জ্বালা – ১৫

পনেরো

এবড়োখেবড়ো টেবিলে যত্ন করে সাজানো খাবারের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল সাওলো। ভাল খাবার; নিজেদের বাগানে ফলানো বীন-সেদ্ধ, লঙ্কার গুঁড়ো মেশানো, ঘন পনিরের সস, মশলা আর বিস্কুট। চেটেপুটে খেল সাওলো, তারপর হেলান দিয়ে বসল। ঠাণ্ডা, নিচু ছাদের ঘরটার ভেতর চারদিকে তাকাল। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, সুচারুভাবে সাজানো গোছানো ঘরটি; উষ্কখুষ্ক চেহারা, ময়লা জরাজীর্ণ পোশাক পরা সাওলোর নিজেকে বড় বেমানান মনে হলো এর সাথে। তবে সামনে উপবিষ্ট গৃহকর্ত্রী আর তার বাচ্চা ছেলে-মেয়ে দুটোকে দেখে মনে হলো না যে, তারা ওরকম কিছু ভাবছে। বাচ্চা দুটো ওর বেঞ্চির পাশে এসে অন্যের সঙ্গে হাত ধরাধরি করে দাঁড়িয়ে আছে। ওদের চোখে আগ্রহ; সম্ভবত পছন্দ হয়েছে ওকে। ওদের দিকে চেয়ে চোখ টিপল সাওলো, তারপর ওদের মায়ের দিকে চেয়ে হাসল ‘গ্রেশিয়াস, সিনোরা!’

মহিলা নড করল। ‘আর দেব?’

মাথা নাড়ল সাওলো। না, ধন্যবাদ, ম্যাম।’

মহিলাকে কিছুটা উদ্বিগ্ন মনে হচ্ছে। ওর উদ্বেগের কারণ সাওলোর অজানা নয়। নিজের ছোট ঘরটা নিজের মত করে সাজিয়ে নিয়েছে ও, এর পেছনে যে তৃপ্তি ও গর্ব, ওটা সম্পূর্ণই ওর নিজের, পাশাপাশি এর নিরাপত্তার দিকটাও ওকে ভাবতে হয়। সাওলো ওকে দোষ দিচ্ছে না—বরং নিজেকে মহিলার সুন্দর সুশৃঙ্খল গৃহস্থালিতে অশুভ সঙ্কেত বহনকারী বলে মনে হচ্ছে ওর। ওর আগমন হয়তো মহিলার যৎসামান্য নিরাপত্তায় মহা দুর্যোগের সৃষ্টি করতে পারে।

ছোট পীপিং রূমটার দরজা-পথে মহিলার স্বামীকে দেখা গেল। অ্যালেসান্দ্রো শক্ত সমর্থ সুঠাম একজন পুরুষ, নাকের নিচে পুরুষ্ট গোঁফ—সব মিলিয়ে চমৎকার চেহারা। ওকেও কিছুটা উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছে, তবে অসন্তুষ্ট নয়। ‘সিনর,’ বলল সে, ‘তোমার সঙ্গী জেগে উঠেছে, খুঁজছে তোমাকে।’

উঠে ওর সঙ্গে গেল সাওলো। পীপিং রূমে ইয়েটস শুয়ে আছে। ওর চোখ-মুখ শুকনো, দৃষ্টি নিষ্প্রভ। এক নজর দেখলে যে কেউই বলবে, ক্লান্তির চরমে পৌঁছে গেছে বেচারা।

‘কী হয়েছিল আমার?’ সাওলোকে দেখে ক্ষীণস্বরে জানতে চাইল সে। ওর পাশে বসল সাওলো। ‘রোদে মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিলে তুমি, মি. ইয়েটস।’

‘হ্যাঁ, মনে পড়ছে এখন। আমার ধারণার চেয়ে অনেক বেশি দূরে ছিল জায়গাটা। তারপর?’

‘বাকি পথটা বুড়ো খোকা কোলে চড়ে এসেছেন!’ হাসল সাওলো।

‘ক্রাইস্ট!’ গাঢ়স্বরে বলল ইয়েটস। সাওলোর বাহু আঁকড়ে ধরল দুর্বল হাতে। ‘কিন্তু স্টেইভ, আমরা থাকতে পারব না এখানে।’

‘অ্যালেসান্দ্রোকে আমি বলেছি যত শীঘ্রি সম্ভব মালপত্র গুছিয়ে ট্যুবাকে চলে যেতে।’

‘ভাল করেছ। সময় নেই, আমিও…’ উঠতে গেল ইয়েটস, সাওলো শুইয়ে দিল ওকে জোর করে। ‘চুপচাপ শুয়ে থাকো। ওরা যাবার সময় তোমাকে নিয়ে যাবে।’

‘আমাকে? তার মানে তুমি যাচ্ছ না!’

‘অ্যালেসান্দ্রোর বাড়তি ঘোড়া আছে একটা। ওকে বলেছি আমি ওটার কথা।’

‘তার মানে, তুমি… জেসাস, অ্যাম্বারগো…’

‘কাউকে তো যেতে হবে, তাই না?’

‘নিশ্চয়। কিন্তু তোমাকে নয়—তুমি যেতে পারবে না।’

‘কেন?’

‘অনেক করেছ তুমি, সাওলো। মেলোডির ব্যাপারটা দুঃখজনক। কিন্তু আমার মনে হয়, অ্যাম্বারগো ওকে মেরে ফেলবে না।’

‘গ্যানো বলেছিল, এর আগেও একটা মেয়েকে খুন করেছে ও।’

‘আমি কুরিয়াপোর কথা ভাবছি, বাছা। ভাগ্য ভাল, পথে ও আমাদের নাগাল পায়নি। ট্র্যাক ধরে ও সোজা এখানে চলে আসবে। এখান থেকে তোমার ট্র্যাক বেছে নিয়ে তোমার পিছু নেবে; লেগে থাকবে ও তোমার পেছনে আঠার মত। ওকে এড়াতে হলে তোমাকেও ট্যুবাক চলে যেতে হবে, স্টেইভ।’

‘আমি তা জানি।’

‘তোমার সাথে আমি তর্কে যাব না, বাছা। হাত ওল্টাল ইয়েটস। ঠিক আছে। প্রার্থনা করি, তুমি সফল হও। তবে… চিৎ হয়ে শুয়ে চোখ বুজল।

‘তোমাকে আমি ফের দেখতে চাই, বাছা।’

‘দেখতে পাবে,’ ওকে আশ্বাস দিল সাওলো। তুমি ট্যুবাকে গিয়ে অপেক্ষা কোরো। আর আমার জন্যে একটা বোতল রেখো…’

‘রাখব, কথা দিচ্ছি।’

উঠানে বেরোল সাওলো। সূর্য ডোবার ঘণ্টা দুয়েক বাকি আর। নিজের ছোট্ট করালটার দরজায় দাঁড়িয়ে গোঁফের আগায় চিমটি কাটছে অ্যালেসান্দ্রো। ওর তিনটে ঘোড়ার মধ্যে দুটো বুড়ো গোছের, আর একটা তেজী শাদা- কালো ছোপের গেল্ডিং। উঠানের একপাশে দাঁড়িয়ে আছে পুরানো একটা ওয়াগন।

অ্যালেসাদ্রোর কাছে গেল সাওলো। ‘বাঁধাছাঁদায় তোমাকে সাহায্য করতে পারি?’

‘কী করব ঠিক বুঝতে পারছি না, সিনর। তুমি কি শিওর, ওরা এদিকে আসবেই?’

‘তোমাকে তো বলেছিই। তাছাড়া তুমি নিজেও নিশ্চয় শুনেছ, কুরিয়াপো রিজার্ভেশন থেকে পালিয়েছে। ওর আসার আগেই তোমাদের সরে পড়া উচিত।’

‘শুনেছি,’ স্বীকার করল মেক্সিকান। ‘শেষ স্টেজটা এখান দিয়ে যাবার সময় ওদের মুখে শুনেছিলাম। তবে আমার ধারণা ছিল, এতদূর পশ্চিমে ওরা নাও আসতে পারে। আমি বউয়ের সঙ্গে কথা বলেছি, ও এসব ছেড়ে ছুড়ে যেতে মোটেই রাজি নয়। অ্যালেসান্দ্রোর গলায় কৈফিয়তের সুর। ‘এটা আসলে ওরই ঘর।’

‘ওর ঘর ওর পরিবার হলো, আমার মতে, তুমি আর ওই বাচ্চা দুটো। তাছাড়া পরে যে-কোন সময় ওখান থেকে তুমি এখানে ফিরে আসতে পারবে। দয়া করে নিজেদের প্রয়োজনীয় মাল-সামানা গুছিয়ে নাও-এক্ষুণি সরে পড়ো এখান থেকে। তোমাদের পাথুরে ঘর আগুনে পুড়বে না—আর পরিস্থিতি শান্ত হলেই এখানে ফিরে আসবে।’

‘এসো, ভারদেদ। আসলে ও এতটা তলিয়ে ভাবেনি।’

‘এসো, বাঁধাছাঁদায় আমিও হাত লাগাচ্ছি।’

দু’জনে মিলে পুরানো ওয়াগনটায় বুড়ো ঘোড়া দুটোকে জুড়ে দিল ওরা। বাসনকোসন প্রভৃতি ব্যবহার্য দ্রব্যাদি এবং মূল্যবান কাপড়চোপড় সব তুলল ওয়াগনে। কম্বল বিছিয়ে ইয়েটসের জন্যে মোটামুটি আরামদায়ক একটা বিছানা তৈরি করে ওখানে শুইয়ে দিল ওকে। তারপর সাওলো অ্যালেসান্দ্রোর দেয়া স্যাডল চাপাল গেল্ডিংয়ের পিঠে। হাঁটিয়ে নিয়ে চলল ওটাকে ওয়াগনের পাশে পাশে। অ্যালেসান্দ্রোর কাছ থেকে একটা কম্বল, পানি রাখার জন্যে চামড়ার বোতল আর ওর ওয়াকার কোল্টটা নিল ধার হিসেবে।

ওয়াগনের পাশে পাশে চলল সে। অ্যালেসান্দ্রোকে আশ্বাস দিয়ে বলল, ‘চিন্তা কোরো না, সিনর। তোমার জিনিসগুলোর একটিও নষ্ট হবে না। ওগুলো অক্ষত অবস্থায় নিয়ে আসব আমি। নষ্ট হলে ক্ষতিপূরণ দেব।’

‘এসো, নাদা! ওসব নিয়ে তুমি ভেব না। অ্যাডিয়স, সিনর!’

স্টেজরোড ধরে পশ্চিমে ওয়াগন ছোটাল অ্যালেসান্দ্রো। চাকার ঘষায় ধূলি উড়তে লাগল। সাওলো কিছুক্ষণ গেল্ডিংটাকে দাঁড় করিয়ে ওয়াগনের যাওয়া দেখল। তারপর পুবদিকে ছোটাল ওটাকে। এখান থেকে উত্তর-পুবে, যেখান থেকে অ্যাম্বারগো পালিয়েছিল, সেখানে গিয়ে ব্যাক-ট্র্যাক করার চেয়ে এটা আরও সহজ। অ্যাম্বারগো আড়াআড়িভাবে স্টেজরোড ক্রস করে সোজা দক্ষিণ দিকে গেছে। এখান থেকে বর্তমান পথে গেলে সাওলো অনেক কম সময়ে ওর নাগাল পাবে বলে আশা করছে।

ওর ধারণা স্যাডলবিহীন ক্লান্ত ঘোড়া নিয়ে অ্যাম্বারগো খুব বেশি দূরে যেতে পারেনি। ঘুম এবং আনুষঙ্গিক অন্যান্য প্রয়োজনে ওকে থামতে হচ্ছে। তাছাড়া ও একা নয়; ক্লান্ত, শ্রান্ত ও অনিচ্ছুক একজন মহিলাকে নিয়ে চাইলেও গতি বাড়াতে পারবে না।

অবশ্য সাওলো নিজেও ক্লান্ত; জীবনে এত ক্লান্তি ও আর কখনও অনুভব করেনি। ওর এখন যেটা দরকার, সেটা হচ্ছে ঘুম— একটানা লম্বা গাঢ় ঘুম। ন।-ঘুমিয়ে আর কতক্ষণ টিকে থাকতে পারবে, বুঝতে পারছে না ও। আর এ-অবস্থায় অ্যাম্বারগোর মত একজন ধড়িবাজ শয়তানের বিরুদ্ধে কিভাবে পেরে উঠবে, তাও জানে না।

সূর্য ডোবার আর সামান্য সময় বাকি। রাতে ওকে থামতেই হবে। তবে অন্ধকার নেমে আসার আগে যতদূর সম্ভব এগিয়ে যাবার চেষ্টা করছে সে। সকালে ভোরের আলো ফোটার আগে আবার শুরু করবে যাত্রা। এর মধ্যে সামান্য কয়েক ঘণ্টার ঘুম ওর জন্যে মহা মূল্যবান।

.

থেঁতলানো ঠোঁট আর জখমী মাড়ির প্রচণ্ড যন্ত্রণা নিয়ে ঘুম থেকে জেগে উঠল অ্যাম্বারগো। ওর কাছ থেকে একটু দূরে ঝড়ে উপড়ে যাওয়া বৃক্ষের মত পড়ে আছে মেলোডি। প্রায় উলঙ্গ। নিচের স্কার্ট পেঁচিয়ে ওর হাতদুটো পেছনে বাঁধা, দু’পাও। মুখ, পিঠ আর শরীরের নানান জায়গায় মারের অজস্র চিহ্ন।

ওর দিকে চেয়ে রইল অ্যাম্বারগো কিছুক্ষণ। থেঁতলানো ঠোঁটে হাসতে গিয়ে পরক্ষণেই ব্যথায় কুঁচকে গেল ওর কপাল। দু’চোখে রাগ ঝলসে উঠল অস্ফুটস্বরে নোংরা একটা খিস্তি আওড়াল মেলোডির উদ্দেশে।

তবে নিজের ওপরও ওর রাগ কম নয়। শাদা চামড়ার বেশ্যাটাকে ভুল বুঝেছিল সে। ভেবেছিল ওর কবলে পড়ে মেয়েটার সাহসই হবে না ওরকম কিছু ঘটাবার। তাছাড়া ও নিজেও কিছুটা অসতর্ক ছিল। আসলে মেয়েটা চমত্কার, অত্যন্ত চমৎকার। এ-রকম মেয়েকে চুমু খাবার সময় যে-কোনও পুরুষের বাহ্যজ্ঞান লুপ্ত হয়ে যাবার কথা।

থেঁতলানো ঠোঁটে আলতো করে আঙুল বুলাল অ্যাম্বারগো। ভাগ্যিস, সময়মত মাথাটা সরিয়ে নিতে পেরেছিল, আরেকটু হলে ওর মাথা ছাতু হয়ে যেত; কিংবা আঘাতটা আরেকটু ওপরে লাগলে কমপক্ষে দু’থেকে তিনটে দাঁত খোয়াতে হত ওকে। আর মেয়েটা যদি পিস্তল চালাতে জানত, তাহলে…ঠাণ্ডা একটা অনুভূতি শিরশির করে উঠল ওর ঘাড়ে, এতক্ষণে পাঁজরে দু’তিনটে বুলেট নিয়ে মরে পড়ে থাকত ও এখানে।

রাগে ওকে মেরে ফেলার জন্যে পিস্তল তুলেছিল অ্যাম্বারগো। কিন্তু পরে অশুভ ইচ্ছেটাকে দমন করতে হয়েছে ওকে। পিস্তলের মুখে কুঁকড়ে যায়নি মেয়েটি—এবং দাঁড়িয়েছিল বুক উঁচু করে। সাপের মত হিস হিস করতে করতে বলেছিল, ‘কুত্তার বাচ্চা!’

উত্তেজনায় ওর বুক ওঠা-নামা করছিল হাপরের মত। আর তাতেই অ্যাম্বারগোর ক্রোধ আবার কামনায় পরিণত হয়েছিল। তবে মেরেছে ও মেয়েটাকে প্রচণ্ড ভাবে, শিক্ষা দেবার আশায়। এক পর্যায়ে অজ্ঞান হয়ে যায় মেলোডি।

উপুড় হয়ে পড়ে আছে মেলোডি। পা দিয়ে ঠেলে ওকে চিৎ করল অ্যাম্বারগো। ককিয়ে উঠল মেয়েটা। ঘুম ভেঙে গেল ওর। চোখ পিট পিট করল, তারপর বিষদৃষ্টিতে চাইল অ্যাম্বারগোর দিকে।

ওর প্রায় উলঙ্গ শরীরে চোখ আটকে গেল অ্যাম্বারগোর। থেঁতলানো ঠোঁট আর জখমী মাড়ির যন্ত্রণা ছাপিয়ে কামনা জেগে উঠল। ডিয়স, শরীর বটে শাদা কুত্তিটার! এগোল ও হাত-পা বাঁধা অবস্থায় বেমক্কা চিৎ হয়ে পড়ে থাকা মেলোডির আতঙ্কিত চোখে চোখ রেখে।

আচমকা থেমে পড়ল অ্যাম্বারগো। ওর সতর্ক কানে অস্ফুট একটা শব্দ এসে ঢুকেছে। পাথরের সাথে ধাতব কিছুর ঘষা খাওয়ার শব্দ। খুব অস্পষ্ট, সূক্ষ্ম। আরেকটু হলে মিস করত সে। তবে সকালের এ শান্ত নীরবতায় ওর কানকে এড়াতে পারল না শব্দটা।

মেলোডিকে ওই অবস্থায় ফেলে রেখে পিস্তলহাতে দৌড়ে গুহামুখে চলে গেল অ্যাম্বারগো। উঁকি দিল সাবধানে, দূরে একটা নড়াচড়ার আভাস চোখে পড়ল। ঝরণার পাড়ে ঝোপঝাড়ের আড়ালে একটা ঘোড়া আর তার সওয়ারিকে দেখা গেল একটু পর। পিস্তল হোলস্টারে ঢুকিয়ে শার্পসটা তুলে নিল সে। অপেক্ষা করতে লাগল। আসুক লোকটা, আরেকটু আসুক। বিকৃত মুখে ভয়ঙ্করভাবে হেসে উঠতে চাইল ও মনে মনে, ব্যথা পেয়ে চোখ কুঁচকাল।

ঝরণার পাড় ধরে আস্তে আস্তে এগিয়ে আসছে ঘোড়সওয়ার। সতর্ক সে, তীক্ষ্ণ নজর বুলাচ্ছে চারপাশে। ওর ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে কিছু একটা খুঁজছে ও-এবং খুঁজে পাবার ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসীও। লোকটার ভাব-ভঙ্গি এবং শারীরিক কাঠামো দেখে অ্যাম্বারগোর কাছে পরিচিত মনে হচ্ছে ওকে। আরেকটু এগোতেই মুখ স্পষ্ট না-দেখেও আগন্তুককে চিনতে পারল ও। সাওলো।

‘বেজন্মাটা ঘোড়া পেল কোথায়?’ আপনমনে বিড়বিড় করল অ্যাম্বারগো। রাইফেলের স্টকে চিবুক ঠেকাল সে, চোখ রাখল সাইটে।

টার্গেট এখনও দূরে, তাছাড়া ভোরের আলো এখনও অনুজ্জ্বল। কিন্তু বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে রাজি নয় অ্যাম্বারগো, সাওলোকে বিন্দুমাত্র সময় দেয়া উচিত হবে না।

হঠাৎ ঘোড়া থামাল সাওলো। ‘গুহার অন্ধকার মুখটা দেখে ফেলেছে নাকি!’ ভাবল অ্যাম্বারগো। ‘তাহলে নির্ঘাত সন্দেহ করে বসবে দোআঁশলা!’

ওর এই দাঁড়ানো অবস্থাই লক্ষ্যভেদের সুবর্ণ সুযোগ— রাইফেলের ট্রিগার টানল অ্যাম্বারগো।

.

ভারী বুলেট আঘাত করল গেল্ডিংয়ের মাথায়। ঘোড়াটার পতন অনুভব করতেই লাফ দিল সাওলো, একটা উইলো ঝোপের ওপর পড়ল। ঘন ঝোপ পতন আংশিক রোধ করল, তারপর গড়িয়ে পড়তে লাগল ও নিচের দিকে। শাপসের শব্দটা চিনতে পেরেছে সাওলো। ক্যানিয়নের দেয়ালে এখনও প্রতিধ্বনিত হচ্ছে ওটার গুরুগম্ভীর আওয়াজ।

ঝরণার তলায় পানিতে গিয়ে পড়ল সে। বেশি পানি নেই ঝরণায়, ইঞ্চিকয়েক মত গভীর। হাঁটু আর দু’হাতে ভর দিয়ে হামাগুড়ি দিল সাওলো পাড়ের দিকে। ভিজে গেছে খানিকটা।

পাড়ের ওপর হাত রেখে সন্তর্পণে মাথা তুলল ও। যেটাকে আগেই গুহা বলে সন্দেহ করেছিল, ওখানে ধোঁয়ার চিহ্ন দেখতে পেল। মাথা আরেকটু

উঁচাল সাওলো, পর মুহূর্তে ওর পায়ের কাছে উইলো ঝোপের ভেতর গিয়ে ঢুকল দ্বিতীয় গুলিটা।

উজানে কয়েকগজ সরে গেল ও। এখানে পাড় ভাঙা, নুড়ি পাথরে ভরা। ভাঙা পাড়ের এক ধার ঘেঁষে আবার উঁকি দিতে গেল সে, সাথে সাথে আরেকটা গুলি এসে বিদ্ধ হলো অন্য ধারটায়। পাথর কণা আর ধুলো উড়ল, ওর ক্লান্তিতে হাঁ-করা মুখে এসে ঢুকল বালি।

পিছিয়ে গেল সাওলো। ইতোমধ্যে আরেকটা গুলি এসে বিদ্ধ হয়েছে প্রায় আগের জায়গাতেই। পিছিয়ে এল ও ফের।

‘ওর দৃষ্টির আড়ালে থেকে সরে যেতে হবে,’ ভাবল সাওলো। ‘নইলে বারবার জ্বালাবে হতচ্ছাড়া স্প্যানিয়ার্ড।’

সাওলোর চেয়ে ভাল অবস্থানে আছে অ্যাম্বারগো গুহার মুখে। ইচ্ছে মত জায়গা পাল্টে ওকে ঘায়েল করার চেষ্টা চালাচ্ছে।

ভেজা কটিবন্ধ থেকে অ্যালেসাদ্রোর দেয়া কোল্টটা বের করল সাওলো। বারুদ সম্ভবত ভিজে গেছে। মৃত ঘোড়ার কাছে পড়ে থাকা স্যাডল ব্যাগে শুকনো বারুদ আর গুলি আছে। কিন্তু অ্যাম্বারগোর গুলির মুখে ওগুলো আর ‘নিয়ে আসা সম্ভব নয়। কোল্টটা এখন ব্যবহারের অযোগ্য।

উজানে শ’দুয়েক গজ দূরে খাড়ির পাড় আর ক্যানিয়ন ফ্লোর ছোট-বড় পাথরে পরিপূর্ণ। ওখানে চলে গেলে সাওলোর বর্তমান অবস্থা পাল্টে যাবে। কিন্তু ওখানে যেতে হলে ওকে পেরোতে হবে মাঝখানের দু’শ’ গজের মত সম্পূর্ণ খোলা জায়গাটা।

খসখসে হাতের তালু চোয়ালে ঘষল সাওলো, চিন্তা করছে। এক দৌড়ে পেরোতে গেলে অতটা পথের কোথাও সামান্য আড়ালও পাওয়া যাবে না। অ্যাম্বারগোর হাতের শার্পসটা আবার বাফেলো গান। ওটার গুলিতে কী হয়, সাওলো তা না-বোঝার মত বেকুব নয়। কিন্তু উপায় নেই। এখান থেকে সরে পড়তে হবে। নয়তো ভেজা বারুদভরা কোল্ট নিয়ে এখানে অপেক্ষা করতে হবে অ্যাম্বারগোর জন্যে।

অ্যাম্বারগো সুযোগের অপেক্ষায় রয়েছে। কিন্তু সাওলোর নিজেকে নিয়ে জুয়ায় নামতে হবে। দু’শ’ গজের মত খোলা জায়গাটা ও অ্যাম্বারগোর চোখে পড়া এবং রাইফেলের সাইটে আসার আগে হয়তো পেরোতে পারবে, কিংবা পারবে না। এটা অনিশ্চিত এবং এ-অনিশ্চয়তাটুকু ওকে মেনে নিতে হবে।

শরীর বাঁকিয়ে ক্রীকের মেঝেয় লাফ দিল সাওলো। মসৃণ পাথুরে পিঠে পিছলে গেল পা, কোনওমতে টাল সামলে মাথা নিচু করে দৌড় দিল উজানে। টান টান উত্তেজনায়, অ্যাম্বারগোর চোখে পড়া থেকে গুলি করা পর্যন্ত কতক্ষণ সময় লাগতে পারে, হিসেব করল মনে মনে। এক সেকেন্ড, দুই সেকেন্ড, তিন- আচমকা ডানে ঘুরল সে, পর মুহূর্তে ওর এক ফুটের মধ্যে এসে পড়ল গুলি। ছলকে উঠল পানি। লাফিয়ে উঠল সাওলো নিজের অজান্তে, ভারসাম্য হারাল, আছড়ে পড়ল পিচ্ছিল পাথরে। হাঁচড়ে-পাঁচড়ে উঠল আবার, দৌড় দিল। ছড়ানো ছিটানো পাথরের আড়ালে পৌঁছে ওগুলোর মধ্যে দিয়ে পাড়ে উঠে এল।

ভাঙাচোরা গ্র্যানিটের একটা স্তূপের পাশে বসল ও। তাকাল চারদিকে। পাথরগুলোর ওপাশে প্রথম ঝোপগুলোর মাঝখানের জায়গাটুকু পুরোপুরি উদোম; সামান্য আড়ালও নেই কোথাও।

খোলা জায়গাটায় তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চোখ বুলাল ও; এক পর্যায়ে দেখতে পেল অ্যাম্বারগোকে। গুহার মুখ সংলগ্ন একটা শৈলশিরায় রাইফেল রেখে গুলি করার জন্যে উন্মুখ হয়ে আছে। পাথরের আড়ালে নড়াচড়া দেখে গুলি ছুঁড়ল ও। কুঁকড়ে গিয়ে মাথা যথাসম্ভব নিচু করে ফেলল সাওলো। ওপরের আলগা অংশে গুলি বিদ্ধ হয়ে চারদিকে কুচি ছড়াল গ্র্যানিট পাথর।

ক্যানিয়ন ফ্লোরটা চড়াই। আচমকা উঠে দৌড় লাগাল সাওলো। ঝোপ পর্যন্ত পৌছার আগে হোঁচট খেল দু’বার। ঝোপে ঢুকে পড়ে আরও কিছুদূর এগোল; শব্দ লুকোনোর চেষ্টা করল না মোটেও। একটু পরই দারুণ আড়াল পেয়ে গেল অ্যাম্বারগোর গুলি থেকে। থামল সে। গর্জে উঠল বাফেলো গান, বুলেট ওর হ্যাটের প্রান্ত ছুঁয়ে ফুট খানেক ওপরে ক্যানিয়নের দেয়ালে বিধল।

‘বেশ, বিড়বিড় করল সাওলো। খেলা এবার আমার হাতে, অ্যাম্বারগো!’

অ্যাম্বারগো ওর অবস্থান থেকে নড়ল। ঝাড়জঙ্গল ভেদ করে ঢাল বেয়ে দ্রুতপদে নামতে শুরু করল। আঁতিপাঁতি করে খুঁজতে শুরু করল যেখানে প্রথমবার সাওলোকে দেখেছিল, সেখানটায়। এদিকে ঢালের ওপর ক্যাটক’ ঝোপের ভেতর দিয়ে নিঃশব্দে ওপরে উঠছে সাওলো। অ্যাম্বারগোকে নজরে রাখার দরকার মনে করছে না।

সাওলো যখন নিশ্চিত হলো যে, অ্যাম্বারগো ওকে অতিক্রম করে নিচের দিকে চলে গেছে, দ্রুত ঘুরে অ্যাম্বারগোর সোজাসুজি ওপরে এসে গেল ও।

ঝোপঝাড় ভেঙে অ্যাম্বারগোর চলার শব্দ ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে এল। সাওলো জানে, অ্যাম্বারগো বোকা নয়। ধোঁকা খেয়েছে, এটা বুঝতে ওর একটুও সময় লাগবে না। ওর কানে আবার ঝোপঝাড় ভেঙে চলার আওয়াজ এল। মাথা নাড়ল সে। অনুমান মিথ্যে নয়। ভুলটা বুঝতে পেরে অ্যাম্বারগো আবার উঠে আসছে ওপর দিকে

ঝোপঝাড় নড়ার শব্দ বন্ধ হয়ে গেল হঠাৎ। অখণ্ড নীরবতা নেমে এল।

অ্যাম্বারগো অপেক্ষা করছে…সাওলোর কাছে অস্ত্র আছে কি নেই বুঝতে পারছে না। ফলে সতর্কতা অবলম্বন করতে হচ্ছে ওকে। তবে নিজের কাছে অস্ত্র হিসেবে বাফেলো গানটা থাকায় আত্মবিশ্বাসী সে। সাওলোর পরবর্তী পদক্ষেপের জন্যে অপেক্ষা করছে এখন।

সোজাসুজি নেমে অ্যাম্বারগোর কাছাকাছি হবার পরিকল্পনা বাদ দিল সাওলো। আড়াআড়ি ভাবে নামতে শুরু করল এবার। ক্যাটক্ল’ ঝোপের মধ্যে এবড়োখেবড়ো পাথর ছড়ানো ছিটানো। অত্যন্ত সতর্কতার সাথে এগোল সে ওগুলোর মধ্যে দিয়ে।

কিছুদূর এগোতেই অ্যাম্বারগোর অবস্থান টের পেল ও। ওর গায়ের মসৃণ চামড়ার পোশাক দেখা গেল ঝোপের ফাঁকে। অ্যাম্বারগোর খুব কাছে পৌঁছে গেছে ও। ওদের মধ্যে এখন সামান্য ঝোপঝাড়ের আড়াল।

ঝোপঝাড়ের ফাঁকে অ্যাম্বারগোকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল। তীক্ষ্ণ নজর বুলাচ্ছে স্প্যানিয়ার্ড ঢালের নিচের দিকে। সাওলো যে ওপরে উঠে ঘুরে ওর ফেলে-আসা অবস্থানে গিয়ে দাঁড়িয়েছে, ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি।

আচমকা উঠে দৌড় দিল সাওলো। কিন্তু ঝোপের সাথে পা বেধে গিয়ে পড়ে গেল হুড়মুড় করে।

চরকির মত ঘুরল অ্যাম্বারগো, বাফেলো গানটা তুলল; তাড়াহুড়োয় মিস করল গুলিটা। কিন্তু তার আগেই লাফ দিয়ে সাওলো ওর কাছে ভিড়ে গেছে। দু’জনের মধ্যে শারীরিক সংঘর্ষ ঘটল। এর আগে গুলিটা বেরিয়ে গেছে সাওলোর বাহু প্রায় ছুঁয়েই।

প্রচণ্ড সংঘর্ষে ছিটকে গেল দু’জন দু’দিকে। নিচের দিকে গড়িয়ে গেল অ্যাম্বারগো, ওর পেছন পেছন সাওলো। কিছুদূর যেতেই ঢালের গা ফুঁড়ে বেরিয়ে থাকা পাথরে আটকে ওর নিম্নগতি রুদ্ধ হলো। বেহুঁশের মত পড়ে রইল সাওলো কিছুক্ষণ। ঢালের কঠিন মাটি আর এবড়োখেবড়ো পাথরের ঘষায় শরীর ক্ষত-বিক্ষত হয়ে গেছে। নাক থেকে রক্ত ঝরতে শুরু করেছে। বাতাসের জন্যে হাঁ করতেই জিভে রক্তের নোনা স্বাদ পেল ও।

অতি কষ্টে উঠে বসল সাওলো। মাথা ঝাড়া দিল ক্ষীণভাবে। চোখ পিটপিট করে চারদিক তাকিয়ে অ্যাম্বারগোর সন্ধান করল। নিচে, কিছুদূরে ওর চোখ স্থির হলো। ওখানে মাথা-নিচু পা-উঁচু হয়ে পড়ে আছে স্প্যানিয়ার্ডের বিশাল বাদামী দেহ।

পাথরে ভর দিয়ে আস্তে আস্তে উঠল সাওলো। ঝোপঝাড় ধরে ঢাল বেয়ে নামতে লাগল। অ্যাম্বারগোর কাছে পৌঁছল। প্রচণ্ড সংঘর্ষে চিৎ হয়ে প্রবলবেগে নিচের দিকে নেমে গেছে অ্যাম্বারগোর শরীর, পাথরে ধাক্কা খেয়ে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেছে মাথা। মগজ, রক্ত ছিটকে বেরিয়ে লেপ্টে গেছে মুখ আর মাথার টুপিতে।

অ্যাম্বারগোর মৃতদেহ থেকে নিজের ছুরি, পিস্তল আর গুলির বেল্ট উদ্ধার করল সাওলো। সংঘর্ষের সময় ছিটকে পড়া বাফেলো গানটাও খুঁজে নিয়ে ধীরে ধীরে পা বাড়াল ঝরণার দিকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *