০৮. সংবাদসূক্ত

সংবাদসূক্ত

ঋগ্বেদে প্রায় কুড়িটি সংলাপ সূক্ত বা ‘সংবাদ-সূক্ত’ রয়েছে ; এদের প্রকাশরীতি কতকটা বিস্ময়কর, কেননা আপাত দৃষ্টিতে এদের মধ্যে আকস্মিকতা এবং যজ্ঞীয় বিনিয়োগের অনুপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। যদিও প্রকৃত সংলাপের মতোই প্ৰকাশ রীতি এগুলিতে রয়েছে, তবু বক্তাদের নাম উল্লিখিত নেই বলে প্রকরণ থেকেই সেগুলি অনুমান করে নিতে হয়। অনেকগুলি সূক্ত পড়ে মনে হয় যেন সেগুলি স্বয়ং-সম্পূর্ণ নয়, এও মনে হয় যেন প্রচলিত পাঠ থেকে ব্যাখ্যামূলক গদ্য অংশ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এই থেকে বহু গবেষক এই সব সূক্তের মৌলিক স্বভাব-বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে নানারকম অনুমান-নির্ভর সিদ্ধান্ত করেছেন। এদের খণ্ডিত অবস্থা বিচার করে ওল্ডেনবের্গ এদের আখ্যান বা গীতিকা-ধর্মী সূক্ত রাপে চিহ্নিত করেছেন। তার মতে, শুধুমাত্র শ্লোকাংশই স্মৃতিতে প্ৰহিত করা হত বলেই ব্যাখ্যামূলক ও সংযোজক গদ্য অংশগুলি লুপ্ত হয়ে গেছে ; প্রতিটি অনুষ্ঠানেই গদ্যাংশগুলি নুতন করে পরিমার্জিত হত, ব্ৰাহ্মণগ্রন্থগুলি প্রকৃত পক্ষে সেইসব বিলুপ্ত অংশ-সমূহের সম্পূরণ করত। সিলভ্যাঁ লেভি জানিয়েছেন যে সংবাদ-সূক্তগুলি নাটকেরই বিশিষ্ট একটি ধরন। এই সব সূক্তের প্রকৃত চরিত্র বা মৌলিক উদ্দেশ্য নির্ণয় করার মতো কোন উপায় আমাদের নেই, তবে যজীয় বিনিয়োগের অনুপস্থিতি থেকে পণ্ডিতরা নানাবিধ অনুমান প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন। সাধারণভাবে ঋগ্বেদের সূক্তগুলি যদিও প্রথাগতভাবে কবির নাম, ছন্দ ও দেবতার নাম এবং যজীয় বিনিয়োগের নির্দেশ দিয়ে থাকে, সংবাদ-সূক্তগুলি কিন্তু সেদিক থেকে প্রচলিত নিয়মের অন্যতম ব্যতিক্রম। এর কারণ নির্দেশ করতে গিয়ে হিবন্টারনিৎস বলেছেন যে সংবাদ-সূক্তগুলি সম্ভবত সমাজ-মানসে ভাসমান গীতিকার অংশ ছিল, যে সব উপাদান। পরবর্তীকালে বিভিন্ন মহাকাব্য, পুরাণ, বৌদ্ধ সাহিত্য এবং এমনকি ধ্রুপদী সংস্কৃত সাহিত্যের নাটকগুলিতেও ব্যবহৃত হয়েছিল। তবে নিশ্চিতভাবে এখন বলা সম্ভব নয়, প্রকৃতই সংবাদ-সূক্তের কোন সহগামী গদ্য অংশ ছিল। কিনা ; তৎকালীন শ্রোতার কাছে এই প্ৰকাশ রীতিই সম্ভবত পৰ্যাপ্ত ছিল, কেননা উত্তরাধিকারসূত্রে লব্ধ প্রত্নকথাও উপাখ্যান যেমন শ্রোতৃ-সমাজের কাছে পরিচিত ছিল তেমনি সর্বজনসম্মত প্ৰকাশারীতি ও উপযুক্ত স্বরন্যাস ও ইঙ্গিতাপূর্ণ প্রত্যক্ষ অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে সম্ভবত শ্রোতা ও দর্শকের কাছে অধিকতর স্পষ্টতা লাভ করত।

সংবাদ সূক্তগুলির মধ্যে উর্বশী ও পুরূরবার সংলাপই (১০ : ৯৫) সর্বাধিক পরিচিত। রাজা পুরূরবার অপ্সরা-বধূ ঊর্বশী চার বছর তার সঙ্গে অতিবাহিত করে পুরূরবাকে ত্যাগ করেছিলেন। পুরূরবা ঊর্বশীকে তীব্র ব্যাকুলতার সঙ্গে অন্বেষণ করে শেষ পর্যন্ত একটি সরোবরে অন্য অন্সরাদের সঙ্গে ক্রীড়ারত হংসীরূপে দেখতে পেলেন। রাজা ঊর্বশীকে প্রত্যাবর্তনের জন্য আকুল অনুরোধ করে ব্যর্থ হলেন। ঊর্বশী দৃঢ়ভাবে পুরূরবাকে প্রত্যাখ্যান করলেন। দু-জনের সংলাপ অত্যন্ত মৰ্মস্পশী–একদিকে রয়েছে বিচ্ছেদ-সম্ভাবনায় কাতর মর্ত মানুষের আর্তি ও আকুতি, অন্যদিকে আছে অপ্সরার স্পষ্ট হৃদয়হীন ঔদাসীন্য। ব্যাবিলনের গিলগামেশ মহাকাব্যের সেই সংলাপমূলক অংশটি এর সঙ্গে তুলনীয় সেখানে দেবী ইষ্টার মরণশীল গিলগামেশকে তার প্রণয়ী হওয়ার জন্য আহ্বান করছেন, কিন্তু মর্ত নায়ক দেবীর প্রণয় প্রত্যাখ্যান করছেন। এই বিষয়বস্তুর সামান্য ভিন্ন ধরনের অভিব্যক্তি ঘটেছে আর একটি সংবাদসূক্তে–এটির নাম যম-যমী সূক্ত (১০ : ১০)। এই সূক্তের আকস্মিক সমাপ্তি গবেষকগণ লক্ষ্য করেছেন। পৃথিবীর সর্বত্র ব্যাপ্ত সৃষ্টিবিষয়ক প্রত্নকথাগুলির সঙ্গেই এই সূক্তের আত্মীয়তা, কেননা এই ধরনের রচনায় এই বিশ্বাস প্রতিফলিত হয় যে মনুষ্যসৃষ্টির প্রাথমিক পর্বে ভ্ৰাতা ও ভগিনীর মিলনের ফলেই মানবজাতির প্রথম সৃষ্টি। পরবতী সমাজে অজাচার নিষিদ্ধ হওয়ার পরে স্বাভাবিকভাবে অবাধ যৌনতার উপর যে নিষেধ আরোপিত হয়, সম্ভবত তারই ফলশ্রুতি হিসাবে আলোচ্য সংবাদসূক্তের উপসংহারটি বিলুপ্ত হয়ে যায়। এছাড়া বৃষাকপিসূক্তে (১০ : ৮৬) ইন্দ্ৰাণী, ইন্দ্র ও তার পোষ্য বৃষাকপির মধ্যে একটি কৌতুহল-ব্যঞ্জক সংলাপ দেখা যায়। বৃষাকপি অর্থাৎ হনুমানের প্রতি ইন্দ্রের মাত্রাতিরিক্ত প্রশ্রয় ইন্দ্ৰাণী মেনে নিতে পারছেন না। লোকসমাজের মধ্যে প্রচলিত ও পরবর্তীকালে সবিশেষ জনপ্রিয় হনুমানউপাসনা পদ্ধতির প্রতি প্ৰথম ইঙ্গিতরূপে এই সূক্তটিকে গ্রহণ করা যায় যে বৈদিক যুগের ইন্দ্র-চর্চাকে যে সমস্ত লোকচৰ্যা পরবতীকালে সম্পূর্ণ নিম্প্রভ করে দিয়েছিল তাদের মধ্যে অন্যতম হনুমান-উপাসনার সূত্রপাত, বৈদিক যুগের অনার্য সংস্কৃতিতে। অন্যান্য সংবাদ-সূক্তগুলির মধ্যে রয়েছে ইন্দ্র, বসুক্র ও তার স্ত্রীর সংলাপ (১০ : ২৮), অগ্নি ও দেবতাদের সংলাপ (১০ : ৫১-৫৩), ইন্দ্র ও মরুতের সংলাপ (১০ : ৬৫), ইন্দ্র ও অগিস্ত্যের সংলাপ (১ : ১৭০), অগস্ত্য, তাঁর শিষ্য, ও অগস্ত্যপত্নী লোপামুদ্রার সংলাপ (১ : ১৭৯)। আরো একটি বিখ্যাত সংলাপ হয়েছে সরমা ও পণিদের মধ্যে (১০ : ১০৮)। এটা অত্যন্ত তাৎপৰ্যপূৰ্ণ যে অধিকাংশ সংবাদ-সুক্তই রয়েছে সংহিতার অন্তিম পর্যায়ে অর্থাৎ প্রথম ও দশম মণ্ডলে। এর কারণ সম্ভবত এই যে সৃষ্টিশীলতার পর্যায় সমাপ্ত হওয়ার পরে যখন সংকলন ও সম্পাদনার প্রক্রিয়া চলছিল তখন জনপ্রিয় গীতিকাগুলিও আহরণ করা হচ্ছিল। সম্ভবত যজ্ঞীয় বিনিয়োগ না থাকায় এই সব গীতিকা পূর্বে সংহিতার অন্তর্ভুক্ত হয় নি।