জ্বালা – ৯

নয়

ওয়াল্টার যা শুনেছে, সেটাকে আরও ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে অন্যদের বলতে শুনল সাওলো, ওদের পাশে দাঁড়িয়েই। শুনতে শুনতে ওদের মুখের ভাবের পরিবর্তন লক্ষ করল ও। ইয়েটস আর হাব বোদ হতাশ চোখে তাকাল ওর দিকে। একটা শীতল ক্রোধের রেশ ছড়িয়ে পড়তে শুরু করল সাওলোর ভেতরে। কী ভেবেছে ওরা ওকে?

ইস্পাত নীল চোখে চাইল ইয়েটস ওর দিকে। ‘কী বলছে ও, স্টেইভ?’

‘ঠিক বলছে,’ কাঁধ ঝাঁকাল সাওলো, …আমি জারিপোর একজন ছেলে। কুরিয়াপো আমার সৎভাই।’

‘তার মানে,’ ইয়েটস অবাক হলো, তুমি আমাদের ধোঁকা দিয়েছ!’

‘মোটেই না,’ সাওলো অনেক কষ্টে নিজেকে সামলাল। শান্তস্বরে বলল, ‘আমি তোমাদের একটুও ধোঁকা দিইনি, বরং ভয়ঙ্কর পরিণতি থেকে বাঁচিয়েছি। নইলে এখন থেকে ঘণ্টা কয়েক আগে মারা যেতে তোমরা, সবাই। কিংবা অ্যাপাচিদের হাতে বন্দী হয়ে হেঁট-মুণ্ডু -ঊর্ধ্বপদ অবস্থায় আগুনের আঁচে সিদ্ধমগজ হতে হতে চেঁচিয়ে দুনিয়া কাঁপিয়ে ফেলতে।’

‘ফালতু কথা!’ ওয়াল্টার খেঁকিয়ে উঠল। ওর সঙ্গে না-এলে খোলা জায়গায় থাকতাম এখন। এমন ফাঁদে পড়া ইঁদুরের অবস্থায় পড়তাম না। ও আমাদের কুরিয়াপোর হাতে তুলে দেবার জন্যে এখানে নিয়ে এসেছে।’

‘তুমিও ফালতু বক বক না-করে মাথাটা একটু খাটাও, ওয়াল্টার!’ মেলোডি প্রতিবাদ জানাল। এখানে নিয়ে আসার সময় আমাদের ট্রেইল লুকনোর জন্যে আপ্রাণ চেষ্টা করেছে ও, করেনি? ও আমাদের পানির খোঁজ দিয়েছে, পথে অ্যাপাচিদের সাথে সংঘর্ষে ওদের দু’জনকে খতম করেছে।’

থ্যাবড়া, মোটা একটা আঙুল তুলে মেলোডিকে থামাবার ভঙ্গি করল ওয়াল্টার। ‘প্রকৃত ব্যাপার হচ্ছে, ম্যাম, ও জানত, কুরিয়াপো দলবল নিয়ে আমাদের কাছে পিঠেই আছে।’ সাওলোর দিকে ফিরল ও। ‘কী, ঠিক বলিনি? জবাব দে, ব্যাটা ইন্ডিয়ান ইঁদুর! নয়তো লাখি মেরে তোর নাকের ডগা উড়িয়ে দেব!’

ওর চোখে চোখ রাখল সাওলো। ‘জানতাম।’

‘জানতে? হায় খোদা!’

চিবুক চুলকাল ইয়েটস, সরু চোখে চাইল সাওলোর দিকে। ‘মিস্টার, তুমি অস্বীকার করছ না কেন?’

‘কী দরকার? আমি তো তোমাদের সঙ্গে মিথ্যে কথা বলিনি।

‘শিট! তুমি ওই বেজন্মাগুলোর হাতে তুলে দেবার জন্যে আমাদের এখানে নিয়ে এসেছ?’ ওয়াল্টারের হাত পিস্তলের কাছে চলে গেল।

ইয়েটস সাওলো আর ওয়াল্টারের মাঝখানে চলে এল। সাবধান করে দেবার ভঙ্গিতে নিজের হাতের রাইফেলটা নাড়ল। এদিকে স্টিফেনের রাইফেলের নল ঘুরে গেল সাওলোর পাঁজর বরাবর।

‘তোমার আঙুল সরাও ট্রিগার থেকে মিস্টার স্টিফেন,’ ওকে হুঁশিয়ার করে দিল ইয়েটস, ওয়াল্টারের দিকে চাইল এরপর। ‘যীশুর কিরে, মুখটা একটু থামাও! ওকে আমি জিজ্ঞাসাবাদ করছি।’

‘জিজ্ঞাসাবাদে কাজ হবে না, মি. ইয়েটস। শপথ করে বলতে পারি, ওই বদমাশ ইন্ডিয়ানটার পেট থেকে একটি কথাও বের করতে পারবে না।’

‘ওর দিকটাও আমাদের শোনা উচিত, তাই না?’ সাওলোর দিকে ফিরল ইয়েটস। ‘স্টেইভ?’

‘আমি যা বলেছি, সত্যি বলেছি, মি. ইয়েটস।

হয়তো। কিন্তু আমার বিশ্বাস, সবটুকু বলোনি।

‘কিছুই লুকোইনি। শোনো, তোমাদের সাথে আমার প্রথম সাক্ষাৎ সবাই অবিশ্বাসের চোখে দেখেছিলে। ওয়াল্টার তো আমার গায়ের ছালটাই তুলে নিতে চেয়েছিল। আমার ধারণা, কুরিয়াপো আমার শত্রু, এ কথা জানার আগেই তোমরা আমাকে বিশ্বাস করেছিলে। না কি?’

‘আর এখনও তো ও ভিন্ন কিছু বলছে বলে মনে হচ্ছে না, মি. ইয়েটস, মেলোডি বলল।

‘ঠিক আছে, ম্যাম, ঠিক আছে। আমি ওর কথা শুনব বলেছিলাম, শুনেছি। তবে দুটো জিনিস বুঝতে পারছি না। এক, কুরিয়াপোর ভাই হয়, এমন একজন দোআঁশলা হুট করে ওর শত্রু বনে যাবে কেন? দুই, এবং তাই বলে একদম শাদাদের পক্ষেই চলে যাবে কেন…’

‘হুট করে নয়, মি. ইয়েটস। ওই মেয়েকে,’ ম্যাগিকে দেখাল সাওলো। চার অ্যাপাচির হাত থেকে ছিনিয়ে নেবার আগে থেকেই কুরিয়াপোকে খুঁজছিলাম আমি।’

‘কেন?’

ওর জন্যে একটা বুলেট খরচ করব বলে রেখেছি আমি।’

‘আচ্ছা!’ স্টিফেনের ঠোঁট বেঁকে গেল বিদ্রূপে।

‘ওকে আগে শেষ করতে দাও!’ আদেশের স্বরে বলল ইয়েটস।

মেলোডিকে যা বলেছে, এদেরও তা-ই শোনাল সাওলো। বলতে বলতে প্রত্যেকের মুখের ভাব লক্ষ করল। হাবের মুখে সূক্ষ্ম সহানুভূতির ভাব ওর নজর এড়াল না। তবে শাদাদের সামনে নিজেকে গুটিয়ে রাখার সহজাত বুদ্ধি ওকে প্রায় নির্বিকার রেখেছে। ইয়েটস কিছুটা বিভ্রান্ত, ওকে বিশ্বাস করতে চাইলেও তা করার যুক্তিসঙ্গত কারণ খুঁজে পাচ্ছে না। কিন্তু ম্যাগি, স্টিফেন আর ওয়াল্টারের মুখ কঠিন। সাওলো বুঝল, ওর কোনও কথাই ওরা বিশ্বাস করবে না। ওদের চোখে ও স্রেফ শত্রু, অন্য কিছু হতে পারবে না।

চোয়ালে হাত ঘষল ইয়েটস। ‘মনে হচ্ছে, যুক্তি আছে ওর কথায়। কিন্তু ধ্যাত্তেরি, চুলোয় যাক সব!’

‘আমার একটা পরামর্শ আছে,’ হালকা, আমুদে গলায় বলল স্টিফেন। ‘আমাদের মধ্যে না হয় আরেকবার ভোটাভুটি হয়ে যাক।’

‘কিসের ভোটাভুটি?’ মেলোডি জানতে চাইল।

‘ওকে গুলি করে মেরে ফেলব, নাকি কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দেবার জন্যে রেখে দেব, সে ব্যাপারে।’

‘আমরা এখানে কেউ বাঁচব না, সবাই মারা পড়ব অ্যাপাচিদের হাতে। অথচ,’ ঘেউ ঘেউ করে উঠল ওয়াল্টার। এ কুত্তার বাচ্চাটা ঠিকই বেঁচে থাকবে শেষ পর্যন্ত!’

‘উত্তম প্রস্তাব। আমি ওকে মেরে ফেলার পক্ষে ভোট দিচ্ছি,’ স্টিফেন বলল।

‘মিস্টার,’ মেলোডি ক্রুদ্ধস্বরে বলল। ‘তোমরা কিন্তু একজন মানুষের জীবন নিয়ে কথা বলছ। নিজেদের কি ভাবছ তোমরা? ঈশ্বর?’

‘না, ম্যাম,’ অমায়িক কণ্ঠে বলল স্টিফেন। ‘আমি শুধু গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার কথাই বলছি। তোমার অমত থাকলে তাও ধরা হবে। তবে এটা কিন্তু সত্যি যে, ওকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে ওর হাত-পা বেঁধে রাখতে হবে। নয়তো সারা দিনরাত একটা মানুষকে চোখে চোখে রাখাটা ভীষণ একঘেয়ে কাজ হবে।’

‘ওকে মেরে ফেলো – মেরে ফেলো ওকে! চেঁচাতে লাগল ম্যাগি।

ওর দিকে তাকাল মেলোডি। ‘তুমি একটা অদ্ভুত চীজ বটে,’ তিক্তস্বরে বলল। ‘অথচ অ্যাপাচিদের হাত থেকে ওই তোমার প্রাণ বাঁচিয়েছিল!’

গোঁফে আঙুল বুলাল স্টিফেন, হাসল। ‘ম্যাম, এখানে বিরুদ্ধ মত প্রকাশের অধিকারও আছে। তারচে’ এক কাজ করো। ওকে আমরা অ্যাপাচিদের কাছে পাঠিয়ে দিই। অ্যাপাচিরা যদি ওকে মেরে ফেলে, তাহলে প্রমাণ হবে যে, ও সত্যি কথা বলেছিল। কী বলো?’

‘ঠিক আছে, ইয়েটস শুকনো কণ্ঠে বলল। ‘ওকে বেঁধে রাখো। আশা করছি, এতে কারও অমত নেই।’ স্টিফেন, ওয়াল্টার আর ম্যাগির দিকে তাকাল সে। এখানে কোনও খুন-খারাবি হোক, চাই না আমি।’

সাওলোর দিকে ফিরল ইয়েটস। সাওলোর চোয়াল শক্ত, চোখ কঠিন; উত্তেজনায় টানটান হয়ে উঠেছে ওর পেশী, প্রস্তুত সে। সতর্ক দৃষ্টিতে ওদের সবার দিকে তাকাচ্ছে। মাথা নাড়ল ইয়েটস। উঁহু, ওটা করতে যেয়ো না, বাছা। তুমি আমাদের সবাইকে কাবু করতে পারবে না।’ হাত বাড়াল সে। ‘অস্ত্রটা এদিকে দাও।’

সহজ হয়ে এল সাওলোর ভঙ্গি। নাও।’

ওর পিস্তলটা খাপ থেকে তুলে নিল ইয়েটস, স্প্যানিশ ছোরাটাও। একটা লাভা প্যাবের কাছে নিয়ে বসাল ওকে। এখানে- হ্যাঁ, এখানেই বসো, বাছা।’

বসল সাওলো পাথরে হেলান দিয়ে। বাহু দুটো ভাঁজ করে হ্যাটের কার্নিসের নিচ থেকে আগুনচোখে তাকিয়ে আছে ও; রাগে শরীরের ভেতরটা টগবগ করে ফুটছে।

একটা রশি বের করে দু’খণ্ড করল ওয়াল্টার। সাওলোর হাত ও পা দুটো বাঁধল শক্ত করে। ঠেসে গিঁঠ দিল।

ওরা সবাই নিজ নিজ অবস্থানে চলে গেল। সাওলোর পিঠের নিচে তপ্ত বালি। গড়াতে শুরু করল সে। অ্যাম্বারগোর কাছাকাছি একটা পাথরের ছায়ায় গিয়ে থামল। অ্যাম্বারগোর দিকে চোখ পড়ল ওর। ওর দিকে চেয়ে আছে মেক্সিকান স্প্যানিয়ার্ড ডাকাতটা, হাসছে। ‘বুদ্ধিটা কাজে এল না, কী বলো? গ্রিঙ্গোরা কম সেয়ানা নয়, না?’

ওকে জাহান্নামে যেতে বলে বাঁধনগুলোর দিকে মনোযোগ দিল সাওলো। বেঁধেছে বটে ওয়াল্টার। পরীক্ষা করে দেখল ও টেনে-টুনে। বৃথা চেষ্টা। আরও শক্ত হয়ে বসে যাচ্ছে রশি। রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যাবার উপক্রম হয়েছে।

মেলোডি এসে বসল ওর পাশে। রাগে মেয়েটার মুখ লাল। ওই গরুগুলোর মাথায় সবটাই গোবর, মি. স্টেইভ। আমি, আমি সত্যি দুঃখিত।’

সাওলো হাসল। ‘দোষ দিচ্ছি না আমি। অ্যাপাচিদের ভয়ে আধমরা হয়ে আছে সবাই।’

‘শুধু ভয় নয়, আরও কিছু আছে। সেটা কী জানো?’ গলা নামাল ও। ‘শোনো, তুমি এদের সাহায্য করতে চেয়েছ, আর ওরা তোমাকে জন্তুর মত বেঁধে রেখেছে। যাক। তুমি বলেছিলে একা হলে যে কোনও সময় এখান থেকে পালিয়ে যেতে পারতে। এমন কী, পায়ে হেঁটে হলেও।’

‘হয়তো বলেছিলাম। কিন্তু আমি পালাচ্ছি না।’

নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরল মেলোডি। ‘নিজেকে আমার অপরাধী মনে হচ্ছে। তুমি যদি আমাকে ওসব কথা না বলতে… কেন বলতে গেলে, বলো তো?’

‘জানি না।’

‘আমার মনে হয়, আমি জানি। তুমি কাউকে বিশ্বাস করতে চেয়েছিলে, স্টেইভ।’

হাঁটুর ওপর দু’হাত রেখে বসেছিল মেলোডি; ওখান থেকে একটা হাত নাড়ল। সাওলো ওকে স্কার্টের ভেতর থেকে একটা ছুরি বের করতে দেখল। পরক্ষণেই ওটা মাটিতে ফেলে দিয়ে উঠে দাঁড়াল মেলোডি। ‘প্রয়োজন মনে করলে ব্যবহার কোরো ওটা।’ ঘুরে হাঁটতে শুরু করল।

ছুরিটা সাওলোর বাহু থেকে ইঞ্চি দুয়েক দূরে পড়েছে, গড়িয়ে ওটাকে পিঠচাপা দিল সে।

আর বেশি হলে ঘণ্টা খানেক পরেই অন্ধকার হয়ে যাবে চারদিক। ওরা দু’তিনজন সম্ভবত গার্ড দেবে রাতে, বাকিরা ঘুমোবে, ভাবল সাওলো।

অন্ধকার ঘনিয়ে রাত নামল এক সময়। গুলিগোলা থেমে যাবার পর এখন পর্যন্ত অ্যাপাচিদের আর কোনও সাড়া-শব্দ পাওয়া যায়নি। অগ্নিকুণ্ডের আলোয় অ্যারোয়োর দু’পাশের পাথরগুলোর আবছা পিঠ দেখা যাচ্ছে। বাকি সমস্ত চরাচর অন্ধকারে নিমজ্জিত। এ-রকম রাত্রির এক অদ্ভুত রূপ আছে, এক অপরূপ মরুরাত্রি।

মাঝ রাতের দিকে ক্লান্ত ও অবসন্ন দলটি ঘুমোবার আয়োজন করতে লাগল। রাতে পাহারা দেবার ব্যাপারে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করল ওরা। ইয়েটস রাতের জন্যে একজন পাহারাদারই যথেষ্ট বলে মত দিল। তার মতে, অ্যাপাচিরা রাতে লড়াই করতে চাইবে না। তাদের তরফ থেকে আক্রমণ যদি আসে, সেটা সকালের দিকেই আসবে। যাহোক পাহারার প্রথম পালার দায়িত্ব ও-ই নিল।

দু’হাঁটু মুড়ে বুকের কাছে নিয়ে এসে ঘুমের ভান করে পড়ে রইল সাওলো। ও যেখানে শুয়েছে, সেখান থেকে আগুনের ধারের লোকগুলোকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। ওদের সামান্যতম নড়াচড়াও ওর চোখ এড়াচ্ছে না। বিশেষ করে অ্যাম্বারগোর ওপর চোখ রাখল ও। ওর ধারণা, স্প্যানিয়ার্ড ডাকাতটা স্রেফ একটা সুযোগের অপেক্ষায় আছে। অ্যাম্বারগোর পা বাঁধা রশিতে, হাতগুলো পিছমোড়া করে শেকলে আটকানো।

প্রায় ঘণ্টা খানেক পরে ক্যাম্পফায়ারের উজ্জ্বল আলো মিইয়ে আসতে লাগল ধীরে ধীরে।

রাতের নিজস্ব কিছু সাধারণ শব্দ আছে। সাওলো চেনে ওগুলো। কান পেতে রইল সে। সন্দেহজনক কোনও শব্দ শোনা যাচ্ছে না। তবে সাওলো জানে, কুরিয়াপোর মতিগতি একশো ভাগ বোঝা কখনও সম্ভব নয়। আশার কথা হলো, রাতের বেলা ও আক্রমণ করবে বলে মনে হয় না। কারণ, নৃশংস যোদ্ধা হলেও, ওর মন কুসংস্কারে ভরা; পুরানো বিধি-নিষেধগুলোর ওপর ওর দারুণ বিশ্বাস। এর পরেও যদি কেউ রাতে আক্রমণ করতে আসে, সেটা সম্ভবত ওর অগোচরেই ঘটবে।

ইয়েটসের দিকে চাইল ও। ক্যাম্পফায়ারের স্বপ্নালোকে ঝিমোতে দেখা যাচ্ছে ওকে। ওর মাথা ঝুঁকে পড়েছে বুকের ওপর। আচমকা সচেতন হলো ও।

আগুন কমে আসায় বন্দী দু’জনকে ওর অবস্থান থেকে এখন আর স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। চোখের কোণে সামান্য নড়াচড়া লক্ষ করে অ্যাম্বারগোর দিকে চাইল সাওলো। স্প্যানিয়ার্ড গুটি মেরে শুয়ে আছে। তবে ও যে জেগে আছে এবং সতর্ক, বুঝতে পারল সে।

বসা থেকে উঠে দাঁড়াল ইয়েটস। ঘুম তাড়ানোর জন্যে হাঁটাহাঁটি শুরু করল। আবার বসে পড়ল। ব্যাগ থেকে ঘড়ি বের করে সময় দেখল, রেখে দিল ঘড়িটা ফের যথাস্থানে। পালার শেষ মিনিটটি পর্যন্ত জেগে থাকার জন্যে ঘুমের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালাচ্ছে ও। কিছুক্ষণ উবু হয়ে বসে থাকল। কিন্তু, সম্ভবত পিঠ ধরে যাওয়ায় লাভা প্যাবের সাথে হেলান দিল। মিনিট পাঁচেক পরে সাওলো যখন ওর দিকে তাকাল, ও তখন গভীর ঘুমে অচেতন।

পাশ ফিরে শোয়া অ্যাম্বারগো ওর কাজ শুরু করল। ধীরে ধীরে হাঁটু বাঁকিয়ে পা পেছনে নিয়ে গিয়ে গোড়ালি উঁচু করল। ওর হাত লম্বা- আঙুলগুলো শক্ত। গোড়ালি ছুঁলো ওর আঙুল। বাঁধনটা শক্ত, তবে খোলা যাবে না এমন নয়; ধীরে ধীরে কাজ শুরু করল সে।

চুপচাপ শুয়ে আছে সাওলো। অ্যাম্বারগোকে এখন বাধা দেয়া ঠিক হবে না। এতে ক্যাম্পের সবাই জেগে যাবে এবং তাতে ওর পরিকল্পনাটা ভণ্ডুল হয়ে যাবে। এটাই এখন ওর জন্যে একমাত্র সুযোগ, এটা হারালে আর সুযোগ নাও মিলতে পারে।

কিন্তু স্প্যানিয়ার্ডটাকে পালাতে দেয়া যাবে না, আটকাতে হবে ওকে যেভাবেই হোক। তবে এখন নয়, অ্যাম্বারগো আগে নিজেকে মুক্ত করুক

পায়ের বাঁধন খুলে ফেলল অ্যাম্বারগো। কিছুক্ষণ শুয়ে রইল চুপচাপ বিশ্রাম এবং সেই সাথে অবস্থাও জরিপ করে নিল। তারপর সাপের মত বুকে হেঁটে এগোল ঘুমন্ত ডেপুটি শেরিফের দিকে।

মেলোডির রেখে যাওয়া ছুরিটা কুড়িয়ে নিল সাওলো, দু’আঙুলে ধরল ওটাকে কায়দা করে। তারপর পাশ ফিরে শুয়ে পা বাঁকা করে যথাসম্ভব পিঠের দিকে তুলল। ওর হাত বাঁধা, তবে পায়ের বাঁধনে ছুরি বসাতে পারল সে। এরপর অনুমানের ওপর নির্ভর করে রশিতে ছুরির পোঁচ লাগাল।

প্রায় নিঃশব্দে পৌঁছে গেল অ্যাম্বারগো গ্যানোর কাছে। শরীরের এক জটিল মোচড়ে নিজেকে হাঁটুর ওপর দাঁড় করাল। ওর পিঠ গ্যানোর দিকে ফিরিয়ে শেকলবাঁধা হাতে সন্তর্পণে গ্যানোর ওয়েস্ট কোর্টের পকেট হাতড়ে চাবিটা বের করে নিল। তারপর আস্তে ধীরে হ্যান্ডকাফের তালা খুলে শেকলটাকে সাবধানে বালির ওপর রেখে উঠে দাঁড়াল।

ইতোমধ্যে পায়ের রশি কেটে ফেলেছে সাওলো। ওর পা এখন মুক্ত, তবে হাত বাঁধা। অ্যাম্বারগো ততক্ষণে বেড়ালের মত নিঃশব্দ পায়ে হাঁটতে শুরু করেছে। ইয়েটসের দিকে এগোচ্ছে সে। রাইফেলটা হাঁটুর ওপর রেখে ঘুমোচ্ছে ইয়েটস। অ্যাম্বারগোর চোখ রাইফেলের ওপর। ওর রাইফেল দরকার।

একটু ইতস্তত করল সাওলো। ওর হাত এখনও বাধা। এ-অবস্থায় অ্যাম্বারগোকে থামানো সম্ভব নয় ওর পক্ষে। চিৎকার দিলে ইয়েটস হয়তো সজাগ হবে, কিন্তু আচমকা ঘুম থেকে জেগে কিছু বুঝে ওঠার আগে অ্যাম্বারগো ওকে কাবু করে ফেলবে।

শরীরকে যতটা সম্ভব কুণ্ডলী বানিয়ে পিঠের ওপর গড়াতে শুরু করল সাওলো। অ্যাম্বারগোর কাছাকাছি হতেই উঠে দাঁড়াল। মাথা নিচু করে সবেগে ছুটে গেল অ্যাম্বারগোর পিঠ সই করে। পেছনে পায়ের শব্দ শুনে ঘুরতে শুরু করল লোকটা। পরমুহূর্তে সাওলোর মাথার প্রচণ্ড গুঁতো খেল পাঁজরে। হুড়মুড় করে মাটিতে পড়ল ওরা দু’জন।

ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়ে গেছে ইয়েটস।

‘ইয়েটস!’ চেঁচাল সাওলো। অ্যাম্বারগোর কাছ থেকে দ্রুত নরে গেল, পরমুহূর্তে উঠে দাঁড়াল।

প্রচণ্ড আঘাতে দিশেহারা অ্যাম্বারগো কোনও মতে উঠে বসেছে। হাত আর হাঁটুতে ভর দিয়ে হামাগুড়ি দিচ্ছে। ব্যথা সওয়ার চেষ্টা করছে। ইয়েটস ব্যাপারটা বোঝার জন্যে সময় নষ্ট করল না: দু’জনের দিকেই রাইফেল বাগিয়ে ধরে চেঁচিয়ে উঠল, ‘ক্রাইস্ট!’

‘ও ওর বাঁধন খুলে ফেলেছে, ইয়েটস!’ বলল সাওলো।

অন্যেরাও ততক্ষণে জেগে উঠেছে। মুখ থেকে কম্বল সরিয়ে অবস্থা দেখে একে অন্যের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছে। ব্যাপারটা বুঝে নিতে দেরি হলো না ইয়েটসের। অ্যাম্বারগোর পাঁজরে কষে লাথি হাঁকাল সে, সাওলোর দিকে তাকাল কঠিন চোখে। ‘ধন্যবাদ। তবে তুমি আমাদের ডেকেও দিতে পারতে।’

‘সময় ছিল না।’

হাব আগুন খুঁচিয়ে ভেতর থেকে জ্বলন্ত কয়লা বের করে তাতে লাকড়ি ফেলল। সাওলোর দিকে তাকিয়ে তিক্ত হাসি হাসল অ্যাম্বারগো। কাজটা বোকার মত করলে, বন্ধু! রাইফেলটা পেলে দু’জনেই পালাতে পারতাম।’

‘নিশ্চয়!’ ওয়াল্টার হাসল বিদ্রূপের ভঙ্গিতে। ‘আচ্ছা, কী ঘটেছিল, বলো তো?’

‘ওটা স্টেইভকে বলতে দাও,’ ইয়েটস বলল। নিজেই জিজ্ঞেস করল, ‘কী ঘটেছিল, বাছা?’

সাওলো সব খুলে বলল।

বালির ওপর থেকে কাটা রশিটা কুড়িয়ে নিল ওয়াল্টার। মেলোডির ছুরিটা হাতে নিয়ে ধূর্ত হাসি হাসল ওর দিকে চেয়ে। ‘এটা সম্ভবত তোমার নয়, ম্যাম?’

‘তাতে কী হয়েছে, ওয়াল্টার? তুমি কি…’

‘বাদ দাও,’ গম্ভীর স্বরে বলল ইয়েটস। তাতে কিছু আসে যায় না ওকে, অ্যাম্বারগোর দিকে ইঙ্গিত করল সে। ‘স্টেইভ থামিয়েছে, এটাই ব্যাপার। স্টেইভ, সম্ভবত, আমার জীবনও বাঁচিয়েছে।’

ঘোঁৎ করে উঠল ওয়াল্টার। ‘তাতে কী?’

তাতে কী, সেটা ব্যাখ্যা করার কোনও কারণ দেখছি না, ওয়াল্টার!’ পকেট থেকে ছুরি বের করে সাওলোর দিকে এগোল ইয়েটস। ওর হাতের বাঁধন কেটে দিল। ‘তোমাদের মধ্যে কারও যদি লড়তে ইচ্ছে করে এ ব্যাপারে,’ হুমকির সুরে বলল সে, ‘দু’জনকে মোকাবেলা করতে হবে। ঠিক আছে?’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *