জ্বালা – ১৩

তেরো

অন্ধকারে ভূতের মত মিলিয়ে গেল হাব। পাথরে জেবরা ডানের খুরের আওয়াজ শোনা গেল কিছুক্ষণ; তারপর মিলিয়ে গেল।

জেবরার পায়ের আওয়াজ অ্যাপাচিদের কানেও পৌঁছেছে নিশ্চয়, ভাবল সাওলো। হাবকে খুঁজে বের করে ফেলবে ওরা শীঘ্রিই; তবে, কপাল ভাল হলে, দেখামাত্র গুলি করবে না। অবশ্য করতেও পারে। কিন্তু আরেকটা শাদা গর্দভ (অন্ধকারে হাবকে তা-ই ভাববে ওরা) কেন যে আগের দুটোর মত আত্মহত্যা করতে ছুটেছে, এটা ভেবে আশ্চর্যও হবে ওরা।

‘আত্মোৎসর্গ করল কালো ভেড়া!’ একটা পাথরে হেলান দিয়ে বলল সাওলো মনে মনে। ‘হাহ্!’

ওর মাথায় ঢেউয়ের মত লাফাচ্ছে যন্ত্রণা, দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করছে ও ব্যথাটা; হাবের রাইফেলের আঘাতে মাথার ভেতরটা চুরমার হয়ে গেছে মনে হচ্ছে।

‘পারবে তুমি, স্টেইভ?’ জানতে চাইল ইয়েটস।

‘পারতে হবে।’ সোজা হলো স্টেইভ। ব্যথা কিছুটা কমছে মনে হচ্ছে, ধীরে ধীরে। মাথা কাজ করতে শুরু করেছে। ওর গুলির শব্দ শোনামাত্র বেরিয়ে পড়ব আমি। তোমরা দু’জন তৈরি হয়ে নাও।

‘কোথায় অপেক্ষা করব আমরা, সাওলো?’ মেলোডি জানতে চাইল।

‘পশ্চিমে। ওই তারাটার দিকে দেখো। ওটার ঠিক নিচেটা কোথায় হতে পারে ঠিক করে নাও। ওদিকে যাত্রা শুরু করো, এক্ষুণি।

‘আমি কখন পৌছব, বলতে পারছি না এখন। একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত অপেক্ষা কোরো আমার জন্যে। ওর মধ্যে না-পৌছালে কেটে পড়বে তক্ষুণি। অপেক্ষা করে সময় নষ্ট করবে না। সোজা ভাগবে ওখান থেকে।’

‘মেক্সের কী হবে?’ অ্যাম্বারগোকে দেখিয়ে জানতে চাইল ইয়েটস।

সাওলোও তাকাল ওর দিকে। ওর পায়ের বাঁধন খুলে দিয়ো। কিন্তু তেড়িবেড়ি করলে অ্যাপাচিদের জন্যে রেখে যেয়ো। তবে আশা করি, নিজের ভাল-মন্দ বোঝার মত ঘিলু ওর মাথায় আছে।’

দাঁত বের করল অ্যাম্বারগো। ‘তুমি, সত্যি, খুব মজার মানুষ, ব্রীড!’

ওর কথা শেষ হবার আগেই হাবের বুনো চিৎকার শোনা গেল। রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে খান খান হয়ে গেল সে-শব্দে। পরমুহূর্তে গুলির শব্দ শোনা গেল। ‘ঠিক আছে,’ বলল সাওলো। দুটো পাকানো রশি তুলে নিল ও কাঁধে। তৃণ, ধনুক আর তীরগুলো নিল হাতে। মেলোডি এসে ওর বাহু ছুঁয়ে দাঁড়াল। ‘স্টেইভ, তোমাকে তোমাকে একটা কথা বলতে চাই…’

নিজের ঠোঁট কামড়াল সে, তারপর মাথা নাড়ল। কী বলবে বুঝতে পারছে না সাওলো। মেলোডির হাত ধরল ও, চাপ দিল আস্তে করে। পর মুহূর্তে হাঁটা শুরু করল, জঙ্গলের ভেতর ঢুকে গেল।

আগের বারের মত হামাগুড়ি দিয়ে নয়, সোজা হয়ে হাঁটছে সাওলো। হাব যথেষ্ট কাভার দিয়েছে ওর কাজে, বিভ্রান্ত অ্যাপাচিরা আগের মত সতর্ক থাকবে না এখন এদিকে, ওদের মনোযোগ এখন ওদিকে। অতএব খুব বেশি সাবধানতা অবলম্বন না করলেও চলবে আপাতত।

জঙ্গলাকীর্ণ পথে মাঝে-মধ্যে ছড়ানো-ছিটানো পাথরের পাশ দিয়ে যতটা সম্ভব দ্রুত হাঁটছে সাওলো, তবে দৌড়াচ্ছে না। চাপমুক্ত ও এখন, ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করতে পারছে। স্প্যানিশ ছোরাটা ধরা ওর হাতে, তৈরি।

ও জানে, ও যদি শত্রুর আওতায় গিয়ে পড়ে আর সেটা যদি শত্রু আগেই জানতে পারে, তাহলে নিঃশব্দে এবং দ্রুততার সাথে শত্রুকে খুন করতে হবে। শত্রুর হঠাৎ প্রতিরোধে তীর-ধনুক ব্যবহার করার সুযোগ পাবে না সে। সেক্ষেত্রে ছুরিটাই কাজ দেবে। ছোরাহাতে নিজেকে যথেষ্ট সশস্ত্র বোধ করছে ও। ও ছুরির ব্যবহার জানে। জানে, ঠিক কখন এবং কোথায় আঘাত করতে হয়। কিন্তু উল্টাপাল্টা ছুরি চালানোর বিপদ কম নয়। হাড়ে ছুরি আটকে গেলে কোনও কাজ দেবে না তা। তবে সবচেয়ে বড় সুবিধে, ছুরি চালানো যায় নিঃশব্দে। সব সময় পরিষ্কার আর ধারাল রাখা যায় একটু যত্ন নিলে। পিস্তল-রাইফেলে কক করার ঝামেলা আছে, ছুরিতে সে-সমস্যা নেই। ছুরি ওগুলোর চেয়ে অনেক দ্রুত চালানো যায়।

হাব চিৎকার বন্ধ করেছে। ওর উইনচেস্টার গুলি বর্ষণ করছে এখন। অ্যাপাচিরাও গুলি ছুঁড়ছে। হাব ঘোড়া ছেড়ে পাথরের আড়ালে লুকিয়ে পড়বে। অ্যাপাচিরা আস্তে আস্তে ঘিরে আসবে ওকে। একা ও বেশিক্ষণ আটকে রাখতে পারবে না ওদের।

গতি বাড়াল সাওলো। যদ্দূর মনে হচ্ছে, ওর কপাল ভাল। অ্যাপাচিদের ঘেরাও থেকে অনেকটা বাইরে রয়েছে ও এবং গন্তব্যের প্রায় কাছে এসে পৌঁছেছে।

থামল সে।

হৈ-চৈ-এর মধ্যেও কাছে কোথাও অন্য ধরনের একটা শব্দ শোনা গেছে। অলৌকিক ধরনের শব্দ। শিউরে উঠল সে, ঘাড় বেয়ে ভয়ের ঠাণ্ডা স্রোত নেমে গেল।

সে এ ধরনের শব্দ আগেও শুনেছে। অ্যাপাচিরা যেখানে ওদের শিকারকে ফেলে চলে যায়, সেখানে শোনা যায় এ-ধরনের শব্দ। বালক বয়সে ছোটখাট অনেক প্রাণীর ওপর নিষ্ঠুরতা দেখাত সে নিজেও। শুর গোত্রের লোকদের দেখেছে বন্দীদের ওপর নির্যাতন চালাতে। প্রচণ্ড যন্ত্রণায় মানুষ আর পশুর গোঙানির মধ্যে তেমন ফারাক থাকে না।

চলতে শুরু করল সাওলো

প্রথমে দুটো ঘোড়া দেখতে পেল। অ্যাপাচিদের গুলিতে মরে গিয়ে পা ছড়িয়ে পড়ে আছে। কাছেই ম্যাগির লাশ। ওর ঘাড় ভেঙে শরীর বেঁকে চুরে গেছে। ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে তৎক্ষণাৎ মরেছে মেয়েটি। গায়ে গুলি কিংবা অন্য কোনও ধরনের নির্যাতনের চিহ্ন দেখা গেল না।

সতর্কতার সাথে চলতে লাগল সাওলো। ঘোড়াগুলোর কাছে পৌছল। সঙ্গে সঙ্গে সে ভয়ানক, রক্তহিমকরা জান্তব গোঙানিটা খুব কাছে থেকেই শুনতে পেল আবার। একটা উঁচুমত ঢালে চড়ল সে, হামাগুড়ি দিয়ে ওটার কিনারে চলে গেল; তাকাল নিচের দিকে।

একটা মানুষ চিৎ হয়ে পড়ে আছে। নগ্ন। হাত-পাগুলো খুঁটির সঙ্গে টান টান করে বাঁধা। চাঁদের মলিন আলোয় ধূসর মাংসপিণ্ডের মত দেখাচ্ছে ওর শরীর। তাতে আধ ডজনের মত বর্শা বিধে আছে। রক্ত জমাট বেঁধেছে বর্শাবিদ্ধ জায়গাগুলোয়। চাঁদের আলোয় কালো, বীভৎস দেখাচ্ছে ক্ষতগুলো। সাওলো জানে, বর্শাগুলো এমন দক্ষতার সাথে হিসেব করে গাঁথা হয়েছে যাতে লোকটা সঙ্গে সঙ্গে মারা না যায়। এটা অ্যাপাচিদের নির্যাতনের এক অভিনব পদ্ধতি। এতে আহত ব্যক্তি তিলে তিলে মৃত্যু-যন্ত্রণা ভোগ করতে করতে একসময় নির্জীব হয়ে মারা যাবে। স্টিফেনেরও মরতে প্রায় সারারাত লাগবে। এর আগে লাগাতার মৃত্যু-যন্ত্রণা সইতে হবে ওকে। বিন্দুমাত্র দয়া দেখাবে না অ্যাপাচিরা।

উঠে দাঁড়াল সাওলো। নিজের কাজে মন দেবার জন্যে নিজেকে তাগিদ দিল। এখানে ওর কিছু করার নেই। ওই লোকটা অসহিষ্ণুতা, ঔদ্ধত্য আর বোকামির দণ্ড পেয়েছে। তবে ও চাইলে একটা কাজ করতে পারে।

ধনুকে তীর জুড়ে ছিলা টেনে ধরল সজোরে। তারপর ছেড়ে দিল 1 জান্তব গোঙানিটা বন্ধ হয়ে গেল একটু পরে।

অপেক্ষা করল সাওলো, কান পেতে থাকল। অ্যাপাচিদের ‘রেমুদা’ খুব একটা দূরে নয়। স্টিফেনের গোঙানি যদি পাহারাদারের কানে পৌঁছায়, তাহলে এর হঠাৎ থেমে যাওয়াও খেয়াল করবে। সতর্ক হয়ে যাবে সে। ওদিকে গুলির শব্দ শোনা যাচ্ছে না আর। তার মানে নিঃশ্বাস ফেলল সাওলো, বিদায়, মি. হাব বোদ!’

এবার অ্যাপাচিরা ফিরে আসবে। কুরিয়াপো বোকা নয়, ডাইভার্শনের কারণ খুঁজবে সে। সন্দেহ জাগবে ওর মনে। ব্যাপারটা বুঝে নিতে বেশিক্ষণ সময় নেবে না। সাওলো উঠল, বিড়ালের মত নিঃশব্দে সঙ্কীর্ণ একটা পথ বেয়ে রিজে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে করালটা দেখতে পেল। একটা ওকোটিলো ঝোপের ভেতর কাঠের খুঁটির ঘেরের ভেতর ঘোড়াগুলো। বিশটার মত হবে।

কাঁধে রাইফেল ঝুলিয়ে পায়চারি করছে গার্ড। একটু আগে গোলাগুলি হয়ে যাওয়ায় বাড়তি সতর্কতা কাজ করছে ওর মধ্যে। ওর চোখে-মুখে উদ্বেগ; ওদিকে কী হচ্ছে জানার জন্যে কৌতূহলে মরে যাচ্ছে বেচারা। কিন্তু পোস্ট ছেড়ে নড়েনি। ছায়া অন্ধকারে লুকোতে সুবিধে হবে বিবেচনা করে সাওলো রিজের মুখে চলে গেল। ঘোড়াগুলোর মধ্যে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। মাটিতে পা ঠুকছে ওরা, নাক ঝাড়ছে। ওর উপস্থিতি টের পেয়ে গেছে ওরা অসতর্ক মুহূর্তে সৃষ্ট কোনও শব্দে কিংবা ওর গায়ের গন্ধে।

পায়চারি বন্ধ করেছে গার্ড, স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে এদিক-ওদিক চোখ বুলোচ্ছে। টের পেয়েছে নাকি ব্যাটা? ভাবল সাওলো। তীর জুড়ল সে ধনুকে। ছুঁড়ে দিল। অ্যাপাচির পাঁজর ছুঁয়ে চলে গেল তীর। অন্ধকারে লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছে। ধপ করে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল অ্যাপাচি। রাইফেল কক করল। সন্ত্রস্ত হলো সাওলো। জানে, গুলি ছুঁড়লে অন্যদের কাছে ওর উপস্থিতি অজ্ঞাত থাকবে না। এদিকে রাইফেলের শব্দ হবে আরও জোরাল। কিন্তু তীর ছোঁড়ারও সময় নেই। ধনুকে জুড়ে লক্ষ্যস্থির করতে প্রচুর সময় নেবে। কোল্ট বের করে পরপর দুটো গুলি ছুঁড়ল সাওলো। কেঁপে উঠল রাইফেলধারী, হাত থেকে রাইফেল পড়ে গেল, যেন অহেতুক একটা বোঝা __ । উল্টে গড়িয়ে পড়ল একপাশে।

গুলির শব্দে রীতিমত চঞ্চল হয়ে উঠল ঘোড়াগুলো। মুখে হাত দিয়ে পাহাড়ী সিংহের অনুকরণে গর্জন করে উঠল সাওলো। দক্ষযজ্ঞ বেধে গেল করালের ভেতরে। চারদিকে পুঁতে দেয়া খুঁটিগুলো তছনছ করে দিয়ে বেরিয়ে পড়ল আতঙ্কিত ঘোড়াগুলো

রিজের ঢাল থেকে প্রায় ঝাঁপ দিল সাওলো। গড়িয়ে গড়িয়ে নামল সরীসৃপের মত। রিজের মধ্য দিয়ে দৌড়ে গেল। সুযোগটা দেখতে পেল। একটা অসতর্ক পনি, কিছুটা পিছিয়ে পড়েছিল সঙ্গীদের তুলনায়। লাফ দিয়ে ওটার পিঠে চড়ে বসল সাওলো। ঘাড়ের কেশর জাপটে ধরে ওটার পেটে হাঁটুর গুঁতো লাগাল।

পুবদিকের করাতের দাঁতের মত এবড়োখেবড়ো পাহাড়ের চুড়োয় ধূসর আলো ফুটতে দেখা গেল। আস্তে আস্তে সারা আকাশে ছড়িয়ে পড়ছে আলো। সাওলো দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে এগিয়ে চলল।

অ্যাপাচিদের ঘোড়াগুলো তাড়িয়ে নিয়ে চলল সে যতটা সম্ভব ছড়িয়ে ছিটিয়ে। মুখে হুস-হাস শব্দ করছে। এর মধ্যে ল্যারিয়েট ছুঁড়ে গোটা তিনেক ঘোড়া ধরেছে ও। সময় ফুরিয়ে আসছে দ্রুত। বার কয়েক চেষ্টা করে চতুর্থটাকে ধরতে না পেরে হাল ছেড়ে দিল অবশেষে। দু’জনকে ডাবলিং করতে হবে একটার পিঠে। কী আর করা!

অন্ধকার সরে গিয়ে রিজের বেঢপ মাথাগুলো ফরসা হয়ে উঠছে ধীরে ধীরে। পিতলের মত বিবর্ণ হলুদ আলোয় চক চক করছে দূরের পাহাড়গুলোর চুড়ো। নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে শিস দিল সাওলো। শ’খানেক গজ দূরে একটা আয়রনউডের ঝোপ নড়ে উঠল। বেরিয়ে এল ইয়েটস ও মেলোডি। হাত বাঁধা অ্যাম্বারগো ওদের সামনে।

‘আমাদের কপাল ভালই মনে হচ্ছে,’ ঘোড়াগুলোর দিকে চেয়ে হাসল ইয়েস। শার্পস রাইফেলটা বাড়িয়ে দিল ও সাওলোর দিকে।

‘কিছু সময়ের জন্যে। ওরা এখনই বেরিয়ে পড়বে ঘোড়ার খোঁজে। গোটা কয়েক কোনওমতে যোগাড় করতে পারলে আমাদের পিছু নেবে। ট্যুবাক এখনও বহু দূর। ওদের কাছ থেকে যতদূর সম্ভব এগিয়ে থাকতে হবে আমাদের।’

.

পশ্চিমে ছুটল ওরা। একটু পর সূর্য উঠে আগুন ছড়াতে শুরু করল। প্রথম প্রথম যতটা সম্ভব দ্রুত ঘোড়াগুলোকে তাড়িয়ে নিয়ে চলল, শীঘ্রই নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে ক্ষান্ত দিল সে চেষ্টায়। প্রচণ্ড তাপ আর পরিশ্রমে ক্লান্ত হয়ে পড়ছে ঘোড়াগুলো। বিশেষ করে দু’জন সওয়ারী বইতে হওয়ায় ওদের শক্তি ক্ষয় হতে লাগল দ্রুত। সাওলো আর মেলোডি অন্য দু’জনের তুলনায় হালকা হওয়ায় পর্যায়ক্রমে প্রতিটা ঘোড়ায় চড়তে লাগল ওরা। একঘণ্টা পর পর প্রতিটা বিশ্রামে ঘোড়া বদলানো হলো। এদিকে জিন ছাড়া ঘোড়ায় চাপায় অনভ্যস্ত বলে ওদের নিজেদেরও কষ্টের সীমা রইল না।

সূর্য যখন পশ্চিমে হেলে পড়ল, একটা ভাঙাচোরা লাভা-ক্যানিয়ন আর রিজে ভরা অঞ্চলে পৌছল ওরা। এতক্ষণ অনেকটা ঘোরের মধ্যে ঘোড়া চালিয়েছে, প্রচণ্ড তাপ আর দারুণ পিপাসায় ওরা বড় এক ক্যান্টিন পানি নিঃশেষ করে ফেলেছে।

সারাক্ষণই পেছনে ট্রেইলের ওপর একটা চোখ রেখেছিল সাওলো। অ্যাপাচিদের আভাস খুঁজেছে তন্ন তন্ন করে। তবে অঞ্চলটা উঁচু-নিচু, ঢেউ খেলানো—এক সঙ্গে অনেকদূর দেখতে পাওয়া সম্ভব হয়নি ওর পক্ষে। তবু মোটামুটি নিশ্চিন্ত ছিল সে। কিন্তু এইমাত্র মাইল দুয়েক পেছনে একটা রিজের ওপর চোখ আটকে গেল ওর। ওখানে জনা তিনেক ঘোড়সওয়ার!

এ তিনজনই সম্ভবত, সাওলো অনুমান করল, সবার আগে ঘোড়া খুঁজে পেয়ে ওদের পিছু নিয়েছে। উঁচু-নিচু ভূমিতে গা ঢাকা দিয়ে এক নাগাড়ে ঘোড়া চালিয়ে ওদের কাছে এসে পড়েছে। অন্যদের জন্যে অপেক্ষা করার তর সয়নি

চোখে ফিল্ডগ্লাস লাগাল সাওলো। এক লাফে ঘোড়া আর সওয়ারী চলে এল ওর চোখের দশগজের মধ্যে। কাহিল অবস্থা হয়ে গেছে জন্তুগুলোর।

সূর্য তার উজ্জ্বলতা হারিয়েছে, দিগন্তে ঝুলে আছে পাকা কমলালেবুর মত। তবে আরও ঘণ্টা দুয়েক থাকবে দিনের আলো। ঘোড়ার প্রতি কোনও রকম মমতা দেখায়নি অ্যাপাচিরা। অন্ধকার নামার আগেই শিকারকে ওদের অগোচরে ওভারটেক করার ইচ্ছে ওদের—এবং অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে তারা তাই করবে।

সবাইকে দাঁড়াতে বলল সাওলো

‘তোমরা এগিয়ে যাও। আমি অপেক্ষা করব ওদের জন্যে।’

থুতু ফেলল ইয়েটস। ‘তুমি একা?’

‘তোমরা এগিয়ে যাও, মি. ইয়েটস। তোমাদের টোপ হিসেবে ব্যবহার করতে চাই আমি।’

ওরা যেখানে থেমেছে, চারদিকে উঁচু-নিচু টিলাবেষ্টিত সমতল ভূমি সেটা। সামনে একটা লাভা-টিলা অ্যাপাচি আর ওদের মাঝে আপাতত আড়াল হিসেবে কাজ করছে। পরিকল্পনাটা ওদের বুঝিয়ে বলল সাওলো। অ্যাপাচিদেরও যেতে হবে লাভা-টিলাটার পাশ ঘেঁষে। সামনে কয়েকশো গজ গেলেই ইয়েটসরা অ্যাপাচিদের চোখে পড়বে। ওদের দেখে স্বভাবতই চঞ্চল হয়ে উঠবে ওরা, তবে সাথে সাথে যথেষ্ট সতর্কতাও অবলম্বন করবে নিশ্চয়। ইতোমধ্যে ইয়েটস তার দলবলসহ সামনে ক্যানিয়নের গোলক ধাঁধায় নিজেদের লুকিয়ে ফেলবে। ও নিজে লাভা-টিলার ওপরে সুবিধাজনক পজিশন নিয়ে অপেক্ষা করবে অ্যাপাচিদের জন্যে। ইয়েটসের দল ওদের প্রলুব্ধ করে ওর রাইফেলের আওতায় নিয়ে আসবে।

‘ইয়েটস,’ বলল সে, ‘ব্যাপারটা কিন্তু ফুলদানি থেকে ফুল নিয়ে গন্ধ শোঁকার মত সহজ নয়, যথেষ্ট ঝুঁকি রয়েছে। ওরা আচমকা গুলিগোলা শুরু করলে তোমাদের সবাই মারা পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।’

‘রয়েছে, তাই না?’ হাসল ইয়েটস। ‘নিশানা হিসেবেও মানুষ অতটা সহজ নয়।’ থুতু ফেলল সে। ‘ঠিক আছে।’

‘স্বাভাবিক গতিতে চলবে তোমরা,’ সাবধান করল সাওলো। পিছনে তাকাবে না। ওরা যেন বুঝতে না পারে যে, ওদের উপস্থিতি আমাদের কাছে ফাঁস হয়ে গেছে। তবে যে-ই গুলির শব্দ শুনবে, অমনি লেজ তুলে পালাবে।’

লাগামটা মেলোডির হাতে ধরিয়ে দিয়ে লাফিয়ে নেমে গেল সাওলো। নিমেষে পাথরের আড়ালে লুকিয়ে ফেলল নিজেকে। একটা রিজ বেয়ে উঠে গেল বিড়ালের মত অনায়াস দক্ষতায়। চূড়া পেরিয়ে ওপাশের এবড়োখেবড়ো পিঠে পৌছে গেল, সামনে আলের মত একটা উঁচু জায়গা। খুব প্রশস্ত নয় আলটা। এপাশে বসে রাইফেলটা রাখল ওটার ওপর। অ্যাপাচিরা যাবার সময় পরিষ্কার দেখতে পাবে ও, ওরা কিন্তু ওকে দেখতে পাবে না। তাছাড়া ওদের সংখ্যা জানা না-থাকায় এবং নিজেদের উত্তেজিত অবস্থায়, ওদের যে অ্যাম্বুশ করা হতে পারে, এটা ওদের মাথায়ও আসবে না।

আমার কমপক্ষে দু’জনকে ঘায়েল করতে হবে…ভাবল সাওলো, তাহলে আশা আছে। অপেক্ষা করতে লাগল ও।

অ্যাপাচিদের ঘোড়ার খুরের শব্দ কানে এল ওর। ইয়েটসরা ওদের চোখে পড়েছে। সতর্ক হলো সাওলো। একটু পরেই লাভা-টিলার পাশে দেখা গেল অ্যাপাচিদের; দুর্দান্তবেগে এগোচ্ছে। সামনের নেতাগোছের লোকটার বুক সই করল সাওলো। ট্রিগারে টান দিল। নীরব ক্যানিয়নে কানফাটা গর্জন তুলল রাইফেল, ঘোড়ার পিঠ থেকে উল্টে পড়ল নেতা অ্যাপাচি।

ওর প্রত্যাশার চেয়ে বেশি প্রতিক্রিয়া দেখাল বাকি দুই অ্যাপাচি। ঘোড়ার পিঠে প্রায় শুয়ে গেল ওরা, চোখের পলকে নিকটবর্তী পাথরগুলোর দিকে ছুটল কভারের আশায়।

রাইফেলে দ্রুত গুলি ভরল সাওলো। অ্যাপাচি দু’জন পাথরের কাছে চলে গেছে প্রায়। আবার গুলি করল সে। মিস হলো। তবে ভয় পেয়ে লাফিয়ে উঠল একটা ঘোড়া, টাল সামলাতে না পেরে পাথরের ওপর গিয়ে পড়ল হুড়মুড় করে। পিঠ থেকে পড়ে গেল ওর সওয়ারী। বাকি ঘোড়াটা পাথরের আড়ালে চলে গেল।

ঘোড়া থেকে পড়ে যাওয়া অ্যাপাচি উঠতে চেষ্টা করছে, পারছে না। আহত হয়েছে লোকটা, বুঝতে পারল সাওলো। বুকে হেঁটে একটা পা টেনে নিচ্ছে। সাওলো চিনতে পারল ওকে। নাবুতো। রাইফেল ওঠাল সে। নাবুতোর ওপর লক্ষ্যস্থির করল। পরক্ষণেই রাইফেল নামিয়ে নিল। নাবুতোর দিক থেকে আপাতত বিপদের আশঙ্কা নেই। অন্য লোকটার দিকে মনোযোগ দিল ও।

সহসা পাথরের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল তৃতীয় অ্যাপাচি; বাঁ দিকে ঝাপ দিল। গুলি করল সাওলো, অ্যাপাচির গোড়ালির ঠিক পেছনে এক ইঞ্চির মধ্যে ধূলি উড়ল। রিলোড করার আগে আরেকটা পাথরের আড়ালে চলে গেল অ্যাপাচি। একটুও দ্বিধা না করে পরক্ষণেই বেরিয়ে এল আবার, বুনো ছাগলের মত তিড়িং বিড়িং করে লাফাতে লাফাতে পাথরের ভেতর দিয়ে দৃষ্টির আড়ালে হারিয়ে গেল।

ওর উদ্দেশ্য পরিষ্কার হয়ে গেল সাওলোর কাছে। ঘুরে লাভা-টিলা বেয়ে ওর পেছনে চলে আসার মতলব করেছে লোকটা। রিজের অপর পাশে সাওলো ওর আগে পৌছাতে না-পারলে ওপর থেকে ওর গুলির মুখে ফাঁদে- পড়া ইঁদুরের দশা হবে সাওলোর।

দ্রুত রিজের ওপাশে চলে গেল ও। তেরছাভাবে পর্যবেক্ষণ করল জায়গাটাকে, তারপর চূড়ার পাশ ঘেঁষে পুব পাশে চলে গেল। ওখান থেকে দেখা যাবে নাবুতোর সঙ্গীকে। ওর সামনে ওপাশে লাভার উঁচু-নিচু ছোট ছোট স্তূপ। স্তূপগুলোকে কাভার হিসেবে ব্যবহার করে সামনে এগোল সে, ঝড়-জল আর রোদে মসৃণ শতাব্দী-প্রাচীন একটা পাথরের ওপর ঘাপটি মেরে বসল।

ওর ডানদিক থেকে আচমকা দেখা দিল অ্যাপাচি। এদিক থেকে ওকে আশা করেনি সাওলো। ফলে তাড়াহুড়োয় অ্যাপাচির সাথে গুলির লাইন ঠিক করতে ব্যর্থ হলো। দাঁড়িয়ে পায়ের গোড়ালির ওপর ঘুরতে গেল। মসৃণ পাথর অসহযোগিতা করল ওর সঙ্গে, পিছলে গেল ওর পা এবং একই সাথে মাথার এক ইঞ্চি ওপরে গুলির শিস শুনতে শুনতে দড়াম করে আছড়ে পড়ল।

পতনই ওর জীবন বাঁচাল। তবে মসৃণ পাথরে পিছলে গড়াতে লাগল ও নিচের দিকে। দু’হাতে পাথর আঁকড়ে ধরে পতন ঠেকাতে গেল সে, ফলে রাইফেলটা ছিটকে গেল হাত থেকে, নিচে গিয়ে পড়ল আরেকটা পাথরের ওপর। গড়াতে গড়াতে একটা খাঁজ খুঁজে পেল সাওলোর আঙুল, পতন ঠেকাল ও কোনওমতে। অন্য হাতে পিস্তল বের করল সঙ্গে সঙ্গে।

ক্ষণিকের জন্যে শত্রুর চোখের আড়ালে রয়েছে ও এখন। তবে পাথরে ওর মোকাসিনপরা পায়ের মৃদু খস খস শব্দ শোনা যাচ্ছে। হঠাৎ দেখা গেল ওকে ওপরে।

উভয়ে উভয়কে একসঙ্গে দেখল এবং প্রায় একই সাথে গুলি করল। সাওলোর কানের এক ইঞ্চি দূর দিয়ে পাথরে ঘষা খেয়ে চলে গেল অ্যাপাচির গুলি। আর সাওলোর গুলি ওর মুখ দিয়ে ঢুকে মাথার পেছন দিয়ে বেরিয়ে গেল।

পাথরের খাঁজে হাত রেখে ধীরে ধীরে পাশে সরে যেতে লাগল সাওলো। ওর মুখে যন্ত্রণা হচ্ছে, চিবুক বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে রক্ত। গুলির ধাক্কায় চলটা- ওঠা পাথরের ধারাল কণায় ওর মুখের নানা অংশ কেটে গেছে।

মসৃণ পাথর পেরিয়ে এবড়োখেবড়ো অংশে পৌঁছে ওপর দিকে বেয়ে উঠতে শুরু করল সাওলো। হামাগুড়ি দিয়ে রিজের চূড়োয় পৌঁছে গেল।

প্রচণ্ড পরিশ্রম আর যন্ত্রণায় হাঁফাচ্ছে ও। কান ঝাঁ ঝাঁ করছে, চোখের সামনে ঘোলাটে দেখাচ্ছে সব কিছু। হঠাৎ গুলির শব্দে সচকিত হলো সে, ঘোর কেটে গেল।

রিজের নিচ থেকে এসেছে গুলির আওয়াজ। নাবুতো আর ইয়েটসের মধ্যে গুলি বিনিময় চলছে সম্ভবত। রিজের চূড়া থেকে নামতে শুরু করল সে উঁচু-নিচু পাথর আর লাভা স্তূপগুলোর আড়ালে। খোলা জায়গা দিয়ে নামতে গেলে নাবুতোর টার্গেট হবার আশঙ্কা আছে।

তবে নাবুতোকে ব্যস্ত রেখেছে ইয়েটস। অবশ্য নারুতোর প্রকৃত অবস্থান ওর জানা নেই। ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে পাথরের আড়ালে আড়ালে নাবুতোর দিকে এগিয়ে আসার চেষ্টা করছে ইয়েটস।

দ্রুত ঘুরে নারুতোর পেছনে প্রায় বিশগজের মধ্যে চলে গেল সাওলো। থামল। প্রায় মাটির সঙ্গে মিশে দুটি পাথরের মধ্য দিয়ে ইয়েটসের অবস্থান আন্দাজ করে গুলি করছে নাবুতো মাঝে-মধ্যে। পেছনে কিছু একটার উপস্থিতি আঁচ করতে পেরে পেটের ওপর ঘুরল ও কিছুটা। দেখতে পেল সাওলোকে। দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে রাইফেলের লিভার টানতে গেল সে; সাওলো পিস্তল কক করল।

‘ওটা ফেলে দাও, নাবুতো,’ শান্ত স্বরে বলল সাওলো। ‘তোমাকে আমি খুন করতে চাই না।’

রক্ত আর ঘামের সাথে ধুলো-বালি মিশে কদাকার দেখাচ্ছে নাবুতোর মুখ; হিসহিসে কণ্ঠে বলল, ‘চারদিন আগেই আমাকে খুন করেছ, শীক-এ-সে!’

রাইফেল তুলতে শুরু করল সে, গুলি করল সাওলো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *