জ্বালা – ৮

আট

বিকেল। অ্যারোয়োতে রোদ নেই এখন। সন্ধের ছায়া ঘনিয়ে এসেছে চারদিক থেকে।

পাথরের পাশে পা ছড়িয়ে চিৎপাত হয়ে পড়ে আছে অ্যাম্বারগো দু’হাতকে মাথার নিচে বালিশ বানিয়েছে। বিশ্রামরত একটা আহত ক্যুগারের মত মনে হচ্ছে ওকে। অর্ধনিমীলিত চোখে সবাইকে দেখছে সে। প্রথমে মেলোডি এবং পরে ওর কাছ থেকে একটু দূরে সাওলোকে অনেকক্ষণ ধরে দেখে নিল।

একটু আগে খাওয়া-দাওয়া শেষ করেছে ওরা। বুনো লতা দিয়ে ফাঁদ তৈরি করে অ্যারোয়োর পশ্চিম দিক থেকে বেশ ক’টি তিতির ধরেছে সাওলো। মেস্কিট বীনসের তৈরি কফির সাথে ঝলসানো তিতিরের মাংস, পরিবেশের হিসেবে, দারুণ উপাদেয় মনে হয়েছে। ক্ষুধার নিবৃত্তি এবং লড়ার মত শক্তি দুটোই হয়েছে স্টেজযাত্রীদের।

সাওলো, দোআঁশলা হলেও, গোনার মত মানুষ বটে, ভাবল অ্যাম্বারগো। গ্রিঙ্গোদেরও ওকে গুনতে হচ্ছে: ইচ্ছেয়-অনিচ্ছেয় যেভাবেই হোক, মেনে নিতে হচ্ছে ওর নেতৃত্ব। এমন কী, যে তিনজন ওকে সবচে’ বেশি অবিশ্বাস করছে, ওয়াল্টার, স্টিফেন আর হডসনের মেয়ে ম্যাগি, ওরাও নিজেদের শাদা চামড়ার বড়াই আপাতত বন্ধ রেখে যতদূর সম্ভব ওর আদেশ-উপদেশ শুনছে।

ম্যাগি ক্রমাগত মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। সে মরতে চায় না- চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে শোনাচ্ছে সবাইকে, যেন আর সবাই মরতে চাইছে। ওকে পাত্তা দিচ্ছে না কেউ। অ্যাম্বারগো কিছুক্ষণ নিবিষ্ট মনে ওর বিলাপ শুনল। নিজের শক্ত হাতের কথা ভাবল এরপর। মেয়েটার গলা টিপে ধরে চেঁচামেচিটা বন্ধ করে দিতে পারলে চমৎকার হত।

জিমি গ্যানোর দিকে তাকাল ও। মাত্র গজ দশেক দূরে একটা পাথরের পাশে কম্বল পেতে শুইয়ে রাখা হয়েছে ওকে। ওর চোখদুটো বোজা, মুখ শিশুর সারল্যে স্খলিত। বুকের বোতাম খোলা; ক্ষতস্থানটা বেঁধে দেয়া হয়েছে মেলোডির পেটিকোট ছিড়ে। রক্তে ভিজে উঠেছে ব্যান্ডেজ। দেখে মনে হচ্ছে আঘাতটা গুরুতর।

লোকটা ভাল, মনে মনে স্বীকার করল অ্যাম্বারগো। সাদাসিধে, নির্ঝঞ্ঝাট, নিজের কাজে নিমগ্ন। তবে অ্যাম্বারগো নিজের তুলনায় কিছুটা নির্বোধ মনে করে ওকে। আলাপ্টার ফালতু মাইনাররা অ্যাম্বারগোকে হাতে পেলে নির্ঘাত গাছে ঝুলিয়ে দিত, বিচার-আচারের ধার ধারত না। আর ওদের হাত হতে বাঁচিয়ে রেখে ওকে সুষ্ঠু বিচারের সম্মুখীন করতে গ্যানোর চেষ্টার অন্ত নেই। ওর একমাত্র চিন্তা কিভাবে এবং কতক্ষণে অ্যাম্বারগোকে ট্যুবাকে পৌঁছে দেবে। ট্যুবাকে বিচারে ওর কী হবে, সে ব্যাপারে ওর মাথাব্যথা নেই। ও নিজের কাজটুকু ঠিকভাবে করতে পারলেই খুশি। ভাল লোক, আপনমনে মাথা নাড়ল অ্যাম্বারগো, ওর নিজের বাবাও গ্যানোর মত ভাল লোক ছিল।

হাসল অ্যাম্বারগো, বিদ্রূপে মুখ বেঁকে গেল ওর। ওর বাবা এবং দুই ভাই খুন হয়েছিল, ও নিজে বেঁচে গিয়েছিল কোনওমতে। ওই রাতেই বাবা এবং ভাইদের হত্যাকারীকে খুন করে বদলা নিয়েছিল ও। অনন্য প্রতাপশালী ডন লুই নিজের ‘কাসা’য় নিজের রক্তের মধ্যে মুখ থুবড়ে পড়েছিল। দশ বছর আগে সনোরায় ঘটেছিল ঘটনাটা। ওর মাথার মূল্য ধার্য করা হয়েছিল ওখানে। আজও ওটা বলবৎ রয়েছে। তবে অ্যাম্বারগো ওখানে আর যায়নি।

এ জীবনটা ভাল লাগে ওর। ওর আছে সোনার বাঁটের একটা নিজস্ব পিস্তল, একটা রৌপ্যখচিত স্যাডল আর চমৎকার একটা বে ঘোড়া। বিবেক- ফিবেকের ধার ধারে না ও; যা ইচ্ছে, তা-ই করে। একটা মানুষের জন্যে এরচে’ বেশি আর কী চাই? যদ্দিন মুক্ত ছিল, খারাপ ছিল না অবস্থাটা; এখন অবশ্য বন্দী, তবে বেশিক্ষণ তা থাকছে না। জিমি গ্যানো আহত, মৃতপ্রায়; পালাবার একটা পথ নিশ্চয় খুঁজে পাবে ও।

শোয়া থেকে গড়িয়ে ঠাণ্ডা মাটিতে উঠে বসল অ্যাম্বারগো। হাতকড়া পরা অবস্থায় নিজেকে দড়ি-বাঁধা শূকরছানার মত লাগছে। উঁহুঁ, মাথা নাড়ল ও, মরার জন্যে মোটেও ভাল বলা যাবে না এই অবস্থাকে।

সারা বিকেল ধরে দু’পক্ষ প্রচুর গুলি চালাচালি করেছে নিজেদের মধ্যে; অ্যাপাচিরা মাঝে-মধ্যে তীরও ছুঁড়েছে। সন্ধের দিকে আচমকা নীরবতা নেমে এল। কোনও পক্ষের জন্যে দেখা বা শোনার মত কোনও দৃশ্য কিংবা সাড়া- শব্দ নেই এখন। মৃত দুই অ্যাপাচির দেহ কখন যে উধাও হয়ে গেছে, অ্যারোয়োর লোকেরা ঠিক বুঝে উঠতে পারল না।

আলাপ্টা থেকে ট্যুবাকের দীর্ঘ পথযাত্রায় রান্নাবান্নার কাজে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে বেরিয়েছিল জিমি গ্যানো। ওর স্যাডল ব্যাগ হাতড়ে একটা স্কিলেট, কফিপট, দুটি প্লেট আর কাপ পাওয়া গেল। খাবার তৈরি করল স্টেইভ, মেলোডি পরিবেশন করল। প্লেট কম থাকায় পালা করে খেল সবাই। তবে মেস্কিট বীনসের তৈরি কফি পান করার সময় কারও মুখ দেখে মনে হলো না, জিনিসটা ওদের পছন্দ হয়েছে। কিন্তু স্টিফেন ছাড়া কেউ খেতে আপত্তি করল না। স্টিফেন জিনিসটাকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করল।

বেড়ালের মত গড়ান দিল অ্যাম্বারগো। ‘সিনোরা,’ হাসিমুখে মেলোডিকে ডাকল, ‘তরল ধরনের ওই জিনিসটা, যেটাকে তোমরা কফি বলে ডাকছ, যদি তোমার সুন্দর হাতে মুখে তুলে দাও, তাহলে এ বান্দার খেতে আপত্তি নেই। অবশ্য তোমার নিজের যদি আপত্তি না থাকে…

মেলোডি সাওলোর দিকে চাইল। সাওলো স্টেইভ কাঁধ ঝাঁকাল। ‘দাও, চাচ্ছে যখন।’

পাত্রটা অ্যাম্বারগোর কাছে নিয়ে গেল মেলোডি। ওর সর্বাঙ্গে দৃষ্টি হানল মেক্সিকান। মেলোডির সুগঠিত লম্বা দুটি পা, শাদাটে সবুজ চোখ আর আগুনরঙা চুল ওকে পাগল করে তুলছে। দীর্ঘ পথশ্রম আর উদ্বেগে মলিন বিষণ্ণ চেহারায় ধুলোবালিমাখা অসংখ্য ভাঁজে খুঁজে ভর্তি ট্রাভেল স্যুট পরা মেলোডিকে অপূর্ব লাগল ওর চোখে। ডিয়স! এরকম রূপসী মেয়েকে কোনও কিছুতেই বেমানান লাগবে না।

‘সিনোরা,’ চোখ খুলল জিমি গ্যানো। জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে ওর শরীর; জড়ানো, প্রায় অস্ফুটস্বরে মেলোডিকে সাবধান করল ও, ‘খবরদার, ও কিন্তু ভয়ঙ্কর লোক!’

রহস্যময় হাসি হাসল অ্যাম্বারগো। ‘বলো, গ্যানো, বলো। বলে দাও, আমি কতটা খারাপ লোক।’

মেলোডি শুকনো স্বরে বলল, ‘আমি বুঝতে পারছি।’

‘নিজের হাতে পিটিয়ে একটা মেয়েকে খুন করেছিল ও, বলল গ্যানো। ‘অবশ্য সেটা প্রমাণ করা যায়নি। তবে আমি জানি।’

ওকে পাত্তা দিল না অ্যাম্বারগো; ঝনাৎ করে শেকল নেড়ে মেলোডির দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলল, ‘এবার নিশ্চয় তোমার সুন্দর দুটো হাতে জিনিসটা আমার মুখে তুলে দেবে?’

‘চাবিটা আমার ওয়েস্টকোটের পকেটে আছে,’ ঘোঁৎ করে বিরক্তি প্রকাশ করল গ্যানো।

স্টেইভ এগিয়ে এল। ডেপুটি শেরিফের পকেট থেকে চাবিটা বের করে নিয়ে অ্যাম্বারগোর হাতকড়ার তালা খুলে দিল। হাতদুটো সামনে নিয়ে আসতে বলল ওকে। তাই করল অ্যাম্বারগো, মেলোডির দিকে চেয়ে আছে ও। চোখ টিপল একবার। মেলোডির চোখে উদ্বেগ ফুটল, ফ্যাকাসে মুখে মাথা নাড়ল সে। হেসে উঠল মজা পেয়ে মেক্সিকান তস্কর।

খাবারের থালাটা ওর হাতে ধরিয়ে দিয়ে পিছিয়ে গেল মেলোডি; আগুনের কাছে গিয়ে বসল। খেতে খেতে ওর দিকে আবার চোখ বুলোতে শুরু করল অ্যাম্বারগো। সন্ধের তামাটে আলোয় মেলোডির আগুনরঙা চুল ঝকমক করছে; ওর ঠাণ্ডা শাদা চামড়ার নিচে উষ্ণ আর উজ্জ্বল রক্তাভ শরীরের কল্পনায় মেতে উঠল সে। মেলোডির গায়ে আঁটসাঁট জ্যাকেট, শরীরের উঁচু-নিচু অংশগুলো নিখুঁতভাবে ফুটে উঠেছে তাতে; ওর উঁচু সুঠাম কাঁধ, দীঘল সুডৌল বাহু আর উন্নত বক্ষদেশ… অ্যাম্বারগোকে ক্রিস্টিয়ানার কথা মনে করিয়ে দিল। ক্রিস্টিয়ানা-সুন্দরী, দীর্ঘাঙ্গী, যৌবনবতী ক্রিস্টিয়ানা ওর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল।

এর আগে ক্রিস্টিয়ানা ওর মোহিনী জালে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ফেলেছিল ওকে। সেটা কি করে সম্ভব হয়েছিল ওর সান্নিধ্যে থাকাকালে বুঝেই উঠতে পারেনি ও, তবে ব্যাপারটা এখন তার কাছে সম্পূর্ণ পরিষ্কার।

সালাজার ক্যাম্পে ওর প্রথম আগমন ওখানকার লোকদের মধ্যে অস্বস্তি জাগিয়েছিল। মেক্সিকানদের সবাই ওকে একজন পিস্তলবাজ আর গোলমেলে লোক হিসেবে জানত। আর সে কারণেই ওর উপস্থিতিতে কারও মুখে সরব আপত্তি শোনা যায়নি। ফলে ওখানকার প্রতিটি ক্যান্টিনায় ছিল তার অবাধ বিচরণ; মদ, জুয়া আর নারী সঙ্গে ওর দিন কাটছিল রাজার হালে।

ঠিক সে সময় ওখানে ক্রিস্টিয়ানার আগমন। ওর সঙ্গে ছিল রোগা হাড্ডিসার এক লোক। প্রতি দু’হপ্তায় মাইনিং ক্যাম্পগুলোয় সাপ্লাই দেয়ার কাজ করত লোকটা। ক্রিস্টিয়ানার হঠাৎ উদয় এবং সালাজারের মত ওঁচা একটা মাইনিং শহরে ওর আগমনের হেতু জানার আগ্রহ অনেকের থাকলেও কোনওদিন মুখ খোলেনি সে। তবে ওর পেশাগত দিকটা খেয়াল করার পর সবারই আগ্রহ মিইয়ে আসে। ক্রিস্টিয়ানা সালাজারের সবচে’ সুন্দরী এবং দামী বেশ্যা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেল। তবে অ্যাম্বারগোর প্রতি দারুণ আগ্রহ প্রকাশ করে ও- এবং এরপর থেকে অ্যাম্বারগো দিন-রাত ক্রিস্টিয়ানার ঘরেই কাটাত।

মাইন অফিসের পে-রোলের সিন্দুক ভাঙার বুদ্ধিটা ক্রিস্টিয়ানাই দিয়েছিল ওকে। বুদ্ধিটা চমৎকার মনে হওয়ায় লুফে নিয়েছিল ও। বেতনের আগের দিন সিন্দুকে প্রচুর টাকা-পয়সা থাকত। মাইন অফিসের একজন কর্মকর্তার সঙ্গে ভাল দহরম মহরম গড়ে উঠেছিল ক্রিস্টিয়ানার। ওর রূপ- যৌবন আর মোহিনী হাসির জালে লোকটা এমন আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়েছিল যে, ওর কাছ থেকে আস্তে আস্তে পুব থেকে পে-রোলের টাকা কখন, কিভাবে আসে, অফিসে ওটা কার দায়িত্বে থাকে ইত্যাদি সব তথ্য খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বের করে নিয়েছিল ও। ইতোমধ্যে অ্যাম্বারগো মাইন অফিসের অবস্থান, লোকসংখ্যা, কাজ সেরে দ্রুত বেরিয়ে যাবার সম্ভাব্য পথ—এসব দেখে নিয়ে পরিকল্পনাটা দাঁড় করিয়ে ফেলেছিল। কথা ছিল, কাজ সেরে অ্যাম্বারগো কাছের পাহাড়ে গিয়ে লুকোবে। ওখানে ক্রিস্টিয়ানা আগে থেকেই ওর জন্যে নির্দিষ্ট একটা জায়গায় অপেক্ষা করবে।

এক শনিবারের বিকেল বেলা কাজটা সারার প্ল্যান করল সে। কালো মুখোশ পরে অফিসে ঢুকে অফিসের একমাত্র কেরানিকে বন্দুকের বাড়ি মেরে কাবু করে কাজ শুরু করল। কিন্তু ওটা ছিল স্রেফ একটা ফাঁদ। যে-সময় সে কাজটা সারছিল খুব দ্রুততার সাথে, সে-সময় ছয়-ছয়টা বন্দুক ওকে চারদিক থেকে টার্গেটে রেখেছিল। অতএব হাতেনাতে ধরা পড়ে অ্যাম্বারগো। পরে ক্রিস্টিয়ানা ওর সামনে আসে। ওর চোখে চোখ রেখে ক্রুর হাসি হেসে মুখে থুতু ছুঁড়ল মেয়েটা। তারপর জানাল, আসলে ওকে ফাঁদে ফেলার জন্যে অনেক বুদ্ধি খাটিয়ে ও পরিকল্পনাটা করেছিল। কারণ, ও বলেছে, এর আগে যে বেশ্যাটাকে অ্যাম্বারগো খুন করেছিল, ও তারই বোন। অ্যাম্বারগো জানে, ঘটনাটা সত্যি। ওই মেয়েটাকে সে স্বহস্তে খুন করেছিল। কিন্তু নিশ্চিত প্রমাণের অভাবে আইন ওর বিরুদ্ধে কিছু করতে পারেনি।

হাত দুটো মুঠো করে আবার খুলল অ্যাম্বারগো। আবার মুঠো করে আবার খুলল। ক্রিস্টিয়ানার কোমল মসৃণ গলাটা টিপে ধরতে কিরকম মজা লাগবে, ভাবছে সে। এ মুহূর্তে ওর দুটো লক্ষ্য। এক, এখান থেকে মুক্তি পাওয়া এবং দুই, ক্রিস্টিয়ানাকে হত্যা করা। বিশ্বাসঘাতকতার শাস্তি হিসেবে এটা ওর প্রাপ্য। ওর ধড় থেকে কল্লাটা টেনে ছিঁড়ে নিয়ে কুত্তাকে খাওয়াবে সে।

ওই দুটোর সাথে অবশ্য এখন আরেকটা যুক্ত হয়েছে। মেলোডি ওকে পাগল করে তুলেছে। ওর জেড পাথরের মত সবুজ চোখজোড়া, আগুনলাল চুল, সারা শরীরের প্রতিটি বাঁক-উপবাঁক ওকে কামনায় অস্থির করে তুলেছে। সবকিছু মিলিয়ে একজন পূর্ণাঙ্গ সুন্দরী মেলোডি। ওকে ওর চাই-ই। এখান থেকে মুক্তি পাবার সাথে সাথে ওকেও না-পেলে ওর মুক্তির আনন্দটাই ফিকে হয়ে যাবে। ডিয়স! এমন একটা মেয়ে ভাল এক বোতল মদের মতই দুর্মূল্য, দুষ্প্রাপ্য।

অস্থির হয়ে উঠল ‘অ্যাম্বারগো। কখন মুক্তি পাবে? সেটা, ভাবল ও, আগামীকাল কিংবা রাত। বলা যাচ্ছে না। ওদের চারদিকে অ্যাপাচিরা ঘিরে আছে—উপরন্তু ওর হাত শেকলবাঁধা। কিন্তু, যা-ই হোক, আগে ওকে বন্দীদশা থেকে মুক্তি পেতে হবে।

‘শান্ত হও,’ নিজেকে বোঝাল সে, ‘সুযোগ তোমার জন্যেও আসবে।’

.

অস্বস্তিবোধ করছে মেলোডি। এই মেক্সিকান নাকি স্প্যানিয়ার্ড, নাকি ধ্যাত্তেরি, যা-ই হোক, কী আসে যায় তাতে, এভাবে চাইছে কেন ওর দিকে? লোকটার চোখে কেমন একটা নগ্ন ঔদ্ধত্য, মেয়েদের ব্যাপারে ওর ষষ্ঠেন্দ্রিয় নির্লজ্জভাবে সজাগ।

মেয়েদের ব্যাপারে পুরুষদের এ ধরনের হ্যাংলামো ওর অসহ্য লাগে এমন কেন ওরা? যেন আস্ত গিলে খাবে!

নিজের সম্পর্কে ভাবল মেলোডি। নিজের পারিবারিক পরিচয় নিয়ে এখন আর মাথা ঘামায় না সে। তবে জানে, ওর চারপাশে যারা এখন আছে, তাদের যে-কোনও কারও চেয়ে অনেক উঁচু পরিবারে ওর জন্ম। কিন্তু তাতে কী? এর জন্যে নিজের বলগাহীন স্বভাবই দায়ী। ওই স্বভাব, আর যা-ই হোক, ওকে আর ঘরে ফিরে যেতে দেবে না। তবে পুরুষদের এ চাউনিটা ওর অসহ্য লাগে। বেশির ভাগ পুরুষই এমনভাবে ওর দিকে তাকায়, যেন ও একটা রঙিন সুদৃশ্য কাচপাত্র।

কার্পেটব্যাগটা তুলে নিয়ে আপার অ্যারোয়োতে চলে গেল মেলোডি। অ্যারোয়োর এ-অংশটায় উঁচু উঁচু পাথরের ঘন সন্নিবেশ; মাঝখানে কিছু জায়গা জুড়ে একটা পরিষ্কার টলটলে জলাশয়। পাথরে ভর্তি জলাশয়ের বুক। পাড়ে চারদিক ঘন ঝোপঝাড়ে আচ্ছাদিত; নিচ থেকে কারও নজরে পড়ার আশঙ্কা নেই।

দ্রুতহাতে পরনের জ্যাকেট, ব্লাউজ প্রভৃতি খুলে ফেলল মেলোডি; চুলের বাঁধন খুলে পিঠের ওপর ছড়িয়ে দিল। ব্যাগ খুলে রূপালি একটা সাবান বের করল। পানিতে হাত ডোবাল পানি এখনও গরম, তবু গোসল সেরে নিল ও।

কাপড় পরে ব্লাউজের বোতাম লাগাচ্ছে, এসময় কারও পায়ের শব্দ কানে এল ওর। জঙ্গলের ভেতর দিয়ে কেউ একজন হেঁটে আসছে ও যেদিকে আছে, সেদিকে। নির্বিকার মুখে বোতাম লাগানো শেষ করল মেলোডি।

সাওলো। একটা পাথরের পাশ থেকে বেরিয়ে এসে মেলোডিকে দেখতে পেল। থমকে দাঁড়াল ও। ওর গা খালি, শার্টটা ঝুলছে হাত থেকে। মেলোডিকে দেখে অবাক হয়নি, তবু ওর বিব্রত ভাবটুকু ঠিকই অনুভব করল মেলোডি।

বালির ওপর বসল মেলোডি, ব্যাগ থেকে চিরুনী বের করে চুল আঁচড়াতে শুরু করল। সাওলোর দিকে চেয়ে হাসিমুখে বলল, ‘লজ্জা পাচ্ছ মনে হচ্ছে?’

ইতস্তত করল সাওলো, তারপর হাসল। ‘নাহ্! বাচ্চাদের সামনে লজ্জা পেতে নেই।’

জলাশয়ের পাড়ে চলে গেল ও। একটা পাথরের ওপর বসে নিচু হয়ে মাথায় পানি দিল। মেলোডির চোখ ওর নগ্ন পিঠে। হাতে পানি নেয়ার জন্যে নিচু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কিলবিল করে উঠছে ওর উদোম কাঁধ আর বাহুর পেশী। ঘোড়ার কেশরের মত চকচক করছে ওর ঘাড়ের ওপর এসে পড়া ভেজা চুল।

চোখ ফিরিয়ে নেবার চেষ্টা করল সে। পারল না। নিজের ওপর বিরক্তি বোধ করল। কী হচ্ছে এসব? সাথে সাথে সাওলোর ওপরও। আসার আর সময় পেল না লোকটা?

ঢোক গিলতে গেল মেলোডি, পারল না। গলা শুকিয়ে খটখটে হয়ে গেছে। কিসের একটা জ্বালা ধীরে ধীরে গলা থেকে বুকের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ছে। এই দোআঁশলা লোকটা, অনুভব করল সে, ওর সমস্ত অস্তিত্বকে টলিয়ে দিয়েছে। এরকম অনুভূতির সঙ্গে আগে কোনওদিন পরিচয় হয়নি ওর। এই প্রথমবারই এটাকে সে উপলব্ধি করছে। ব্যাপারটা এখনও ওর কাছে অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে।

উঠে দাঁড়াল সাওলো; ওর দৃষ্টি নিচের দিকে। শার্টটা গায়ে চড়াতে চড়াতে দুঃখপ্রকাশ করল ও মেলোডির কাছে, ‘সরি!’

‘অত বিনয়ী হবার দরকার নেই তো!’ মেলোডির কণ্ঠে অসহিষ্ণুতা। ‘বসো এখানে।’ নিজের পাশে কিছুটা জায়গা ফুঁ দিয়ে পরিষ্কার করে দিল সে।

একজন ইন্ডিয়ানের মতই দু’হাঁটুর ওপর দু’হাত রেখে উবু হয়ে বসল সাওলো। মেলোডি খেয়াল করল, ওর দু’হাতের কবজিতে শাদা গোলাকার দুটো দাগ। অধিকাংশ লোকের তুলনায় ওর হাতগুলো কিছুটা ছোট, তবে চৌকো। শক্ত গাঁটের মোটা মোটা আঙুলে অসম্ভব শক্তিশালী দেখাচ্ছে হাতদুটোকে।

পিঠে একটা শিরশিরে অনুভূতি টের পেল মেলোডি। অনুভূতিটা ভয়ের। এ ধরনের হাতকে ভয় পায় ও; এগুলো পুরুষের হাত—এবং পুরুষের হাত প্রবঞ্চক।

একটা কাঠের চ্যাপ্টা স্প্লিন্টার নিয়ে নাড়াচাড়া করছিল সাওলো স্প্লিন্টারটা ওর গলা থেকে শক্ত সুতো দিয়ে ঝোলানো। কৌতূহল প্রকাশ করল, ‘ওটা কী?’

‘এটা? ৎসি-ডালটাই।’

‘হাহ্!’ হেসে উঠল মেলোডি। ‘অ্যাপাচি শব্দ, না?’

‘হ্যাঁ,’ স্বীকার করল সাওলো। ‘এটা মন্ত্রপূত কবচ।’

‘তুমি বিশ্বাস করো ওসবে?’

‘করি, সম্ভবত। আমি উপকার পেয়েছি।’ তাবিজটা হাতের তালুতে রাখল সাওলো। পুরানো এবং বহুল ব্যবহারে প্রায় মসৃণ।

‘এটা দিয়ে কী কাজ হয়, বলো তো?’

‘এটা যে কোন ক্ষতি বা কষ্ট থেকে রেহাই দেবে তোমাকে।’

‘দূর! ওরকম আমি নিজেও ব্যবহার করেছিলাম। কাজ হয়নি।’

‘হয়, হয়,’ জোরের সাথে বলল সাওলো। একটু থামল, তারপর জিজ্ঞেস করল, ‘তোমার স্বামী কখন ছেড়ে গিয়েছিল তোমাকে, ম্যাম?’

সাওলোর প্রশ্নে অবাক হলো মেলোডি। হাসল ও, জবাবটা এড়িয়ে যেতে চাইল প্রথমে, পরে মত পাল্টাল। ‘আট বছর আগে। আমার বয়স তখন তেইশ। তার মানে আমি এখন একত্রিশ, না?’ একটু থামল ও। কিছু মনে কোরো না। তোমাকে কিন্তু আমার চেয়ে কম পক্ষে পাঁচ বছরের ছোট দেখায়।’

‘তিন বছর।’

‘ঠিক আছে। এখন এসো, সঙ্কোচ কোরো না, আমার পাশে দাঁড়াও দেখি।’

দাঁড়াল উভয়ে পাশাপাশি। মেলোডি সাওলোর চোখে চোখে চেয়ে হাসল। মজার ব্যাপার কী জানো? আমি তোমার সমান লম্বা আর তোমার চেয়ে তিন বছরের বড়।’

তারমানে এ নয় যে, তুমি আমার মাতৃস্থানীয়া কেউ। কিন্তু এর মানেটা কী বলো তো?’

‘কিছু না, স্রেফ কৌতূহল। আমার আবার ওই জিনিসটা একটু বেশি। আমার মনে হচ্ছিল, তোমার চেয়ে আমি লম্বা হব।’

‘কেন মনে হচ্ছিল?’

‘ঠিক বলতে পারব না,’ হালকা স্বরে বলল মেলোডি। তবে সাওলোর কানে হালকা শোনাল না। নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরল মেলোডি। ‘আমি মেয়েটা মনে হয় একটু বেশি অনুসন্ধিৎসু। রাস্তায় তুমি আমাদের সঙ্গে ছিলে, বিপদ-আপদ মোকাবেলা করেছ, এখনও করছ। আমার ধারণা, এতেই তুমি বেঁচে থাকার আনন্দ খুঁজে পাও।’

‘আমারও তাই মনে হয়। তুমি ঠিকই আন্দাজ করেছ।’

হাসল মেলোডি। ‘আমি একজন মহিলা-এবং মহিলাদের কৌতূহল বেশি। তোমার ব্যাপারটা… আসলে তোমাকে আমার ভাল লেগেছে।’ সাওলোর একটা হাত নিজের হাতে নিল ও। ওর কবজিতে গোলাকার দাগটার ওপর আঙুল বুলাল। ‘এটা কিভাবে হয়েছে?’

‘সান সাওলোতে। ওরা আমাকে বেঁধে রেখেছিল।’

‘খোদা!’ আঁতকে উঠল মেলোডি। ‘কেন?’

সাওলো হাসল। শাদা মানুষের বিচার। ভুল সময়ে ভুল জায়গায় হাজির হয়েছিলাম আমি। গরু চুরি করে পালাচ্ছিল কিছু লোক। ওদের পেছনে পসি ধাওয়া করছিল। ওদের ট্রেইল ক্রস করার সময় পসির হাতে ধরা পড়ে যাই আমি। ওরা আমাকে সন্দেহভাজন হিসেবে গ্রেফতার করে।

‘কিন্তু কেন? তোমার সাথে তো গরু পায়নি ওরা। পেয়েছিল?’

‘পায়নি। তবে পাবার দরকারও মনে করেনি। আসলে সে সময় ওখানকার শেরিফ নির্বাচন হচ্ছিল। আমাকে পেয়ে হাতে চাঁদ পেয়েছিল শেরিফ পদপ্রার্থী পসিদলের নেতা। কাজ দেখাবার অমন সুযোগ পায়ে ঠেলতে চায়নি ও। আমি তো একজন সামান্য দোআঁশলা। অতএব একজন দোআঁশলাকে জেলে পুরতে দ্বিতীয়বার ভাবতে হয়নি ওদের।’

তিক্ত শোনাল সাওলোর গলা। ‘দু’বছর ওখানে বন্দী ছিলাম। এর মধ্যে একবারের জন্যেও শেকল খোলা হয়নি স্রেফ খাবার সময়টা ছাড়া। জায়গাটার নামে নিজের নামকরণ করেছি— আমার বয়স তখন মাত্র আঠারো।

সাওলোর হাতটা ছেড়ে দিল মেলোডি। ‘কিন্তু তারপরও তো তোমার আক্কেল হয়নি।’

‘কোন ব্যাপারে?’

‘এই যে, এরপরও শাদা মানুষদের প্রাণ বাঁচানোর জন্যে নিজের জীবন বাজি ধরেছ। লড়াই করছ অ্যাপাচিদের বিরুদ্ধে।’

হয়তো বাঁচাতে চেষ্টা করার মত কিছু ভাল লোক আছে এখানে। তাছাড়া একজন কালোও আছে, যে আদতেই ভাল।

‘তাই! কিন্তু তুমি তো আমাদের কারও কাছে কোনও ব্যাপারেই ঋণী নও। তুমি পালাতে চাইলে…’

‘বেশ বেশ, হাত তুলে মেলোডিকে থামিয়ে দিল সাওলো। ‘আরেকটা ব্যাপার আছে এখানে। আমার এক ভাই আছে। একবার ওর জীবন বাঁচিয়েছিলাম আমি। ও আমাকে দারুণ ঘৃণা করে এখন।’

‘জীবন বাঁচিয়েছ বলে?

‘হয়তো। হয়তো তুমি ওর কথা শুনেছ। এ পর্যন্ত বহু মানুষ খুন করেছে। একবার আমার কয়েকজন বন্ধুকে খুন করেছিল ও। এখানেও হয়তো কেউ কেউ মারা যাবে ওর হাতে। অথবা আমি ওকে ঠেকাতে পারব।’

‘সে কি এখানে আছে? ওই অ্যাপাচিদের সাথে?’

জবাব দিল না সাওলো, যেন ওর কথা শুনতে পায়নি। ওর চোখের দৃষ্টি কঠিন হয়ে উঠল। ‘একমাত্র গুলিই ওকে ঠেকাতে পারে।’

‘তোমার ভাই!’

‘হ্যাঁ, কুরিয়াপো।’

আচমকা কারও পায়ে জঙ্গল মাড়ানোর শব্দ শোনা গেল। দ্রুত এগোল সাওলো শব্দ লক্ষ্য করে। একটা পাথরের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল ওয়াল্টার, ফুট বিশেক দূরে দাঁড়াল। ওর মেদবহুল খসখসে মুখে হাসি। ‘জেসাস!’ বিড় বিড় করল ও, ‘চমৎকার একটা খবর হবে বটে! বাহ্, দারুণ চমৎকার!’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *