জ্বালা – ১১

এগারো

সাওলোদের পক্ষের একজন মারা গেছে লড়াইয়ে। ওয়াল্টার। মাথায় গুলি লেগেছিল ওর।

তবে একা মরেনি ঘাগু লড়িয়ে প্রাক্তন সৈনিক। নিজের পঁয়তাল্লিশ ক্যালিবারের বড় সার্ভিস রাইফেলের অব্যর্থ লক্ষ্যে অ্যাপাচিদের দু’জনকেও সঙ্গে নিয়ে গেছে। তবু ওয়াল্টারের মৃত্যুটা লড়াইয়ে সাওলোদের জন্যে বড় ধরনের ক্ষতি বলতে হবে।

এদিকে ইয়েটসও একজনকে হত্যা কিংবা মারাত্মকভাবে আহত করেছে। তিনটি দেহই সরিয়ে নিয়েছে অ্যাপাচিরা; কেবল দেহগুলোর পতনের জায়গায় রক্তের দাগ ছাড়া একটু আগে হয়ে-যাওয়া মরণপণ লড়াইয়ের কোনও চিহ্ন আর অবশিষ্ট নেই কোথাও।

সূর্য এখন আরও ওপরে উঠে এসেছে।

কবর খোঁড়ার উপযোগী যন্ত্রপাতি নেই ওদের সঙ্গে। তবু হাত দিয়ে নরম বালি খুঁড়ে যতটা সম্ভব বালিচাপা দিল ওরা ওয়াল্টারকে, সাওলো আর হাবের হাতে নিহত লাশ তিনটে এবং মৃত ঘোড়াটাকেও। ফুলে ফেঁপে ওঠা মৃত ঘোড়ার দেহ থেকে বিকট গন্ধ ছড়ানো বন্ধ হওয়ায় শান্ত হলো জীবিত ঘোড়াগুলো।

বিশ্রাম নিতে একটা বড়সড় পাথরের ছায়ায় বসল ওরা। মেলোডি পাহারার দায়িত্বে থাকল। অবশ্য সাওলোও সতর্ক রইল।

সবচে’ নিচের ট্যাংক থেকে ঘোড়াগুলোকে পানি খাইয়ে আনল সে। ওপরের ট্যাংকগুলোর পানি প্রচণ্ড তাপে এবং তাদের এতগুলো মানুষের তৃষ্ণা মেটাতে গিয়ে দর্শনীয়ভাবে কমে এসেছে গত চব্বিশ ঘণ্টায়। ঘোড়াগুলোর অবশ্য খাবারের অভাব হচ্ছে না। মনের সুখে মেস্কিট পাতা আর গ্যালেটা ঘাস চিবুচ্ছে ওরা। তবে নিজেদের খাবারের যোগান নিয়ে উদ্বিগ্ন সাওলো। ফাঁদে তিতির পড়া কমে গেছে আগের চেয়ে; সতর্ক হয়ে গেছে পাখিগুলো।

পানির উৎস অফুরন্ত নয়; খাদ্য সমস্যা ক্রমে ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠার আশঙ্কা। অ্যাপাচিদের অনুকরণে তীর-ধনুক বানিয়ে নিল সাওলো। এটা একটা চমৎকার অস্ত্র! অ্যাপাচিদের মনোযোগ আকর্ষণ না-করে নিঃশব্দে শিকারের জন্যে দারুণ উপযোগী। প্রচুর বুনো বিগহর্ন মেষ ট্যাংকে পানি খেতে আসে। কাছেই…সম্ভবত উঁচু রিজগুলোর কোথাও থাকে ওগুলো। উত্তরের পাহাড়ী বিগহর্নের চেয়ে ভিন্ন প্রজাতির এগুলো। মারতে পারলে খাদ্য সমস্যার মোটামুটি সমাধান হবে।

‘আমাদের খাবারে টান পড়ে যাবে,’ ঘোষণা করল সাওলো। ‘পাখিগুলো চালাক হয়ে গেছে, ফাঁদে পড়তে চাইছে না।’ হাত উঁচিয়ে দূরের রিজগুলোর দিকে দেখাল সে। ‘ওখানে কিছু বিগহর্ন আছে। সন্ধের দিকে গিয়ে ওখান থেকে একটা মারার চেষ্টা করব আমি।’

‘তাই নাকি!’ টিটকারি মারল স্টিফেন। ‘সম্ভবত ওটাই তোমার সঙ্গে আমাদের শেষ দেখা হবে!’

‘গাধার মত কথা বোলো না। আমি ঠিকই ফিরব।’ স্টিফেন কতটুকু ওজনের মানুষ, জেনে গেছে সাওলো; পাত্তা দিল না ওকে।

‘আমাদের সবার একত্রে যাওয়াটাই সম্ভবত ভাল হবে। ঘোড়া নিয়ে যাব আমরা। আসল কথা হলো, অ্যাপাচিরা তোমাকে একা পেয়ে যেতে পারে। আর হারাবার মত প্রচুর লোক আমাদের নেই।’

‘উহুঁ,’ ইয়েটসের সঙ্গে একমত হলো না সাওলো। আমাদের লোকসংখ্যার তুলনায় ঘোড়া কম। তিনটে মাত্র। তিনজন তিনটে ঘোড়া নিয়ে গেলে বাকি যারা থাকবে, এক ঘণ্টাও টিকতে পারবে না ওরা কুরিয়াপোর সামনে।’

‘আমার কাছে একটা বুদ্ধি আছে,’ স্টিফেন বলল। ওর বলার ভঙ্গিটা এতই জরুরী শোনাল যে, সবাই এক সাথে ওর মুখের দিকে চাইল। ও বলে চলল, ‘ধরো, স্টেইভ, তুমি একটা ঘোড়া নিয়ে পালিয়ে গেলে। এখন কুরিয়াপো যদি সত্যি সত্যি তোমাকেই চায়, তাহলে তুমি আমাদের সাথে নেই—এটা জানার পর সবকিছু বাদ দিয়ে তোমার পেছন পেছন ছুটবে। এদিকে তোমার পালানোর ব্যাপারটা ওরা টের পাবার আগে অনেক দূর চলে যেতে পারবে তুমি। কী বলো? চমৎকার বুদ্ধিটা, না?’

‘না। তোমার হিসেবে দুটো জিনিস ভুল হয়েছে। প্রথমত, কুরিয়াপো চাইলেও এখন আর তোমাদের ছেড়ে দিতে পারবে না। ওর লোকেরা তা মানবে না। তোমাদের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে প্রচুর বন্ধু বান্ধব হারিয়েছে ওরা। এটা ওদের অহমিকায় ঘা দিয়েছে। ওরা এখন আগের চেয়ে সতর্ক। তোমাদের মধ্যে একজন বেঁচে থাকলেও ওরা এখান থেকে নড়বে না।’

ঠাণ্ডা, হাড়-জ্বালানো হাসি হাসল স্টিফেন। ‘আর বাকিটা?’

‘বাকিটা হলো,’ হাসল সাওলো নিজেও, ‘আমি আত্মহত্যা করতে মোটেই আগ্রহী নই। তুমি আমাকে তা-ই করতে বলছ।’

‘এটা একটা সুযোগ,’ যেন নিজেকে শোনাল স্টিফেন; তারপর তাকাল সাওলোর দিকে। ‘সুযোগটা তাহলে আমিই নিচ্ছি।’

‘হোলস্টারে ছোবল বসাল ওর হাত, পিস্তল বের করে উঁচিয়ে ধরল। তা হলে এই হলো কথা। মি. দোআঁশলা, আমিই যাচ্ছি।’

কর্কশ কণ্ঠে হেসে উঠল অ্যাম্বারগো। ‘বে ঘোড়াটা, মিস্টার! এখনও তোমার জন্যে তৈরি।

‘ওটাই নিচ্ছি আমি।’ ইয়েটসের দিকে চাইল স্টিফেন। ‘ঘোড়াটা নিয়ে আসো শিগগির।’

আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াল ইয়েটস। ‘ব্যাপারটা আরেকবার ভেবে দেখো, স্টিফেন। মনে হয়, স্টেইভ ভুল বলেনি। ওর কথা মেনে না চলার কারণ এখনও ঘটেনি।’

‘জাহান্নামে যাক ও। ওর কথা তুমিও শুনেছ। অ্যাপাচিরা আমাদের কাউকে ছাড়বে না। ওরা আক্রমণ না-করলে হয়তো আমরা টিকে থাকব কিন্তু তাতে কী লাভ, এখানে এই হতচ্ছাড়া জায়গাটায় রোদে পুড়ে ভাজা ভাজা হওয়া ছাড়া?’

‘যে পানি আছে,’ সাওলো বোঝানোর ভঙ্গিতে বলল, ‘তাতে আরও কিছুদিন চলবে। ইতোমধ্যে দু’একটা বিগহর্ন মেরে খাদ্য সমস্যার সমাধান করতে পারব আমরা। মোদ্দা কথা হলো, এতে ভেবে-চিন্তে উপায় বের করার একটা সুযোগ নিশ্চয় পেয়ে যাব।’

‘ভাবো তুমি যদ্দিন ইচ্ছে!’ বিদ্রূপের স্বরে বলল স্টিফেন। ‘আমি এখনই ভাগছি। কই, ইয়েটস? পিস্তল নাড়াল ও, ‘ঘোড়াটা এনে স্যাডল চাপিয়ে দিতে বললাম না?’

হাত উল্টে হতাশার ভঙ্গি করল ইয়েটস। তারপর ধীরে ধীরে হাঁটতে শুরু করল বে’র উদ্দেশে।

সবার দিকে চোখ রাখা যায়, এমন সুবিধাজনক জায়গায় দাঁড়িয়েছে স্টিফেন, তবে ওর চোখ সাওলোর ওপর। এক মুহূর্তের জন্যেও নড়ছে না। গুলি করার ছুতো খুঁজছে ও, বুঝতে পারল সাওলো।

বসা থেকে উঠে দাঁড়াল হাব।

‘তোমার আবার কী হলো?’ খেঁকিয়ে উঠল স্টিফেন।

‘পায়ে খিল ধরে গেছে, স্যার,’ বিনীত কণ্ঠে জানাল হাব।

‘চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকো, গাধা কোথাকার! একদম নড়বে না।’

বে’র পিঠে স্যাডল চাপিয়ে ধীরে ধীরে ওটাকে হাঁটিয়ে নিয়ে এল ইয়েটস। লাগামটা ধরিয়ে দিল স্টিফেনের হাতে। ফোঁৎ করে শ্বাস ছাড়ল ঘোড়াটা, মাথা নাড়ল। কিলবিল করে উঠল ওর ঘাড়ের পেশীগুলো। ওটার চওড়া বুক, শক্তিশালী কাঁধ আর লম্বা, শক্ত পা দেখে সাওলো অনুমান করল, খোলা জায়গায় দৌড়ে এর জুড়ি মেলা ভার হলেও, পাথুরে রুক্ষ এলাকায় খুব একটা সুবিধা করতে পারবে না। আর এটার আরোহী হবে ভেদ করার জন্যে চমৎকার টার্গেট।

ব্যস্ত সমস্ত ভঙ্গিতে ঘোড়ার পাশে গেল স্টিফেন। রেকাবে এক পা রেখে সাবলীল ভঙ্গিতে চড়ল ওটার পিঠে; ওর হাতের পিস্তল একচুলও নড়ল না ওদের ওপর থেকে

হাসল সে। ‘তোমাদের গুডবাই জানাচ্ছি ভাইয়েরা। তবে বেশি সময়ের জন্যে নয়। যত শীঘ্র সম্ভব সাহায্য নিয়ে ফিরব আমি।’

‘হাহ্!’ হাসল অ্যাম্বারগো। নরক থেকে খুব বেশি সাহায্য তুমি আনতে পারবে না!’

অশ্বারোহীর দিকে ধীরে ধীরে এগোল সাওলো, বে’র ডানপাশে গিয়ে দাঁড়াল। স্টিফেন ধারাল গলায় বলল, ‘বাস, যথেষ্ট এগিয়েছ, ব্ৰীড!

সাওলো মৃদু কণ্ঠে বলল, ‘যেয়ো না. মি. স্টিফেন। কেন অনর্থক মরতে চাইছ?’

‘খ্যাক’ করে উঠে ওকে জাহান্নামে যেতে বলল স্টিফেন

একপা পিছু হটল সাওলো, সেই সাথে আর এক পাশে সরে গেল। স্টিফেনকে বিরক্ত করে ওর মনোযোগে চিড় ধরাতে চাইছে সে।

‘নোড়ো না বলছি, স্টেইভ! কানে শোনো না?’ ধমকে উঠল স্টিফেন।

মনোযোগে চিড় ধরল স্টিফেনের। হাবের জন্যে এটুকুই যথেষ্ট সময় বলে আশা করল সাওলো।

ওর আশা বৃথা গেল না। একটুও ইতস্তত করল না হাব। বিশাল শরীর নিয়ে পলকে চলে এল স্টিফেনের পেছনে ঘোড়ার কাছে। লম্বা দু’হাতে স্টিফেনের পিস্তল ধরা হাতের বাহু আর কোমর আঁকড়ে ধরল। স্টিফেন প্রস্তুত ছিল না এর জন্যে। আচমকা আক্রমণে দিশেহারা হয়ে পড়ল। পিস্তলের বাড়ি লাগাল ও হাবের কাঁধে। প্রচণ্ড আঘাতে গুঙিয়ে উঠল হাব, তবে হ্যাঁচকা টানে স্যাডল থেকে নামিয়ে আনল স্টিফেনকে। একটা শিশুর মত তুলে ধরে একহাতে ওর হাত থেকে পিস্তলটা কেড়ে নিল, তারপর ছুঁড়ে ফেলল ওকে বালিতে

নাক থেকে রক্ত আর ধুলো-বালি মুছতে মুছতে উঠে বসল স্টিফেন। রাগে দাঁতে দাঁত ঘষছে। ‘তোমাকে আমি খুন করব, স্যাম্বো!’

‘শুনে খুশি হলাম!’ দাঁত বের করল হাব। ‘আশা করি পিস্তল ছাড়াই ওটা পারবে!’

পিস্তলটা নিয়ে লোফালুফি করল হাব বার দুয়েক, তারপর ওটাকে ট্রাউজারের পকেটে চালান করে দিল।

.

উত্তপ্ত সূর্য সারাদিন অ্যারোয়োতে আগুন ছড়াল। সময় কাটতে লাগল ধীর, অসহনীয় ধীর গতিতে। ডেপুটি শেরিফ জিমি গ্যানোর অবস্থা ক্রমশ খারাপের দিকে যাচ্ছে। জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে ওর শরীর। সীমান্ত এলাকার স্প্যানিশ ভাষায় এক নাগাড়ে প্রলাপ বকছে সে। মাঝে-মধ্যে ক্যাথারিনা বলে একজন মহিলার নাম উচ্চারণ করছে। ওর বউ হবে সম্ভবত, ভাবল সাওলো। শেষ পেটিকোটটা ছিঁড়ে তৃতীয়বারের মত ওর ব্যান্ডেজ বেঁধে দিল মেলোডি পুরানো রক্তে ভেজা ব্যান্ডেজ পাল্টে। তবে, সাওলো বুঝতে পারছে, ডাক্তারের হেফাজতে নিতে না পারলে ডেপুটি শেরিফ আর একদিনও টিকবে না।

আকাশ-মাটি দাউ-দাউ করে জ্বলছে মরু-মধ্যাহ্নের ঝাঁঝাল হলুদ রোদে। চারদিকে খাঁ-খাঁ করছে নৈঃশব্দ্য। এরই মধ্যে কোথাও না কোথাও অ্যাপাচিদের ভয়ঙ্কর অস্তিত্ব নৈঃশব্দ্যকে আরও ভয়াবহ করে তুলছে। পাথরের আড়ালে উত্তপ্ত ছায়ায় শুয়ে দর দর করে ঘামছে সবাই; চুপচাপ, কথা বলার শক্তিও যেন হারিয়ে ফেলেছে ওরা আতঙ্ক আর অবসাদে।

তবে সাওলোর অবস্থা ততটা ভয়াবহ নয়। সারাক্ষণই চোখ-কান খোলা রয়েছে ওর। অ্যারোয়োর ভেতরের উত্তপ্ত বদ্ধ বাতাস আর চামড়া-জ্বালানো রোদ সেদ্ধ করে দিচ্ছে ওকে, তবু ওর অ্যাপাচি সুলভ সহিষ্ণুতা আর প্রশিক্ষণ ওকে ঠিক থাকতে সাহায্য করছে। নিজের সঙ্গীদের দিকেও তীক্ষ্ণ নজর রাখছে ও। তীব্র তাপ, দুশ্চিন্তা এবং আতঙ্কে পাগলামি দেখা দিতে পারে- কিছু একটা করার জন্যে মরিয়া হয়ে ওঠে অনেকে; অন্যের প্রতি সহানুভূতি কিংবা দায়িত্ববোধ কিছুই অবশিষ্ট থাকে না তখন। সাওলো জানে, ওদের মধ্যে কেউ যদি ওই ধরনের সমস্যায় আক্রান্ত হয়, তাহলে পুরো দলেরই বিপদ ঘটতে পারে। ও তাই সতর্ক। কিন্তু ওর সমস্ত সতর্কতাকে অনাবশ্যক প্রমাণ করে দিল দলটা। ওরকম কিছু করার শক্তিও কারও আছে বলে মনে হচ্ছে না। নির্জীব হয়ে পড়ে আছে সবাই। এমন কী, ম্যাগি পর্যন্ত ওর পাগলামি বাদ দিয়ে চুপচাপ মড়ার মত শুয়ে আছে এক পাশে।

তবে হাবের অবস্থা ভিন্ন। ওদের মধ্যে ব্যতিক্রম কেবল সে-ই। নিজের সাহসের প্রমাণ পেয়ে আত্মবিশ্বাস বেড়ে গেছে ওর। চোখ-কান সতর্ক রয়েছে তারও। মাঝে-মধ্যে সাওলোকে বিশ্রাম দিচ্ছে সে পাহারার দায়িত্ব থেকে।

সূর্য অস্ত যাচ্ছে। তীব্র হলুদ রোদ ক্রমশ লাল হয়ে উঠছে, বিশাল মরুভূমির বুকে নামছে ধীরে ধীরে সন্ধের ছায়া। দুপুরের প্রচণ্ড তাপ কমে ঠাণ্ডা হয়ে আসছে বাতাস।

কুরিয়াপোর কথা ভাবছে সাওলো। ওর জন্যে একটি মাত্র বুলেট খরচ করবে ও। কিন্তু তার আগে ওকে পেতে হবে নাগালে; রাইফেলের সাইটে কিংবা পিস্তলের আওতায়। ওকে মারলেই যে ওদের বর্তমান অবস্থার পরিবর্তন ঘটবে, এমন মনে করে না ও। অবশ্য নেতার মৃত্যুর পরে তা-ই হওয়া উচিত। কিন্তু, সাওলো জানে, তা হবে না। এখনকার অবস্থা ভিন্ন। নিজেদের পক্ষের প্রচুর লোকক্ষয়ের পর বেপরোয়া হয়ে উঠেছে অ্যাপাচিরা। চরম প্রতিশোধ নেবার চেষ্টা ওরা করবে।

আজ রাতে বিগহর্ন শিকারে যাবার কথা ভাবল সাওলো। খাবার ফুরিয়েছে ওদের। অবিলম্বে খাবার চাই। দু’একটাকে মেরে আনা ছাড়া খাবার সংগ্রহের আর কোনও পথ নেই। কাজটা ওকেই করতে হবে। অন্য কাউকে পাঠানোর ঝুঁকি নেয়া যাবে না। ওদের সামান্য ভুল পুরো দলের জন্যে বিপদ ডেকে আনতে পারে।

কিন্তু এ-অবস্থায় অনন্তকাল থাকা যাবে না। এ থেকে মুক্তি পাবার রাস্তা বের করতে হবে—এবং তা খুব দ্রুত।

সন্ধের আবছা অন্ধকারে একজনকে এগিয়ে আসতে দেখা গেল। কাছে আসতে চেনা গেল ওকে। মেলোডি। ওর হাতে কার্পেটব্যাগ। সাওলোর কাছে এসে দাঁড়াল মেলোডি, ওর দিকে তাকাল। কথা বলল না, একটু হেসে চলতে শুরু করল ফের; ঝোপের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেল।

প্রায়ান্ধকার মরুভূমির দিকে তাকাল সাওলো। ওখানে বিশাল নির্জনতা ক্রমে রহস্যময় রূপ ধারণ করছে। আগের ভাবনায় ফিরে যেতে চাইল সে, কিন্তু ওর কানে জল নড়ার ক্ষীণ শব্দ এসে ঢুকল। মনোযোগ নষ্ট হলো ওর। পাথরের ওপর থেকে নেমে ঝোপের দিকে এগোল সেও। গতকাল যেখানে মেলোডির সঙ্গে কথা বলেছিল, সেখানে গিয়ে দাঁড়াল।

ঝোপের ফাঁকে মেলোডিকে পানির ধারে পাথরের ওপর বসে থাকতে দেখা গেল। মেলোডির লম্বা শাদা পা দুটো নগ্ন। বুট আর মোজা খুলে এক পাশে রাখা। পা ধুচ্ছে মেয়েটি। ওর চুল খোলা, কাঁধের ওপর ছড়ানো।

সাওলোর উপস্থিতি ঠিকই বুঝতে পারল মেলোডি। সন্ধের আলো- আঁধারিতে সোনালি চুলে কাঁপন তুলে ঘাড় ফেরাল। ‘হ্যালো!’

ধীরে ধীরে উঠে সাওলোর কাছে চলে এল ও। স্বল্পালোকে মেয়েটির চোখের রহস্যময় দৃষ্টি অনুভব করল সাওলো। ‘স্টেইভ!…তুমি কি এক্ষুণি ‘যাচ্ছ?’

‘না। রাত নামুক আগে।’

ওর দিকে তাকিয়ে থাকল মেলোডি। চোখে কিছুটা উদ্বেগ।

সন্ধের আবছা অন্ধকার ঝোপের ভেতর অদ্ভুত এক মায়াজালের সৃষ্টি করেছে। চারদিকে প্রকৃতির একান্ত নিজস্ব শব্দ ছাড়া আর সব কিছু নীরব। একে অন্যের দিকে চেয়ে থাকল ওরা দীর্ঘ সময়। তারপর মেলোডি এগোল। মিশে গেল সাওলোর বুকের সঙ্গে। ওর নরম বুকের উষ্ণতা অনুভব করল সাওলো, শিউরে উঠল। পরক্ষণেই মুখের ওপর মেলোডির নিঃশ্বাস টের পেল। কিছু বুঝে ওঠার আগে মেলোডি চুমু খেল ওকে। কেঁপে উঠল সাওলোর পা থেকে মাথা পর্যন্ত। সাড়া দিল সে নিজেও। তারপর দু’জনের অগোচরে শব্দহীন দীর্ঘ অনেকগুলো মুহূর্ত কেটে গেল।

ইয়েটস, হাব আর স্টিফেনকে পাহারার দায়িত্বে রেখে সাওলো স্টেইড যখন অ্যারোয়ো থেকে বেরোল, তখন মধ্যরাত। লুক আউট পোস্টে ইয়েটস এবং এর দু’দিকে হাব আর স্টিফেন তাদের অবস্থান নিল।

সাপের মত এঁকেবেঁকে ঝোপঝাড়ের ভেতর দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে চলল সাওলো। বাকস্কিনের তৃণ আর মেস্কিট ডালের ধনুক ওর পিঠের সঙ্গে বাঁধা। ঝোপঝাড়ের ভেতর চলতে অসুবিধে হচ্ছে, তবে আগে থেকে এ ধরনের চলাফেরায় অভ্যস্ত বলে বেশি বেগ পেতে হলো না ওকে। প্রায় নিঃশব্দে সামনে এগিয়ে যেতে পারছে ও।

সাওলো জানে, এসব ঝোপঝাড়ের ভেতর কোথাও লুকিয়ে আছে অ্যাপাচিরা। প্রতি এক গজ অন্তর থামছে সে, পুরো এক মুহূর্ত অপেক্ষা করছে অস্বাভাবিক কোনও শব্দ শোনার আশায়। অন্ধকার ওকে সাহায্য করছে, তবে অসুবিধে হলো, ও নিজেও বেশিদূর দেখতে পাচ্ছে না। মরুর আকাশে এক চিলতে হলুদ পনিরের মত ক্ষয়িষ্ণু চাঁদের আলো; সামান্য আলো কোনওমতে চারদিকের ছড়ানো-ছিটানো পাথরগুলোকে দৃশ্যমান করে তুলেছে।

প্রায় আধঘণ্টায় বড় জোর পঞ্চাশ গজ পেরোল সাওলো। অ্যাপাচিদের সঠিক অবস্থান অনুমান করার কোনও উপায় নেই। তবে এটা নিশ্চিত যে, ওরা আছে কাছে-পিঠে কোথাও ছড়িয়ে-ছিটিয়ে।

চলতে চলতে আচমকা থেমে গেল সাওলো। কান পাতল। একটা ক্ষীণ নড়াচড়ার আওয়াজ পেয়েছে ও। ডানপাশে একটা ভূতুড়ে ছায়ামূর্তি দেখা গেল মুহূর্তের জন্যে, পরক্ষণেই মিলিয়ে গেল ওটা। পরবর্তী পদক্ষেপ নেবার আগে প্রায় পাঁচ মিনিট নিঃসাড় পড়ে রইল ও নিজের জায়গায়। পরের ক’টা মিনিট ঘোড়ার পা আছড়ানোর শব্দ শুনল। অ্যাপাচিদের খুব কাছে এসে পড়েছে ও, বুঝতে পারল।

একঘণ্টা পেরিয়ে গেল। অ্যারোয়ো পেছনে রেখে অনেকদূর চলে এসেছে সাওলো। অ্যাপাচিরা ওর উপস্থিতি টের পায়নি। উঠে দাঁড়াল সে। মাথা নিচু করে ঝোপের ফাঁকে ফাঁকে সামনে এগোল আরও কিছুক্ষণ। তারপর নিশ্চিন্ত হলো। অ্যাপাচিদের অনেক পেছনে ফেলে এসেছে ও। শিকারের দিকে এবার পূর্ণ মনোযোগ দিল সাওলো।

ক্ষীণ একটা শব্দ শোনা গেল কোথাও; ঘাস চিবানোর শব্দ। চারদিকে তাকাল ও। কিছু দেখা যাচ্ছে না। বাতাসের গতি বোঝার চেষ্টা করল। মেস্কিট ডালের তৈরি ধনুক ওর হাতে, তূণ থেকে তীর বের করে ধনুকে জুড়ল ও। সাবধানে এগোল সামনের দিকে; একটা গাছকে পাশ কাটাল যথেষ্ট ফাঁক রেখে। ওর দৃষ্টিপথে বাধা হয়েছিল ওটা এতক্ষণ। ফাঁকা জায়গায় এসে সামনের উঁচু-নিচু ভূমির পুরোটাই দেখতে পেল সে।

হঠাৎ থেমে গেল শব্দটা। নিজের জায়গায় জমে গেল সাওলো। ঘাস চিবোনোয় ব্যস্ত জন্তুটাও নিশ্চয় কিছু একটা টের পেয়েছে। অপেক্ষা করল সে; আশা করছে, বিগহর্নটা ওর জায়গা থেকে নড়বে এবং ওর চোখে পড়বে। আপাতত চুপচাপ থাকাই দরকার মনে করছে সাওলো। ছোটকাল থেকে এ ধরনের শিকারে অভ্যস্ত নয় ও, তবু ও জানে, ধৈর্য ধরা এবং শান্ত থাকাই একজন শিকারীর প্রাথমিক বৈশিষ্ট্য। তাকে প্রধানত যেটা মেনে চলতে হয়, তা হচ্ছে অপেক্ষা করা এবং তৈরি থাকা।

চুপচাপ কেটে গেল আরও কিছু সময়। হঠাৎ পেছনে আরেকটা শব্দে সচকিত হলো সাওলো। ওদিকে মনোযোগ দিল ও। হয়তো, ভাবল, ছোট কোনও প্রাণী—তবে অন্য কিছু হওয়াটাও বিচিত্র নয়।

সামনে ঘাস চিবোনোর শব্দ শোনা যাচ্ছে আবার। একটা সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দিচ্ছে না সাওলো। অ্যাপাচিরা হয়তো ওর উপস্থিতি টের পেয়ে গেছে এবং…কিন্তু সম্ভাবনাটায় পুরোপুরি সায়ও দিল না সে। ওরকম হলে এতক্ষণে সাজ সাজ রব পড়ে যেত ওদের মধ্যে। তবে ওদের কেউ যদি একা বাহবা কুড়োতে চায়, তাহলে অবশ্য ভিন্ন কথা।

তবে সাওলোর ভয় ওর শিকারকে নিয়ে। আচমকা শব্দে পালিয়ে যেতে পারে ওটা লেজ তুলে। আশার কথা, জন্তুটা সন্দেহ কাটিয়ে উঠে চরছে এখন নিশ্চিন্ত মনে। মাঝে-মধ্যে পাথরে ওর খুরের শব্দ শোনা যাচ্ছে।

একটু পরে খাওয়া শেষ করল জন্তুটা। পাথুরে ভূমিতে ওর চলার শব্দ শোনা গেল। পেট পুরে খেয়ে-দেয়ে ঘরে ফেরার মতলব করছে ব্যাটা। আনমনে হাসল সাওলো, তাকিয়ে রইল। জন্তুটার পায়ের শব্দে বুঝতে পেরেছে সামনে কোথাও পাথরের আড়াল থেকে খোলা জায়গায় বেরোবে ওটা; তখন দেখা যাবে পুরোপুরি।

উবু হয়ে বসল সে। তীর-ধনুক বাগিয়ে তৈরি। হঠাৎই দেখা গেল মেষটাকে। একটা অগভীর জায়গা পেরোচ্ছে। থামল জন্তুটা, বাঁকা শিঙদুটো নাড়াল। ধনুকের ছিলায় টান দিল সাওলো তীর বরাবর তাকিয়ে।

ঠিক সে মুহূর্তে ওর পেছনে শোনা গেল শব্দটা আবার। একমুহূর্ত সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগল ও। এখনই তীর ছুঁড়তে হবে, নয়তো ঘুরে পেছনে ফিরে সম্ভাব্য শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে

তীর ছুঁড়ে দিল সে। শিকারীর সহজাত বোধ থেকে বুঝতে পারল, তীরটা জন্তুটার কাঁধের মাংসে গেঁথেছে। প্রায় একগজ লম্বা একটা লাফ দিল মেষটা, গড়িয়ে গেল; একটা পাথরের সঙ্গে সংঘর্ষ ঘটল ওর শক্ত শিঙজোড়ার।

অর্ধবৃত্তাকারে পেছনে ঘুরতে শুরু করল সাওলো, আরেকটা তীর বের করে ততক্ষণে ধনুকে জুড়ে ফেলেছে প্রায়। তীক্ষ্ণ চোখে ঝোপের দিকে তাকাল। ওর এখনও ধারণা, বুনো কোনও জন্তুর শব্দ ওটা, তবে ততটা নিশ্চিত বোধ করছে না। অবশ্য এটাও ঠিক, ভাবল ও, অনেক সময় আকস্মিক কোনও শব্দকে অস্বাভাবিক মনে হতে পারে স্নায়বিক উত্তেজনার কারণে।

সামনে এগোল। একটা ঢালু জায়গায় এসে দাঁড়াল। সামনে দুটো পাথরের বোল্ডারের ফাঁকে মৃত পশুটাকে দেখতে পেল। পশুটার কাছে চলে গেল সে। চাঁদের ক্ষীণালোকেও ওটার শাদা লোম চকচক করছে। ছুরি বের করল ও। মৃতদেহটাকে পাথরের মাঝখান থেকে বের করে এনে খোলা জায়গায় রাখল। তারপর নিচু হয়ে ওটার নাড়ীভুঁড়ি আর চামড়া ছাড়ানোর উদ্যোগ নিল। কাজটা প্রায় শেষ করে এনেছে, এমন সময়ে শব্দটা ফের শুনল।

শব্দটার ব্যাপারে পুরো মনোযোগ দিতে পারল এবার সাওলো। একটা পায়ের শব্দ; ধীর অথচ দৃঢ় পদক্ষেপে হাঁটছে একটা মানুষ। চট করে কাছের বড় পাথ: টার আড়ালে চলে গেল ও। হামাগুড়ি দিয়ে পাথরের পাশ থেকে সামনে চোখ বুলাল। একটা কিছুর নড়াচড়া চোখে পড়ল ওর। মানুষটা হেঁটে আসছে সরাসরি ওর দিকে। লুকোচুরির কোনও ভাব নেই ওর মধ্যে। অপেক্ষা করতে লাগল সে রক্তমাখা ছোরা হাতে। অবাক হয়েছে, লোকটা পাগল নাকি মাথা খারাপ!

একটা গোলাকার পাথরের পাশে চলে এল লোকটা। একজন অ্যাপাচি। লাফ দিল সাওলো ওকে লক্ষ্য করে। বাউলি কেটে সরে গেল লোকটা। শেষ মুহূর্তে ওর একটা কবজি চেপে ধরল সে। পরক্ষণে ওর ছোরা-ধরা হাত লোকটার শক্ত মুঠোর ভেতর ধরা পড়ল। দু’জনে জড়াজড়ি করতে করতে নিচের ভূমিতে পাথরের পাশে গড়িয়ে পড়ল।

আচমকা ওর নাম ধরে ডাকল লোকটা, ‘সাওলো!’

ছোরা-ধরা হাতটা লোকটার মাথার ওপর তুলে নামিয়ে আনার চেষ্টা করছিল সে পূর্ণ শক্তিতে। ঢিল দিয়ে সরিয়ে আনল হাতটা। ওকে ছেড়ে দিয়ে উঠে দাঁড়াল। ‘আঙ্কেল!’

উঠে দাঁড়াল আঙ্কেল নিজেও। শীর্ণকায়; শুকনো, দড়ির মত পাকানো পেশী লোকটার। মুখে রঙের হালকা প্রলেপ। ‘আমার মনে হয়, কিছু কিছু জিনিস তুমি ভুলে গেছ, ভাতিজা! হয়তো আমার শেখানোর দোষ সেটা। ওর কণ্ঠে বিদ্রূপ।

সাওলো হাসল। ‘কিংবা হয়তো তুমি চমৎকার শিক্ষাই দিয়েছিলে। ওটা যে তুমি আমি অনেক আগেই বুঝতে পেরেছিলাম।’ হুল ফোটাল সেও।

‘ভাল,’ বিরসকণ্ঠে মন্তব্য করল আঙ্কেল নেপুতে।

‘পিছু নিয়েছিলে তাই না? গুলি খেতে পারতে তুমি।’

বালির ওপর বসে পড়ল নেপুতে। সাওলো নিজেও বসল। ‘তোমার ওই ফালতু তীরকে ফাঁকি দেয়া আমার জন্যে ডালভাত। ধনুকে তুমি আগেও দুর্বল ছিলে, ব্যাটা।’

বুড়ো মেয়েমানুষদের মত ফালতু বকবক কোরো না তো!’ বিরক্ত হলো সাওলো। ইঙ্গিতে মেঘটাকে দেখাল ও। ওটাকে তীর ছুঁড়েই ঘায়েল করেছি আমি।

‘একটা বাঁকা লাঠি হাতে পেলে বাচ্চারাও মারতে পারবে ওটাকে।’ লম্বা একটা হাত বাড়িয়ে সাওলোর হাঁটু ছুঁলো বুড়ো। ঠাট্টা করলাম। আসলে আমি একটা সুযোগ নিয়েছি তোমার সঙ্গে কথা বলার জন্যে। জানতাম, শিকারে তুমি রাইফেল ব্যবহার করবে না।’

অসংখ্য ভাঁজে-ভুজে ভরা বুড়ো লোকটার বয়সী মুখের দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাল সাওলো: এই লোকটা ওর শিক্ষক, বন্ধুও ছিল বটে। ‘তুমি জানতে যে, ওটা আমি?’

‘তো কী?’ অবাক দৃষ্টিতে চাইল বুড়ো। ঠোঁট ওল্টাল। শাদাদের মধ্যে এমন কে আছে যে, একজন অ্যাপাচির মতই নির্ভয়ে অ্যাপাচিদের পাশ কাটিয়ে যেতে পারে সাপের মত নিঃশব্দে? বাম হাতে একমুঠো বালু নিয়ে ডানহাতের তালুতে ঢালল বুড়ো। হয়তো বোকামি করে ফেলেছি। কিন্তু তোমার সাথে আমার কথা আছে।’

‘আমার সাথে তোমার কী কথা?’

‘জানি না,’ মাথা নাড়ল বুড়ো। অভিযোগের স্বরে বলল, ‘তুমি শাদা- চোখোদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছ!’

‘এটা আমার আর কুরিয়াপোর ব্যাপার!’ সাওলোর গলায় রাগ।

‘জানি।’ আঙুলের ফাঁক দিয়ে বালু ফেলতে লাগল বুড়ো। তবে তুমি যতটা না শ্বেতাঙ্গ, তারচে’ অনেক বেশি অ্যাপাচি, ব্যাটা!’

‘আমি দু’দিকেই সমান।

‘অ্যাপাচির ভাগই বেশি তোমার মধ্যে। অনেক আগে ওটা লক্ষ করেছি আমি।’

সাওলো পরিহাসের হাসি হাসল। ও রক্তের বাঁধন কেটেছে, অ্যাপাচিদের হত্যা করেছে। অবশ্য এতে কোনও বিদ্বেষ কিংবা ঘৃণা ছিল না। তবু সে হত্যা করেছে, এটাই হলো কথা।

দু’জনের মধ্যে নীরব কয়েকটি মুহূর্ত কেটে গেল। ওদের নীরবতাকে ব্যঙ্গ করেই যেন একটা প্যাঁচা রাতের নৈঃশব্দ্যকে ছিঁড়ে-ফেড়ে দিয়ে ডেকে উঠল কোথাও। বুড়ো ওর দিকে তাকিয়ে নিচের দিকে চাইল আবার। মাঝে- মধ্যে ভাবি, এ সবের কোনও অর্থ নেই। কিন্তু…কিন্তু জীবনটা খুব খারাপ নয়, ব্যাটা। বেঁচে থাকাটা আনন্দের। এর মধ্যে আমাদের যুদ্ধ করে যেতে হয়। আমরা পুরুষ তো!’

‘কিন্তু তুমি তো কোনওদিনই যুদ্ধ পছন্দ করোনি, আঙ্কেল?’

‘তাতে কী আসে যায়? আমার পছন্দ-অপছন্দের কতই বা আর দাম? যৌবনে অনেক কিছু ভাবতাম, সেগুলো প্রকাশও করতাম। ওরা আমাকে মেয়েমানুষ বলে খ্যাপাত। এর পরেও আমি লড়াই করতাম।’

‘কিন্তু লড়াই করেও তুমি শান্তির কথা বলতে, তাই না?’

‘তোমার বাবা আমার কথা শুনত না। দাঁড়াও, ব্যাটা! তোমার জ্বালা আমি বুঝি, ও তোমাকে ছেলে বলে স্বীকার করে না। কিন্তু তবু তুমি ওর ছেলে। শাদা চামড়াদের দেয়া হুইস্কি যখন ওর পেটের বারোটা বাজাল, তখনই চৈতন্য হলো ওর। এখন ও কুরিয়াপোর জন্যে চিন্তিত। আমাকে পাঠিয়েছে ওকে এ-পথ থেকে ফেরানোর জন্যে। পাগলামি, না?’

‘কুরিয়াপোকে এসব কে বলবে?’

‘আর ও শুনবেই বা কেন।’ এক মুহূর্ত চুপ করল ও। শাদা চামড়াদের ক’জন আছে আর?’

‘প্রচুর। আমরা তোমাদের শায়েস্তা করব, আঙ্কেল।

‘কিভাবে? তোমাদের যথেষ্ট খাবার দাবার নেই, পানির স্টকও সীমিত।  তোমরা টিকতে পারবে না।’

ট্যুবাক থেকে আরও শ্বেতাঙ্গ আসবে সাহায্য নিয়ে।’

‘ওরা আসতে আসতে তোমরা সবাই মারা পড়বে।’

‘দেখা যাক।’

‘শোনো, ভাতিজা!’ ভুরু উঁচাল বুড়ো চাচা। ওদের ছেড়ে চলে আসো তুমি। কুরিয়াপোর সঙ্গে দ্বন্দ্ব অন্য সময়ে অন্য কোথাও মোকাবিলার জন্যে তুলে রাখো। গতকাল আমরা তোমাদের প্রায় কবজা করে ফেলেছিলাম 1 এরপর পুরোটাই করে ফেলব।’

হাসল সাওলো। ‘কুরিয়াপো আবার আক্রমণের সাহস পাবে? প্রচুর লোক হারিয়েছে ও।’

‘অপেক্ষা করবে ও। তবে অন্যেরা করবে না। ওরা আর দাম দিচ্ছে না ওকে। মানতে চাচ্ছে না। সঙ্গীদের হারিয়ে ওরা মহা খাপ্পা। নাবুতো তোমাকে হত্যা করবে বলে প্রতিজ্ঞা করেছে। তোমার গুলিতে ওর পায়ের হাড় ভেঙেছে। আক্রমণ করার জন্যে অন্যদের উত্তেজিত করে তুলছে সে।’

‘আমি যাব না। কুরিয়াপোর সাথে বোঝাপড়ার ব্যাপার রয়ে গেছে আমার।’

আবার নীরবতা নেমে এল দু’জনের মধ্যে।

‘আমিও এরকম বলতাম, সাওলো,’ অবশেষে বলল বুড়ো নেপুতে। ‘কারণ তুমি আর আমি ভিন্ন কেউ নই। আমার রক্ত বইছে তোমার শরীরেও। আমিও এটাই বলতাম। আমরা দু’জনই হয়তো এ লড়াইয়ে মারা যাব। এটা একমাত্র,’ ওপরের দিকে ইঙ্গিত করল বুড়ো, উ-সেন জানে।’ থামল ও। ‘আবার যখন দেখা হবে, তোমাকে আমি খুন করব, ভাতিজা।’

‘এবং আমিও তোমাকে তা-ই করব, আঙ্কেল।’

‘এন জু!’ হাসল বুড়ো। ‘চমৎকার! হয়তো তুমি আমাকে খুন করবে, নয়তো আমি তোমাকে। চমৎকার! একই কথা, ব্যাটা!’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *