উইলিয়াম অ্যান্ড মেরী – রোল্ড ডাহল
মৃত্যুর আগে উইলিয়াম পার্ল খুব সামান্য অর্থ রেখে গিয়েছিল স্ত্রী মেরীর জন্য। উইলিয়ামের মৃত্যুর হপ্তাখানেক পর তার আইনজীবী মেরীকে একটি খাম দিয়ে বলল, ‘আমাকে বলা হয়েছে এটা আপনাকে পৌঁছে দিতে। জিনিসটা সম্ভবত ব্যক্তিগত। কাজেই বাসায় গিয়ে খাম খুললেই ভাল হবে।’
মিসেস পার্ল খামটা নিয়ে, কোন কথা না বলে চলে এল বাড়িতে। খামটা খোলার আগে এক মুহূর্ত চিন্তা করল। এর মধ্যে ফর্মাল কোন চিঠি থাকতে পারে। উইলিয়ামের ব্যবহারে কখনও ইনফরমাল কিছু দেখেনি মেরী। লোকটা অভিনয় করতে জানত না। মেরীর সঙ্গে কোনদিন অভিনয় করেওনি। মেরীর ধারণাই ঠিক। খাম খুলে একটা ফর্মাল চিঠিই পেল সে। তাতে লেখা: আমার প্রিয় মেরী, আমার বিশ্বাস আমার চির বিদায়ে তুমি খুব বেশি ভেঙে পড়বে না, বরং নিজের কাজগুলো ঠিকঠাকমত চালিয়ে যাবে। আর টাকা-পয়সা খরচ করার ব্যাপারে সতর্ক থেকো…ইত্যাদি ইত্যাদি।
খামের ভিতর চিঠি ছাড়াও একগুচ্ছ কাগজ চোখে পড়ল তার। বেশ মোটা কাগজের তাড়াটা। কাগজের তাড়াটা কৌতূহলী করে তুলল মিসেস পার্ল ওরফে মেরীকে। সে একটা সিগারেট ধরাল। তারপর মন দিল পড়ায়। ছোট, স্পষ্ট হস্তাক্ষরে লেখা। ভাষা সাবলীল। উইলিয়ামের আত্মজীবনী বলা চলে।
কিন্তু এ কেমন আত্মজীবনী? একটানে লেখাটা পড়ে ফেলল মেরী। তারপর স্তম্ভিত হয়ে বসে রইল। তারপর আবার পড়া শুরু করল। এবার ধীরে ধীরে প্রতিটি শব্দ আর বাক্য যেন মগজে ঢুকিয়ে নিল সে।
প্রিয় মেরী, এই লেখাটি একান্ত তোমারই জন্যে। আমি চলে যাবার কয়েকদিন পর তোমার কাছে লেখাটি হস্তান্তর করা হবে। তবে লেখাটি পড়ে ভয় পেয়ো না। এটা আর কিছু নয়, ল্যান্ডি আমাকে নিয়ে কী করতে চলেছে তারই একটি ব্যাখ্যা মাত্র। আর তার কাজে আমি কেন সম্মতি জানিয়েছি, তার থিওরি এবং প্রত্যাশা সবকিছুর ব্যাখ্যাই তুমি এর মধ্যে পাবে। গোটা ব্যাপার জানার অধিকার তোমার আছে। কারণ তুমি আমার স্ত্রী। অবশ্য এর আগে বহুবার ব্যাপারটা তোমার কাছে বলার চেষ্টা করেছি। কিন্তু তুমি শুনতে চাওনি। পুরো ব্যাপারটা জানার পর তোমার মানসিকতার পরিবর্তন ঘটবে হয়তো। হয়তো আমাকে নিয়ে গর্বও হবে তোমার। আমি জানি আমার সময় দ্রুত ঘনিয়ে আসছে। তাই কাজটা করতে মোটেই দ্বিধাবোধ করিনি। সতেরো বছর আমি কাটিয়েছি অক্সফোর্ডে। এখানে পড়াশোনা শেষ করে অধ্যাপনা শুরু করেছি। কাজেই যখন জানতে পারলাম প্রিয় এ জায়গা থেকে চিরদিনের জন্য চলে যেতে হবে, কারণ ক্যান্সার হয়েছে আমার, স্বভাবতই মুষড়ে পড়লাম। আর ক্যান্সারটা ধরা পড়েছে এমন এক সময়ে যে, বেঁচে থাকার কোন আশাই নেই। ধীরে ধীরে নিঃশব্দ মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলাম আমি। তারপর, হপ্তা ছয়েক আগে, মঙ্গলবারের এক সকালে ল্যান্ডি এল আমার সাথে দেখা করতে। তারপর সবকিছু কেমন যেন ওলোট পালোট হয়ে গেল। হাসপাতালের বেডে শুয়েছিলাম আমি। ল্যান্ডি এল খুব সকালে। তখনও তোমার আসতে অনেক দেরি। ওকে তো তুমি চেন। যেখানে যায়, মনে হয় যেন ঝড় এসেছে। হাসি, আনন্দ আর উচ্ছ্বাসের তাজা বোমা একটা। হাসতে হাসতে ঢুকল ও আমার কেবিনে। দাঁড়াল বিছানার পাশে। ঝকঝকে চোখ মেলে কিছুক্ষণ দেখল আমাকে। তারপর বলল, ‘উইলিয়াম, দোস্তো। এতদিনে যা চেয়েছি পেয়ে গেছি আমি। তোমার মত একটি কেসই চেয়েছি এতদিন।’ জন ল্যান্ডির সাথে তেমন ঘনিষ্ঠতা নেই তোমার। ও খুব একটা আমাদের বাড়িতে যায়ওনি। তবে ওর সাথে আমার বন্ধুত্বের বয়স নয় বছর হলো। দর্শনের শিক্ষক হলেও মনোবিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহ আমার প্রচুর। ল্যান্ডিরও তাই। ফলে দু’জনের বন্ধুত্ব গড়ে উঠতে সময় লাগেনি।
যা হোক, ল্যান্ডি আমার বিছানার পাশের একটা চেয়ারে বসে বলল, ‘তুমি আর ক’দিনের মধ্যেই মারা যাচ্ছ, তাই না?’
এ ধরনের সরাসরি প্রশ্ন ল্যান্ডির মত মানুষকেই মানায়। তবে বলার ভঙ্গিটা এমন যে, মৃত্যুপথযাত্রী মানুষও কিছু মনে করতে পারবে না ওর কথায়।
‘তুমি মারা যাবার পর ওরা তোমাকে কবর দেবে,’ বলে চলল ল্যান্ডি, ‘তুমি কী মনে কর, তারপর স্বর্গে চলে যাবে?’
‘এ ব্যাপারে আমার সন্দেহ আছে,’ বললাম আমি।
‘নাকি নরকে?’
‘নরকে যাবার মত অপরাধ তো আমি করিনি, কিন্তু এসব কথা কেন ল্যান্ডি?’
‘কারণ’ আমাকে সতর্কভাবে লক্ষ করল ও। ‘আমি জানি মৃত্যুর পর তুমি জানতেও পারবে না তোমার কোথায় জায়গা হলো, তোমাকে কে কী বলল, যদি না…’ থামল সে, মৃদু হাসি ফুটল ঠোঁটে, আরও কাছে এগিয়ে এল। ‘…যদি না তোমার সমস্ত ভার আমার হাতে তুলে দিয়ে না যাও। তোমাকে একটা প্রস্তাব দিচ্ছি, গ্রহণ করবে?’
আমার দিকে এমন ক্ষুধার্ত ভঙ্গিতে তাকিয়ে রইল ও যেন আমি সরেস গরুর চর্বিদার একটা রান, ঝোলানো হয়েছে আমাকে দোকানে, ও মাংসের টুকরোটা কিনে নিয়েছে, র্যাপিং পেপারে মুড়িয়ে দেয়ার অপেক্ষায় আছে।
‘কথাটা খুব সিরিয়াস, উইলিয়াম। একটা প্রস্তাব দেব। গ্রহণ করবে কিনা?’
‘তোমার কথার মাথা-মুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছি না।’
‘সব কিছুই তোমাকে ব্যাখ্যা করব। শুনবে আমার কথা?’
‘বলো শুনি। কারণ, কথা শুনতে আমার কোন ক্ষতি নেই। বরং লাভ। বিশেষ করে মৃত্যুর পরে লাভবান হবে, যদি আমার প্রস্তাব মেনে নাও।’ শুনে লাফিয়ে উঠলাম আমি। ল্যান্ডি বলতে শুরু করল :
‘একটা জিনিস নিয়ে গত কয়েক বছর ধরে আমি গবেষণা করে চলেছি, উইলিয়াম। এখানকার দু’একটি হাসপাতাল আমাকে গবেষণার কাজে যথেষ্ট সহায়তা করছে। ল্যাবরেটরির প্রাণীদের ওপর সফল এক্সপেরিমেন্ট চালিয়েছি আমরা। এখন শুধু মানুষের ওপর এক্সপেরিমেন্ট বাকি। আমার ধারণা, আমি সে এক্সপেরিমেন্টেও সফল হব।’
বিরতি দিল ল্যান্ডি। ঝুঁকে এল আমার দিকে। ওর চোখ জ্বলজ্বল করছে উত্তেজনায়, তীব্র আলো যেন বিচ্ছুরিত হচ্ছে চোখের মণি থেকে। যেন আমাকে বলতে চাইছে, একমাত্র আমিই তোমাকে রক্ষা করতে পারি।
আবার শুরু করল ল্যান্ডি:
‘বেশ অনেকদিন আগে একটি রাশান শর্ট মেডিকেল ফিল্ম দেখেছিলাম। ছবিটি ভয়ংকর তবে যথেষ্ট চিত্তাকর্ষকও। ছবিটিতে দেখিয়েছে-একটি কুকুরের ধড় থেকে মুন্ডু সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়েছে, কিন্তু মস্তিষ্ক বা ব্রেনের ভেতর কৃত্রিম হৃদপিন্ডের আর্টারি এবং ভেইন থেকে স্বাভাবিক রক্ত সরবরাহ করা হচ্ছে। অবাক ব্যাপার হলো-একটা ট্রের মধ্যে বসানো কুকুরটার মাথা ছিল জ্যান্ত! ওটার ব্রেন কাজ করছিল। নানা টেস্টের মাধ্যমে ওরা ব্যাপারটা প্রমাণ করেছে। যেমন, যখন খাবার দেয়া হত, খাবার কুকুরটার মুখের সামনে ধরলে ওটার জিভ বেরিয়ে আসত, খাবার চেটে খেত। ঘরের ভিতর কেউ ঢুকলে তাকে চোখ দিয়ে অনুসরণ করত কুকুরটা।
‘এ থেকে একটা ব্যাপার পরিষ্কার হয়ে যায়-মাথা এবং মস্তিষ্ক দুটোর কোনটারই জ্যান্ত থাকার জন্যে শরীরের বাকি অংশের অবলম্বনের প্রয়োজন পড়েনি। শুধু অক্সিজেন মেশানো রক্তের সরবরাহই কাটা মুন্ডুটাকে বাঁচিয়ে রাখছিল।
‘ওই ছবিটি দেখার পর আমার মাথায় একটি বৈপ্লবিক চিন্তা চলে আসে। আমি ভাবতে থাকি মৃত্যুর পর কোন মানুষের খুলি থেকে ব্রেন খুলে নিয়ে তাকে যদি কৃত্রিম উপায়ে বাঁচিয়ে রাখা যায়, কেমন হয়? এরপর আমি এ বিষয় নিয়ে গবেষণা শুরু করে দিই। আর মানুষ নিয়ে গবেষণার জন্যে তোমাকে আমি বেছে নিয়েছি, বন্ধু। কারণ তুমি তো আর ক’টা দিন পর মরেই যাবে।’
‘ঠাট্টাচ্ছলে জানতে চাইলাম কাজটা সে কীভাবে করবে। এর দীর্ঘ এবং জটিল বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আমাকে দিয়েছে ল্যান্ডি। কিন্তু সে বর্ণনায় গিয়ে আমি তোমার বিরক্তি উৎপাদন করতে চাই না, মেরী। আর তা তুমি বুঝবেও না। শুধু এটুকু বলি, ল্যান্ডি এমন এক আজব যন্ত্র আবিষ্কার করেছে, যার মধ্যে রয়েছে একটি কৃত্রিম হৃৎপিন্ড। এটি অক্সিজেন মেশানো রক্ত উৎপাদন করবে সঠিক তাপমাত্রাসহ, সে রক্ত পাম্প করে আমার ব্রেনে সরবরাহ করা হবে, আমার মৃত্যুর পরে। আর এই পদ্ধতিতে নাকি বছরের পর বছর আমার ব্রেন বেঁচে থাকবে, মানে আমি বেঁচে থাকব! কৃত্রিম হৃৎপিন্ডের কখনও ক্ষয় হবে না, রক্ত সরবরাহ থাকবে নিয়মিত। তাতে কোনদিন ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হবার আশঙ্কা থাকবে না এবং আমার ব্রেন নাকি দুই থেকে তিন শতাব্দী এভাবে অক্ষয় হয়ে থাকবে।
‘পরিকল্পনাটা রোমহর্ষক এবং উত্তেজক তো বটেই। শুরুতে অবশ্য ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। রাজি হইনি। পরে ভাবলাম মরে তো যাচ্ছিই। তবু বিজ্ঞানের জন্যে নিজেকে উৎসর্গ করলে ক্ষতি কী? তা ছাড়া ল্যান্ডির উদ্ভট গবেষণা সফল হলে, আবার আমি বেঁচে উঠব। বেঁচে থাকতে পারব টানা তিনশোটি বছর। ইতিহাস সৃষ্টি করব আমি। আবার বেঁচে ওঠার প্রবল উন্মাদনা পেয়ে বসল আমাকে। ল্যান্ডিকে বললাম অপারেশনের জন্যে আমি প্রস্তুত। অবশ্য অপারেশনটা হবে আমার মৃত্যুর সাথে সাথে। কারণ হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে যাবার চার থেকে ছয় মিনিটের মধ্যে অক্সিজেন এবং তাজা রক্তের সরবরাহের অভাবে অকেজো হয়ে যায় ব্রেন। কাজেই এর আগেই অপারেশনটা করতে হবে। তবে ল্যান্ডি জানিয়েছে তার আশ্চর্য মেশিনের কারণে আমার ব্রেন কোনভাবেই ড্যামেজ হবে না। অপারেশনে আমার মাথাটা কেটে আলাদা করে রাখা হবে একটা বেসিনে। মূলত ওটাই হবে এরপর থেকে আমার ঘরবাড়ি।
‘ল্যান্ডি বলেছে, অপারেশনের পরে সবকিছুই আমি দেখতে পাব। এমনকী খবরের কাগজ বা বইও পড়তে পারব। তবে শুরুতে একটি নির্দিষ্ট সীমানায় এটির আওতা সীমাবদ্ধ থাকবে। পরে ধীরে ধীরে এর পরিধি বৃদ্ধি পাবে। অবশ্য আমি মানুষের কথা শুনতে পাব না। শোনার ক্ষমতা দাবি করেছিলাম ল্যান্ডির কাছে। ল্যান্ডি বলেছে, ওটার ব্যবস্থা করা এ মুহূর্তে তার পক্ষে সম্ভব নয়। আর কথাও বলতে পারব না। কারণ আমার তো মুখই থাকবে না। শুধু চোখে দেখার জন্যে আমার ব্রেনের সাথে একটি কৃত্ৰিম মণি লাগিয়ে দেয়া হবে। আমি যে সচেতন অবস্থায় আছি, সবকিছু দেখতে পাচ্ছি, এটা জানা যাবে ইলেকট্রোএনসেফালোগ্রাফের সাহায্যে। ইলেকট্রোডগুলো সরাসরি আমার মস্তিষ্কের সামনের অংশের সাথে জোড়া লাগানো থাকবে। শেষে ল্যান্ডি বলল, ‘তুমি অসাধারণ এক ইতিহাস সৃষ্টি করতে চলেছ, উইলিয়াম। তোমাকে কেউ বা কোন কিছু বিরক্ত করবে না। তুমি কোন যন্ত্রণাও অনুভব করবে না। কারণ যন্ত্রণা অনুভব করার মত কোন নার্ভ তোমার থাকবে না। ভয়, দুঃখ, তৃষ্ণা, খিদে কোন কিছুই তোমাকে স্পর্শ করবে না। এমনকী কোন রকম জৈবিক কামনাও জাগ্রত হবে না। শুধু ব্রেনের মধ্যে থাকবে তোমার স্মৃতিশক্তি, তোমার চিন্তা- চেতনা, বুদ্ধি। কে জানে একদিন হয়তো অসাধারণ কোন সূত্ৰ তুমি আবিষ্কার করে বসবে!’
‘আমি অসাধারণ কোন কিছু আবিষ্কার করে ফেলব কিনা জানি না। তবে এটা যে অসাধারণ একটা ব্যাপার ঘটতে চলেছে, তাতে কোনই সন্দেহ নেই।
‘আমি এ ব্যাপারটা নিয়ে তোমার সাথে বহুবার কথা বলতে চেয়েছি, মেরী। কিন্তু তুমি আমার কোন কথাই শুনতে চাওনি। তারপর ব্যাপারটি লিখে যাবার সিদ্ধান্ত নিই। অবশ্য দীর্ঘ সময় লেগেছে লিখতে। তবে তোমাকে ‘বিদায়’ বলব না। কারণ ছোট্ট একটা চান্স আছে। ল্যান্ডি যদি তার কাজে সফল হয়, আবার হয়তো তোমার সাথে দেখা হবে আমার। ‘আমি আমার উকিলকে বলে যাব এ লেখাটি যেন আমার মৃত্যুর এক হপ্তা পর তোমার কাছে হস্তান্তর করা হয়। এখন, যখন তুমি লেখাটি পড়ছ, ল্যান্ডির অপারেশনের পর সাতদিন চলে গেছে। গোটা ব্যাপারটা সম্পর্কে তুমি অবহিত হলে। জানি না এখন কী করবে, তবে আমার অনুরোধ ল্যান্ডির সাথে দেখা করো। আমি তাকে বলেছি তুমি সাত দিনের দিন তার সাথে দেখা করবে।
তোমার বিশ্বস্ত স্বামী
উইলিয়াম
বি: দ্র: আমি চলে যাবার পর থেকে সবসময় ভদ্রভাবে চলাফেরার চেষ্টা করবে, মনে রাখবে বৈধব্য খুব কঠিন জিনিস। মদ পান করবে না। অহেতুক টাকা ওড়াবে না। সিগারেট খাবে না। তুমি জান আমি নিজে সিগারেট খাইনি কোনদিন, কারও খাওয়া পছন্দও করি না। দোকানের পেস্ট্রি খাবে না। লিপস্টিক মাখবে না। টেলিভিশন অ্যাপারেটাস কিনবে না। গরমের সময় আমার ফুল গাছে নিয়মিত পানি দেবে। আর আমার ফোন ব্যবহার করার কোন প্রয়োজন নেই বলে আশা করছি লাইনটা কেটে দেবে।’
মিসেস পার্ল পান্ডুলিপির শেষ পাতাটি আস্তে রেখে দিল সোফার উপর। তার ছোট্ট মুখখানা কঠিন আকার ধারণ করেছে, ফুলে উঠেছে নাকের পাটা। গোটা ব্যাপারটা তার কাছে বীভৎস লাগছে। লেখাটার কথা মনে পড়তে শিউরে উঠল গা।
ব্যাগ খুলে আরেকটা সিগারেট বের করল সে, ধরাল। ঘন ঘন টানে ধোঁয়ায় ভরিয়ে ফেলল ঘর। ধোঁয়ার মেঘের ভিতর থেকেও স্থির তাকিয়ে রইল নতুন কেনা নতুন মডেলের বিশাল আকারের টেলিভিশনের দিকে। টিভিটা উইলিয়ামের টেবিলের উপর রেখে দিয়েছে সে। উইলিয়াম যদি দৃশ্যটা দেখত কী বলত, ভাবল মিসেস পার্ল।
হঠাৎ মনে পড়ে গেল বছর খানেক আগের একটা ঘটনা। রান্নাঘরের খোলা জানালার সামনে দাঁড়িয়ে সে মাত্র একটা সিগারেট ধরিয়েছে, রেডিওতে উচ্চস্বরে ড্যান্স মিউজিক বাজছে, এমন সময় বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত ওখানে তার স্বামী এসে হাজির। মেরীকে সিগারেট খেতে আর গান শুনতে দেখে কী ভয়ানক রেগে গিয়েছিল উইলিয়াম! তারপর থেকে সে স্ত্রীর হাতখরচা বন্ধ করে দেয়। মেরীর সিগারেট খাওয়া দু’চক্ষে দেখতে পারত না উইলিয়াম। তার এক কথা-যে জিনিস উইলিয়ামের অপছন্দ তার স্ত্রী তা খাবে কেন? অনেক কিছুই অপছন্দ ছিল উইলিয়ামের। এমনকী বাচ্চা-কাচ্চাও পছন্দ করত না বলে মেরী মা হতে পারেনি।
এখন কোথায় গেল তোমার পছন্দ-অপছন্দ? মনে মনে হাসল মিসেস পার্ল।
সিগারেট শেষ করল সে। তারপর আরেকটা ধরিয়ে পা বাড়াল টেলিফোনের দিকে। টিভি সেটের পাশেই ওটা রাখা। উইলিয়ামের মৃত্যুর পরেও সে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেনি। এদিকে উইলিয়াম বিশেষভাবে অনুরোধ করে গেছে মেরী যেন অবশ্যই ড. ল্যান্ডির সাথে যোগাযোগ করে। এক মুহূর্ত ইতস্তত করল সে, তারপর ইনডেক্স খুঁজে ল্যান্ডির নাম্বার বের করল।
‘আমি ড. ল্যান্ডির সাথে কথা বলতে চাই, প্লিজ!
‘কে বলছেন?’
‘মিসেস পার্ল। মিসেস উইলিয়াম পার্ল।’
‘এক মিনিট, প্লিজ!’
একটু পরেই ল্যান্ডির কণ্ঠ ভেসে এল।
‘মিসেস পার্ল?’
‘জ্বী, বলছি।’
এক মুহূর্ত নীরব থাকল ওপাশ।
‘অবশেষে ফোন করলেন, মিসেস পার্ল! আমি সত্যি খুব খুশি হয়েছি। একবার আসবেন হাসপাতালে? তা হলে কথা বলা যেত। আপনি বোধহয় ঘটনাটা জানার জন্যে আগ্রহী হয়ে আছেন, না?’
মিসেস পার্ল নিশ্চুপ রইল।
‘সবকিছুই চমৎকারভাবে শেষ হয়েছে। ওটা শুধু জীবিত নয়, মিসেস পার্ল, ওটা সচেতন। দ্বিতীয় দিনেই ওটার জ্ঞান ফিরেছে। খুব ইন্টারেস্টিং ব্যাপার, নয় কী?’
মিসেস পার্ল ল্যান্ডিকে বলে যাবার সুযোগ দিল। ‘আর ওটা দেখতে পাচ্ছে। প্রতিদিন ওটাকে খবরের কাগজও পড়তে দিচ্ছি।’
‘কী কাগজ?’ তীক্ষ্ণ গলায় জিজ্ঞেস করল মিসেস পার্ল।
‘ডেইলী মিরর। পত্রিকাটার হেডলাইনগুলো বড়বড়। পড়তে সুবিধা।’
‘ও মিরর পত্রিকা পড়ে না। ওকে টাইমস দেবেন।’
এক মুহূর্ত নীরবতা। তারপর ডাক্তার বলল, ‘ঠিক আছে, মিসেস পার্ল। তাই দেব। ওটাকে খুশি আর সন্তুষ্ট রাখার চেষ্টাই করে যাচ্ছি।’
‘ওটা ওটা করছেন কেন, ঝাঁঝিয়ে উঠল মিসেস পার্ল। ‘বলুন ওকে!
‘জ্বী, ওকে,’ বলল ডাক্তার। ‘দুঃখিত, মাফ করবেন। যা হোক, ওকে খুশি রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। তাই আপনাকে আসতে বলছি। ও আপনাকে দেখলে খুশিই হবে।’
দীর্ঘক্ষণ চুপ করে রইল মিসেস পার্ল। তারপর বলল, ‘আচ্ছা। আসছি আমি।’
‘আসলে খুব ভাল হবে। জানতাম আপনি আসবেন। আপনার জন্যে অপেক্ষা করব আমি। সোজা দোতলায় চলে আসবেন।’
আধঘণ্টা পর হাসপাতালে পৌঁছে গেল মিসেস পার্ল।
‘ওকে দেখে আশাকরি অবাক হবেন না,’ ডক্টর ল্যান্ডি ওর পাশে হাঁটতে হাঁটতে বলল।
‘হব না।’
‘প্রথম দর্শনে শক্ড হতে পারেন। আসলে ওর বর্তমান চেহারাটা খুব একটা দর্শনযোগ্য নয়।’
‘আমি চেহারা দেখে ওকে বিয়ে করিনি, ডক্টর।’ ঘুরল ল্যান্ডি, সরাসরি তাকাল মিসেস পার্লের দিকে
কী অদ্ভুত এক মহিলা, ভাবল সে। একসময় দেখতে সুন্দরী ছিল। এখন ক্লান্ত, জীবনযুদ্ধে পরাজিত, বিপর্যস্ত লাগছে। খানিক চুপচাপ হাঁটল ওরা।
‘ভেতরে গিয়ে অস্থির হয়ে উঠবেন না,’ বলল ল্যান্ডি। ‘সরাসরি ওর মুখের দিকে না তাকানো পর্যন্ত ও বুঝতেই পারবে না যে আপনি এসেছেন। ওর চোখ সবসময় খোলা থাকে। তবে চোখের মণি নড়াচড়া করার ক্ষমতা নেই। কাজেই ওর দেখার ক্ষমতাও সীমাবদ্ধ। বর্তমানে আমরা ওকে ছাদের দিকে তাকানো অবস্থায় রেখেছি। আর হ্যাঁ, ও কিছুই শুনতে পায় না। কাজেই যে কোন কথা বলতে পারবেন মন খুলে। এই যে, এসে পড়েছি।’
ল্যান্ডি একটা দরজা খুলল, মিসেস পার্লকে ছোট, চৌকোনা ঘরটাতে ঢুকতে ইঙ্গিত করল। ‘আমি ওর খুব বেশি কাছে যেতে চাই না,’ মিসেস পার্লের বাহুতে হাত রেখে বলল সে। ‘এখানে একটু দাঁড়িয়ে ধাতস্থ হয়ে নিন।’
ঘরের মাঝখানে, উঁচু, সাদা একটা টেবিলের উপর বড় আকারের সাদা এনামেল বাটির মত একটা ওয়াশ বেসিন দাঁড় করানো। বেসিন থেকে আধা ডজন প্লাস্টিক টিউব বেরিয়ে এসেছে। টিউবগুলো কতগুলো কাঁচের পাইপের সাথে সংযুক্ত। পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে, একটা মেশিন থেকে বেরিয়ে আসা রক্ত গড়িয়ে নামছে পাইপ থেকে। ল্যান্ডি জানাল, ওটার নাম হার্ট মেশিন। ওটাই রক্ত সরবরাহ করে বাঁচিয়ে রেখেছে উইলিয়ামকে। হার্ট মেশিন থেকে ছন্দায়িত মৃদু শব্দ আসছে।
‘ওটার মধ্যে আছে,’ বেসিনের দিকে ইঙ্গিত করল ডাক্তার। ‘এতদূর থেকে পরিষ্কার দেখতে পাবেন না। একটু কাছে যান। তবে খুব বেশি কাছে নয়।’
ল্যান্ডি মিসেস পার্লকে নিয়ে দুই কদম সামনে বাড়ল।
ঘাড় লম্বা করে মিসেস পার্ল দেখল বেসিনের ভেতরটা তরল একটা পদার্থে বোঝাই। তরল জিনিসটা পরিষ্কার এবং স্থির। তার উপর ভাসছে গোলাকার একটা ক্যাপসুল, আকারে কবুতরের ডিমের সমান।
‘ওটা ওর চোখ,’ বলল ল্যান্ডি। ‘দেখতে পাচ্ছেন?’
‘হ্যাঁ।’
‘চোখটা খুব ভাল অবস্থায় আছে। ওটা ওর ডান চোখ। ওই চোখে সে আগের মতই দেখতে পায়।’
‘ছাদ দেখার মধ্যে মজার কিছুই নেই,’ মন্তব্য করল মিসেস পার্ল।
‘শুধু ছাদ দেখতে হবে না ওকে। সে ব্যবস্থাও আমরা করব। তবে এত দ্রুত তা সম্ভব নয়।’
‘ওকে ভাল কোন বই পড়তে দিন।’
‘অবশ্যই দেব। আপনার কোন সমস্যা হচ্ছে না তো, মিসেস পার্ল?’
‘না।’
‘তা হলে আরেকটু সামনে এগোই, চলুন। গোটা জিনিস পরিষ্কার দেখতে পাবেন।’
টেবিলের সামনে এসে দাঁড়াল ল্যান্ডি মিসেস পার্লকে নিয়ে।
‘ওই দেখুন,’ বলল ল্যান্ডি। ‘ওই যে আমাদের উইলিয়াম।’
যা ভেবেছিল তারচেয়ে প্রকান্ড লাগল উইলিয়ামকে, আর রক্তটাও অনেক বেশি গাঢ়। সারফেসের উপর নানা ভাঁজ আর বলিরেখা নিয়ে উইলিয়াম বড় আকারের শুঁটকি করা একটা আখরোটের আকার পেয়েছে। চারটে বড় ধমনী আর দুটো শিরা বেরিয়ে আছে ওর ব্রেনের সম্মুখভাগ থেকে, ঢুকেছে প্লাস্টিক টিউবের মধ্যে, হার্ট মেশিনের প্রতিটি স্পন্দনের সাথে, রক্ত যখন ঢুকছে, এক সাথে সবগুলো টিউব মৃদু ঝাঁকি খাচ্ছে।
‘ঝুঁকে সরাসরি চোখের দিকে তাকান,’ পরামর্শ দিল ল্যান্ডি। ‘তা হলে ও আপনাকে দেখতে পাবে। আপনি ওর দিকে তাকিয়ে হাসুন, চুমু খাওয়ার ভঙ্গি করুন। সম্ভব হলে ভাল ভাল কিছু কথা বলুন। শুনতে না পেলেও কী বলছেন বুঝতে পারবে নিশ্চয়ই।’
‘চুমু খাওয়ার ভঙ্গি করাটা ও মোটেই পছন্দ করবে না,’ বলল মিসেস পার্ল। ‘আমি বরং অন্যভাবে ওর সাথে কথা বলি। কিছু মনে করবেন না।’ সে টেবিলের কোনায় গিয়ে দাঁড়াল, ঝুঁকল বেসিনের উপর। সরাসরি তাকাল উইলিয়ামের চোখের দিকে।
‘হ্যালো, ডিয়ার,’ ফিসফিস করল সে। ‘এই যে আমি মেরী।’ উজ্জ্বল চোখটা অদ্ভুত কটমট করে তাকিয়ে রইল তার দিকে। ‘কেমন আছ, প্রিয়,’ জিজ্ঞেস করল সে। ‘ঠিক আছ তো?’
স্বচ্ছ প্লাস্টিক ক্যাপসুলের মধ্যে চোখটা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। চোখের বরফ নীল মণির চারদিকের সাদা জমিনের উপর সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম লালচে শিরাগুলোও স্পষ্ট। মনে হলো মিসেস পার্লের কথা শুনে কেঁপে উঠল মনিটা।
‘তোমার চিঠি পেয়েছি, ডিয়ার। সাথে সাথে ছুটে এসেছি দেখতে। ড. ল্যান্ডি বললেন, তুমি নাকি ভালই আছ। আস্তে আস্তে বললে তুমি হয়তো আমার ঠোঁটের নড়াচড়া দেখে বুঝতে পারবে কী বলছি।’
সন্দেহ নেই চোখটা দেখছে ওকে।
‘ওরা তোমার যত্নআত্তির কোন ত্রুটি করছে না, ডিয়ার। চমৎকার হার্ট মেশিনটা নিয়মিত পাম্প করে চলেছে। আমাদের দুর্বল হার্টের চেয়ে ওটা অনেক বেশি শক্তিশালী। আমাদের হার্ট যে কোন সময় অকেজো হয়ে যেতে পারে। কিন্তু তোমারটার সে সম্ভাবনা নেই।’
কাছ থেকে চোখটাকে দেখছে মিসেস পার্ল, বোঝার চেষ্টা করছে ওটার ভাষা।
‘তুমি বেশ আছ, ডিয়ার। সত্যি ভাল আছ।’
চোখটার মধ্যে কোথায় যেন কোমলতা আর দয়ার ছায়া লক্ষ করল মিসেস পার্ল, যা আগে কখনও দেখেনি।
‘আপনি কি নিশ্চিত ও সচেতন?’ ডাক্তারের দিকে তাকাল সে।
‘অবশ্যই।’ জবাব দিল ডাক্তার।
‘আমাকে দেখতে পাচ্ছে?’
‘একশোবার।’
‘ব্যাপারটা দারুণ, না? ও নিশ্চয়ই খুব অবাক হচ্ছে সবকিছু দেখে।’
‘ওর অবাক হবার কিছু নেই। সে খুব ভালভাবেই জানে সে কোথায় এবং কেন। যদি কথা বলার ক্ষমতা থাকত, তা হলে আপনার সাথে আলাপও চালিয়ে যেত।’
কথা বলতে পারে না বলেই আমার উপর আর বিধি-নিষেধের বেড়াজাল আরোপ করতে পারবে না, ভাবল মিসেস পার্ল। তুমি অনেক ভুগিয়েছ আমাকে। এবার আমার পালা।
‘ভাল কথা, ডক্টর,’ বলল সে, ‘ওকে আমি কখন বাড়ি নিয়ে যেতে পারব?’
‘মানে?’
‘বললাম কখন ওকে বাড়ি নিয়ে যাবার অনুমতি পাব।’
‘আপনি ঠাট্টা করছেন,’ বলল ল্যান্ডি।
ধীরে ধীরে মাথা ঘোরাল মেরী, ঠান্ডা চোখে তাকাল ল্যান্ডির দিকে।
‘আমি কেন আপনার সাথে ঠাট্টা করতে যাব।’
‘ওকে এখান থেকে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।’
‘কেন সম্ভব নয় বুঝতে পারছি না।’
‘এটা একটা এক্সপেরিমেন্ট, মিসেস পার্ল!’
‘ও আমার স্বামী, ড. ল্যান্ডি।’ নার্ভাস ভঙ্গিতে হাসল ল্যান্ডি। ইয়ে মানে…’
‘ও আমার স্বামী,’ কণ্ঠে রাগ নেই, খুব শান্ত গলায় কথাটা পুনরাবৃত্তি করল মেরী। যেন ডাক্তারকে মনে করিয়ে দিল সাধারণ ব্যাপারটা।
‘সবাই জানে, আপনি এখন বিধবা, মিসেস পার্ল,’ জিভ দিয়ে ঠোঁট ভেজাল ল্যান্ডি। ‘কাজেই আপনার দাবি ত্যাগ করা উচিত।’
ঝট্ করে ঘুরে দাঁড়াল মিসেস পার্ল, জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। ‘যা বলার বলে দিয়েছি,’ ব্যাগ খুলে সিগারেট বের করল। ‘আমি ওকে বাড়ি নিয়ে যাব।’
দুই ঠোঁটের ফাঁকে ওকে সিগারেট গুঁজতে দেখল ল্যান্ডি, সিগারেট ধরাল। এ মহিলা সত্যি অদ্ভুত, আবার ভাবল সে। বেসিনে স্বামীকে অমন অবস্থায় দেখে মনে হয় মজাই পেয়েছে।
ওখানে তার স্ত্রীর ব্রেন যদি ওভাবে পড়ে থাকত আর তার স্ত্রী ক্যাপসুলের মাঝ থেকে তার দিকে তাকিয়ে থাকত, তা হলে কেমন হত?
মোটেই ভাল লাগত না ল্যান্ডির।
‘আমার ঘরে যাবেন?’ জিজ্ঞেস করল সে।
জানালার সামনে দাঁড়িয়ে আছে মিসেস পার্ল, শান্ত-নিরুদ্বেগ চেহারা নিয়ে সিগারেট ফুঁকে চলেছে।
‘জ্বী,’ জবাব দিল সে।
টেবিলের ধার দিয়ে যাবার সময় দাঁড়িয়ে পড়ল মিসেস পার্ল, আবার ঝুঁকল বেসিনের উপর
‘মেরী চলে যাচ্ছে, সুইট হার্ট,’ বলল সে। ‘তোমাকে বাড়ি নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করছি। ওখানে ঠিকমত যত্ন-আত্তি করতে পারব তোমার। আর শোন, ডিয়ার…’
হাসল সে, ঠোঁটে আবার সিগারেট গুঁজল, ভঙ্গি করল টান দেয়ার চোখটা জ্বলে উঠল ভীষণভাবে।
চোখের দিকে সরাসরি তাকাল মিসেস পার্ল, মণির ঠিক মাঝখানে আলো দেখতে পেল। যেন আগুন জ্বলছে। প্রচন্ড রাগ নিয়ে তাকিয়ে আছে চোখটা তার দিকে।
নড়ল না মিসেস পার্ল, বেসিনের উপর ঝুঁকে দাঁড়িয়েছিল। এবার ঠোঁটে গোঁজা সিগারেটে মস্ত টান দিল। ফুসফুসের মধ্যে ধোঁয়াটা ধরে রাখল তিন/চার সেকেন্ড। তারপর হুশ্ শব্দে নাকের দুই ফুটো দিয়ে ধোঁয়ার পাতলা দুটো স্রোত বেরিয়ে এল, সরাসরি আঘাত করল বেসিনের পানিতে, সারফেসে ঘন নীল মেঘের ঢেউ সৃষ্টি করল, বুজিয়ে দিল চোখটা।
ল্যান্ডি দরজার কাছে পৌঁছে গেছে, ডাক দিল, ‘আসুন, মিসেস পার্ল।’
‘ওভাবে কটমট করে তাকাবে না, উইলিয়াম,’ নরম গলায় বলল মিসেস পার্ল। ‘কটমট করে তাকালে দেখতে ভাল লাগে না।’
ল্যান্ডি ঘুরল, ঘাড় লম্বা করল, মহিলা কী করছে দেখতে চায়।
‘অনেক হয়েছে,’ ফিসফিস করল মিসেস পার্ল। ‘এখন থেকে মেরীর আদেশেই তোমাকে চলতে হবে। বোঝা গেছে?’
‘মিসেস পার্ল,’ বলল ল্যান্ডি, এগিয়ে আসছে ওর দিকে।
‘কাজেই আর দুষ্টুমি করা চলবে না,’ আবার সিগারেটে টান দিল সে। ‘দুষ্টুমি করলে অনেক দুর্ভোগ আছে তোমার কপালে।
ল্যান্ডি চলে এসেছে ওর পাশে, হাত ধরে টেনে নিয়ে চলল।
‘বিদায়, প্রিয়,’ গলা ছেড়ে বলল মিসেস পার্ল। ‘আমি শীঘ্রি আসছি।’
‘অনেক হয়েছে, মিসেস পার্ল।’
‘ও খুব সুইট, না?’ ল্যান্ডির দিকে বড় বড় চোখ রেখে বলল সে। ‘তাই না, ডার্লিং? ওকে বাড়ি নিয়ে যাবার জন্যে আর তর সইছে না আমার।’