জ্বালা – ৪

চার

ইনজুন! ইনজুন! ইনজুন!

ঘোড়ার চলার তালে তালে সাওলোর মাথার ভেতর বাজছে মেয়েটির দেয়া গালটি। জ্বালা ধরে যাচ্ছে ওর গায়ে; সাথে সাথে অবাকও লাগছে এরপরও মেয়েটাকে থামতে বাধ্য করছে না বলে। এটা ঠিক নয়।

তবে মেয়েটির জন্যে এক ধরনের সহানুভূতিও বোধ হয় কাজ করছে ওর মধ্যে। অ্যাপাচিদের কবল থেকে ভয়াবহ দুঃস্বপ্নের স্মৃতি নিয়ে মুক্তি- পাওয়ায় মেয়েটি হয়তো ওর হাফ-অ্যাপাচি মুখ দেখে নিজেকে স্থির রাখতে পারছে না; প্রবল প্রতিক্রিয়ায় তীব্র ঘৃণার সঙ্গে থুতু ছড়িয়ে দিতে চাইছে। স্বাভাবিক অবস্থায় ইন্ডিয়ানদের প্রতি শাদা মানুষদের এই মনোভাব কিছুটা লুকানো থাকে, কিন্তু এধরনের অবস্থায় নগ্নভাবে প্রকাশ হয়ে পড়ে তা।

শাদা মানুষ! সাওলো জানে, শাদা মানুষেরা কী I

চোদ্দ বছর বয়সেই প্রথম শাদা মেয়েমানুষ সম্পর্কে সচেতন হয়েছিল সে। ওর কাছে নিজের মাকে কখনও শাদা মেয়ে মানুষ মনে হত না; ভাবত ওটা অ্যাপাচিদেরই আরেকটা ধরন। এদিকে সান লাজেরোর এজেন্টের বউ মিসেস ক্যাম্পবেল ছিল যুবতী এবং সে ইন্ডিয়ানদের একদম পছন্দ করত না। ইন্ডিয়ানদের সান্নিধ্যে বিরক্ত হত, সে জন্যে ওদের কাছে যাবার সময় এক বোতল স্মেলিং সল্ট সঙ্গে রাখত।

কিন্তু মিশনারির বউ ছিল অন্য ধরনের। সাওলোর ভাল লাগত ওকে। প্রায় সময় মিশনের চারপাশে ঘুর ঘুর করত সে আর টুকটাক কাজ করে দিত। এক সময় রেভারেন্ড মি. এবং মিসেস স্টেইভ ওকে অনানুষ্ঠানিকভাবে হলেও সন্তান হিসাবে স্বীকৃতি দেন, এমনকী, তাঁদের শেষ নাম ব্যবহারের অনুমতিও দেন। মিসেস স্টেইভ তাকে শেখান কিভাবে সুন্দর জীবনযাপন করতে হয়, কিভাবে অন্যের সাথে ভাল ব্যবহার করতে হয়। ষোলো বছর বয়সে রিজার্ভেশন থেকে বেরিয়ে আসে সে। তার রক্তে তখন অস্থিরতার ঢেউ, কল্পনায় কঠিন জীবনের লোভনীয় হাতছানি।

এর কয়েকমাস পরে ওর সঙ্গে বিশালবক্ষা হেনা পিয়েটের পরিচয় হয় হেনা তখন নচেসে ওর সদ্যপ্রয়াত স্বামীর পরিত্যক্ত নোংরা বিশাল বাড়িটায় থাকত। সাওলো ওর আশ্রয়ে খেতে পরতে পেত আর রাতে ওর সাথে ঘুমোত। ওর প্রতি কৃতজ্ঞ ছিল সে, তবে ওর কাছেও হেনার কৃতজ্ঞ থাকার যথেষ্ট কারণ আছে বলে মনে করত।

সুতরাং শাদা মেয়ে মানুষদের সম্পর্কে ভালই জানা আছে ওর।

.

দুপুরের দিকে দুটি রিজের মাঝখানে একটা শৈলশিরায় পৌছল ওরা। শৈলশিরাটার নিচ দিয়ে চলে গেছে স্টেজ রোড; বিশাল মরুভূমির মধ্য দিয়ে যাওয়া রাস্তাটাকে একটা ধূসর ফিতের মত দেখাচ্ছে। কিন্তু অঞ্চলটি উঁচু- নিচু, ফলে কিছুদূর গিয়ে রাস্তা হারিয়ে গেছে টিলা-টক্করের আড়ালে। তবে সাওলো জানে, ঠিক কোথায় আছে ওরা। এখান থেকে ট্যুবাক এবং সিলভারটনের দূরত্ব প্রায় সমান, ট্যুবাক হয়তো সামান্য কাছেই হতে পারে।

কিন্তু এ-মুহূর্তে দরকার বিশ্রাম। একটা বিশাল পাথরখণ্ড চোখে পড়ল ওর। সূর্যকে আড়াল করে প্রচুর ছায়ার সৃষ্টি করেছে ওটা। আশ্রয় হিসেবে জায়গাটা পছন্দ করল সে। ম্যাগির দিকে চাইল। নিস্তেজ হয়ে পড়েছে মেয়েটা, ঘোড়ার পিঠের ওপর নুয়ে পড়েছে ওর মাথা। তবে চোখের দৃষ্টি স্বচ্ছ, জ্বলজ্বল করছে ঘৃণায়। পাত্তা দিল না সাওলো; ওকে ঘোড়ার পিঠ থেকে নামতে সাহায্য করার জন্যে হাত বাড়াল। ওর হাত এবং কাঁধে ভর দিয়ে নেমে এল মেয়েটি; তবে, সাওলো অনুভব করল, ওর শরীর এখনও শক্ত, অনমনীয়

পাথরের ছায়ায় গিয়ে ক্লান্তিতে ধপ করে বসে পড়ল ম্যাগি। এক মুঠো জার্কি আর দু’চুমুক পানি বাড়িয়ে দিল সাওলো ওর দিকে। বাকি পানিটা দূরে সরিয়ে রাখল। পানির স্টক দ্রুত ফুরিয়ে আসছে; ফ্লাস্কে আর আধ পাইন্ট পানি থাকতে পারে।

খুব বেশি দূর হেঁটে যাবার অবস্থা নেই ম্যাগির, ওর ঘোড়াটারও সে অবস্থা। স্টেজের অপেক্ষায় রাস্তার দিকে চোখ রেখে কাছাকাছি কোথাও বসে থাকবে কি না ভাবল সাওলো।

কুরিয়াপোর কথা ভাবল ও। রক্তপিপাসু রাক্ষসটা নির্ঘাত সাওলোর ট্রেইল ধরেছে এখন; একটুও থামবে না সে, বাজি ধরে বলতে পারে সাওলো।

সিদ্ধান্ত নিল ও। ম্যাগিকে ঘোড়ায় চড়িয়ে নিজে হেঁটে যাবে। তাতে ম্যাগি আর ওর ঘোড়া দু’জনেরই বিশ্রাম হবে। ওর জেবরা ডানটা মরুভূমির ঘোড়া, প্রয়োজনে সামান্য পানি আর যৎকিঞ্চিত টরনিল্লো বীনস কিংবা ক্যাকটাসের ওপর নির্ভর করে টিকে থাকতে পারে।

ঘোড়ার পিঠে ম্যাগি, সাওলো হেঁটে যাচ্ছে। কিছুদূরে ঢালু হয়ে নেমে গেছে স্টেজ রোড। ওখানে রাস্তায় স্টেজকোচের চাকার দাগ চোখে পড়ল ওর। মাত্র ঘণ্টাকয়েক আগের পুরানো দাগ। সম্ভবত সকালের দিকেই পেরিয়ে গেছে স্টেজকোচটি। হতাশ হলো ও। এর মানে, আগামী কয়েকদিনের জন্যে আর স্টেজকোচ পাওয়ার সম্ভাবনাটা রইল না।

পশ্চিমে ট্যুবাকের দিকে মুখ করল সাওলো; গতি বাড়াচ্ছে না, হেঁটে যাচ্ছে ধীর পদক্ষেপে। মাথার ওপর সূর্য আগুন ঢালছে, তীব্র রোদে ঝলসে যাচ্ছে বিস্তীর্ণ খোলা অঞ্চল। দরদর করে ঘামছে ও, চামড়া জ্বলে যাচ্ছে। তবে আপাতত মন দিচ্ছে না ওদিকে, আশপাশ পর্যবেক্ষণ করছে অখণ্ড মনোযোগে। হঠাৎ থেমে গেল ও। বসে পড়ল রাস্তার ওপর। নালবিহীন ঘোড়ার পায়ের ছাপগুলো এখনও তরতাজা।

অ্যাপাচি!

ওপর-নিচ মাথা দোলাল সাওলো। স্টেজকোচটার পেছন পেছন গেছে অ্যাপাচিদের দলটা।

সামনে তাকাল সাওলো। রাস্তাটা উঁচু হয়ে উঠে গেছে একটা পাহাড়ের মাথায়। এরপর ঢাল বেয়ে নিচে নেমে চোখের আড়ালে চলে গেছে। সাওলো জানে, স্টেজকোচ এবং তার যাত্রীদের ভাগ্যে যা-ই ঘটুক, তা ঘণ্টা কয়েক আগেই ঘটে গেছে; তবু সতর্কতায় টান টান হয়ে উঠল ওর শরীর। ধীরে ধীরে সামনে এগুলো সে, ঢাল বেয়ে নিচে নামল; তারপরই দেখতে পেল দৃশ্যটা।

রাস্তায় পড়ে আছে স্টেজকোচ; ঘোড়াগুলো মৃত। রক্ত-মাংস দলা পাকিয়ে গেছে হারনেসের সাথে। তবে মানুষের মৃতদেহ দেখা যাচ্ছে না কোথাও।

লঘুপায়ে হেঁটে কোচটার কাছে গেল সাওলো। খুঁটিয়ে দেখতে লাগল কোথাও কোনও সূত্র পাওয়া যায় কি না। বিমুখ হতে হলো না ওকে। প্রচুর চিহ্ন ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ওটার চারপাশে। অ্যাপাচিরা, সচরাচর যা করে থাকে, ঘোড়াগুলোর দখল নিতে চেয়েছে। স্টেজ থামানোর জন্যে প্রথমে তাই সামনের ঘোড়া দুটোকে হত্যা করে বাকিগুলোকে থামিয়েছে।

স্টেজের দরজা টেনে খুলল ও। এক ঝাঁক মাছির গুঞ্জন শোনা গেল ভেতরে, উড়তে শুরু করল মাছিগুলো। একটা মৃতদেহ পড়ে আছে ভেতরে। রক্ত শুকিয়ে জমাট বেঁধে গেছে বুকের কাছটায়। হাতদুটো বুকের ওপর ভাঁজকরা।

লোকটার পরনে কাজের পোশাক; সুতরাং যাত্রী নয়—ড্রাইভার কিংবা গার্ড হবে। অবশ্য সাধারণ যাত্রী হবার সম্ভাবনাকেও একদম উড়িয়ে দেয়া যায় না। তবে স্টেজকোচ আক্রমণে সাধারণ ড্রাইভার বা গার্ডকে প্রথম টার্গেট হিসেবে ধরা হয়ে থাকে।

মৃত লোকটার হাতের পাতা উল্টে দেখল সাওলো। কড়াপড়া হাত নয়, মোটামুটি মোলায়েম; ড্রাইভারদের হাত কড়া পড়া থাকে। তাহলে সম্ভবত স্টেজকোচের গার্ড ছিল মৃত লোকটা।

স্টেজকোচের অপরাপর যাত্রীদের কথা ভাবল সাওলো। অ্যাপাচিরা যেহেতু এদের বন্দী করে নেয়নি, সুতরাং ড্রাইভার আর অন্যরা পালিয়েছে নিশ্চয়। কিন্তু কিভাবে? যদ্দূর বোঝা যাচ্ছে, কুরিয়াপোর আক্রমণকারী দলটি ছোট ছিল না—ওর দলের প্রায় সবাই এতে উপস্থিত ছিল। স্টেজের ভেতরে বাইরে পরিত্যক্ত গুলির খোসার ছড়াছড়ি; বোঝাই যাচ্ছে, পালাবার আগে রীতিমত হেভি একটা ফাইট দিয়েছে যাত্রীরা।

কিন্তু তাতে তো জয়ী হবার কথা নয় তাদের। রাস্তার ওপর খোলা জায়গায় পড়ে আছে স্টেজকোচটা, অ্যাপাচিদের গুলি থেকে আড়াল পাবার মত কিছুই নেই। চারপাশের অসংখ্য পাথরকে আড়াল হিসেবে ব্যবহারের সুবিধা পেয়েছে অ্যাপাচিরা, অতএব ওদের হেরে যাবার কথা নয়।

তাহলে কিভাবে বেঁচে গেল স্টেজযাত্রীরা?

ব্যাপারটা বোঝার জন্যে একটুও মাথা ঘামাতে হল না সাওলোকে। আসলে স্টেজযাত্রীরা তাদের সর্বশক্তি দিয়ে প্রতিরোধ সৃষ্টি করলেও তাদের হেরে যাওয়াটা ছিল স্রেফ সময়ের ব্যাপার। কুড়িজন অ্যাপাচির সম্মিলিত আক্রমণে তাদের অবস্থা স্টেজের ঘোড়া দুটোর মতই হত; কিন্তু নাবুতোর কাছে সাওলোর খবর পাওয়ামাত্র স্টেজ লুটের ব্যাপারটা গুরুত্বহীন হয়ে যায় কুরিয়াপোর কাছে। এক মুহূর্ত দেরি করেনি ও, যে অবস্থায় ছিল, স্টেজযাত্রীদের ঠিক সে অবস্থায় রেখে সাওলোকে ধরার জন্যে রওয়ানা হয়ে যায় ও। আর তাতেই অক্ষত অবস্থায় পালাতে পেরেছে শ্বেতাঙ্গরা।

আরেকটু খুঁজতেই ওদের ট্র্যাক পেয়ে গেল সাওলো। অ্যাপাচিরা অপ্রত্যাশিতভাবে আক্রমণ প্রত্যাহার করে নেবার পর একমুহূর্তও দেরি করেনি ওরা, পশ্চিমে ট্যুবাকের দিকে যাত্রা শুরু করে দিয়েছে

ওদের পায়ের ছাপ পরীক্ষা করতে লাগল সাওলো। চ্যাপ্টা হীলের জুতো-পরা দু’জনের মধ্যে একজন নিশ্চয় ড্রাইভার, অন্যজন মাইনার হতে পারে। কোন কাউবয় নেই দলটিতে। বাকি দুজন লোকের মধ্যে একজন, জুতোর হালকা ছাপ থেকে ধরে নিল ও, মহিলা।

পাঁচজন লোক এবং তাদের একজন মহিলা। সম্ভবত ওদের কারোরই ধারণা নেই এরকম রোদে জ্বলা ঊষর প্রান্তরে হেঁটে যাবার পরিণতি কী হতে পারে। ওদের ধরতে হবে, সিদ্ধান্ত নিল ও। সে নিজেও অবশ্য হেঁটে যাচ্ছে, তবে একটু পা চালিয়ে গেলে ধরে ফেলা অসম্ভব হবে না। ও শুধু এখন মনে- প্রাণে কামনা করছে, ওদের সঙ্গে যেন পানি থাকে।

ঘণ্টা খানেকের মধ্যে ম্যাগির চোখ ঘুমে জড়িয়ে আসতে লাগল। ঘোড়া থামিয়ে ওটার পেটের সাথে মেয়েটির দু’হাঁটু আর পমেলের সাথে কবজি দুটো বাঁধল সাওলো।

মাথার ওপর বত্রিশ দাঁত মেলে নিঃশব্দে হাসছে সূর্য। মরুদিগন্তে অযুত তরঙ্গে উদ্বাহু নৃত্যে মেতেছে শ্বেতশুভ্র তাপ। মাথার ভেতর মগজ যেন টগবগ করে ফুটছে, তাপের সূক্ষ্ম কণা কাঁটার মত বিধছে চোখের ভেতর। কুরিয়াপো আসুক আর না-ই আসুক, আগে তাদের দরকার লম্বা বিশ্রাম আর ঘুম—এবং তা এ-মুহূর্তেই। এছাড়া পানির ব্যবস্থাও করতে হবে। খুঁজে পেতে হবে লুকোনো কোনও উৎস, এর জন্যে যদি মূল্যবান কিছু ঘণ্টার অপচয়ও ঘটে, তাও সই।

আপাতত স্টেজযাত্রীদের ট্রেইলে লেগে রইল সাওলো। যদ্দূর মনে হচ্ছে ওরা বেশি দূরে নেই আর। দলের মহিলার হাঁটতে বোধ হয় সমস্যা হচ্ছে। পায়ের স্খলিত অগভীর ছাপ থেকে বোঝা যাচ্ছে সেটা। চারদিকে একশিলা পাথরের মধ্য দিয়ে বয়ে-যাওয়া রাস্তাটি এঁকেবেঁকে গেছে; প্রচণ্ড সূর্যালোকে পুড়ে কমলালেবুর রঙ ধারণ করেছে প্রাচীন পাথরগুলো।

দাঁড়াও ওখানে। একদম নড়বে না। হাতদুটো মাথার ওপর তোলো।’ সঙ্গে সঙ্গে দাঁড়িয়ে পড়ল সাওলো। অবাক হয়নি ও মোটেও। সামনে ঝোপে ঢাকা পাথরের আড়াল হতে ভেসে এসেছে লোকটার গলার স্বর। মনে মনে হাসল সাওলো। আনাড়ি লোক। ওর ধারণা, ঝোপঝাড় আর পাথরের ওপাশে ভালই আড়াল নেয়া হয়েছে। কিন্তু ওর রাইফেলের ব্যারেলটি স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, কপালের ওপর নামিয়ে পরা হ্যাট, মুখের খোড়ো রঙ আর পরনের কাপড় কিছুই বাদ যাচ্ছে না।

‘বলো, শুনছি,’ সাওলো সাড়া দিল।

‘যেভাবে আছ, সেভাবে থাকো, আদেশ করল লোকটি, তারপর কাঁধের ওপর দিয়ে পেছনে চাইল। ‘ঠিক আছে, বেরিয়ে আসো সবাই।’

পাথর বেয়ে বেরিয়ে এল লোকটা, রাস্তার ওপর এসে সাওলোর কাছ থেকে গজ পাঁচেক দূরে দাঁড়াল।

ঝোড়ো কাকের মত চেহারার গাট্টাগোট্টা লোকটাকে ভূতের মত লাগছে। মুখটা একটু বাঁকানো, বিষণ্ন, বুলডগের মত। রাইফেলটা অবহেলে ধরে আছে ও। তবে অস্ত্র ধরার ভঙ্গি থেকে সাওলোর সন্দেহ হলো, অস্ত্রের মালিক ওটা ঠিকমত চালাতে জানে কি না।

‘নাম কী তোমার?’

সাওলো দাঁড়িয়ে আছে সহজ ভঙ্গিতে। ‘পেছনের স্টেজকোচটা কি তোমাদের ছিল?’ জানতে চাইল সে।

ওপর-নিচ মাথা দোলাল লোকটা। ‘আমি ওটার ড্রাইভার। কার্প ইয়েটস আমার নাম।’ তামাক-চিবানো থুথু ফেলল সে রাস্তার পাশে। ‘তোমারটা বলোনি।’

‘সাওলো স্টেইভ।’

অন্যরাও বেরিয়ে এসেছে ততক্ষণে। আঙটির মত গোলাকার এক সারি পাথরের আড়ালে অপেক্ষা করছে। ওদের একজনের পরনে আর্মির ড্রেস, পুরানো, রঙচটা। বাকি দু’জনকে পোশাকে-আশাকে কিছুটা ভদ্রগোছের মনে হচ্ছে। আরেকজন নিগ্রো, ওর দিকে উৎসুক দৃষ্টিতে চাইল সাওলো। অন্যসব কৃষ্ণাঙ্গের মতই সে, তবে অতটা পরিপাটী নয় চেহারায়। শাদা, ফ্যাশনেবল পোশাক পরা বাকি জন আরেকটা পাথরের আড়ালে মেয়েটার সঙ্গে দাঁড়িয়ে; পাথুরে ভূমিতে চলাফেরায় সাহায্য করছে ওকে।

রাইফেলটা বাহুর ওপর তুলে নিয়ে সামনে এগোল ড্রাইভার। ‘তোমার পেছনে ওটা কে, বাছা? তোমার বউ?’

‘না।’

‘গুড গড! দাঁড়িয়ে পড়ল লোকটা, তাকাল তেরছা চোখে। ওকে এভাবে বেঁধে রেখেছ কেন?’

‘ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে হাত-পা না-ভাঙার জন্যে।’

‘তাই নাকি! অতটা খারাপ ওর অবস্থা?’

ইয়েটসের গলা এখন কিছুটা মৃদু, তবে রাইফেলটা নামায়নি এখনও; সোজা সাওলোর বুক সই করে রয়েছে ওটার নল। ‘তোমার কথা সত্যি বলে মনে হচ্ছে। এবার ওর বাঁধন খুলে দেয়া যায়, কী বলো?’

ম্যাগির মাথা ঝুঁকে আছে সামনের দিকে; দড়ির বাঁধনটাই কেবল কিছুটা সোজা রেখেছে ওকে। ড্রাইভারের কথা শুনে মাথা তুলল ও, চারদিকে তাকাল শূন্যদৃষ্টিতে, তারপর সাওলোর দিকে চোখ ফেরাল; ওর চোখে এখনও ঘৃণা আর অবিশ্বাস।

হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল মেয়েটা, ‘মি. ইয়েটস? ওহ, মি. ইয়েটস, তুমি?’

‘আরে! চমকে উঠল ড্রাইভার। ‘এ যে দেখছি পার্ক হডসনের মেয়ে!’ সাওলোর দিকে চাইল ও। এ ব্যাপারে নিশ্চয় দেবার মত জবাব তোমার আছে?’ রাইফেল নাড়াল। ‘বলো, শুনি।’

‘বলব, রাজি হলো সাওলো। তবে তার আগে আমাদের দরকার পানি আর বিশ্রাম।’

ম্যাগিকে বন্ধনমুক্ত করার জন্যে ঘোড়ার কাছে গেল ও। দড়ি খোলার জন্যে মেয়েটির কবজিতে হাত রাখামাত্র চেঁচিয়ে উঠল ও, ‘মি. ইয়েটস, খোদার দোহাই, ওকে ছুঁতে দিয়ো না আমায়।’

‘ঠিক আছে, মিস্টার।’ রাইফেলের লিভারে টান দিল ইয়েটস। দূরে সরে দাঁড়াও ওর কাছ থেকে।’

‘সেও ওদের একজন!’ হড়বড় করে বলতে শুরু করল ম্যাগি, ‘দেখতে পাচ্ছ না তোমরা? ওর দিকে তাকাও না!’

‘সত্যি বলছে ও, ইউনিফর্ম পরা লোকটা সায় দিল মৃদু স্বরে। সাওলোর এক গজের ভেতর চলে এল ও। বিয়ারের পিপের মত মোটা শরীর ওর, থ্যাবড়া ঠোঁটঅলা নিষ্ঠুর মুখের দু’পাশে মোটা জুলফি, দেখাচ্ছে বুনো মোষের মত। ‘এই বদমাশটার দিকে তাকাও। ইন্ডিয়ান ও দোআঁশলাও হতে পারে। নইলে আমার নাম সার্জেন্ট ওয়াল্টারই নয়।’

‘ঠিক আছে,’ নাক গলাল ইয়েটস, ‘আমি দেখছি ওকে। তুমি ওর বাঁধন খুলে দাও, সার্জ।’

একপাশে দাঁড়ানো জেবরা ডানটার দিকে এগোল প্রাক্তন সৈনিক ওয়াল্টার। কাছাকাছি হতেই প্রবল বেগে মাথা ঘোরাল ঘোড়াটা; দাঁত বের করল কামড়ে দেবার ভঙ্গিতে।

‘উরেব্বাপ!’ লাফিয়ে পিছিয়ে এল ওয়াল্টার। এ যে দেখছি আস্ত শয়তান!’ হোলস্টারে হাত দিল সে।

‘হো-সাহ্!’ সাওলো শান্তভাবে কথা বলল ঘোড়াটার সাথে। সঙ্গে সঙ্গে থেমে গেল ঘোড়াটা। ‘যাও এবার।’ ওয়াল্টারের দিকে ফিরে ইঙ্গিত করল সে।

পকেট থেকে ছুরি বের করল ওয়াল্টার, মেয়েটার বাঁধন কাটল, তারপর নামতে সাহায্য করল ওকে। দাঁড়াতে পারছে না মেয়েটা। বিড়বিড় করে গাল বকল ইয়েটস, বাঁধন কষে গিয়ে কালসিটে দাগ পড়ে গেছে ম্যাগির দু’হাতের কবজিতে।

‘ওখানে ছায়ায় বসাও ওকে। কেউ একজন ক্যান্টিনটা নিয়ে এসো, তাড়াতাড়ি।’

‘হাব, ওটা নিয়ে আসো।’

‘এক্ষুণি আনছি, মি. স্টিফেন।’

শাদা সৌখিন-পোশাক দিয়েছে আদেশটা, আদেশ পালনে তৎপর হলো নিগ্রো হাব। পাথরের ওপারে চলে গেল ও, একটু পরে ফিরে এল ক্যান্টিনসহ।

‘মি. ওয়াল্টারকে দাও ওটা,’ আদেশ দিল স্টিফেন।

‘দিচ্ছি, স্যার।’

স্টিফেনের হাতে একটা ওয়াকিং-স্টিক, ওটার ওপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়েছে ও। শান্ত, বিতৃষ্ণ চোখে দেখছে সব কিছু, যেন কিছুতেই ক্ষমা করতে পারছে না চলমান ঘটনাগুলোকে। ওর মুখ ছিমছাম, চটপটে, হাসিমাখা; কথাবার্তা আচারসিদ্ধ, উচ্চারণে আভিজাত্যের টান। কিছুটা বিবর্ণ হলেও চুলগুলো পরিপাটী করে আঁচড়ানো, আর নাকের নিচে চমৎকার ছাঁটের একজোড়া গোঁফ। ওর গায়ে লিনেনের শাদা রঙের শার্ট— ধূলিধূসর; ফুলের নক্সাঅলা ওয়েস্টকোটটা যাতে সবার চোখে পড়ে, সেভাবে খোলা কোটের বোতাম। কোমরে হোলস্টার, বহু ব্যবহারে মলিন পিস্তলের বাঁট। স্টিফেনকে এক নজরে চিনতে গেলে ভুল করার যথেষ্ট সম্ভাবনা থেকে যাবে, যে-কারও জন্যেই।

ম্যাগিকে পানি খাওয়াচ্ছে ওয়াল্টার। ম্যাগি আরও পানি চাইছে। এখন না, ম্যাম, আরেকটু পরে আবার পাবে, ওকে বোঝাচ্ছে সে। সোজা হয়ে দাঁড়াল এরপর, সাওলোর দিকে চেয়ে হাসল; কুৎসিত হাসি। ‘তোমার রাইফেলটা একটু দাও তো আমাকে মি. ইয়েটস, দোআঁশলাটাকে এখানেই শুয়ে দিই।’

‘না।’ একমত হলো না ইয়েটস ওর সাথে। আগে আমাদের বর্তমান ঝামেলা থেকে মুক্ত হতে হবে। ম্যাগির দিকে ফিরল ও, তারপর মিস হডসন, ঠিক কী ঘটেছিল খুলে বলো তো?’

‘ওকে, একটা মসৃণ পাথরের গায়ে হেলান দিয়ে বসেছে ম্যাগি, ওয়েটসের কথায় এপাশ-ওপাশ মাথা নাড়াল, আঙুল উঁচিয়ে দেখাল সাওলোকে, ‘ওকে ওকে ওকে…ওকে জিজ্ঞেস করো! ওই করেছে এসব!’

‘কী করেছে? কী করেছে ও, ম্যাম? সব খুলে বলো।’

‘ও তো আধাআধি পাগল হয়ে গেছে, চতুর্থ যাত্রীর গলা শোনা গেল। ‘বুঝতে পারছ না তোমরা?’

চমৎকার সুরেলা কণ্ঠ মেয়েটির, তাকাল সাওলো ওর দিকে, পূর্ণ দৃষ্টিতে। সুগঠিত স্বাস্থ্যের লম্বা মেয়েটি, ঠাণ্ডা এবং এক কথায় সুন্দর। অগ্নিশিখার মত টকটকে লাল ওর চুলের রাশি, ত্রিশের মত হবে বয়স।

মেয়েটির পরনে গভীর জলরঙা সিল্কের পোশাক, দামী। ধুলো-বালি জমেছে পোশাকের ওপর। ক্লান্ত ও বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে মেয়েটাকে, সম্ভবত পথশ্রমে। শরীরের রঙ মাখনের মত, বড় ব্রিমের স্ট্র হ্যাটের নিচে ঢাকা পড়েছে ওর রোদে মলিন চিবুক আর গলা।

আমারও তাই মনে হচ্ছে, ম্যাম,’ যথাসম্ভব বিনীত কণ্ঠে ওর সাথে ঐকমত্য প্রকাশ করল ইয়েটস। ‘কিন্তু আমাদের সমস্ত ঘটনা জানা দরকার।’

সাওলোর দিকে ইঙ্গিত করল মেয়েটা, ‘ওকে কেন জিজ্ঞেস করছ না?’ চমৎকার আকর্ষণীয় একজন মহিলা, মনে মনে স্বীকার করল সাওলো, একদম রাণীর মত।

নাক ঝাড়ল ওয়াল্টার ঘোঁৎ করে। ‘ধ্যাৎ, ম্যাম, আমার বিশ্বাস বদমাশটা আগাগোড়াই মিথ্যে বলবে।

‘তুমি কিভাবে জানো?’

‘কেন, ওর নোংরা চেহারাই বলে দিচ্ছে ও একজন মিথ্যেবাদী। আমার তো মনে হয়, ও কুরিয়াপোর চেলাদের একজন।

‘ওর চোখ, চুল আর রঙ দেখেই বলে দিচ্ছ?’ মৃদু হাসল মেয়েটা। ওর কাপড়-চোপড়, মালপত্র আর ওর ইংরেজি উচ্চারণের দিকে খেয়াল করো তো? সামান্য যেটুকু শুনেছি, তাতে মনে হচ্ছে না ও ইংরেজি তোমার চেয়ে খারাপ বলে।

‘কিন্তু হো-সাহ্ শব্দটা আমি ইনজুনদেরই বলতে শুনেছি ঘোড়া সামলানোর সময়। আমার ধারণা ও দোআঁশলা। তুমি কী বলো, ভাই?’

‘বলার সুযোগই তো দিলে না এতক্ষণ,’ নির্বিকার মুখে বলল সাওলো। ‘আমার মা ছিল শ্বেতাঙ্গ, বাবা অ্যাপাচি। অ্যাপাচিদের সাথে বড় হয়েছি আমি। এটাই হলো ঘটনা।’

‘এবং আরও ঘটনা হলো একজন দোআঁশলা শত্রু শাদাদের পোশাক পরে এবং ইংরেজি রপ্ত করে চারদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে।’ হাতের রাইফেল নাড়াল ইয়েটস। ‘আর এখন পার্ক হডসনের মেয়েটাকে ঘোড়ার সাথে বেঁধে এ পথ ধরে চলে যাচ্ছে। সম্ভবত একটা গল্পও তৈরি আছে তোমার এ ব্যাপারে?’

‘আছে, তবে গল্প নয়। দিন চারেক আগে পার্ক হডসনকে আক্রমণ করেছিল কুরিয়াপোর চার চেলা। আমি যখন ওকে পাই, তখন ও মারাই যাচ্ছিল। মরার আগে কী ঘটেছিল তা, আর মেয়ের খবরটা বলে যেতে পেরেছিল। অনুরোধ করেছিল মেয়েটাকে উদ্ধার করার জন্যে। আমি ওর মেয়েকে উদ্ধার করেছি ওদের হাত থেকে। ব্যাপার এটাই।’

‘ব্রাদার,’ কথা বলল ইয়েটস, ‘ব্যাপারটা অত সোজা নয়। তুমি কি জানো যে, তুমি একজন দোআঁশলা?’

‘জানি—এবং বলেছিও তোমাদের।’

‘তাহলে তুমি কি বলতে চাচ্ছ যে, চার-চারজন ষণ্ডামার্কা অ্যাপাচিকে ধাওয়া করে এবং ওদের কাবু করে মেয়েটাকে ছিনিয়ে নিয়েছ তুমি? হয়তো তুমি এটাও চাও যে, তুমি তাদের চারজনকেই হত্যা করেছ, এটা আমরা বিশ্বাস করি।’.

‘তিনজন। একজন পালিয়েছে।’

‘যীশু,’ গুঙিয়ে উঠল ওয়াল্টার, ‘তুমি রক্ষে করো!’ মেয়েটির দিকে ফিরল ও বিজয়ীর ভঙ্গিতে। ‘কী, বলেছিলাম আমি?’

‘হডসনের দোকানটা এখান থেকে কোনদিকে?’ সাওলো জানতে চাইল।

‘পুবদিকে,’ জবাব দিল ইয়েটস। ট্যুবাকের এদিকে মাইল ত্রিশেক হতে পারে। আমরা ওদিকেই যাচ্ছিলাম।’

‘আমিও। খেয়াল করেছ নিশ্চয়?’

গম্ভীরভাবে মাথা দোলাল ইয়েটস। ‘অর্থাৎ বলতে চাচ্ছ, ওকে ওর মৃত বাপের কাছে নিয়ে যাচ্ছিলে। তাই না?’

‘ব্যাপারটা নিয়ে ঠাট্টা কোরো না, মিস্টার।’

‘না করার কোনও কারণ আছে?’

ইয়েটসের ওপর থেকে চোখ সরাল সাওলো। তাকাল অন্য সবার দিকে। মেয়েটার চোখদুটো জীবন্ত, আকর্ষণীয় ও বুদ্ধিদীপ্ত মনে হচ্ছে। গরমচোখে চেয়ে আছে ওয়াল্টার, ওর দৃষ্টিতে চরম সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলার আভাস। উদাসীন চোখ স্টিফেনের, যেন এসবের ধারে-কাছে ও নেই; নিগ্রো হাব নির্বিকার।

আবার ইয়েটসের দিকে চাইল ও। ইয়েটসের দৃষ্টি এখন সরল হয়ে এসেছে। পুরো ব্যাপারটা খুলে বলার দরকার বোধ করল সাওলো।

‘একে নিয়ে, ইশারায় ম্যাগিকে দেখিয়ে বলল ও, ট্যুবাকের দিকে যাচ্ছিলাম আমি। এখান থেকে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে অ্যাপাচিদের সাথে দেখা হয়েছিল।’

ওদের বিশ্বাস করানোর জন্যে যেটুকু দরকার, ঠিক সেটুকু খুলে বলল সাওলো। নাবুতোকে পালিয়ে যাবার সুযোগ দেবার কথাটা চেপে গেল, বলল, ও পালিয়েছে; বলল, অ্যাপাচিদের হাতে নির্যাতনের ভয়াবহতা মেয়েটির মাথা বিগড়ে দিয়েছে, তাই সাওলোকে অ্যাপাচি বলে ভাবছে। আর, কিছু গুছিয়ে চিন্তা করতে না পারায় অসংলগ্ন কথাবার্তা বলছে।

শেষ করল সাওলো। চোয়াল ঘষছে ইয়েটস, চিন্তা করছে; একটু পরে মাথা দোলাল। ‘সত্যি বলছে বলে মনে হচ্ছে।’

‘ম্যান,’ খেঁকিয়ে উঠল ওয়াল্টার। ‘বোকামি করছ তুমি। তুমি নিজেও একটু আগে বলেছ, একজন শাদা মানুষকে বাঁচানোর জন্যে তিনজন অ্যাপাচিকে খুন করতে পারে না ও।’

‘পারুক আর না-ই পারুক, ইয়েটস বলল, ‘ওর গল্পে কিন্তু কোনও ফাঁক নেই।’ রাইফেল নামাল ও, ‘মেয়েটাকে চুরি করে আনলে এতক্ষণে ওর সর্বনাশ করে, এমন কী ওকে খুন পর্যন্ত করে ফেলে যেতে পারত ও। সাথে নিয়ে শাদা মানুষদের শহরে যেতে চাইত না। আমি ওর কথা বিশ্বাস করেছি।’

স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল সাওলো। ‘তোমাদের পানির কী অবস্থা?’

‘সবার জন্যে আধা চুমুক করেও হবে না,’ ওয়াল্টার জবাব দিল। একটু থামল ও। ‘তাতে কী? কোন দোআঁশলার সাথে পানি শেয়ার করার ইচ্ছে নেই আমাদের।

ওকে পাত্তাই দিল না সাওলো; ইয়েটসের দিকে চাইল। মাথা নাড়ল ইয়েটস। ‘এটাই একমাত্র পানির ক্যান্টিন আমাদের। হডসন’স স্টেশনে পৌছার মত পর্যাপ্ত পানিও নেই। তোমরা দু’জন না এলেও একই অবস্থা হত। গ্যাড়াকলে পড়ে গেছি, ভাই। এদিকে স্টেজও বন্ধ। কুরিয়াপো আর ওর দলবলের জ্বালাতনের কথা শুনতে পেয়ে কর্তৃপক্ষ সার্ভিস প্রত্যাহার করে নিয়েছে।’

‘তা তোমাদের সফরটা খুব জরুরী মনে হচ্ছে?’

‘অতটা না। সফরটা মি. স্টিফেনের।’ শ্রাগ করল ইয়েটস। ‘ভাল টাকা পাচ্ছিলাম আমি, ডোবারও।’

‘গার্ড?’

‘হুঁ। গুলি ছোঁড়ার সুযোগও পায়নি বেচারা।’

উবু হয়ে বসল সাগুলো। ‘সফরটা বিপজ্জনক। তোমাদের, শাদা মানুষদের জন্যে রীতিমত ভয়াবহ। সাথে প্রচুর পানি থাকলেও শাদাদের পক্ষে এখান থেকে হডসনের স্টেশনের মত অতটা দূরে পায়ে হেঁটে যাওয়া সম্ভব নয়।’

‘এছাড়া আর কী করার আছে?’

‘আছে।’ ডানহাতের তর্জনি দিয়ে মাটিতে আঁকিবুকি কাটল সাওলো। ‘এই হলো রাস্তা…আর ঠিক এখানে, আমাদের থেকে ঠিক উত্তরে-পশ্চিমে হলো রেডোন্ডো ট্যাংকস, চেনো নিশ্চয়?

‘চিনি। কিন্তু ঠিক এ সময়টায় ওটা নাকি শুকিয়ে যায়—কিংবা পানি নষ্ট হয়ে যায়। খাওয়ার মত থাকে না।’

‘সব সময় শুকায় না। আর নষ্ট হয়ে গেলেও খাওয়ার উপযোগী করা যায়।’

‘আমাদের উত্তরে যেতে হবে। তোমার পরামর্শ মত চললে ওখানে পৌঁছতে অনেক সময় লাগবে।’

‘অনেক সময় লাগলেও পৌঁছতে পারবে।’ ইয়েটসের দিকে অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে চাইল সাওলো। রেডোন্ডোতে প্রচুর পানি পাবে তোমরা, ক্যান্টিন ভরে নিতে পারবে। এছাড়া ট্যুবার আর রেডোন্ডোর মাঝখানে আরেকটা লুকনো উৎস চিনি আমি। প্রয়োজনে ওখান থেকেও ক্যান্টিন ভর্তি করা যাবে।’

‘ম্যান,’ সাওলোর পাশে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল ড্রাইভার। ‘প্রচণ্ড উত্তাপে নরকের রাস্তার মত হবে পথটা; অবশ্য অ্যাপাচি এবং হয়তো তোমার জন্যে নয়। আমাদের জন্যে। তোমার কথামত প্রচুর পানি সাথে থাকলেও।

‘স্বাভাবিকভাবে হেঁটে গেলে তোমরাও পারবে,’ আশ্বাস দিল সাওলো, ‘প্রয়োজনে বিশ্রাম নেবে, দিনের সবচে’ গরম সময়টায় ঘুমিয়ে নেবে।’

‘বেশ। কিন্তু রসদের ব্যাপারটা কী হবে? আমাদের সাথে সামান্য ক’টা স্যান্ডউয়িচ ছাড়া আর কিছু নেই।’

হাসল সাওলো। ‘অ্যাপাচিদের মত পেটুক তোমরা নও নিশ্চয়। সামান্য খাবারে অনেকদিন কি করে কাটাতে হয়, আমি দেখিয়ে দেব।’

‘তুমি যে পারবে,’ মুখ বিকৃত করল ড্রাইভার ইয়েটস, ‘আমার তাতে সন্দেহ নেই। আমার চেয়ে বেশি চেনো হয়তো এ অঞ্চলটা। আমি কিন্তু ওই ট্যাংক খুঁজে পেতে গেলে নিজেই নিখোঁজ হয়ে যাব।’

‘হ্যাঁ, অঞ্চলটা চিনি আমি!’

‘যীশুর কসম, ইয়েটস, চেঁচিয়ে উঠল ওয়াল্টার, ‘তুমি নিশ্চয় এই দোআঁশলাটাকে বিশ্বাস করে ওর কথা মত…’

একটা পাথরের ওপর থুতু ফেলল ইয়েটস, পাথর বেয়ে ওটার গড়িয়ে পড়া দেখতে দেখতে বলল, ‘আমি বিশ্বাস করছি। তুমিও করতে শুরু করো। নরকের ভেতর দিয়ে আমাদের স্বর্গের দিকে পথ দেখিয়ে নিচ্ছে একজন ইনজুন, চিন্তাটা, আমার বিশ্বাস, ততটা খারাপ লাগবে না তোমার।’

‘আমার দরকার নেই’ উদ্ধতস্বরে জানাল ওয়াল্টার। ‘তোমার একার সিদ্ধান্তে চলবে না সবকিছু। আমি এ ব্যাপারে ভোটাভুটি চাইব।’

নাক গলাল স্টিফেন, ছড়ি দোলাতে দোলাতে রায় দিল, ‘ওটাই মনে হচ্ছে ভাল হবে। আমি ইয়েটসকে সমর্থন করছি। ওর পরামর্শটা সুচিন্তিত।’

‘আমি এর বিপক্ষে, ঘোঁৎ করে উঠল ওয়াল্টার। ‘আমাদের পথ দেখিয়ে নেয়ার পেছনে ওই দোআঁশলাটার সঙ্গত কোনও কারণ নেই।’ ডাচেসের দিকে ফিরল ও সমর্থনের আশায়। ‘আছে, ম্যাম?’

না থাকারও তো কোন কারণ…মানে…’ একটু ইতস্তত করল মেয়েটি, ‘আসলে থাকা-না থাকা কোনওটার ব্যাপারেই পুরোপুরি নিশ্চিত নই আমরা তবে তুমি একটু বেশি সন্দেহপ্রবণ, ওয়াল্টার।’

‘পক্ষে দু’জন বিপক্ষে একজন, ইয়েটস ঘোষণা করল, ‘ঠিক আছে, স্টেইভ।’

নিগ্রোর দিকে তাকাল স্টেইভ। ‘ভোট দেয়ার আরেকজন বাকি আছে।’

‘হাব আমার পক্ষে ভোট দেবে।’ গোঁফের ডগায় পাক দিল স্টিফেন।

‘সেটা ও-ই বলুক।’

আবার ঘোঁৎ করে উঠল ওয়াল্টার, ‘ওই নিগারটার আবার কিসের ভোট?’

‘বাস, বাস, মীমাংসার ভঙ্গিতে হাত তুলল ইয়েটস। ‘তাতে কিছু আসে যায় না। এখন পক্ষে তিন, বিপক্ষে এক। ওর ভোটে আর এমন কিছু হেরফের হবে না।’

‘উঁহু, মৃদু অথচ দৃঢ়স্বরে আপত্তি জানাল সাওলো, ‘ওর বক্তব্য অবশ্যই থাকা উচিত।

মেয়েটি হাসল। ‘অতটা সেন্সিটিভ হবার দরকার কী, বন্ধু? ওর ভোটও চাই, এই তো? তা তোমার ভোটটা কোন পক্ষে মি. হাব?’

‘উঁহু, শুধুই হাব,’ সংশোধনী আনল স্টিফেন। ‘হাব বোদ। মিস্টার- টিস্টার নেই। নাকি আছে, হাব?’

‘নেই, স্যার,’ জবাব দিল হাব। ‘একদম নেই।’

এক মুঠো বালি তুলে নিয়ে এক হাত থেকে অন্য হাতে নিল সাওলো। ফেলে দিয়ে হাত ঝাড়ল। হাবের দিকে না তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি কী বলো, হাব?’

‘আমি মি. স্টিফেনের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করছি, স্যার।’

এবার চাইল সাওলো ওর দিকে। ‘সাওলো অথবা স্টেইভ।’ পরক্ষণেই স্টিফেনের দিকে ঘুরল ওর চোখ। স্যার-ট্যার নেই।’

বিশাল গোঁফের ফাঁকে সামান্য হাসল স্টিফেন, নড করল পরিহাসের ছলে। তাহলে মি. স্টেইভ, আমরা এখন তোমার হাতে, কী বলো?’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *