জ্বালা – ৭

সাত

অ্যাপাচিদের সাড়া-শব্দ নেই এখন। যতদূর চোখ যায় তাপ-তরঙ্গের উদ্বাহু নৃত্য কেবল, জন-প্রাণীর চিহ্ন দেখা যাচ্ছে না। তবে নিশ্চিন্ত হলো না সাওলো। অ্যাপাচিদের বিশ্বাস নেই। যে কোনও সময়, যে কোনও দিক থেকে আচমকা হাজির হতে পারে ওরা মিলাদ

ও প্রথমে নিজেদের অবস্থান বিচার করল, তারপর সবাইকে যার যার দায়িত্ব বুঝিয়ে দিল।

অ্যারোয়োর নিম্নাংশ ক্রমশ চওড়া হয়ে গেছে; ওদিকে প্রায় পঞ্চাশ ফুটের মত জায়গা কিছুটা অরক্ষিত। তবে চারদিক থেকে বিশাল কালো ব্যাসল্টের ঘের জায়গাটাকে প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে মোটামুটি সুবিধা দিয়েছে ব্যাসল্টের প্যাবগুলো উঁচু, সহজে চড়ার মত নয়; মাঝখানের গ্যাপগুলো ছোট বড় পাথরের বোল্ডার আর জঙ্গলে আকীর্ণ।

অ্যারোয়োতে মাঝে-মধ্যে দু’একটা জায়গায় খোলা। তবে ওগুলো নিয়ে ভাবছে না সাওলো। ওগুলো অনায়াসে কভার করা যাবে। এত

ব্যাসল্টের গ্যাপগুলো নিয়েই ও মাথা ঘামাচ্ছে। ওগুলো দিয়ে ঢোকার চেষ্টা করবে অ্যাপাচিরা, কাভার হিসেবে ব্যবহার করবে ব্যাসল্টের ঘের থেকে খোলা জায়গার দিকে এগিয়ে আসা ঝোপঝাড় আর ছড়ানো ছিটানোর বোল্ডারগুলোকে। কয়েকটি সম্ভাব্য প্রবেশ পথ চিহ্নিত করল সাওলো। নিজের লোকদের অ্যারোয়ো-মুখের প্রবেশ পথগুলোয় এনে কড়া নজর রাখতে বলল জঙ্গলাকীর্ণ ও ছড়ানো ছিটানো পাথরখণ্ডে ভর্তি গ্যাপগুলোর দিকে।

ঘোড়াগুলোর প্রতি নজর দিল ও। সবচে’ নিচের ট্যাংক থেকে পানি খাইয়ে নিল। সামান্য বিশ্রাম, পানি এবং দানা পেয়ে মোটামুটি চাঙ্গা হয়ে উঠেছে ওগুলো।

সাওলো যেখানে, ওখান থেকে সামান্য কয়েক গজ দূরে পজিশন নিয়েছে ইয়েটস। অ্যারোয়োর নিচের অংশ কভার করছে। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে খালি জায়গাটার দিকে আড়চোখে চাইল। কথা বলল তারপর, ‘ওরা আমাদের অবস্থান না জেনে ধেয়ে আসবে না নিশ্চয়, কী বলো? অ্যাপাচিদের নিয়ম তো তাই, না?’

‘সবচেয়ে ভাল কাজ দেবে এমন উপায়ই অবলম্বন করে অ্যাপাচিরা,’ সাওলো জানাল ওকে। ‘সুতরাং নিশ্চিত করে কিছু বলা যাচ্ছে না। আমার বিশ্বাস, কুরিয়াপো দলের সবাইকে এক সঙ্গে একই কাজে লাগাবে না। তাছাড়া ও গাধা নয়, ঘটে বুদ্ধি ধরে। ও আমাদের গুলি ছুঁড়তে প্রলুব্ধ করবে, যাতে আমরা এলোপাতাড়ি গুলি ছুঁড়ে সব গুলি ফুরিয়ে ফেলি।

‘ক্রাইস্ট!’ অস্বস্তিভরে থুতু ফেলল ইয়েটস, ‘ওরা হয়তো রাতের আঁধারে গা ঢাকা দিয়ে আমাদের কাছে চলে আসবে!’

‘উঁহু,’ মাথা নাড়ল সাওলো, ‘ওরা রাতে যুদ্ধ করবে না। কিন্তু ওদের আমি বেরিয়ে আসতে বাধ্য করব।’ গ্যাপগুলোর দিকে নজর বুলাল। কড়া নজর রাখবে ওদিকে। কুটোটি নড়লেই ফুটো করে দেবে, ঠিক আছে?’

দাঁত বের করে হাসল ইয়েটস। ‘একশো ভাগ।’

অ্যারোয়োর মাঝামাঝি জায়গায় পজিশন নিয়েছে ওয়াল্টার। ওখান থেকেই চিৎকার করল ও সাওলোর উদ্দেশে, ইনজুনদের সম্বন্ধে তো তুমি অনেক কিছুই জানো, না? একদম তোমার হাতের তালুর মতই!’ ওর মুখে ঘিনঘিনে হাসি।

‘অন্তত ওদের হাত থেকে বেঁচে থাকার জন্যে যতটা জানা দরকার, ততটা জানে নিশ্চয়,’ খেঁকিয়ে উঠল ইয়েটস। ‘কিন্তু সমস্যাটা কী? তুমি ওর পেছনে লেগেছ কেন?’

জামার হাতায় ঘর্মাক্ত মুখটা মুছল ওয়াল্টার, ওর চোখ সরল না সাওলোর ওপর থেকে। ‘গাধার মত না চেঁচিয়ে মাথাটা খাটাও একটু। চিন্তা করো, কুরিয়াপো কি করে আমাদের আগে এখানে চলে আসে? আর ও তো চলে গিয়েছিল, সুতরাং আমরা কেউ না জানালে কি করে জানবে যে, আমরা ঠিক এখানেই আসব?’

হেঁটে ওর কাছে চলে গেল সাওলো। চোখে চোখ রাখল। ‘তুমি ঠিক কী বোঝাতে চাইছ, ওয়াল্টার?’

‘নির্দিষ্ট করে কিছু না।’ চোখ সরাল ওয়াল্টার। তবে ব্যাপারটায় কৌতূহল বোধ করছি। মনে হচ্ছে, আগাগোড়াই তুমি জানতে যে, ওরা আমাদের পেছনে ধেয়ে আসছে।’

‘কিভাবে জানতাম, সেটা তুমি নিশ্চয় বুঝিয়ে বলবে?’

‘বলার সময় এখনও আসেনি, স্টেইভ। তবে একটা চোখ আমার তোমার ওপর থাকবেই।’

লোকটাকে উপেক্ষা করল সাওলো; ঘুরে হাঁটতে শুরু করল। প্রত্যেকের অবস্থান দেখতে লাগল। ভেজা কাপড়ে মুখ ঢেকে একটা পাথরের ওপর শুয়ে আছে ম্যাগি মাঝের ট্যাংকটার পাড়ে। ওর পাশে মেলোডি পাথরটায় হেলান দিয়ে আছে। ক্লান্ত মেয়েটা, বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে; সাওলোকে দেখে হাসল। ওর চোখ সজীব, দৃষ্টি স্নিগ্ধ। ‘হ্যালো,’ বলল ও। ‘একদম ভোজবাজি দেখিয়ে দিলে কিন্তু। তা আমার জন্যেও কি একটা রাইফেলের বন্দোবস্ত করা যায় না?’

‘আগে ফ্রেশ হয়ে ওঠো। আর মাথাটা নিচু করে রাখো।

‘দুশ্চিন্তা কোরো না তো।’ ওকে আশ্বস্ত করল মেলোডি।

হাব বোদের কাছে গেল ও। একটা পাথরের ওপর বসেছে ও, হাতে অ্যাপাচিদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়া উইনচেস্টার; কিছুটা হতাশ দেখাচ্ছে ওকে। ‘এটা,’ ইশারায় নিজের হাতের রাইফেলটা দেখাল ও, ‘ম্যাডামকে দিলেই ভাল হবে। আমি রাইফেল চালাতে জানি না- এমন কী, লোড করতেও না।’

ওর হাত থেকে রাইফেলটা নিল সাওলো। অস্ত্রটার বাঁট থেকে ব্যারেল পর্যন্ত কোনটার কী কাজ এবং কিভাবে কী করলে কী হয়, ওকে বোঝাল। ‘ঠিক আছে এবার?’

‘দেখা যাক,’ শুকনো স্বরে বলল হাব।

হাঁটতে হাঁটতে বেসিনের কাছে চলে এল সাওলো। চারপাশের নরম মাটিতে বিভিন্ন পশু—বিগহর্ন মেষ, ক্যুগার, কয়োট, অ্যান্টিলোপের পায়ের ছাপ। পানি খেতে আসে ওরা এখানে—তবে মানুষের সাড়া পেলে ভয়ে আর এদিক মাড়াবে না প্রাণীগুলো। অ্যারোয়োতে নানারকম বুনোফলের সাথে মেস্কিট বীনস, র‍্যানডম পাফ বলও রয়েছে প্রচুর। এখানে কিছুদিন থাকতে হলে এগুলো ওদের খাদ্যের প্রয়োজন মেটাবে। তাছাড়া জঙলা জায়গাগুলোয় প্রচুর তিতিরও রয়েছে। ফাঁদ পেতে ধরা যাবে। আর এ ধরনের জায়গায় যেটা সবচে’ জরুরী, সেটা পানি এবং পানি ওদের যথেষ্ট আছে। কারণ তিনটে ট্যাংকই ওদের দখলে। অথচ অ্যাপাচিদের পানি আছে অতি সামান্য- কিংবা হয়তো একদম নেই-ই। তবে, ওটার ব্যবস্থা ওরা ঠিকই করে ফেলবে। ওরা জানে কোত্থেকে কিভাবে পানি যোগাড় করতে হয়। মামার

‘এই যে… স্টেইভ!’

স্টিফেন। একটা ব্যাসল্ট প্যাবের পাশে পজিশন নিয়েছে ও; ময়লা একটা রুমাল বের করে মুখ মুছল। সাওলোর দিকে বিতৃষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল। ওকে নোংরা আর বিস্রস্ত দেখাচ্ছে; আগের মত শান্ত, সমাহিত ভাব নেই। সাওলো ওর কাছে গেল।

‘এভাবে বসে বসে ওদের জন্যে অপেক্ষা করাটা ঠিক হচ্ছে বলে মনে করো তুমি?’ জানতে চাইল স্টিফেন।

‘এরচেয়ে ভাল কোনও বুদ্ধি আছে নাকি তোমার মাথায়?’

‘চারটে ঘোড়া আছে আমাদের, আছে না? তার মধ্যে তোমার দুটোর অবস্থা তো কাহিল। ওই মেক্সিকান দুটোর ঘোড়াদুটো কিন্তু তরতাজা। ওকোটিলো ঝোপের কাছে বিচরণরত ঘোড়াদুটোর দিকে মাথা হেলাল স্টিফেন। ওগুলোর একটা বে আর একটা পিন্টো ঘোড়া। আমাদের দু’জনের একজন ওখান থেকে একটা নিয়ে বেরোনো যায় কি না চেষ্টা করে দেখব। বেরোতে পারলে কিন্তু কেল্লা ফতে। সাহায্য নিয়ে…’

কাছে একটা পাথরের ছায়ায় নিদ্রাতুর টিকটিকির মত পড়ে রয়েছে অ্যাম্বারগো। নড়ে উঠল সে, ওর হাতের শৃঙ্খল ঝন ঝন করে বেজে উঠল। মাথা ঝাঁকিয়ে কপালের ওপর এসে পড়া সমব্রেরোটা সরাল সে, বিড়বিড় করে গাল বকল, ‘স্টুপিডো!’

সামান্য হাসল স্টিফেন। ‘আমার মতে, প্রথমে একজন অ্যাপাচিদের মনোযোগ আকর্ষণ করার জন্যে এদিক সেদিক ছোটাছুটি করবে। সেই ফাঁকে দ্বিতীয়জন…’

হাহ্!’ হেসে উঠল অ্যাম্বারগো। চমৎকার বুদ্ধি! সেই প্রথম একজন যে তুমিই হবে না তার গ্যারান্টি কী?’

চাই আমি হলে…’ একটু ইতস্তত করল স্টিফেন, তা বেশ, হব। আমি ওদের ভয় করি না। আমি অবশ্য হব।

‘বাহ্!’ অ্যাম্বারগো হাসল। ‘তা মিস্টার, ওই বড় ঘোড়াটাই তো? ওটা আমার। দেব তোমাকে। ওটা নিয়ে তুমি বেরিয়ে পড়ো। আমি নিশ্চিত, সাথে সাথেই মরতে পারবে তুমি।’

‘আমরা দু’জনেই মারা পড়ব, সাওলো বলল। বোকা নয় কুরিয়াপো। ওকে ধোঁকা দেয়া যাবে না।’

ঠাণ্ডা চোখে সাওলোর দিকে তাকাল স্টিফেন। পছন্দ হলো না সাওলোর। লোকটার ভাব-ভঙ্গিতে সাহসের চেয়ে নির্বুদ্ধিতার ছাপই বেশি- আর এ ধরনের নির্বুদ্ধিতা রীতিমত আত্মঘাতী।

‘তাহলে আমি একাই যাব। আর তুমি, তুমি একটা ভীতুর ডিম, স্টেইভ!’

‘আমি কী আর কী নই, সেটা তোমার কাছে প্রমাণ করার গরজ বোধ করছি না,’ সাওলো শান্তভাবে বলল। ‘তবে তুমি যাচ্ছ না কোথাও।

‘ঘোড়াটা যে আমার, তা তুমি নিশ্চয় শুনেছ?’

‘শুনেছি। তবে তুমিও দিতে পারবে না। শোনো মিস্টার,’ ওর দিকে চাইল সাওলো, ‘এখানে আমরা নয়জন আর ঘোড়া আছে চারটে। এখানে আমরা সবাই বিপদগ্রস্ত এবং এই চারটে ঘোড়াই সবার সম্বল।

‘ওটা তোমার হিসেব,’ অতি কষ্টে মেজাজ ঠিক রাখল স্টিফেন, ‘আমার নয়।’

‘ঠিক বলেছ, ওকে সমর্থন করল অ্যাম্বারগো। ‘তুমি নিশ্চয়ই একটা দোআঁশলার কথায় নিজের মত পাল্টাচ্ছ না, কী বলো? আমি, এই ঘোড়ার মালিক, অ্যাম্বারগো, তোমায় ঘোড়া দিচ্ছি। দোআঁশলাটার তাতে কিছুই বলার নেই।’

মোটা সোটা শরীর নিয়ে লম্বা লম্বা পা ফেলে এগিয়ে এল ডেপুটি শেরিফ জিমি গ্যানো। শোনো ওয়েটিনো, কথা একদম বন্ধ।’ হাতের রাইফেলটার নল ঠেকাল ও অ্যাম্বারগোর চিবুকের নিচে। ‘নয়তো এটা তোমার গলা দিয়ে ঢুকিয়ে দেব, কমপ্রেন্দে?’

বেড়ালের মত পিঠ উঁচিয়ে উপুড় হয়ে ছিল এতক্ষণ অ্যাম্বারগো, চিৎ হয়ে গেল ফের। ‘অবশ্যই জিমি, তুমি যা বলবে তা-ই।

স্টিফেন আর সাওলোর মাঝখানে গিয়ে দাঁড়াল জিমি, স্টিফেনের দিকে ফিরল। ‘ওয়েটিনো আমার বন্দী। বন্দীর নিজস্ব কোনও ইচ্ছে-অনিচ্ছে থাকে না। অতএব ঘোড়াটা তোমাকে উপহার দেবার অধিকার ওর নেই, কী বলো?’

‘তাই নাকি? তাহলে ধরে নিচ্ছি তুমিও সাওলোর পক্ষে।

‘হ্যাঁ। অ্যাপাচিদের চিনি আমি। ওর মত এত ভাল লোক সম্ভবত আমি ওদের মধ্যে আর দেখিনি। কিন্তু তোমাকে আমি বলতে পারি, তুমি একা কিংবা আমাদের দু’একজনকে ভাগিয়ে নিয়ে চলে গেলে তাতে কিছু আসবে যাবে না।’ সাওলোর দিকে ফিরল ও। ‘এখন দিন। রাতের অন্ধকারে পালাবার মত একটা সুযোগ হয়তো আমরা পেতেও পারি, তাই না?’

‘ওটা আমাকে তৈরি করে নিতে হবে,’ সাওলো জবাব দিল। ‘তোমরা পারবে না।’

‘ঠিক আছে, তোমাকে আমি বিশ্বাস করি। হয়তো এক-দু’দিন টিকে থাকতে পারলে সাহায্য পেয়ে যাব আমরা। একটা স্টেজ লুট হবার খবর নিশ্চয় ট্যুবাকে পৌছবে। উদ্ধারকারী দল চলে আসবে। তারপর ট্র্যাক খুঁজে বের করে উদ্ধার করবে আমাদের।’

‘হতে পারে,’ সাওলো বলল। তবে এক-দু’দিনের মধ্যে তার আশা করাটা ঠিক হবে না। কারণ এই স্টেজটার যাত্রা শিডিউল মোতাবেক ছিল না। এটি ছিল একটা স্পেশাল ট্রিপ। ওদের কাছে এটার খবর যখন পৌঁছবে, ওরা আগে চিন্তা করে দেখবে, কী করা যায়। কেউ কেউ হয়তো ভাববে, আমরা নিজেরাই পৌছে যেতে পারব। আর যখন দেখবে আমরা পৌঁছিনি, তখন আর ওদের আসা না আসায় কিছুই আসবে যাবে না।’

‘ঠিক আছে,’ কাঁধ ঝাঁকাল ও। ‘দু’তিনদিন অপেক্ষা করে দেখা যাক ওদের কাছে খবর পৌছে কি না। মনঃস্থির করা জন্যে না হয় আরও দু’দিন সময় দেয়া যাক। এরপর…’

‘তখন সব শেষ হয়ে যাবে,’ শান্ত নিচু স্বরে বলল সাওলো।

‘সেক্ষেত্রে আমার পরামর্শ হচ্ছে, বাইরের সাহায্যের আশা বাদ দিয়ে নিজেদের সাধ্যমত কিছু করা।’

‘তুমি বলছ, রাতে একটা উপায় খুঁজে বের করে ফেলবে?’ ঠাণ্ডা নিস্পৃহকণ্ঠে জানতে চাইল স্টিফেন

‘ফেলতে পারব। তবে সেটা ঘোড়ার পিঠে চড়ে নয়, পায়ে হেঁটে পালাতে হবে। ঘোড়ার পিঠে পালালে আগামীকাল ভোরে ওরা আমাদের ট্র্যাক খুঁজে বের করে পিছু নেবে।’

‘হাহ্!’ বিদ্রূপ ঝরে পড়ল স্টিফেনের গলা থেকে। তাহলে আমাদের স্রেফ অপেক্ষাই করতে হবে। তা কতক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে, বলো তো?’

গোড়ালির ওপর ঘুরল সাওলো, পিছিয়ে ঘোড়ার কাছে চলে গেল। ‘ধীরে, খুব ধীরে,’ নিজেকে বোঝাল, হুল ফোটানোর সুযোগ দিয়ো না ওদের।’

খাপ থেকে ছুরি বের করল সে। ছোট ছোট ঘাস আর ওকোটিলোর ডাল কেটে জড় করতে লাগল। আগামীতে ঘোড়াগুলোকে কাজে লাগাতে হলে ওদের জীবিত এবং তরতাজা রাখতে হবে। সামনে কয়েকটা পাথরের আড়ালে একটা করালের মত সৃষ্টি হয়েছে। ওখানে সামান্য গ্যালেটা ঘাস আর মেস্কিট বীনসের ঝোপ দেখা যাচ্ছে। চারটে ঘোড়ার খাওয়ার জন্যে মোটামুটি যথেষ্ট বলতে হবে।

নিজের জায়গা থেকে উঠে ওর কাছে চলে এল মেলোডি। একটা পাথরের সঙ্গে হেলান দিল। ‘ওটা কিসের জন্যে?’

‘করাল হিসেবে ব্যবহার করা যায় কি না ভাবছি।’

‘ওদের ওপর নির্ভর করতে যেয়ো না। ওয়াল্টার আর স্টিফেনের কথা বলছি।’

‘দুটো অপদার্থকে মিলিয়ে একটা পদার্থ করে নেয়া যাবে না হয়। কী বলো?’ সাওলো হাসল।

‘অত শত জানি না,’ ঠোঁট উল্টে অবজ্ঞার ভঙ্গি করল মেলোডি, ‘সিলভারটনে আমি খুব ভাল অবস্থানে ছিলাম। ভাল মদ, উঁচু দরের জুয়া আর রুচিশীল মহিলাদের নিয়ে ছিল আমার কাজ-কারবার। তবে তাতে লুকোছাপা কোনও ব্যাপার ছিল না। আমার দামী খদ্দেরদের মধ্যে ওরা দু’জনও ছিল। স্টিফেন ওখানে ভাগ্য ফেরাবার চেষ্টা করছিল। কিন্তু জুয়া ওকে ডুবিয়েছে শেষ পর্যন্ত। তাছাড়া শুনেছি মেয়েদের ব্যাপারেও নজর খারাপ ছিল ওর। অবশ্য কোনওদিন প্রমাণ পাইনি সেটার। পোকার খেলে আর হৈ-চৈ করে সময় কাটাত। আসলে ওসব সে উপভোগ করত।’

‘আর প্রাক্তন সৈনিক?’ সাওলো জানতে চাইল।

‘হ্যাঁ, ওয়াল্টার।’ হাসল মেলোডি। ও আসলে একজন পেশাদার ভিক্ষুক। বাহুতে চোট পেয়ে সেনাবাহিনীর চাকরি হতে বাতিল হয়ে যায় ও। অ্যাপাচিদের কাজ। দোআঁশলাদের ও একদম দেখতে পারে না।’ সাওলোর চোখে চাইল সে। ‘শব্দটা ব্যবহারের জন্যে দুঃখিত।’

সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে কপাল থেকে ঘাম মুছল সাওলো। ‘বাদ দাও।’

‘প্রাচুর্য বা সম্পদও একসময় একঘেয়ে হয়ে ওঠে। এই যে তুমি ছুটে চলেছ,’ কাঁধ ঝাঁকাল মেলোডি, ‘এটাই ভাল।’ সামান্য পরিবর্তিত হলো ওর মুখের ভাব। ‘আমি একজনকে বিশ্বাস করেছিলাম, উচিত হয়নি সেটা।

‘একজনকে?’

‘একজন বা বহুজন। তাতে আর তফাৎ কী?’ মেলোডির কণ্ঠে ঝাঁজ। ‘অনেক দেখেছি আমি, কিন্তু তাতে হয়েছেটা কী? অভিজ্ঞতা? অভিজ্ঞতায় আমার কোনও লাভ হয়নি।’

এক পাঁজা ঘাস আর ওকোটিলোর ডাল এনে দুটো প্যাবের পাশে গাদা দিয়ে রাখল সাওলো। বলল, ‘লাভ-অলাভ আসলে তুমি কী চাও, তার ওপরই নির্ভর করে।’

‘তাই? তুমি কি জানো, তুমি কী চাও?’

‘আমার চাওয়ার আর কিছু নেই। আমি সব পেয়েছি।

‘সব পেয়েছ?’ বিদ্রূপ ফুটে উঠল মেলোডির চোখে-মুখে। স্বাধীনতা? ওটাও কি পেয়েছ?’

‘মনে হয়।’

মেলোডি হাসল, বোকার মত কথা বোলো না, বন্ধু। তুমি এখন এখানে, তাই না? আমাদের কাছে আটকা পড়ে আছ। পালিয়ে যাচ্ছ না। এর কারণ, আমার ধারণা, তোমার নৈতিকতা বোধ কিংবা মানবিকতা। এ ধরনের একজন মানুষকে, আর যা-ই হোক, মুক্ত বা স্বাধীন বলা যায় না।

সাওলো হাসল। ‘বিপদ দেখলে আমি ঠিকই সরে যেতে পারি।’

হাসল মেলোডিও। সরে গেল ও পাথরটার কাছ থেকে। তার মানে এখনও বিপদ দেখোনি তুমি। তাহলে আর দেখবেও না। অন্তত অ্যাপাচিদের গুলি খেয়ে মরার আগে।’

আগের জায়গায় চলে গেল মেলোডি। ইতোমধ্যে সাওলোর জেবরা ডান ওর কাছে এসে ওর বাহু চেটে দিল। মাঝারি মাপের একটা থাবড়া লাগাল সাওলো জন্তুটার নাকে, কান মলে দিল। মুখব্যাদান করে দাঁতের পাটি দেখাল ডান, কামড়ে দেবে। পাত্তা দিল না সাওলো তাকে। আবার ভুলল থাবড়া। বেগতিক দেখে রাস্তা মাপল জেবরা ডান।

মেলোডির কথাগুলো ভারছে ও, ঠিক কি না মনে মনে বিচার করছে। এটা ঠিক, নিজের জেবরা ডানটা নিয়ে ও ইচ্ছে করলে এখনই পালাতে পারে। অ্যাপাচিরা চারদিক ঘিরে থাকলেও ওদের ফাঁকি দেয়া অসম্ভব হবে না ওর পক্ষে। কয়েক ঘণ্টা বিশ্রাম, খাবার এবং পানি পেয়ে জেবরা ডান এখন দৌড়ের জন্যে তৈরি। কিন্তু, কুরিয়াপোর টার্গেট ও হলেও, ওকে না পেলে সে যে এদের ছেড়ে দেবে, তা নয়। কুরিয়াপো এদের সবাইকে কচুকাটা করবে। সাওলো যদি ট্যুরাক থেকে সাহায্য নিয়ে আসে, যখন আসবে, অনেক দেরি হয়ে যাবে তখন।  

নিজের রাইফেলটা তুলে নিল ও। হেঁটে বোতলমুখো ওঅশটার কাছে গেল। একটা উঁচুমতন পাথর বেছে নিয়ে ওটার ওপর বসল

ঠিক সে মুহূর্তেই ব্যাপারটা শুরু হয়ে গেল। আচমকা মেস্কিটের ঝোপ আর পাথরখণ্ডের আড়াল থেকে ধূলিধূসরিত মূর্তি বেরিয়ে এল কয়েকটা; বেরিয়েই ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেল এবং চোখের পলক না ফেলতে অদৃশ্য হয়ে গেল ফের। এরই মধ্যে গোটাকয়েক গুলির শব্দ শোনা গেল: তবে সেগুলো অ্যারোয়োতে অবস্থানকারীদের গুলির শব্দ নয়; অ্যারোয়োর ওরা যখন রাইফেল তুলল, দেখা গেল, টার্গেট করার জন্যে ওখানে তখন বাতাস ছাড়া আর কিছুই নেই।

পরবর্তী কয়েক মিনিট চুপচাপ কাটল। আবার বেরোল ওরা, চোখের পলকে গুলি ছুঁড়ল কয়েকটা, পর মুহূর্তে গায়েব হয়ে গেল; যেন মাটির সাথে মিশে গেছে। তীর চি

সাওলোর যোদ্ধাদের জন্যে ব্যাপারটা বাতাসে গুলি ছোঁড়ার সমান হলো। আবার নড়ে উঠল অ্যাপাচিরা, গুলি ছুঁড়ল এবং ওদের প্রতিপক্ষ লক্ষ্যস্থির করার আগেই লুকিয়ে পড়ল ফের।

চা এভাবে অ্যারোয়োর প্রায় পঞ্চাশ গজের মধ্যে এসে গেল ওরা। আচমকা

তীব্র একটা হুইসেল বেজে উঠল। সাওলোর মনে হলো, এতক্ষণে পূর্ণোদ্যমে আক্রমণ শুরু করতে যাচ্ছে অ্যাপাচিরা। এ

ও জানে, এটা আসলে অ্যাপাচিদের একটা চাল মাত্র। কুরিয়াপো আনাড়ি নয়। ও জানে, প্রতিপক্ষ কোণঠাসা এবং বাধা দেবার জন্যে ভাল ভাবেই তৈরি হয়ে আছে। তাছাড়া সাওলোকে হালকা ভাবে নেবার মত দুঃসাহস ওর নেই। সুতরাং চূড়ান্ত আক্রমণে যেতে যথেষ্ট হিসেব-নিকেশ করতে হচ্ছে ওকেও। আসলে আচমকা আক্রমণের ভান করে প্রতিপক্ষকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলে মানসিকভাবে দুর্বল করে দিতে চাচ্ছে সে।

সময় বয়ে চলল। মাঝে-মধ্যে দু’পক্ষের মধ্যে বিক্ষিপ্ত গুলি বিনিময় হয়েছে। হঠাৎ হঠাৎ একেক জন অ্যাপাচি যোদ্ধা ব্যাঙের মত লাফিয়ে বেরিয়ে এল গুপ্তস্থান থেকে। ওরা কিছু বুঝে ওঠার আগে এক-আধ পশলা গুলি ছুঁড়ে ফের অদৃশ্য হয়ে গেল।

ব্যাপারটা প্রথম থেকেই পছন্দ হচ্ছিল না ওয়াল্টারের। এক পর্যায়ে ধৈর্য হারাল সে। একটু দূরে একটা ওকোটিলোর ঝোপ নড়ে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে ট্রিগার টানল সে, চেম্বার খালি না হওয়া পর্যন্ত থামল না। ওকোটিলো ঝোপটা ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল; কিন্তু ওখানে কেউ আছে বলে কারও মনে হলো না।

গড়ান দিয়ে নিজের পজিশন পাল্টাল সাওলো। ওয়াস্টারকে চিৎকার করে বলল, ‘অনর্থক গুলির অপচয় করছ কেন?

খেঁকিয়ে উঠল প্রাক্তন সৈনিক, ‘চোপ্, ব্যাটা ইনজুন!’

জবাবে কিছু বলল না সাওলো।

অ্যারোয়োর ভেতর আগুন ঝরাচ্ছে সূর্য। পাঁজর আর বুটের ভেতর পায়ের গোড়ালি বেয়ে ঘামঝরা টের পেল সাওলো। রাইফেলের বাঁটে গাল রেখে চারদিক পর্যবেক্ষণ করতে লাগল। ওর অবস্থান কিছুটা ওপরে হওয়ায় মাঝে-মধ্যে ঝোপঝাড়ের আন্দোলন চোখে পড়ল ওর। অন্যরা নিচ থেকে অতটা লক্ষ করতে পারল না। তবে গুলি ছুঁড়ল না সাওলো।

ঘাড় ও কাঁধে প্রচণ্ড চাপ অনুভব করছে ও। যন্ত্রণাবোধ করছে। টেনশনটা টের পেল সে। পাথরের ওপর থেকে নেমে মাটিতে পা ছড়িয়ে বসল। হাত দুটো কোলের ওপর রাখল বিশ্রামের ভঙ্গিতে।

ওদিকে বকোয়াজ লোকটা গুলি ছুঁড়তে শুরু করল ফের। রাগের চোটে নিজের অবস্থান থেকে অনেকটা বেরিয়ে পড়ল। গুলির সাথে সাথে অনবরত খিস্তিও ছুঁড়ে দিচ্ছে ও অ্যাপাচিদের উদ্দেশে, কুত্তার বাচ্চারা — কুত্তার বাচ্চারা…কুত্তার বাচ্চারা…কুত্তার…’

দূরে একটা ঝোপের ওপর দিয়ে ঢালু হয়ে নেমে যাওয়া একটা পাথরের আবছা পিঠ নজরে পড়ল ওর। পাথরের পাশে সামান্য ঝোপ; নড়ছে মাঝে- মধ্যে। তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সাওলো ঝোপটার দিকে। আবার নড়ল ওটা, সামান্য বিরতি দিয়ে ফের নড়তে শুরু করল। এবার একটু জোরেসোরে। হাসল সাওলো। ওয়াল্টারের মত ওখানেও কেউ একজন অধৈর্য হয়ে উঠেছে। রাইফেলটা তুলল সে, সময় নিয়ে সই করল, তারপর টেনে দিল ট্রিগার। ‘খাঁউ’ শব্দে খেঁকিয়ে উঠল কেউ একজন, লাফিয়ে চোখের সামনে বেরিয়ে এল, চ্যাপ্টা পাথরের ওপর উঠে গেল। রক্তে ওর বাদামী মুখ লাল হয়ে উঠেছে।

ইয়েটস আর স্টিফেনও নীরব রইল না। আহত অ্যাপাচি ছটফট করছিল। ওদের গুলি প্রথমে যেন ওকে পাথরের সাথে গেঁথে ফেলল, পরমুহূর্তে উল্টে পড়ল ওর লাশ।

তীক্ষ্ণ, পিলে-চমকানো ডাক ছাড়ল অ্যাপাচি যোদ্ধারা। সাথে সাথে পূর্ণোদ্যমে ঝাঁপিয়ে পড়ল যুদ্ধে। গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে আড়াল থেকে বেরিয়ে এল ওদের তিনজন। সাওলোর গুলিতে রাইফেল ফেলে পেটে হাত দিয়ে হুড়মুড় করে ঘোড়ার পিঠ ছেড়ে ভূমিতে পড়ল এক অ্যাপাচি। ওর পরবর্তী গুলিটা বিধল আহত অ্যাপাচির দাঁড়ানো ঘোড়াটার কাঁধে। তীক্ষ্ণ জান্তব চিৎকার ছেড়ে পেছনের জোড় পায়ে লাথি হাঁকাল ঘোড়াটা, সামনে এগোল। পেছনে ওর প্রভু ফেঁসে যাওয়া পেট আর ক্ষত-বিক্ষত নাক-মুখ নিয়ে উল্টে পড়ে রইল।

যেভাবে শুরু হয়েছিল, তারচে’ দ্রুত থেমে গেল গোলাগুলি। মুহূর্তে পাথুরে ভূমিটা জনশূন্য হয়ে পড়ল; কেবল মৃত অ্যাপাচির আহত ঘোড়াটা অসহায়ের মত পড়ে পড়ে পা ছুঁড়তে লাগল যন্ত্রণায়।

দ্রুতপায়ে হেঁটে সাওলোর কাছে চলে এল নিগ্রো হাব। ওর কালো মুখ উত্তেজনায় জ্বলজ্বল করছে; দারুণ উপভোগ করছে যেন সে পুরো পরিস্থিতিটা।

‘মি. স্টেইভ, ওর গলায় উল্লাস। ‘একজনকে ফেলে দিয়েছি আমি।’

‘গুড বয়!’ উৎসাহ দিল সাওলো ওকে।

‘স্টেইভ।’

সামান্য চমকাল সাওলো। মেলোডি ডাকছে ওকে চাপা গলায়। ঘাড় ফিরিয়ে চাইল ও। একটা পাথরে হেলান দিয়ে বসে আছে ডেপুটি শেরিফ। ওর মুখ বুকের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। মেলোডি ধরে রেখেছে ওকে। গ্যানোর দু’হাত ওর বুকে, আঙুলের ফাঁক গলে রক্ত বেরোচ্ছে অঝোরে। যন্ত্রণায় শেরিফের অলিভ রঙের মুখ ফ্যাকাসে।

‘হায় খোদা… হায় খোদা!’ গ্যানোর দিকে চেয়ে চেঁচিয়ে উঠল ম্যাগি। হামাগুড়ি দিতে শুরু করল মেয়েটা পাগলের মত। ‘এখানে আমরা সবাই মারা যাচ্ছি। হায় খোদা!’

ওর দিকে তাকাল না সাওলো একবারও। দ্রুত পদে গ্যানোর কাছে চলে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *