• Skip to main content
  • Skip to header right navigation
  • Skip to site footer

Bangla Library

Read Bengali Books Online (বাংলা বই পড়ুন)

  • সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • Login/Register
  • My Account →
  • সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • Login/Register
  • My Account →
  • বাংলা ডিকশনারি
  • বাংলা কৌতুক
  • বাংলা লিরিক্স
  • বাংলা রেসিপি
  • হেলথ টিপস এন্ড নিউজ

বাংলা নতুন/পুরাতন বইয়ের পিডিএফ ডাউনলোড/সন্ধান করতে আমাদের বাংলা পিফিএফ সাইটে ক্লিক করুন।

Bangla PDF

ইতিহাসের আলোকে বৈদিক সাহিত্য – সুকুমারী ভট্টাচার্য

লাইব্রেরি » সুকুমারী ভট্টাচার্য » ইতিহাসের আলোকে বৈদিক সাহিত্য – সুকুমারী ভট্টাচার্য
ইতিহাসের আলোকে বৈদিক সাহিত্য – সুকুমারী ভট্টাচার্য

ইতিহাসের আলোকে বৈদিক সাহিত্য – সুকুমারী ভট্টাচার্য

ইতিহাসের আলোকে বৈদিক সাহিত্য – সুকুমারী ভট্টাচার্য

বৈদিক সাহিত্যের পরিধির মধ্যে সংহিতা থেকে সূত্ৰ-সাহিত্য পর্যন্ত বিধৃত, অর্থাৎ খ্রীস্টপূর্ব দ্বাদশ শতক থেকে খ্রীস্টীয় পঞ্চম-ষষ্ঠ শতক পর্যন্ত প্ৰায় দেড় হাজার বছরে বেদকেন্দ্ৰিক যে-সাহিত্য রচিত হয়েছিল তার ইতিহাস। এ-সাহিত্যের প্রথম পর্যায়ে, বহুদেবতার উদেশে রচিত স্তব, প্রার্থনা যেমন আছে, তেমনি আছে সমাজজীবনের নানা গৌণ চিত্র ও কিছু অধ্যাত্মবিষয়ক রচনাও।

পরবর্তী ব্ৰাহ্মণসাহিত্যে যজ্ঞের প্রণালী, উপযোগিতা, পুরোহিতের ভূমিকা ও দক্ষিণা সম্বন্ধে নির্দেশ এবং তৎসংশ্লিষ্ট কিছু আখ্যায়িকাও আছে। তার পরে কর্মকাণ্ড অর্থাৎ যজ্ঞকৰ্ম ও যজ্ঞতত্ত্ব অনেকটা গৌণ, রূপকায়িত আকারে দেখা দেয় আরণ্যকসাহিত্যে, যার পূর্ণ পরিণতি উপনিষদে। এদুটিকে জ্ঞানকাণ্ড বলে।

এই গ্রন্থে বেদকে তার আর্থসামাজিক পরিবেশের মধ্যে রেখে বিচার করার চেষ্টা রয়েছে। বেদ লিখিত রচনা নয়, কথ্য ও শ্রৌত রচনা, ফলে লিখিত রচনা থেকে তার প্রকৃতি ও উপাদান কতকটা ভিন্ন। পরিশেষে, বৈদিক সাহিত্য যে শুধু ধর্মগ্ৰন্থই নয়, সাহিত্যও বটে, এই কথাটি স্মরণে রেখে যথাসম্ভব এর সাহিত্যিক মূল্যায়নেরও প্ৰয়াস আছে এ গ্রন্থে।

লেখিকা একাদিক্ৰমে আঠাশ বছর যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে সংস্কৃত বিভাগের অধ্যাপিকা ছিলেন। বহু জ্ঞানগর্ভ গ্রন্থের রচয়িতা। বর্তমানে এশিয়াটিক সোসাইটির সিনিয়র রিসার্চ ফেলোরূপে গবেষণা গ্ৰন্থ রচনায় নিযুক্ত।

.

মুখবন্ধ – ইতিহাসের আলোকে বৈদিক সাহিত্য

বৈদিক সাহিত্যে অবস্থান শুধুমাত্র ভারতীয় সাহিত্যেরই সূচনা পর্বই জাগতিক নয়, ইন্দো-ইউরোপীয় জনগোষ্ঠীর প্রথম পূর্ণাঙ্গ ধর্মীয় ও সাহিত্যিক কীর্তিরূপেও তার পরিচিতি। ইদানীং শুভ লক্ষণ দেখা যাচ্ছে যে, ইতিহাস, পুরাতত্ত্ব, সাংস্কৃতিক নৃতত্ত্ব, সমাজবিদ্যা, তুলনামূলক ধর্ম ও লোক পুরাণ, ভাষাতত্ত্ব এবং দর্শনশাস্ত্রের মত সহযোগী বিষয়ে নিরস্তর গবেষণার ফলে বৈদিক সাহিত্যের আলোচনাও সমৃদ্ধতর হয়ে উঠছে। বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণায় উদ্ভূত সিদ্ধান্তকে সমন্বিত করেই আমরা বৈদিক জনসাধারণের জীবন, চিন্তাধারা, নীতিবোধ ও বিশ্বাসের সম্যক পরিচয় পেতে পারি। বৈদিক সাহিত্য আলোচনার ক্ষেত্রে অনেক অভ্যন্তরীণ ও বাইরের বিঘ্ন রয়েছে। তৎকালীন জীবনযাত্রা বিষয়ে নির্ভরযোগ্য তথ্য এখনও খুবই বিরল ; ইতিহাস ও পুরাতত্ত্ব থেকে বৈদিক মানুষের দৈনন্দিন ও সামাজিক জীবনযাত্রা সম্বন্ধে উপাদান যা আমরা যৎসামান্য পেয়েছি, তাও আবার প্রায়ই রক্ষণশীল ও উগ্ৰজাতীয়তাবাদী মানসিকতায়, চিরাভ্যস্ত অনড় কুসংস্কারে কিংবা বিপরীতমুখী তাচ্ছিল্য ও অবহেলায় আবিল হয়ে উঠেছে। সাহিত্য হিসাবে বৈদিক সাহিত্যকে প্ৰাপ্য মর্যাদা দেওয়া হয় নি, কেবলমাত্র ধর্মীয় রচনা রূপেই অধিকাংশ সময় তাকে গ্ৰহণ করা হয়েছে। বহু শতাব্দীর বৈদেশিক শাসনের ফলে ভারতীয়দের মনে জাতীয় অসম্মানের ক্ষতিপূরণের প্রবণতা থেকে একধরনের মিথ্যা উন্নাসিকতার উদ্ভব হয় । বৈদিক সাহিত্যচর্চায় তার অনিবাৰ্য প্রভাবও দেখা যায়। অন্যদিকে পরাধীন জীবনের অনগ্রসরতা ও বৈজ্ঞানিক উন্নতির অভাবের ক্ষতিপূরণের জন্যে আধুনিকীকরণ ও প্রগতির বিপরীত মেরুতে বৈদিক সাহিত্যের কল্পিত গৌরবকে উপস্থাপিত করা হয়। দুর্ভাগ্যের বিষয়, বৈদিক সাহিত্যের আলোচনা তখনই নূতন করে আমাদের দেশে শুরু হ’ল যখন সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে জাতীয় আন্দোলন দেখা দিয়েছিল। তখনকার বৈষয়িক জীবনের হীনতা ও অভাববোধকে চাপা দেওয়ার জন্য দেশপ্রেমিক চিন্তানায়কেরা বৈদিক সাহিত্যের তথাকথিত তুরীয় আধ্যাত্মিকতার মধ্যে আশ্রয় নিলেন। আমাদের সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের মধ্যে যা কিছু যথার্থ গৌরবের দিক ছিল, তার স্বাস্থ্যকর আলোচনার সম্ভাবনা এতে বিশেষভাবে ব্যাহত হ’ল। পরিবর্তে দেখা গেল রুগ্ন এক গর্ববোধ, অর্থহীন উন্নাসিক আত্মসন্তুষ্টি, দৃষ্টিভঙ্গির চূড়ান্ত বিভ্রান্তি এবং গবেষণার নামে অবৈজ্ঞানিক কাল্পনিকতার প্রসার। রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির প্রয়োজনে এই প্রবণতাকে প্রশ্ৰয় দেওয়া হল ; আমাদের অন্তঃসারশূন্য গর্ববোধ ও আত্মতৃপ্তির মোহাচ্ছন্ন উন্মাদনা বৈদিক সাহিত্যের গবেষণাকে স্বপ্রতিষ্ঠা হতে দিল না।

বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে নৃতত্ত্ববিদ, ঐতিহাসিক, ভাষাতাত্ত্বিক, ব্যাকরণবিদ, কোষবিশারদ, লোকপুরাণবিশেষজ্ঞ, দার্শনিক, ধর্মতত্ত্ববিদ প্রমুখ গবেষকরা বৈদিক সাহিত্যের বিচিত্র দিকের উপর আলোকসম্পাত করার ফলেই আমরা আজ বিষয়টিকে সামগ্রিকভাবে পর্যালোচনা করতে পারছি। উনিশ শতকের বিদ্যাচর্চার সাধারণ পরিবেশে ওতপ্রোতভাবে যে রোম্যাণ্টিকতা ছিল, তার প্রভাবও বৈদিক সাহিত্য আলোচনায় দেখা গেছে। তবে এই শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধেই বৈদিক সাহিত্য রচনায় নতুন এক পরিণত ধারার সূত্রপাত হয়েছে বলা যায়। বৈদিক সাহিত্যের সাম্প্রতিক আলোচনায় চিরাগত কুসংস্কার, পূর্বনির্ধারিত ধারণা কিংবা চেতন বা অবচেতন স্বার্থন্বেষার ভূমিকা তুলনামূলকভাবে কম হওয়াতে অকারণ নিন্দা বা অহেতুক প্ৰশংসা বিশেষ দেখা যায় না। প্রাচীন গ্রিক সাহিত্য আলোচনার ক্ষেত্রেও একধরনের পূর্বনির্দিষ্ট সংস্কার ছিল ; কিন্তু গ্রিস যেখানে সাধারণভাবে স্বাধীন, ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে তা না হওয়াতে প্রাচীন সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্পর্কে মোহবিস্তারের মানসিক প্রয়োজন একসময়ে যেন অনিবাৰ্য হয়ে উঠেছিল। ঐতিহাসিক উপাদান সামান্য হলেও যতটুকু আমরা পেয়েছি, তাকে উপেক্ষা করার ফলে বৈদিক সাহিত্যের আলোচনা একদেশদর্শিতায় আক্রান্ত। এমন একটা ভুল ধারণা এখনও ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে যে বৈদিক সাহিত্যের কোন বস্তুগত উৎস নেই, শূন্যের মধ্যেই তার সৃষ্টি। অবশ্য সাম্প্রতিক গবেষণার নিরাবেগ ও নির্ব্যক্তিক দৃষ্টিভঙ্গি উত্তরোত্তর শক্তিশালী হয়ে ওঠায় বৈদিক সাহিত্য আলোচনার ক্ষেত্রেও আমরা এই সত্য ক্রমেই মেনে নিচ্ছি। যে নৈতিক মূল্যবোধ ধর্মীয় বিশ্বাস ও দার্শনিক চিন্তাধারা প্রকৃতপক্ষে উৎপাদনপদ্ধতির বিশেষ্যস্তরে বৈদিক জনগোষ্ঠীর বিশেষ সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থানের পরিচয় বহন করছে। তাই আমরা এখন বৈদিক সাহিত্যকে শুধু ধর্মীয় রচনা হিসাবে না দেখে সৃষ্টিধর্ম সাহিত্যরূপেও গ্রহণ করতে পারছি। জনসাধারণের মধ্য থেকে তাদেরই নিগুঢ় অনুপ্রেরণার তাগিদে এই সাহিত্যের জন্ম বলেই জনসাধারণের বৈষয়িক জীবনযাত্রার বিধি দিয়েই তা মূলত নিয়ন্ত্রিত।

ইন্দো-ইয়োরোপীয় জনগোষ্ঠীর যে শাখা শেষ পর্যন্ত ভারতে পৌঁছেছিল, ইরানের মধ্য দিয়েই তারা এদেশে আসে। সম্ভবত, সেই সময় তারা কাসাইটুদের প্রতিবেশী রূপে কিছুকাল কাটিয়েছিল—এই কাসাইটু শাখা বস্তুত ইন্দো-ইয়োরোপীয়দের সেই গোষ্ঠী যারা মূল জনস্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে খ্রিস্টপূর্ব ষোড়শ শতকের কাছাকাছি সময়ে ইরানে বসতি স্থাপন করে। গবেষকরা আরও বলেন যে খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় সহস্রাব্দের দ্বিতীয়ার্থে অজস্র ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দল ইরান থেকে ভারতবর্ষে নুতন বসতির সন্ধানে প্রবেশ করেছিল। অনুমান করা যায়, ১৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ নাগাদ ইরানীদের সঙ্গে প্রত্ন-ভারতীয় আর্যজনগোষ্ঠীর তুমুল মতান্তর ও বিচ্ছেদ ঘটে এবং দক্ষিণপূর্বদিকে ভ্ৰমণ করতে করতে এরা একসময় ভারতবর্ষে উপস্থিত হয়। এই গোষ্ঠীর আগমনের কিছুকাল পূর্বে, সম্ভবত ১৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের কাছাকাছি, অন্য একদল ইন্দো-ইয়োরোপীয় গোষ্ঠী খাইবার গিরিপথ দিয়ে কাবুল উপত্যকায় এবং অন্য আরেকটি দল আরও কিছুকাল পরে হিন্দুকুশ পর্বত দিয়ে বালখ এলাকায় উপস্থিত হয়। পণ্ডিতরা মনে করেন যে, এই সব জনগোষ্ঠীর মধ্যে শেষোক্তেরা পরবর্তীকালে বৈদিক আৰ্য হিসাবে পরিচিত হয়েছিল, কিন্তু প্রথমোক্তরা পূর্বেই ইরান থেকে অল্প সংখ্যায়। ভারতবর্ষে এসে শান্তিপূর্ণভাবে প্ৰাগাৰ্যদের মধ্যে মিশে গিয়ে আর্যাবর্তে বসতি স্থাপন করেছিল।

সেই সময় উত্তর ভারতের বিভিন্ন স্থানে যে সিন্ধু সভ্যতার স্ফূরণ ঘটেছিল, তা ছিল ব্রোঞ্জ যুগের নাগরিক সংস্কৃতি, এবং নৌবাণিজ্যের মধ্য দিয়ে মিশর ও সুমেরের সঙ্গে তার সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। সেই সব অঞ্চলের জনসাধারণ পশুপালন ও মৃগয়ার দ্বারা জীবিকা নির্বাহ করত ; ধাতুবিদ্যা ও বয়নশিল্প যেমন তাদের জানা ছিল, তেমনি অলংকারের প্রয়োজনে বিচিত্র ও বহুমূল্য পাথর খোদাই-এর কাজও তারা আয়ত্ত করেছিল। তুলা চাষ করে সুমেরীয়দের কাছে বিক্রি করত, এমন প্রমাণও পাওয়া গেছে।

ভারতবর্ষে উপনীত হওয়ার বহু পূর্বে বৈদিক আৰ্যরা তাদের মূল ইন্দোইয়োরোপীয় পিতৃভূমি পরিত্যাগ করে দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় বেরিয়ে পড়ে এবং যাত্রাপথের বহু স্থানেই তারা দীর্ঘকাল অতিবাহিত করে। তাই মধ্য প্রাচ্যে প্রত্ন-ভারতীয় আর্য ভাষার কিছু কিছু শব্দের ইঙ্গিত পাওয়া গেছে ; আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব বিংশ শতাব্দীতে মিতান্নি রাজ্যের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তে যে নুজি শিলালেখটি পাওয়া গেছে, তাতে ঘোড়ার বিভিন্ন রং নির্দেশ কবতে নিম্নোক্ত শব্দগুলি ব্যবহৃত হয়েছে।–বব্রু (সংস্কৃত-বভ্রু), পরিত (সং-’পলিত’) ও পিন্ধব (সং-’পিঙ্গল’)। তাছাড়া, খ্রিস্টপূর্ব অষ্টাদশ শতাব্দীর কাসাইট্‌ জাতির নথিপত্রে কয়েকজন ভারতীয় দেবতার নাম পাওয়া যায় (সুরিঅস্‌, মরুত্তস্‌, এবং বুগাস্‌–সংস্কৃতে সূর্য, মরুতঃ ও ভগ), পঞ্চদশ শতাব্দীর তেল্‌-এল্‌-মিতান্নি শিলালেখে কিছু প্রত্ন-ভারতীয় আৰ্য নাম (অর্ততম, মুক্তর্ন এবং দশরত্ত), বৈদিক দেবনাম (ইন্দর ও মিত্থ্রর, উরুবন, নসেত্ত) এবং বন্য অশ্বের বশীকরণ সংক্রান্ত কিছু শব্দ পাওয়া গেছে। এছাড়া প্রত্ন-ভারতীয় আর্য সংখ্যাবাচক শব্দেরও সন্ধান পাচ্ছি, যেমন-ঐক্য, তের, পঞ্জী, সত্ত এবং নব। খ্রিস্টপূর্ব দশম শতাব্দীতে সম্রাট সলোমন ভারতবর্ষ থেকে চন্দনকাঠ পেতেন ; লক্ষণীয় যে হিব্রু ভাষায় ময়ুর, বানর, গজদন্তু, তুলা এবং চন্দনবাচক শব্দগুলি সমার্থক ভাবতীয় শব্দ থেকেই গৃহীত হযেছে। ভাবতবর্ষের সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যোব যে দীর্ঘকালব্যাপী বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল তা খ্রিস্টপূর্ব নবম শতাব্দীতে তৃতীয় সলোমানে রাজত্বকালীন নথিপত্র থেকেও প্ৰমাণ করা যায়। এতে দেখছি, ভাবতবর্ষ থেকে বানর ও হাতি আমদানি করা হত। অষ্টম শতাব্দীতে তৃতীয় টিগলেথ-পিলেসেব ভারতবর্ষ থেকে দামি পাথর পাচ্ছেন এবং সপ্তম শতাব্দীতে অসুর . … একটি দলিলে ‘সিন্ধু’ শব্দটি পাওয়া গেছে। বভেরু জাতকে রয়েছে, ভারতীয় বাণিজ্যপোতগুলি ময়ুর নিয়ে ব্যাবিলনের দিকে যাচ্ছে। সুমেরুয়দের জ্যোতির্বিদ্যা এবং ব্যাবিলনের পরিমােপরীতি ভারতবৰ্যকে প্রভাবিত করেছিল। গ্রিসের সঙ্গে ভারতবর্ষের প্রাথমিক বাণিজ্য সম্পর্ক মিশরের মধ্য দিয়ে এবং ফিনিশীয় ও পারসিক বণিকদের মাধ্যমে গড়ে উঠেছিল। কোন কোন গবেষক বলেছেন যে ভারতীয় উপকূলে হরপ্লার বন্দরগুলি থেকে খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় এবং দ্বিতীয় সহস্রাব্দে বাহরেইন, সুমেরু এবং উত্তর সিরিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। যষ্ঠ শতাব্দীতে অবশ্য গ্রিসের সঙ্গে ভারতবর্ষের সরাসরি বাণিজ্যিক যোগাযোগ স্থাপিত হয়। সুতরাং আমরা লক্ষ্য করছি, সিন্ধু সভ্যতার সময় থেকে উপনিষদের কাল পর্যন্ত ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের সঙ্গে ভারতবর্ষের যোগাযোগ প্ৰায় নিরবচ্ছিন্ন ছিল, কেবলমাত্র বৈদিক আৰ্যদের আগমনের পরে কয়েক শতাব্দীর জন্য বাণিজ্যিক সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল।

ব্যবহারিক সংস্কৃতির দিক দিয়ে সিন্ধু উপত্যকার অধিবাসীরা নবাগত আৰ্যদের চেয়ে বহুগুণে শ্রেষ্ঠ ছিলেন। সংগ্রামে জয়লাভ করে আর্যরা যখন এই সংস্কৃতিব বাতাবরণে বসতি স্থাপন করলেন, তখন দৈনন্দিন সান্নিধ্য ও পারস্পবিক বিবাহসূত্রে আদিম লোকজীবনের অনেক উপাদানই তারা আত্মস্থ করে নিলেন। তাই মৃৎকুটীরবাসী আর্যরা যদিও কয়েক শতাব্দীর জন্য নিজেদের জীবনযাত্রা সম্পর্কে কোন পুরাতাত্ত্বিক অবশেষ রেখে যান নি ; কিছুকাল পরেই কিন্তু গৃহ ও মৃৎপাত্র নির্মাণে তাঁরা যে প্ৰাথমিক প্ৰয়াস শুরু করেছিলেন তার কিছু কিছু প্ৰমাণ পাওয়া গেছে। কিন্তু উপাদানগত বিচারে শ্রেষ্ঠতর সংস্কৃতির প্রভাব যাযাবর ও পশুপালক আৰ্যদের উপর কীভাবে সর্বাত্মক হয়ে উঠেছিল তার কোন নিদর্শন কোথাও পাওয়া যায় না। আবার সিন্ধু উপত্যকার অধিবাসীরা যদিও আর্যদের মতো নিরক্ষর ছিলেন না, তবু তাঁদের ধর্মীয় বা সাধারণ জীবনবোধ সংক্রান্ত কোন সাহিত্যকর্মের অবশেষ আজও আবিষ্কার করা যায়নি।

ঋগ্বেদ সংহিতার পর্যায়ে আর্য সংস্কৃতির উপর প্রাগাৰ্য প্রভাব সম্পর্কে আমাদেব ধারণা সম্পূর্ণই অনুমান-নির্ভর। তবে বৈদিক যুগেব শেষ পর্বে আমবা কিছু কিছু স্পষ্ট প্রমাণ পেয়েছি। অনাৰ্য উপাদান নির্ণয়ের অন্যতম পদ্ধতি হ’ল অন্যান্য ইন্দো -ইউরোপীয় সংস্কৃতির সঙ্গে প্রতিতুলনা করে সাধারণ ঐতিহ্যগত বৈশিষ্ট্যগুলি চিহ্নিত করা। যদিও এই পদ্ধতিতে প্রচুর ত্রুটি রয়েছে এবং এর ফলাফলও সবসময় সন্তোষজনক নয়, তবুও ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক সাক্ষ্যপ্রমাণের অভাবের ফলে বৈদিক সংস্কৃতি সম্পর্কে নিরাবেগ সিদ্ধান্ত গ্রহণের পক্ষে এই পদ্ধতিটি অপরিহার্য। বৈদিক সাহিত্যের শেষ পর্যায়ে আমরা একটি জটিল ও মিশ্র সংস্কৃতির সম্মুখীন হই— আর্য ও প্ৰাগাৰ্য উপাদানের সংশ্লেষণ একটি বিশেষ প্রবণতারূপে স্বীকৃতি লাভ করে, যদিও স্বভাবতই বিজয়ীর ভাষা, সাহিত্য, ধর্ম ও সাংস্কৃতিক বিশ্ববীক্ষা বিজিতের উপর আগ্ৰাসী প্রভাব বিস্তার করে।

প্ৰাচীন পারসিকদের সঙ্গে আর্যদের বিচ্ছেদ ঘটে যাওয়ার পরে তারা প্রথমোক্তদের নামের সঙ্গে বিদ্বেষসূচক বিশ্লেষণ ‘দহাএ’, বা ‘দত্থু’ যুক্ত করে, ভারতবর্ষে বসতি স্থাপন করার সময় আদিম অধিবাসীদের ক্ষেত্রেও এই শব্দজাত “দাসু’ শব্দটি প্রয়োগ করা হয়। বৈদিক সাহিত্য অবশ্য দসু্যর প্রতিশব্দরূপে অসুর’s ব্যবহৃত হয়েছে। এর সঙ্গে লোকপুরাণ-নির্দেশিত সেই পদ্ধতি তুলনীয় যার সাহায্যে গ্রিক জাতিও গ্রিসের প্রাকহেলেনীয় যুগের জনগোষ্ঠীকে বর্ণনা করত। বিজয়ীর প্রত্নকথার টাইটানদের নির্বাসিত করা হয়েছে পৃথিবীর শেষপ্রান্তে শীতল ও অস্পষ্ট দূরত্বে, আর তাদের কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে প্ৰেম, শ্ৰীতি ও বিদ্বেষের বিচিত্র মিশ্র মনোভাবের আততি ।

সিন্ধু উপত্যকার সভ্যতা সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান মূলত পুরাতত্ত্ব-নির্ভর ; সেখানে আমরা এমন কিছু উপাদানের সন্ধান পাই যা পরবতীকালে ব্রাহ্মণ্যসংস্কৃতিতে রূপান্তরিত অবস্থায় স্থান লাভ করে। লোথালে যে তিন ধরনের বেদী আবিষ্কৃত হয়েছে। (অর্ধচন্দ্ৰ, গোল ও আয়তক্ষেত্রের আকৃতিবিশিষ্ট) তা বৈদিক যজ্ঞের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বেদীর কথাই মনে করিয়ে দেয় ; এছাড়া প্রত্নপশুপতি মূর্তি, মাতৃকামূর্তি, ধ্যানমগ্ন ভঙ্গী মূর্তির আনুষ্ঠানিক অবগাহনের প্রমাণ এবং সাধারণভাবে পুরোহিত-তান্ত্রিক সমাজ-ব্যবস্থার ইঙ্গিত নিঃসংশয়ভাবে পরবতী ব্ৰাহ্মাণ্য-তন্ত্রের উপর ব্যাপক প্রভাবের পরিসর পরিস্ফুট করে। প্ৰাগাৰ্য চিন্তাধারা এবং যদিও প্রায় সম্পূর্ণতই আমাদের কাছে অপরিচিত। তবু অনুমান করতে বাধা নেই যে বৈদিক সাহিত্যের শেষ পর্যায়ে বিশ্ববীক্ষায় যতটুকু পরিবর্তন এসেছে তার পশ্চাতে সিন্ধুসভ্যতার সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের ভূমিকা মোটেই গৌণ নয়। এটা ঠিকই যে সেই যুগের কোন লিখিত বা মৌখিক সাহিত্যের নিদর্শন আমাদের জানা নেই, কিন্তু তা থেকে নিশ্চয়ই আমরা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারি না যে সিন্ধু উপত্যকার অধিবাসীদের কোন নিজস্ব সঙ্গীত, গীতিকা কিংবা ধর্মীয় ও লোকজীবনের গাঁথা ছিল না। সাহিত্য যেখানে বিজয়ীর সঞ্চায়ের মধ্যেই রক্ষিত হয়। সেখানে বিজিতের সৃষ্টি কোনো সরাসরি স্বীকৃতি পায় না। শুধুমাত্র পরবতী সাহিত্যে রূপান্তরিত অন্তর্বস্তুর মধ্যেই আজ প্রাগবৈদিক সাহিত্যের অস্তিত্ব কল্পনা করা সম্ভব।

ভারতীয় সাহিত্যধারার আদিমতম নিদর্শন ঋগ্বেদ, দশটি মণ্ডলে বিভক্ত সহস্ৰাধিক মন্ত্রের সংকলন। দ্বিতীয় থেকে সপ্তম মণ্ডল এই গ্রন্থের প্রাচীনতম অংশ। এদের ‘পারিবারিক মণ্ডল’ বলা হয়ে থাকে কেননা ছয়টি কবি পরিবারের বিভিন্ন সদস্য এই কটি মণ্ডলের অন্তর্গত মন্ত্রগুলি রচনা করেছিলেন। অষ্টম মণ্ডল রচিত হয় এই অংশের কিছুকাল পরে। এই আটটি মণ্ডলের মধ্য থেকে সোমদেবের উদ্দেশ্যে রচিত মন্ত্রগুলি একত্র সংকলিত করে একটি পৃথক মণ্ডল প্ৰস্তুত করা হয়। এই নবম মণ্ডলের অন্তর্গত মন্ত্রগুলি সোমযোগে আবৃত্তি করা হত। এর অল্প কিছুকাল পরে প্ৰথম মণ্ডলের দ্বিতীয় অংশ রচিত হয়েছিল। এই মণ্ডলের প্রথম অংশ রচিত হয় সবচেয়ে অর্বাচীন দশম মণ্ডলের সমসাময়িক কালে। পারিবারিক মণ্ডলগুলিতে বহু সংখ্যক অভিন্ন বিষয়বস্তুর পুনরাবৃত্তি দেখা যায়। কিন্তু অষ্টম মণ্ডলে কিছু কিছু নূতন বিষয়বস্তুর আবির্ভাব লক্ষ্য করা যায়। নবম মণ্ডল সোমদেবের উদ্দেশে নিবেদিত মন্ত্রসমূহের কৃত্রিম একটি সংকলন, ফলে এই মণ্ডলের সূক্তগুলি বিভিন্ন সময়ের রচনা এবং সেগুলিতে কোন নূতনত্ব আশা করা যায় না। প্রকৃতপক্ষে প্রথম মণ্ডলের প্রথম অংশে এবং দশম মণ্ডলে নূতন কিছু বিশ্বাস ও ধারণা, বিষয়বস্তু এবং দৃষ্টিভঙ্গির সুস্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যায় ; নূতন সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় চেতনা এই প্ৰথমবার আত্মপ্ৰকাশ করে। আমরা তাই যুক্তিগ্রাহ্যভাবেই অনুমান করতে পারি যে পরস্পর ভিন্ন দুটি জনগোষ্ঠীর সমীপ্য ও সমন্বয়ের ফলেই এই নূতনত্বের উদ্ভাসন দেখা গিয়েছিল। প্ৰথম মণ্ডলের প্রথম অংশ এবং দশম মণ্ডল সম্ভবত তথাকথিত মহাভারতের যুদ্ধের সমসাময়িক, অর্থাৎ আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব নবম শতকের রচনা।

সংহিতা রচনার শেষদিকে সমগ্ৰ উত্তর ভারতে সামাজিক ও ব্যবহারিক জীবনে গুরুতর পরিবর্তন ঘটছিল। আর্যরা কৃষিকাজে লাঙলে লোহার ফলা বা কাঠের লাঙলের ব্যবহার শিখে নিয়েছিল, ধীরে ধীরে অরণ্যভূমি বাসযোগ্য ও কৃষিযোগ্য করে তুলছিল এবং ক্ৰমে পূর্ব ও দক্ষিণ অঞ্চলে নুতন বসতি স্থাপন করছিল। ক্রমাগত অপরিচিত ও অনধিগত অঞ্চলে আধিপত্য ও বসতি বিস্তার, প্ৰাথমিক সম্পদ সঞ্চায়ের ফলস্বরূপ শ্রেণীবিন্যাসেব সূচনা, কয়েক শতাব্দীর বিরতির পর মধ্য-প্রাচ্যের সঙ্গে নূতনভাবে নৌবাণিজ্যের সূত্রপাত ইত্যাদি ধীরে ধীরে সামাজিক জীবনের বিন্যাসকে আমূল পরিবর্তিত করে দিল। কৌম সমাজ ভেঙে গিয়ে গোষ্ঠীগুলি পিতৃতান্ত্রিক পারিবারিক ব্যবস্থায় বহুধা বিভক্ত হয়ে গেল, ফলে এই সমস্ত ‘কুল’ বা পরিবার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভূম্যধিকারী সংস্থায় পরিণত হ’য়ে নিজেদের প্রয়োজন অনুযায়ী শ্রমশক্তির ব্যবস্থাপক হয়ে উঠল। খাদ্যোৎপাদনের প্রকৃতি পরিবর্তিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে উৎপাদন সম্পর্কগুলিও পুনর্বিন্যস্ত হল। পশুপালনের পরিবর্তে মূখ্য জীবিকা নির্বাহের উপায়রূপে দেখা দিল কৃষিকর্ম। এই মৌলিক পরিবর্তন সাহিত্যেও প্রতিফলিত হল। কেননা যজ্ঞে পশু-মাংসের আহুতির সঙ্গে কৃষিজাত শস্যের হাব্য যুক্ত হল, কখনো বা তার পরিবর্তে দেখা গেল উদ্ভিজ্জ দ্রব্যের অর্ঘ্য এবং সেই সঙ্গে দেখা দিল জীবমাত্রের প্রতি করুণাদ্র মনোভাব ; যজ্ঞে হন্তব্য পশুর প্রতি সম্বোধিত মন্ত্রে এই অপরাধবোধেরই প্রকাশ। কৌম সমাজ যখন ভেঙে গেল নূতন সামাজিক মূল্যবোধের উন্মেষে পারিবারিক সম্পর্কও পরিবর্তিত হল, প্ৰভুভৃত্যের সম্পর্ক এবং নারীর গৌরবহানিতে নুতন এক বাস্তব সামাজিক বোধের প্রমাণ পাওয়া গেল।

সংহিতা সাহিত্যকে আমরা মুখ্যত দেবতাদের উদ্দেশ্যে স্তুতি ও প্রার্থনারূপে চিহ্নিত করতে পারি। বৈদিক দেবগােষ্ঠীর প্রাচীনতর অংশ প্রকৃতপক্ষে প্রাকৃতিক শক্তির কল্পনাসমৃদ্ধ প্ৰকাশরাপে আমাদের সম্রাম ও বিস্ময় উদ্রক করে। নিসর্গের মানবায়িত অভিব্যক্তি চমৎকার কাব্যগুণমণ্ডিত হয়ে দেবতাদের আকৃতি, পরিচ্ছদ, অলৌকিক কাৰ্যকলাপ এবং ওজসিতার বর্ণনায় প্রতিফলিত। অবশ্য সাধারণভাবে এইসব রচনায় পরিশীলন, কল্পনা বা প্রতিভার ভূমিকা গৌণ। আর্যদের বসতি স্থাপনের পরেও বেশ কয়েক শতাব্দী ধরে যে সংহিতা শাখার নিরবচ্ছিন্ন রচনা চলছিল, তাতে বিচিত্র বিষয়বস্তুর প্রকাশ দেখি। এতে আছে স্তোত্র, যুদ্ধগীতি, প্ৰত্নকথা, গীতিকা, মাদক সেবনের সংগীত, অপরাধীর প্রায়শ্চিত্ত গাথা, কামগীতি, বিবাহসংগীত, নূতন ধর্মচৰ্চার ইঙ্গিত, দাতার প্রশংসা বা দানস্তুতি, নাট্যসংলাপময় মন্ত্র বা সংবাদসূক্ত, ভক্তিগীতি, দার্শনিক ভাষ্য, সৃষ্টিতত্ত্বমূলক মন্ত্র, সংশয় ও অন্বেষাজ্ঞাপক মন্ত্র ইত্যাদি। সংহিতা রচনার একটা বাধা ছিল এই যে তার বহু বিচিত্র বিষয়বস্তুর জন্য এটাই একমাত্র প্রকাশ মাধ্যম ছিল, যদিও এর ছন্দোবৈচিত্র্য ও আঙ্গিকের দ্বারা এ রচনা অনেকটা মনোজ্ঞ হয়ে উঠতে পেরেছে। তবে কিছু চিত্রকল্পের আশ্চর্ষ সজীবতা ও সৌন্দর্য সূক্তগুলির কাব্যগৌরব বৃদ্ধি করছে। মহাভারতের যুদ্ধ বা খ্রিস্টপূর্ব নবম শতকে আর্যাবর্তের জাতীয় জীবনের কোনো ঘটনা সম্ভবত সাহিত্যের প্রকাশভঙ্গি  এবং বিষয়বস্তুতে যুগান্তর এনে দিয়েছিল, সংহিতাধর্মী রচনা এরপর আর দেখা গেল না। ঋগ্বেদের প্রথম মণ্ডলের প্রথম অংশ এবং দশম মণ্ডল শুধুমাত্র ইতস্তত বিক্ষিপ্ত মন্ত্রগুলিকে একত্র করে, তখনো পর্যন্ত সংকলিত ধর্মগ্রন্থে সন্নিবিষ্ট করে সেগুলির সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেছিল। সামবেদে কোন নুতন মন্ত্র নেই, কেবল যজুর্বেদে কিছু কিছু নুতন যজ্ঞানুষ্ঠানবিষয়ক মন্ত্র পাওয়া যায়। এদের মধ্যে রয়েছে প্রাগার্য বিষয় সংবলিত শতরুদ্রিয়র মতো মন্ত্রসমষ্টি। অথর্ববেদে বহু ঋগ্বেদীয় মন্ত্রের পুনবাবৃত্তি হয়েছে, আবার এতে এমন কিছু ঐন্দ্ৰজালিক সন্মোহন মন্ত্র রয়েছে সুদূর অতীতে যাদের উৎস, এছাড়াও আছে প্ৰাগাৰ্য সমাজসংস্থান ও বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারা ও তদ্বারা প্রভাবিত দার্শনিক ও সৃষ্টিতত্ত্ব সম্পর্কিত বেশ কিছু মন্ত্র।

সংহিতা সাহিত্যের প্রাচীনতর অংশ যেমন গ্রামীণ সংস্কৃতির ফসল, তেমনি বৈদিক যুগের শেষ পর্যায়ে দেখি নাগরিক সংস্কৃতির উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ প্রতিফলিত হয়েছে। তবে সন্দেহ নেই যে, এই দুই স্তরের মধ্যে বহু শতাব্দীর ব্যবধান। নুতন উৎপাদনপদ্ধতির ফলস্বরূপ নাগরিক সংস্কৃতির অভ্যুদয় ঘটতে অন্তত পাঁচশ’ বছর লেগেছিল ; এই রূপান্তরের প্রক্রিয়ায় প্রাচীন সমাজের অনেক বৈশিষ্ট্যই কালের গর্ভে বিলীন হয়ে গেল। আৰ্য-সামাজিক পরিপ্রেক্ষিতে যেসব মৌলিক পরিবর্তনের ফলশ্রুতিতে সামাজিক মূল্যবোধ ও বিশ্ববীক্ষায় চরিত্রগত রূপান্তর ঘটে যায়, যার ফলে নুতন সংহিতা-সাহিত্য সৃষ্টির প্রয়োজন ফুরিয়ে গেল, তাদের মধ্যে রয়েছেলোহার লাঙলের ফলা আবিষ্কারের ফলে কৃষিব্যবস্থার কিছু প্রসার ও তাজনিত উদ্ধৃত্তি শস্যের সঞ্চয়, সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী দ্বারা বৃহৎ জনসমষ্টির শাসন, ক্রমবর্ধমান সম্পদ আহরণ, প্রাথমিক মুদ্রাব্যবস্থার সূত্রপাত, পূর্বাঞ্চলে তামা ও লোহার খনির আবিষ্কার এবং ফলে সেইদিকে বসতি স্থাপনের জন্য জনগোষ্ঠীর পূর্বমুখে যাত্রা, ধাতুশিল্প ও কারিগরী বিদ্যা এবং সংশ্লিষ্ট বাণিজ্যের প্রসার, জ্যোতিবিদ্যার চর্চার ফলে পঞ্জিকার প্রবর্তন ও তার দ্বারা কৃষি ও নৌবাণিজ্যের সুশৃঙ্খল নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি। আমাদের আরো মনে রাখতে হবে যে রাষ্ট্রনৈতিক ক্ষেত্রেও সেই সময় গুরুতর পরিবর্তনের সূচনা হয়েছিল ; ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বতন্ত্র রাজ্যে গোষ্ঠীপতিরা রাজা হয়ে শাসনভার পরিচালনা করতে শুরু করেছিলেন ; আর তাদের রাজ্যের ভৌগোলিক সীমা বিস্তারের উচ্চাকাঙক্ষা ও প্রতিবেশী রাজ্যের আগ্রাসী আক্রমণ থেকে রাষ্ট্রনৈতিক নিরাপত্তা সুদৃঢ় করার বাসনাকে পুরোহিতরা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য মূলধন রূপে কাজে লাগিয়েছিলেন। এই সমস্ত ক্ষুদ্র গোষ্ঠীপতি, রাজা ও রাজন্যবর্গের সমৃদ্ধি ও রণক্ষেত্রে সাফল্য অর্জনকে নিশ্চিত করার জন্য পুরোহিতরাও বাজপেয়, রাজসূয় ও অশ্বমেধের মতো দীর্ঘস্থায়ী ও ব্যয়সস্কুল নূতন নূতন যজ্ঞানুষ্ঠানের উদ্ভাবন ও প্রবর্তন করলেন।

ঋগ্বেদ রচনার শেষ পর্যায়ে যে নুতন যুগের সূত্রপাত, তখন অভিনব সৃষ্টিমাধ্যম রূপে ‘ব্রাহ্মণ” সাহিত্যের সূচনা হল। সমৃদ্ধিশালী কৃষি-অর্থনীতির কল্যাণে রাজকীয় অর্থকোষগুলি যখন পরিপূর্ণ পুরোহিতরা তখন একদিকে নূতনতর যজ্ঞানুষ্ঠানের উদ্ভাবন এবং অন্যদিকে পুরাতন রীতিকে পরিমার্জিত ও পরিবর্ধিত করার দিকে মনোনিবেশ করলেন। সমৃদ্ধ পুরোহিততন্ত্রের বিচিত্র কার্যকলাপের প্রমাণ বিধৃত রয়েছে ব্ৰাহ্মণগ্রন্থগুলিতে। আর্যবসতি মধ্যদেশ পর্যন্ত বিস্তুত হওয়ার পর যজ্ঞকেন্দ্ৰিক ধৰ্মচর্য শীর্ষবিন্দুতে উপনীত হয়েছিল ; যজ্ঞের সংখ্যা চক্রবৃদ্ধিহারে বৃদ্ধি পেতে লাগল, সেগুলির বহুবিচিত্র শাখা-প্ৰশাখা সূত্রকারে লিপিবদ্ধ করার প্রবণতাও পুরোহিতদের মধ্যে দেখা গেল-আর তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়ে গেল যজ্ঞ পরিচালক পুরোহিতদের সংখ্যা এবং যজ্ঞদক্ষিণারূপে দেয় দ্রব্য ও সম্পদের পরিমাণ। যেহেতু বৃহৎ অঞ্চল জুড়ে তখন আর্যদের বসবাস তাই পারস্পরিক যোগাযোগ সহজসাধ্য ছিল না, অভ্ৰান্ত আচার-অনুষ্ঠান বিষয়ক শাস্ত্ররচনার অনিবাৰ্য প্রয়োজনও তাই দেখা দিল। সেই সঙ্গে যজ্ঞধর্ম সম্পর্কিত জ্ঞান দূরবতী অঞ্চলসমূহে পুরোহিত রচিতসাহিত্যের উৎসাহী পণ্ডিতদের মাধ্যমে প্রচার করার প্রয়োজনও দেখা দিল। বস্তুত সেইসময় পুরোহিতরা ধর্মপ্রচারকের ভূমিকা পালন করতে গিয়ে যজ্ঞচর্যার মধ্যে যে তাত্তিক ঐক্য স্থাপনের চেষ্টা করেছিলেন, তারই ফলশ্রুতিরূপে বিভিন্ন অঞ্চলের অধিবাসীদের সাংস্কৃতিক উপলব্ধিতে একধরনের সংহতি সৃষ্টি হয়েছিল।

বৈদিক ভারতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানগুলি তুলনামূলকভাবে জটিলতর ; আপাতদৃষ্টিতে এগুলি বিবিধ উৎস-জাত আচার অনুষ্ঠানের সংশ্লেষণ—তবে বিশেষ বিশেষ ঋতুযাগের অনুষ্ঠান ও চান্দ্র উৎসবগুলি বাদ দিলে কোন অনুষ্ঠানেরই বার্ষিক বা অন্য কোন সময়সীমা নির্দিষ্ট নেই। অঞ্চল ও পরিবার ভেদে অসংখ্য সামান্য রূপান্তর সহ যে বিপুল সাহিত্য ব্ৰাহ্মণ শাখায় গড়ে উঠেছিল, তা সংহিতার চেয়েও স্পষ্টতরভাবে তৎকালীন সমাজের সম্পূর্ণ চিত্রকে সংরক্ষণ করেছে। তখন সামাজিক শ্রেণীবিন্যাসে শূদ্র, দাস ও নারীর মর্যাদা অবনমিত হচ্ছে, পুরোহিতদের দক্ষিণার বৈচিত্র্য ও পরিমাণ স্ফীততর হচ্ছে এবং বর্ণভেদ ও শ্রেণীবিন্যাস ধীরে ধীরে শিলীভূত হয়ে পরস্পরবিচ্ছিন্ন বর্গে পরিণত হয়েছে। উচ্চতর বর্ণের লোকেরা সম্পদ কুক্ষিগত করে সমাজের সুবিধাভোগী অংশরূপে নিম্নবর্গের হতমান জনসমষ্টিকে শাসন করেছে। ব্রাহ্মণ গ্রন্থসমূহে আমরা প্রাসঙ্গিক ইতিহাস, ভূগোল, শিক্ষা, সামাজিক আচার ব্যবহার, নৈতিক মূল্যবোধ ও দার্শনিক মননের পরোক্ষ পরিচয় পাই। এই সব গ্রন্থের প্রাথমিক লক্ষ্য অবশ্যই বিভিন্ন যজ্ঞানুষ্ঠান। তবুও জনসাধারণের মধ্যে এই ধর্মচৰ্যার কিছু ভূমিকা ছিল বলে পরবতী যুগের সাহিত্য অপেক্ষা ব্ৰাহ্মণ গ্রন্থগুলিকে সামাজিক বাস্তবের অধিকতর প্রতিফলন ঘটেছে। কিন্তু যজ্ঞানুষ্ঠানগুলির অতিপল্পবিততাত্ত্বিক ব্যাখ্যা, ক্রমবর্ধমান জটিলতা ও ব্যয়বৃদ্ধি সাধারণ জনমানসে বিপরীত প্রতিক্রিয়ার অবিশ্বাস ও প্রতিরোধের জন্ম দিল এবং প্রত্যক্ষভাবে যজ্ঞ অনুষ্ঠানে অসমর্থ বিপুল সংখ্যক জনসাধারণ যজ্ঞের নির্বাক ও নিরাসক্ত দর্শকে পরিণত হল। জনমানসের কাছে যজ্ঞের ক্রমবর্ধমান জটিলতাকে বিশ্বাস্য করে তোলার প্রয়োজনে পুরোহিতেরা প্ৰত্যেক অনুষ্ঠানের অনুপুঙ্খকে প্রত্নকথা ও আদিকল্পের সঙ্গে সম্পর্কিত করে তুলতে চাইলেন। সৃষ্টিতত্ত্বও পাপপূণ্যের নির্দিষ্ট দার্শনিক ধারণার সঙ্গে সম্পর্কিত হওয়ার ফলে ব্ৰাহ্মণসাহিত্য সুপরিকল্পিতভাবে নিরর্থক ও রহস্য প্ৰন্থিল হয়ে উঠল যেমন পৃথিবীর সব ধর্মগ্রন্থেই ঘটেছে। কল্পকুহেলি সৃষ্টির সচেতন প্রবণতাকে যুক্তিসম্মত করে তোলার চেষ্টায় দেখা দিল শুষ্ক ও গতানুগতিক রচনাশেলী। ব্রাহ্মাণের বহুস্থানেই সমসাময়িক লোকজীবনের পরিবর্তনশীল অবস্থা প্ৰতিফলিত হয়েছে। অনেক রাজ্য, রাজ্যাধিপতি ও রাজকীয় পুরোহিতদের উল্লেখের সঙ্গে সঙ্গে শাসকশ্রেণীর রাজনৈতিক ও ধর্মীয় ক্ষমতারও কিছু কিছু বিবরণ এগুলিতে পাওয়া যায়। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে, ব্ৰাহ্মণসাহিত্যের প্রথম পৰ্যায় শেষ হওয়ার পরেই সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর মধ্যে দ্বন্দ্বের নিদর্শন দেখা দিচ্ছে। রাজন্যশক্তি ও ব্রাহ্মণদের মধ্যে যেমন দ্বন্দ্ব দেখা দিল তেমনি বিভিন্ন পুরোহিত পরিবারের মধ্যে অভিসামন্ত শক্তির ধারকদের মধ্যে এবং নবজায়মান বণিকশক্তি বৈশ্যদের সঙ্গে উচ্চতর দুটি শ্রেণীর দ্বন্দ্বও ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠল। সংহিতা যুগের সামাজিক সমন্বয়বোধ ক্রমশ ক্ষীয়মান হয়ে তখন নূতন ধরনের সমস্যাযুক্ত একটি নতুন সমাজব্যবস্থার সূত্রপাত হয়ে গেছে। যজ্ঞধর্ম প্রথমদিকে সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠায় সহায়ক হলেও পরবতী যুগের বহুমুখী জটিলতায় তার এই ভূমিকা আর রইল না। কেননা মুষ্টিমেয় বিত্তবান রাজা এবং ক্ষত্ৰিয় বংশজাত অভিজাত রাজন্যবর্গ ছাড়া অন্য কারো পক্ষেই যজ্ঞানুষ্ঠান করা সম্ভব ছিলনা। এই সব অনুষ্ঠান থেকে কেবলমাত্র রাজা ও বিত্তবান ক্ষত্রিয়রা প্ৰত্যক্ষ বা আধ্যাত্মিক লাভের আশা করতে পারতেন ; অন্যদিকে যজ্ঞ সম্পাদন করে পুরোহিত-সম্প্রদায় যথেষ্ট ধন উপার্জন করতেন, কিন্তু সাধারণ মানুষের কাছে তার কোন প্রত্যক্ষ প্রাসঙ্গিকতাই ছিল না। জনমানসকে অভিভূত করার জন্য প্রতিটি নূতন অনুষ্ঠানের ওপর অতিরিক্ত গুপ্ত রহস্যের দ্যোতনা আরোপ করা হতে লাগল এবং তাদের গ্রহণযোগ্য ও বিশ্বাস্য করে তোলার জন্য নুতন প্রত্নকথা ও উপাখ্যান আবিষ্কার করে ইন্দ্ৰজাল, রহস্য, আপাতযৌক্তিকতা এবং যজ্ঞের ফলবত্তার স্তুতি যজ্ঞবৰ্ণনার সঙ্গেই যুক্ত করা হয়েছিল। যজ্ঞ অনুষ্ঠানের যৌক্তিকতা, হিংস্রতা ও পশুহত্যার প্রয়োজনীয়তার সমালোচনা এবং যজ্ঞের উৎস, অনুষ্ঠান, পদ্ধতি ও যজ্ঞালব্ধ সুফল সম্পর্কে বিচিত্র উপাখ্যান যে আমরা ব্ৰাহ্মাণ-সাহিত্যের মধ্যেই পাই তাতে প্রমাণিত হচ্ছে যে আক্ষরিক ব্যাখ্যা জনসাধারণের কাছে অপ্রতুল ও অগ্রাহ্য বলে বিবেচিত হচ্ছে। ফলে, মুলে যা আধ্যাত্মিক ছিল না, তার আধ্যায়ীকরণের মধ্যে দিয়ে নূতন ধরনের এক তাৎপর্য অন্বেষণের সূত্রপাত হয়েছে। অভিনব মনস্তাত্ত্বিক সত্য রূপে ‘শ্রদ্ধা’র আবির্ভাবও অন্য এক ধরনের প্রত্নকথার জন্ম দিয়েছে, স্পষ্টতই এর একটা বাস্তব ভিত্তিভূমিও ছিল।

স্মরণ করা প্রয়োজন যে এই সময়েই মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে নৌবাণিজ্য দীর্ঘবিরতির পর পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ফলে নূতন বিশ্বাস, দেবতা, আচারচর্যা, প্রত্নকথা, উপাখ্যান, উপকথা, উপাসনা-পদ্ধতি, বৈজ্ঞানিক চিন্তা ও বহুবিধ সাংস্কৃতিক উপাদান মধ্যপ্ৰাচ্য ও তার মারফৎ ইয়োরোপ থেকে এদেশে এসে পৌঁছেছিল। লোহার লাঙলের ফলা ব্যবহারের ফলে পূর্বের তুলনায় অধিকতর কৃষিখামারের সংস্থান ব্যবস্থা সম্ভব হওয়াতে স্বল্প পরিমাণ হলেও ফসলের মজুত ভাণ্ডার গড়ে উঠেছি। ধাতুশিল্পজাত দ্রব্যের ব্যবসা এবং নৌবাণিজ্য ও অন্তর্বাণিজ্যলব্ধ সম্পদ কৃষিজাত সমৃদ্ধিকে বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছিল। কিন্তু এই সমস্ত সম্পাদই মুষ্টিমেয় ধনাঢ্য ব্যক্তির কোষাগারে পুঞ্জিত হচ্ছিল। বৃত্তিগত শ্রেণীবিন্যাস বেশ দ্রুত সম্প্রসারিত হচ্ছিল এবং বর্ণবিভাগও ক্রমশ কঠোরতর হয়ে উঠছিল, দরিদ্র পশুচারী ও কৃষিজীবী বৈশ্য এবং দরিদ্র শূদ্র ও দাসের যে বিপুল জনসাধারণ তারা শোষণের চাপে ক্রমে তলিয়ে গেল। সাহিত্য স্বৰ্গ ও নরক বর্ণনা দেখা দিল-স্পষ্টতই সম্পদশালী ব্যক্তির জীবনযাত্রার প্রতিফলন দেখা গেল স্বৰ্গকল্পনায় এবং অন্যদিকে অসহায় নিম্নবর্গীয় যন্ত্রনাদন্ধ জনতার নিপীড়ণের ছবি ফুটে উঠল নরক কল্পনায়। ধনী ও দরিদ্রের মধ্যবতী ব্যবধান ক্রমাগত প্রসারিত হওয়ার ফলে সর্বসাধারণের জীবন পরবর্তী সাহিত্য অকল্যাণ ও পাপের অভিব্যক্তির উৎস হয়ে উঠল। আমরা অবশ্য রাজসভাগুলিতে দার্শনিক আলোচনাসভা অনুষ্ঠিত হওয়ার বিবরণ পেয়েছি ; সেই সঙ্গে এই সময়ে অরণ্যবাসী তপস্বী আচার্য ও ভ্ৰাম্যমাণ সন্ন্যাসীদের দ্বারা নূতন এক মূল্যবোধ প্রবর্তিত হচ্ছিল যাতে যজ্ঞবিদ্যা বা অধ্যাত্মতত্ত্বের বিশ্লেষণ ও আলোচনা রয়েছে। যজ্ঞ-অনুষ্ঠান বিষয়ক অনুপুঙ্খ এবং আধ্যাত্মিক তাৎপর্যযুক্ত প্ৰত্নকথার ক্রমবর্ধমান প্রয়োগ এই নবজায়মান জীবনবীক্ষার পরিচয় বহন করে। এই সময়েই নূতন উপনিবেশ স্থাপনের জন্য বিন্ধ্যপর্বত অতিক্রম করে আর্যরা দক্ষিণাত্যের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। খনিজ সম্পদের আকর্ষণে পূর্বে ও দক্ষিণে নূতন বসতি গড়ে উঠে, নৌবাণিজ্যের পুনরাবির্ভাবে আরবসাগরের উপকূলবর্তী পশ্চিমাঞ্চলেও নূতন বসতির পত্তন হয়। সুপরিচালিত ধর্মসঙ্ঘের ব্যবস্থাপনা না থাকায় বিস্তৃত অঞ্চলব্যাপী বসতিগুলির মধ্যে সাংস্কৃতিক ঐক্য ও সামঞ্জস্য স্থাপন অসম্ভব হয়ে উঠে ছিল। উপরন্তু, সুবিধাভোগী ধনিকশ্রেণীর নৈতিকতা, মূল্যবোধ ও বিশ্ববীক্ষা থেকে জনসাধারণ ক্রমশ দূরবতী ও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। অনুমান করা যায় যে, অথর্ববেদে প্রাপ্ত লোক-বিশ্বাস ও প্ৰাকচারগুলি সাধারণ মানুষের মধ্যে ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। অবশ্য, বহুপ্রাচীন কাল থেকেই এই সব লোকচার লঘু ঐতিহ্যরূপে বিদ্যমান ছিল। জাদুঘর বা ‘শামন” পুরোহিতের ভূমিকা নিয়ে ঝাড়ফুঁক বশীকরণ মন্ত্র পাঠ করত, অলৌকিক জাদু দেখিয়ে নানারকম অনুষ্ঠান পরিচালনা করত এবং পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে দৈনন্দিন যে অজস্র আধি-ব্যাধি দুঃখ-দুৰ্দশা রয়েছে সেই সব পাঠ ও জাদু অনুষ্ঠানের সাহায্যে দূর করার চেষ্টা করত। বিভিন্ন জাতি গোষ্ঠীর মিশ্রণ এবং তজ্জনিত সাংস্কৃতিক সংশ্লেষণের ফলে প্রাগ্বৈদিক সিন্ধু সভ্যতা ও অন্যান্য পূর্বাঞ্চলীয় সংস্কৃতির আচার ব্যবহার, বিশ্বাস ও জীবনযাত্রার উপাদান আৰ্যসমাজে দীর্ঘকাল ধ’রেই স্থান পেয়ে আসছিল ; বৈদিক যুগের শেষ পর্যায়ে অর্থাৎ ঋগ্বেদ রচনার অস্তিমস্তর থেকে শুরু করে যজু ও অথর্ববেদ ব্ৰাহ্মণ সাহিত্যের মধ্যে দিয়ে আরণ্যক ও উপনিষদের কাল পর্যন্ত আর্যাবর্তে প্রকৃতপক্ষে দুটি স্বতন্ত্র ধর্ম প্রচলিত ছিল—একটি হল সমষ্টিগত যজ্ঞধর্মের বৃহৎ ও সম্ভ্রান্ত ঐতিহ্য অর্থাৎ সংহিতা ও ব্রাহ্মণসমূহে কথিত ধর্মবিধি, দ্বিতীয়টি হল দৈনন্দিন গাৰ্হস্থ-জীবনের অমঙ্গল-বিনাশকারী জাদুকর পুরোহিতদের ক্রিয়াকলাপসংবলিত লঘু ও গীেণ ঐতিহ্য। এই দুটি ঐতিহ্যের মধ্যে প্রত্যক্ষ কোন সংঘাত ছিল না বলে সুস্পষ্ট শ্রেণীভেদগত সামাজিক অবস্থানে এরা সমান্তরালভাবে সহাবস্থান করত।

যজ্ঞাগুলি যখন অত্যন্ত ব্যয়বহুল হয়ে উঠল এবং ঐহিক ফলদানে এদের নিরন্তর ব্যর্থতা যখন যজ্ঞ সম্বন্ধে জনসাধারণের আস্থা নষ্ট করছিল তখন সংশয়াচ্ছন্ন জনমানসে নুতন ধর্মচৰ্যা অন্বেষণের আগ্রহ দেখা দিল। ঐন্দ্রজালিক অনুষ্ঠানও যদি নিশ্চিত ফলের প্রতিশ্রুতি দিতে পারে না, তবু এতে কোন দেবতার হস্তক্ষেপ বা ব্যয়বহুল পুরোহিত্যতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনা এবং দীর্ঘকাল-ব্যাপী অনুষ্ঠানের জন্য দুর্মুল্য উপকরণ সংগ্রহের প্রয়োজন নেই। অন্যদিকে এই সব ক্ষেত্রে এমন উপাদান ব্যবহাত হয় যাদের প্রত্যক্ষ বিজ্ঞানসম্মত উপযোগিতা রয়েছে ; যেমন অথর্ববেদে কথিত জাদু অনুষ্ঠানগুলিতে এমন কিছু ওষধি ও ধাতু প্ৰযুক্ত হত যাদের ভেষজপরীক্ষিত গুণ আকাঙিক্ষত ফল দিতে সমর্থ। বিভিন্ন প্রকার ওষধি ও ধাতুর বৈজ্ঞানিক প্রয়োগের প্রাথমিক স্তর যেহেতু অথর্ববেদে দেখা দিয়েছিল, আমরা তাই এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে, বিজ্ঞানমনস্কতা ও সাংস্কৃতিক মননে অভূতপূর্ব উন্নতির পূর্বাভাস এরই মধ্যে সূচিত হয়েছিল।

এইভাবে ব্ৰাহ্মণ রচনার যুগে দুটি সমান্তরাল প্রবণতার অবস্থান বহিরঙ্গ ও অন্তৰ্ধত দিক দিয়ে ব্রাহ্মণ্যধর্মের ভবিষ্যৎকে ধ্বংস করতে উদ্যত হল। লোকায়ত লঘু ঐতিহ্য সেই বহিরঙ্গ দিকেরই প্রতিভূ যা অধিকতর গ্রহণযোগ্য একটি বিকল্পের সন্ধান দিতে পেরেছিল। খুবই তাৎপৰ্যপূর্ণভাবে সম্ভ্রান্ত বৃহৎ ঐতিহ্যের অস্তিম পর্যায়ে লঘু ঐতিহ্যের উপাদানগুলি আত্মসাৎ করে নিয়েছিল। অন্তধৃত উপাদানের প্রভাবে যজ্ঞধর্ম নিরস্তর জটিলতর হয়ে ওঠায় একসময় তা জনসাধারণের আয়ত্তের বাইরে চলে গেল এবং ফলে সংশয় ও প্রশ্নের আবির্ভাবে, স্বভাবত স্পষ্ট ও অপ্রতীকী বিষয়বস্তুকে প্ৰতীকায়িত করে তোলার প্রবণতা দেখা দিল, কিন্তু রহস্য আবরণ নির্মাণের এই চেষ্টা যজ্ঞকে আধ্যাত্মিক ব্যঞ্জণাগৰ্ভ করে তোলায় তা সম্পূর্ণতই জনসাধারণের বোধ্যাতীত হয়ে উঠল। প্রতীকী ব্যাখ্যা প্রাধান্য লাভ করায় মূল অনুষ্ঠান তাৎপৰ্যহীন হয়ে কাৰ্যত পরিহার্য বিবেচিত হল ; এতে যজ্ঞধর্মের ভবিষ্যৎও চিরকালের মত নির্ধারিত হয়ে গেল। ব্রাহ্মণসাহিত্যে যজ্ঞধর্ম চুড়ান্তে শীর্ষবিন্দুতে উপনীত হয়ে তারপরে অবধারিত ধ্বংসের পথে ক্ৰমান্বয়ে গিয়ে আপন মহিমা থেকে বিচ্যুত হল। আপাতদৃষ্টিতে যদিও যজ্ঞানুষ্ঠান চলতে থাকলে, দুটি স্তরে প্রতিস্রোত প্রবহমাণ ছিল : বিরুদ্ধবাদী চিন্তাবিদদের মধ্যে ও নিম্নবগীয় জনসাধারণের মধ্যে। বস্তুত বৈদিক যুগের শেষ পর্যায়ে যে নব্যচিন্তার সূত্রপাত হল তার দ্বারাই উপনিষদের মতো স্বতন্ত্র ধারার সৃষ্টি সম্ভবপর হয়ে উঠেছিল, প্রথমোক্ত বিরুদ্ধবাদী মনস্বীদের গোষ্ঠী তারই ফলশ্রুতি। অন্যদিকে, শেষোক্ত সাধারণ মানুষের মধ্যে সমান্তরাল ধর্মীয় আন্দোলনের ফলেই অথর্ববেদ আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি লাভ করেছে, এই আন্দোলন ধীরে ধীরে কিন্তু নিশ্চিত পদক্ষেপে অগ্রসর হওয়াতেই ব্ৰাহ্মণ্যধর্ম আমূল রূপান্তরিত হয়ে পৌরাণিক হিন্দুধর্মে পরিণত হয়েছে। এই প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ হতে যদিও দীর্ঘকাল লেগেছে, তবু যজ্ঞধর্মের আংশিক বিপরীত প্রতিক্রিয়া রূপে নূতন এই ধারার আভাস ব্রাহ্মণসাহিত্যের যুগেই পরিস্ফুট হয়েছিল। প্রাচীন বৈদিক সংস্কৃতি কয়েক শতাব্দী ধ’রে কিছু কিছু জনপ্রিয় বিশ্বাস ও সংস্কারকে আত্মস্থ করে নিয়েছিল ; কিন্তু, ক্রমশ যজ্ঞের মধ্যবতী ভারসাম্য ভেঙে গেলে এবং পৌরাণিক যুগে সম্পূর্ণ নূতন স্তরে অভিনব সংশ্লেষণ না হওয়া পর্যন্ত এদের মধ্যে ব্যবধান ক্রমাগত বাড়তেই লাগল।

নব্যচিন্তার প্রকৃত অভিব্যক্তিরূপে আরণ্যক ও উপনিষদ শ্রেণীর গ্রন্থসমূহ ব্ৰাহ্মণসাহিত্যের অব্যবহিত-পরবতী উত্তরসূরী হয়ে উঠল। ব্ৰাহ্মণগুলিতে যে সমস্ত প্রবণতা সূত্রাকারে নিহিত এবং যেসব অর্থনৈতিক সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উপাদানসমূহ উপস্থিত ছিল, পরবর্তী যুগে তৎপ্রসূত আন্দোলন কেবল আরো বেগবান ও স্পষ্টতরই হল। ধর্মীয় চিন্তাধারায় এর ফলে কিছু গুণগত পরিবর্তন দেখা দিল। কিছুদূর অবধি ধারাবাহিকতা বজায় থাকলেও পরিবর্তনই ততক্ষণে বেশি তাৎপর্যবহ হয়ে উঠেছে। কেননা এই পরিবর্তন ছিল মৌলিক। আধ্যাত্মিক দৃষ্টিভঙ্গি সম্পূর্ণভাবে বদলে গেল ; ঋগ্বেদে জীবনই আকাঙিক্ষত সেই সম্পদ যাকে যতক্ষণ সম্ভব আকণ্ঠ ভোগ করতে হবে এবং সমস্ত বস্তুগত ও আধ্যাত্মিক প্রয়াস মানুষকে এই লক্ষ্য পূরণের অভিমুখেই প্রচারিত করবে। কিন্তু নুতন যুগে জীবন অনিবাৰ্য অবিমিশ্র অমঙ্গল বলে গণ্য হল, তাই জীবন থেকে পলায়নই হল তখন একমাত্র লক্ষ্য। তাছাড়; জীবন শুধু প্রত্যক্ষগোচর ইহলৌকিক সীমায় এখন আর আবদ্ধ রইল না ; মানুষের কাজের ভাল-মন্দ, পাপ-পূণ্যের ফল, আনন্দ ও যন্ত্রণাররূপে তা অবশ্যভোগ্য। এই সিদ্ধান্ত দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য সৃষ্ট হল জন্ম-জন্মান্তরের এক অবিচ্ছিন্ন কল্পনা। এই শৃঙ্খল ভঙ্গ করাই হয়ে উঠল মানুষের চরম আধ্যাত্মিক লক্ষ্য। সংহিতা ও ব্রাহ্মণের যুগে জাগতিক অভীষ্ট লাভের এই ছিল উদ্দেশ্য এবং যজ্ঞানুষ্ঠানই ছিল তার সিদ্ধির একমাত্র উপায় ; কিন্তু এমন কর্ম ও জন্মান্তরের অবিচ্ছেদ্য পরম্পরা ছিন্ন করার পক্ষে যজ্ঞ সম্পূর্ণ অপর্যাপ্ত বলে বিবেচিত হল। বস্তুত যজ্ঞ নিজেই কর্ম হওয়াতে এই যুগে তা হানিকর রূপেই গণ্য হল। জন্মান্তর-গ্রন্থি চিরতরে মোচন করার জন্যই কর্ম রুদ্ধ হওয়া প্রয়োজন। এই যুগেই সর্বপ্রথম দেহ ও আত্মা, বস্তু ও ভাবনার মধ্যে স্পষ্ট বিভেদ প্ৰদৰ্শিত হল ; সম্ভবত যাজ্ঞবল্ক্যই এই চিন্তাধারার প্রথম প্ৰবক্তা।

ব্ৰাহ্মণসমূহের শ্রেষ্ঠ অধিবিদ্যাসূচক অংশে যে ঐতিহ্যের স্ফূরণ ঘটেছিল, সাহিত্য হিসাবে আরণ্যক ও উপনিষদ তারই উত্তরসূরী। যেহেতু ঋষিকবিগণ আত্মাকে পরমাত্মার সঙ্গে অভিন্নরূপে উপলব্ধি করলেন, কাব্যিক অভিব্যক্তিতে এল গাঢ়তা ও উদ্বেলতা ; কল্পনার অভূতপূর্ব প্রসার আত্মা ও ব্রহ্মের বিচিত্র বিশ্লেষণে যুক্ত করল আশ্চর্য দীপ্তি, গভীরতা ও মহিমা। নূতন যুগের সাহিত্য মূলত বোধিনির্ভর ; সবচেয়ে তাৎপৰ্যপূর্ণ বিতর্ক রচিত হয়েছে সেইসব বাজা, ঋষি কিংবা মুনিসঙ্ঘের মধ্যে, তৎকালীন সমাজের কাছে যাদের ভাবমূর্তিতে আধ্যাত্মিক দীপ্তি ছিল বিশেষভাবে উজ্জ্বল। কিন্তু ব্ৰাহ্মণ-সাহিত্যের অধিকাংশই যজ্ঞানুষ্ঠানবিষয়ক শুষ্ক, নিম্প্রভ ও গতানুগতিক নির্দেশাবলীতে পরিপূর্ণ—তখনকার সমাজের কাছে এদের প্রাসঙ্গিকতা যেন প্রশ্নাতীত। এদের মধ্যে আমরা সমাজব্যবস্থার নির্ভরযোগ্য চিত্র খুঁজে পাই ; এমনকি, প্রত্নকথাগত কল্পনার প্রকাশগত আভাসও এতে রয়েছে—কিন্তু প্ৰকৃত আত্মিক অন্তর্দৃষ্টির নিদর্শন এতে খুব বিরল। পক্ষান্তরে, আরণ্যক এবং উপনিষদ মোটেই পুরোহিতকেন্দ্ৰিক সাহিত্য নয়। এগুলি প্রথমদিকে যজ্ঞের প্রতীকী ব্যাখ্যা দিয়ে তারপর যজ্ঞকে বর্জন করে আধ্যাত্মবিদ্যার বিমূর্ততর ক্ষেত্রে নিবিষ্ট হয়েছে। বস্তুত নব্যচিন্তার উদগাতা হিসাবে এদের প্রকৃত তাৎপর্য এখানেই নিহিত। অত্যন্ত বাস্তব অর্থের দিক দিয়েই আরণ্যক ও উপনিষদগুলি পূর্ববতী যুগবাহিত মূল্যবোধকে সুনির্দিষ্টভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে। এই যুগের কবিতা নিগুঢ় তাগিদে সম্পূর্ণ নিজস্ব স্বতন্ত্র এক কাব্যভাষা নির্মাণ করেছে-এই নিবিড় শক্তিশালী ও যথাযোগ্য রচনাশৈলী মনোজ্ঞ চিত্রকল্প মণ্ডিত হয়ে কাব্যে এমন সৌন্দৰ্য সঞ্চার করেছে যে, একমাত্র ঋগ্বেদ ও অথর্ববেদের কিছু কিছুমন্ত্রের সঙ্গেই তা প্রতিতুলনীয়। ঋষিকবির অভিজ্ঞতা সম্পূর্ণ নূতন ছিল বলেই অভিব্যক্তি আশ্চর্য দ্যুতিমান হতে পেরেছে। মানুষের আধ্যাত্মিক স্বরূপের সন্ধানে যথার্থ আন্তরিক আকৃতি ছিল বলে চিত্রকল্পে অভিনব গতি ও সৌষ্ঠব বারংবার সঞ্চারিত হয়েছে। পূর্ববতী সাহিত্যের মতো ধর্মীয় রচনা তখন আর একই রকম রইল না, তবু সাধারণ দৈনন্দিন জীবনের ঘটনা ও চিত্র এখনও অনেক পাওয়া যায় ; নিম্নবর্গীয় জীবনের দারিদ্র, মালিন্য ও বৈচিত্র্যহীনতাই উচ্চমার্গীয় আধ্যাত্মিক আলোচনাচক্রের বাস্তব পরিপ্রেক্ষাটি নির্মাণ করছিল। সাধারণ পার্থিব প্রয়োজনের প্রতি কোন উন্নাসিক অবজ্ঞা বা উপেক্ষা নেই ; তবে ব্রহ্মের তুলনায় এই সব জাগতিক বাস্তব সত্য, তাই যজ্ঞ এখন অনেক কম গুরুত্বপূর্ণ। অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধির ভাববাদী দ্বান্দ্বিকতা অনিবাৰ্যভাবে বাস্তব সম্পর্কে দ্বিমুখী প্রবণতার জন্ম দিয়েছে। কিন্তু এখনও তা সর্বব্যাপী বা স্পষ্টভাবে অভিব্যক্ত নয় ; কেননা এই পর্যায়ে উপনিষদের যাত্রা আরম্ভ হয়েছে, শঙ্করাচার্যের বেদান্ত দর্শন তখনও অনেক দূরে। কিন্তু স্পষ্ট শ্রেণী বিভাজন এবং বিত্তহীন উৎপাদক ও বিত্তবান ভোক্তার মধ্যেও অনতিক্রম্য সামাজিক ব্যবধান সৃষ্টি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কর্ম ও জ্ঞানের দুই দৃষ্টিভঙ্গির সুস্পষ্ট ভেদরেখা চিহ্নিত হয়ে গেল ; তারই সূত্র ধরে চিন্তাক্ষেত্রে ভাববাদী অধ্যাত্মবিদ্যার ক্ষেত্ৰ প্ৰস্তুত হল এবং দেখা দিল বস্তু ও ভাব, দেহ ও আত্মার মধ্যে দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক। চরিত্রগতভাবে যাজক-তান্ত্রিক হয়েও ব্রাহ্মাণ-সাহিত্য এমন এক ধর্মমতের প্রতিনিধিত্ব করেছিল যাতে অন্তত কিছুদূর পর্যন্ত সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ সম্ভবপর ছিল ; কিন্তু উপনিষদের ধর্ম ও দর্শন ছিল অপেক্ষাকৃত নিরাবয়ব এবং কঠোরভাবে সংরক্ষণশীল–মূলত তা সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবে শ্রদ্ধাভাজন বিদ্বৎসমাজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল।

উপনিষদের পরবতীকালে সাহিত্য নামে সূত্রসাহিত্য পরিচিত এর অপর নাম বেদাঙ্গ। ছয়টি বেদাঙ্গের মধ্যে রয়েছে : শিক্ষা, ব্যাকরণ, ছন্দ, জ্যোতিষ, নিরুক্ত ও কল্প। শেষোক্ত কল্পসূত্রে আবার চারটি উপবিভাগ রয়েছে : শ্রৌত (সামূহিক যজ্ঞ অনুষ্ঠানের বিধি), গৃহ (দৈনন্দিন ও পারিবারিক আচার অনুষ্ঠানের নিয়ম), ধর্ম (সামাজিক বৰ্ণাশ্রম ধর্মের বিধি) এবং শুল্ব(বেদী নির্মাণের প্রয়োজনীয় জ্যামিতি)। এই ছয়টি বেদাঙ্গেরই সাধারণ একটি ভাষাগত আঙ্গিক রয়েছে : অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত ও যথাযথ সূত্রনিবদ্ধ গদ্যে এইগুলি রচিত এবং চূড়ান্ত শব্দসংক্ষেপ। এগুলির প্রত্যেকের বিশিষ্ট লক্ষণ। অবশ্য বেদাঙ্গগুলির রচনাশৈলী বিষয়ভেদে পরস্পর থেকে ভিন্ন ; কোথাও শব্দগত শব্দপ্রয়োগগত কঠোরতা বেশি, কোথাও বা কম ; কোথাও বা গদ্য রচনার মধ্যেই কিছু কিছু শ্লোক ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত, কোথাও বা গদ্যে সুস্পষ্ট ভাবেই ব্ৰাহ্মণসাহিত্যের প্রতিধ্বনি। স্বচ্ছতা, যথার্থতা ও গুরুত্ব আরোপের প্রয়োজনে মাঝে মাঝে চিত্রকল্প ব্যবহৃত হলেও কোন বেদাঙ্গই সাহিত্যিক ঔৎকর্যের জন্য প্ৰয়াসী নয়। এগুলি নিঃসন্দেহে প্ৰধান যাজক পরিবারগুলির মধ্যে মৌখিক সাহিত্যরূপে রচিত ও সংরক্ষিত হয়ে শিক্ষক-ছাত্র পরম্পরায় এক প্ৰজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে হস্তান্তরিত হত। বেদাঙ্গগুলিতে কিছুমাত্র সাহিত্যিক মূল্য নেই এবং এই নেতিবাচক সাহিত্যের দিক থেকে বৈদিক সাহিত্যের ইতিহাসে তাদের অনন্য করে রেখেছে; বেদাঙ্গের আর একটি বৈশিষ্ট্য হল এই যে বেদাঙ্গ কখনোই নিজেকে অপৌরুষেয় বলে দাবি করে নি। যজ্ঞানুষ্ঠানের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পূক্ত হয়েই বেদাঙ্গগুলি রচিত হলেও ব্যাকরণ, নিরুক্ত (অর্থাৎ বুৎপত্তি শাস্ত্র) জ্যোতির্বিদ্যা, জ্যামিতি এবং ছন্দঃশাস্ত্রের মতো নিরীক্ষাধর্মী বৈজ্ঞানিক অনুশীলনের সূত্রপাত এদেরই মধ্যে। অল্পকাল পরেই বৈদিক অনুষ্ঠানের সঙ্গে এই সমস্ত বৈজ্ঞানিক প্রবণতার সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায় এবং ধর্মনিরপেক্ষ বিজ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে এই বিষয়গুলি স্বতন্ত্র ক্রমবিবর্তন শুরু হয়।

সন্দেহ নেই, বেদাঙ্গ ধারার মধ্যেই শেষের বিবর্তন শুরু হয়ে গিয়েছিল ; সেই বিশেষ পরিপ্রেক্ষিতে এদের উদ্ভবে বৈদিকধর্মের ভিত্তিমূল শুধু কম্পিতই হয় নি, প্রকৃতপক্ষে অতি দ্রুত শিথিল ও স্খলিত হচ্ছিল। পূৰ্বযুগের ধর্মবিশ্বাস যখন সম্পূর্ণ অপ্রচলিত ও প্রত্যাখ্যাত সেইসময় বেদাঙ্গ রচনার মধ্য দিয়ে সেই ধর্মীয় সাহিত্যধারার বোধ ও বিশ্বাসের কালসীমা প্রসারণের একটি প্রাণপণ প্ৰয়াস হয়েছিল। সেই সময় বৌদ্ধধর্ম, জৈনধর্ম, আজীবিক ধর্ম এবং অন্যান্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ধর্মীয় প্রশাখার উদ্ভব যেমন পূর্ব যুগের ধর্মচৰ্যার জীবনীশক্তিকে শুষে নিয়েছিল তেমনি বহিরাগত আক্রমণকারীদের আবির্ভাব সামাজিক ও রাজনৈতিক স্তরে একটি তুমুল আবর্তেরও সৃষ্টি করেছিল। এরই পাশাপাশি জাতিভেদ প্ৰথা ক্রমেই জটিল ও কঠোর হয়ে উঠছিল। সমুদ্রপথে বাণিজ্যের মাধ্যমে বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে যোগাযোগ গ্রামীণ সমাজের মধ্যে আর কোন নূতন সুস্থ শোণিতধারা সঞ্চালন করতে পারে নি। কেননা বণিক সমাজের প্রতিনিধিরা গ্রামের কৃষক ও কারুশিল্পীদের শ্রমশক্তি শোষণ করত, কিন্তু সর্বদাই তাদের গ্রামের প্রাথমিক স্বয়ংসম্পূর্ণতা ও বিচ্ছিন্নতার মধ্যে অজ্ঞানের অন্ধকূপে নিমজ্জিত রাখত। যে অর্থনৈতিক ও উৎপাদন ব্যবস্থায় যজ্ঞধর্ম বর্ধিষ্ণু হতে পারত, ইতিমধ্যেই তা অপ্রচলিত হয়ে পড়েছিল। এইজন্য উপনিষদে তখনই নব্যচিন্তা অভিব্যক্ত হতে পারল, যখন তাদের বোধিদীপ্ত পরিপ্রেক্ষা ও অনুষ্ঠানবিরোধী ভূমিকা আচারমূলক যজ্ঞধর্মের সজীবতাকে হরণ করে নিল-ভাবাদর্শের ক্ষেত্রে তখন এক বিপুল শূন্যতার সৃষ্টি হল। তৎকালীন চিন্তাবিদরা অনুমান করতে পারছিলেন যে বৈদিক যজ্ঞধর্ম আর সামাজিকভাবে যুক্তিগ্রাহ্য কিংবা অর্থনৈতিকভাবে সমর্থনযোগ্য থাকবে না, তাই তাদের প্রাথমিক প্ৰয়াস ছিল সম্পূর্ণ যজ্ঞবিধিকে যথাযথভাবে এবং যতদূর সম্ভব সংক্ষিপ্ত আকারে সংরক্ষণ করার জন্যই! সূত্র-সাহিত্যের জন্ম এভাবেই ; এগুলি কোন কবি বা ধর্মতত্ত্ববিদের রচনা নয়-সাধারণভাবে সেইসব পেশাদার পুরোহিত ও যজ্ঞবিদ্যার গবেষকগণই সূত্র প্রণয়ন করেছিলেন, যাঁরা লক্ষ্য করেছিলেন বৈদিক বিদ্যাচর্চার অধোগতি, মৌলিক গ্ৰন্থসমূহের বিদূষণ, যজ্ঞ-অনুষ্ঠানে ক্রমবর্ধমান ত্রুটিবিচ্যুতির হার, মন্ত্রের ত্রুটিপূর্ণ উচ্চারণ এবং দেখছিলেন অনুষ্ঠানের বাহ্যিক দিক সম্পর্কে অজ্ঞতা-হেতু মূলপাঠের প্রকৃত তাৎপর্য অনুধাবনে অক্ষম পুরোহিতের ভুল উচ্চারণে মন্ত্র আবৃত্তি ও ভুল পদ্ধতিতে যজ্ঞ পরিচালনা।

সূত্ৰ-সাহিত্যের পরিপ্রেক্ষিত তীব্র রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আলোড়নের সাক্ষ্য বহন করছে-একদিক্ৰমে বহু বৈদেশিক আক্রমণের ফলে অসংখ্য নূতন নূতন জনগোষ্ঠী। উত্তর ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে বসতি স্থাপন করছিল এবং সেই সঙ্গে নিয়ে এসেছিল অপরিচিত ধর্মবিশ্বাস, সামাজিক ব্যবহারবিধি ও সংস্কার। তৎকালীন শিল্পে ও সাহিত্যে এই ঐতিহাসিক ঘটনাপ্রবাহের প্রভাব অসামান্য গুরুত্ব ও গভীরতা সঞ্চার করেছিল। সেই সময় দেখা গেল তৎপর বৈদেশিক বাণিজ্য, গান্ধার ও মথুরা শাখার শিল্পকলা, বৌদ্ধধর্মের হীনযান থেকে মহাকাশযান উত্তরণ ও তার সঙ্গে বিপুল এক সাহিত্যসম্ভারের উত্থান। রচিত হল মহাভারত ও রামায়ণ, ‘মহাবস্তু’ ও ‘ললিতবিস্তর’, আর, সেই সঙ্গে বাৎস্যায়ন, পতঞ্জলি, অশ্বঘোষের গ্ৰন্থরাজি। সেই যুগের তাম্রলিপিসমূহে ধ্রুপদী রচনাশৈলীর সূত্রপাত হল, ভূমিদানপত্র ও তাম্রলিপিতে নুতন ভূমিব্যবস্থার বিবরণ পাওয়া গেল। সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ এই তথ্য যে, এটাই হল অভিপৌরাণিক যুগ ; ঠিক পরের যুগেই ধর্মীয় সাহিত্যের নূতন ধারা অর্থাৎ পুরাণ-সাহিত্যের রচনা আরম্ভ হল। তবে, পুরাণের প্রকৃত পূর্বসূরী হচ্ছে দুটি আর্য মহাকাব্যের নায়কের জীবনী ; রামায়ণে রাম এবং মহাভারতে কৃষ্ণ, সেইসঙ্গে মহাবস্তু ও ললিতবিস্তরে বুদ্ধও। আসলে এ যুগ হ’ল আঞ্চলিক দেবতার ক্রমে দেবাদিদেব উন্নয়নের যুগ। অবশ্য নুতন সাহিত্যধারার সূচনার পূর্বে আদিম ধর্মবোধের পুনরুত্থান ঘটেছিল ; কেননা, উপনিষদ ও বৌদ্ধশাস্ত্রের দুর্বোধ্য তত্ত্ব সাধারণ মানুষের আয়ত্তের বাইরে ছিল। যেহেতু প্ৰকৃতি শূন্যতা সহ্য করতে পারে না, তই লঘু ঐতিহ্যের অন্তর্বতী ধর্মবিশ্বাস আবার সামাজিক চেতনার বহিঃস্তরে আত্মপ্রকাশ করল এবং যুক্তিসিদ্ধ উপন্যাস-পদ্ধতি রূপে গৃহীতও হল। বস্তুত, এতদিন তা আর্য ও অনার্য জনগোষ্ঠীর সামূহিক অবচেতনায় অন্তঃসলিলা ধারারূপে বিদ্যমান ছিল। তাই সূত্রসাহিত্য যদিও প্রকাশ্যভাবে বৈদিক ধৰ্মচর্যাকে ঘনীভূত ও সংক্ষিপ্তাকারে লিপিবদ্ধ করেছে, তবুও বেদাঙ্গের মাঝে মাঝেই অবৈদিক দেবতা ও পূজার আচার অনুষ্ঠান প্রাধান্য পেয়েছে।

বৈদিক সাহিত্যের সক্রিয় রচনার কাল প্ৰায় দেড় হাজার বছর। সাহিত্যের দৃষ্টিকোণ থেকে সৃজনশীলতার চূড়ান্ত সিদ্ধি ঘটেছিল প্রারম্ভিক ও অন্তিম পর্যায়ে অর্থাৎ ঋগবেদ ও উপনিষদের রচনাসময়ে। অথর্ববেদের কিছু মন্ত্র ছাড়া অন্য কোন সংহিতাই কোন মর্মস্পশী উপলব্ধি, উন্নতস্তরের ভাবনা বা তাৎপৰ্যপূর্ণ অভিজ্ঞতা উপহার দিতে পারে নি। ব্ৰাহ্মণ-সাহিত্য যৎসামান্য কিছু স্মরণীয় কাব্যাংশ যদিও পাওয়া যায়, তবুও এই ধারার বিপুল পরিধির তুলনায় পরিমাণগতভাবে তা খুবই নগণ্য। যজুর্বেদ, সামবেদ, অথর্ববেদের অধিকাংশ, ব্ৰাহ্মাণ-সাহিত্যের বিশাল পরিসর এবং সমগ্ৰ বেদাঙ্গসূত্র সম্পূর্ণই অকাব্যিক ; আনুষ্ঠানিক প্রয়োজনপিন্ধি ও পার্থিব সমৃদ্ধি লাভের উদ্দেশে এবং যজ্ঞানুষ্ঠানের যথাযথ জ্ঞান ও প্রয়োগের জন্য এইগুলি রচিত। সুতরাং স্বভাবধর্মেই এই রচনাগুলি প্রয়োগবাদী, গদ্যধর্মী ও প্রেরণাহীন।

ঋগ্বেদ থেকে উপনিষদের কালে উপনীত হতে গিয়ে আক্রমণকারী আর্যদের সহজ যাযাবর পশুচারী সামাজিক অবস্থান এবং ভারতবর্ষের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবন আমূল পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছিল। কৃষিনির্ভর ও একটি জটিল মুদ্রা-ব্যবহারী অর্থনীতি, কুটিরশিল্প ও বাণিজ্যনীতি পশুপালক সমাজের পুরাতন অর্থব্যবস্থার স্থান অধিকার করে নিল। আর্যদের সঙ্গে প্রাগার্য ও অনার্য জনগোষ্ঠীর সংমিশ্রণে আদিম কৌম সমাজের পরিবর্তে ক্ৰমে ক্ৰমে পূৰ্ণবিকশিত শ্রেণীবিভক্ত সমাজব্যবস্থার পত্তন হল ; পিতৃতান্ত্রিক পরিবারই এই সামাজিক কাঠামোর প্রাথমিক ভিত্তি। অবৈদিক ও অনাৰ্য উৎসজাত লোকপ্ৰিয় বিশ্বাস ও ধর্মচৰ্যার বিচিত্র উপাদান আত্মসাৎ করেই পূর্ববতী সরল যজ্ঞনির্ভর বৈদিক ধর্ম থেকে সংশ্লেষণ-প্রবণ অভিপৌরাণিক ধর্ম জন্ম নিয়েছিল। ভারতীয় জীবনের বিচিত্র ক্ষেত্রে ভিন্নমুখী পরিবর্তনের স্তরগুলি বৈদিক সাহিত্যের বিপুল পরিসরে প্রতিফলিত হয়েছে ; দেড়হাজার বছর ধ’রে ভারতীয় জীবনযাত্রা ও চিন্তাধারায় নিরন্তর বিবর্তনের প্রামাণিক সাক্ষ্যরূপে তার স্থান অনস্বীকার্য। স্পষ্টতই তখনকার সমাজে যারা যাজকতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক প্রাধান্য ভোগ করত, সাহিত্য মুখ্যত তাদেরই চিন্তা, স্বাৰ্থ, আচার-ব্যবহার, দৃষ্টিভঙ্গি এবং সমাজের বাকি অংশের জন্য পরিকল্পিত রীতিনীতির প্রতিফলন হয়েছিল। তবু পরোক্ষভাবে সমগ্র সমাজের প্রতিচ্ছবিও কিছু এতে রয়ে গেছে। তাছাড়া ১২০০ খ্রিস্ট-পূর্বাব্দে বৈদিক আৰ্যদের এদেশে আগমণের সময় থেকে ৬০০ খ্রিস্ট-পূর্বাব্দে লিখিত সাহিত্যের আবির্ভাবের সময় পর্যন্ত ভারতীয় সাহিত্যের একমাত্র নিদর্শনই হবে বেদ ; আর, কেবলমাত্র এই জন্য তা অমূল্য। সেই সঙ্গে ইন্দো-ইয়োরোপীয় পরিবারের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ভাবনা ও আচরণের প্রথম পূর্ণাঙ্গ দলিল রূপে বৈদিক সাহিত্য এক অসামান্য গীেরবময় আসনের অধিকারী।

Book Content

১. ঋগ্বেদ সংহিতা – প্রথম অধ্যায় 32 Topics
Lesson Content
0% Complete 0/32 Steps
০১. ঋগ্বেদ
০২. রচনাকাল
০৩. ভাষ্যকার
০৪. সূক্তসমূহের প্রকৃতি ও কাঠামো
০৫. স্তোত্রগীতি সম্বন্ধে ঋষিকবিদের দৃষ্টিভঙ্গি
০৬. রচনা প্রকরণ
০৭. সূক্তের শ্রেণীবিভাগ
০৮. সংবাদসূক্ত
০৯. দানস্তুতি
১০. বালখিল্য
১১. খিলসূক্ত
১২. অন্যান্য সূক্তাবলী
১৩. নিবিদ্‌
১৪. আপ্রী সূক্ত
১৫. সোমমণ্ডল
১৬. সর্বেশ্বেরবাদ
১৭. একেশ্বরবাদ
১৮. উপাখ্যান ও প্ৰহেলিকা
১৯. সূর্যাসূক্ত
২০. দূতকারের অনুশোচনা
২১. যমসংহিতা
২২. মণ্ডূকসূক্ত
২৩. রাত্রিসূক্ত ও অরণ্যানীসূক্ত
২৪. ঋগ্বেদ : লোকায়ত না ধর্মসাহিত্য?
২৫. রচনারীতি : ভাষা
২৬. স্বর
২৭. মৌখিক সাহিত্যরূপে ঋগ্বেদ
২৮. চিত্রকল্প
২৯. বৰ্ণনা
৩০. ধর্ম ও দর্শন
৩১. নীতিবোধ
৩২. প্ৰত্নকথা
২. সামবেদ সংহিতা – দ্বিতীয় অধ্যায় 6 Topics
Lesson Content
0% Complete 0/6 Steps
০১. সামবেদ সংহিতা
০২. ছন্দ ও ভাষা
০৩. ধ্বনি ও স্বরগ্রাম
০৪. সামবেদ ও সোমযাগ
০৫. চন্দ্ররূপে সোম
০৬. সামবেদের উৎস
৩. যজুর্বেদ সংহিতা – তৃতীয় অধ্যায় 7 Topics
Lesson Content
0% Complete 0/7 Steps
০১. যজুর্বেদ সংহিতা
০২. রচনাকাল
০৩. বিষয়বস্তু
০৪. অনুষ্ঠান চৰ্যা
০৫. সমাজ
০৬. আঙ্গিক ও ভাষা
০৭. ইন্দ্ৰজাল
৪. অথর্ববেদ সংহিতা – চতুর্থ অধ্যায় 16 Topics
Lesson Content
0% Complete 0/16 Steps
০১. পাঠভেদ (অথর্ববেদ সংহিতা)
০২. মূলপাঠ (অথর্ববেদ সংহিতা)
০৩. রচয়িতা (অথর্ববেদ সংহিতা)
০৪. বিষয়বস্তু (অথর্ববেদ সংহিতা)
০৫. বৈদিক ঐতিহ্যে অথৰ্ববেদের অস্বীকৃতি
০৬. রচনাকাল (অথর্ববেদ সংহিতা)
০৭. সূক্তসমূহের শ্রেণী বিন্যাস
০৮. সমাজ (অথর্ববেদ সংহিতা)
০৯. দেবসঙ্ঘ
১০. দর্শন (অথর্ববেদ সংহিতা)
১১. ব্রাত্য সূক্ত
১২. মৃগার ও কুন্তাপসূক্ত
১৩. ধর্মবিশ্বাস
১৪. ইন্দ্ৰজাল বা জাদু
১৫. আঙ্গিক ও ভাষা
১৬. কাব্যগুণ (অথর্ববেদ সংহিতা)
৫. ব্রাহ্মণ – পঞ্চম অধ্যায় 17 Topics
Lesson Content
0% Complete 0/17 Steps
০১. ব্রাহ্মণ
০২. পাঠভেদ (ব্রাহ্মণ)
০৩. গৌণরচনা (ব্রাহ্মণ)
০৪. আঙ্গিক ও ভাষা (ব্রাহ্মণ)
০৫. দেবকাহিনী
০৬. ইন্দ্ৰজাল বা জাদু
০৭. দেবসঙ্ঘ
০৮. সমাজ (ব্রাহ্মণ)
০৯. ইতিহাস (ব্রাহ্মণ)
১০. রাজ-পদবী
১১. অর্থনীতি (ব্রাহ্মণ)
১২. পরিবার (ব্রাহ্মণ)
১৩. নারী (ব্রাহ্মণ)
১৪. জাতিভেদ (ব্রাহ্মণ)
১৫. সামাজিক আচার (ব্রাহ্মণ)
১৬. দেবতা ও অসুর
১৭. নীতিবোধ (ব্রাহ্মণ)
৬. আরণ্যক – ষষ্ঠ অধ্যায় 6 Topics
Lesson Content
0% Complete 0/6 Steps
০১. আরণ্যক
০২. বিষয়বস্তু (আরণ্যক)
০৩. আঙ্গিক (আরণ্যক)
০৪. সমাজচিত্র (আরণ্যক)
০৫. দেবসঙ্ঘ (আরণ্যক)
০৬. জ্ঞান ও জ্ঞানতত্ত্ব
৭. উপনিষদ – সপ্তম অধ্যায় 15 Topics
Lesson Content
0% Complete 0/15 Steps
০১. উপনিষদ
০২. বিষয়বস্তু (উপনিষদ)
০৩. রচয়িতা (উপনিষদ)
০৪. আঙ্গিক ও ভাষা (উপনিষদ)
০৫. শিক্ষাব্যবস্থা (উপনিষদ)
০৬. আর্থনীতিক জীবন (উপনিষদ)
০৭. পারিবারিক চিত্র (উপনিষদ)
০৮. নীতিবোধ (উপনিষদ)
০৯. ব্ৰাহ্মণ ও ক্ষত্ৰিয় (উপনিষদ)
১০. দেবসঙ্ঘ (উপনিষদ)
১১. যজ্ঞানুষ্ঠানের নবতর ব্যাখ্যা (উপনিষদ)
১২. অতীন্দ্ৰিয়বাদী ও অধ্যাত্মবাদী প্রবণতা
১৩. নতুন উপাসনা পদ্ধতি : প্রশ্ন ও সংশয়
১৪. পুনর্জন্ম ও মুক্তি (উপনিষদ)
১৫. কাব্য (উপনিষদ)
৮. বেদাঙ্গসূত্র – অষ্টম অধ্যায় 24 Topics
Lesson Content
0% Complete 0/24 Steps
০১. বেদাঙ্গসূত্র
০২. রচনাকাল (বেদাঙ্গসূত্র)
০৩. আঙ্গিক ও ভাষা (বেদাঙ্গসূত্র)
০৪. শিক্ষা (বেদাঙ্গসূত্র)
০৫. ব্যাকরণ (বেদাঙ্গসূত্র)
০৬. নিরুক্ত (বেদাঙ্গসূত্র)
০৭. জ্যোতিষ (বেদাঙ্গসূত্র)
০৮. বিবিধ সূত্র (বেদাঙ্গসূত্র)
০৯. কল্পসূত্র (বেদাঙ্গসূত্র)
১০. সহায়ক সূত্র
১১. গৃহ্যসূত্র
১২. রচনা পরিচয় (গৃহ্যসূত্র)
১৩. রচনাকাল (গৃহ্যসূত্র)
১৪. বিষয়বস্তু (গৃহ্যসূত্র)
১৫. গৃহ্যসূত্রের উৎস
১৬. ধর্ম (বেদাঙ্গসূত্র)
১৭. সমাজ (বেদাঙ্গসূত্র)
১৮. ধর্মসূত্র
১৯. রচনা (ধর্মসূত্র)
২০. রচনাকাল (ধর্মসূত্র)
২১. আঙ্গিক ও ভাষা (ধর্মসূত্র)
২২. বিষয়বস্তু (ধর্মসূত্র)
২৩. শুল্বসূত্র
২৪. কল্পসূত্রে প্রতিফলিত জীবন ও সমাজ
লেখক: সুকুমারী ভট্টাচার্যবইয়ের ধরন: প্রবন্ধ ও গবেষণা
আপেক্ষিক মূল্যায়নে রামায়ণ ও মহাভারত - সুকুমারী ভট্টাচার্য

আপেক্ষিক মূল্যায়নে রামায়ণ ও মহাভারত – সুকুমারী ভট্টাচার্য

পুরাণ ও অন্যান্য – সুকুমারী ভট্টাচার্য

পুরাণ ও অন্যান্য – সুকুমারী ভট্টাচার্য

Bibidha-Prabandha-Sukumari-Bhattacharjya

বিবিধ প্ৰবন্ধ – সুকুমারী ভট্টাচার্য

পুনরাবলোকনে বাল্মীকির রাম - সুকুমারী ভট্টাচার্য

পুনরাবলোকনে বাল্মীকির রাম – সুকুমারী ভট্টাচার্য

Reader Interactions

Leave a Reply Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ডিকশনারি

কৌতু্ক / জোকস

লিরিক

রেসিপি

বিবিধ রচনা

হেলথ

Download PDF


My Account

Facebook

top↑

Login
Accessing this book requires a login. Please enter your credentials below!

Continue with Google
Lost Your Password?
egb-logo
Register
Don't have an account? Register one!
Register an Account

Continue with Google

Registration confirmation will be emailed to you.