জ্বালা – ৫

পাঁচ

সন্ধে ঘনাবার আরও ঘণ্টা চারেক বাকি। সময়টা কাজে লাগাবার সিদ্ধান্ত নিল সাওলো। মধ্যাকাশ থেকে অনেকটা নিচে নেমে এসেছে সূর্য, উত্তাপ কমেছে কিছুটা। মরুভূমিতে পথ চলার জন্যে এটাই প্রকৃষ্ট সময়। স্টেজযাত্রীরা অ্যাপাচিদের আক্রমণের পর পায়ে হেঁটে বেশি দূর এগোতে পারেনি, তবু এতে তারা ক্লান্ত, বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। এর চেয়ে বহুগুণ লম্বা পথ সামনে পড়ে রয়েছে পাড়ি দেবার জন্যে। সেটা আরও খারাপ হতে পারে। সাওলো ব্যাপারটা নিয়ে ওদের সঙ্গে খোলাখুলি আলাপ করল।

ওদের সঙ্গে মালপত্র বিশেষ নেই। ওয়াল্টারের যৎসামান্য, পকেটে করে বয়ে নেবার মত; মেয়েটার আছে ছোট একটা কার্পেটব্যাগ, ইয়েটসের রাইফেল আর খাবার বইবার ন্যাপস্যাক। তবে নিগ্রো হাব বইছে স্টিফেনের দুটো বড় বড় পোর্টমেন্টো। চওড়া, লম্বা সুগঠিত স্বাস্থ্য হাবের, বয়স ত্রিশের ওপরে; কালো শরীরে তারচে’ কালো বোর্ড কাপড়ের স্যুট চড়িয়ে হাসিমুখে পোর্টমেন্টো দুটো বইছে ও। সাওলো, একসময় মন্তব্য করল, ‘একজনের পক্ষে বইবার জন্যে ওই ধরনের একটা বাক্সই যথেষ্ট ভারী।’

‘ধন্যবাদ,’ বাক্সদুটো সামলাতে সামলাতে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করল হাব। ‘তবে আমি ঠিকই ম্যানেজ করতে পারব।’

‘বেশি দূর পারবে বলে মনে হচ্ছে না,’ সাওলো সন্দেহ প্রকাশ করল।

কিছুটা পিছিয়ে ছিল স্টিফেন, লম্বা পা ফেলে এগিয়ে এল। মি. স্টেইভ,’ হাতের ছড়িটা দিয়ে সাওলোর বাহুতে টোকা দিল ও, ‘প্রকৃত ব্যাপারটা তোমার জানা নেই। তাই হয়তো এ ধরনের কথাবার্তা বলছ। তোমার অবগতির জন্যে জানাচ্ছি, হাব আমার বেতনভুক ভৃত্য। জিনিসগুলো আমার পছন্দমত জায়গায় নিয়ে যেতে আমাকে সাহায্য করাটা ওর দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। ঠিক আছে?’

‘বরাবর।’

‘তাহলে ওকে ওর কাজ করতে দাও।’

ঘোড়াগুলোকে নিয়ে সামনে এগিয়ে গেল সাওলো। হাবকে ওর পোর্টমেন্টোগুলো জেবরা ডানটার পিঠে তুলে দিতে বলবে বলে ভাবল একবার, পরক্ষণেই বাতিল করে দিল চিন্তাটা। হাব নিজেই যদি ওই অহঙ্কারী শাদা মানুষটার জন্যে গাধার বোঝা বইতে চায়, তাহলে ওকে বইতে দেয়াই উচিত।

তাছাড়া টীম হর্সগুলোর অবস্থাও কাহিল, জেবরা ডানের মত শক্ত ঘোড়াটা পর্যন্ত পরিশ্রমে মাথা নিচু করে রেখেছে। পানির কাছে পৌঁছার আগ পর্যন্ত ঘোড়াগুলোর পিঠে অতিরিক্ত মাল বোঝাই কিংবা কারও চড়া সম্ভব হবে না।

সামনে, এলাকাটা আরও বিস্তৃত আর শূন্য। পড়ন্ত বেলায় সূর্যের আলোয় গোলাপী আভা, দূরে পর্বতশীর্ষে চিকচিক করছে রোদ; দিনের প্রচণ্ড উত্তাপ কমে ঠাণ্ডার ভাব দেখা দিয়েছে। কিন্তু ক্লান্ত হতাশ আর বিধ্বস্ত যাত্রীদের কাছে তাও অসহ্য মনে হচ্ছে। ওদের কারও তেমন হাঁটার অভ্যাস নেই, কেবল ইয়েটস আর ওয়াল্টারকে কিছুটা শক্ত দেখাচ্ছে। ওয়াল্টার ম্যাগির পাশে হাঁটছে, অপ্রকৃতিস্থ মেয়েটাকে প্রায় টেনে নিয়ে যাচ্ছে; স্টিফেন অন্য মেয়েটার পাশে-একটা হাত বাড়িয়ে দিয়েছে ওর সাহায্যার্থে, তবে তার নিজের অবস্থা ওর চেয়ে খুব একটা ভাল নয়।

দ্রুত পা চালিয়ে সাওলোর পাশে চলে এল ইয়েটস, মিনিটখানেক চুপচাপ হাঁটল পাশাপাশি। একসময় বলে উঠল, ‘অ্যাপাচিদের ব্যাপারটা এখন মজার মনে হচ্ছে আমার কাছে। ঘোড়াগুলো আর স্টেজটার অবস্থা থেকে ওদের আক্রমণের ধরনটা নিশ্চয় বুঝতে পারছ তুমি। কিন্তু হঠাৎ করে সবকিছু ছেড়ে ছুড়ে এরকম পাততাড়ি গুটানো! ব্যাপার কেমন অবাস্তব মনে হচ্ছে।

‘বুঝতে পারছ না?’

‘নাহ্! মাথা-মুণ্ডু কিছুই না। পুরোপুরি বাগে পেয়েছিল ওরা আমাদের। কিন্তু হঠাৎ করেই হাওয়া! আমরা তো প্রথমে ভেবেছিলাম, ওটা স্রেফ ফাঁদ একটা। তাই অপেক্ষা করতে লাগলাম। কিন্তু ওদের লেজটাও দেখা গেল না আর।’ থুতু ফেলল ও। ‘কুরিয়াপোসহ ওর যোদ্ধারা সবাই এতে ছিল, অন্তত আমার তা-ই ধারণা।’

‘হতে পারে।’

‘কিন্তু নিশ্চিন্ত হতে পারছি না। মনে হচ্ছে, ওরা ফের আসবে।’

শ্রাগ করল সাওলো। বলা যায় না। ওদের হঠাৎ করে চলে যাবার পেছনে হয়তো কোন কারণ আছে। হয়তো এর চেয়ে বড় কোন শিকারের, খোঁজ পেয়েছিল ওরা। ওটা যদি তাড়াতাড়ি শেষ করে ফেলতে পারে, আমার বিশ্বাস, ফের আসবে ওরা। ওরা জানে, তোমাদের সঙ্গে ঘোড়া নেই, পায়ে হেঁটে যাচ্ছ, সুতরাং ওরা জানবে, বেশিদূর যেতে পারনি তোমরা।’

‘হ্যাঁ,’ সায় দিল ইয়েটস, ‘আমারও তা-ই ধারণা। আমরা যদি ট্র্যাক লুকোতে পারতাম!’

‘প্রার্থনা করো,’ আশ্বাস দিল সাওলো, ‘লাভা অঞ্চলে পৌছতে পারলে তার আর দরকার হবে না।’

‘লাভা অঞ্চল?’

‘হ্যাঁ।’ অর্ধবৃত্তাকারে হাত ঘোরাল সাওলো। ‘সামনে। একটু পরেই দেখতে পাবে। একটা মোষকেও ওখানে ট্র্যাক করা সম্ভব নয়। ওখানেই সুবিধেমত একটা জায়গা বেছে নেব আজকের জন্যে।’

ঘোঁৎ করে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল ইয়েটস। ‘তোমার খুব কষ্ট হবে, বাছা।

হাসল সাওলো। ‘তোমার লোকদের যদি আর ঘণ্টা খানেক হাঁটাতে পারো, তাহলে আজকের রাতটা লাভা অঞ্চলে কাটাব আমরা।’

‘আমি ওদের সাথে কথা বলতে যাই।’

পিছিয়ে গেল ইয়েটস। নিজের লোকদের সঙ্গে নিচু গলায় কথা বলতে শুনল ওকে সাওলো।

আপনমনে হাসল ও। তিক্ত হাসি। লাভা অঞ্চলে কুরিয়াপোকে খসিয়ে দেয়া যাবে শুনে হয়তো খুশি হবে স্টেজযাত্রীরা। কিন্তু একটা ব্যাপার ওরা জানবে না। ট্র্যাক হারিয়ে ফেললেই যে কুরিয়াপো ওদের ধাওয়া করা থেকে ক্ষান্ত হবে, তা কিন্তু নয়। কুরিয়াপো জেনে নেবে, ওর সৎভাই সাওলো স্টেজযাত্রীদের সঙ্গে আছে। ওদের নরক পর্যন্ত ধাওয়া করার জন্যে এটাই ওর কাছে যথেষ্ট। তবে ও বোকা নয়। ট্র্যাক হারিয়ে মাথা খাটাতে শুরু করবে। শাদাদের সঙ্গে যথেষ্ট পানি নেই এবং তা পাবার জন্যে সাওলো ওদের কোথায় নিয়ে যেতে পারে, সেটা আন্দাজ করা ওর জন্যে মোটেই সমস্যা হবে না। এ পথে পানি পেতে হলে রেডোন্ডো ট্যাংকসে যেতেই হবে সবাইকে।

অবশ্য সাওলো যদি এখন কুরিয়াপোকে এড়াতে চায়, ওর জন্যে একটাই পথ খোলা আছে। সেটা হলো স্টেজযাত্রীদের ফেলে চুপি চুপি অন্য পথ ধরা। ওকে এদের সঙ্গে পেলে এদেরও ছাড়বে না কুরিয়াপো। তবে ওকে ছাড়াও যে স্টেজযাত্রীরা নিরাপদ, তা কিন্তু নয়। ওকে না-পেলেও এদের হত্যা করবে রক্তপিপাসু জানোয়ারটা।

অবশ্য কুরিয়াপোকে এড়িয়ে যাওয়া যে ওদের পক্ষে একেবারেই অসম্ভব, তাও কিন্তু নয়। তবে তা করতে হলে যে করেই হোক, কুরিয়াপোর আগেই রেডোন্ডো ট্যাংকসে পৌছতে হবে এবং প্রয়োজনীয় পানি সংগ্রহ করা মাত্র কেটে পড়তে হবে। সবচে’ ভাল হয়, ট্যাংকসের কাছে না-গিয়ে পারলে। তবে সাওলো জানে, সেটা সম্ভব নয়। কারণ পানি তাদের অবশ্যই চাই।

একটা ব্যাপারে ও এখন নিজের কাছে পরিষ্কার। এদের প্রতি ওর একটা দায়িত্ববোধ জন্মে গেছে ইতোমধ্যেই। যেভাবেই হোক দায়িত্বটা বর্তেছে ওর ওপর। সে জন্যে ওর খারাপও লাগছে না। আসলে মিশ্র রক্তের হওয়াতে দু’পক্ষকেই ওর আত্মীয় মনে হয়। শাদা ও ইন্ডিয়ানদের মধ্যে ভয়াবহ দাঙ্গা- হাঙ্গামায় বিশেষ কোনও পক্ষাবলম্বন করতে গিয়ে বিপাকে পড়ে যায় ও। এছাড়াও দু’পক্ষেই ওর বন্ধুর সংখ্যাও নেহাৎ কম নয়।

লাভা অঞ্চলের মুখে এসে পড়েছে ওরা; মাটি এখানে বন্ধুর। সতর্কভাবে এগোবার তাগিদ বোধ করল সাওলো। অঞ্চলটা সে চেনে ভাল করে। বেশ কয়েক বছর আগে শেষবার এসেছিল এখানে। লাভা অঞ্চলে ধারাল ব্যাসল্টের ভয় থাকলেও মসৃণ বালুময় পথ খুঁজে নেয়া খুব একটা কঠিন হবে না। কিন্তু সাওলো একটা শক্ত পাথুরে ট্রেইল বেছে নিতে চাইছে, যাতে পেছনে ওদের ট্র্যাক খুঁজে পাওয়া না-যায়।

বিশাল লাভা অঞ্চল, রুক্ষ, পাথুরে, রৌদ্রদগ্ধ; অ্যাপাচিরাও এখানে আসে না পারতপক্ষে। প্রাচীনকালে ভয়াবহ অগ্ন্যুৎপাতে উৎক্ষিপ্ত লাভা জমে কঠিন হয়ে যাওয়া উপরিভাগ অসংখ্য ভাঁজে বিভক্ত, এবড়োখেবড়ো। এখানে-ওখানে বিসনাগা, চোলা আর ওকোটিলোর ঝাড়। ক্যুগার, নেকড়ে, বিগহর্ন আর অ্যান্টিলোপের চারণভূমি।

সূর্য ডুবে যাচ্ছে দিগন্তের গর্ভে তপ্ত লাল লৌহগোলকের মত। চারদিকে কুয়াশা নেমে আসছে। সাওলো জানে, অন্ধকারে পথচলা সম্ভব নয় লাভা অঞ্চলে। এখনই রাতের জন্যে বিশ্রামের জায়গা ঠিক করতে হবে।

‘স্টেইভ,’ ইয়েটসের কাতরকণ্ঠ শোনা গেল পেছন থেকে, ‘যীশুর কিরে, আর পারছি না!’

‘ঠিক আছে, ইয়েটস, ওকে আশ্বাস দিল সাওলো, ‘মিনিটখানেকের মধ্যেই আজকের মত থামব আমরা।’

এবড়োখেবড়ো ভূমিতে হঠাৎ খাড়া হয়ে উঠে-যাওয়া একটা টিলার একপাশকে ক্যাম্প করার জন্যে পছন্দ করল ও। টিলার খাড়া গা আগুনের জন্যে চমৎকার আড়াল হবে।

চ্যাপ্টা হয়ে মাটিতেই বসে পড়ল সবাই। ক্লান্তিতে মৃত প্রায়। কথা বলার শক্তি পর্যন্ত নেই কারও। শুকনো ঝোপঝাড় জড় করে আগুন জ্বালল সাওলো। সামান্য নড়াচড়া দেখা গেল দলের মধ্যে, আগুনের কাছে এগিয়ে এল সবাই। একটা স্যান্ডউয়িচ বের করল ইয়েটস ন্যাপসাক থেকে।

স্টিফেন সামান্য দূরে মসৃণ একটা পাথর খণ্ডে হেলান দিয়ে বসেছে। ওর কম্বলটা বের করে দেবার জন্যে চেঁচিয়ে হাবকে আদেশ দিল সে। বিশালদেহী নিগ্রো নীরবে আদেশ পালন করল, তারপর একটা স্যান্ডউয়িচ বের করে বাড়িয়ে দিল ওর দিকে বিনীত ভঙ্গিতে।

সাওলোর কাছে অবোধ্য ঠেকছে ব্যাপারটা। হাব ঘোড়ার মত প্রচণ্ড শক্তিশালী; সুদর্শন, ভদ্র এবং মনে হয় শিক্ষিতও, তাহলে উদ্দেশ্যহীন এক যাত্রায় কেন এসেছে ও অশিক্ষিত আর গোঁয়ার ফুলবাবুটির সঙ্গে? তাহলে কি ওর শরীরের কালো রঙই ওর শিক্ষা-দীক্ষা, শক্তি-সামর্থ্য সব কিছুকে অর্থহীন করে রেখেছে? ওর ভাগ্য পরিবর্তনে কোন কাজেই আসছে না?

তাই হবে হয়তো, সিদ্ধান্তে পৌছাল সাওলো। আসলে হাব স্টিফেনের ক্রীতদাসই বটে, ওর ব্যাপারে স্টিফেনের ঔদ্ধত্যপূর্ণ মন্তব্যটা মনে পড়ল সাওলোর।

আগুনের পাশে এসে বসল ইয়েটস। ‘পানির ব্যাপারে কী করতে বলো তুমি?’ সাওলোকে জিজ্ঞেস করল সে।

‘জনপ্রতি আধ কাপ। বাকি আধ কাপ কাল সকালের জন্যে।’

‘এতেই শেষ হয়ে যাবে। এখান থেকে ট্যাংকস আর কতদূরে হবে, বাছা?’

‘কাল দুপুরের আগেই পৌঁছাব আশা করছি।’

‘পানি ছাড়া সময়টাকে অনেক লম্বা মনে হচ্ছে। তাছাড়া পানি থাকবে ওখানে?’

‘থাকতে পারে। এর চেয়ে গরমের দিনেও ওখানে পানি থাকতে দেখেছি আমি।

স্টিফেনের গলা শোনা গেল এবার। স্যান্ডউয়িচ চিবোতে চিবোতে জানতে চাইল, ‘ঠিক কখন আমরা সিলভারটনে পৌঁছুতে পারব?’

শ্রাগ করল সাওলো। পায়ে হেঁটে কখনও সিলভারটন যাইনি। তিন- চারদিন লাগতে পারে।’

স্টিফেনের দিকে ঘাড় ফেরাল ইয়েটস। ‘তোমাকে যেন কিছুটা উদ্বিগ্ন মনে হচ্ছে। জানতে পারি, কেন?’

‘অনায়াসে। গোপন কিছু নয়।’ গোঁফে মোচড় দিল স্টিফেন। বছর কয়েক আগে আমাদের পরিবার সর্বস্বান্ত হয়ে গেছে। যুদ্ধের পরে জর্জিয়ায় আমরা ঋণের দায়ে নিজেদের সব সম্পত্তি হারিয়েছি। আমাদের মধ্যে অনেকে তখন পশ্চিমে চলে যায় কপাল ফেরাবার আশায়। আমার বড় ভাই কিছু পুঁজি সংগ্রহ করে সানফ্রান্সিসকোয় জাহাজ-ব্যবসার মাধ্যমে বেশ কিছু পয়সা উপার্জন করেছিল। কয়েকদিন আগে খবর পেয়েছি মারা গেছে ও। ওর সম্ভাব্য উত্তরাধিকারীদের মধ্যে আমিও একজন। পশ্চিমে যাচ্ছি তাই। আর তোমরা তো জানো, পশ্চিমের ট্রেন সিলভারটন থেকেই ছাড়ে। বুঝতেই পারছ, দেরি হলে আমার জন্যে সমস্যার সৃষ্টি হবে।’ সাওলোর দিকে চাইল স্টিফেন। ‘আশা করি, তোমার এখানে নাক গলাবার মত কিছু নেই, মি. স্টেইভ।’

‘একদম নেই,’ একমত হলো সাওলো। ‘শকুনের মেলা অনেক দেখেছি আমি।’

অবজ্ঞার হাসি হাসল স্টিফেন। ভাল। বুঝতে পেরেছি, একদম ইঁদুরের মতই নিরীহ তুমি। টাকা-পয়সার ব্যাপারে খামোকা চুলকোনি নেই।’

‘আছে, তবে ওটা আমার পায়ে। আর টাকায় সারে না ওটা।’

‘বেশ, বেশ!’

ম্যাগি শুয়ে আছে পাশ ফিরে, কাঁদছে ফুঁপিয়ে। সবার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে রেখেছে। চেঁচানো কিংবা হাত-পা ছোঁড়ার মত শক্তিও আর অবশিষ্ট নেই ওর শরীরে। স্বস্তি পাচ্ছে সবাই এতে।

মেয়েটির জুতো ছিঁড়ে গেছে। কার্পেটব্যাগ থেকে সুঁই-সুতো বের করে ওগুলো সেলাই করছে ও। কাজ শেষ করে উঠে দাঁড়াল, ম্যাগির পাশে এসে বসল; সান্ত্বনা দেবার ভঙ্গিতে কিছু বলল ওকে। সাড়া দিল না মেয়েটি, তাকালও না। অনড় শুয়ে রইল।

‘শোনো, রূঢ়স্বরে বলল ও। ‘শিগগির উঠে পড় বলছি। বিড়ালের মত মিউ মিউ করছ কেন? ধরো, এটা নাও, খেলে গায়ে জোর পাবে কিছুটা।’

নিজের স্কার্ট উঁচিয়ে পেটিকোটের পকেট থেকে একটা চ্যাপ্টা বোতল বের করল সে। মেয়েদের পেটিকোটে পকেট থাকার ব্যাপারটা একদম অজানা নয় সাওলোর কাছে। মেয়েরা সাধারণত স্মেলিং সল্ট রাখে ওখানে। কিন্তু ও অবাক হয়ে দেখল, ওর হাতের বোতলটায় স্মেলিং সল্ট নয়, তরল পদার্থে ভরা ওটা। ম্যাগির কাঁধের নিচে একটা হাত গলিয়ে ওর মাথা উঁচু করে ধরল সে, অপর হাতে ঠোঁটের কাছে ধরল বোতলটা।

‘এটা ইমার্জেন্সির জন্যে। খাও। এর আগে খাওনি আর? এক মিনিটেই সুস্থ বোধ করবে।’

জিভ দিয়ে নিচের ঠোঁট চাটল ওয়াল্টার। ‘ম্যাম, তোমার পেটিকোটে আর পকেট নেই?’ ওর চোখ বোতলটার দিকে।

‘থাকলেও, ওর দিকে তাকাল মেয়েটি, ‘তুমি সেটা কখনও দেখতে পেতে না।’ হাতের বোতলটায় কর্ক লাগাল ও, তারপর ছুঁড়ে দিল ওয়াল্টারের দিকে। ‘নাও, এটা আমার পক্ষ থেকে।

দু’হাতে লুফে নিল ওয়াল্টার বোতলটা; খুশিতে চক চক করছে ওর চোখ। ‘তুমি সত্যি গ্রেট!’ কর্ক খুলে মুখে উপুড় করে দিল সে বোতলটা। ঢক ঢক করে গিলতে শুরু করল ভেতরের তরল পদার্থ।

‘আহ্!’ ধীরে ধীরে মুখের ভাব আর চোখের দৃষ্টিতে পরিবর্তন ঘটতে শুরু করল ওর। হঠাৎ অতিরিক্ত উৎফুল্ল দেখাতে লাগল ওকে এবং কিছুটা বোকাটেও

বসা থেকে উঠে দাঁড়াল ও, ঘুরতে লাগল চারদিকে। একটু পর ধুপ ধাপ পা ফেলে এগিয়ে এল সাওলোর কাছে। আড়চোখে ওর দিকে তাকাল। ‘তোমার সাথে এখন পর্যন্ত ভাল ব্যবহার করিনি আমি, স্টেইভ। ধ্যাৎ, আসলেই হয়তো তুমি ভাল। অন্তত তোমার মত শান্তিপ্রিয় ইনজুন আমি আর দেখিনি। আশা করি, তুমি এসব মনে রাখবে না, বাছা!

‘হ্যাঁ, বাছা,’ সাওলো হাসল, ‘ওটা আমি এতক্ষণে ভুলেই গেছি।’

‘বাছা,’ শব্দটার ওপর জোর দিল সাওলো।

খ্যাক খ্যাক করে হাসল ওয়াল্টার নিজেও, যেন দারুণ একটা মজার কথা বলেছে সাওলো। এলোমেলো পায়ে টলতে টলতে ইয়েটসের দিকে এগোল ও, দু’পা বাড়াল, তিনবারের সময় উল্টে পড়ল ওর পাশে; অল্পের জন্যে বেঁচে গেল আগুনে পড়া থেকে।

ওর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়েছিল মেয়েটি, চোখ ফিরিয়ে নিল ও বিতৃষ্ণ ভঙ্গিতে। ম্যাগির দিকে চাইল। ঘুমিয়ে পড়েছে ম্যাগি। আস্তে আস্তে হাত বের করে নিল সে ওর কাঁধের নিচ থেকে।

উঠে জুতো সেলাইয়ের অসমাপ্ত কাজটা নিয়ে বসল ফের। কিন্তু অচিরে বুঝতে পারল, কাজটা প্রায় অসম্ভব। জুতোর চামড়া ছিঁড়ে চলে এসেছে সোল থেকে।

‘ইস, যদি একটা ছুরি পেতাম…মি. স্টেইভ, তোমার ছুরিটা পাওয়া যাবে?’

‘নিশ্চয়, ম্যাম।’ উঠে গিয়ে নিজের ছুরিটা ওর হাতে দিল সাওলো।

চোখ কপালে উঠল মেয়েটির। ‘আরে, এরকম চুরি তো আর দেখিনি!’

‘ছুরি নয় এটা ম্যাম, স্প্যানিশ ড্যাগার।

উল্টেপাল্টে ছুরিটা দেখল মেয়েটা। ‘চমৎকার!’

টলেডো স্টীলের তৈরি ছুরিটা; দ্বিধারী, তীরের মত সোজা।

‘কোথায় পেয়েছ ওটা?’ কৌতূহল প্রকাশ করল মেয়েটি।

‘উপহার।’

উপহারটা যত্ন করে রেখে দিয়ো, পরামর্শ দিল সে।

সাওলো অবশ্য ছুরিটা যত্ন করেই রেখেছে। দুর্লভ স্প্যানিশ ড্যাগার বলে নয়, ওটা একটা উপহার এবং উপহারটা ওর বাবা জারিপোর কাছ থেকে পাওয়া বলেই। জারিপোর দাবি, যৌবনে একজন ‘গ্রান্ডি’কে হত্যা করে এটি হাতিয়ে নিয়েছিল সে। একবার মাতাল অবস্থায় দিলখোলা হয়ে ওর আধা শ্বেতাঙ্গ ছেলেটাকে ওটা উপহার দিয়ে দেয়।

কিন্তু ছুরি দিয়ে কাজ হলো না। জুতোজোড়া এমনভাবে ছিঁড়েছে যে, ওটা আর মেরামতের উপযোগী নয়। হতাশা ব্যক্ত করল মেয়েটি।

‘আমার কাছে মোকাসিন আছে একজোড়া,’ বলল সাওলো। তুমি ওগুলো নিতে পারো।’

মোকাসিনগুলো সুন্দর; মেয়েটি ওগুলোর অ্যাপাচি ডিজাইনের প্রশংসা করল।

স্কার্ট উঁচিয়ে পেটিকোটটা হাঁটু পর্যন্ত তুলে মোকাসিনগুলো পরে নিল সে। ওর কালো মোজা-পরা পা দুটো লম্বা আর সুগঠিত। যে কোন পুরুষকে মুগ্ধ করার মতই, ভাবল সাওলো। মোকাসিন পরে উঠে দাঁড়াল মেয়েটি; হাঁটাহাঁটি করল একটু। তারপর সাওলোর কাছে এল। ‘দারুণ ফিট করেছে তো!’ হাসল সে। ‘খুব খুশি হয়েছি। কোথায় পেয়েছ তাই জানতে চাচ্ছি না।’

সাওলোও হাসল। উন্নতবক্ষা, স্বাস্থ্যবতী মেয়েটা; ক্যাম্পের আগুনের আলোয় ওর পূর্ণ অবয়ব পরিস্ফুট হয়ে উঠেছে। দীর্ঘাঙ্গী মহিলা, লম্বায় প্রায় সাওলোর সমান হবে। আলোয় চকচক করছে ওর সোনালি চুল। অস্বস্তি বোধ করল সাওলো। মেয়েটি প্রশংসার জবাবে কিছু বলতে গেল; বোকার মত শেষে প্রশ্ন করে বসল অপ্রাসঙ্গিকভাবে, ‘তোমার নাম?’

‘মেলোডি ক্রিসমোর পরে অবশ্য মেলোডি উইলসন…’ ইতস্তত করল ডাচেস, ট্যুবাকে একটা জুয়ার দোকান চালাতাম, গানও গাইতাম। এখন দোকান নেই। নতুন ধান্দায় আছি।’

‘মি. উইলসন কোথায়?’

‘মারা গেছে। প্রায় আট বছর আগে।’ সন্তর্পণে দীর্ঘশ্বাস চাপল মেলোডি। ‘দারুণ একজন মানুষ ছিল ও। সুবিবেচক।’ হাসল ম্লানমুখে। ‘তবে মরার ব্যাপারে খুব একটা সুবিবেচনার পরিচয় দিতে পারেনি। এখন থেকে আটবছর আগে নিজের পূর্ণ যৌবনা স্ত্রীকে ফেলে মরে যাওয়াটাকে নিশ্চয় সুবিবেচনার কাজ বলবে না তুমি, যদি তার সাহায্যে আসার জন্যে অসংখ্য আজেবাজে লোক লাইন ধরে ছুটে আসে।’

আজ রাতে কোন গোলমালের আশঙ্কা করছে না সাওলো। তবু রাতে পাহারা দেবার জন্যে ডিউটি ভাগ করে দিল। ওয়াল্টারের ভাগে পড়ল রাতের প্রথম অংশের পাহারা। সাওলোর বিশ্বাস, অ্যাপাচিরা এখনও এ পর্যন্ত এসে পৌছেনি—আর যদি এসে যায়, অন্তত রাতে ওরা আক্রমণ করবে না। কারণ, রাতে যুদ্ধ করা ওদের রীতিবিরুদ্ধ। সাওলো শুয়ে পড়ল, মাথার নিচে দু’হাত রেখে আগামীকালের কথা ভাবতে লাগল ও।

যে করেই হোক, রেডোন্ডো ট্যাংকসে ওদের কুরিয়াপোর আগে পৌঁছতে হবে। তাহলে নির্বিঘ্নে নিজেদের পানির প্রয়োজন মিটিয়ে সটকে পড়তে পারবে ওরা। নইলে কুরিয়াপোকে মোকাবেলা করা ছাড়া উপায় থাকবে না।

হতাশা বোধ করছে ও। মনে মনে নিজের লোকবলের কথা ভাবল। ওয়াল্টার সম্ভবত পোড় খাওয়া, কঠিন লোক। বাকিদের কাউকে সেরকম মনে হয় না। তবে একটা ব্যাপারে ও নিশ্চিত, ওদের কেউ ভীতু নয়। ভীতু হলে এরকম গোলযোগপূর্ণ সময়ে ট্যুবাক থেকে বেরিয়ে আসত না। সাহসী ওরা, নয়তো চরম বোকা।

.

ভোরে চারদিক ফর্সা হয়ে ওঠার অনেক আগেই সবাইকে ডেকে তুলল সাওলো। যাত্রা শুরু করার জন্যে তৈরি হতে বলল ও। গতকাল সারাদিন প্রচণ্ড খাটুনির ধকল একরাতের ঘুমে কাটিয়ে উঠতে পারেনি যাত্রীরা কমবেশি আপত্তি জানাল সবাই। তবে সবচে’ বেশি অসন্তোষ প্রকাশ করল ওয়াল্টার। ধ্যাত্তেরি, এত সকালে ওঠানোর কী দরকার ছিল, অ্যাঁ?’

ঠাণ্ডায় ঠাণ্ডায় এগিয়ে যাওয়া দরকার,’ ব্যাখ্যা করল সাওলো। ‘চলো।’

পর্যুদস্ত সৈন্যদলের মত অগত্যা ওকে অনুসরণ করল সবাই। উত্তরে চলল ওরা। ক্রমে ভোরের আলোয় লাভা অঞ্চল স্পষ্ট হয়ে উঠতে লাগল ওদের চোখে। মরাটে শাদা দেখাচ্ছে চারদিক। এক সময় পাখির কলকাকলিতে সবুজ ঝোপঝাড় মুখরিত হয়ে ওঠায় যেন জীবন ফিরে পেল পুরো লাভা অঞ্চল।

হেঁটে সাওলোর পাশে চলে এল ওয়াল্টার। ‘ধূমপান করার মত কিছু আছে নাকি তোমার সাথে, স্টেইভ?’

‘আছে। তবে তোমার হয়তো পছন্দ হবে না।’

‘কি করে জানলে?’

কথা না বাড়িয়ে নিজের স্প্যানিশ সিগার থেকে একটা বাড়িয়ে দিল ও ওয়াল্টারের দিকে।

সিগারেটটা হাতে নিয়ে চোখ কুঁচকে পর্যবেক্ষণের দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ দেখল ওয়াল্টার, নাক দিয়ে ঘোঁৎ করে বিজাতীয় একটা শব্দ করে সিগারের গোড়াটা দাঁতে কেটে নিয়ে লাইটার জ্বালিয়ে আগুন ধরাল। টান দিয়ে ধোঁয়া গিলে পরক্ষণেই মুখ বিকৃত করল, যেন শুকনো গোবরপোড়া ধোঁয়া গিলে ফেলেছে। একটু সামলে নিয়ে এরপর সাবধানে টানতে লাগল সিগারটা।

সাওলো মাঝে-মধ্যে ঘাড় ফিরিয়ে পেছনে দেখছিল। নাক গলাল ওয়াল্টার। ‘বারবার পেছনে কী দেখছ, স্টেইভ?’

‘কিছু না।’

‘তাহলে চোরের মত করছ কেন?

‘স্রেফ সতর্কতা, ওয়াল্টার। জানোই তো, সাবধানের মার নেই।’

সূর্য ওঠার পর দ্রুত উত্তাপ বাড়তে শুরু করল। অচিরে গতি মন্থর হয়ে এল যাত্রীদের। এলোমেলো পায়ে হোঁচট খেতে খেতে চলতে লাগল ওরা। ওয়াল্টার আর ইয়েটস মেয়েদের দিকে দৃষ্টি দিল।

দুটো ভারী পোর্টমেন্টো মাথায় হাবের অবস্থা সবচে’ খারাপ বোধ হচ্ছে। ওর জামাকাপড় ঘামে ভিজে জবজবে হয়ে গেছে। ক্লান্ত খচ্চরের মত হাঁফাচ্ছে।

বিশ্রামের জন্যে যাত্রা বিরতি দিল সাওলো। ক্যান্টিনের অবশিষ্ট পানিটা বাঁট করে দিল সবার মধ্যে আধকাপ করে। নিজের ভাগের পানিটুকু ঢালল ও ফ্লাক্সে। একটু ইতস্তত করল: আরও আধকাপ পানি ঢেলে নিল ও ফ্লাস্কে।

‘একমিনিট,’ নাক গলাল স্টিফেন, ‘আমরা সবাই পেয়েছি আধকাপ করে। আর তুমি পুরো এক কাপ নিয়েছ?’

‘আমার আধ কাপ আর মি. বোদের আধকাপ। তবে আমি সবটুকুই ওকে দিতে চাই। তোমার ওই বোঝা টানতে হলে ওর আমাদের চেয়ে বেশি পানির প্রয়োজন হবে। তোমার আপত্তি আছে এতে?’

হাসল স্টিফেন। ‘একদম না। তুমি যদি নিজেরটা দান করে দাও, আমার তাতে ক্ষতি কী?’

অবসন্ন শরীরে মাটিতে শুয়ে আছে হাব। সাওলো ফ্লাস্কহাতে ওর কাছে আসতেই আপত্তি জানাল ও, ধন্যবাদ. মি. স্টেইভ। কিন্তু আপনার ভাগের পানি আমাকে দেবেন না।’

‘আমি এখন পানি খাব না। আমাদের চেয়ে তোমার পানির দরকার বেশি। অবশ্য তুমি না খেলে সেটা ভিন্ন কথা। অন্যদের বিলিয়ে দেব আমি পানিটা।’

ঝকঝকে শাদা দাঁত বের করে হাসল হাব। হাত বাড়াল সাওলোর দিকে। ‘অদ্ভুত মানুষ তুমি, মি. স্টেইভ।’

সাওলোর হাত থেকে ফ্লাক্সটা নিল ও, ছোট ছোট চুমুকে নিঃশেষ করল পানিটুকু।

‘তোমার পোর্টমেন্টো দুটো আমার ঘোড়ার পিঠে বেঁধে দিতে পারো,’ প্রস্তাব করল সাওলো, ‘কেন কষ্ট করে বয়ে বেড়াচ্ছ শুধু শুধু?’

‘ধন্যবাদ। কিন্তু সেটা করতে পারব না। মি. স্টিফেন আপত্তি করবে।’

‘আপত্তি করার কী আছে?’

‘সেটা আমি জানি না। তবে রাগ করবেই।’

‘তোমার এ-চাকরিটা তুমি পছন্দ করো?’

‘এটা চাকরি, মি. স্টেইভ, খালি ফ্লাস্কটায় ঢাকনা লাগাল হাব, সাওলোকে ফিরিয়ে দিতে দিতে বলল, ‘কালোদের জন্যে পছন্দ-অপছন্দ করার কিছু নেই। সেটা তুমিও জানো, না?’

‘জানি না আমি,’ সাওলো বলল। ‘তবে আমার মতে, কালো মানুষদেরও পছন্দ-অপছন্দ করার অধিকার থাকা উচিত। মানুষকে হয় মানুষের মত বাঁচতে হবে, নয়তো কুকুরের মত।

বুকের ওপর আড়াআড়ি করে হাত রেখে একটা পাথরে হেলান দিয়ে বসল হাব। বলতে লাগল, শৈশবে খুব সুখে ছিলাম, মি. স্টেইভ। আমার এক বছর বয়সের সময় মালিকের প্রথম বাচ্চা হয়। আমাকে মি. এডসনের আজীবন ভৃত্য হিসেবে পছন্দ করা হয়। ফলে আমাদের নিগ্রোদের জন্যে তৈরি ঘর থেকে মি. এডসনের প্রাসাদে সর্বক্ষণের জন্যে স্থানান্তর ঘটে আমার। এরপর মি. এডসনের জন্যে বিদেশ থেকে এক্সপার্ট শিক্ষক আনা হয়। ওদের সঙ্গে থেকে থেকে বিশুদ্ধ ইংরেজীতে কথা বলাটা রপ্ত করে ফেলি। আমার ইংরেজি শুনে তোমার তা-ই মনে হয় না?’

‘মোটামুটি।’

মৃদু হাসল হাব। ‘গৃহযুদ্ধ শেষ হবার পর আমরা ক্রীতদাসরা মুক্তি পেয়ে গেলাম। আমার বয়স তখন ষোলো। আমার মনিবের অবস্থা খুব খারাপ হয়ে গেল হঠাৎ। বাবা-মার কাছে ফিরে গেলাম আমি। জর্জিয়ার অনুর্বর অঞ্চলে সামান্য জমিজমার ওপর বেঁচে থাকার চেষ্টা করতে লাগল আমার পরিবার। পরিবারের সবাই মিলে জমিতে অমানুষিক পরিশ্রম করতাম। কিন্তু সে তুলনায় ফসল পেতাম যৎসামান্য। আমরা উপোস করতে শুরু করলাম।

‘আমাদের এক শ্বেতাঙ্গ প্রতিবেশীর মুরগির খামার ছিল। খিদের জ্বালায় একরাতে কয়েকজন মিলে মুরগি চুরি করলাম। মাত্র তিনটে মুরগি। পরের দিন একদল শ্বেতাঙ্গ ভদ্রলোক, মাতাল হয়ে নিগ্রো পাড়ায় এসে প্রতিটা ঘর থেকে গৃহকর্তাদের ধরে নিয়ে গাছে ঝুলিয়ে দিল। তারপর প্রত্যেক ঘর থেকে একদম ছোট ছেলে কিংবা মেয়েটাকে নিয়ে তাও গাছে ঝুলিয়ে ওদের পাছায় বেত মারল নির্মমভাবে এবং পরে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করল।’

মাথা নিচু করে এক নাগাড়ে বলে গেল হাব; ওর দু’হাত বুক থেকে নামিয়ে কোলের ওপর রাখা- মুষ্টিবদ্ধ। আচমকা মাথা তুলল ও, তাকাল সাওলোর দিকে। ‘আমি আমার পিতা-মাতার একমাত্র সন্তান ছিলাম মি. স্টেইভ।’

নিরুত্তরে ওর দিকে চেয়ে রইল সাওলো।

‘সেদিন থেকে, আবার কথা বলল হাব, ‘জেনে গেছি, দাসত্ব থেকে মুক্তি পেলেও কৃষ্ণাঙ্গদের পছন্দ কিংবা অপছন্দ করার স্বাধীনতা আসেনি মোটেও আসেনি।’

‘একটাই জিনিস আছে, হাব,’ ধীরকণ্ঠে বলল সাওলো। ‘হয় স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকব, নয়তো মরে যাব। এ-দুটোর একটা বেছে নিতে হবে মানুষকে। আর মানুষতো এর চেয়ে অনেক তুচ্ছ কারণেও মারা যায়, যায় না?’

‘উঁহু,’ মাথা নাড়ল হাব। ‘তোমার সঙ্গে একমত হতে পারছি না, মি. স্টেইভ। একটা মানুষ অনেক কারণে যুদ্ধ করতে পারে। সেটা হোক ওর আদর্শ, দেশ বা পরিবারের জন্যে। কিংবা যুদ্ধে অনায়াসে প্রাণ দিতে পারে। ওর মৃত্যুর পর ওর উত্তরাধিকারীরা সে-যুদ্ধকে সামনে এগিয়ে নেয়।’

হতাশার ভঙ্গিতে হাত ওল্টাল ও। ‘কিন্তু আমার যে কোন স্পর্ধাই শেষ পর্যন্ত অন্তঃসারশূন্য হতে বাধ্য। আমার লোকেরা যুগ যুগ ধরে সন্ত্রস্ত অবস্থায় বেঁচে আছে, আমরা যুদ্ধ করি না—তবে দু’একজন ন্যাট টার্নার যে ওদের মধ্যে নেই তা নয়। কিন্তু ওরা সবাই মারা যায়। ওদের মৃত্যু আর তোমাদের ইন্ডিয়ানদের বিক্ষিপ্ত প্রতিরোধ শাদাদের জন্যে বিশেষ কোনও সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে না? দুটোই সমান।

‘আমি শুধু তোমার কথাই বলছি, হাব। তুমি একজন মানুষ; তোমার কী সিদ্ধান্ত সেটাই বলো।

‘আমার সিদ্ধান্ত?’ হাসল হাব। মরে যাবার চেয়ে বেঁচে থাকতে বেশি ভালবাসি আমি।’

‘ঠিক আছে তাহলে, মি. বোদ,’ সাওলো উঠে দাঁড়াল। ‘তুমি আসলে মরেই আছ। হয়তো তোমাকে সমাধিস্থ করার কাজটা আমাকেই করতে হবে। কী বলো?’

দলের অন্যরা একটু দূরে বিশ্রাম করছিল। ওদের কাছে গিয়ে যাত্রার জন্যে তৈরি হতে বলল ও। ওয়াল্টার ঘোঁৎ করে বিরক্তি প্রকাশ করল। তুমি খুব তাড়াহুড়ো করছ, স্টেইভ। আমার ধারণা, রেডোন্ডো ট্যাংকস আর বেশি দূরে নয়।

‘এখন হাঁটা শুরু করলে এক ঘণ্টার মধ্যে পৌঁছে যাব।’

বলতে বলতে পেছনে ব্যাকট্রেইলে নজর বুলাল সাওলো। ধু-ধু করছে ফেলে আসা ট্রেইল, জন-মনুষ্যের চিহ্নও নেই এখন পর্যন্ত।

সামনে ফিরল ও, এগিয়ে চলল সবাইকে নিয়ে। ওয়াল্টার কৌতূহলী দৃষ্টিতে দেখছে ওকে, অনুভব করল ও।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *