৃশ্য থেকে চোখ ফিরিয়ে ফুলগাছগুলোর দিকে তাকালাম। সেখানেও তেমনি অত্যন্ত ভয়াবহ বিকৃতির চিহ্ন। অনেক ফুল গাছের মাঝখানে যে ফুলটা ফুটে আছে তা দেখলে মনে হয় মড়ার খুলি। কোনটার আকৃতি সাপের মত, কোনটা দুর্গন্ধে ভরা, এ সব নির্ঘাত কোন জঘন্য-রুচির উদ্ভিদ-বিজ্ঞানির কান্ড, যে এক উদ্ভিদের সঙ্গে অন্য উদ্ভিদের মিলনে এইসব ন্যক্কারজনক সৃষ্টি করেছে। আর একটি ব্যাপার দেখে আমার গায়ে হিমের স্রোত বয়ে গেল, এইসব উদ্ভিদের রঙ সবুজ নয়, একেবারে সাদা।

দুর্গের সামনের প্রকাণ্ড দরজায় চলে এলাম। যে সেতু পার হয়ে গেলাম তার নীচের গর্ত দেখলে হৃৎকম্প হয়, তার গর্ভ সবুজ জলের কাদায় পূর্ণ, কিছু গা ঘিন-ঘিন করা প্রাণী সেখানে চলা ফেরা করছে। কুইল্প যখন ঘণ্টা বাজাল তখন আমার শরীর আপনা থেকেই কেঁপে উঠল। এখন আর ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়, এগোতেই হবে আমাকে। আমার দুই নীরব সঙ্গীর দিকে চকিতে তাকালাম, তাদের একজন এক দৈত্যাকার মানুষ, আর অন্যজনের বিকৃত মুখে কর্কশ ফিসফিসে আওয়াজ।

প্রধান ভৃত্যের পরিপাটি পোশাক পরা একটি আকৃতি চোখে পড়ল, কিন্তু তার মুখাবয়ব কুকুরের। সে আমাকে অভিবাদন করে ভিতরে যেতে বলল পটিউস যেখানে আমার মালপত্র রেখেছিল সেই জায়গাটা সে ইঙ্গিতে দেখিয়ে দিল। দু’জনে দরজা বন্ধ করে দিলে আমি প্রধান ভৃত্যের ইঙ্গিতে তাকে অনুসরণ করলাম। খোলা ফায়ারপ্লেসে আগুন জ্বলছে। আমি যখন প্রবেশ করলাম তখন একটা গ্রাণ্ড ফাদার ক্লকে সাতটা বাজল। হলঘর পার হয়ে ভৃত্যটি টোকা মেরে সেটা খুলে তার পরের ঘরটায় যেতে ইশারা করল।

এটি ডাইনিং রুম। সুন্দরভাবে ঘরটি সাজানো, সেখানে দু’জনের জন্যে খাবারের ব্যবস্থা। ফায়ারপ্লেসের পাশে দাঁড়িয়ে ডক্টর ভোলো, পরনে সান্ধ্য পোশাক। আমাকে দরজার কাছে দাঁড়াতে দেখে তিনি এগিয়ে এলেন। করমর্দনের জন্যে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, ‘ড. জেমস, ওয়েলকাম। লম্বা ভ্রমণ শেষ আপনার নিশ্চয় খিদে পেয়ে যাবে তাই সাতটার সময়েই ডিনারের ব্যবস্থা করলাম।’

আমার অনুরোধে তিনি আমাকে শেরি পরিবেশন করলেন এবং ফায়ারপ্লেসের কাছে একটা চেয়ারে নিয়ে গিয়ে বসালেন।

তিনি বললেন, ‘ডিনারের সময় আমি সবসময় ডিনার জ্যাকেট পরি, আপনিও পরতে পারেন। তবে বেশি দেরি করবেন না যেন।’

আমি প্রস্তুত হয়ে এলে তিনি ঘণ্টা বাজালেন। একটি মেয়ে সুপ নিয়ে ঘরে প্রবেশ করল। অমন সুন্দরী আমি জীবনে দেখিনি। সে চলে গেলে ভোলো সুপ খেতে খেতে এমনভাবে আমার দিকে তাকালেন যেন আমার মনের কথা বুঝতে পেরেছেন। বললেন, ‘হ্যাঁ, আমি আপনার সঙ্গে একমত, বিয়াট্টিচে সত্যিই খুব সুন্দরী।’ একথা বলার সময় চশমার আড়াল থেকে তাঁর নীল চোখে যে ভীতিকর আলো ফুটল তাতে আমার মেরুদণ্ড দিয়ে একটা হিমেল স্রোত বয়ে গেল। এরপর যখন বিয়াট্টিচে ডিনার নিয়ে এল তখন ভোলো বললেন, ‘বিয়াট্টিচে, ইনি হচ্ছেন ড. জেমস, আমার কাজে সাহায্য করতে এসেছেন।

বিয়াট্টিচে আমার দিকে তাকিয়ে নড করল তবে কোন কথা বলল না। আমি তার মুখের দিকে তাকিয়ে হাসলাম। সত্যিই সে সুন্দরী, অসাধারণ রূপবতী।

কিছুক্ষণ পরে সে আবার ফিরে এল। তার হাতে লেগে টেবিলের একটা ন্যাপকিন হঠাৎ পড়ে গেল। সেটা তুলতে সে আর আমি একসঙ্গে নিচু হয়েছি বিয়াট্টিচে একটুকরো কাগজ আমার হাতে গুঁজে দিল। ভোলো অবশ্য লক্ষ্য করলেন না। কাগজটা আমি আমার পকেটে ফেললাম, বিয়াট্টিচে ন্যাপকিনটা টেবিলে বিছিয়ে দিল। সে চলে গেলে ভোলো বললেন, ‘এবার আমাদের কাজ শুরু করা দরকার। সে জন্যে তেমন তাড়া নেই। তবে যখন ঘরে যাবেন ঘণ্টা বাজিয়েন, প্রধান ভৃত্য ব্রেডি আপনাকে নিয়ে যাবে। ঘরে ফায়ারপ্লেসের ব্যবস্থা আছে, সেখানে কিছু বই আর লেখবার সরঞ্জামও পাবেন। আর রইল ব্র্যাণ্ডি, শুভরাত্রি।’

এই বলে তিনি চলে গেলেন, এবং একটু পরেই আমি ঘণ্টা বাজালাম। সঙ্গে সঙ্গে কুকুরমুখো প্রধান ভৃত্য চলে এল। সে আমাকে দোতলার একটা ঘরে নিয়ে গেল। দরজা বন্ধ করে আমি ঘরটা ভাল করে লক্ষ্য করতে লাগলাম।

ঘরটা বেশ আরামের। একজনের শোয়ার মত একটা খাট সেখানে। একটা ছোট টেবিলে হুইস্কি রাখা আছে, আর ফায়ারপ্লেসের কাছে আছে একটা ইজিচেয়ার, আর একটা সবুজ বাক্সে সিগারেট। আমার বাক্স-প্যাঁটরা খুলে পায়জামা আর ড্রেসিং গাউন বের করে রাখা হয়েছে। অর্থাৎ আমার আরামের ব্যাপারে কোন খুঁত নেই। একটা সিগারেট নিয়ে দেশলাইয়ের জন্যে পকেটে হাত দিতে বিয়াট্টিচের দেওয়া কাগজের টুকরোটা হাতে ঠেকল। সেটা খুলে পড়লাম:

‘আমি বিয়াট্টিচেজ স্কেলিমোর, চিত্রাভিনেত্রী, যার আত্মহত্যার খবর দু’মাস আগে খবর-কাগজে প্রকাশিত হয়েছিল। চলে যান এখান থেকে, তারপর দলে ভারি হয়ে ফিরে আসুন। আরও অনেকে এখানে মহা বিপদের সম্মুখীন।’

সঙ্গে সঙ্গে তিনটে ব্যাপার আমার কাছে খুব পরিষ্কার হয়ে গেল। এক, বিয়াট্টিচে সত্যি কথাই বলছে, দুই, মোটর বোটের চালক সত্যিই বিখ্যাত গায়ক পটিউস ম্যালোয়ে, আর তিন, আমাকে পালাতেই হবে এখান থেকে। দরজাটা বন্ধ করতে গেলাম, কিন্তু দেখলাম সেটা বাইরে থেকে বন্ধ। আগুনের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থেকে আমি চেয়ারে বসে রইলাম। এখন আর ভয় পাচ্ছি না,ভাবছি অন্য কথা। এখন আমাকে ব্যবস্থা নিতে হবে, জানতে হবে ড. ভোলো সম্বন্ধে। তাঁর দৌড় কতটা আর তাঁর আগামী কর্মপন্থা কী। আমার এখন কাজ নিজেকেসহ অন্যদেরকে তাঁর কবল থেকে উদ্ধার করা। উত্তেজনার লেশমাত্র আর আমার মধ্যে নেই। আমি বিজ্ঞানী, এবং এ দেশ ইংল্যাণ্ড, তা ছাড়া সাহায্য পেতে বেশি দূরেও যেতে হবে না। ইতিমধ্যেই যা দেখেছি তাতে আমার মন বিতৃষ্ণা আর আতঙ্কে ভরে গেছে যাদের দেখেছি তাদের চেহারা মনে পড়ছে, মনে পড়ছে ভূতুড়ে বাগানটার কথা। কিছুক্ষণ পরে আমি আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়লাম, এই অভিযানের শেষ দেখে তবে ছাড়ব, এই সঙ্কল্প করে।

.

ঘুম ভাঙল ভোরে, ঘড়িতে তখন ছ’টা বেজে দশ মিনিট। ঘর অন্ধকার, বাড়ির কোথাও কোন সাড়া নেই, কেবল দূর থেকে আসা একটা ক্ষীণ বেসুরো আওয়াজ ছাড়া। স্থির হয়ে রইলাম কিছুক্ষণ, তারপর উঠে মুখ হাত ধুলাম। দাড়ি কামালাম, পোশাক পরলাম। বিয়াট্টিচে যখন আমার প্রাতরাশ নিয়ে প্রবেশ করল তখন বেলা সাড়ে সাতটা। ট্রে-টা তার হাত থেকে নিয়ে আমি ফায়ারপ্লেসের কাছের টেবিলের উপরে রাখলাম।

বললাম, ‘এবার বলুন কী বলবেন।’ আমি দরজাটা বন্ধ করতে যাচ্ছি, সে কঠিন স্বরে বলল, ‘না, খোলাই থাক ওটা।

‘আচ্ছা, দরজাটা বাইরে থেকে বন্ধ করা হয়েছিল কেন?’ আমি জিজ্ঞাসা করলাম।

‘কারণ আপনিও এখানে বন্দী, এখানকার অন্য সকলের মতই।’

‘বাজে কথা। যখন ইচ্ছে আমি এখান থেকে চলে যেতে পারি।’

‘পারেন না। চেষ্টা করলেই বুঝতে পারবেন আমি ঠিক বলছি কি না।‘

‘কিন্তু আমি তো এখানকার পথঘাট সবই চিনি, তাহলে ফিরে যেতে পারব না কেন?’

‘সব চেনেন? দেখেছেন উঁচু পাঁচিল, যার উপরে বিদ্যুৎত্তায়িত সুচলো লোহা? দেখেছেন তাঁর তৈরি দৈত্যদের, যারা দিনরাত পাহারায় থাকে? দেখেছেন কুইল্পকে, কুকুর-সিংহকে, বা কুকুরমুখো ব্রেডিকে?’

‘হ্যাঁ, দেখেছি তো।’

‘এরাই সব নয়। এদেরকে তিনি তৈরি করেছেন, তাঁর সাফল্যের নিদর্শন হিসেবে।’ এই বলে সে দু’হাতে মুখ ঢাকল।

হাতদুটো সরিয়ে দিলাম আমি। বললাম, ‘বলুন, সব বলুন, সব কিছুই আপনাকে বলতে হবে!’

‘কিন্তু শুধু তো সাফল্যই নয়, ব্যর্থতারও নজির আছে। দেখেছেন তো বাগানটা, দেখেছেন সেখানে তাঁর অত্যাচারের কী পরিণতি হয়েছে?’

‘হ্যাঁ, দেখেছি।’

‘জমিনে তিনি বিশেষ সাফল্য পাননি, সেখানে কেবলই তাঁর ব্যর্থতা আর ব্যর্থতা। এবার আমার পালা আসবে, আমি জানি তা। ঠিক কবে আসবে তা জানি না, তবে, আর হয়তো আর দেরি নেই।

এই বলে সে ভয়ার্ত চাপা চিৎকারের সঙ্গে আমার বাহুবন্ধনে ধরা দিল। আমি তাকে চেপে ধরলাম, এমনভাবে দু’জনে আলিঙ্গনবদ্ধ হলাম, যেন দু’জনেই অত্যন্ত বিপন্ন এবং পরস্পরকে ছাড়া আমাদের সাহায্যের আর কেউ নেই। হঠাৎ সে মুখ তুলে তাকাল, একসঙ্গে অনেক কথা বলে গেল:

‘দু’মাস হলো আমি এখানে এসেছি। ওঁর সঙ্গে আমার লণ্ডনে দেখা হয় এবং সিনেমায় একটা কাজ করার জন্যে উনি আমাকে এখানে ডেকে আনেন। অন্য যাদের এখানে দেখা পাব বলেছিলেন তাদেরকে তিনি আদৌ ডাকেননি, যদিও বলেছিলেন তারা এখানে আছে। একদিন প্রচার করে দিলেন আমি আত্মহত্যা করেছি। আপনি হয়তো লক্ষ্য করেননি, তাদেরকেই তিনি এখানে নিয়ে এসেছেন যাদের মধ্যে কোন না কোন বৈশিষ্ট্য আছে, কারও কণ্ঠস্বর ভাল, কেউ দেখতে সুন্দর, যার মধ্যে কিছু বিশেষ গুণ আছে, যাতে তিনি…’ এই পর্যন্ত বলে সে থেমে গিয়ে শিউরে উঠল।

‘থেমে গেলেন কেন, বলুন, ‘যাতে তিনি’ কী? আমি জিজ্ঞাসা করলাম।

‘যাতে তিনি সেই বৈশিষ্ট্যকে কুৎসিত করে তুলতে পারেন। সৌন্দর্যকে ঘৃণা করেন তিনি। এক অমঙ্গলের দেবতা তিনি, নিষ্ঠুর, নোংরা এক স্ৰষ্টা, পৃথিবীকে নোংরা বস্তুতে ভরে তুলতে চান। ব্রেড ছিল এক অত্যন্ত সুদর্শন তরুণ। ওঁর অস্ত্রোপচারের ফলেই তার এই দশা, তার ক্ষেত্রে সফল হয়েছেন তিনি। কিন্তু তাঁর ব্যর্থতা হচ্ছে মাটির নীচে, ওই সব বিকলাঙ্গ গাছগুলোর মধ্যে। আপনি কি জানেন না কেন আপনাকে তাঁর প্রয়োজন?’

‘না, বলুন।’

আপনাকে নিয়ে কদাকার কোনো গবেষণা করবেন। তিনি সবসময় চেষ্টা করছেন কেমন করে বিশ্রী চেহারার নতুন নতুন গাছ তৈরি করা যায়। তাঁর উদ্দেশ্যই হচ্ছে সুন্দর পৃথিবীকে অসুন্দরে পরিণত করা। এই অসুন্দর- করণের কাজে যখন সাফল্য পান তখন তিনি খুশি হন, নিজের কীর্তি মহানন্দে হাসেন। একটা ফুলকে তিনি মড়ার খুলির রূপ দিয়েছেন। একটা গাছের পাতাগুলোকে এমন করেছেন যে সেগুলো ভাঙা হাত আর আঙুলের মত দেখায়—ওই, ওই শুনুন…’

দু’জনে নিশ্চল হয়ে কাছাকাছি দাঁড়িয়ে ছিলাম। যে আশ্চর্য আওয়াজটা আসছিল ক্রমেই সেটা জোরালো হয়ে উঠছে। অদ্ভুত বেসুরো এক আওয়াজ। যেন অনেক মানুষ একসঙ্গে কাতরাচ্ছে।

‘তিনি বলেন নীরবতা সুন্দর, বড় বেশি সুন্দর, তাই তা ভঙ্গ করা দরকার। এই যে আওয়াজ, এ অনেকক্ষণ ধরে চলবে, এ বৈদ্যুতিক কৌশলে তৈরি। তারপরেই তিনি হঠাৎ বন্ধ করে দেবেন, এবং তারপর যখন আবার শুরু করবেন তখন তা আরও বীভৎস লাগবে।’

‘এসব ব্যাপার নিয়ে কি তিনি আপনার সঙ্গে কথা বলেছেন?’

‘হ্যাঁ, নিশ্চয়। একে তিনি ‘প্রয়োজনীয় শিক্ষা’ বলে অ্যাখ্যা দিয়েছেন, এ তাঁর নতুন ধর্মমত, এরকম আরও অনেক গালভরা কথা তিনি বলেছেন। কোন কিছুই তিনি গোপন করেন না, তাই আমি জানি আমাকে তিনি কোন বীভৎস, কুৎসিত এবং জীবন্ত আতঙ্কে পরিণত করতে চলেছেন…

এই বলে সে আমার কাঁধে মুখ লুকোল। আর আমিও তাকে জড়িয়ে ধরলাম। হঠাৎ তার মাথার উপর দিয়ে ভোলোকে দেখতে পেলাম, দরজার কাছে দাঁড়িয়ে শয়তানি হাসি হাসছেন।

বললেন, ‘আশা করি আপনার প্রাতরাশ সারা হয়েছে।’ এমনভাবে বললেন, যেন আমাকে আর বিয়াট্টিচেকে অমন ঘনিষ্ঠ ভঙ্গিতে লক্ষই করেননি। তারপর বললেন, ‘ঠিক করেছি আটটার সময় কাজ শুরু করব এবং সকালবেলা বেশ খানিকটা এগোতে পারব। প্রস্তুত হয়ে আসুন, বিয়াট্টিচে আপনাকে আমার পড়বার ঘরে নিয়ে আসবে।’

ভোলো চলে গেলে আমি এক কাপ কফি পান করলাম। বিয়েট্রেচকে বললাম, ‘চলুন ওঁর ঘরে যাই। আপনাকে আমি এখান থেকে নিয়ে যাবই, সে-জন্যে ওঁকে খুন করতে হলেও পেছপা হব না।’

আবার সে আমার আলিঙ্গনে ধরা দিল।

.

ভোলোর পড়বার ঘরে আছে কিছু বই, অণুবীক্ষণ যন্ত্র আর কিছু যন্ত্রপাতি। তাঁর পরনে সাদা কোট।

এবার আমি যা বলব তা কোন পাগলের যুক্তিতেও আসে না। একমাত্র বিয়াট্টিচে যে কথা বলেছিল তা দিয়েই তার ব্যাখ্যা হতে পারে। তা হচ্ছে, অত্যন্ত হীন কোন কারণে তিনি সৈান্দর্য ঘৃণা করেন এবং তা নষ্ট করতে চান, যে বস্তু সাধারণ সুস্থমস্তিষ্ক মানুষ রক্ষা করতে চায়, উপভোগ করতে চায়। আমাকে দেখে সরাসরি বললেন, ‘জেমস, আমার মনে হয় তোমার বিয়াট্টিচেকে বিয়ে করা উচিত।’

ওঁর মানসিকতা আন্দাজ করার মত যখন একটা সূত্র আমি পেয়েছি এবং জেনেছি তাঁর কোন কথাই বিশ্বাসযোগ্য নয়, সবই তাঁর সর্পিল মনের শয়তানি মাত্র, তাই ঠিক করেছি এমন ভাব দেখাব যেন তাঁর কথা সহজভাবে নিচ্ছি, আর তাঁর প্রতিটি কথা ও কাজের উপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখব।

আমার মনের ভাব কিছুতেই তাঁকে বুঝতে দেব না, এবং তাঁর সমস্ত কথায় ও কাজে যেন সমর্থন জানাচ্ছি এমন ভাব করব। তাই এই আকস্মিক প্রস্তাবের কোন উত্তর করলাম না।

তিনি বলে চললেন, ‘সুন্দরী, অত্যন্ত সুন্দরী ও,’ তাঁর চোখে একটা শয়তানি আভা খেলে গেল। তারপর বললেন, ‘তোমার দু’জনেই তরুণ, গতকাল এবং আজ সকালেও আমি প্রমাণ পেয়েছি তোমরা পরস্পরের প্রতি আকৃষ্ট। হ্যাঁ, অবশ্যই তোমাদের বিয়ে করা উচিত। তা ছাড়া তার চোখে তুমিই যখন এখানকার একমাত্র পুরুষ।’

এই ইঙ্গিত আমার কাছে এমন অসহ্য হয়ে উঠল যে ইচ্ছে করল এখুনি তাঁকে আক্রমণ করে বসি—গলা টিপে ধরি, ওই ভয়ঙ্কর চোখ দুটো অন্ধ করে দিই। কিন্তু আমি জানি তা কোনমতেই সম্ভব নয়, কারণ তাহলে সঙ্গে সঙ্গে কুইল্প আর কুকুর-সিংহ ছাড়াও আরও কোন প্রাণী আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। এক মারাত্মক, বাতিকগ্রস্ত মানুষের সঙ্গে আমাকে মোকাবিলা করতে হচ্ছে, তাই, যদি ওর মতলব থেকে বেরিয়ে আসতে হয় তাহলে আমাকে অত্যন্ত সাবধানে চলাফেরা করতে হবে। এবং তা আমাকে করতে হবে প্রাণের দায়ে।

‘যেহেতু তুমি কোন জবাব দিচ্ছ না তাই ধরে নিচ্ছি আমার প্রস্তাবে তোমার সমর্থন আছে। তোমাদের বিয়ের সব বন্দোবস্ত আমিই করব। আমারই ছোট গির্জায় আজ থেকে এক সপ্তাহ পরে সেই উৎসব অনুষ্ঠিত হবে। বিয়ের এক সপ্তাহের মধ্যে তো বরের কোন কাজে ব্যস্ত থাকা উচিত নয়, তাই না? তাছাড়া বিয়াট্রিচেরও প্রস্তুতি দরকার,—তবে, সে ভারটা আমার উপরেই রইল।’

শেষের এই কথাগুলোয় আমার মেরুদণ্ড ঠাণ্ডা হয়ে এল, কারণ বিয়াট্রিচে যে আশঙ্কা করছিল এ কথায় তারই ইঙ্গিত রয়েছে। আমি বললাম, ‘না না তা কেন, আমি আজ থেকেই কাজ শুরু করতে চাই। কাজ করব বলেই তো এখানে আসা।’

এই ভয়ঙ্কর এলাকাটা ভাল করে লক্ষ করা বিশেষ প্রয়োজন, কিন্তু তিনি যে আমাকে বন্দী করে রাখতে চাইছেন তা বুঝতে অসুবিধে হলো না, এবং তা বলপ্রয়োগ না করেই করতে চান। এবং আমার কথার জবাবে যা বললেন তাতে আমার সেই সন্দেহ আরও দৃঢ় হলো।

শয়তানি হাসি হেসে উনি বললেন, ‘না না, কাজ কোনমতেই নয়, যতদিন না বিয়ে হচ্ছে ততদিন তোমার কোন কাজ নেই।’

তখন একটা মতলব আমার মাথায় এল। বললাম, ‘বেশ, তবু আমি একবার এলাকাটা ঘুরে ফিরে দেখতে চাই।’

এরপর বেশ কিছুক্ষণ নীরবতা, দু’জনে তাকিয়ে রইলাম পরস্পরের মুখের দিকে। তারপর তিনি বললেন,’ বেশ তো, যাও না যেখানে খুশি, সবই খোলা। দেখে নাও না ঘুরে ফিরে।’ এই বলে তিনি মুচকি হাসলেন। তারপর বললেন, ‘দেখবে, বেশ চিত্তাকর্ষকই মনে হবে। আচ্ছা বেশ এবার আমি একটু কাজ করি, কেমন?’

ঘুরে ফিরে এলাকাটা দেখার একটা ইচ্ছে আমার সত্যিই ছিল, এবং সম্ভব হলে বিয়াট্রিচের সঙ্গে দেখা করে আমাদের বিয়ের কথা তাকে জানাব এ বাসনাও ছিল, যদি অবশ্য ইতিমধ্যেই সে না জেনে থাকে। ভেলোকে তাঁর পড়বার ঘরে রেখে আমি বারান্দা দিয়ে এগিয়ে গেলাম। এগোচ্ছি আর প্রত্যেকটা ঘর পরীক্ষা করে দেখছি, তিনি অবশ্য বলেছেন কোথাও গোপন কিছু নেই। তা, গোপনীয়তার আর কীই বা থাকবে, যখন এখানকার বাসিন্দারা সকলেই বন্দী?

আঁকাবাঁকা পথ ধরে আমি এগিয়ে চলেছি আর একটার পর একটা দরজা খুলছি এবং বন্ধ করছি। সেগুলোর অনেকগুলোই হয় খালি, কিংবা অব্যবহৃত। এক কোণের একটা ঘরে পৌঁছে গেলাম যেটা সম্প্রতি তৈরি হয়েছে, সেখানেই আমি ভোলোর কাজের আর শয়তানি প্রতিভার পরিচয় পেলাম।

একটা ঘরে অপারেশনের সব ব্যবস্থা আছে, সেটাও খালি। সেখান থেকে বেরিয়ে আসতেই চমকে উঠলাম, আমার শিরা উপশিরায় কাঁপন ধরল। হঠাৎ বিভিন্ন ধরনের আওয়াজ একসঙ্গে আমার কানে এল-যেন একশোটা সাইরেন বিভিন্ন সুরে একসঙ্গে ধ্বনিত হলো। তা এমনই অশ্রাব্য আর কুৎসিত যে ইচ্ছে হলো চিৎকার করে, গালাগালি করে উঠি। তারপর, যেমন আচমকা শুরু হয়েছিল তেমনি থেমেও গেল। আমার সারা শরীর কেঁপে কেঁপে উঠল, মনে হলো যেন আমার উপর লক্ষ্য রাখা হচ্ছে, এবং বিশেষ বিশেষ সময়েই ওই আওয়াজটা করা হচ্ছে।

বাঁ দিকের একটা ঘরের দরজা খোলা-মাত্র এক নতুন আতঙ্কে আমি নড়াচড়ার ক্ষমতা পর্যন্ত হারিয়ে ফেললাম। ঘরের এক কোণে একটা লোহার খাঁচা, সেই খাঁচার ভিতরে খুব তাড়াতাড়ি চার হাতে পায়ে যাকে নার্ভাসভাবে দ্রুত চলাফেরা করতে দেখছি, প্রথম দর্শনে তাকে একটা সাদা বানর বলে মনে হলো। কিন্তু ভাল করে লক্ষ্য করার পর বুঝতে অসুবিধে হলো না যে সে একজন মানুষ, বানরের মত চেহারার। দরজার কাছে আমাকে দেখে সে খাঁচার শিকে হাত দিয়ে থেমে দাঁড়াল। এবং মহা আতঙ্কের সঙ্গে আমি দেখলাম তার শুকনো গাল বেয়ে জল পড়ছে। যেভাবে সে করুণ চোখে আমার দিকে তাকাতে লাগল তাতে বুঝতে পারলাম সে আমার সাহায্য চাইছে।

কিন্তু তাকে কোনরকম সাহায্য করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়, তাই তার অবস্থা দেখে আমার যত কষ্টই হোক আমি চলে আসতে বাধ্য হলাম। গেলাম আর একটা ঘরে। দরজা খুলতে দেখলাম সেখানে উদ্ভিত জগতের সব অভিনব, ভয়ঙ্কর ভয়ঙ্কর গাছ। এবং ভয়ে কুঁকড়ে গেলাম যখন দেখলাম একটা গাছের ডগা আমার দিকে এগিয়ে আসছে, এবং এক সময় আমার মুখ স্পর্শ করল, কোন মতলবে হয়তো। বুঝতে পারলাম, ভোলো এমন এক প্রাণী তৈরি করতে চাইছেন যা হবে একাধারে উদ্ভিদ এবং জীব। সেটার মধ্যে পচন আর মৃত্যুর গন্ধ। ভয়ের চোটে আমি তাড়াতাড়ি বন্ধ করে দিলাম দরজাটা। দেখলাম ভোলো আমার পাশে দাঁড়িয়ে, তাঁর পরনে সেই সাদা কোট, আর হাতে একটা পাত্রে সবুজ তরল পদার্থ। বিষ বলেই মনে হলো।

আমি এত কিছু জেনে গেছি লক্ষ করার পরেও ব্যাপারটা তিনি যেরকম শান্তভাবে গ্রহণ করলেন তা থেকে বুঝতে পারলাম যে তিনি জানেন আমি তাঁর হাতে সম্পূর্ণ বন্দি।

‘তুমি ঘুরে ফিরে যা দেখলে তাতে তোমার কৌতূহল জাগছে নিশ্চয়। ‘ কথাটা তিনি এমন সহজভাবে বললেন, যেন লন্ডনের কোন বড় হাসপাতালের পরীক্ষাগারে বসে কথা বলছেন। তারপর মাথা দোলালেন, ‘লাঞ্চ ঠিক বেলা একটায়।’ এই বলে, আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই তিনি চলে গেলেন।

.

লাঞ্চের ঠিক আগে বিয়াট্রিচের সঙ্গে আমার দেখা হয়ে গেল, সে খাবার ঘর থেকে বেরিয়ে আসছিল। তার হাত ধরে ফিসফিস করে বললাম, ‘শুনুন, কথা আছে…’

‘আমি জানি, উনি আমাকে বলেছেন, যেন আমি…’ সে মাথা নাড়ল, তার চোখে জল এসে গেল।

আমি বললাম, ‘এ সবই আমরা সহ্য করছি,এজন্যে যে হয়তো এ থেকেই মুক্তির একটা সুযোগ মিলে যাবে।’

এ কথায় সে ঘাড় নেড়ে সায় দিল। বলল, ‘তবে সাবধান এটা যে তাঁর কোন ভয়ঙ্কর মতলবেরই অংশ তাতে কিন্তু সন্দেহ নেই।’

‘হু। তবে আমরা ভান করব ব্যাপারটাকে যেন মেনে নিয়েছি। যাই হোক, আপনার সঙ্গে যোগাযোগ রাখব…’

হঠাৎ পেছন থেকে ভোলোর কণ্ঠস্বর: ‘ও, বিয়ের পাত্র পাত্রী। বাঃ চমৎকার! তবু ধৈর্য ধরা উচিত। একটা সপ্তাহ মাত্র, সে আর ক’টা দিন! তারপর তো সারাটা জীবন পড়ে আছে, যত খুশি আনন্দ করবে তখন।-এবার লাঞ্চ।’

লাঞ্চে বিয়াট্রিচেকে দেখতে পেলাম না, শুধু সেদিন লাঞ্চেই নয়, এই এক সপ্তাহের মধ্যে একবারের জন্যেও তার দেখা পেলাম না। তার কাজ সব করল ব্রেডি। আট দিনের দিন মাঝরাতে ভোলো নিজে এসে আমার ঘুম ভাঙালেন, তাঁর সঙ্গে কুইল্প। উঠে বসলাম, হঠাৎ আলো চোখে পড়ায় চোখ পিট-পিট করে বললাম, ‘কী চান?’

ওঠো, পোশাক পরে নাও, জেমস। তোমার আজ বিয়ে।’

আমি বললাম, ‘বেশ, ঠিক আছে।’ নিজেরই গলার আওয়াজ নিজের কাছেই অবিশ্বাস্য ঠেকল- হতে পারে না, এ হতেই পারে না, তবে, যেরকম আশা করছিলাম ঘটনা যদি সেদিকে মোড় নেয় তাহলে হয়তো এ থেকেই মুক্তি-প্রচেষ্টার সূত্রপাত হতে পারে। বললাম, ‘পোশাক পরার সময় আমি একা থাকতে চাই, দশ মিনিটের মধ্যেই তৈরি হয়ে আসছি।’

ভোলো বললেন, ‘বেশ তো,’ পাশবিক উল্লাসে তাঁরা সারা শরীরে যেন খুশির হিল্লোল বয়ে গেল। তারপর যোগ করলেন, ‘পোশাক পরা হলে খাওয়ার ঘরে এসো, আগে একটু পানাহার করা যাবে।’

ওঁরা চলে গেলে আমি পোশাক পরে নিলাম, তারপর এগিয়ে চললাম। এগোচ্ছি, চিন্তায় আমার মন উদ্বেলিত। কীভাবে এই সুযোগটাকে কাজে লাগাব। খাবার ঘরে যেতে ভোলোর ঘরের সামনে দিয়ে আমাকে যেতে হবে। দরজাটা খোলা ছিল, দেখলাম বিয়াট্টিচে বধূর শুভ্র পোশাকে সেজেছে। তার সঙ্গে কথা বলতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু দুটো কারণে বিরত হলাম শেষ পর্যন্ত। তার একটা হলো সেই মুহূর্তে তার নড়াচড়া। ভোলোর ডেস্কের উপরে সে ঝুঁকে ছিল, মনে হলো একটা ড্রয়ার খুলে সেটা উল্টোপাল্টে দেখছে, আর অন্যটা হলো, যখন ইতস্তত করছিলাম তার কাছে যাব কি না ঠিক সেই সময়ে খাবার ঘরের দরজাটা খুলে গিয়েছিল। আমি সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে গেলাম সেদিকে। ভোলো আমাকে দেখে বললেন, ‘এসো জেমস। অনেক সময় নিয়েছ পোশাক পরতে। বিয়ের বর অমন নিড়বড়ে হবে কেন? এসো কিছু পান করা যাক।’

কিছু পান করার দরকার সত্যিই আমার ছিল, তাই বেশ কড়া হুইস্কি পান করলাম আমি। পানপাত্র নামিয়ে রাখতেই ভোলো বললেন, ‘এবার… চলো গির্জায়।

সেই ভয়ঙ্কর শোভাযাত্রা আর আজব পরিবেশের বর্ণনা সম্ভব নয়। সবার আগে চলেছে কুইল্প আর সবার শেষে ভোলো, মাঝখানে আমি। মনে হচ্ছে যেন আমি ফাঁসির দড়ি পরতে যাচ্ছি। এমন সময় রাতের স্তব্ধতা ভেঙে এক দীর্ঘ, তীক্ষ্ণ চিৎকার শোনা গেল, তা শেষ হলো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে হাসিতে। আমি টলছি, আমার শরীরের সব রক্ত যেন জমাট বেঁধে যাচ্ছে।

যেন বেশ মজা পেয়েছেন এইভাবে ঠান্ডা গলায় ভোলো বললেন, ‘সিমিয়নের বোধহয় ঘুম ভাল হচ্ছে না।’ বুঝতে পারলাম এ নামটা তিনি সেই নর-বানরকে দিয়েছেন, যাকে আমি খাঁচার মধ্যে দেখেছি।

ভোলো আবার বললেন, ‘কিংবা হয়তো ও তোমাকে হিংসে করছে, কী বল জেমস?’

যে বারান্দা দিয়ে আমরা চলেছি আগে সেখানে যাইনি। একটা ঘরের সামনে পৌঁছলে কুইল্প সেটা চাবি ঘুরিয়ে খুলল। দেখলাম সেটা একটা প্রাচীন ছোট গির্জা, অস্পষ্ট আলো সেখানে। ধীরে ধীরে উঠে গেলাম। শরীর সম্পূর্ণ ঢাকা কালো পোশাক পরা এক মূর্তি সেখানে নিশ্চল দাঁড়িয়ে আছে।

আবার খুলে গেল দরজাটা, ফিরে দেখলাম বিয়াট্টিচে প্রবেশ করছে কুকুরমুখো মানুষের বাহুতে ভর করে। বিয়াট্টিচের পরনে তখনও বধূর পোশাক, মুখ ঘোমটা দিয়ে ঢাকা। সে এসে আমার পাশে দাঁড়াল। শুরু হলো বিবাহোৎসব, ভোলোর চোখে শয়তানের দৃষ্টি। উৎসব শেষে হলে তিনি বললেন, ‘এবার আমরা বিবাহিত দু’জনকে বিয়ের আসরে নিয়ে যাব, তারা মধুচন্দ্রিমা যাপন করবে।’

আবার শুরু হলো শোভাযাত্রা।

মনে হলো এবার ভোলোর সময় এসেছে, তার এত প্রস্তুতি এই মুহূর্তটার জন্যে। এক ইতর-সুলভ উত্তেজনা যেন পেয়ে বসেছে তাঁকে। তিনি বললেন, ‘জেমস, এসো, তোমার সুন্দরী স্ত্রীকে চুম্বন করো।’

আমি বললাম, ‘করব, কিন্তু এক্ষুনি নয়, আপনারা চলে গেলে তখন।’ এই ভয়ঙ্কর জায়গায় একমাত্র যাকে সহকর্মী হিসেবে পেয়েছি তার সঙ্গে একা থাকার জন্যে তখন আমি ছটফট করছি।

‘বাজে কথা বোলো না, শান্তি আর সুখের এই চুম্বন আমরা প্রত্যক্ষ করতে চাই। চিরদিনের প্রথা এই। নমুনা হিসেবে একটা চুম্বন দেখার পরেই আমরা ঘরে যাব। যাও যাও, চুম্বন কর, ওকে চুমু খাও!’

ভেবে দেখলাম ওঁর কথা না শুনলে নিষ্কৃতি নেই। তা ছাড়া বিয়াট্টিচের রূপ আর বন্ধুত্বের কথাও মনে পড়ল, কাছে গিয়ে ওড়না খুলে চুম্বন করতে গেলাম। সেই সময় ভোলোর উত্তেজনা এমন তুঙ্গে পৌঁছল যে উত্তেজনার আতিশয্যে তাঁর মূর্ছা যাওয়ার দশা। এবং সেই মুহূর্তেই আমি লোকটার পাশবিক, ঘৃণ্য রুচির পূর্ণ পরিচয় পেলাম। ওড়নার অন্তরালে যে মুখ আমার চোখে পড়ল এককালে তা ছিল সুন্দর, কিন্তু ভোলোর অস্ত্রোপচারের ফলে তা হয়েছে অত্যন্ত বীভৎস, দেখলে বিতৃষ্ণায় মন ভরে ওঠে। সে মুখে ঠোঁট নেই, চোখে পাতা নেই, সে চোখ লাল, নিষ্প্রাণ। মুখ বলতে একটা গহ্বর, সেখানে আছে শুধু মাড়ি আর দাঁত, কথা বলার শক্তিও তার নেই। পলকহীন দু’চোখ আমার দিকে স্থির তাকিয়ে আছে, সে চোখ কোন সময়েই বন্ধ হয় না। আমার মুখে একটাও কথা সরল না, আপনা থেকেই আমার ঠোঁট মাড়ির উপরে সরে গেল। চমকে পেছিয়ে গেলাম আমি। মিনিট দুয়েকের জন্যে যেন আমি আতঙ্কের বশে মরতেই বসেছিলাম। সেই অবস্থাতেই ভোলোর হাসি আমার কানে এল, ‘যাও যাও, চুম্বন কর, অসুবিধে কী? ও- যে তোমার চুম্বনের প্রতীক্ষায় রয়েছে!

ভয়ঙ্কর প্রাণীটির দিকে তাকিয়ে আমি যেন পাথরে পরিণত হয়েছি। এবার ভোলো তাঁর শেষ তুরুপের তাস খেললেন। হঠাৎ খুব গম্ভীর হয়ে গেলেন। কুইল্পকে বললেন, ‘বুঝেছি, বুঝেছি, ওদের দু’জনকে ঠিক মানাচ্ছে না, বধূর আপত্তির কারণটা বুঝতে পারছি, সে এমনই বর চায় যে হবে তার সমান। এর একটা ব্যবস্থা করা দরকার।’

তারপর আমার দিকে ফিরে বললেন, ‘এসো, জেমস। আমার অপারেশনের ঘর তুমি দেখেছ, সেখানে সব কিছুই ঠিক-ঠিক সাজানো আছে। যাতে তোমাদের দু’জনেরই তৃপ্তি হয় সেই চেষ্টা করব,তোমাকে ও অপারেশন করে তোমার বধূর মত চেহারা বানিয়ে দেব।’

আমার দু’হাত মুষ্টিবদ্ধ হলো। এখন আমাকে অপারেশনের জন্যে নিয়ে যাওয়া হবে, আর তার পরেই আমার বীভৎস রূপান্তর ঘটবে।

ভোলো বললেন, ‘কুইল্প, নিয়ে চল ওকে।’

কুইল্প আমার দিকে এগিয়ে আসছে, এমন সময় একটা ব্যাপার ঘটে গেল যে জন্যে ভোলোর মনোযোগ মুহূর্তের জন্যে সেদিকে আকৃষ্ট হলো, এবং তা দেখে ভোলো হাত উঁচু করলেন। বিকট চেহারার বধূটি পায়ে পায়ে আমার দিকে এগিয়ে আসতে শুরু করেছে।

ভোলো বলে উঠলেন, ‘থামো কুইল্প, থামো। অত্যন্ত দারুণ এ দৃশ্য, বধূ স্বামীকে আলিঙ্গন করতে চলেছে। একটু দাঁড়াও।’

মহা আতঙ্কে আমি পেছিয়ে গেলাম এক পা। এমনভাবে সে হাত বাড়িয়ে আমার দিকে এগোচ্ছে, যেন আমাকে আলিঙ্গন করে চুম্বন করবে। আতঙ্কের উপর আতঙ্ক! আবার হেসে উঠলেন ভোলো। আমি পেছোতে থাকলাম, কিন্তু আর পেছানো সম্ভব হলো না, পিঠ দেয়াল স্পর্শ করেছে। মহিলাকে কাছে ঘেঁষতে না দেয়ার জন্যে আমি দু’হাত সামনে বাড়িয়ে দিলাম।

কাছে এসে সে এক হাতে আমার কাঁধ জড়িয়ে ধরল। কাঁপতে কাঁপতে আমি মাথা নিচু করলাম। অনুভব করলাম, তার অন্য হাত পোশাকের ভিতরে চলে গেল। একটা শক্ত ধাতব বস্তু সে আমার হাতে দিল। তখন বুঝতে পারলাম কী সে ড্রয়ারের ভিতরে খুঁজছিল, সে হচ্ছে এই রিভলভারটা, যেটা সে এখন আমার হাতে দিল।

ভোলোর গলা শুনতে পেলাম, ‘চমৎকার! ওকে বুকে জড়িয়ে ধর, জেমস, তোমার জন্যে যে ও কাঁদছে!’

রিভলভারটা আমি শক্ত হাতে চেপে ধরলাম তার শরীরের আড়ালে। তারপর একপাশে সরে গেলাম শত্রুদের মুখোমুখি হতে। সেইসঙ্গে মহিলাটিও সরে গেল যাতে শত্রুদের ঠিক সামনে পাই। আতঙ্কের কালো ছায়া ভোলোর মুখে খেলে গেল। চিৎকার করে কুইল্পকে আদেশ করতেই দৈত্যটা আমার দিকে এগিয়ে এল।

‘ধর ওকে, ধর, কুইল্প! টুকরো টুকরো করে ফেল ওকে!’ ভোলো চিৎকার দিলেন।

কোন মানুষ নয়, এক দানবের আমি মোকাবিলা করছি। সঙ্গে সঙ্গে আমি রিভালভারের ট্রিগার টেনে দিলাম একবার, দু-বার তিনবার। হাত তুলে, টলতে টলতে কুইল্প মাটিতে পড়ে গেল।

এবারে আমি ভোলোকে অসহায় অবস্থায় পেয়ে গেলাম। প্রচণ্ড ক্রোধে বলে উঠলাম, ‘এবার আর তোর নিস্তার নেই। তোর মরণ আমার হাতে।’

হঠাৎ ভোলো মেঝেয় শুয়ে পড়ে চিৎকার করে অনুরোধ করলেন তাঁকে ছেড়ে দিতে, আর দু’হাত মেঝেতে ঠুকতে থাকলেন।

তাঁর ভয়ঙ্কর চিৎকার শুনে তাঁর হাতে যারা বিকলাঙ্গ হয়েছে তাদের অনেকেই সেইসঙ্গে এমন চিৎকার করে উঠল যে সেই সমবেত চিৎকার যেন মাইলের পর মাইল ছড়িয়ে পড়ল।

সেই সঙ্গে অকস্মাৎ সাইরেনগুলোর বন্য আওয়াজও শোনা গেল, এবং সেই পৈশাচিক তাণ্ডবে মুহূর্তের জন্যে আমি ভোলোর কথা ভুলে গেলাম। জীবন ভিক্ষা করতে করতে তিনি গুঁড়ি মেরে আমার দিকে এগোচ্ছিলেন, লক্ষ্য করিনি কখন তিনি পোশাকের ভিতর থেকে একটা ছোট ছুরি বের করে নিয়েছেন। কিন্তু বধূর পোশাক পরা মহিলাটি লক্ষ্য করেছিল, যেই তিনি আমাকে লক্ষ্য করে ছুরি বসাতে যাচ্ছিলেন সেই মুহূর্তে সে আমার সামনে লাফিয়ে পড়ল, ছুরিটি তার হাতে বিদ্ধ হলো। দেখলাম তার বাহু থেকে রক্ত ঝরছে। আমি আবার রিভলভারের ট্রিগার টেনে দিলাম এবং সঙ্গে সঙ্গে ভোলোর ভবলীলা সাঙ্গ হলো।

আমি এবার আমার রক্ষাকর্তার দিকে তাকালাম যাকে বিকলাঙ্গ বিয়াট্টিচে বলে মনে করেছিলাম। কিন্তু ততক্ষণে তারও মৃত্যু হয়েছে, ছুরিতে বিষ মাখানো ছিল। মূর্তিমান অমঙ্গলের মৃত্যুতে তখন সব হট্টগোল থেমে গেছে, এবং সেই মুহূর্তে বর-কনের ঘরের দরজার কাছে একজন এসে হাজির হলো।

আমি যেন নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে পারলাম না। এ যে বিয়াট্টিচে, সম্পূর্ণ সুস্থ এবং স্বাভাবিক।

সে আমার কাছে এগিয়ে এল, আমি জড়িয়ে ধরলাম তাকে। আমার কাঁধে সে মুখ লুকোল, তার সারা শরীর কাঁপছে।

শেষ পর্যন্ত আমি বললাম, ‘জানো,-আমি ভেবেছিলাম বধূটি বুঝি তুমি!’

আমার দিকে মুখ তুলে বিয়াট্টিচে বলল, ‘ও হচ্ছে ভোলোর স্ত্রী। আপনার আর আমার বিবাহ ভোলোর পক্ষে সহ্য করা সম্ভব হত না, কারণ সে বুঝতে পেরেছিল এমন এক বন্ধুত্ব আমাদের মধ্যে গড়ে উঠেছে যা নষ্ট করা কোনমতেই তার পক্ষে অসম্ভব নয়। আর সেইজন্যেই সে তার বিকৃত চেহারার বধূকে দিয়ে ওই পৈশাচিক খেলায় মেতে উঠতে চেয়েছিল। ওদের স্বামী স্ত্রী দু’জনেরই পরস্পরের প্রতি প্রচণ্ড ঘৃণা ছিল, স্ত্রীকে সে নিজের হাতে ওই পৈশাচিক রূপ দিয়েছিল।’

আমি বললাম, ‘বিয়াট্টিচে, মহিলাটি আমার জীবনও বাঁচিয়েছে।’

ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়ে আমরা সেখানকার আশাহত মানুষদের মুক্তি দিলাম। নিপুণ চিকিৎসকের পক্ষে যা করা সম্ভব সবই তাদের জন্যে করা হলো। সেই থেকে ওই দুর্গটি নির্জন আরও নীরব। আশা করি এর কথা আর কেউ মনে রাখবে না, এবং আমার স্ত্রী বিয়াট্টিচে আর আমিও ভুলে যেতে যথাসাধ্য চেষ্টা করব।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *