জ্বালা – ৬

ছয়

তীব্র তাপে ঝলসে যাচ্ছে যাত্রীরা, ঘামছে দরদর করে। তবু হাঁটার বিরাম নেই। দিগন্তে ঝকঝক করছে উজ্জ্বল উত্তপ্ত রোদ; মরীচিকার মত লাগছে ক্লান্ত পিপাসার্ত পথিকদের চোখে। অনেকদূরে, অসংখ্য উঁচু ভূমির ওপর একটা রিজের কাঠামো জেগে উঠছে; কালো ব্যাসল্টে তৈরি রিজটা আশপাশের সবগুলো টিলা-টক্করের মাথা ছাড়িয়ে ওপরের দিকে উঠে গেছে।

‘ওইখানে,’ একটা হাত উঁচু করল সাওলো, ‘ওই রিজটা পেরোলেই রেডোন্ডো ট্যাংকস।’

ঠিক সে মুহূর্তে আচমকা হোঁচট খেল হাব, পড়ে গেল মাটিতে উপুড় হয়ে। কোনওমতে দু’হাত ও দু’হাঁটুর ওপর ভর দিয়ে উঠল সে, মাথা নাড়ল মৃদুভাবে। থেমে ওকে দেখতে লাগল সবাই।

ধুলোমাখা মুখ তুলল হাব। ‘মি. স্টিফেন, আ-আমি দুঃখিত। বোঝাটা আর বওয়া সম্ভব হবে না আমার পক্ষে।’

‘ওটা তুলে নাও, হাব। চলো। তুমি নিশ্চয় স্টেইভকে বলতে শুনেছ, রেডোন্ডো ট্যাংকস আর বেশি দূরে নয়,’ মৃদুস্বরে আদেশ দিল স্টিফেন।

‘আমি দুঃখিত, স্যার। ওগুলো মাথায় নিয়ে আর এক পাও হাঁটতে পারব না।’

রোদে জ্বলা চোখ দুটো সরু করে চাইল স্টিফেন। ঠাণ্ডাস্বরে বলল, ‘পাগলামি কোরো না, হাব। ব্যাগদুটো তুলে নাও তাড়াতাড়ি।’

হাঁটু গেড়ে বসা অবস্থায় চোখ তুলে স্টিফেনের দিকে চাইল হাব। নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল কয়েকমুহূর্ত। আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াল হাঁফাতে হাঁফাতে। ‘না, স্যার, মনে হচ্ছে না যে পারব।’

‘আহ্,’ বিরক্তি চাপার চেষ্টা করছে স্টিফেন। ‘ঠিকই পারবে।’

কাঁধ সোজা করে দাঁড়িয়ে রইল হাব বোদ। ‘আমার মনে হয় না, স্যার। তাছাড়া…’ একটু হাসল ও। তারপর বলল, ‘আমি আর তোমার চাকরিতে নেই। এই মুহূর্ত থেকেই তোমার চাকরি থেকে অব্যাহতি নিলাম আমি।’

‘হাহ্,’ ব্যঙ্গ করল ওয়াল্টার, ‘ক্রীতদাসের মুখে দেখছি চ্যাটাং চ্যাটাং কথা ফুটেছে! ঝেড়ে দাও তো ওকে, বাছা।’ স্টিফেনের দিকে চাইল ও হাসিমুখে।

সাপের মত কোমরের বেল্টে ছোবল বসাল স্টিফেনের হাত; পিস্তল বের করে আনল নিমেষে। সূর্যালোকে ওটার নীল ইস্পাতের নল ঝিক করে উঠল। ক্রুর হাসি হাসল সে। ‘অব্যাহতি নিয়েছ, না? এবার? ওই ব্যাটা হতচ্ছাড়া কালো ভিখারী, তোল ওগুলো!’

পিস্তল নেড়ে পোর্টমেন্টো দুটোর দিকে নির্দেশ করল সে।

‘না, স্যার, ইতস্তত করছে হাব। ওর ধুলোবালি মাখা কালো মুখ বেয়ে ঘামের ধারা বইছে। ‘মোটেই পারব না।’

পাঁই করে পায়ের গোড়ালির ওপর ঘুরল সাওলো। যখন স্টিফেনের দিকে ফিরল, তখন ওর চোখে আগুন আর হাতে আগুন ঝরানোর অপেক্ষায় উদ্যত রাইফেল; তাকিয়ে আছে ওটা স্টিফেনের পেট বরাবর। নিজের কাছে তোমার কতটা দাম, স্টিফেন?’

ঠাণ্ডাহাসি হাসল স্টিফেন। ‘চমৎকার!’ পিস্তলটা ঠেলে খাপের ভেতর ঢোকাল। ‘হাব, আমার তো ধারণা ছিল, কেউ আমাকে বিরক্ত করলে তুমি আমার হয়ে কথা বলো -আর তোমাকে বিরক্ত করলে আমি বসে থাকতে পারি না!’

‘তোমার প্রথম ধারণাটা একদম সত্যি—কিন্তু দ্বিতীয়টা বুঝতে পারিনি কোনওদিন। কিন্তু এখন আর তাতে কিছুই আসে যায় না।’

‘ঠিক আছে, হাব। কিছুই যায় আসে না। কিন্তু ব্যাপারটা অত সহজে মিটে যাচ্ছে না।’ আড়চোখে তাকাল ও সাওলোর দিকে। এর জন্যে উচিত শিক্ষা তুমি অবশ্যই পাবে। কথা দিচ্ছি হাব, বঞ্চিত হবে না। সে সময় তোমার দোআঁশলা বন্ধুর বন্দুক তোমার পাশে নাও থাকতে পারে।’

রাইফেলটা সামান্য নাড়াল ‘সাওলো। তারপর ঘুরে এগিয়ে গেল সামনে। স্টিফেন ছাড়া বাকিরা ওকে অনুসরণ করল। স্টিফেন প্রথমে একটা ব্যাগ তুলে নিল, তারপর অন্যটা। কয়েক মিনিটের মধ্যে অনেকটা পেছনে পড়ে গেল সে। হোঁচট খেতে খেতে কোনওমতে হাঁটতে লাগল মুখ দিয়ে অনবরত খিস্তি ওগরাতে ওগরাতে। শেষমেষ হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল। হেঁড়ে গলায় হাঁক দিল, ‘এক মিনিট অপেক্ষা করো। হতচ্ছাড়া ব্যাগগুলো আবার বাঁধতে হচ্ছে আমাকে। হেই, আরে! আমাকে ফেলে যেয়ো না।’-

হাঁটা বন্ধ করল না সাওলো; চেঁচিয়ে জবাব দিল, ‘পা চালিয়ে এসো। আমাদের ধরে ফেলতে পারবে।’

ঝেড়ে গাল দিল স্টিফেন সাওলোকে। লাভ হলো না তাতে। ওরা সামনে এগিয়ে চলল ওকে ওর পোর্টমেন্টোসহ হাঁটু গেড়ে বসা অবস্থায় ফেলে রেখে। ক্রমে চড়াই শুরু হলো; দিগন্তে ব্যাসল্টে তৈরি উঁচু রিজটা আরও স্পষ্ট হয়ে উঠতে লাগল। রিজ পেরিয়ে রেডোন্ডো ট্যাংকস।

হঠাৎ থেমে পড়ল সাওলো, চারদিকে তাকাল।

দক্ষিণে চোখ আটকে গেল ওর। সূক্ষ্ম, অতি সূক্ষ্ম একটা পরিবর্তন লক্ষ করল সে ওদিকটায়। তীব্র উজ্জ্বল রোদকে সামান্য ম্লান করে দিয়ে একটা পাতলা ধুলোর স্তর ভাসছে ওদিকের বাতাসে। পরিবর্তনটা ওর অভিজ্ঞ চোখকে ফাঁকি দিতে পারেনি।

‘কী হয়েছে, বাছা?’ ইয়েটস জানতে চাইল।

‘দেরি করে ফেলেছি আমরা, ইয়েটস। ওরা আমাদের আগে পৌঁছে গেছে।’

‘কুরিয়াপো?’

ওপর-নিচ মাথা দোলাল সাওলো।

ব্যাসন্টের রিজের দিকে তাকাল সাওলো। জায়গাটা মুক্ত নেই এখন আর, প্রচুর পাথর ফেলে ওখানে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা হয়েছে।

ট্যাংকসের সামনে খোলা জায়গাটায় প্রচুর পাথর ছড়ানো ছিটানো; তবে অতদূর পেরিয়ে ওই পর্যন্ত পৌঁছুতে পারলে লড়ার মত মোটামুটি একটা জায়গা পাওয়া যাবে।

‘সাওলো,’ আবার ডাকল ইয়েটস। ‘তুমি নিশ্চিত যে, ওরা অ্যাপাচি?’

‘একশো ভাগ।’

কঠিন চোখে ওর দিকে তাকাল ইয়েটস। ‘তুমি জানতে ওরা অনুসরণ করছে আমাদের? কমান

‘নিশ্চিত ছিলাম না।’

স্টিফেন এসে পড়ল এর মধ্যে। দুটো ব্যাগ নিয়ে টলমল পায়ে হাঁটছে ও মেয়েরা সহ অন্যদের অবস্থাও তথৈবচ।

খুব আস্তে আস্তে এগোল ওরা। মেলোডিকে হাঁটতে সাহায্য করছে সাওলো, একহাতে ওর বাহু আঁকড়ে রেখে মাঝে-মধ্যে অ্যাপাচিদের অগ্রগতির দিকে লক্ষ রাখছে। ধূলির মেঘ আচমকা ছেঁড়াখোঁড়া হয়ে ছড়িয়ে- ছিটিয়ে পড়ছে চারদিকে, এগিয়ে আসছে দ্রুত।

‘আমরা পারব না।‘ হোঁচট খেল মেলোডি, পড়ে যাচ্ছিল, টেনে ধরে ওর পতন রোধ করল সাওলো। তুমি পালাও,’ ফিসফিস করল মেলোডি ‘তোমার তো ঘোড়া আছে। তুমি কেন থাকছ? তুমি তো চলে যেতে পারো।’

‘হয়তো। কিন্তু আমি যাচ্ছি না,’ নিজের মত ব্যক্ত করল সাওলো।

‘কেন? তোমার তো ঋণ নেই আমাদের কাছে!’

শেষপর্যন্ত পাথরের কাছে গিয়ে পৌছতে পারল ওরা। কিন্তু অ্যাপাচিরাও অনেকটা কাছে এসে পড়েছে। ঘোড়ার পিঠে উপুড় হয়ে প্রায় শুয়ে পড়েছে ওরা, আড়াল থেকে ঘোড়া ছুটিয়ে খোলা জায়গায় এসে পড়ল। তাদের শিকার ঠিক তাদের সামনেই, সম্পূর্ণ অরক্ষিত অবস্থায়।

একহাতে মেলোডির বাহু খামচে ধরে রেখেছে সাওলো, অন্যহাতে ঘোড়াদুটো টেনে নিচ্ছে। সঙ্গীদের নিয়ে পাথরের মধ্যে দিয়ে ছুটল। ইতোমধ্যে স্যাডল থেকে রাইফেলগুলো বের করে প্রত্যেকের হাতে গছিয়ে দিয়েছে একটা করে।

পাথরের ভেতর ঢুকে পড়েছে অ্যাপাচিরাও। আড়াল দেখে দেখে পজিশন নিল। দু’একটা ফায়ারও করল এদিক-সেদিক। শুক

ওয়াল্টার ঘুরে দাঁড়াল, একহাঁটুর ওপর বসে পড়ল পিস্তল হাতে। গুলি করল কয়েকবার। হাবও এসে গেল ওর পাশে বসল। গর্জন করে উঠল ওয়াল্টার, ‘সর্ এখান থেকে, শালা কেলো ভূত! এদিকে আমি আছি।’ দা নিজের হাতের রাইফেলটার দিকে অসহায়ভাবে তাকাল হাব; সরে পড়ল ওখান থেকে। তারপর দৌড় লাগাল অন্যদের পেছনে।

একটু ইতস্তত করল স্টিফেন। ব্যাগদুটো একপাশে রেখে দিয়ে ওয়ান্টারের পাশে চলে এল। ওর দিকে এক নজর তাকাল ওয়াল্টার দু’জনে মিলে এক নাগাড়ে গুলি বর্ষণ করতে শুরু করল। বাকিদের কাভার দিচ্ছে ওরা। সাওলো মেলোডিকে এবং ইয়েটস ম্যাগিকে ছুটতে সাহায্য করছে; হাব ছুটছে ওদের পেছনে পেছনে।

এক জুলী অ্যাপাচিদের ছুটোছুটি বন্ধ হয়ে গেছে।

ওয়াল্টার আর স্টিফেন পিছিয়ে এসে অন্যদের অনুসরণ করল।

পরিস্থিতির উন্নতি ঘটেনি। আচমকা অ্যাপাচিরা দু’দলে বিভক্ত হয়ে গেল। একহাতে ঘোড়ার পাঁজর আঁকড়ে ধরে নিচু হয়ে অপর হাতে গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে বেরিয়ে এল ওরা, পরমুহূর্তে বোল্ডারের ফাঁকে ছড়িয়ে পড়তে লাগল।

ওদের উদ্দেশ্য পরিষ্কার সাওলোর কাছে। ওরা তাদের ট্যাংকস আর ওদের মাঝখানে পেতে চায়। এরপর সাঁড়াশি আক্রমণ চালাবে দু’দল দু’দিকে থেকে, গুলিতে ঝাঁঝরা করে দেবে। বোল্ডারের যৎসামান্য প্রতিবন্ধকতায় দু’মিনিটও টিকতে পারবে না সাওলোরা।

দাঁড়িয়ে পড়ল সাওলো। হাত নেড়ে সঙ্গীদের যেখানে আছে, সেখানে থেমে পড়ার সঙ্কেত দিতে গেল। আচমকা একজন অ্যাপাচি যোদ্ধা আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে ট্যাংকসের দিকে ঘোড়া ছোটাল, পর মুহূর্তে একটা গুলির শব্দ শোনা গেল এবং ট্যাংকসমুখী অ্যাপাচির ঘোড়াটা যেন হোঁচট খেয়ে আরোহীসহ হুড়মুড় করে মাটিতে পড়ে গেল। ভূপাতিত আরোহী উঠে খিঁচে দৌড় লাগাল আড়ালের জন্যে, আরেকটা গুলি এসে শুইয়ে দিল ওকেও। পর মুহূর্তে চারদিক থেকে প্রচণ্ড গোলাগুলি শুরু হয়ে গেল।

দুটো গুলি একই উৎস থেকে এসেছে, বুঝতে পারল সাওলো। কিন্তু ঠিক কোনদিক থেকে এসেছে, সেটা বুঝতে পারল না। তবে ট্যাংকসের দিকের বাতাসে হালকা ধুলো ও ধোঁয়ার আভাস দেখে বুঝতে দেরি হলো না, গুলিদুটো ওদিক থেকে এসেছে।

ওদিকে কেউ আছে—এবং সম্ভবত বন্ধুভাবাপন্ন। অ্যাপাচিদের দিকে গুলি ছুঁড়ছে ও। এরকম কিছুর আশা করেনি অ্যাপাচিরা। লোকটার পরবর্তী গুলি এসে আরেকটা পনিকে বিদ্ধ করল পরের গুলিতে ওটার ধাবমান মালিককেও।

দু’দিক থেকে গুলির মাঝখানে পড়ে গেল অ্যাপাচি যোদ্ধারা। প্রমাদ গুনল ওদের দলপতি; সাওলো ওর কর্কশ গলা শুনতে পেল। কুরিয়াপো চিৎকার করে নিজের লোকদের পিছু হটার নির্দেশ দিচ্ছে।

একটা পাথরের গা ঘেঁষে বসল সাওলো, শার্পসটা কক করল। অ্যাপাচিদের পনিগুলোর খুরের দাপটে ধুলো উড়ছে চারদিকে। ধুলোর প্রকোপে দৃষ্টি অস্পষ্ট হয়ে গেছে। কুরিয়াপোকে টার্গেট করার চেষ্টা করল সে, কিন্তু স্পষ্ট করে চিনে উঠতে পারছে না।

গুলির শব্দ, ঘোড়াগুলোর চেঁচামেচি, তাদের খুরের আওয়াজ—সবকিছু মিলে জায়গাটাকে নরক সমতুল্য করে তুলল। ট্যাংকসের দিক থেকে আরেকবার গুলির শব্দ শোনা গেল। আরেকজন অ্যাপাচিকে নিচে গড়িয়ে পড়তে দেখল সাওলো। কুরিয়াপোকে চেনার চেষ্টা চালাচ্ছে ও দৃষ্টিকে যথাসম্ভব তীক্ষ্ণ করে তুলে। কিন্তু ধুলোর চাদর আরও মোটা হয়ে উঠল ওর ‘চোখে। একজন যোদ্ধা নয়, তার ছায়াকে নড়াচড়া করতে দেখল সাওলো। আচমকা পেছনে ঝাঁপ দিল ছায়াটি। ছুটল প্রাণপণে। তার পেছনে ছুটল আরও কিছু ছায়া, নিমেষে হারিয়ে গেল ধুলোর মেঘ আর পাথরের আড়ালে।

ট্যাংকসের পথ এখন মুক্ত।

হাত ধরে মেলোডিকে প্রায় টেনে নিয়ে চলল ও। অন্যেরা ওর পিছু নিল। ওয়াল্টার আর স্টিফেন মাঝে মাঝে অ্যাপাচিরা যেদিকে অবস্থান করছিল, সেদিকে গুলি পাঠাতে লাগল।

ব্যাসল্টের পেছন থেকে বেরিয়ে এল একটা লোক। সামনে এগিয়ে এসে একটা পাথরের ওপর দাঁড়াল। হাতের রাইফেলটা মাথার ওপর তুলে নাড়াতে লাগল সে। তারপর পাথর থেকে নেমে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগল।

তৃষ্ণার্ত ঘোড়াগুলো পানির গন্ধ পেয়ে চঞ্চল হয়ে উঠল। গতি বাড়িয়ে দিল ওরা। একটা অগভীর অ্যারোয়ো ধরে এগোল জন্তুগুলো ট্যাংকসের দিকে।

লোকটার আরও কাছে পৌছল যাত্রীরা। ওর চেহারা এখন স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। অস্ফুটস্বরে বিস্ময় প্রকাশ করল ইয়েটস, ‘আরে! এ যে দেখছি জিমি গ্যানো!’

‘কে ও?’ সাওলো জানতে চাইল।

‘আলাপ্টার ডেপুটি শেরিফ।’

‘জায়গাটা চিনি। ওখানকার খনিগুলোয় মেক্সিকানরা কাজ করে।’

‘ঠিক তাই। কিন্তু অবাক লাগছে, এতটা দক্ষিণে কেন ও?’

অ্যারোয়োর পাড়ে গিয়ে পৌঁছল ওরা। জিমি গ্যানো ওদের অ্যারোয়োর ভেতরে নিয়ে চলল। পানির মূল উৎস প্রায় বর্গাকার, অ্যারোয়োর ঠিক মধ্যভাগে। তিন থেকে চার ফুট গভীর পানি, লাভার দেয়ালের ছায়ায় ঢাকা। অ্যারোয়োর ওপর দিকে শেষ মাথায় সঙ্কীর্ণ দেয়ালের ওপাশে আরেকটা উৎস। তুলনামূলকভাবে কিছুটা ছোট ওটা; মেইন ট্যাংকের নিচের দিকে, যেখানে অ্যারোয়োর দেয়াল অধিকতর চওড়া ও ছোটবড় নানা ধরনের পাথরে ভরা, সেখানে আরেকটি উৎস।

‘কী খবর, জিমি?’

‘পার্ক! নিশ্চয় স্টেজটা হারিয়েছ তুমি?

‘গতকাল,’ স্বীকার করল ইয়েটস। ‘পরিচয় করে দিচ্ছি, ও সাওলো স্টেইভ—আর সাওলো, এর নাম তো আগেই বলেছি। না?’

মোটাসোটা গড়নের ছোটখাট মানুষ গ্যানো। বয়স চল্লিশ থেকে পঁয়তাল্লিশের মধ্যে হবে। গামলা আকৃতির ভুঁড়ির আভাস পেটে, নাকের নিচে কালচে ধূসর গোঁফ, মাথা গোলাকার, দু’চোখ বিষণ্ন। পরনে ভাজভাঙা কালো ধূলিধূসরিত স্যুট। কিছুটা উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছে ওকে, হাতের কাজটা ঠিকমত উপভোগ করতে পারছে না- এমন একটা ভাব মুখে। তবে সব কিছু মিলিয়ে একজন ভাল লোক ও দক্ষও, ভাবল সাওলো।

ইতোমধ্যে পানি খেয়ে মোটামুটি সুস্থির হয়েছে সবাই। ইয়েটস ওদের সঙ্গে গ্যানোর পরিচয় করিয়ে দিল। গ্যানো টুপি খুলে সম্মান দেখাল মেয়েদের।

‘ম্যান, ইয়েটস ওকে বলল। ‘অনেকদূর এসে পড়েছ তুমি। আলাপ্টায় যেতে এদিকে আসার দরকার নেই। বোলো না যেন পথ হারিয়েছ। এদিকে অ্যাপাচিদের উৎপাতের কথা শোনোনি? কুরিয়াপোর নেতৃত্বে ক্ষ্যাপা মোষের মত দাবড়ে বেড়াচ্ছে। তছনছ করে দিচ্ছে সব কিছু।’

‘কুরিয়াপো!’ অবাক হলো গ্যানো। ‘ও না শুনেছিলাম রিজার্ভেশনে!’

‘ভুল শোনোনি। কিন্তু মাত্র দিন পাঁচেক আগে ওখান থেকে পালিয়েছে ও। তারপর সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে নরক গুলজার করতে করতে দক্ষিণে চলে এসেছে। আমাদের সাথে ট্যুবাক আর সিলভারটনের মাঝামাঝি জায়গায় মোলাকাত হয়েছিল। সবগুলো ঘোড়া হারিয়ে পায়ে হেঁটে পালিয়েছি আমরা। সঙ্গে পানি ছিল না আমাদের। পরে সাওলোর সাথে দেখা হলে ও আমাদের এদিকে নিয়ে আসে। কিন্তু অবাক হচ্ছি কুরিয়াপোর পালানোর খবরটা পাওনি বলে।’

কাঁধ ঝাঁকাল জিমি গ্যানো। আলাপ্টা অনেক দূরের পথ, পার্ক। তুমি তা জানো। পাহাড়ের ভেতর। দু’সপ্তাহে একটিমাত্র সাপ্লাই ট্রেন ওখানে খাবার নিয়ে যায়। ওদিকে মানুষজন একদম যায় না বললেই চলে।’

‘তাই হবে। কিন্তু এত দূরে কি করে এলে?’

সামনে এগোল গ্যানো। ওরা ওকে অনুসরণ করল। সামান্য দূরে, একটা পাথুরে ঢালে গিয়ে পৌছল। ওখানে ক্যাম্প করেছে গ্যানো। একজন লোক শুয়ে আছে ক্যাম্পে ওদের দিকে পাশ ফিরে। ওর হাতে হ্যান্ডকাফ। পিছমোড়া করে বাঁধা। মাথায় পরা বিরাট সমব্রেরোটা মুখ ঢেকে রেখেছে ওর। লোকটা ঘুমুচ্ছে সম্ভবত, তা না হলে চুপচাপ বিশ্রাম নিচ্ছে।

‘ওর জন্যে আসতে হয়েছে,’ ইশারায় লোকটাকে দেখিয়ে বিরসকণ্ঠে জবাব দিল গ্যানো।

কার ঘোঁৎ করে উঠল পার্ক ইয়েটস, ‘কে ও, বলো তো?’

ওয়েটিনো অ্যাম্বারগো। আমার অফিসের পে-রোল সেফ লুট করে পালাতে গিয়েছিল, কিন্তু ছোট্ট একটা ভুলের জন্যে আবার আমার সঙ্গে ফিরতে হচ্ছে।

‘কোথায়? ট্যুবাক?’

‘ওখানেই তো সবকিছু। কাউন্টি অফিস, শেরিফ, জাজও। আর আমি তো স্রেফ ডেপুটি শেরিফ, আলাপ্টায় তাই কেউ যেতে চাইবে না। এদিকে অ্যাম্বারগো হলো মহাবজ্জাত। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওকে ট্যুবাকে নিয়ে যাওয়া দরকার। আলাপ্টার রাস্তা সম্পর্কে তুমি নিজেও আমার চেয়ে কম জানো না। নরকে যাবার রাস্তাটাও সম্ভবত অত খারাপ নয়। কখনও পাহাড়ে উঠেছে, কখনও নেমে গেছে পাতালে। মূল রাস্তা ছেড়ে তাই শর্টকার্ট করার জন্যে এদিকে এসেছি। ভেবেছিলাম এখান দিয়ে স্টেজকোচ পাওয়া যাবে। কিন্তু স্টেজের নাম-ঠিকানাও নেই। কেন, বলো তো?’

‘স্টেজকোচ কর্তৃপক্ষ আপাতত লাইন বন্ধ রেখেছে। আমি বিশেষ ট্রিপে যাচ্ছিলাম।’

মাটিতে শুয়ে থাকা লোকটি আস্তে আস্তে উঠে বসল। কাজটি করতে প্রচুর পরিশ্রম হলো ওর। বসে হাঁফাতে লাগল।

অ্যাম্বারগো লোকটা লম্বা, দাঁড়ালে ছয় ফুটের ওপর আরও তিন-চার ইঞ্চি হবে। নড়াচড়া করার সময় মনে হয় বুনো বেড়াল হাঁটছে কিংবা বিশাল বাদামী এক র‍্যাটলার ফণা তুলে দুলছে। রোদে পুড়ে গায়ের চামড়া পোড়ামাটির মত রঙ ধরেছে।

বয়স ত্রিশের বেশি হবে না, কিন্তু এর মধ্যেই বুড়োটে দেখাচ্ছে লোকটাকে। দু’চোখের কোণে অসংখ্য ভাঁজ, দেখে মনে হয়, চল্লিশ থেকে পঁয়তাল্লিশ বছর হবে বয়স। আগেকালের স্প্যানিশদের মত বরফ শীতল চোখ; চামড়ার তৈরি পোশাক পরেছে—সমব্রেরো, জ্যাকেট এবং টাইট ট্রাউজার।

‘বুয়েনস দিয়াস,’ শুভেচ্ছা জানাল লোকটি। আমার তরে মা

মাথা নাড়ল ইয়েটস, গ্যানোর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমাদের পরবর্তী কর্মপন্থা ঠিক করে নেয়া উচিত। এত কিছুর পর মনে হয় না, কুরিয়াপো আমাদের ছেড়ে কথা বলবে।’ একটু থেমে বলল, ‘স্টেইভ অ্যাপাচিদের ব্যাপার ভাল বোঝে। ও আমাদের এতদূর নিয়ে এসেছে। এর পরের ব্যাপারটাও ওর ওপর ছেড়ে দেয়া উচিত। অবশ্য তোমাদের সবার মতামত সাপেক্ষে। কারি

‘হাহ্!’ হাসল অ্যাম্বারগো। সাওলোকে খুঁটিয়ে দেখছে ও, অ্যাপাচিদের সম্বন্ধে অবশ্যই জানবে ও। ও নিজেই তো…’

‘চুপ করো তুমি!’ ধমকে উঠল গ্যানো। তোমার স্প্যানিশ অহঙ্কারের ফুটো পয়সা দামও নেই আমার কাছে। ওর বিষণ্ন দৃষ্টি সাওলোর দিকে ঘুরল। ‘তুমি যদি অ্যাপাচি সম্পর্কে জানো আর পার্ক ইয়েটস তোমায় বিশ্বাস করে, তা-ই যথেষ্ট। আমরা তোমার পেছনে আছি।’

হাসল সাওলো, নড করল। ডেপুটি শেরিফকে ভাল লেগেছে ওর।

‘ধন্যবাদ।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *