জ্বালা – ১০

দশ

স্বপ্ন দেখছিল হাব বোদ; ঘুমের মধ্যে হাত-পা নেড়ে গোঁ-গোঁ শব্দ করছিল। আচমকা জেগে উঠল ও, লাফিয়ে উঠে বসল। ওর সারা শরীর ঘামে ভিজে জবজবে। আগুন নিভে গেছে অনেক আগে। কয়েক মুহূর্ত আচ্ছন্নের মত বসে রইল হাব, ফ্যাল ফ্যাল করে চারদিকে তাকাল। তারপর বিশাল আকাশের নিচে চারদিক ঘিরে দাঁড়িয়ে-থাকা কালো লাভার পাহাড় ওকে সচেতন করে তুলল। কোথায় আছে, মনে পড়ল ওর। আধা অন্ধকারে ঘড়িতে সময় দেখল। চারটে বাজার পাঁচ মিনিট বাকি; ওর পাহারার পালা এসে গেছে।

উঠে দাঁড়াল হাব, আঙুল দিয়ে চুল আঁচড়ে নিল। পরনের পোশাক থেকে ঝেড়ে ধুলো-বালি ছাড়াল। একটা বিরস হাসি ফুটল ওর মুখে। অনেক বছর ধরে গৃহভৃত্য আর দেহরক্ষীর কাজ ওকে কিছুটা খুঁতখুঁতে স্বভাবের বানিয়েছে। মনিবদের ফিটফাট পোশাক আর চালচলন ও নিজের অজান্তেই আয়ত্ত করে ফেলেছে।

নিজের রাইফেলটা কুড়িয়ে নিল ও, তাকাল ঘুমন্ত মানুষগুলোর দিকে; তারপর সাবধানে একজনের দিকে এগোল। কাছাকাছি পৌঁছুতেই নড়ে উঠল ঘুমন্ত শরীর। হাব দেখল, ও সাওলো। অবাক হলো। বালির ওপর ওর পায়ের সামান্য শব্দে ঘুম ভেঙে গেছে লোকটার। চোখ কিঞ্চিৎ ফাঁক হলো সাওলোর, এবং সম্ভবত হাবকে দেখে উৎসাহ হারিয়ে আবার বন্ধ হয়ে গেল।

লোকটার প্রতিক্রিয়া অসাধারণ, ভাবল হাব; ঈর্ষাবোধ করল। দুর্দান্ত সাহসীও বটে লোকটা।

অ্যারোয়োর শেষ মাথায়, যেখানে স্টিফেন পাহারা দিচ্ছে, ওখানে পৌছল সে। একটা উঁচুমতন পাথরের ওপর বসেছে স্টিফেন। হাব ওকে ডাকল, ‘মি. স্টিফেন, স্যার?’

‘হাব?’ সাড়া দিল হাবের প্রাক্তন মনিব।

‘আপনার পালা শেষ, স্যার।’

বিতৃষ্ণ চোখে ওর দিকে তাকাল স্টিফেন। বোঝাই যাচ্ছে, দারুণ নাখোশ ও নিগ্রোটার ওপর। ওর আপাদমস্তক দেখল বিরক্ত ভঙ্গিতে, যেন মনিব তাকাচ্ছে তার চাকরের দিকে কাজে খুঁত ধরার পর।

মৃদু হাসল হাব।

‘অত হাসি কিসের?’ রুক্ষ স্বরে জানতে চাইল স্টিফেন।

এমনি, স্যার। হাবের গলায় বিনয়; তবে আগের মত বিগলিত নয়, কিছুটা শুষ্ক। ‘আসলে আমার খুব খারাপ লাগছে এখন। অত সংক্ষিপ্ত নোটিসে আপনার চাকরি থেকে অব্যাহতি নেয়া…কাজটা ন্যায্য হয়নি মনে হচ্ছে।’

‘তোমাদের অন্য অনেক অপরাধের তুলনায়,’ স্টিফেন ঠাণ্ডা স্বরে মন্তব্য করল। ‘এটা এমন বড় কিছু নয়, হাব।’

‘…আসলে আমি হয়তো একটু অহঙ্কারী হয়ে পড়েছিলাম, স্যার।’

আধা অন্ধকারে স্টিফেনের শাদা মুখে ক্রোধের ভাব হাবের দৃষ্টি এড়াল না। তবে স্টিফেনের গলার স্বর শান্ত।

‘অহঙ্কারী হয়ো না, বাছা,’ স্টিফেন উপদেশ ঝাড়ল, ‘তোমাদের মত লোকেরা রোগ-জীবাণুর মতই আমাদের দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে দেশটাকে বরবাদ করে দিচ্ছ। তোমাদের মধ্যে রোগটা সংক্রমিত করেছে ওই বেজন্মা কার্পেটব্যাগাররাই। আর এখন সেটা অশিক্ষিত সাধারণ নিগ্রোদের মধ্যেও প্লেগের মত দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। তোমরা নিগাররা এখন আমাদের আইনসভায় ঢুকছ, আমাদের সনাতন মূল্যবোধকে ধূলিসাৎ করে দিচ্ছ। যুদ্ধ যা ধ্বংস করতে পারেনি, তা তোমরাই শেষ করে দিচ্ছ।’

বসা থেকে লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল স্টিফেন। রাগে লাল হয়ে গেছে ওর মুখ। ওর রাইফেলের মুখ নিচের দিকে; ধীরে ধীরে ওটা ভুলতে শুরু করল সে। হাবের গলা শুকিয়ে গেল, কিন্তু ভীতিটা প্রকাশ করল না ও। নিজের রাইফেলটাও তুলল ও। চোখ জ্বলে উঠল স্টিফেনের। দূর হও, স্যাম্বো! আমার চোখের সামনে থেকে দূর হও!’

ধীর এবং সতর্ক পায়ে এক পাশে সরে গেল হাব। স্টিফেন পাথরের ওপর থেকে নেমে এল, হাবকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে সামনে এগোল। ঘুমন্ত লোকগুলোর কাছ থেকে সামান্য দূরে একটা পাথরের ওপর বসল; সিগার জ্বালাল।

হাব সামনে তাকাল। সামনে ঊষর কালো পাথুরে ভূমি, রাতের ক্ষয়িষ্ণু প্রেক্ষাপটে ক্রমে স্পষ্ট হয়ে উঠতে শুরু করেছে। বাতাস বইছে ধীরলয়ে। হঠাৎ চমকে উঠল ও, ওর সামনে, নিচে কী যেন নড়ে উঠেছে! পর মুহূর্তে নিজের বোকামিতে লজ্জা পেয়ে গেল। ‘বাতাসে সোপউয়িডের পাতা নড়ে উঠেছে, তাতেই আমার আত্মা খাঁচা ছাড়ার যোগাড়! হাসল হাব মনে মনে। তারপর কষে ধমক লাগাল নিজেকে, ‘একজন দুর্দান্ত ওয়েস্টার্ন ম্যান হও অন্তত একবারের জন্যে হলেও সাহসী হবার চেষ্টা করো! ছায়া দেখেই লাফিয়ে উঠো না!’

রাইফেলটা কোলের ওপর আড়াআড়ি রেখে বসল সে।

কিছুক্ষণ পর। মৃদু কথোপকথনের শব্দ কানে এল ওর। মাথা ফেরাল ও ক্যাম্পের দিকে। স্টিফেনের পাশে একজনকে দেখা গেল। ম্যাগি হডসনকে চিনতে পারল হাব। ওদের কথাবার্তা স্পষ্ট শোনা গেল।

‘কিছু মনে কোরো না, মিস্টার,’ ম্যাগি ক্ষমাপ্রার্থনার সুরে বলল। ‘আমার ঘুম ভেঙে গেছে।’

‘মোটেই না, মিস! দয়া করে বসো।’

আমি জানতাম, তুমি বিরক্ত হবে না…তুমি ভদ্রলোক।’ স্টিফেনের পাশে বসল ও। আমি খুব আতঙ্কের মধ্যে আছি, কিন্তু আতঙ্কিত না হয়েই বা উপায় কী, বলো?’

‘অবশ্যই,’ সায় দিল স্টিফেন। আতঙ্কিত হবার যথেষ্ট কারণ আছে। তোমার বিপদের ধরনটা আমি বুঝি, ম্যাম। তবে অতটা হতাশ হবার দরকার নেই।’

‘আমি হতাশ হতে চাই না। কিন্তু… ম্যাগি ভগ্নকণ্ঠে বলল, ‘এ হতচ্ছাড়া দেশটাকে আমি ভীষণ ঘৃণা করি। আমার একমাত্র কামনা, যত শীঘ্র সম্ভব, এ-দেশ থেকে চলে যাওয়া।’

‘আমি তোমাকে দোষ দেব না, ম্যাম। তোমার মত সুন্দরী আর রুচিশীল মেয়ের উপযোগী দেশ নয় এটা।’

এক মুহূর্ত নীরব রইল ম্যাগি, ভাবল; তারপর বলল, ‘আমি পালাতে চেয়েছিলাম একবার…কিন্তু বাবা ধরে নিয়ে আসে। বাবা এ জন্যে খুব খারাপ ব্যবহারও করেছিল আমার সাথে।

‘তুমি একদম হতাশ হয়ো না।’ স্টিফেন মেয়েটির দিকে তাকাল, উৎসাহ দিল ওকে মৃদু হেসে। ‘তুমি একে তরুণী—তায় সুন্দরী। তোমার জন্যে সারা দুনিয়া অপেক্ষা করছে…তুমি চাইলে…’

এভাবে অনেকক্ষণ ধরে অনেক স্তুতিবাক্য আর আশ্বাসবাণী শোনাল স্টিফেন মেয়েটিকে। মেয়েটি ওর ভদ্র ব্যবহার আর আশার বাণীতে আশ্বস্ত বোধ করল।

অবাক হলো হাব। শ্বেতাঙ্গ এ লোকটাকে সে অনেক দিন ধরে চেনে। জানে ওর স্বভাবের প্রতিটি খুঁটিনাটি। অত্যন্ত মেয়েঘেঁষা লোকটা; প্রত্যেকবারই ও মেয়েদের পটানোর সময় নিখুঁত ভালমানুষের অভিনয় করে। কালোদের এ লোকটা কুকুর-বেড়ালের মত মনে করে। ওর কাছে থাকা অবস্থায় হাব নিজে কোনওদিন সামান্য ভাল ব্যবহার পায়নি।

কিন্তু কেন? হাবের কাছে এ এক অনন্ত জিজ্ঞাসা। মনের ভেতর এ এক অনিচ্ছাকৃত রক্তাক্ত খোঁড়াখুঁড়ি। ও কিছুতেই বোঝে না যে, শাদা আর কালো দু’জনেই তো মানুষ, রঙ ছাড়া ওদের মধ্যে আর পার্থক্যটা কোথায়? শক্তির দিক দিয়ে ও স্টিফেনের চেয়ে অনেকগুণে শ্রেয়। ইচ্ছে করলে নিমেষেই ওকে পিষে ফেলতে পারে। সে ওরই সমান, বরং বুদ্ধিমত্তা আর শিক্ষাগত দিক দিয়ে ওরচেয়ে ভাল। সে ভাল কথা বলতে পারে, ওর আচার-আচরণ মার্জিত। ঐতিহাসিক, সামাজিক, জৈবিক প্রতিটা দিক দিয়েই হাব বুদ্ধি এবং কাজের সমন্বয় ঘটাতে পারে। তাহলে? তাহলে কেন সে ওই লোকটার চেয়ে নিকৃষ্ট? কেন, হা ঈশ্বর, কেন?

পার্থক্য কোথায় সেটা ও জানে না এমন নয়। পার্থক্য আসলে মনে। যুগ যুগ ধরে শাদারা কালোদের দাস বানিয়ে রেখেছে। দাস হিসেবে ওরা কালোদের পছন্দ করে। কিন্তু তাদের মানুষ করার দায়িত্ব কখনও বোধ করেনি। কালোরা শাদাদের দাস হবে, এটাকে স্বাভাবিক বলে ভেবে এসেছে ওরা। এদিকে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে কালোদের মনেও এমন একটা বোধ ছাপ মেরে গেছে যে, শাদাদের দাস হবার জন্যেই ওদের জন্ম। এখনও মানুষ হবার আকাঙ্ক্ষা কালোদের মধ্যে তীব্রভাবে জেগেছে, তা বলা যাবে না। এদিকে দাসত্বপ্রথা আইনগতভাবে উচ্ছেদ হয়ে গেলেও শাদারা তাতে ক্ষুব্ধ এবং কালোরা অসহায় বোধ করছে। দাস্যভাব এবং হীনম্মন্যতা তাদের চিন্তা-চেতনায় রয়ে গেছে এখনও। আর এর জন্যে কালোদের এবার নিজের বিরুদ্ধেই সংগ্রামে নামতে হবে।

হাব ঠিকই উপলব্ধি করল, স্টিফেন আর ওর মধ্যে প্রকৃত পার্থক্যটা এখানেই।

.

স্টিফেন আর ম্যাগির গলা শোনা যাচ্ছে। ম্যাগি হাসছে, খসখসে আমুদে হাসি। ওদিকে তাকাতে ইচ্ছে হলো না ওর, বিতৃষ্ণা বোধ করছে।

একটা ঘোড়া ডেকে উঠল ভীতস্বরে। জঙ্গলের সামনে করালের দিকে চাইল হাব, সাওলোকে দেখা যাচ্ছে। সাওলো করালে ঢুকল, মৃদুস্বরে কথা বলল ঘোড়াগুলোর সঙ্গে—ওদের শান্ত করল; তারপর বেরিয়ে এল। অ্যারোয়োর ওপর দিকে এগোল ও। স্টিফেন আর ম্যাগির পাশ দিয়ে যাবার সময় দেখেও না দেখার ভান করল। একটা উঁচু পাথর বেয়ে হাবের পাশে চলে এল। কী খবর?’

‘এ পর্যন্ত ভাল,’ বলল হাব। তবে মনে কোরো না যেন খারাপ হলে তোমার কাছে লুকোব। ঘোড়াগুলোর কী হয়েছিল?’

‘মরা ঘোড়াটার গন্ধ পাচ্ছে সম্ভবত। ফুলে ওঠার আগে ওটাকে ঢেকে দিতে হবে।’ উঠে দাঁড়াল সাওলো। চারদিক ফর্সা হয়ে আসছে, হাব। পাহারার দরকারটা ঠিক এখনই।’

‘মি. স্টেইভ, আপনি কি মনে করেন যে, অ্যাপাচিদের হাত থেকে বেঁচে থাকার সুযোগ এখনও আছে?’

‘যতক্ষণ পর্যন্ত ওদের নাগালের বাইরে থাকতে পারব, ততক্ষণ আছে। ওরা যদি অ্যারোয়োতে ঢুকতে পারে, তাহলে আর নেই। আমরা সবাই যদ্দূর সম্ভব নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছি।’ থামল সাওলো। ‘কেবল হডসনের ওই মেয়েটা ছাড়া।’

এক মুহূর্ত চুপ করে রইল হাব। তারপর বলল, ‘আমি মনে হয় আমার দায়িত্ব পালন করতে পারছি না।’

‘তুমি তোমার দায়িত্ব ঠিকভাবেই পালন করে যাচ্ছ, হাব।’

অনিশ্চিত দৃষ্টিতে নিজের হাতের রাইফেলটার দিকে চাইল হাব, যেন ভাবছে, ওটা দিয়ে আসলে কী করা হয়। ‘আমি ভীষণ ভয় পাচ্ছি, মি. স্টেইভ। ওরা আক্রমণ করলে আমি হয়তো আতঙ্কে বেহুঁশ হয়ে যাব।’

‘উঁহু, মোটেই বেহুঁশ হবে না। তুমি ওদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে।’

‘আপনি অত নিশ্চিত হলেন কী করে? আমি কেন যুদ্ধ করব? কার জন্যে? ওই শাদাদের বাঁচানোর জন্যে?’

উঁহুঁ। কারও জন্যে নয়, তুমি নিজের জন্যে যুদ্ধ করবে।’

‘আমার জন্যেই বা কেন?’ হঠাৎ ভাঙা গলায় চেঁচিয়ে উঠল হাব। ‘আধা মানুষ হয়ে থাকার জন্যে? শাদা মানুষদের দেয়া স্বাধীনতার প্রহসন হয়ে থাকার জন্যে? ঈশ্বর! আমাকে ফের দাসত্বই দাও! সেখানে আর যা-ই থাক, অন্তত ভণ্ডামি নেই!‘

সাওলো ধীর কণ্ঠে বলল, ‘তোমার কথা আমি বুঝি, হাব। তুমি যা বলছ, তার সবই সত্য। আর এটা আমি তোমাকে আগেই বলেছিলাম, একবারের জন্যে হলেও ঘাড় সোজা করে দাঁড়াও, লড়াই করো। মাথা নুয়ে সারাজীবন বেঁচে থাকার চেয়ে উঁচু করে এক মিনিট বেঁচে থাকাটা অনেকগুণে সম্মানের।’

‘তুমি তো তা-ই করছ, তাই না?’ বিদ্রূপের স্বরে বলল হাব। ‘কিন্তু কই? তবুও তো অবজ্ঞার জ্বালা ঠিকই পোহাচ্ছ। আর তুমি তো নিজের চেষ্টায় বেঁচে থাকছ, ওদের সাহায্যে নয়।’

‘ঠিক তাই।’

বিতৃষ্ণ হাসি হাসল হাব। ‘কিন্তু আমি পারছি না, মি. স্টেইভ। আমি…’

হঠাৎ একটা হাত তুলে ওকে থামতে ইঙ্গিত দিল সাওলো। সতর্ক সে, উৎকর্ণ।

‘কী-ক্কী হয়েছে?’

জবাব দিল না সাওলো। হাব পাথুরে ভূমির ওপর চোখ বুলাল দ্রুত চারদিক পুরোপুরি ফর্সা এখন। আকাশ পরিষ্কার। দূরে সান্তা ক্যাটালিনার চুড়ো স্পষ্ট হয়ে উঠছে। সূর্য এখনও চুড়োর আড়ালে, তবে হলুদ-সোনালি আলোর আভাসে চকচক করছে চুড়ো।

একটা মৃদু শিসের শব্দ শোনা গেল। পাখি ডাকছে?

এক মুহূর্ত কিছু দেখা গেল না কোথাও কেবল পাথরখণ্ড আর বুনো ঝোপঝাড় ছাড়া। তারপর হঠাৎ যেন মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে এল মূর্তিগুলো। দ্রুত, ঝড়ের গতিতে ছুটে এল।

মরু প্রভাতের অলৌকিক নৈঃশব্দ্যকে শতধা বিভক্ত করে দিয়ে গর্জে উঠল সাওলোর রাইফেল। হাবের কানে তালা লেগে গেল। পেট চেপে ধরে গড়িয়ে পড়ল একজন অ্যাপাচি। গুলির শব্দে অ্যারোয়োর লোকেরা ছুটে এল। ওদের চোখে-মুখে ঘুমের রেশ, তবে হাতে রাইফেল। আবার গর্জে উঠল সাওলোর রাইফেল, ধূলিশয্যা নিল আরেক ইন্ডিয়ান কাটা কলাগাছের মত।

শাদারা নিজ নিজ পজিশনে চলে গেছে সবাই নিমেষেই। গতকালের অভিজ্ঞতা কাজ দিচ্ছে ওদের। আচমকা পেছনে গুলির শব্দে সচকিত হলো হাব। অ্যাপাচিদের অন্য দলটা এবার তেড়ে-ফুঁড়ে আসছে। দ্রুতবর্ষী উইনচেস্টারের একটানা গুলির শব্দে প্রভাতের সমাহিত ভাবটা ছিঁড়ে-ফেড়ে গেল।

কেউ একজন চেঁচিয়ে উঠল। গুলি লেগেছে।

আচমকা যেন বজ্রপাত ঘটল হাবের মস্তিষ্কে। তীব্র আতঙ্কে ও নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারাল। মরিয়া হয়ে উঠল। রাইফেলটা তুলে ধরে ট্রিগারে টান দিল। রাইফেলের ধাক্কায় কেঁপে কেঁপে উঠছে ওর শরীর। পাগলের মত গুলি করছে সে বিশেষ কোন টার্গেট ছাড়াই।

ওর সামনে সবকিছুই ঘটছে যেন স্বপ্নের মত; যেন চারদিকের ছড়ানো- ছিটানো পাথরখণ্ড, ঝোপঝাড়, অ্যাপাচি, গুলির শব্দ—এসবের কোনও বাস্তব ভিত্তি নেই—এবং স্বয়ং সেও গুলি চালাচ্ছে ভয়ঙ্কর এক দুঃস্বপ্নের ভেতর। ওর চারদিক যেন ভূতুড়ে আলোয় আচ্ছন্ন, আর তার মধ্যে দিয়ে ভূতের মতই ছুটে আসছে অ্যাপাচিরা। কিন্তু এর পরেও সে জানে, ওদের কাউকে অ্যারোয়োর-মুখের দিকে আসতে দেয়া যাবে না-একটাকেও না।

অ্যারোয়ো-মুখের দিকে একটা ফাটল লক্ষ্য করে দৌড়ে আসছিল একজন অ্যাপাচি। সাওলোকে ওদিকে ছুটতে দেখা গেল। ওর হাতের শার্পসটার ওঠা-নামা লক্ষ করল হাব। পরমুহূর্তে ফাটলের ছুটে আসতে থাকা শত্রুর অভ্রভেদী চিৎকার কানে এল ওর। চার হাত-পায়ে আছড়ে পড়ল অ্যাপাচি শক্ত পাথুরে ভূমির ওপর।

সবকিছুই ঘটছে যেন স্বপ্নের মধ্যে। মানুষগুলো গুলি করছে এবং গুলি খেয়ে চেঁচিয়ে গলা ফাটাচ্ছে। ওর মনে হলো, ও যেন ক্রমশ ডুবে যাচ্ছে, চারদিকের সব ঘটনার নিচে চাপা পড়ে যাচ্ছে।

অ্যারোয়ো-মুখে মানুষের নড়াচড়া সচেতন করল ওকে। একটা ইন্ডিয়ান। বাঁদরের মত ছোট ছোট লাফে ওর দিকে এগিয়ে আসছে।

রাইফেল ঘুরিয়ে ওকে টার্গেট করতে চাইল হাব। তার আগেই অ্যাপাচিটা ছোরা হাতে ওর ওপর এসে পড়ল। রাইফেল ফেলে দিয়ে বিহ্বলের মত ওকে জাপটে ধরল হাব। অ্যাপাচির গ্রিজ মাখানো দেহ থেকে কাঠ পোড়ানো ধোঁয়ার গন্ধ ওর নাকে ঝাপটা মারল। দু’জনেই একসাথে গড়িয়ে পড়ল ওরা, গড়াতে শুরু করল। পিচ্ছিল শরীর নিয়ে সুবিধা আদায় করতে চাইছে অ্যাপাচি। কোনওক্রমে কবজা করতে পারছে না ওকে হাব।

হঠাৎ গড়ানো বন্ধ করে দিল দু’জন একসাথে। হাব এখন ইন্ডিয়ানটার বুকের ওপর। ওর দু’হাত দৃঢ় মুষ্ঠিতে ধরে আছে অ্যাপাচির দু’হাত, ছুরি চালাতে পারছে না অ্যাপাচি। ওর আর অ্যাপাচির মুখের মধ্যে কয়েক ইঞ্চি মাত্র ফাঁক এখন, তীব্র ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে ওর দিকে চেয়ে আছে ইন্ডিয়ানটা।

ওপর দিকে ধাক্কা দিল অ্যাপাচি সর্ব শক্তিতে। হাবের মুষ্টি শিথিল হয়ে গেল। একহাত ছুটে গেল ওর, অন্য হাতটিও ছুটে যাবার উপক্রম হলো। ওকে ছেড়ে দিয়ে পাগলের মত পিছু হটল হার, বেদিশের মত তাকাল এদিক-সেদিক।

বালির ওপর চকচকে জিনিসটা চোখে পড়ল ওর। সাওলোর গুলিতে নিহত অ্যাপাচির হাতে রয়েছে জিনিসটা। ছোট একটা কুড়োল।

পড়ি কি মরি করে ছুটে গিয়ে জিনিসটা আঁকড়ে ধরল হাব; হ্যাঁচকা টানে ছিনিয়ে নিল ওটা মৃত অ্যাপাচির শক্ত হয়ে আসা হাতের মুঠো থেকে। দু’হাতে হাতলটা আঁকড়ে ধরে সোজা হলো হাঁটুর ওপর। ছুটে আসছে অ্যাপাচি চুরিহাতে।

সজোরে ছুঁড়ে দিল হাব কুড়োলটা।

মাঝপথে একবার পাক খেল ওটা, পরক্ষণেই ধেয়ে আসা অ্যাপাচির খুলিতে কোপ বসাল। মাংস এবং হাঁড় কাটার শব্দের সাথে মিলে গেল অ্যাপাচির জান্তব গোঙানি; মুহূর্তের জন্যে থেমে গেল লোকটা, তারপর ধপ করে পড়ে গেল বালির ওপর।

মাথা নাড়ল হাব, টলছে ও। তাকাল চারদিকে। অ্যাপাচিদের আক্রমণের ধার কমে গেছে। দু’একটা গুলির শব্দ শোনা গেল এদিক-ওদিক; তারপর আচমকা থেমে গেল সব।

বসে পড়ল হাব। ওর প্রথম এলোপাতাড়ি গুলিতে নিহত হয়েছে আরেকজন অ্যাপাচি। পুরো ব্যাপারটা অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে ওর কাছে। দু’জন মানুষকে ও-ই খুন করেছে!

চোখ তুলে চাইল হাব। সাওলো ওকে পর্যবেক্ষণের দৃষ্টিতে দেখছে- আর কি আশ্চর্য! ওর সঙ্গে স্টিফেনও আছে!

পেটের ভেতরটা গুলিয়ে উঠল হাবের। চোখের সামনে দু’হাত মেলে ধরল, আবার মুঠো করল—খুলল আবার। ‘ঈশ্বর!’ মৃদু হাসি ফুটল ওর মুখে। ‘ঈশ্বর! এই তাহলে ব্যাপার! আমি একজন পুরুষের মতই লড়াই করেছি!’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *