জ্বালা – ১৪

চৌদ্দ

পরদিন ঠিক দুপুরের সময় ট্যাংকস এবং ট্যুবাকের মধ্যবর্তী উৎসটায় পৌছল ওরা। ম্যাকলিন পর্বতমালা থেকে উৎপন্ন একটা শুকনো ওঅশের মধ্যে উৎসটা।

ওঅশের বালুময় চত্বরে বিশ্রামের আয়োজন করল ওরা। হাঁটু গেড়ে বসে ওঅশের এক জায়গায় হাত দিয়ে বালু খুঁড়তে লাগল সাওলো। কিছুক্ষণের মধ্যে বড়সড় একটা গর্তের সৃষ্টি হলো। পানি দেখা গেল ওটার তলায়, কিছুক্ষণের মধ্যে গর্তটা ভরে গেল পানিতে। কিছুটা দূরে আরেকটা গর্ত খুঁড়তে শুরু করল ও একইভাবে।

ইয়েটস, অ্যাম্বারগো আর মেলোডি জিরোচ্ছে ছড়ানো ছিটানো পাথরের ছায়ায়। ভয়াবহ উত্তাপ স্পঞ্জের মত শুষে নিয়েছে ওদের সমস্ত প্রাণশক্তি। ইয়েটস আর মেলোডি লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল, চোখ বন্ধ করে ভাবছে ওরা; ক্লান্তি কাটানোর চেষ্টা করছে।

একটু দূরে আরেকটা পাথরের ছায়ায় হাঁটু মুড়ে বসে অ্যাম্বারগো, চারদিকে তাকাচ্ছে নিশ্চিন্ত ভঙ্গিতে; ওর চোখে কৌতুক। ঘোড়া চালাতে সুবিধা করে দেবার জন্যে ওর হাতদুটো পেছন থেকে সামনে এনে শেকলবদ্ধ করা হয়েছে। লম্বা হাতদুটো ওর হাঁটুর ওপর আলগোছে রাখা; মুখে সব সময়ের মত নোংরা কুটিল হাসি।

সন্ধের কিছু পরে সামনের সিলভার ক্যাম্পে পৌঁছার আশা করছে ওরা। সাওলোর মত কট্টর বাস্তববাদী মানুষও ক্রমশ বিশ্বাস করতে শুরু করেছে সেটা। তবে সেটা নির্ভর করছে পেছনে কুরিয়াপো কতদূরে আছে তার ওপর। ও জানে, কুরিয়াপো থেমে নেই। কোনওমতে কয়েকটা ঘোড়া ধরে নিয়ে কাঁচা রক্তের গন্ধ পাওয়া নেকড়ের মত সদলবলে ছুটে আসছে সে। জানে, শাদা মানুষেরা ওর সামনেই আছে।

অ্যাম্বারগোর জন্যেও সময়টা খুব গুরুত্বপূর্ণ এখন। ওর সুযোগ খুঁজে নেবার সময় ক্রমশ ফুরিয়ে আসছে। পালাবার চেষ্টা সে করবেই। বিশ্রাম নেবার ফাঁকে ফাঁকে এদিকে ওদিকে তীক্ষ্ণ নজর রাখছে সে, সুযোগ সৃষ্টি হওয়া মাত্র কাজে লাগবে।

সাওলোও ওর ওপর কড়া নজর রাখছে। স্প্যানিয়ার্ডটাকে সামান্য বেচাল দেখালেই গুলি করবে।

ওদের সঙ্গে খাবার নেই। ফুরিয়ে গেছে গত রাতে। খুঁজে-পেতে পথে যা পাওয়া গেছে, তা সবার মধ্যে বাঁটোয়ারা করে দিল সাওলো। ফলের মত জিনিসগুলো, নরম, স্বাদহীন।

খেতে খুব একটা আপত্তি করল না কেউ। গরমে, পরিশ্রমে আর ক্ষুধায় সবার প্রাণ ওষ্ঠাগত প্ৰায়।

চিবোতে চিবোতে মুখ বিকৃত করল মেলোডি। ‘মাই গড! এটা কী জিনিস?’

‘তু না,’ হাসল সাওলো, ‘নোপাল ক্যাকটাসের ফল।’

‘আর ওগুলো?’

‘স্কুয়া ক্যাবেজ। কাঁচাগুলো খেতে ভাল। ওগুলো পাইনি।’

‘পুরো ইউএস আর্মি মিলেও যদি অ্যাপাচিদের কাবু করতে না পারে, তাহলে অবাক হব না আমি। এগুলো খেয়েও যদি অ্যাপাচিরা দিব্যি টিকে থাকতে পারে, তাহলে তো ওরা অপরাজেয়।

অ্যাম্বারগো ছাড়া হাসল সবাই।

হঠাৎ কিছুটা আনমনা হলো মেলোডি। ‘হাব, বিড়বিড় করল সে, ‘এই মানুষটাকে সারা জীবন মনে রাখব আমি। কি দুঃসাহসিক কাজই না করেছে সে… সাওলোর দিকে চাইল মেয়েটি, বিশ্বাস করতে পারো যে, আমাদের জন্যেই কাজটা করেছে!’

‘পারি। ও জানত, আমরা এটা আজীবন মনে রাখব।’

আমিও। তবে ওর ওভাবে মরার দরকার কী ছিল, তা বুঝতে পারছি না।’

‘দরকার ছিল। ও আমাদের চেয়ে উপযুক্ত হতে চেয়েছিল।’

‘তাহলে বলতেই হয়, ও তা-ই হয়েছে।

গর্তগুলো চেক করল সাওলো। পানিতে ভরে গেছে। অবশ্য পরিষ্কার পানি নয়, কিছুটা ঘোলাটে। ক্যান্টিনে পানি ভরল সে, মেলোডিকে দিল।

‘ইচ্ছেমত খেয়ে নাও।’

একচুমুক খেল মেলোডি, মুখ বিকৃত করল। ‘সাওলো, আমি ঠিক অভিযোগ করছি না, তবে…’

‘মিনারেল। তবে এতে ক্ষতি হবে না। কোনও কোনও জায়গায় এমন পানিও পাওয়া যায়, খেলে তালু আর জিহ্বা আটকে যায় আঠায়।’

ক্যান্টিনটা ইয়েটসের দিকে বাড়িয়ে দিল মেলোডি। ওঅশের মধ্যে নরম বালুর ওপর পায়চারি করতে শুরু করল। ঘোড়ার পিঠে বসে বসে পিঠে খিল ধরে গেছে, খিল ছাড়ানোর চেষ্টা করছে।

ইয়েটসের হাত থেকে ক্যান্টিনটা নিয়ে অ্যাম্বারগোকে পানি খাওয়াল সাওলো। ‘ক্যান্টিনটায় আবার পানি ভরে মুখ বন্ধ করে রাখল। তারপর ঘোড়াগুলোকে পানি খাওয়াতে শুরু করল গর্ত থেকে।

সুযোগটা ঠিক এ সময়েই পেয়ে গেল অ্যাম্বারগো।

ওর কাছ থেকে গজ তিনেক দূরে পায়চারি করছিল মেলোডি। এতটুকু দূরত্ব আর সাওলোর সামান্য অসতর্কতাই যথেষ্ট বিশালকায়, লম্বা আর দানবের মত শক্তিশালী স্প্যানিয়ার্ডের জন্যে।

হঠাৎ র‍্যাটল সাপের মত গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে গেল লোকটা, পরমুহূর্তে লাফ দিল মেলোডির উদ্দেশে। মেলোডির হাঁটুর পেছনে আঘাত করল। উপুড় করে ফেলে দিয়ে চড়ে বসল ওর পিঠের ওপর।

শেষ ঘোড়াটাকে পানি খাওয়াচ্ছিল সাওলো। শব্দ শুনে ঘুরে দাঁড়াল, হাত থেকে রশিটা ফেলে দিয়ে পিস্তল বের করে কক করল ও। কিন্তু দেরি হয়ে গেছে ততক্ষণে। মেলোডি অ্যাম্বারগোর নিচে পড়ে আছে উপুড় হয়ে, ওর পিঠের ওপর হাঁটু ঠেকিয়ে গলার নিচে হাত দিয়ে ওপর দিকে চাঁড় দেবার ভঙ্গিতে ধরে আছে স্প্যানিয়ার্ড। সেকেন্ডের ভেতর ঘটে গেছে ব্যাপারটা।

‘ছোট একটা ঝাঁকুনি দেব, ব্রীড!’ ফিস ফিস করে জানাল অ্যাম্বারগো। ওর বাদামী মুখ চকচক করছে কুটিলতায়। ‘ছোট্ট একটা ঝাঁকুনি…বাস, মট করে ভেঙে যাবে মেয়েটার ঘাড়। দেব?’

বিপজ্জনক ভঙ্গিতে পড়ে আছে মেলোডি। ওর ঘাড় বেঁকে রয়েছে বাম দিকে। দু’হাতে অ্যাম্বারগোর শেকল পরানো হাত দুটো ছাড়ানোর ব্যর্থ চেষ্টা করছে সে। ওর নখ দেবে গেছে অ্যাম্বারগোর মাংসল হাতে, রক্ত বেরোচ্ছে। ঘোঁৎ করে উঠল অ্যাম্বারগো, চাপ বাড়াল; হাত দূরে সরিয়ে নিল আতঙ্কিত মেলোডি।

‘অস্ত্রটা, ব্রীড, আদেশ দিল অ্যাম্বারগো হুমকির স্বরে, ‘ওটা এদিকে ছুঁড়ে দাও।’

মুহূর্তের জন্যে ইতস্তত করল সাওলো। ভীষণাকার ধারণ করল অ্যাম্বারগোর মুখভাব। ‘আর একবার…’ চাপ বাড়াল সে। মেলোডির অস্ফুট আর্তনাদ শোনা গেল।

ছুঁড়ে দিল সাওলো পিস্তল অফ-কক করে। অ্যাম্বারগোর হাঁটুর কাছে পড়ল।

মেলোডির গলার নিচ থেকে হাত সরাল অ্যাম্বারগো। তড়িৎ গতিতে পিস্তলের ওপর ঝাঁপ দিল। পিস্তল হাতে উঠে দাঁড়াল।

‘চাবিটা। ওটার জন্যেই তো এত সমস্যা, না? তাড়াতাড়ি!’ হাসছে সে। ‘এবার ছুরি। হ্যাঁ, ছুরিটা.. আস্তে…সাবধান বলছি, হ্যাঁ, ঠিক আছে। এবার তোমার কার্তুজেরা—হ্যাঁ, কার্তুজগুলো। বাহ্, বাহ্! এবার, ব্রীড, শুয়ে পড়ো- উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ো। তুমি— ইয়েটস, তুমিও!’

উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল ওরা। শেলবেল্ট পরে নিল অ্যাম্বারগো। শেকল খুলে ফেলেছে ও ইতোমধ্যে। একটু দূরে রাখা রাইফেলগুলো কুড়িয়ে নিয়ে প্রত্যেকটা চেক করল, তারপর পাথরে আছড়ে একটার মেকানিজম নষ্ট করে ফেলল। ঘোড়াগুলোর কাছে গেল। সাওলোর শার্পসটা তুলে গুলি করল একটাকে, মাথায়। লুটিয়ে পড়ল ঘোড়াটা। পা ছুঁড়ল, নিথর হয়ে গেল এরপর। কুঁকড়ে একপাশে দাঁড়িয়ে রইল বাকি দুটো ঘোড়া, কাঁপছে। রাইফেলটার ব্যারেলে টোকা দিল অ্যাম্বারগো, ‘চমৎকার জিনিস, ব্রীড তোমার রাইফেলটা। ধন্যবাদ দিচ্ছি তোমাকে।’

সাওলোর বেল্টে আরও কিছু গুলি ছিল ওটার। ওখানে থেকে একটা বের করে নিল অ্যাম্বারগো, ঢোকাল। ‘এগুলোর একটাও আর নষ্ট করব না।—এমন কী, তোমাদের ওপরেও না।’

বালুর ওপর উপুড় হয়ে পড়েছিল মেলোডি। অতিকষ্টে মাথা তুলল হাত ও হাঁটুর ওপর শরীরের ভর রেখে। ওর কাছে গেল অ্যাম্বারগো, চুলের গোছা ধরে দাঁড় করাল ওকে পায়ের ওপর। হ্যাঁচকা টানে ওর মাথা পেছনে ঝোঁকাল, পিস্তলটা ঠেসে ধরল চিবুকের নিচে। ‘তেড়িবেড়ি করবে না, সুন্দরী। তাহলে ঠুস করে দেব। আমার সঙ্গে যাবে তুমি। ওই ঘোড়াটা তোমার জন্যে। চড়ে বসো ওটায়। খবরদার, চালাকি করতে যেয়ো না- তাহলে এই সুন্দর মাথাটায় তিন-তিনটে গুলি ঢুকিয়ে দেব, বুঝলে?’ ধাক্কা দিয়ে পাঠিয়ে দিল ওকে ঘোড়ার দিকে।

‘ওকে কেন নিয়ে যাচ্ছ? ওকে তো তোমার দরকার নেই!’ প্রতিবাদ করল সাওলো।

‘আমার কাউকেই দরকার নেই। তবে ও একখানা খাসা মাল এবং আমি একজন পুরুষ!’ খিক খিক করে হাসল তস্কর। পিস্তলটা উঁচিয়ে ধরল সাওলোর মাথা বরাবর। ‘একটামাত্র গুলি, ব্রীড, তোমার মাথায়, তাহলেই তোমার জারিজুরি শেষ। কিন্তু গুলি নষ্ট করতে চাই না আমি। তোমার ভাই তো আসছেই। অস্ত্র নেই, ঘোড়াও নেই তোমার সাথে। বেশিদূর যেতে পারবে না হেঁটে। নাহ্, তোমার ভাইটাকে হতাশ করা ঠিক হবে না। কী বলো?’

আবার হাসল অ্যাম্বারগো, হাসির দমকে কেঁপে কেঁপে উঠল ওর বিশাল শরীর। ঘুরল ও, মেলোডি দাঁড়িয়েছিল, জাপটে ধরল ওর কোমর। প্রায় তুলে নিয়ে গেল ওকে ঘোড়াগুলোর কাছে। অপেক্ষাকৃত দুর্বল ঘোড়াটার পিঠে বসিয়ে দিল ওকে; ঘোড়া দুটোর রশি খুলে নিয়ে একটা মেলোডির ঘোড়ার গলায় বাঁধল। স্ট্র্যাপ দিয়ে আটকে পানির ক্যান্টিনটা কাঁধে ঝোলাল, তারপর অন্য ঘোড়াটায় চড়ে বসল। মাথায় পরা সমব্রেরোর ব্রিমে টোকা দিল মজা করার ভঙ্গিতে। ‘তোমাদের সবার কপাল মন্দ হোক, হাঁদার দল!’

মেলোডির ঘোড়ার লীড রোপ হাতে নিল ও, দক্ষিণ দিকে চলতে শুরু করল শিস দিতে দিতে।

‘জেসাস!’ উঠে দাঁড়াল ইয়েটস। ‘লোকটা—’

মাথা নাড়ল সাওলো। আমাদেরও সরে পড়া উচিত!’

‘ট্যুবাক?’ ওর দিকে ফিরল ইয়েটস। ‘পায়ে হেঁটে অতদূর কখনও সম্ভব নয়।’

‘একটা সম্ভাবনা সব সময়ই থেকে যায়, মি. ইয়েটস।’

চিবুক চুলকাল ইয়েটস। ‘হ্যাঁ। একটা উপায় সম্ভবত আছে…’

‘কী সেটা?’

ট্যুবাক এখান থেকে কতদূর?’

‘মাইল বিশেক তো হবেই।’

‘ঠিক আছে,’ হাত উঁচিয়ে দক্ষিণ দিকে দেখাল ইয়েটস, ‘স্টেজরোড এদিকে কিছুটা উত্তরে বেঁকে গেছে। মনে হয়, মাইল পাঁচেক গেলে পেয়ে যাব।’

‘অতটা ঘুরে গেলে শহরে পৌছতে অনেক দেরি হবে, মি. ইয়েটস।’

‘তা হবে,’ স্বীকার করল ইয়েটস। ‘কিন্তু আমরা শহরে যাব না। শহরের পুবে, মানে এদিকে মেক্সিকান আউটফিট আছে একটা। এখান থেকে কয়েক মাইল মাত্র। একটা-দুটো ঘোড়া পেয়ে যেতে পারি আমরা ওখানে। অবশ্য…’ অনিশ্চয়তার ভাব দেখা গেল ওর গলায়, ‘অ্যাপাচিরা ওর মধ্যে যদি ওকে তাড়িয়ে না-দিয়ে থাকে। তাহলে ওখানে যাওয়াটা স্রেফ সময়ের অপচয় ছাড়া আর কিছু হবে না।’

দক্ষিণে তাকাল সাওলো। মরুভূমিতে এখন অস্পষ্ট হয়ে এসেছে মেলোডি আর অ্যাম্বারগোর অবয়ব। ‘ঠিক আছে,’ সম্মতি দিল ও। ‘ঝুঁকিটা নেব আমরা।’

.

সারাটা জীবন সুযোগের সন্ধানে ফিরেছে অ্যাম্বারগো। ওর মতে, সুযোগ চিনে নিতে হয় এবং সময়মত ওটার দিকে হাত বাড়াতে হয়। ভাগ্যের ওপর নির্ভর করে বসে থাকলে কিছুই হয় না।

‘সেংগ্রে দে ক্রিস্তো!’ আপনমনে বিড়বিড় করল সে, হাসল।

প্রায় আধঘণ্টা পরে ঘোড়া থামাল ও। কাঁধ থেকে ক্যান্টিন নামিয়ে মুখ খুলে পানি খেল; মেলোডির দিকে বাড়িয়ে দিল ক্যান্টিনটা। লোভাতুর দৃষ্টিতে জরিপ করল ওকে। মেয়েটার মুখ শুকনো, চোখ বসে গেছে, চিবুকে সামান্য রক্তের ধারা, শুকিয়ে গেছে। তবে ওর সবুজ জীবন্ত চোখে তীব্র ঘৃণার আগুন, জ্বলছে ধিক ধিক করে।

‘বুনো সিংহী!’ মনে মনে স্বীকার করল অ্যাম্বারগো। মুখে বলল, ‘তুমি স্রেফ একজন মেয়েমানুষ, সুন্দরী! পানিটুকু খেয়ে নাও, গায়ে বল পাবে তারপর আরও ভালভাবে ঘৃণা করতে পারবে। নাও।’

এ-পর্যন্ত একটা কথাও বলেনি মেলোডি ওর সাথে। এখনও বলল না। তবে ওর হাত থেকে ক্যান্টিনটা নিল। কয়েক ঢোক পানি খেয়ে ফিরিয়ে দিল ফের।

‘এবার আমি হেঁটে যাব, সুন্দরী! দেখো, আমি লোকটা খারাপ না। কী বলো? আমি হাঁটব আর তুমি ঘোড়ায় চড়ে যাবে রাণীর মত, অ্যাঁ!’

লীডরোপ হাতে মেলোডির ঘোড়ার পাশে পাশে চলল অ্যাম্বারগো। ওর নিজের ঘোড়ার অবস্থা কাহিল। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে ওটা, মাংসপেশীর বিক্ষেপে থরথর করে কাঁপছে। ওর বিশাল শরীরের ভর সইতে পারেনি ক্ষুদ্র পনিটা, এক নাগাড়ে দীর্ঘপথচলার পর ধুঁকছে এখন। ওটাকে ছেড়েই রওনা হয়েছে অ্যাম্বারগো।

সামনে, অনেক দূরে সান্তা রিতা পর্বতমালার ভাঙাচোরা নীল অবয়ব দেখা যাচ্ছে আকাশের কোলে। ওদিকে সনোরা দশ বছর আগে একবার ওখানে ছিল ও, ওখানেই যাবে আবার।

মেয়েটাকেও নিয়ে যাবে সাথে। খাসা মাল। যদ্দিন ইচ্ছে থাকবে ওর সাথে। অ্যাম্বারগো সুন্দরী মেয়েদের মূল্য বোঝে। তবে কথা একটাই, ওকে অ্যাম্বারগোর অনুগত থাকতে হবে। সেটা বোঝা যাবে আজ রাতেই, ঘুমোবার সময়। তবে মেয়েটার চোখে প্রবল ঘৃণার আগুন। এটা পছন্দ হচ্ছে না ওর। মেয়েদের অত দেমাগ থাকা ভাল নয়। ঠিক আছে, তেড়িবেড়ি করলে আপদ চুকিয়ে দেয়া যাবে।

সামনে বিস্তৃত অঞ্চল ভাঙাচোরা – এবড়োখেবড়ো। মাঝে-মধ্যে সবুজের চিহ্ন, মরাটে। হাঁটার জন্যে খুব খারাপ পথ। তবে শিকার আর পানি সম্ভবত মিলবে। এ-অঞ্চল সম্পর্কে ভাল ধারণা নেই ওর, এটাই কেবল উদ্বেগে ভোগাচ্ছে ওকে। তবে আশার কথা হচ্ছে, পরিস্থিতি আগামীকালের মধ্যেই পাল্টাবে। পরিচিত অঞ্চলে পৌঁছে যাবে ও।

সামান্য হাঁটায় ওর হাঁটু আর পায়ের গোছায় টান ধরেছে, ব্যথা করছে। কপাল কুঞ্চিত করল সে। জেসাস মারিয়া! সারাক্ষণ ঘোড়ার পিঠে-থাকা মানুষের কাজ নয় হাঁটা। কিন্তু এই দুর্বল ঘোড়ার পিঠে দু’জনের বসা সম্ভব নয়—আর মেয়েটাকে ফেলে যাওয়াও ওর পক্ষে কঠিন।

মাঝে-মধ্যে ঘাড় ফিরিয়ে পেছনে তাকাচ্ছে অ্যাম্বারগো। অ্যাপাচিদের ভয় করছে না। ট্যাংকসের কাছ থেকে ট্রেইল ধরে অ্যাপাচিরা, ওরা যেখানে থেমেছিল, সেখানে আসবে। প্রথমে একটু বিভ্রান্ত হবে, সন্দেহ নেই; তবে কুরিয়াপো যেহেতু অ্যাপাচি এবং ধুরন্ধর, শিকার চিনতে ভুল করবে না। সাওলোর ট্র্যাক ঠিকই চিনে নেবে।

অবজ্ঞার হাসি হাসল অ্যাম্বারগো। সাওলো আর ইয়েটস কি ট্যুবাকে পৌছতে পারবে? কিভাবে? ইয়েটস পোড়-খাওয়া কঠিন লোক, সন্দেহ নেই—কিন্তু বয়স হয়েছে ওর। তবে সাওলো ওকে ফেলে চলে যাবে না। দোআঁশলাটার নীতিবোধ একটু বেশিরকমের টনটনে। ওদের খুঁজে বের করতে কুরিয়াপোকে মোটেই বেগ পেতে হবে না।

সামনে রিজ হালকা হয়ে এসেছে। লাল মাটির টিলাগুলো ক্যাটক্ল’ আর ম্যাঞ্জানিটার জঙ্গলে পরিপূর্ণ। অল্পক্ষণেই কটনউড আর উইলো গাছে ভরা একটা রিজের ধারে এসে পড়ল ওরা। এরপরে একটা ক্যানিয়ন। ছোট্ট একটা ঝরণা বয়ে যাচ্ছে ধার ঘেঁষে। একটা কটনউড গাছের গোড়ায় ছোট্ট একটা খরগোসকে ঘাস খেতে দেখা গেল। পিস্তল বের করল অ্যাম্বারগো, গুলি করল।

সূর্য পশ্চিম দিগন্তের কোলে গিয়ে ঠেকেছে। প্রকৃতি শীতল হয়ে উঠতে শুরু করেছে আস্তে আস্তে। ক্যানিয়নের দেয়ালে তাকাল অ্যাম্বারগো, রাত কাটাবার মত যুৎসই জায়গা খুঁজছে। একটু পরে গুহাটা নজরে পড়ল। ক্যানিয়নের মুখ থেকে সামান্য ভেতরে, রাত কাটানোর জন্যে চমৎকার আশ্রয় হবে। এছাড়া পেছনে রেখে আসা ট্রেইলের ওপরও চোখ রাখা যাবে ওখান থেকে।

লম্বা রশিতে বেঁধে একটা ঘেসো জায়গা দেখে ঘোড়াটাকে চরতে দিল সে। ছোট্ট করে আগুন জ্বালল গুহার বাইরে একটা সমতল জায়গা দেখে। খরগোসটার চামড়া ছাড়িয়ে ভাল করে ঝলসে নিল আগুনে। নরম খরগোসের মাংস গরম গরম খেতে দারুণ উপাদেয় লাগল ওদের কাছে।

খাওয়া শেষ করে জায়গাটা চেক করতে বেরোল অ্যাম্বারগো। সুন্দর জায়গা। চমৎকার! আজ রাতটা এখানে কাটাবে ও, কাল সারাদিনও। জিরোবে মেয়েটাকে নিয়ে। রাতে ফের যাত্রা শুরু করবে। সেটাই ভাল হবে, ঠাণ্ডায় ঠাণ্ডায় আরামসে যাওয়া যাবে। সীমান্তে ইয়াঙ্কি গভর্নমেন্টের আইন এখন খুব গরম। খুনের আসামী হিসেবে আইন খুঁজছে ওকে; রাতের চলাটাই ওর জন্যে নিরাপদ ও আরামদায়ক হবে।

ফিরে এল ও। এর মধ্যে মেলোডি ওর নিজের দিকে নজর দিয়েছে। অগোছালো চুল খুলে বেঁধেছে সে, বসে আছে আগুনের পাশে, ক্লান্ত ভঙ্গিতে।

‘হাহ্! সুন্দরী, তোমার মোলায়েম জিভটা অনেকক্ষণ ধরে বেকার বসে আছে। এবার একটু নাড়াচাড়া করো। রোমান্টিক ধরনের কিছু একটা বলো। কেউ নেই এখানে আমি আর তুমি ছাড়া। জমবে ভাল, কী বলো?’

বরফশীতল চোখদুটো তুলল মেলোডি ওর মুখের ওপর। ‘রোমান্টিক ধরনের কথাবার্তাই বলতে চেয়েছি সারা জীবন। তোমরা কেউই শোনোনি।’ ওর ঠোটের কোণে মৃদু ব্যঙ্গের হাসি।

হাত থেকে দাঁত খোঁচানিটা দূরে ফেলে দিল অ্যাম্বারগো, আঙুলের টোকায়। ‘কথা ফুটেছে, না?’ মেলোডির কাছে গেল সে, হাত ধরে ওকে দাঁড় করিয়ে দিল। ‘শোন, শাদা কুত্তি! মিষ্টি কথা বলে অ্যাম্বারগোকে টলাতে পারবি না। তোদের মত বেশ্যাদের আমি ভাল করে চিনি। ওই দোআঁশলাটার সঙ্গে যে তোর ফষ্টিনষ্টি ছিল, আমি আগেই জানতাম।’

‘তাতে কী?’ রুখে উঠল মেলোডি। ‘দোআঁশলা হলেও ও মানুষ। তুমি কী?’

মাথা পেছনে হেলিয়ে উদ্ধত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়েছে মেলোডি। ওর চোখে চ্যালেঞ্জ।

ওর শরীরের উষ্ণতা অনুভব করছে অ্যাম্বারগো। একহাতে ওর কোমর আঁকড়ে ধরে অন্য হাত ওর পিঠে বুলোচ্ছে। উদগ্র কামনায় জ্বলতে জ্বলতে ওকে টেনে ধরে চুমু খেতে গেল সে।

ওকে অবাক করে দিয়ে কোনওরকম প্রতিবাদ করল না মেলোডি—বরং সাড়া দিল। তীব্র চুম্বনে আবদ্ধ করে রাখল ও মেয়েটিকে।

অ্যাম্বারগোর কোমরে বাঁধা হোলস্টারের দিকে আস্তে আস্তে হাত বাড়াল মেলোডি। ছোঁ মেরে পিস্তলের বাঁট আঁকড়ে ধরে টান দিল।

উদগ্র কামনায় বাহ্যজ্ঞানবিলুপ্ত এবং নিজের শক্তিতে প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসী অ্যাম্বারগোর মাথায় এ ধরনের আশঙ্কার কথা আদপেই আসেনি। বিশ্বাসই করতে পারল না ও ব্যাপারটা প্রথম এক মুহূর্ত। যখন চৈতন্য হলো, কিছুটা দেরি হয়ে গেছে তখন। মেয়েটাকে ঠেলে দিল ও সজোরে। পেছনে ছিটকে পড়ার আগে নেমে এল মেলোডির পিস্তল, প্রচণ্ড আঘাতে ছাতু হয়ে যাওয়া থেকে কোনওমতে মাথা বাঁচাল অ্যাম্বারগো; ওর নাক আর ঠোঁটে পিছলে পিস্তল নেমে গেল নিচের দিকে

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *