ভ্যাম্পায়ার অব ক্রগলিন গ্ৰাঞ্জ – উইলিয়াম রাশনেক টেম

ভ্যাম্পায়ার অব ক্রগলিন গ্ৰাঞ্জ – উইলিয়াম রাশনেক টেম

ইংল্যাণ্ডের কাম্বারল্যাণ্ডের একটি বাড়ির নাম ক্রগলিন গ্রাঞ্জ। ফিশার নামের একটি পরিবার একশ বছরেরও বেশি সময় ধরে এ বাড়ির মালিক ছিল। তবে গত শতকে তারা বাড়িটি এন্ড্রু, গর্ডন এবং এমা নামের তিন ভাই- বোনের কাছে ভাড়া দিয়ে অন্যত্র চলে যায়।

তিন ভাইবোন খুব সহজেই সবকিছু গুছিয়ে নেয় এবং পাড়াপড়শীর সঙ্গে তাদের সখ্যও গড়ে ওঠে।

গ্রীষ্মের এক গরমের দিনে, নোনাধরা বাতাসে কাজকর্ম করা অসম্ভব, তিন ভাইবোন দ্রুত রাতের খাবার খেয়ে নিল। তারপর তারা এসে বসল বারান্দায় একটু ঠাণ্ডা বাতাসের পরশ পাবার আশায়। আকাশে তখন পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছে, লন এবং বাগান স্নান করছে অমলধবল জোছনায়।

অনেকক্ষণ বসে গল্প করার পরে ওদের মধ্যে ক্লান্তি চলে এল। তারপর ভেতরে গিয়ে তারা যে যার ঘরে চলে গেল। এমন গরম পড়েছে ঘুমায় কার সাধ্য। জানালার ঝাঁপ খুলে রেখে, বালিশগুলো স্তূপ করে তাতে হেলান দিয়ে বসল এমা। নিচতলার এ ঘরের জানালা দিয়ে দিব্যি চাঁদ দেখা যায়। এমা বসে বসে চাঁদের আলো উপভোগ করতে লাগল।

হঠাৎ তার মনে হলো দুটো আলোক বিন্দু যেন গাছের আড়াল থেকে উঁকি দিচ্ছে। এই গাছগুলো তাদের বাড়িটির লনকে গাঁয়ের গির্জার কবরখানা থেকে আলাদা করেছে। প্রথমে আলোক বিন্দু দুটোকে জোনাকি পোকা বলে ভ্রম হলো তরুণী এমার। কিন্তু ওগুলোর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখতে পেল ওগুলো ক্রমে কাছিয়ে আসছে। মনে হলো কালো একটা ছায়ার সঙ্গে তারা যেন লেপ্টে আছে। চাঁদের আলো পড়া গাছের ছায়া ও নয়। তারচেয়েও কালো ছায়া।

এমা আঁতকে উঠল দেখে ওই ছায়াটা এগিয়ে আসছে তাদের বাড়ি লক্ষ্য করে। মাঝে মাঝে লনের গাছের ছায়ায় হারিয়ে যাচ্ছে তারপর আবার উদয় হচ্ছে। যত এগোচ্ছে ততই আকারে বড় হয়ে উঠছে অশুভ ছায়াটি এবং ক্রমেই কাছিয়ে আসছে… চলে আসছে আরও কাছে….

ভয়ে কাঠ হয়ে গেল এমা। গলা ফাটিয়ে চিৎকার দিতে চাইল কিন্তু গলা শুকিয়ে যেন মরুভূমি। একটুও রা বেরুল না। ও নড়াচড়া করতেও ভয় পাচ্ছে পাছে সামান্যতম শব্দেও ছায়াটা ওর দিকে ছুটে আসে। কাচের জানালা আর কাঠের পাতলা ফালি ওই ছায়ামূর্তিকে এক মুহূর্তের জন্যও রুখতে পারবে না ভাল করেই জানে এমা।

আতংকিত মেয়েটি দেখল ছায়াটি হঠাৎ করে এক দিকে ঘুরে দাঁড়াল। ওটা সোজা ওর দিকে আসার বদলে ঘুরে অন্যদিক থেকে বাড়িতে ঢুকবার মতলব করেছে, এমন ভাবনা মাথায় উদয় হলো এমার। লম্বা, কালো ছায়ামূর্তি চোখের আড়াল হতেই সে এক লাফে বিছানা থেকে নেমে ছুটল হলঘরের দরজার দিকে

দরজার গোলাকার হাতলে মাত্র হাত রেখেছে এমা, কানে ভেসে এল রক্ত হিম করা নখের আঁচড়ের শব্দ। খচ খচ খচ করে কেউ জানালায় নখ দিয়ে আঁচড় কাটছে। ঘুরতেই সে দেখতে পেল একটা বীভৎস বাদামী রঙের মুখ আগুনের মতো গনগনে লাল চোখ মেলে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। ছায়ামূর্তিটি ফ্রেঞ্চ উইণ্ডোতে (ঝুল বারান্দার দিকে মুখ করা জানালা যা একই সঙ্গে দরজা হিসেবেও ব্যবহার করা যায়) আঁচড় কাটছে। জানালাটি ভেতর থেকে বন্ধ। শক্ত কাঠের এই জানালা ভাঙা সহজ নয় ভেবে একটু স্বস্তি পেল এমা। সে বেডরুমের দরজা খুলে হলরুমে পালাবে ভেবেছিল কিন্তু টানাটানি করেও শতবর্ষের পুরানো ছিটকিনি খোলা গেল না। নিজের ঘরে বন্দী হয়ে গেল এমা।

বাইরের ভয়াল দর্শন লোকটা আবার আঁচড় কাটল সার্সিতে। তারপর নখ দিয়ে জানালার কাচ আটকে রাখা সীসা খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তুলতে লাগল। আবার চিৎকার দেয়ার চেষ্টা করল এমা, বদলে হালকা গোঙানি বেরিয়ে এল দুই ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে।

হীরক আকৃতির একখণ্ড সার্সি হেলে পড়ল ভেতরের দিকে, মেঝেতে পড়ে চৌচির হলো। লম্বা, হাড্ডিসার একটা আঙুল সদ্য সৃষ্ট ফাঁক দিয়ে প্রবেশ করল ভেতরে, জানালার ছিটকিনি খুঁজে পেতে একটানে খুলে ফেলল। এমা একলাফে বিছানার ওপর উঠে পড়ল ক্লজিটের ভেতরে ঢুকে পড়ার আশায়। কিন্তু তার আগেই ভৌতিক মূর্তিটা লাফ মেরে ঢুকে পড়ল ঘরে, লম্বা লম্বা আঙুল দিয়ে ওর চুলের মুঠি চেপে ধরল এবং ওকে বিছানার ওপর থেকে অর্ধেকটা শরীর টেনে নামিয়ে গলায় বসিয়ে দিল দাঁত।

কামড়টা যেন গলায় ভিমরুলের দংশন, যন্ত্রণায় আকাশ-বাতাস ফাটিয়ে চিৎকার দিল এমা। কুৎসিত মুখটাকে দু’হাতে ঠেলে সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করতে লাগল ও গলার ওপর থেকে। শুনতে পেল ওর ভাইয়েরা চিৎকার করছে এবং দরজায় দমাদম আঘাত করছে। ওদের সাড়া পেয়ে দানবটা এমাকে ছেড়ে দিয়ে জানালা গলে ছুটে পালাল।

এন্ড্রু এবং গর্ডন যখন দেখল দরজা খুলছে না তখন প্রচণ্ড ধাক্কা মেরে দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকল।

ঘরে ঢুকে তারা দেখে তাদের বোন চিৎ হয়ে পড়ে আছে। অজ্ঞান। গলা দিয়ে রক্ত বেরুচ্ছে। ফ্রেঞ্চ উইণ্ডোর ওপাশে, চন্দ্রালোকিত লনে প্রথমে কিছুই ঠাহর হলো না চোখে। তারপর গর্ডন চেঁচিয়ে উঠল, ‘আমি ওকে দেখতে পেয়েছি।’ সে লম্বা একটা দেহের দিকে আঙুল তুলে দেখাল। ওটা বড় একটা ওক গাছের নিচ দিয়ে ছায়ার মধ্যে ছুটে পালাচ্ছে। একটুও দ্বিধা না করে সে ছায়ামূর্তিটির পেছন ধাওয়া করল। কিন্তু তারচেয়ে দানবটার গতি দ্বিগুণ, প্রকাণ্ড লাফ মেরে মেরে সে দেয়াল টপকে চার্চের গোরস্তানের মধ্যে ঢুকে পড়ল।

গর্ডন পাথুরে দেয়ালটার কাছে এসে শুধু পাথরের কবর আর ভল্ট (পাতালকুঠুরি) ছাড়া কিছু দেখতে পেল না। ছায়ামূর্তি পালিয়েছে। হতাশা এবং রাগ নিয়ে সে বোনের কাছে ফিরে এল।

এমা এতক্ষণে জ্ঞান ফিরে পেয়েছে। এন্ড্রু একটা ভেজা তোয়ালে দিয়ে তার গলার ক্ষত মুছে দিচ্ছে।

‘আজ বাকি রাতটা আমরা পাহারায় থাকব’ বলল এন্ড্রু। ‘কাল সকালের ট্রেনেই চলে যাব লণ্ডন।’

‘কী বলছ এন্ড্রু ভাইয়া! এইতো গর্ডন ভাইয়া এসে পড়েছে!’ বলল এমা। ‘তুমি কি দেখতে পেয়েছ কে আমাকে হামলা করেছিল?’

‘না,’ তার ভাই বলল। ‘গোরস্তানে ওটা পালিয়ে গেছে। তবে শয়তানটা যে-ই হোক, এণ্ড্রু ঠিকই বলেছে। এখানে আর থাকা যাবে না। যত দ্রুত সম্ভব এ জায়গা ছেড়ে আমরা চলে যাব।’

মাথা নাড়ল এমা। ‘আমরা এখানে কত ভাল আছি। একটা ঘটনা ঘটল আর তাই ভয় পেয়ে পালিয়ে যেতে হবে?’

দুই ভাই তাদের ছোট বোনকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করল। কিন্তু গোঁ ধরে রইল এমা। ‘আমরা এ বাড়ি সাত বছরের জন্য ইজারা নিয়েছি।’ বলল সে। ‘আর এখানে এসেছি এক বছরও হয়নি। এ বাড়ির ভাড়া গুণতে হবে একদিকে আবার অন্যদিকে নতুন বাসা ভাড়া করার ক্ষমতা আমাদের নেই।’

বোনের যুক্তি অনিচ্ছাসত্ত্বেও মেনে নিল দুই ভাই। খবর শুনে পরদিন স্থানীয় এক রক্ষী এসে বলল, ‘এ নিশ্চয় কোনো উন্মাদের কাজ, কোনো পাগলা গারদ থেকে পালিয়েছে। তবে সে দ্বিতীয়বার আর হামলা চালাবার চেষ্টা করবে বলে মনে হয় না।’

তাই ওরা ক্রগলিন গ্রাঞ্জেই থেকে গেল। তবে এন্ড্রু এবং এমা ওদের ঘর অদলবদল করল। এমা এখন রাতের বেলা জানালার ঝাঁপ ফেলে রাখে। আর তার দুই ভাই গুলিভরা পিস্তল সবসময় সঙ্গে রাখে।

.

শীতকালটি কেটে গেল কোনো ঘটনা ছাড়াই। তবে মার্চ মাসে একটা ঘটনা ঘটল। জানালার ঝাঁপে নখের খচর মচর আঁচড়ানোর শব্দে ঘুম ভেঙে গেল এমার। তাকিয়ে দেখে জানালার ঝাঁপের ওপরে একটি সার্সি, যেটি বন্ধ করা সম্ভব হয়নি, সেখান থেকে সেই ভয়ঙ্কর বাদামী মুখটা ওর দিকে কটমট করে তাকিয়ে আছে।

ভয়ে গগনবিদারী চিৎকার দিল এমা। তার দুই ভাই পিস্তল বাগিয়ে সঙ্গে সঙ্গে ছুটে এল। দেখল ছায়ামূর্তিটা লন ধরে ছুটে যাচ্ছে। এন্ড্রু সঙ্গে সঙ্গে গুলি করল। গুলি লাগল ওটার পায়ে। তবু ওটা খোঁড়াতে খোঁড়াতে গোরস্তানের দেয়ালের ওপর উঠে পড়ল। দুই ভাইও ছুটে গেল, দেখল কালো মূর্তিটা একটা পরিত্যক্ত ভল্টের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেছে।

.

পরদিন স্থানীয় সেই রক্ষী, কর্তৃপক্ষ এবং ক্রগলিন গ্রাঞ্জের পাড়া পড়শীসহ এমা, এন্ড্রুও গর্ডনের উপস্থিতিতে ভল্টটি খোলা হলো। ভেতরে অসংখ্য কফিন। সবগুলোই ভাঙা। শুধু একটি আস্ত রয়েছে। যদিও ওটার ঢাকনি আলগা।

এন্ড্রু এবং গর্ডন কফিনের ঢাকনি তুলল। আঁতকে উঠল এমা। কফিনের ভেতরে শুয়ে আছে সেই বাদামী চেহারার ভয়ঙ্কর মূর্তিটা। ওটার গায়ের চামড়া ঝুলে পড়েছে, একটা পায়ে বুলেটের ক্ষত দেখা গেল।

‘ভ্যাম্পায়ার’ শব্দটি উচ্চারণ করার কেউ সাহস না পেলেও সবাই বুঝতে পারল একমাত্র ওইরকম দানবই দিনের বেলা কফিনে শুয়ে বিশ্রাম নেয় আর রাতের বেলা রক্ততৃষ্ণায় বেরিয়ে পড়ে। তারা ভ্যাম্পায়ারটার বুকে কাঠের গোঁজ ঢুকিয়ে দেয়ার পর লাশটা পুড়িয়ে ফেলল।

এরপরে ক্রগলিন গ্রাঞ্জে আর কোনোদিন ভ্যাম্পায়ারের উপদ্রুব হয়নি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *