কুল এয়ার – এইচ. পি. লাভক্রাফট

কুল এয়ার – এইচ. পি. লাভক্রাফট

কথা শুরু

আপনারা আমাকে জিজ্ঞেস করছেন, দমকা ঠান্ডা বাতাসে আমি ভয় পাই কেন? ঠান্ডা ঘরে ঢুকে আমি অন্যদের চাইতে বেশি কাঁপি কেন? শরৎকালের শীতের ছোঁয়া লাগা দিনের অবসানে যখন সন্ধ্যার হিমেল হাওয়ার পরশ আমার শরীরে লাগে তখন আমার গা গুলিয়ে ওঠে। মনে জেগে ওঠে প্রবল বিতৃষ্ণার ভাব। অনেকে বলে মানুষ দুর্গন্ধে যেমন সাড়া দেয়, আমি ঠিক তেমনি সাড়া দেই শৈত্যের মুখোমুখি হয়ে। এ কথা অস্বীকার করছি না। কোন ভয়ঙ্কর ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আমার এই শৈত্যবিরোধী অদ্ভুত মানসিকতার সৃষ্টি হয়েছিল তা আপনাদের খুলে বলছি। আপনারাই বিচার করবেন আমার এই অদ্ভুত আচরণের সত্যিকারের কোন কারণ আছে কিনা।

যাঁরা কল্পনা করেন যে আতঙ্ক কেবল অন্ধকার নৈঃশব্দ এবং নির্জনতার সঙ্গেই যুক্ত, তাঁরা মহা ভুল করেন। আমি এই আতঙ্কের সন্ধান পেয়েছিলাম এক আলোকদীপ্ত মধ্য অপরাহ্নে-এক জনবহুল নগরীর এক অতি সাধারণ ফ্ল্যাটে। আমি একাও ছিলাম না। সেখানে ছিলেন কল্পনার ছিটেফোঁটা নেই এমন এক গৃহকর্ত্রী এবং দুজন শক্ত সমর্থ পুরুষ।

ব্যাপারটা এবার খুলেই বলি।

১৯২৩ খ্রীস্টাব্দের বসন্তকাল। আমি নিউইয়র্কের এক অখ্যাত মাসিকপত্রে কিছু লিখবার কাজ পেয়েছিলাম। কাজটা খুব লাভজনক নয়। ভাবলাম, যাই হোক, দুটো পয়সা তো পাওয়া যাবে। যে টানাটানি চলছে তাতে যা পাওয়া যায় তাই লাভ।

কিন্তু নিউইয়র্কে আমার থাকার কোন জায়গা নেই। একটা জায়গা খুঁজতে হবে আমাকে। মাসিক পত্রিকা থেকে বেশি টাকা পাওয়া যাবে না। কাজেই আমাকে খুঁজতে হবে একটা সস্তা থাকার জায়গা। বেশি ভাড়া দিতে পারব না। তাই একটা সস্তা বোর্ডিং থেকে অন্য সস্তা বোর্ডিং-এ ঘরের খোঁজ করতে লাগলাম।

এমন একখানা ঘরের খোঁজ করতে লাগলাম আমি, যা বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, যে ঘরে কিছু আসবাবপত্তর রয়েছে এবং যার ভাড়াও বেশ কম। একের পর এক কতগুলি নোংরা,বাজে ঘর দেখলাম আমি। তবে কি এগুলির ভিতর থেকেই একখানা ঘর বেছে নিতে হবে আমাকে?

কিন্তু না, শেষ পর্যন্ত ওয়েস্ট ফোরটিনথ স্ট্রিটে একটি বাড়ির খোঁজ পেলাম। আগে যে বাড়ি দেখেছি সেগুলির চাইতে এটি অনেক ভাল। এ বাড়িতে যদি মাথা গুঁজার একটু ঠাঁই পাওয়া যায় তবে বেশ হয়।

বাড়িটি পাঁচতলা। বাদামি রঙের পাথর দিয়ে তৈরি। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় চল্লিশের দশকের শেষ দিকে তৈরি করা হয়েছিল। ভিতরের কাঠের কাজ এবং মার্বেল পাথরের জাঁকজমক দেখে ধারণা হয়, এই বাড়ি যিনি তৈরি করিয়েছিলেন তিনি ছিলেন সমাজের ওপরতলার বাসিন্দা। তাঁর কেবল আর্থিক সমৃদ্ধিই ছিল না, সুরুচি-বোধও ছিল। বাড়ির ঘরগুলি বড় বড় এবং উঁচু উঁচু। দেওয়ালের কাগজ পুরানো হলেও খুবই দামি। কার্নিশের সুন্দর প্লাস্টারের উপরে চমৎকার অলঙ্করণ তবে সিলিং-এর একদিকে বিশ্রী ভেজা দাগ। বোধহয় ওপরের ঘরে রান্না হয়।

ঘরের মেঝে বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। দরজা আর জানালার পর্দাগুলি পুরানো হলেও তাদের সৌন্দর্য এখনও ম্লান হয়ে যায়নি। স্নানের ঘরে গরম জলের ব্যবস্থা রয়েছে। সে জল হঠাৎ তাপ হারিয়ে ফেলে না। জলের সরবরাহও আচমকা বন্ধ হয় না। বাড়িখানা আমার খুবই পছন্দ হল। আমি একটা ফ্ল্যাট ভাড়া করলাম। ভাড়াটা আমার সীমিত সাধ্যের মধ্যে। এত কম ভাড়ায় ফ্লাট পেয়ে বেশ অবাকই হলাম।

সাপ শীতকালে শীতঘুম দেয়। শীত শেষ হলে আবার জেগে ওঠে আমার শীতঘুম দেবার পক্ষে এটা একটা চমৎকার জায়গা।

এ বাড়ির বর্তমান মালিক এক স্প্যানিশ মহিলা। পুরুষালি চেহারার এই মহিলার মুখে অস্পষ্ট গোঁফের আভাসও রয়েছে। নাম মিসেস হেরেরো। একটু স্থূলকায় এই মহিলা গালগল্প আর পরনিন্দা পরচর্চা করে আমাকে বিরক্ত করতেন না। এমনকি চারতলায় আমার ফ্ল্যাটের বসার ঘরে অনেক রাত পর্যন্ত ইলেকট্রিক লাইট জ্বললেও তা নিয়ে কোন উচ্চবাচ্য করতেন না।

মহিলার সঙ্গে বিভিন্ন ফ্ল্যাটের ভাড়াটের মোটামুটি সদ্ভাবই ছিল।

এ বাড়ির অন্য ভাড়াটেদেরও আমার পছন্দ হয়েছিল। তারা শান্ত, চুপচাপ, গায়ে পড়ে অন্যের সঙ্গে কথা বলতেও আসত না। ওদের বেশির ভাগই স্পেনদেশের মানুষ। এরা সমাজের সব চাইতে নীচু তলার মানুষদের চাইতে একটু উপরের স্তরের মানুষ। সারাদিন কঠিন পরিশ্রম করে এসে এরা এত ক্লান্ত হয়ে পড়ত যে প্রতিবেশীদের সঙ্গে গল্পগুজব করার ইচ্ছে বা ক্ষমতা থাকত না।

এ বাড়ির পরিবেশ আমাকে খুশি করল। এই বিশাল বাড়িখানায় কত লোক রয়েছে, কিন্তু একটুও হৈ হট্টগোল নেই! চারদিক নীরব-নিঝুম। এখানে শব্দ বলতে কেবল রাস্তায় ছুটন্ত গাড়ির শব্দ। সেই শব্দে আমি খুব বিরক্ত হতাম।

অদ্ভুত অভিজ্ঞতা

দেখতে দেখতে সেই বাড়িতে আমার তিনটে সপ্তাহ কেটে গেল। তারপরই ঘটল সেই অদ্ভুত ঘটনাটা।

একদিন রাত আটটার দিকে আমি ঘরের মধ্যে টিপ টিপ করে জল পড়ার শব্দ শুনতে পেলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই অ্যামোনিয়ার উগ্র উৎকট গন্ধে আমার ঘর ভরে গেল। ক্রমে সেই গন্ধ অসহ্য হয়ে উঠল। কোথা থেকে আসছে এই উৎকট গন্ধটা? উপরের দিকে তাকিয়ে দেখি সিলিং-এর সেই ভিজে জায়গা থেকে চুঁইয়ে চুঁইয়ে জল পড়ছে। আর তা থেকেই উগ্ৰ গন্ধটা ছড়িয়ে পড়ছে।

এই উৎকট গন্ধটা এক্ষুণি বন্ধ করা দরকার। এর উৎসটা বন্ধ করতে হবে। পাঁচতলার লোকদের এখনই বলতে হবে তারা যেন নীচের তলার বাসিন্দাদের অসুবিধার সৃষ্টি না করেন।

কিন্তু আমার ঘরের উপরে কে বা কারা থাকেন আমি জানি না। এর আগে জানার জন্য তেমন তাগিদও বোধ করিনি। কিন্তু এবার তো জানতে হয়।

মিসেস হেরেরো থাকেন বেযমেন্ট-এ। বড় বাড়ির মাটির নীচের তলাই হলো বেযমেন্ট। আমি ছুটে তাঁর কাছে গেলাম। আমার অভিযোগ শুনে মিসেস হেরেরো বললেন, ‘হ্যাঁ, ব্যাপারটা এখনই বন্ধ করতে হবে। চিন্তা করবেন না। এক্ষুণি সব ঠিক হয়ে যাবে। এ হল ডক্টর মুনোজ-এর কান্ড।’

‘ডক্টর মুনোজ?’ আমি বললাম।

‘হ্যাঁ, ডক্টর মুনোজ,’ মিসেস হেরেরো চিৎকার করতে করতে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠতে লাগলেন। আমি চললাম তাঁর পিছু পিছু।

‘তিনি কে?’ আমি যেতে যেতে প্রশ্ন করলাম। মিসেস হেরেরো বললেন, ‘উনি একজন ডাক্তার। যত রাজ্যের ওষুধ আর রাসায়নিক পদার্থ নিয়ে দিনরাত মেতে আছেন। বুড়ো ডাক্তার নিজে খুব অসুস্থ। কিন্তু অন্য কোন ডাক্তারের সাহায্য নেবেন না তিনি। নিজের চিকিৎসা তিনি নিজেই করতে চান। ডক্টর মুনোজ-এর অসুখটাও একটু অদ্ভুত ধরনের। দিনের অধিকাংশ সময়েই তিনি অদ্ভুত গন্ধভরা স্নান ঘরে ঢুকে থাকেন, বলেন, জলের সঙ্গে নানা ওষুধ আর রাসায়নিক দ্রব্য মিশিয়ে তিনি নাকি স্নান করেন। তাঁর যে অসুখ তাতে নাকি এরকম স্নান না করলে তাঁর অবস্থা মারাত্মক হয়ে উঠবে। তা উনি নিজের ঘরে যতবার খুশি গন্ধভরা জল দিয়ে স্নান করতে পারেন, সেখানে কেউ বাধা দিতে যাবে না ওঁকে। কিন্তু অন্য ঘরের বাসিন্দাদের বিরক্ত করতে পারেন না উনি। এতবার তীব্র গন্ধের জলে স্নান করেও ডাক্তার মুনোজ নাকি উত্তেজিত এবং উত্তপ্ত হন না। ডাক্তার তাঁর ঘরে পারতপক্ষে কাউকেই ঢুকতে দিতে চান না। তাঁর ঘরের সমস্ত কাজ তিনি নিজেই করেন। তাঁর ছোট ঘরখানা শিশি বোতল আর যন্ত্রপাতিতে ভর্তি। বৃদ্ধ ডাক্তার এখন আর চিকিৎসাও করেন না।

‘কিন্তু একসময় তিনি একজন বিখ্যাত মানুষ ছিলেন,’ মিসেস হেরেরো বলে চললেন, ‘বারসিলোনায় থাকার সময় আমার বাবা ডাক্তার মুনোজের নাম শুনেছিলেন। এই তো একটু আগেই উনি একজন পাইপ-মিস্ত্রির ভাঙা হাত ঠিক মত যথাস্থানে ‘সেট’ করে দিয়েছিলেন। লোকটা হঠাৎ হাতে আঘাত পেয়েছিল। আশ্চর্যের ব্যাপার হল এই যে ডাক্তার মুনোজ কখনও বাড়ির বাইরে যান না। কেবল মাঝে মাঝে বাড়ির ছাদে একটু পায়চারি করেন। আমার ছেলে এসটেবান বাইরে থেকে ওঁর খাবার, পোশাক- পরিচ্ছদ, ওষুধপত্তর আর রাসায়নিক পদার্থগুলি নিয়ে আসে। এই বুড়ো বয়সে ঘরে আটকে থেকে উনি যে কি গবেষণা আর পরীক্ষা নিরীক্ষা করেন তা কে জানে! আজ আবার হয়ত এক নতুন পরীক্ষা শুরু করেছেন।’

বলতে বলতে মিসেস হেরেরো পাঁচতলার একখানা ঘরের দিকে চলে গেলেন। আমিও চারতলায় নিজের ঘরে ফিরে এলাম। জানলাম আমার ঘরের ঠিক উপরেই থাকেন একদা বিখ্যাত ডাক্তার মুনোজ।

সিলিং চুঁইয়ে টিপ টিপ করে জল পড়াটা বন্ধ হল। চলে গেল উৎকট উগ্র গন্ধটা। ঘরের মেঝেটা পরিষ্কার করে খোলা বাতাসের জন্য আমি রাস্তার দিকের জানালাটা খুলে দিলাম। বাইরের ফুরফুরে বাতাস এসে ঢুকল ঘরের মধ্যে। দেহমন স্নিগ্ধ হয়ে গেল।

মাথার উপরে পাঁচতলার ঘরে মিসেস হেরেরোর ভারী পায়ের শব্দ শুনতে পেলাম। ভদ্রমহিলা চেঁচামেচি করে কি যেন বলছেন।

এ বাড়িতে তিন সপ্তাহ থাকার পর এই প্রথম আমি ডাক্তার মুনোজের নাম শুনেছি। পাঁচতলায় কোন মানুষ থাকে বলে আমার জানা ছিল না। ওপর থেকে গ্যাসোলিন চালিত কোন যন্ত্রের মৃদু শব্দ ছাড়া আর কোন শব্দ আমার কানে আসত না। পাঁচতলায় আমার ঘরের উপরে যিনি থাকেন, তাঁর পায়ের আওয়াজ নিশ্চয়ই খুব হালকা।

অবাক হয়ে ভাবতে লাগলাম কি এমন অদ্ভুত রোগ হয়েছে ভদ্রলোকের, যার জন্য তিনি মোটেই বাইরে বেরোতে চান না? কেন তিনি বারো মাস নিজেকে ঘরবন্দী করে রেখেছেন? কেন বাইরের কোন চিকিৎসকের সাহায্য নিতে চান না তিনি। কেন এই একদা বিখ্যাত মানুষটি নিজেকে এমনি করে লুকিয়ে রেখেছেন? একি ভিত্তিহীন, অযৌক্তিক পাগলামি? ভাবলাম অনেক বিখ্যাত ব্যক্তির জীবনেই একটা করুণ এবং বিয়োগান্তক দিক থাকে। ডাক্তার মুনোজের জীবনেও নিশ্চয়ই সেরকম কোন ব্যাপার ঘটেছে। অথবা এও হতে পারে ডাক্তার মুনোজের মতো প্রতিভাধর ব্যক্তির প্রতিভার অপমৃত্যু ঘটেছে কোন কারণে। আর সেজন্যই তিনি নিজেকে নিয়ে গিয়েছেন লোকচক্ষুর অন্তরালে।

অনেক ভেবেও কোন সিদ্ধান্তে আসতে পারলাম না।

ডক্টর মুনোজ

ডক্টর মুনোজের সঙ্গে আমার হয়ত কোনদিনই দেখা হত না, কিন্তু দেখাটা হয়ে গেল ঘটনাচক্রে।

লেখার চাপ পড়েছিল। সকাল থেকে নানান পত্রিকার চাহিদা মেটাবার জন্য একমনে লিখে যাচ্ছিলাম। দুপুরের একটু আগে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লাম। বুকের মধ্যে দারুণ যন্ত্রণা শুরু হল। বুঝলাম আমার হার্ট-অ্যাটাক হয়েছে। এই আক্রমণের ফলে যে ভীষণ বিপদ ঘটতে পারে ডাক্তারেরা সে সম্বন্ধে আমাকে আগেই সতর্ক করে দিয়েছিলেন। নষ্ট করার সময় নেই, এক্ষুণি ডাক্তার দেখাতে হবে আমাকে। কিন্তু বুকে অসহ্য যন্ত্রণা, নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে, এরকম অবস্থায় চারতলা থেকে নিচে নেমে ডাক্তার দেখাব কি করে? নামার বা হাঁটার ক্ষমতাই তো নেই আমার। হঠাৎ মনে পড়ল মিসেস হেরেরোর কথা। তিনি ডক্টর মুনোজের কথা বলেছিলেন। তিনি একটা পাইপ-মিস্ত্রির ভাঙা হাত ঠিকমত ‘সেট’ করে দিয়েছিলেন। এখন প্র্যাকটিস না করলেও এককালে তিনি একজন বিখ্যাত ডাক্তারই ছিলেন। ভাবলাম তাঁর কাছেই যাই না কেন। সিঁড়ি দিয়ে একটুখানি তো উঠতে হবে। এটুকু পারব না? পারতেই হবে আমাকে।

কোনরকমে উঠে দাঁড়ালাম। টলমলে অসুস্থ দেহটাকে টানতে টানতে নিয়ে গেলাম পাঁচতলায় ডক্টর মুনোজের ঘরের সামনে। দুর্বলভাবে দরজায় টোকা দিলাম। ঘরের ভিতর থেকে ইংরেজিতে সাড়া পাওয়া গেল। কণ্ঠস্বরটা অদ্ভুত। বন্ধ দরজার ডান দিকে—একটু দূর থেকে কণ্ঠস্বরটা আসছে। বন্ধ ঘরের বাসিন্দা জানতে চাইলেন, আমি কে-আমার আসার উদ্দেশ্য কি? দুর্বল কণ্ঠে প্রশ্নের উত্তর দিলাম। আমার উত্তরের পর যে দরজাটার সামনে আমি দাঁড়িয়েছিলাম তার পাশের বন্ধ দরজাটা খুলে গেল।

আর সঙ্গে সঙ্গেই হিমেল হাওয়ার একটা অদৃশ্য স্রোত যেন ঝাঁপিয়ে পড়ল আমার উপরে। সেটা ছিল জুন মাসের শেষ দিকের একটি অতি উত্তপ্ত দিন। সেদিন সব চাইতে বেশি গরম পড়েছিল। কিন্তু তা হলে কি হবে। প্রচন্ড শীতে আমার শরীরের হাড় পর্যন্ত কেঁপে উঠল। কোন রকমে চৌকাঠ পেরিয়ে কাঁপতে কাঁপতে ঘরে ঢুকলাম।

ঘরটি বিশাল। ঘরের বাসিন্দা যে ধনী এবং সুরুচিসম্পন্ন, তা ভিতরের মূল্যবান এবং সুন্দর সুন্দর আসবাবপত্র দেখে বোঝা গেল। দেখে অবাক হয়ে গেলাম। আমার ধারণা ছিল যে এই বিশাল বাড়ির বাসিন্দারা সবাই দরিদ্র-বড়জোর নিম্নবিত্তের মানুষ। কিন্তু এ ঘরে তো দেখছি আভিজাত্য, সমৃদ্ধি এবং সুরুচির ছাপ। বাড়িখানার সর্বত্র দারিদ্র্য আর জীর্ণতা। তার মধ্যে যে এমন একখানা সুন্দর এবং সুসজ্জিত ঘর থাকতে পারে কল্পনাই করা যায় না।

ঘরের মধ্যে ভাঁজ করা গদি আঁটা বিছানাটাই দিনের বেলা সোফার কাজ করে। ঘরের মেহগনী কাঠের আসবাবপত্র, দামি পুরু চিত্রিত পর্দা, পুরানো চিত্র, দেওয়ালে দামি দামি বইভরা তাক-এ সব দেখে মনে হয় না যে ঘরখানা কোন বোর্ডিং হাউস-এর বেডরুম, বরং মনে হয় কামরাটি যেন কোন পন্ডিত মানুষের পড়াশোনা করবার জায়গা।

পাশের হলঘর আমার ঘরের ঠিক উপরে। মিসেস হেরেরো এ ঘরখানার কথাও বলেছেন আমাকে। হলঘরে নানা আকারের শিশি-বোতল আর যন্ত্রপাতি। ঘরখানা নিঃসন্দেহে ডক্টর মুনোজের ল্যাবরেটরী। ওখানেই ডক্টর নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা আর গবেষণা করেন। তার পাশে আর একখানা ঘর। সেখানে ডক্টর মুনোজ বিশ্রাম করেন। তারপর একটা বিশাল স্নানের ঘর। ডক্টর মুনোজের বিশ্রাম করবার ঘরের দেওয়ালের মধ্যে তৈরি করা হয়েছে একটা চোর-কুঠরি। সেখানে রয়েছে অস্ত্রোপচারের জন্য প্রয়োজনীয় দামী এবং দুষ্প্রাপ্য সব যন্ত্র। আচ্ছন্ন দৃষ্টিতে আমি এসব দেখলাম। দেখেই বুঝতে পারলাম ডক্টর মুনোজ উচ্চবংশের ধনবান একজন মানুষ।

আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন ডক্টর মুনোজ। খর্বকায়। তবে তাঁর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলি আনুপাতিক। ডক্টরের পোশাকের কাটছাঁট খুবই সুন্দর এবং তা দেহের সঙ্গে সম্পূর্ণ মানানসই। তাঁর আভিজাত্যপূর্ণ মুখে ব্যক্তিত্বের ছাপ। কিন্তু সে মুখে অযথা গর্ব বা ঔদ্ধত্যের প্রকাশ নেই। ডক্টর মুনোজের মুখে লৌহ-ধূসর শ্মশ্রু-গুল্ফ। ঈগলের ঠোঁটের মত বাঁকা নাকের উপরে স্প্রিংযুক্ত এবং ডান্ডিছাড়া ‘পেঁনেই’ চশমা। সেই চশমা ঢেকে রয়েছে দু’টি কালো চোখ। ডক্টর মুনোজের চেহারায় কেল্ট জাতির প্রাধান্য থাকলেও নাকের গড়নে মূর জাতির প্রভাবও অস্বীকার করা যায় না।

সুন্দর করে ছাঁটা চুলের মাঝখান দিয়ে সিঁথি। দেখলে মনে হয় দক্ষ নাপিতের কাঁচির ছোঁয়া পড়েনি ওতে। ডক্টর মুনোজ নিজেই চুল কেটেছেন।

এক কথায় বলা যায়, ডক্টর মুনোজের চেহারার মধ্যে একটা আভিজাত্য, বুদ্ধিমত্তা এবং সুরুচির ছাপ রয়েছে।

এক দমকা হিমেল হাওয়ার অদৃশ্য স্রোতের মধ্যে আমি ডক্টর মুনোজকে দেখতে পেলাম। আমার মনটা বিতৃষ্ণায় ভরে গেল। অবশ্য তাঁর চেহারা বা ভাবভঙ্গীর মধ্যে বিতৃষ্ণার কোন কারণ ছিল না। কেবল ভদ্রলোকের দেহের কৃষ্ণাভ নীলচে রঙ এবং তাঁর হিমশীতল স্পর্শই বোধহয় আমার মানসিক বিতৃষ্ণার মূলে ছিল। কিন্তু ভদ্রলোকের নিজের অসুস্থতার কথা ভেবে আমি হয়ত রঙ আর স্পর্শের ব্যাপারটা অগ্রাহ্য করতে পারতাম, কিন্তু ঐ প্রচন্ড হিমেল হাওয়ার স্রোতই বোধহয় আমার মনটাকে প্রবল বিতৃষ্ণায় আচ্ছন্ন করে ফেলল। এরকম একটি গরম দিনে এমন প্রচন্ড শৈত্য অস্বাভাবিক-অবিশ্বাস্য-অকল্পনীয়। আর অস্বাভাবিক ব্যাপারই মনের মধ্যে জাগিয়ে তোলে বিতৃষ্ণা, অবিশ্বাস এবং আতঙ্ক

কিন্তু চিকিৎসাশাস্ত্রে ডক্টর মুনোজের অসাধারণ নৈপুণ্য দেখে আমার… মনের বিরক্তি আর বিতৃষ্ণার ভাবটা ক্রমেই কেটে যেতে লাগল। তাঁর রক্তহীন কম্পিত হাত দু’খানির স্পর্শ হিম-শীতল হলেও অসাধারণ তৎপরতার সঙ্গে সে হাতজোড়া আমার উপরে কাজ শুরু করল। আমার দিকে মাত্র একবার তাকিয়েই তিনি বুঝতে পারলেন এই মুহূর্তে আমার কোন্ ওষুধের প্রয়োজন। দীর্ঘ দিনের অভিজ্ঞতার ফলেই ডক্টর মুনোজ এই অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন।

ডক্টর মুনোজ আমাকে ওষুধ দিলেন।

অদ্ভুত রকমের শূন্য অথচ সুন্দর, সুরেলা এবং কম্পিত কণ্ঠে তিনি বলতে লাগলেন, ‘মৃত্যুর বিরুদ্ধে আমি তিক্ততম শপথ নিয়েছি। আমি হলাম মৃত্যুর সব চাইতে বড় শত্রু। মৃত্যুর সঙ্গে সংগ্রাম করবার জন্য আমি আমার সমস্ত সম্পদ ব্যয় করেছি-নানা রকমের অদ্ভুত এবং অবিশ্বাস্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছি। আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব আমাকে ত্যাগ করেছে। আজ আমি একা—আমি নিঃসঙ্গ-আমি ক্লান্ত-অবসন্ন। আজও আমি মৃত্যুর বিরুদ্ধে একক সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছি। আমার লক্ষ্য মৃত্যুর সমূলে উৎখাত।’

ডক্টর মুনোজের মধ্যে বোধ হয় একটি পরোপকারেচ্ছু অনুরক্ত ব্যক্তি রয়েছে। এই অনুরাগটা হ’ল নিজের চিকিৎসাবিদ্যা এবং গবেষণার প্রতি। আমার বুক পরীক্ষা করতে করতে তিনি ক্রমাগত কথা বলতে লাগলেন। পাশের ল্যাবরেটরী থেকে আমার জন্য ওষুধ এনে একটা মিক্সচার তৈরি করার সময়েও তাঁর কথা বলা থামল না। মনে হয় এই বাড়ির পরিবেশে তিনি আমার মত একজন সদবংশের শিক্ষিত মানুষকে পাবার আশা করেননি। তাই আমাকে পেয়ে তাঁর মনে এতদিন ধরে যে কথাগুলি জমে ছিল তা বাক্যস্রোতের আকারে বেরিয়ে আসতে লাগল। অতীতের সুখের দিনের যে সব সুন্দর সুন্দর স্মৃতি তাঁর মনের মধ্যে জেগে উঠতে লাগল, তা তিনি আমার কাছে অকপটে বলতে লাগলেন।

ডক্টর মুনোজের কণ্ঠস্বর অদ্ভুত হলেও অন্ততপক্ষে তা সান্তনাদায়ক। সেই স্বরই যেন যন্ত্রণার অনেকখানি উপশম করে দেয়। তাঁর মুখ থেকে অনর্গল কথা বেরিয়ে আসছে ঠিকই, কিন্তু তিনি কখন শ্বাস নিচ্ছেন আর কখন নিঃশ্বাস ছাড়ছেন তা বুঝতে পারলাম না। আমি অসুস্থ। সেই অসুস্থতা থেকে আমার মনটাকে সরিয়ে নেবার জন্যই বোধ হয় ডক্টর মুনোজ তাঁর মতবাদ আর পরীক্ষা নিরীক্ষার কথা অনর্গল বলে যেতে লাগলেন। আমার দুর্বল হৃৎপিন্ড নিয়ে আমাকে সান্তনা দিতে লাগলেন। বেশ মনে আছে যে, অত্যন্ত বিচক্ষণতা এবং কৌশলের সঙ্গেই তিনি কম্পিত কণ্ঠে সান্ত্বনার বাক্যগুলি উচ্চারণ করছিলেন। ডক্টর মুনোজ বলছিলেন, ‘ইচ্ছাশক্তি এবং চেতনা জৈব জীবন থেকে অনেক বেশী শক্তিশালী। সুতরাং কোন স্বাস্থ্যবান এবং শক্তিশালী মানুষের দেহকে যদি সতর্ক এবং বিজ্ঞানসম্মতভাবে সংরক্ষণ করা যায় তবে সেই দেহ বর্ধিত ইচ্ছাশক্তি এবং বর্ধিত চেতনার বলে এক ধরণের সস্নায়বিক জীবনীশক্তি বজায় রাখতে পারবে। হ্যাঁ, দেহের সাংঘাতিক ক্ষয়ক্ষতি, ত্রুটি এমনকি গুরুত্বপূর্ণ কোন অঙ্গের অনুপস্থিতি সত্ত্বেও প্রচন্ড ইচ্ছাশক্তি আর পরিবর্তিত চেতনার বলে সেই দেহ আশ্চর্যজনকভাবেই বেঁচে থাকতে পারে।

‘সেই অদ্ভুতভাবে বেঁচে থাকা দেহ স্বাভাবিক মানুষের মত সব কাজকর্ম করতে পারবে না। অনেক ক্ষেত্রেই তার ক্ষমতা সীমিত হয়ে পড়বে। কিন্তু স্লোগান করবে, খাবে, ঘুমোবে। সে পড়াশোনা করতে পারবে, কিছু কাজকর্মও করতে পারবে। কিন্তু আগেই বলেছি তার অনেক ব্যাপারেই সীমাবদ্ধতা থাকবে। তা যাতে না থাকে— সে যাতে স্বাভাবিক মানুষের মতই সমস্ত কাজকর্ম করতে পারে, সেজন্যই আমি গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছি। এই দুরূহ গবেষণার জন্যই আমার এই স্বেচ্ছানিবার্সন।’

তারপর সুর পাল্টে কিছুটা পরিহাস-তরল কণ্ঠে তিনি বললেন, ‘একদিন হয়ত আমি আপনাকে হৃৎপিন্ড ছাড়াই বেঁচে থাকবার কৌশল শিখিয়ে দিতে পারব। অন্ততঃপক্ষে পরিবর্ধিত চেতনা নিয়ে নিজের অস্তিত্ব বজায় রাখবার উপায়টা তো নিশ্চয়ই শেখাতে পারব। তা হলে হৃৎপিন্ড নিয়ে আপনি আর কোন ঝামেলায় পড়বেন না।’

‘কিন্তু আমার গবেষণায় তো বাধা পড়ে যাচ্ছে। আমি নিজেই তো অসুস্থ হয়ে পড়েছি। আমার রোগটাও খুব জটিল। এই রোগ আমার মনকেও আক্রমণ করেছে। মানসিক দিক থেকে আমি বিভ্রান্ত হয়ে পড়ছি। কোন দিকেই আর গভীরভাবে মনঃসংযোগ করতে পারি না আমি। অথচ আমার যে গবেষণা তাতে দরকার গভীর মনঃসংযোগ।’

‘এই অদ্ভুত রোগের জন্যই আমাকে দিন-রাত হিমশীতল পরিবেশের মধ্যে বাস করতে হয়। উত্তাপ যদি বেড়ে যায় আর সেই বর্ধিত তাপমাত্রা যদি কিছুক্ষণ থাকে, তবে তা আমার পক্ষে মারাত্মক হয়ে ওঠে। সেজন্যই আমি নিজের বাসস্থানের তাপমাত্রা পঞ্চান্ন অথবা ছাপ্পান্ন ডিগ্রী ফারেন হাইটের মধ্যে রাখতে চাই। এই হিমশীতল পরিবেশে থাকতেই আমি অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি। শৈত্য আমার কাছে নিষ্ঠুর দৈত্য নয়- শৈত্য হল আমার কাছে মিত্র।’

‘ঘরের মধ্যে হিমশীতল পরিবেশ বজায় রাখবার জন্য আমার ফ্ল্যাটে সব সময়েই একটা গ্যাসোলিন ইঞ্জিন চালু থাকে। এই ইঞ্জিনের পাম্প-এর সাহায্যে শীতল অ্যামোনিয়া উষ্ণতাকে শোষণ করে। এর ফলে আমার পরিবেশের শীতল তাপমাত্রা বজায় থাকে। এজন্যই আমার ঘর সব সময়েই হিমশীতল। আপনি যাতে অবাক হয়ে অদ্ভুত কিছু ভেবে না বসেন সেজন্যই একথাটা বললাম।’

ডক্টর মুনোজ থামলেন। চশমার কাঁচের ওপাশ থেকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন আমার দিকে। কেমন যেন একটু অস্বস্তিই বোধ করলাম।

পরিচ্ছদ বাড়ল

খুব অল্প সময়ের মধ্যেই আমি সুস্থ হয়ে উঠলাম। ডক্টর মুনোজকে ধন্যবাদ জানিয়ে আমি তাঁর পাঁচতলার হিমশীতল ঘর থেকে কাঁপতে কাঁপতে বেরিয়ে

এলাম।

সেই থেকে আমি ডক্টর মুনোজের একান্ত অনুগত ভক্ত হয়ে উঠলাম।

এরপর থেকে আমি প্রায়ই ডক্টর মুনোজের সঙ্গে দেখা করতে যেতাম। অবশ্য প্রত্যেকবারই গরম ওভার কোট পরে যেতাম। ডক্টর মুনোজ আমার কাছে তাঁর গোপন গবেষণার বিষয়গুলির কথা বলতেন। বলতেন সেই সব গবেষণার ভয়ঙ্কর ফলাফলের কথা।

ডক্টর মুনোজের বই-এর সেলফগুলিও আমি দেখতাম। সেলফে অনেক মোটামোটা ভল্যুম সাজানো ছিল। বইগুলো খুবই পুরানো। সত্যি বলতে কিছু বই দেখে আমি আঁতকেই উঠতাম। ভয়ে আমার শরীরে কাঁপুনি শুরু হ’ত।

ডক্টর মুনোজের সুচিকিৎসায় আমি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠলাম। আমার সেই গুরুতর হৃদরোগ আর রইল না। ডক্টর মুনোজের সঙ্গে আলোচনা করে আমার মনে হ’ল যে তিনি মধ্যযুগের পন্ডিতদের যাদুমন্ত্র এবং অলৌকিক সংষ্কারগুলো মোটেই উপহাস বা ঘৃণা করেন না। বরং সেগুলোর প্রতি তাঁর এক অদ্ভুত ধরণের শ্রদ্ধা রয়েছে। কেননা তিনি মনে করেন, মধ্যযুগের এসব রহস্যময় গুপ্ত সূত্রের মধ্যে অনেক বিরল মনস্তাত্ত্বিক উদ্দীপক শক্তি রয়েছে। এই উদ্দীপক শক্তি স্নায়ুতন্ত্রের উপর অদ্ভুত প্রভাব বিস্তার করতে পারে। যে স্নায়ুতন্ত্র থেকে জৈব স্পন্দন পলায়ন করেছে তার উপরও এই উদ্দীপক শক্তির আশ্চর্য প্রভাব দেখা যাবে।

গবেষক ডক্টরের এসব কথার কিছুটা বুঝতে পারলেও বেশীরভাগটাই বুঝতে পারতাম না। কি করে বুঝব? আমি তো বিজ্ঞানে অজ্ঞান। তবুও আমি ডক্টর মুনোজের এমন অন্ধ ভক্ত হয়ে পড়েছিলাম যে, বুঝি বা না বুঝি তাঁর কথাগুলি আমার ভাল লাগত।

একদিন ডক্টর মুনোজ বললেন, ‘আমি যে অদ্ভুত রোগে ভুগছি তার শুরু দীর্ঘ আঠারো বছর আগে। ভ্যালোন্সিয়ায় প্রবীণ গবেষক ডক্টর টোরেস- এর সঙ্গে আমি আমার গবেষণা আরম্ভ করেছিলাম।

আমরা মৃত্যুকে পরাভূত করবার জন্য নিরলস গবেষণা শুরু করলাম। কিন্তু কাজের চাপে আমি অসুস্থ হয়ে পড়লাম। ডক্টর টোরেসই আমার চিকিৎসা এবং সেবা-শুশ্রূষা করতে লাগলেন। প্রবীণ গবেষক ডক্টর টোরেস আমারপ্রাণ বাঁচালেন বটে, কিন্তু তিনি নিজে রক্ষা পেলেন না। যার বিরুদ্ধে আমরা সংগ্রাম করছিলাম সেই মৃত্যুই তাকে ছিনিয়ে নিয়ে গেল আমার কাছ থেকে।’

একটু থামলেন ডক্টর মুনোজ, তারপর ফিস্ ফিস্ করে গোপন কথা বলার ঢঙে বললেন, ‘আমাকে সারিয়ে তুলবার পদ্ধতিটি ছিল অসাধারণ। তার মধ্যে এমন অনেক ব্যাপার ছিল যা কিনা বয়স্ক এবং রক্ষণশীল বৈজ্ঞানিক গ্যালেন্স-এর কাছে মোটেই সমর্থনযোগ্য ছিল না।

দেখতে দেখতে কয়েক সপ্তাহ কেটে গেল। দুঃখের সঙ্গে লক্ষ্য করলাম ডক্টর মুনোজ ক্রমেই দুর্বল এবং শক্তিহীন হয়ে পড়ছেন। মিসেস হেরেরোও এরকম একটা ইঙ্গিতই করেছিলেন। ডক্টরের মুখের নীলাভ কালচে রঙটা ক্রমেই গাঢ় থেকে গাঢ়তর হয়ে উঠছে। তাঁর কণ্ঠস্বরও ফাঁপা এবং অস্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে ক্রমে ক্রমে। ডক্টর মুনোজ-এর দেহের পেশীগুলিও হারিয়ে ফেলছিল গতি এবং কার্যকরী ক্ষমতা। পেশীগুলির মধ্যে নিখুঁত সমন্বয় ও আর নেই। ডক্টরের মন আর ইচ্ছাও যেন স্বাভাবিক অবস্থায় না থেকে ক্রমেই স্থিতিস্থাপকতা হারিয়ে ফেলছে।

এই দুঃখজনক পরিবর্তন ডক্টর মুনোজ-এর অজানা নয়। তিনি এ সম্পর্কে সম্পূর্ণ সচেতন। ধীরে ধীরে তাঁর ভাবভঙ্গী আর কথাবার্তাও ভয়ানক শেস্নষাত্মক হয়ে উঠতে লাগল। ডক্টর মুনোজ সম্পর্কে আমার মনে প্রথম দিকে যে সূক্ষ্ম বিকর্ষণ ছিল, তা আবার ধীরে ধীরে ফিরে আসতে লাগল।

অদ্ভুত অদ্ভুত খেয়াল পেয়ে বসল ডক্টর মুনোজকে। বিদেশী সুগন্ধী মশলার দিকে তাঁর আকর্ষণ বাড়তে লাগল। বিশেষ করে বাড়ল মিশরের সুরভিত ধূপ-ধুনোর প্রতি আকর্ষণ। তাঁর ঘরে ঢুকলেই মনে হত যেন কোন ফারাও-এর শীতল সমাধি-কক্ষে ঢুকে পড়েছি আমি।

এ সময় ডক্টর মুনোজ-এর ঠান্ডা বাতাসের চাহিদা বেড়ে গেল। আমার সাহায্য নিয়ে তিনি তাঁর ঘরে অ্যামোনিয়া পাইপ ব্যবস্থার সম্প্রসারণ এবং বিবর্ধন ঘটালেন। পাম্প এবং রেফ্রিজারেটিং মেশিন-এর ক্ষেত্রেও ঈষৎ পরিবর্তন করা হ’ল। ঘরের তাপমাত্রা যাতে চৌত্রিশ অথবা চল্লিশ ডিগ্রীর বেশী না হয় তার জন্যই পাম্প আর মেশিন-এর ক্ষেত্রে রদবদল করা হ’ল। অ্যামানিয়ার শোষকতায় ঘরে শৈত্য বাড়াত বাড়াতে একসময় তাপমাত্রা আঠাশ ডিগ্রীতে নামিয়ে আনবার ব্যবস্থাও করা হ’ল।

সংলগ্ন বাথরুম এবং ল্যাবরেটরী অবশ্য এতটা তাপহীন করা হ’ল না। প্রচন্ড ঠান্ডায় বাথরুম-এর জল যাতে জমে না যায় সেদিকে লক্ষ্য রাখা হ’ল। রাসায়নিক প্রক্রিয়াগুলি যাতে কোনক্রমেই ব্যাহত না হয়, সেদিকেও ডক্টর মুনোজ দৃষ্টি রেখেছিলেন। ঘরের হিমেল হাওয়ার স্রোত যাতে কোনমতেই সংলগ্ন বাথরুম এবং ল্যাবরেটরীতে ঢুকতে না পারে তার জন্য সব রকম সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হ’ল।

কিন্তু ঝামেলা এল অন্যদিক থেকে। পাশের ভাড়াটেরা অভিযোগ করতে লাগল, ডক্টর মুনোজের ঘর থেকে প্রায়ই প্রচন্ড হাওয়ার স্রোত এসে আছড়ে পড়ে তাদের উপরে। শরৎকালে এরকম ঠান্ডা হাওয়ার কথা কল্পনাও করা যায় না! ডক্টর মুনোজ কী এমন গবেষণা করছেন? তাঁর অদ্ভুত অদ্ভুত গবেষণার জন্য বাড়ির অন্য ভাড়াটেদের অসুবিধায় পড়তে হবে কেন?

ভাড়াটেদের অভিযোগে মিসেস হেরেরো বিব্রত হয়ে পড়লেন। তিনি ডক্টর মুনোজের কানে কথাটা তুললেন। ডক্টরের নির্দেশে আমি তাঁর ঘরের দরজায়, জানালায় ভারী ভারী পর্দা টাঙিয়ে দিলাম।

ঔচিত্যের সীমাবহির্ভূত এ মহা আতঙ্ক যেন আশ্রয় নিয়েছে ডক্টর মুনোজের দেহে। এই আতঙ্ক খুবই অস্বাস্থ্যকর। বিশেষ করে ডক্টরের মত দুর্বল স্বাস্থ্যের লোকের পক্ষে তো বটেই।

ডক্টর মুনোজ এখন দেখা হলেই মৃত্যুর কথা অবিরাম বলতে থাকেন। সমাহিত করা বা অন্ত্যোষ্টিক্রিয়া সংক্রান্ত কোন আলোচনা শুরু হলে তিনি অদ্ভুতভাবে হাসতে থাকেন। সে হাসিতে কোন প্রাণ নেই।

ক্রমেই ডক্টর মুনোজ অস্থির, উত্তেজিত এমনকি ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে লাগলেন। কিন্তু তিনি আমাকে কঠিন ব্যাধি থেকে মুক্তি দিয়েছেন। তাই ডক্টরের অবস্থা যে রকমই হোক না কেন, কৃতজ্ঞতা-বশে আমি তাঁকে পরিত্যাগ করতে পারলাম না। কতগুলি অপরিচিত ভাড়াটের করুণার উপরে তাঁকে ছেড়ে দিতে আমার বিবেকে বাঁধল। আমি ডক্টর মুনোজ-এর ঘর ঝাঁট দিয়ে ধুলোবালি পরিষ্কার করতাম, তাঁর প্রয়োজনীয় কাজগুলো করে দিতাম, ফাইফরমাস খাটতাম।

একটা পুরু অলেস্টার গায়ে দিয়ে আমি ডক্টর মুনোজের ঘরে ঢুকতাম। তাঁর ঘরে ঢুকবার জন্যই আমি অনেক খুঁজে এই অলেস্টার-টা কিনেছিলাম। ডক্টরের দোকান থেকে কেনাকাটার কাজও আমিই করতাম। ডক্টর মুনোজ তাঁর গবেষণার জন্য যে সব রাসায়নিক দ্রব্য চাইতেন অনেক খুঁজে পেতে আমি তা জোগাড় করতাম। মাঝে মাঝে তিনি এমন সব অদ্ভুত জিনিস চাইতেন যা আমি কোন জায়গা থেকেই সংগ্রহ করতে পারতাম না।

ডক্টর মুনোজের বাসস্থান যেন ক্রমেই আরো… আরো আতঙ্কঘন হয়ে উঠতে লাগল। কেন এই আতঙ্কের আবহাওয়া? আমি তার কোন ব্যাখ্যা দিতে পারব না। সমস্ত বাড়িটাতেই সব সময় কেমন ভ্যাপসা গন্ধ। ডক্টর মুনোজের ঘরের মধ্যে এ গন্ধ ছিল আরও তীব্র-আরও মারাত্মক। সুরভিত মশলা এবং ধূপধুনোর গন্ধও সেই ভ্যাপসা গন্ধটাকে ঢেকে রাখতে পারত না। বরং দু’রকম গন্ধ এবং রাসায়নিক দ্রব্যের ঝাঁজ মিশে গিয়ে আরেক অদ্ভুত গন্ধের অদৃশ্য স্রোত যেন বইত ডক্টর মুনোজের ঘরে।

পর্দা-টানা ঘরে ম্লান আলোয় বিছানায় শুয়ে ডক্টর বোধ হয় সেই বিচিত্ৰ গন্ধ উপভোগ করতেন।

ডক্টর মুনোজ বার বার স্নান করতে লাগলেন। এ ব্যাপারে অবশ্য তিনি আমার সাহায্য নিতেন না। ভাবতাম বিচিত্র অসুখের জন্যই বোধ হয় তাঁকে বার বার স্নান করতে হচ্ছে। তার অদ্ভুত অসুখটা কি? কেন এই অসুখের কথা কাউকে জানাচ্ছেন না তিনি? নিজের মনকে এই সব প্রশ্ন করতাম আমি। কিন্তু কোন জবাব পেতাম না। প্রশ্ন করে এক অজানা আতঙ্কে আমি কেঁপে উঠতাম।

ডক্টর মুনোজকে দেখলেই মিসেস হেরেরো বুকে ক্রশ আঁকতেন। তিনি ডক্টরকে আমার উপরেই ছেড়ে দিয়েছিলেন। এমন কি তিনি তাঁর ছেলে এসটেবানকে দিয়ে ডক্টর মুনোজ যেসব কাজ করাতেন, তাও বন্ধ করে দিলেন। মায়ের কথায় এসটেবান আর ডক্টর মুনোজের ঘরে ঢোকে না। ফলে ডক্টরকে নিয়ে আমি খুবই মুশকিলে পড়ে গেলাম। শেষে একদিন বললাম, ‘ডক্টর, আপনি খুব অসুস্থ, সত্যি বলতে কি আপনার অসুস্থতা দিন দিন বেড়েই চলেছে। আপনি অনুমতি দিলে আপনার চিকিৎসার জন্য একজন অভিজ্ঞ ডাক্তার নিয়ে আসতে পারি।’

আমার কথা শুনে ডক্টর মুনোজ খুব রেগে গেলেন। ক্রোধ তাঁর রোগ- দুর্বল দেহের জন্য মারাত্মক হয়ে উঠতে পারে ভেবে আমি খুব ভয় পেয়ে গেলাম। তাই আর কথা বাড়ালাম না। ডক্টরের ভাব দেখে মনে হ’ল কোন ডাক্তারের উপরেই যেন তাঁর কোন আস্থা নেই। অন্য ডাক্তারদের যেন তিনি গ্রাহ্যই করতে চান না।

খাওয়ার ভান করাটা ছিল ডক্টর মুনোজের কাছে একটা আনুষ্ঠানিক ব্যাপার মাত্র। বিশেষ কিছুই খেতেন না তিনি। ক্রমে এই স্বল্প আহারটুকুও বন্ধ করে দিলেন। কেবল মাত্র মানসিক শক্তিই বুঝি তাঁকে টিকিয়ে রাখল।

এ সময় আর একটা অদ্ভুত অভ্যাস পেয়ে বসল ডক্টর মুনোজকে। তিনি লম্বা লম্বা কাগজে দলিলের মত কি সব যেন লিখে রাখতে শুরু করলেন। লেখা শেষ হলে এক একখানা দলিল এক একটা খামের মধ্যে ভরে খামগুলি আঠা দিয়ে আটকে দিতেন। তারপর খামগুলিকে সিল করে সেগুলো তিনি ড্রয়ার-এর মধ্যে রাখতেন। ডক্টর মুনোজ আমাকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, তাঁর মৃত্যুর পর আমি যেন দলিলগুলি বিশেষ কয়েকজনের কাছে পাঠাই। কোন্ দলিল কাকে পাঠাতে হবে তা-ও তিনি খামের উপরেই লিখে রাখতেন।

যাঁদের কাছে খামগুলো পাঠাতে হবে তাঁদের মধ্যে অধিকাংশ‍ই পূর্বভারতীয় দ্বীপপুঞ্জের শিক্ষিত অধিবাসী। একখানা খামের উপরে একজন বিখ্যাত ফরাসী চিকিৎসকের নাম ছিল। অনেকেরই ধারণা সেই চিকিৎসক আর ইহজগতে নেই। তাঁর সম্পর্কে নানা রকম অবিশ্বাস্য এবং অকল্পনীয় কানাঘুষো একসময় শোনা যেত। খামগুলো আমি খুলি নি। সেগুলো আমি না পাঠিয়ে পুড়িয়ে ফেলেছিলাম।

ডক্টর মুনোজের চেহারা, আচার-আচরণ এবং কণ্ঠস্বর ক্রমেই আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে লাগল। তাঁর উপস্থিতি পর্যন্ত অসহ্য হয়ে উঠল আমার কাছে। সেপ্টেম্বর মাসে একজন লোক ডক্টরের ডেস্ক ল্যাম্প-টা মেরামত করতে এসেছিল, ডক্টর মুনোজকে এক ঝলক দেখেই সে মৃগী রোগীর মত হাত-পা ছুঁড়তে ছুঁড়তে অজ্ঞান হয়ে গেল। লোকটার জন্য প্রেসক্রিপসন লিখে দিলেও ডক্টর মুনোজ কিন্তু তার দৃষ্টির আড়ালেই নিজেকে লুকিয়ে রাখলেন। জ্ঞান ফিরে আসবার পর লোকটা ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে তার মেরামতির কাজটা শেষ করল। লোকটা বিশ্বযুদ্ধের আতঙ্কের দিনগুলিতেও কোন দিন এতটা ভয় পায় নি। কাজ শেষ করে সে টলোমলো পায়ে বেরিয়ে এল ডক্টর মুনোজের হিমশীতল কক্ষ থেকে।

মহা আতঙ্কের দিন

অক্টোবরের মাঝামাঝি এল সেই আতঙ্কঘন দিনটি। এল হঠাৎ। এমন হঠাৎ এল যে আমরা হতবুদ্ধি হয়ে গেলাম—বিমূঢ় হয়ে পড়লাম। একদিন রাত এগারটার দিকে রেফ্রিজারেটিং মেশিন-এর পাম্পটা বিকল হয়ে গেল। ফলে তিন ঘণ্টার মধ্যেই অ্যামোনিয়া ঠান্ডা করবার কাজটা অসম্ভব হয়ে উঠল 1 ডক্টর মুনোজ মেঝের উপরে দ্রুত পা ঠুকে আমাকে উপরে যাবার নির্দেশ দিলেন। আমি ছুটে গেলাম তাঁর ঘরে।

বিকল যন্ত্রটাকে মেরামত করবার জন্য আমি প্রাণপণে চেষ্টা করতে লাগলাম। ডক্টর মুনোজ নিষ্প্রাণ শূন্যকণ্ঠে অভিশাপের পর অভিশাপ বর্ষণ করে চললেন। তাঁর সেই ঘর্ঘরে কণ্ঠস্বর ভাষায় বর্ণনা করা যায় না কিন্তু আমার অদক্ষ হাতের সমস্ত প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হল, ডক্টর মুনোজের অভিশাপের বর্ষণ আরও বেড়ে গেল।

আমি ছুটলাম একটা গ্যারেজ-এর দিকে। গ্যারেজ-টা সারারাত খোলা থাকে। সেখান থেকে একজন মেকানিক-নিয়ে এলাম, সে পাম্পটাকে পরীক্ষা করে বলল, ‘সকালের আগে কিছু করা সম্ভব নয়, সকালে একটা পিস্টন পেলে মেরামতির কাজ করা যাবে।‘

এ কথা শুনে ডক্টর মুনোজ যেন একেবারে উন্মাদ হয়ে গেলেন। ক্রোধে আতঙ্কে তাঁর মুমূর্ষ দেহটা যেন ভেঙেচুরে যাবার উপক্রম হ’ল। হঠাৎ প্রচন্ড আক্ষেপ দেখা দিল ডক্টরের দেহে। দু’হাতে চোখ চেপে ধরে তিনি ছুটলেন বাথরুমে। একটু পরে টলমল পায়ে হাতড়াতে হাতড়াতে ঘরে ফিরে এলেন। দেখলাম ডক্টর মুনোজের মুখে শক্ত করে ব্যান্ডেজ বাঁধা। তাঁর চোখদু’টি আমি আর কখনও দেখতে পাই নি।

ঘরের ভিতরের হিমশীতল হাওয়া প্রায় নষ্ট হয়ে গিয়েছে। আবহাওয়া ক্রমেই গরম হয়ে উঠছে। ডক্টর মুনোজ আর সহ্য করতে পারছেন না এই ক্রমবর্ধমান উষ্ণতা। ভোর পাঁচটা নাগাদ ঘরের উত্তাপ সহ্য করতে না পেরে তিনি বাথরুমে ঢুকলেন। আমাকে নির্দেশ দিলেন আমি যেন সারারাত খোলা থাকে এমন ক্যাফেটেরিয়া আর ওষুধের দোকান থেকে যতটা সম্ভব বরফ সংগ্রহ করে তাঁকে দিয়ে আসি।

আবার ছুটলাম। অনেকটা বরফ সংগ্রহ করে রাখলাম বাথরুমের বন্ধ দরজার সামনে। ভিতর থেকে হুকুম এল, ‘আরও… আরও বরফ নিয়ে আসুন আমার জন্য।’

আবার ছুটতে হ’ল আমাকে। আবার বরফ এনে রাখলাম বন্ধ বাথরুমের সামনে।

বাথরুমের ভিতরে জল ছিটাবার শব্দ শুনতে পেলাম। বন্ধ দরজার ওপাশ থেকে ডক্টর মুনোজের ক্ষীণ কর্কশ কণ্ঠস্বর ভেসে এল, ‘আমি আর সহ্য করতে পারছি না… আরও আরও বরফ চাই আমার… সব… বরফ চাই!’

আমার ছোটাছুটি আর থামল না। শেষ পর্যন্ত দিনের আলো ফুটল। দোকানগুলিও এক এক করে খুলল। আমি এসটেবানের কাছে সাহায্য চাইলাম। বললাম, ‘তুমি হয় বরফ নয়তো একটা পিস্টন যোগাড় করবার ব্যবস্থা করো। তুমি একটার দায়িত্ব নিলে আমি অন্যটার দায়িত্ব নিতে পারি।’ কিন্তু মায়ের নিষেধে এসটেবান কোন কাজ করতেই রাজী হ’ল না।

শেষ পর্যন্ত আমি একটা ভবঘুরে লোককে কিছু পারিশ্রমিক দিয়ে কাজে লাগলাম। এ লোকটির দেখা পাই এইট্‌থ এভিনিউর কোণে। বরফের দোকানির সঙ্গে তাকে পরিচয় করিয়ে দিলাম। ঠিক হ’ল সে এই বরফের দোকান থেকে বার বার বরফ নিয়ে গিয়ে তা ডক্টর মুনোজের বাথরুমের সামনে রাখবে। তাকে এই দায়িত্ব দিয়ে আমি ছুটলাম একটা পিস্টন আর একজন দক্ষ মেকানিকের খোঁজে।

কাজের যেন আর শেষ নেই। যতই সময় কেটে যেতে লাগল ততই আমি ডক্টর মুনোজের মতই রেগে যেতে লাগলাম। সময় যেন আমার মুঠোর ভিতর থেকে উড়ে বেরিয়ে যেতে লাগল। সকাল থেকে আমার পেটে কিছু পড়ে নি, তার উপরে আবার পিস্টন আর মেকানিক যোগাড় করবার জন্য এত ছোটাছুটি। কখনও আমাকে টেলিফোন করতে হচ্ছে, কখনও বা ভূগর্ভস্থ পথে বা ভূ-পৃষ্ঠের পথে যেতে হচ্ছে শহরের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। ছোটাছুটি করতে করতে আমার হাঁপ ধরে গেল। সঙ্গে সঙ্গে মাথা গরম হয়ে মেজাজটা আরও চড়া হয়ে উঠল।

শেষ পর্যন্ত পিস্টন জোগাড় হ’ল। দু’জন মেকানিকও পেয়ে গেলাম। বেলা দেড়টার সময় পিস্টন আর মেকানিক দুজনকে নিয়ে আমাদের বাড়িতে এলাম। আমার পক্ষে ডক্টর মুনোজকে যতটা সাহায্য করা সম্ভব তা আমি করেছি। আমার দিক থেকে কাজে কোন গাফিলতি হয় নি বলেই আমার বিশ্বাস। আশা করি সময়মতই এসে পড়েছি।

আমি বাড়ি পৌছলাম। কিন্তু আমার আগেই আতঙ্কের কালো মেঘ সেখানে পৌঁছে গিয়েছিল।

ফ্ল্যাট বাড়ির ভিতরে তখন খুব হৈচৈ চলছে। আতঙ্কিত কণ্ঠস্বর ছাপিয়ে উঠছিল প্রার্থনার গুরুগম্ভীর সুর। এক অশুভ, আতঙ্ককর দানবীয় প্রভাব যেন আচ্ছন্ন করে ফেলেছে বাড়ির পরিবেশ। বাড়ির বাসিন্দাদের মধ্যে কেউ কেউ তো মালা জপ করতেই শুরু করেছে।

ভাড়াটেরা চেঁচামেচি করছে। ডক্টর মুনোজের বন্ধ ঘরের ভিতর থেকে একটা উৎকট দুর্গন্ধ বেরিয়ে সমস্ত বাড়ির আবহাওয়াটাকেই বিষাক্ত করে তুলেছে। যে ভবঘুরে লোকটাকে আমি কাজে লাগিয়েছিলাম, শুনলাম, সে লোকটা নাকি দ্বিতীয়বার বরফ রেখেই চিৎকার করে ছুটে পালিয়ে গিয়েছিল—আর ফিরে আসে নি।

মনে হয় কৌতূহলী হয়ে সে দরজার ফাঁক দিয়ে ভিতরে উঁকি দিয়েছিল। আর এই অতিরিক্ত কৌতূহলের ফলেই লোকটা কিছু দেখে ভয় পেয়ে পালিয়ে গিয়েছিল। সে দরজা বন্ধ করে যায় নি। কিন্তু এখন দরজাটা ভিতর থেকে বন্ধ। ভিতর থেকে ধীরে ধীরে ফোঁটায় ফোঁটায় জল পড়বার শব্দ ছাড়া অন্য কোন শব্দ আসছিল না।

প্রচন্ড ভয় আমার মন আচ্ছন্ন করে ফেলল। কিন্তু তা সত্ত্বেও মিসেস হেরেরো আর মেকানিক দু’জনের সঙ্গে পরামর্শ করে আমি বললাম, ‘এখন দরজাটা ভেঙে ফেলা ছাড়া আর তো কোন উপায় দেখতে পাচ্ছি না।’

মিসেস হেরেরো বললেন, ‘দাঁড়ান, ভাঙবার আগে অন্যভাবে একবার চেষ্টা করে দেখি দরজাটা খোলা যায় কিনা। ‘

মিসেস হেরেরোর চেষ্টা সফল হ’ল। তিনি তারের সাহায্যে অনেক কসরৎ করে শেষ পর্যন্ত দরজার তালা বাইরে থেকে খুলে ফেললেন। আমি, মিসেস হেরোরো আর দু’জন মেকানিক ডক্টর মুনোজের ফ্ল্যাটে ঢুকলাম।

কিন্তু ঢুকেই আমাদের নাকে রুমাল চাপা দিতে হ’ল। একটা উৎকট দুর্গন্ধে সমস্ত ঘরটা ভরে গিয়েছে।

ঘরের সমস্ত জানালা খুলে দিলাম। রোদ এসে ঢুকল ঘরে। নাকে রুমাল চাপা দিয়ে দুরু দুরু বুকে এগোলাম দক্ষিণের ঘরগুলোর দিকে। ওদিকেই রয়েছে ডক্টর মুনোজের ল্যাবরেটরী এবং বাথরুম। দুপুর গড়িয়ে গিয়েছে। খোলা জানালা দিয়ে রোদ এসে পড়েছে ঘরে। পরিচিত হিমেল হাওয়া আর নেই। সূর্যের তাপে ঘরগুলো উত্তপ্ত।

কিন্তু ডক্টর মুনোজ কোথায়? তাঁকে তো কোথাও দেখতে পাচ্ছি না। তিনি কি বন্ধ ঘরের ভিতর থেকে অদৃশ্য হয়ে গেলেন!

দেখলাম এক সারি কালো আঠাল পদচিহ্ন খোলা বাথরুম থেকে বেরিয়ে চলে গিয়েছে হল ঘরের দরজার কাছে। তারপর সেখান থেকে এগিয়ে গিয়ে পদচিহ্ন থেমেছে একটা ডেস্কের সামনে। ডেস্কের কাছের মেঝেতে কিছুটা জল জমে আছে, আর সেই জলের মধ্যেও রয়েছে কালো আঠাল বস্তু।

ডেস্কের উপরে একখানা কাগজ। তাতে পেন্সিল দিয়ে আঁকাবাঁকা অক্ষরে কি সব লেখা। দেখে মনে হয় এ যেন কোন দৃষ্টিহীনের হাতের লেখা। যে লিখেছে সে কাগজখানাকে আঁকড়ে ধরেছিল।

কাগজখানাতেও কালো আঠালো দাগ। কাগজটি থেকেও সেই উৎকট দুর্গন্ধ আসছিল। কাগজের বুকে কেউ যেন তার শেষ কথাগুলি লিখে গিয়েছিল।

ডেস্কের কাছ থেকে পায়ের চিহ্ন চলে গিয়েছে একটা কাউচের দিকে। কাউচের কাছেই পদচিহ্ন শেষ। কাউচের হাতল দু’টো উঁচু বলে তার ভিতরে কি আছে তা প্রথমে বুঝতে পারলাম না।

কাউচের ভিতরে যা ছিল তার উপর দৃষ্টি পড়তেই আমি মহা আতঙ্কে শিউরে উঠলাম। কি দেখলাম তা এখন বলতে চাই না। পকেট থেকে দেশলাই বের করে আমি কালো আঠাল বস্তু মাখা দুর্গন্ধময় কাগজখানাকে পুড়িয়ে ফেললাম। আঁকাবাঁকা লেখায় ভরা কাগজখানা ছাই হয়ে গেল।

কাউচের দিকে তাকিয়ে আমি যখন মহা আতঙ্কে থরথর করে কাঁপছি তখন মিসেস হেরেরো আর দু’জন মেকানিক নিদারুণ আতঙ্কে উন্মাদের মত বিকট চিৎকার করতে করতে সেই নারকীয় ঘর ছেড়ে নীচের দিকে ছুটে গেলেন।

পরে শুনেছিলাম তাঁরা বিকারগ্রস্ত রোগীর মতই প্রলাপ বকতে বকতে স্থানীয় থানায় অসংলগ্নভাবে তাঁদের কথা বলতে পেরেছিলেন।

অপরাহ্নের হলুদ আলোয় দুর্গন্ধময় কাগজখানায় যে সব ভয়ঙ্কর কথা লেখা ছিল তা আমার কাছে সম্পূর্ণ অবশ্বাস্য বলেই মনে হয়েছিল।

ঘরে বিকেলের রোদ, নীচে জনবহুল ফোরটিনথ স্ট্রীট থেকে ভেসে আসছে ছুটন্ত মোটরগাড়ি আর ট্রাকের শব্দ। পরিবেশ একান্তভাবেই বাস্তব। অলৌকিকত্বের কোন ছিটেফোঁটারও এই পরিবেশে থাকবার কথা নয়। কিন্তু স্বীকার করতে লজ্জা নেই যে এরকম পরিবেশের মধ্যেও আমি কাগজের লেখাগুলি বিশ্বাস করেছিলাম।

কাগজের উপরে আঁকাবাঁকা অক্ষরে যা লেখা হয়েছিল, তা কি আমি এখন বিশ্বাস করি? নিজেকে বার বার এই প্রশ্ন করেছি। অনেক বছর কেটে গিয়েছে, কিন্তু আজ পর্যন্ত এ প্রশ্নের উত্তর পাই নি। তবে এটুকু বুঝেছি যে এমন অনেক বিষয় আছে যা নিয়ে মানুষের বেশী মাথা ঘামানো উচিত নয়। আমি এটুকুই বলতে পারি যে অ্যামোনিয়ার গন্ধকেই আমি সব চাইতে বেশী ঘেন্না করি। আর অস্বাভাবিক হিমেল হাওয়ার পরশ আমাকে খুব ভয় পাইয়ে দেয়। দারুণ আতঙ্কে অনেক সময় আমি চেতনা হারিয়ে ফেলি।

এবার বলছি সেই দুর্গন্ধময় কাগজখানায় আঁকাবাঁকা অক্ষরে কি লেখা ছিল :

‘এই আমার শেষ। আমার শেষ মুহূর্ত দ্রুত এগিয়ে আসছে। বরফের আর কোন দরকার নেই। বরফ রাখতে এসে একটা লোক ভয় পেয়ে পালিয়ে গেল। ও আর বরফ নিয়ে এখানে আসবে না।

ঘরের উত্তাপ প্রতি মুহুর্তে বেড়ে যাচ্ছে। আমার শরীরের ‘টিসু’ বা কলাগুলি এই উত্তাপ সহ্য করতে পারছে না। আমার ধারণা, সেদিন আপনাকে আমি যা বলেছিলাম তা এবার আপনি বুঝতে পারছেন। শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ এবং যন্ত্রের কাজ বন্ধ হয়ে গেলেও প্রচন্ড ইচ্ছাশক্তি এবং স্নায়ুর ক্ষমতা দিয়ে দেহকে সংরক্ষিত করে রাখবার কৌশলটির কথাই বলতে চাইছিলাম আমি। এ একটি চমৎকার মতবাদ। কিন্তু এই কৌশলের আশ্রয় নিয়ে অনির্দিষ্ট কালের জন্য দেহকে সংরক্ষিত করে রাখা যায় না। ক্রমিক অবক্ষয়কে এড়ানো কোনভাবেই সম্ভব নয়। আমার কৌশলের আশ্রয় নিলে সেই অবক্ষয়টা আসবে ধীর গতিতে। অবক্ষয়ের অনিবার্যতার দিকটা আমি আগে ভেবে দেখি নি। ডক্টর টোরেস কিন্তু এ ব্যাপারটা জানতেন। আর জানবার ফলেই তিনি যে আঘাত পেয়েছিলেন, সেই আঘাতই তাঁর মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়াল। ডক্টর টোরেসকে যা করতে হয়েছিল, তা তিনি সহ্য করতে পারেন নি।

চিঠির মাধ্যমে আমি যে নির্দেশ দিয়েছিলাম সেই নির্দেশ অনুযায়ী ডক্টর টোরেস আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন একটা অদ্ভুত অন্ধকার জায়গায়। আমার নির্দেশ মত সেবা-শুশ্রূষা করে তিনি আমাকে আবার জাগিয়ে তুললেন-নিয়ে এলেন জীবনের রাজ্যে। কিন্তু আমার শরীরের যন্ত্রগুলি আর কাজ করল না। তাই আমার আবিষ্কৃত কৌশলে আশ্রয় নিয়েই আমার দেহকে কৃত্রিমভাবে সংরক্ষণ করতে হ’ল, কেননা আজ থেকে আঠারো বছর আগে স্বাভাবিকভাবেই আমার মৃত্যু হয়েছিল!’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *