জ্বালা – ২

দুই

উপুড় হয়ে শুয়ে আছে সাওলো মেস্কিট ঝোপের আড়ালে। হাতের ফিল্ডগ্লাসটা দূরে অ্যাপাচি ক্যাম্পের ওপর স্থির করল। চারজন অ্যাপাচি বিশ্রাম নিচ্ছে মাটিতে শুয়ে, কথা বলছে নিজেদের মধ্যে জার্কি চিবুতে চিবুতে। যত্নের সাথে একে একে প্রত্যেকের মুখের ওপর ফিল্ডগ্লাস স্থির করল ও। একজনকে চিনতে পারল। নাবুতো—ওর বাল্যবন্ধু। বাকি তিনজন অপরিচিত, জারিপো পরিবারের কেউ নয় ওরা।

ফিল্ডগ্লাসটা এবার মেয়েটার ওপর স্থির করল ও। মুখ বুজে কাজ করছে ম্যাগি। এখান থেকে, ওখান থেকে লাকড়ি কুড়িয়ে এনে অগ্নিকুণ্ডে ফেলছে। খোঁড়াচ্ছে ও, এক হাতা লাকড়ি এনে আগুনের পাশে রাখল।

শোয়া থেকে লাফিয়ে উঠল এক অ্যাপাচি, এক লাফে মেয়েটার কাছে পৌছে গেল। ডান হাতটা ঘুরিয়ে এনে প্রচণ্ড এক চড় কষাল ওর গালে- তারপর প্রায় আধমিনিট ধরে তালিম দিল সম্ভবত কিভাবে আগুনে লাকড়ি ফেলতে হয় আর কি করে আগুনকে ধোঁয়াবিহীন রাখতে হয়। আরেকটা চড় কষাল ও মেয়েটার অপর গালে, তারপর বীরদর্পে সঙ্গীদের কাছে ফিরে গেল। ওর সঙ্গীরা হাসছে, কাজটা সন্তুষ্ট করেছে ওদের। অতদূর থেকেও, ওদের ভাব-ভঙ্গিতে সাওলোর তা বুঝতে মোটেই কষ্ট হলো না।

সকালে ঘুম থেকে উঠে ওদের অনুসরণ করতে শুরু করেছিল ও। আয়রন উড, মেস্কিট, পালো ভার্দে আর ক্যাটক্ল’-এর ঝরাপাতার নিচে ওদের ট্রেইল ঢেকে গেলেও খুঁজে পেতে বিন্দুমাত্র বেগ পেতে হয়নি ওকে। অবশ্য শ্বেতাঙ্গদের জন্যে এটা প্রায় অসম্ভব একটা ব্যাপার। কিন্তু সাওলো পুরো শ্বেতাঙ্গ নয়, বাবার দিক থেকে ইন্ডিয়ান রক্ত বইছে ওর শরীরে, তাছাড়া ও বড় হয়েছে অ্যাপাচিদের সাথে, সুতরাং অ্যাপাচিগুলোকে ট্রেইল করতে গিয়ে এক মিনিটের জন্যেও বিভ্রান্ত হতে হয়নি ওকে—এবং তার ফলে এখন অ্যাপাচিদের ক্যাম্পের কাছে একটা জায়গায় বসে ওদের ওপর নজর রাখছে সে।

ট্র্যাক লুকোনোর চিন্তাও অ্যাপাচিদের মাথায় আসেনি। আর্মিরা যে অনুসরণ করছে না এটা জানা ছিল ওদের। আর আর্মি ছাড়া অন্য কেউ পেছনে লাগতে পারে, এটাও ওরা ভাবেনি। ফলে সামনে এগিয়েছে নির্ভাবনায়। বন্দীকে নিয়ে সারাদিন পুবে গেছে ওরা, একবারও দিক পরিবর্তন করেনি। একটানা চলা ওদের ভেতর ক্রমশ একঘেয়েমির জন্ম দিয়েছে। সাথের বন্দীটি যদি মেয়ে না-হয়ে পুরুষ হত, তাহলেও হয়তো কিছুটা উত্তেজনার খোরাক পেত দলটি। কিন্তু স্রেফ জৈবিক আকর্ষণ ছাড়া ওর প্রতি বাড়তি কোনও আগ্রহ নেই ওদের। ফলে দুপুরের দিকে ঘোড়ার রাশ টেনে নিশ্চিন্তে বিশ্রামের আয়োজন করেছে। সাওলো অনুমান করল, বিশ্রামের ফাঁকে ওরা ওদের আগামী কর্মকাণ্ড নিয়েও আলাপ-আলোচনা করবে।

ওদের সঙ্গে কুরিয়াপো নেই। ওরা সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না এরপর ওর সাথে মিলিত হবে নাকি শাদা মানুষ শিকার করার কাজটা আরও কিছুদিন চালিয়ে যাবে।

হডসনের সাথে দেখা হবার আগে পর্যন্ত চারজনের এ দলটির প্রতি বিশেষ কোন আগ্রহ ছিল না সাওলোর। সে ওদের পিছু নিয়েছিল স্রেফ কুরিয়াপোর কাছে পৌঁছানোর জন্যে। কুরিয়াপো যে ওদের মধ্যে নেই, সেটা ও ট্র্যাকিংয়ের শুরু থেকেই বুঝতে পেরেছিল। এ দলটির সঙ্গে লাগতে যেত না সে—বরং কুরিয়াপোর খোঁজে এদের অজান্তে এদের সাহায্যই নিত।

কিন্তু এখন পরিস্থিতি ভিন্ন। হডসনকে কথা দিয়েছে সে ওর মেয়েকে অ্যাপাচিদের হাত থেকে উদ্ধার করবে বলে। এর মানে কিন্তু এও নয় যে, মেয়েটির জন্যে ওর ভেতর আলাদা কোন অনুভূতি জেগেছে। বরং মেয়েটি শ্বেতাঙ্গ না হয়ে মেক্সিকান কিংবা ইন্ডিয়ান হলে এর চেয়ে অনেক বেশি সহানুভূতি থাকত ওর। এদিকে ধর্ষণ বা ধর্ষণের পরে হত্যা—এসবের হোতাদের প্রতিও তেমন কোন বিদ্বেষভাব বা ক্রোধ নেই ওর ভেতর। ওই ব্যাপারটা উভয় ক্ষেত্রেই সমান। শাদা সৈন্যরাও একই ব্যাপার ঘটিয়ে থাকে ইন্ডিয়ান গ্রাম আক্রমণ করে দখল করে নেবার পর। ওরাও নির্বিচারে গুলি চালিয়ে হত্যা করে ইন্ডিয়ানদের, টেনে হিচড়ে জঙ্গলে নিয়ে যায় ওদের বউ- ঝিদের। সাওলো ক্ষোভের সাথে লক্ষ করেছে, শাদা মেয়েদের ওপর ইন্ডিয়ানদের ওই ধরনের হামলার সমালোচনা শাদা মানুষদের মুখে প্রচুর শোনা গেলেও ইন্ডিয়ান মেয়েদের ক্ষেত্রে একই ঘটনায় তাদের মুখে স্রেফ কুলুপ আঁটা থাকে।

ফিল্ডগ্লাসের সাহায্যে হডসনের মেয়েকে গভীরভাবে লক্ষ করেছে ও। মারধরের কারণে গায়ে কালশিরে পড়া এবং খুঁড়িয়ে হাঁটা বাদে ঠিকই আছে ম্যাগি। একেবারে প্রথম দিকে, ইন্ডিয়ান হামলার পর পর যা ঘটেছে, ওটাকে আমলে না এনে ভাবলে মনেই হবে না যে, শারীরিক ক্ষতির কারণ হতে পারে এমন কোন কষ্ট ওকে ভোগ করতে হয়েছে।

তবে ম্যাগির জীবনটা দুলছে সূক্ষ্ম সুতোর সাথে। যে কোন মুহূর্তে মারা যেতে পারে ও। ওকে মেরে ফেলা বা জ্যান্ত রাখার ব্যাপারটা এই চারজন অ্যাপাচির মর্জির ওপর নির্ভরশীল। আবার আরও অনেক দিন বেঁচে থাকতে পারে মেয়েটা। সেটাই আশার কথা। হডসনের মেয়েকে ইন্ডিয়ানদের হাত থেকে উদ্ধার করার ব্যাপারে ওকে দেয়া প্রতিশ্রুতি পালনে সাওলো বদ্ধপরিকর। ওর এখন একমাত্র লক্ষ্য, ম্যাগিকে ইন্ডিয়ানদের হাত থেকে জীবিত উদ্ধার করা। এজন্যে হয়তো ওদের মেরেই ফেলতে হবে। এর ফলে কুরিয়াপোকে খুঁজে পাবার সুযোগটা ওকে হারাতে হবে। হোক। তবু সে প্রতিশ্রুতি পালন করবে।

সাপের মত নিঃশব্দে বুকে হাঁটতে শুরু করল ও। জঙ্গলের ভেতর দিয়ে রিজের কানায় এসে থামল। সন্তর্পণে উঠে দাঁড়াল। তারপর বিড়ালের মত নিঃশব্দ পায়ে নেমে গেল রিজ বেয়ে; অর্ধবৃত্তাকারে ঘুরে পেছনে একটু দূরে বেঁধে রাখা ঘোড়ার কাছে গিয়ে পৌঁছল।

সূর্য এখন আরও নিচে নেমে এসেছে। পাহাড়ের সবুজ-নীল গায়ে বিকেলের আলো-ছায়া। এবড়োখেবড়ো পাথরে প্রতিফলিত হচ্ছে ক্রমশ লালচে হয়ে আসা আলো। একটা রিজে চড়ে উপত্যকায় অ্যাপাচিদের ক্যাম্পটা আবিষ্কার করেছিল সাওলো। ওখান থেকে একদম কাছে ছিল ক্যাম্পটা। কিন্তু সূর্যও ছিল ওর সামনে। ফলে ফিল্ডগ্লাসে সূর্যের আলো প্রতিফলিত হয়ে চতুর অ্যাপাচিদের কাছে ওর উপস্থিতি ফাঁস হয়ে যাবার ভয়ে ঝুঁকি নেয়নি ও। ধৈর্যের সাথে অনেকটা পথ ঘুরে বিপরীত দিকের রিজটার ওপরে গিয়ে ওঠে। তারপর নিশ্চিন্তে ফিল্ডগ্লাস চোখে লাগিয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে ওদের ওপর নজর বুলোতে শুরু করে।

আগের রিজটার উদ্দেশে যাত্রা করল সাওলো। ওখান থেকে অ্যাপাচি ক্যাম্পের দূরত্ব অর্ধেকেরও কম। সাওলো জানে, শত্রুর যত কাছে যাওয়া যায়, শত্রুকে ঘায়েল করাও তত সহজ ও নিশ্চিত হয়।

আক্রমণ করার আগে যতটা সম্ভব অ্যাপাচিদের কাছাকাছি পৌঁছার পরিকল্পনা করল ও। এ ছাড়াও আরও কিছু পরিকল্পনা খতিয়ে দেখল। কোনওটাই শেষ পর্যন্ত মনে ধরল না। ও জানে, ওর প্রতিপক্ষ অ্যাপাচি। শাদা মানুষ হলে অতটা ভাবার দরকার হত না। রাত হওয়া পর্যন্ত চুপচাপ বসে থেকে অন্ধকারে ক্যাম্পে পৌঁছে চুপি চুপি ওদের ঘোড়াগুলোকে খেদিয়ে দিলেই হত। বিভ্রান্ত শাদা মানুষদের মধ্যে নিঃসন্দেহে হৈ-চৈ পড়ে যেত। চারদিকে ছুটোছুটি শুরু করত ওরা। এই ফাঁকে মেয়েটাকে নির্বিঘ্নে চুরি করে নিয়ে আসতে পারত সে। বিনা রক্তপাতে কাজটা সারা যেত—এবং সেটা মেয়েটার জন্যেও ঝুঁকিপূর্ণ হোত না। কিন্তু অভিজ্ঞতা থেকেই জানে সাওলো, অ্যাপাচিদের সাথে ওসব ধানাইপানাই চলবে না; এই ধরনের পদক্ষেপ স্রেফ আত্মহত্যার সামিল হবে।

বর্তমান পরিকল্পনাটাকেও পুরোপুরি নিশ্ছিদ্র বলা যাবে না হয়তো। এতে অ্যাপাচিদের তিনজনকেই মেরে ফেলতে হবে; কপাল ভাল হলে হয়তো দু’জনকে মারলেও চলবে। তবে বিনা রক্তপাতে মেয়েটাকে উদ্ধার করা সম্ভব হবে না। তাছাড়া ওর নিজের মারা যাবার আশঙ্কাও থাকে এতে। আবার এমনও হতে পারে, আক্রান্ত হয়ে অ্যাপাচিরা প্রথমেই মেয়েটাকে মেরে ফেলতে চাইবে। জীবিত হারাতে চাইবে না ওকে।

স্যাডল ব্যাগ থেকে মোকাসিনজোড়া বের করল ও। বুট খুলে ওগুলো পরল। স্ক্যাবার্ড থেকে শার্পসটা বের করে যত্নের সাথে গুলি ভর্তি আছে কি না চেক করল। সীসে আর পেতলে তৈরি চার গুলির পুরানো বাফেলো গান। অস্ত্র হিসেবে ভয়ঙ্কর। কুরিয়াপোর ওপর প্রতিশোধ মিশনটা শেষ করার জন্যে এক বন্ধুর কাছ থেকে ধার করে এনেছে সে ওটা।

একটা অনুচ্চ রিজে উঠে হাঁটতে শুরু করল সে। চারদিকে ছড়ানো- ছিটানো পাথর আর আগাছার ঘন জঙ্গলের ভেতর দিয়ে পথ করে নিতে হচ্ছে। চলতে চলতে একটা চোখ রাখছে অ্যাপাচি ক্যাম্পের ওপর। রিজের নিচে ক্যাম্প এবং ওপরে ওর মধ্যেকার প্রতিটি জিনিসের ওপর আরেকটা চোখ বুলোচ্ছে। সতর্ক থাকতে হচ্ছে বিশ্রামরত অ্যাপাচিদের চোখে না পড়ে যাবার ব্যাপারেও।

দ্রুত হাঁটার তাগিদ বোধ করছে—কিন্তু গতি বাড়াতে পারছে না ও এবড়োখেবড়ো পাথুরে পথ বেয়ে জঙ্গলাকীর্ণ পথটুকু পেরোতে প্রচুর সময় লাগছে।

এক সময় রিজের ঢাল বেয়ে নামতে শুরু করল, উপত্যকা-মেঝেয় এসে দাঁড়াল অল্পায়াসেই।

এবড়োখেবড়ো উপত্যকা, অসমতল। বিশালাকার পাথর খণ্ড চারপাশে ছড়ানো-ছিটানো; মেস্কিটের নিবিড় ঝোপ।

ক্যাম্পের যতটা সম্ভব কাছে চলে এল সাওলো। ফিল্ডগ্লাস হাতে পর্যবেক্ষণ করার সময় এক জায়গায় দুটি পাথর চাঁইকে মনে মনে চিনে রেখেছিল। দুটি পাথর প্রায় গা ঘেঁষাঘেঁষি অবস্থায় পড়ে আছে। পাথর দুটোর মাঝখানের সামান্য ফাঁক বরাবর গিয়ে দাঁড়াল ও, টুপি খুলে একপাশে রাখল, তারপর আস্তে আস্তে মাথা উঁচিয়ে অ্যাপাচি ক্যাম্পের অবস্থা দেখার চেষ্টা করল।

পুরো ক্যাম্পটাকে পরিষ্কার দেখতে পেল ও। ইন্ডিয়ানদের ঘোড়াগুলো একপাশে বাঁধা। চারটে পনি, সাওলো লক্ষ করল, বাকি একটি টীমহর্স। হডসনের একটি ছাড়া বাকি সবগুলো ঘোড়া ওরা মেরে ফেলেছে; জীবিত ঘোড়াটা রেখে দিয়েছে মেয়েটার জন্যে।

এক নজরে পুরো অবস্থাটা মাথায় গেঁথে নিল সে। পরিস্থিতি বিবেচনা করছে। গুলি-গোলা শুরু হলে অ্যাপচিরা কী করে বসতে পারে? ওরা কি আগে ঘোড়ার দিকে ছুটবে? মনে হয় না। পায়ে-হাঁটা মানুষের চেয়ে ঘোড়ার পিঠে-চড়া মানুষ সহজ টার্গেট, ওরা তা জানে। ওদের ক্যাম্পের চারপাশে প্রচুর ঝোপঝাড় রয়েছে। একটু বুদ্ধি খরচ করলে ঘোড়াগুলোর দিকে ফিরেও চাইবে না তারা; আক্রান্ত হওয়ামাত্র ঝোপেঝাড়ে গা ঢাকা দিয়ে আক্রমণকারীর মোকাবেলা করবে।

নাবুতোর সঙ্গে আরেকজন তরুণ অ্যাপাচি; পায়চারি করছে দু’জন ধীর পায়ে, কথা বলছে। মাঝে-মধ্যে একে অন্যের মুখোমুখি দাঁড়াচ্ছে, সম্ভবত বিতর্ক চলছে দু’জনের মধ্যে কোনও বিষয়ে; বাকিরা শুনছে। আগুনের পাশে মাথা নিচু করে মেয়েটা বসে আছে, আরও কাঠ গুঁজে দিচ্ছে ওখানে।

শাপসটা তুলল সাওলো, ধীরে-সুস্থে লক্ষ্য স্থির করল। নাবুতোকে টার্গেট করেছে ও। একমুহূর্ত ওর ওপর স্থির থাকল রাইফেলের নল। একটু ইতস্তত করল, তারপর বিশালদেহী অ্যাপাচির দিকে ঘোরাল নলটা। প্রচণ্ড শব্দে গর্জে উঠল পুরানো রাইফেল।

ধার-করা এ অস্ত্রটায় এর আগে আর গুলি ছোড়েনি ও। পুঞ্চাশ ক্যালিবারের গুলি লক্ষ্যের এক ইঞ্চি ওপর দিয়ে গেল। ফলে বুক সই করে ছোঁড়া হলেও গুলিটা অ্যাপাচির চিবুকে আঘাত হানল। খচ্চরের লাথি খেয়ে উল্টে যাবার মত করে চিৎ হয়ে পড়ল লোকটা।

গুলির শব্দ প্রতিধ্বনি ছড়াল চারদিকে। চমকে ওঠা পনিগুলোর মধ্যে হুড়োহুড়ি পড়ে গেল। আতঙ্কিত ঘোড়াগুলো একটা আরেকটার ঘাড়ে গিয়ে পড়ল।

ইন্ডিয়ান যোদ্ধারা নিজেদের স্বভাবানুযায়ী প্রবল বিস্ময়ে স্থির হয়ে গেল নিজ নিজ জায়গায়, যেন মাটির সাথে মিশে গেছে। এমন কিছু ঘুণাক্ষরেও আশা করেনি ওরা। এ-পর্যন্ত শুধু নিজেরাই হানা দিয়ে এসেছে; ট্রেনিং পেয়েছে লক্ষ্যের দিকে নিরবচ্ছিন্ন এগিয়ে যাবার, অন্যের লক্ষ্যে পরিণত হবার নয়। ফলে সাওলোর আক্রমণ ওদের কাছে এতই অপ্রত্যাশিত হলো যে, দীর্ঘ কয়েক মুহূর্ত, চৌকস যোদ্ধা হওয়া সত্ত্বেও, স্রেফ বেকুব বনে রইল ওরা।

অ্যাপাচিদের এই আপাতবিমূঢ় ভাবকে কাজে লাগাল সাওলো। এ- ফাঁকে তাজা গুলি ভরে নিতে গেল রাইফেলে।

আচমকা নড়ে উঠল এক অ্যাপাচি, নিজের রাইফেলের উদ্দেশে ঝাঁপ দিল। রাইফেলটা হাতে পেয়ে তিন-চার গড়ান দিয়ে চোখের নিমেষে জঙ্গলের ভেতর ঢুকে গেল। আরেকজন ঘোড়ার উদ্দেশে ছুটল। একটা গাছের সাথে ফসকা গেরোয় বাঁধা ছিল ঘোড়াটা। হ্যাঁচকা টানে রশিটা খুলে নিয়ে লাফ দিয়ে ওটার পিঠে চড়ল অ্যাপাচি, পাগলের মত পা দাবাল পেটে তড়িঘড়ি করে রিলোড শেষ করে অস্ত্র উঁচাল সাওলো। কিন্তু দেরি হয়ে গেছে। গাছ-পালার ফাঁকে অদৃশ্য হয়ে গেল ওর টার্গেট। চোখের কোণে নারুতোকে দেখল সে। চোখের পলকে ঘুরে গেল ওর অস্ত্রের নল। নাবুতোর হাতে খোলা ছুরি, মেয়েটির দিকে এগুচ্ছে ও।

গুলি ছুঁড়ল সাওলো। কিন্তু তাড়াহুড়োর ফলে লক্ষ্যভ্রষ্ট হলো কিছুটা। বুক সই করা গুলি এবার নিচু হয়ে নারুতোর হাঁটুতে গিয়ে বিঁধল। ঝাঁকুনি দিয়ে আগুনের পাশে পড়ল নারুতো। আগুন আর ছাইয়ের ওপর পাগলের মত গড়ান দিল। হাঁচড়ে পাঁচড়ে উঠে বসল, দু’হাত আর এক হাঁটু ব্যবহার করে অদ্ভুত ভঙ্গিতে কাছের ঝোপটার দিকে ছুটল, আহত হাঁটু ল্যাগব্যাগ করছে চলার দমকে। মৃদু হাসল সাগুলো; যেতে দিল ওকে বিনা বাধায়।

আগুনে দেবার জন্যে লাকড়ি নিয়ে আসছে মেয়েটা; এসব গোলা-গুলি ওর মধ্যে কোনও প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করছে কি না বোঝা যাচ্ছে না। মৃত অ্যাপাচিটার দিকে তাকাল সে। দাঁড়িয়ে রইল। হাত থেকে লাকড়ি খসে পড়ল পায়ের কাছে, লক্ষই করল না। আস্তে আস্তে বসে পড়ল ও, দু’হাঁটুর মধ্যে মুখ গুঁজল। রাইফেলে গুলি ভরতে ভরতে নিচু স্বরে কথা বলল সাওলো, ‘নোড়ো না, মেয়ে, একদম নোড়ো না। ওভাবেই বসে থাকো।

কিছু সময় কেটে গেল এরপর। একটু আগের গোলা-গুলির পর উপত্যকায় হঠাৎ নীরবতা নেমে এসেছে। নীরবতা প্রকট হয়ে উঠেছে। কান পেতে রইল সাওলো।

অ্যাপাচিদের দু’জন পালিয়েছে; একজন ঘোড়ার পিঠে, আরেকজন পায়ে হেঁটে। তাই বলে ওরা একদম পালিয়ে গেছে, ভুলেও অমন ভাবছে না সাওলো। আছে ওরা কোথাও ঘাপটি মেরে। আচমকা আক্রান্ত হয়ে সাময়িকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়লেও এতক্ষণে ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করার সুযোগ পাচ্ছে। নিশ্চয় গুলির উৎস খুঁজে পাবার চেষ্টা করছে। অবশ্য শত্রুর পরিচয় এবং সংখ্যা কত, জানে না ওরা। তবে গুলির শব্দ বিশ্লেষণ করলে সংখ্যা সম্পর্কে ধারণা পেয়ে যাবে অনায়াসে। কারণ দুটো গুলি একই উৎসকে নির্দেশ করবে। অতএব ফিরে আসবে ওরা নিঃশব্দে। সন্তর্পণে রিজ থেকে উপত্যকা সমতলে নেমে এল ও।

উপত্যকায় ছোট বড় আগাছার ঘন ঝোপ। ঝোপের ভেতর দিয়ে রাইফেল হাতে এগুলো সে। দু’পক্ষই সতর্ক এখন; আক্রমণোদ্যত। যথাসম্ভব খোলা জায়গা এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করছে সাওলো। নিজেকে অদৃশ্য শত্রুর সহজ টার্গেট হতে দিতে রাজি নয়।

উত্তর-দক্ষিণে ফিতার মত প্রলম্বিত মেস্কিট ঝোপের ভেতর দিয়ে প্রায় শ’খানেক ফুট গেল সে। আচমকা মেস্কিট ঝোপ ফুরিয়ে গেল। সামনের খোলা জায়গাটা বালুকাময়, পাথুরে; এখানে ওখানে দু’একটা ক্যাটক্ল’ ঝাড়। ফিতার শেষ মাথায় পৌঁছে অপেক্ষা করল খানিকক্ষণ। যতটা সম্ভব বাইরে চোখ বুলাল। কাউকে দেখা গেল না; কারও নড়াচড়ার আভাস কিংবা আওয়াজ পাওয়া গেল না।

আরও কিছু সময় ধৈর্য ধরল ও। ঝুঁকিটা নিতেই হবে,’ শোনাল নিজেকে।

বাকি পথটুকু প্রায় হামাগুড়ি দিল। আচমকা নিচু হয়ে দৌড় দিল সামনে আড়ালের উদ্দেশে।

বাম দিক থেকে রাইফেল গর্জে উঠল, ডাইভ দিল সাওলো মাটিতে। একটা আলগা পাথরে লাগল ওর রাইফেলের আগা, ছিটকে গেল ওটা হাত থেকে। গড়ান দিল সাওলো। একটু ইতস্তত করল, হস্তচ্যুত অস্ত্রটা তুলে আনার কথা ভাবল। কিন্তু পর পর দু’দুটো গুলি দু’পাশের আলগা পাথরের বি-ঙ শব্দ তুলতেই উৎসাহে ঠাণ্ডা পানি পড়ল ওর। তিন নম্বর গুলিটা পায়ের কাছে পড়তেই রাইফেল-উদ্ধারের আশা ত্যাগ করতে হলো। উবু হয়ে এঁকেবেঁকে সামনে এগোল সে, অপেক্ষাকৃত উঁচু পাথুরে জমিতে গিয়ে পড়ল, গা ঢাকা দিল পাথরের আড়ালে।

হোলস্টার থেকে ৪৫ অস্ত্রটা বের করে হাতে নিল সাওলো। অপেক্ষা করতে লাগল।

রাইফেল হারিয়ে নিজের অবস্থা বিচার করছে ও। দু’অ্যাপাচির দু’জনের কাছেই রাইফেল আছে। এবার আস্তে আস্তে যদি চেপে আসে ওরা দু’দিক থেকে, অবস্থা খারাপ হয়ে যাবে ওর। ৪৫ পিস্তল দিয়ে কিছুই করতে পারবে না রাইফেলের মোকাবেলায়। স্বস্তির বিষয় হলো, ওরা ওর রাইফেল হারানোর কথা নাও জানতে পারে।

‘উঁহু,’ মাথা নাড়ল সে, ‘সরে যেতে হবে এখান থেকে। নইলে…’

পাথরের আড়াল থেকে লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল সাওলো; খিঁচে দৌড় লাগাল কিছুদূর সামনে থেকে আবার শুরু হওয়া মেস্কিট ঝোপের দিকে গুলিবর্ষণকারী অদৃশ্য শত্রুকে লক্ষ্য ঠিক করার সুযোগ না দেবার জন্যে এঁকেবেঁকে দৌড়াচ্ছে সে পাথরের ফাঁকে ফাঁকে।

আচমকা ঘোড়ার খুরের শব্দের সাথে গুলির আওয়াজ শোনা গেল। ছুটন্ত অবস্থায় এক চোখের কোণায় এক অশ্বারোহীকে খোলা জায়গায় বেরিয়ে আসতে দেখা গেল। দ্রুত ছুটে আসছে ঘোড়া দু’পাঁজরে মালিকের দু’পায়ের রামগুঁতো খেতে খেতে। প্রচণ্ড দৌড়ের মধ্যে আচমকা ঘোড়ার গতি পরিবর্তন করল রাইফেলধারী অ্যাপাচি। সাওলোর সামনে চলে এল। ঘোড়ার চিঁহির সাথে গলা মিলিয়ে বুনো হুঙ্কার ছাড়ল ও।

গুলি করল সাওলো। মিস করল। ততক্ষণে অ্যাপাচি ওর সামনে চলে এসেছে। পিস্তল হোলস্টারে ঢুকিয়ে কাঁধ আর কোমর বাঁকিয়ে আচমকা লাফিয়ে উঠল ও ওপর দিকে। ধাবমান অশ্বারোহীর গায়ে গিয়ে পড়ল। ধরাশায়ী হলো অশ্বারোহী প্রচণ্ড ধাক্কায় টাল সামলাতে না পেরে। সাওলো নিজেও ওর ওপর গিয়ে পড়ল। পিছলে বেরিয়ে গেল সন্ত্রস্ত ঘোড়াটা। পাথরের সাথে গুঁতো লেগে রাইফেলটা হাতছাড়া হয়ে গেছে অ্যাপাচির।

পিস্তল বের করল সাওলো। অন্ধ আক্রোশে অ্যাপাচির পাঁজরে ঠেকাল সজোরে। তারপর ওটা খালি করল ওখানে। প্রতিটি বুলেটের ধাক্কায় কেঁপে কেঁপে উঠল সে; তারপর নিথর হয়ে গেল। ওর মুখের দিকে চাইল সাওলো। অ্যাপাচির মুখ পশ্চিম দিকে ফেরানো, অস্তগামী সূর্যের মান রশ্মি পড়েছে তাতে; মৃত্যুকালীন আক্ষেপে ভয়াবহ দেখাচ্ছে।

যেভাবে ছিল, সেভাবে পড়ে রইল ও কিছুক্ষণ, তারপর নড়ে উঠল আরেকজন আছে এখনও।

হঠাৎ নিজের অবস্থান সম্পর্কে সচেতন হলো সাওলো। একদম খোলা জায়গায় বাকি রাইফেলধারীর সহজ টার্গেট হয়ে বসে আছে সে। মেরুদণ্ড বেয়ে শীতল স্রোত নামল ওর। মৃদুস্বরে গাল বকল। বাকি অ্যাপাচিটা হয়তো এ মুহূর্তে রাইফেল তুলে ওর মাথা সই করছে। লাফ দিয়ে উঠে পড়ি কি মরি ছুটতে শুরু করল। সামনে কিছুটা যেতে পারলে জঙলা ঝোপের আড়াল পাওয়া যাবে, তবে তার আগে অক্ষত শরীরে সামনের খোলা জায়গাটা পেরোতে হবে।

সামান্য জায়গা। কিন্তু সাওলোর মনে হচ্ছে, অনন্ত কাল ধরে দৌড়াচ্ছে ও। প্রতিটি মুহূর্তে রাইফেলের গর্জন আশঙ্কা করছে। এক সময় জায়গাটা পেরোল। গুলি করেনি অ্যাপাচি।

ঝোপের ভেতর ঢুকে পড়ে হাঁফাতে হাঁফাতে পিস্তলে গুলি ভরল সে। অপেক্ষা করতে লাগল।

উত্তেজনা বোধ করছে সাওলো। চিন্তিতও। যে কোনও মুহূর্তে গুলি করতে পারত অ্যাপাচি। করেনি। তার মানে হয়তো ওর গুলি ফুরিয়েছে নয়তো কাজ করছে না রাইফেলের মেকানিজম। তবে তাতে,

স্বীকার করল সে মনে মনে, অবস্থার হেরফের তেমন হয়নি। অ্যাপাচিরা খালি হাতেও ভয়ঙ্কর। লড়তে পারে ওরা মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মেশিনের মত বিরামহীন, অক্লান্ত

পিস্তল হাতে আস্তে আস্তে মেস্কিট ঝোপের ভেতর দিয়ে সামনে এগোল সাওলো। একটা পাথুরে জায়গায় এসে থামল। সূর্য অস্ত যায়নি এখনও। উত্তপ্ত পাথর আর ঝোপ-ঝাড়ের ভ্যাপসা গরমে ঘামছে সে দর দর করে। বুক, পিঠ আর পাঁজর বেয়ে নামছে ঘাম। মিনিট খানেক অপেক্ষা করল সে, চারদিক পর্যবেক্ষণ করল তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে। সতর্ক।

আচমকা টিকটিকিটার ওপর চোখ পড়ল ওর। গজ দশেক দূরে একটা পাথরের ওপর খেলা করছে। হঠাৎ থমকে গেল ওটা, নিশ্চল রইল কিছুক্ষণ; কিছু একটা শোনার চেষ্টা করছে যেন। একটু পর লেজ নাড়ল, অস্বস্তিভরে দু’পাশে মাথা নাড়ল; তারপর আচমকা ছুট লাগাল নিচের দিকে, পাথরের তলায় গিয়ে সেঁধোল।

কান পাতল সাওলো নিজেও। চারদিক নীরব, নিস্তব্ধ। হঠাৎ শব্দটা শুনল সে। মোকাসিন-পরা পায়ের খস খস শব্দ।

শব্দ লুকানোর জন্যে বাহু আর পাঁজরের মাঝখানে চেপে রেখে পিস্তল কক করল সাওলো। শব্দটার দূরত্ব আন্দাজ করল, তারপর পাথুরে জায়গাটা পেরোল সন্তপর্ণে। একটা বড়সড় পাথরখণ্ডের ওপর গিয়ে দাঁড়াল।

অপেক্ষা করল সাওলো। শব্দটা আবার শোনার জন্যে কান পাতল। শোনা গেল না আর। ওর চারদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে অজস্র পাথরখণ্ড। পাথরের ফাঁক বেয়ে চলতে শুরু করল ও, ধীর পায়ে। সামনে একটা মানুষ সমান উঁচু পাথরের ওপর চোখ পড়ল। সামান্য থমকাল। ওটার আড়ালে চাইলে যে কেউ ঘাপটি মেরে থাকতে পারে। আর, ও যদি শব্দের উৎস নির্ণয়ে ভুল না-করে থাকে, তাহলে ওই পাথরটার আড়ালেই লুকিয়ে আছে অ্যাপাচিটা।

পাথরটার দিকে হাঁটতে শুরু করল সাওলো দ্রুতপদে। লুকানো শত্রুকে নিঃসন্দেহ রাখতে চায় ও। একটা ব্যাপারে সে এখন নিশ্চিত যে, অ্যাপাচিটার কাছে রাইফেল নেই—কিংবা থাকলেও ওটার মেকানিজম কাজ করছে না। অতএব আক্রমণ করতে হলে অ্যাপাচিকে ওর কাছে এসে দেখা দিতে হবে।

দ্রুতপদে এগিয়ে যাচ্ছে ও পাথরটার দিকে, শব্দ লুকোবার চেষ্টাও করছে না। ও কিছুই সন্দেহ করেনি—এমন একটা ধারণা দিতে চায় অ্যাপাচিকে।

পাথরের কাছে এসে গেল ও, গা ঘেঁষে সামনে এগোল। সতর্কতায় টান টান হয়ে গেছে ওর স্নায়ু। আচমকা পায়ের পাতার ওপর ভর করে চলন্ত অবস্থায় ঘুরে দাঁড়াল সে। চিতাবাঘের মত, উদ্যত ছুরি হাতে, অ্যাপাচিকে ওর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে দেখল। পিস্তল বের করে নিমেষে গুলি করল সে। গুলির ধাক্কায় ঘুরে গেল অ্যাপাচি, ছুরিসহ দু’হাত তুলল ওপর দিকে, তারপর ডিগবাজি খেয়ে সাওলোর গা ঘেঁষে আছড়ে পড়ল। পরক্ষণেই হামাগুড়ি দেবার ভঙ্গিতে উঠে বসল। ওর বুকে লেগেছে গুলি। রক্তে জামা ভেসে যাচ্ছে। দাঁতে দাঁত চেপে, শরীরের সমস্ত শক্তি একত্র করে ছুরি ধরা হাতটা উঁচু করল অ্যাপাচি, ছুঁড়ে মারার ভঙ্গি করল; পরক্ষণে ঢলে পড়ল সামনের দিকে। ছুরিধরা হাতটা সাওলোর দু’পায়ের ফাঁকে আছড়ে পড়ল। লাফিয়ে একদিকে সরে গেল সাওলো। পাথুরে জমিতে ঠোকর খেল ছুরির ফলা।

পিস্তল খাপে ঢোকাল ও। একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল মৃত শত্রুর মুখের দিকে।

অ্যাপাচির ছুরিটা তুলে নিল ও, কার্তুজগুলোও। কিছুদূরে ওর অকেজো রাইফেলটা দেখতে পেল। নিজের রাইফেলটাও দেখল ওখানে। কাছেই দ্বিতীয় অ্যাপাচির মৃতদেহ পড়ে আছে। নিজের ও মৃত অ্যাপাচির রাইফেল দুটো তুলে নিল ও।

প্রচণ্ড অবসাদে শরীর ভেঙে পড়তে চাচ্ছে। ক্যাম্পের দিকে হাঁটা শুরু করল সাওলো। নারুতোর কথা মনে হতেই হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিল কাছাকাছি আসতে থমকে দাঁড়াল ও। ব্যাপারটা নিজের চোখে দেখেও বিশ্বাস হতে চাইল না। ভয়ঙ্কর আক্রোশে বিকৃত মুখ নাবুতোর। ক্যাম্পে একটা পাথরের সাথে হেলান দিয়ে রাখা দুটো রাইফেল। যেখানে ও আহত হয়েছিল, সেখান থেকে মোটামুটি দূরে ছিল পাথরটা। সাওলোর ব্যস্ততার সুযোগে নিজেকে ইঞ্চি ইঞ্চি করে ছেঁচড়ে নিয়ে এসেছে নাবুতো রাইফেলগুলোর কাছে: মাত্র ফুটছয়েক দূরত্ব এখন ও আর পাথরটার মধ্যে।

সবচে’ বেশি অবাক হলো সাওলো ম্যাগির নিষ্ক্রিয়তায়। মেয়েটাকে যেভাবে দেখে গেছে ও, সেভাবেই রয়েছে। একই অবস্থায় হাঁটুর ওপর থুতনি রেখে আগুনের পাশে বসা। নাবুতোর ইঞ্চি ইঞ্চি করে এগিয়ে আসা দেখছে নির্বিকার দৃষ্টিতে। কোনও প্রতিক্রিয়া নেই।

সাওলো ক্যাম্পের সামনে খোলা জায়গায় এসে দাঁড়াল। ফুটছয়েক দূরে রয়েছে নাবুতো এখনও রাইফেলগুলো থেকে। সাওলোকে দেখে থেমে গেল ও। হতাশার চিহ্ন ফুটে উঠেছে মুখে। হাল ছেড়ে দিল সে, দু’হাত দু’দিকে মেলে দিল।

একটুও অবাক হয়নি সে। যেন জানত, কী ঘটবে। সাওলোর হাতের অস্ত্রগুলোর ওপর চোখ বুলিয়ে নিল একবার, তারপর হাসল। সবাইকে শেষ করেছ?

জবাব দিল না সাওলো। হাতের অস্ত্রগুলো নামিয়ে রেখে পাথরে হেলান দিয়ে রাখা অস্ত্র দুটো নিয়ে এল। সবগুলো অস্ত্র খানিকটা দূরে একটা ঝোপের পাশে নিয়ে রাখল। মেয়েটার দিকে এগোল এরপর। কাছে গিয়ে নিচু হয়ে একটা হাত রাখল ওর কাঁধে আশ্বাসের ভঙ্গিতে। ‘তুমি ঠিক আছ, ম্যাম?’

ম্যাগি ওর দিকে তাকাল না। চুপচাপ বসে রইল। মৃদু ঝাঁকি দিল ওকে সাওলো। ‘মিস হডসন!’

ধীরে ধীরে মুখ তুলল ম্যাগি। ওর নির্বিকার শাদা মুখে কোন ভাব নেই। আয়ত চোখ দুটোতে দৃষ্টি নেই, শূন্য। আবার ঝাঁকি দিল ওকে সাওলো। ‘ম্যাগি!’

সাড়া দিল না মেয়েটি এবারও। এমন কী, সাওলোর প্রশ্ন যে শুনতে পেয়েছে, এমন কোনও লক্ষণও নেই চোখে-মুখে। মুখ নিচু করল ও, হাঁটুর ওপর চিৎ করে মেলে ধরল দু’হাত। অ্যাপাচিদের টানা-হেঁচড়ার চিহ্ন ওর সুডৌল, পুষ্ট দু’হাতে।

শ্বাস টানল সাওলো। চমৎকার গঠন মেয়েটির হাত দুটোর, স্রেফ সুন্দর।

নাবুতো কথা বলল, ‘ও তোমার কথা শুনছে না।’

সাওলো চাইল ওর দিকে। ‘ঘোড়ায় চড়তে পারবে?’

‘কী জানি?’

‘আমি তুলে দেব। চালাতে পারবে না?’

কাঁধ ঝাঁকাল নাবুতো। ‘কেন?’

‘আমাকে কোথায় দেখেছ, কুরিয়াপোকে যেন তা জানাতে পারো।

নাবুতো হাসল। ওর চোখ দুটো চকচক করছে প্রতিহিংসায়। ‘মজার লোক তুমি, সাওলো! বাজি ধরে বলতে পারি, শোনামাত্র ওখান থেকে তীর ছুঁড়ে এখানে এসে লুফে নেবার মত দ্রুতবেগে ছুটে আসবে কুরিয়াপো। হাহ্। অনেক ঠাট্টা হয়েছে, এবার খুনটা সেরে নাও।’

‘খুনোখুনির দরকার নেই আর। যথেষ্ট হয়েছে এ-পর্যন্ত।’

‘এর জন্যে?’ মেয়েটির দিকে মাথা ঝাঁকাল নাবুতো।

‘হ্যাঁ।’

‘তোমার মেয়েমানুষ?’

‘না। শোনো নাবুতো, ও আমার মেয়েমানুষ না হোক, ও একটা মেয়ে। শাদা মানুষের মেয়ে? হোক। অ্যাপাচি মেয়ে হলেও এই একই ব্যাপার ঘটত। ঠিক আছে?’

‘না,’ গোঁয়ারের মত অস্বীকৃতি জানাল নাবুতো। ‘তুমি অ্যাপাচি নও, শাদা মানুষও নও। তুমি, থুতু ফেলল সে, ‘তুমি বাদুড়ের মত। ইঁদুরও নও, পাখিও নও। আমি,’ ঘৃণায় মুখ বেঁকে গেল ওর, ‘আসলে জানি না তুমি কী!’

এক মুহূর্ত ওর দিকে চেয়ে রইল সাওলো। তারপর ঠাণ্ডাস্বরে বলল, ‘অনেক লাশ পড়েছে, নাবুতো।’ এগিয়ে গেল ও। ‘ওঠো।’ নাবুতোকে ধরে উঠতে সাহায্য করল। ঘোড়ার কাছে হাঁটিয়ে নিয়ে তুলে দিল ওটার পিঠে।

‘আমার মনে হয় তুমি কুরিয়াপোকে খুঁজতে গিয়ে আমাদের পেয়ে গেছ। তারপর,’ ইশারায় ম্যাগিকে দেখাল নাবুতো, ‘ওকে ছিনিয়ে নেবার জন্যে এই কাণ্ড ঘটিয়েছ। তাই না?’

ওর হাতে লাগাম ধরিয়ে দিল সাওলো। ‘যাও, কুরিয়াপোকে গিয়ে বোলো-যা তোমার ইচ্ছে হয়।

‘এন জু!’

পনির পাঁজরে অক্ষত হাঁটুর গুঁতো লাগাল নাবুতো। উপত্যকা পেরিয়ে উত্তরে ছোটাল ওটাকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *