জ্বালা – ৩

তিন

‘ম্যাম, তোমার আত্মীয়-স্বজন আছে কেউ? কোথায় থাকে ওরা? নাম বলতে পারবে কারও?’

হাঁটুর ওপর থুতনি রেখে ম্যাগি চেয়ে আছে আগুনের দিকে। এবার নিয়ে কমপক্ষে বিশ থেকে পঁচিশ বার জিজ্ঞেস করেছে সাওলো কথাগুলো। কয়েক ঘণ্টা ধরে ওকে কথা বলানোর চেষ্টা করছে, একটি শব্দও বের করতে পারেনি ওর মুখ দিয়ে। অ্যাপাচিদের কবল থেকে মুক্তি পাবার পর থেকে এখন পর্যন্ত একটি শব্দও উচ্চারণ করেনি ম্যাগি

খুব সামান্যই সাড়া দিয়েছে মেয়েটি সাওলোর কথায়। ওর ‘ওঠো’, ‘বসো’, ‘খাও’, জাতীয় আদেশগুলো বিনা প্রতিবাদে মেনেছে ম্যাগি। তবে প্রাণ ছিল না তাতে। যন্ত্রচালিতের মত কাজগুলো করেছে ও।

সাওলো প্রথমে ভয় করেছিল, মেয়েটি হয়তো মাথায় আঘাত পেয়েছে। তবে আঘাতের কোনও চিহ্ন না দেখে স্বস্তিবোধ করে সে। ওর গায়ে টানা- হেঁচড়া আর অ্যাপাচিদের মারধরের কিছু হালকা দাগ। কাপড়-চোপড় নোংরা আর অসংবৃত হওয়ায় কিছুটা মলিন দেখাচ্ছে ওকে। আর ও যে খুঁড়িয়ে হাঁটছে, ওটার জন্যে দায়ী ওর হাঁটুতে পাওয়া আঘাতটাই। ওর সমস্যা আসলে মনে, ভাবল সাওলো, হয়তো আচমকা প্রচণ্ড মানসিক আঘাতে এ অবস্থা হয়েছে মেয়েটার। কিন্তু এই অবস্থায় ওর জন্যে কী করতে পারে সে?

মেস্কিটের আরও কিছু শুকনো ডাল ফেলল ও আগুনে। তেজি হয়ে উঠল আগুন। গুহার পাথুরে দেয়াল আর ছাদে লাল অগ্নিশিখার প্রতিফলন ঘটল। অ্যাপাচি ক্যাম্প থেকে ম্যাগিকে এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জামগুলো নিয়ে এসে এখানে নতুন ক্যাম্প করেছে সাওলো। ক্যাম্পটা অ্যাপাচি ক্যাম্প থেকে মাইল কয়েক উত্তরে।

ম্যাগির এ-অবস্থায় ডাক্তার দেখানো দরকার। ভাল একজন ডাক্তার ছাড়া ওকে সুস্থ করে তোলা যাবে না। এজন্যে যেতে হবে, ছোটখাট কোনও শহরে নয়, সিলভারটন কিংবা ট্যুবাকের মত বড় শহরে। সাওলো যেখানে ক্যাম্প করেছে, সেখান থেকে দুটো শহরই প্রায় সমান দূরত্বে। একটা পুবে আর একটা পশ্চিমে। যে-কোনও একটায় যাওয়া যায় অবশ্য। তবে যাওয়াটা সমস্যা হবে। হত না, যদি এখান থেকে স্টেজকোচ পাওয়া যেত। স্টেজকোচে যাওয়াটা দ্রুত এবং আরামের হত। অবশ্য ঘোড়ায় চড়েও দ্রুত যাওয়া যায়। কিন্তু সেখানে সমস্যা হবে ম্যাগিকে নিয়ে। এ-অবস্থায় স্যাডলে তুলে দিলে মেয়েটি ঘোড়া চালিয়ে যেতে পারবে- এটা আশা করা গেলেও, সম্ভবত ঝুঁকিপূর্ণ হবে। নিজের এই অস্বাভাবিক অবস্থায় দ্রুত ঘোড়া চালাতে গিয়ে দুর্ঘটনায় পড়তে পারে ও।

সূর্য ডোবার পর বেশিক্ষণ ট্রেইলে থাকেনি সাওলো। দেখে-শুনে ক্যাম্প করেছে রাতের জন্যে; সকালে উঠে ট্রেইলে ফের নামবে। সিলভারটন কিংবা ট্যুবাকে যেতে হলে প্রথমে হেইন্স অ্যান্ড হারমার সড়কে উঠতে হবে। সড়কটা এখান থেকে মাইল ত্রিশেক উত্তরে। আগামী দিনের কর্মসূচি নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করতে বসল ও।

উত্তর দিকে যাবার কথা ভাবল সাওলো। নারুতোও গেছে ওদিকে। তবে ও সম্ভবত জানে না কুরিয়াপো এখন ঠিক কোথায় আছে। কিন্তু তাতে খুব একটা অসুবিধে হবে না। অ্যাপাচিদের কিছু নির্দিষ্ট জায়গা আছে, যেখানে ওরা খবর আদান-প্রদান করে। নাবুতো ও-রকম কোনও একটায় গিয়ে কুরিয়াপোর খবর নেবে। ওকে না-পেলে খবর রেখে যাবে ওর জন্যে। একসময় কুরিয়াপো জানতে পাবে তা।

সাওলো জানে, ওর খবর পাওয়া মাত্র তীরবেগে ধেয়ে আসবে কুরিয়াপো। নাওয়া-খাওয়া ভুলে ট্রেইল করবে ওকে। হডসনের মেয়েটাকে হাত করার লোভ ওকে দ্বিগুণ উৎসাহ যোগাবে তাতে। অবশ্য ওকে জীবন্ত ধরার আগ্রহও ওর কোনও অংশে কম নয়।

চিন্তাটা একটুও পছন্দ হচ্ছে না সাওলোর। ও কুরিয়াপোকে পিছু ধাওয়া করতে চায়—পেছন থেকে ওর ধাওয়া খেতে নয়। নিজেকে কুরিয়াপোর শিকার হতে দিতে রাজি নয় ও। তবে ব্যাপারটা নির্ভর করছে নাবুতোর ওপর। অ্যাপাচিরা অনেক ক্ষেত্রেই খেয়ালের বশে চলে। নাবুতোর সঙ্গে ওর বাল্যকালে বন্ধুত্ব ছিল, তা বলে সেটা এখনও আছে, বিশেষ করে নাবুতোর দিক থেকে—একথা হলফ করে বলা যাবে না। অ্যাপাচিদের ভাব-ভঙ্গি দেখে ওরা কী করবে আর কী করবে না, অনুমান করা সম্ভব নয়। নারুতোর তিন সঙ্গীর মত ওকেও হত্যা না করায় ও সাওলোর প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবে, সেটাও নিশ্চয় করে বলা যাবে না। আসলে ওদের কাছে শাদা মানুষের মূল্যবোধ অনুযায়ী কৃতজ্ঞতা বা বিশ্বাসঘাতকতার আলাদা কোনও অর্থ নেই।

যাহোক, এ-ব্যাপারে চোখ-কান খোলা রাখা ছাড়া আপাতত আর কিছু করার নেই। মেয়েটার উপযুক্ত চিকিৎসার জন্যে এখন ওকে উত্তর দিকে যেতে হচ্ছে। নইলে কুরিয়াপোর মুখোমুখি হবার সম্ভাবনা এড়াতে চাইলে নিজের পছন্দসই দিক বেছে নিতে পারত। কিন্তু ম্যাগির যা অবস্থা, তাতে ওকে ডাক্তার দেখাতে না-পারলে অবস্থার অবনতি ঘটার আশঙ্কা রয়েছে।

ক্যাম্প-ফায়ারের ওপর দিয়ে ম্যাগির পানে চাইল ও। ওর দৃষ্টিতে জেদ। মেয়েটার গায়ে ছেঁড়াখোঁড়া একটা নকশাদার কেলিকো। ঠাণ্ডায় কাঁপছে ও। মৃদু স্বরে গাল বকল সাওলো, আগুনে আরও কাঠ চাপাল। তারপর থলে থেকে একটা সালতিলো (চাদর) বের করে ওর কাঁধে ছুঁড়ে – দিল। চুপচাপ সালতিলো খানা যত্ন করে গায়ে জড়াল ম্যাগি, তারপর আগের মত চেয়ে রইল আগুনের দিকে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকাল সাওলো। ওম পাচ্ছে এখন মেয়েটি, কাঁপুনি কমেছে।

একটু পর নড়ে উঠল ম্যাগি। এই প্রথম সাওলোর বলা ছাড়া নড়ল ও। হাত তুলে মাথার চুল ছুঁল। আঙুল দিয়ে আঁচড়ানোর চেষ্টা করল। ব্যাগ থেকে একটা চিরুনি বের করে ওর দিকে বাড়িয়ে দিল সাওলো। খানিকক্ষণ শূন্যদৃষ্টিতে চিরুনিটার দিকে তাকিয়ে থেকে হাত বাড়াল ম্যাগি ওটার দিকে।

গায়ের শাদা রঙটা বাদ দিলে মেয়েটি সুন্দর, মনে মনে স্বীকার করল সাওলো। ওর চুল চকচকে মধুরঙা, সাওলোর মায়ের চুলও ছিল ওই রঙের। ওর মনে আছে, ছোটবেলায় মা ওকে ঝরণার পাড়ে বসিয়ে রেখে নিজের চুল ধুয়ে আঁচড়াত আর সূর্যালোকে মায়ের ভেজা চুল সোনার সুতোর মত চকচক করত।

অবশ্য মাকে নিয়ে বাল্যকালে সাওলোর লজ্জারও অন্ত ছিল না। মায়ের গায়ের রঙ ছিল শাদা, অ্যাপাচিদের চোখে যা ফ্যাকাসে, অন্যদের মায়েদের মত তামাটে ছিল না; তবু মায়ের মধুরঙা চুলের জন্যে কিছুটা গর্ববোধও ছিল ওর। খেলার সাথীদের কেউ তাকে ‘শাদা-চোখ’ বলে খ্যাপাতে চাইলে পিটিয়ে ওর নাক ভেঙে দিতে চাইত।

সেবার গ্রীষ্মকালে, সাওলোর বয়স যখন চোদ্দ, ইউ এস আর্মি জারিপোর পরিবারকে সান লাজেরো রিজার্ভেশনে নিয়ে আসে। ওর শৈশবের দিনগুলো বেশির ভাগ মেক্সিকোতে কেটেছিল। এর আগে সাওলো ওর মাকে ছাড়া আর কোনও শাদা চামড়ার মহিলা দেখেনি। সান লাজেরোতে সে আরও দু’জন শ্বেতাঙ্গ মহিলা দেখতে পায়। ওদের একজন রিজার্ভেশনের ইন্ডিয়ান এজেন্টের বউ মিসেস প্রেস্টন, অন্যজন রেভারেন্ড ড্যাটর স্টেইভের বউ মিসেস স্টেইভ। মিসেস প্রেস্টন ছিলেন সুন্দরী ও তরুণী, আর মধ্যবয়সী মিসেস স্টেইভ মোটেই আকর্ষণীয়া ছিলেন না। সেবারই সাওলো প্রথম উপলব্ধি করল যে, সুন্দরী দু’ধরনের—ইন্ডিয়ান সুন্দরী আর শ্বেতাঙ্গ সুন্দরী। এরপর থেকে নিজের মাকে সে সুন্দরী হিসেবে ভাবতে শেখে।

কিন্তু জারিপোর কাছে থেকে নিজের সব সৌন্দর্যই হারিয়েছিল সাওলোর মা। একসময়কার জেন হোয়াইট নামের উজ্জ্বল তরুণীর কিছুই আর অবশিষ্ট ছিল না ওর মধ্যে। তার চকচকে শাদা রঙ তখন ফ্যাকাসে মেরে গেছে, মধুরঙা চুলে নেমেছে ধূসর ছায়া। দীর্ঘকাল ধরে অ্যাপাচিদের সাথে থেকে আমূল পরিবর্তন ঘটেছিল ওর। চলনে-বলনে নিজেকে অ্যাপাচি হিসেবে পরিচিত করতেই আগ্রহ ছিল বেশি। পোর্ট বিউদ্রির সেনা অফিসারদের সঙ্গে দেখা হবার পর ওদের প্রশ্নের জবাবে নিজেকে হাফ ইন্ডিয়ান হিসেবে পরিচয় দেয় সে। ওর ভয় ছিল, সঠিক পরিচয় দিলে ওকে ভার্জিনিয়া পাঠিয়ে দেয়া হতে পারে। ওর হাবভাব ও চেহারা-সুরতের হাল দেখে সেনা অফিসাররা ওকে অবিশ্বাস করার কারণ খুঁজে পায়নি।

এরপর থেকে সান লাজেরোর রিজার্ভেশনে ছিল সাওলোর মা। সাওলো এখানে সেখানে ঘোরাঘুরি শেষে দিন কয়েক আগে মাকে দেখতে গিয়েছিল। কুরিয়াপো তখন পালিয়েছে ওখান থেকে।

মা-ছেলে একান্তে কিছুক্ষণ কথা বলেছিল। কথা বলার ফাঁকে মাকে লক্ষ করেছে ও। আরও ফ্যাকাসে আর রোগা হয়েছে সে আগের চেয়ে; তবে চোখ দুটো সজীব এখনও।

মায়ের মুখে সাওলো কুরিয়াপোর কীর্তির কথা শুনেছে। রিজার্ভেশনে থাকার সময় ওখানকার ইন্ডিয়ান এজেন্টকে খুন করে পালিয়েছে সে বিশজন মাথা গরম আর রক্তপিপাসু সঙ্গীকে নিয়ে।

ওর মা অভিযোগের সুরে বলেছে, ‘তোমার ভাই ওকে হত্যা করে পালিয়েছে। এখন ওয়াশিংটনের কর্তাদের কাছে কে যাবে আমাদের জন্যে? তান-তান চমৎকার মানুষ ছিল। শাদা মানুষেরা এখন তোমার ভাইকে কী শাস্তি দেয় কে জানে!’

‘ওটা আমার মাথা ব্যথা নয়,’ সাফ সাফ বলে দিয়েছে সাওলো। আর ওকে আমার ভাই বলবে না।’

‘কেন? তোমরা দু’জনই জারিপোর ছেলে!’

‘জারিপো তা বলে না আমার সম্পর্কে।

‘বলবে না। কোনদিনই বলবে না সে। তুমি নিজেই তা জানো।’

জানে সাওলো। ভাল করেই জানে। বহুবার শুনে শুনে মুখস্থ হয়ে গেছে ওর।

দক্ষিণপন্থীদের ফোর্ট সামটার দখলের খবর যখন অ্যারিজোনায় পৌছায়, তখন সাওলোর মায়ের বাবা কর্নেল রস্টাম হোয়াইট ফোর্ট স্প্যানিঙের কমান্ডার। বাস্তব উপলব্ধি দ্বারা অহেতুক গৃহযুদ্ধটা এড়ানো যাবে, তখনও এমন ধারণা ছিল কারও কারও মনে; সে মুহূর্তে ইউ এস আর্মি কমিশন থেকে পদত্যাগ করে রস্টাম হোয়াইট। ও তখন নিজ রাজ্য ভার্জিনিয়ার পক্ষে যুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে।

সে সময় অ্যাপাচিরা, যুদ্ধের কারণে, নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছিল। সর্বত্র নরক গুলজার করছিল ওরা লুটপাট, খুন-জখম আর ধর্ষণের মাধ্যমে। চারদিকে ওদের আক্রমণের ভয়ে সাধারণ মানুষ তটস্থ। কর্নেল রস্টাম হোয়াইট খুব তাড়াহুড়ো করছিল; অ্যাপাচিদের উৎপাত কমার অপেক্ষা করতেও রাজি ছিল না সে। এমন কী, নিজের সাথে এসকর্ট দেবার জন্যেও অনুরোধ জানায়নি কর্তৃপক্ষের কাছে। নিজের বউ আর একমাত্র মেয়েকে নিয়ে প্রাইস সিটির উদ্দেশে যাত্রা করে সে। পথেই অ্যাপাচি হামলায় পড়ে স্বামী-স্ত্রী দু’জনে প্রাণ হারায়। ষোলো বছরের কন্যা জেনকে জারিপো হত্যা করেনি।

জেনের কাছে এটা এখনও একটা রহস্যময় ব্যাপার। কারণ, এমন নয় যে, জারিপো ওর রূপে মুগ্ধ হয়ে ওকে বাঁচিয়ে রেখেছিল। জারিপোর হাবভাবে কোনওদিন জেনের প্রতি সামান্য আকর্ষণও প্রকাশ পায়নি। সে বরং অনেকবার ওর মুখের ওপর বলে দিয়েছে যে সে অতি কুচ্ছিত একটা মেয়েলোক। অবশ্য নারীসুলভ ক্ষমতাবলে জারিপো বলা শুরু করার আগে থেকেই জেন ওর প্রতি জারিপোর অনাকর্ষণের ব্যাপারটা উপলব্ধি করতে – পেরেছিল।

জারিপো ইন্ডিয়ান কুসংস্কার ও তন্ত্রমন্ত্রের ভক্ত। জেনের এখন ধারণা, ওর মধুরঙা উজ্জ্বল চুলের সাথে নিজের যাদুমন্ত্রের ভক্তির একটা যোগসূত্র খুঁজে পেয়েছিল সে।

রাতের অন্ধকার ছাড়া জারিপো কোনদিন জেন হোয়াইটকে স্পর্শ করেনি। দিনে ওর ছায়াও মাড়াত না। ওদিকে জারিপোর প্রথম স্ত্রী, ইয়াকি ইন্ডিয়ান মহিলা প্রচণ্ড ঘৃণা করত জেনকে, মাঝে-মধ্যে প্রহারও করত মারাত্মকভাবে। ইয়াকি মহিলার এই ঘৃণা জেনের ছেলে হবার আগ পর্যন্ত জারিপোর অগোচরে থাকলেও পরে কিন্তু আর গোপন থাকেনি। জেনের ছেলেকে নিজের ছেলের প্রতিদ্বন্দ্বী ভেবে নিয়ে সে জারিপোকে অনবরত ওদের বিরুদ্ধে ফুসলাতে শুরু করে। এক পর্যায়ে জারিপো জেন আর সাওলোকে ঘর থেকে বেরও করে দেয়।

এই স্মৃতিগুলো মোটেও সুখের নয়। জঙ্গলের পাশে মায়ের জীর্ণ ঘরটার সামনে দাঁড়িয়ে মায়ের সাথে কথা বলতে বলতে সাওলো এসব ভাবে।

ওর ইয়াকি সত্মা অনেকদিন আগে মারা গেছে, কিন্তু যে রক্তবীজ ও রেখে গেছে পৃথিবীতে, তার দাপটে নিরীহ মানুষ এখন অতিষ্ঠ। কুরিয়াপোর প্রতি ওর একটুও টান থাকার কথা নয়, অন্তত ওর নিজের মায়ের সঙ্গে কুরিয়াপোর মায়ের নির্দয় ব্যবহারের কথা মনে করলে। আবার এটাও ঠিক, সে তেরো বছর বয়সে শিকারে গিয়ে কুরিয়াপোকে ভালুকের হাত থেকে বাঁচাতে এগিয়ে যাবার পেছনে অন্য অনেক কিছুর সঙ্গে রক্ত সম্পর্কের ভূমিকাও কম ছিল না।

সে হিসেবে মা তাহলে একদম ভুল বলেনি। কুরিয়াপো ওর ভাই বটে কিন্তু পরিস্থিতি তাতে পাল্টাচ্ছে না। কুরিয়াপোকে ধাওয়া না করে উপায় নেই ওর।

সচেতন হলো সাওলো। এসব স্মৃতি ওর জন্যে আনন্দের নয়। মন থেকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করল সে কষ্টকর স্মৃতিগুলোকে।

সে ম্যাগির দিকে তাকাল। চুল আঁচড়াচ্ছে মেয়েটি এখনও। উঠে দাঁড়াল ও, ঘুরে মেয়েটির কাছে গিয়ে ওর হাত ধরল। ‘ঠিক আছে, ম্যাম। এবার তোমাকে ঘুমোতে যেতে হবে।’

চুপচাপ ওর দিকে চাইল মেয়েটি। সাওলো আবার ডাকল ওকে, ‘ম্যাম, ঘুমোবে না!’

নিজের বেডরোলটি খুলে ম্যাগির জন্যে বিছিয়ে দিল ও, তারপর ঘুরে আগুনের পাশে আগের জায়গায় বসল। কম্বল জড়িয়ে শুয়ে পড়ল ম্যাগি আগুনের দিকে পাশ ফিরে। থলে থেকে একটা চাদর বের করে নিল সাওলো, গায়ে জড়িয়ে জুৎ হয়ে বসল।

‘কে তুমি?’

চমকে উঠল সাওলো। ম্যাগি কথা বলছে! ওর দিকে তাকাল সে। একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে মেয়েটি কম্বলের তলা থেকে। ওর চোখে আগের সে শূন্য দৃষ্টি নেই এখন।

উঠে দাঁড়াল সাওলো

‘কী করতে চাও আমাকে নিয়ে?’

‘কিছুই না।’

তাহলে আমার কাছে এসো না।’

‘আসব না।’ ওকে আশ্বস্ত করল সাওলো।

আবার বসল ও, মেয়েটিকে লক্ষ করতে লাগল। ম্যাগিকে কিছুটা স্বাভাবিক মনে হচ্ছে এখন, চোখ ঘুরিয়ে চারদিকে দেখছে সে, বিস্মিত

‘হায়, খোদা!’ অস্ফুটে বিড়বিড় করল সে, ‘আমি কোথায়?’ সাগুলোর দিকে ফিরল, ‘কে তুমি?’

‘স্টেইভ। তোমাকে ইন্ডিয়ানদের হাত থেকে আমি উদ্ধার করেছি, ম্যাম।’ হাসল সে আশ্বাসের ভঙ্গিতে.

‘ইন্ডিয়ান!’ আচমকা মুখে হাত দিল ম্যাগি। ‘তাহলে আমার বাবা? আমার বাবা কোথায়?’

‘তোমার বাবা মারা গেছে।’

‘কী!’ কম্বল সরিয়ে ধীরে ধীরে উঠে বসল মেয়েটি। ‘মারা গেছে! না, বিশ্বাস করি না আমি।…ওকে ওরা মারেনি।’

‘আমি ওকে যখন দেখি, তখনও মারা যায়নি তোমার বাবা। মারা যাবার আগে তোমার কথা বলেছে আমাকে।’

‘না। মিথ্যে কথা! মিথ্যে বলছ তুমি!’

সাওলো উঠে দাঁড়াল আবার। ‘শোনো, ম্যাম…

‘খবরদার! কাছে আসবে না!’ রুখে উঠল ম্যাগি।

‘আমি তোমার ধারে-কাছেও যাব না। কিন্তু তোমার জানা উচিত…’ দু’চোখে আগুন ঝরাল ম্যাগি। ‘না। আমার বাবা তোমাকে পাঠায়নি। তুমি নিজেই এসেছ তোমার নোংরা উদ্দেশ্য নিয়ে।’

‘শোনো, ম্যাম…’

‘না!’ অগ্নিকুণ্ডের পাশ ঘুরে চেঁচাতে চেঁচাতে ওর দিকে এগিয়ে এল ম্যাগি। ‘তুমি মিথ্যুক! তুমি একটা নোংরা পচা ইন্ডিয়ান!’ দাঁতে দাঁত ঘষতে ঘষতে সাওলোকে চড় মারার জন্যে হাত ওঠাল ও। সাওলো ওর হাত ধরে ফেলল।

পা চালাল ম্যাগি। সাওলো ওকে থামাবার চেষ্টা করল। কিন্তু মেয়েটির ওপর আবার উন্মাদনা ভর করেছে। ওর নাকের পাটা ফুলে ফুলে উঠছে দারুণ আক্রোশে। সাওলোকে আঁচড়ে-কামড়ে ছিঁড়ে-খুঁড়ে ফেলতে চাইছে ও। শেষ মুহূর্তে মাঝারি মাপের একটা ঘুসি হাঁকাল সাওলো ওর কাঁধে। লুটিয়ে পড়ল ম্যাগি চেঁচাতে চেঁচাতে। পড়ে ফোঁপাতে লাগল।

‘শোনো, শান্তস্বরে ওকে বোঝাতে চাইল সাওলো। তোমার কোনওধরনের ক্ষতি করার ইচ্ছে আমার নেই।’

নিজের চাদর আর রাইফেলটি তুলে নিল ও, অ্যাপাচিদের কাছ থেকে দখল করা অস্ত্রগুলোও নিল। মেয়েটির হাতের কাছে অস্ত্রশস্ত্র থাকাটা নিরাপদ নয় এখন।

ক্যাম্প থেকে মাত্র গজ ছয়েক দূরে ক্যানিয়ন-মুখ। সাওলো অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ওখানে চলে গেল। ক্যানিয়নের পিঠ থেকে ঢালু হয়ে যাওয়া সরু মুখটার দেয়ালে হেলান দিয়ে বসল পা ছড়িয়ে। ওর ছড়ানো পা বিপরীত পাশের দেয়াল ছুঁয়েছে প্রায়। গায়ে চাদর জড়াল ও, রাইফেলগুলো রাখল একপাশে। নিশ্চিন্ত বোধ করছে। ক্যানিয়নটা বক্স, ফলে এর অপর মুখ দিয়ে উন্মাদ মেয়েটা অন্ধকারে পালাতে পারবে না।

ম্যাগি ওকে একদৃষ্টে লক্ষ করছে। ফোঁপাচ্ছে সামান্য, শেষমেষ শুয়ে পড়ল বালিতে। একটু পরে উঠে গিয়ে বেডরোলে শুয়ে গায়ে কম্বল জড়াল।

ওর ঘুমের দরকার, ভাবল সাওলো, রাতে ভাল ঘুম হলে হয়তো সকালে সুস্থ হয়ে উঠবে.

রাতে ঘুমের ঘোরে মেয়েটির কান্না আর ফোঁপানির শব্দে বেশ কয়েকবার ঘুম ভেঙে গেল সাওলোর। সকালে উঠে এ-মেয়ে, তিক্ততার সঙ্গে ভাবল ও, আবার যন্ত্রণা শুরু করবে।

কিন্তু সকালে উঠে ওর ধারণাকে ভুল প্রমাণ করে দিয়ে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক আচরণ করল ম্যাগি। ক্যাম্প গুটোনোর ব্যাপারে সাওলোর টুকিটাকি সাহায্যের অনুরোধে নির্বিবাদে সাড়া দিল ও। তবে সারাক্ষণ মুখটা পাথরের মত শক্ত করে রাখল। মাঝে-মধ্যে চোখাচোখি হতেই ওর চোখে খুনী দৃষ্টি অনুভব করল সাওলো। আশঙ্কা বোধ করল, মেয়েটি হয়তো মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছে।

খুব সকালে, ইগনাসিও পর্বতমালার ভাঙাচোরা শীর্ষগুলোকে প্রথম সূর্য যখন গোলাপী আভায় রঞ্জিত করছে, যাত্রা শুরু করল ওরা। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে গোলাপী আভা হারিয়ে উত্তপ্ত হয়ে উঠল সূর্য-আর সান ইগনাসিওর গায়ে ধূসর কর্কশ ছোঁয়া লাগল। চারদিকে বিস্তীর্ণ রুক্ষ প্রান্তর, বালি আর পাথরখণ্ডে ভর্তি; মাঝে-মধ্যে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত বিয়ার ঘাস, কঠিন, নগ্ন টিলা—টক্কর-ভঙ্গুর; কোথাও কিছু ওক আর পিফনের ঝাড়।

পানির ব্যাপারে চিন্তিত সাওলো। ওদের পানির স্টক সীমিত। গতকাল থেকে সে নিজে এক ঢোক পানিও খায়নি। মেয়েটিকেও দিচ্ছে খুব কম। কম পানিতে ওর তেমন সমস্যা হচ্ছে না। সমস্যা হচ্ছে ম্যাগির। বারবার পানি চাইছে, ওর বরাদ্দ করা পানিতে সন্তুষ্ট থাকছে না।

একজন অ্যাপাচি জানে কোথায় পানির গোপন উৎস রয়েছে কিংবা কোথায় পানি খুঁজতে হবে। একজন শ্বেতাঙ্গের জন্যে অ্যারিজোনার এ-অংশে প্রায় একশো বর্গ মাইলের মধ্যে পরিচিত কয়েকটি ওঅটর হোলই সম্বল। তবে গ্রীষ্মের মাঝামাঝি সময়ে এখন ওগুলো শুকিয়ে ফেটে চৌচির হয়ে যাবার সম্ভাবনা বেশি। কেউ যদি এসময় দূরযাত্রায় বের হয়, ওকে এমনভাবে চলতে হবে যেন সবগুলো ওঅটর হোল ওর পথে পড়ে। আনাড়ি পথিক হলে শেষ পর্যন্ত পানির অভাবে মরতে হবে।

সাওলোর জানামতে, ওর বর্তমান অবস্থান থেকে সবচে’ কাছের পানির উৎসটি প্রায় দশ মাইল দূরে জারিমল্লো ওয়েলসে। কিন্তু সেখানে এখন পানি আছে কি না কে জানে। অ্যাদ্দিনে ওটা শুকিয়ে যাবার কথা। এরপর আছে লাভা রিজার্ভেয়রের কাছে রেডোন্ডো ট্যাংকস। ওখানে সারা বছর পানি থাকে। তবে জায়গাটা প্রায় তিরিশ মাইল উত্তর-পশ্চিমে। আর হেইন্স অ্যান্ড হারমার রোড তার চেয়ে অনেক কাছে। সুতরাং উত্তরে সড়কের উদ্দেশে যাওয়াটাই ভাল হবে—আর কপাল ভাল হয়তো একটা স্টেজকোচ পাওয়া যেতেও পারে।

দুপুরের আগেই দিগন্তে অস্পষ্ট হলুদ ছায়াগুলো নড়তে দেখল সাওলো। একটু পরই ধুলোর মধ্য থেকে অবয়বগুলো স্পষ্ট হয়ে উঠতে লাগল। ওরা যে কুরিয়াপো ও তার সঙ্গী, বুঝতে অসুবিধা হলো না ওর। নাবুতো ওদের পথ দেখিয়ে নিয়ে আসছে।

ডানদিকে ঘোড়া ঘোরাল সাওলো। ম্যাগির ঘোড়াটাকেও তাই করল রশিতে টান দিয়ে। একটা রিজের ওপর ওর চোখ। শ’খানেক গজ দূরে হবে রিজটা ওদের কাছ থেকে—নিচু, মাঝে-মধ্যে ভাঙাচোরা; এখানে ওখানে ওকের ঝোপ। ঝোপের আড়ালে চুপচাপ বসে শত্রুদের ওপর চোখ রাখা যাবে ওদের চোখ বাঁচিয়ে। ঘোড়া দুটোকেও লুকিয়ে রাখা যাবে পাথর আর ঝোপঝাড়ের আড়ালে।

ঘোড়া থেকে নামল সাওলো। মেয়েটাকে বলল যেখানে আছে, সেখানে অপেক্ষা করার জন্যে। তারপর বিড়ালের মত নিঃশব্দ পায়ে ফিল্ডগ্লাস হাতে রিজ বেয়ে উঠে গেল। রিজের মাথায় বসে ফিল্ডগ্লাস চোখে লাগাল।

অনেকক্ষণ ধরে পর্যবেক্ষণ করল সাওলো অশ্বারোহীদের, শেষ পর্যন্ত নিশ্চিত হলো। ওরা যে লাইনে আসছে, সেভাবে এলে সাওলোদের অবস্থান থেকে বেশ কয়েকশ’ গজ দূর দিয়ে অতিক্রম করে যাবে। মানুষগুলো এখনও খুঁটিয়ে দেখার মত কাছে এসে পৌছেনি, তবে ওরা যে কুরিয়াপোর লোক, এতে কোনও সন্দেহ নেই। অবশ্য টহলরত ইউ এস ক্যাভারলি ট্রুপও হতে পারত, তবে কুরিয়াপোর ভয়ে এতটা দক্ষিণে ওরা আসবে বলে মনে হয় না।

নিচে হুটোপুটির শব্দ শোনা গেল। চোখ থেকে ফিল্ডগ্লাস নামিয়ে ওদিকে তাকাল সাওলো। খাড়াই বেয়ে ওপরে ওঠার চেষ্টা করছে ম্যাগি। সাওলো ফিরে চাইতেই থেমে গেল।

‘ওপরে উঠতে চাইলে,’ হাঁক দিল ও, ‘হামাগুড়ি দিয়ে উঠতে হবে তোমাকে। নইলে ওদের চোখে পড়ে যাবে।’

সাওলোর কথামত কাজ করল ম্যাগি। আস্তে আস্তে উঠে এসে সাওলোর পাশে বসল মাঝখানে ফুট দুয়েক ফাঁক রেখে। দিগন্তে উড়ন্ত ধুলোর দিকে চাইল ও. অনেকটা কাছে এসে পড়েছে ধুলো এখন।

‘আরে!’ হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল ম্যাগি, ‘এগুলো দেখছি…’

উঠে দাঁড়াতে গেল ও। সাওলো ফিরল ওর দিকে, কাঁধ চেপে ধরে মুখে হাত দিয়ে বসিয়ে দিল ওকে।

‘চুপ একদম! ওগুলো অ্যাপাচি।’

ওর হাতের নিচে স্থির হয়ে গেল মেয়েটি। সাওলো আস্তে আস্তে হাত সরিয়ে নিল ওর কাঁধ আর মুখ থেকে।

একটু পর, হঠাৎ হোলস্টারে টান অনুভব করল সাওলো পর মুহূর্তে ওর কোল্টটা হাতে নিয়ে ওর কাছ থেকে এলোমেলো পায়ে দূরে সরে গেল ম্যাগি। সাওলোর থেকে নিচে কয়েক গজ দূরে দাঁড়িয়ে ওর দিকে পিস্তল সই করল। ‘কী করছ?’ শান্তস্বরে জিজ্ঞেস করল সাওলো। বুঝতে পারছ না ওরা অ্যাপাচি?’

‘না, মিথ্যে কথা। ওরা অ্যাপাচি নয়। দাঁতে দাঁত ঘষল ম্যাগি। ওরা আমার খোঁজে আসছে। আমার বাবা পাঠিয়েছে ওদের।’

এতক্ষণ বসেছিল সাওলো, আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াল এবার। এগুলো মেয়েটির দিকে।

‘তোমাকে বলেছি আমি,’ বলল সে। ‘তোমার বাবা বেঁচে নেই।’

‘তুমি মিথ্যে কথা বলছ।’ পিস্তলের ট্রিগারে চাপ বাড়াল ম্যাগি। ওর নখ শাদা হয়ে উঠল।

সাওলো পিস্তলের দিকে চাইল। ‘ওটা কক করে নিতে হবে।’

বলতে বলতে লাফ দিল ও। ম্যাগি কিছু বুঝে ওঠার আগেই কবজিতে আঘাত পেয়ে কঁকিয়ে উঠল। পিস্তল পড়ে গেল ওর হাত থেকে। ওটা ধরার জন্যে ঝাঁপিয়ে পড়তে গেল সে। বাম হাতে ঝাপটা দিল সাওলো, ডান দিকে কাৎ হয়ে পড়ল ও। সাওলো পিস্তলটা ধীরে-সুস্থে তুলে নিল।

‘তোমাকে মাত্র আর একবার বলব আমি, ঠাণ্ডা শোনাল সাওলোর গলার স্বর। ‘তোমার বাবা মারা গেছে। আমি নিজেই ওকে কবর দিয়েছি।’

‘না, না, না!’ উন্মাদের মত চেঁচাল ম্যাগি, ‘ও মরেনি, মরেনি!’

আচমকা ঝাঁপিয়ে পড়ল ও সাওলোর ওপর, দু’হাতের নখ দিয়ে খামচি মারতে গেল ওর মুখে। সহ্যের সীমা পেরোল সাওলোর, প্রচণ্ড চড় বসাল ও মেয়েটির দু’গালে পর পর দু’বার। পিছিয়ে গেল ম্যাগি চড় খেয়ে, আর্তনাদ করে উঠল; চড়ের দাগ বসে গেছে ওর দু’গালে। আবার চড় মারল সাওলো আগের চেয়ে আরও জোরে। বসে পড়ল ম্যাগি, এক হাতে মুখ ঢাকল। আঙুলের ফাঁকে সাওলোর দিকে চাইল; ওর চোখে নগ্ন ঘৃণা।

‘নোংরা ইঁদুর!’ হিসহিসিয়ে উঠল সে সাপের মত। ‘ডার্টি ইনজুন!’

‘তোমাকে উদ্ধার করার জন্যে তিন-তিনটে খুন করেছি আমি,’ মেয়েটির ক্ষত-বিক্ষত মুখের দিকে চাইল সাওলো। আর তুমি কি না আমাকে…ধ্যাত্তেরি!’

মাথায় আগুন ধরে গেল সাওলোর। মনে মনে মেয়েটিকে জাহান্নামে যেতে বলে রিজের চূড়ায় উঠতে গেল। শেষের ক’গজ হামাগুড়ি দিয়ে পার হলো। তারপর চোখে ফিল্ডগ্লাস লাগিয়ে উপুড় হয়ে বসল।

এসে পড়ল অশ্বারোহীরা। সাওলোর হিসেবমত কয়েকশ’ নয়, প্রায় এক হাজার গজ দূর দিয়ে রিজটিকে পাশ কাটাল ওরা। ফিল্ডগ্লাস চোখে লাগিয়ে খুঁটিয়ে দেখল সাওলো। ওদের সংখ্যা এবং অস্ত্রের পরিমাণ আন্দাজ করল। প্রায় বিশজনের একটা দল। বোঝা যায়, ছোট ছোট গ্রুপে বিভক্ত যোদ্ধারা জরুরী ভিত্তিতে একত্রিত হয়েছে। বিশজনের দলের মধ্যে প্রথমে নাবুতোকে চিনতে পারল ও—এবং নাবুতোর পাশে কুরিয়াপোকে।

কুরিয়াপোর অপর পাশে তার চাচা, জারিপোর সৎভাই, নেপুতে। নেপুতেকে চিনতে কষ্ট হলো না সাওলোর। নেপুতে কৃশ, কাঠখোট্টা-লম্বা, অন্য যে কোন অ্যাপাচির তুলনায়। কারণ ওর মা অ্যাপাচি ব্র্যান্ডের নয়, কোমাঞ্চি। সাওলো এদের সাথে ওকে দেখে আশ্চর্য বোধ করল। নির্বিরোধী কিন্তু ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ নেপুতে, খুন-জখম-হত্যার ঘোরবিরোধী; জারিপোর সময়েও এসব ব্যাপারে নিজের অনাগ্রহের কথা স্পষ্ট করে বলত এবং অন্যদেরও বিরত থাকতে বলত এসব থেকে। সেই কিনা এসে জুটেছে তার মাথা-গরম ভাইপোর সাথে! এটা কি করে হয়? অথচ ওরই প্রভাবে জারিপো আস্তে আস্তে শাদামানুষদের ব্যাপারে নিজের ক্রুর দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টেছিল।

একদম অদৃশ্য হয়ে না-যাওয়া পর্যন্ত সাওলো পর্যবেক্ষণ করল যোদ্ধাদলটাকে। এরপর নিচে নেমে এসে মেয়েটাকে ঘোড়ায় চড়তে বলল।

ঠিক কতটা সময় পাওয়া যাবে জানে না সাওলো। তবে সড়কে গিয়ে ওঠার মত যথেষ্ট সময় হাতে আছে বলে আশা করছে। সেখান থেকে যে- কোন একটা শহরের দিকে ঘোড়া ছোটাবে। তবে এটা নির্ভর করছে ওদের ব্যাকট্রেইল কতক্ষণ ওদের চোখে পড়ছে না, তার ওপর। ওরা যদি সরাসরি নাবুতোদের ক্যাম্পে গিয়ে পৌঁছে, তাহলে সাওলোর ট্রেইল খুঁজে নিয়ে ওকে ধাওয়া করার আগে কয়েক ঘণ্টা সময় পাওয়া যাবে।

ভাঙাচোরা টিলা-টক্কর আর মাঝে-মধ্যে ওক-ওকোটিলা ঝোপে আকীর্ণ বিস্তীর্ণ প্রান্তরের দিকে চোখ মেলে দিল সাওলো। সূর্য আগুন ঢালছে, তপ্ত রোদে ঝলসে যাচ্ছে আকাশ, মাটি আর দূর দিগন্তের সঙ্গে মিশে থাকা অস্পষ্ট পাহাড়শ্রেণী। এর মধ্যেই পথ চলতে হবে, জানে সাওলো। ওর সাথের অর্ধোন্মাদ মেয়েটিকে নিয়ে আপাতত পালাতে হবে ওকে। কুরিয়াপোর মুখোমুখি হবে সে-কিন্তু এভাবে, ওর ধাওয়া খেতে খেতে নয়, ধাওয়া করতে করতে।

ম্যাগি আসছে পেছন পেছন। ওর ঘোড়ার সাথে দড়ি দিয়ে বাঁধা মেয়েটার ঘোড়া। ঘাড় ফিরিয়ে পেছনে চাইল সাওলো। মেয়েটার চোখে চোখ পড়ল। ওর চোখে ঘৃণা—নগ্ন ঘৃণায় ঝলসে যাচ্ছে দু’চোখ; ফাটা দু’ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে গাল বকছে বিড়বিড় করে।

সাওলো চোখ ফেরাল সামনের দিকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *